• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | উপন্যাস
    Share
  • সন্ত্রাস (৩) : কৌশিক সেন



    || ৫ ||
    “They knew now that if there is one thing one can always yearn for, and sometimes attain, it is human love.”
    এয়ারপোর্টটা অদ্ভুত রকমের খালি, সব দোকান বন্ধ, আশপাশে মাত্র কয়েকজন লোক মুখোশে মুখ ঢেকে হনহনিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, যেন কোনরকমে এই তল্লাট থেকে পালাতে পারলে তারা বাঁচে। রোহনের গা শিরশির করে উঠলো, মনে হলো এটা কিছুতেই বাস্তব নয়। ও নির্ঘাত রাস্তা ভুল করে একটা বিদঘুটে সাই-ফাই সিনেমার সেটের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। কয়েক মাস আগেই কি অদ্ভুত প্রাণবন্ত আর চলমান ছিল এই সানফ্রানসিস্কো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। বারগুলোতে এমন ঘেঁষাঘেঁষি ছিল যে একটা টুল খালি পেতে কপাল লাগত বিস্তর। অচেনা মানুষের গা ঘেঁষে বসে দিব্যি নিশ্চিন্তে গপ্পো জুড়ত অচেনা মানুষ। সিকিউরিটির সামনে লম্বা লাইনগুলো এঁকে বেঁকে চলে যেত অনেক দূর অবধি। সেই সব লাইনের মানুষগুলো পিঁপড়ের মতন ব্যস্ত অথচ সুশৃঙ্খল ছন্দে টার্মিনালের দিকে এগোতে থাকত সারাক্ষণ। কেউ যাচ্ছে কাজে কেউ বা ছুটিতে, সবার হাতে, কানে বা পকেটে বিরাজ করছে বিশ্বস্ত মোবাইল। জঙ্গম এই জীবনধারাকে ভালোবেসে, ঝলমলে অ্যালুমিনিয়ামের ডানা মেলে ওরা উড়ে যেতে চেয়েছে পৃথিবীর এক দিগন্ত থেকে অন্য দিগন্তে। সেই সব আশা-আকাঙ্ক্ষা, আবেশ আর উদ্দীপনাকে কে যেন এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিল, ভেঙে পড়ল সংসক্তির এই মহান দূর্গ। যেন আদ্যিকালের কোন এক হানাবাড়ির কবর ফুঁড়ে অশুভ আত্মা উঠে এল, মারী নামক ভুলে যাওয়া আতঙ্কটিকে নতুন করে চিনতে বাধ্য হল মানুষ। রোমাঞ্চকর কোনো সিনেমায় নয়, কঠোর বাস্তবে।

    বাবা কেমন আছে? মহাভয়ের শীতল নিঃশ্বাস নিজের ঘাড়ের ওপরে টের পেল রোহন। বাবার সঙ্গে শেষবার দেখা হবার স্মৃতি আদৌ সুখকর নয়। রোহন, পিতৃদ্রোহী রোহন, তুমিই না ঠিক করেছিলে বাবাকে বাদ দিয়েও দিব্যি চলে যাবে তোমার জীবন?

    “রোহন! এই রোহন! কি যন্ত্রণা, চোখ খারাপ হয়েছে নাকি তোর? কালা তো আগেই ছিলি।” কানের কাছে প্রায় চেঁচিয়ে বলা কথাগুলোয় রোহনের আত্মচিন্তার জাল ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার। ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে শ্যামলা রঙের এক তরুণী, ছোটখাটো এবং তন্বী তার গড়ন। সরল অথচ বুদ্ধিদীপ্ত মুখ, চশমার আড়ালে তীক্ষ্ণ হলেও আলগা একটা কৌতুক মাখানো চোখদুটো অসম্ভব জীবন্ত। কাঁধ অবধি ছাঁটা ঘন কালো কোঁকড়া চুল মুখের চারদিকে পরিষ্কার একটি ফ্রেম তৈরি করেছে।

    “সরি মাম্পি সরি, তোকে চিনতেই পারিনি। চুলটুল কেটে এক্কেবারে অন্যরকম দেখাচ্ছে, তার ওপরে মুখে মাস্ক,” অপ্রস্তুত হয়ে বলল রোহন। মাস্কটা মুখ থেকে নামিয়ে হাসল শ্রুতি, ঝকঝকে সাদা ওর নিখুঁত দাঁতের সারি। দুজনেই বুঝতে পারছে যে গত কয়েক বছরে ওরা খুব দ্রুত যুবক-যুবতী হয়ে উঠেছে, কৈশোরের খুনসুটি মাখানো মুখগুলোকে ঝট করে খুঁজে বার করা মুশকিল এখন। শুধু হাসিগুলোই যা আগের মতন আছে।

    “মাস্কটা পরে নে, আর চটপট হাতে মেখে নে দেখি এটা--” পার্কিংলটের দিকে যেতে যেতে নিপুণ হাতে জিনিসপত্র সাপ্লাই করে গেছে শ্রুতি। ক্যালিফোর্নিয়ার উদার সূর্যালোক ওদের মনের কোনায় জমা অন্ধকারের সঙ্গে লড়াই করছে এখন। শত্রু যতই অদৃশ্য হোক, যৌবনের অটুট স্পর্ধা তার সামনে শক্ত হয়ে রুখে দাঁড়াতে চাইছে এই দুঃসময়ে।

    “বাবা কেমন আছে? ইজ হি গোয়িং টু মেক ইট? আমি জাস্ট একবার হাসপাতালে যেতে পারি?”

    “রোহন, হি ইজ স্টিল অন দি ভেন্টিলেটর। যিনি চিকিৎসা করছেন তিনি বাবার পরিচিত, বাবাও ওদিকটা একটু সামলে নিয়েই চলে আসবে। তুই একটু ধৈর্য ধর, প্যানিক করিস না প্লীজ। আমরা সবাই আলাদা আলাদা জায়গা থেকে আসছি, আইডিয়ালি আমাদের সেলফ-কোয়ারেন্টিনে থাকা উচিত। সেটা হয়তো সম্ভব হবে না কিন্তু তাই বলে হাসপাতালের আই-সি-ইউতে যাবার প্রশ্নই ওঠে না এখন। মেসোকে একটু ভালো হয়ে উঠতে দে। দিস ইজ অল নিউ রিয়্যালিটি অ্যান্ড উই মাস্ট কমপ্লাই ফর গ্রেটার গুড।”

    ফাঁকা রাস্তা দিয়ে গাড়িটা ছুটে চলেছে। দোকানপাট সব বন্ধ, একদা কলরবমুখর ফুটপাথগুলোর হতশ্রী চেহারার দিকে চোখ তুলেও যেন তাকানো যায় না আর। তিন বছর পরে নিজের শহরে ফিরছে রোহন। কিন্তু এই মৃত্যু উপত্যকা কি সত্যিই ওর কৈশোরের শহর?

    “ওকল্যান্ডে তোর কাজের জায়গায় সব ঠিক আছে তো রে?” শ্রুতি বলল। রোহনের এই একদম চুপ করে থাকাটা অসহ্য লাগছে ওর।

    “ঠিকই আছে।” সংক্ষিপ্ত উত্তর রোহনের।

    “প্রায় বছর তিন বাদে বাড়ি ফিরছিস তুই?”

    “হ্যাঁ। বাবাকে বলে গেছিলাম আর ফিরবই না।” রোহন একটা তিক্ত হাসি হাসল।

    “বুঝলাম। ওদিকে মাসিমণি তার মধ্যেই কয়েকবার তোর কাছ থেকে ঘুরে এসেছে, তাই না?”

    “হ্যাঁ কিন্তু বাবা একবারও যায়নি। বেচারা মা--” রোহনের গলা ধরে এল এবার।

    “কিছু মনে করিস না রোহন কিন্তু তোদের এই বাবা-ছেলের ঝগড়াটা কিন্তু--”

    “মাম্পি এটা শুধু বাবা-ছেলের ঝগড়া নয়। আমি আমেরিকার এই কর্পোরেট কালচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। সমাজ, পরিবার বা পরিবেশ, কোনো কিছুর তোয়াক্কা না রেখে এই যে লাগামছাড়া কনজিউমারিজম, তার সঙ্গে আমার প্রবলেম ছিল। বাবাকে আমি একজন কোলাবরেটর হিসাবে ভাবতাম, যারা বাকি দুনিয়াতেও এই কালচার ছড়িয়ে দিচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে বাবাকে কতভাবেই না হার্ট করেছি, তার জন্য মাপ চাওয়ার সময়টুকুও হয়তো মিলবে না! মাই গড মাম্পি, দিস ম্যান! দিস গ্লোব ট্রটিং, হার্ড হিটিং ওল্ড ম্যান অফ মাইন, অসহায় হয়ে ভেন্টিলেটরে লটকে আছে!! ভাবতে পারছিস?” বিড়বিড় করে যেন নিজের সাথেই কথা বলছে রোহন।

    “রোহন, তুই অকারণেই এরকম গিল্ট-কমপ্লেক্সে ভুগছিস রে। তোর সঙ্গে মেসোর যে আইডিওলজিক্যাল ডিফারেন্স হয়েছিল সেটাও যেমন সত্যি, তোদের মধ্যে ভালবাসাটাও তেমনি সত্যি, দুটোই সমান ইনটেন্স। বাবা-ছেলের মধ্যে এরকম হয়, আবার মিটেও যায়। এই দেখ না, বাবা অসুস্থ শুনেই তুই সব অভিমান ভুলে তড়িঘড়ি এক লাফে এসে হাজির হয়েছিস।”

    “মায়ের ওপর দিয়ে কি যাচ্ছে তাই ভাবছি।” রোহন কথা ঘোরালো।

    “মাসিমণি শক্ত আছে। মাকেই বরং সামলানো যাচ্ছে না।” চিন্তিত গলায় উত্তর দিল শ্রুতি, “মায়ের কি করে যেন ধারণা হয়ে গেছে যে বাবা এসে গেলেই মেসো ম্যাজিক্যালি ভালো হয়ে যাবে।”

    “বড়ো মাসি চিরকালই খুব ইমোশন্যাল আর ফ্যামিলির ব্যাপারে প্রোটেকটিভ। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি,” আনমনে বলল রোহন। স্মৃতিরা দুমদাম করে ইচ্ছেমতন ধাক্কা মারছে মাথার ভেতরে। গত কয়েক বছরের দূরত্ব, নতুন কাজ, নতুন পরিবেশ আর বন্ধুরা এই মুহূর্তে কেমন যেন অবাস্তব আর অপ্রয়োজনীয় ঠেকছে। ও যেন একটা সিনেমা দেখছিল, সিনেমাটা শেষ হয়ে গেছে, এখন হল থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরার সময়। ওদের বাড়ি, বাড়ির সামনের সবুজ লন, পিছনে আকাশরেখায় ঢেউখেলানো পাহাড়, নিজের ঘরের অগোছালো বিছানা, বিছানার পাশে ফেলে রাখা আধখাওয়া প্লেট, মায়ের নিঃশব্দ আসাযাওয়া, বাবার গম্ভীর মুখ, খাবার টেবিলে ঝগড়া, এ সবকিছুই অসম্ভব জ্যান্ত আর উজ্জ্বল এই মুহূর্তে। বরং মাঝখানের বছরগুলোই উটকো, অবাস্তব, যেন একটা ভিডিও গেম, অলীক নির্বাসনের চোরকুঠুরি। সেখানে ঠাসাঠাসি করে গোঁজা রয়েছে ওকল্যান্ডের ছোট্ট ফ্ল্যাট, নোংরা বাথরুম, কাজের জায়গায় আশাভঙ্গ, উইকএন্ডে প্রেম খোঁজা, শরীর নিঙড়ানো, হ্যাংওভার, ঠান্ডা অখাদ্য খাবার আর না-কাচা জামাকাপড়ের গাদা।

    গাড়ি এখন এই শহরের বিখ্যাত এক সেতুর কাছাকাছি, চারদিকে সবুজ পাহাড়ের গায়ে ছবির মতন বাড়ি, তাদের ফাঁকে ফাঁকে উপসাগরের নীল জল উঁকিঝুঁকি মারছে। এ দৃশ্য প্যানডেমিকের আগে আর পরে প্রায় একই। খুব লক্ষ করে দেখলে বোঝা যাবে যে জগিং করতে খুব একটা কেউ বেরোয়নি, সাইকেল বা স্কেটবোর্ড নিয়ে হুস করে চলে যাওয়া লোকজনের সংখ্যাও কম। লাঠি হাতে বুড়ো মানুষ কিংবা প্র্যাম ঠেলা নতুন বাবা-মায়েদেরও দেখা যাচ্ছে না। যারা আছে তাদের অনেকেরই সঙ্গী সারমেয়, দুনিয়া উল্টে গেলেও তাদের বাইরে না বেরিয়ে গতি নেই। কুকুরের নিত্যকর্ম একটা সিরিয়াস ব্যপার, মালিকরা তার ইজ্জত না রাখতে পারলে নিজেরাই লজ্জায় মরে যাবে।

    গাড়িটা অভ্যস্ত রাস্তার মোড়ে এসে ডানদিকে ঘুরতে চলেছে, এমন সময় হঠাৎ করেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল রোহন।

    “মাম্পি, এক মিনিট। তুই গাড়িটা একটু সাইড করতে পারিস?”

    শ্রুতি খুব একটা অবাক না হয়েই গাড়ি সাইড করল। রোহন এসে থেকেই উদ্ভট ব্যবহার করছে, ও এখনও বাস্তব পরিস্থিতিটাকে ঠিকমতো হজম করতে পারেনি। মায়ের সামনে দাঁড়ানোর আগে হয়তো ওর আরেকটুখানি সময় দরকার।

    “বল, কি বলবি?” কপালের ওপর থেকে অবাধ্য চুলগুলো সরিয়ে রোহনের চোখের দিকে সোজা তাকালো শ্রুতি, ওর চোখের দৃষ্টি কোমলে কঠিন।

    “অ্যাম আই আ ব্যাড কিড?” ফিসফিস করে বলল রোহন।

    শ্রুতি চুপ করে থাকল। এই নিয়ে ওর নিজের মনেই অনেক প্রশ্ন। হাইস্কুলে ফাটাফাটি রেজাল্ট করার পরে বাবা বলেছিল বস্টনে থেকে যেতে, ডাক্তারি পড়তে। শ্রুতি জীবনে সেই প্রথম বাবার অবাধ্য হয়েছিল, চলে এসেছিল দেশের অন্যপ্রান্তে, ক্যালিফোর্নিয়ায়। সেই নিয়ে বেশ একটু অশান্তি হয়েছিল চ্যাটার্জি পরিবারে তখন। “আমি কিছু বুঝতে পারছি না মাম্পি! হার্ভার্ডে আমার কলিগরা সবাই তোকে সাহায্য করবে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ল্যাবরেটরিগুলোর দরজা খোলা থাকবে তোর জন্য। তুই বাড়ি ছেড়ে অতদূর যেতে চাইছিস কেন?”

    “ঠিক ওইজন্যেই বাবা। আমি জানি যে ছোটবেলা থেকে তোমার কথামতন পড়াশুনো করেই আমি এই স্কলারশিপটা পেয়েছি। কিন্তু আমার নিজের কি ভালো লাগে, না লাগে সেগুলো এবার আমায় নিজেই বুঝে নিতে হবে। প্লীজ বাবা, আমাকে আমার ইচ্ছেমতন ডিসিশন নিতে দাও। জাস্ট ওয়ান টাইম!”

    “তার মানেটা কি? তুই কি প্রি-মেড কোর্সে ভর্তি হবি না নাকি?” চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞাসা করেছিল মা, কিন্তু সাথে সাথে শ্রুতির উত্তরও ছিল তৈরি। সত্যি কথা বলতে কি প্রশ্নটা মায়ের দিক থেকে আসায় ও হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল কেননা বাবার দিকে সোজা তাকিয়ে কথাটা বলার মতন সাহস হচ্ছিল না ওর কিছুতেই। কিন্ডারগার্টেন শেষ করার দিন থেকেই এবাড়িতে ঘোষণা হয়ে গেছিল যে মেয়ে বড়ো হয়ে ডাক্তার হবে। তখন থেকেই দেওয়ালে অ্যানাটমির চার্ট ঝুলছে, আর সময়ে অসময়ে ওকে পাকড়াও করে বায়োলজির হরেক এলাকায় টহল দিয়ে বেরিয়েছে বাবা। ভালো লাগাটা কখন অসহ্য লাগায় বদলে গেল, শ্রুতির নিজের কাছেই সেটা রহস্য। সেদিন অবশ্য কোনো সংশয় ছিল না, যথাসম্ভব ঘাড় বেঁকিয়েই উত্তর দিয়েছিল ও।

    “না, লিবারেল আর্টসে ভর্তি হবো ঠিক করেছি। আমার কিছুটা সময় দরকার। এখনই নিজেকে হবু ডাক্তার হিসাবে ভাবতে পারছি না মা।”

    এরপর বাবা স্রেফ গুম হয়ে গেছিল। সংক্ষেপে “যা খুশি করো” বলে সোজা উঠে চলে গেছিল স্টাডিতে। বেশ খানিকটা বকাবকি, কান্নাকাটি করার পরে শেষ অবধি বাবাকে মানানোর কাজটা করতে হয়েছিল মাকেই। আসলে হাজার হোক, ও যে মাসিমণির কাছাকাছি থাকবে, সেটাও একটা বড়ো ভরসা ছিল মায়ের। ডর্মিটরিতে ওকে রেখে আসার সময় মায়ের তুলনায় বাবাকেই যেন আরো বেশি করে বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। ভেতরে ভেতরে বাবা কতটা কষ্ট পেয়েছিল এখন বুঝতে পারে শ্রুতি।

    “আই রেসপেক্ট ইয়োর ডিসিশন মাম্পি। গুড লাক।” গাড়িতে ওঠার সময় কেমন যেন অসহায় গলায় বলেছিল বাবা। সাধারণ কয়েকটা কথা, তাও সবসময় কানে বাজে শ্রুতির। পাশে বসা এই রোহন ছেলেটা তিন বছর ধরে বাবার ওপর রাগ করে বসে আছে। ওর মনের মধ্যে এখন কি ঝড় বয়ে চলেছে কে জানে।

    “ইজ দ্যাট হোয়ার হি ইজ?” গুঙিয়ে উঠেছে রোহন। এই শহরের রাস্তাগুলো পাহাড়ের গায়ে গায়ে আঁকাবাঁকা, অনেক সময় খাড়াই, তারপর আবার ঢালু। এই রকম একটা বাঁকের মুখে আকাশরেখায় বিরাট বাড়িটা ঝলমল করছে, তার ওপরে লেখা ইউ-সি-এস-এফ মেডিক্যাল সেন্টার। দানবিক ওই বাড়িটার কোন এক ছায়াচ্ছন্ন করিডরের প্রান্তে, ওষুধ আর অসুস্থতার গন্ধ মাখানো কোন এক বিছানায় আচ্ছন্ন হয়ে ঘুমিয়ে আছে রোহনের বাবা, শ্রুতির রুডিমেসো।

    “ইয়েস।” আস্তে করে বলল শ্রুতি। ওর খুব ইচ্ছে করছে গাড়িটা থামিয়ে রোহনকে ছোটবেলার মতন জড়িয়ে ধরে। ওর এলোমেলো মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখে অনেকক্ষণ। খুব করে ভোলায়, পারলে বা ঘুমই পাড়িয়ে দেয়, তারপর শিয়রের কাছে বসে থাকে চুপচাপ। ইচ্ছেটা থেকে থেকে এমন তীব্র হয়ে উঠছে, গলার মধ্যে টনটনে ব্যথাটা নিচের দিকে নেমে আসতে চাইছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। প্রাণপণে নিজেকে স্টেডি করে, স্টিয়ারিং, গ্যাস আর ব্রেকের মধ্যে সমস্ত মনোযোগ জড়ো করতে চাইছে শ্রুতি, ওর কপালের ওপরে ক্রমশই জমে উঠছে ঘামের ফোঁটা। ওর পাশে বসে ক্লান্তি আর জেটল্যাগে আচ্ছন্ন হয়ে আছে রোহন।

    অবশেষে ওরা এখন নিজেদের পাড়ায়। এ জায়গাটাও ভারি সুন্দর, মসৃণ পথের দুধারে সারি সারি আলোকিত বসতবাড়ি, তাদের সামনে নিখুঁত ম্যানিকিওর করা সবুজ লন, গাছে গাছে রঙিন ফুল আর সরস ফলের সমারোহ। বিশ্বাস হওয়া মুশকিল যে এমন সুন্দর জায়গায় মৃত্যু তার বিকট অশুভ মুখ দেখাতে সাহস পায়। গ্যারেজের মধ্যে গাড়িটা ঢুকিয়ে বিরাট একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল শ্রুতি। বাড়ির ভেতর থেকে হাসিকান্না মেশানো অদ্ভুত এক কোলাহলের স্রোত এসে ওদের ঘিরে ধরেছে। শ্রুতি আলগোছে ওর পাশে বসে থাকা আধা ঘুমন্ত মানুষটাকে সেই স্রোতে ভাসিয়ে দিল। ওর কাজ আপাতত এখানেই শেষ।

    ঘুমন্ত ব্যাকইয়ার্ড। গোলাপ গুচ্ছের অন্ধকারে আলোর ফোয়ারা, ছোট্ট পুকুরের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে অতি স্বচ্ছন্দ রঙিন কইমাছ এবং গোল্ডফিশ। একলা টেলিফোনের জন্য এমন জায়গাই আদর্শ।

    “দাদা, কেমন আছিস? কি করছিস এখন?" কানের ওপর ফোনটাকে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল শ্রুতি। অনেকক্ষণ ধরেই ও সমুর কথা ভাবছে। দাদা কি করছে এখন একলা একলা, ওর ওই একরত্তি অ্যাপার্টমেন্টে, নিউইয়র্কের বাতাসে যখন বিষ।

    “দাঁড়িয়ে আছি এখনও। চারদিকে অনেকে অসুস্থ, বন্ধুদের মধ্যে বেশ কয়েকজন হাসপাতালে। নিউ ইয়র্ক সিটি এখন ধুঁকছে রে মাম্পি! এমন লাইভলি আর অপটিমিস্টিক শহরটা শেষ অবধি একটা ফালতু ভাইরাসের কাছে হেরে গিয়ে নাস্তানাবুদ। ছোটবেলায় আমাদের সঙ্গে খেলতে খেলতে বাবা একটা অদ্ভুত কথা বলত মনে আছে তোর--হেরো, হেরো, বাগবাজারের মেরো। বাগবাজার কোথায় আমি জানি না কিন্তু হারতে কেমন লাগে সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি আজকাল।”

    “দাদা, তুই খালি খালি এরকম নেগেটিভ চিন্তা করিস না। বাবার মতন ডাক্তাররা দিনরাত্রি কাজ করছে, ওষুধ তৈরি হবে, ভ্যাকসিন আসবে, দিস নাইটমেয়ার উইল এন্ড।”

    “কিস্যু হবে না! আমাদের গভর্নমেন্ট চালাচ্ছে কতগুলো মূর্খ আর দাম্ভিক লোকজন, দেশটাকে তারা গোল্লায় না পাঠিয়ে থামবে না। বলে রাখছি শোন, আমেরিকার ছড়ি ঘোরানোর দিন শেষ, এরা নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করে মরবে এবার।” তিক্ত গলায় বলল সমু।

    “আচ্ছা ওসব কথা থাক। তোর গার্লফ্রেন্ডের খবর কি তাই বল।”

    “ভালোই আছে।”

    “তোর গলাটা শুনে ভালো ঠেকছে না দাদা। ঝগড়া করেছিস নাকি?”

    “সব ঠিক আছে। পার্সোন্যাল লাইফ নিয়ে আমি এখন ভাবছি না রে মাম্পি। অনেক বড়ো সমস্যা আমাদের সামনে এখন। তুই, মা, মাসিমণি, তোরা সবাই কেমন আছিস বল? রোহন কি বলছে? অনেকদিন বাদে বাড়ি ফিরেছে না ছেলেটা?”

    সমু এলোপাথাড়ি প্রশ্নের স্রোত বইয়ে দিচ্ছে, বেখাপ্পা পরিহাসও করল কয়েকবার। দুচার কথায় উত্তরগুলো সাজিয়ে দিয়ে শেষ অবধি ফোনটা রেখেই দিল শ্রুতি। ওর বুকের ভেতর থেকে চেপে রাখা নিঃশ্বাসগুলো একে একে ছাড়া পেল, কাউকে না জানিয়ে চুপচাপ মিলিয়ে গেল রাত্রির বাতাসে। দাদা ভালো নেই এবং সেটা শুধু ঘরবন্দী থাকার জন্যই নয়, ওর ব্যক্তিগত জীবনেও কিছু একটা গণ্ডগোল হয়ে গেছে নির্ঘাত। ছোটবেলা থেকেই দাদার গলায় সামান্য পর্দার হেরফের নির্ভুলভাবে বুঝতে পারে শ্রুতি। দাদা বেচারা জানেও না যে শ্রুতির কাছে একটা ম্যাজিক আয়না আছে যেখানে ওর মনের ছায়াগুলো পরিষ্কার ফুটে ওঠে। জানলে নিশ্চয়ই খুব রেগে যেত দাদা, ছোটবেলার মতন চুল টেনে দিত শ্রুতির।

    ছোটবেলার মতন। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আপনমনেই হেসে উঠল শ্রুতি। ছোটবেলায় মাসিমণির মতন লম্বা আর ঢেউখেলানো চুল ছিল ওর। মায়ের খুব গর্ব ছিল ওই নিয়ে কিন্তু বড়ো হবার সাথে সাথে পয়লা মওকাতেই চুল কেটে ফেলেছিল শ্রুতি। হয়ত ওটাই ছিল ওর প্রথম প্রতিবাদ। এখন চাইলেও ওর চুল টানতে পারবে না দাদা, মুঠো করে ধরতেই পারবে না আগের মতন। চুল বড়ো রাখা মানেই চুল বাঁধার যন্ত্রণাময় ইতিবৃত্ত। আমেরিকার সব শহরে একটা করে বাঙালি ক্লাব আছে, তারা আর কিছু না হোক ফি-বছর রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন আর দুর্গাপুজোয় বিচিত্রানুষ্ঠান করবেই করবে। সেইসব সময়ে মা খুব যত্ন করে ওর চুল আঁচড়ে খোঁপা বেঁধে দিত, তারপর শাড়ি পরে স্টেজে উঠে নাচগানও করতে হত ওদের। এই নিয়ে ঝামেলাও পাকাত বিস্তর, কার ছেলেমেয়ে কখন মাচায় উঠল তাই নিয়ে পলিটিক্সের অন্ত ছিল না। এবছর না হবে রবীন্দ্রজয়ন্তী, না হবে পূজা, প্রবাসী জীবনের সব পাগলামি, সব মজার গল্পেরা একঘেয়েমির অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।

    বাড়ির ভেতরটা অদ্ভুত রকমের চুপচাপ। মা, মাসিমণি আর রোহন তিন জনেই এখনও শোবার ঘরে বিছানায় বসে আছে। টিভিটা চলছে, সেখানেও প্যানডেমিক নিয়ে আলোচনা, ওরা কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে একই খবর বার বার দেখে চলেছে। শ্রুতি জানে ও যদি ফ্রিজ থেকে খাবার বার করে মাইক্রোওয়েভে গরম করে টেবিলে রেখে না দেয় তবে হয়তো না খেয়েই শুয়ে পড়বে সবাই। আসলে হাসপাতালের বাইরে থেকেও ওরা এক অসহ্য রোগে ভুগছে, ওদের মনের ওপরে প্রতি মুহূর্তে অত্যাচার চালাচ্ছে এই সৃষ্টিছাড়া অসুখ। অসুস্থতা তো নতুন কিছু নয়, মানুষ চিরকালই অসুখে পড়েছে, রোগযন্ত্রণা ভোগ করেছে, শেষ অবধি সুস্থ হয়ে উঠেছে কিংবা ওঠেনি। যাই হোক না কেন, সেইসব সময়ে প্রিয়জনেরা আরো বেশি করে রোগীর পাশে থেকেছে, অসুখের কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে তাদের সেবা আর সান্নিধ্য। কিন্তু আজকের সমস্যা পুরোপুরি অন্যরকম, কেউ এর জন্য এক ফোঁটা তৈরি ছিল না, পরিস্থিতি কি হয়ে দাঁড়াতে পারে আদৌ কেউ তা ধারণা করতে পারেনি। স্মরণকালের মধ্যে এই প্রথম বিশ্বজোড়া তামাম মনুষ্যজাতিটাই একসঙ্গে আক্রান্ত, তাই সুস্থ এবং অসুস্থ সকলেই আপাতত যে যার নিজস্ব জেলখানায় বন্দী। সবার মাথার ওপর সলিটারি কনফাইনমেন্টের হুলিয়া ঝুলছে। কি অসহ্য এ পরিস্থিতি যখন প্রিয়জন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে জেনেও তার পাশে গিয়ে হাতটুকু ধরার উপায় নেই। এরই নাম চূড়ান্ত সন্ত্রাস।

    একে একে সকলকে ডিনার টেবিলে এনে হাজির করল শ্রুতি। সামান্য খাবার, আজ সকালে রান্না করে রেখে গেছিল ও, সেটাই যত্ন করে পরিবেশন করল সবাইকে। ওর ভেতরটা ভেসে যাচ্ছে অসীম মমতায়। কলেজে প্রথমবার শারীরিক মিলনের পরে পাশে শুয়ে থাকা নিঃশেষিত পুরুষটির প্রতি যেমন অনুভূতি হয়েছিল ঠিক সেইরকম তীব্র আর গভীর আজকের এই অনুভূতি। মা, মাসিমণি, তোমরা আমার পরিবার, এতদিন না চাইতেই আমাকে দুহাত ভরে ভালোবাসা দিয়েছো, আমার প্রতিটি স্মৃতির মধ্যে লুকিয়ে আছো তোমরা। তাই আজকের এই দুঃখরাতে আমি তোমাদের সঙ্গে জেগে থাকব। আমার স্বাস্থ্য আর তারুণ্য আছে, লড়াই দেবার, পরিশ্রম করার সংকল্প রয়েছে। সব রকম আঘাত থেকে তোমাদের আড়াল করার জন্য আমি আমার প্রাণপণ প্রতিরোধের ঢাল বাড়িয়ে ধরব।

    রাত এখন বারোটা, একে একে সব আলো নিভে গেছে। দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া। শ্রুতি নিজের ঘরে এসে কমপিউটার খুলে বসল। বাবাকে সারা দিনের রিপোর্ট পাঠাতে হবে। অদৃশ্য দানবের কয়েদখানা থেকে মুক্তি পাবার চাবি খুঁজে বেড়াচ্ছে বাবার মতন বৈজ্ঞানিকেরা। ইতিহাসের শিক্ষা এটাই যে একদিন না একদিন মানুষের কাছে হার মেনে পাতালে ফিরে যাবে দানব। ততদিন দাঁতে দাঁত চেপে কঠোর শৃঙ্খলায় অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

    “বাবা, কেমন আছো?”

    “কেমন আছিস মাম্পি? তোর মা কেমন আছে? মাসিমণি? রোহন ঠিকঠাক এসে পৌঁছেছে তো?”

    “সবাই ভালো আছে বাবা, সবাই কোভিড নেগেটিভ। চিন্তা কোরো না, আমি তো আছি।” গলার মধ্যে অনেকটা আত্মবিশ্বাস আমদানি করে বলে উঠল শ্রতি। ওদিক থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ভেসে এল যেন। আজকের মতন তাহলে গল্প শেষ, এখন ঘুমের দেশে যাবার সময়।


    || ৬ ||
    “I have no idea what's awaiting me, or what will happen when this all ends. For the moment I know this: there are sick people and they need curing.”
    বিরাট ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটটাকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে, একদিকে কোভিড আক্রান্ত রোগীরা অন্যদিকে বাকি সবাই। হাসপাতালের আরো কয়েকটা এলাকা এখন কোভিড ইন্টেন্সিভ কেয়ার, সেখানে পর্দা ঢাকা সারি সারি নতুন ভেন্টিলেটর বেড, তার মধ্যে একটাও খালি পড়ে নেই। সকাল বেলায় চাকের চারদিকে মৌমাছির ঝাঁকের মতন স্বাস্থ্যকর্মীরা বেড থেকে বেডে ছুটে বেড়াচ্ছে--ডাক্তার নার্স, ল্যাবরেটরির লোকজন, রেস্পিরেটরি থেরাপিস্ট, ভলান্টিয়ার। মৌমাছির সঙ্গে তুলনাটা বেশ জুতসই কেননা আপাদমস্তক গাউন, মাস্ক, চশমা গ্লাভস আর টুপিতে ঢাকা মানুষগুলোকে দেখতে প্রায় একই রকম, তাদের শারীরিক ভাষায় ব্যস্ততা ছাড়া আর কিছু নেই। চারদিকে একটা দম আটকানো, বুক ধড়ফড় করা পরিবেশ। চিরকাল সকালের রাউন্ড শুরু হবার রেসিডেন্ট, স্টাফ আর নার্সদের মধ্যে দুটো কথা, এক কাপ কফি, একটুখানি হাসিঠাট্টা বিনিময় হতো, সেসব এখন গল্পকথার পর্যায়ে। এক গ্লাস জল খেতে গেলেও আলাদা ঘরে গিয়ে খেতে হবে, তারপর আবার মুখে উঠবে মুখোশ।

    মৌমাছিদের মধ্যে রন চ্যাটার্জি ও তার দলবল কাল রাত্রি থেকে ঘন্টাখানেকের জন্যও বিশ্রাম নিয়েছে কিনা সন্দেহ। প্রতিটি নতুন রোগীকে নথিবদ্ধ করা হয়েছে, এর মধ্যে অর্ধেক রোগী নতুন ওষুধ পাবে বাকি অর্ধেক পাবে স্যালাইন কিন্তু কে যে কি পেল সেই তথ্যটি থেকে যাবে সকলের অজানা, যতদিনে স্টাডি না শেষ হয়। সকাল বেলায় এমার্জেন্সি টিম মিটিং ডেকেছে রন।

    “মনে রেখো, ডাটা সেফটি অর্থাৎ ট্রায়াল শেষ হওয়া পর্য্যন্ত তথ্য গোপন রাখা আমাদের সবচেয়ে বড়ো দায়িত্ব। কে কি ওষুধ পাচ্ছে, কজন সুস্থ হচ্ছে কিংবা হচ্ছে না, কাকপক্ষীতেও যেন তার আভাস না পায়। হ্যাঁ, আমরা ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে কাজ করব কিন্তু তাদের হয়ে নয়। ইন্ডাস্ট্রিকে বাদ দিয়ে আমাদের চলবে না কিন্তু প্রতি মুহূর্তে মনে রাখতে হবে যে তাদের আর আমাদের উদ্দেশ্য আলাদা। এই প্যানডেমিকের আবহাওয়ায় অনেক নতুন ওষুধ আর ভ্যাকসিন বাজারে আসবে, অনেক লগ্নি আর মুনাফার সুযোগ হবে, কিন্তু ইনভেস্টিগেটর হিসাবে সেসব থেকে আমরা একশো হাত দূরে থাকব। পরিষ্কার করে বলছি তোমরা আরেকবার সবাই কান খুলে শুনে রাখো। যাদের বানানো ওষুধ বা ভ্যাকসিন আমাদের ট্রায়ালে ব্যবহার করছি সেই কোম্পানিদের সঙ্গে কোনরকম অর্থনৈতিক সম্পর্ক রাখা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। পারিবারিক কারণে আমাকে যদি বস্টন ছাড়তে হয় তাহলে ডক্টর ম্যাক্স অ্যারোনস প্রিন্সিপ্যাল ইনভেস্টিগেটর হিসাবে কাজ দেখাশুনো করবেন, তাছাড়া আমি নিজেও চব্বিশ ঘণ্টা অন কল থাকব। আর এই হচ্ছে মিরিয়ম, আমাদের নতুন রিসার্চ স্কলার, ও তোমাদের সঙ্গে কাজ করবে, শী উইল বি দি লিয়াজোঁ বিটউইন আস। তোমরা জানো ডক্টর অ্যারোন্স-এর নিজের যথেষ্ট কাজ আছে, তা সত্ত্বেও উনি যে অনুগ্রহ করে আমাদের কাজটার দায়িত্ব নিয়েছেন এজন্য আমি কৃতজ্ঞ।”

    দম নেবার জন্য থামলো রন, ওর গলাটাও যেন কেঁপে গেল একটুখানি। বাইরে ওকে শান্ত থাকতে হবে কিন্তু ওর ভেতরে যে লড়াইটা চলছে, তার উত্তাপ যেন অসহ্য হয়ে উঠছে ক্রমশই। যতই অনলাইনে কাজ হোক না কেন, এই পরিস্থিতির মধ্যে নিজের হাসপাতাল আর ল্যাবরেটরি থেকে দূরে থাকাটা ও কিছুতেই মন থেকে মানতে পারছে না। এদিকে মিরিয়ম দিব্যি এর মধ্যেই সবার সঙ্গে আলাপ করে নিয়েছে।

    দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেল, এমন ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে দিনটা। রনের খিদে-তেষ্টা সব উবে গেচ্ছে, পাগলের মতন এক বেড থেকে আরেক বেডে ছুটে চলেছে ও। দুপুর একটা নাগাদ ওকে জোর করে ইউনিট থেকে বার করে আনল ম্যাক্স।

    “যথেষ্ট হয়েছে। মিমি স্পেসিমেন কালেক্ট করছে, ওর সঙ্গে আরো দুজন আছে। তুমি এক মিনিটের জন্য ঠান্ডা হয়ে বোসো রন।”

    মধ্যযুগের নাইটদের যেমন বর্ম, ওদের তেমনি পি-পি-ই অর্থাৎ পার্সোন্যাল প্রোটেকটিভ ইকুপমেন্টস। একে একে সেগুলোর বাঁধন থেকে মুক্তি পেয়ে কাউচে এলিয়ে পড়েছে রন, উত্তেজনা নিভে গিয়ে স্নায়ু এখন অসাড় হয়ে আসছে ক্লান্তিতে। ম্যাক্স দেখতে পেল ওর নাকের দুপাশে চেপে বসা এন-৯৫ মাস্কের কিনারা স্থায়ী একটা কালশিটে ফেলেছে, চশমার পিছনে দুচোখ ফোলা আর রক্তিম। সাদা কোটের পকেট থেকে একটা পেপারব্যাক বই উঁকি মারছে।

    “দি প্লেগ বাই আলবেয়ার কামু। ওই ফ্রেঞ্চ-আলজেরিয়ান ভদ্রলোক এখনও তোমার ঘাড়ে চেপে আছেন দেখছি। কিন্তু এই সময়ে এক্সিস্টেনশিয়ালিস্ট নভেল পড়া স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর বন্ধু,” বইটা হাতে নিয়ে পাতা উল্টোতে উল্টোতে বলল ম্যাক্স।

    “দি বুক ইজ হন্টিং মি।” অবসন্ন গলায় উত্তর দিল রন।

    “ওকে তুমি ডক্টর বার্নাড রিউ, তোমার স্ত্রী দূরে থাকে এবং অসুস্থ, ধরেই নাওয়া যায় টিউবারকিউলোসিস, কেননা সেই সময় ইউরোপে স্যানিটরিয়ামে টিবি রোগীরাই থাকত। তুমি প্রথম প্লেগের পেশেন্ট দেখলে, তুমি স্বাস্থ্য অধিকর্তাদের সজাগ করার চেষ্টা করলে, তোমাকে কেউ পাত্তা দিল না। তারপর যখন রোগ সারা শহরে ছড়িয়ে পড়লো, তখন তুমি যন্ত্রের মতন রোগীদের চিকিৎসা করে চললে, সব নিজস্ব অনুভূতিকে নির্বাসনে পাঠিয়ে কেননা সেটাই তোমার কর্তব্য। তা এই গল্পে আমি কোথায় আছি রন?”

    “আমি জানি না ম্যাক্স। আন্দাজ করতেও ভয় করে আমার। তাছাড়া আমি ডক্টর রিউয়ের মতন নির্বিকার কর্মযোগী নই, আমার পরিবারের দাবি আমি অস্বীকার করতে পারি না।” রন বিড়বিড় করে বলল।

    “ওই বইটায় আমার প্রিয় চরিত্র কিন্তু জাঁ টেরু, ডক্টর রিউর বন্ধু এবং সহকর্মী। আদর্শবাদী টেরু বিশ্বাস করে যে প্লেগ কখনো আপনা আপনি কখনও পিছু হটে না। মানুষই তাকে ঠেলে সরিয়ে দেয়, শ্রম আর বিজ্ঞান মিলে তাকে নির্মূল করে।” ম্যাক্স বলল। রন উত্তরে কি একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই দরজা ঠেলে একজন ঘরে ঢুকেছে।

    “কফি?”


    ওরা দুজনেই দরজার দিকে ফিরে তাকাল। কাগজের ট্রের ওপরে তিন কাপ কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিমি, ওর মুখে এখনও মাস্ক কিন্তু পি-পি-ইর বজ্র আঁটুনির অনেকটাই ইতিমধ্যে ছেড়ে ফেলেছে। ওর পরনে এখন একটা আটপৌরে সাদা কোট আর জিনস, টুপির বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে বাদামি চুল কাঁধ ভাসিয়ে দিচ্ছে, চক্ষু দুটি অনাবৃত এবং বাঙ্‌ময়।

    “ওঃ প্রাণ বাঁচালে সুইটহার্ট, এসো আমাদের আলোকিত করো। রন, এই মেয়েটি ফ্রেঞ্চ ভাষায় তুখোড়, তুমি স্বচ্ছন্দে ওর সাথে কামুর সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে পারো। তুমি তো জানোই, আমার বিশ্বাস যে সংকট যতই গভীর হোক না কেন, তার তাত্ত্বিক বিচার সর্বদাই মুখরোচক।” ম্যাক্স বিগলিত গলায় বলল।

    কফির কাপে চুমুক দিয়ে আরাম বোধ করল রন। ম্যাক্স আর মিমি ওকে একটা অদ্ভুত জায়গায় নিয়ে যায়, সেখানে ও প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নিতে পারে। ওর নিজের জীবনের চারদিকে আবেগ, অনুযোগ, কর্তব্য আর সামাজিকতার একটা অদৃশ্য পাঁচিল তোলা আছে, খুব ভেতরে ভেতরে প্রায়ই সেটা অসহ্য লাগে ওর। ওর মনে এমন বন্ধনহীন গ্রন্থি যদি থাকে, যেখানে একে অপরের উষ্ণ সান্নিধ্য উপভোগ করা যায়, শ্যাম্পেনের বুদ্বুদের মতন হাওয়ায় উড়তে থাকে সূক্ষ্মবিচারের জাল কিন্তু প্রতিদিনের খেরোর খাতা সেখানে নাক গলাতে পারে না।

    “তুমি ফ্রেঞ্চ জানো? ইন্টারেস্টিং। কোথায় শিখেছ জানতে পারি?”

    “ডক্টর চ্যাটার্জি, ফ্রেঞ্চ আমার দ্বিতীয় মাতৃভাষা বলতে পারেন। আমাদের পরিবার প্যালেস্টাইন থেকে ফ্রান্সে এসে সেটল করেছিল, ওখানেই আমার ছোটবেলা কেটেছে।” মিরিয়ম বলল।

    “রাইট, রাইট তোমার রেসুমে দেখছিলাম। তুমি ডাক্তারি পড়েছো অ্যাথেন্সে, তাইনা?”

    “হ্যাঁ। আমেরিকায় আসার আগে প্যারিসেও বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছি,” খুব মৃদুস্বরে বলল মিরিয়ম, ওর গলায় মধ্যে একটা অদ্ভুত দুঃখের অনুরণন। যারা অনেকবার দেশ বদল করেছে, অনেক স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস যাদের গায়ে লেগে আছে, একমাত্র তারাই এইরকম করুণ সুরে কথা বলতে পারে।

    “কথিত আছে যে শিক্ষিত মানুষের দুটো মাতৃভূমি হয়। একটি, ভাগ্যবশে যেখানে তার জন্ম, এবং অন্যটি ফ্রান্স।” অস্ফুট গলায় বলল রন। বিজাতীয় এক ক্লান্তি এসে ওকে গ্রাস করতে চাইছে এখন। কফির কাপে জোরালো চুমুক দিয়ে ও সেটাকে দূরে ঠেলে দিতে চাইল।

    “রন, ইউ শ্যুড গো। আগেই তো বলেছি ফ্যামিলি ফার্স্ট। এখানকার কাজ আমরা সামলে নেব,” ম্যাক্স এগিয়ে এসে বলল এবার।

    “ঠিক আছে আমি অফিসে যাচ্ছি, অনেক কাগজপত্রে সই করতে হবে। কাল সকাল আটটার সময় মিটিং ডাকো, সেখানে যেন রিসার্চ ইউনিট, ফার্মা কোম্পানির রেপ্রেসেন্টেটিভ আর রিভিউ বোর্ডের সবাই হাজির থাকে।” ক্লান্ত পায়ে দরজার দিকে এগোতে এগোতে কথাগুলো বলল রন।

    “আপনি কিছু খেয়েছেন? গতকাল সকাল থেকে আপনাকে এক মিনিটের জন্যও বসতে দেখিনি। আমি আর ম্যাক্স স্যান্ডউইচ খেয়ে নিলাম, আপনি তো সেটাও রিফিউজ করলেন।” ব্যাকুল গলায় মিরিয়ম বলে উঠল। ওর কথাগুলো রনের বুকের ওপরে সজোরে একটা ধাক্কা মারল যেন। ওর মনে হল সেই ধাক্কায় যেন পর পর বন্ধ দরজাগুলো সব খুলে যাচ্ছে, আলোকরশ্মিরা ছুটে চলেছে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে। অনেক কাল আগের কিছু পরিচিত কথা কানের মধ্যে হাতুড়ি পিটোচ্ছে--“রুনু তুই খেয়েছিস? লক্ষ্মী বাবা আমার, বেরোনোর আগে খেয়ে বেরো। জানি কথা শুনবি না, ঠিক বাবার মতন গোঁয়ার হয়েছিস তোরা দুই ভাইবোন।”

    “না না, আসলে খিদে নেই। তিন কাপ কফি খেয়েছি যে। তোমরা এদিকটা দেখো আমি কাগজপত্র রেডি করি।” আমতা আমতা করে কথাগুলো বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রন। যে ভাবেই হোক ওর এখন একলা হওয়া জরুরি। খাওয়াদাওয়া আর অনিয়ম নিয়ে যে দিনরাত্তির নালিশ করত সেই অশীতিপর মহিলাটি এখন কলকাতায়, বাইপাসের ধারে কোন এক ভুঁইফোঁড় অ্যাপার্টমেন্টের তিনতলায় একলা একলা দিন কাটাচ্ছে। বাবা নামক সেই গোঁয়ার লোকটা তার বদঅভ্যাসগুলোর পুরো উত্তরাধিকার রনকে ধরিয়ে দিয়ে চুপচাপ একটি ওয়ান-ওয়ে টিকিট কেটে ছায়ার দেশে পগার পার। তারপর থেকে প্রতিদিন সকালে চোখ মেলার সাথে সাথে যে চিন্তা ওকে বিদ্ধ করে তার সঙ্গে কাজ অথবা সংসারের এক ফোঁটা সম্পর্ক নেই। মায়ের দেখাশোনা করার জন্য দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার যে মহিলাটি সব সময়ের জন্য রয়েছে, সে যেন যথাস্থানে থাকে, কেননা নাহলে তাসের ঘরের মতই ভেঙে পড়বে সবকিছু। ওরা দুই ভাইবোন মায়ের রুনু আর রুম্নি, দুজনেই দেশছাড়া, আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে যারা বেঁচে আছে তারা সবাই অসুস্থ এবং চলৎশক্তিহীন তাই একসময় জমজমাট বাড়ি এখন শুনশান ফাঁকা। বোন থাকে দুবাইতে, ভগ্নীপতি সেখানে সফটওয়্যার এঞ্জিনিয়র। ওদের একমাত্র ছেলে অটিস্টিক, তার রহস্যময় মানসিক জগতে বাইরের লোক পা রাখতে পারে না। ভাইবোনের মধ্যে উদাসীনতার ক্ষীণ ধারা বইতে শুরু করেছিল কবে, কোন অভাগা মুহূর্তে, সে কথা হয়তো ভুলে গেছে ওরা দুজনেই। সেই ধারা বাড়তে বাড়তে এখন অকূল পাথার। রনের মনে হল এই প্যানডেমিক যেন আধুনিক যুগের স্বাভাবিক পরিণতি। পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া আর মুখোসে মুখ ঢাকার মহান ট্র্যাডিশন সেই কবে থেকেই না শুরু হয়ে গেছে। কামু তাঁর বইয়ের লড়াকু চরিত্র জাঁ টেরুর মুখ দিয়ে মোক্ষম কথাটাই শুনিয়ে দিয়েছেন বটে--But what does it mean, the plague? It's life, that's all.

    পেপারওয়ার্ক শেষ করতে করতে বিকেল হয়ে গেল। সারাটা সময় ধরে এইসব উদ্ভট এলোমেলো ভাবনারাও হানা দিতে থাকল ওর মাথাভর্তি উদ্বেগ আর যন্ত্রণার ফাঁকে ফাঁকে। গাড়ি চালানোর সময় ঘুমের আলতো ছোঁয়া টের পেয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠল ও, প্রাণপণে বাড়িয়ে দিল রেডিওর ভলিউম। দরজা খুলে ফাঁকা বাড়ির ভেতরে পা দিয়ে অকারণেই শিউরে উঠল একবার। ওর মনে হল এবাড়িতে কেউ কোনোদিন ছিল না, সবটাই ওর অসুস্থ মগ্নচেতনার প্রতিফলন। বিরাট লিভিংরুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজের মনেই হেসে উঠল রন চ্যাটার্জি। ওর পকেটের টেলিফোনটাও প্রায় সাথে সাথে বেজে উঠল নির্ভুল বিশ্বস্ততায়।

    “বাবা ঠিক আছো?” ওধারে মাম্পির গলা পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রন।

    “ঠিক আছি রে। তোরা কেমন?”

    “আমরা তো ঠিকই আছি কিন্তু রুডি মেসো তো এখনো ভেন্টিলেটরে। মায়ের সঙ্গে কথা বলবে একটু?”

    “দে। আচ্ছা দাঁড়া আমি ফেস টাইম করছি।” নিঃশ্বাস চেপে বলল রন।

    ফোনের পর্দায় নিপুর মুখটা ফুটে উঠতেই বোঝা গেল যে ওদিকের পরিস্থিতি ভালো নয়। চেহারার দিকে নিপুর নজর আছে; সকাল বেলা মুখ ধোয়ার সাথে সাথেই আলগা একটু প্রসাধন করে নেওয়া ওর অভ্যাস। এইরকম হতশ্রী অবস্থায় ওকে কোনোদিন দেখেনি রন। চুল উস্কোখুস্কো, মুখের ওপর কেউ যেন এক বোতল কালি ঢেলে দিয়েছে, চোখ দুটো ফুলে, লাল হয়ে বেদম অবস্থা।

    “তুমি কবে আসছ?”

    “কালকের আগে পারব না নিপু। আশা করছি--”

    “এখনও আশা করছ! এদিকে রুডি তিন দিন হয়ে গেল ভেন্টিলেটরে।” নিপুর গলা ধরা হলেও সেখানে ক্ষোভের অভাব নেই।

    “আমি গেলেই রুডি ম্যাজিক্যালি সুস্থ হয়ে উঠবে না নিপু। তুমি শুধু একজন রোগীর কথা ভাবছো, কিন্তু আনফরচুনেটলি আমাকে অনেক রোগীর কথা ভাবতে হচ্ছে। তাছাড়া এ রোগটা এমনই যে কাছাকাছি থাকার চেয়ে দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয়। শুধু আমাদের জন্য নয় সারা দেশটার জন্য।”

    কথাগুলো মনেই রয়ে গেল রনর। ওই ব্যথাবিদ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে কথারা ওর গলাতেই আটকে গেল। কয়েক মুহূর্তের অসহ্য নীরবতা ঝুলে থাকল নির্বিকার সাইবারস্পেসে।

    “তোমার চেহারাও তো খুব খারাপ দেখাচ্ছে রন।” নিস্তব্ধতা ভেঙে অন্যরকম একটা ব্যাকুলতা ভেসে এল এবার। রনের গলার ভেতরে অদ্ভুত একটা দলা পাকিয়ে উঠল। আশ্চর্য, ওর কি অভিমান হচ্ছে? এই সময়টা, ও যখন জীবনের সবচেয়ে বড়ো লড়াইটা লড়ছে, তখন ওর পাশে থাকার বদলে নিপু বোনের কাছে চলে গেল বলে কোথাও কি একটা লেগেছে ওর? কে জানে?

    “শোনো, তুমি যে নতুন ওষুধটা নিয়ে কাজ করছ সেটা রুডিকে দিতে পারো না? কি যেন তোমরা বলো? কমপ্যাশনেট ইউজ?”

    কথাটা শুনে থমকে গেল রন, ওর মাথার মধ্যে বিপদসংকেত বেজে উঠল কোথাও একটা। নিপু কি ভাবছে ওর হাতে ম্যাজিক্যাল প্যানাশিয়া গোছের কিছু একটা আছে যেটা দিলেই রুডি ঝড়াকসে ভালো হয়ে উঠবে? ও তো নিজেই জানে না যে ওর ওষুধ আদৌ কাজ করবে কিনা। এরকম অসংখ্য ওষুধ আর ভ্যাকসিন নিয়ে দুনিয়ার প্রতিটি ল্যাবরেটরি লড়ে যাচ্ছে, তার মধ্যে কোথায় কোনটা টিঁকবে, কোনটা বাতিল হবে তার কিছুরই ঠিকঠিকানা নেই।

    “নিপু, রুডিকে যারা দেখছে তারা দেশের সেরা ডাক্তার নার্সদের একটা টিম। তারাও নতুন ওষুধ নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছে, ডিসিশন তারাই নেবে। সেক্ষেত্রে আমার নাক গলানোর প্রশ্নই ওঠে না।” ক্লান্ত গলায় বলল রন।

    “ঠিক আছে। তুমি সাবধানে থেকো।” কেমন যেন নির্লিপ্ত, আশা ছেড়ে দেওয়া গলা ভেসে এলো দূর থেকে। রনের খারাপ লেগে উঠল আবার। সব কিছু কি যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায়?

    “আমি আসছি কাল। চিন্তা কোরো না।”

    “তুমি ঘুমিয়ে নাও একটু এখন। কাল রেড আই ফ্লাইট ধরবে তো? টিকিট কেটেছো?” নিপুর গলায় পরিচিত ব্যস্ততা এবার। রন আসবে এইটুকু জেনেই ও ভরসা পেয়েছে। বেচারা!

    টেলিফোন ছেড়ে দিয়ে নিজের স্টাডিতে গিয়ে বসল রন। এই ঘরটা ওর বড়ো প্রিয়, এখানে দেওয়াল বলে কিছু নেই, মেঝে থেকে সিলিং অবধি জমকালো চেরি কাঠের বুকশেলফ দিয়ে মোড়া। নানান অদ্ভুত জিনিষ জমাবার শখ আছে ওর, তাই টেবিলের ওপর শোভা পায় পুরনো মাইক্রোস্কোপ, কম্পাস আর সেক্সট্যান্ট, তিব্বতী ঘণ্টা, অ্যান্টিক ঘড়ি, টেলিফোন আর আতসকাঁচ। এসবের মধ্যেই যখন দরকার তখন ওর ল্যাপটপটা ঠেলেঠুলে জায়গা করে নেয়। দরজার ওপরে তিনটে সাদা কালো ছবি, সাধারণ ফ্রেমে বাঁধানো--মাঝখানে রবীন্দ্রনাথ, দুপাশে নেতাজী আর বিবেকানন্দ। ছবিগুলো কলকাতায় পাড়ার দোকান থেকে বাঁধানো, ওদের প্রাথমিক ঠিকানা ছিল রনের হোস্টেলের ঘরের দেওয়াল। তারপর একদিন রনের স্যুটকেসে বন্দী হয়ে নানান সময়ে নানান ঘাটের জল খেতে খেতে ওরা আপাতত এই বস্টন শহরে থিতু হয়েছে। বইয়ের সারির দিকে এক ঝলক তাকালেই বোঝা যাবে ডক্টর রণজিৎ চ্যাটার্জি কি প্রজাতির গ্রন্থকীট। বাংলা সাহিত্যের রথী মহারথীদের পাশে পাশে শোভা পাচ্ছে ইংরেজ, ফ্রেঞ্চ আর রাশিয়ান লেখকরা, ল্যাটিন আমেরিকাও পিছিয়ে নেই। রামায়ণ, মহাভারত আর সংস্কৃত সাহিত্যের পাশে আধুনিক কবিতার বই, রাজনীতি, অর্থনীতি আর চারুকলার ওপর গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ সংকলন, সবাই বিনা বিবাদে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে গোটাকতক বই দেখা যাবে কিন্তু সাম্প্রতিক ডাক্তারি শাস্ত্রের ওপরে একটা বইও নেই। ওবিষয়ে যা কিছু সবই ইচ্ছেমতন রনের ল্যাপটপের নখদর্পণে উপস্থিত।

    ক্যাবিনেটের তলায় লুকোনো একটা এলাকায় বোতল আর গ্লাস রাখা আছে। ব্যালভানি নামক ঈষৎ মিষ্টি সিঙ্গল মলটের বোতল থেকে প্রকাণ্ড একটা পেগ ঢেলে নিল রন। যে ভাবেই হোক না কেন, ঘুমিয়ে পড়তে হবে এখন। কাল সকালে অনেক কাজ অনেক দায়িত্ব।

    শরীর ভেঙে ক্লান্তি নেমে আসছে, মাথার মধ্যে অ্যালকোহলের ধোঁয়া, তবু চেয়ারটা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না ওর। সামনে রাখা ল্যাপটপের ওপরে কামুর চটি বইটা পড়ে আছে তার মলাটের ওপর রক্তাক্ত এক ইঁদুরের মৃতদেহ। ডক্টর রিউ বার্নার্ড মহত্ব চায়নি, হিরো হবার বিন্দুমাত্র বাসনাও তার ছিল না। ঘটনাচক্রে ও আবিষ্কার করেছে যে শহরে প্লেগ ছড়ানোর উপক্রম। সেই মুহূর্ত থেকে ও শুধু ডাক্তার হিসাবে নিজের কর্তব্যটুকু যথাযথভাবে করে যেতে চাইছে। ওর স্ত্রী অসুস্থ হয়ে স্যানাটরিয়ামে ভর্তি, ওর উপরওয়ালারা বিরক্ত অথবা উদাসীন, ঈশ্বর অথবা অন্য কোন মহান আদর্শে ওর বিশ্বাস নেই, তবুও শুধু ঠিক কাজটুকু ঠিক সময়ে করার জন্য ও জীবনপাত করছে। ঠিক কাজ করা এত সহজ অথচ এত অসম্ভব কঠিন।

    ঘুমিয়ে নেওয়া সত্যিই দরকার, অ্যালকোহলের ঘুম বিশ্রাম আনে না, বরং সকালের অবসাদ আরো বাড়িয়ে দেয়। নিজেকে জোর করে শাসন করার চেষ্টা করল রন, কিন্তু বোতলের মধ্যেকার তরল বিষ ঠিক যেন এক অদৃশ্য সাপের মতন ওর শরীরের মধ্যে ঢুকতে চাইছে অনর্গল। আরেকটা পেগ ঢেলে নিয়ে এলোমেলো পায়ে ওপরে শোবার ঘরের দিকে এগোল রন। বিছানায় শুয়েও ল্যাপটপটাকে ছাড়তে চাইল না, মেসেজ দেখতে দেখতে, মেসেজের উত্তর দিতে দিতে একসময় পাকে পাকে জড়িয়ে ধরা অবসন্নতার আশ্রয়ে শরীরটাকে ছেড়ে দিল ও। এ ঠিক ঘুম নয়, জাগরণ তো নয়ই, এ এক অন্য ধরনের আচ্ছন্ন অবস্থা, যার প্রতিটি স্তরে অসুস্থ চেতনার অনুরণন। গভীর শংকা আর তিক্ত অভাববোধ থেকে উঠে আসা দৃশ্যাবলী, যাদের স্থান কাল পাত্র আলাদা হলেও কেন্দ্রীয় ধারণাটি একইরকম। কিছু একটা হারিয়ে গেছে, কিছু একটা ঠিকঠাক জায়গায় নেই, অনেক চেষ্টা করেও কিছু একটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তাই ক্রমাগতই ঘনিয়ে আসছে সংকট। সেই সব সংকটময় স্বপ্নের নাগপাশে আটকে গিয়ে নরম বিছানার ওপর ছটফট করতে লাগল ডাক্তার রন চ্যাটার্জি।

    একটা বয়েসের পরে শোবার আগে বেশি মদ্যপান করলে শেষরাতে উঠতে হবেই। তখন মরুভূমির মতন শুকনো গলা আর মাথাভর্তি যন্ত্রণা নিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে হবেই একবার। সকাল চারটে নাগাদ ঠিক ওইভাবেই উঠে বাথরুমে গেল রন, আলো জ্বালিয়ে আয়নায় নিজের ভাঙাচোরা মুখটার দিকে তাকিয়ে দেখল একবার। ঠিক তখনই ম্যাজিকের মতন ওর মনের আয়নায় শেষ স্বপ্নটা ঝলসে উঠল। না সেটা কোনো ডিসটোপিয়া নয়, অশুভ অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে চাবি খোঁজার গল্প নয় সেটা। ও দেখেছে একটা আলোকিত পোডিয়াম, ইউনিভার্সিটির উজ্জ্বল রত্নেরা সেখানে সারি দিয়ে বসে আছেন। নানা জায়গা থেকে এসেছেন আরো বহু বিশিষ্ট লোকজন। আলো অন্ধকারের মধ্যে দীর্ঘাঙ্গী এক তরুণী একের পরে এক স্লাইড দেখিয়ে চলেছে, সেখানে গ্রাফ, চার্ট আর পরিসংখ্যানে জীবনদায়ী এক ওষুধের জয়জয়কার। প্রশংসা আর প্রাপ্তির পরম মুহূর্তগুলোতে ও প্রতিবার মুখ ঘুরিয়ে স্টেজের ওপরে বসে থাকা ডক্টর চ্যাটার্জির দিকে চকিতে একবার করে ফিরে তাকাচ্ছে। মেয়েটির চোখের তারায় বুদ্ধির ঝলক অথচ মুখের ভাবে কোমল সমর্পণ। ও বুঝিয়ে বলছে কেমন করে ডক্টর চ্যাটার্জি ব্যক্তিগত কারণে বাইরে থেকেও প্রতিটি পদক্ষেপে এই রিসার্চ প্রজেক্টের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাজ্জবের কথা এই যে ম্যাক্সকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

    গরম জলে খুব করে স্নান করে নিল রন। কড়া এক কাপ কফি খেয়ে বসে গেল ল্যাপটপ নিয়ে। মিটিং শুরু হবার আগে সব ডকুমেন্ট ই-মেইল করে ঠিক জায়গায় পাঠাতে হবে।

    ঠিক পাঁচটার সময় টুং করে মেসেজ, “গুডমর্নিং প্রফেসর চ্যাটার্জি, আপনি কি সারা রাত না ঘুমিয়ে রয়েছেন? আপনার পাঠানো ই-মেইল দেখলাম এক্ষুনি।”

    মেয়েটা সত্যিই কাজের মনে হচ্ছে। নাহলে এমন কাকভোরে খবর নেয়। এক ঝলক অকারণ ভালো লাগা ওর মনের ওপর দিয়ে বয়ে গেল হঠাৎ।

    “তুমি তো দেখছি আর্লি রাইজার। দেখা হবে তাহলে।”

    “দেখা হবে। আপনি বুঝি বিকেলে রেড আই ফ্লাইট ধরবেন? প্রার্থনা করি আপনার পরিবারের সবাই যেন সুস্থ থাকে।”

    “প্রার্থনা? সাবধান মিরিয়ম, ম্যাক্স শুনলেই রেগে উঠবে কিন্তু। ও ব্যাটা ঘোর নাস্তিক।”

    “ওর রাগের আমি থোড়াই কেয়ার করি। আমি মিডল ইস্টার্ন মিস্টিসিজমের বেজায় ভক্ত, তা সে ইসলামিক হোক কিংবা খ্রিস্টান। আসলে সুফি আইডিয়াগুলো সব তো ভারতীয় বেদান্ত থেকেই এসেছে তাইনা?”

    ইমপ্রেসড হবার কি আর শেষ নেই? মেয়েটা শেষ অবধি বেদান্ত আওড়াচ্ছে! ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বাইরের আকাশে আস্তে আস্তে একটা অদ্ভুত স্বচ্ছ গোলাপি রং ফুটে উঠছে না? আরেকটা দিন, আরেকটু সম্ভাবনা, মনের মধ্যে আবার নতুন করে অনন্তের অনুরণন—

    আজি এ প্রভাতে রবির কর,
    কেমনে পশিল প্রাণের পর?
    কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান?
    না জানি কেমনে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
    “মিরিয়ম, আমরা এখন সহকর্মী, তুমি আমাকে রন বলে ডাকতে পারো।”

    “ঠিক আছে কিন্তু তাহলে আপনাকেও আমায় মিমি বলে ডাকতে হবে।”

    “মিমি কিন্তু বাংলা নাম। ওই নামে একজন বাঙালি অভিনেত্রী আছেন যাঁকে দেখতে অনেকটা তোমার মতন, আর তোমার মতই ভার্সেটাইল। ডাকাবুকো টাইপের মহিলা, খুব ভালো অভিনয় করেন, রাজনীতিও করেন।” নিজের গলার তরল স্বাচ্ছন্দ্য দেখে নিজেই ঘাবড়ে গেল রন।

    “আই অ্যাম সো ফ্ল্যাটার্ড। দেখা হবে তাহলে?”

    “দেখা হবে মিমি। এইট-ও-ক্লক শার্প।”

    ল্যাপটপের ডালা বন্ধ করে এক ঝাঁকুনিতে নিজেকে খাড়া করে তুলল ও। পুব আকাশ থেকে নতুন আলোর বন্যা বইছে। ফালতু বিষাদে ঝিমিয়ে পড়ে থাকার সময় নেই এখন।


    || ৭ ||
    “And he knew, also, what the old man was thinking as his tears flowed, and he, Rieux, thought it too: that a loveless world is a dead world, and always there comes an hour when one is weary of prisons, of one's work, and of devotion to duty, and all one craves for is a loved face, the warmth and wonder of a loving heart.”
    ঘন্টাদুয়েক হয়ে গেল ফুটপাথের দিকে ঠায় তাকিয়ে বসে আছে সাম্য। ওয়াশিংটন হাইটস নিউইয়র্কের কলেজপাড়া, ওর অ্যাপার্টমেন্টে অর্ধেকের বেশি টেনেন্টই ওর মতন গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট। বাকিটা পাঁচমিশালী হলেও তাদের মধ্যে সিংহভাগ রিটায়ার্ড বুড়োবুড়ি। এই দুই দলের মধ্যে খুব একটা প্রীতির সম্পর্ক নেই। বাচ্চারা হইহট্টগোল করে, এখানে সেখানে নোংরা ফেলে রাখে। তাদের মধ্যে অনেকেই আবার বিদেশি, তাদের খাবারদাবার, ভাষা আর আদবকায়দা সবই অন্যরকম। ম্যানেজমেন্টকে মাঝে মাঝেই নানারকম নালিশের মীমাংসা করতে হয়, আর সেইসব মীমাংসায় কোন পক্ষই খুশি হয় না। তবে এর মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম আছে। অসমবয়সীদের মধ্যে মাঝে মাঝে দোস্তিও হয়ে যায় যেমন সাম্যর ঠিক উল্টো দরজার প্রতিবেশী মিস্টার রবার্ট উইলসন ওরফে বব। সাম্য এই অ্যাপার্টমেন্টে পা দেওয়ার সময় থেকেই কোনো অজানা কারণে ভদ্রলোকের ফেভারিট। উনিই মোটামুটি বুড়ো হাড়ে ভেল্কি দেখিয়ে সাম্যকে এখানে থিতু করেছিলেন। এর আগে এইরকম এক্কেবারে একলা কোনোদিন থাকেনি সাম্য। টেলিফোন, ইন্টারনেন্ট, ইলেকট্রিসিটি, রান্নার গ্যাস, আবর্জনা, পার্কিং, হোম সিকিউরিটি ইত্যাদি যাবতীয় খুঁটিনাটি উনিই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ওকে। প্রত্যেকটা দিনই যখন দিশেহারা অবস্থা, তার ওপরে যখন তখন মন খারাপ। সেই সময় মিস্টার উইলসনকে দেখে ওর কলকাতার দাদুর কথা মনে পরত। উনিও ছিলেন ঠিক একই রকম সদাহাস্যমুখ আর খেলাচ্ছলে নানান দরকারি কায়দা শিখিয়ে দিতে ওস্তাদ। হঠাৎ গতকাল যখন অ্যাম্বুলেন্সের লোকজন এসে অজ্ঞান অবস্থায় ওঁকে স্ট্রেচারে শুইয়ে নিয়ে চলে গেল, তখন উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা হয়েও সাম্য কিছুই জানতে পারেনি। কখন যে ভদ্রলোক অসুস্থ হয়েছিলেন কাকপক্ষীতেও টের পায়নি সেকথা। শরীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে কারোকে বিরক্ত করার মতন মানুষই ছিলেন না উনি। কিন্তু এই প্যানডেমিকের সময় প্রতিদিন অন্তত একবার করে বুড়ো মানুষটির খোঁজ নেওয়াটা উচিত ছিল না কি সাম্যর? মা আর দাদু কি সেই শিক্ষাই দেয়নি ওকে? আসলে গত কয়েকদিন নিজেকে নিয়েই এমন ব্যস্ত ছিল যে প্রতিবেশীর খোঁজ নেবার মতন মনের অবস্থা ছিল না ওর। এখন দেখতে পেয়েছে টেলিফোনের ব্যস্ত পর্দার এককোনায় পড়ে থাকা কালকের তারিখে সেই ছোট্ট মেসেজ, তার মধ্যে প্যানিকের কোন চিহ্ন নেই। “হ্যাভিং আ ব্যাড ফিভার। থিংক দিস কুড বি ইট। গেটিং হেল্প। ইউ বি কেয়ারফুল কিডো।”

    অ্যাম্বুলেন্স ডাকার আগে নিজের বাঁচামরার কথা চিন্তা না করে প্রতিবেশী ছেলেটাকে সাবধান করে দিতে চেয়েছেন ভদ্রলোক। আহা, ছেলেটার ছোঁয়াচ না লেগে যায়। দাদু বেঁচে থাকলে এবং এখানে থাকলে ঠিক এই কাজটাই করত।

    ফুটপাথে একদল বিভ্রান্ত পায়রা ভিড় করেছে। ওরা বুঝতে পারছে না যে মানুষগুলো কোথায় গেল, এবং ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা খাবারের টুকরোর সেই চিরকালীন পরম্পরার মাঝখানে এমন অবিশ্বাস্য আকাল নেমে এল কোত্থেকে? বাড়ির আশপাশে সারাক্ষণ যার দেখা মিলত সেই বেওয়ারিশ কালো বেড়ালটাও মাস খানেক হয়ে গেল বেমালুম উধাও। কে জানে মানুষেরা টের পাবার আগেই হয়ত অদৃশ্য শত্রুর গন্ধ পেয়ে গিয়েছিল জন্তুটা।

    এই বছরটাকে কেমনভাবে মনে রাখবে ও? সুখদুঃখের বিচারে কার পাল্লা ভারী? ফাঁকা ফুটপাথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজেকে প্রশ্ন করল সাম্য। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বসন্তের হাওয়া যখন প্যানডেমিকের বিষ বয়ে আনছে ঠিক তখনই তো ওর জীবনে নতুন বসন্তের উল্লাস। কি করে যে এটা সম্ভব হল, এমন এক অসহ্য দুঃসময়ে?

    ওয়াশিংটন হাইটসে ওদের রাস্তাটার নাম ১৫৪ স্ট্রীট। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে ডানদিকে খানিকটা পথ হেঁটে গেলেই ব্রডওয়ের মোড়। যাঁরা নিউইয়র্ক নামক অদ্ভুত শহরে থাকেননি, কিংবা হয়তো ট্যুরিস্ট হিসাবে ঘুরে এসেছেন তাঁদের কাছে ব্রডওয়ে মানেই টাইম স্কোয়ার, আর আলো ঝলমলে থিয়েটার পাড়া। রাস্তাটা কিন্তু আসলে বেহদ্দ লম্বা, তের মাইল ম্যানহাটানে, দুই মাইল ব্রংক্সে তারপর প্রায় আঠেরো মাইল শহরতলীর মধ্যে দিয়ে উত্তরে চলে গেছে। জীবনের বাকি সব কিছুর মতই রাস্তাটার মাত্র একটুখানিই আলো আর আনন্দে ঝলমল, বাকিটা আটপৌরে, অথবা মলিন। ১৫৪ স্ট্রীট আর ব্রডওয়ের মোড়টা যেমন নিতান্তই সাধারণ, মেক্সিকো আর দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা ইমিগ্র্যান্ট লোকজনের আস্তানা। ওইখানে একটা গ্রসারি স্টোরে সাম্যর সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল রামোনার। কাউন্টারের পিছনে বসে একমনে বই পড়ছিল মেয়েটা কিন্তু ওকে দেখার সাথে সাথে বই রেখে উঠে দাঁড়িয়েছিল। ওর কেনা জিনিসপত্রগুলো পটাপট স্ক্যান করে প্ল্যাস্টিকের ঝোলায় ভরে ফেলেছিল নিপুণ হাতে। সেটা ছিল জানুয়ারি মাস, ঝিরঝিরে তুষারপাতের সঙ্গে হানা দিচ্ছিল উত্তুরে হাওয়ার ঝাপটা। ওর অ্যাপার্টমেন্ট মাত্র আধমাইল দূরে হলেও ঝোলাগুলো বইতে বইতে বরফে পিছল রাস্তাটুকু পার হওয়া আদৌ সুখকর অভিজ্ঞতা নয়। বাড়িতে এসব কিছুই করতে হতো না, গ্রসারি নিয়ে মায়ের গাড়ি সোজা ঢুকে যেত গ্যারেজে, কিচেনের দরজা খুললেই ভেসে আসত আরামদায়ক উত্তাপ।

    বইটার দিকে নজর গেল সাম্যর। ইজাবেল আলেন্দের লেখা উপন্যাস--আইল্যান্ড বিনিথ দা সী। হাইতির ত্রীতদাস বিদ্রোহের পটভূমিকায় লেখা বইটা ওরও খুব পছন্দের।

    “আপনি আলেন্দের লেখা ভালোবাসেন?”

    “হ্যাঁ।”

    “আমিও। আমি অবশ্য স্প্যানিশ জানি না।

    “ও, আই সি।” শেষ ঝোলাটা ওর হাতে তুলে দিয়েছিল মেয়েটি, ওর দৃষ্টি তখনও বইয়ের দিকে।

    “খুব ঠান্ডা পড়েছে। এক কাপ কফি পেতে পারি?’ প্রায় মরিয়া হয়ে বলেছিল সাম্য। কাউন্টারের পিছনেই কফি মেশিনটা দেখা যাচ্ছে। মেয়েটি বিনা বাক্যব্যয়ে মাঝারি সাইজের একটি কাপ ভর্তি করে এগিয়ে দিয়েছিল।

    “কত দাম?” ক্রেডিট কার্ডটা এগিয়ে দিয়েছিল সাম্য, এবং ঠিক তক্ষুনি ওর চোখে চোখ রেখে ফিক করে একটুখানি হেসেছিল রামোনা।

    “এটা কমপ্লিমেন্টারি। আপনি পঞ্চাশ ডলারের ওপর জিনিস কিনেছেন, তাই।”

    “ও থ্যাংকস। গভীর আগ্রহে ধূমায়িত কাপটা টেনে নিয়েছিল সাম্য। বাইরে তুষারপাত বেড়ে গেছিল হঠাৎ করেই। প্রায় মিনিট কুড়ি বাদে কফি শেষ করে ফুটপাথে পা রেখেছিল ও। হাতের ব্যাগগুলো তখন আদৌ ভারী লাগেনি, ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যেও শীত করেনি এতটুকু। হালকা পায়ে দোকান ছাড়িয়ে দশ পা গেছে কি যায়নি কোনরকম ভূমিকা ছাড়াই ঘটে গেছিল ঘটনাটা। একমাস বাদে এক শুক্রবারের সন্ধ্যায় কাছাকাছি একটা রেস্তোরাঁর আলো অন্ধকারে বসে বৃথাই সেই মুহূর্তটার বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছিল ওরা দুজনে।

    “আচ্ছা সেদিন তুমি কি করে বুঝলে যে আমি আছাড় খেয়েছি। এই তো দেখছ আমার চেহারা, খুব একটা আওয়াজ হবার কথা তো নয়।” সাম্য বলেছিল।

    “হয়নি তো। আসলে আমিই দরজা দিয়ে উঁকি মেরেছিলাম। মনে হয়েছিল দেখি তো ছেলেটা কোনদিকে যাচ্ছে--” বলতে বলতে মুখে হাত দিয়ে হাসতে শুরু করল রামোনা, ঝলমল করে উঠল ওর হাতের বালা আর কানের দুল। রামোনা মেন্ডেজ নামক তরুণীটিকে দেখতে অনেকটাই ভারতীয় মেয়েদের মতন। ওর রং উজ্জ্বল বাদামি, একটু লম্বাটে মুখ, কালো চুল, কালো পক্ষ্মরেখায় ঢাকা আয়ত চক্ষু, শরীরের তরঙ্গরা উদ্ধত এবং গভীর। ওরা মেক্সিকোর লোক, কিন্তু প্রায় তিন পুরুষ নিউইয়র্কের বাসিন্দা। ওদের পরিবার এই এলাকার বিভিন্ন গ্রসারি স্টোর, গ্যাস স্টেশন আর রেস্টুরেন্টের কর্মী।

    “কি দেখলে? বোকা ছেলেটা ফুটপাথে চিৎপাত?”

    “ঠিক তাই। আমার খুব মজা লাগছিল যে অচেনা ছেলেটা মুদির দোকানে এসে হিস্প্যানিক মেয়েটির কাছে ম্যাজিক রিয়ালিজম নিয়ে বক্তব্য রাখতে উৎসুক। কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়ানো খদ্দেরদের মধ্যে অনেকেই আমার সঙ্গে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করে কিন্তু তুমি — ও মাই গড তুমি!”

    ঝর্নার মতন বয়ে চলা হাসির মাথামুণ্ডু কিছুই না বুঝে মার্টিনির গ্লাসে চুমুক দিয়েছিল সাম্য। পানীয়টি অতিশয় বিস্বাদ, এর থেকে ম্যাঙ্গো লস্যি ঢের ভালো। ভদকাটা লস্যির মধ্যে মিশিয়ে নেওয়া যায় না?

    “আমি কি?”

    “তুমি ছিলে একগুচ্ছ লিলি আর কারনেশন ফুলের মতন ফ্রেশ, ওদেরই মতন লাজুক অথচ সিক্রেটলি সিডাকটিভ। তোমার সব কিছুই ছিল অপরিচিত, আমার বাইরের জগৎ থেকে অনেক দূরে অথচ ভেতরের জগতের খুব কাছাকাছি।”


    “তুমি আমাকে এমনভাবে কমপ্লিমেন্ট দিচ্ছ যেমন ছেলেরা মেয়েদের দেয়। মাই গড, শেষ অবধি ফুলের সঙ্গে তুলনা!” মুখের রেখায় রাগের চিহ্ন ফোটাবার বৃথা চেষ্টা করেছিল সাম্য কিন্তু ওর চোখ তখন অন্য কথা বলতে ব্যস্ত। লো কাট একটা ড্রেস পরে এসেছে রামোনা, ওর চুলগুলো মাথার ওপরে চুড়ো করে বাঁধা। ওর শরীর থেকে অচেনা এক মহাদেশের গন্ধ ভেসে আসছে, সেই গন্ধে মাথা ঝিমঝিম করছে সাম্যর।

    “দিনকাল বদলে গেছে এখন যে যাকে যেমন ইচ্ছে কমপ্লিমেন্ট দিতে পারে, আবার ইচ্ছে হলে গালমন্দও করতে পারে। গেট ইউজড টু ইট।” চিকেন উইং চিবোতে চিবোতে দার্শনিক গলায় বলেছিল রামোনা। বাইরে তখনও থেকে থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের ইলশেগুঁড়ি তুষারপাত। কথা শেষ হতে হতে মাঝরাত্তির পেরিয়ে নতুন দিন এসে গেছে কখন ওরা টেরও পায়নি।

    “আমাদের সমাজটা একদম আলাদা, জানো। লেখাপড়ার চর্চা খুব একটা নেই, রোজকার জীবনের প্রায় পুরোটা জুড়ে খালি টিঁকে থাকার লড়াই। একটা পরিবার কোনোরকমে শিকড় গেড়ে বসেছে, তাদের কাছে আশ্রয় নিতে প্রতিদিন স্রোতের মতন আসছে নতুন নতুন সব পরিবার। সবাই বেআইনি, সবাই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, সবাই কাজের শেষে যে যার নিজের খোলসের মধ্যে ঢুকে পড়তে ব্যস্ত। তোমরা ভারতীয়রা যেমন নিজেদের দেশে উচ্চশিক্ষা নিয়েই এদেশে আসো, আইন মেনে ভিসা বানিয়ে চাকরি নাও, তারপর দেখতে দেখতে শহরতলীর সাদা পাড়ায় বাড়িঘর কিনে ফেল, আমরা তো সেসব কথা ভাবতেও পারি না। আমাদের ইমিগ্রেশনের ইতিহাস বলতে শুধু জমাট বাঁধা কান্না, ঘাম আর রক্ত। সেখানে রয়েছে ড্রাগ কার্টেল, হিউম্যান ট্র্যাফিকিং, ইমিগ্রেশন পুলিশ, স্থানীয় মাফিয়াদের উৎপাত আর হাড়ভাঙা খাটুনি। এর মধ্যেই কেউ ছবি আঁকে, কেউ গান গায়, কেউ মাফিয়াদের দলে ভর্তি হয়, কেউ আবার পলিটিক্সে নামার চেষ্টা করে--”

    “আবার কেউ কেউ আধুনিক স্প্যানিশ ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করে থাকে।” সাম্য গম্ভীরভাবে বলল। মার্টিনিরা এখন মাথার মধ্যে সুড়সুড়ি দিচ্ছে, দুঃসাহসী সব চিন্তাভাবনা কড়া নেড়ে যাচ্ছে যখন তখন।

    “হ্যাঁ ওটা খুব বেশি লোকে করে না। তাই তুমি সেদিন যখন আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করলে যে আমি মার্কেজের উপন্যাস আর নেরুদার কবিতা অরিজিন্যালে পড়েছি কিনা এবং আলেন্দের ওপর মার্কেজের প্রভাব কতখানি, তখন আমার যে কি ভালো লাগল। তারপর তুমি যখন উদারপন্থী চিলেয়ান প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দের সঙ্গে লেখিকার সম্পর্ক, চিলের ডিক্টেটর পিনোশেটের ক্ষমতা দখল, ভেনেজুয়েলায় ওঁর নির্বাসিত জীবনের ইতিহাস, ইত্যাদি নানান তথ্য উগরে যেতে শুরু করলে তখন--” হঠাৎ মুখের ওপর হাত চেপে থেমে গেছিল রামোনা।

    “তখন কি?” দমবন্ধ গলায় বলেছিল সাম্য।

    “তখন মনে হয়েছিল ছেলেটা এমনভাবে আমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছে, খপ করে একটা চুমু খেয়ে ওর কথার স্রোত থামিয়ে দিলে কেমন হয়?” মুখ থেকে হাত নামিয়ে হেসে উঠেছিল ও আর ঠিক সেই মুহূর্তেই যেন এক তড়িৎচুম্বকীয় বিক্রিয়ার মতন টেবিলের দুধার থেকে ওদের দুই জোড়া ঠোঁট মিলে গেছিল।

    ক্রিং-টিটিলিং-টং!

    চমকে খাড়া হয়ে বসল সাম্য। বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন ওর দুচোখ জুড়ে ঘুম নেমে এসেছিল, অ্যাকোরিয়ামের মধ্যে রঙিন মাছদের মতন স্বপ্নেরা ঘোরাফেরা করছিলো অনায়াস স্বচ্ছতায়। টেলিফোনের উদ্ভট রিংটোন ওকে এক ঝটকায় বাস্তবে এনে ফেলল। অদৃশ্য ফোনের খোঁজে চেয়ার থেকে কার্পেট অবধি বোকার মতন হাতড়ে বেড়ালো খানিকক্ষণ, তারপর বালিশের তলা থেকে কোনোরকমে উদ্ধার হল যন্ত্রটা। তার মধ্যে একবার থেমে গিয়ে রিং হতে শুরু করেছে আবার।

    “দাদা! কি হল ফোন ধরছিস না কেন? নির্ঘাত ঘুমোচ্ছিলি নয়তো ফোনটা হারিয়ে ফেলেছিস।” উল্টোদিক থেকে চেনা গলার বকুনি এবং অব্যর্থ ডায়াগনোসিস। সাম্য হেসে ফেলল, ওর মনের ওপর দিয়ে এক ঝলক টাটকা হাওয়া বয়ে গেল যেন। শ্রুতি সবার থেকে ছোট হয়েও এই দুর্যোগে সবার দেখাশোনার ভার নিয়েছে।

    “দুটোই। এখন বল ওদিকের কি পরিস্থিতি? মা কেমন আছে? রুডিমেসো?”

    “সবাই যেমন তেমন। তুই কেমন আছিস আগে বল? যা সব ইমেইল লিখছিস, মনে হচ্ছে তোর অবস্থাই সব থেকে খারাপ।” শ্রুতির উদ্বিগ্ন গলা ভেসে এল ওধার থেকে।

    “ও, কাল রাত্তিরের কথা বলছিস? সত্যিই খুব জোর ধাক্কা খেয়েছিলাম রে মাম্পি। উল্টোদিকের ফ্ল্যাট থেকে ভদ্রলোককে অজ্ঞান অবস্থায় বার করে নিয়ে গেল, আমি কিছুই করতে পারলাম না। আমি আসলে খুব খারাপ নেবার, তাই না?”

    “কাল রাত্রে কিসের নেশা করেছিলি? মদ না গাঁজা?” গম্ভীর গলায় প্রশ্নটা শুনে খুবই হকচকিয়ে গেল সাম্য।

    “কেন নেশা করতে যাব কোন দুঃখে? খামোকা এসব আলতু ফালতু প্রশ্নের মানেটা কি?”

    “সন্ধ্যে থেকে নেশা করে মাঝরাতে ইমেইল ছাড়ার একটা প্রবলেম আছে। কার মেইল কার কাছে চালান হয়ে যায় তার ঠিক নেই। তুই তোর প্রেমিকাকে লেখা চিঠি আমায় পাঠিয়েছিস, ওর কাছে কি গেছে কে জানে?” শ্রুতির গলা শুনে মনে হয় ও হাসি চাপছে, কিন্তু এদিকে সাম্যর মাথায় বজ্রাঘাত।

    “মাম্পি, ভালো হচ্ছে না কিন্তু।”

    “একদম ভালো হচ্ছে। তুই খুব রোম্যান্টিক দাদা, তোর ফীলিংসগুলোও খুবই জেনুইন, শুধু ওই এরোটিক ইমেজারিগুলো এট্টু যাকে বলে ইমম্যাচিওর। তা হোকগে। একদিকে প্রতিবেশী ভদ্রলোকের জন্য তোর চিন্তা, পরিবারের জন্য তোর অ্যাংজাইটি, অন্যদিকে প্রেমিকার সাথে দেখা করতে না পারার দুঃখ, দুটোই খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। সত্যি কথা বলতে কি এই নিয়ে পাঁচ বার পড়েছি।

    “মাই গড মাম্পি! আমি রাখছি, পরে ফোন করব।”

    “দাদা! দাদা শোন, আই অ্যাম সো প্রাউড অফ ইউ। তোর গার্লফ্রেন্ডের ফোন নম্বরটা দে প্লীজ।”

    চুলোয় যাক প্রাউড অফ ইউ। কেলেঙ্কারিটা কতদূর গেছে তার কিনারা না করতে পারলে এক্ষুনি হার্ট অ্যাটাক হবে ওর। টেলিফোন ফেলে দিয়ে এক ঝটকায় ল্যাপটপটা খুলে ফেললো সাম্য। ইনবক্সে যেতেই এক লহমায় সব প্রহেলিকা পরিষ্কার। রাত দুটো নাগাদ রামোনা লিখেছে—

    “সমু ডার্লিং,

    ভুল করে তোমার বোনকে লেখা চিঠিটা আমার কাছে পাঠিয়েছ। অন্যের চিঠি পড়া উচিত নয় জানি, তাও পড়েছি। একবার নয়, সারারাত্রি ধরে অনেকবার। তোমার কষ্ট, তোমার সংশয় আর রাগ, সবকিছু এমন করে ফুটে উঠেছে যে মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই ওদের ছোঁয়া যায়। তোমাকে যত বেশি করে চিনতে পেরেছি, ততই মন ভরে উঠেছে। দেরি কোরো না, এক্ষুনি তোমার বোনের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দাও। অবশ্য ভয়ও করছে তোমার পরিবারে এই চালচুলোহীন মেক্সিকান মেয়েটির জায়গা হবে তো?

    আশা করি আমাকে লেখা চিঠি তোমার বোনের কাছে পাঠাওনি। তুমি যা সব বর্ণনা দাও সেগুলো অন্য কেউ পড়লে লজ্জায় মরে যাব আমি। অবশ্য ভালোবাসায় আর লজ্জা কি, ভালোবাসার অভাবই বরং সবথেকে বড়ো লজ্জার বিষয়।

    আশা করি বইটা পড়ে শেষ করেছো--লাভ ইন দি টাইম অফ কলেরা। বইটাতে মার্কেজ দেখিয়েছেন কিভাবে কলেরা একটা চরিত্র হয়ে উঠতে পারে, বাকি চরিত্রদের মধ্যে সেও আসাযাওয়া করে কিন্তু তাই বলে তাদের জীবনগুলো থেমে থাকে না। আর মার্কেজের কাছে জীবন মানেই তো ভালোবাসা পাবার আর হারানোর ইতিহাস। আধুনিক পৃথিবীর প্রথম প্যানডেমিকের ছায়ায় যারা প্রেমে পড়েছিল, তাদের ভাগ্যে কি লেখা আছে, ইতিহাস সে কথা বলবে। আমি শুধু এইটুকুই জানি যে তোমার মতন আমারও চারপাশে একের পর এক সংকট হানা দিয়ে চলেছে এখন। শুধু অসুস্থতা আর মৃত্যুই নয়, ইকোনোমিক ডিজাস্টার থাবা বসাচ্ছে সব জায়গায়। তুমি কি জানো ভাড়ার টাকা না দিতে পেরে কত পরিবার উৎখাত হতে বসেছে। কতজন চাকরি হারিয়ে, সর্বস্ব খুইয়ে জেলখানার দরজায় পৌঁছে গেছে। যে রেস্টুরেন্টে বসে তুমি আমায় প্রথমবার চুমু খেয়েছিলে, সেইরকম কয়েকশো রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে এই শহরে, জানো? সেইসব জায়গায় যারা দিন আনত, দিন খেত, তারা সবাই এখন স্টার্ভিং অ্যান্ড কনফিউজড। তাদের সবার জন্য এক ফোঁটা করে চোখের জল ফেলতে হলেও সারাদিন ধরে কাঁদতে হবে। তাই আমি ঠিক করেছি কাঁদব না একেবারেই। আমাদের বাঁচতে হবে, বাঁচাতে হবে। প্যানডেমিকের সুযোগ নিয়ে চারদিক থেকে রেসিস্ট আর হেট মংগাররা মাথা তুলছে। তাদের সঙ্গে লড়তে হবে, এই মর্বিডিটির মধ্যেই নবজীবনের গান গাইতে হবে আমাদের। ডিপ্রেসড হয়ে শুয়ে থাকার সময় নয় এখন।

    সমু আমার প্রিয়তম, আমাকে নিয়ে একটুও চিন্তা কোরো না তুমি। ঝড় বয়ে গেলে ভাঙা দরজার পাশে আমি তোমার অপেক্ষায় বসে থাকব। তুমি এই কদিন সাবধানে থেকো, তোমার পরিবারের সবাই ভালো থাকুক, যারা এখন অসুস্থ তারা সুস্থ হয়ে উঠুক। দূষণমুক্ত নতুন এক পৃথিবী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা একদিন না একদিন সেখানে পৌঁছে যাবই, দেখে নিও।

    ইতি,

    একান্তই তোমার রামি।”

    চিঠির সঙ্গে পাঠানো আদরে উজ্জ্বল ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো সাম্য। এ যেন কমেডি অফ এররস। বিষণ্ণতা কেটে গিয়ে মনের ভেতরটা পুরনো দিনের মতন হেসে উঠল আবার। ওর চোখে পড়ল না রাস্তার ওপর পুরনো আসবাবপত্র টেনে এনে ফেলছে কারা যেন। আজ হঠাৎ করেই ঠান্ডা পড়েছে, খোলা আকাশের নিচে ডাঁই করে রাখা পুরনো বইগুলোর পাতারা ডানা মেলে উড়ছে হিমশীতল হাওয়ায়। ও দেখতে পেল না পাশের ফ্ল্যাটের মেয়েটি আর তার বয়ফ্রেন্ড কখন চোরের মতন মুখ লুকিয়ে আলাদা আলাদা ট্যাক্সিতে উঠছে। চাকরি খুইয়ে, বাড়িভাড়ার টাকা দিতে না পেরে ওরা ফিরে যাচ্ছে যে যার বাবা মায়ের কাছে, শহর থেকে অনেক দূরে। ওদের স্বপ্ন আর সম্ভাবনার মৃতদেহ পড়ে আছে বরফ গলা ফুটপাথের ওপর। এর মধ্যেই বসন্ত আসবে, এই রকম আরো অনেকে মৃতদেহ জমা হতে থাকবে আগামী কয়েক মাস প্রতিদিন।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ (শেষ)
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments