১৬
১৯৫৯
শেষ পর্যন্ত সুপণ্ডিত, বরিশালের বেদপ্রসাদ ঘোষের মেয়েকেই বিয়ে করল সূর্য। নীপমঞ্জরী। মেয়েটি ছবি আঁকে, চৌরঙ্গীর গভর্মেন্ট আর্ট কলেজে পড়েছে।
বেদপ্রসাদ এক বিখ্যাত অধ্যাপক। বরিশালের ব্রজমোহনের ছাত্র। অশ্বিনী দত্তের হাতে গড়া। কলকাতায় বাসাবাড়িতে থাকেন। রাজাবাজার অঞ্চলে। বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে, তাই এই মানুষটিকে আবালবৃদ্ধবনিতা চেনে। পায়ে ক্যাম্বিশের জুতো পরে ইনি ময়দানে প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের আড্ডায় হেঁটে যেতেন নিয়মিত। ধুতি আর চাদরে চিরন্তন বাঙালি পড়ুয়া। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। হাতে সর্বত্র বই নিয়ে ঘোরেন।
বেদপ্রসাদ শেয়ালদা অঞ্চলে হেঁটে চলেছেন, বিকেলের দিকে এই দৃশ্য বিরল নয়। যার সাথেই দেখা হয়েছে, হাসি মুখে তাঁরা স্যারকে এসে নমস্কার জানালেই তিনি স্মিত আস্যে বলেছেন, আমার বড় মেয়ে নীপমঞ্জরীর বিয়ে এই জ্যৈষ্ঠের নয় তারিখে। এসো কিন্তু।
বিয়ের দিন সন্ধেবেলা স্নেহলতা দেখলেন অসংখ্য অভ্যাগতের চাপে বাড়ির সামনের ছোট্ট চকমেলানো পাথরবাঁধানো বারোয়ারি জায়গাতে বাঁধানো প্যান্ডেল ফাটে ফাটে। বারংবার ছুটলেন ভাঁড়ার বের করতে। কলকাতা ঢুঁড়ে মণ্ডামিঠাই আনাতে হল বার বার। দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছিল ভাত, মাংস। তেলের টিন রাশি রাশি চাবি দিয়ে ভাঁড়ার খুলে ঠাকুরকে যোগান দিতে হচ্ছিল। সুবৃহৎ কর্মকাণ্ড। ঘোষমশাইয়ের প্রথম কন্যাদায়। ভালই মিটল স্নেহলতার সুগৃহিণীপনায়।
১৯৫৯ সালের মে মাসে বিবাহ হল সূর্যশেখর নীপমঞ্জরীর। কোডাইকানালে হনিমুন করতে গেল নীপমঞ্জরীরা। নীপু একটা নতুন জীবনে ঢুকবার মুহূর্তে থমকে দাঁড়িয়েছিল খানিক। পার্ক স্ট্রিটের ট্রিংকাজ -এ খেতে যাওয়া, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান গায়ক বাদকের ইংরেজি গান শোনা, সবই তার কাছে নতুন।
বাবা শিক্ষক হলে এই সময়ে যতই নাম ডাক হোক, পকেট গড়ের মাঠ থাকে। বিশেষত যাঁর এতগুলি ছেলেমেয়ে। তার ওপর নীপুরা মানুষ হয়েছে বিপুলভাবে ব্রাহ্ম রীতিনীতিতে। সিম্পল লিভিং আর হাই থিংকিং-এর শিক্ষায় শিক্ষিত। ফলত, বিলাস ব্যসনের প্রতি চাপা অপছন্দের ভাব আছে নীপুর। তা জেনেই, সূর্য তাকে নিয়ে তুলেছে প্রাচীন এক বাংলোতে। ঝাঁ চকচকে নতুন হোটেলে নয়। যদিও সরকারি চাকুরে দাদা অজিতও বৌদিকে নিয়ে মধুচন্দ্রিমায় গেছিলেন, তবু এই হনিমুনের ব্যাপারেও চাপা উত্তেজনার সঙ্গে নীপুর মুখে একটা যেন-কিছুই-হয়নি ধরনের অবজ্ঞার ভাব আছে।
ফেরার পর কয়েকদিনের ভেতরেই কলকাতায় ঘটে গেল ভয়াবহ সব ঘটনা।
বাংলার সমস্ত অবস্থাটাই এখন প্রবল নড়বড়ে হয়ে আছে। সরকারের তরফে রেশন অব্যবস্থা এমন তুঙ্গে উঠেছে যে সাধারণের নাগালের বাইরে আজ সব খাদ্যবস্তু। খাদ্য সমস্যা ক্রমশ ঘোরালো আকার নিচ্ছে। এর ভেতরেই এইবারের বর্ষা যথাসময়ে এল না চাষির কুঞ্চিত ভ্রূ সমান করতে। ভয়াবহ খরার ফাটা মাটির ছবি দিনের পর দিন ছাপা হচ্ছে অমৃতবাজার পত্রিকায়, যুগান্তরে আনন্দবাজারের প্রথম পাতায়। খরা ও খাদ্যশস্যের উৎপাদন না হওয়ায় প্রায় দুর্ভিক্ষ দোরগোড়ায় এসে ছায়া ফেলেছে যে বাংলায়, সে বাংলায় যে গ্রাম থেকে কৃষিজীবী মানুষ কাজ ও খাবারের সন্ধানে কলকাতামুখী হবে তাতে আর আশ্চর্য কী! অন্যদিকে বামপন্থী দলগুলির সংহত করা শক্তির প্রকট প্রকাশ ঘটেছে। মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি একত্র হয়ে দফায় দফায় মিছিল মিটিং করছে।
৩১ আগস্টের সকাল কোনদিন ভুলবে না সূর্য। সোমবার সকালে আপিসে বেরল নিয়মমত। বাড়িতে নীপমঞ্জরীর একটা নতুন ক্যানভাস ধরার কথা। কিন্তু নতুন বাড়ি, নতুন মানুষজন। সে যেন উৎসাহ পাচ্ছিল না। দশটায় চৌরঙ্গি পেরুল, কেমন একটা থমথমে ভাব টের পেল সূর্য।
যেভাবে বৈশাখের আকাশে একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায় হাওয়া, তারপর একটু একটু করে কালো ঘন মেঘ জমা হয় উত্তর পশ্চিম দিকে, আর ক্রমশ দানা বাঁধে ঝড়ের পূর্বাভাস, দুপুরের দিক থেকে টের পাওয়া গেল এক উত্তাল ভিড় জমা হচ্ছে বলেই পথঘাট থমথমে সকাল থেকেই।
বিকেলে তিন লাখ লোকের মিছিল বেরিয়েছিল গোটা কলকাতায়। ধর্মতলায় মূল মিছিল, কিন্তু শোভাবাজার থেকে ভবানীপুর, দমদম থেকে ময়দান... সমস্ত কলকাতা জুড়ে বজ্রগর্ভ মেঘের মত জমে উঠল প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আক্রমণ। সরকারের অথর্ব দুর্নীতিগ্রস্ত পরিকল্পনাহীন প্রশাসনের বিরুদ্ধে, স্বতঃস্ফূর্ত আর সংগঠিত প্রতিবাদ। খাদ্য আন্দোলনের মিছিল শেষ অব্দি পর্যবসিত হল এক কুরুক্ষেত্রে।
আপিসে জানালায় দাঁড়িয়ে সেই বজ্রগর্ভ মেঘের গর্জন শুনতে পেয়েছিল সূর্য। পিল পিল করে লোক যাচ্ছে, পথে বাড়তে বাড়তে চলেছে জনসংখ্যা... মিছিল ক্রমশ সরু থেকে চওড়া নদীর স্রোতোধারায় পরিণত হচ্ছে। সূর্য তার অন্য কলিগদের সঙ্গে তাদের ছ তলার কাচের জানালায় এসে দাঁড়িয়ে দেখেছিল এই তুমুল উন্মাদনা। হাত আকাশে ছুঁড়ে দিচ্ছে মানুষ। চিৎকার করছে। স্লোগান উঠছে। পা মেলাচ্ছে যারা মিছিলে তারা শুধু ছাত্র নয়, মজুর নয়। দূরাগত গ্রাম থেকে আসা কৃষকেরা আছে। আর আছে অজস্র রিফিউজি। গত পঞ্চাশের দশক থেকেই তারা ছিল এই ধরনের সব আন্দোলনে। তিপ্পান্নর এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে এক পয়সার লড়াই...ট্রাম জ্বালানো, ট্রামের লাইন উপড়ে ফেলা ক্রুদ্ধ জনতার অনেকটাই ছিল রিফিউজিরা। চার হাজার লোককে জেলে পুরেছিল সেবার প্রশাসন। কয়েকজন মারা গিয়েছিল পুলিশের গুলিতে। চুয়ান্নর শিক্ষক আন্দোলনের কথা বিদেশে বসে জেনেছিল সূর্য। তবে এইবার যা প্রত্যক্ষ করল তা তার রোমকূপে শিহরণ আনল। পাশে দাঁড়ানো কমার্শিয়াল ডিপার্টমেন্টের অলকেশ আর সে, দুজনেই হতবাক হয়ে গেছিল রাজপথের দিকে তাকিয়ে। তিল ধারণের স্থান নেই পথে।
ভবানীপুরে, শ্বশুরবাড়িতে বসে নীপমঞ্জরীও শুনতে পেল নদীতে জোয়ারের গর্জন। তাদের বাড়ি গলির ভেতরে, কিন্তু সামনের বস্তির সব লোক সেদিন বড় রাস্তায়... তাদেরই কেউ কেউ ফিরে এসে ফার্স্ট হ্যান্ড রিপোর্ট দাখিল করছিল চিৎকার করে। আর দূরে দূরে কোথায় কী কী ঘটে গেছে, নানা গুজবে পল্লবিত হয়ে ফিরে আসছিল। কোথায় ভাঙচুর হয়েছে, কোথায় জ্বালানো হয়েছে সরকারি বাস। মানুষ নাকি মরছে পুলিশের গুলিতে।
নীপমঞ্জরী তাদের রাস্তামুখো জানালায় দাঁড়িয়েছিল দু হাতে জানালার শিক ধরে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল তার। নিজেরাও উদবাস্তু একরকমের। নিজেই জানে তার দাদু অনেক অনেক দীর্ঘজীবী হতেন, দেশ ভাগ না হলে। আজ সেইসব কথা ভেবে চোখে জল আসছিল। কিন্তু অন্যদিকে ভয়ে প্রাণ উড়ে যাচ্ছিল সূর্যশেখরের কী হবে, সে বাড়ি ফিরবে কীভাবে তা ভেবে।
ভাবতে ভাবতেই সাড়ে পাঁচটার সময়ে টেলিফোনটা রি রি করে বেজে উঠল। সদ্য এই জিনিসটিকে ভাল করে চিনছে নীপু। ধরে স্বামীর গলাটা শুনতে পেয়ে প্রাণে জল এসেছে তার।
কী অবস্থা? তুমি ঠিক আছ তো? আমরা এখানে কী সব শুনছি। অনেক গুজব ভাসছে। নব্বই জন মারা গেছে ফায়ারিং-এ? আজ কী করে বাড়ি আসবে তুমি? বেরিও না অফিস থেকে। পারলে না হয় থেকেই যাও।
আজ না হয় বেরুলাম না, কিন্তু এই জিনিস তো একদিনে মিটে যাবার নয়, নীপু। কাল চলবে, হয়ত পরশুও। অত না মরলেও গুলিতে লোক মরেছে। আর গুলি করাই তো হচ্ছে মবকে ডিসপার্স করতে। অজিতদাকে ফোন করো তো একবার। উনি তো একেবারে ধর্মতলার কাছাকাছি। গুলি ওদিকেই চলেছে নাকি শুনছি।
আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
কয়েক দিনের ভেতর সরকারের পুলিশ হাজারে হাজারে লোককে হাজতে চালান করল। কেউ জানে না গুলিতে মৃতের সঠিক সংখ্যা। হয়ত পঞ্চাশ, হয়ত আশি। দুশো জন প্রতিবাদী নিখোঁজ। কলকাতার এদিকে ওদিকে গজিয়ে উঠছে শহিদ বেদী। সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে, ওয়েলিংটন স্কোয়ার বলেই যাকে ওরা চেনে, শহিদ বেদিটি প্রায় যেন তীর্থস্থান হয়ে গেল দূরাগত চাষি থেকে ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীদের। বাতাসে বারুদের গন্ধ, হাতে প্রাণ আর মনে এক টাটকা সূর্যোদয়ের আশা ... এক ডাকে এতগুলো মানুষকে মিছিলে শামিল করতে পারার ক্ষমতার আগুন... নেতাদের প্রত্যেকের ধুলোভর্তি পায়ে, শিরাওঠা পেশল, পাঞ্জাবি গুটিয়ে তোলা হাতে, আর দৃপ্ত মুখে তখন অন্য এক গতি। হাজার হাজার কিলোওয়াটের ইঞ্জিন যেন জুড়ে দেওয়া হয়েছে অনড় এক রেলগাড়িতে... জনতা জনার্দনের রেল।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ত্রিগুণা সেন ছয়ই সেপ্টেম্বর কালো পতাকা তুলে দিয়েছেন। সরকারের হাতে এত এত মানুষের অত্যাচার, প্রাণনাশের প্রতিবাদ।
বুদ্ধিজীবীদের বিশাল অংশ পথে নেমেছেন। রক্তে দামামা বাজে সূর্যের। সারাদিন সারা সকাল সারা সন্ধে শুধু আলোচনা এই একই বিষয় নিয়ে। খাদ্য আন্দোলন বাংলার রাজনীতির মঞ্চটাকে চিরতরে বদলে দিয়ে গেল।
অথচ নীপু অবাক হয়ে যায়, সূর্য একই সংগে অফিসের ফাংশনে মদ্যপান করেছে সেদিন। ক্যাবারে ডান্স দেখেছে। কী বৈপরীত্য এক মানুষের ভেতরেই। কী স্ববিরোধ। আচ্ছা, কাল তোমরা মদ খেয়েছিলে?
নাক কুঁচকে বলেছিল সেদিন সকালে নীপু।
খুব কম, নীপু। কেন, গন্ধ পেয়েছিলে? আমি কিন্তু চুইং গাম চিবিয়ে এসেছিলাম।
কোথায় ছিল তোমাদের মিটিং?
মুলাঁ রুজে।
উফফ, ক্যাবারে হয় ওখানে।
আরে ক্যাবারে যারা নাচে তারাও কিন্তু মানুষ, নীপু। রুশ মেয়েরা নাচে। অ্যাংলো মেয়েরা নাচে। মিস শেফালি বলে একটি বাঙালি মেয়েও নাচছে এখন।
ছিঃ! ওসব মেয়েদের কথা আলোচনা করতেও আমার বাধে।
তুমি ভীষণ পিউরিটান, নীপু।
হুঁ। তা আমি আছি। তবে তোমার ব্যাপার বুঝি আমি। তুমি আপিসে সাহেব, বাড়িতে ভারতীয়, রাস্তায় কমিউনিস্ট!
ধারালো, মেধাবী চাউনি দিয়ে ফালাফালা করে যেন সূর্যকে দেখে নিয়েছে নীপু।
এই অবজ্ঞার ভাবকেই সূর্য ভাবে নীপুর স্নবারি। আর এ নিয়েই মদনদেব নানা প্যাঁচ পয়জার খেলে যান স্বামী স্ত্রীর মনের আঙিনায়।
সেদিন রাতে এক প্রস্থ মান অভিমান কান্না বর্ষণ ঘটে গিয়েছে এই বিষয় নিয়েই। খুব নিবিড় আশ্লেষে পরস্পরের কাছাকাছি এসেছিল ওরা। চাপা মেয়ে নীপু। নিজের অনুভূতি বাইরে আনে না, তবু এক এক দিন কেমন হয়ে যায় সে, আসলে সূর্যের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার মুহূর্তে সে বুঝতেই পারে না এটা স্বপ্ন দেখছে না সত্যি ঘটছে। কেমন সৌন্দর্যের ঘোর ঘোর ভাব। স্বামীর নগ্নতাকেও সে মাইকেলেঞ্জেলোর মূর্তির মত সৌন্দর্যের শেষ কথা ভাবে। নয়নসুখ পায়। আর নিজের ভেতর, অসংখ্য দেওয়ালের বেড়ি ঠেলে হঠাৎ দেখতে পায় বাঘিনীর মত এক কামনাময়, দুরন্ত শরীরী উত্থান।
—এই তুমি না খুব অসভ্য, জান তো?
—তুমিও অসভ্য, জানতে না? কখনো কখনো আগুনের গোলার মত এই মেয়েটা আমার সবটা পুড়িয়ে খাক করে। সূর্য আশ্লেষে বলল।
—ধ্যাত। আমি কোনদিন অসভ্য কথা ভাবিনি অসভ্য ভাবে চলিনি। ছেলেরা আমাকে ভয় পেত।
—তাই বোধ হয় তোমার আগুন তুমি ভেতরে ধরে রেখেছিলে। ছাইচাপা আগুন এখন দাউ দাউ!
—আচ্ছা কোনদিন আমরা বুড়ো হব? এইসব রমণ রতির কথা ভুলে যাব? দাঁতের ব্যথা নিয়ে, পেট পরিষ্কার হওয়া নিয়ে কথা বলব শুধু? তোমার দাদু দিদিমা যেমন বলেন?
—তখনো আমাদের ভেতরে প্রেম থাকবে। প্রেমের আঠা আসল শরীরই তো! তুমি তো আর্টিস্ট। খাজুরাহো কোনারকের যুগল মিথুন মূর্তিদের দেখোনি?
—এঁকেওছি। স্কেচ করেছি খাতা ভরে।
—এই যে শরীরে শরীর মিলিয়ে, স্বেদবিন্দুর সঙ্গে স্বেদবিন্দু মিলিয়ে এক হয়ে যাওয়া। রতি ও রমণ। এসবই তো। জ্বাল দেওয়া দুধের মত আমাদের প্রেম ঘন হবে আরো। বুড়ো হতে হতে ক্ষীরের মত হয়ে যাবে আমাদের প্রেম...
—তবে এতদিন যে শিখেছিলাম কামনাবাসনা সব মন্দ জিনিস?
—এসব স্বর্গীয় কামনাবাসনার মুহূর্তকে মরজীবনের তুচ্ছতা বলে মহাপুরুষরা ওড়াতে পারেন, জীবনের, সমাজের আর সংসারের কাজ চলে এই আকর্ষণের ওপরেই তো। মায়াই বল আর আঠাই বল। এই তো ধরে রেখেছে সবকিছুকে।
আবার ওরা দুজনে লীলায়িত হয়, বিছানায় গড়াতে গড়াতে হিংস্র শব্দ করে, আনন্দে সূর্য বলে, আমি কী পেলাম তুমি জান না নীপু। আমার কত ভয় ছিল, আমার অনেক বন্ধু বিবাহিত জীবনে অসুস্থা, রুগ্না অথবা অনিচ্ছুক স্ত্রীর সঙ্গে দিনযাপনে বাধ্য। তুমি আমাকে কত সুখী করেছ তুমি নিজেই জান না। … এইসব বালকসুলভ আবেগতাড়িত কথার পরে হঠাৎ বালকসুলভ ক্রন্দন করতে থাকে সূর্য।
তখন তাকে সামলানো দুষ্কর। সে-রাতে রতিক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পর হঠাৎ নীপুর ঘুম ভেঙ্গে সে দেখে সূর্য হাউমাউ করে কাঁদছে বিছানার এক পাশে বসে। এগুলো যে তার দুঃখ বিলাস তাতে নীপুর কোন সন্দেহই নেই। সে পিঠে হাত বোলায়, মাথা রাখে স্বামীর কাঁধে।
সূর্য বিলাপের ঢঙে বলে, তুমি বুঝতে পারবে না তোমায় কত ভালবেসেছি। আর তোমার তো অনেক গুণমুগ্ধ, তুমিও তো আমার মত একটা ভোঁদাই বর চাওনি কোনদিন। ওই পূর্ণেন্দুর মত ছিপছিপে, কালোশ্যামের মত রূপবান আর্টিস্ট ছেলে হলে তোমার ভাল হত। আজ ও কেমন করে তোমার পানে চেয়েছিল তুমি লক্ষ কর নি, আমি করেছি…ইশ ধনুকের ছিলার মত ছেলেটা।
দুম দুম করে পিঠে কিল মেরে, প্রায় হিংস্র হয়ে নীপু ওকে চুপ করায়। কী বোকা, কী বোকা তুমি, অ্যাঁ? এমনও ভাবে পুরুষমানুষ? সব পেয়েও? তুমি তো দেখি রবি ঠাকুরের গানকেও ছাপিয়ে যাবে। জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না, হায় ভিরু প্রেম হায় রে।
আবার আর এক শৃঙ্গারলীলায় মাতে তারা দ্রুত। কান্না বদলে যায় হাসিতে।
তবে, নীপুর কলেজের সহপাঠী আর্টিস্ট বন্ধুদের হিংসে করে বলে মনে হয় না সূর্য। তাদের কাছে সূর্যদা প্রিয়, আড্ডাবাজ, গপ্পুরে। সেখানে কোন মান অভিমান সন্দেহ নেই। আর্ট কলেজের বন্ধু আর বান্ধবীরা হই হই করে এসে তাদের আলিপুরের ফ্ল্যাটে মাংস, পোলাও, দই মিষ্টি সাঁটিয়ে গেছে। নীপুর বিয়েতে পাওয়া অসংখ্য ডিনার সেট আর টি সেটের সদব্যবহার হয়েছে। শুধু ওদের পাওয়া সাতটা সরবতের সেট আর পঁচিশটা সুবোধ ঘোষের ভারত প্রেম কথা ধীরে ধীরে অন্যদের বিয়ের অনুষ্ঠানে উপহার দিয়ে দিয়ে শেষ করতে হচ্ছে।
নীপুর বন্ধুদের মধ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্র ধীরাজ চৌধুরী, যোগেন চৌধুরী। যোগেন বয়সে খুব ছোট, ছোটখাট চেহারা, বিনয়ী, হাত ভীষণ পাকা। দারুণ স্ট্রোক তুলির। অনিতা রায়চৌধুরী বা শ্যামশ্রী বসুও খুব চমৎকার আঁকে।
১৭
সূর্য এখন ঠিক করেছে আর্টের যত বই নীপুর আছে সেসব সে পড়ে ফেলবে। নীপুকে অবশ্য পরিবর্তে সে এত্তো আধুনিক কবিতা পড়িয়ে দিয়েছে। রীতিমত শোধ বোধ হয়েই গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বাইরে এতদিন বোধ হয় নীপুর আর কোন আধুনিক কবিতাই সেভাবে পড়া ছিল না। আধুনিক কবিতাকে দুর্বোধ্য বলে যে নাক সিঁটকোত, সে এখন সুভাষ মুখুজ্জে আর বুদ্ধদেব বসু, সুধীন দত্ত, বিষ্ণু দে আর জীবনানন্দ চেনে, বোঝে।
মানব এখন খুব ডিকের কাছে যায়। ওর প্রথম কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি ডিকে-কে দেবে ভাবছে। প্রায় পাঁচ ছ বছরে নানা কাগজে, বিশেষ করে কৃত্তিবাস, শতভিষাতে ছাপতে ছাপতে বেশ কিছু কবিতা জমে গিয়েছে।
ইতিমধ্যে সূর্যর বামপন্থী বন্ধুদের অনেকেই কিন্তু উলটো কথা বলছে। বলছে, এত কবিতা লেখা বাঙালির দুর্বলতা মাত্র। যেখানে মানুষের পেটে অন্ন নেই, শরীরে বস্ত্র নেই, সেখানে রোমান্টিক কবিতা লেখা এক ধরনের অপরাধ।
সূর্যও তা কখনো বিশ্বাস করে। কিন্তু অন্য অনেক কাজও তো সাহিত্যের মাধ্যমে করা যায়। যায় না? বিজ্ঞান নিয়ে কিশোরদের উপযোগী কটা লেখা লিখে নিজের লেখক হবার ব্যর্থ বাসনাকে সে জিইয়ে রেখেছে। নতুন আপিসের এত এত কাজ। একটা নতুন সংসারের উত্তেজনা। তাও, লেখার খাতা বেরিয়ে আসে সন্ধেবেলা। তখন মনে পড়ে। প্রেমেনজেঠু বলেছিলেন। লেখো সূর্য, বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প লেখো এবার। তোমার হাত ভাল।
লিখতে পারে। ছাপবে কোথায়? কোন প্রতিষ্ঠিত কাগজ কি তার মত নতুন লেখকের লেখা ছাপবে? এত বড় লেখক তিনি, বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প প্রেমেনজেঠু লেখেনও দুর্দান্ত কায়দায়। যেকোন পত্রিকা লুফে নেয়। তাঁর হাতে যাদু আছে। ঘনাদা সিরিজের গল্পগুলো সর্বজনগ্রাহ্য হয়েছে। প্রতি গল্পে গল্পচ্ছলে একটা করে নতুন বৈজ্ঞানিক সত্য বা তত্ত্ব সামনে আনেন। কিন্তু ওঁর খ্যাতি আর কব্জির জোর তো সূর্যর নেই। দ্বিধা আর কুন্ঠা ঝেড়ে ফেলে তবু একটা গল্পের খসড়া করল ও। সমুদ্রতলে প্রাচীন জীবাশ্ম খুঁজতে যাওয়ার রোমাঞ্চকর গল্প। প্রেমেনজেঠু বুদ্ধি দিয়েছিলেন, গল্প একাধিক লেখা চাই আর সব লেখার ভেতরে ভেতরে মালা গাঁথার মত একটা সূত্র থাকে যেন। ওর ক্ষেত্রে সেই সূত্র একজন স্যার, এক বৈজ্ঞানিক সমর মিত্র। নানা গল্পের পুঁতি গাঁথা যাবে ডক্টর মিত্র আর তার ছাত্র বিমান চৌধুরীকে দিয়ে।
বেশ লিখেছ হে সূর্য! হবে তোমার এই লাইনে। আরো লেখো কটা। আলাদা আলাদা ভাবনা নিয়ে লেখো।
আপনি বলছেন? ঘাড় চুলকে লাজুক হাসল সূর্য। তারপর কুন্ঠিত স্বরে গলা ঝেড়ে জিজ্ঞাসা করল,
ছাপা তো হবে না এসব। কে ছাপবে আমার মত নতুনের লেখা!
আরে আরে সে নিয়ে তুমি ভেবো না। বলিনি তোমায় আমি? তোমাকে যেমন তাতাচ্ছি আরেকটা ছেলেকেও খুব তাতাচ্ছি এখন।
কে?
অদ্রীশ। অদ্রীশ বর্ধন। বউবাজারের সার্পেন্টাইন লেনের ছেলে। তা তোমার থেকে বয়স বছর পাঁচেক কমই হবে। জাস্ট পাস করে বেরিয়েছে। মুম্বইতে একটা চাকরি করছিল। তারপর ব্যাঙ্গালোরে গেল। কিন্তু ভাল লাগেনি কমার্শিয়াল ফার্ম। ছেড়েছুড়ে চলে এসেছে। এখন কলকাতায়। কাগজ করবে ভাবছিল। আমি বলেছি সেই বস্তাপচা গল্প কবিতা সামাজিক পালা চাই না। নতুন কিছু করো। বিজ্ঞান নিয়ে করো। বিজ্ঞানভিত্তিক কল্পগল্প। একেবারে আম পাঠকের জন্যই লিখবে সবাই। বিজ্ঞানের গল্প কিন্তু পড়বে শুধু বৈজ্ঞানিকরা নয়। সবধরনের পাঠক।
তাই? বেরিয়েছে সে কাগজ?
না না, শিগগিরই বেরুবে। ও বলছে সায়েন্স ফিকশন হল "মহাকাশ যুগের রূপকথা"।
—বাহ জেঠু, এ তো একেবারে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ভাবা। নতুন ভাবনা।
—দাঁড়াও একটা কাজ করি। তুমি বরং আগামী শনিবার কলেজ স্ট্রিট কফি হাউজে এস। ওকে ওখানে আসতে বলি। আমরা এদিক থেকে যাই। বসে মুখোমুখি কথা বলা যাবে খনে। একদম নতুন কাজ হবে হে।
১৮
এই কফি হাউজে কফি তো ভালই। এরা চিকেন পকোড়াটা করে দারুণ। খেয়ে দেখো সূর্য।
অদ্রীশ বর্ধন ঢুকল। পাতলা চেহারা। রোগার ওপর চনমনে গড়ন। টিকলো নাক। লম্বাটে মুখ। চোখ দুটি ধারাল। প্রাণশক্তি যেন চোখের মধ্যে ফুটে বেরচ্ছে। কফি হাউজের দরজা দিয়ে ঢুকে প্রথমটা ধাঁধা লেগে যায়। এত চৌকো টেবিল। টেবিলগুলো ঘিরে এত এত মানুষ বসে আছে। সিগারেটের ধোঁয়াতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে অত বড় হল ঘর। বাঁদিকে ডানদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ কোণের টেবিলে প্রেমেন মিত্তিরকে দেখে মুখে একটা চওড়া হাসি ফুটে ওঠে অদ্রীশের। এগিয়ে যায় তাড়াতাড়ি সেদিকে।
এসো হে অদ্রীশ, এসো। এই যে আলাপ করিয়ে দিই। এ হল সূর্যশেখর রায়। এ হল অদ্রীশ বর্ধন। আর কেউ আসছে নাকি হে?
হ্যাঁ রণেনকে বলেছি আসতে।
একটু পরে রণেন আসে। একেবারেই বাচ্চা ছেলে। ভাল করে গোঁফদাড়ি গজায়নি। ছোটখাট চেহারা। অদ্রীশ দীর্ঘদেহী। চারজনে আড্ডা জমে ওঠে। এক প্রবীণ। তিন অপেক্ষাকৃত তরুণ। সূর্য বিয়ের পর বেশ গোলগাল হয়েছে। মাথায় অল্প টাক পড়েছে। চুল দ্রুত উঠে যাচ্ছে সূর্যর। কেয়ো কার্পিনেও কাজ হচ্ছে না। তাকে বয়সের তুলনায় ভারিক্কি লাগে এখন।
তা বলো অদ্রীশ, রণেন কী খাবে।
সূর্য ফুট কাটে, আমরা তো একটু আগেই দু প্লেট চিকেন পকোড়া অর্ডার দিলাম। ওগুলো এই এলো বলে। আগে সেগুলো ধ্বংস করা যাক। তারপর দেখছি। আজকে কিন্তু আমি খাওয়াব।
তা খাওয়াবে না কেন। তুমি বিলিতি কোম্পানির চাকুরে এখন।
এরা কিন্তু চিকেন স্যান্ডুইচটা দিব্যি করে প্রেমেনদা। মুখে দিলে গলে যায় মাখন আর সেদ্ধ মুরগির ফালি।
গুছিয়ে বসে পত্রিকা নিয়ে আলোচনা শুরু হল।
সাদা চাপকান পরা, মাথায় সাদা কাপড়ের ঝুঁটি দেওয়া পাগড়ি পরা বয় এসে অর্ডার নিয়ে যায় আবার। অদ্রীশ উদগ্রীবভাবে হাত পা নেড়ে কথা বলতে থাকে। তার অনেক পরিকল্পনা, অনেক আশা, স্বপ্ন। নতুন পত্রিকা যেন তার সন্তান। এখনও ভূমিষ্ঠ হয়নি।
প্রেমেনদা হাত তুলে তাকে থামান।
—আগে বলো কাগজের নাম কী ঠিক করলে।
—ভেবেছি আশ্চর্য। না কি ফ্যান্টাস্টিক দেব?
প্রশ্নালু চোখে অদ্রীশ প্রেমেন্দ্র মিত্রের মুখের দিকে দেখে।
আশ্চর্যই থাক। বাংলা কাগজ, বাংলা নাম।
প্রথম ইস্যুর সম্ভাব্য লেখক তালিকা ফাইনাল?
হ্যাঁ আমার অনুবাদে এইচ জি ওয়েলসের টাইম মেশিন থাকবে। আর হ্যাঁ আমি কিন্তু স্বনামে সম্পাদক থাকছি না। আকাশ সেন নাম দিয়ে বেরুবে।
হ্যাঁ যতদিন মৌলিক লেখা প্রচুর পাওয়া না যায়, তোমরা অনেকটা অনুবাদ দিয়ে ফাঁক ভরাতে পার। জান তো অদ্রীশ, সূর্যর কথা তোমাকে আগেই তো বলে রেখেছি। আমার সহপাঠী সরিৎশেখরের পুত্র। ও কিন্তু বিদেশে যখন ছিল প্রচুর মার্কিন সায়েন্স ফিকশন পত্রিকা কিনেছিল। জাহাজে ওর বইই এসেছে দু ট্রাংক। তার মধ্যে সেসবও এসেছে।
তাই? ওহ দারুণ। পড়াবেন তো? অনুবাদও চাই কিন্তু।
সূর্য হাসে। —অবশ্যই। ভাল জিনিস তো ভাগ করে নিতেই হয়। এখন তো গ্র্যান্ড হোটেলের আর্কেডেও বইয়ের দোকান থেকে কিনছি। আর্থার সি ক্লার্ক, ফিলিপ কে ডিক। তারপর ক্লাসিকস অফ এস এফ ১৯৬০ এসেছে দেখে কিনলাম সেদিন। ওরা বললে আনিয়েও দেয় ভাল বই।
হ্যাঁ তপনদার দোকানে আমিও কিনি। তবে রেস্ত আর ক'টাকা পকেটে। বাড়িতে খুব ঝামেলা হয়। চাকরি ছেড়েছুড়ে চলে এসেছি তো। সূর্যদা আপনি কিনুন, আর ও থেকে অনুবাদও করুন পারলে। অনুবাদটা করবেন বেনামে। আর আপনার স্বনামে, মৌলিক গল্প তো নেবই। আমি সায়েন্স ফিকশনের একটা বাংলা প্রতিশব্দ ভেবেছি। বিজ্ঞানভিত্তিক কল্পগল্প। কেমন হবে?
দারুণ। আমি তো এতদিন বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প হিসেবেই লিখে আসছি। অনেকে বিজ্ঞাননির্ভর গল্পও বলে। এই নামটা বোধ হয় আরেকটু নান্দনিক হবে।
হ্যাঁ, আর কল্পগল্প নামটায় কল্পনার একটা জোরালো ভূমিকা আছে। অদ্রীশদার এই ভাবনাটা আমার মনে ধরেছে। মানে, বিজ্ঞানের শুকনো কচকচি দিয়ে তো শুধু, সাহিত্য হয় না। কল্পনাই আসল। আধার বিজ্ঞান।
কিশোর প্রায় রণেন বিজ্ঞের মত করে বলল। সবাই একমত।
প্রেমেন বললেন, প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়টা ভাল হতে হবে। অমনি লাজুক মুখে অদ্রীশ বলল, লিখেছি একটা।
আরে পড়াও পড়াও দেখি কী লিখলে। অদ্রীশের পকেট থেকে বেরিয়ে এল খসড়া কাগজখানা। জাঁদরেল সম্পাদকীয় লিখেছে সে।
"অতিমানবের যুগ আসছে!"
আরে বাহ। টাইটেলেই তো মার দিয়া কেল্লা। তার পর সে জুলিয়াস সাইমনস-এর একটি উক্তি দিয়ে শুরু করেছে। শার্লক হোমস-এর পদ্ধতির ডিটেক্টিভের চরিত্রেরা মুছে যাচ্ছে, তার জায়গায় এসেছে সুপারম্যান বা অতিমানব।
"বাস্তবিকই ওদেশে যুক্তিনির্ভর রহস্যঘন গোয়েন্দা কাহিনীর চেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সায়েন্স ফিকশন অর্থাৎ বিজ্ঞাননির্ভর কল্প কাহিনী।" তারপর অদ্রীশ বলেছে অরওয়েলের নাইনটিন এইটিফোর আর হাক্সলির ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ডের কথা। ছুঁয়ে গেছে মেরি শেলি-র ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের কথা। বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্যের আরো উদাহরণ দিয়ে, অদ্রীশ বলেছে, প্রগতিধর্মী জাতি বলে আমরা গর্ব অনুভব করি। অথচ ওদেশে যা জনচিত্তের অন্তরালে লুকিয়ে যেতে বসেছে, আমরা আজও তাকে সাগ্রহে অভ্যর্থনা জানাচ্ছি।
কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, মহাকাশযুগে শুধু পাশ্চাত্যই প্রবেশ করেনি—সারা দুনিয়া প্রবেশ করেছে। ওদেশের অসাধারণ অগ্রগতি এদেশের চিন্তাজগতে যে বিপুল আলোড়ন তুলেছে—তারই প্রথম প্রকাশ ঘটল "আশ্চর্য!" পত্রিকার মধ্যে। কল্পনার রঙে রঙিন বিস্ময়কর মৌলিক চনমনে বৈজ্ঞানিক গল্প ছাড়াও আশ্চর্য! পত্রিকায় প্রকাশিত হবে দেশবিদেশের বহু রোমাঞ্চকর কাহিনি। ভারতীয় ভাষায় এ ধরনের পত্রিকা আর আছে বলে আমাদের জানা নেই।
তোমার কাগজের তো একটা লোগো লাগবে অদ্রীশ! কাকে দিয়ে আঁকাবে বল তো?
বলুন না আপনি বলুন। আমার বন্ধুদের মধ্যে আর্টিস্ট বলতে তো হিমানীশ আছে। হিমানীশ গোস্বামী।
আরো উঁচু ডালে মইটা বাঁধো অদ্রীশ। সত্যজিতকে বলব?
ওরেব্বাবা! সত্যজিতবাবু এখন পৃথিবীবিখ্যাত চলচ্চিত্রকার! পাঁচখানা আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া লোক! এক পথের পাঁচালিই তো বোধ হয় বার্লিনে স্যান ফ্রান্সিস্কোতে আরো কোথায় কোথায় পুরস্কার পেয়ে বসে ছিল। এখন তো প্রতিবছর যান বার্লিনে বা কানে। আমার মত চুনোপুঁটি ওঁকে অ্যাপ্রোচ করবে কীভাবে!
আমি বলছি দাঁড়াও ওকে।
হ্যাঁ আপনি বললে তো হবেই। কিন্তু প্রথমেই টাকা পয়সা তো দিতে পারব না প্রেমেনদা।
আরে দাঁড়াও দাঁড়াও। ওসব কথা উঠছে কিসে! সত্যজিত আমাকে বলেছিল যে সারা পৃথিবীতে যেখানে এস এফ এত এগিয়ে গেছে, সেখানে বাংলা সাহিত্যে যে সায়েন্স ফিকশনের যে কোন ধারাই নেই, এটা ওকে পীড়া দেয় খুব। ওর বাপ ঠাকুদ্দার পত্রিকা সন্দেশ ও আবার একষট্টি থেকে নতুন করে চালাচ্ছে, দেখেছ কি? সেখানে তো ও ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু নামে একটি খ্যাপাটে বৈজ্ঞানিকের চরিত্র সৃষ্টি করেছে। ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি।
হ্যাঁ সে তো পড়েছি! তবে আমাদের ব্যাপারে উৎসাহ দেখাবেন কিনা ভাবছিলাম। দারুণ হবে তো তাহলে। একটা নক্ষত্র উনি আজকের দিনে। আমাদের কাগজের উপদেষ্টা হিসেবে পদ্মশ্রী প্রেমেন্দ্র মিত্রের পাশাপাশি ওঁর নামও যদি রাখা যায়। যদি লীলা মজুমদারকেও আনা যায়। আমরা তরুণেরা তো লিখবই।
চন্দ্রনাথকে ডেকে নেব। চন্দ্রনাথ দে। আর্টিস্ট। ওকে শিল্প উপদেষ্টা হিসেবে রেখো। ছবিতে গল্প রেখো। কার্টুন স্ট্রিপ খুব জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে উঠে আসছে বিলেত আমেরিকায়।