• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | উপন্যাস
    Share
  • সন্ত্রাস (২) : কৌশিক সেন



    ।।৩।।
    All I maintain is that on this earth there are pestilences and there are victims, and it's up to us, so far as possible, not to join forces with the pestilences.
    এখন ভোর বেলা। খাটের ওপরে খোলা একটা স্যুটকেস, নিপু হাতের সামনে যা জামাকাপড় পাচ্ছে না দেখেই ঠুসে দিচ্ছে ওটার মধ্যে। ওর চোখ জ্বালা করছে, রগের ওপরে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে কেউ। ওদিকে রন ওর স্বাভাবিক শান্ত গলায় অপুর সাথে কথা বলে চলেছে। নিপুর সাথে সাথে ও প্রায় সারারাত জেগে কাটিয়েছে কিন্তু রাতজাগা ওর অনেক দিনের অভ্যেস, তাই নিপুর মতন অস্থির আর অসুস্থ হয়ে পড়েনি ও। ফোনটা স্পিকারে আছে তাই দুদিকের কথাবার্তাই নিপু শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু অর্ধেক কথার মানে ও বুঝতে পারছে না। ফাঁদে পড়া জন্তুর মতন ওর মাথা-ভর্তি ধোঁয়াশার মধ্যে একটাই চিন্তা জ্বলজ্বল করছে--কি করে, কত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওর বোনের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো যায়। ওর সব কষ্ট, সব আশংকা ঠিক সমান দুভাগে ভাগ করে নেওয়া যায়, ঠিক সেই ছোটবেলাকার মতন।

    “না না তুই আসিস না। সাংঘাতিক ছোঁয়াচে রোগ, ট্রাভেল করতে নিষেধ করছে সবাই। আমি শ্রুতিকেও বারণ করেছি আসতে। রোহন তো নিউজিল্যান্ডে, ওর আসার প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া এসে করবেই বা কি? রুডি আই-সি-ইউতে, আমিও সেখানে ঢুকতে পারছি না। ওর ডাক্তার খুব ভালো, রনের মতোই সিনসিয়ার, খুব যত্ন করে দেখছে।” অপুর গলাটা ভাঙা ভাঙা কিন্তু পরিষ্কার। নিপু যেমন মেজাজী আর আবেগপ্রবণ, অপু তেমনি শান্তশিষ্ট মাটির মানুষ। ওদের একমাত্র ছেলে রোহন, খুবই ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। ওর প্রিয় বিষয় হল পরিবেশবিদ্যা, বিশেষ করে ওশেনোগ্রাফি, তাই নিয়েই ও অকল্যান্ডে কাজ করতে গেছে। ওদের বাবা-ছেলের সম্পর্কটা বেশ একটু জটিল। রোহন শুধু পরিবেশপ্রেমী নয় রীতিমতন পরিবেশ যোদ্ধা বা এনভিরনমেন্টাল অ্যাক্টিভিস্ট। সমুদ্রের জল পরিষ্কার রাখার জন্য ও পারলে দুনিয়ার সব কলকারখানা বন্ধ করে দেয়। ও বাড়িতে এলে খাবার টেবিলে রোজ ঝগড়া বাঁধে। রোহন কট্টর নিরামিষাশী, অপু মাছ ছাড়া খেতে পারে না এবং রুডির মতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মানুষকে বাদ দিয়ে আর যা কিছুই নড়াচড়া করে তাদের প্রত্যেকটিকে খাদ্য হিসাবে পরখ করে দেখা উচিত। শাকান্নভোজীদের ও কৃপার চোখে দেখে এবং প্রায়ই তাদের সঙ্গে মনুষ্যেতর প্রাণীদের তুলনা দেয়। ওর শখ ছিল যে ছেলে বড়মেসোর মতন ডাক্তার হবে, কিন্তু রোহন সেই আশায় অনেক আগেই এক বালতি বরফওয়ালা ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিয়েছে।

    “মেডিসিন ইজ নো লংগার আ নোবল প্রফেশন। ফার্মাসিউটিক্যাল বিগ মানি ওটাকে আগাগোড়া নষ্ট করে দিয়েছে। পুরো ব্যাপারটা এখন শুধু একটা ব্যবসা।” ও বলতো। খেপে গিয়ে চেঁচামেচি করতো রুডি, কিন্তু রন সব সময় বোনপোর পক্ষে।

    “রোহন ঠিক কথা বলেছে, আমাদের প্রফেশন আজকে এক বিরাট সংকটের মুখোমুখি। টাকা আর টেকনোলজি যেখানে হাত ধরাধরি করে চলে সেখানে প্রগতি মানেই মুনাফা। কিন্তু ডাক্তারির যে এলাকাটা ধোঁয়াটে, ইন্ট্যানজিবল, যার মূলধন হচ্ছে ইন্সটিংক্ট আর কমপ্যাশন, সেটা আজকের যুগে ডেফিনিটলি এনডেঞ্জারড। আমরা সবাই আমাদের ভেতর আর বাইরের মধ্যে সমন্বয় খোঁজার চেষ্টা করছি। রোহনের সেটাই করা উচিত যার মধ্যে ও নিজস্ব মূল্যবোধ খুঁজে পায়।” রন বলতো। উজ্জ্বল চোখে রোহন তাকিয়ে থাকতো ডাক্তারমেসোর দিকে।

    কোথায় গেল সেই সব সুন্দর দিন, ফায়ারপ্লেসের আলো, ছেলেমেয়েদের উজ্জ্বল মুখ, দরজা খুললেই বারান্দায় ঝাঁপিয়ে পড়া অদূর সমুদ্রের এলোমেলো উচ্ছ্বাস! কোথাকার এক অদ্ভুত সন্ত্রাস এসে গ্রাস করে নিল সবকিছু।

    “তোরা কেউ কিন্তু আমার কথা শুনছিস না। ওদিকে রোহন অকল্যান্ডের ইউ-এস এমব্যাসিতে ধরনা দিয়ে বসে আছে, ও যেমন করে হোক আসবেই আসবে। তোর নিজেরও তো অ্যাজমা আছে, তোর একেবারেই এক্সপোজড হওয়া উচিত নয়। শ্রুতিও আমার কথা না শুনে অলরেডি এখানে আসবে বলে ড্রাইভ করতে শুরু করে দিয়েছে। আচ্ছা, একটা বিপদ তো হয়েছেই, তোরা শুধু শুধু আরেকটা বিপদ না বাঁধিয়ে কি ছাড়বি না? প্লীজ, তুই ওকে আসতে বারণ কর দিদি, তোর পায়ে পড়ি--” অপুর গলাটা সত্যিই ভাঙা লাগছে এবার, বেশ বোঝা যায় যে ও কান্না চাপছে।

    “অপু তুই প্লিজ চুপ কর। আমার যদি এরকম হতো তো তুই কোনো কথা শুনতিস? তুই সব ফেলে আমার কাছে ছুটে আসতিস না, বল?” নিপুও কাঁদতে শুরু করেছে এবার।

    “সবার আগে আমি ঠিক লোকের কাছে পরামর্শ নিতাম দিদি। সেই লোক তোর বাড়িতেই আছে, হি ইজ ইন দি ফ্রন্টলাইন। তুই ওর কথামতন চল, ওর অ্যাডভাইজ ফলো কর, শুধু এইটুকুই বলবো। তোর ছেলে নিউ ইয়র্কে থাকে, ওখানেও তো সাংঘাতিক অবস্থা, ওকে সাবধানে থাকতে বল। এটা সবার জন্যেই খারাপ সময় দিদি, ঠিক কেটে যাবে দেখিস, তুই পাগলামি করে আর বিপদ বাড়াস না।”

    ফোন ছেড়ে দিয়েছে অপু। নিপু উদভ্রান্তের মতন বিছানার ওপরে বসে পড়লো। রন এসে পাশে বসলো, ওর হাতটা এখন নিপুর কাঁধের ওপর। সারারাত্রিই প্রায় এইভাবেই কেটেছে।

    “নিপু এই অসুখটার অনেক কিছুই এখনও আমাদের অজানা। যতটুকু জানা আছে সেই অনুযায়ী অপু ডেফিনিটলি এক্সপোজড কিন্তু ও অসুস্থ নাও হতে পারে। ওর এক্ষুনি টেস্ট করানো উচিত। আমাদের খুব কশাস থাকতে হবে। সমু আমার কথামতন নিজের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরোচ্ছে না, কাউকে আসতে দিচ্ছে না, এমনকি ওর গার্লফ্রেন্ডকেও নয়। নিউ ইয়র্ক বা লস অ্যাঞ্জেলসের মতন শহরে এটাই নিরাপদ থাকার একমাত্র উপায়। রোহনকেও আমি আসতে বারণ করেছি, ও আমার কথা শুনবে কিনা জানি না। মাম্পি ড্রাইভ করে লস অ্যাঞ্জেলস থেকে সানফ্রানসিস্কো যাচ্ছে, ওর রিস্ক অনেকটা কম। আমি কিন্তু রেকমেন্ড করবো যে ও যেন মাসির বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও থাকে। শহরে ওর বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব আছে তাদের মধ্যে এমন একজনকে বেছে নিতে হবে যার কোনো এক্সপোজার কিংবা ট্রাভেল হিস্ট্রি নেই। যদি অঘটন কিছু একটা ঘটে যায় অপুর পাশে অন্তত একজন থাকবে। অপু ঠিকই বলেছে, তুমি গিয়ে ওকে সাহায্য কিছু করতে পারবে না, কিন্তু তোমার নিজের বিপদ বাড়াবে।” ক্লাসে লেকচার দেবার মতন কথা বলে চলেছে রন। নিপু চুপ করে শুনতে থাকলো ক্লাসে ছাত্ররা যেমন অধ্যাপকের কথা শোনে। কিছু কিছু শব্দ ঠিক যেন বুলেটের মতন ওর বুকে বিঁধে গেল, একটা হাহাকার ছিটকে এলো একদম ভেতর থেকে।

    “অঘটন! কি অঘটনের কথা বলছো রনি? রুডি মারা যেতে পারে? তখন অপুর কাছে আমি থাকবো না ও একলা ওর স্বামীর সৎকার করবে!! কি করে বলতে পারলে তুমি? নিজের বোনের দায়িত্ব অন্যদের ওপর ফেলে দিয়ে আমি নিজে নিরাপদে থাকবো, এই তোমার বিধান! আর এই যে তুমি রোজ রুগী ঘাঁটছো, ল্যাবে কাজ করছো এগুলো ঝুঁকি নয়। তাহলে তো আমারও উচিত এই বাড়িতে না থাকা, তাই না?”

    চিৎকার করছে নিপু, রনকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে পাগলের মতন। ও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। শেষ রাতে নিপু যখন ঘুমিয়ে পড়েছিল সেই সময়ে ও সবাইকে ফোন করেছে, ইমেইল পাঠিয়েছে, নিজে এক মিনিটের জন্যেও বিশ্রাম নেয়নি। নিপু জানে যে রন চুপ করে অপেক্ষা করবে, তারপর ও একটু শান্ত হলে আবার যথারীতি স্নান করে, কফি খেয়ে হাসপাতালে রওনা হবে। এ রকম কতবার হয়েছে। ধারাল যুক্তির ছুরি দিয়ে ও কেটে খানখান করেছে নিপুর সমস্ত আবেগ আর অভিমানের কালো পর্দাগুলো। একটা পাথরের দেওয়ালের সাথে কুস্তি লড়তে গেলে শেষ অবধি দেওয়াল তো জিতবেই।

    এখন সকাল আটটা, আরো অনেকক্ষণ বুঝিয়েসুঝিয়ে, আশ্বাস দিয়ে শেষ অবধি হাসপাতালের দিকে রওনা হয়েছে রন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে এই দুঃখেও হাসি পেয়ে গেল নিপুর। কে জানে কত বছর পরে ওর জন্য পুরো এক ঘণ্টা দেরি করে অফিসে গেল লোকটা।

    ফোনটা বেজে উঠেছে আবার। শ্রুতির ফোন, ও বোধহয় পৌঁছে গেছে এতক্ষণে।

    “মাম্পি তুই কোথায়। মাসিমণি কেমন আছে?” কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলো নিপু। মাম্পি ওর আদরের ডাকনাম।

    “মা, আর ইউ ওকে?”

    আশ্চর্য প্রশ্ন! এই সময় কেউ কি ওকে থাকতে পারে না থাকা উচিত? একগাদা কথা নিপুর গলার কাছে ভিড় করে এলো, তার মধ্যে মাত্র কয়েকটাই কোনোরকমে উচ্চারণ করা গেল শেষ অবধি।

    “আমার খুব ভয় করছে রে মাম্পি।”

    “বুঝতে পারছি মা। এই সবকিছুই নিউ রিয়্যালিটি, আমাদের সবাইকেই নতুন করে বাঁচতে শিখতে হবে। আমি একজন বন্ধুর কাছে উঠেছি, মাসিমণিকে মিট করেছি, এখন হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলবো। সবার কোভিড টেস্ট নেগেটিভ এলে তারপর বাড়িতে মুভ করবো। তুমি এখানে থাকলে যা করতে আমি তাই করছি মা, ইউ হ্যাভ টু রিলাই অন মি।”

    অবিকল বাবার মতন কথা বলছে মেয়ে। মাথা ঠাণ্ডা রাখো, হেস্টি কিছু কোরো না, গাইডলাইন মেনে চলো। কিন্তু অপুর বিপদের সময় কাছে গিয়ে হাতে হাত রেখে দাঁড়াতে পারবে না, এমন পরিস্থিতি সহ্য করা ওর পক্ষে সত্যিই যে অসম্ভব। অথচ সবাই শতমুখে ওকে তাই করতে বলছে! এক্ষুনি ছেলের কাছ থেক টেক্সট মেসেজ এলো, সেখানেও ওই এক কথা--বাবার কথা শুনে চলো, স্টে সেফ। স্টে সেফ!! স্টে সেফ?? যখন মানুষের হৃৎপিণ্ডটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় তখন কি করে সে শুধু নিজেকে নিয়ে নিরাপদ থাকতে পারে?

    অনেক কথা, অনেক আশ্বাস দিয়ে ফোন রেখে দিল মাম্পি। নিউ ইয়র্ক থেকে ছেলে ফোন করে আবার বলল যে ও ভালো আছে। বুকের মধ্যে পাথরগুলো একটুখানি হালকা হলো খানিকক্ষণের জন্য।

    সকাল পেরিয়ে দুপুর বেলা হয়ে গেল, এক দানা খাবারও মুখে তুলতে পারছে না নিপু। ঘণ্টাগুলো ক্রমশই অসহ্য থেকে অসহ্যতর হয়ে উঠছে। কাউকে ফোন করে কোনো লাভ নেই কেননা সবাই একই কথা বলবে। কাঁচের জানলার ওধারে বসন্তকাল, হালকা রোদ্দুর, টিউলিপ আর ড্যাফোডিল, ব্যস্ত পাখিদের কিচিরমিচির আর কাঠবেড়ালিদের ছোটাছুটি। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল ওর, সময়ের বিরাট ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেল, তারপর তার কাঁটাগুলো ঝড়ের বেগে ঘুরতে লাগলো পিছনের দিকে। বছর, মাস, দিন, মিনিট সেকেন্ড সব যেন বৃষ্টিধারার মতন ঝরে পড়তে লাগল ওর চারপাশে। ও বুঝতে পারলো মিথ্যেই এতক্ষণ নিজেকে মানানোর চেষ্টা করছে, শেষ অবধি যেতে ওকে হবেই হবে। বিকেল চারটের সময় একটা ডাইরেক্ট ফ্লাইট আছে, বস্টন টু সানফ্রানসিস্কো। রন কি খুব রাগ করবে? কাজটা হয়তো খারাপ হবে খুব। জীবনে কোনোদিন নিপু এরকম বেপরোয়া কাজ করেনি। কিন্তু সবকিছুরই তো একটা করে প্রথমবার হয়।

    এয়ারপোর্ট। চারদিক শুনশান ফাঁকা, দোকানগুলোর ঝাঁপ বন্ধ, এমনকি স্টারবাকসের কফির দোকানটাও। এখনও সময় আছে নিপু ফিরে যেতে পারে। ভয় করছে যে! ভীষণ ভয় করছে ওর। এয়ারপোর্টটা কেমন যেন অচেনা লাগছে, সবকিছু যেন এক অশুভ আশংকায় আধমরা।

    পরিষ্কার আকাশে ডানা মেলে উড়ছে এরোপ্লেনটা এখন। ওরা নিপুকে একটা ফ্রি আপগ্রেড দিয়েছে, তাই এই মুহূর্তে ও বিজনেস ক্লাসের আরামদায়ক কেদারায়। আশপাশে দশটা লোক আছে কিনা সন্দেহ, তাই একলা একলা ঘণ্টাগুলো যেন কাটতেই চাইছে না। নিজের সাথে নিজেই কথা বলে চলেছে নিপু। মাঝ আকাশে ও এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে, রন ওকে ফোন করলে পাবে না, হয়তো চিন্তা করবে। সারা সকাল দুপুরে রন মেরেকেটে তিনটে টেক্সট করেছিল কিনা সন্দেহ। হ্যাঁ টেক্সট করেছিল, ও উত্তর দেয়নি, কিন্তু রন একটা ফোন করতেও তো পারতো। রক্তহীন ক্ষুদে ক্ষুদে টেক্সট মেসেজের বদলে ও যদি দু-মিনিটের জন্য ফোনটা করতো, যদি ওর গলাটা একবার শুনতে পেতো তাহলে হয়তো শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তো নিপু।

    নিপু হয়ত রনকে কিছুটা বোঝে, কিছুটা বোঝে না, কিন্তু অপু যে ওর নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে জড়ানো। অপুর সঙ্গে কথা হয়নি এমন একটাও দিন নেই ওর জীবনে। আজকে কলকাতায় সল্ট লেকের একটা নিঃসঙ্গ বাড়িতে বাবা-মা টেলিভিশনের সামনে বসে আছে, ফোনগুলো ওদের হাতের মুঠোর মধ্যে অপেক্ষায় থাকতে থাকতে উত্তপ্ত। কাজের লোক আসেনি, অনেকদিন বাদে ওরা নিজেরাই রান্না করছে, বাসন ধুচ্ছে। ওরা ভরসা করে বসে আছে যে প্রতিকার একটা হবেই। ওদের জামাই একজন বিখ্যাত ডাক্তার সে ঠিক সবাইকে সুরক্ষিত রাখবে।

    এরোপ্লেনের অর্ধেকটাই ফাঁকা, সবাই মুখে মুখোস পরে বসে আছে, অনেকের হাতেই রবারের গ্লাভস। নিপুর মনে হল তড়িঘড়িতে কিছুই সাথে আনা হয়নি। বাড়িটার নানান জায়গায় ছোটো ছোটো টেবিল পেতে রেখেছে রন, তার ওপরে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, গ্লাভস, মাস্ক আর রকমারি জীবাণুনাশক পরিপাটি করে সাজিয়ে রেখেছে। জিনিষগুলো নিয়ে এলে অন্তত অপু আর মাম্পির কাজে লাগতে পারতো।

    ও এখন পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট উঁচুতে, এখানে আকাশ পরিষ্কার নীল। প্লেনের জানলা দিয়ে নিচের দিকে তাকালেই চোখে আসবে অদ্ভুত এক সাদা মেঘেদের এক অদ্ভুত দুনিয়া, সেখানে আছে পাহাড়, উপত্যকা, প্রাসাদ আর অরণ্য। শুধু একজোড়া ডানা নেই বলে মানুষ এই বাধাহীন মহান শূন্যতার খোঁজ পায় না। তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিপু বুঝতে পারলো যে সময় আর শূন্যতা কেমনভাবে একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। সেই শূন্যতার মধ্যে অতীত যেন বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি জীবন্ত।

    সেই যে বছরটা ও হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেবে, অপু ক্লাস টুয়েলভে উঠবে। দোতলার ঘরে পাশাপাশি ওদের পড়ার টেবিলদুটো, উল্টোদিকে কখনও ওদের প্রাইভেট টিউটর কখনও স্বয়ং বাবা। বাবা ইকনমিক্সের লোক কিন্তু ইংরেজি আর অঙ্ক দুটোই দারুণ পড়াত। ওদের প্রাইভেট টিউটর ছিল রবীনদা, প্রেসিডেন্সির ফিজিক্স অনার্সের নামকরা ছাত্র। সবাই জানতো যে রবীনদা বছরখানেকের মধ্যেই আমেরিকা চলে যাবে। ওরা দুই বোনেই আলাদা আলাদা করে মনে মনে রবীনদার প্রেমে পড়েছিলো কিন্তু বাইরে সেটা দেখানোর সাহস ছিলো না কারোরই। একে তো রবীনদা ওদের পিসতুতো দাদা, সেখানে একটা গোলমেলে গন্ধ আছে, তার ওপর রয়েছে মায়ের সদাসতর্ক উপস্থিতি। ওরা দুই বোন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো যে মায়ের চশমাটিতে এক্স-রে লাগানো আছে তাই এই বাড়ির দেয়াল বা দরজা কোনটাই যথেষ্ট আড়াল নয়।

    পরীক্ষার ঠিক চার সপ্তাহ আগে অপু জ্বরে পড়লো। পাড়ার ডাক্তারবাবু এসে দেখে গেলেন। ওর বিছানার পাশে বসে নামতা পড়ার মতন নিপু ওকে কেমিস্ট্রি আর বায়োলজি বই থেকে পড়ে শোনাতে লাগলো যাতে দুজনেরই কিছুটা মুখস্ত হয়ে যায়। ঝাঁ-ঝাঁ দুপুর বেলার গরমেও অপু কম্বল মুড়ি দিয়েও কাঁপছে, ওর মুখ লাল, চোখ আধবোজা, কিন্তু ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি ঠিক লেগে আছে। ছোটবেলা অল্পস্বল্প জ্বর হলে ওরা খুশিই হতো বরং। কাঁথার তলায় ঢুকে প্রাণের সুখে গল্পের বই পড়ার সময় ছিল ওটা, বাবা নিজে গিয়ে নতুন বই কিনে আনতো। খাটের কিনারায় একটা বালতি পেতে, মাথার তলায় অয়েলক্লথ লাগিয়ে কেটলির জলে মাথা ধুইয়ে দিত মা। সেই ঠাণ্ডা জলের ধারায় কি যে আরাম। জ্বর ছাড়লে মাগুর মাছের ঝোল আর গলা ভাত দিয়ে পথ্য হতো, সেই পাতলা ঝোলের স্বাদ এখনও ওর মুখে লেগে আছে। কিন্তু সেবার জ্বরটা কমার নাম করলো না তার বদলে ছোটো ছোটো জলভরা ফোস্কা উঠলো অপুর সারা গায়ে। পাড়ার ডাক্তারকে আসতে হল আবার এবং তারপরেই মায়ের দরবারে জরুরি ডাক পড়লো নিপুর।

    “অপুর চিকেন পক্স হয়েছে, ছোঁয়াচে রোগ, তোদের এখন একসাথে থাকা ঠিক হবে না। তুই মাসিমণির বাড়ি গিয়ে থাকবি, ওখান থেকেই পরীক্ষা দিবি। চল আমি তোর জিনিসপত্র গুছিয়ে দিচ্ছি তার আগে ভালো করে চান করে আয়।” মা বলেছিল। সেই প্রথম ওদের দুই বোনের আলাদা হওয়া।

    হপ্তাখানেক কেটে গেছিল তারপর। নিপুর রুটিন খুব একটা বদলায়নি। রবীনদা এখন মাসিমণির বাড়ি এসে ওকে পড়িয়ে যায়। এখানে মায়ের এক্স-রে চশমা নেই, মাসিমণিও চাকরি করে তাই সকাল বেলায় বাড়ি মোটামুটি ফাঁকা। নিপুর মনের মধ্যে একটা ঝড় বয়ে চলেছিল, কালো মেঘের মধ্যে যেমন বিদ্যুৎ খেলা করে ঠিক তেমনি ওর ভেতরটা কাঁপছিল নিষিদ্ধ উত্তেজনায়। রবীনদার সঙ্গে পড়ার বাইরে রোজই কিছু কিছু কথাবার্তা হয়ে চলেছিল তখন। নিপু জানতে পেরেছিল রবীনদার প্রিয় ভাবনাগুলো, যার সবটা জুড়ে সেই আশির দশকের বামপন্থী রূপকথা। প্রচুর চেষ্টা করে ফিজিক্স আর নন্দনতত্ত্ব মিশিয়ে অদ্ভুত সব কবিতা লিখত ও তার মধ্যে আপেক্ষিকতা থেকে নারী শরীরের নানান অনুপুঙ্খ ইচ্ছেমতন যাতায়াত করতো। ভাগ্যক্রমে পাঠক-পাঠিকা ছিল মাত্র কয়েকজনই এবং তারা সবাই হয় ওর বন্ধু অথবা ছাত্রছাত্রী। উদ্দীপনার সেই সপ্তম স্বর্গে বাস করেও নিপু কিন্তু স্বস্তি পাচ্ছিল না কিছুতেই। আনন্দ আর উত্তেজনার পাশাপাশি সাংঘাতিক একটা অপরাধবোধ ওকে পেয়ে বসেছিল। ও কি অপুর অসুস্থতার সুযোগ নিচ্ছে, রবীনদাকে চুরি করে একলা উপভোগ করছে? আচ্ছা, ওদের দুজনের মধ্যে একজনকে তো বেছে নিতে হতোই রবীনদাকে, তাহলে এইভাবেই কেন নয়? কিন্তু সমস্যাটা এই যে অপুকে কষ্ট দিয়ে ও যে কিছুতেই ভালো থাকতে পারবে না। সেই অদ্ভুত টানাপোড়েনের সময় এক রাত্তিরবেলা স্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছিল ও। দেখেছিল, রবীনদা যেন ওকে আদর করছে, ওর সারা শরীরে তীব্র আর অসহ্য সুখের অনুভূতিরা ছুটে বেড়াচ্ছে একদল বুনো ঘোড়ার মতন বাধাহীন উদ্ধত স্বাধীনতায়। হঠাৎ দরজা ঠেলে অপু ঢুকল, ওর হাতে চায়ের কাপ আর বিস্কুট, ওর মুখেচোখে ধিক্কার মাখানো।

    “দিদি আমার অসুখ, আর সেই সুযোগে রবীনদাকে তুই একলা চুরি করে নিলি, আমাকে একবার জানালিও না। তুই ওকে চাইলে আমি তো এককথায় সরে দাঁড়াতাম। তুই যে আমার দিদি, তোর জন্যে আমি সব করতে পারি।” স্বপ্নের অপু আবার কথা বলে উঠলো আর সাথে সাথে জোর একটা ঝাঁকুনি খেলো এরোপ্লেনটা। সীট বেল্ট লাগানোর আদেশ জ্বলে উঠলো, শোনা গেল ক্যাপ্টেনের গলায় সাবধানবাণী। সেদিন ঠিক এইভাবে একটা ঝাঁকুনি খেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠেছিলো নিপু, শরীরের সুখ ছাপিয়ে উঠেছিল মনের শোচনা। সেই রাত্রেই ও ঠিক করেছিলো অপুকে দেখতে যাবে। সবাই বকবে, রাগ করবে, হয়তো ওরও অসুখ হবে, সামনে পরীক্ষা। তাও যেতে ওকে হবেই, বলতে হবে ওর মনের মধ্যে কি হচ্ছে। নিপুদের বাড়ি ছিল নিউ আলিপুরে, মাসিমণির বাড়ি গলফ গ্রীনে, লর্ডস বেকারীর মোড় থেকে সাঁইত্রিশ নম্বর বাসে আধঘন্টাও লাগে না। পরের দিন ঠিক দুপুর তিনটের সময় কাউকে কিছু না বলে ও বাড়ি গিয়ে হাজির হয়েছিল। ও জানতো যে বাবা অফিসে, মা কাজকর্ম সেরে ঠিক এই সময়টায় একটু গড়িয়ে নেয়। সদর দরজার চার্জে থাকে মঞ্জুদি, ওদের বহুদিনের কাজের লোক। টুং করে বেল বেজে ওঠা এই সময় খুব একটা অস্বাভাবিক নয়, ফিরিওয়ালা, ফ্ল্যাটের দারোয়ান বা ঠিকে কাজের লোক, ইত্যাদি নানান জনতা এই সময়টা আসে, মঞ্জুদিই তাদের সামলায়।

    ঠোঁটে আঙুল চেপে চোখ গোল গোল করে ও বাড়িতে ঢুকেছিল সেদিন। মঞ্জুদি বোধহয় বুঝতে পেরেছিল যে বেগতিক দেখলে নিপু ওর গলাই চেপে ধরবে, তাই ওর হাঁ করা মুখ থেকে খুব একটা শব্দ বেরোয়নি। এক এক লাফে তিনটে করে সিঁড়ি ডিঙিয়ে নিপু পৌঁছে গেছিল ওদের দোতলার ঘরে।

    “দিদি!”

    “অপু চুপ! আমি তোকে একটু দেখেই চলে যাবো। প্লীজ মা কে জাগাস না।”

    অপুর অবাক হওয়া মুখটা এখনও ও চোখের সামনে পরিষ্কার দেখতে পায়। সে কি চেহারা হয়েছিল অপুর? যাকে বলে রীতিমতন বীভৎস! সারা মুখে গলায় অজস্র ফোস্কা, তার অনেকগুলোর ওপরে চুমটি পড়েছে, কোথাও কোথাও শুকনো রক্তের দাগ। অপু কি তাহলে মরে যাবে? এখানে ওর ছোট বোনটা এইরকম অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে আর ও!? ছিঃ নিপুণা ছিঃ।

    নিপু ওকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল সেদিন। কি বলেছিল তার একবর্ণও এখন মনে নেই। ওর সমস্ত সত্ত্বার মধ্যে এক মহাভয় এসে বাকি সব অনুভূতিদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল অনায়াসে। মা ছুটে এসে ওদের আলাদা করলো, টেলিফোন পেয়ে অফিস থেকে ছুটে এলো বাবা, তার পিছনে পিছনে আরো কয়েকজন। নিপু পুরো দুদিন ধরে কেঁদেছিল, কিছুতেই ওকে অন্য কোথাও পাঠানো যায়নি। ডাক্তার বলেছিলেন যা ছোঁয়াচ লাগার লেগে গেছে, এখন ও বাড়িতেই থাকতে পারে। আশ্চর্যের কথা অপু খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠলো তারপর। জ্বর ছাড়লো, সব ফোস্কা মিলিয়ে গেল, ঠিক পাঁচদিনের মাথায় গলা ভাত আর মাগুর মাছের ঝোল খেলো ও। দুজনে আবার একসঙ্গে বই খুলে বসলো, রবীনদাও চলে এলো তিন সপ্তাহের মাথায়। নিপু প্রাণপণে চেষ্টা করতো চোখ তুলে রবীনদার দিকে না তাকাতে। তাকালেই কান গরম হয়ে যেত, তলপেটে যেন একটা ক্ষুদে পাখির পাখার ঝাপটানি টের পেতো ও। পরীক্ষা হয়ে গেল, আস্তে আস্তে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এল বাড়িতে। সবাই বলল নিপুর নাকি খুব জোর ইমিউনিটি আছে, তাই চিকেন পক্স ওকে ছুঁতে পারেনি।

    একটা কথা রন ছাড়া কেউ জানে না। বাড়িতে ফেরার কয়েকদিন পর ওর একটুখানি জ্বর জ্বর আর মাথাব্যথা হয়েছিল। স্নান করার সময় বাঁ-দিকের বুকে আর ডান দিকে কোমরের কাছে দুটো ক্ষুদে ক্ষুদে জলভরা ফোস্কার হদিস পেয়েছিল ও, ভয়ের চোটে কাউকে বলেনি। ওই নিয়েই পরীক্ষা দিয়েছিল, ধরতে পারেনি কেউ। বাঁদিকের বুকের ওপরে ফোস্কাটা লাল হয়ে উঠেছিল আর খুব ব্যথা কিছুদিনের জন্য। সেরে যাবার পরেও ওখানে একটা হাল্কা কালো দাগ থেকে গেছে, রন ছাড়া কেউ সেটা দেখেনি। হানিমুনের সময় ওরা যখন লজ্জা কাটিয়ে সদ্য সদ্য পরস্পরের শরীর চিনেছে, সেই সময় দাগটা ওকে দেখিয়েছিল নিপু। গল্প শুনে রন ওকে বুঝিয়ে বলেছিল কিভাবে একই ভাইরাস থেকে কারো কম, কারো বেশি অসুখ হয়।

    ওদের দুই বোনের মধ্যে অপুই বেশি সুন্দরী, ওর মুখ, চোখ, নাক, চিবুক সবই নিখুঁত, দুধে আলতায় গায়ের রং, কোমর ছোঁয়া ঘন চুলের ঢেউ। কিন্তু স্বভাবে ও ভীষণ লাজুক আর চাপা। অন্যদিকে নিপুকে ঠিক সুন্দরী বলা যায় না কিন্তু ওর চেহারার মধ্যে একটা চটক আছে। নিপুর স্বভাবটা ধারালো, ওর সাহস আর রাগ দুটোই কিছু বেশি। প্রেমিকদের উৎপাত শুরু হতে দেরি হয়নি তাই কলেজ শেষ হতে না হতেই চটজলদি ওদের এন-আর-আই সৎপাত্রদের হাতে সমর্পণ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়েছিল বাবা-মা।

    সেই থেকে ওরা বিদেশি ফুলের গুচ্ছ নিয়ে দিন কাটাচ্ছে।

    এয়ার হোস্টেসের ডাকে জেগে উঠল নিপু। প্লেন নামছে, জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঢেউ খেলানো পাহাড়, নীল উপসাগর, ছবির মতন উজ্জ্বল এক সেতু আর অসংখ্য বাগান দিয়ে সাজানো রূপসী শহর সানফ্রানসিসকো। ফোনটা হাতে নিতে না নিতেই একগাদা উত্তপ্ত মেসেজ হই হই করে ওর দিকে তেড়ে এলো। অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে এখন।


    ।।৪।।
    Thus, each of us had to be content to live only for the day, alone under the vast indifference of the sky.
    সারাদিন ভূতের মতন কাজ করার পরে সন্ধ্যা বেলায় ম্যাক্সের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে হাজির হয়েছে রন। নেহাত মাথা কাজ করছে না এবং পারিবারিক ফ্রন্টে সংকট ঘনীভূত, নাহলে লকডাউনের মধ্যে কারো বাড়ি যাবার পাত্র ও নয়। ফোনে ওর পারিবারিক পরিস্থিতির পুরো গল্পটা শোনার পর ম্যাক্স নিজেই জোরজবরদস্তি করে বাড়িতে ডেকে নিয়েছে ওকে।

    “এমনিতেই আমরা দুজনে চব্বিশঘণ্টা ভাইরাস ঘাঁটছি, বাড়তি ঝুঁকি আর কি হবে। এইরকম সিচুয়েশনে একলা একলা ডিসিশন নেওয়া ঠিক নয়। চলো, ইচ্ছে হয় তো মাস্ক খুলো না।"

    “ম্যাক্স, তুমি জানো, আমার ভাইরোলজি ল্যাব একটা মস্ত বড়ো গ্রান্ট পেয়েছে। একটা নতুন অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ, আমরা যার নাম দিয়েছি এম-১২১৯, সেটাকে খুব তাড়াতাড়ি হিউম্যান ট্রায়ালে নিয়ে যেতে হবে। আমি যদি না থাকি কাজটা কি করে এগোবে বলো? প্রটোকলগুলো এখনো দেখা হয়নি, অথচ এই সপ্তাহে জমা না দিলেই নয়।” ক্লান্ত গলায় রন বলল।

    “রন, আমি বলছি তুমি ওয়েস্ট কোস্টে চলে যাও। ফ্যামিলি ফার্স্ট। আমি পার্ট টাইম তোমার কাজটা দেখবো, তুমিও ওখান থেকে অনলাইন প্রত্যেকদিনের প্রগ্রেস দেখতে পাবে। ঠিক সময়মতন সব হয়ে যাবে দেখো।”

    “তোমার ভ্যাকসিন ট্রায়ালটা শুরু হয়েছে, সেটাও তো একই রকম ইম্পর্ট্যান্ট ম্যাক্স। তুমি কি করে আরো দায়িত্ব কাঁধে চাপাবে? এই বিপদে আমাদের সবাইকেই যে যার এলাকায় নিজের একশভাগ দিতে হবে। নিপু যে কেন এমন অবুঝের মতন কাজ করলো?” রনের গলায় ক্ষোভ আর অসহায়তা।

    “হৃদয় তার নিজস্ব যুক্তিতে চলে রন।” ম্যাক্স হাসলো।

    “আচ্ছা ম্যাক্স, তুমি তো গত দশ বছর ধরে এই নিয়ে গলা ফাটালে? আধুনিক দুনিয়া যেভাবে চলছে তাতে আজ হোক, কাল হোক প্যানডেমিক একটা হতে বাধ্য, তার মোকাবিলা করার জন্য আমরা একেবারেই তৈরি নই। আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখন ওয়াল স্ট্রীটের মুনাফাবাজদের খপ্পরে, জনস্বাস্থ্যে টাকা বরাদ্দ করতে সকলেরই গায়ে জ্বর আসে, সরকারি নীতিনির্ধারকরা হয় দালাল নয়তো অপোগণ্ড। তুমি যখন ভুরি ভুরি স্ট্যাটিস্টিক্স দেখিয়ে এসব কথা বলতে তখন ওরা কেমন অদ্ভুত মুখ করে তাকিয়ে থাকতো মনে আছে তোমার? ওদের কাছে তুমি ছিলে বাস্তবজ্ঞানহীন, বামপন্থী এবং সবজান্তা একটি আপদবিশেষ যার উপদেশ কেউ কোনোদিন শুনবে না অথচ যে ব্যাটাচ্ছেলে কোনোমতেই বোবা হয়ে থাকতে রাজি নয়। আজকে যখন টেবিলের ওপাশে সেই সব হাতিঘোড়ার দল সবাই একসঙ্গে পাঁকে পড়েছে, যখন তোমার প্রতিটি ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে, তখন ঠিক কি রকম অনুভূতি হচ্ছে তোমার?”

    ছাতের দিকে তাকিয়ে যেন নিজেকেই প্রশ্নটা করলো রন। ওদের দুজনের হাড়ের ভেতরে একই উত্তর মেরুর হাওয়া বইছে। হায়, এখন যদি অজ্ঞানতার উষ্ণ দীঘির মাঝখানে খুব কষে একটা ডুব দেওয়া যেত। যদি ভেবে নেওয়া যেত যে যা হচ্ছে সবই শুধু ক্ষণিকের দুঃস্বপ্ন, দুনিয়াদারি যেমন চলছিল খুব শিগগিরই ঠিক তেমন ভাবেই আবার চলবে। মাথার ওপরে মুরুব্বিরা আছেন, তাঁরা বিচক্ষণ লোক, ভেবেচিন্তে একটা ব্যবস্থা তাঁরা অবশ্যই করবেন। শুধু এই বিশ্বাসটুকু থাকলেই তো এমনটা একলা, উলঙ্গ অবস্থায় এই মৃত্যু উপত্যকার অন্ধকারে টহলদারি করতে হতো না ওদের কয়েকজনকে।

    “আমার খুব ভয় করছে রন। তোমার জন্য, আমার নিজের জন্য, আরো অনেক বন্ধুদের জন্য ভয় করছে। নিজেকে একটুও জয়ী বলে মনে হচ্ছে না।” ম্যাক্স বলল।

    “ভয় আমারও করছে কারণ তোমার মতন আমিও বিপদের মাত্রাটা পরিষ্কার বুঝতে পারছি। যারা মুর্খের স্বর্গে বসে আছে তাদের ভয়ডর নেই। মহাদুর্দশা আসছে, আমাদের পরিচিত পৃথিবীর চেহারাটা অনেকখানি বদলে যাবে, সেই বিরাট বিবর্তনের মধ্যে আমার, তোমার সত্যিই কিছু করার নেই। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে প্রাণপণ লড়াই দেওয়াই এখন একমাত্র কাজ। যুদ্ধ লেগেছে, এখন অস্ত্র ফেলে দিয়ে কনফিউজড হয়ে বসে থাকা কোনো বিকল্প নয়। এই যুদ্ধে আমাদের ব্যক্তিগত অনুভূতিরা সবাই একপক্ষে, ডাক্তার এবং গবেষক হিসাবে আমাদের কর্তব্য অন্যপক্ষে।”

    “তুমি দেখছি গীতা আওড়াচ্ছ। একটাই ছোটো সমস্যা আছে। আমাদের রক্ষা করার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে হাজির নেই।” ম্যাক্স গম্ভীর মুখে বললো। এর মধ্যে ওর ফোনটাও বেজে উঠেছে।

    “এক্সকিউজ মি। হ্যালো--”

    “দরজা খোল, আমি বাইরে” পরিচিত গলায় ফিসফিসানি ভেসে এল ওদিক থেকে।

    রীতিমতন অপ্রস্তুত হয়ে দরজা খুললো ম্যাক্স। মিরিয়ম খুব বেখাপ্পা সময়ে এসে হাজির হয়েছে। মিরিয়ম ওরফে মিমি ম্যাক্সের নতুন বান্ধবী, ওরই ভ্যাকসিন ল্যাবে কাজ করে। মিমি কিন্তু অধ্যাপক রন চ্যাটার্জিরও অপরিচিত নয়। মেডিক্যাল স্কুলে থাকার সময় ও রনের ভাইরোলজি ক্লাসের ছাত্রী ছিল। ও প্রায়ই বায়না ধরে, ডক্টর চ্যাটার্জির সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দাও। ম্যাক্স ঠিক করেছিল যে একদিন তিনজন একসঙ্গে লাঞ্চ খেতে যাবে তার মধ্যে এইসব হাঙ্গামা হয়ে সব গুবলেট।

    “মিমি। ল্যাবে যাওনি আজ?”

    “সারপ্রাইজ। কি ব্যপার ম্যাক্স, তুমি কি আমাকে বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে ঠিক করেছো? বেডরুমে বুঝি অন্য কেউ আছে?” তরল পরিহাসের গলায় বলেছে মিরিয়াম।

    “আরে না না, এসো।”

    ঘরে ঢুকে সোফায় আধশোয়া অবস্থায় ওর প্রাক্তন অধ্যাপককে দেখে প্রচণ্ড হকচকিয়ে গেল মেয়েটা। কেউ কেউ ঘাবড়ে গেলে তোতলা হয়ে যায়, মিমি তাদের মধ্যে একজন। ওর মুখ থেকে যেসব আওয়াজ বেরোতে লাগলো তার ভাষা কিংবা অর্থ, কোনোটারই হদিশ বার করা কঠিন।

    “ডিয়ার রন, পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিমি, আমার গার্লফ্রেন্ড, ওর পুরো নাম মিরিয়ম নাসার। তুমি ওকে চিনলেও চিনতে পারো, তোমার ভাইরোলজি কোর্সের ছাত্রী ছিল গত বছরে।”

    রন বোকার মতন হাঁ করে তাকিয়ে আছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি পেয়ে গেল ম্যাক্সের। বেচারা রন খুব প্রিন্সিপলড, নিয়ম মানা সংসারী লোক, মেয়ের বয়েসি গার্লফ্রেন্ড ব্যপারটা চট করে হজম করা ওর পক্ষে একটু মুশকিল।

    “আমি তাহলে আজ উঠি। বাই মিরিয়ম, তোমাকে দেখে ভালো লাগলো।” রন এক লাফে উঠে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু সাথে সাথেই ওর হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিল ম্যাক্স, “আরে বসো বসো প্রফেসর, মিমি তোমার বিরাট ভক্ত, ওর মতে তোমার মতন টিচার বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নেই।”

    “ভগবান রক্ষা করো।” মনে মনে বললো রন কিন্তু কৌতূহল ওর দৃষ্টিকে চালিত করলো অজান্তেই।



    মিমি কুণ্ঠিত পায়ে ঘরের ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে, ওর পরনে একটা লাল আর কমলা মেশানো ফ্লোরাল ডিজাইনের ড্রেস। উল্টোদিকের বিরাট কাঁচের জানলা দিয়ে বিকেলের রাশি রাশি রোদ্দুর এসে লুটিয়ে পড়েছে ওর সারা গায়ে। রোদ্দুরটা যেন লাভার স্রোতের মতন বয়ে চলেছে পাহাড় থেকে উপত্যকায়, উদ্ধত বুক থেকে ক্ষীণ কটিতটে, ভরাট নিতম্ভ ছুঁয়ে দীর্ঘ সুঠাম পা বেয়ে গোড়ালি পর্যন্ত। একঢাল বাদামি চুল ওর কাঁধ থেকে পিঠের মাঝামাঝি অবধি ছড়ানো, সেখানেও রোদ্দুর মাখামাখি। ওর মুখের রেখাগুলোয় গ্রীক ভাস্কর্যের তীক্ষ্ণতা কিন্তু চোখ দুটো যেন ভীতা হরিণীর মতন। প্রাক্তন ছাত্রীটির সঙ্গে এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখা হয়ে গিয়ে মনটা কেমন অকারণেই হালকা হয়ে গেল রনের। ডুবন্ত মানুষ যেমন মরিয়া হয়ে জলের ওপরে মাথা তোলে, ঠিক তেমনি ও যেন দম নিয়ে বাঁচল কয়েক মুহূর্তের জন্য। সৌন্দর্যের এই এক অদ্ভুত নিরাময়ী ক্ষমতা আছে, জটিলকে সে নিমেষের মধ্যে সরল করে দেয়, বিপন্নতাকে মুছে দিয়ে জীবনকে আবার সহনীয় করে তোলে।

    “এই দেখো সমস্যার সমাধান নিজে থেকেই এসে হাজির।” উৎসাহিত গলায় বলে উঠলো ম্যাক্স, “মিমিকে আমি ফুলটাইম তোমার ল্যাবে বদলি করলাম। ও আমাকে আর তোমাকে একসঙ্গে রিপোর্ট করবে। দুজনে মিলে কাজটা ঠিক সময়ে নামিয়ে ফেলবো দেখে নিও।”

    “কিন্তু তাতে তোমার কোন অসুবিধা হবে না। তাছাড়া মিরিয়মও নিশ্চয়ই ওর নিজস্ব কোনো একটা প্রজেক্টে ইনভলভড আছে।" রনের দ্বিধা কাটতে চাইছে না।

    “এই সময়ে, আমার, তোমার, সক্কলের একটাই প্রজেক্ট রন--সেটা হল এই হতচ্ছাড়া ভাইরাসকে জাহান্নমে ফেরত পাঠানো।” ম্যাক্সের উৎসাহ ধাপে ধাপে উঠছে। রন আড়চোখে দেখতে পেলো মিমির মুখও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, গাঢ় বাদামি চোখের তারায় প্রত্যাশার ঝিলিক।

    “আমি আপনার ল্যাবে কাজ করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করবো স্যার,” খুব আস্তে করে বলল মিমি। কথাগুলো বলার সময় ওর গালের ওপরে এমন রক্তিমাভা ফুটে উঠলো, যে তাদের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশই থাকলো না।

    “ঠিক আছে কাল সকালে আমি সব পেপারওয়ার্ক তৈরি করে পাঠিয়ে দেবো। যে ওষুধটা নিয়ে আমরা কাজ করছি সেটা কিন্তু প্রপ্রাইরেটরি, ফাইপ্রো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির সম্পত্তি। তাই তোমাকে অনেক রকম কনফিডেনশিয়ালিটি এগ্রিমেন্টে সই করতে হবে। মনে রেখো, ওষুধটা ওরা দিচ্ছে বটে, কিন্তু রিসার্চটা করছি আমরা, এবং সেই রিসার্চের ফলাফল কি হবে সেটা এই মুহূর্তে প্রেডিক্ট করা অসম্ভব।” রন বলল।

    “আমি জানি প্রফেসর চ্যাটার্জি। আপনার সায়েন্টিফিক ইন্টিগ্রিটির কথা ইউনিভার্সিটির সবাই জানে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনার প্রোটোকলের এক তিল নড়চড় হবে না। তাছাড়া আমাদের ভ্যাকসিনটাও তো ওই একই কোম্পানির প্রডাক্ট তাই আমি এতদিন ওদেরই সঙ্গে কাজ করছি।” মৃদু অথচ দৃঢ় গলায় বলল মিমি। ম্যাক্স ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এখন। মুখে কিছু না বললেও এটা স্পষ্ট যে মিমির প্রতিটি কথার জন্য জামিন থাকছে ম্যাক্স। ওদের দুজনকে পাশাপাশি দেখলেই বোঝা যায় যে অদৃশ্য এক বিদ্যুৎশিখা ওদের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। সেই শিখার মধ্যে দীপ্তি যতটা আছে ততটাই আছে দহন।

    “ম্যাক্স ব্যাটাচ্ছেলে দিব্যি আছে দেখছি, এই নিয়ে কতবার যে ওর হৃদয় ভাঙল, আবার জোড়া লাগলো তার হিসাব রাখা মুশকিল।” মনে মনে বললো রন। বছরদুয়েক আগে মিলানে সেই যে এক ইটালিয়ান মেয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল, তখন তো মনে হয়েছিল মামলা বেশ সিরিয়াস, বিয়ের আংটি অবধি কেনা হয়ে গেছে। ম্যাক্স তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটা প্রজেক্টের ডাইরেক্টর। মেয়েটির নাম পেনিলোপি, ডাকনাম পেনি, মিলানের এক ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে। সব ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু প্রজেক্ট শেষ হয়ে যাবার পরে মেয়েটি কিছুতেই আমেরিকা আসতে রাজি হলো না। তার বদলে ও ধরে বসলো যে ম্যাক্স ইটালিতে থেকে যাক, ওর মতন লোকের কাজের অভাব কি, এখানকার ইউনিভার্সিটি ওকে লুফে নেবে। তাছাড়া টাকার জন্য চাকরি করার দরকার ওর এ জন্মে হবে না। পেনি আমেরিকান সরকারি নীতির প্রবল বিরোধী, একটা মাথামোটা সাম্রাজ্যবাদী দেশের নাগরিক হতে ও আদপেই রাজি নয়।

    বিয়ের আংটি ফেরত নিয়ে যথাসময়ে একলাই ফিরে এসেছিল ম্যাক্স। এই ঘরের আধো অন্ধকারে বসে গাঁজার ধোঁয়া সহযোগে বুকের ভার নামিয়েছিল ও সেদিন।

    “জানো রন, ইউরোপিয়ানরা ভণ্ডামি জিনিষটা বেশ ভালো রপ্ত করেছে। ব্যাটারা পাঁচশো বছর ধরে কলোনিগুলোর ওপরে যথেচ্ছ লুটপাট চালিয়েছে, তারপর নিজেদের মধ্যে মারপিট করে পৃথিবীটাকে প্রায় শেষ করে এনেছিল, অথচ এখন ওরাই নাকি উদার মানবিকতার ধ্বজাধারী। ওদের অলীক সমাজবাদের সঙ্গে রেলগাড়ির কামরাগুলোর তুলনা দেওয়া যায়। এঞ্জিনটা হচ্ছে আমেরিকা, সে ছুটছে বলে ওরাও সমান তালে ছুটছে, কিন্তু ওরা সুশীল, সুভদ্র, সংস্কৃতিবান, ওদের গায়ে কয়লার গুঁড়ো লেগে নেই। ওদিকে এঞ্জিনটার মহা সমস্যা। ধনতন্ত্র এবং ভোগবাদের জোড়া ফার্নেস তাকে চালু রাখতে হবে, সেখানে চব্বিশ ঘণ্টা কয়লার জোগান দিয়ে চলতে হবে, সুতরাং হাত নোংরা করতে সে বাধ্য। না বন্ধু আমি ধাপ্পাবাজির স্বর্গে বাস করতে চাই না। তার চেয়ে এই বিভ্রান্তিকর নরকই আমার প্রার্থিত, যেখানে ভালো, মন্দ, মেধা, মূর্খামি, উচ্চাশা আর কুঁড়েমি সবাই একসঙ্গে জড়িয়ে আছে ইন দি সেম মেল্টিং পট। আমূল পরিবর্তনের জন্য যেরকম জোরদার গণ আন্দোলন হওয়া দরকার তা একদিন এই দেশেই হবে দেখে নিও।”

    ‘আমার তো উল্টোটা মনে হয় ম্যাক্স। আমি তো বলবো, মেয়েটাকে ডিচ করে খুব জোর ভুল করেছো তুমি। মিলানে একটা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে থাকতে, বারান্দায় থাকতো অজস্র ফুলগাছ, শোবার ঘরের জানলা থেকে দেখা যেত পিয়াজা দেল ডুমোর গথিক চূড়া। শহরের সবচেয়ে ছোট্ট আর নির্জন একটা কাফেতে তোমরা সেই রেনেসাঁসের সময় হারিয়ে যাওয়া পুরনো ওয়াইন আর সম্রাটভোগ্য পাস্তার খোঁজ পেয়ে যেতে।”

    “থামো থামো, আর এগিয়ো না বৎস রন, তোমার মনের ওই রোম্যান্টিক ছবিটা মনেই রেখে দাও কারণ বাস্তবের মিলান এখন একেবারে আলাদা। একদিকে ওটা একটা প্রকাণ্ড বাজার, দুনিয়ার সব ব্র্যান্ড ওখানে দোকান খুলে বসেছে, অন্যদিকে ট্যুরিস্ট ইন্ডাস্ট্রির দাপটে ওটা এখন মোটামুটি একটা অবরুদ্ধ শহর। ইটালিতে ট্যুরিস্ট আসতো চিরকালই কিন্তু এখন যেরকম পাইকারি হারে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ লোক শহরের প্রতিটি স্কয়ারে উপচে পড়ছে, তার তুলনা ইতিহাসে নেই। যারা কস্মিনকালে ঘর ছেড়ে বেরোয়নি তারা এখন ফি-বছর প্যাকেজ ট্যুর নিয়ে দুনিয়া কাঁপিয়ে বেড়ায়। ইটালির যেকোন বিখ্যাত স্কয়ারে চলে যাও দেখবে প্ল্যাকার্ড আর মাইক নিয়ে চৈনিক ট্যুরিস্টদের গাদাগাদি ভিড়। অন্যেরাও পিছিয়ে নেই, পূর্ব ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা, এমনকি তোমাদের ইন্ডিয়া থেকেও দলে দলে লোক হাজির। দুনিয়ার কয়েক বিলিয়ন লোকের হাতে হঠাৎ কিছু বাড়তি পয়সা এসেছে, এবারে তারা সবাই হপ্তাখানেকের জন্য নবাব সাজতে চায়। তার ওপর দুনিয়ার সব জাতের উদ্বাস্তু আর বেআইনি ইমিগ্র্যান্টরা আছে, ইউরোপ তাদের গিলবেও না ওগরাবেও না, সমাজের বাইরে একপাশে ঠেলে রাখবে। মোদ্দা কথা ইউরোপে আমি থাকতে পারবো না, আমার বাড়ি এইখানে, স্বাধীনতার জন্মভূমি এই বরফ প্যাচপ্যাচে বস্টন শহরে।” ম্যাক্স বলেছিল। “তুমি যে অতি-দক্ষিণপন্থীদের মতন কথা বলছ,” ইচ্ছে করেই খোঁচাটা মেরেছিল রন, “সাধারণ লোক বেড়াতে যাচ্ছে, রিফিউজি আর ইমিগ্র্যান্টরা কিছুটা হলেও আশ্রয় পাচ্ছে, খেতে পরতে পাচ্ছে, এটাই কি প্রগতির লক্ষণ নয়? এককালে শুধু বড়লোকেরা দেশভ্রমণে বেরোত এখন মধ্যবিত্তরাও যেতে পারছে, সে তো ভালো কথা।”

    ম্যাক্স একদৃষ্টিতে রনের দিকে চেয়ে থেকেছিল খানিকক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে যে কথাগুলো বলেছিল সেটা ভবিষ্যৎবাণীর মতন শুনিয়েছিল সেদিন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ওর কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল।

    “বাম-ডান, গরীব-বড়লোক বুঝি না প্রফেসর, কিন্তু এপিডেমিওলজিস্ট হিসাবে এইটা হলপ করে বলতে পারি যে আজকের দুনিয়ার পরিস্থিতি মোক্ষম একটি প্যানডেমিক পয়দা হবার জন্য আদর্শ। একদিকে কনজিউমার সোসাইটির রাক্ষুসে খিদে মেটাবার জন্য কোটি কোটি সস্তা শ্রমিক চাই, যার ফলে শহুরে বস্তিগুলো ফুলে ফেঁপে উঠছে। অন্যদিকে লাখে লাখে মানুষ, ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক দুনিয়ার সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাদের চোখে দেখতে পাওয়া যায় না তারাও কিন্তু চুপ করে বসে নেই, তারাও আণ্ডা-বাচ্চা নিয়ে সারা দুনিয়া চষে বেরাতে চায়, তাদেরও শখ-আহ্লাদ আছে। ওদিকে যাঁদের হাতে সিদ্ধান্ত নেবার ভার, দুনিয়ার সেই সব ক্ষমতাশালী প্রভুরা বহুদিন যাবৎ বাস্তবকে নিজেদের সুবিধামতন বানিয়ে নিতে অভ্যস্ত। দেওয়ালের লেখন যতই জ্বলজ্বল করে উঠছে ততই তাঁরা নতুন নতুন আষাঢ়ে গপ্পো তৈরি করে বাজারে ছাড়ছেন। বোমাটা যখন ফাটবে তাঁরা তখনও একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে পাবলিকের মাথা গুলিয়ে দেবেন।”

    সেই সময়টা ছিল ২০১৯ সালের হেমন্তকাল, বস্টন শহরের গাছগুলো তখন যেন কোন এক উদাসী ফকিরের লাল আর হলুদ রঙের আলখাল্লা গায়ে জড়িয়ে বসেছিল। ঘাসের ওপরে ঝরা পাতার রঙিন এলোমেলো নকশি কাঁথা বিছিয়ে দিয়েছিল, হাওয়ায় ভাসছিল শিশির আর কুয়াশার গন্ধ। প্রতি বছর এই সময়টাতে শহরের ছেলে বুড়ো সবাই উদাস হয়ে যায়। ম্যাক্সের ফ্ল্যাট থেকে রনও উদাস মনে বাড়ি ফিরেছিল। দরজা খোলার সাথে সাথেই অবশ্য হালকা হয়ে গেছিল মনটা। ও ভুলেই গেছিল যে দুপুরের ফ্লাইটে অপু আর রুডির আসার কথা, পরের হপ্তায় এখান থেকে ওরা সবাই মিলে ফ্লোরিডায় ছুটি কাটাতে যাবে। ঘরের মধ্যে একরাশ আলো আর হুল্লোড় ছিল সেদিন। ঠিক সেই সময়ে দুনিয়ার অন্য কোন প্রান্তে নিঃশব্দে ম্যাক্সের ভবিষৎবাণী ফলতে শুরু করেছিল, কেউ তার হদিশ পায়নি।

    আজকে আবার ও ম্যাক্সের বাড়ি থেকে বিদায় নিয়েছে মাথার মধ্যে অসাড় যন্ত্রণা আর অগাধ বিপন্নতার ভার নিয়ে। ম্যাক্স নতুন সাথী খুঁজে পেয়েছে, মারীর বিভীষিকার মধ্যেও ও একলা নয়। রন কিন্তু এই মুহূর্তে দ্বিধাবিভক্ত। এই সময় বস্টন ছেড়ে যাওয়াটা কি ঠিক কাজ হবে? হ্যাঁ, ম্যাক্সের ওপর ওর ভরসা আছে, মিমিও অপরিচিত নয়, তবু দিনের শেষে ডক্টর রণজিৎ চ্যাটার্জি এই প্রজেক্টের প্রিন্সিপ্যাল ইনভেস্টিগেটর। অন্যদিকে সেই একই ব্যক্তির পুরো পরিবার এখন ক্যালিফোর্নিয়ায়, রুডি যেখানে বাঁচার জন্য লড়ছে। হয়ত এর পরে অপুও অসুস্থ হবে, ওর পিছু পিছু বাকি সবাই। ওরা সবাই যেন অথৈ জলের ডুবতে ডুবতে রনের দিকে হাত বাড়িয়ে আছে। কিন্তু এখানে ওর রোগীদের প্রতিও ও যে সমান দায়বদ্ধ। যেসব কাজের দায়িত্ব এখানে ওর ওপরে পড়েছে, তাদের গুরুত্বও যে অপরিসীম। এই সব ছেড়ে নিজের পরিবারের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোই কি উচিত কাজ? আবার রুডির সত্যিই কিছু একটা হয়ে গেলে নিপু বা অপু কেউই কি কোনোদিন ক্ষমা করবে ওকে?



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ (শেষ)
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments