• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫ | এপ্রিল ১৯৯৮ | রম্যরচনা
    Share
  • কথার কথা (৩) : সোডা জল
    | | ৩ | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০

    শব্দের জঙ্গলে বাঘ!

    শীত প্রায় নেই বললেই চলে। মেজোদাদুর বাগানে ফুলের গাছগুলো নুয়ে পড়েছে ভারে। গাংলু একটা ছিটকাপড়ের শাড়ি বের করে পরেছে কোথা থেকে। গ্যাঞ্জাম পরেছে আদ্দির ফিনফিনে পাঞ্জাবী। অংকস্যার বললেন- কোকিলের ডাক শুনতে পাচ্ছিস তোরা?

    মেজোদাদু খুরপি হাতে সকাল থেকে নেমে পড়েছেন বাগানে। হাঁটুর উপর ধুতি। পিচকিরি লাগানো লোহার কেটলি থেকে রহস্যময় তরল পদার্থ ছিটিয়ে দিচ্ছিলেন কেয়ারিগুলোতে। বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে চশমাটা ঠেলে বললেন- ওগুলো আসলে চৌধুরীদের প্রেশার কুকার। জামাই এসেছে বলে কাল থেকে এলাহি কাণ্ড।

    অংকস্যার চোখ বুজে বললেন- কোকিলও আছে। একটা কোকিল ওরই মধ্যে লুকিয়ে আছে। দূরে কোথাও পাতার আড়ালে। ডাকটা মিশিয়ে দিচ্ছে অন্য শব্দের মধ্যে। যাতে চেনা না যায়। কেয়ারফুলি শুনুন।

    কেয়ারফুলি শুনতে গিয়ে মেজোদাদুর ঝাঁঝরি থেকে বেশ খানিকটা রহস্য-সিরাপ পড়ে গেল কালো গোলাপের গায়ে। মেজোদাদু শিউরে উঠে আ: চুক্‌ চুক্‌ করে উঠলেন।

    বোতল বোতল সোডা আসে মেজোদাদুর জন্য। ঠান্ডা থাকতেই গোপন কী সব পদার্থ মেশান তার সাথে। ফুলগাছের গোড়ায় পড়ে সেই আরক। মেজোদাদু বলেন- ভিটামিন ওয়াটার। আর্মিতে থাকতে এক ব্রিগোডিয়ারের প্রাণ রক্ষা করে নাকি উপকরণগুলো জেনেছিলেন। গল্পটা অসাধারণ। মেজোদাদুর ফুরিয়ে গিয়েছিলো অ্যামুনিশান, ব্রিগোডিয়ারের ফুরিয়েছিলো ব্রান্ডি। চীন সীমান্তে দুটো থলে হাতবদল হয়। দুজনেরই প্রাণ বেঁচেছিলো নাকি। ভিটামিন ওয়াটারের ফর্মুলাটা মেজোদাদুর উপরি পাওনা।

    অংকস্যার চোখ বুজেই বললেন- অনেক শব্দের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে থাকে যে শব্দ, শব্দের জঙ্গলে সেই হল বাঘ। মনোযোগ চাই ঘোষবাবু, মনোযোগ।

    গাংলু, সাজপাট দিয়ে এসে বললো- কোকিলা বসুর ঝুমকো নাচ দেখবেন তো আমাদের ক্লাবের ফাংশানে চলুন স্যার। আবৃত্তি, গান, নাটক এসবও থাকবে।

    অংকস্যার আগ্রহ দেখিয়ে বললেন- এত সব?

    কিন্তু গ্যাঞ্জাম আজকে ছাড়বে না বলেই রেখেছে। অগত্যা বাগানের কাছে টেবিল পেতে অংকস্যারকে বসতেই হয় সান্ধ্যসূত্রের ক্লাসে।


    - সান্ধ্যসূত্র কোথায়, কখন আবিষ্কার হয় তার লেখাজোখা নেই। গোটা বৃহদারণ্যক উপনিষদটাই তো একটা কথার ধাঁধা। মহাভারতেও ঢের পাবি। আধুনিক যুগের ক্রসওয়ার্ডে সান্ধ্যসূত্রের প্রচলন শুরু হয় কুড়ির দশকের মাঝামাঝি। চালু করেন ইংলন্ডের Observer পত্রিকার Torquemada. বলে ভুরু নাচালেন অংকস্যার। - Torquemada হলো প্রথম স্পেনিশ ইন্‌কুইসিটারের নাম। ইন্‌কুইসিটারেরা ছিলেন একধরনের ধার্মিক হাইকোর্টের হর্তাকর্তা। এই ছদ্মনামের আড়ালে যিনি Observer-এর ক্রসওয়ার্ড চালাতেন তাঁর আসল নাম ছিলো Edward Powys Mathers. Torquemada-র পর পত্রিকাটির কঠিন ও সান্ধ্য ক্রসওয়ার্ডের ঐতিহ্য বজায় রেখেছিলেন Xiemens (আসল নাম Derric Somerset Macnutt) এবং সাম্প্রতিককালে Azed (আসল নাম Jonathana Crowther).

    মেজোদাদু খুরপি হাতে উঠে এসেছেন উঠোনে। তাঁকে দেখাচ্ছে হয়তো কোন স্পেনিশ ইন্‌কুইসিটারের মতই। বললেন- সারাক্ষণ ইংরেজি ক্রসওয়ার্ডের ইতিহাস বলে যাচ্ছো মোহন। বাংলার কথা কিছু বলবে?

    অংকস্যার হাতজোড় করে বললেন- আই জয়েন মাই পাম্‌স্‌ স্যার। আমরা ইতিহাসবিস্মৃত জাতি। বকি বেশি, লিখি কম, কাজের কাজ করি না বললেই চলে। আমাদের ইতিহাস যদি অন্যেরা লেখে তো আমরা কৃপা করে পাঠ দিতে পারি শুধু। বলাই বাহুল্য বাংলা ধাঁধা বা ক্রসওয়ার্ডের কোন ইতিহাসই আমি খুঁজে পাইনি। সম্ভবত কাজটা ছেড়ে দেওয়া আছে পরবর্তী কোন শিক্ষিততর কিংবা উন্নততর প্রজন্মের জন্য। গ্যাঞ্জাম গাংলুরা হয়তো পারবে। যদি না অবশ্য বাংলাই ততদিনে একটা অপ্রয়োজনীয় ভাষা হয়ে পড়ে।

    মেজোদাদু খুরপি তুলে বললেন- বলো কি মোহন? সবাই সেদিনও বলতো- What Bengal thinks today….।

    অংকস্যার ব্যজার মুখে বললেন- কথাটা বলেই আমাদের সর্বনাশ করে দিলেন গোখলে। বাংলা পৃথিবীর অর্বাচীনতম ভাষার একটা। আজও অধিকাংশ বাঙালি অক্ষরজ্ঞানহীন। আধুনিক অর্থে সাহিত্য ও সংস্কৃতির মুখ দেখেছি মেরেকেটে দেড়শো বছর। তাতেই আমাদের ধারণা হয়ে গেছে আমরা পৃথিবীর সেরা। আসলে ভারত উপমহাদেশের মধ্যেও আমরা কারো কারো চেয়ে পিছিয়ে। উন্নত দেশের উন্নত ভাষাগুলোর ধারেকাছেও জায়গা হবে না বাংলার।

    গাংলুর এতক্ষণ একটা উড়ু উড়ু ভাব ছিলো। অংকস্যারের শেষ কথাগুলো কানে ঢুকতেই চড়াক্‌ করে সিধে হয়ে বসেছে। ছলাৎ করে গরম লাল রংও উঠে এসেছে নাকের ডগায়, কানে। মেজোদাদু আর গ্যাঞ্জামের দিকে চেয়েই সে বুঝেছে বাংলার হয়ে লড়বে সে একাই। কড়া একটা মুখবন্ধ করতে যাচ্ছিলো, গ্যাঞ্জাম তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে দেয়।

    - ব্রিটিশ যুগের বাংলা ক্রসওয়ার্ড নিয়ে সেদিন কী বলছিলেন স্যার? ভালোই হত নাকি সেসব? সে নিয়ে কিছু বলুন না।

    অংকস্যারের মুখ দেখেই বোঝা যায় নতুন উদ্যম পেয়ে গেছেন।

    - কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই, কোন দলিল দস্তাবেজ নেই। শুধু স্মৃতি থেকে বলছি। পুরোনো বাংলা পত্রিকায় যে-সব ক্রসওয়ার্ড বেরোত তা অনেক সময় বেশ ভালোই হত। একটা সূত্র এখনো মনে আছে। দু অক্ষরের শব্দ। সূত্রটা এরকম: “এ বিরাট বিশ্বে, অম্বরে অম্বরে, নানা সূত্রে এর গুণ বিকাশপ্রাপ্ত হয়”। কী উত্তর হবে বলতো?

    ঘড়ি ধরে একমিনিট সময় দিলেন অংকস্যার। কেউ পারলো না। একগাল হেসে অংকস্যার বললেন- উত্তর হল “সূচ”। সান্ধ্যসূত্রের আলোচনাটা এখান থেকেই শুরু করা যাক তাহলে। এক কাপ চা অর্ডার করে দাও কেউ।

    রান্নাঘর থেকে চা আসার আগেই মেজোদাদু উঠোনের কলে হাত পা ধুয়ে কাঁধের গামছা দিয়ে হাত মুছতে মুছতে চলে এলেন টেবিলে। পেন্সিল রেডি করাই ছিলো। রাখা ছিলো অংকস্যারের তৈরি নতুন ক্রসওয়ার্ড। মেজোদাদু টাগরা দিয়ে তৃপ্তিসূচক শব্দ করে বললেন- অনেক শারীরিক খাটাখাটি গেছে সকাল থেকে। এবার শুধু মাথা খাটাবো। সান্ধ্যসূত্রের সমাধান খুঁজবো আর গল্প শুনবো তোমার।

    অংকস্যার আঙুল তুলে বললেন- গল্প নয় ঘোষবাবু। এসব আসলে অংক।

    নতুন ছক এখানে

    ডানদিকে
    ১) বালি আগলে কানা, ছোট্ট মেয়ে বা না। ৪) দ্বিধা কি কেশদাম? সূক্ষ্ম এর নাম। ৭) পোলাও হলে বাসি, পান লাগিয়ে হাসি। ৮) নিরাকার সাপের গেছে পাঁচ পা আছে এক, পাপীজন তিনবরন অবাক হয়ে দ্যাখ। ১০) লজ্জা ঘৃণা ভয়, এক ভিন্ন নয়। ১১) শবের সাথে জড়াবি, চেতনা কাড়া “করাবি”। ১৩) ইরানের দুজনের সঙ্গী হতে হলে, পথে যে শহর পাবে প্রসিদ্ধ ভূতলে। ১৫) ধোপানীকে কি দেবো? একটি রজনী দেবো। ১৭) সান্ধ্যসূত্রের মূলেও। ধূর্জ্জটির চুলেও। ১৮) যেদিকে তাকাই বপু, কলেবর নেই, প্রাচীরে সে আছে আর আছে জাপানেই। ১৯) কাজের বাজার জগত ধর, মনে হবে পঞ্চশর। ২১) প্রদেয় এক তারায়, ঠগ বলছে পাড়ায়। ২৩) জানার আগে, জানার পরে, জানার মাঝে, তিন অজানা তিন ঠিকানা কেমন নাচে! ২৫) বেতাল মাতাল পাত- মাতিস জগন্নাথ। ২৭) হাঁ করে কপ খাচ্ছ, মেঘ ডাকলে যাচ্ছ। ২৮) চিত করলে কথা, নইলে গায়ের ব্যথা। ২৯) থামাতে ব্যথা থাকো, মাথায় মাথা রাখো। ৩০) কানের লতিদুটো ধরে, পেঁচা তো একটু একটু করে।

    নীচে
    ১) (রজনী) না যেতে, পোনা নে হাত পেতে। ২) কাঁকন হয়ে বাজে, কিম্বা জেনানা যে। ৩) বনের রং সাদা, কানে বস রে দাদা। ৪) চুপ চুপ দেয় ডুব একটাকে তোলো, এক কর দিলে পর স্তব্ধ হও বোলো। ৫) কাঠের মত জ্বলে, গুরুর সাথে চলে। ৬) রা কাড়লে কাড়ো, বৌটা জপায় আরো। ৯) বন্ধন উত্তীর্ণ পার্শ্ব, দ্বিপদের এক পা আর শ। ১১) রাজার নাম বড়, মহাভারত পড়ো। ১২) তানপুরায় আজ, বীরের দেশ বাজ। ১৪) যমেও অরুচি হবে? আরেক যম হ তবে। ১৬) কি বৌ বলে দিন গে, হোক না ভুল লিঙ্গে। ১৯) কামাতে যার মানা (করেছে কী মামী?), হাজার হোক মামা, আছো বলেই দামী। ২০) থাক না জ’র কাঁখে, সবাই জানে যাকে। ২১) প্রতিবাদে জাপটে খায়, বর কনের বসছে গায়ে। ২২) হাতের চেটোর পরে, তরল কত ধরে? ২৪) আবাদ করে যাচ্ছো- আচ্ছা, দেখতে পাচ্ছো? ২৬) তবে রে, বে দিলি না যেমনি, মাথারা মা পাবে না, তেমনি। ২৮) জ্বললে কিবা, তিমিরে দিবা?

    - “সূচ” দিয়েই শুরু করা যাক। চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন অংকস্যার। সূত্রটাকে এখানে সান্ধ্য বলা হচ্ছে কেন? কারণ দুটো pun আছে কথাটায়। (এইখানে গাংলুর দিকে চেয়ে অংকস্যার জিজ্ঞেস করলেন- pun-এর বাংলা কি? গাংলু চিবুক চুলকোচ্ছে। অংকস্যার একটা সান্ধ্য হাসি দিয়ে বলে চললেন)। অম্বর মানে আকাশ আবার অম্বর মানে বস্ত্র। “নানা সূত্রের” অর্থ “নানা ভাবে”-ও হতে পারে আবার “নানা সূতোয়”-ও হতে পারে। পুরো বাক্যটারই দুটো আলাদা মানে সম্ভব। প্রথম যে মানেটা মাথায় আসবে তার কোন নির্দিষ্ট উত্তর নেই। তৎক্ষণাৎ ধরে নিতে হবে যে সেই মানেটা পরিত্যাজ্য। আসল মানেটা লুকোনো। এবং লুকোনো মানেটা খুঁজে বের করলে উত্তর বেশ স্পষ্ট। Pun হল সান্ধ্য সূত্রের প্রাণ। ভালো করে শব্দগুলো নাড়াচাড়া করতে হবে সেই জন্য। প্রাণটা লুকিয়ে আছে কোথায়? সেটা খুঁজে পেলেই জট খুলতে থাকবে হুড়হুড় করে।

    - শব্দের জঙ্গলে বাঘ। মন্তব্য করে গ্যাঞ্জাম। অংকস্যার একটা বিনীত চুমুক দিয়ে বলেন- বহুৎ খুব!

    - এবার কিছু উদাহরণ নিয়ে আলোচনাটা করা যাক। বলে কাগজে বড় বড় করে লিখতে থাকেন অংকস্যার।

    সূত্র: “আধখানাতে প্রতিশব্দ জুড়লে ফের এর প্রতিশব্দ।

    উত্তর: “বারবার”।

    - এটাতে pun কোথায় মোহন? জিজ্ঞেস করলেন মেজোদাদু।

    অংকস্যার বললেন- pun তো শুধু প্রাণ। কিন্তু হৃদয়? ক্রসওয়ার্ডের হৃদয় হল rebus. বাংলা কী হবে গাংলু? গাংলুর দিকে আর ভয়ে তাকাচ্ছেন না অংকস্যার। বললেন- একটা শব্দকে ভেঙ্গে তার খণ্ডগুলোকে অন্য ধ্বনি বা শব্দের সংকেত দিয়ে চেনানো হলে সেই সূত্রকে rebus বলা যেতে পারে। তবে গোটা শব্দটা আলাদাভাবে চিনিয়ে দিলেই ভালো। উপরের উদাহরণটা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। প্রথমত, বারবার-কে ভেঙ্গে আধখানা করলে পাওয়া যাচ্ছে “বার”। এবার তার সঙ্গে “বার” শব্দকেই “বার”-এর সমার্থক শব্দ ভেবে যোগ করা যেতে পারে। আবার “প্রতিশব্দ” কথাটা ভাঙলে পাওয়া যাবে “প্রতি-শব্দ”, এবং “প্রতিবার” মানেও “বারবার”। কিন্তু এখানেই শেষ নয় খণ্ডযোজন করার পর “বারবার” শব্দটা আবার ফিরে পাওয়া যাচ্ছে এবং তা “ফের” শব্দের প্রতিশব্দ। সুতরাং অংকটা দাঁড়াচ্ছে:

    বারবার/২= বার

    বার + বার= বারবার

    প্রতি + বার= প্রতিবার= বারবার

    বারবার= ফের

    মেজোদাদু অংকেতেই কাঁচা। এতগুলো সমানচিহ্ন দেখে একেবারে থ হয়ে গেছেন। অংকস্যার আরেকটা কাগজ টেনে নিয়ে লিখতে থাকেন।

    - আরেকটা rebus দ্যাখ। সূত্র হল “রগড়টা জমতো কিন্তু চড় মেরে দিলো বলে বদরাগী”। উত্তর হল “রগচটা”। এবার অংকটা এগোচ্ছে আরো। ইকোয়েশনগুলো এরকম।

    রগড়টা + চ – ড়= রগচটা

    - “চ” এসে “ড়” মেরে দিলো (অর্থাৎ একটা প্লাস হল আর অন্যটা মাইনাস) তাই রগচটা। মজাটা হল এই যে পুরো সূত্রটাতেই কথার সঙ্গতি থাকছে- রগচটা লোক যে চড় মারবে তাতে আশ্চর্য কি? মাইনাস সাইন ছাড়াও একটা নতুন জিনিশ পাওয়া যাচ্ছে এই সূত্রটায়। কী সেটা?

    গ্যাঞ্জাম বললো- “চড়” কথাটা ভাঙতে হবে।

    অংকস্যার বললেন- শাবাস। rebus-এর সূত্রেও rebus. ইংরেজি সান্ধ্য এমন অনেক কিছু করা যায় যা বাংলায় করা কঠিন। তার কারণ ওদের ভাষা alphabetic- অক্ষরনির্ভর, আমাদের ভাষা phonetic অর্থাৎ ধ্বনিনির্ভর। ব্রিটিশরা পৃথিবী জিতে নিলো, বাঙালিরা পারলো না। অনেকে বলে কারণ আমাদের এই যুক্তাক্ষর। তবু phonetic ভাষার কিছু কিছু সুবিধে আছে। Rebus-এ আমরা খুব পাকা হতে পারি। ওদের ছাড়িয়ে যেতে পারি হেসে খেলে।

    গাংলু এবার সান্ধ্য হাসি ছেড়েছে একটা। যার মানে- তা কি আর জানতাম না? অংকস্যার খসখস করে আরো কয়েকটা ইকোয়েশন লিখে ফেললেন।

    ১.
    সূত্র: “জগত লেজকাটা সাক্ষরকে পেলে শৌখিন জামা হতে পারে” উত্তর: “লেসকাটা”

    জগত= জ + গত

    জ গত লেজকাটা= লেজকাটা- জ= লে—কাটা

    সাক্ষর= স + অক্ষর

    লে—কাটা+স= লেসকাটা

    ২.
    সূত্র: “খানা খেলে জলখাবারের খাস্তা”

    উত্তর: “নাস্তা”

    জলখাবার = নাস্তা

    খানা = খা + না

    “খা” অক্ষর যদি “না” অক্ষরকে খায় তাহলে :

    নাস্তা= না + খা= খাস্তা

    ৩. সূত্র: “সফর যেন মনিবের মনোমত হয়”

    উত্তর: “নফর”

    সফর= স+ফর; যেন= যে+ন; ন+ফর= নফর

    ৪. সূত্র: “চতুষ্পদের লেজে একটু তা পড়লে কিছু বিদ্যে হয়”

    উত্তর: “চারপাতা”

    চারপা+তা= চারপাতা

    ৫. সূত্র: “ফুলের উজান দিলো যে সূত্র উত্তরাধিকারীর জন্য”

    উত্তর: “ফল” উজান= উ+জান; ফুল-উ=ফল

    মেজোদাদু ভয়ে ভয়ে ডিশ থেকে চোঁ করে খানিকটা ঠান্ডা চা খেয়ে বললেন- এসবই কি rebus মোহন?

    অংকস্যার ক্ষেপে গিয়ে বললেন- এবার একটা বাংলা প্রতিশব্দ চাই-ই। যে বের করবে তাকে পুরস্কার দেবো। Rebus এর চেয়ে বেশি মজা বাংলা সূত্রগুলোতে। তবে আমাদের অন্য টেকনিকও আছে। এই সূত্রটা দেখুন- “অথবা লু এর কথা ভাবো”। এখানে “বালু” শব্দটা লুকিয়ে আছে সূত্রের মধ্যেই। আত্মগোপন করে আছে। কোকিলের ডাকের মত। ইংরেজিতে বলবে hidden word.

    গাংলু এতক্ষণ পরে মুখ খুলেছে। - তাহলে দেখাই যাচ্ছে স্যার ওরা যা পারে বাংলাতে সবই পারা যায়। পৃথিবীর উন্নত ভাষাগুলোর চেয়ে কোন অংশেই পিছিয়ে নেই। থাকলে কি রবীন্দ্রনাথের মত কবি পেতাম?

    অংকস্যার জবাব দেওয়ার আগেই একটা চমকপ্রদ ব্যাপার। কোথাও থেকে স্পষ্ট অমিততেজ কু আওয়াজ। এ কোন প্রেশার কুকার নয়, নিঃসন্দেহে বসন্তের কোকিল। অংকস্যার দুহাত তুলে বললেন- শ্‌ শ্‌ শ্‌ শ্‌…।

    ঘুরে ফিরে অনেক সুরে গেয়ে থামলো কোকিলটা। মেজোদাদু প্লেট চেটে সহর্ষে বললেন- এ নিশ্চই চৌধুরীদের পাগলা বৌ। কাল পূর্ণিমা তো, তার উপরে ননদাই এসেছে। ক্ষেপে আছে পুরো। নইলে লাস্ট কোকিল দেখেছি সিক্সটি ফোরে ইম্ফলে। এতটা পর্যন্ত বলেই অংকস্যারের গম্ভীর মুখে দেখে চুপসে গেলেন মেজোদাদু।

    অংকস্যার কাগজ পেন্সিল ছেড়ে হেলান দিয়ে বসেছিলেন চেয়ারে। একটু উদাস হয়ে বললেন- সত্যি আমরা পিছিয়ে আছি রে গাংলু। কিন্তু নিজেরাই বুঝতে চাই না সে কথা। রবীন্দ্রনাথ তো এই ভয়েই বার বার সাবধান করে দিতেন। সেসবও কেউ মনে রাখেনি। বাংলা ভাষাতে অনেক কিছু করাই হয়তো সম্ভব। কিন্তু চেষ্টার অভাবে করা হয়নি। এর দুটো কারণ। এক, আমাদের পকেট ফাঁকা। দুই, আমরা (এইখানে অংকস্যার আর গম্ভীর মুখ রাখতে না পেরে একটু হেসে ফেললেন), আসলে আমরা বেশ নাক উঁচু আর সিরিয়াস টাইপের লোক। সাহিত্যের কথা যেতে দে, শুধু ভাষার ক্ষেত্রেই আমি সহজ উদাহরণ দিয়ে দেখাতে পারি বাংলা শব্দের ক্ষমতা বা দুর্বলতার ব্যাপারে আমাদের জ্ঞানের সঞ্চয় কি রোমাঞ্চকর কম। তোরা বলবি তাতে ভাষার কোন ক্ষতি হয় না। আমি মানতে পারবো না। মনে করতে পারিস ভাষা একটা জটিল অংক। যাকে শুধু ক্রমাগত আবিষ্কার করাই সম্ভব। দাবা খেলার মত। খেলতে থাকার মধ্যেই বুঝতে থাকা।

    মেজোদাদু চশমা এঁটে আবার ক্রসওয়ার্ড নিয়ে বসেছেন। বাগান থেকে ছুটে আসছে বসন্তের গন্ধ। ভারী নিরালা এক পরিবেশ। তপোবন তপোবন ভাব। গ্যাঞ্জাম চায় আলোচনাটা আরো চলুক। গাংলুও শাড়িটা কোমরে পেঁচিয়ে নিয়েছে শক্ত করে। ছাড়বে না সে সহজে।

    মেজোদাদু বললেন- এ কি মোহন, এটাতে তো দেখছি সূত্রগুলো ছড়া হয়ে গেছে সব। বাপরে! সান্ধ্যসূত্র, তায় ছড়া! খাটতে হয়েছে খুব? ব্রাভো!

    অংকস্যার খুশি হয়ে বললেন- শুক্রিয়া। শব্দগুলোকে একটু যত্ন করলাম আর কি। পরিশ্রম হলেও পণ্ডশ্রম নয়। অ্যাডভেঞ্চার ইজ অ্যাডভেঞ্চার! অ্যাডভেঞ্চারের বাংলা কী হবে গাংলু?

    - জমেছে। মনে মনে বললো গ্যাঞ্জাম।


    অংকস্যারের আগের বারের ক্রসওয়ার্ডের উত্তর এখানে

    শব্দশিকারির আগের বারের ক্রসওয়ার্ডের উত্তর এখানে


    প্রথম দুজন শব্দশিকারীর জন্য পরবাসের টি-শার্ট পুরস্কার! – সম্পাদক।

  • | | ৩ | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments