• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • চানশাল ঘাটীতে বুড়োবুড়ি : রাহুল মজুমদার



    পুজো পেরোতেই পা সুড়সুড়

    পুজো পেরোতেই কুঁজোর চিত হয়ে শোয়ার রোগটা নিয়ম মেনে চাগাড় দিয়ে উঠল। অবশ্য টিকিটপত্তর, হোটেল বুকিং টুকিং Global Destination-এর সুমিতের দৌলতে মাস চারেক আগেই সারা ছিল।

    অতএব ১৫ অক্টোবর ২০২৪, লক্ষ্মীপূজার আগের রাতে নেতাজী (এক্সপ্রেস)-র পেটে বসে রওয়ানা দিল বুড়োবুড়ি। বাইরের গরম 'ঠান্ডা কামরার' বাইরেই গুমরোতে থাকল। রাত দশটা থেকে পরের গোটা দিনটা আর প্রায় পুরো রাত মুঘলসরাই, মানে ইয়ে দীনদয়াল উপাধ্যায়, কানপুর, ইলাহাবাদ, থুড়ি, এখন তো সে প্রয়াগরাজ, পুরোনো দিল্লী হয়ে মাত্তর তিন ঘন্টা লেটে বুড়োবুড়িকে চণ্ডীগড়ে পুরোনো কালকা মেল পুরোনো রোগ বজায় রেখেই ভোর পৌনে চারটেয় নামিয়ে কালকার দিকে দৌড় লাগাল।

    চানশাল নামটা বেড়ুয়ে বাঙালির কাছে হিব্রু মনে হলেও হতে পারে, ট্রেকাররা কিন্তু চানশাল ঘাটীকে চেনেন অনেকদিন ধরেই। শিমলা জেলার সবচেয়ে উঁচু (৩৭৪৯ মি.) এই গিরিবর্ত্ম পেরিয়ে ডোডরা ক্ওয়ার হয়ে রুপিন ঘাটী পেরিয়ে চলে যাওয়া যায় নৈটেয়ারে ট্রেক করে। বছর কয়েক আগেও টিক্করি থেকেই আরম্ভ হতো পায়ে হাঁটার পালা। এখন বছরে কয়েক মাস গাড়ি, এমনকী বাসও চলে ডোডরা ক্ওয়ার অবধি।

    গাড়ি চলে, এই ভরসাতেই বুড়োবুড়ির এ পথে পাড়ি জমানোর পরিকল্পনা। চণ্ডীগড়ে চতুর্চক্রযান নিয়ে অপেক্ষা করার কথা ঋষভের। তাকে ফোন করে নিজেদের আগমনবার্তা জানাল বুড়ো।

    স্টেশনের বাইরেই গাড়ি নিয়ে রেডি ছিল ঋষভ। গাড়িস্থ হতেই সে চলমান হলো। আঁধার তখন সবে সরে পড়ার আঁটঘাট বাঁধছে।

    রাতবিরেত যখনই হোক, বাঙালি চায়ের কাঙাল। বুড়োবুড়ির কাঙালপনা টের পেয়ে রাত ফুরোনোর আগেই ঋষভ গাড়ি থামাল। হাতে (বানানো) গরম চা শেষ রাতের ঠান্ডাকে খানিক শায়েস্তা করার পর গাড়ি আবার ফাগুমুখী। লক্ষ্মীপূর্ণিমার বিশাল হলদেটে চাঁদ অবাক হয়ে বুড়োবুড়ির সীটে হেলান দেওয়া দৌড় দেখতে দেখতে ডুব দিল; এগিয়ে এলো দিন। তমোঘ্ন-র সোনালী কিরণে সওয়ার হয়ে সকাল এলো। সেই আলোয় উদ্ভাসিত হলো চরাচর। দু দুটো টানেল পার করে শিমলাকে বাইরে থেকেই বেড় দিয়ে পেরিয়ে স্নিগ্ধ সূর্যকিরণে স্নান করতে করতে একসময় কুফরি পার করে ফাগুতে এসে টুক করে ডানদিকের একটা মাইক্রো চড়াই চড়ে HPTDC-র HOTEL APPLE BLOSSOM-এর আঙিনায় এসে দম নিল ঋষভের গাড়ি। হোটেল দেখেই বুড়োবুড়ির দিল খুশ। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে ঘর দেখে খুশী দু গুণ হয়ে উঠল। যেমন সুন্দর হোটেল, তেমনই সুন্দর সকলের ব্যবহার। শীতকালে বরফে খেলাধুলো করতে লোকজন ভীড় জমায় এখানে; এখন তুলনায় অনেকটাই নির্জন।



    জানালার ধারে বসে চা খেতে খেতে নিচের চত্বরে আসন্ন কোনও বিয়ের প্যান্ডেল বাঁধা দেখতে দেখতে চোখ পাড়ি জমাচ্ছে পিছনের পাহাড়ের সারির দিকে, ঘননীল আকাশে ঈগল আর দ্রিঘাংচুদের চক্কর মারার দিকে। এত আনন্দের মাঝে একফোঁটা বিষাদ — বুদ্ধির ঢেঁকি বুড়ো আবিষ্কার করল, তার পেন্টুলেরা বাড়ির আলমারিতে আরামে ঘুমোচ্ছে। অতঃ কিম! মুশকিল আসান হয়ে দেখা দিলেন হোটেলেরই একজন; অযাচিতভাবে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে স্থানীয় দোকান থেকে কিনিয়ে দিলেন — সহজেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেল — কলকাতার থেকে অনেক কম খরচে।

    বাকি দিনটা বুড়োবুড়ির কাটল আরাম আর আলস্যের সঙ্গে দোস্তী করে।

    ফাগু থেকে রোহড়ুর পথে হাটকোঠি

    পরদিন সূর্যকিরণ জানালায় টোকা দিয়ে জানিয়ে দিল, উঠতে হবে, বুড়োবুড়ির আজ রোড টু রোহড়ু। এমন জায়গা ছেড়ে যেতে মন খুব একটা না চাইলেও ছাড়তেই হলো। বিদায় জানিয়ে এক ঝাঁক আন্তরিক হাসিমুখ দেখে ঋষভ ভরসায় বেরিয়ে পড়ল বুড়োবুড়ি। পথও মনকাড়া সৌন্দর্যের খনি। আলোছায়া মেখে মসৃণ পথ ধরে একরকম উড়ে চলা। সকালের রোদমাখা ছোট ছোট বসতি, মন্দির প্রকৃতির বুকে যেন কয়েক টুকরো মণিমুক্তো। ঋষভের হাতে গাড়ি যেন কথা বলছে।

    একসময় পেরিয়ে এলাম খড়াপত্থর। আগের চেনা খড়াপত্থরের আঙিনায় এবার বুড়োবুড়ি থাকবে ফেরার পথে। সূর্য এখন প্রায় মাঝগগনে; দু সারি বাড়ি আর দোকানের মাঝ দিয়ে গাড়ি এসে দাঁড়াল হাটকোঠির মা হটকেশ্বরীর মন্দিরের দোরগোড়ায়।

    এই সুপ্রাচীন মন্দিরে অধিষ্ঠিতা মা হটকেশ্বরী মহিষমর্দিনী দুর্গা। লোকবিশ্বাস, এখানেই হয়েছিল মহিষাসুর বধ। ৮ম/৯ম শতকের এই মন্দিরের গঠনশৈলী, পরিবেশ ভক্তি আর শান্তির উদ্রেক করে। প্রথা অনুযায়ী, জুতো আর চামড়ার বেল্ট ইত্যাদির মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ; তার জন্য ব্যবস্থাও অবশ্য রয়েছে। হাটকোঠির মানুষজনও খুব সরল — এক সদ্যতরুণ নিজের থেকেই এগিয়ে এসে হুইলচেয়ার এনেই শুধু দিল না, সমস্তক্ষণ সঙ্গে নিয়ে সমস্তটা ঘুরিয়ে দেখাল! সঙ্গে রইল ঋষভ। মন্দিরে দক্ষিণার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই; চরণামৃত, প্রসাদ সকলেরই প্রাপ্য। বেশ কিছুক্ষণ এই মন্দিরে কাটাতে পুণ্যার্থীদের, দর্শনার্থীদের আনাগোনা লেগেই আছে। বর্তমান 'অবশ্যকর্তব্য' একা, দোকা বা দল বেঁধে ছবি তোলা চলছে। সবকিছুর মধ্যেই এক অদ্ভুত সারল্য — বুড়োবুড়ির মন ভালো হয়ে গেল।





    অলংকরণ (Artwork) : স্কেচঃ লেখক
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments