বাসস্টপে দেখা হয়নি কোনোদিন। এই লঝঝড়ে জীবনেও নেহাত দায়ে না পড়লে বাসের জন্য দাঁড়াইনি কখনো। কেউ বাসরাস্তায় দেখা করার কথা বহুকাল বলেনি। অনেক দিন আগে, নেহাতই কম বয়সে, গ্রাম থেকে যখন ফিরছি শহরের দিকে একজন সবার চোখ এড়িয়ে পিছু-পিছু ন্যাড়া বাসস্টপ পর্যন্ত এসেছিল। তার বয়সও আমারই মতো, কিন্তু তার মুখটা মনে নেই। সেদিন ফুচকাওলার ময়লার ঝুড়িতে বেমক্কা হাওয়া লেগে অনেক শালপাতা উড়ে গেছিল এটুকু মনে আছে।
বন্ধুরা ট্রেনে চড়ে গেছি এখানে ওখানে, সাইকেলে, অটোরিক্সায়। কিন্তু বাসে খুব কম। জীবনে কেবল নিয়মিত ছিল একাত্তর নম্বর। শিয়ালদায় উঠে সল্টলেক। টাকরা শুকিয়ে ওঠা গরমেও বনবিতানের অলৌকিক বিকেল দেখতে গেছি দিনের পর দিন। হাতে মুঠো করে রেখেছি বান্ধবীর গরম হাত। ফিরেছি সল্টলেক-যাদবপুর মিনিতে। এর বাইরে বাস নেই। তবু স্বপ্নে বাসস্টপ আসে। নীল-লাল নর্থবেঙ্গল বাস। রাস্তার ধারের খোড়ো চালের চা-মিষ্টির দোকান। সকালে ভেজে রাখা ঠান্ডা শিঙাড়া। আর আমার জীবনে যত না-হওয়া নৌকাখণ্ড ঘটে চলে বাসস্টপে।
একটা জলের বোতল কিনলাম। অচেনা নাম। বানানো হয় চব্বিশ পরগনার মহেশতলায়। এতক্ষণ তোমার কাঁধে মাথা রেখে বসেছিলাম। আঃ, ঘুম। জিভে স্বাদ গেছে, তবু একটা গন্ধে মাতোয়ারা মন। জলের বোতলের গায়ে তারিখ খুঁজি, এক্সপায়ারি ডেট। কিস্যু নেই। মহেশতলায় কারমোজাইমের কারখানা আছে, বড়ো-বড়ো ওয়্যারহাউস আছে, লোহার কারখানা, ঘরে-ঘরে প্যান্ট সেলাই, নালায় বিষাক্ত অ্যাসিড। কিন্তু জল নেই। মানে ছিপি খুললেই আমার এতকালের জ্বর সারিয়ে দেবে এমন জলের বোতল তো তৈরি হয় না সেখানে। এদিকে আমার নৌকা ভাসাতে আস্ত নদী চাই। তাই বিরক্ত হয়ে ছিপিটা একটানে খুলে ফেলে বোতলটা দিয়ে দিলাম বাসস্টপে আমার পাশের বেঞ্চিতে বসে থাকা ভিখিরিটাকে। সে খানিকক্ষণ আমার দিকে আহাম্মকের মতো তাকিয়ে থেকে তারপর ঢকঢক করে নিমেষে জলটা শেষ করে আমাকে কৃতার্থ করার মতো মুখ করে খালি বোতলটা ফের বাড়িয়ে ধরল আমার দিকে। আমি কথা বাড়ালাম না। উঠে গিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিলাম বোতলটা। এতক্ষণ খেয়াল করিনি তোমার হাত ধরা শিশুটিকে। ও কি তোমার মেয়ে? ছেলেও হতে পারে। এত কম বয়সে হঠাৎ করে ঠাহর করা যায় না। তোমার হাত ধরে তোমার শিশুটি, সে বেলুন চায়। যদিও বাসস্টপে কোনো বেলুনওলা নেই। আমার নৌকাখণ্ডে একজন ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর আছে। সিড়িঙ্গে চেহারার ড্রাইভারটা কেবলই বিড়ি খায়। কন্ডাক্টরের ঝোঁক নিজের দিকেই। একমনে বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ডান হাতের বুড়ো আঙুলের নখ সাফ করে চলেছে। যেন অনেক কালের ময়লা জমে আছে। পাশের বিশাল ঝিলটায় তিরতির করছে জল। আমার মনে হল লোকটাকে বলি একটা ডুব দিয়ে আসুন। কিন্তু কেমন একটা সংকোচ হল। হঠাৎ জোর আওয়াজ, বৃষ্টি এল না কি? না না, কৃষ্ণনগর থেকে বাস এল একটা। কিন্তু কোনো লোক নামলও না, কেউ ওঠারও ছিল না। বাসস্টপে আমরা চারজন— আমার পাশের ভিখিরিটা হাঁ করে ঘুমিয়ে পড়েছে, তোমার শিশুটি, তুমি চশমা খুলে ব্যগে রাখলে আর আমার প্রবল তেষ্টা। আমার কয়েকটা লাইন মনে পড়ে গেল হঠাৎ :
তোমার নদী জলে নৌকো ভাসাবারতুমিও বেশ শান্ত যেন, কথা বললে না তো একবারও। আমি লুকিয়ে তোমার আঙুলের ডগায় হলুদ-মশলার দাগ দেখেছি। আমি কি অনুমতি চেয়েছিলাম তোমার কাঁধে মাথা রাখার আগে? বিব্রত তুমি? তোমার কণ্ঠস্বর একবারও শুনলাম না। আমি যত শৃঙ্খলা ভেঙেছি জীবনে যত প্রশ্রয় দিয়েছি নৈরাজ্য, তুমি ততই শান্ত হয়ে গেলে যেন। তুমি উঠে গিয়ে জলের ধারে একা হেঁটে এলে খানিক, তোমার শাড়ির নীচে চোরকাঁটা। শিশুটিকে দেখছি না। ঘাড় বেঁকিয়ে একবার আমাকে দেখলে এক মুহূর্তের জন্য, ফের হাঁটতে লাগলে একা। আমি জানি স্মৃতিকে শরীর দিতে নেই—
ইচ্ছে জেগেছিল শ্রাবণে,
তখনই ছারখার খরার খর রোদে
বিশাল জনপদ শুকনো
কে হবে মেঘদূত? বলবো কাকে ডেকে
এ ভাষা তুলে নাও ওষ্ঠে।
কোথাও মেঘ নেই, মেঘেরা চাকরির
দস্তখৎ মেনে মৌন।
যত দূরে ততো দূরে থাকোকিন্তু আমার স্বপ্নে কোনো চন্দনের বন নেই, বাসস্টপ আছে। বিপন্ন পরকীয়া নেই, সব লণ্ডভণ্ড স্মৃতি আছে। কিংবা যা হতে পারত, হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কোনোদিন বুঝতেই পারিনি সহজ কথাগুলো। সহজ কথাগুলো চিরকাল অবহেলা করে-করে এই রাত সফর শুরু করার আদৌ কোনো অর্থ নেই। কিন্তু আমি নাচার। আমার নৌকাখণ্ডের পাত্র-পাত্রী এবং বাকি কুশীলব হাজির, কেবল নদীটির পথ বলে দেয়নি কেউ। আমি ‘পৃথিবীর নদী গাছ পাহাড় পাথর/ সকলের কাছে যাই, বসি, থাকি, বিনিময় করি/ তাদের হাতের সেঁকে শোক থেকে সেরে উঠি, তবু’ অতিথিশালার খুব কাছেই যে নদীটির কথা জানতাম তাকে খুঁজে পেলাম না কোনো দিন। সেই যে ঘাটের গায়ে গিয়ে নৌকার পাশটা ঠেকেই আবার ধাক্কা লেগে পিছু হটবে একটুখানি, তারপর ফের ধীরে গিয়ে লাগবে ঘাটের সমান। দুটো চারটে লোক উঠবে, সাইকেল নিয়ে কেউ। হয়তো নতুন বর-বউ, বিয়ে হয়েছে গত রাতে। নৌকা ফের ঘাট ছেড়ে খানিকটা পাড়ের সমান্তরালে এগিয়ে মাঝ নদীর পথে পাড়ি দেবে। যতক্ষণ না আসছে পরের ঘাটটা। আমি ঘাটগুলোর নাম আজ আর মনে করতে পারি না। শুধু শুরু আর শেষটুকু ছাড়া। তোমাকেও তো একভাবে পাইনি। কখনো মনে হয় সদ্য দেখা হয়েছিল, কখনো মনে হয় রোজ দেখছি, কখনো মনে হয় প্রায় তিরিশ বছর পেরিয়ে গেছে। একটা দুটো করতে-করতে আমার পাকা দাড়ি-চুল ইদানীং প্রৌঢ়ত্বের গায়ে ঢলে পড়েছে। এদিকে তোমার বয়স বিলকুল সেই রকম। সেই যখন আমার পৌঁছতে একটু দেরি হলে ঘন-ঘন ঘড়ি দেখতে। রাগ চড়ত, নাকের পাটা ফুলিয়ে কথা না-বলে রাজাবাজার মোড় পর্যন্ত হেঁটে যেতে পাশাপাশি। আমি ‘জলের উৎকণ্ঠা নিয়ে মাটির গভীরতম মূলে/ জরা-খরা শোকতাপ পৃথিবীর মতই প্রাচীন’ মানুষটির মতো হেঁটে গেছি। তুমি কত অনায়াসে বুনে গেছ লাল উলের গোলা। ময়দানের পেট চিরে যাওয়া ট্রামের জানলায় দেখেছি অনেক নীল প্লাস্টিকের ড্রাম গড়িয়ে কলকাতায় নামছে হুগলি সেতুর গড়ানে রাস্তায়। বাবুঘাটের বাসস্টপ স্বপ্নে আসে না, আসে না প্রয়াগ রেস্টুরেন্ট। শুধু একাত্তর নম্বর আর ঠা ঠা দুপুর। কাল অবশ্য আকাশ মেঘলা ছিল। তোমার হাতে ছিল শিশুটির আঙুল। লোহার গেটের পাশটাতে গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা। তোমার মুখটা একটু ফোলা, যেন দুপুরে ঘুমিয়ে উঠেছ টইটম্বুর। তার আগে ভাত খেয়েছ সময় নিয়ে। স্নান? এখনও কি অনেকটা সময় লাগে? ‘তুমি তো মেঘালয়ে, নিজের উদ্যানে/ ঝরনা জলে স্নান নিত্য।/ আমার নৌকোর হাজারো ভুল ত্রুটি/ তা ছাড়া হাওয়াও শত্রু।’ আমার ভেঙে গেছে সপ্ত ডিঙা। চোরা স্রোতে মুছে গেছে অতীত এবং বর্তমান। আমার রাত দীর্ঘ হচ্ছে শুধু। বাচ্চা ছেলের মতো আমি স্বপ্ন-প্রত্যাশী হয়ে থাকি সারা দিন। দিনমানে হট্টগোলে তোমাকে চাই না। নিরালায় বাসস্টপে উজ্জ্বল দিনে আমার স্বপ্নেরা রঙিন হয়। ভলকে-ভলকে বাসের যাতায়াত হঠাৎ দূরের লাল আলোয় থেমে গেলে কলকাতায় বসেও সমুদ্রের গর্জন শোনা যায় এত স্তব্ধতা রবীন্দ্রসদনের পুবদিকের বাসস্টপে, দুপুরবেলা। আমার বয়স কমে। স্বপ্ন বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত একটা বাস আসে, আমায় উঠতে হবে। তুমি রয়ে গেলে নীচে রাস্তায়। পাদানি বেয়ে উঠে দেখি আমার বসার সিটে বমি করে রেখেছে বাসস্টপে আমার পাশে বসে থাকা সেই ভিখিরিটা। যে আমাকে খালি জলের বোতল ফেরত দিয়ে কৃতার্থ করেছিল।
যে যার ঠিকানা যাই ভুলে
দৈনন্দিনে এলে না যখন
কদাচিৎ ভ্রমণের বন
ইচ্ছে হলে রাঙিও শিমূলে।
ব্যবহৃত কবিতাগুলি পূর্ণেন্দু পত্রীর।