It is in the thick of calamity that one gets hardened to the truth - in other words, to silence.“রুডি কবে বাড়ি আসবে? ও তো বেশ ভালোই আছে তাই না?” টেবিলে একরাশ ব্রেকফাস্ট সাজাতে সাজাতে অপর্ণা বলল। সকাল এখন দশটা, ওদের খোলামেলা রান্নাঘর আর খাবার জায়গাটা রোদ্দুরে ভেসে যাচ্ছে এখন, টাটকা কফির গন্ধে ম-ম করছে বাতাস।
“নিপু, পেশেন্টকে ডিসচার্জ করার জন্য আমাদের কতগুলো প্রোটোকল আছে। অন্তত দুটো নেগেটিভ কোভিড টেস্ট আর একটা পজিটিভ অ্যান্টিবডি টেস্ট হলে সবথেকে ভালো। এসব শেষ করতে করতে এখনও কয়েকটা দিন লেগে যাবে তবে ও খুব তাড়াতাড়ি ইমপ্রুভ করছে, চিন্তার কিছু নেই।” সুগন্ধ স্যান্ডউইচে দাঁত বসিয়ে উত্তর দিলো রন। ব্রেকফাস্টের পরে হাসপাতালে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে সবাই। আজকে রোহন আর অপু রুডির সঙ্গে দেখা করতে যাবে। অনেকগুলো নিয়মকানুন বেঁকিয়ে ব্যবস্থাটা করতে পেরেছে রন। এরই মধ্যে এম-১২১৯ ট্রায়ালের খবরাখবর বাজারে বেরিয়ে গেছে, সেই নিয়ে চতুর্দিকে হইহই।
গাড়ি চালাতে চালাতে রন বুঝতে পারলো একদিকে যেমন গভীর ক্লান্তিতে ওর ভেতরটা চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়তে চাইছে, আবার অন্যদিকে ঠিক তার পাশেই দাউদাউ করে জ্বলছে উত্তেজনার ফার্নেস। ও জানে যে কাজটা ঠিক করে শেষ করার জন্য ওর বস্টনে ফিরে যাওয়া এই মুহূর্তে একান্তই দরকারি কিন্তু এখানে সবাই মিলে এমনি চেপে ধরে আছে, যেন ও প্লেনে উঠলেই রুডি আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে।
ম্যাক্স আর মিরিয়ম দিনরাত্রি ট্রায়াল নিয়ে পড়ে আছে। বলতেই হবে যে ওর মতন দক্ষ অ্যাসিস্ট্যান্ট পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, কয়েক ঘণ্টা অন্তর প্রতিটি রিপোর্ট ও নতুন করে পাঠিয়ে চলেছে। তার সাথে সাথে টুকরো টুকরো মজার কমেন্ট যেগুলোর দিকে তাকালেই মন খুশি হয়ে ওঠে। তাও মনের পিছনে অস্বস্তি যায় না। বড্ড জুনিয়র যে মেয়েটা। বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ বড্ডই পিছল রাস্তা, একে তো তার বাঁকে বাঁকে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির রাঘব বোয়ালেরা ওঁত পেতে আছেন, আবার তার চেয়েও বড়ো বিপদ গবেষকের ব্যক্তিগত নাম কেনার প্রবণতা। এদেশের অ্যাকাডেমিক জগতে একটা কথা আছে- পাবলিশ অর পেরিশ। পাবলিশ করার তাগিদে ভুল তথ্য চালিয়ে দেবার উদাহরণ বিরল নয়।
ম্যাক্সের ফোন। অধীর আগ্রহে যন্ত্রটা কানে লাগাল রন।
“কেমন চলছে কাজকর্ম?” উদ্বিগ্ন গলায় বলল রন।
“এখন অবধি সব কিছুই ঠিকঠাক। তুমি তো ডাটাগুলো নিজেই দেখেছো। চিন্তা নেই মিমি সব কিছুর চার্জে আছে।” ম্যাক্সের গলায় উৎসাহ যেন ফেটে পড়ছে।
“হ্যাঁ সে তো দেখতেই পাচ্ছি। ও একলা হাতে আর কি কি সামলাচ্ছে সেটাই চিন্তার বিষয়।”
“হা-হা। ইউ টেক কেয়ার ওল্ড চ্যাপ। হোপ ইয়োর ব্রাদার-ইন-ল গেটস বেটার।” ফোন রেখে দিল ম্যাক্স। এর মধ্যেই ওরা হাসপাতালে পৌঁছে গেছে। সেই প্রাচীন নাইটদের বর্ম শিরস্ত্রাণ এবারে ওদের সামনে এসে হাজির।
“ডাক্তারমেসো, এগুলো রিয়ালি কমপ্লিকেটেড। বুঝিয়ে দাও।”
রোহন খুবই উত্তেজিত, এই প্রথম বাবার সঙ্গে দেখা হবে ওর! গ্লাভস, মাস্ক আর গাউনে ওকে মুড়ে দিতে দিতে নানান সাবধানবাণী শোনাতে লেগে গেল রন- এইটা করবে, ওইটা করবে না।
রুডি বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। ওকে আগের থেকে ভালো দেখাচ্ছে অনেকটাই।
“ভালো আছি রে। মা কোথায়?” ফ্যাঁসফেঁসে গলায় উত্তর দিলো রুডি। ওর চোখ অশান্ত, একবার রোহন আর একবার রনের চোখের মধ্যে সেটা ঘুরপাক খেয়ে মরছে। সেই দৃষ্টির মধ্যে নানান প্রশ্নের আনাগোনা।
“মা আসবে এক্ষুনি। তোমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না তো বাবা?
“না রে, কোন কষ্ট নেই। তোদের কতো অসুবিধা হল বলতো,” হাসার চেষ্টা করলো রুডি।
“কারো কিচ্ছু অসুবিধা হয়নি, এমনিতেই সবকিছু বন্ধ আছে। তুমি ভালো হয়ে ওঠো বাবা, উই হ্যাভ আ লট টু ক্যাচ আপ,” রোহন উত্তেজিত এখন। বাবা আর ছেলের প্রাক্তন যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যিখানে বিরাট একটা সাদা পতাকা উড়ছে এখন।
“উই শিওরলি ডু,” রুডি বলল, ওর ঠোঁটের ওপরে হাসিও খেলে গেল এক ঝলক, কিন্তু তারই মধ্যে ওর এক ঝলক দৃষ্টি দ্রুতবেগে রনের দুচোখ ছুঁয়ে ফিরে এল আবার। ও দূরের খবর চাইছে, কিন্তু একই সাথে কাছের এই নতুন বাস্তবতাকে ঠেলে সরিয়ে দিতেও পারছে না।
“রোহন তুই যা এবার, মা কে একটু আসতে দে। একজনের বেশি ভিজিটর একসঙ্গে অ্যালাউড নয়। ডক্টর রাঘবন বাইরে আছেন, উনি তোদের হেল্প করবেন।” একটু আচমকাই বলে উঠলো রন।
“ঠিক আছে ডাক্তারমেসো। সি ইউ বাবা, গেট ওয়েল অ্যাজ ফাস্ট অ্যাজ ইউ ক্যান।” তড়িঘড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো রোহন। বিশ্বাস, আবার সেই বিশ্বাসের গল্প। বেচারা!
“বস!”
“রুডি কম্পোজ ইয়োরসেলফ। ব্যাড নিউজ। শী ইজ ডেড।”
“সেটাই ধরে রেখেছিলাম। খবরটা কনফার্ম করার জন্য ধন্যবাদ। আরেকটা অনুরোধ করতে পারি?”
“যা বলার তাড়াতাড়ি বলো রুডি।” দাঁত চেপে বললো রন।
“ক্যান ইউ সিকিওর মাই ফোন অ্যান্ড কম্পিউটার?”
“আই উইল ট্রাই রুডি। নাউ রিল্যাক্স।”
রিল্যাক্স অসম্ভব জেনেও কথাটা বলল রন। পার্সোন্যাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট গায়ে চড়াতে আর খুলতে কিছুটা সময় তো লাগবেই। পনেরো মিনিট বড়ো জোর, তারপরেই ঘরে ঢুকবে অপু। পুরো দুই সপ্তাহ পরে, এতখানি যমে মানুষে লড়াই চলার পরে দেখা হবে দুজনে। মাত্র পনেরো মিনিট। তারই মধ্যে যা বলার বলে ফেলতে হবে ওকে, কিন্তু এসব কথা বলার থেকে শোনা কম কঠিন নয়।
“ওর নাম জাই কু, ও আমাদের বায়োটেক কোম্পানির রিসার্চ নার্স ছিল। যা ভাবছো, তা নয় বস, শী ওয়াজ নট মাই লাভার। লোকজন যখন অসুস্থ হতে শুরু করলো, ও অথরিটিকে জানিয়েছিল, কেউ ওর কথায় পাত্তা দেয়নি। ভাগ্যিস আমাকে জোর করে ফেরত পাঠিয়েছিল, নাহলে হয়তো চীনা হাসপাতালেই আমার গতি হতো, তোমরা আমার হদিশও পেতে না। জাই আমার বন্ধু ছিল বস, এ ঠিক কিরকমের বন্ধুত্ব আমি বুঝিয়ে বলতে পারবো না।”
“বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। আমি জানি।” ফিসফিস করে বলল রন।
“আমরা কেসগুলোর একটা ফাইল তৈরি করেছিলাম। উই ওয়ান্টেড টু রিপোর্ট টু ডব্লিউ-এইচ-ও। মাঝখান দিয়ে সব গণ্ডগোল হয়ে গেল। আমাকে ওরা অ্যারেস্ট করার হুমকি দিলো হঠাৎ- দি চার্জ ওয়াজ অ্যাডাল্ট্রি অ্যান্ড ইমমরাল বিহেভিয়ার। শেষ মুহূর্তে জাই আমাকে আমেরিকান এমব্যাসিতে পৌঁছে দিয়েছিল। কিন্তু দেখাই যাচ্ছে যে ও নিজে পালাতে পারেনি। আই থিংক সামবডি বিট্রেড হার। সামবডি উই নো।”
“ওই এলাকার অনেকেই পারেনি রুডি। দে ডায়েড লাইক ফ্লাইজ। তুমি এখন ওই সময়টা থেকে মন সরাবার চেষ্টা করো। পীস ইজ ভাইট্যাল ফর হীলিং।”
কয়েক মুহূর্তের জন্য সব চুপচাপ। দুজন মানুষ শান্তির সন্ধানে শূন্যের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। এর মধ্যেই ঘরের দরজাটা খুলে গেল হঠাৎ। ডক্টর ইভানভ উঁকি মেরেছেন, তাঁর সঙ্গে ছোটোখাটো চেহারার আরেকজন ভদ্রলোক। যেহেতু সকলের পরনেই স্পেসস্যুট তাই চেনা অচেনা ঠিক করে বোঝা দায়।
“এক মিনিটের জন্য বিরক্ত করছি, মাপ করবেন। ইনি ডক্টর রিচার্ড শী, ডবলিউ-এইচ-ও থেকে এসেছেন। চায়নার এপিসেন্টারে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা উনি রেকর্ড করে রাখতে চান।
রিচার্ড শী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্লিনিক্যাল ইনভেস্টিগেটর। খুবই অপ্রস্তুত হয়ে মগজের এখানে-ওখানে হাতড়াতে শুরু করলো রন। ভদ্রলোকের চোখ দেখে মনে হচ্ছে পরিচিত, কিন্তু ঠিক করে মনে আসছে না কিছুই। শালা, এই উৎকট সময় ঠিকঠাক কারো মুখ দেখারও উপায় নেই।
“হ্যালো ডক্টর চ্যাটার্জি, আমাকে মনে করতে পারছেন?” অ্যাকসেন্টে শুনে বোঝা যায় যে ভদ্রলোক চীনদেশীয়।
“বস, প্লীজ স্টে!” রুডির ফ্যাঁসফেঁসে গলা আরো অস্বাভাবিক শোনালো হঠাৎ। রন ইতস্তত করলো।
“মাপ করবেন, ডক্টর চ্যাটার্জি কিন্তু আমি কি পেশেন্টের সঙ্গে কিছুটা সময় একলা থাকতে পারি? আসলে এই প্যানডেমিকের সঠিক উৎস নিয়ে অনেক জল ঘোলা হচ্ছে তো। কথা দিচ্ছি পাঁচ মিনিটের বেশি লাগবে না।” বিনয়ের অবতার হয়ে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে পড়েছেন শী। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাইরে বেরিয়ে এলো রন। মনের মধ্যে কি যেন একটা খচখচ করছে। হাঁটতে হাঁটতেই ফোনটা বার করে নম্বর ডায়াল করলো একটা।
“মিমি একটা খবর চাই। ডব্লিউ-এইচ-ওতে রিচার্ড শী নামে কোনো ইনভেস্টিগেটর আছে কিনা, এবং থাকলে সে এখন কোথায়, তার অ্যাসাইনমেন্টই বা কি?
“তোমার প্রথম প্রশ্নটার উত্তর এক্ষুনি দিতে পারি কিন্তু দ্বিতীয়টার নয়। হ্যাঁ, ডক্টর শী আমাদের দুজনেরই পরিচিত, যদিও ম্যাক্সের সঙ্গে ওঁর সম্পর্কটা অনেক দিনের। ভদ্রলোক ডব্লিউ-এইচ-ওর সিনিয়র এপিডেমিওলজিস্ট ছিলেন--” মিরিয়ম বলল। ওর গলাটা অসম্ভব ফ্রেশ শোনাচ্ছে।
“ছিলেন? এখন নেই। তাহলে এখন কি করেন উনি?” মিমির কথা শেষ হবার আগেই অধৈর্য প্রশ্ন রনের।
“আরে সেটাই তো রহস্য। বললাম না যে তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই। এটুকু জানি যে উনি এখন প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করেন, লিয়াঁজো হিসাবে। একদিকে গবেষণা, অন্যদিকে ওষুধের বাজার, তার মাঝখানে উনি।”
হঠাৎ রোহনকে দেখতে পেয়ে থেমে গেল রন। হলওয়েটা বৃত্তাকার, হাঁটতে হাঁটতে ও যেখানটায় এসে পড়েছে সেখান থেকে রুডির ঘরটা কাছেই। কিন্তু রোহন ওরকম হন্তদন্ত হয়ে চলল কোথায়?
“রোহন! কি হয়েছে? মা কোথায়?"
“বাবা কিরকম যেন করছে ডাক্তারমেসো। আমাকে বাংলায় বলল বাড়ি চলে যেতে।” উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠলো রোহন।
“বাবার ঘরে আর কেউ ছিল?”
“হ্যাঁ, আরেকজন ডাক্তার, বাবাকে একটা ফোন থেকে কিসব দেখাচ্ছিল যেন।”
“রোহন তুই সবাইকে নিয়ে বাড়ি চলে যা, এদিকটা আমি দেখছি।” বলতে বলতে দ্রুত পা চালালো রন। ঘরে ঢুকে দেখে বিছানায় একলা শুয়ে আছে রুডি, ওর চোখমুখ মৃতের মতন ফ্যাকাসে।
“আমার শরীরটা খারাপ লাগছে বস। তুমি অপুকে আসতে দিয়ো না, ও ভয় পাবে,” রুডির গলাটা জড়িয়ে গেল হঠাৎ, কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে ঝুলে পড়লো মুখের একদিক। নিমেষের মধ্যে রনের চোখ থেকে মাথার মধ্যে বিপদসংকেত ছুটে গেল, প্রতিবর্তক্রিয়ারা ঝাঁপিয়ে পড়লো অভ্যস্ত দক্ষতায়।
“কোড ব্লু কোড ব্লু! পেশেন্টের স্ট্রোক হচ্ছে!!”
রোহন, অপু কিংবা শ্রুতি, কেউই জানতে পারলো না কিছুই। হলওয়ে বেয়ে দ্রুত ছুটে চলা কিছু পদশব্দ, যান্ত্রিক গড়গড়ানি আর চাপা গলায় কিছু নির্দেশ, ব্যাস। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে রুডি আবার আই-সি-ইউয়ের কিউবিক্যালে ঢুকে গেছে, ওর শরীরের এখানে-ওখানে সাপের মতন ঢুকে পড়েছে নতুন একগাদা কেবল এবং ক্যাথিটার। শরীরের ডানদিকটা অবশ হয়ে গেছে রুডির, কথা বলার যেটুকু শক্তি ফিরে এসেছিল, তাও হারিয়ে গেছে একই সঙ্গে।
যে দিনটার শুরু হয়েছিল পুরন্ত আশাবাদ নিয়ে, অন্ধকূপ থেকে ওপরে তাকিয়ে আলোর বৃত্ত দেখতে পেয়েছিল সবাই, সেই দিনটাই আবার অতল অবসাদের মধ্যে নেমে গেল। পরিবারের সবাই ভূতে পাওয়া মানুষের মতন লিভিংরুমের এখানে ওখানে শরীর এলিয়ে দিল অসাড় যন্ত্রণায়। রন হাসপাতাল থেকে ফেরেনি, শ্রুতিকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে যে রুডির অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো, তাও রাত্তিরটা ও হাসপাতালেই কাটাতে চায়। আগের মতন এবারেও সক্কলকে বুঝিয়েসুঝিয়ে, মুখে খাবার গুঁজে বিছানায় পাঠানোর ভার শ্রুতিরই ওপর। ওর সারা শরীর যখন ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে দাদার ফোনটা এলো ঠিক তখনই, অর্থাৎ রাত এগারোটার পরে।
“বাবার কাছে সব শুনলাম। কেমন আছে সকলে?”
“বিধ্বস্ত। আসলে সবাই খুব আশা করে বসেছিল তো, তাই হঠাৎ এই নেগেটিভ ডেভেলপমেন্টটা খুব জোর ধাক্কা দিয়েছে।” ক্লান্ত গলায় শ্রুতি বলল। সারাদিন হাল ধরে থাকতে থাকতে ওরও গলায় ক্লান্তির ছোপ লাগতে শুরু করেছে এবার।
“বাবাও সেই কথাই বলছিল জানিস। অনেকক্ষণ কথা হল বাবার সঙ্গে।” কেমন যেন অন্যরকম একটা গলা ভেসে এল ওধার থেকে। অনেকটা দ্বিধা আর সমবেদনা মেশানো নার্ভাস কণ্ঠস্বর, ঠিক দাদার মতন নয় একেবারেই।
“কি বলছিল রে বাবা?” শ্রুতি একটু অবাকই হল। বাবা আর দাদা অনেকক্ষণ কথা বলেছে, এটা একটা খবর বটে।
“অনেক কথা। বাবাকে এত কথা বলতে অনেকদিন শুনিনি। মানে লেকচার নয়, জাস্ট কথা।”
একটুক্ষণের জন্য চুপচাপ। দুই ভাইবোন নিরাপদ দূরত্ব থেকে একে অন্যকে যাচাই করে চলেছে এখন। শ্রুতি জানে যে বাবা আর দাদার কথাবার্তা প্রায়ই খণ্ডযুদ্ধে শেষ হয়। মনে হচ্ছে আজ সেরকম কিছু হয়নি।
“মাম্পি, হি ইজ আ ভেরি টায়ার্ড সোল। আওয়ার ওল্ড ম্যান।”
“দাদা, আমি সেটা জানি, কিন্তু তোরই বুঝতে অসুবিধা হয়। বাবার ওপর অনেক চাপ, অনেক দায়িত্ব। একদিকে প্রফেশন, আরেকদিকে পরিবার, তাও লোকটা লড়ে যাচ্ছে, পিছু হটছে না। মেনে নিচ্ছি হি ইজ স্টাবর্ন বাট, বাট সো আর ইউ। তোরা দুজনেই সমান। যাকগে, বাবা কি বলল তাই বল?”
“বাবা বলল, এই অসুখটাকে আমরা ঠিক করে বুঝতে পারছি না, শুধু চটজলদি একটা রেমেডি খুঁজে বার করার মতলবে আছি। উই আর লুকিং ফর আ প্রফিটেবল শর্টকাট।”
“বুঝলাম না দাদা। আরেকটু বুঝিয়ে বল প্লীজ--”
“দেখ যে রোগটা প্র্যাকটিক্যালি আমাদের গ্রহটাকে অচল করে দিয়েছে, তার ওষুধ আর ভ্যাকসিন কি ধরনের মুনাফা নিয়ে আসবে চিন্তা করতে পারিস?”
“পারি, কিন্তু আমাদের সিস্টেমে ওটাই তো স্বাভাবিক তাই না? মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার। ক্যানসার, হেপাটাইটিস, এইচ-আই-ভি সব এলাকায় ওই একই নিয়ম।”
“বাবা যা বলল, তার যতটা আমি বুঝলাম, তাই তোকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। নভেল করোনাভাইরাস নামক ভাইরাসটি এমন কিছু একটা আহামরি অসুখ বাঁধায় না। অসুস্থতাটা আসে রোগীর নিজের ভেতর থেকে, বলতে গেলে সে নিজেই নিজের হাতে মারা যায়।”
“ইউ লস্ট মি দেয়ার, দাদা।”
“ইয়া, আই লস্ট হিম টু। বাবা আধা ঘণ্টা ধরে বকে গেল, মনে হয় নিজেই নিজেকে শোনাচ্ছে। তার মধ্যে যেটুকু বুঝলাম তোকে বলছি। আমাদের শরীরের নিজস্ব ডিফেন্স মেকানিজম যা কিছু আছে- যেমন ধর কেটে গেলে একসময় রক্ত বন্ধ হয়ে যায়, ইনফেকশন হলে জ্বর হয়, পা মচকে গেলে ফুলে ওঠে, ব্যথা হয়, এইসব আরকি। এগুলো যদি যে যার নিজের ইচ্ছেমতন চলতে শুরু করে, তাহলে যা কাণ্ড হবে, এই হতচ্ছাড়া ভাইরাস ঠিক সেটাই ঘটাচ্ছে।”
“বাবা কোথায় আছে রে এখন? অনেকক্ষণ হয়ে গেল কোনো খোঁজখবর নেই।” হঠাৎ চিন্তিন্ত হয়ে উঠলো শ্রুতি। এই সব জটিল কথাবার্তার পিছনে জীবন্ত যেসব মানুষেরা রয়েছে, তাদের ভালোমন্দ নিয়েই যে ওর কারবার।
“শরীরটা তোদের ওয়েস্ট কোস্টেই আছে কিন্তু আমার ধারণা মেন্টালি বাবা ইজ ব্যাক টু বস্টন। বলছিল ওদের এম-১২১৯ ট্রায়ালে নাকি কতগুলো গণ্ডগোল আছে, সেসব ঠিক করতে হবে। শুধু অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ দিয়ে এই অসুখের চিকিৎসা করা অসম্ভব কারণ যারা মারা যাচ্ছে তারা সরাসরি ইনফেকশনের জন্য মরছে না। তারা মরছে কেননা তাদের ভেতরে একটা লাগামছাড়া ইনফ্লামেশন শুরু হচ্ছে, শরীরের ভেতর রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছে এখানে সেখানে। ওইগুলোকে আটকাতে পারলেই তাদের প্রাণ বাঁচানো যাবে। সেই প্রাণ বাঁচানোর জন্য ভাইরাসকে তড়িঘড়ি খতম করা খুব একটা জরুরি নয়। খুব সস্তা এবং সবার পরিচিত পুরনো ওষুধপত্র দিয়েই তার চিকিৎসা করা সম্ভব।
“দাদা, আমি এখনও কিছু বুঝতে পারছি না।”
“আচ্ছা আরেকবার বলছি। আমাদের জানাশোনা অনেক ওষুধ আছে যা দিয়ে এই প্রদাহ আর রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়াটা ঠেকানো যেতে পারে। কিন্তু ওই রকম চিকিৎসায় কারো লাভ নেই। সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং ব্যাপারটাও ব্যবসার জন্য অতিশয় ক্ষতিকারক। আসল দরকার একগাদা দামি ওষুধ আর দামি ভ্যাকসিন যাতে করে সারা দুনিয়ায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করা যায়। তাই সব রিসার্চের আসল নজর ওইদিকে। কিছু বুঝলি?
“বোধহয় না। যাহোক এটা জেনে ভালো লাগছে যে তুই আর বাবা অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছিস। বাই রে দাদা, রামোনাকে আমার গুডনাইট জানিয়ে দিস। মনে হচ্ছে বাবা ফিরেছে, আমি যাই খাবারগুলো গরম করে দিই,” ফোন রেখে দিল শ্রুতি।
বাবা ঢুকলো ঝোড়ো কাকের মতন। তুলনাটা চমৎকার কেননা এই ফাঁকে বেশ একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, ওর এলোমেলো চুল আর চশমার কাঁচ ভিজিয়ে সারা গায়ে ছড়িয়ে রয়েছে সেইসব বেয়াদপ বৃষ্টিবিন্দু।
“মা কেমন আছে রে?” মাথা মুছতে মুছতে প্রশ্ন করলো রন। মাইক্রোওয়েভে গরম করা এক প্লেট চিকেন আলফ্রেডো পাস্তা এখন টেবিলের ওপরে ওর অপেক্ষায়।
“মা আর মাসিমণি দুজনেই প্রথমে খুব শকড ছিল, তারপর তোমার কাছ থেকে আপডেট পেয়ে এখন কিছুটা ভালো। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছে।”
“পাস্তাটা তো বেশ হয়েছে রে। তুই বানিয়েছিস?” হাসল রন।
“না বাবা, এটা প্রি-কুকড। আমি শুধু একটুখানি দেশি টাচ দিয়েছি। ধনেপাতা আর কাঁচালঙ্কা।” হাসিতে যোগ দিলো শ্রুতি। পরের দশ মিনিট ধরে চুপচাপ শুধু মুখ চালানোর শব্দ, বোঝাই যায় একজন সারাদিন বিশেষ কিছু দাঁতে কাটেনি। গভীর আদরের দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে বসে থাকলো শ্রুতি, ঠিক সময় জলের গ্লাসটা বাড়িয়ে ধরতে ভুললো না।
“ইজ হি আউট অফ ডেঞ্জার?” প্লেটটা সরিয়ে নিতে নিতে কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলো ও।
“ডেঞ্জার? ও, ইয়েস, হি ইজ আউট অফ ডেঞ্জার। এটা শুধু একটা কমপ্লিকেশন, ঠিক সময় ধরা পড়েছে, সেরে যাবে। কিন্তু গন্ডগোলটা অন্য জায়গায়। আমার মনে হচ্ছে আমরা অসুখটাকে ফান্ডামেন্টালি ভুল বুঝছি।” কেমন যেন একটা ভূতে পাওয়া অস্বাভাবিক গলায় বললো রন।
“বাবা, আমি শুনেছি। তুমি দাদার সঙ্গে কথা বলেছ, আমি জানি। কিন্তু এখন তোমার ঘুমনো দরকার তাই এ নিয়ে আজ রাত্তিরে কোনো কথা হবে না। যাও, চেঞ্জ করে শুয়ে পড়ো এখন।” কড়া গলায় বলল শ্রুতি।
শোবার ঘরে ঢুকে থমকে গেল রন। ও ভেবেছিল রোজকার মতন নিপু ঘুমিয়ে পড়েছে, চুপচাপ নিজের দিকের কম্ফর্টার উঠিয়ে শুয়ে পড়লেই চলবে এখন। তার বদলে বিছানার ওপর একটা পাথরের মূর্তির মতন বসে আছে নিপু। রন বুঝতে পারলো যে এখানে আসার পর থেকে নিপুর সঙ্গে একটি বারের জন্যও একান্তে কথা বলা হয়নি ওর। ওরা দুই বোনে একজায়গায় থেকেছে, ও আরেক জায়গায়, মাঝখানে পেন্ডুলামের মতন এদিক ওদিক করেছে শ্রুতি আর রোহন।
“নিপু, ঠিক আছো তো? চিন্তা কোরো না এটা একটা টেম্পোরারি সেটব্যাক, ঠিক হয়ে যাবে।” আমতা আমতা করে বলল রন। নিপু কেমন যেন অন্যরকম একটা স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর মুখের দিকে।
“আমার ভালো লাগছে না রনি।” নিপু বলল।
ভালো লাগছে না? কার ভালো লাগছে এখন? রাজপ্রাসাদ থেকে কুঁড়েঘর, যে যেখানে আছে সবাই তো এখন একই অমঙ্গলের ছায়ায়। এই জানা কথাটা বলার জন্য নিপু এত রাত্তিরে জেগে বসে আছে কেন? অবাক লাগলো রনর, কিন্তু অভিজ্ঞতা ওকে বলে দিলো যে নীরবতাই এক্ষেত্রে নিরাপদ।
“আমার মনে হচ্ছে আমরা সবাই মরে যাবো। কেউ বাঁচবো না। শুধু শরীরটা নয়, আমাদের সম্পর্কগুলোও মরে যাবে।” অদ্ভুত গলায় বলল নিপু।
“কি হয়েছে, ঠিক করে বলবে তুমি?” বিরক্তি চাপার চেষ্টা করলো রন। মাঝরাত্তিরে এ কি নাটক শুরু হলো রে বাবা!
“রুডির ফোনটা গাড়ির মধ্যে পড়েছিল এতদিন। রোহন ওটা খুঁজে বার করেছে, হি চার্জড ইট আপ।”
“তার পর?” মাথার ভেতরে বিপদসংকেতটা উপেক্ষা করার ভান করলো রন।
“তার পর কি আমি জানি না। শুধু জানি তোমরা কিছু একটা লুকোচ্ছো। এটা কি সত্যি যে, রুডি যখন চায়নায় যেতো, তখন ও একা থাকতো না?” নিপু বললো।
“নিপু, এটা ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, তাছাড়া এখনও এই গল্পটার অনেকখানিই স্পেকুলেশন। আমরা এর মধ্যে মাথা না গলালে, লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না। মনে রেখো আমরা এসেছি পারিবারিক বিপদের সময় পাশে দাঁড়াতে। ওদের জীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান করা আমাদের কাজ নয়। তাছাড়া বাবাই হোক আর যেই হোক, অন্যের ল্যাপটপ খুলে দেখাটাও উচিত না। আর ও পাসওয়ার্ডটাই বা পেল কোত্থেকে?” অক্ষম বিরক্তিতে গজগজ করলো রন।
“খুব সহজ। পাসওয়ার্ড ওর নিজের নাম।” নিপু বলল।
“তাহলেই দ্যাখো, রুডি ওকে কতটা ভালোবাসে, আর ছেলেটা সুযোগ পেলেই বাবাকে ঠুকতে ছাড়ে না, এখন তো ওর পার্সোনাল এলাকাতেও নাক গলাচ্ছে। এটাকে সাপোর্ট করা যায় না নিপু,” মনের মধ্যে রুডিকে গাল পাড়তে পাড়তে বললো রন। আচ্ছা আচ্ছা ঝানু লোকেরা সবাই এই ভুলটা করে কেন? নিজের আর কাছের মানুষদের নামগোত্র নিয়ে যন্তরের পাসওয়ার্ডে ঢুকিয়ে দেয়।
“মাঝে মাঝে তোমাকে আমার অদ্ভুতরকম অচেনা লাগে রনি। তোমার ডিকশনারিতে সম্পর্ক কথাটার ঠিক কি মানে লেখা আছে, খুব জানতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা, তোমার জীবনেও কি এইরকম সব ব্যক্তিগত অধ্যায় রয়েছে, যাদের নিয়ে আলোচনা করা অপ্রয়োজনীয়?”
“কি জ্বালাতন! এর মধ্যে হঠাৎ আমাকে নিয়ে পড়লে কেন?” রন বুঝতে পারলো, ভেতরে একটা গরম হাওয়া বইতে শুরু করেছে। সেটা রাগ, আশংকা নাকি স্রেফ বিরক্তি বলা কঠিন।
“আসলে আমিই বোধহয় সব চাইতে বোকা রনি। আমি না ঘরকা, না ঘাটকা। বেচারা অপুর আইডেনটিটি শুধু ওর এই সংসার, সেখানে রুডিকে তার জায়গায় রাখতেই হবে, বাবা আর ছেলের সম্পর্কটাকেও বাঁচাতেই হবে, যে করে হোক। আমিও তো ওইরকম ভাবতে চাই, কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠি না। ইউ মে বি আ গ্রেট গাই, তবুও রোজকার জীবনে তোমার কাজ আর কথার মধ্যে অসংগতিগুলো আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে, আমি ওগুলোকে ইগনোর করতে পারি না কিছুতেই। তোমার অ্যামবিশন, তোমার নার্সিসিজম, তোমার গোঁয়ার্তুমি- এগুলো সব আমার হাড়ে হাড়ে চেনা। তার জন্য আমার ভালোবাসা কমে যায় না, শুধু মনের খুব ভেতরে একটা অসহায় কষ্ট জমা হয়। সব সত্ত্বেও তোমাকে যে বড্ড ভালোবাসি রনি, শুধু সব সময় সেটা মুখে বলতে পারি না।”
বুকের ভেতরে দুই রকমের ডানার ঝাপটানি একই সঙ্গে টের পেল রন। পাখি ফিরে আসছে তার পরিচিত নীড়ে এবং অন্যত্র পাখি উড়ে চলেছে সমুদ্রের ঢেউ ছুঁয়ে ছুঁয়ে অজানা দিগন্তে।
“চলো আজ বরং চুপচাপ আগের মতন করে শুয়ে পড়ি। অনেকদিন ওইভাবে শুইনি নিপু। তোমার মাথাটা আমার কাঁধের ওপর, তোমার আলগা চুলগুলো আমার গালের ওপরে সুড়সুড়ি দিচ্ছে,” হঠাৎ হেসে উঠে বলল রন। চারিদিকে গজিয়ে ওঠা কাঁটাতারওয়ালা দুর্গপ্রাকার এইভাবেই ঠেলে সরাতে চাইলো ও। অনেকদিনের জমে ওঠা ক্লান্তির ভারে নিপুও ভারাক্রান্ত হয়ে ছিল, তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই অভ্যস্ত ভঙ্গিমায় শুয়ে থাকতে দেখা গেল ওদের।
রাত্তির দুটো। ধরে নেওয়া যায় যে বিরাট বাড়িটার মধ্যে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। দম বন্ধ করে পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল রোহন। ওর হাতে একটা সুদৃশ্য চামড়ার ব্যাগ, তার মধ্যে রুডির ফোন আর ল্যাপটপ। অফিসঘরটা লিভিংরুমের এক কোনায়, সেখানে গিয়ে যন্ত্রটাকে জীবন্ত করে তুললো ও। কলেজে থাকতে হ্যাকার হিসাবে ওর নামডাক ছিল, এই সব পরিচিত ইন্টারনেট সিকিউরিটির দেওয়াল ডিঙিয়ে যাওয়া ওর কাছে ছেলেখেলা।
হাতের কাছে যা ফাইল পাচ্ছে কপি করে ফেলছে রোহন। পরে সব একসঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে। বাবা আর ওর চৈনিক কোম্পানির কলিগরা কি এই ভাইরাসের ব্যাপারটা অনেক দিন আগে থেকেই জানতো, অথচ ওরা কাউকে কিছু বলেনি? সত্যিই কি ব্যবসা বাঁচানোর জন্য জেনেশুনে সারা পৃথিবীকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে ওরা? আঙুল দিয়ে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতন ও বাবার জীবনের চেনা স্তরগুলোকে ছাড়িয়ে ফেলছে, উঠে আসছে অজানা তথ্য, অদ্ভুত শাঁসালো নতুন এক একটা স্তর, তার অসহ্য ঝাঁঝে জ্বলে যাচ্ছে ওর দুই চক্ষু। কাজ করতে করতে নিজের সঙ্গে বিড়বিড় করে কথা বলছে ও। খোঁজো, খোঁজো, খুঁজতে থাকো রোহন। সত্য জিনিষটা যেন একটা পাথরের দেওয়াল, চেতনার অলিগলি বেয়ে দৌড়তে দৌড়তে একদিন ওটার সঙ্গে তোমার মুখোমুখি ধাক্কা লাগবেই। হারিয়ে যাওয়া নিস্তব্ধতার সন্ধান পেয়ে যাবে তুমি সেদিন।
When a war breaks out, people say: “It’s too stupid; it can’t last long.” But though a war may well be “too stupid,” that doesn’t prevent its lasting. Stupidity has a knack of getting its way; as we should see if we were not always so much wrapped up in ourselves.শহরে বিকেল বেলা। ভিজে ফুটপাথের ওপর দিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে চলেছে রামোনা, ওর এক হাতে ঝোলানো ব্যাগের মধ্যে কাগজে মোড়া সাবওয়ে স্যান্ডউইচ, অন্য হাতে প্ল্যাস্টিকের ঝোলায় এক বোতল সস্তা ওয়াইন। জুন মাস শুরু হয়েছে, বাতাস এখন উষ্ণ থেকে উষ্ণতর। অদ্ভুত এক জাদুবাস্তবিকতার খোলা থিয়েটারে বসে দিন কাটাচ্ছে শহর নিউ ইয়র্ক। সে থিয়েটারে সব আছে শুধু দর্শক নেই। জীবনের অর্কেস্ট্রা স্তব্ধ হয়ে গেছে, সেই কুখ্যাত অপেরার ভূত এসে বন্ধ করে দিয়েছে থিয়েটারের দরজা। কবে আবার সেই দরজা খুলবে, দর্শক উপছে পড়বে ফুটপাথ থেকে গ্যালারিতে সেই দিনটার অপেক্ষায় বসে বসে ঝিমোচ্ছে মহানগর। খুব ক্লান্তিকর একঘেয়ে ক্রনিক অসুখের মতন এই সময়টা, কেউ ভালো নেই, কেউ মন খুলে হাসছে না। এরই মধ্যে বিকেল বেলায় ঝুপ করে এক পশলা বৃষ্টি নামলো, সাথে সাথে সাম্যর সাথে প্রথম দেখা হবার দিনটার কথা মনে এসে গেল রামোনার। ও ভাবলো সব ভুলে গিয়ে আবার সেদিনের মতন হেসে উঠলে কেমন হয়। তার সঙ্গে এটাও মনে হল যে বাড়িতে খাবারদাবার কিচ্ছু নেই, ফেরার আগে স্যান্ডউইচ তুলে নিলে বেশ হয়।
বব উইলসন চলে যাবার পরে অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে দুটো সপ্তাহ কাটিয়েছে ওরা। প্রেম আর মৃত্যু, আতঙ্ক আর আশ্লেষ মেশানো সেই সময়টার একটা নামও ঠিক করে ফেলেছিল দুজনে মিলে- অল্টারনেটিং কারেন্ট। একবার মনে হয়েছে যে পৃথিবীর যা হয় হোক, ওরা দুজনেই তো দুজনের জন্য যথেষ্ট। এই যে হাত বাড়ালেই ওরা ছুঁতে পারছে একে অপরকে এবং তার চাইতে বেশি আনন্দ যখন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোথাও নেই, তখন বাদবাকি সব কিছুই আসলে অবান্তর। কিন্তু তারপরেই জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে যখন দেখতে পেয়েছে আরেকটা বাড়ির সামনে অ্যাম্বুলেন্স আর স্ট্রেচার, কিংবা আরেকজন প্রতিবেশী, ঘর হারিয়ে নেমে পড়েছে রাস্তায়, তখন নিজেদের খুব অপরাধী মনে হয়েছে ওদের। মনে হয়েছে এই সময়ে সুখী থাকাও বুঝি অন্যায়। আনন্দ আর যন্ত্রণা একে অন্যের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে অনায়াস স্বচ্ছতায়- অল্টারনেটিং কারেন্ট। সেখান থেকেই ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ওদের মনের এই বিবর্তিত বিদ্যুৎ দিয়েই অন্যদের অন্ধকার ঘরে আলো জ্বালতে হবে। ওরা দুজনে একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় নাম লিখিয়েছে- ভলান্টিয়ার্স ফর আমেরিকা অফ গ্রেটার নিউ ইয়র্ক। দুই কোটি মানুষের বসতি এই এলাকায়, বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় এদের সকলেই বুঝি সচ্ছল, সক্ষম এবং সামাজিক। কিন্তু শরীরের পিছনে যেমন ছায়া থাকে তেমনি এই স্যুট-টাই শোভিত কর্পোরেট আমেরিকার ঠিক পেছনেই রয়েছে প্রান্তিক ও অসুখী মানুষদের দীর্ঘতর ছায়া। সেই ছায়ার মধ্যে মুখ গুঁজে রয়েছে অনেক অনেক মানুষ, টাইম স্কোয়ারে আকাশ ভাসানো বিজ্ঞাপনী আলোর তলায় আবছা অন্ধকারে কিলবিল করছে অভাবী, বয়স্ক, নেশাখোর এবং গৃহহীনদের অতি বিচিত্র এক মহাসম্মেলন। সাধারণ অবস্থাতেই তাদের বসবাস ছিল সমাজের কিনারায়, হোমলেস শেল্টার, জেলখানা, সরকারি বৃদ্ধাশ্রম, অথবা স্রেফ ফুটপাথে। প্যানডেমিক এসে তাদের একেবারে ছারখার করে দিয়েছে। অবাক কাণ্ড এটাই যে এতদিন যারা মোটামুটি অদৃশ্য ছিল সেই সব মানুষের অগাধ বিপন্নতার সময়ে সাহায্যের শক্ত হাত বাড়িয়ে দিয়েছে একঝাঁক তরুণ-তরুণী। এই সেদিনও ওরা ছিল যৌবনের স্পর্ধায় উজ্জ্বল, সম্ভাবনায় সজীব, পথের পাশে নর্দমায় পড়ে থাকা বিবর্ণ, বয়স্ক পৃথিবীটার দিকে ফিরেও তাকায়নি কেউ। অথচ এই সংকটের সময়ে ওদেরই মধ্যে একদল গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। স্বার্থ কিংবা নিরাপত্তার তোয়াক্কা না রেখে, এক পয়সা পারিশ্রমিক না নিয়ে তারা নগর প্রশাসনের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে চলেছে দিনরাত। কেমন করে এই মিরাকল সম্ভব হল, ভবিষ্যতে কখনো সমাজবিজ্ঞানীরা সেই নিয়ে গবেষণা করবেন। আমরা শুধু এইটুকু বলতে পারি যে নিউ ইয়র্ক সিটির দারুণ দুঃসময়ে তার যুবসমাজ বজ্রের মতই প্রতিরক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেই সব নানা রঙের, নানা ভাষার, নানা জাতির বহুবিচিত্র অথচ এককভাবে প্রত্যয়ী স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে রয়েছে আমাদের সাম্য আর রামোনা।
অ্যাপার্টমেন্টের দরজার সামনে এসে একটু থমকে গেল ও। দরজাটা খোলা নাকি? আজকাল শহরে ক্রাইম খুব বেড়ে গেছে। লোকজনের চাকরিবাকরি নেই, নেশাগ্রস্তরাও ক্ষ্যাপা কুকুরের মতন এখানে ওখানে ঘুরে বেরেচ্ছে সহজ শিকারের সন্ধানে।
খুব সাবধানে পা টিপে টিপে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো রামোনা। পাল্লার ফাঁক দিয়ে একগুচ্ছ কালচে রঙের পিয়োনি উঁকি মারছে। ড্রাগ অ্যাডিক্ট কিংবা কোনো পেটি ক্রিমিন্যাল ওর পছন্দের ফুল হাতে নিয়ে বাটপাড়ি করতে আসবে এটা মোটামুটি আশাতীত, সুতরাং ধরে নেওয়া যায় যে এটা সমুর কীর্তি। কি যে ছেলেমানুষ আর পাগলের মতন রোম্যান্টিক ছেলেটা! রামোনার মাঝে মাঝে হাসি পায়। যে জীবন থেকে ও উঠে এসেছে সেখানে শরীর দামি, মন সস্তা। শরীরের দিক থেকে এই ভারতীয় ছেলেটা ওর কাছে নিতান্তই শিশু, কিন্তু ওর মনের মধ্যে লুকিয়ে আছে অতলান্তিক শান্তি আর গভীরতা। সেই গভীরতার উৎসে রয়েছে ওর অনেক কালের জমিয়ে রাখা ধন, প্রাচীন এক সংস্কৃতির মাটিতে বোনা, রূপকথার মণিকোঠায় জমিয়ে রাখা সোনার ফসল। এমন অসীম সম্পদ হাতে আছে তবুও ও সদাই অস্থির আর অধৈর্য, বেলাভূমির ওপর প্রতিমুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়া ঢেউয়ের মতন। ও জানে না যে আর্থ-সাংস্কৃতিক দিক থেকে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া, কয়েকশো বছরের নিঃসঙ্গতার অভিশাপ ঘাড়ের ওপরে বয়ে চলতে থাকা জনজাতিগুলোর বৌদ্ধিক সমস্যা কি রকম ভয়ঙ্কর। তাই সাহিত্যের জাদুবাস্তবতা নিয়ে ও যখন কথার ফুলঝুরি ছোটায় তখন হাসিই পায় রামোনার, আর সেই হাসির পিছনে খুব সাবধানে লুকিয়ে রাখা কয়েক ফোঁটা অশ্রু টলমল করে। সেটা আনন্দের না আশংকার, ঠিক করে বুঝে উঠতে পারে না ও।
এই সব কথা ভাবতে ভাবতেই বাড়ির দরজা ওর সামনে। সেই দরজা খুলতে না খুলতেই আলগা হয়ে যাওয়া ফুলগুলো কার্পেটের ওপর ঝরে পড়ল। দুটো উদগ্রীব শরীর একে অপরের সঙ্গে মিশে গেল আগুন যেমন দমকা হাওয়ার সঙ্গে মিশে যায়। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো ছোট্ট ঘরটা কিন্তু সেই আগুনে জ্বালা নেই ধোঁয়া নেই, আছে শুধু অনাবিল দ্যূতি। ওদের এলোমেলো বিছানা, ছড়িয়ে থাকা বইপত্র, ক্ষুদে ডাইনিং টেবিলের মাঝখানে সাবধানে বাঁচিয়ে রাখা অর্কিড, রান্নাঘরের বেসিনের মধ্যে ডাঁই করে রাখা এঁটো প্লেট আর সসপ্যান, সব কিছু কাঁচা সোনার মতন উজ্জ্বল হয়ে উঠলো সেই আলোয়। ভালোবাসার সোনালি ঝর্ণায় স্নান করে ভাষাহীন এক অব্যক্তর মধ্যে হারিয়ে গেল দুজনে। আবার নতুন করে মানুষের ভাষা খুঁজে পেতে বেশ খানিকক্ষণ সময় লেগে গেল ওদের।
“রামি।”
“উঁ।”
“হাউ ওয়াজ ইয়োর ডে?”
“কে জানে। মনে হয় ভুলে গেছি--”
“তার মানে তোমার সঙ্গে পাগলামি করার পর আমার কেমন যেন অ্যামনেশিয়া হয়, অতীত আর ভবিষ্যৎ বাদ দিয়ে শুধু এই মুহূর্তটাই একমাত্র সত্যি বলে ভাবতে ভালো লাগে। গত দশ ঘণ্টায় যা কিছু হয়েছে, এরই মধ্যে সব অনেক দূরে সরে গেছে, সবই আবছা, স্বপ্নের মতন বলতে পারো। শুধু তোমার সঙ্গে এক্ষুনি এক বিছানায় একসাথে মিশে থাকাটাই খুব করে সত্যি।”
বলতে বলতেই উঠে পড়েছে রামোনা, প্লেটের ওপর স্যান্ডউইচ আর গ্লাসের মধ্যে ওয়াইন ঢালতে ব্যস্ত ও এখন। সকালে ফোটা ফুলের মতন ওর শরীরের চারপাশে শুধু তার নিজস্ব শিশিরের স্বেদবিন্দু। ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনের ভেতরে খুব একটা অপরাধবোধের খোঁচা টের পেল সাম্য। ডিনারটা ওর বানিয়ে রাখা উচিত ছিল। তাহলে শিফটের শেষে বাড়তি কাজটুকু করতে হতো না ওকে। ঘরকন্নার সব এলাকাতেই রামোনার তুলনায় ও আস্ত একটি অপদার্থ।
“তোমার বাবা কেমন আছেন এখন?”
“খুব ক্লান্ত, শ্বাসকষ্টটাও কিছুটা রয়ে গেছে, তার ওপরে খিদে নেই একদম। এই রোগটা থেকে যারা সেরে উঠছে তাদের অনেকেরই এই অবস্থা জানো। তার ওপর ডিপ্রেশনে ভুগছে কেননা দোকানটা বন্ধ, টাকাপয়সায় টানাটানি। তাও তো বাবার চারপাশে পরিবার বলে একটা বস্তু আছে, দেখাশোনা করার লোক আছে অনেক। এই শহরে লক্ষ লক্ষ লোক একলা থাকে। তারা হাসপাতাল থেকে ফিরছে, তারপর যে যার আস্তানায় বন্দি, চাকরি নেই, শরীর দুর্বল, বাজার করতে যাবার শক্তিটুকুও নেই, অবসাদ যেন একটা ভারী পাথরের মতন বুকের ওপর চেপে বসেছে। তাদের কথা ভাবতেও আমার ভয় করে সমু।”
টুকটাক কাজ করতে করতে কথা বলছে রামোনা, নিজের উদাস নগ্নতার দিকে ওর আদৌ নজর নেই। সাম্যর বুকের ভেতরকার ড্রামটাও দ্রুত থেকে দ্রুততর লয়ে বেজে চলেছে। এইরকম সময় জুতসই কথা খুঁজে পাওয়া মুশকিল, তার চেয়ে ছোটখাটো একটা বক্তৃতা দেওয়া অনেক সহজ। এই রকম বক্তৃতার বিষয়বস্তু অবশ্য বাবার কাছ থেকেই শেখা ওর।
“সেইখানেই তো আমাদের কাজ রামি। কোভিড কাণ্ড শুরু হবার সাথে সাথেই বাবা আমাকে কামুর লেখা ওই বইটা পড়তে বলেছিল- দি প্লেগ। বইটা পড়ে আমার মনে হল কি জানো? প্লেগ আসলে এক চিরন্তন অস্তিত্ব, যেমন কিনা ভূমিকম্প বা সুনামি। এরা যেন মানুষের হাতে বানানো সভ্যতার সামনে ছুঁড়ে ফেলা প্রকৃতির দস্তানা, সামনাসামনি এক হাত ডুয়েল লড়ে যাবার চ্যালেঞ্জ। আমরা ভেবেছিলাম যে গত পঞ্চাশ বছরে আমরা এতটাই স্মার্ট হয়ে গেছি যে প্রকৃতিকে পাত্তা দেবার প্রয়োজনটাই মিটে গেছে আমাদের। আসল ভুলটা সেইখানে, তাই আজ রাজা থেকে ফকির অবধি সবাই এমন বিভ্রান্ত আর অসহায়। রাজাদের নিয়ে চিন্তা কম, তাদের দেখাশুনো করার অনেক লোক আছে। অন্যদিকে এই রোগটা অজস্র সাধারণ লোককে ধনেপ্রাণে মেরে ফকির বানিয়ে দিয়েছে, তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতন কেউ নেই।” বিছানাটা ঠিক করতে করতে কথা বলছে সাম্য। ওর গলায় হতাশার সুর লাগার আগেই রামোনা ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, দুহাতের নরম বাঁধনে জড়িয়ে ধরেছে ওর কোমর।
“আমরা আছি। আমাদের মতন ভলান্টিয়াররা আছে, এই দুঃসময়ে তাদের পাশে দাঁড়াবে বলে। এই কাজটার মধ্যে অদ্ভুত একটা উল্লাস আছে সমু। এর মধ্যে পয়সা বানানোর চাপ নেই, নাম কেনার সুযোগ নেই বরং অসুস্থ হবার ঝুঁকি আছে। তবুও এইসব অনাত্মীয়, অপরিচিত মানুষদের জন্য অকারণে শ্রম দেওয়া কি যে আনন্দের! তোমার সঙ্গে দেখা না হলে এই পৃথিবীটার হদিস পেতাম না কোনোদিন।” বলতে বলতে আরো ঘন হয়ে এসেছে রামোনা। সাম্য টের পাচ্ছে ওর পিঠের ওপরে ওর দুই বুকের কোমল অথচ সজাগ স্পর্শ, কাঁধের ওপরে আলতো করে চেপে ধরা চিবুক, শুনতে পাচ্ছে কানের ভেতরে গরম নিঃশ্বাস মেশানো কথাগুলো। এরকম সময় মাঝে মাঝে ইংরেজি আর স্প্যানিশ মিশিয়ে কথা বলে রামোনা, কিন্তু তাদের মানে বুঝতে সাম্যর একটুও অসুবিধা হয় না।
“আমরা, যাদের নাকি এই দেশে বহিরাগত বলে ভাবা হয়, আমাদের স্বভাব হচ্ছে একসাথে জড়ো হয়ে থাকা। আমরা ছোটবেলা থেকে জেনে যাই যে চারদিকে একটা অদৃশ্য দেওয়াল খাড়া হয়ে আছে। সমাজের মেইনস্ট্রিমকে আমরা বিশ্বাস করি না, তারাও আমাদের করে না। আমাদের মার্জিন্যাল একজিস্টেন্সের খুঁটিনাটি তারা শুধু নিজেদের প্রয়োজনে সহ্য করে নেয়। ঝাঁকে মিশে থাকাই বুঝি আমাদের টিঁকে থাকার একমাত্র উপায়। তুমি জানো, এটাকেই ঘেটো মেন্টালিটি বলে। তুমিই কিন্তু আমায় বুঝিয়েছ যে তোমার মতন আমিও এই দেশে জন্মেছি, এই সমাজ আমারও সমাজ, এর ভালোমন্দ সব কিছুই আমার। এই বিরাট দেশটায় শক্ত করে পা রাখার মতন অনেক জায়গা আছে, যেখানে দাঁড়িয়ে আমি স্বচ্ছন্দে বাকি সকলের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারি। তার আগে এই সমাজটাকে নিজের বলে ভালবাসতে হবে আমায়, কিছু পাবার আগে কিছু দিয়ে দেখাতে হবে। এই বোধটুকু ঠিক সময়ে খুঁজে না পেলে হয়তো আমিও চিরকাল মার্জিনালই থেকে যেতাম সমু।”
এই সব ছেঁড়া ছেঁড়া সলিলোকির মাঝখানেই ওরা আবার সম্মিলিত। এভাবেই কেটে যায় ঘন্টার পরে ঘণ্টা। এইরকম সময়ে রামোনা যেন একলাই নিজেকে তৃপ্তির শিখরে নিয়ে যায়, ওকেও সযত্নে নিঃশেষ করে দিতে ভোলে না। তারপরে একসময় গাঢ় ঘুমের মধ্যে ডুবে যায় ওরা দুজন। পরদিন ভোর বেলা ফোনের অ্যালার্ম বেজে উঠবে, সাম্য ভলান্টিয়ার সেন্টারের দিকে রওনা হবে, বাড়ি থেকে কাজ করবে রামোনা। তার পরের হপ্তায় রুটিন উল্টে যাবে আবার। সন্ধ্যা বেলা ক্লান্ত পায়ে একজন যখন ঘরে ফিরবে, টেবিলের ওপর মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে থাকবে আরেকজন। ওদের নজর ঘুরতে থাকবে মোবাইলের পর্দা থেকে কাউন্টারের ওপরে রাখা মাইক্রোওয়েভ ওভেনটার দিকে। অবশ্য তফাত থেকে যাবে তবুও। সাম্য বাড়ি থাকলে সব অগোছালো। কিন্তু রামোনা যখন বাড়ি থাকে, কিচেন, বাথরুম, একফালি বসার জায়গা আর ছোট্ট বেডরুম তখন ছিমছাম, প্রতিটি সামান্য জিনিস পরিপাটি করে সাজানো যে যার জায়গায়।
“তুমি এমন ভালো গিন্নি, আর তোমার ভবিষ্যৎ স্বামীটি সবদিক থেকে কিরকম আস্ত অপদার্থ বলো দেখি!” ওকে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলবে সাম্য।
“চুপ করো খোসামুদে কোথাকার। ফিশিং ফর কমপ্লিমেন্টস,” রামোনা বলবে। নিজেকে সাবধানে ছাড়িয়ে নিয়ে ফটাফট প্লেট, কাঁটা সাজিয়ে ফেলবে ও। আগে ভদ্রলোকের মতন ধৈর্য ধরে একসাথে বসে ডিনার তারপরে প্রেম, এটাই ওর বাড়িতে থাকা সন্ধ্যাগুলোর জন্য অলিখিত নিয়ম।
“আজ আমরা কয়েকজন ব্রুকলিনের একটা নার্সিং হোমে গেছিলাম। বয়স্ক লোকদের কি সাংঘাতিক দুরবস্থা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। একে তো প্রায় ফর্টি পারসেন্ট লোক ইনফেকটেড, যাদের বাড়াবাড়ি তারা নাহয় হাসপাতালে, কিন্তু বাকিরা তো এক একটা ঘরে বন্দী। যাদের ইনফেকশন নেই তাদেরও যতখানি সম্ভব আলাদা করে রাখা হয়েছে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব যে যেখানে ছিল, তাদের আসাযাওয়া করাও মোটামুটি বন্ধ, অর্থাৎ লোকগুলো প্র্যাকটিক্যালি জেলে। যারা হাসপাতাল থেকে ফিরে আসছে তারাও কোয়ারেন্টিনে, অনেকে এমন দুর্বল যে নিজে থেকে খাবারটা উঠিয়ে খেতে অবধি পারছে না।”
“আমাকে কাল কুইন্স শহরের একটা হোমলেস শেল্টারে যেতে হবে। ওখানে লোক ধরছে না কিন্তু তাদের মিনিমাম সার্ভিসটুকু দেবার মতন ব্যবস্থা নেই। যাকে বলে স্কেলিটন স্টাফ, ঠিক তাই। জানো ওদের মধ্যে অনেকেই ড্রাগ অ্যাডিক্ট বা মানসিক রোগী। আমার কিন্তু ওদের নিয়ে কাজ করতে ভয় করে না জানো। যারা সব আশা ছেড়ে দিয়েছে, তখন কেউ তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে তারা কিরকম অদ্ভুতভাবে তাকায়, দেখেছো?”
“বাবা ফোন করেছিল। ইন্ডিয়াতে আমাদের কলকাতা শহরেও নাকি খুব খারাপ অবস্থা। বাবা বলছিল ওখানেও বয়স্ক লোকদের খুব অসুবিধা হচ্ছে। অনেকেই একলা থাকে, তাদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ হয়ে গেছে, যারা ডোমেস্টিক সার্ভিস দিত তারাও কেউ আসতে পারছে না। আমাদের গ্র্যান্ডপেরেন্টরাও একলা থাকে, তাদেরও একই অবস্থা। সবচেয়ে খারাপ কথাটা এই যে এইরকম একলা থাকা বাবা-মায়েদের মধ্যে কারোর যদি কিছু একটা হয়ে যায় তখন তাদের প্রবাসী ছেলেমেয়েরা ফিউনেরালের জন্যও ফিরতে পারবে না। আমেরিকা, ইউরোপ আর অস্ট্রেলিয়া থেকে কমার্শিয়াল ফ্লাইট প্রায় সবই তো বন্ধ। কি ভয়ঙ্কর কথা বলো তো?
“ট্রু। আমি তো ভাবতেও পারি না যে আমার পেরেন্টদের ফিউনেরালে আমি যেতে পারছি না,” কথাটা বলে ফেলেই চট করে নিজেকে সামলে নেবে রামোনা। ও প্রতিজ্ঞা করেছে এই সময়ে নেগেটিভ কথা বলবে না একটাও।
“এত মানুষের এমন অকথ্য দুরবস্থা হতে পারে, ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয় রামি। ইন্ডিয়াতে কয়েক মিলিয়ন মাইগ্র্যান্ট লেবারার আছে তারা সবাই একসঙ্গে একদিনে বেকার হয়ে পড়লো, সরকার তাদের দিকে তাকিয়েও দেখলো না। হাজার হাজার লোক পায়ে হেঁটে নিজেদের গ্রামে ফিরতে শুরু করলো, তাদের মধ্যে বাচ্চা, বুড়ো অসুস্থ লোক, সবাই আছে। রেললাইন ধরে চলার সময় মালগাড়ি চাপা পড়ে মারা গেল ছাব্বিশ জন। পুলিশ প্রশাসন ওদের হেল্প করার বদলে নানাভাবে হ্যারাস করলো, সবমিলিয়ে মারা গেল প্রায় তিনশ মানুষ। এই যুগে কেমন করে এটা হতে পারে বলো তো?” মোবাইলে কতগুলো ছবি দেখাতে দেখাতে কথা বলছে সাম্য। ধুলোমাখা শরীর, ঘোলাটে দৃষ্টি আর ক্ষতবিক্ষত পা সমেত ছবিগুলো সত্যিই ভয়াবহ। প্রতিদিনই ইন্টারনেট ঘেঁটে এইরকম কিছু না কিছু ডিপ্রেসিভ খবর হাজির করবেই ও।
“এটা একটা খুব খারাপ সময় সমু, কিন্তু কেটে যাবে, বিশ্বাস করো। তোমার বাবার মতন মেডিক্যাল সায়েন্টিস্টরা দিনরাত্তির কাজ করছেন। ওষুধ আর ভ্যাকসিন ঠিক বেরিয়ে যাবে দেখো।” মাথাটা ওর কাঁধের ওপরে রেখে কানে কানে সান্ত্বনা দেবে রামোনা।
এইরকমভাবেই কেটে যাচ্ছে একটার পরে একটা দিন। প্রতিদিন একই সংসক্তি আবার একই বিপন্নতা। একবার রাত্রির প্রথম অন্ধকারে বিষাদ আর ক্লান্তিতে নুয়ে পড়া, আবার ভালোবাসার সঞ্জীবনী স্রোতে ডুব দিয়ে ভোরবেলায় আবার উদ্দীপিত হয়ে ওঠা। সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে যে এক অবরুদ্ধ শহরের বাসিন্দা হয়েও মোটামুটি সুখেই আছে ওরা। সৈনিকেরা যেমন ট্রেঞ্চে থাকে, পাহাড় জঙ্গলে গিয়ে লড়াই দেয়, আবার লড়াই শেষ হলে সেই ট্রেঞ্চেই ফিরে এসে ক্লান্ত শরীরগুলো এলিয়ে দিয়ে ঘুমোয়, সেইরকমই দীর্ঘ দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে আমাদের দুই স্বেচ্ছাসেবক সৈনিক। বাইরের রাস্তায় রাস্তায় তখন ফ্যাসিস্ট সৈন্যদের পদধ্বনির মতন অদৃশ্য অথচ প্রকট এই অতিমারীর দোর্দণ্ডপ্রতাপ চলছে তো চলছেই। থিকথিকে জনবহুল, গায়ে গা লাগানো বিরাট বিরাট সব শহরাঞ্চল, যারা কারুর তোয়াক্কা না করে কয়েক শতাব্দী দিব্যি কাটিয়ে দিয়েছে, এই মুফূর্তে তারা সবাই এই অদ্ভুত ভয়ের রাজত্বে দিশেহারা। ম্যানহাটান, ব্রংকস, ব্রুকলিন, কুইন্স, লং-আইল্যান্ড, দুনিয়ার সব জাতির এই মেল্টিং পট, আটশো আলাদা আলাদা ভাষায় কথা বলা এই নগরাঞ্চল এখন নিশ্চুপ, তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে সন্ত্রাস। এগারোই সেপ্টেম্বরের এরোপ্লেনওয়ালা টেররিস্টরা এর সিকির সিকিও করে উঠতে পারেনি।
ভোররাতে ঘুম ভেঙে গেল সাম্যর। বাবার সঙ্গে ফোনে অনেকক্ষণ কথা হয়েছে আজ দুপুর থেকে। তারপরে বিকেলে শ্রুতির সঙ্গেও বেশ খানিকক্ষণ। শেষ অবধি ওকে বলতে হয়েছে যে কাজ আছে এবার ফোন রাখতেই হবে। মা বোধহয় রাগ করলো একটু। বাড়ির সঙ্গে কথা বলার সময় ও আলাদা করে রাখতে চায় কিন্তু প্রায়শই সেটা হয়ে ওঠে না। যেমন আজকে এই সব কথাবার্তার ফলে ঠিক সময় রান্না করাই হয়ে উঠলো না ওর। সী-ফুড কারি বানাবে ঠিক করে চিংড়িমাছ, স্ক্যালপ আর কাঁকড়া এনে রেখেছিল সেসব ফ্রিজেই রয়ে গেল। অবাক কাণ্ড এটাই যে এইসব গাফিলতির খবর রামি কিভাবে যেন টের পেয়ে যায়, ঠিক সময়মতন খাবার নিয়ে আসে। খুব লজ্জা লাগে ওর তখন।
পারিবারিক ওয়েদার রিপোর্ট বলছে যে আকাশ এখনো মেঘলা। নানান জনের নানারকম সমস্যা, সেগুলো একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে উদ্ভট আকার নিয়েছে। বাবা বস্টনে ফিরতে না পেরে ফ্রাসট্রেটেড, ওদিকে মা আর মাসিমণি কেউ কাউকে ছাড়তে রাজি নয় এখনও। রুডিমেসো সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে কিন্তু সেখানেও কিছু একটা ঠিক নেই, ব্যবসার গণ্ডগোল নাকি আরো গভীরের ব্যপার, মাম্পি ফোনে পরিষ্কার করে বলছে না। রোহন তো রীতিমতন রহস্যময়, মাঝে মাঝে রুক্ষ আর সারক্যাস্টিক, ওর সঙ্গে কথা বলাও কঠিন। টুকরো টুকরো যেটুকু শুনেছে তাতে দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে গেছে ওর। রুডিমেসোর ব্যবসাপত্তর সবই তো চায়নার সঙ্গে, সেসব কি অবস্থায় আছে কে জানে।
বাবা শহরে নেই কিন্তু বাবার ট্রায়াল শেষ। এখন পিয়ার রিভিউ, তারপর পাবলিকেশন এবং আশা করা যায় খুব তাড়াতাড়ি সরকারি অনুমোদন নিয়ে ওষুধ বাজারে এসে যাবে। তা সত্ত্বেও বাবা কিন্তু খুশি নয়। বাবার ধারণা যে ট্রায়ালের ডাটাগুলো নাকি এখনও ঠিক ম্যাচিওরড হয়নি, আরো অপেক্ষা করা দরকার। এদিকে সরকার আর ওষুধ কোম্পানিরা সমানে চাপ দিয়ে চলেছে। বাবার কাজের জায়গায় ফেরা খুবই প্রয়োজনীয় কিন্তু রুডিমেসোর জন্য বাবা এখনও ক্যালিফোর্নিয়াতেই রয়ে গেছে। এক এক সময় নিজেকে কেমন যেন বিচ্ছিন্ন মনে হয় ওর অথচ কারণটা কিছুতেই খুঁজে পায় না। যে যার নিজের মতন করে লড়াইটা লড়ছে তবুও ওর জীবন অন্য সকলের থেকে আলাদা। পরিবার কি সেটা বুঝবে, সম্মান করবে, মেনে নেবে রামিকে, মেনে নেবে ওদের যৌথ জীবনযাপন? সব মিলিয়ে অনেকগুলো প্রশ্নচিহ্ন জেগে আছে এইখানে, এই ছোট্ট ঘরে, ছোট্ট জানলার ওপাশে ফিকে হয়ে আসা এক টুকরো পুবালী আকাশরেখায়। ওইখানে, ওই আলো অন্ধকারের মাঝখানে অস্ফুটে প্রকাশ পেতে চাইছে আরো একটা ভারাক্রান্ত দিন, শুরু হতে চলেছে আরেক প্রস্থ লড়াই।
Nobody is capable of really thinking about anyone, even in the worst calamity.“ম্যাক্স ক্যান ইউ এক্সপ্লেইন? ব্যাপারটা কি হচ্ছে ওখানে? এম-১২১৯ এতো তড়িঘড়ি ছাড়পত্র পেয়ে গেল, ওষুধটার ট্রেড নেম অবধি ঠিক হয়ে গেল কেমন করে বলতে পারো। ট্রায়াল তো এখনও শেষ হয়নি, তথ্যপ্রমাণ এখনও আধাখ্যাঁচড়া, এর মধ্যে প্রেস কনফারেন্স না ডাকলে চলছিল না তোমাদের?” রনের গলায় ক্লান্তি এবং বিরক্তির আধা আধা মিশ্রণ। ও বসে আছে রুডির ব্যাকইয়ার্ডে ছোট্ট একটা গাজিবোর ভেতরে। আটকোনা কটেজটি বাগানের ঠিক মধ্যিখানে, দেওয়ালের বদলে তার চারদিকে শুধুই জানালা, সেখানে ঝোলানো সাদা পর্দাগুলো যেন নৌকোর পালের মতন উড়ছে।
We can't stir a finger in this world without the risk of bringing death to somebody. Yes, I've been ashamed ever since; I have realized that we all have plague, and I have lost my peace.
“চারদিক থেকে প্রচণ্ড চাপ রন। সবাই চায় তাড়াতাড়ি ওষুধ বাজারে আসুক, ভ্যাকসিন তৈরি হোক। অপেক্ষা করতে করতে হদ্দ হয়ে গেছে সবাই। তাছাড়া এখন অবধি ডাটা যা আছে আমার মতে তা যথেষ্ট। মনে রেখো এটাও একটা কম্পিটিশন, অন্যেরা হাত গুটিয়ে বসে নেই। ভ্যাকসিন আর অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ বাজারে আসবেই, মাঝখান থেকে বোকা হয়ে যাবো শুধু আমরা।” ম্যাক্সের গলার মধ্যেও ক্লান্তি আর বিরক্তির আধাআধি মিশেল। নতুন ধরনের যে ভ্যাকসিনটা নিয়ে ও কাজ করছে সেখানেও তো ঝক্কি কম নয়।কিন্তু ম্যাক্স রনের মতোই সাবধানী ইনভেস্টিগেটর, তাড়াহুড়ো করা তো ওর স্বভাব নয়। ও যে চাপের কথা বলল কোত্থেকে সে চাপটা আসছে?
ওর সঙ্গে যারা কাজ করছে তারা প্রায় সকলেই রনের পরিচিত শুধু দুজন বাদে। সবাই কথাটা মনে হতেই খাড়া হয়ে বসলো রন। ভাবতে চেষ্টা করলো যে গত দুমাসের এই রুদ্ধশ্বাস নাটকে নতুন চরিত্র বলতে কে কে আছে। তালিকার প্রথমে অবশ্যই রয়েছে মিমি। ও না থাকলে এই প্রজেক্ট কবেই বন্ধ হয়ে যেত। রন আর ম্যাক্সের মধ্যে যখনই মতান্তর হয়েছে তখনই ম্যাজিকের মতন দুজনের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে মিমি। সত্যিই অদ্ভুত ক্ষমতা বটে মেয়েটার! দুটো প্রবল ব্যক্তিত্বশালী পুরুষকে ও যেন দুই হাতে অবহেলায় সামলে রেখেছে। একটু হাসি, নরম গলায় বলা দু-একটা কথা, নম্র অথচ ক্ষুরধার যুক্তি দিয়ে ঘায়েল করেছে দুজনকেই, কিন্তু আহত হতে দেয়নি কাউকে।
দুই নম্বর অপরিচিত ব্যক্তির নাম রিচার্ড শী। সেখানেও এক অদ্ভুত সমাপতন। চাইনিজ-আমেরিকান ডক্টর শী, ম্যাক্সের পূর্ব পরিচিত এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সিনিয়র এপিডেমিওলজিস্ট। উহান আউটব্রেকের সময় প্রাথমিক রিপোর্টগুলো যাঁরা পাঠিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে উনিও একজন। চায়নার সরকারি স্বাস্থ্যবিভাগের সাথে ওঁর সরাসরি যোগাযোগ ছিল। সেই বাবদে অনেক মহল থেকে অভিযোগের আঙুল ওঠে, সত্য গোপন এবং গাফিলতি দুরকম অভিযোগই ওঁকে শুনতে হয়। এখন উনি অনেকগুলো ফার্মা কোম্পানির মার্কেটিং কনসালট্যান্ট এবং সেই বাবদে এম-১২১৯ ট্রায়ালের মিটিংগুলোতে ওঁকেও মাঝে মাঝে দেখা গেছে। ওদিকে ভদ্রলোকের সঙ্গে রুডির সম্পর্কটা ঠিক কিরকম সেটাও ঠিক পরিষ্কার নয়।
ল্যাপটপের পর্দায় সংখ্যা আর অক্ষরের স্রোত বয়ে চলেছে, পরিসংখ্যানগুলো তন্ন তন্ন করে ঘেঁটে দেখছে রন। খুবই আশাব্যঞ্জক কিন্তু যথেষ্টরকম পরিপক্ব হয়নি ওরা এখনও। যা সুন্দর তা যে সবসময় সত্যি নয়, অনুমান যতোই জোরালো হোক তবুও সে যে প্রমাণ নয়, গবেষণার এই গোড়ার কথাটা কি ভুলে গেছে সবাই? ল্যাপটপের ডালাটা বন্ধ করে ভূতের মতন একলা অন্ধকারে বসে রইল রন, তারপর দরজা খুলে বাগানে বেরিয়ে এল পায়ে পায়ে। রাত এখন গভীর, মারীর অশুভ ছায়ার তলায় ঝিমিয়ে রয়েছে সুন্দরী শহর সানফ্রানসিস্কো। পাহাড়ে পাহাড়ে আলোকমালাও কেমন যেন স্তিমিত, পথঘাট জনহীন, ফাঁকা ফুটপাথের ওপর দীর্ঘরেখা টেনে ঝিমোচ্ছে সারি সারি ল্যাম্পপোস্টের ছায়া। অপরিবর্তিত শুধু আকাশ, সেই আকাশে চাঁদের উজ্জ্বল মুখ, সেই মুখের চারিদিকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মেঘমালা, উপসাগরের জলে তাদের স্বপ্নিল প্রতিফলন। অপরিবর্তিত ওর এই অদ্ভুত অনিদ্রার মধ্যে টালমাটাল পায়ে একলা পায়চারি করে চলা। হাঁটছে রন, ওর মাথার চারপাশে এক ঝাঁক পোকার মতন চিন্তাগুলো ভনভন করে চলেছে। কাল সকালবেলায় ওর ফ্লাইট। পরশুদিন সকালে প্রেস কনফারেন্স। সবাই আশা করে বসে আছে নতুন ওষুধ আর ভ্যাকসিন আসবে, পরাজিত প্যানডেমিক ফিরে যাবে পাতালের অন্ধকারে, আবার জলে ভাসবে জাহাজ, আকাশে উড়বে এরোপ্লেন। মানুষ আবার ইচ্ছেমতন পাড়ি দেবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে, মাথা উঁচু করে, মুখোশ ফেলে দিয়ে, নির্ভয়ে, সহজ সাবলীল ছন্দে। কি বিরাট আর মহান এই প্রত্যাশা, কেমন অবুঝ অথচ অনিরুদ্ধ এর আবেদন!
রুডি পুরো আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরে প্যারালাইজড ছিল, কিন্তু তারপর খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে এবং ঠিক পাঁচদিনের মাথায় হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়। প্রায় পুরো সময়টা ওর পাশে প্রহরীর মতন জেগে ছিল রন। ও যেন ফিরে গেছিল মেডিক্যাল কলেজের সেই বিস্ময় আর অনুসন্ধিৎসায় ভরা দিনগুলোতে। চিকিৎসার দায়িত্ব ওর নয়, ওর কাজ শুধু দেখে যাওয়া। প্রতিদিন নতুন নতুন রোগী আসছে, ডেরেক আর সাশা তাদের টিম নিয়ে লড়াই দিয়ে চলেছে দিনরাত। রনের সঙ্গে যেন একটা অলিখিত চুক্তি হয়ে গেছে ওদের। দর্শক হলেও রনের পরামর্শ মূল্যবান, প্রশ্ন করলেই ওর মতামত পাওয়া যায়, কিন্তু আগ বাড়িয়ে একটা কথাও বলে না ও। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালগুলো পুরোদমে এগোচ্ছে, কমতে শুরু করেছে মৃত্যুর সংখ্যা, সুস্থতার হারও বেড়ে চলেছে, কিন্তু রোগটাকে বশে আনা যাচ্ছে না কিছুতেই। মানুষ জাতিটার যাবতীয় জ্ঞানবিজ্ঞান আর প্রযুক্তির সামনে এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস তার উৎকট অনিশ্চয়তার ব্রহ্মাস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওসামা-বিন লাদেন, মোল্লা ওমর কিংবা আল-বাগদাদি যে অনাবিল আতঙ্কের স্বপ্ন দেখেছিল, কোথাকার এক মাছের বাজারে পয়দা হওয়া সর্দিজ্বরের ভাইরাস তার একশোগুণ আতঙ্ক ছড়াতে সক্ষম, এর থেকে হাস্যকর আর কি আছে? অহংকারের পতন বুঝি এভাবেই হয়। নট উইথ আ ব্যাং বাট আ হুইম্পার।
“ডাক্তারমেসো!” কুণ্ঠিত গলায় ডাকটা এসে ওর ধ্যানভঙ্গ করলো। গাজিবোর দরজায় দাঁড়িয়ে রোহন। ওর মতন এই ছেলেটাও রাতে ঘুমোয় না।
“রোহন, তুই ঘুমোতে যাসনি এখনও। রাত তো অনেক হল।” আধা ঘুমন্ত গলায় বলল রন, সম্ভবত নিজেকেই শুনিয়ে।
“সারাদিন তোমার সঙ্গে কথা বলার সময় হয় না। আমি জানি রাত্তিরে তোমাকে ফাঁকা পাওয়া যাবে,” কুণ্ঠিত গলায় বলল রোহন। ওর মাথার পিছনে গাছপালাদের এলোমেলো ছায়া, জ্যোৎস্নায় আধো অন্ধকারে তারাও রহস্যময়। গোপন কথা বলার জন্য এই না মাহেন্দ্রক্ষণ।
“ডাক্তারমেসো, আমি বাবার ওপর মিথ্যে সন্দেহ করেছিলাম। জাই-কু নামে মেয়েটির সঙ্গে বাবার কোন খারাপ সম্পর্ক ছিলো না।” রোহনের গলায় অনুতাপ, কিন্তু তার পিছনে যেন একটুকরো স্বস্তি উঁকি মারছে।
“তোর কমপিউটার ফরেনসিক শেষ হল তাহলে? যাক, খারাপ সম্পর্ক ছিলো না শুনে আশ্বস্ত হলাম। কিন্তু ভালো সম্পর্কটা কি রকম ছিল শুনি?” রন হাসি চাপলো। এই যুগের আমেরিকান বাচ্চারাও মাঝে মাঝে মাঝে রক্ষণশীল কথাবার্তা বলে ফেলে। নিজেরা যতই যাচ্ছেতাই করুক না কেন, পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটির পবিত্রতা বজায় রাখতে উৎসুক সবাই।
“না না আমি সেভাবে বলিনি,” ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে লজ্জা পেল রোহন, “আসলে জাই ছিল বাবার খুব ভালো বন্ধু আর ডক্টর শী’র গার্লফ্রেন্ড। ওরা তিনজনে অনেক সময় কাটাত। কিন্তু আসল রহস্যটা অন্য জায়গায়।”
“আচ্ছা। গল্প বেশ জমে উঠেছে দেখছি।” সোজা হয়ে বসলো রন, ওর চোখের তারায় চমকে উঠলো কৌতূহল। এই ডক্টর শী নামক ব্যক্তিত্বটি প্রথম থেকেই ওকে ধাঁধায় ফেলেছে।
“তুমি জানো যে বাবার কোম্পানি চায়না থেকে নানান জিনিস ইমপোর্ট করে, বিশেষ করে হেলথ কেয়ার সেক্টরের জিনিসপত্র। এই বছরের জানুয়ারি মাস নাগাদ কোম্পানির শেয়ারের দাম যখন বেশ চড়া, বাবা হঠাৎ নিজের সব শেয়ার বিক্রি করে দেয়। দেখা যাচ্ছে যে ডক্টর শী, যিনি নাকি আগের বছর অপেক্ষাকৃত অল্প দামে বাবার কোম্পানির প্রচুর শেয়ার কিনেছিলেন, তিনিও একই সঙ্গে সব শেয়ার বেচে দেন। তারপর থেকে ওই শেয়ারের দাম নামতে নামতে এখন কোম্পানিটাই জলের দরে বিক্রি হয়ে গেছে।”
“তার মানে? রুডির সাধের কোম্পানি লাটে উঠেছে! বলছিস কি তুই?” খবরটার আকস্মিকতায় হাঁ হয়ে গেল রন। এই নিয়ে রুডি কিংবা অপু কেউই তো ওকে একটি কথাও বলেনি।
“ন্যাচারালি, কেননা প্যানডেমিকের পরে চায়না থেকে হেলথ কেয়ার ইকুইপমেন্ট কেনার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু আগেভাগেই শেয়ার চড়া দামে বেচে দেবার ফলে বাবার অতটা ক্ষতি হয়নি। ওই টাকা আবার নতুন করে ইনভেস্ট করেছে বাবা। আর এই সব কাণ্ডকারখানায় বাবার পার্টনার কে বলো তো?”
“আন্দাজ করতে পারি। ডক্টর শী।”
“ঠিক তাই। দেখা যাচ্ছে উনিই এখন বাবার পার্টনার। আমার ধারণা শেয়ার বেচা এবং কেনা, সব ওনারই পরামর্শ মতন চলছে আপাতত।”
“তোর মা জানে এসব কথা?” ক্লান্ত গলায় প্রশ্ন করলো রন। হঠাৎ করেই খুব ঘুম পাচ্ছে ওর। মৃত মানুষদের মুখগুলো চোখের সামনে ভাসছে। দেখতে পাচ্ছে রাতদিন কাজ করা ডাক্তার, নার্স আর হাসপাতাল কর্মীদের সারি সারি রাতজাগা লাল চোখ। এর মধ্যেই শেয়ার কেনাবেচা চলছে, চুপচাপ টাকা বানিয়ে চলেছে কিছু লোক। অসংখ্য সাধারণ মানুষ রুজিরোজগার হারিয়ে পাগল হবার সামিল, কিন্তু তার মধ্যেও ব্যবসা ঠিক ব্যবসার নিয়মে চলেছে। যুদ্ধের সময়েও ঠিক তাই হয়, এর মধ্যে আশ্চর্য হওয়ার মতন কিছু নেই।
“মা আদৌ কিছু জানে না। বাবার ল্যাপটপ হ্যাক না করলে আমিও কিছু জানতাম না। মুশকিল এই যে ল্যাপটপটা আর আমার দখলে নেই। বাবা একটু ভালো হয়ে উঠেই ওটাকে সিকিওর করেছে।” হাসল রোহন। রন হাই তুললো আবার। সত্যি কথা বলতে কি এটাও খবর কিছু নয়। অপু খুবই ঘরোয়া টাইপের মেয়ে, রান্নাবান্না, বই, সিনেমা, সিরিয়াল আর গান শোনা নিয়েই ওর দিন কাটে। চাকরিটা পার্ট টাইম, ওটা হাতখরচের টাকা তোলার জন্য। বছরে দুবার ইন্ডিয়া ও যাবেই, সেখানে বয়স্কদের দেখাশোনার ভার পুরোপুরি ওর ওপর। রুডির ছুটন্ত জীবনের মাঝখানে ও যেন উঠোনে পোঁতা তুলসীগাছ।
আরো কিছুক্ষণ কথা বলে উঠে পড়লো ওরা। রোহন খুবই বিচলিত, ওর মাথায় নানান ধরনের ষড়যন্ত্রের গপ্পো বাসা বেঁধেছে। ডক্টর শী উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। করোনাভাইরাসের উৎপত্তি নাকি ওখান থেকে, এবং সেটা ইচ্ছাকৃত কিনা তাই নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে জল্পনার অন্ত নেই, কোনো কোনো রাজনীতিক নেতা সুকৌশলে সেই আগুনে হাওয়া দিয়ে চলেছেন। রোহনের মাথায় ঢুকেছে যে ডক্টর শীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে ওর বাবার কিছু একটা মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে। রোহন নীতিগতভাবে বাবার বিরুদ্ধে কিন্তু সেই বাবারই সুরক্ষার জন্য ওর দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। মনের গভীরে কোথাও ওর দৃঢ়বিশ্বাস যে বাবা অপরাধী হতে পারে না, আসল অপরাধীরা কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছে, তাদের খুঁজে বার করতেই হবে। আদর্শবাদের অমল দীপ্তি ওর মুখের চারদিকে খেলা করে বেড়াচ্ছে, চাঁদের আলো যেমন মেঘের চারপাশে খেলা করে। সেই দিকে তাকিয়ে ক্রমশই আরো আরো ক্লান্ত হয়ে পড়ছে রন।
“রোহন তুই শুতে যা, রাত অনেক হল,” অসহায়ভাবে বিড়বিড় করলো ও, “একদিন তুই বুঝতে পারবি যে জীবনের এই বিরাট জটিল ক্যানভাসে ভালোমন্দের হিসাব সব একদিন গুলিয়ে যায়, সেই আপেক্ষিকতার অন্ধকারে হাতড়ে বেরায় মানুষ।” কথাগুলো শেষ হবার আগেই রন বুঝতে পারলো যে গাজিবোর আরামদায়ক সোফার ওপরে ও একলা, সম্ভবত নিজের অজান্তেই কিছু সময়ের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিল। রোহন চলে গেছে, মুখের চারপাশ থেকে ডালপালা সরিয়ে ফেলে মধ্যগগনে উঠে এসেছে চাঁদ। এই অটুট জ্যোৎস্নার মধ্যে এক ফোঁটা বিভ্রান্তি নেই, সত্যের মুখ তাই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ও এখন।
ল্যাপটপটা টেনে নিয়ে ম্যাক্সকে একটা ইমেইল লিখল ও, কপি করলো মিমিকে। তারপর গভীর ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়লো সোফায়।
কখন সকাল হয়েছে ওর মনে নেই। কখন ঘরে ফিরলো সেও বিস্মৃতি। এখন ভোরবেলায় খুব সম্ভবত নিপু জানলার পর্দাগুলো টেনে দিয়েছে, তাই উপসাগর থেকে রাশি রাশি রোদ্দুর এসে ভাসিয়ে দিয়েছে ঘরটাকে। এমন উজ্জ্বল আলোয় আপনা থেকেই চোখ খুলে যায়, ঘুম পালায়, রাতের বিভ্রান্তি ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আবার যুদ্ধের জন্য তৈরি হয় মানুষ।
“ওঠো এবার। দুপুরে ফ্লাইট, তার আগে ফ্রেশ হয়ে নাও রাতপেঁচা আমার।” তরল প্রশ্রয়ের সুরে বলা কথাগুলো যেন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে সকালের রোদ্দুরে মিশে গেল, এক ঝটকায় উঠে বসলো রন। ধূমায়িত কফির কাপ হাতে নিয়ে বিছানার পাশে নিপু দাঁড়িয়ে আছে। সেই নারী, যে আর যুবতী নয়, রহস্যময়ী নয়, অথচ যার শরীরের প্রতিটি রেখায় স্থিতিশীল সখিত্বের আবেদন। ওর বুকের একদম ভেতর থেকে আশ্বাস আর আরামের এক টুকরো নিঃশ্বাস বয়ে গেল সবার অগোচরে।
খুব তাড়াতাড়ি স্নান করে তৈরি হয়ে নিল রন। কফি শেষ হবার আগেই ও ফিটফাট এবং দীর্ঘ যাত্রার জন্য তৈরি। ব্রেকফাস্ট শেষ, এখন ঘন্টা খানেক ও রুডির সঙ্গে একলা কাটাতে চায়। রুডির ফিজিওথেরাপিস্ট আসবে ঠিক দুপুর নাগাদ, তার আগে এইটুকু সময় ওর একান্তই প্রয়োজন। রুডির বেডরুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল রন।
“রুডি, আমি বস্টন ফিরে যাচ্ছি। বাকি সকলে রইলো, ওরা তোমার দেখাশুনো করবে। চিন্তা কোরো না, খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে তুমি।”
রুডি হাতটা একটুখানি বাড়িয়ে ধরলো, ওর সারা শরীর এখন বাঙ্ময়। পুরো জোর ফিরে আসেনি, মুখের হাসিটা সামান্য বাঁকা, কথাগুলো মাঝে মাঝে একটু জড়িয়ে যাচ্ছে।
“জানি। এম-১২১৯ ট্রায়াল পাবলিশড হতে চলেছে। কনগ্র্যাচুলেশন!” কাঁপা কাঁপা গলায় বলল রুডি। ওর মুখে একটা অদ্ভুত হাসি।
“রুডি, তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না। এখনও ডাটা ফাইন্যাল হয়নি, অনেক কিছুই খতিয়ে দেখা বাকি, এখনই তুমি আমাকে কনগ্র্যাচুলেট করছো কেন?” চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করলো রন।
“আমি জানি তুমি যেখানেই হাত দাও সেখানেই সোনা ফলে বস। তুমি আর তোমার ম্যাজিক ওষুধ না থাকলে থোড়াই আমি বেঁচে ফিরতাম।” রুডি বলল।
“কিন্তু সোনা ফলানো তো আমার উদ্দেশ্য নয় রুডি। আমি একজন অ্যাকাডেমিক ফিজিসিয়ান, আমার কাজ গবেষণা আর রোগীর চিকিৎসা। এই কাজে তথ্যপ্রমাণ আমার একমাত্র অস্ত্র, এর মধ্যে ম্যাজিক কোথায় পাও তোমরা?” চেষ্টা করেও গলার মধ্যে বিরক্তিটুকু চাপতে পারলো না রন কিন্তু রুডির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।
“আরে বস, আম আদমি যা বোঝে না তাই ম্যাজিক, সেটা যখন বাজারে বিক্রি হয় তার নাম টেকনোলজি। মোদ্দা কথা ইউ আর আ গ্রেট গাই অ্যান্ড আই লাভ ইউ।”
“তাহলে শোনো। আমার দৃঢ় ধারণা এম-১২১৯ না পেলেও তুমি দিব্যি সুস্থ হয়ে উঠতে, স্ট্রোকও হতো না যদি দুটো সাধারণ জিনিষ আমরা জানতাম। এই রোগের চিকিৎসার জন্য দরকার অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি ওষুধ যেমন স্টেরয়েড, এবং অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট ওষুধ যা রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না। এই ভাইরাস নিজে যতখানি ক্ষতি করে, রোগী নিজেই নিজের ক্ষতি করে তার দশগুণ। খুব তাড়াতাড়ি এটা আমি প্রমাণ করে ছাড়বো।”
“তার মানে?” অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রুডি।
“সে অনেক কথা, পরে বুঝিয়ে বলবো। তার আগে একটা প্রশ্ন আছে,” প্রসঙ্গ পালটাল রন। হঠাৎ করে এইসব কথা বলে ফেলার জন্য মনে মনে পস্তাচ্ছে ও এখন। বেচারা রুডি শুধু শুধু কনফিউজড হয়ে যাবে। বিজ্ঞান আর গবেষণা নিয়ে কথা বলার জন্য ও তো এখানে আসেনি।
“তোমার বন্ধু ডক্টর রিচার্ড শী এখন কোথায় আছেন, কি করছেন, তুমি কি কিছু জানো?”
বেশ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলো রুডি। রন দেখতে পেল ওর আহত মুখের ওপর দিয়ে নানান ভাবের খেলা চলছে।
“বস, তুমি কি শুনেছো, কতটা আন্দাজ করেছো জানি না। শালা, অর্ধেক সময় তো অজ্ঞান হয়েই ছিলাম। আজ থাক, অন্য একদিন কথা হোক?” ফিসফিস করে বলল ও। সত্যিই অপু আর নিপু আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে, যে কোন সময়ে ঘরে ঢুকে পড়তে পারে। কিন্তু রনের মাথায় যেন খুন চেপে গেছে।
“রুডি, তোমার ব্যবসার কি অবস্থা? চায়নার সঙ্গে লেনদেন তো গোল্লায় গেছে, তাহলে কি করছো তোমরা এখন?”
“এই সব নিয়ে এক্ষুনি কথা না বললে হয় না?” রুডির গলায় একটা অসহায় সুর। জানলা দিয়ে সকালের রোদ্দুর এসে ঘর ভাসিয়ে দিচ্ছে, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে প্রিয়জন। এ সময় ভালোবাসার, বিবাদের নয়। রন একবার ভাবলো কথাবার্তা এইখানেই শেষ হোক, রুডির হাতটায় আলতো চাপ দিয়ে লিভিংরুমে নেমে যাওয়া যাক। অপু, নিপু, বাচ্চারা সবাই ভিড় করে আসুক, তারপর পারিবারিক উষ্ণতার আবেশ গায়ে মেখে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হলেই ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু রোহনের প্রশ্ন আর ওর নিজের উপলব্ধি মিলিয়ে মনের মধ্যে যে আবছা ছবিটা ফুটে উঠেছে সেটাকে আরেকটু স্পষ্ট করতে না পারলেও যে শান্তি নেই।
“শুধু একটা কথা বলো রুডি। তুমি কি অন্য কোথাও ইনভেস্ট করেছো? মানে হেলথ সেক্টরে? আসলে তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছে খুব, তাই জানতে চাইছি। কৌতূহল বলতে পারো,” রন আমতা আমতা করে বললো। নিজের কথা নিজের কানেই হাস্যকর ঠেকলো ওর কাছে।
রুডি কিছু বলছে না, রনর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে শুধু। ও চিরকালই সুপুরুষ, অনেকটা ওজন ঝরে যাবার ফলে চেহারার মধ্যে কেমন যেন একটা নতুন তীক্ষ্ণতা এসেছে এখন। আগেকার সেই ডোন্ট-কেয়ার ভাবটা চলে গিয়ে ওকে কেমন যেন ভাবুক আর বিষণ্ণ লাগছে যদিও সচেতনভাবে ও ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে সেটা। মুখের হাসিটা সামান্য বেঁকে গেছে, চোখের দৃষ্টির মধ্যে অদ্ভুত একটা ছায়া, সেই ছায়ার মধ্যে সন্ত্রাস আর সন্দেহের মিশ্রণ। বহুযুগ আগে রন যখন প্রথম এদেশে রেসিডেন্সি করতে আসে, তখন কিছুদিনের জন্য ওকে কাজ করতে হয়েছিল এক সরকারি ক্লিনিকে, যেখানে যুদ্ধফেরত সৈনিকদের চিকিৎসা হয়। অনেক অজানা কথা শিখেছিল ও তখন- শেল শক, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসর্ডার। কেমন একটা অস্থির বিপন্নতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো ওরা। আজ, এতদিন বাদে রুডির চোখের মধ্যে সেই অদ্ভুত বহুমাত্রিক যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেল ও।
“আই অ্যাম সরি রুডি। ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে শুধু শুধু তোমাকে বিব্রত করলাম। ডোন্ট ওরি অ্যাবাউট ইট। আসি তাহলে?” কোনওরকমে কথাগুলো বলে পালাবার তাল করলো রন। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে, রুডির উত্তর এসে ওকে গেঁথে ফেলেছে ঘরের দরজায়।
“বস তোমার মেডিক্যাল এথিকসে যেমন কিছু নিয়ম আছে, সেখানে একের কথা অন্যকে বলা অনুচিত, ঠিক তেমনি আমাদের ব্যবসায়ীদের মধ্যেও কিছু এথিক্যাল ইস্যু আছে। ভালো ব্যবসায়ী ঠিক সময় ঠিক পার্টনার খুঁজে নেয় এবং তাই নিয়ে মন্ত্রগুপ্তি বজায় রাখে। আবার সুযোগ পেলে এক ব্যবসায়ী আরেকজনকে খতম করেও দিতেও ছাড়ে না। আসলে এটা একটা লড়াই, যেখানে অ্যাটাক, ডিফেন্স, পশচারিং আর স্টেলথ, সবকিছুই দরকার লাগে। তুমি জেনে রাখো যে সেই লড়াইতে আমাকে কাবু করা সহজ হবে না। একটা সেটব্যাক হয়েছিল, কিন্তু আমি আবার ঘুরে দাঁড়াবো।”
এর পরে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে রন টের পেল ওর চোখের পাতা কাঁপছে, কপালে সামান্য ঘাম। কাজপাগল রন চ্যাটার্জি কাজে ফেরার আগে নার্ভাস হচ্ছে কেন? ও যেজন্য এসেছিল সুষ্ঠুভাবে তা শেষ করেই তো ফিরছে। রুডি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছে, পারিবারিক ফ্রন্টে এখন শান্তি এবং কৃতজ্ঞতা। ওদিকে ওর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও গবেষণার রিপোর্ট ছাপা হতে চলেছে। নতুন ওষুধ বেরোবে, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাবে অসংখ্য মানুষ। তারপর শুরু হবে মাস ভ্যাকসিনেশন, দুনিয়া থেকে নির্মূল করতে হবে সভ্যতার শত্রু এই ভাইরাসকে। ওর তো এখন উৎসাহে চনমন করার কথা। নিজেকে ঝাঁকুনি নিয়ে চাঙ্গা করার চেষ্টা করলো রন, জোর করে হাসি টেনে আনলো মুখে।
নিপু আর অপু দুজনেকেই বেশ খুশি খুশি লাগছে। ঠিক হয়েছে রুডি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠা অবধি নিপু থেকে যাবে, বাচ্চারা পরের হপ্তায় ফিরবে যে যার কাজে। রোহন আর মাম্পি ওকে ড্রাইভ করে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাচ্ছে।
যাবার পথে খুব বেশি কথা হলো না। রন যেন ভেতর থেকে ঝিমিয়ে পড়েছে। মাম্পি সাধারণত বকরবকর করে সবাইকে ব্যস্ত রাখে কিন্তু আজকে ও একদম চুপচাপ। নিউইয়র্ক থেকে ছেলে ফোন করলো, কথা হল কিছুক্ষণ। রনের এক একবার মনে হয় এই বিষণ্ণ সময়ে ছেলেটা ভালোই আছে বলতে হবে। প্রেম এবং পরোপকার, এই যুগল রূপকথার আলিঙ্গনে দিন কাটছে ওর।
এয়ারপোর্ট। রোহন হঠাৎ নিচু হয়ে ওকে প্রণাম করতে গেল। ব্যাপারটা এতই অপ্রত্যাশিত যে প্রায় আঁতকে উঠে ওকে ধরে ফেললো রন।
“ভালো থাক, বাবাকে ভুল বুঝিস না। আস্তে আস্তে দেখিস, সব ভালো হয়ে যাবে।” চেষ্টা করে গলার মধ্যে কিছুটা আশাবাদের সুর টেনে আনার চেষ্টা করলো ও।
এবার শ্রুতির পালা। ও এগিয়ে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো বাবাকে। কয়েক মুহূর্তের জন্য কি আরাম।
“নিজের খেয়াল রেখো আর যাই হোক নিজেকে দোষী কোরো না। আমি ফোন করবো রোজ।” শ্রুতি আস্তে আস্তে বললো। মনের ওপর চেপে বসা পাথরটা যেন সরে গেল একটুখানি।
এতক্ষণে আকাশ। পায়ের তলায় মিলিয়ে যাচ্ছে মুখোসে ঢাকা ত্রস্ত পৃথিবী, অথচ মেঘেরা ঠিক আগের মতন অবাধ স্বাধীনতায় ভ্রাম্যমান। জোরে একটা নিঃশ্বাস নিল রন। সামনের কয়েকটা দিন প্রি-পাবলিকেশন, তখন অনেক কাজ, অসংখ্য মিটিং। কেজো চিন্তার ফাঁকে ফাঁকে একটা মুখ উঁকি মেরে যাচ্ছে। মিরিয়ম, ম্যাক্সের সঙ্গিনী, বিউটি উইথ ব্রেইন মিরিয়ম।