• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৯ | জুলাই ২০২৫ | বিবিধ
    Share
  • জলের মতো ঘুরে ঘুরে : শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়
    | | | | | ৬

    তাদের ডাকনাম ভুলে গেছি

    দুপুর রোদে প্রায় খালি ট্রেনটা যেই এসে দাঁড়াল পার্কসার্কাস স্টেশনে, হুড়মুড়িয়ে একটি পরিবার এসে বসল আমার সামনের সিটগুলোয়। তিনজন মহিলা, তাদের মধ্যে বাচ্চা-কোলে একজন, সঙ্গের লোকটি বেশ গোবেচারা। তাকে প্রাণপণে বুঝিয়ে চলেছে তিনজন নারী— টিকিট যদি নাও-বা থাকে তাতে ক্ষতি নেই কোনো! কোলের বাচ্চাটি জানলার রডে জিভ ঠেকাচ্ছে, কিন্তু তার মায়ের সেদিকে হুঁশ নেই। মায়ের বয়স গোটা তিরিশ। গালে মেচেতার দাগ। একগাল দাড়ি নিয়ে লোকটি কিছুতেই বোঝাতে পারছে না এই প্রমীলা বাহিনীকে। কিন্তু তার মুখে যন্ত্রণার ছাপ। সে কি মেনে নিতে পারছে না যুক্তির এই প্রগাঢ় ঠাট্টা? হাজারও অজুহাতের উচ্চকিত বাক্স্পন্দে অস্থির হয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি ওপাশে একটা ট্রেন চলেছে দক্ষিণের দিকে। হঠাৎ আমিও যেন চলতে শুরু করলাম।

    তীব্র গরমের দুপুরে শেয়ালদায় বরফ-জলের দোকানে শেষ আধুলিটাও খরচ করে টাকরার কাছটায় জ্বালা। ট্রেনে দাঁড়িয়ে দেখি ভালদেররামা বাঁ-বগলে ক্যাসিও সিন্থেসাইজার নিয়ে বিষণ্ণ ঠোঙা থেকে মুড়ি খাচ্ছে। ভালদেররামার নাম জানি না। শুধু ওর মাথাভরা লতানো গাছের মতো কালো চুলই ওকে মিলিয়ে দিয়েছে কলম্বিয়ার কার্লোস ভালদেররামার সঙ্গে। আমি তখন ফুটবল বুঝি। আর সদ্য পড়েছি ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’। কর্নেল যেভাবে পাত্রের নীচের জংধরা অংশ সহ চেঁছে কফি তোলেন, আমিও প্রায় প্রতিদিন ভালদেররামাকে দেখে জীবন চেঁছে গল্প তোলার চেষ্টা করি। আমি জেনেছি আমার ভালদেররামা আগে পাড়ার জলসাগুলোয় বাজনা বাজাত। সিজনে ভালোই উপায় হত। টালিগঞ্জেও যে কয়েকবার যায়নি তা নয়। তবে চালিয়াৎ প্রোডাকশন ম্যানেজারদের কয়েক ডজন সিগারেট খাইয়ে বুঝে গেছিল ওপথে কিছু হবার নয়। এদিকে হাইকোর্ট সেসময় রায় দিয়েছে রাত দশটার পর আর কোনো জলসা করা যাবে না। তাই ভালদেররামা রাস্তা না পেয়ে সারাদিন বেশ কয়েকবার আপ ডাউন শেয়ালদার ট্রেনে শুধু সিন্থেসাইজার বাজায়। গান গাইতে পারে না সে। তার বন্ধুরা যারা গাইত, তখনও লজ্জা ভেঙে ট্রেনে গাইতে আসার জোর পায়নি। শিয়ালদার দক্ষিণে যেসব ট্রেন চলে তাতে গানবাজনার শুরু আমার ভালদেররামার হাতেই। আমি রোজ ওর বাজনা শুনি। মাঝে-মাঝে গান চিনতে পারি। মাঝে-মাঝে পারি না। চিনতে পারলে ভিড় ট্রেনেও মনটা দরজার বাইরে উড়ে যায়। কিন্তু বাজনা শেষ হলে যখন পয়সা চাইতে আসে তখন আমাকে হঠাৎ উদাসীন হয়ে পড়তে হয়। যেন শুনছিলামই না এমন ভান করতে হয়। কেননা তাকে দেবার মতো আমার কাছে প্রায় কিছুই থাকত না তখন। আমার সর্বক্ষণ তখন মনে হত :

    কলকাতা আমার বুকে বিষম পাথর হয়ে আছে
    আমি এর সর্বনাশ করে দিয়ে যাব—
    আমি একে ফুসলিয়ে নিয়ে যাবো হলদিয়া বন্দরে
    নারকোল নাড়ুর সঙ্গে সেঁকো বিষ মিশিয়ে খাওয়াবো—
    কলকাতা আমার বুকে বিষম পাথর হয়ে আছে।
    আমি এমনিই ভাবতে-ভাবতে আসলে না-ভাবার অভ্যেস করে ফেলেছিলাম। কখনো দিবাস্বপ্নের প্রায়। যা কখনো হয়নি, যা কখনো হবে না, যা হতে নেই— সব ভাবতাম। ভেবে-ভেবে গুলিয়ে যেত স্টেশন। যাদবপুরে নেমে ঘোরের মধ্যে হেঁটে যেতাম রোদে। দরজা খুলে ঘরে ঢুকে আধো অন্ধকার ঠান্ডা আচ্ছন্ন করত, আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। মনে মনে বলতাম ‘আমি সেই মানুষ, আমাকে চেয়ে দ্যাখো/ আমি ফিরে এসেছি/ আমার কপালে রক্ত/ বাষ্প-জমা গলায় বাস-ওল্টানো ভাঙা রাস্তা দিয়ে ফিরে এলাম’।

    আসলে বড্ড অসহায় ছিল তখনকার দুপুরগুলো। কোথাও যে যাব, তার উপায় নেই। কলকাতায় যুবতীরা দুপুর রোদে পর্দা টেনে ঘুমোয়, কিশোরীরা স্কুলে যায়। আর আমি নাদান যুবক ট্রেনে চড়ে চার-পাঁচটা স্টেশন যাই আসি। না-ভাবার খেলা প্র্যাকটিস করি। ট্রেন চলতে-চলতে কখনো পার্ক সার্কাস ব্রিজের তলায় নোংরা দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়ায়, আমি দেখি এখানেও কেমন দমবন্ধ সব। দেওয়াল ডিঙিয়ে সব সময় ওপারটা দেখা যায় না। আমি আগামীকাল দেখার নেশায় বেশ কয়েকবার আঙুলের ডগায় দাঁড়াবার চেষ্টা করিনি এমন নয়, কিন্তু লাভ হয়নি কিছু।

    আজ অবশ্য শিয়ালদায় নেমে হেঁটে গেলাম সুরম্য সব বিপণীর পাশ দিয়ে। ভিড়ের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে অটোরিক্সায় গিয়ে পৌঁছলাম কলেজ স্ট্রিট মোড়। সেখানে প্রাচীন মূর্তিটা কার— বটকৃষ্ণ পাল না কৃষ্টদাস পালের সেটা মনে পড়ছিল না ঠিক। তাই কাছে গিয়ে দেখছিলাম। তারপর স্বভাববশে বোঝার চেষ্টা করলাম পাতিরামের তাপসদা স্টল খুলেছে কি না। ঠাহর হল না। তারপর উলটো দিকে ঘুরে দেখি দুই চেনা মুখ। তারা আমায় অভ্যর্থনা করল হাসি মুখে। একজন আমার নিকট বন্ধু। তার বইয়ের শো-রুমে আজ সভা। গতকালও ছিল। সেখানে গতকাল জঁ-লুক গোদারকে নিয়ে বলেছেন আমার প্রিয় এক মানুষ। সেই সভায় সলতে পাকানোর কাজ করতে হয়েছিল আমাকে। মানে শুরুতে দু-চার কথা বলে আলোচনার পরিবেশ তৈরি করা। বহুকাল আগে দিব্যেন্দুদা বলেছিল যেকোনো জনসভা যখন শুরু হয় তখন যে বক্তৃতা করে তার দক্ষতা কী অপরিসীম! দলে-দলে লোক ঢুকছে, কেউ সিগারেট টানছে, কারুর সঙ্গী গেছে ভিড়ে পিছিয়ে, কারুর মনে হচ্ছে একবার প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে এলে বেশ হয়। এমন সময় যে-বক্তা তার মনের অবস্থা কল্পনা করুন। কেউ শুনছে না বুঝেও থামার উপায় নেই। যতক্ষণ না ভিড় থিতু হচ্ছে প্রধান বক্তারা কেউ উঠবে না। কোনো সভায় সূচনাকথা বলার দায়িত্ব থাকলে আমার বারবার দিব্যন্দুদার কথাগুলো মনে পড়ে। দিব্যন্দুদাকেও। কারণ আমাদের জেলায় এই রকমের সভাগুলোতে সে ছিল চিরকালের প্রথম বক্তা। কিন্তু কাল আমার বলতে বেশ ভালো লাগছিল। অনুষ্ঠানটার পরিকল্পনায় আমারও কিছুটা অংশগ্রহণ ছিল। হঠাৎ কলেজ স্ট্রিটে আমার অনুভূতিমালা যেন সজীব হয়ে উঠছিল। কিন্তু আজ আমায় করতে হবে আরও বেমক্কা এক কাজ। এক সফল চলচ্চিত্রকারের সঙ্গে বসে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে আলোচনা। শো-রুমে ঢুকতেই মিষ্টি একটা গন্ধ আর ঠান্ডা বাতাস একবারে বুক জুড়িয়ে দেয়। এদিকে একজন আমার দিকে এগিয়ে দিল এক বোতল মিনারেল ওয়াটার। একজন ডকুমেন্টারি তুলিয়ে যেচে এসে আলাপ করে গেলেন। ফোন নম্বর চাইলেন। অতঃপর পুষ্পেপত্রে উদ্বোধন করে শুরু হল সভা। পরিচালকমশাইয়ের সঙ্গে জমে গেল আলোচনা। তাঁর দুটি ছবি দেখেছি আমি। খুব যে মুগ্ধতা ছিল তা নয়। তবু মানুষটিকে ভালো লেগে গেল। কেউ জানলও না আমি কোনো প্রস্তুতি ছাড়া একটা সভা পরিচালনা করে ফেললাম। সভা শেষে আমার বন্ধুটির চোরা হাসি। ভুল বললাম। কেউ জানত না এমন নয়। আমার বন্ধুটি জানত। সভা শেষে আরও বন্ধুজনেরা ঘিরে বসল আমায়। চারদিকে বন্ধুদের কথা, এয়ার কন্ডিশনারের মৃদু আওয়াজ। আমি চাইলেই আর এক বোতল জল পেতে পারি। চা না খেয়ে কফি চাইলেও এনে দেবে কেউ। চারদিকে যেন রঙিন প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ যেন চমক ভাঙে। আমি ধীরে উঠে বাইরে আসি। সিগারেট ধরাই। মাথার মধ্যে পাক খায়— ‘চতুর্দিকে এত সুবাতাস,/ এত প্রজাপতি দেখে দুর্দিনের জন্য ভয় হয়’। সঙ্গে-সঙ্গে পকেট থেকে মোবাইল বের করে স্ত্রীকে ফোন করি। জানতে পারি মা-মেয়েতে রেস্তরাঁয় চিকেন রোল খাচ্ছে। আমি সিগারেটটা পায়ে পিষে টয়লেটের দিকে যাই।

    ফিরতি পথে ট্যাক্সি নেওয়া যেত, মেট্রোয়, নিদেন পক্ষে অটো চড়ে আসা যেত শিয়ালদা পর্যন্ত। কিন্তু আমি পায়ে হেঁটে ট্রেন ধরে যাদবপুর এলাম। স্টেশনের ডাউন প্ল্যাটফর্মে কোনো দোকানদার আমার চেনা নয়। কেননা এখানে অপেক্ষা করতে হয়নি কখনো। সব সময়েই ট্রেন থেকে নেমে বেরিয়ে গেছি স্টেশনের বাইরে। আজ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে আপ প্ল্যাটফর্মের দোকানগুলো ঝুঁকে দেখতে থাকলাম। খবরের কাগজ পত্রপত্রিকা নিয়ে বসে যে দশাসই চেহারার লোকটি, তার নাম মনে পড়ল না। যার দোকান থেকে চা খেতাম, তাকে দেখতে পেলাম না। বাজারে বেরিয়ে মুদিখানার দোকান, কেরোসিনের মাসির দোকান, চালের দোকান— কারুর নাম মনে পড়ল না। আমি ভাবলাম ওষুধের দোকানদারের নামটা নিশ্চয় মনে পড়বে। কিন্তু তার দোকানের সামনে দাঁড়িয়েও মনে পড়ল না। চেষ্টা করলাম সাইন বোর্ড না দেখে রাস্তাটার নাম মনে করতে। তাও পারলাম না। হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরব বলে প্ল্যাটফর্মের দিকে পা বাড়িয়ে এক অন্ধ ভিক্ষুক দম্পতিকে চেনা লাগল। আপন মনে হেসে আমি ট্রেন ধরে পরের স্টেশনে। বাড়ি ঢোকার আগে দোকান থেকে দশটা ক্যালপল ৬৫০ কিনলাম। এক প্যাকেট পনির, একটা ক্যাডবেরি’জ ডেয়ারি মিল্ক নিলাম মেয়ের জন্য, নিজের জন্যে এক প্যাকেট সিগারেটও। এরপর তালা খুলে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে এক-এক করে সব নাম মনে পড়তে লাগল। এমনকী কেরোসিনের মাসির বরের নাম যে দিলীপ ছিল তাও নির্ভুল মনে পড়ল। ঘরে ঢুকে পা ধুয়ে চেয়ারে বসতেই মনে পড়ে গেল কয়েক বছর আগে ভালদেররামাকে এক বিকেলবেলা দেখেছি বারুইপুর স্টেশনে চায়ের দোকানে। এখন আর বাজনা বাজায় না। সকাল-সন্ধে চায়ের দোকান চালায়। সঙ্গে বিস্কুট, কেক। ছিমছাম দোকান। ছোটো করে চুল ছাঁটা। আমি উস্কে দিলাম স্মৃতি। লাজুক মুখে একবার দেখল আমাকে। বলল, হ্যাঁ। আমি কথা বাড়াইনি। চা খেয়েছি বিস্কুট খেয়েছি। কয়েকটা বাপুজি কেক কিনে ব্যাগে ভরে নিয়েছি। দাম দিয়েছি তার কথামতো। হিসেব করিনি।

    ব্যবহৃত কবিতাপঙ্ক্তিগুলি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের

  • | | | | | ৬
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments