• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৫ | জুলাই ২০২৪ | বিবিধ
    Share
  • জলের মতো ঘুরে ঘুরে : শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়
    | ২ | | |



    প্রতিবিপ্লবের সকাল

    আমাদের শোবার ঘরের জানলার ঠিক সামনে চারতলা সমান নোনা গাছটি বছরে সামান্য কয়েকবারই চোখে পড়ে। বিশেষ করে যখন নিয়ম মেনে সব পাতা ঝরিয়ে ফেলে আবার সম্পূর্ণ নগ্ন শরীরে অচিরেই নতুন পাতার পোশাক জড়িয়ে নেয়। ব্যাপারটা এতটাই দ্রুততায় হয় প্রতি বছর বেশ অবাক লাগে এই নির্মোক ত্যাগ ও নবযৌবনের হাত ধরাধরি দেখতে। কিন্তু এখন তার সময় নয়। আজ সকালে শরতের মেঘভাঙা আলোয় মনে হল দিব্য হাসির হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে গাছের শরীরে। সকাল সাতটা হবে। ঘণ্টা দশেক আগে খাওয়া ঘুমের বড়ির রেশ কেটে গেছে। দু-রাত না ঘুমোনোর স্মৃতিও শরীর থেকে মুছে গেছে বলে মনে হচ্ছে। এমনিতে আমি খুব গাছপালা পশুপাখির খবর রাখি তা নয়, কিন্তু আজ সকালে হঠাৎই গাছের পাতায় তাকিয়ে মনে পড়ে গেল প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানের এক কলি— ‘হাসির মেজাজ সবার’। মাও জে দংয়ের লেখা কবিতায় সুর বসানো ‘কীসের ভয় সাহসী মন লালফৌজের’। অনুবাদ কমলেশ সেনের। উনিশশো তিরানব্বুই-চুরানব্বুই সাল থেকে না-হোক হাজারবার গানটা শুনেছি। কিন্তু এমনভাবে কখনো ধরা দেয়নি এই হাসির মেজাজ। জীবনানন্দের ‘শিকার’ কবিতায় নক্ষত্রহীন গোটা রাত মেহগনির মতো অন্ধকার সুন্দরী থেকে অর্জুনের বনে ঘুরে ঘুরে চিতাবাঘিনীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে যেভাবে সুন্দর বাদামি হরিণটি ভোরের আলো ফুটলে যেভাবে নদীর জলে নিজের শরীরটা ছেড়ে দিয়েছিল, আজ তেমন নয়। আজ মাথার ভেতর গুনগুন করছে, ‘তুষার ঝরে নিযুত শিখর/ রোদে ঝলমল/ মিন পাহাড়, মিন পাহাড়,/ মিন পাহাড় লাফিয়ে পার/ লাল ফৌজ আহা/ হাসির মেজাজ সবার। বহুদিন ভেবেছি ওটা নীল পাহাড়। তখনো মাওয়ের কবিতাটা পড়িনি। আর সবচেয়ে বেশি জোর পড়েছিল ‘কীসের ভয় সাহসী মন লালফৌজের’ ওপর। যখন নিজের ভেতরে ডুবে গেছি কোনো হতাশায়, সামনে দেওয়াল ছাড়া কিছু দেখিনি। পরের দিনগুলো কাটবে কীভাবে! কপর্দকশূন্য অবস্থায় রাত দশটায় যাদবপুর স্টেশনে। ধার-কর্জের জীবনে। কিংবা যেদিন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে এসেছিলাম শেষবার। আর দুটো সিঁড়ি উঠে গেলে ফেলে আসা ডিগ্রিটার জন্য কেউ আমাকে মূর্খ বলত না। সেসব রাতে এ-গান আমাকে খুব উদ্বুদ্ধ করেছে এমনটাও নয়। আমি বরং নিজের দিকে মুখ ফেরানো কবিতাতেই শান্ত হয়েছি চিরকাল। তবু আজ সকালে লং মার্চের গান আমাকে দুলিয়ে দিয়ে গেল। সেই ১৯৩৪-৩৫ সাল। ৬,০০০ মাইলের যাত্রা। চিয়াং কাইশেকের জাতীয়তাবাদী বাহিনীর আক্রমণে লালফৌজের আশি হাজার যোদ্ধা দক্ষিণপূর্বের ঝিয়াংশি ছেড়ে উত্তর মুখে এগিয়ে যেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ইয়েনান পৌঁছয় মাত্র আট-ন হাজার লালফৌজ। মাওয়ের কবিতাটা যেন সমগ্র যাত্রার নির্যাস :

    The Red Army fears not the trials of the Long March,
    Holding light ten thousand crags and torrents.
    The Five Ridges wind like gentle ripples
    And the majestic Wumeng roll by, globules of clay.
    Warm the steep cliffs lapped by the waters of Golden Sand,
    Cold the iron chains spanning the Tatu River.
    Minshan's thousand li of snow joyously crossed,
    The three Armies march on, each face glowing.
    ১৯৩৫-এর পার্টি কনফারেন্সে মাও এই লং মার্চকে তিনটি দিক থেকে ব্যাখ্যা করেছিলেন, লং মার্চ চিনা পার্টির ইস্তাহার, লং মার্চ প্রচার বাহিনী, কেননা এগারোটি প্রদেশের কুড়ি কোটি মানুষের কাছে তারা প্রমাণ করেছে লালফৌজই গণমুক্তির একমাত্র পথ, আর লং মার্চ এগারোটি প্রদেশে বীজ বুনে গেছে— মাওয়ের ভাষায় যে-বীজ, ‘will sprout, leaf, blossom, and bear fruit, and will yield a harvest in the future’. কিন্তু রাজনীতির গতি বড়ো একপেশে। বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে ভাবার সময় দেয় না মোটে। ধর্মের নামে যেমন হয়। মাওয়ের রাজনীতির ধারা চীন পালটে ফেলেছে কবে। তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ারে ট্যাঙ্কের সন্ত্রাসের ছবি কে ভুলেছে? হাজার দুয়েক মানুষকে হত্যার সরকারি বিবৃতি ছিল প্রতিবিপ্লবী শক্তিকে না কি খতম করা গেছে। ওই সাইকেল চালানো, রিকশা ভ্যানে বন্ধুর দেহ নিয়ে রাস্তা দিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েগুলোর ভিডিয়ো দেখে আজও আমার খতম শব্দটায় আপত্তি। লং মার্চও কি ফিউডালিজমকে ধ্বংসের নামে সন্ত্রস্ত করেনি মানুষকে? কিন্তু সত্তরের দশকে বাঙালি শেষবার স্বপ্ন দেখেছিল এই চেয়ারম্যান মাওকে ঘিরেই। দার্জিলিং জেলার রুগ্ন তেজি মানুষটি বলেছিলেন— ‘১৯৭০ সাল আসছে বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে। ভারতবর্ষের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত আলোড়িত হবে। শোষক শ্রেণিও উন্মত্ত হয়ে উঠবে। তাই ১৯৭০ সাল বিরাট সম্ভাবনার, বিরাট আঘাতের’। চারুবাবুর আঘাতের ভবিষ্যৎবাণী সত্যি হয়েছে, সম্ভাবনা আদৌ ছিল কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে তুলতে আজ ক্লান্ত লাগে বড়ো। ১৯৬৬-৬৭ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যপত্র ‘অরণি’র সম্পাদক তিমিরবরণ সিংহ যে এক কবিতায় লিখেছিলেন : ও পাগল, ও পথ তুই মাড়াসনে মাড়াসনে/ ও পাগল, পাগলামি তুই ছাড়/ ঘরে তোর মুমূর্ষু বোন/ পাগলামি তুই ছাড়/ বল তো,/ শহীদ হওয়া কি আমাদের পোষায়?’ ১৯৭১-এর ২৪ ফেব্রুয়ারি বহরমপুর জেলে আরও ষোলোজনের সঙ্গে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় তিমিরকে। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত লিখেছিলেন : ‘লোহিতচন্দনে/ সেইজন শুয়ে থাকে তীব্রসুখী— শহীদ আমার—’। বরানগর, বারাসাত, কোন্নগরে শহীদ বেদির খবর রাখে কেউ? আর গৃহযুদ্ধে নিশানের হাতছানিতে অন্য দলের যারা মেরেছে এবং মারা পড়েছে তাদের আদর্শ কী ছিল? সন্ত্রাসের প্রহর পেরিয়ে হাসির মেজাজে পৌঁছতে পারেনি বাঙালি সেই দশকে। মৃত্যুর ওপারেও নিশ্চয় তালা খোলেনি। এতদিন পরে এসব অ্যানাটমি ক্লাসে ফর্মালিনে ডুবিয়ে রাখা প্রত্যঙ্গ নেড়েচেড়ে কী লাভ? আজ একাদশী। আজকেও আনন্দবাজার দেবে না। সাতদিন পর মেয়ের পরীক্ষা শুরু। স্ত্রী মণীন্দ্র গুপ্ত আর নিজের সংসার নিয়ে গবেষণার চাপে বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে চলেছেন। উনিশ তারিখ সন্দীপন আর শিলাদিত্য সিংহরায়ের সঙ্গে দেখা হবে কলেজপাড়ায়। অরণিদা রোজ শুনতে চাইছেন আমার নতুন কোনো লেখা। আমার মতো প্রতিবিপ্লবীর ঘুম ভেঙে নোনা গাছটিকে দেখে আপন মনে হেসে দুধ চিনি ছাড়া এক কাপ চায়ের সামনে বসা ছাড়া উপায় কি!


    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে
  • | ২ | | |
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments