• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ১০০ | অক্টোবর ২০২৫ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • চানশাল ঘাটীতে বুড়োবুড়ি (৩) : রাহুল মজুমদার


    লরোটে ভোর এলো চুপিসাড়ে, নরম আলো নিয়ে। ছ-টার সময় আলোর ছটা নিয়ে পূষণদেব লরোটকে দিনের প্রথম আশীর্বাদ বিতরণ করলেন। সকালবেলা আলো ঝলমলে লরোটকে আরও সুন্দর লাগছে। সাতটার আগেই বুড়োবুড়ি হাতে গরম চা পেয়ে গেল বাড়ির বৌমার হাসিমুখের সঙ্গে। সাড়ে সাতটার মধ্যে আমাদের সারথি ঋষভও উঠে পড়ল। আজ বুড়োবুড়ি চানশাল ঘাটী থেকে ঘুরে আসবে। ন-টা বাজিয়ে ব্রেকফাস্টে পেট ভরিয়ে সোনালী রোদের ওম গায়ে লাগিয়ে বুড়োবুড়ি রওনা দিল চানশাল ঘাটীর উদ্দেশে। আঁকাবাঁকা পথে দু কিলোমিটার চড়ার পর এলো ক্যাম্পসাইট। সীজনে নাকি এখানে তাঁবুর মেলা লেগে যায়। পথের দু ধারে খাড়া দাঁড়ানো আখাম্বা গাছগুলো কখনও জোট বেঁধে গল্প করছে, কখনও আবার দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আড়চোখে পরস্পরকে দেখছে। তাদের ফাঁকে ফাঁকে ছোট গাছ আর ঝোপঝাড়েরা জায়গা করে নিয়েছে। সকলেই সকালের ইষদুষ্ণ রোদে সকাল সকাল স্নান সেরে নিচ্ছে। এর মাঝে মূর্তিমান আপদের মতো দুই বুড়োবুড়ি ঋষভকে সঙ্গী করে ওদের হামামে ঢুকে পড়েছে। ওদেরই অভিশাপেই মনে হয় দূর আকাশে অন্নপূর্ণা, মাছাপুছারেরা বুড়োবুড়িকে দেখা দেবে না ঠিক করে মেঘে মুখ ঢেকে রইল। উচ্চতা বাড়ছে, বড় গাছেরা থেমে গিয়ে রডোডেনড্রনদের জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে। মার্চ-এপ্রিলে এ জায়গাটা রডোডেনড্রন ফুলে রাঙা হয়ে থাকবে। বারো হাজার ফুট ছাড়াবার কিছুক্ষণ পরে একটা বাঁকে এসে রডোডেনড্রনেরাও বেঁকে বসল ; তারা আর যেতে রাজি নয়। পথ প্রথম থেকেই ছিল মাটির। পাহাড়ের প্রায় মাথায় উঠে পাহাড়ের মাথা এখন ন্যাড়া হওয়ার পর প্রথম গজানো খোঁচা খোঁচা চুলের মতে সবুজ, পাঁশুটে ঘাসে ছাওয়া হওয়ায় হাওয়ার দাপট যথেষ্ট। তাই পথের ধুলো মাঝেমধ্যেই ঘূর্ণি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ১২৩০০ ফুটে (৩৭৪৯ মি.) পৌঁছতেই পথের ধারের বোর্ড জানিয়ে দিল, এসে গিয়েছে বুড়োবুড়ির এবারের লক্ষ্য চানশাল ঘাটী। পাহাড়ের প্রায় মাথায় হওয়ায় নজর অবাধে ছুটছে দিগন্ত অবধি।ঢেউয়ের পরে ঢেউ তুলে পাহাড়ের দল নীল দিগন্ত ছুঁয়েছে। প্রায় ন্যাড়া হলদেটে সবুজ থেকে গাঢ় সবুজ,তারপর নীলচে সবুজ হয়ে নীল আকাশে গিয়ে মিশেছে। যেখানে বুড়োবুড়ি গাড়ি থেকে নেমেছে, সেখান থেকে সবুজ জমি হালকা ঢালু হয়ে এগিয়ে আবার অল্প ওপরে উঠে একটা ছোট পাথরে গড়া মন্দিরের গোড়ায় গিয়ে থেমে, তার পরেই ঝাঁপ মেরেছে নিচপানে। তার সবুজ কার্পেটের গায়ে হেথা হোথা নানান সাইজের ছোট ছোট পাথর চুমকির মতো বসানো। বনাশীঁরা দেবের মন্দির ছোট হলেও দেবতা যে মোটেই হেলাফেলার নন, তা ওঁর মন্দিরের চারধারে নৈবেদ্যর পরিমাণ দেখলেই মালুম হয়। কোথা দিয়ে যে চল্লিশ মিনিট পেরিয়ে গেল, বুড়োবুড়ি টেরই পেল না। শনশনে হাওয়ার শব্দ ছাড়া কোনও শব্দ নেই, বুড়োবুড়ি আর ঋষভ ছাড়া কোনও মানুষ নেই (অবশ্য একটা গাড়ি হুউশ করে চলে গেল ডোডরার দিকে), অদ্ভুত নিঃশব্দ চরাচরে সময় থমকে যায়। এগারোটা নাগাদ বুড়োবুড়ি ফেরার পথ ধরল। লরোটে ফিরে এলো দেড় ঘন্টায়। বাকি দিনটা কাটল খুশিতে আলস্যে, প্রকৃতি দেখে, আপেল খেয়ে, বসে গড়িয়ে। সূর্য যখন সোনালী থেকে লালচে হতে আরম্ভ করল, বুড়ো বেরোল পাড়া বেড়াতে। পথের ধুলো এখন রাঙা আলোয় আবির সেজে বসে আছে; গাছেদের কালচে সবুজও গায়ের এখানে ওখানে সেই রাঙা আবির মেখে নিয়েছে। সেই দৃশ্যে বিভোর হয়ে বুড়ো পথ হাঁটছিল, আলো গাঢ় হয়ে নিভন্ত হয়ে আসায় ফেরার পথ ধরল। দিনের আলো নিভে যাওয়ার আগেই বুড়োবুড়ির সামনে চা-টা এসে হাজির। লরোটের শেষ রাতটা গভীর ঘুমে কাটল বুড়োবুড়ির।

    আবার সোনালী সকাল। তবে, কোথায় যেন একটু বিষাদের ছোঁয়া সেই আলোয়। এই দু দিনেই কেমন সকলে আপন হয়ে উঠেছিল। চমৎকার আলুর পরোটায় ব্রেকফাস্ট সেরে সাড়ে ন-টায় বুড়োবুড়ি উঠে বসল গাড়িতে। এত সুন্দর জায়গা, এত সুন্দর মনের মানুষদের ছেড়ে যেতে মন চাইছে না, কিন্তু যেতে তো হবেই, হয়ই।

    শিলাদেশ হয়ে নদী পেরিয়ে টিক্করী এলো পৌনে এগারোটায়, দশ মিনিটে চিড়গাঁও। সাড়ে এগারোটায় রোহড়ুকেও পেরিয়ে গেল বুড়োবুড়ির গাড়ি। ভরদুপুরে হাটকোঠি পেরোনোর পর চড়া রোদ এ সি গাড়ির জানালার বাইরেই তড়পে চলল। আধঘন্টা পরে ঋষভ গাড়ি দাঁড় করাল খড়াপত্থরের টুরিস্ট লজ গিরিগঙ্গার সামনে।

    আগে থেকে ঠিক করা ঘরে যেতে গেলে নামতে হবে একতলা। সেটা বেশ অসুবিধাজনক। তাই ঘর বদলে এই তলাতেই চমৎকার একখানা ঘর পেয়ে বুড়োবুড়ির জান তররর্ হয়ে গেল। বাড়তি ভাড়ার তাড়ায় পকেটে টান। সেটা সামলাতে বুড়োকে কটকটে রোদ্দুর সামলে এ টি এম বাবার শরণাপন্ন হতে হলো। পকেট শান্ত মানে মন শান্ত। শান্ত মন নিয়ে বুড়ো খড়াপত্থর বাজারে এসে প্রথমেই খড়াপত্থর দেবীর মন্দিরে পেন্নাম ঠুকল। তালাবন্ধ কোলাপসিবল্ গেটের আড়াল থেকে সর্বাঙ্গে জরির কাজ করা লাল চেলি জড়িয়ে মা দুর্গা সে পেন্নাম পেলেন কিনা বোঝা গেল না। ফেরার পথে খড়াপত্থরের একমাত্র খুদে 'জুয়েলারি শপ' থেকে বুড়ির জন্য একটা রুপোর আংটি নিল ঘুষস্বরূপ। লজে ফিরে শান্তি শান্তি শান্তি আরাম।





    অলংকরণ (Artwork) : স্কেচঃ লেখক
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments