[এই গল্পের পটভূমিকা আশির দশকের উত্তরভারত, যখন হাতে হাতে স্মার্টফোন দূরের কথা, ল্যান্ডলাইন ফোন বা এমনকি স্মার্ট মানুষও ছিল বিরল । কলেজের ছেলেমেয়েরা খবরের কাগজ এবং বই পড়ে যা বোঝার বুঝত। গল্পটি লিপিবদ্ধ হয় নব্বইয়ের দশকে; রিলিজ হবার পর সুপারফ্লপ। যুবক যুবতীদের পৃথিবী এখন এতটাই সরে এসেছে সে যুগ থেকে যে এরকম সেকেলে প্রেমের গল্প আজ বিনোদন হিসেবে অবান্তর। এই সম্পাদিত পুনর্মুক্তিকে লিঙ্গবৈষম্যের ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে দেখাই ভালো। ]
রাহুলের ডায়েরি থেকে:
“... আজ মেঘলা সকালে অর্জুন গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে হি হি করে ঠান্ডা বাতাস আসছিল ঘরে। জানলার গরাদে মাথা ঠেকিয়ে সেই হিম খাচ্ছিলাম। পরে গরম কোর্তাটা গায়ে চাপিয়ে ড্রেন-পাইপ বেয়ে নেমে গেলাম রাস্তায়। কুকুরের তাড়া না খেয়ে সোজা ইউনিভার্সিটির মাঠে। ঘেসুড়েদের সাথে গল্প করলাম কিছুক্ষণ। তারপর কিংসওয়ে ক্যাম্পের বাজার থেকে আট আনার ছোলাভাজা কিনে হাঁটতে হাঁটতে রবীন্দ্রকলোনি। পলাশদের বাড়ি।
ছাতের ওপর পলাশ স্নান করে ঘুরছিল। ভিজে চুল পিঠের উপর বিপজ্জনকভাবে ফেলা। কুটকুট করে ছোলাভাজা খেয়ে মনটাকে শান্ত করে নিলাম। আটটা বাজলে, মেঘের তসর ফাঁক করে যখন একটু ফ্যাকাশে আলো দেখা গেল তখন...”
ছাত থেকেই শ্যামলী লক্ষ করল রাহুলকে। পাঁচিলের ধারে দাঁড়িয়ে কিছু খাচ্ছে। ছুটির দিনে এখানে এতদূর কেন? আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে চটপট ছাদ থেকে নেমে এল শ্যামলী।
—হঠাৎ এখানে ঘুরঘুর করছিস কেন রাহুল?
শ্যামলীকে দেখে একটু থতমত খেয়ে যায় রাহুল। —বাড়ি থেকে পালিয়েছি। ড্রেন পাইপ বেয়ে নামলাম। বলে সে।
—তো ড্রেনেই নেমে গেলি না কেন? রাহুলের ভুলভাল কথায় একটুও না চমকিয়ে বলে শ্যামলী। —এখানে কে ডেকেছিল?
—প্রেতাত্মা। বলে রাহুল। —গেছো ভুত। একটা অনুসন্ধানে এসেছি বলতে পারিস। তোদের পাড়ার কিছু লোককে জেরা করতে হবে। তোকে দিয়েই শুরু করা যায়।
—একদম আবোল তাবোল কথা বলবি না। এটা ভদ্রলোকের পাড়া। এখানে কারো সঙ্গে আমি তোকে কথা বলতে দেব না।
আহত হয় রাহুল। ধাক্কা খায়। সে এতটা খারাপ, নীচ, জোচ্চোর বা খচ্চর যে তার হাত থেকে পুরো পাড়াটাকেই বাঁচানো দরকার? পাড়াতে এমন কেউ নেই যে রাহুলের সঙ্গে দুটো কথা বলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না! এটা শ্যামলী বলতে পারল, যার সাথে তার পাকা কথাবার্তা হয়ে গেছে!
শ্যামলীর চোয়ালের কাঠিন্য এবং চিবুকের আত্মবিশ্বাস দেখে অবশ্য আর নালিশগুলো জিভে আনা সম্ভব হল না। কথাবার্তাও যা হয়ে আছে সে সব কাঁচাই মনে হচ্ছে এখন।
—চলে যেতে বলছিস? ঠিক আছে। ছোলাটা খেয়ে নিয়ে চলে যাবে, ভাবে রাহুল। —তুই খাবি একটু? না সকালে কিছু খাস না?
—না থ্যাংক্স। তোকেও অসভ্যের মত রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। ভিতরে আয়।
রাহুল দাঁড়িয়ে ছোলা চিবোতেই থাকে। যেতে উদ্যত শ্যামলী থমকে যায়।
— কী হল?
রাহুল ভাবছিল পলাশ কি বুঝতে পারছে না? মেঘলা আকাশ, পাগল করা হাওয়া, অর্জুন গাছের শরশরানি, উড়ন্ত আঁচল, দূরে বড়ো রাস্তার ভিজে অ্যাস্ফল্টের উপর ডিটিসি বাসের গড় গড় আওয়াজ... সবাই বলছে শুধু একটাই কথা। পালা, পালা, পালা, পালা ... ।
মুখ ঘুরিয়ে রাহুল বলতে চায় — আয় পলাশ, চল পালাই! বাড়ির লোকেদের জন্য একটা চিরকুট ছেড়ে যাবি: মা, আমাকে রাক্ষসে ধরিয়াছে। খুঁজিবার বৃথা চেষ্টা করিও না। তাহলে রাক্ষস তোমার মেয়েকে খাইবে।
শ্যামলী হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। গোল গোল চোখে চেয়ে আছে রাহুল। কিছুই বলছে না। ছেলেটা দিন কে দিন বোকা আর ভাবালু হয়ে যাচ্ছে। বেশি সিনেমা দেখার ফল না ড্রাগস নিচ্ছে কে জানে।
—চল ভিতরে চল। চা খাওয়াব।
—তোর বাবা বাড়িতে? না বেরিয়েছেন?
কয়েক মাস আগে, দু-দশ জন বন্ধু মিলে ওরা পিকনিকে গিয়েছিল। মেয়েদের বিয়ের জন্য সম্বন্ধ আসছে কিনা প্রশ্ন তুলল কোনো গবেট। তারপর অবশ্য মেয়েরাই লুফে নিল প্রশ্নটা, যেন এর অপেক্ষাতেই ছিল।
—হ্যাঁ। ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছিল শ্যামলী। —অনেক সম্বন্ধ আসছে আমার। ডাক্তার, সি এ, ইঞ্জিনিয়ার, পলিটিশিয়ান। একজন তো আবার লেখক। সত্যিকারের প্রতিভাবান নাট্যকার একজন। ভালো ভালো সব সম্বন্ধ!
ভালো ভালো সম্বন্ধ?! ভেবেছিল রাহুল। ভালো ভালো মানে?
—সবাইকেই পছন্দ হচ্ছে? জিজ্ঞেস করেছিল সে।
—নিশ্চয়ই। তোর মতো বিশ্ববখাটে তো নয় কেউ। রাহুলকে পর্যবেক্ষণ করে বলেছিল শ্যামলী। সকলেই নিজের নিজের ফিল্ড-এ সেরা। হাই অ্যাচিভারস। দেখতেও ভালো। ছ' ফুট লম্বা!
—সক্কলে ছ ফুট? রাহুল প্রচণ্ড অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল।
—দু-একজন বাদে। তাড়াতাড়ি বলেছিল শ্যামলী। —আমার কাছে ছবি আছে। দেখবি নাকি? বাড়িতে আসিস, দেখাব। তুই যাকে পছন্দ করবি তাকেই নাহয় ... ।
রাহুল পরে ডায়েরিতে লিখেছিল: “...এটা অপমান নয়? লুম্পেন ডাক্তার, জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার, যাত্রার দারোয়ানের ফটো দেখব বসে বসে আমি? যদিও মনের মধ্যে একটা কাঁটা বিঁধিয়ে দিয়েছে ইচ্ছে করে। লেখকটাও কি ছ'ফুট? তাহলে ডুবে মরাই উচিত আমার...”
— মুখ দেখেই কি মানুষ চেনা যায় পলাশ! রাহুল বোঝাবার চেষ্টা করেছিল।
— সে তো একশোবার! পুরুষমানুষের চেহারাটাই সব নয়। গুণ আছে কিনা সেটাও একটু আধটু জানতে হবে। বলেছিল শ্যামলী। —এরা সবাই গুণী। মহা ট্যালেন্টেড। ফাইভ ফিগার স্যালারি। দেশে বিদেশে কত নাম। খবরের কাগজে তো হামেশাই ছবি বেরোয়। পলিটিশিয়ানটা কি বলেছে জানিস? বলেছে — পলাশ, সব ফাংশন-এ, উদ্বোধনে, ছবি ওঠে আমার। কিন্তু কেমন একা একা লাগে সেই সব ছবি। তোমার মতো একজন সুন্দরী মেয়ে পাশে থাকলে আরো ভালো দেখাত। সেই জন্যেই বিয়ে করতে চাই। নইলে স্বদেশ প্রেমীদের জীবনে বিয়ের স্থান কোথায়?
—কী ফ্যান্টাসটিক? কী আত্মত্যাগ, তাই না? ঝলসে উঠেছিল শ্যামলী। মধুমিতা ঠোঁট বেঁকিয়েছিল। রাহুল চুপ করেই ছিল।
পরে একটু একান্তে পেয়ে সে শ্যামলীকে জিজ্ঞেস করেছিল—তোকে ওই ব্যাটা পলিটিশিয়ান পলাশ বলে ডাকে?
—হ্যাঁ। বলছিল —আমি পলিটিশিয়ান থেকে পলাশ সিয়ান না হয়ে যাই! মধুর হেসে জানায় শ্যামলী। কী সুইট তাই না?
—রিডিকিউলাস! বলতে বাধ্য হয়েছিল রাহুল।
তারপরের কথোপকথন খারাপ লাইনে চলে যায়।
—তুই, তুই একটা মীন মাইন্ডেড...
—স্কাউন্ড্রেল। তাই তো?
—ছোটোলোকদের মতো মুখ খারাপ করিস না।
—তুই নিজে কী? মিথ্যে অহংকারে অন্ধ এক মেয়েমানুষ। এ উওম্যান ব্লাইন্ডেড বাই ভ্যানিটি।
শেষ কথাটা বোধহয় বলা উচিত হয়নি। রাহুল আটকাতে পারেনি। শুনে শ্যামলী খানিক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর মোচড় মেরে যেতে উদ্যত হলে রাহুল খপ করে হিন্দী সিনেমার লোফারের মত তার বাঁ হাতের কব্জি চেপে ধরে।
—ছেড়ে দে হাত! ছাড় বলছি!
—পলাশ শোন!
—কোনো কথা শুনতে চাই না। তুই একটা ছোটোলোক।
—তুই বিয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছিস। তোকে এই ভয়ঙ্কর পরিণতি থেকে বাঁচাতে চাইছি আমি। তাছাড়া, আমার মনে হয় যে কিছুদিন অপেক্ষা করলে হয়তো আমরা দুজনেই বুঝতে পারব যে তুই আর আমি বেশ কম্প্যাটিবল।
—শাট্ আপ। তুই নিজেই পাগল। লেট গো।
তারপর রাহুল শ্যামলীর হাত ছেড়ে দেয়। শ্যামলী দাঁতে দাঁত চেপে বেণী দোলাতে দোলাতে চলে যায়। একটু পরে এমন ভাব দেখায়, যেন কিছুই হয়নি।
দূরে রেডিও কলোনির উঁচু ট্রান্সমিটারের উপর দিয়ে এক ঝাঁক পাখি উড়ে চলেছে। চতুর্দিকে ভোরবেলার প্রশান্তি। এত হাওয়া, রাহুলের মাথার চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
—পলাশ!
—বল।
—তোর আর আমার সম্পর্কটা কি অস্বাভাবিক?
—তোর সব কিছুই অস্বাভাবিক। আমার সব কিছুই স্বাভাবিক।
—পিকনিকের দিন যা হল তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দু:খিত।
—আগেও বলেছিস। আমি ভুলেও গেছি সেসব।
—কিন্তু আমি পলিটিশিয়ানটাকে ভুলতে পারিনি। তার কাছে গিয়ে পার্সোনালি ক্ষমা চাইতে চাই।
—আর জ্বালাস না মাইরি। চা খাবি তো খা। নইলে এ পাড়া থেকে যা। আমাদের বাড়ির সামনে জোকারের মতো দাঁড়িয়ে থাকিস না। লোকেরা তো মেয়েদেরই দুর্নাম করে!
—সেটা ঠিক। গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ে রাহুল। আমারও কানে কিছু কিছু কথা এসেছে। খারাপ লাগে শুনতে।
রাহুল লক্ষ করেনি শ্যামলীর প্রতিক্রিয়া। আপন মনেই বলে সে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু শ্যামলী যেতে যেতেও থমকে গেছে। শক লাগার মতো।
—তার মানে? কে কী বলেছে আমার নামে? হোয়াট ডু ইউ মীন?
রাহুলের ডায়েরি:
“...পলাশের সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা, সে সহজে মিথ্যে বলতে পারে না। যারা মিথ্যে কথা বলে না, তারা মনে করে অন্যরাও মিথ্যে বলে না। এই ভেবে ঠকে যায়। তাই মিথ্যে কথা মাঝেসাঝে বলা ভালো।
পলাশদের বাড়িতে উঠতি বয়েসের ছেলেদের ঘনঘন যাতায়াত। নিজেকে ধরছি না। অদ্ভুত সব ছুতো করে ছেলেরা ঢুকে পড়ে ওদের বাড়িতে। পলাশ এবং তার মা দুজনেই এসব ছেলেদের হাতে বাচ্চা। একবার তরুণের বড়দা একবছর গায়েব থেকে ফিরল। জেলে ছিল বলেই শুনেছি। ওদের বাড়িতে গিয়ে সেও লুচি তরকারি খেয়ে এল। বলল অস্ট্রেলিয়া ঘুরে এসেছে।
পলাশদের বাড়িতে ছেলেরা যায় বলে পাড়ার লোকেরা একটু-আধটু নিন্দে করে। এসব আমরা সবাই শুনেছি। পলাশের বাবার উচিত এই খচ্চরের দলটিকে কান ধরে বের করে দেওয়া। কিন্তু বুঝলে তো ...”
—তোদের পাড়ার লোকেরাই বলছে, অথচ তুই তার একটুও আঁচ পাসনি?
—বাজে কথা না বলে, আসল কথাটা বল।
—চল তোর ঘরে যাই। মাথা ঠান্ডা করে শুনবি।
—না তোকে এখনই বলতে হবে। কে বলেছে? ওই গাঙ্গুলীদের বাড়ির কেউ?
—আমি কারো নাম নিতে পারবো না।
—নিশ্চয়ই ওরাই বলেছে। আমি ওদের হাড়ে হাড়ে চিনি। পরশ্রীকাতর, কৃপণ এবং ছোটোলোক।
—দ্যাট্স রাইট। এই যে আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে খোশগল্প করছি এটা ওরা কিন্তু অবসার্ভ করছে। গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছি। ওরা নোট করে নিচ্ছে। ছবি তুলেই যে রাখছে না কে জানে!
—হাঁ করে বোকার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে সোজা বাড়িতে এলেই তো পারতি! শুধু শুধু সিন ক্রিয়েট করার কী দরকার ছিল?
গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে রাহুল লক্ষ করে যে শ্যামলী আনমনা হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে পাড়ার লোকেরা চর্চা করছে শুনে কোন মেয়ের মন ভালো থাকে? শ্যামলীকে হঠাৎ মনে হল বেশ দুর্বল।
ঘরে ঢুকে একটু স্বাভাবিক হয়ে যায় শ্যামলী। শ্যামলীর মা রাহুলকে এই সাত সকালে দেখে অবাক হয়ে গেলেন।
—হঠাৎ? কী ব্যাপার?
রাহুলকে জবাব দিতে হয় না। সে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকে। যা মিথ্যে বলার এক্ষেত্রে শ্যামলীই বলে।
—কয়েকটা বই নিয়েছিলাম মা। ফেরৎ নিতে এসেছে।
দুজনে গিয়ে ঢোকে শ্যামলীর ঘরে। একদিকের দেয়ালে আমির খানের একটি পোস্টার। উল্টো দিকের দেয়ালে বিবেকানন্দ। দুজন মনীষী পরস্পরের দিকে চোখ পাকিয়ে আছে। মাঝখানে একশো বছরের ব্যবধান না থাকলে কী হত বলা মুশকিল। শ্যামলী এই রণভূমিতে স্বচ্ছন্দে বিহার করে। জামাকাপড় পাল্টাবার সময় সে নিশ্চয়ই বিবেকানন্দের মুখোমুখি হয় না। ভাবল রাহুল।
—চা হবে?
—হোক। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে রাহুল।
শ্যামলী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে পায়ের উপর পা তুলে দেয়। হাঁ করে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। কিছু একটা ভাবছে। জানলার বাইরে গাঙ্গুলীদের ছা্ত। একটা বেলগাছ। ছাতে কিছু কাপড় শুকোচ্ছে।
রাহুলের ডায়েরি থেকে:
“ঝুলন্ত সায়ার পিছন থেকে একজোড়া বিষণ্ণ চোখ আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। পুরুষ না মেয়ে বোঝা গেল না। আমি জানলার কাছে গিয়ে হাত নাড়ালাম। ফিস ফিস করে ডাকলাম। ওমনি চট করে সরে গেল চোখ দুটো।
ওদের সুবিধের জন্য আমি জানলার পর্দাটা ভালো করে সরিয়ে দিলাম...”
—চা।
ঠক করে টেবিলের উপর কাপ রাখার আওয়াজে চটকা ভঙ্গ হয় রাহুলের। হাত বাড়িয়ে নি:শব্দে চায়ের কাপটা টেনে নেয় সে। প্লে্টে কিছু নিমকি আর একটা বড়ো সড়ো মাছের ডিমের বড়াও জুটেছে। শ্যামলী শাড়ির আঁচলটা ভালো করে কোমরে জড়িয়ে খাটের উপর পা ঝুলিয়ে বসেছে। তার হাতে কোনো কাপ নেই।
—চা কম পড়েছে? ব্যস্ত হয়ে বলে রাহুল।
—আমি এখন খাই না। বেশি চা খেলে রঙ-ও কালো হয়ে যায়।
—তাই নাকি? তাহলে সাহেবরা এতো ফর্সা হল কী করে? ওরাই তো এদেশে চা আনে।
—ফালতু বকিস না রাহুল। কাজের কথাটা বল।
—কাজ?
—গাঙ্গুলীরা কী বলেছে বল। কিচ্ছু লুকোবি না।
—ও। সেই কথা।
রাহুল আরাম করে চায়ে চুমুক দেয়। গাঙ্গুলীদের ছাতে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। রেডিওতে সকাল বেলার গানের আসর হচ্ছে কোথাও... ইনহি লোগো নে লে লিনা দুপাট্টা মেরা...
—খুবই সাঙ্ঘাতিক কথা। রাহুল দু চারটে চুমুক দিয়ে বলে শেষ পর্যন্ত। —মাইন্ড ইউ। কে বলেছে, কাকে বলেছে সেসব কিচ্ছু বলছি না। জনৈকা মহিলা একাধিক মহিলাদের কথাটা বলেছেন।
—কথাটা কী?
—তোদের বাড়িতে নাকি ভূত আছে! নির্লিপ্ত ভাবে ডিমের বড়ায় কামড় দেয় রাহুল।
রাহুলের ডায়েরি থেকে:
“ ...অসাধারণ রান্নার হাত পলাশের মায়ের। পলাশের বাবার একটু খাওয়াদাওয়ার বাতিক আছে। সাত সকালে ডিমের বড়া! তাও একটি প্রায়-লোফার অপদার্থ ছেলের জন্য। এই বাড়িতে জামাই ষষ্ঠীতে কীরকম খাওয়ানো হবে ভাবো... "
—অ্যাঁ। কী বললি? শ্যামলী একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছে। এরকম একটা কথা রাহুলের কাছেও সে আশা করেনি। —ঠাট্টা করিস না রাহুল। মাইরি বলছি লপ্পর খেয়ে যাবি।
—বিদ্যা। রাহুল তৎক্ষণাৎ দিব্যি গালে। গলার চামড়া দু ইঞ্চি টেনে ধরে মা কালীর নামে শপথ করে সে। —আরে আমিও শুনে এইরকমই তাজ্জব হয়ে গেছি! একেবারেই অবিশ্বাস্য! তুই একবার বলে দে নেই। তারপর দ্যাখ আমি ওদের কী করি। রাহুল ভাব দেখায় যেন সত্যিই উত্তেজিত হয়ে গেছে। চা টা টেবিলের উপর সরিয়ে রাখে সে।
শ্যামলী বুঝতে পারছে না কী বলবে। —ভূত? আমাদের বাড়িতে ভূত? তুই ঠিক শুনেছিস তো?
—আলবাৎ? তোদের বাড়িতে রাত্রে কেউ প্রদীপ হাতে ঘুর ঘুর করে?
—কই না তো?
—হয়তো তোর মা কিছু খোঁজেন। প্রদীপ কি মানুষে জ্বালায় না? রাহুল সাহায্য করতে চায়।
—মা আবার কী খুঁজবে? বোকার মতো কথা বলিস না রাহুল। বললাম তো কেউ ঘোরে না। বিরক্ত হয়ে বলে শ্যামলী।
—ওকে, ওকে। বাগানে মাঝে মাঝে বাদুড় ঝুলে থাকে কি?
—মোটেই না।
—সিঁড়ির ঘরে দুপুরবেলা গা ছম ছম করে?
—ভ্যাট। বানিয়ে বানিয়ে বলছিস এসব?
—বিদ্যা। রাহুল এবার কন্ঠনালী পাকড়ে ধরে টানে।
—ওসব কিছু হয় না আমাদের বাড়িতে। কে বলছে এসব?
—তাহলে গতমাসে গাঙ্গুলীদের মেয়েটা ছাতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গোঁ গোঁ করছিল কেন?
শুনেই শ্যামলী ভীষণ ক্ষেপে গেল। ফেটে পড়ল একেবারে।
—এই কথা বলছে ওরা? এই কথা? ওই মেয়েটার ফিট-এর রোগ আর দোষ হবে আমাদের বাড়ির? কেন, ভূত থাকলে তো ওদের বাড়িতেই থাকার কথা। ওই মেয়ের ঘাড়ে চাপে রোজ।
রাহুল হাত তুলে শান্ত করতে চায় শ্যামলীকে। —মাথা ঠান্ডা কর পলাশ। রাগার কী আছে? বাড়িতে ভূত থাকাটা তো আর দোষের না। তবে, ঠান্ডা মাথায় ভেবে বল, তোদের বাগানের ওই বেল গাছটা কেটে ফেললে কেমন হয়?
শ্যামলীর মুখের হাঁ আরো বেড়ে যায়। —কেন? বেল গাছটা কার কী ক্ষতি করেছে? আশ্চর্য!
—কিছুদিনের জন্য লোকের মুখ বন্ধ হয় আর কি। ওই গাছটা বেয়েই একটা লোক দুপুরে অযথা ওঠা-নামা করে তো!
—মিথ্যে কথা। কে দেখেছে?
—সেটা এই মুহূর্তে রিভিল করতে পারছি না। তবে ব্যাপারটা ভেবে দেখিস। জলে থেকে কুমিরের সাথে বিবাদ ভালো নয়। এই পাড়াতেই থাকতে হবে তো তোদের?
—ঠিক আছে। দেখা যাক কে কুমির। উটকো পাঁচ-জনের কথায় আমাদের এতদিনের বেল গাছটা কেটে ফেলব? তুই ওদের বলে দিস সাহস থাকে তো আমাদের সাথে সোজাসুজি কথা বলতে।
—ঠিক আছে। খবরটা পাস করে দেব। রাহুল টেবিল থেকে একটা গল্পের বই টেনে নেয়। বইটা কোলের উপর রেখে সাবধানে চায়ে চুমুক দিতে থাকে। —সবাইকে ছেড়ে তোদের নিয়েই লোকেরা এতো গুজব রটায় কেন বলতো?
রাহুলের ডায়েরি:
“পলাশের টেবিলের একটা পায়া ভাঙা। পেরেক দিয়ে জোড়া আছে। দক্ষিণের দেয়ালে বেঙ্গল সুইট হোমের ক্যালেন্ডার। রামকৃষ্ণের ছবি, উপরে বেলুড় মঠ, মা কালী। ওই ছবিটা ঘুম থেকে উঠেই দেখতে পায় পলাশ। ডানদিকের কাঠের আলমারিটা চাবি দিয়ে বন্ধ করা থাকে। ওখানে কী রাখে ওরা?
এইসব ভালো লাগে আমার। একদিন ঠিক মনে হবে যে বয়েসের তুলনায় বুদ্ধি খুবই কম ছিল আমাদের..."
—কেন আমাদের নামে এসব রটায় জানিস? শ্যামলী ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়েছে। চুল খুলে একটু ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে তাকে। মুখে বেশ একটা হিংস্রতার ছাপ।
—কারণ ওরা আমাদের হিংসে করে। আমরা কারো নামে কিছু রটাই না, আমার বাবা সেই সকাল বেলা বেরিয়ে যায়, রাত্রে ফেরে। ওদের কারো বাবাদের মতো নয়। ওই ডঃ গুপ্তর মতো নয়। মহিলাদের সাথে অসভ্য কথা বলে না। মা সব জায়গায় যায় কিন্তু লোকেদের নামে নিন্দে করে না। আমার ভাইটা পড়াশোনায় একটু ভালো। সেইজন্য। এইসব কারণে ওরা আমাদের দেখতে পারে না। আমরা ওদের মতো নই বলে আমাদের নিন্দে করে ওরা। আজকে যদি আমি চৌধুরিদের তিনটে মেয়ের মতো পাড়ার দাদাদের সাথে ঢলাঢলি করতাম তাহলে ওরা আমাদের নিজের দলে টেনে নিত। আমি সেটা করি না বলে ওরা আমায় সহ্য করতে পারে না।
এক নি:শ্বাসে মনের বেদনা প্রকাশ করে ফেলে শ্যামলী। চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে পড়ছে তার।
—এই হচ্ছে আমাদের পাড়া। এরা নাকি সভ্য, শিক্ষিত, প্রবাসী বাঙালি। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে ন্যাকা ন্যাকা কবিতার অনুষ্ঠান করে। আবার হোলিতে জলসার নাম করে মেয়ে এনে স্টেজে ক্যাবারে নাচায়। তখন তুই দেখিস নি এদের! যাদের কাকা-জ্যাঠা বলে ডাকি তাদের কী লোভী দৃষ্টি! ছি:!
ঘেন্নায় বেঁকে গেছে শ্যামলীর মুখ। খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে সে আঁচলের খুঁট চিবোতে থাকে। তারপর ফস করে ঘুরে গিয়ে গাঙ্গুলীদের বাড়ির দিকের জানলাটা সশব্দে বন্ধ করে দেয়।
রেডিওতে অন্য গান হচ্ছে। দূর থেকে রফি-র গলা... কিত্না প্যায়ারা ওয়াদা হ্যায় ইন মতওয়ালি আঁখোঁ কা...
রাহুল বই থেকে চোখ তুলে শ্যামলীকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে। ছোটোবেলার হিন্দী পাঠ্যপুস্তকের লাইন মনে পড়ে যাচ্ছে... খুব লড়ী মরদানী উয়ো তো ঝাঁসীওয়ালী রাণী থী...
বেশ কিছুক্ষণ দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল শ্যামলী। তারপর যখন ঘুরে তাকাল, তখন দুশ্চিন্তার সব রেখা সরে গিয়ে হালকা হাসি ঝলমল করছে। একটি উজ্জ্বল দিনের জন্য একটি উজ্জ্বল হাসি। রাহুল তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নেয়।
রাহুলের ডায়েরি:
“... মুখের উপর দুষ্টু-বুদ্ধির ছায়া দেখলাম। পলাশ আমাকে বলল — চোখ বন্ধ কর রাহুল।
আমি বললাম — প্লিজ কান বন্ধ করতে বলিস না। ইচ্ছে করে বললাম। ভীষণ বিরক্ত হয়ে ও ভ্রূকুটি করল আর আমি হাসি চেপে বলতে থাকি— প্লিজ, চোখ বন্ধ করলেই কান বন্ধ হয়ে যায়। নি:শ্বাসও নিতে পারি না। মনে হয় ডুবে যাচ্ছি। তুই তো জানিস আমি ঠিক সাউন্ড নই।
—চোখ বন্ধ কর চুপচাপ। কড়া গলার আদেশ। অগত্যা মেনে নিলাম। পলাশ ফিক করে একটু হাসল মনে হল।
চোখ বন্ধ করে ফেলতেই মনের দৃষ্টি খুলে গেল। বুঝতে পারি পলাশ ঘরের এক দিক থেকে অন্য দিকে যাচ্ছে। আলমারিটা খুলল। কী আছে ওই আলমারিতে? লম্বা মতো। খবরের কাগজ জড়ানো। খানিকটা কাঠের। এবং খানিকটা ঝকঝকে স্টিল-এর।
বন্দুক!! রাইফেল, নি:সন্দেহে!
কথা বলছে পলাশ। মজা করে করে। ভুলিয়ে রাখার মতো কথা। —সাউন্ড নয়? কোথায় গলদ রে তোর? সেই সঙ্গে টোটা ভরছে। দুখানা, ব্যাটারির মতো বড়ো বড়ো টোটা। বাহান্ন মিলিমিটার বাকশট্! এ দিয়ে তো বাঘ মারে!!
এই অবস্থাতেও একটু গর্ব মেশা তৃপ্তি হয়। বলি—গলদটা পারিবারিক। এই এখানে। ডান হাতের তর্জনী দিয়ে কপালের মাঝখানটা দেখিয়ে দিই। — এখানেই তো সব দোষ। হেড অফিসে। মনে মনে বলি — এখানেই মার! পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ-এ। ফিসফিস করে বলে ফেলি— মিস করিস না।
—কি বললি? শুনতে পেয়েছে পলাশ।
—কিছু না।
খুট করে একটা শব্দ হয়। সেফটি ক্যাচটা তুলে দিল বোধহয়। তারপর অনেক্ষণ বেশ চুপচাপ। অধৈর্য হয়ে পড়ি। এইম করতে এতক্ষণ লাগে? নাকেই মেরে দেবে বোধহয়।
—চোখ খোল!
এইরে, আর ইচ্ছে করছে না চোখ খুলতে। শুধু মন দিয়েই তো চমৎকার দেখা যায়। মন দিয়েই দেখব। যখন তখন মাথা দোলাব। শুঁড়ের উপর তুলে নেব পুরো জগৎটাকেই।
—কী হল, চোখ খোল!
আমি অসহিষ্ণু হয়ে উঠি। —কেন, বেশ তো দেখতে পাচ্ছি। তোর প্রবলেমটা কী?
—দেখতে পাচ্ছিস?
—নিশ্চয়ই।
—কী দেখছিস?
—একটু আগে দেখছিলাম বাকশট। এখন দেখছি হাতির শুঁড়। একটু পরে হয়তো দেখব... রোমাঞ্চকর স্নানের দৃশ্য। কিশমিশ ..."
সরু সরু আঙুল এসে জোর করে চোখের পাতা টেনে খুলে দিল রাহুলের।
—এইবার বল কী দেখছিস।
পায়া ভাঙা টেবিলের উপর চারটে কালার ছবি। তিনটে ক্লোজ আপ। একটা মিডল্ রেঞ্জ। রাহুলের দিলরুবার চারটি উজবুক পাণিপ্রার্থী।
—গাধার বিউটি কনটেস্ট?
হাসিতে উপচে পড়ে শ্যামলী। ফ্ল্যুট-এর মতো সুরেলা স্বর বেরিয়ে আসে তার গলা দিয়ে।
—জেলাসি, জেলাসি! উহ কী হিংসে! বাব্বাহ! এই দ্যাখ, একে দ্যাখ। উদীয়মান খেলোয়াড়। ব্যাঙ্ক-এ চাকরি করে। বড়ো বড়ো জায়গা থেকে খেলার জন্য অফার আসছে।
হাতে নিয়ে ছবিটা মন দিয়ে দেখে রাহুল। যতটা সম্ভব নির্লিপ্ত ভাবে বিচার করার চেষ্টা করে। পাত্র হিসেবে এই উৎসুক মেয়েটির কতটা যোগ্য এ?
—ফ্যামিলি কেমন? জিজ্ঞেস করে রাহুল।
—খুব ভালো। আশ্বাস দেয় শ্যামলী। হং-কং-এ ছিল দশ বছর।
—ছ ফুট?
—রাইট-ও। বলে মাথাভর্তি চুল ঝাঁকায় শ্যামলী। —দেখতে ভালোই, তাই না?
—হ্যাঁ। স্বীকার করতেই হয় রাহুলকে। বেশ খাঁজকাটা মুখ। দাবড়া চোয়াল। ঈষৎ বাদামী চুল। বাঙালি ছেলের পক্ষে খুবই ভালো চেহারা।
—একে হাতে রাখ। ছাড়িস না। শেষ পর্যন্ত সুচিন্তিত অভিমত দেয় রাহুল।
—সত্যি বলছিস?
—মিথ্যে বলার কোনো গরজ থাকতে পারে কি?
— আর এগুলো?
বাকি ছবিগুলো এলেবেলে মনে হয় রাহুলের। একটি ছেলের জুলপি লম্বা। ব্যাকব্রাশ। সে নাকি জুতোর ব্যবসা করে। রাহুলের মনে হয় ছেলেটাকে সে বাসের পিছনে দাঁড়িয়ে বিড়ি খেতে দেখেছে।
—এটাকেও ট্রাই করে দেখতে পারিস। মেহনতি ছেলে হবে। ব্যবসা করছে যখন। বিড়িটা যদি অভ্যেস করে নিতে পারিস...
—ধ্যাত। আসলে এদের কাউকেই আমার তেমন পছন্দ নয়। আমি ‘না’ বলে দিয়েছি।
—তবে যে বললি ভালো ভালো সব সম্বন্ধ?
ছবিগুলো তুলে নেয় শ্যামলী। আবার তাসের মতো ফেলে দেয় টেবিলে।
—ভালো দিয়ে কী হবে রাহুল? ভালো তো অনেক আছে। রাহুলের বোকামিতে যেন ক্লান্ত বোধ করে সে। —ভালোতে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আই ওয়ান্ট দ্য বেস্ট!