• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪ | ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ | রম্যরচনা
    Share
  • কথার কথা (২) : সোডা জল
    | ২ | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০

    কঠিন বিকল্পের পরিশ্রম নেই

    মেজোদাদু এক সপ্তাহ ধরে উসখুস করছিলেন। --মোহন কবে আসবে রে? দু-একবার জিজ্ঞেসও করলেন গাংলুকে। কারণ জিজ্ঞেস করলে কিছু বলছেন না।

    অংকস্যার প্রচণ্ড লজ্জা পেয়ে যান। --অফুলি স্যরি, অফুলি স্যরি, বলতে থাকেন বার বার। ঝোলায় হাতটা ঢুকিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে বের করে আনেন ছক-কাটা কাগজটা। মেজোদাদু নিতে যাচ্ছিলেন, অংকস্যার টুক করে হাতটা সরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন--আপনার কতদূর হল? মেজোদাদু ছোঁ মেরে কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে বললেন--হান্‌ড্রেড পার্সেন্ট রাইট। শুধু মিলিয়ে দেখবো বলে…। অংকস্যার বললেন--দেখান তো দেখি। মেজোদাদু যেতে যেতেই বললেন--আরে সময় নেই বাপু, স্টেট্‌সম্যানের ক্রসওয়ার্ডটা অর্ধেক হয়ে পড়ে আছে। অংকস্যার বিমর্ষ হয়ে বললেন--ও। আমিও একখানা এনেছিলাম অবশ্য…।

    বারান্দায় পা ঝুলিয়েই বসে পড়লেন অংকস্যার। গ্যাঞ্জাম আর গাংলুকে বললেন--আচ্ছা ইংরেজি ক্রসওয়ার্ড লোকে এত খায়, বাংলাটা খায় না কেন বলতো?

    বলতে বলতেই অংকস্যার ঝুলি থেকে আরো কিছু ছক-কাটা কাগজ বের করেছেন। গাংলুর পোষা নেড়ি কুকুর মিচকে সেগুলো দৌড়ে খেতে আসছিলো, অংকস্যারের এক মোক্ষম ধমকে পিলে চমকে পগার পার। গ্যাঞ্জাম মনে মনে ভাবে--এ কুকুর ফিরলে হয়।

    গাংলু বলে--আসলে কি জানেন স্যার, বাংলা ক্রসওয়ার্ডগুলো বড্‌ডো সোজা।

    অংকস্যার আনমনা হয়ে বলেন--সেটাও একটা কারণ হবে। তবে কি জানিস বাজারের খেলাটা হল সাপ্লাই আর ডিমান্ডের। চাহিদা আর জোগান। এটাও একটা অংক। বাংলাদেশে পাড়ায় পাড়ায় উচ্চাঙ্গের সাহিত্যসৃষ্টির জন্য ম্যাগাজিন বেরোয়। তাতে কি শক্ত শক্ত সব কবিতা থাকে দেখেছিস? গ্যাঞ্জাম তুইও এরকম একটা ম্যাগাজিনের সাথে…

    অংকস্যারের কথা শেষ হবার আগেই গ্যাঞ্জাম হাত তুলে প্রতিবাদের নৃত্যনাট্যই নামিয়ে দেয় একটা। --আমি শুধু ছাপা হলে ঘাড়ে করে প্রেস থেকে পাড়ায় নিয়ে আসি স্যার। এই গাংলুটা কবিতে লেখে। লুকিয়ে।

    গাংলুর কান লাল হয়ে গেলেও ঝটপট সামলে নেয়। –-তাতে দোষের কি? রবি ঠাকুরও তো…

    অংকস্যার হাত তুলে বলেন--শান্তি, শান্তি। দোষ একেবারেই নেই। মার্কেটে যার দর আছে তার জোগান কেউ না কেউ দেবেই। প্রশ্ন হল বাংলা ক্রসওয়ার্ডের দর এত কম কেন? একটু ভাবলে দেখবি এর মধ্যেই আমাদের সমাজের একটা পরিচয় লুকিয়ে আছে। বলতে বলতে অংক স্যারের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। --ক্রসওয়ার্ড নিয়ে ভাবতে ভাবতে সপ্তাহে কিছু মজার তথ্য পেয়েছি বুঝলি! বলতো প্রথম ক্রসওয়ার্ড কে, কবে, কোথায় বানিয়েছিলেন?

    মেজোদাদু গুটি গুটি চশমাটা কুড়িয়ে নিয়ে রোদে পিঠ দিয়ে বসে পড়লেন কাছাকাছি। খবরটা তাঁর মত বাঘা শব্দশিকারীরও নিঃসন্দেহে জানা নেই। অংকস্যার একটা চিরকুট বের করে পড়লেন--১৯১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর “নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড” কাগজের রবিবারের সংখ্যায় প্রথম ক্রসওয়ার্ড বেরোয়। আবিষ্কারকের নাম Arthur Wynne. মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে জিনিশটা এমন মহামারীর মত ছড়িয়ে যায় যে ১৯২৪ সালে “দ্য টাইম্‌স” কাগজে লেখা হয় যে অ্যামেরিকার মানুষ দৈনিক পঞ্চাশ লক্ষ কাজের ঘন্টা নষ্ট করেছে ক্রসওয়ার্ড করে।

    চিরকুটটা নামিয়ে রেখে অংকস্যার বলেন--ভাব একবার? একশো বছরও হয়নি খেলাটা আবিষ্কৃত হয়েছে আর এর মধ্যেই আমরা এত পিছিয়ে পড়লাম। গাংলুর দিকে তাকিয়ে বললেন--আচ্ছা কবিতা পড়ে বাংলার মানুষ দিনে কাজের কঘন্টা নষ্ট করে তার কোন পরিসংখ্যান আছে? গাংলুর গম্ভীর মুখ দেখে অংকস্যার আর ঘাঁটান না। –-অংক, ইতিহাস, পরিসংখ্যান সবেতেই আমরা কিরকম পিছিয়ে ভাবতে পারবি না। বৃটিশ যুগে বাংলা ক্রসওয়ার্ডের এরকম দৈন্যদশা ছিলো না, কিন্তু তার কোন লিখিত ইতিহাস পেলাম না কোথাও, মায়ের সঙ্গে একঘন্টা বকর বকর করে বের করেছি সে খবর।

    মেজোদাদু এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিলেন। এবার আকাশের দিকে মুখ করে মিঠে গলায় বলছেন --মোহন, আজকে একটা ছক বানিয়ে এনেছো বলছিলে না?

    অংকস্যার সংবিৎ ফিরে পান। –-নিশ্চয়ই! কিন্তু আপনার স্টেট্‌সম্যান?

    মেজোদাদু আকাশের দিকে চেয়েই বললেন--সে তো আর পালাচ্ছে না। মাতৃভাষা বলে কথা। আগেরটা মন্দ কিছু বানাও নি তো।

    অংকস্যার আর কথা না বাড়িয়ে ঝুলি থেকে নতুন ছকটা বের করে দ্যান।

    ডানদিকে

    ১) অনাদি, বাজারের দাম অবহেলা করলে হে। ৪) কি বার্তা এনেছো দূত যাতে বহুরূপী বাদ পড়ে আর থাকে কি। ৭) চটের থলিতে বসত দেখি। ৮) সংক্ষেপে মাতা শয়ন করলেন বলা অর্থকর। ১০) দুই ঘর জুড়ে এক। ১১) স্বভাবসিদ্ধ অপ্রকৃতিস্থ বা অদ্ভুত। ১৩) এ ধরনের ঐশ্বর্য চেয়েছে কিরকম করে। ১৫) দিবে আর নিবে, উল্টাইবে পাল্টাইবে, তবেই না ব্যবসায়ীর কাজ। ১৭) ফুলের উজান দিল সূত্র যে উত্তরাধিকারীদের জন্য। ১৮) এক মাথার বলি। ১৯) চতুষ্পদের লেজে একটু তা পড়লে কিছু বিদ্যে হয়। ২১) বৃত্তের ষেষে পাওয়া যায় এই সন্দেহজনক ব্যাপার। ২৩) বাসনা মুগ্ধ স্ত্রীলোক যাকে নিষাদ বোধ করে নি। ২৫) অপক্কের উল্টো কিন্তু পরদা। ২৭) হীরের ওজনে পড়েছে তিক্তের ঘাড়েই। ২৮) কারা দুজন লুকোতে পারে কাকিমার ঘরে? ২৮) পুরাতন ভৃত্যের অনুগত ভৃত্য। ৩০) রগড়টা হত কিন্তু চড় মেরে দিল বলে বদরাগী।

    নীচে

    ১) আটক করতে যাকে অবধি আটকেছে তারো কিন্তু কিছুই নেই শেষে। ২) খানা খেলে জলখাবারের খাস্তা। ৩) বিষ্ণুর মা’র কি হন বললে বিষ্ণুরই নাম করা হয়? ৪) বিলের মুখে ঘুঁষি পড়লেই বেরিয়ে আসবে কেঁচোর মত। ৫) মেনির বোনপো বলে ‘এলুম”, ভাগ্নেও বলে--বাবা গেলুম। ৬) দাঁতের মাঝখানে কিরকম? তার দিয়ে দেখো, দেখা পাবে। ৯) ঠোঁটকাটা শুভাশিষ নিঃশব্দে মেয়ে হয়ে গেছে। ১১) অসময়ে সাবালকের পায়ের সামনে পড়বে কাল। ১২) স্বর্ণলতিকার হৃদয় আসল নয়। ১৪) সফর যেন মনিবের মনোমত হয়। ১৬) দেবতা বলে আমাকে দাও, বাঙালী বলে বরফে দাও। ১৯) চামচেকেই দিয়ে দিলে আর কে উড়বে পেঁচার সাথে। ২০) তামসে সে নই, আরো রস দিলে মধুময়। ২১) অবলা পশুর উপকারের মধ্যে রহিতেও গো। ২২) জগত লেজকাটা সাক্ষরকে পেলে শৌখীন জামা হতে পারে। ২৪) ঝুমকো থেকে খসা মণির কোথাও বাতি। ২৬) ক্লেশে ক বর্ণ? ২৮) কা তব কান্তা চ--কবি একথা বললে তার স্বচ্ছ মানে।

    মেজোদাদু নতুন ক্রসওয়ার্ড পেয়ে মহা খুশি। পকেট থেকে চিবিয়ে ছিবড়ে করা একটা পেন্সিল বের করেছেন। সেটা দেখেই অংকস্যারের মনে পড়ে গেছে, আগেরদিনের কথা। হাঁক দিলেন--গ্যাঞ্জাম, একটা অঙ্ক দেওয়া ছিলো না? উত্তরটা কষাই ছিলো গ্যাঞ্জামের। খাতাটা এনে সে ধরিয়ে দেয় অংকস্যারের হাতে।

    গ্যাঞ্জামের টোপো-গণিত:

    ৯x৯ ছকে জ্যামিতিক সূত্র সবচেয়ে বেশি হতে পারে ৮১-টা (যদি প্রতিটা ঘরেই একটা শব্দ থাকে)। এক্ষেত্রে সাংকেতিক সূত্রের সংখ্যা ১৮ (শব্দসংখ্যার সমান)। সাংকেতিক সূত্র সংখ্যার ন্যূনতম মানও ১৮, কেননা প্রতিটি অনুলম্ব (horizontal) ও উল্লম্ব (vertical) ৯ ঘরের পাটিতে অন্তত একটি শব্দ থাকতেই হবে। না নইলে ক্রসওয়ার্ড দুটি প্ররথক ও বিযুক্ত ক্রসওয়ার্ডে ভাগ হয়ে যায়। তাহলে জ্যামিতিক সূত্র আর সাংকেতিক সূত্রের অনুপাতের সর্বাধিক মান হয় ৮১/১৮=৪.৫। একই যুক্তিতে দেখা যাচ্ছে nxn ছকে এই অনুপাতের সর্বাধিক মান n/২।

    অংকস্যার তো সমাধান দেখে আনন্দে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। --তুই তো সাধারণ ক্ষেত্রের সমাধানটাও করে রেখেছিস রে। শাবাশ। এই তো চাই। জানিস তো, মাঝে মাঝে মনে হয়, এই বাংলা ক্রসওয়ার্ডের অনাদরের পিছনেও আমাদের পরিশ্রম এড়াবার জন্য চিন্তা আর বুদ্ধির খেলাগুলোই পত্রিকাটত্রিকা থেকে বাদ দিয়েছি। তোদের দেখে আশা হয়। হয়তো তোরা দিন ফেরাবি বাংলার। অংকস্যার ভাবাবেগে আবার নির্বাক হয়ে যান।

    গ্যাঞ্জাম উৎসাহ পেয়ে বলে--স্যার, গতবার সান্ধ্য সূত্রের কথাটা তুলে আর কিছু বলেন নি। এবার ছাড়ছি না।

    ততক্ষণে অংকস্যার ঘড়ি দেখে--বাপ্‌রে, বলে উঠে পড়েছেন। গ্যাঞ্জাম-গাংলুকে বললেন--পরে হবে রে। আজকে মায়ের সাথে দাবা খেলার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। দেরী হয়ে গেলে কেলেংকারী। মা সে যুগের হাই সোসাইটির মহিলা ছিলো জানিস তো। বৃটিশদের মত পাংচুয়াল। পাংচুয়াল কথাটার কোন ভালো বাংলা প্রতিশব্দ নেই বলে কালই খোঁটা দিয়েছে আমায়।

    গ্যাঞ্জাম মুখ ভার করে থাকে। অংক স্যারের এই লোভ দেখিয়ে কেটে পড়াটা ভারি অন্যায়।

    অংকস্যার বললেন--আগের ক্রসওয়ার্ডের সমাধানটা দ্যাখ। একটু চিন্তা কর এ নিয়ে। অভিজ্ঞতা বাড়লে আলোচনাটাও জমবে। টোপো-গণিতটা ভুলে যাসনি তো?

    (এক নম্বর ক্রসওয়ার্ডের সমধান এখানে)

    গ্যাঞ্জাম গুণিয়ে দেয়। এক, জ্যামিতিক সূত্র হবে বেশি। দুই, কালো ঘরের সংখ্যা হবে কম। তিন। সূত্র হবে সহজ নয়, সান্ধ্য।

    --ব্রাভো। উঠতে উঠতে বলেন অংকস্যার। --ভালো কথা, তোদের ওই পত্রিকায় কি আমার ক্রসওয়ার্ড দিতে পারি? টাকাফাকা চাই না। এমনিই দেবো।

    গ্যাঞ্জামের মুখ করুণ হয়ে গেছে। গাংলু বলে--স্যার, ওটা একটা সিরিয়াস পত্রিকা। আমরা কিছু নতুন সাহিত্য তৈরি করার চেষ্টা করছি। খেলাধুলোর জায়গা নয় ঠিক...।

    অংকস্যার হইহই করে বলেন--ব্যাস্‌, ব্যাস্‌, বুঝে গেছি। আমিও তাই ভেবেছিলাম। এদিকে সিরিয়াস জাত বলে বৃটিশদের বদনাম হয়ে গেল, ভাবো। কোন কম সিরিয়াস পত্রিকার খবর পেলে দিস।

    অংকস্যার উঠোন পেরোতে যাবেন এমন সময় একধার দিয়ে মিচকেকে ছুটে পালাতে দেখা গেল। মুখে স্টেট্‌স্‌ম্যানের বেশ কয়েকটা পাতা। অংকস্যার রে রে করে উঠলেন। --গেল, গেল ঘোষবাবু, আপনার স্টেট্‌স্‌ম্যান নিয়ে গেল ব্যাটা উল্লুক! কিন্তু মেজোদাদু এমন নিবিষ্টমনে পেন্সিল চিবোচ্ছিলেন যে তাঁর কানেই ঢুকলো না সে আওয়াজ।

    দুই নম্বর ক্রসওয়ার্ডের সমাধান পরের সংখ্যায়। পরের সংখ্যা প্রকাশের আগে তার সমাধান পরবাসে পাঠাবার জন্য পাঠকদের চ্যালেঞ্জ দিয়ে রাখা হল। প্রথম দুজন সঠিক শব্দশিকারীর জন্য পরবাসের টি-শার্ট পুরস্কার! -–সম্পাদক।



    অলংকরণ (Artwork) : অমিতাভ সেন
  • | ২ | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments