এক চক্কর হেঁটে এসে বেসিনের সামনে মুখে জল থাবড়াতে থাবড়াতে কথা হয় সূর্যর নিজের প্রতিবিম্বের সঙ্গে। মন কেমনের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে এভাবেই মাথার ঠিক রাখা, নিজের স্বাভাবিক ছন্দ বজায় রাখা——
—কী হে সুজ্জিকুমার, তোমার দেশে ফেরা তো দূর অস্ত।
— সে তো বোঝাই যাচ্ছে। আচ্ছা ফাঁসান ফেঁসেছি আমরা, কী বলো? প্রতিবিম্ব জবাব দিল।
— তা কোনরকমে ভোটকম্বলের তৈরি কোট পরে একটা শীত কেটেছে। এবার আসছে আরেক শীত। দেখেছ তো, আকাশেবাতাসে গাছের পাতায় হেমন্তের সাড়া পড়েছে।
—হুঁ দেখিনি আবার! তোমার তো খুব শখ ছিল রবি ঠাকুর পড়ে, বসন্ত আর হেমন্ত দেখবে, গাছে পাতায় প্রকৃতির রং আর রূপের কারিকুরি দেখবে। কলকাতায় তো কিছুই পাওনি, বহরমপুরে তাও অল্পসল্প টের পেতে কুঁড়ি আসা, নতুন কিশলয় ফোটা। আর হেমন্তের ঝুপ করে অন্ধকার নামা। এখানে এখন দ্যাখো বসে বসে, ফল কালার। ঝরাপাতার রঙ! হলুদ পাতা কমলা পাতা, লাল টুকটুকে পাতারা মচমচ করছে পায়ের তলায়।
—না জানি আর কটা হেমন্ত কটা শীত কাটবে। এর পর আসছে ক্রিসমাসের ছুটি। লালমুখো মার্কিন ছাত্ররা চলে যাবে নিজেদের বাড়িতে। আমাকে একা হস্টেলে থেকে যেতে হবে! ঐ শ্যাম, কিম আর চ্যাং-দের সঙ্গে।
ওই তো গুটিকয় এশীয় ছাত্র। তার ভেতরে আবার আছে সুন্দরী মারাঠি ললনা, বিধু বৈদ্য। কয়েকবার বিধুর কথা দাদু আর মাকে লিখেওছে ও। ওদিক থেকে কোন উৎসাহ আসেনি, সাড়া শব্দ না। কৃষ্ণার ব্যাপারটাও ঝুলছে।
আয়নায় তাকিয়ে মুচকি হাসল সূর্য। বিধু কী ভাল লুচি বানালো সেদিন। খেয়ে মুগ্ধ হয়েছি বলেই কি প্রাণ টাটাচ্ছে? বিজ্ঞানী ভারতীয় ললনা... মুম্বইতে বাবার অঢেল টাকা। ওর সঙ্গেই ঝুলে পড়ব? ওদিকে বাঙালি রক্ষণশীল বাবা মা, দিদিমা দাদু মত দেবেন না। নিরামিশাষী মেয়ে একেই।
প্রতিবিম্ব ফেরত দিলে হাসি। তুমি পতঙ্গ, বিধুর রূপ আর সঙ্গে গুণ, দুইই আগুন। সন্দেহ নাই তায়! তোমাকে পুড়ে মরতেই হবে মনে হচ্ছে হে! খামোখা ডানা পুড়িয়ে ফিরো না। বিধুর বাবাও তো হিরে ব্যবসায়ী। তোমার সঙ্গে তার বিয়ে দেবে কেন?
—তাহলে এই ছুটিতে কোথায় পালাবে? নইলে তো এশীয় ছাত্রদের জমায়েতে ঘুরে ফিরে সেই বিধু বৈদ্য!!! বরং পালাও টম বা পিটারের সঙ্গে ওদের দেশের বাড়িতে। ঝুলে পড়ো রোড ট্রিপে?
টাকাপয়সা জমিয়ে সূর্য বস্টন দেখতে গেছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে লাল ইঁটে গাঁথা দেওয়াল, তার গায়ে সবুজ আইভির লতা জড়িয়ে-মড়িয়ে সে কী অপূর্ব শোভা। ভেতরে সেই বিশাল বিশাল বিখ্যাত ভবনগুলো। পৃথিবীর যাবতীয় পণ্ডিতের ক্রিয়াকর্মের যজ্ঞ চলেছে, চলে আসছে ঊনবিংশ শতকের থেকে এইসব ভবনে।
সে এখানে পড়তে আসেনি কিন্তু যত বিখ্যাত মানুষের কাজের ভারা ভারা স্বর্ণধান এখান থেকে উঠেছে। তাদের বিশাল ধানের গোলার ওপরে, সে সামান্য কিছু পরিশ্রমের ফসল রাখছে এইমস-এ বসে। এ যেন কাম্যুর লেখা সেই মিথ অফ সিসিফাসের গল্প। পাহাড়ের মাথায় বিশাল পাথর ঠেলে তোলা... হ্যাঁ এটা ঠিক যে বিজ্ঞান প্রযুক্তির অগ্রগতি একেবারে নৈরাশ্যের নয়, ক্রমশ প্রগতির দিকে তার বিস্তার, একটার ওপর আরেকটা পাথর রেখে রেখে তবেই তো এই মানব সভ্যতার সৌধ নির্মাণ হয়েছে। ঘন্টার পর ঘন্টা ল্যাবরেটরিতে কাটিয়ে তবেই অগণিত ছাত্র-বিজ্ঞানীর পরিশ্রম একটা কোন থিওরি বা তত্ত্বকে প্রমাণ করেছে, সে তত্ত্বের ওপরে দাঁড়িয়েছে তার পরের তত্ত্ব। এভাবেই প্রগতি। এভাবেই সভ্য সমাজের বিবর্তন।
সূর্য ধীর পায়ে, যেন পা টিপে টিপে সন্তর্পণে, লাইব্রেরিতে যায়। মূল লাইব্রেরিটায়। প্রবেশ অবাধ। কোটি কোটি বই আকাশসমান ছাত অব্দি রাখা। এইখানে লাইব্রেরিতে বসে নীরবতার এক অনৈসর্গিক সুর শোনা যায়। ওপর থেকে ঝুলে আসা সবুজ আচ্ছাদন দেওয়া রিডিং লাইটস। টেবিলে টেবিলে একেবারে নিঃশব্দে বই পড়ছে ছেলেমেয়েরা। খস খস শব্দ পাতা ওল্টানোর। আর কিছু নেই। অনেক উঁচু ছাতের দিকে তাকালে মাথা ঘোরে। দিকে দিকে স্কাইলাইট থেকে প্রতিফলিত আলোতে কিছু কারুকাজ চোখে পড়ে।
এখানেই কাজ করে গেছেন রসায়ন-ভৌত বিজ্ঞানের বিজ্ঞানীশ্রেষ্ঠ অনেকেই। রজার অ্যাডামস ১৯১২ সালে পিএইচডি করেছেন এখান থেকে। আরে আরে, ইনিই তো সেই অ্যাডামস ক্যাটালিস্ট-এর অ্যাডামস! এই বিজ্ঞানীই প্রথম গাছগাছড়ার থেকে জটিল জৈব যৌগ নিষ্কাশন করেছিলেন... আবিষ্কার করেছিলেন ভেজিটেবিল অয়েলের ভেতরের কম্পোজিশন, উদ্ভিদ্জাত অ্যালকালয়েডের হালহদিশ দিয়েছিলেন। হাইড্রোজেনেশনের জন্য সহজ অনুঘটকের আবিষ্কর্তাও ইনি। আজ সূর্য যে অশ্বগন্ধার শেকড়ের অ্যালকালয়েড নিয়ে কাজ করছে, সেই সিঁড়ির ধাপটি তৈরিই হত না যদি না অ্যাডামস কাজ করে যেতেন অনেক নিচের একটা ধাপে দাঁড়িয়ে। তখনো কেউ ভাল করে জানত না, নানা উদ্ভিদ থেকে তৈরি ঔষধের ক্রিয়াকর্মের ভেতরে কী আছে। যুগ যুগ ধরে মানুষ ভ্যানিলা ব্যবহার করেছে, আবার কচু থেকে ওষুধ বানিয়েছে, আদা থেকে ওষুধ বানিয়েছে, এইসব গাছগাছড়ার উপকরণের ভেতরের পরমাণু স্তরে গিয়ে তাদের কম্পোজিশন জানা হল এই তো সেদিন, ১৯০০ সালের এদিকে ওদিকেই। ছবির মত স্পষ্ট হল কার্বনের সঙ্গে হাইড্রোজেনের পরমাণুদের হাত ধরাধরি, তাদের শৃঙ্খল বানানোর ইতিবৃত্ত। অন্য অন্য সব পদার্থের অণু ভেঙে দেখানো শুরু হল তার ভেতরে কার্বন পরমাণুরর সঙ্গে জুটি বাঁধা অন্য অন্য সব পদার্থের পরমাণুরা কীভাবে আছে। নানা আশ্চর্য জটিল যৌগের অণু ধরে ধরে দেখা হল। এই সব যৌগেরই সমাহার, আমাদের বিশ্বভুবনে ছড়িয়ে থাকা যত জীবিত পদার্থ...অথবা বহুযুগ আগে মৃত হাইড্রোকার্বন মাটির তলার শেল অয়েল, যা থেকে নিষ্কাশিত হয় পেট্রোলিয়াম, আর বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে পাওয়া যায় কেরোসিন প্যারাফিন থেকে শুরু করে অনেক জিনিস। নাপাম, যা নাকি যুদ্ধে বিস্ফোরক বোমা বানাতে গবেষকরা উঠে পড়ে লেগেছেন, আবার অন্যদিকে মেয়েদের ঠোঁটে লাগাবার জন্য জেলির মত পদার্থ যেটা, সেই পেট্রোলিয়াম জেলি। দিদিমা লাগান ভেসলিন। তার ভেতরে সেই পেট্রোলিয়াম জেলি। এমনিভাবেই ছড়িয়ে আছে অঢেল যৌগ অণু, প্রতি জিনিসের ভেতরে ঢুকলেই যেন থরে থরে বিস্ময় লুকিয়ে আছে। ভেল্কিবাজির আড্ডাখানা ...
হারভার্ডেই কাজ করেছিলেন গিলবার্ট এন লুইস, ১৯১২ সাল নাগাদই তিনিও পিএইচডি করে চলে যান ক্যালিফোর্নিয়া। যে ভদ্রলোক কেমিকাল বন্ডিং-এর ধারণার জনক। দুটি পরমাণুর ভেতরে যুগ্ম ইলেকট্রন ভাগ বাঁটোয়ারা করে নেবার ফলে যে শৃঙ্খল তৈরি হয় সেই কোভ্যালেন্স বন্ড আবিষ্কার করেছিলেন লুইস। লুইসের সিম্বল না ব্যবহার করে একজন জৈবরসায়নবিদের গতি নেই। কার্বনের চার পাশে চারটে দাঁড়ি দিয়ে হাইড্রোজেন বা অন্য অন্য পদার্থের সঙ্গে তার গাঁটছড়া বাঁধার কথা বোঝাতে পেরেছিলেন প্রথম লুইস। লুইস স্ট্রাকচার বলে কথিত এই জিনিসটা নাকি লুইস স্বপ্নে পেয়েছিলেন। এসব গল্পকথা অবিশ্যি। রাতে কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না কীভাবে ছবির মত করে দেখাবেন যেকোন যৌগ অণুর স্ট্রাকচার। তারপর স্বপ্নে দেখেন ছেলেমেয়েরা হাত ধরাধরি করে নাচছে। আর সেখানেই ছিল সমাধান। গোল হয়ে ঘুরে আসা কার্বন স্ট্রাকচারের ছবিটা মাথার ভেতরে গেঁথে নিয়ে সকালে উঠলেন তিনি।
কার্বন, একটা অতি আশ্চর্য পরমাণু। তার প্রতি পরমাণুতে আছে ছটা করে প্রোটন আর ছটা করে ইলেকট্রন। আবার একটা হাইড্রোজেন পরমাণুতে আছে একটা ইলেকট্রন। কাজেই একটা কার্বন পরমাণু, যে নাকি হেদিয়ে মরা প্রেমিকের মত কখনো একা থাকতে জানে না, সে তখন আনতাবড়ি ঘুরে ফিরে বেড়ানো ফ্রি হাইড্রোজেন পরমাণুকে আশপাশে পেলেই গাঁটছড়া বাঁধে, চারটে হাইড্রোজেন পরমাণু তখন ঘিরে থাকে একটা কার্বনকে। এভাবেই অন্য পদার্থদের ভ্যালেন্সি অনুযায়ী তাদের সঙ্গেও জুড়ে যায় কার্বন।
অর্গ্যানিক কেমিস্ট্রি বা জৈব রসায়নের একেবারে গোড়ার কথা এই কোভ্যালেন্সি বন্ড। তার আবিষ্কার যিনি করলেন তিনি একচল্লিশ বার নোবেলের জন্য মনোনীত হলেও নোবেল পেলেন না একবারের জন্যও। রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হয়েই খুশি থাকতে হল তাঁকে।
পিটারের সঙ্গে কথা হয় যখন। এমনই সব কথা।
এক কাপ করে কফি নিয়ে বসে কত অনন্ত কথা বলে ওরা।
তুমি জানো, পিটার, আমার ভবিষ্যতের কোন পরিকল্পনাই নেই।
সে কি! এত পরিশ্রম করছ। এখানে আরো রিসার্চ করবে না তুমি?
তুমি করবে কি?
না, বোধ হয় চাকরিই খুঁজব।
কেন? তুমিও তো খাটছ খুব।
আমার তো বাবা-মায়ের টাকা নেই। এই লেখাপড়ার ব্যাপারে সব খরচ আমিই চালাই। ক্লাস থাকে না যখন তখন বারে গিয়ে কাজ করি, কাফেতে কাজ করি। একবার জ্যানিটরের কাজও করেছি। যে পয়সা দেবে তাকেই আমার শ্রম দেব।
এখানে আসার আগে আমার সত্যি অনেক ভুল ধারণা ছিল। মনে হত তোমরা বড়লোক দেশ। অভাব অভিযোগ নেই।
অভাব আছে, অভিযোগ নেই। আমাকে খেটে পিটে নিজেরটা করে নিতে হবে। মিলিয়নেয়ারের ছেলে তো নই।
আপনা হাত জগন্নাথ, মনে মনে বলে সূর্য। ডিগনিটি অফ লেবার। এখানে সবাই জানে সেটার মূল্য।
সুরিয়া জানো তো আমেরিকা হল স্বপ্নের দেশ। সবাই এখানে এসে নিজের স্বপ্ন সফল করতে পারে। স্ট্যাচু অফ লিবার্টি তো ডাকছে সবাইকে, বলছে এসো আমার মশালের আলোয় পথ চিনে চিনে।
না পিটার। এ দেশ আমার ভাল লেগেছে। কিন্তু চিরতরে এখানে থেকে যেতে চাই না।
দেশে ফিরে কী করবে? ইউ হ্যাভ এ গার্লফ্রেন্ড দেয়ার? অনেকটা চওড়া করে হাসল পিটার। যেন সূর্যের সিক্রেট জেনে ফেলেছে, এমন দুষ্টু মুখ করল।
আমার কেউ নেই। আমি ফিরে কী যে করব তাও কি জানি? কিন্তু আই হ্যাভ ওল্ড পেরেন্টস। আমার অনেক পিছুটান। চাকরি নিতে হবেই। নইলে এ দেশে থেকে বছরের পর বছর গবেষণা করতাম। এমন পরিবেশ, এমন ল্যাব!
ওদের কথা ঘুরে যায় গবেষণার দিকেই।
গবেষণা জিনিস্টা এমনই, এক জীবনে কিছুই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। আজ তারা যে কাজ করছে হয়ত তাদের নাতিরা এসে সেই পথে খানিক দূর অগ্রসর হতে পারবে।
— সেই তো; আমাদের বিজ্ঞানীর জীবন এমনই। আশা অনেক, প্রত্যাশা শূন্য। সত্য ঢাকা আছে অজ্ঞানের ঘোমটায়। সে আড়াল অনেক পরিশ্রমে একটুখানি সরাতে পারাও যেন সারাজীবনের কাজ। অথচ বৈষয়িক প্রাপ্তির ভাঁড়ার হয়ত খালিই থেকে যায়। তুমি অনেক টাকা করতে চাও, পিটার?
— টাকা করতে হলে নতুন কর্পোরেশনগুলোতে চাকরি নিতে হবে। ইট ডিপেন্ডস অন মাই গার্ল। আমার বান্ধবী যদি বলে অনেক টাকা চাই তার। ভাল গাড়ি চাই। ওয়াশিং মেশিন চাই। আমাকে কর্পোরেশনেই যেতে হবে।
—তাও আমেরিকার মত দেশে এক অধ্যাপকের খাওয়া-পরার অভাব থাকে না। ল্যাবরেটরি গড়ে তোলার জন্য অর্থও হয়ত পাওয়া যায়। ভারতে? জুতোর শুকতলা খসে যাবে ফান্ডিং পেতে। সরকারে লেখালেখি করতে। তবে জুটবে ঠিকঠাক যন্ত্রপাতি ল্যাবের জন্য। আমার মেন্টর শংকরদা হিজলিতে যেভাবে লড়েছিলেন।
বিকেল গড়িয়ে পড়ে। পিটার বিকেলে পাব-এ যাবে। বারটেন্ডিং করবে। কিছু টাকা পাবে। নিজের শেষটা একটা সবজে রঙের সরু বোতল নিয়ে গলায় ঢালবে তিতকুটে বিয়ার। তার বন্ধুরা এসে ডাক দেয়। সে উঠে যায়। সূর্য একাই বসে থাকে। কাফেটেরিয়ার সামনে সারি সারি মেপল গাছ। হেমন্তে তাদের পাতার রং উজ্জ্বল রঙ্গিন।
এ লাইনে নৈরাশ্য এসে পড়বে যেকোন সময়। জীবন কেটে যাবে লড়তে লড়তে। প্রাতঃপ্রণম্য আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বেঙ্গল কেমিক্যালস গড়েছিলেন কী পরিমাণ পরিশ্রমে, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয়। স্বপ্নের জোর ছিল, স্বদেশির আদর্শ ছিল তাই হয়ত খানিকটা তাঁর উদ্যমের মোটরটাকে চালিয়েছিল। নতুবা কীভাবেই বা সম্ভব ছিল ঐ পাহাড়ের মত কাজ তোলা!
সূর্য জীবন সম্পর্কে কোন কথা আগে ভাবেনি তা তো নয়। তবে একাকিত্বের ভেতর বসে বসে অনেক কিছু বোঝা যায়। আচ্ছা, আমি কি অলস? আমি কি পরিশ্রমী? অন্যেরা তাকে পরিশ্রমী বলেই জানে। কিন্তু সে তো জানে সে ভেতরে ভেতরে অলস। আর ততোধিক বিভ্রান্ত।
হঠাৎ বিচ্ছিন্ন বোধ করে সবার থেকে। এরা এই দেশের ছেলেমেয়ে। পিটার টম রোজ। ওরা কেন এত সহজে সন্তুষ্ট। দারিদ্র্য আছে, কিন্তু ওদের তো ভেতরে কোন ক্ষোভ নেই? আশায় বাঁচে চাষা। আমাদের দেশে চাষা শব্দটা নিন্দার। তাই কি সূর্য আশায় বাঁচে না? না কি সূর্য তৃতীয় বিশ্বের বলে এত অসন্তুষ্টি, এত আত্মপ্রশ্ন তার?
কেন মনে হচ্ছে এত টাকা খরচ করে পড়ে দেশেই ফেরা উচিত আর দেশের জন্য কাজ না করাটা হবে অন্যায়? তৃপ্ত জীবন, আরামদায়ক খাতে বইতে থাকা জীবন, কেন ভাল্লাগে না তার?
আকুতি ছাড়া বাঁচা নেই। কোথাও আঘাত ছাড়া সূর্যালোক নেই! কষ্ট ছাড়া বেঁচে থাকা গর্দভের জীবন। এই সত্য এখন জলের মত সহজ।
যাক, আপাতত কিছু বছর চিন্তা নেই। দুশ্চিন্তাকে ঘিরে ঘিরে, শুক্তি যেমন মুক্তো গড়ে সেরকম জীবন গড়বে সূর্য। সামনে বিক্ষুব্ধতা, অনেকটা পথ চলার... এইটুকুনি না থাকলে হয় না। এখন তাকে অনেক অনেক পরিশ্রম করতে হবে। তার জীবনে আদর আহ্লাদের ক্যোটা ফুরিয়ে গেছে। বাৎসল্য স্নেহ পাবার বয়স আর নেই। সামনে এখন কাজ কাজ আর কাজ।
কবে কাজ শেষ হবে কে জানে? রিসার্চ শেষ করতে হবে।
ত্রিশ বছর বয়স হবার আগে, সে ভেবেছিল, দুটো জিনিস হবে তার। এক, প্রেম। দুই, জ্ঞানলোকের চাবিকাঠির সন্ধান। আঠাশ পুরে গেল কিন্তু দুটোর কোনটাই হল না।
হাই-ই, ল্যাবে যাবে না? প্রায় ছুটতে ছুটতে ফিরে এল পিটার, জ্যাকেট ফেলে গেছে চেয়ারের হাতলে। মজা করার সময় শেষ। টাইম ইজ আপ। লেটস গো অ্যান্ড স্লগ।
হ্যাঁ যাই। উঠে পড়ল। আজ অনেক রাত অব্দি খাটতে হবে। ওই জায়গাতেই পরিত্রাণ। রেডিওতে জ্যাজ চালাবে পিটার। ল্যাবে যাবার সময়টুকু বাদ দিলে... মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনো করার সময়টুকু বাদ দিলে ভীষণ অস্থির লাগে। মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতা যেন কমে আসছে মনে হয়। কেমন একটা হেদিয়ে যাওয়া ভাব।
নাঃ তেড়েফুঁড়ে লাগতেই হবে।
তারুণ্যের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে লড়ে যাওয়া, প্রেমে থাকা... প্রেমের জন্য মাইল মাইল ছুটে যাওয়া। কিন্তু সে তো সঠিক লোককে পেল না। উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার মত কোন বিশুদ্ধ মানবী কেন এল না। তার মিউজ হল না!
চিঠিটা লিখতেই হল। অপছন্দের কাজ। একেবারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা। একবারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা। এসব সূর্যের একদম স্বভাবে নেই। দোলাচলে ছিল বছর খানেক। এখন আর না। এভাবে সে তো নিজেকেও আটকে রাখছে, আর কৃষ্ণাকেও। তদুপরি কৃষ্ণার বাবা-মাকেও।
সে যেসব মেয়েদের জন্য হৃদয়ের অন্তঃস্থলে টান অনুভব করছে তারা কেউ প্রাপ্য নয়... আর যাকে বিয়ে করবে না তার প্রতি প্রেম দেখানোটাও তার কাছে সঠিক নয়... নিজেকে চেপে রাখা, টেনে ধরে রাখা তাই অনিবার্য হচ্ছে...চিঠিটা সে লিখেই দিল শেষপর্যন্ত। কৃষ্ণাকে অন্যত্র বিয়ে দিতে পারেন।
১১
কৃষ্ণা, আজ শিবরাত্রি সে খেয়াল আছে কি তোর? বাবা কাল যে নতুন গয়নাটা গড়ে এনেছেন সেইটে বার করে পর মা। শিবের মাথায় জল দিলে তবে তো শিবের মত বর পাবি।
প্রাচীন বাড়িটা তার চৌকো টালির উঠোন আর চকমিলানো ঘরের সারগুলো শুদ্ধ, কৃষ্ণার সমস্ত সত্তাকে নিজের পাকে পাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।
সকাল সকাল কৃষ্ণা আজ স্নান করেছে, ভিজে চুল পিঠের ওপর মেলে দেওয়া। শাড়ি পরেছে সাদার ওপর ধনেখালির মিহি ডুরে। বিকেলে মায়ের ঢাকাই নামিয়ে পরবে। কলেজ যাওয়া কবেই বন্ধ, রোজ ছুটি। কলেজে যাক আর ওই ধবধবে ফর্সা রং রোদে জ্বলে তামাটে হোক। তবেই হয়েছে। সতেরো-আঠেরো বছর বয়সের একটা অবিবাহিতা মেয়ে ঘাড়ের ওপর থাকা যে কী বিষম…, তা এযুগের বাবা-মা মাত্রেই বোঝে। পারিবারিক কৌলিন্য, আভিজাত্য, সব অক্ষত রেখে কুল শীল মিলিয়ে একটা বিয়ে দিয়ে দাও। মেয়ের মন খারাপের রোগ আছে? বিয়ে দিয়ে দাও ঠিক হয়ে যাবে। মেয়ের ঘুম হয় না, খিদে হয় না? খাওয়া নিয়ে খুঁতখুঁত আছে? বিয়ে দিয়ে দাও ঠিক হয়ে যাবে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়ে অন্য বাড়ির পুরুষের চোখের তিরে বিদ্ধ হচ্ছে... ওটাই নাকি আবার তার ভাল লেগে গেছে? বিয়ে দিয়ে দাও, ঠিক হয়ে যাবে।
ব্রত, বার, উপোস, পুজোআচ্চা... হাতে ধরে ধরে ছোট থেকে মায়ের কাছে তো শিখেইছে কৃষ্ণা। এখন পুজোর ঘরে অনেকটা সময় বসে বসে মায়ের সঙ্গে ফুল সাজায়। মায়ের লক্ষ্মী পুজোর সময়ে বসে বসে দেখে। সব শেষে মা যখন লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়েন দুলে দুলে, সুর করে করে, সেগুলোও মন দিয়ে শোনে কৃষ্ণা। গল্প আছে একটা। নারদ এসে স্বর্গে উপবিষ্ট লক্ষ্মী-নারায়ণকে জানাচ্ছেন মর্ত্যের কষ্টের কথা। মানুষের অভাব অনটনের কথা। উত্তরে লক্ষ্মী যা বলছেন তা খুব স্পষ্ট।
নারদের বাক্য শুনি কহেন নারায়ণী।
বিশ্বমাতৃকা আমি জগতের জননী।।
কারো প্রতি নাই আমার ক্রোধানল।
ভুগিছে মর্তবাসী নিজ নিজ কর্মফল।।
মহামায়ার স্বরূপে নারী সত্য বচন।
মর্তবাসী না মানে এই কথন।।
নারীর পরমগতি স্বামী ভিন্ন কেবা।
ভুলেও না করে নারী স্বামী পদসেবা।।
যথায় স্বেচ্ছায় ঘুরিয়া বেরায়।
গুরুজনে অকারণে মন্দ বাক্য কয়।।
যে নারী সকালে না দেয় ছড়া।
করি তার সংসার আমি লক্ষ্মীছাড়া।।
অতিথি যদি উপস্থিত হয় দ্বারে।
দূর দূর করে বিতারিত করে তারে।।
গুরুদেবের প্রতি ভক্তি নাহি করে।
আমি যে থাকি না তাহার ঘরে।।
এয়োতি নারী সিঁদুর না দেয় কপালে।
মলিন বস্ত্রে যথা ইচ্ছা তথা ঘোরে।।
নিত্য যে না করে অবগাহন।
তারে ছাড়ি করি অন্যত্র গমন।।
দেব দ্বিজে কদাপি ভক্তি না করে।
সকলের সাথে মত্ত সদা কলহে।।
তিথি ভেদে নিষিদ্ধ বস্তু যে বা খায়।
হই না কভু তার ওপর সহায়।।
যে মনুষ্য ভক্তি ভরে একাদশী না করে।
নাহি হই প্রসন্ন তাহার ওপরে।।
উচ্চ হাসি হাসিয়া যে নারী ঘোরে।
ঘোমটা না টানে মস্তক উপরে।।
গুরুজন দেখি যারা প্রণাম নাহি করে।
সন্ধ্যাকালে ধূপ দীপ নাহি জ্বালে ঘরে।।
এমন নারী যে গৃহেতে করে অবস্থান।
কভু নাহি পায় তারা লক্ষ্মীর বরদান।।
কহো নারদ কি দোষ আমার।
জীব ভোগে কর্মদোষে তাহার।।
মা পড়েন আর কৃষ্ণা মিটিমিটি হাসে। হি-হি, এ তো বেশ কথা। লক্ষ্মীদেবী বলছেন সব দোষ মেয়েদের! যত অনাছিষ্টি কাণ্ড পৃথিবীর, সেসবের জন্য নাকি মেয়েরাই দায়ী। মা-ও তো সর্বদা ওকে বলেন, সংসারে শান্তি রাখে মেয়েরা। শান্ত থাকবি, লক্ষ্মী হয়ে থাকতে শিখবি। মুখে মুখে কথা বলবি না। বাবার মুখের ওপর মা একটাও কথা বলেন না কখনো। বাবা বাইরে থেকে তেতেপুড়ে এলে জামা এগিয়ে দেওয়া জল এগিয়ে দেওয়া, মায়ের এই কাজ। এখন মায়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণাও করে। বাবা হয় কথায় নয় কথায় রেগেই আছেন। কে বাবার সঙ্গে মামলা করেছে। দেশের বাড়ির মস্ত পুকুরে কোন প্রতিবেশী বিষ দিয়ে দিল। সব মাছ মরে ভেসে উঠল। বাবা চললেন মামলা ঠুকতে। কোন প্রতিবেশীর আম গাছের মস্ত ডালখানা ওদের পাঁচিলের ওপর এসে পড়ল। সে ডাল কাটানোর জন্য সারা একটা দিন কোমরে চাদর বেঁধে বাবা রোদ্দুরে রইলে… একের পর এক সমস্যা। আর সবকিছুর পর বাড়ি ফিরেই বাবার কী মেজাজ, সব মেজাজ মায়ের ওপরে।
নে নে, শিবঠাকুরের মাথায় ভাল করে জল ঢাল, তবে তো শিবের মত বর পাবি!
কৃষ্ণা সব মন দিয়ে করছে, করবেও। শিবের মত বর? সে মনে মনে সূর্যশেখরের মুখটা কল্পনা করে আর মিটিমিটি হাসে। কিন্তু কই সে? কটা চিঠি প্রথমদিকে লিখেছিল বটে। তারপর সব চুপচাপ। পুরুষমানুষ বোধ হয় এমনই। আর কোন খোঁজ নেই। এই নিয়েও বাবা-মায়ের মধ্যে একটা গোলমাল ধূমায়িত হয়ে উঠেছে সে টের পাচ্ছে। বাবা বলছেন, সে ছেলে মিথ্যেবাদী। প্রথমে বলে গেল দুবছরে ফিরে আসব, অপেক্ষা করুন। দেবযানী খুড়ির নাতি বলে আমি রা কাড়িনি। এখন দেখি তার তিন বছর চার বছর লেগে যাবে। ওদিকে সে কোন মেম বিয়ে করে বসে রইলেই তো গেল। এসব ফেরেব্বাজি এসব চিটিংবাজি চলবে না।
সামনে পেলে ধরতাম কলার চেপে... বাবা মিশমিশ করে দাঁত ঘষে বললেন। মা সরু গলায় বাবাকে কাটলেন আর ধমক খেলেন একটি প্রমাণ সাইজের। মায়ের কথা হল, তার জন্য অপেক্ষা করতে কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল। এদিকে যে ঘটক আসছেন রোজ নতুন নতুন পাত্রের কথা নিয়ে। কলকাতায় কি আর পাত্র নেই?
বাবা বলছেন, সে ছেলে চিটিংবাজি করে ছাড়া পেয়ে যাবে এইটেই আমার সহ্য হচ্ছে না ছোটবউ। বিয়ে আমি এখুনি বসিয়ে দিতে পারি মেয়ের। আগে চিঠি লিখি, নাকে খত দিয়ে তাকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়াই, সে দেখি কেমন করে হাত ধুয়ে ফেলে!
কৃষ্ণার ভাল লাগে না এই বিবাদ। সে গান শোনে রেকর্ডের। ভাল ভাল রেকর্ড বেরুচ্ছে। শাপমোচনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন "বসে আছি পথ চেয়ে ফাগুনের গান গেয়ে যত ভাবি ভুলে যাব মন মানে না" ... সে তো কৃষ্ণারই কথা।
মায়ের সঙ্গে মামাবাড়ি চুঁচড়োতে যেতে ট্রেনে চাপতে হয়েছিল। অনেকদিন পরে বেরনো বাড়ি থেকে। সেজেগুজে, চুল টাইট করে বেঁধে। মায়ের হালকা রং শাড়ি, তার ওপর একটি হালকা এন্ডির চাদর দিয়ে গা সম্পূর্ণ ঢাকা। কৃষ্ণা আজকের তরুণী, মা-মাসিদের মত চাদরে গা সে ঢাকবে না। গলাবুক ঢাকা সাদা কেম্ব্রিকের ব্লাউজ পরেছে। সে যেন টের পায় চারিদিকের পুরুষদের চোখ তাকে ছুঁয়ে স্পর্শ করে যাচ্ছে। যেন বা লেহন করেও যাচ্ছে। বহুদিন পর বেরুনো, তাই কেমন যেন কুঁকড়ে যায় কৃষ্ণা। সিটের ওপর জবুথবু হয়ে থাকে। মা বকা দেয়, কোলকুঁজো হয়ে বসে আছিস কেন? ঠিক করে বস। আবার শাড়ির আঁচল এতটুকু সরে গেলে বলে, বোকা মেয়ে, হাঁদা মেয়ে, ভাল করে শাড়িটাও পরতে শিখলি না।
মামাবাড়ি যাবার পথে সে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক চলেছেন ট্রেনে, সঙ্গে আপাদমস্তক কালো বোরখায় ঢাকা একটি মেয়ে। বোরখা পরা মেয়ে আগেও দেখেছে সে। মুসলমান সমাজের মেয়েরা অসূর্যম্পশ্যা, তাদের মুখ পরপুরুষ যাতে না দেখে সেজন্যেই কালো জালিকাটা কাপড়ে চোখটা অব্দিও ঢাকা, মাথা থেকে পা অব্দি একটা টানা কালো পর্দার আড়ালে তারা পর্দানশিন হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। এ দৃশ্য নতুন না, কিন্তু আজ যেটা দেখে কৃষ্ণা স্তম্ভিত হয়ে গেল, সেটা হল এই বৃদ্ধ লোকটির সঙ্গে ওই ছিপছিপে মেয়েটির চলাফেরা। যেন ছায়ার মত অনুসরণ করছিল সে স্বামীকে। তার বয়স বেশি নয় তা চলার গতি থেকেই স্পষ্ট। যদিও একবারের জন্যে তার মুখ দেখেনি কৃষ্ণা। কিন্তু মেয়েটি তার সিটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। কালো জালিকার ভেতর দিয়ে দুটো চকিত শুর্মা পরা চোখের চাউনি তার চোখ এড়ায়নি।
এর পর যেটা ঘটল, প্রস্তুত ছিল না কৃষ্ণা। শ্রীরামপুর পেরুতে পেরুতে বৃদ্ধটি সিট পায়, অমনি কেমন আয়েশে বসে পড়ে। স্ত্রী উচ্চবাচ্য করে না। দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ বৃদ্ধটি দেখে চন্দননগর এসে গিয়েছে। তখুনি নামতে হবে, খেয়াল ছিল না। ঢুলুনি এসেছিল বোধ হয়। নিজেরই দোষে আগে থেকে ট্রেনের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়নি। ভিড় ঠেলে বেরুতে এখন সময় লাগবে ভেবে বৃদ্ধ উতলা। সে হিংস্রভাবে, এই, চল্ চল্ বলে তার স্ত্রীকে গলাধাক্কা দিতে দিতে গেটের কাছে নিয়ে যায়। ঠিক যেভাবে মানুষ অনিচ্ছুক পশুকে ধাক্কা দিতে দিতে নিয়ে যায়, হুবহু সেই ভঙ্গি। মেয়েটি সজোর ধাক্কায় টাল সামলাতে পারছে না। কোনমতে আগে চলেছে। তারা নেমে যাবার পরও অনেকক্ষণ দৃশ্যটা তার মনের মধ্যে একটা কালো ছায়া রেখে গেছে। একটা মেয়ের দাম তার স্বামীর কাছে কী, কতখানি? সে কি পোষা কুকুরবেড়ালেরও অধম নাকি? প্লাটফর্মে সে চোখ দিয়ে খোঁজে মেয়েটিকে বা তার স্বামীকে। তারা ততক্ষণে ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়েছে। স্বামীর পরিপূর্ণ অধীন, সম্পত্তির মত এই মেয়েটা। ওর রোজকার জীবন কেমন, ভাবতে গিয়ে গলার কাছটা দলা পাকিয়ে যায় কৃষ্ণার।
কয়েক মাসের মধ্যে সূর্যশেখরের একটা চিঠি অ্যাটম বোমার মত এসে পড়ে তাদের বাড়িতে। ধূমায়িত বাবাকে দেখা যায় বসবার ঘরে। সাংঘাতিক উত্তেজিত। হাতের কাছে যা পাবেন যেন ভেঙে ফেলবেন। চিৎকার করে মাকে বলছেন, অপমানে মাথা কাটা গেল আমার। আমাদের বংশে এমন ব্যাপার কখনো ঘটেছে! ছোকরা আমার মেয়েটাকে প্রেমপত্র লিখে খোঁটা করে দিয়ে গেল... এঁটো করে দিয়ে গেল লম্পট, বেইমানটা।
মা কাঁদলেন, কৃষ্ণাও কাঁদল, দুজন সম্পূর্ণ দু-রকম কারণে। মা কাঁদলেন নিন্দার ভয়ে, মেয়েসন্তান, সোমত্ত মেয়ে, তার এক জায়গায় বিয়ের কথা হয়ে ভেঙে যাওয়া, কত লোকে কত কথা বলবে, হয়ত পরের সম্বন্ধে কানভাঙানি দিয়ে বিয়ে ভেস্তেও দিতে পারে। কী যে হবে। কৃষ্ণা কাঁদল বেদনায়, প্রত্যাখ্যানের সূক্ষ্ম অপমানের কাঁটায়... সূর্যদা তাকে অন্তত চিঠি লিখে জানাতে পারত, কী এমন কারণ ঘটল, সে আর তাকে বিয়ে করবে না।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ফুটফুটে ফর্সা চেহারাটাকে সহসা চিনতে পারে না কৃষ্ণা। মা তাকে সর বাটা, মুশুর ডাল বাটা মাখায়। ধবধবে ননীর মত অঙ্গ। তেল পিছলে পড়ে। সেই চেনা মুখটাকে অচেনা লাগল নিজেরই। রক্তহীন মৃত মানুষের মুখের মত ফ্যাকাশে লাগল কৃষ্ণার। তার রূপ আছে সবাই ছোটবেলা থেকে তাকে বলেছে। কিন্তু সেই রূপ কি যথেষ্ট ছিল না সূর্যদার জন্য? আরো কিছু চাই?
মা ঘরে ঢুকলেন... এতক্ষণ পুজোর ঘরে বসে গুমরে ছিলেন। এবার কৃষ্ণা সন্ধে অব্দি বাসি কাপড় ছাড়েনি, গা ধোয়নি, চুল আঁচড়ায়নি দেখে যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন তিনি।
পোড়ারমুখী, অপয়া একটা! কোন গুণ নেই তোর? পারলি না ছেলেটাকে বশে রাখতে? অত দাম দিয়ে এয়ারলেটার কিনে এনে দেওয়া হল, নীল গোলাপি কালি, পার্কারের কলম? একটা ভাল চিঠিও লিখতে পারিসনি? সারাদিন বাড়ি বসে করিস কি? রাশি রাশি নাটক নবেল তো গিলিস?
রাতে খেতে বসে বাবা গম্ভীর, থমথমেভাবে কৃষ্ণার দিকে দেখলেন। কৃষ্ণা থালায় করে লুচি এনে বাবার পাতে দিচ্ছিল। থাক্ থাক্ বললেন বাবা, হাত দিয়ে নিষেধ করলেন। তারপরও কৃষ্ণা জোর করে বাবাকে লুচি দিচ্ছিল।
হঠাৎ ক্রোধে অগ্নিবর্ণ হয়ে বাবা বললেন, কালই ঘটকমশাইকে ডেকেছি। প্রথম যে পাত্র হাতে পাব তোর বিয়ে দিয়ে দেব। তুই হলি আমার গলার কাঁটা। যে লোকের গলায় মেয়ের বোঝা পাথরের মত ঝুলে থাকে সে কখনো মন খুলে খেতে পারে নাকি?
সত্যি তো? কী যোগ্যতা আছে তার? সারাজীবন কোন যোগ্যতাটা সে অর্জন করতে পারল। শুধু বাবা-মায়ের কথা শুনে চলেছে। লক্ষ্মীমেয়ে হতে চেয়েছে। তার তো দুলাইনের পরিচয় লেখা হবে খবরের কাগজে বিয়ের বিজ্ঞাপনে। ফর্সা, সুন্দরী, গৃহকর্মনিপুণা, সূচীশিল্পে দক্ষা। বিএ পাঠরতা।
ভাল প্যারাকি আর হিঙের কচুরি ভাজতে শিখেছে গতকাল অব্দি সে। সকালে হারমোনিয়ামে সরগম সেধেছে। আড়াইখানা রবীন্দ্রসংগীত জানে। তাহলে, এসব কি কোন যোগ্যতাই নয়? কী জন্য আজ জীবন তার ব্যর্থ হয়ে গেল?
উদ্গত কান্নার অশ্রুজলে উপাধান সিক্ত হয়ে গেল কৃষ্ণার। কী তার আছে যার জোরে সে পৃথিবীর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারে? বলতে পারে, এই যে আমি, আমি কৃষ্ণা।
১২
১৯৫৭
“এ সপ্তাহে আমার কাজ শেষ হয়ে গ্যালো। এখন থিসিস লিখতে শুরু করেছি। এখন শুধু একটু-আধটু এধার-ওধার হয়তো বাকি থাকবে, থিসিস লিখতে লিখতে সেটা শেষ করব। আশা রাখি মার্চের কনভোকেশনের জন্য তৈরি হতে পারব। এপ্রিল কি মে মাস নাগাদ বাড়িমুখো পাড়ি দেব। এখন জাহাজের জন্য লিখছি। কতদিন বাদে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
কাজটা মোটের ওপর মন্দ হয়নি। সর্পগন্ধার অ্যালকালয়েডের জাতি চরিত্তির জানবার পদ্ধতি বার করিছি। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে একটা আফ্রিকান অ্যালকালয়েডের চরিত্তির নির্ণয় করেছি এছাড়া সর্পগন্ধার সারপেন্টিন অ্যালকালয়েড সম্পর্কেও জানতে পেরেছি যা ছিল কিনা আমার প্রথম দিককার কাজ এবং যা নিয়ে হিমসিম খাচ্ছিলাম। দেখা যাচ্ছে সাধারণ পদ্ধতির মূল্য আছে সর্বত্র।
মার্কিনী রাসায়নিক পত্রিকায় এর একাংশ বেরিয়ে গেছে। বহু লোক তার প্রশংসা করে চিঠি লিখেছে। পদ্ধতি অন্যলোকে ব্যবহার করে তাদেরও কিছু কিছু সমস্যার সমাধান করেছে।
আজ এখানে মোটে শীত নেই। গত সপ্তাহে মাইনাস চল্লিশ ফারেনহাইট পর্যন্ত নেমেছিল। এসপ্তাহের গোড়ায়ও বেশ শীত ছল কিন্তু আজ শুদ্ধু ৩২—৩৫ ফারেনহাইট। ঘরের ভেতর বেশ গরমই লাগছে কারণ যে অনুপাতে ঘর গরম করেছে আগে তা কমাতে একটু সময় লাগে।
“থিসিস ২/৩ লেখা হয়ে গেছে। বাকিটুকু এই সপ্তাহে শেষ করবো। তারপর বেঞ্চি পরিষ্কার করে জাহাজের জন্য অপেক্ষা করবো। জাহাজের জন্য লিখেছি নিউ ইয়র্কে। মার্চে আমার কনভোকেশন, তারপর দু এক মাসের মধযেই নিশ্চয়ি জাহাজ মিলে যাবে। দেশ দেখাটেখা হবে না। পথে যা পড়ে তাই দেখে ফিরতে হবে আর কি।
খড়্গপুরের ব্যাপার ট্যাপার কিছু বুঝতে পারছি না। শুনছি ওরা মনোনয়ন করে পাঠিয়েছে দিল্লীতে। তা আমার নাম তার মধ্যে আছে কিনা তাতো বুঝতে পারছি না। দিল্লির লোকদের তো আঠারো মাসে বছর। লিখবে কিনা কে জানে।
“কাশ্মীরের ব্যাপার নিয়ে এখানে কাগজে পত্তরে খুব লেখালেখি হচ্ছে। ভারতবর্ষ সংযুক্ত রাষ্ট্র পরিষদ অগ্রাহ্য করেছে – এই কথা খুব জোর গলায় ঘোষিত হচ্ছে মার্কিনী মুল্লুকে। কাশ্মীরের ব্যাপারে ভারতবর্ষের নৈতিক নিষ্ঠা সম্পর্কে তর্কবিতর্ক চলছে। যা বোঝা যাচ্ছে ভারতবর্ষের পক্ষে এটা একটা মানসিক সমস্যা। মুশকিল এই যে পাকিস্তানের আন্দোলনের ফলে আবার দাঙ্গাহাঙ্গামা না বাধে। দেশের সমস্যা যারা সমাধান করতে পারছে না, দাঙ্গা বন্যা মহামারীতে তাদের সুবিধে কারণ দেশের লোকের মন ঐদিকে নিবিষ্ট হবে।
কৃষ্ণার বাবার একটা চিঠি পেয়েছি। উনি কৃষ্ণাকে আমার দেওয়া সব চিঠি, উপহার দেওয়া আমার সব জিনিশ ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছেন।”
ফেরার দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলেছে সূর্য। জাহাজ বুক করে ফেলল। জাহাজ প্রথমে যাবে আটলান্টিক পেরিয়ে ইউরোপে। ইউরোপ ঘুরে দেখবে কিছুটা। এ ইচ্ছে তার অনেক দিনের। তারপর আবার জাহাজ ধরবে। সুয়েজ ক্যানেল হয়ে জাহাজ আরব সাগর দিয়ে ঢুকবে। বোম্বে শহরে নামবে সে। সেখান থেকে ট্রেন ধরবে।
জাহাজের টাকা আগেই জমিয়েছিল। ছাত্র পড়ানোর টাকা থেকে নিজের থাকাখাওয়া, দেশে টাকা পাঠানো ছাড়াও, জাহাজের ভাড়া অল্প অল্প করে জমিয়েছে। যেকোন উদবৃত্ত কৃপণের মত ব্যাঙ্কে রেখেছে নিয়মিত।
কাজ তার মন্দ হয়নি। মাথায় রেশমের চৌকো টুপি আর কালো চোগা চাপকান পরে তাদের বিশাল গ্র্যাজুয়েশন উৎসব হয়ে গেল। আগের উইকেন্ড-এ ভারতীয় ছাত্ররা গান বাজনা করেছে, সবাই শুনেছে ভিনদেশিদের গান। বন্ধুদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। মন কেমন এক রকমের বিষণ্ণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দেশে ফেরার উত্তেজনাও কম নেই।
পরিশ্রম করলেই তবেই বিদেশে কিছু পাওয়া যায়। বসিয়ে খাওয়াবে না কেউ কারুকে। আমেরিকায় একটা কথা আছে, দেয়ার আর নো ফ্রি লাঞ্চেস। গতর খাটিয়ে খাটিয়ে এখন ক্লান্ত সূর্য। এদিকে এভাবে খাইখালাসি বন্দোবস্তের মত, ইনডেঞ্চার লেবারের মত খেটে চলা। দিনে ক্লাস রাতে রিসর্চ।
ওদিকে দেশে চাকরির সম্ভাবনায় কোন আশার আলো নেই। হিজলিতে প্রফেসর ঘোষ রিটায়ার করার পর নতুন যিনি অর্গানিক কেমিস্ট্রির দায়িত্বে, তিনি সূর্যর চিঠির জবাবই দেন না।
পড়ানোর চাকরি দেশে ফিরলে পেয়ে যাবে, একথা ধরে বসে ছিল সূর্য। শ্রদ্ধা সম্মান, স্থিতু জীবন, এইসবের মোহ তার।