• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯১ | জুলাই ২০২৩ | উপন্যাস
    Share
  • সন্ত্রাস (৪) : কৌশিক সেন



    ।।৮।।
    “But, you know, I feel more fellowship with the defeated than with saints. Heroism and sanctity don't really appeal to me, I imagine. What interests me is being a man.”
    দুই ডাক্তারের মধ্যে একজন রোগা লম্বা, আরেকজন বেঁটে মোটা। খুব ছোটবেলায় সাদাকালো টেলিভিশনে দেখা লরেল হার্ডির মতন। এমন অসময়ে এইরকমের উদ্ভট তুলনা ওর মাথায় কি করে এলো কে জানে। খেয়ালি মন কখন যে কোন ঘরের দরজা খুলে দেয় তার ঠিক নেই।

    “আসুন ডক্টর চ্যাটার্জি। আমাদের আগেও দেখা হয়েছে, আপনার হয়তো মনে নেই। বস্টনে এম-১২১৯ ট্রায়ালের জন্য যে ইনভেস্টিগেটরস মিটিং হয়েছিল সেখানে আমি ছিলাম। এনিওয়ে আমি ডেরেক রাঘবন, পালমোনোলজিস্ট, ইনি সাশা ইভানোভ, ইনফেকসাশ ডিজিস স্পেশালিষ্ট, আমরা দুজনে আপনার ব্রাদার-ইন-ল’র দেখাশুনো করছি। আশাকরি আমাদের ব্যবস্থাপনায় আপনি সন্তুষ্ট। আপনি মত দিলে আমাদের পেশেন্টকে আজ বিকেল নাগাদ এক্সটিউবেট করা যেতে পারে” বেঁটে ভদ্রলোক এগিতে এসেছেন।

    “অনেক ধন্যবাদ আপনাদের”, মনের মধ্যে হাতরে মুখগুলো খুঁজে বার করার চেষ্টা করলো রন। এই সময়ে কাজটা মোটেই সহজ নয়। ওদের সারা গা ঢাকা গাউন, চোখের সামনে স্বচ্ছ প্ল্যাস্টিকের ঢাল, মুখে এন-নাইন্টিফাইভ মুখোশ। কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে ওঠা সংখ্যা আর গ্রাফগুলোর দিকে মন দিলো ও। কয়েক মুহুর্ত সবাই চুপচাপ।

    “আপনারাই সব সিদ্ধান্ত নেবেন। তাও যদি প্রশ্ন করেন তো বলি, আমার মতে আরেকদিন অপেক্ষা করা বোধহয় ভালো হবে।” একটু বাদে কুণ্ঠিত স্বরে বললো রন। কিছু একটা ওর ঠিক লাগছেনা, কিন্তু সেটা যুক্তি দিয়ে আরেকজনকে বোঝানো অসম্ভব।

    “আরে না না, ডক্টর চ্যাটার্জি আপনি মিথ্যেই ভয় পাচ্ছেন। দেখুন আমরা দুজনেই তো একই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ইনভেস্টিগেটর তাইনা? যেসব রোগী এই নতুন অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ পাচ্ছেন তাঁরা সাত দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠছেন, এটা তো এখন জানা খবর। আমি আপনাকে কনফিডেন্টলি বলতে পারি যে আপনার রিলেটিভ আসল ওষুধটাই পেয়েছেন এবং উনি সুস্থ হয়ে উঠবেনই,” সাশা নামক অল্পবয়েসী ডাক্তারটি যারপরনাই উত্তেজিত, প্রবীণ ডক্টর রাঘবনও ঘাড় নাড়ছেন। ঘাড় নাড়ার ভঙ্গিটা দেখে বোঝা যায় ভদ্রলোক দক্ষিণ ভারতীয়। রন আর কথা বাড়াল না। মাথার ভেতরে অস্বস্তিটা থেকেই যাচ্ছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জগতে অতি-উৎসাহ মোটেই ভালো গুণ নয়, ওর থেকে যে দোষটি জন্মায় তার নাম বায়াস। পরিসংখ্যানের নৈর্ব্যক্তিক নিয়মে নিজেকে বেঁধে রাখতে পারাই গবেষকের সবচাইতে বড়ো গুণ, তারই নাম অ্যাকাডেমিক সততা। অন্যদিকে রয়েছে বিরাট ক্ষমতাশালী ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি, যাদের প্রতিটি পদক্ষেপ জরিপ করে চলছে ওয়াল স্ট্রীট, সেখানে সত্যমিথ্যার মাঝখানে অনেকটা ধোঁয়াটে এলাকা আছে যেখানে জুয়া আর ফাটকাবাজির স্বর্গরাজ্য।

    রুডির দিকে মন হিল ও। ছটফটে মানুষটা তার আর টিউবের জঙ্গলের ভেতরে চুপ করে শুয়ে আছে। কষ্ট কমাবার জন্য ওকে আধো ঘুমে রেখে দেওয়া হয়েছে, চোখ দুটো তবুও জীবন্ত। ভেন্টিলেটর যন্ত্র তার নির্দিস্ট ছন্দে ওর বুকের মধ্যে বাতাস ঠেলে দিচ্ছে, মনিটরের গায়ে ফুটে উঠছে ওর প্রতিটি হৃৎস্পন্দন।

    “রুডি ক্যান ইউ হিয়ার মি?” ফিসফিস করে বলল রন।

    কোনো কথা যদিও শোনা গেলনা কিন্তু রুডির চোখে একটা পরিচিত ভঙ্গি ফুটে উঠলো, অক্সিমিটার লাগানো হাতের আঙুল নড়ে উঠলো একটু। রন অনুভব করতে পারলো ওর উত্তরটা- ইয়েস বস।

    “তুমি ঠিক হয়ে যাবে। ভয় পেয়োনা, আমরা সবাই এখানে আছি” আবার ফিসফিস করলো রন।

    রুডির আঙুলটা নড়ল আবার। চোখ দুটো পরিষ্কার তাকালো রনের দিকে। আবার ইঙ্গিতে উত্তর ভেসে এলো- আই নো। নো ওরিস।

    নো ওরিস। কোনো চিন্তা নেই, পরোয়া নেই কোনো কিছুর। এই শব্দবন্ধটি রুডির মুখে কতদিন শুনেছে রন। নানান পরিস্থিতিতে যখনই সমস্যা দেখা দিয়েছে, তখনই দরাজ বুক আর প্রকাণ্ড চোয়াল নিয়ে এগিয়ে এসেছে রুডি। ওর মুখে কতবার শুনেছে ওই একই আশ্বাস- চিন্তা নেই, নো ওরিস। রনর বাবা যেদিন চলে গেলেন, হাসপাতাল থেকে কেওড়াতলা, ওর পাশে ছায়ার মতন লেগে ছিল এই লোকটা। যেন চোখের নিমেষে দশ হাজার মাইল পেরিয়ে ঠিক সময়ে সক্কলের আগে কলকাতা পৌঁছে গেছিল রুডি। রন তখন দিশেহারা, স্থানীয় ডাক্তার আর হাসপাতাল, কোনটাই ওর পছনমতন নয়। বাবা ভেন্টিলেটরে পরে আছে দশদিন হয়ে গেল, রন বুঝতে পারছে যে নানারকম যন্ত্র হাজির থাকলেও যন্ত্রীরা অপদার্থ কিংবা স্রেফ অনুপস্থিত। ট্রাকিওস্টোমি করা হয়েছে কিন্তু বাবার নিঃশ্বাস নেবার ক্ষমতা তবুও প্রায় শূন্যে। এই অবস্থায় টিউব খুলে রোগীকে মরফিন দেওয়াই সঠিক, যাতে সে বিনা কষ্টে ইললীলা সাঙ্গ করতে পারে। কিন্তু কে নেবে সেই সিদ্ধান্ত, পিঠের ওপরে অপরাধবোধের প্রকাণ্ড বোঝাটাই বা নামবে কোথায়? মা আর আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে নানান কথা, নানান অনুযোগ। এই ঘুর্ণিঝড়ের মাঝখানে রুডি এসে দাঁড়ালো, তারপর থেকে রনর চারপাশে একটা অদৃশ্য কাঁচের দেওয়াল নেমে এলো যেন। ও নিজের শোক নিয়ে একলা হবার সময় পেলো, বাইরের সব ঝামেলা একা হাতে সামলে গেল রুডি। তিনদিন বাদে যখন নিপু এল, পরিচিত আর অপরিচিত লোকে বাড়ি ভরে গেল, রন ততক্ষণে নিজের দুই পায়ের ওপর শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওর একলা ভেঙেচুরে যাবার সাক্ষী হয়ে ছিল শুধু একজন, যে এখন এই মুহুর্তে সামনের বিছানায় শুয়ে আছে।

    অবশেষে বাড়ি। গ্যারেজের দরজাটা বন্ধ করার সময় অজান্তেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রন। এখন অবধি সব খবর ভালো, রুডিকে কাল এক্সটিউবেট করা হবে, আশা করা যায় তারপর থেকে ও ভালো হয়ে উঠবে ক্রমশই। লিভিংরুমে সবাই জমায়েত হয়েছে তাদের সামনে দাঁড়ানো সহজ হবে আজ। গত কয়েকদিন খুব কঠিন সময় কেটেছে এইখানে।

    আজ শনিবার, শ্রুতি তাড়াতাড়ি উঠে সকলের জন্য রান্না করেছে। ও জানে যে ভোরবেলা কেউ ওঠার আগে বাবা হাসপাতালে চলে যাবে, সাড়ে নটা নাগাদ ফোন করে সেদিনের পরিস্থিতি জানিয়ে দেবে শ্রুতিকে। মা নয়, মাসিমণি নয় ফোনটা প্রথমে সবসময় শ্রুতির কাছেই আসে, সেখান থেকে ফিলটার হয়ে খবরগুলো বাকি সকলের কাছে পৌঁছয়।

    “বাবা, এই নাও তোমার কফি,” দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে এক ঝলক আলো এসে পড়লো রনর ক্লান্ত চোখের ওপর। চোখেরা রাত দুটোর আগে বন্ধ হয়না আজকাল, অথচ সকাল সকাল ছটার মধ্যে ঠিক আবার খুলে যায়।

    “থ্যাংকস মাম্পি”

    “আজ দুপুরে ঘুমোবে কিন্তু। ঘর অন্ধকার করে দেবো, কেউ তোমাকে বদার করবেনা। তোমার ফোন আমার জিম্মায় থাকবে” আরোপিত গম্ভীর গলায় বলল শ্রুতি। সদ্য স্নান করে এসেছে ও, ভেজা চুলগুলো থেকে জলের ফোঁটারা গড়িয়ে পড়ছে ওর কাঁধের ওপর।

    “মাম্পি পাকামি করিস না। তুই আমার থেকে বেশি কাজ করিস রোজ”

    কফির কাপটা নিয়ে নরম কাউচের মধ্যে ডুবে গেল রন। জানলার ওধারে ক্যালিফোর্নিয়ার উদার সূর্য্যালোক ছড়িয়ে আছে লেবুগাছ আর ফ্লাওয়ার বেডের ওপর। দূর থেকে ভেসে আসছে উপসাগরের শনশনে হাওয়া আর পাথরের ওপর আছড়ে পড়া ঢেউয়ের কলতান।

    “তোমার ওষুধের জন্যই ও ভালো হয়ে উঠলো” খুব মৃদু স্বরে বলল অপু। ও এমনিতেই খুব কম কথার মেয়ে। রুডি হাসপাতালে ভর্তি হবার পর থেকে ও ঠাকুরঘরে অনেকটা সময় থাকে, বাকি সময়টা নিপুকে আঁকড়ে ধরে কাটিয়ে দেয়। রোহন বেশিভাগ সময় নিজের ঘরে কিংবা মাম্পির সঙ্গে কাটায়, ওর ভেতরে কি যে হয়ে চলছে, অন্য কারো কাছে তার খবর নেই।

    “অপু, আমি সত্যিই জানিনা যে কি ওষুধের জন্য কি হচ্ছে কিন্তু রুডির অবস্থা যে ইম্প্রুভ করছে এটাই সবথেকে বড়ো কথা। সো লেট আস রিজয়েস অন দ্যাট” কফির কাপটা সামান্য তুলে আস্তে আস্তে বলল রন।

    “তুমি যাই বলো, আমরা মনে করি যে তোমার জন্যই রুডি ভালো হয়ে উঠছে। এই ভয়ঙ্কর সময়ে সবকিছুর মধ্যে একজন ভিতরকার মানুষ থাকা খুবই জরুরি” খুব কনফিডেন্ট গলায় নিপু বললো। দুই বোন ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে, দুজনের চোখেই আশার ঝিলিক। রনের মনে হল বিষাদখিন্ন এই পরিবারের কাছ থেকে এইটুকু আনন্দ আর আশাবাদ কেড়ে নেবার কোনই অধিকার নেই ওর। ও আসার পর থেকে রুডি যে সুস্থ হয়ে উঠছে, এটা নিতান্তই কাকতালীয়। যদিও ও প্রিন্সিপ্যাল ইনভেস্টিগেটর, এম-১২১৯ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সারা দেশের অনেকগুলো হাসপাতালে চলছে, ইউ-সি-এস-এফ মেডিক্যাল সেন্টার যে তাদের মধ্যে একটা, সেখানেও ওর কিছুই করার নেই। প্রতি দুজন রোগীর মধ্যে একজন ওষুধ পাবে, অন্যজন পাবে প্লাসিবো। রুডি আদৌ ওষুধ পেয়েছে কিনা, পেলেও উপকারের সম্ভাবনা কতখানি, এসব তথ্য এখন অন্ধকারে।

    “দেখবে, রুডি একটু ভালো হয়ে উঠলেই তোমার কোম্পানির স্টক কিনবে” অপু বলে উঠলো, ওর গলায় এই প্রথম আশাবাদের সুর, অথচ কথাটা শোনা মাত্রেই রনের মেজাজ খারাপ।

    “অপু, ফাইপ্রো ফার্মা আমার কোম্পানি নয়, ওটা একটা পাবলিকলি ট্রেডেড মালটিন্যাশন্যাল ওষুধ কোম্পানি। যেহেতু আমি ওদের প্রডাক্ট নিয়ে গবেষণা করছি, ওদের স্টক কেনা আমার পক্ষে বেআইনি। রুডি অবশ্যই কিনতে পারে কিন্তু সেটাও আমাকে ডিসক্লোজ করতে হবে”

    “আচ্ছা আচ্ছা ওসব কথা পরে হবে। এখন খেয়ে নাও, খাবার গরম করে দিয়েছি। কি চেহারা হয়েছে তোমার? বাব্বা কটা দিন ছিলাম না তার মধ্যেই বোধহয় দশ পাউন্ড ঝরিয়ে ফেলেছ?” নিপু আদুরে গলায় বললো। রন এসে থেকেই দেখছে যে নিপুর মেজাজ ভালো হতে হতে প্রায় মধুযামিনীর কাছেপিঠে গিয়ে হাজির এখন। বোনের বিপদের সময় ওর স্বামী আর মেয়ে যে এসে হাল ধরেছে, সেই গর্ব ঝরে পড়ছে ওর প্রতিটি বাক্যবন্ধে।

    “আমি জানি তুমি মানবেনা কিন্তু আমার বিশ্বাস যে তুমি না এলে রুডি এত তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠতোনা। চিরটা কাল দেখে এসেছি যে ভেতরকার লোক হাজির থাকলে সব সময় কাজ অন্যরকম হয়” চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল নিপু। ওদের গেস্ট বেডরুমটা বেশ বড়ো আর আরামদায়ক।

    “মাম্পি কোথায়?” ক্লান্ত গলায় প্রশ্ন করলো রন। কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না ওর। মানুষ মনে মনে যা চায় বাস্তবেও তাই বিশ্বাস করতে ভালোবাসে, সেই বিশ্বাসে আঘাত দিলে কষ্ট পায়।

    “রোহনের ঘরে, আর কোথায়? দুজনের খুব ভাব হয়েছে এখন। ছোটবেলায় তো কেউ কাউকে সহ্য করতে পারতোনা, খালি মারপিট করতো” নিপুর গলায় কেমন একটা দুশ্চিন্তার রেশ।

    “ছোটবেলা আর বড়োবেলার মধ্যে অনেক তফাৎ নিপু। দাঁড়াও ওদের সঙ্গে কথা বলে আসি” ঝট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রন।

    রোহনের ঘরটা দোতলায় কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা গেল দরজা বন্ধ। রুডির বিশাল বাড়িতে কাউকে খুঁজে বার করা মাঝে মাঝে মুশকিল হতে দাঁড়ায়। একতলায় ওদের নিজেদের বেডরুম, ধরে নেওয়া যায় অপু ওখানেই আছে। গেস্টরুমটা বেসমেন্টে, সেখানে ঘর ছাড়াও আছে আলোকিত ওয়েট বার, সারি সারি দুর্মূল্য মদিরার বোতল, প্রশস্ত কার্পেটে ঢাকা পার্টি এরিয়া, বিলিয়ার্ড রুম এবং কাঁচে ঢাকা ছোট্ট সুনীল একটি ইনডোর সুইমিং পুল। এত সব ছেড়ে রুডি এখন মাকড়শার জালে আটকানো পোকার মতন হাসপাতালের এক ঘুপচি ঘরে সংখ্যাহীন আঁকাবাঁকা নানা রঙের তার, ক্যাথিটার আর টিউবের মাঝখানে ঝুলে রয়েছে।

    পায়ে পায়ে বেসমেন্টে নেমে এল রন। একবার ভাবলো ঘরেই ঢুকে পরে, বিছানায় নিপুর পাশে, অভ্যস্ত স্পর্শ আর গন্ধের মাঝখানে নামিয়ে রেখে দেয় ক্লান্ত শরীরটাকে। কিন্তু অদ্ভুত একটা স্নায়বিক উত্তেজনা ওকে ভূতের মতন তাড়া করে চললো, সুস্থ হয়ে বসতে দিলো না কিছুতেই। কাঁচের দরজাটা খুলতেই ওর মুখের ওপরে এক ঝলক গরম আর ভিজে হাওয়া, তার সাথে ভেজাল মেশানো জ্যোৎস্না এসে পড়লো। আশেপাশে ল্যান্ডস্কেপ লাইটগুলো জ্বলছে, তাই এই পুর্ণিমার রাতেও জ্যোৎস্না যেন তার আদত চেহারাটিকে খুঁজে পাচ্ছেনা। সারি দেওয়া পাম গাছগুলোর বিরাট পাতাগুলো ঠিক ওর মনের মতোই অজানা অস্থিরতায় চঞ্চল, তাদের গোড়া ঘেঁষে আঁকাবেঁকা ফ্লাওয়ার বেড। সেখানেও অযত্নে কিছু আগাছার আস্তানা হয়েছে, কিন্তু এই ঘোলাটে আলো-অন্ধকারে কে যে ফুলগাছ আর কে আগাছা বোঝা প্রায় অসম্ভব।

    “বাবা”

    আলো অন্ধকারের মধ্যে ডাকটা যেন মহাসিন্ধুর ওপার থেকে ভেসে এল। উদভ্রান্ত চোখে এদিক ওদিক তাকালো রন যেন মেয়ে ওর বিপদে পড়েছে কোথাও। ও দেখতে পেল জ্যোৎস্না ভেদ করে দুজন তরুণ তরুণী কখন ওর দুপাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তারা পুরোপুরি সুস্থ এবং নিরাপদ।

    “রোহন, মাম্পি, তোদেরই খুঁজছিলাম। ঠিক আছিস তো তোরা” নিজের উদ্বিগ্ন গলা শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেল রন।

    “আমরা তো ঠিকই আছি ডাক্তারমেসো, যা কাজ করার তো তুমি একাই করে চলেছ” রোহন এসে ওর ডান হাতটা ধরেছে এবার, বাঁ হাতের আঙুলে শ্রুতির আঙুলের স্পর্শ। সেই যুগল স্পর্শের মধ্যে রন টের পেল হারিয়ে যাওয়া শৈশব আর যৌবনের সুগন্ধ, কিছু মানুষের একসাথে সুদীর্ঘ পথ হাঁটার এক অনির্বচনীয় সংগীত। ও জানে যে এই সংগীত একেবারেই সাবজেক্টিভ, ব্যক্তিগত মায়া, সংস্কৃতি আর বিশ্বাস দিয়ে বানানো। সময়ের অন্তহীন ছবিটার মধ্যে এরা পেন্সিলের কাটাকুটি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাও এই মুহুর্তে এই আধো জ্যোৎস্নার তরল অন্ধকারে এটাই একমাত্র সত্য, মহাবিশ্বে এর থেকে জীবন্ত আর কিছু নেই।

    “আয় বোস” একটা খালি বেঞ্চির দিকে আঙুল দেখালো রন, “শুনেছিস নিশ্চয়ই, সব ঠিকঠাক থাকলে কাল রুডিকে এক্সটিউবেট করা হবে, ধরে নেওয়া যায় যে ও আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠবে তার পরে”

    “তুমি কতটা কমফর্টেবল বাবা। আমরা এই নিয়েই কথা বলছিলাম এতক্ষণ?” শ্রুতি বললো। এখানে জ্যোৎস্নায় যদিও ল্যাম্পের আলোর ভেজাল মেশানো, তবু ওর মুখটা অসম্ভব নরম আর নিষ্পাপ দেখাচ্ছে এখন।

    “দেখ আমরা তো একটা অ্যালগোরিদম ফলো করি, পার্সোন্যাল মতামত সেখানে অতটা ইম্পর্ট্যান্ট নয়। যে ওষুধটা ওকে দেওয়া হয়েছে সেটা কাজ করছে বলেই তো মনে হয়।” যান্ত্রিক গলায় বলল রন। ওর প্রতি রক্তবিন্দু আশা করে আছে যে কথাগুলো যেন সত্যি হয়।

    “আমরা ইন্টারনেটে নানারকম অস্বস্তিকর খবর পাচ্ছি ডাক্তারমেসো। কোনটা ঠিক কোনটা ভুল, কিছু বুঝতে পারছিনা। ওরা বলছে যে এই সব ট্রায়ালগুলোকে নাকি ম্যানিপুলেট করা হচ্ছে, বিগ মানি ইজ ইনভলভড, দে আর কলিং দা শটস। আমি কিন্তু শিওর যে তুমি যা করছো সেটাই ঠিক,” রোহনের গলা শুনেই বোঝা যায় যে ও প্রাণপণে আশ্বস্ত হতে চাইছে। ও চাইছে ছোটবেলার মতন ডিজনিল্যান্ডে দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে চুপচাপ ডাক্তারমেসোর কাঁধে উঠে পড়তে। যতই ঝিমুনি আসুক না কেন, ওখান থেকে পড়ে যাবার কোনো ভয় নেই।

    “তোকে হাজারবার বলেছি না যে ইন্টারনেটে দৈনিক নতুন নতুন কন্সপিরেসি থিয়োরিগুলো নিয়ে মাথা ঘামাবিনা” বাবা আর বাবার কলিগরা যা করছে পুরো দায়িত্ব নিয়েই করছে। যা এখন ওপরে গিয়ে শুয়ে পড়, মাসিমণি তোর জন্য জেগে বসে রয়েছে” শ্রুতি বলল, ওর গলায় কেমন যেন একটা নতুন খুঁজে পাওয়া আত্মবিশ্বাস। রোহনও দিব্যি ভালো ছেলের মতন শুনে নিল ওর কথা।

    “ঠিক আছে, গুড নাইট ডাক্তারমেসো”

    “গুড নাইট”

    রাত্রে বৃষ্টি হবে কিনা বোঝা যাচ্ছেনা। বাবা আর মেয়ে বেঞ্চিতে পাশাপাশি বসে চুপচাপ। হাওয়ায় একটা জলজ তরঙ্গ মাঝে মাঝে ভেসে আসছে, দূর থেকে যেন শোনা যাচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগরের গুঞ্জন।

    “বাবা, ইউ শুড টেক সাম রেস্ট,” শ্রুতির আঙুলগুলো এখনো রনর আঙুলের সঙ্গে জড়ানো। কেউ কাউকে ছাড়তে চাইছেনা, যদিও দুজনেরই ঘুমের একান্ত প্রয়োজন।

    “রোহনকে কিরকম বুঝছিস এখন? তোরা তো খুব ক্লোজ এখন, সবসময় একসাথে থাকিস” কথাগুলো নিজের কানেই বোকা বোকা শোনালো রনর। ও জানে ওর মুখ দিয়ে নিপুই প্রশ্নটা করছে।

    “উই আর ক্লোজ অ্যাজ কাজিনস শ্যুড বি, স্পেশ্যালি ডিউরিং আ ফ্যামিলি ক্রাইসিস,” সামান্য শব্দ করে হেসে উঠলো শ্রুতি। ওইটুকু হাসির মধ্যেই সব বলা হয়ে গেল, ছোট্ট একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বয়ে গেল রনর বুকের ভেতর। এই স্বস্তিটুকু ভাগ করে নেওয়া যায় কিনা ওর জানা নেই।

    “মাসিমণি আর রোহন এক ঘরে শোয় এখন। রোহন কাছে না থাকলে ঘুমোতে পারেনা মাসিমণি। ইন মেনি ওয়েজ, দে আর ব্যাক টু হিজ চাইল্ডউড ডেজ। এরকম ক্রাইসিসের সময় এটাই হয়ত স্বাভাবিক,” আস্তে আস্তে বলল শ্রুতি, ওর গলায় গভীর সমবেদনার সুর।

    “তুইই যা, শুয়ে পড় এবার। একবার দেখে নিস মা ঘুমালো কিনা”

    “তুমিও ঘুমিয়ে নাও বাবা। সেই সকালে হাসপাতালে গেছ, তারপর তো এক মিনিট বসোনি”

    “আমার অভ্যাস আছে রে। আজকের রিপোর্টগুলো একবার দেখে নিয়েই শুয়ে পড়বো”

    মেয়েকে শুতে পাঠিয়ে দিয়ে একলা ক্লান্ত পায়ে আবার বাগানে এসে বসলো রন। এতক্ষণে মেঘের ভেলারা এসে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে জ্যোৎস্না, কৃত্রিম আলোরা সবাই নিভে গেছে, যা কিছু দৃশ্যমান তার মধ্যে প্রায় পুরোটাই এই মুহুর্তে আধিভৌতিক। আস্তে আস্তে পকেট থেকে ও বার করে আনলো ফোনটা। দু একটা রিপোর্ট স্ক্রোল করে দেখলো, তারপর কনট্যাক্ট লিস্টে একটা নামের ওপর গিয়ে স্থির হয়ে গেল ওর আঙুল। দেশের অন্যপ্রান্তে বেজে উঠলো অন্য আরেকটা ফোন।

    “মিমি! আজকের রিপোর্টটা?”

    “মাই গড রন, তোমার ওখানে বোধহয় এখন রাত দুটো কি তিনটে। কি করছ তুমি এত রাত্তিরে? ওদিক থেকে পুরুষ গলায় উত্তর এলো। গলাটা কিঞ্চিৎ জড়ানো, সুতরাং দ্রব্যগুণের গল্পটা আন্দাজ করে নেওয়াই যায়।

    “ও ম্যাক্স। সরি। ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি? প্রচণ্ড থতমত খেয়ে বলল রন। নিজেকে থাপ্পড় কষাতে ইচ্ছে করলো একটা।

    “মিমি বোধহয় এখনও কাজ করছে, ফোনটা ফেলে গেছে এখানেই। ওকে দেবো?

    “না না, তুমিই তো আছো। আজকের রিপোর্ট কেমন ম্যাক্স? পেশেন্টরা কিরকম রেসপণ্ড করছে বলতে পারো? সাইড এফেক্ট প্রোফাইলটা ঠিকমতন রেকর্ড হচ্ছে তো?” কোনোরকমে প্রশ্নগুলো গলা দিয়ে বার করে আনলো রন। “সব মিলিয়ে রিপোর্ট আদৌ খারাপ নয় রনি, আমরা প্রিলিমিনারি পাবলিকেশনের জন্য তৈরি। তবে কিনা কাল সকালে আরেকটু ভালো করে তোমায় বলতে পারবো। তুমি এই নিয়ে চিন্তা করে আর শুধু শুধু রাত্তির জেগোনা” জড়ানো গলায় উত্তর এলো, তার ভেতরে কোথাও বুঝি একটা সামান্য বিরক্তির আভাষ আছে। থাকাই স্বাভাবিক।

    “আসলে মিডিয়াতে এমন হাইপ হচ্ছে যে কেমন যেন ভয় করছে আমার”

    “কাম অন রনি। এই বাজারে হাইপ তো হবেই!”

    ম্যাক্সের কথার বাইরে ঘরের মধ্যে খুব মৃদু ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু শব্দ শুনতে পেলো রন। ভাষা নয়, ভাষাকে আড়াল করে দেওয়া কিছু শব্দ। ঠিক যেমন আজকে এই নির্ঘুম রাত্তিরে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ এসে যখন ইচ্ছে তখন আড়াল করছে পুর্ণিমার চাঁদকে, অদ্ভুত একটা না বোঝা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ছে ঘুমন্ত পৃথিবীর ওপর। শব্দ বুঝিয়ে দিচ্ছে যে ওই বিছানায় আরেকজন কেউ শুয়ে আছে, অন্ধকারে ভাসছে তার শরীরের গহন সজীব উত্তাপ।

    একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠতে যাচ্ছিল রন আর তখনই টুং করে এসে গেল মেসেজটা।

    “এভরিথিং ইজ গোয়িং গ্রেট, প্রফেসর। ইউ নিড টু স্লীপ নাউ। গুডনাইট। মিমি” মেসেজের তলায় একটা হাসিমুখের ইমোজি বোকার মতন ঠাণ্ডা বেঞ্চিটার ওপরে আবার বসে পড়লো ও। হয়তো সত্যিই এভরিথিং ইজ রিয়ালি গ্রেট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধটা দারুণ কাজ করছে। কয়েক মাসের মধ্যে ভ্যাকসিন ট্রায়ালগুলোও অনেকদূর এগিয়ে যাবে। রুডি সুস্থ হয়ে নিজের পায়ে হেঁটে বেরিয়ে আসবে হাসপাতাল থেকে। পৃথিবীর দরজা খুলে যাবে আবার, কনফারেন্স হলগুলো নতুন উত্তেজনায় সরগরম হয়ে উঠবে। নতুন এক প্রাণদায়ী ওষুধের একজন আবিষ্কারক হিসাবে প্রফেসর রন চ্যাটার্জির টুপিতেও উঠবে নতুন সম্বর্ধনার পালক। তবু এই উদ্ভট রাত্রির অনিদ্রার মধ্যে বসে কেবলই মনে হচ্ছে, যদি না হয়। যদি কোথাও একটা ভুল হয়ে গিয়ে থাকে। স্ন্যাপ ডিসিশন, খুব দ্রুত সিদ্ধান্তে আসা নিয়ে ওর বরাবরই একটা আপত্তি ছিল, কে জানে বয়েস হবার সাথে সাথে এখন সেটা বাতিকের দিকে চলে যাচ্ছে নাকি? কে জানে? মাঝে মাঝে কিছু ভালো লাগেনা আজকাল। কে জানে কেন ভালো লাগে না?

    ।।৯।।
    “In this respect, our townsfolk were like everybody else, wrapped up in themselves; in other words, they were humanists: they disbelieved in pestilences. A pestilence isn't a thing made to man's measure; Therefore, we tell ourselves that pestilence is a mere bogy of the mind, a bad dream that will pass away. But it doesn't always pass away and, from one bad dream to another, it is men who pass away, and the humanists first of all, because they have taken no precautions.”
    “হ্যালো দাদা, গ্রেট নিউজ। রুডিমেসোকে এক্সটিউবেট করা হয়েছে, এখন অক্সিজেনে আছে। তোর কি খবর রে, একদম যে চুপচাপ? শ্রুতি প্রায় চেঁচিয়েই বলল। ঘরের মধ্যে কয়েকজন মিলে একসাথে কথা বলছে এখন।

    “ভালোই” ওদিক থেকে সংক্ষিপ্ত উত্তর।

    “বাড়িতে সবাই খুব এক্সাইটেড। তুই কথা বলবি মায়ের সঙ্গে? মাসিমণিও জিগ্যেস করছিলো তোর কথা।

    “এখন থাক। রাখছি রে মাম্পি। একটু ব্যস্ত”

    “দাদা! কিছু একটা হয়েছে। তোর গলাটা ভালো শোনাচ্ছে না”

    “না রে ওসব কিছু না। পরে কথা বলছি” শ্রুতি আর কিছু বলার আগেই কেটে গেল ফোনটা। খুবই চিন্তিত দৃষ্টিতে স্ক্রীনটার দিকে তাকিয়ে থাকলো ও। দাদাটা থেকে থেকেই এমন অন্যরকম গলায় কথা বলে আজকাল।

    এই মুহুর্তে বাড়ির বাকি লোকেরা একটা ল্যাপটপের সামনে লাফালাফি করছে। হাসপাতালে রুডির মুখের সামনে ফোনটা ধরে বসে আছে রন। জুম কল চলছে যদিও রুডি এখনও কথা বলতে পারছেনা। শুধু ওর মুখের ওপরে থেকে থেকে একটুকরো ব্যথাবিদ্ধ হাসির আভা ফুটে উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে। শ্রুতিও একবার উঁকি মারলো কিন্তু ওর মনটা খচখচ করেই চলেছে। কি হল দাদার, শরীর খারাপ হল নাকি?

    দুপুর একটা নাগাদ সবাই খাওয়াদাওয়া শেষ করেছে, এতদিন পরে বাড়িতে একটু স্বস্তির আবহাওয়া। শ্রুতি এরই মধ্যে দুবার সাম্যকে টেক্সট করে জবাব পায়নি, মরিয়া হয়ে ও বাবাকেই ফোন করলো শেষ অবধি।

    “হ্যালো বাবা। এর মধ্যে দাদার সঙ্গে কথা হয়েছে তোমার?”

    “না তো রে” একটু অবাক হয়েই বলল রন। সত্যিই তো খেয়াল হয়নি কাল থেকে ছেলে একেবারে চুপচাপ।

    “ওকে ফোন করে খবরটা দিয়েছিলাম। খুব মনমরা লাগলো, কিন্তু কি ব্যাপার বলল না কিছুতেই। আমার ফোন ধরছেনা, তুমি একবার দেখবে?”

    “আচ্ছা দেখছি দাঁড়া। তুই তো সত্যিই আমাদের সকলের মা হয়ে উঠেছিস রে মাম্পি, সবার দিকে তোর খেয়াল আছে” ফোন ছেড়ে নিজের মনেই হেসে উঠলো রন। ওর মনটা ফুরফুরে লাগছে সকাল থেকেই। রুডি ভালো আছে, বস্টন থেকেও ভালো খবর। মিমির সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হয়েছে, মেয়েটা সত্যিই অসাধারণ। এই রকম জটিল বায়োমেডিক্যাল রিসার্চের প্রতিটি এলাকা, ডাটা, চার্ট, অ্যাডভার্স ইভেন্টস সব কিছুই যেন ওর কণ্ঠস্থ।

    সাম্যর নম্বরটায় আবার কল করলো রন। উত্তর নেই। মেসেজ রেখে দিল একটা।

    দুপুর দুটো। দুই ডাক্তারের সঙ্গে লাঞ্চ সেরে আবার ধড়াচুড়ো লাগিয়ে রুডির বেডের কাছে এসে বসলো রন। ডেরেক আর সাশা দুজনেই উৎসাহে ডগোমগ, এবং তার বেশ কিছুটা রনের মধ্যেও সঞ্চারিত এখন। নিজেকে জয়ী আর সার্থক মনে হচ্ছে বেশ। কিন্তু ওদিকে নিউইয়র্কে ছেলেটা এখনও কল ব্যাক করছেনা কেন?

    হঠাৎ ভাঙা গলায় অদ্ভুত একটা গোঙানি শুনে প্রায় চমকে উঠলো রন। রুডির ঠোঁট কাঁপছে, কথা বলার প্রাণপণ চেষ্টায়।

    “রুডি সব ঠিক আছে। তুমি কথা বলার চেষ্টা কোরোনা, শুধু শুধু কষ্ট পাবে”

    রুডির আঙুলগুলো লেখার ভঙ্গিতে নড়ে উঠলো। একবার, দুবার, তিনবার এবং তার সাথে সাথে গলার মধ্যে থেকে সেই ফ্যাঁসফেসে গোঙানির আওয়াজ। ওর মুখের ওপরে এখন অতল বিপন্নতার অন্ধকার। কয়েক মুহুর্ত ইতস্ততঃ করে একটা প্যাড আর পেন বাড়িয়ে দিল রন।

    দুপুর তিনটে। এর মধ্যে সাম্যর কাছ থেকে ছোট একটা টেক্সট এসেছে- গেট ওয়েল কুইকলি রুডি মেসো, হ্যাপি ফর ইউ, মাসিমণি। বাকি সবার জন্য ওইটুকুই যথেষ্ট হলেও শ্রুতি দাদাকে তার চেয়ে অনেক ভালো চেনে। দাদার নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে, নাহলে ও ফোন করতো, বকবক করে মাথা ধরিয়ে দিতো সবার। আশংকায় মাথার ভেতরটা দপদপ করছে ওর। মনে হচ্ছে একটা চিঠি লিখে রেখে সোজা এয়ারপোর্টে যায়, নিউইয়র্কের প্লেনে চেপে বসে। এমন সময় এলো ফোনটা। এমন উত্তেজনায় ও ফোনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো যে হাতের মধ্য থেকে পিছলে যন্ত্রটা ঠিকরে পড়লো মেঝেতে, মসৃণ হার্ডউডের ওপর দিয়ে এক দৌড়ে ঢুকে গেল ক্যাবিনেটের তলায়। শ্রুতির হাত খুব ঘেমে যায়, এই নিয়ে ছোটবেলা থেকেই ওকে মাঝে মাঝে অপ্রস্তুত হতে হয়েছে।

    “ওঃ, শিট, মি অ্যান্ড মাই সোয়েটি হ্যান্ডস!”

    দেখা গেল ফোনটা আস্তই আছে, ওদিকের মানুষটাও একই জায়গায়। ওর চিন্তিত গলা শোনা যাচ্ছে, “ মাম্পি, এই মাম্পি, কিসের আওয়াজ হল রে?”

    “কিছু হয়নি, আই ড্রপড দা ফোন। কি ব্যাপার দাদা, তুই আমার কাছ থেকে কি লুকোচ্ছিস বলতো? সকাল থেকে ইউ আর বিহেভিং সো উইয়ার্ডলি” হঠাৎ খুব রাগ হয়ে গেল শ্রুতির। ও চেষ্টা করলেও খুব বেশি রাগ দেখাতে পারেনা, শুধু ওর গলার আওয়াজটা অন্যরকম হয়ে যায়। যারা ওকে চেনে তারা ঠিক বুঝতে পারে।

    “বব ইজ ডেড। ডে ক্রিমেটেড হিম টুডে আফটারনুন! ফ্যামিলির কেউ আসতে পারেনি” ভুতুড়ে গলায় উত্তর ভেসে এল আটলান্টিকের কূল থেকে। বব অর্থাৎ রবার্ট নামের কেউ একজন মারা গেছে, তার মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে, পরিবারের লোকেরা এসে পৌঁছতে পারেনি। নিউইয়র্ক শহরে এই মুহুর্তে এটা একটা সাধারণ ঘটনা।

    “দাদা তুই ঠিক আছিস তো? একটা হাহাকার ঠিকরে বেরিয়ে এল শ্রুতির ভেতর থেকে। ও হঠাৎ বুঝতে পারল যে দুনিয়ার কোথায় কে মারা গেল, তাই নিয়ে ওর বিন্দুমাত্র মাথাব্যাথা নেই। ওর সব চিন্তা, সারাক্ষণের সমবেদনা শুধু ওর পরিবারের কয়েকজনকে ঘিরে। মনের মধ্যে এই একটুকরো চেতনার আগুন ঝলসে ওঠার সাথে সাথে যেন লজ্জায় মাথা নেমে গেল ওর। তাহলে কি ও ভেতরে ভেতরে স্বার্থপর, শুধু নিজের প্রিয় লোকেদের ভালো থাকাটুকুই ওর কাছে আসল? এক মুহুর্তের জন্য কথা ফুটল না ওর মুখে।

    “আমি একদম ভালো আছি রে। আমি আর রামোনা, আমরা দুজনে মিলে একজন আধা-অচেনা মানুষের সৎকার করলাম জানিস? আমি হিন্দু, রামি ক্যাথলিক, বব খুব সম্ভবতঃ প্রটেস্ট্যান্ট কিন্তু ইলেকট্রিক চুল্লীর কাছে সবাই সমান। পরের পর বডি ব্যাগগুলো আগুনে পুড়ে গেল। বব উইলসনের একমাত্র মেয়ে অ্যারিজোনায় থাকে, সে সারারাত গাড়ি চালিয়ে কোনরকমে যখন এসে পৌঁছল তখন ছাইটুকুও আলাদা করার উপায় নেই। কি কাঁদছিল, কি কাঁদছিল মেয়েটা, সে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। খালি বলছিল- দিস উইল ব্রেক মি! দিস উইল ব্রেক মি! কথাটার মানে কি বলতে পারিস মাম্পি”

    ওরা দুজনেই চুপচাপ, হয়ত কান্না চাপার চেষ্টা করছে দুজনেই। পুরো আধ মিনিট বাদে নীরবতা ভাঙল শ্রুতি।

    “তুই জানিস দাদা, আরেকটু পরে ফোন করলে তুই আমার সঙ্গে কথা বলতে পারতিস না। আই উড হ্যাভ বিন ইন দা স্কাই। আমি নিউইয়র্ক যাবো বলে টিকিট কাটার চেষ্টা করছিলাম। ওখানে যদি তোর কিছু হতো, আর আমি সেখানে না থাকতে পারতাম, দ্যাট উড হ্যাভ ব্রোকেন মি। আমি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতাম। পৃথিবীতে ভয়ঙ্কর কিছু একটা হচ্ছে আমি জানি, কিন্তু আমার সব চিন্তা শুধু আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে। এটা নিশ্চয়ই খুব খারাপ, তাই না রে দাদা?

    “না রে, সবাই আসলে ওইরকম। তোকে বলা হয়নি রামির বাবাও কোভিড ইনফেক্টেড, কিন্তু হাসপাতালে যায়নি, বাড়িতেই বসে আছে, আরো কতজনকে এরই মধ্যে ইনফেক্ট করেছে কে জানে। ওদের বিশ্বাসের জগৎ পুরোপুরি আলাদা, ওদের বাস্তবতা অন্যরকম। রামি বলে ওরা আসলে অন্য গ্রহের মানুষ, পালাতে পালাতে এইখানে এসে আটকে গেছে! ওও তো পালিয়ে এসেছে আমার বাড়িতে, আমরা দুজনেই এখন ঘরবন্দী।”

    কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল সাম্য। ওর উত্তেজনায় ভরা আওয়াজ মিলিয়ে গিয়ে বাঁশির মতন মৃদু অথচ সুরেলা একটা ফিসফিসানি শোনা গেল এবার।

    “হাই, দিস ইজ রামোনা”

    “হাই রামোনা। দিস ইজ মাম্পি, দি এভার অ্যানোইং সিস্টার”

    “দা ডার্লিং সিস্টার। ইউ আর সো প্রেশাস মাম্পি। বলতে চাইলাম যে তোমার ভাই ভালো আছে, আমিও ওর সঙ্গে আছি। চিন্তা কোরোনা, আই উইল টেক কেয়ার অফ হিম”, ফিসফিসে বাঁশির কণ্ঠ কথা বলে উঠলো আবার। সেই সুরে সুর মিলিয়ে বুকের ভেতর থেকে বিরাট একটা নিঃশ্বাস শেষ অবধি বার করে আনতে পারলো শ্রুতি। সকাল থেকে চেপে রাখা যন্ত্রণাটা একতাল পাথরের মতন খসে পড়লো সেই মুহুর্তে।

    “রামোনা, তুমি শুধু দাদার কাছাকাছি থাকো, প্লীজ ওকে একলা কষ্ট পেতে দিওনা, আমি সেইজন্য চিরদিন তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকবো। আমি জানিনা কেন যাদের সঙ্গে বড়ো হয়ে উঠেছি তাদের সবাইকে এমন অবুঝের মতন ভালোবাসি। আমার শুধু ভয় করে যে শুধু অন্ধের মতন ভালোবাসাই হয়তো যথেষ্ট নয়, ওদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য আরো অনেক কিছুর প্রয়োজন, সেসবের কিছুই হয়তো আমি জানিনা, বুঝতে পারিনা। শুধু কষ্টটা ভাগ করে নেবার চেষ্টা করতে পারি”

    অনেক কথা হয়েছিল সেদিন। হয়তো আরো অনেক বছর বাদে রোজকার কোনো স্বাভাবিক সন্ধ্যায়বেলায় সেদিনের বলা কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করবে ওরা। বলাবাহুল্য সে চেষ্টা বিফলে যাবে। মনের মধ্যে ভাষার কোলাহল পেরিয়ে বোধের যে অটুট গভীরতা নেমে এসেছিল, তার তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবেনা আর কোনোদিন। এই পৃথিবীর অতি চঞ্চল, কলরবমুখর নগরীরা সবাই তখন এক ত্রস্ত গভীর নিস্তব্ধতার মধ্যে নিমগ্ন। সেই গভীর অমাবস্যায় মধ্যে দীপ জ্বালিয়েছে শুধু অহেতুক ভালোবাসা।

    বিকেল পাঁচটা। ক্লান্ত পায়ে দরজা ঠেলে ঢুকেছে রন, সাথে সাথে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাড়ির বাকি সকলে। সবাই জানতে চায় রুডি কেমন আছে, একেবারে সুস্থ হয়ে উঠতে আর কতদিন? রন ভাসা ভাসা কয়েকটা উত্তর দিলো, তারপর সোজা গিয়ে বসলো রুডির স্টাডিরুমে। হাভে ভাবে বুঝিয়ে দিল যে এই সময়টা ও একাই থাকতে চায়। এই কদিনে সবাই ওর এইরকম মুড স্যুইং দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, কেউ আর ওকে ঘাঁটালোনা। অনেক দিন গ্রসারি করা হয়নি, খাওয়াদাওয়ার ইচ্ছে ছিলনা কারো। ওরা দুই বোন বেরোলো গ্রসারি করতে রোহনও ওদের সঙ্গে নিলো। রুডি বাড়ি ফিরলে কি ধরনের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে সেই নিয়ে কথাবার্তাও হল কিছু। বাড়িটা ফাঁকা হয়ে যাবার পরে শ্রুতি পায়ে পায়ে এসে বসলো বাবার কাছে। কিছু না বলতে ওরা দুজনেই বুঝে গেছে যে বেশ কিছু কথাবার্তা আছে এখন।

    “ইউ গো ফার্স্ট বাবা। রুডিমেসো কেমন আছে?”

    রন ইতস্ততঃ করলো একটু। তারপর জামার বুকপকেট থেকে ভাঁজ করা একটুকরো কাগজ বার করে আনলো। প্রায় অবোধ্য কিছু আঁকিবুঁকি কিন্তু মনে হয় একটা অচেনা দেশের ফোন নম্বর আর অজানা ইমেইল অ্যাড্রেস।

    “এটা আবার কি?” খেই হারিয়ে প্রশ্ন করলো শ্রুতি।

    “রুডির বান্ধবী, উহান সিটির বাসিন্দা। খবর নিতে চাইছে”

    “বান্ধবী?” শ্রুতির গলায় কৌতূহল।

    “কিরকম বান্ধবী জানিনা। এমন কেউ যার জন্য রুডি কেয়ার করে। রুডির কাছে ফোন বা ল্যাপটপ নেই, ওষুধের ঘোরের মধ্যে আছে কিন্তু তাও এই নিয়ে খুব উতলা মনে হল” রন দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

    “সো রুডিমেসো ওয়াজ হ্যাভিং অ্যান অ্যাফেয়ার ইন চায়না?” বিস্ময়ে ফেটে পড়া গলায় বললো শ্রুতি।

    “সেটা আমরা এখনও জানিনা রে মাম্পি।ওর বিজনেস পার্টনারও হতে পারে। রুডির সঙ্গে এর থেকে বেশি কমিউনিকেট করাও এই মুহুর্তে সম্ভব নয়। আমি ফোন নম্বরটা ডায়াল করে দেখেছি, কেউ ধরছেনা। ই মেইল করেছি, জবাব আসেনি এখনো। এবার তুই বল দাদার ব্যাপারটা কি?

    “দাদার উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের বয়স্ক ভদ্রলোক মারা গেছেন। দাদার সঙ্গে ভাব ছিল খুব। মনে আছে দাদা বলছিল সেবার যে ওকে সেটল করতে সাহায্য করেছিলেন উনি।

    “হ্যাঁ হ্যাঁ, মিস্টার উইলসন না কি একটা যেন নাম। আমাদের সঙ্গে দেখাও হয়েছিল একবার”, রনি মনে করার চেষ্টা করলো, “ইস, নিউইয়র্কে কোভিড মর্টালিটি খুব বেড়ে গেছে গত দুই সপ্তাহে।”

    “ওরা বডিগুলো ক্রিমেট করে দিচ্ছে, বাড়ির লোক, বন্ধুবান্ধব কাউকে কাছে আসতে দিচ্ছেনা। দাদা ব্যাপারটা ঠিক নিতে পারেনি।

    “প্লেগের সময় তাই করতে হয়রে। নিষ্ঠুর বলে মনে হয় কিন্তু সকলের স্বার্থে ওটাই করা উচিৎ,” পাশে রাখা চটি বইটার দিকে আরেকবার তাকালো রন, তারপর হতাশ গলায় যোগ করলো, “আমি আগে থেকে জানলে হয়ত কিছু হেল্প করতে পারতাম”

    “পারতে না বাবা। ওখানে অবস্থা খুবই খারাপ এখন। আমি অন্য কথা ভাবছি? তোমরা ওদের দুজনকেই বস্টনে নিজেদের কাছাকাছি এনে রাখনা কেন? এমনিতেই কাজকর্ম সবই তো অনলাইনে চলেছে, তেমনি চলবে। ওদের দুজনেরই যথেষ্ট এক্সপোজার হয়েছে, তোমার কাছাকাছি থাকলে ওরা হয়ত আরেকটু সুরক্ষিত থাকবে। দে নীড ইয়োর সাপোর্ট।”

    “তোকে বলে রাখা ভালো যে এই হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা মেক্সিকান গার্লফ্রেন্ডের ব্যাপারটা মা একেবারেই ভালোভাবে নেয়নি মাম্পি। জাস্ট এখন আরো বড়ো ঝামেলা চলছে বলে ওদিকে ওর মন নেই। অন্যদিকে তোর দাদা আমাকে একটা টাইর‍্যান্ট মনে করে, সত্যি কথা বলতে কি ওর সঙ্গে আমার কানেকশন খুবই সামান্য। তুই আর তোর মা ওর মন জুগিয়ে কথাবার্তা চালাতে পারিস কিন্তু আমি ফ্রাসট্রেটেড হয়ে যাই। ওরা কি সত্যিই আমার সাহায্য চায়। চাইলে বলতে পারেনা কেন?” রন গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে বললো। কোথা থেকে আবার একফালি অভিমানের মেঘ এসে মনের আকাশে জমা হয়েছে।

    “বাবা, ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি যে তুমি দাদাকে তোমার ধারালো ইন্টেলেকচুয়াল সত্ত্বার উত্তরাধিকারী বলে মনে করো, আর আমাকে দেখতে চাও সেই ছোট্ট আদুরে মেয়েটার মতন। এইভাবে তুমি একসঙ্গে দুই ফ্রন্টে লড়াই জিততে চাও। কিন্তু আমরা দুজনে শুধু তোমার প্রডিজে নই, আমাদের নিজস্ব সত্ত্বা আছে। তুমিই সেটা আমাদের শিখিয়েছ। এটা তুমি কি ভেতর থেকে বুঝতে পারো বাবা?” এক আঙুল দিয়ে হুইস্কির পাত্রটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে বললো শ্রুতি।

    “কি বলছিস, কিছু বুঝতে পারছি না রে মাম্পি,” রনের গলায় গভীর অসহায়তা ফুটে উঠছে এখন।

    “একথাটাও তোমার বোঝা উচিৎ যে তুমি আর মা আলাদা দুজন মানুষ। মায়ের পৃথিবী ফীলিংসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তোমার পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে ইন্টেলেক্টের ওপর। তোমাদের ছেলেমেয়ে হিসাবে এই দুই এলাকাই আমাদের পারিবারিক বাসস্থান, এদের কোনো একটাকে বাদ দিয়ে আমাদের বেঁচে থাকা কঠিন। গণ্ডগোল এইখানে যে এই দুই পৃথিবীর মধ্যে যখন লড়াই বেঁধে যায় তখন আমরা কোথায় শক্ত হয়ে দাঁড়াবো বুঝে উঠতে পারিনা। মাথায় ঢুকল কিছু?” চুরি করে নেওয়া গ্লাসটিতে লম্বা একটা চুমুক মেরে বললো শ্রুতি।

    “লেট আস ফোকাস ব্যাক অন রুডি। শুনলই তো, চায়নার হট জোনে ওর খুবই পরিচিত কেউ একজন আছে, যার পরিস্থিতি অজানা। এবার আমাদের কি করা উচিৎ? হুইস্কির গ্লাসটা নিজের দখলে এনে বলল রন।

    “খোঁজ নাও বাবা। তোমার টিমের সঙ্গে ডব্লিউ-এইচ-ও’র সরাসরি যোগাযোগ আছে। ফাইন্ড আউট, মহিলাটি কে, বেঁচে আছে কিংবা নেই। রুডিমেসোর জন্য এটা হয়তো খুবই জরুরী”

    “মাম্পি, তুই একটু আগে বললি যে তোদের মায়ের পৃথিবী অনুভূতিনির্ভর। আমি যদি সেটা না বুঝি, আমার অনুভূতি যদি ওরকম তীব্র না হয়, সেটা কি আমার দোষ?” রন বিড়বিড় করে বললো।

    “না বাবা, তুমি তুমিই, তোমার মতন করে সত্যি। আমি তোমাকে, কিংবা মা আর দাদাকে বিচার করতে বসিনি, আমার কাছে তোমরা সবাই যে যার নিজের নিজের এলাকায় বাস্তব অথচ অন্যরকম” শ্রুতি বললো, আর ওর কথা শেষ হবার আগেই বিরাট ঘরটার নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে রনর সেলফোনটা বেজে উঠলো হঠাৎ।

    “হ্যালো”

    “ক্যান আই বি দা ফার্স্ট টু কনগ্রাচুলেট ইউ প্রফেসর চ্যাটার্জি? নাকি তুমি ইমেইলটা দেখেছো?” উচ্ছল একটা গলা ভেসে এল ওধার থেকে। মিরিয়মের ফোন।

    “কিসের জন্য বলতো?” আগ্রহ আর অস্বস্তি মিশিয়ে বলল রন”

    “নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন আমাদের এম-১২১৯ স্টাডির প্রাথমিক রিপোর্ট ছাপাচ্ছে। আগামী সপ্তাহেই! সো এক্সসাইটিং না?”

    রনের মনে পড়ে গেল লাঞ্চের টেবিলে এখানকার দুই ডাক্তারের প্রবল এক্সসাইটমেন্টের কথা। এই তাহলে ব্যাপার। এম-১২১৯ ট্রায়াল তড়িঘড়ি আলোয় আসছে। প্রেস কনফারেন্সটি শুধু হবার অপেক্ষা, তারপরেই স্টক মার্কেটে ঝড় উঠবে। বড্ডো তাড়াতাড়ি আনব্লাইন্ড করে ফেললো ট্রায়ালটাকে ওরা। অবশ্য সারা পৃথিবী যেমন চটজলদি ওষুধ চাইছে, এই অসহ্য মুখোশ লাগানো জেলখানা থেকে রেহাই পাবার পথ খুঁজছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, তখন ধীরে চলো নীতি কারই বা মনে ধরবে?

    “মিমি, পেপারওয়ার্কগুলো ঠিক করে রেখো। আমি ফিরেই সব রিভিউ করবো”

    “তোমার জন্য সব রেডি থাকবে। শুধু একটা কথা। ম্যাক্স যেমন আমার ওপর নির্ভর করে সেরকম তুমি করতে পারোনা কেন?”

    মিরিয়ামের গলায় কেমন একটা কাঁপা কাঁপা অভিমানের সুর। রনের ভেতরে একটা ঝড় ওঠার সংকেত জেগেই মিলিয়ে গেল। ওর মনে হল এখুনি কোথাও পালিয়ে যাওয়া দরকার।

    “বাবা, কার ফোন?” সরল গলায় প্রশ্ন করলো মেয়ে।

    “কিছু না রে। শোন, আমাকে কতগুলো দরকারি কাজ করতে হবে। তুই শুয়ে পড় মা, আর রাত জাগিসনে” এক হাতে হুইস্কির গ্লাসটা টেনে নিল রন।

    “রাত জাগবে আর মদ খাবে। আসলে আমাকে তুমি একটুও ভালোবাসো না বাবা” প্রায় ঠোঁট ফুলিয়ে বলল মেয়ে, যদিও ওর রাগ শরৎকালের মেঘের মতন।

    “কেন এরকম বলছিস?” রন হাসার চেষ্টা করলো একটু।

    “এইভাবে ড্রিঙ্ক করতে থাকলে তোমার হেলথ খারাপ হতে বাধ্য। তুমি আমাদের কথা ভাবছোনা। ইউ আর বিইং সেলফিস”

    “সরি রে মাম্পি। তুই আর আমার মা হয়ে থাকিসনা, আমাকে একটু কাজ করতে দে। কথা দিচ্ছি আর খাবোনা”

    “ওকে বাবা, আই ট্রাস্ট ইউ” গালে গাল লাগিয়ে অস্ফুট একটা আওয়াজ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মেয়ে।

    রাত্রির আলো অন্ধকার এসে চারিদিকে ভিড় করেছে আবার এখন। সেই অন্ধকারের মধ্যে থেকে থেকে বিদ্যুৎচমকের মতন একটিই শব্দবন্ধ ঝলসে উঠছে- আই ট্রাস্ট ইউ। কেমন করে এতো সহজে কথাগুলো বলতে পারলি মা? তুই জানিস না যে ট্রাস্ট একটা অসম্ভব জিনিষ। দুজন আলাদা মানুষ, যাদের ব্যক্তিত্ব সুগঠিত, তারা কি সত্যিই পরস্পরকে ভেতর থেকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে? নাকি শুধু ধর্মবিশ্বাস নয়, সব রকম বিশ্বাসই অপ্রাকৃতিক, বানিয়ে তোলা আইডিয়া। বিশ্বাস নয়, ভালোবাসা তো নয়ই, মানুষ শুধু সুবিধার খাতিরে অন্যান্য মানুষকে সহ্য করতে শেখে। যতক্ষণ সহ্য করতে পারে, ততক্ষণই সমাজ।

    রাত বাড়তে থাকলো, একটানা কাজের মধ্যে ডুবে গেল রন। এম-১২১৯ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রতিটি ডাটা সেট অনলাইনে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলো, যেন ওগুলোর ওপরে প্রাণটাই নির্ভর করছে ওর। নাঃ কোথাও কোনো গণ্ডগোল নেই, সবই লেফাফাদুরস্ত পরিষ্কার।

    রাত্তির দুটো। তিনঘণ্টা পিছিয়ে আমেরিকার পূর্ব উপকূলে এখন রাত্রি এগারোটা। ছেলেটা কি করছে এখন। মেক্সিক্যান গার্লফ্রেন্ড নিয়ে আগে থেকেই নিপুর মহা অশান্তি ছিল, এখন আবার দুজনে একসাথে থাকছে। সব চেয়ে বড়ো কথা দুজনেই পাইকারি হারে কোভিড এক্সপোজড। আশা করা যায় যে তারুণ্যই ওদের রক্ষা করবে। এই সৃষ্টিছাড়া চৈনিক ভাইরাসের অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে, যার নাম অনির্দেশ্যতা, কিছুতেই একে ঠিকঠাক চেনা যায়না। কোথায়, কখন যে এর ভয়াবহ ডানার ঝাপটা শোনা যাবে, আগে থেকে তার আন্দাজ মেলা অসম্ভব।

    আরো ঘণ্টাখানেক কাজের মধ্যে ডুবে রইলো রন। ল্যাপটপের ডালাটা বন্ধ করার ঠিক আগে মনে পড়লো মিরিয়ামের কথা। অকারণেই। কি অমানুষিক খাটনিই না খাটছে মেয়েটা। ওর একহাতে ম্যাক্সের ভ্যাকসিন ট্রায়াল, অন্যহাতে রনের অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ।

    এদিকওদিকে ফোন বেজে যাচ্ছে, কেউ তুলছে না কোনোখানেই। বিশ্বসংসারে সবাই কি ফোন অফ করে বসে আছে? ম্যাক্স কি বাড়িতে নাকি হাসপাতালে? হয়তো সারাদিনের কাজ শেষ করে সন্ধ্যেবেলায় ওরা সেই চেনা অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এসেছে, মিরিয়ম তখন স্টোভের ওপর থেকে নামিয়ে এনেছে উষ্ণ মুরগির সূপ আর টাটকা রুটি। তার থেকেও উষ্ণ মানবিক সান্নিধ্যের মধ্যে আরামে ঘুমিয়ে পড়েছে ম্যাক্স। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে শুধু। কিন্তু ঘুমোতে যাওয়ার আগে শেষ একটা ইমেইল লিখতেই হবে ওকে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গ্যানাইজেশনের একজন পরিচিত কর্তাব্যক্তির কাছে, যে উহান আউটব্রেকের প্রতিটি খুঁটিনাটি খবর রাখে। মৃত ব্যক্তিদের তালিকায় একটা বিশেষ নাম আছে কিনা জানতে হবে ওর।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ (শেষ)
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments