১৯৫৩
গঙ্গার ওপরে, প্রশস্ত স্ট্র্যান্ড রোডের ওপর ইম্পিরিয়াল পেন্টস অ্যান্ড কেমিকালস-এর আপিস। আটতলা বাড়িটা চৌকো আর লম্বা। উদ্ধত চেহারা। একটা কালো তেল-চুকচুকে চেহারার ইংরেজ আমলের খাঁচার মত লিফট সূর্যকে পৌঁছে দিয়েছিল প্রাইভেট লিমিটেড-এর সাততলায়। এই লিফটগুলোকে দেখলে অবাক লাগে আজকাল। পুলি আর চাকার যৌথ ঘড়ঘড়ানি, মসৃণভাবে দশ-বারোটা লোক সমেত খাঁচাটাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে তিন তলা চার তলা আটতলায়। প্রযুক্তির যুগের অন্যতম বিস্ময় এই।
খুব মেঘ করেছিল আজ। বিকেলের দিকে বৈশাখের আকাশ ছেয়ে এসেছিল কালো মেঘে। কালবৈশাখীর পূর্বাভাস। সূর্য গিয়েছিল অবিনাশদার আপিসে। পরিচিতর চেয়ে কিছু বেশি, আপন তুতো দাদার চেয়ে কিছু কম। অনাত্মীয় হয়েও আত্মীয়। কেমিস্ট্রির প্রাক্তন ছাত্র।
অবিনাশের আপিস খুব চমৎকার জায়গায়। সাততলার গঙ্গামুখী দিকটায় এ-দেওয়াল থেকে ও-দেওয়াল কাচ দিয়ে ঢাকা জানালা। এখনকার এই অতি আধুনিক বহুতলগুলো বেশ করেছে। কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে। ব্রিটিশ চলে গেছে, তার ফেলে যাওয়া শহরটায় নতুন যা কিছু তার শান আলাদা। রং আলাদা। অবিনাশ তার ঘুরন চেয়ারে বসে, কাচ ঢাকা মস্ত সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সামনে, কালো মোটা টেলিফোনে কার সঙ্গে জানি কথা বলছিল, আর সূর্য দাঁড়িয়ে ছিল জানালার দিকে মুখ করে। ডান দিক গঙ্গা, বাঁ-দিকে ময়দান, ওই দেখা যায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। গঙ্গার ওপরে ছেয়ে যাওয়া কালো মেঘের জটাজাল দেখে তার বুকের ভেতর দ্রিমি দ্রিমি করে বাজনা বাজছিল আজ।
ঝড় কিন্তু হল না, উল্টে খানিক বাদেই মেঘের অনেকগুলো স্তরের ভেতর থেকে হঠাৎ ফুটে বেরুল সূর্যের ছটা। একেবারেই নাটকীয় ভঙ্গিতে সেই আলো নেমে আসা মাত্র যেন ইন্দ্রজাল ঘটে গেল। গোটা কলকাতার রূপ ফেটে পড়ল। কনে দেখা আলো! কথাটা সবার শোনা কিন্তু আজ হাতেনাতে প্রমাণ। বিকেলের এই অস্তরাগ যখন মেঘ ফেটে বের হয়, যার ওপর পড়ে, সত্যিই তাকে অপরূপ রূপে অভিষিক্ত করে তোলে। এই যে কলকাতাটাকে এক ঝলক দেখল সূর্য, আবারো এ শহরটার প্রেমে পড়ে গেল প্রচণ্ডভাবে।
আর তৎক্ষণাৎ সূর্যর ভীষণ আপশোস হল। সে যদি খুব বড়লোক হত, আর তার থাকত একটা ক্যামেরা। খচ খচ করে এ সৌন্দর্যকে সে বন্দি করে নিত ফিল্মের স্ট্রিপে। ক্যামেরা একটা বিপ্লব, যদিও এখনো কজন ভারতীয়ই বা এ শখের জিনিসটি কেনার মত মুরোদ রাখে।
প্রেমেন জেঠু, প্রেমেন মিত্তির একটা ছোটদের গল্প লিখেছেন কাগজে। রূপকথার রাজকুমার আর গল্পের নায়কের দেখা হয়ে গেছে তেপান্তরের কিনারে। গল্পের হিরো এ যুগের ছেলে। কিশোরের হাতে আছে ক্যামেরা। রাজপুত্র তাই দেখে হাঁ। জন্মে সে এ জিনিস দেখেনি।
প্রেমেন জেঠু নিজে কিনা চিত্রপরিচালক, তাইতে ক্যামেরার মহিমা জানেন। কে জানে কবে নিজের পায়ে দাঁড়াবে সূর্য, কবে পাবে চাকরিবাকরি একটা চলনসই। ভিখিরির ছেলের মত ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখটাকার স্বপ্ন দেখার মত এখনো তার কাছে ভবিষ্যতের সবটাই স্বপ্ন। কোন প্রত্যাশা পায় না, নিরাশার অন্ধকার অনেকটা ওই মেঘের চাদরের মতই তাকে ঘিরে ফেলে মাঝে মাঝেই। কোথায় কীভাবে মেঘ ছ্যাঁদা হবে, দেখা যাবে আশার আলো, তাই ভাবে।
এ মুহূর্তে এও লক্ষ করল সূর্য, যে নিজের সওদাগরি আপিসের কাজে ব্যস্ত অবিনাশদা একবারের জন্যেও মুখ তুলে এই মেঘের শোভা আর এই মেঘছেঁড়া আলোর অপরূপ বৈভব লক্ষ করলেন না। তবে কি জীবনে সফল হওয়া মানে এই-ই, একটা বড় বাড়িতে চাকরি, টেবিলে দু-দুখানা টেলিফোন যন্ত্র... অথচ প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগের মন বা ফুরসত কোনটাই না থাকা? তবে তা কেমন সাফল্য? অনেকগুলো টাকা রোজগারের ধান্ধায় খেটে মরা শুধু?
মনটা আরো দ্বিধাদীর্ণ হয়ে যায় সূর্যের। আজই অবিনাশদা তার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন একটা কথা। যদি বড় কিছু করতে হয় জীবনে, তবে বিদেশ যেতেই হবে। বিজ্ঞান প্রযুক্তি গবেষণা নিয়ে বেশিদূর যাওয়া এ বাংলায়, এ ভারতে বসে সম্ভব না। সদ্য স্বাধীন ভারত। ছ'-বছর হল। এখনো সদ্যোজাত শিশুর মত, নড়বড়ে। তাই... অবিনাশদা নিজে গ্রেট ব্রিটেনে কয়েক মাস কাজ করে এসেই এই ব্রিটিশ সওদাগরি কম্পানিতে মোটা মাইনের চাকরি পেলেন। রসায়নের গবেষণায় ওসব দেশে অনেক নতুন কাজ হচ্ছে। রবার, পলিপ্রপিলিন নামে একটা নতুন জিনিস নিয়ে গবেষণা করে এসেছে অবিনাশদা। গবেষণা আর নতুন নতুন প্রডাক্ট আবিষ্কারের কাজ। সত্যি বলতে তাকে বেশ ঘাবড়ে দিয়েই অবিনাশদা চোখ মটকে বলেছিলেন--আয় সূর্য তোকে আমাদের একটা প্রডাক্ট দেখাই।
তারপর ড্রয়ার থেকে সযত্নে ও সংগোপনে বার করে দিয়েছিলেন একটি প্যাকেট।
ভদ্রসমাজে এ জিনিস কোন বঙ্গসন্তান একে অন্যকে দেখায় না। অবিনাশদা খুক খুক করে কেশে বলেছিলেন, আমরা এটা বানাই রে। কোয়ালিটি গ্রেট ব্রিটেনে তৈরি জিনিসের সমতুল্য, বিদেশি কোম্পানি ছাড়া এ দেশে কারুর এই কোয়ালিটির জিনিসের নো হাউ নেই। ভারতের মত বহু কোটি জনসংখ্যার দেশে কদিন পরেই দরকার হবে এ জিনিস অনেক অনেক। তুই লজ্জা পাস না। জানি বিয়ে করিস নি। তবু আমার তরফ থেকে এক প্যাকেট গিফট রইল। কমপ্লিমেন্টারি স্যাম্পল।
সন্তর্পণে রুমালে মুড়িয়ে পকেটে ঢোকায় সূর্য। তার ফর্সা কান লাল হয়ে গিয়েছে। রবারের অন্যতম ব্যবহার এই এক। নব্য সমাজে ক্রমশ জনপ্রিয়ও হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে বাত্তিওয়ালা, মানে আলোকপ্রাপ্ত পুরুষনারীদের জগতে। দুর্জনে, মানে নৈতিকতার ধ্বজাধারীরা বলে, এসব খোদার ওপর খোদকারির ফলেই সমাজের অধঃপাতে যাবার আর দেরি নেই। সন্তানজন্মই নাকি পুরুষনারীর দেহমিলনের একমাত্র সঠিক পরিণাম আর মানুষ সেটাকেই ফুৎকারে উড়িয়ে নিজে ঠিক করছে সে সন্তান চায় কি চায় না।
ফ্যামিলি প্ল্যানিং, এই শব্দটা পঞ্চাশের দশকে নতুন উদয় হয়েছে বটে... আগের মত আটটা নটা ছেলেপিলে গর্ভে ধরতে কেউ আর চাইবে না। ভালই তো এই নতুন বিধান, নতুন বন্দোবস্ত। নইলে তো সূর্যের মত অভাগা আরো কয়েকটা জন্মাত। যাকে বড়দার ঠিক দেড় বছরের মাথায় জন্মানোর জন্য আজ শিকড়বিচ্ছিন্ন হয়ে দিদিমার কাছে মানুষ হতে হয়েছে। তাকে স্তন্য দিতে পারেনি রুগ্না রক্তহীনা গর্ভধারিণী মা। কোলে তুলে নিয়েছেন শক্তসমর্থ মাতৃসমা দিদিমা। হয়ত অভাগা সে। আবার হয়ত এরই ফলে, তার আসলে ভাগ্য খুলে গেছে, কে জানে। তবু এই চক্ষু ফোটার আগে আগেই তার হাতবদল, সূর্যর মনে হয়, জীবনের এক বিশাল ঘটনা। যার ওপরে তার কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না বলেই, ভাবলে খুব অসহায় লাগে। জীবন বড় জটিল।
অবিনাশদার মত কি শেষে কন্ডোম উৎপাদক কম্পানিতে নটা ছটার চাকরি পাবে সূর্য? আপাতত সে কিচ্ছু জানে না। এটুকু জানে, এই দীর্ঘ লেখাপড়ার সুড়ঙ্গের শেষে আলোর খোঁজে চলেছে সে। বিদেশ যাবে ভাবছে। এখনো জানে না, জাহাজভাড়া দেবে কে? বড়লোক শ্বশুরের পয়সায় উনবিংশ শতকে ছেলেরা বিদেশ যেত লেখাপড়া করতে। আজকাল আর সেইভাবে নিজেকে বেচে বিদেশ যায় না কেউ।
বাবা কি দেবেন টাকা? বাবার নিজেরই যা অবস্থা! দাদু অসুস্থ। প্রৌঢ়।
অবিনাশের দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে একটি চনমনে চেহারার যুবক। বয়স হয়ত বা সূর্যেরই মত। ভীষণ তুখোড়, মুখে চওড়া হাসি।
আরে এসো এসো তিমির এসো।
অবিনাশ উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপার থেকে তিমিরের সঙ্গে হ্যান্ড শেক করে। তারপর সূর্যকে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলে--এই তিমির হল আমাদের কম্পানির কর্মাশিয়াল ডিরেক্টর। কেমিক্যাল কম্পানিতে কিন্তু কেমিস্টের থেকে ওর কদর বেশি। ওদের ডিপার্টমেন্ট পুরো বিজ্ঞাপনের দপ্তরটা দেখে।
বিজ্ঞাপন? মানে এই যে সব হোর্ডিং দেখি ...
হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই দেখুন চৌরঙ্গি মোড়ের একটা হোর্ডিং, এখান থেকেও আবছা দেখা যাচ্ছে। হা হা, স্ট্র্যাটেজিক লোকেশন ওটা, প্রচুর দাম দিয়ে রিটেনারশিপ নিতে হয়েছে।
আচ্ছা! প্রায় কিছুই না বুঝে, ভ্যাবলার মত হাসে সূর্য।
অবিনাশদা বলে, বুয়েচ ভায়া, এই জগতটা একদম আলাদা। আমাদের কম্পানির অ্যানুয়াল স্টেটমেন্ট দেখবে, কেমিক্যাল কাঁচামালের পেছনে যা খরচ তাচ্চে বিজ্ঞাপনের পেছনে খরচা অনেক বেশি। ভুলে যেও না, এটা বিজ্ঞাপনের যুগ। পহলে দর্শনধারী বাদ মে গুণবিচারী।
সূর্য নতুন করে অবাক হয়। তারপর ভাবে, অবাক হবার কীই বা আছে। আজকাল তো রাস্তায় বেরলেই বিশাল বিশাল হোর্ডিং চোখে এসে লাগে। এত ছবি, এত শব্দ সর্ব ইন্দ্রিয়ের ওপর ঝাঁপায় যে কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবে বুঝেই পায় না লোকে।
তিমির কাজের কথা বলে চলে যায়। অবিনাশ বলে, চলো তোমার সঙ্গে বেরুই। আজ নিউ মার্কেটের পেছনে রয়াল বলে ওই দর্জির দোকানটা দেখিয়ে দেব। পুরো সাহেবদের কাটের জামাকাপড় যদি চাও, ওই আলির দোকানে যেতেই হবে। ধুতি পাঞ্জাবি পরে ভিসার ইন্টারভিউ দিতে যাবে না নিশ্চয়ই তুমি?
গ্যালিস দেওয়া ফুল শার্ট আর প্লিটেড প্যান্ট পরে আছে অবিনাশদা। ওরকম প্যান্ট শার্ট অঙ্গে না উঠলে জীবনে পরের ধাপে পৌঁছনো যাবে না। যাবে কি?
বিজ্ঞাপনই এখন সব। নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে বিক্রয় করতে পারা না-পারা তার পুঁথিগত বিদ্যার চেয়েও আজ বেশি দরকারি। বুকের ভেতরের হাওয়া চুপসে গেলেও, আপাতদৃষ্টিতে আত্মবিশ্বাসী ভাবটা জাগিয়ে রাখে সূর্য। ঢোলা শার্ট আর ধুতি পরা হেমন্তকুমারকে মানাতে পারে, তার বোধ হয় আর চলে না।
আমেরিকা যাবার জন্য ভিসা নিতে যেতে হবে একদিন। যদিও যাওয়া হবে কি না জানা নেই। বিজ্ঞাপন না, আপাতত বিজ্ঞানেই তার মন। সেই যে কবে ক্লাস টেনের বইতে পড়েছিল কার্বন শৃঙ্খলের গল্প, জেনেছিল, আশ্চর্য ও অলৌকিক সেই শৃঙ্খল দিয়ে বাঁধা আছে আমাদের প্রকৃতিজগত, আমাদের অস্তিত্বের মূলে সবকিছুতেই আছে কার্বন... সেই থেকে অরগ্যানিক কেমিস্ট্রির প্রতি সূর্যর টান। বহরমপুরে বি এসসি-তে রসায়ন নেবার সময়ে কাচের শিশি-বোতল- বিকার, কটু রাসায়নিকের ঝাঁঝ, নানা তরল মেশাবার উত্তেজনা তার শিরায় শিরায় প্রবেশ করেছে, আর এম এসসি-তে কলকাতায় পড়তে এসে তো সে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলল যে কাজ যা করবে তা জৈব রসায়ন বা অর্গ্যানিক কেমিস্ট্রি নিয়েই। আপাতত অশ্বগন্ধার শিকড় নিয়ে কাজটা করার জন্য লড়াই চলছে। ইতিমধ্যে জীবনের নানা ওঠাপড়া, ঘাত প্রতিঘাতের ভেতর ধাক্কা খেতে খেতে সে এক অজানিত ভবিষ্যতের সামনে থমকে দাঁড়িয়েছে।
ধবধবে মর্মরে গাঁথা ভিক্টোরিয়া আলোতে জ্বলজ্বল করছে আর তার পাশেই মরকত মণির মত সবুজ ময়দানটি। এই শহর তার নিজের নয়, তবু সূর্য এই শহরকে এখন বড় ভালবেসে ফেলেছে। নিজের নয়, ভাবছেই বা কেন সে। তার জন্মদাতা পিতা শ্রীপুর খুলনা থেকে এসে এখানেই ডেরাডান্ডা বেঁধেছেন তো। বাবা আর কাকা। কেরানির চাকরি, ভবানীপুর নামে দক্ষিণ কলকাতার এক বর্ধিষ্ণু অঞ্চলে বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস, কাছেই অল্প একটু জমি কিনে বড় রাস্তার ওপরেই বাড়ি তৈরি, তার জন্য বাজারে অনেক দেনা... সব মিলিয়ে বাবা তো এখন খাস কলকাতার লোক। সব জেনেও বার বার সূর্য বলে নিজেকে, আমি কলকাতার ছেলে নই। তার শৈশব টাকিতে আর কৈশোর বহরমপুরে কেটেছে। সে বি এসসি পড়েছে বহরমপুর কলেজে। কলকাতা তার কাছে মস্ত শহর, রাজধানী, তার গমক ঝমক আলাদা। কিন্তু আপন নয় এখনো। প্রিয় নয়। প্রিয় হতে হয়ত আরো কয়েকবছর লেগে যাবে। দাদুও বাড়ি কিনেছেন এখানে। দিদিমা, যাকে সে মা বলে ডাকে, বলেন দাদুর কোন বৈষয়িক বুদ্ধি নেই নাকি। সারাক্ষণ যা ঝাঁঝাল মন্তব্যে দিদিমা দাদুকে অভিষিক্ত করেন, আর কহতব্য না।
সূর্য ব্রত নিয়েছে, দাদুকে বৈষয়িক ব্যাপারে সাহায্য করবে সে। দাদুর বাড়ির এক তলা ভাড়া দিয়েছেন দাদু। জুটেছে এক খিটকেল, অতি শয়তান ভাড়াটে। প্রতি মাসে ভাড়া আদায় করতে প্রাণান্ত। ওপরে ঘরগুলিতে সূর্য এখন থাকে কলকাতায় এলে।
কলকাতার এদিকে-ওদিকে ঘুরে, প্রিয়, প্রার্থিত মানুষের সঙ্গ করতে করতে শেষ পর্যন্ত কলকাতার এ প্রান্তটাকে সে ভালই বেসে ফেলেছে। বকুলবাগান, বেলতলা ... আহা নামগুলোই কেমন মধুঝরা। বীথির মত দুদিকে গাছে গাছে ঢাকা এইসব রাস্তা। বকুল শুধু কেন। এ পথে আছে আম, শিরীষ, ছাতিম, কদম গাছ অনেক। ছায়াচ্ছন্ন পথে গ্রীষ্মের দুপুরেও জড়িয়ে থাকে অভিজাত পাড়ার মায়া।
তবে সূর্যর মত আরো হাজার হাজার তরুণের কাছেই মফস্বলের বর্ধিষ্ণু টাউন ছেড়ে কলকাতায় আসা কেবলই উচ্চ শিক্ষার জন্য অথবা ভাগ্যান্বেষণে।
আর তাদের মধ্যে কোটিকে গুটিক দেখাও দিকি, যাদের মোহিনী পাকে বেঁধে ফেলেনি এই মনুমেন্টের শহরখানা? যাকে যাদুঘরের শহরটা যাদু করেনি? ভানুমতীর খেল দেখায়নি? বলেনি, এসো ভায়া এসো, আমার গঙ্গার পাড়ে বসে ক্ষণেক জুড়িয়ে নাও নিজেকে, এমন মিঠে হাওয়া সারা পৃথিবীর কোথাও নেই।
২
অক্টারলোনি মনুমেন্টের এলাকাটার নাম ধর্মতলা। যেন কলকাতার নাড়ী। সব ধুকপুকুনির কেন্দ্র। ময়দান নামের একটা বিশাল ফুসফুস আছে কলকাতার, সবাই জানে। গঙ্গার হাওয়া সে সবুজ ঘাসের মাঠকে বীজন করে, সজল রাখে। তবে মনুমেন্টের তলার জমিতে ঘাস নেই। কেননা শুকনো জমিতে হাজার মানুষের পদপাত। লালচে ধুলোর মাঠ। এখানে মানুষ এসেছে হাজারো কাজে। মূল কাজ এদিক-ওদিক যাবার পথে গাড়ি বদল। বাসে বা ট্রামে ওঠা। তাছাড়া আছে নানা রকমের প্রতিবাদের ব্যাপারস্যাপার। যত্তো মিছিল করা, মিটিংএ যোগ দেওয়া সব এই এসপ্ল্যানেডে। বিদেশের সব বিখ্যাত শহরের প্লাজা বা এস্প্ল্যানেডের আদলে কলকাতাকেও সাহেবরা গড়ে তুলতে চেয়েছে এরকম একটা চমৎকার এসপ্ল্যানেড দিয়েই। এ পাড়ায় কাজের লোকে যে কাজেই আসুক, অকেজো ভিখিরি ভবঘুরে টুরিস্ট আর বেকারের সংখ্যাও নগণ্য নয় এখানে। হাত ঘোরাতে জানলে বাতাস থেকেও নাকি টাকা বানানো যায়। নানা কাজের অছিলায় দুটো পয়সা উপায় করা যায় এই পাড়ায়। তাছাড়া আছে নানা খুচরো মজা। রানি ভিক্টোরিয়ার মন্দির দর্শন, ঘোড়ার গাড়ি চেপে হাওয়া খাওয়া, গঙ্গার ধারে যাওয়া। বেলুন কিনে বাচ্চার হাতে দেওয়া। পাঁচ পয়সার বরফকাঠি মুখে দিয়ে চুষতে চুষতে ধুলো পায়ে হাঁটা ময়দানের কানাত ধরে।
তারপরেও ধুলো উড়বে না? অক্টারলোনি মনুমেন্টের তলায় শনি রবিবারের মেলায় কত লোক। কত রকম খেলা। খিলোনা। এখানে ছুটির দিনে মানুষ আসবে আর নানা নাচ দেখবে। কখনো মানুষের নাচ কখনো বাঁদরের নাচ। মাঝে মাঝেই খেলা দেখাবে "ভানুমতী কা খেললল..." বলে হাঁক দেওয়া লোক। ছোট মেয়েকে চাপিয়ে দেবে সরু দড়ির মাথায়। হাতে বাঁশের সরু লাঠি নিয়ে হেঁটে যাবে সে মেয়ে, দড়িতে পায়ের দু আঙুল জড়িয়ে জড়িয়ে। বুড়ো আঙুল টাটিয়ে উঠবে। দু আঙুলের মাঝের হাজা ঝনঝন করে জানান দেবে। তবু হাঁটবে। পেটের দায়। হাওয়া থেকে ছুঁয়েছেনে দু পয়সা আনতে হবে যে। নইলে ভুখা মরতে হবে।
খেল দেখাবে গাঁট কাটার দল। পকেটমারের দল। কলকাতার বাইরের লোক দেখলেই তারা চিনতে পারে, সঙ্গে সঙ্গে কাছে ঘেঁষে আসে। আপনি হয়ত অক্টারলোনি মনুমেন্টের পদতলে হাওয়া খেতে এসে চার আনার বাদামভাজা নিয়ে মশগুল, হাঁ করে ওপরে তাকিয়ে দেখছেন জান লড়ানো ঘুড়ির ভোকাট্টাবাজি। এদিকে পাশ দিয়ে হাওয়া হয়ে গেল আপনার টাকার ব্যাগটি। আপনাকে হালকা করে দিল সুচতুর হাতসাফাইয়ে গাঁটকাটা পকেটমার। রোগা পাতলা এই পকেটমার ছেলেটা কিন্তু। মুখটা তার বড্ড করুণ। চোখের তলা টেনে ধরলে দেখবে রক্ত নেই শরীরে। খুব চেপে ধরলে মায়ের অসুখ, বাবা পঙ্গু এমন কোন গল্প বেরিয়ে আসবে, আসবেই।
মাঝে মাঝে পিটুনি খায়। ধরা পড়ে গেলেই। সব লোক মিলে হাতের সুখ করে। গু গোবর মাড়ানো চটি দিয়ে পেটায়। লোকে বলে সবচেয়ে বেশি যে লোকগুলো হামলে পড়ে পেটায় তারা আসলে পকেটমারের দলেরই লোক। নাটক করে, বেশি বেশি আওয়াজ করে মারে। আগলে রাখে, যাতে অন্যেরা না বেশি হাতের সুখ করতে পারে। আর পকেটমারটা ভাণ করে মরে যাবার। অজ্ঞান হয়ে যাবার... একটু মার খেয়েই হেদিয়ে পড়ে যায় মাটিতে লুটিয়ে। সব নাটক। তাছাড়া পকেটমারের কাছে চোরাই মাল কখনো থাকে না। চোরাই মাল ততক্ষণে দলের লোকের হাতে হাতে হয়ে গেছে পগার পার। অন্য কোন জানগুরুর কাছে পৌঁছে গেছে। কাজেই পকেটমার ধরলেও কোন সুরাহা হবে না, পুলিশে দিলেও লাভ নেই। কিচ্ছু ফেরত পাওয়া যাবে না। প্রমাণ লোপাট হয়ে যাবে।
এই সবের মধ্যে প্রচুর ধুলো ওড়াউড়ি করে। মস্ত লাল বাড়িটা, ময়দান থেকে অনতিদূরেই। সে বাড়ির চৌহদ্দিতে ঠিক হয় কলকাতার কোন রাস্তা এখন কাটাকাটি হবে, কোন নর্দমায় মেথর নামাতে হবে, ময়লা বালতি করে করে তুলে আনতে হবে... বর্ষায় কোথায় জল জমতে পারে। ও বাড়ির পেটেই নাকি আছে সায়েবদের বানানো কলকাতার নকশা। যে নকশা আর খুঁজেই পাওয়া যায় না। সারা কলকাতার পেটের তলার জালিকাকার নালীপথ... যা গিয়ে পড়েছে মা গঙ্গার বুকে, সেই পুরোটা ছকে দেওয়া আছে সে নকশায়। তবু বছর বছরই কলকাতার এই সব রাস্তার, এইসব নালা নর্দমার হাল হকিকত দেখা হবে, গুচ্ছ গুচ্ছ টাকা স্যাংশন করানো হবে। শহরটাকে একটু বাসযোগ্য করতে। শুধু মানুষের সংখ্যাই তো কতগুণ যে বেড়ে চলেছে এ শহরে। দেশভাগের পর দেশে আছড়ে পড়েছে উদবাস্তুরা। সাতচল্লিশ থেকে এই তিপ্পান্ন-চুয়ান্নর মধ্যে ফুলে ফেঁপে উঠেছে জনসংখ্যা। পোয়াতি মেয়ের গর্ভের মত। এ দেশ তো এখনো ভাল করে ফ্যামিলি প্ল্যানিংও শেখেনি। ওদিকে সচ্ছিদ্র সীমা দিয়ে আসছে ও বাংলার মানুষ।
তো, ওই লাল ধুলো উড়তে থাকা ময়দানে বেশি ভিড় হলে, লালবাড়ির থেকেই ভিস্তিওয়ালা পাঠানো হয়। মাইনে করা ভিস্তিওয়ালারা আসে। কবে থেকে ইংরেজরা ভিস্তিওয়ালার পোস্ট তৈরি করেছিল কে জানে বাবা। তবে আজও তারা আছে। মাঠের ধুলোতে হেই হেই করে দৌড়াতে দৌড়াতে যায় ঘোড়ার মত। কাঁধে চর্ম থলি, থলিতে ভরা জল। বাদামি চামড়ার থলির সরু মুখ থেকে হাতের অনবদ্য এক কায়দায় তারা জল ছেটায়। ওই কায়দাটা না জানলে আর জল ছেটাতে ওদের ডাকা কেন।
এই ভিস্তিওয়ালারা ওই লাল টুকটুকে ইটে গাঁথা সায়েবদের তৈরি করপোরেশনের টানা বারান্দা দেওয়া বাড়িগুলোতেও কাজে লাগে। খসখস ভেজানোর কাজ।
অবশ্য, ইদানীং তাদের এদিকটায় ভিস্তিওয়ালার পোস্টে লোক নেই অনেকদিন। খসখসের পর্দাগুলো অমনি ধুলো খাচ্ছে। নিয়মিত ওঠানো, নামানো, দড়িতে টান টান করে গুটিয়ে তোলা, সব তো দরকার। আরো দরকার গ্রীষ্মের দিনে জল ছেটানো।
ওই যে দেখা যাচ্ছে অজিতকে। অজিত এই আপিসে ফাইনান্সে কাজ করছে এই ক'বছর। তার এখন "গ্রুপ এ" চাকরি। বিরাট পদ। মস্ত ঘর। বিশাল চামড়াবাঁধানো চেয়ার। বড় বড় জানালা, জানালার মধ্য দিয়ে আসে গঙ্গার মিষ্টি হাওয়া। জানালা থেকে ঝুলছে বড় বড় খসের পর্দা। গোটা বাড়িটাই এই সেদিন চলে যাওয়া ইংরেজদের স্মৃতিবাহী। শুধু ওই ভিস্তিওয়ালারা এসে জল ছেটায় না এই যা। মাঝে মাঝে ক্লার্ক রমাকান্ত এসে পিয়ন সুদাসকে হুকুম করে। এই, দে না বাবা ভিজিয়ে, খসের পর্দাটা। আহা, ভেজালে, সেই ইংরেজ আমলের স্মৃতির মতই মৃদু সুন্দর ঘুম ঘুম খসখসের গন্ধ এসে ঝাঁপাবে। অফিসার থেকে কেরানি, দ্বিপ্রাহরিক আহারের পর, পান চিবোবে যখন। তাদের অলস সুখের সঙ্গে মিলেমিশে যাবে ঘ্রাণেন্দ্রিয় দিয়ে আসা খসখসের গন্ধটা আর স্পর্শেন্দ্রিয়ে এসে লাগবে শীকরশীতল বাতাস। তবে না আরাম, তবে না মজা। ঘুম এসে যাবে চোখে, তবে কলম ঠেকিয়ে রাখা হবে সঠিক লাইনে, হিসেবের পাতায়। বড়বাবু মেজো বাবুরা মাথা ঝুঁকিয়ে, চশমা ঝুলিয়ে বসে থাকবে, তার ওপরের বড় মেজো সায়েবরা এসে সামান্য ধাক্কা দিলেই, বিড় বিড় করে উঠবে, হিসেবের পাখিপড়া বুলি, তিনে কত্তি তিন...
অজিত এইসব জানেন। তিনি পরশুরাম পড়েছেন। বাহান্ন বছর বয়সে প্রথম লেখার কলম ধরেই মানুষটা বাঙালির নাড়ি টেপা অব্যর্থ বিষবৈদ্য। শহরের বিষ ঝেড়ে দেবেন। কজ্জলীর আলো যত, কালিমাও আছে। তবু রসে টইটুম্বুর সে লেখা।
অফিসের বাবুদের দাপট সহ্য করতে গেলে যে ধাতুতে গড়া হতে হয় অজিত তার উল্টো ধাতুর লোক। সটান সোজা পিঠ, পিঠে একটা গোটা শিরদাঁড়া। কারুকে তোয়াক্কা নেই।
রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময়ে অজিতকে দেখতে লোকে ঘুরে ঘুরে তাকাবে। কালো, তৈলচিক্কণ চুলে ব্যাকব্রাশ। কালো, মাছি পিছলে পড়া মুখে শক্তি আর সামর্থ্যের সঙ্গে বুদ্ধির মিশেল। চোয়াল শক্ত। ক্ষুরধার বুদ্ধি আর অসম্ভব ভাল স্মৃতিশক্তি অজিতের আস্তিনে লুকনো দুটি তাস।
শার্ট প্যান্ট কোট পরা লোক পঞ্চাশ দশকের কলকেতায় পথে ঘাটে চলতে এক আধটা চোখে পড়বেই। অধিকাংশ ধুতি বা হাফ হাতা সাদা মিলের কাপড়ের শার্ট পরা, ধুতিপরা লোক। "খাদি খদ্দরে"র জমানা যায়নি, অনেক দেশপ্রেমী পরিবারই খদ্দর পরে। তবে সাধারণ্যে এখন মিলের কাপড়ের কদর বেশ। কলকাতার আশপাশে আর গুজরাত মুম্বইয়ের দিকে অনেক মিল গড়ে উঠেচে। সেসব মিল থেকে থান আসছে, আর সস্তা কাপড় মুসলমান মিয়াঁ দর্জির হাতে হাতে কাটিং হয়ে শার্ট হচ্ছে। শার্টের বাইরে পকেট, ভেতরেও গোপন পকেট। মাইনের সাড়ে চোদ্দ টাকাটা যাতে পকেটমারের হাতে মারা না পড়ে সেই ব্যবস্থাই হচ্ছে আর কি।
বাঙালি যেন দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একদল খদ্দর খদ্দর, অন্যদল পেন্টুলুন পেন্টুলুন। অজিত বাড়িতে আদুল গায়ে ধুতি পরে থাকে আর ধুতির খুঁট জড়ায় গায়ে। কিন্তু বাইরের জগতে পেন্টুলুনে তার কোন আড়ষ্টতাই নেই। উঠতি জমানার উঠন্তি পত্তনের মানুষ সে।
অফিসের শেষে আজ রাস্তায় নামল অজিত। মাত্র কয়েক বছরই হল চাকরি তার। প্রথম দু বছর শিমলাতে ট্রেনিং। তারপর প্রথম পোস্টিং রাঁচিতে ডেপুটির পোস্টিং। মস্ত বাংলো পেয়েছিল বলে বাবা মাকে নিয়ে ঘুরিয়ে এনেছিল সেখানে। রাঁচিতে থাকতে থাকতেই অজিতের বিয়ের সম্বন্ধ আসে। আমেদাবাদে তাদের এক পিসির স্বামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তাঁরই এক প্রবাসী বাঙালি সহকর্মীর মেয়ের সঙ্গে সম্বন্ধ। বিয়েও হয়ে যায় তার পর পরই। সুরঙ্গমা ফুটফুটে সুন্দরী। ভাল গান জানে। ডাকনাম তার, সাহেবি কায়দায়, ডলি।
এইবার বাড়ির দিক থেকেও চাপ তৈরি হয়। বউসহ তার কলকাতায় পোস্টিং নেওয়াই বাঞ্ছনীয়। বাবা মায়ের সঙ্গে তাদের রাজাবাজারের বাসাবাড়িতে সস্ত্রীক ঘর পাতল অজিত।
অফিসের সায়েবদের সবার নামে নামে গাড়ি পাওয়া যায় আরো উচ্চপদে উঠলে। আপাতত অজিতের পুল-কার আছে। সাদা রং করা পেটমোটা অ্যাম্বাসাডর গাড়ি। তাতে সাদা তোয়ালে পাতা থাকে। জানালায় সাদা লেসের পর্দা স্প্রিং দিয়ে লাগানো। দুজন আরো কলিগের সঙ্গে সেটায় চাপে সে। সেই গাড়ি আজ নেবে না অজিত। গিন্নির হুকুমে আজ কিছু জিনিস কিনবে হগের বাজার থেকে। তার কর্পোরেশন আপিসের পেছনের গেট দিয়ে বেরুলেই হগের বাজার। চুলের ফিতে থেকে
সায়ার লেস, এমনকি মেমসাহেবদের মত বব কাট উইগ, বা কায়দা করা বুফা খোঁপার ভেতরে পুরে দেওয়ার জন্য নকল চুল, সবটাই পাওয়া যায় এক ছাতের তলায়। তার আমেদাবাদে বড় হওয়া, অসামান্য গজল গাইয়ে, নার্গিসের মত ফুটফুটে গৃহিণীটির এসব কেতাদুরস্ত জিনিস ভারি পছন্দের। শৌখিন মানুষের জন্য আস্ত একটা স্বর্গরাজ্য পাতা চমৎকার একটা মার্কেট। তেকোনা ঢালু ছাতের তলায় জালের মত বেছানো। সুরঙ্গমাকে নিয়ে এখানে আসেন প্রায়ই অজিত, হলুদ ট্যাক্সিতে চড়ে। আজ হুকুম হয়েছে আগের দিনের কিনে নিয়ে যাওয়া কাপড়ের অনুরূপ কাপড় আরো খানিকটা কিনে নিয়ে যাবার। থান থেকে কেটে নেওয়া ফুল ছাপ মিলের ছিটকাপড়। বম্বেমার্কা জিনিস।
দ্রুত পা চালিয়ে হগের বাজারের কাজটা শেষ করলেন অজিত। তারপর চৌরঙ্গির দিকটায় গেলেন। গ্রান্ড হোটেলের পাশ দিয়ে হাঁটতে অপূর্ব লাগে। প্রশস্ত চৌরঙ্গি যেন যে কোন বিদেশি শহরের সংগে টেক্কা দেবে। আরেকটু হাঁটলেই ওদিকে টলটলে আয়নার মত পুষ্করিণী। হিন্দিতে বলে তড়াগ। এ অঞ্চলে বাদামভাজা বিক্রি করে যারা, অথবা সরু মোড়ার ওপর লাল সালু ঢাকা ফুচকার ঝুড়ি নিয়ে বসে, তারা সব বিহার থেকে এসেছে, ওরা ওই তড়াগের আশপাশে জটলা করা মানুষদের জন্যই পসরা সাজায় রোজ। শান্ত জলের পাশে সাদা রেলিং। তার পেছনেই মনুমেন্ট। ধর্মতলার মোড়।
ও পারটা যদি সাধারণের তো এপারটা অভিজাতের, টাকাওয়ালাদের। আগে ছিল সাহেবদের। চলে যাবার পর ঝড়তি পড়তি অনেক সাহেব রয়ে গেছে, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান নামের একটি মিশ্র প্রজাতির সাহেবমেম কম নেই। এঁদের অনেকের গাত্রবর্ণ ভারতীয়ের কিন্তু চোগাচাপকান ইংরেজদের। বর্ণসংকর হলেও এ পাড়ার এঁরাই জান। চৌরঙ্গির আর্কেডে অজস্র সুসজ্জিত দোকান। লম্বা লম্বা পা ফেলে অজিত হাঁটতে লাগলেন। কাতারে কাতারে লোক অফিস ফেরতা চলেছে। হেঁটে ধর্মতলা গিয়ে বাস ধরবে। গত দশ বছরে অস্বাভাবিক জনস্রোত এসে আছড়ে পড়েছে কলকাতায়। যে কোন টাউন প্ল্যানারের মাথায় বজ্রাঘাত ঘটাতে পারে এই ঘটনা। কত কিছু যে দরকার এ শহরটার, এ রাজ্যটার, তার ইয়ত্তা নেই। চাই ভাল পয়ঃপ্রণালী থেকে ম্যালেরিয়া রোগের চিকিৎসা। চাই বিজলি বাতি চাই জলের কল।
আরে অজিত যে!
হঠাৎ হাঁক শুনে চমকে তাকালেন অজিত। সামনে বিস্ফারিত চোখে হাসি মুখে তাঁর স্কুলজীবনের বন্ধু অবিনাশ দাঁড়িয়ে। সঙ্গে আরেকটি তরুণ। অবিনাশের গাত্রবর্ণ মিশমিশে কালো। মির্জাপুর রোডের মিত্র ইনস্টিটিউশনের নামজাদা ফরোয়ার্ড খেলোয়াড়। এখন সওদাগরি আপিসে কাজ করে। বেশ চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে। কয়েক মাস ব্রিটেন ঘুরে এসে কালোসাহেব হয়েছে বলে কথা। পোশাক ফিটফাট। সঙ্গের ছেলেটি যথেষ্ট গৌরবর্ণ। চশমা পরা, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। বয়স বেশ কিছুটা কমই হবে তাঁদের তুলনায়।
আরে ব্রাদার! করেছ কী! এতদিন গা ঢাকা দিয়ে ছিলে। কী খবর?
খবর আদান-প্রদান হল। বিয়ে করেছে আর কলকাতা কর্পোরেশনের বড় অফিসার শুনে আরো তম্বিতম্বা করল অবিনাশ। এত বড় চাকরি বাগালে, বিয়েও করে নিলে, আর আমাদের খাওয়ালে না! তুমি যে কিছু একটা করে দেখাবে, তা আমরা আগেই জানতাম। খুব খুশি হয়েছি কিন্তু এখন ছাড়াছাড়ি নেই। চলো অন্তত কোয়ালিটিতে বসে একটা চিকেন কাটলেট বা কাবাব খাওয়াও। আমরা ওদিকেই যাচ্ছিলাম।
অজিতের বর্তমান কর্মস্থলের খবর জেনে অবিনাশ উচ্ছ্বসিত। সঙ্গের ছেলেটির সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দিল। তার ইউনিভার্সিটির জুনিয়র, এও রসায়নের ছাত্র, ভবানীপুর অঞ্চলে থাকে এখন। নাম সূর্যশেখর। অর্গ্যানিক কেমিস্ট্রি নিয়ে হিজলিতে কাজ করছে। শিগগিরই পিএইচ ডি করবে। অশ্বগন্ধা শেকড়ের ভেতর থেকে ওষুধ বানাবে, রাসায়নিক ফর্মুলা আবিষ্কার করবে। বিদেশ যাবার চেষ্টা খুঁজছে। টাকার জোগাড় হলেই চলে যাবে।
ভারি চমৎকার এই সায়েবপাড়ার পথে ছড়ানো অভিজাত, দামি রেস্তোরাঁগুলো। সাড়ে তিনশো টাকা মাইনেতে ন মাসে ছ মাসে এমন রেস্তোরাঁতে ঢোকা কি আর যায় না? তবে উপযুক্ত সঙ্গী চাই। অজিত মনে মনে নোট করলেন, ডলিকে আর দুই বোন নীপুদীপুকে নিয়ে এখানে আসতে হবে।
কোয়ালিটি রেস্তোরাঁ দিল্লিতেও আছে। কনট প্লেসে। সেখানে খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল একবার ট্রেনিং ফেরত। কলকাতার কোয়ালিটি বছর কয়েক আগে খুলেছে। তুলতুলে নরম নান রুটি। মুর্গার কাবাব, জিভে দিলে গলে যায় হুঁ হুঁ বাবা, এর নাম মোগলাই খাবার। কলকাতার বেশি জায়গায় পাওয়া যায় না। পার্ক স্ট্রিটের গর্ব এই কোয়ালিটি। আর এক গর্ব চিনে রেস্তোরাঁ পিপিং। সেখানে নীপমঞ্জরী আর রূপমঞ্জরীকে নিয়ে একবার এসেছিলেন অজিত, সদ্য চাকরি পাওয়ার পর। স্প্রিং চিকেন নামে একটা এমন নতুন খাবার খেয়েছিলেন এখনো মুখে লেগে আছে।। মুর্গি মুসলমানের খাবার ছিল এই সেদিন অব্দি। সাবেকি হিঁদুর হেঁসেলে রাম পাখি ঢোকে না বিশেষ। তবে অজিত বাইরে বিস্তর খেয়েছেন। বাড়িতে মা এক আধবার বানিয়েছেন। তবে এসব রেস্তোরাঁয় এমনভাবে রান্না করা হয় সেই পাখি, মাংসের স্বাদ কোথায় যেতে পারে বলে বোঝান যায় না। ফাউল কাটলেট বল আর স্প্রিং চিকেন, অথবা এই কোয়ালিটির রেশমি কাবাব। অনবদ্য।
আজ তাঁরা গল্প করতে করতে কোয়ালিটিতে অনেকক্ষণ কাটালেন। মধ্যে কোয়ালিটির ফোন থেকেই বাড়িতে ফোন করে দিলেন ডলিকে। দেরি হলে চিন্তা না করতে। মা-ও চিন্তা করবেন অন্যথা। আজ তার সন্ধেটা বেশ কাটল। শুরু হল কফি দিয়ে শেষ হল বিখ্যাত পদ টুটিফ্রুটি দিয়ে। সরু লম্বা কাচের গেলাসে নানা ফলের টুকরো আর তার ওপর গোলাপি স্ট্রবেরি আইসক্রিম। সব শেষে একটা লাল টুকটুকে চেরির টুকরো বসানো। লম্বা চামচ দিয়ে খেতে হয় কোয়ালিটির এই বিখ্যাত টুটিফ্রুটি।
খেতে খেতে দেশের সমসাময়িক অবস্থা, রাজনীতি নিয়ে কথা হচ্ছিল। অবিনাশ বেশ টেরিয়ে দেখছিল তাকে। কেননা সে সরকারি চাকুরে। যাই বল আর তাই বল, নেহেরু সাহেব বিদেশি কোম্পানিদের সাদরে এ দেশে থাকতে দিয়েছেন বটে, তবু সরকারি চাকরি যারা করে তাদের ঠাটবাটই আলাদা, সম্ভ্রম অন্য মাত্রার। সূর্যও প্রায়ই শ্রদ্ধা বিস্ময় মেশানো চোখে অজিতকে দেখছিল। চুপচাপ হলেও সূর্যশেখর বেশ পড়ুয়া ছেলে। অজিত বা অবিনাশের মত চোখে মুখে কথা বলে না। বিজ্ঞানে তার জ্ঞান তো আছেই তা বাদের শুধু নিজের ক্ষেত্রেই আগ্রহ আবদ্ধ না, সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যেও আগ্রহ, রাজনীতি আর অর্থনীতিতেও। সেই বলছিল, নেহেরু সাহেবের পাঁচসালা পরিকল্পনার কাছে বিজ্ঞানীদের প্রত্যাশার কথা।
কেমন রোমাঞ্চিত বোধ করেন অজিত। নিজে ফাইনান্সের লোক, বাজেট তৈরি, বাজেট খরচ করা, টাকা মঞ্জুর করার প্যাঁচ পয়জার, ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট এসব নিয়ে মেতে থাকেন আজকাল। প্রকৃত বৈজ্ঞানিকের খুব দরকার আছে মনে হয় তবু এ দেশটার। স্বাধীন ভারতের প্রথম দশক এখনো শেষ হয়নি। এই ছেলেটির মুখে চোখে দেদীপ্যমান বিজ্ঞানের প্রতি ভালবাসা।
হঠাৎ বিদ্যুত চমকের মত অজিতের মনে হল, এই ছেলেটি কি কায়স্থ? তাদের পালটি ঘর নাকি? তাহলে একে তার বোন নীপমঞ্জরীর পাত্র হিসেবে তো ভাবাই যায়? সম্ভাবনাটা তো একেবারে উড়িয়ে দেবার নয়।
পকেট থেকে কাগজ বের করে খসখস করে তার ওপর ফাউন্টেন পেন দিয়ে নিজের অফিসের ফোন নম্বর লিখে দিলেন অজিত, আর বাড়ির ঠিকানা ও বাড়ির নম্বরও। একদিন বাড়িতে আসতে বললেন অবিনাশ আর সূর্যশেখর দুজনকেই।
সূর্যশেখর বিনীতভাবে জানাল, আপাতত সে পাগলের মত তার লেখাপড়ার কাজ করছে। কাজ শেষ করা আর বিদেশ যাবার জন্য নানা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি পাঠানো। এখন কয়েক মাস এসব কাজেই যাবে। তবু একবার সে নিমন্ত্রণ রক্ষার চেষ্টা করবে বইকি।
কথায় কথায় অজিত জানলেন, সূর্যর দাদামশাই ছিলেন আমলা। ইংরেজ আমলে বহরমপুরে জেলার ছিলেন। তারপর জরিপের কাজের জন্য বিখ্যাত গোপালনগরের সার্ভে ভবনে বসতেন। এখন অবসর নিয়েছেন, ফিরে গেছেন টাকিতেই। তবে কলকাতায় তাঁর যে বাড়িটি কিনেছেন, সূর্য সেখানেই থাকে।
বলতে বলতে যেন ছেলেটির গলা ধরে এল। আহা রে। ছেলেটির বাবা মা নেই বোধ হয়। দাদু দিদার কাছে মানুষ। সত্যিই তো, উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন সফল করতে কতটাই না করতে হয় এই দরিদ্র দেশের সন্তানকে।
পার্ক স্ট্রিট ধরে হেঁটে হেঁটে আবার ওরা চৌরঙ্গিতে ফিরে আসে। চৌরঙ্গি রোডের একদিক চলে গেছে দক্ষিণমুখী, সোজা বেরিয়ে গেছে ওরা একটা বাসে চেপে। অবিনাশের শ্বশুরবাড়ি হাজরায়। আর ওই ছেলেটিও যাবে ভবানীপুর। ওরা একটা হলুদ ট্যাক্সি ধরে নেয়। বড় বড় পা ফেলে অজিত হাঁটা দেন উল্টোফুটে।
শ্যামবাজারমুখী একটা দোতলা লাল তিন নম্বর বাসে লাফিয়ে ওঠেন অজিত। এ বাস এখন ধর্মতলা স্ট্রিট ওয়েলিংটন স্কোয়ার মৌলালি শেয়ালদা হয়ে তাকে রাজাবাজারে নামিয়ে দেবে।
দোতলার একেবারে সামনের দিকের সিট খালিই আছে। এক পাশে বসে আছে এক প্রেমিক যুগল। মেয়েরা এসব বাসের দোতলায় কখনোই প্রায় ওঠে না। খুব দুঃসাহসী পুরুষ সঙ্গী থাকলে তবেই। এখনও ডুরেশাড়ি পরা উনিশ কুড়ির মেয়েটির গলাঘাড়ে ঘামে চিপে বসা কেশদাম, আর মুখে চোখে এক অনির্বচনীয় আনন্দের ছোঁয়া, সঙ্গের রোগাপাতলা ছেলেটির চোয়ালের রুকুশুখু দাড়ি, যেন সদ্য বসন্তের আঁচ এনে দেয়।
অজিত অন্যদিকের সামনের সিটে মৌজ করে বসেন। এখানে বসলে গোটা কলকাতার রাস্তাগুলোকে রাজার মত উচ্চতা থেকে দেখা যায়। যেন কলকাতা শাসন করছেন, এমন একটা মনের ভাব হওয়া কিছু বিচিত্র নয়। কোথায় লাগে পুল কার, অ্যামবাসাডরের গদি।
লাল টুকটুকে দোতলা বাসের দোতলায় ওঠার কী যে চার্ম, তা পাঁচের দশকের মধ্যদিন থেকে মধ্যরাতের কলকাতা শাসন করা যুবকরাই শুধু জানে।