—হু আর ইউ? আপনি কে?
রাহুলের কথাগুলো বুঝতে সময় লেগে গেল শ্যামলীর। তারপরেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছে সে। মুঠো পাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে। রাহুলই অবস্থা বুঝে সামলে যায়। শ্যামলীই বটে, আর কেউ নয়।
—ঠাট্টা করছিলাম। ইয়া-আ-আ- হু। তোরাও এখানে উঠেছিস নাকি?
এদিক ওদিক তাকিয়ে রাহুল আর কাউকে দেখতে পায় না। শ্যামলীর বাবা-মা কাছাকাছিই কোথাও আছেন আশা করা যায়। কিন্তু এত জায়গা থাকতে এই সস্তার ধর্মশালায় কেন?
—নো কোয়েশ্চেনস্। শ্যামলী কঠিন থাকে। মাটি থেকে চাবি কুড়িয়ে নিয়ে নিজেই তালাটা খুলতে এগিয়ে যায়। যেন এসবই তার অধিকার। রাহুল এখন কিছু বলে না। একদিন সব নিয়ে হিসেব হবে।
—যা প্রশ্ন করার আমিই করব এখন। আগে বল—গায়ে নামাবলী কেন? সন্ন্যাসী হবার চেষ্টা করছিস নাকি?
—না, সেসব কিছু না। মাসিমারা কোথায়?
—নো কোয়েশ্চেনস্ বললাম না? শ্যামলী তালাটা পুটুশ করে খুলে ফেলে। দরজা খুলতেই আটক ধোঁয়ার গন্ধ। ওদিককার জানলাটা বৃষ্টির জন্য বন্ধ করা ছিল। নাক টিপে ঘরে ঢোকে শ্যামলী। ঘরের মাঝখানে একটা দড়ি টাঙিয়ে পার্টিশন করে দিয়েছে বনমালী। দড়িটায় ভিজে গামছা আর পাজামা ঝুলছে। দুদিকে দুটো খাটিয়া। বেশ স্যাঁতস্যাঁতে ভাব আছে একটা।
—মাই গড! এখানে থাকিস তোরা?
—হ্যাঁ, দারুণ জায়গা, তাই না? এটাই নাকি ধর্মশালার হনিমুন স্যুইট।
—বাজে ইয়ার্কি মারিস না। শ্যামলী একবার গিয়ে রাহুলের দিকটা আরেকবার বনমালীর দিকটা ভালো করে ঘুরে দেখে নেয়। বনমালীর দিকটা একেবারেই অগোছালো। বিছানার উপর জামাকাপড়, খবরের কাগজ, ঝোলা, কলম, ম্যাগাজিন ছড়িয়ে আছে। কোকশাস্ত্রের ছবিওয়ালা বই। শ্যামলী চোখ গোল গোল করে দ্যাখে। রাহুল বোঝে, পড়ার ইচ্ছে, কিন্তু সকলের সামনে এসব ধরা যায় না।
দীর্ঘশ্বাস পড়ে শ্যামলীর। তাঁতের শাড়িতে তাকে ক্লান্ত ক্লান্ত দেখায়। মুখখানা তবু সন্দর। কোকশাস্ত্র আর কামশাস্ত্রের বই দুটো সে তুলে ধরে। শ্যামলীর অসাধ্য কিছু নেই, রাহুল একমুহূর্তের জন্য ভাবে খুলে একটু পড়তে চায় হয়তো। কিন্তু শ্যামলী আস্তে হেঁটে গিয়ে কাঁচের জানলাটা ধাক্কা দিয়ে খুলে বইদুটো ধীর হাতে শিক গলিয়ে ফেলে দিয়েছে অকস্মাৎ।
—তোরা কি পাগল হয়ে গিয়েছিস রাহুল?
রাহুল মনে মনে ভাবে—কে কাকে কী বলছে? হঠাৎ ভগবানকে ডাকতে শুরু করে দেয়। শ্যামলীকে নিয়ে কোনোদিন এরকম চিন্তায় পড়েনি। বিড়বিড় করে বলে রাহুল—এই পাগল মেয়েমানুষের হাত থেকে আমায় বাঁচাও ভগবান। এর বাবা-মা কোথায়? গার্জেন কই?
মামিমার কাছ থেকে শেখা কথাদুটো বার বার আওড়ায়। —গুরুদেব দয়া করো। হরি-ঠাকুর রক্ষা করো।
রাহুলের ডায়েরি থেকে:
“... আমার তো মনে হয় গল্পের শেষ। কী হবে আর ডায়েরি রেখে? খাদের ধারে এসে পা ঝুলিয়ে বসে পড়েছি। ইচ্ছে হয় ফিরে গিয়ে একটার পর একটাকে ধরি আর পেট ফাঁক করি। তারপর তো ওরা আমায় এক্সপার্ট হাতে মারবেই। ইচ্ছে হয় পলাশদের দোতলার ঘরে ঢুকে হুড়হুড় করে সমস্ত লুচি-তরকারি-মাছের বড়া বমি করে ফেরৎ দিয়ে আসি। ইচ্ছে করে কলেজে ফিরে সবকটা পরীক্ষায় বসি। পাস-ফেল তো বিধাতার হাতে। নিজের হাতে যতটুকু আছে। মাকে একটা সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাই। মরার আগে সবাইকে দেখিয়ে দিই—কি ধরনের মানুষ ছিলাম বা হতে পারতাম, সঠিক পথে রাখার সবাই যদি একটু চেষ্টা করত।
ইস্কুলে থাকতে কেউ করেনি। করলেও তেমন গা দিয়ে নয়। আমরা তো এতগুলো ছেলে একসঙ্গে খারাপ হয়ে গেলাম—সেটা কি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নজরে পড়েনি? নিশ্চয়ই তাঁদের নজর ছিল অন্যদিকে। ফিজিক্যাল এডুকেশনের ক্লাস নিতে এসে গিরিবাবু ডেস্কে মাথা রেখে ঘুমোতেন—এই তোরা রিডিং পড়, বলে। আমরা তো যা শিখলাম সব গোমেজ, পান্নালাল—এদের কাছে। তারাই বোর্ডে মেয়েদের পেটের ভিতর কিসব থাকে এঁকে সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছিল। মেয়েরাই দেখে শুনে থ।
শর্মিলা তফাদার—যে পরে ডাক্তারি পড়তে যায়, সে-ই শুধু অসন্তুষ্ট হয়ে বলেছিল—পেটের দুদিকে দুটো ইউটেরাস এখবর তোদের কে দিয়েছে? জবাবে বদরাগী পান্না শর্মিলার চশমার ডাঁট বেঁকিয়ে দিয়ে বলেছিল—বোর্ডের ছবিটা ভালো করে দ্যাখ, ইডিয়ট। এখন সেই পান্না একটা পানের দোকান খুলে বসে আছে। উচ্চ-মাধ্যমিকে জিরো-তে অল আউট। পরের বছর ফলো অন করে আবার গোল্লা। কলেজে ঢুকতেই পারল না বেচারা। একবার ঢুকে গেলে ঠিক বেরিয়ে যেত। কলেজে কেউ ফেল করে না। কত ওপেনিং পেত। লিডারশিপ কোয়ালিটি ছিল ছেলেটার। যত্নের অভাবে নষ্ট। আমাদের স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাকে স্কুলের গণ্ডি পার করে দেবার সামান্য দায়িত্বটুকু পালন করতে পারলেন না। তাহলে আসলে ফেল-বয় কারা?
বরং প্রাইমারি স্কুলের দিদিমনিরা ভালো ছিলেন। গুন-ভাগটা ঠিকঠাক শিখেছি। তাঁদের মাইনে ডবল করে দেওয়া উচিত।
পরে সেই গিরিবাবুরও দায়িত্বহীনতার জন্য চাকরি যায় যায়। আরো কয়েকবছর পর। একই ক্লাস। ফিজিক্যাল এডুকেশনে বছরের পর বছর সেই একই ডায়াগ্রাম। বোধহয় ইয়েগুলো প্রত্যেক বছর একটু বড় করে আঁকা হতো। গিরিবাবু একদিন পড়াবার চেষ্টা করে হেসে ফেললেন। সেই দেখে আমরা যেই একটু গম্ভীর হবার ভান করেছি, অমনি কায়দা করে বললেন—এসব তোমাদের বাবাদেরও আছে। পিছনের ডেস্ক থেকে অমনি কে বলল—কিন্তু আপনার বাবার তো ছিল না। তারপর থেকে গিরিবাবুর কাছ থেকে আমরা ছেলেরা শুধু ঘৃণাই পেয়েছি। ঘৃণা আর অবজ্ঞা।
স্কুল ইনস্পেকশনের দিন গিরিবাবুর উপর চরম প্রতিশোধ। ক্লাসে এসে চুপ করে বসে আছেন, হাঁড়ির মতো মুখ। আমরা বই খুলে রিডিং পড়ছি। ক্লাস শুরু হবার আগে কে বা কারা বোর্ডে চক দিয়ে চার লাইনের কাব্য লিখে রেখেছে, ক্যালিগ্র্যাফি করে। গিরিবাবুর নজরে পড়েনি, কারণ তিনি কোনোদিন বোর্ডের দিকে তাকান না।
ক্লাসের মাঝামাঝি ইন্সপেক্টর এসে ঢুকলেন। দিল্লী বোর্ডের বড়ো অফিসার। অবাঙালি ভদ্রলোক, বাঙালি মহিলাকে বিয়ে করেছেন নাকি, ভালো বাংলা বলতে পারেন। প্রতিবছর বাংলা স্কুলগুলো ইনিই দেখেন। ভাইস প্রিন্সিপাল তাঁকে দরজার গোড়ায় এনে ছেড়ে দিলেন।
—ক্লাস টেন? বলতেই গিরিবাবু হ্যাঁ হ্যাঁ করে ঘুম থেকে উঠে বললেন—ইয়েস স্যার! ইয়েস স্যার!
—কিসের ক্লাস হচ্ছে? ভদ্রলোক ঢুকেই অমায়িক ভাবে জিগ্যেস করলেন।
নবনীতা, ফার্স্ট বেঞ্চে বসেছিল, সেও ঘাড় বেঁকিয়ে লাজুক হেসে বলল—সেক্স এডুকেশন স্যার!
গিরিবাবু হৈ হৈ করে ইংরেজিতে বললেন—সী মিন্স ফিজিক্যাল এডুকেশন, ফিজিক্যাল এডুকেশন! এই ঠিক করে বলো!
ইন্সপেক্টর মুচকি হেসে ক্লাসের ভিতর দু-পা ঢুকলেন। গিরিবাবু এতই হাত কচলাতে ব্যস্ত যে নবনীতার কথা তৎক্ষণাৎ ভুলে গিয়েছেন। ইন্সপেক্টর ঘুরেই দেখলেন বোর্ডে বাংলা অক্ষরে পদ্য। আস্তে আস্তে গর্বের সাথে শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণে পড়লেন। চারটে সাধারণ, মামুলি লাইন—
বার বার যদি তুমি চটকাবে তাকেশুনে গিরিবাবুর মুখটা লাল টকটকে হয়ে গেছে। ইন্সপেক্টর বললেন—এর মানে কী গিরীশবাবু? গিরিবাবু মুখ নিচু করে তোতলাতে তোতলাতে বললেন—আই ডোন্ট নো স্যার!
একদিন ঠিক তুমি মটকাবে তাকে
মনে রেখো এই কথা গিরিরাজ কয়
মেয়েদের ভয় নেই, ছেলেদেরই ভয়।
পরের দিন শুনলাম গিরিবাবু আসেননি। কেউ বলল অসুস্থ, কেউ বলল সাসপেন্ড। ভাইস প্রিন্সিপাল ক্লাসে এসে বললেন—তোমাদের কাছ থেকে এরকম ব্যবহার আশা করিনি। তারপর মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বললেন—তোমরা নিশ্চয়ই দেখেছ কে লিখেছে?
মেয়েরা জানত। কিন্তু কেউ জবাব দিল না।
এই মেয়েরাই আমাদের সঙ্গে পিকনিকে ঠিক চলে যেত। আমরা খারাপ হয়ে যাচ্ছি জেনেও। উচ্চ মাধ্যমিকের পর যারা মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেয়ে গেল তারা আর সম্পর্ক রাখার সময় পেল না। ছেলেরা সবাই অ্যাাভারেজ বা খারাপ রেজাল্ট করলাম। চিরকালই তাই হয় এই স্কুলে, দু-একজন ব্যতিক্রম বাদে। সব দোষের জন্যেও ছেলেরাই দায়ী।
গোমেজ পিছনের ডেস্ক থেকে হাত তুলে বলেছিল—আই অবজেক্ট স্যার! লেখাটা কোনো মেয়েও লিখে থাকতে পারে। তাহলে কি আমাদের ফ্রেম করা হচ্ছে?
অন্য কেউ হলে মার খেত। গোমেজকে মেরে শুধু নিজের হাতে ব্যথা হবে, তাই ভিপি কিছু না বলে চলে গেলেন। মেয়েরা তখন ফিকফিক করে হাসছে।
এখন তাদের অনেকেই টুকটাক বিয়ে-থা করে ভালো ঘরে ঢুকে পড়েছে। বলাই বাহুল্য সেসব ভালো ঘরের ছেলেরা আমাদের স্কুলের নয়। আমাদের বিপথে রওনা করে দিয়ে তারা তো নাম-যশ কেনার পথই ধরলো। মানবিকতার দিক দিয়ে তাহলে তারা কাঁহাতক সাচ্চা? শুধু কি ভালো দিনের বন্ধু?
পলাশ সেদিক দিয়ে লক্ষ গুন ভালো। বহুদিন পর্যন্ত পাশে ছিল। ওরকম দু-একজন ছিল, আছে। মনে হয় এবার নিজে থেকেই এদের ছাড়ি। ধ্বংসের পথে মহিলা ও শিশুদের নিতে নেই। পলাশকে এবার লাইফ বোট-এ তুলে দিতে হবে। যার নাম দেবুদা...”
শ্যামলী জানলার কাছে দাঁড়িয়ে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলে—সে কোথায়?
—সে মানে কে? বনমালী?
—তার নাম মুখে নিতে চাই না। ইররেসপনসিব্ল, অশ্লীল ছেলে। এইসব বই তুইও পড়িস রাহুল?
—না। পড়তে দেয়ও না। সারাদিন খাটিয়ে মারে। এটা এনে দে। ওটা এনে দে। ভিক্ষে করে আন। পড়ব কখন?
—পড়তে হবেও না তোমাকে? তুই কি বুঝতে পারছিস না যে সবাই তোকে এক্সপ্লয়েট করার চেষ্টা করছে?
রাহুল অর্থবহুল একটা পজ দেয়। শ্যামলীর চোখে চোখ রেখে। দুই হাত জড়ো করে দাঁড়িয়ে শ্যামলী, যেন কতই বা উতলা।
—কে আমাকে এক্সপ্লয়েট করছে তুই জানিস?
শ্যামলী ঘুরে জানলার দুটো পাল্লা হাট করে খুলে দেয়। ভিজে ভিজে বাতাস আসে ওইদিক থেকে। পাঁচিলের ওপারেই গলি—সেখান থেকে কচুরি ভাজার গন্ধ। কচুরির গন্ধে দুজনেই একটু হতবাক হয়ে যায়। সিরিয়াস কথাবার্তার মধ্যে একটা লোভের ব্যাপার এসে পড়েছে। দুজনেই যেন নাক উঁচু করে গন্ধ নেবার চেষ্টা করে। জায়গাটা খারাপ না। যতই বলুক শ্যামলী। রাহুল নিজের বিছানাটা একটু টান টান করে দিয়ে ডাকে।
—বসবি তো বোস।
—দ্যাখ তোর জন্য সেই ভোর সকালবেলা উঠে বেরিয়ে পড়েছি। সারাক্ষণ না খাওয়া। কত কষ্ট করতে হলো। বসতে বসতে বলে।
আবার চোখ ছলছল না করে ওঠে, প্রমাদ গোনে রাহুল। কী করে খবর পেল তারা এখানে এসে বাসা নিয়েছে? কার সাথে এল? গার্ডিয়ান কই?
—আমার জন্য?
—তোর জন্য নয়তো কী? মায়ের খোঁজখবর নিয়েছিস কিছু এ কদিন? তোর কোনো দায়িত্বজ্ঞান নেই? যে যা বলছে তাই করছিস?
—মায়ের কী হল?
—কিছু হয়নি। তোকে ফিরে যেতে হবে।
—আজই?
—আমাদের সঙ্গেই। বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
রাহুলের মনে পড়ে যায়, বড়ো রাস্তার উপর একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল। দিল্লীর নম্বর প্লেট। এখানে বিরল নয়। রাহুলের অবশ্য নিজস্ব অসুবিধে আছে ফেরার।
—কিন্তু পলাশ আমার যে লাইফ রিস্ক? বনমালীই তো বাঁচালো!
—ফালতু অজুহাত দিস না রাহুল। তুই এমন কেউ না যাকে না মারলে গুণ্ডাদের চলছে না। কবে চুকে-বুকে গেছে সব। এখন তো রেগুলার কলেজ হচ্ছে। কোনো ঝঞ্ঝাটই নেই। প্রবলেম হলে তোর দেবুদা সামলে দেবে বলেছে। ওর চেনা লোক আছে দুটো পার্টিতেই।
—সেটা আগে বলিসনি কেন?
শ্যামলী খাটের উপর আরেকটু জাঁকিয়ে বসে। সিলিং-এর দিকে চেয়ে বলে—জানতাম নাকি? এই তো জানলাম। আস্তে আস্তে জানছি সব, দেখছিস না? নে: আর দেরি করিস না। জিনিসপত্র প্যাক করে নে। উঠতে হবে।
—আর বনমালী?
—মরুক সে।
রাহুলের একটা রুকস্যাক ভরে ফেলতে বেশি সময় লাগে না। শ্যামলীও সাহায্য করে। নামাবলীটা খুলে একটা শার্ট পরেছে। শ্যামলীর কথামতো বাথরুমে গিয়ে পাজামা খুলে প্যান্টও পরে আসে।
—নামাবলীটাও যাবে?
—দাম দিয়ে কেনা।
শ্যামলী আর দ্বিরুক্তি না করে আটভাঁজ করে ফেলে। রাহুলই ঠেসেঠুসে ঢোকাচ্ছে সব।
—এসব আবার কী?
—গাঁজার ছিলিম।
—হোয়াট?!!
—বনমালী খায়। আমি তো স্মোক করি না।
শ্যামলী নেড়ে চেড়ে দেখে রেখে দেয়।
—কুইক, কুইক। ঢিলেঢালা কাজ আমি পছন্দ করি না। এই কাগজের মধ্যে কী?
খবরের কাগজ জড়ানো তিন চারটে ভিজে আন্ডারপ্যান্ট। কিছু বলার আগেই খুলে দেখেছে শ্যামলী। বনমালীর প্রভাবে এখন রাহুল সাশ্রয়ী হয়েছে। সাত-দিনে একবার আন্ডারওয়ার পাল্টায়। বনমালী বুঝিয়েছিল পুরুষদের অত লাগে না। একটু পরিষ্কার থাকবি। তাহলে দু-সপ্তাহও চালানো যায়। ময়লাগুলো জমিয়ে রেখে একদিন কাচলেই হলো।
রুকস্যাক কাঁধে নিয়ে শ্যামলীর পিছু পিছু বেরিয়ে আসে রাহুল। চাবিটা আগরওয়ালকে দিয়ে বেরিয়ে যাবে। বনমালীর কাছ থেকেও ওখানেই বিদায় নিয়ে নিতে হবে। এতদূর থেকে কেউ নিতে এসেছে, তাকে কি ফিরিয়ে দেওয়া যায়?
আগরওয়ালের অফিসে ঢুকতেই শ্যামলীর গার্ডিয়ানের মুখোমুখি। দেবুদা চেয়ারে বসে হাতলের উপর একটা লম্বা পা তুলে রেখেছে। রাহুলকে দেখিয়ে শ্যামলী বলছে—কতক্ষণ লাগল একে আনতে?
দেবুদা ঘড়ি দেখে বলে—পনেরো মিনিট। কমই হবে। এই স্পিডে চললে গঙ্গায় একটা ডুব দিয়ে যাওয়া যায়।
বনমালী পাশের সিটে হতভম্বের মতো বসে আছে। আগরওয়াল হৈ হৈ করে বলল—রাহুলবাবু চলে যাচ্ছেন নাকি? আমি তো ভাবলাম আপনার দোস্তরাই থেকে যাবেন।
শ্যামলী বলল—আচ্ছা গঙ্গার ঘাট এখান থেকে কতদূর?
দেবুদা বলে—পরের বার। তবে ঘাটটা সত্যিই কতদূর?
আগরওয়াল বলে—আধা মাইল। রাহুলবাবুই নিয়ে যাবেন আপনাদের।
বনমালী টেবিলে একটা বিরাট চাপড় মেরে বলে—ড্যাম ইট! তুই চলে যাচ্ছিস?
এই শব্দকল্পের মধ্যে রাহুল একা ঠান্ডা। ভেবেচিন্তে বলে—তুই বলিস তো থেকে যাই।
এবার শ্যামলী আর দেবুদার হতভম্ব হবার পালা। আর বনমালী নিজের চেয়ারে আরাম করে বসে এদিক ওদিক চায়।
শ্যামলী আর বনমালীর মধ্যে এরকম কিছু একটা হতোই। অনেকদিন ধরেই বাতাসে একটা ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছিল। এতদিন ধরে বনমালীই একটা আপার হ্যান্ড নিয়ে এসেছে—তার কোনো দুর্বলতা ছিল না বলে। সে যদি বলতো—রাহুল তুই যাচ্ছিস? যা। তাহলে শ্যামলী জিতেও জিততো না। হয়তো রাহুল দিল্লী অবধি গিয়ে আবার ফেরার বাস ধরত।
সবই বুঝতে পারে রাহুল। তাকে একটা সাইড নিতে হবে। যে জিতবে সেদিকেই যাবে কি? বনমালীটা বাউণ্ডুলে—জীবনে কিছু হচ্ছে না তার। কিন্তু মন খুব শক্ত। কানের মধ্যে আবার কেউ বলে দেয়—যে পক্ষের পরাজয় সে পক্ষ ত্যাজিতে মোরে কোরো না আহ্বান। কিন্তু পরাজয় যে কার হবে সেটাই ঠাহর পাওয়া যায় না।
শ্যামলী রাহুলের রুকস্যাকটা খিমচে ধরে থাকে। যেন বনমালী গায়ের জোরেই কেড়ে নেবে। রাহুলের মনে হয় শ্যামলী ভয় পেয়ে গেছে। বনমালী হাত-পা ছড়িয়ে বসে দেবুদাকে বলল—এত ঝামেলা করলেন কেন? খবর চাই তো ফোন করলেই হোত।
শ্যামলীকে সে পাত্তাই দিচ্ছে না।
দেবুদা বলল—সারপ্রাইজ! সারপ্রাইজ দেবার জন্য তো। তোমরা কি রাহুলের জন্য ফাইট করবে নাকি?
বনমালী স্মিত হেসে চুপচাপ বসে থাকে। হঠাৎ শ্যামলী এমন একটা গলা বের করে যা শোনার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। ভাঙা বাঁশির মতো—প্রায় ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেলার আগে মেয়েদের যেরকম গলা হয়।
—এরকম শত্রুতা করছিস কেন বনমালী? তোদের কি আর বিয়ে হবে না?
দেবুদা কথাটা শুনে তার আগু-পিছু কিছুই বুঝতে না পেরে হাঁ হয়ে গেছে, আর বনমালী চেয়ারটা এক ঝটকায় পিছনে সরিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে তর্জনী তুলে শাসাতে থাকে।
—ড্যাম ইট, পলাশ, ড্যাম ইট! রাহুলকে নিয়ে যা খুশি কর। আই ডোন্ট কেয়ার। বাট ওয়াচ ইট! ওয়াচ ইট! কার সাথে কথা বলছিস সেটা খেয়াল রেখে—
রাহুলের ডায়েরি থেকে:
“... আসল কথাটা তাই। পলাশ বোঝে। বুঝবে না হয়?
সবাই এক একদিকে ছিটকে যাচ্ছি। কেউ উপরে কেউ নিচে। ছেলেরা দিচ্ছে পানের দোকান, মেয়েরা খুলছে ডিসপেনসারি। পলাশ সোজা পথ বেছে নিয়ে দেবুদাকে বিয়ে করে ফেলেছে। দোষের নয়, দোষ দেওয়াও উচিত নয়। শুধু আমাদের, যাদের কিছু হচ্ছে না—তাদের ব্যর্থতাবোধ ও তাই থেকেই একটু রাগ-বিদ্বেষ এইসব জন্মে পরিষ্কার মনের জল ঘোলা করে দেয়। পলাশের কাছে (বা দূর থেকে) বনমালীর হয়ে, নিজের হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমাদের পড়াশোনা, চাকরি, বিয়ে কিছুই হলো না। গুরু পেলাম না। জীবনে সেট্ল হতে পারার সময় বোধহয় পেরিয়েই যাচ্ছে। তা হোক। যারা তাদের পথ খুঁজে পেয়েছে তাদের হিংসে করব কেন?
বরং কাছাকাছি থাকব। তদের সুখ থেকে আনন্দ পাব। এই একদিন, কোনো ছুটি কিম্বা পূজাপার্বণের দিনে—ভালো ইস্ত্রি করা জামা, স্যুট ইত্যাদি পরে চলে যাব তদের বাড়িতে। বাগানে ডিনারের টেবিলে পলাশের ছেলে বা মেয়েকে হাঁটুর উপর বসিয়ে নাচাব। তিন-চার ঘন্টা কোয়ালিটি সময় কাটিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে আসব একলা ঘরে।
হু হু করে ট্যাক্সির জানলা দিয়ে হাওয়া। এইসব ভাবছিলাম। পিছনের সিটে আমি, পলাশ, দেবুদা। সামনে ড্রাইভারের পাশে বনমালী। হরিদ্বার-দিল্লীর রাস্তার দুদিকে আখের ক্ষেত। তার ওপারে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। চোখ ধাঁধিয়ে যায়। দেবুদা সারাক্ষণ বকর বকর করে বনমালী আর ড্রাইভারের সাথে। একবার বলল গাড়ি থামাতে—আখ তুলে আনা যায় কিনা দেখবে। বলতে বলতেই ড্রাইভার গাড়িও থামিয়েছে। ওরা তিনজন নেমে গেল ক্ষেতের মধ্যে। ড্রাইভার আর বনমালী আখের উপরেই হিসি করতে লাগলো।
পলাশ বলল—এ কী লোকের পাল্লায় পড়লাম রে বাবা! সবাইকে ধোলাই খাওয়াবে। আমি আর পলাশ গাড়ি থেকে নেমে একটু হাত পা ছড়িয়ে নিচ্ছি।
পলাশ ওদের দিকে আড়চোখে একনজর দেখে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল—ওই আখ আমি ধুয়েও খাব না। আমি বললাম—চেনা লোকের ইয়ে বলে? ফ্যামিলিইয়ারিটি ব্রিড্স কনটেম্পট। শুনে পলাশ হাসল। বলল—বিয়ের পর আমরা প্রায়ই এরকম বেরিয়ে পড়ব, কি বল?
আমাদের সঙ্গে নিবি? জিগ্যেস করতেই বলল—নেব। তোদের দুজনকে নেব। আমি বললাম কেন? পলাশ বলল—এই যে কথা শুনলি, তাই। আমি বললাম—সে তো তুই ভ্যাঁক করে ফেললি বলে। পলাশ বলল—রাখ তোর ভ্যাঁক। একটু সিরিয়াসলি কিছু বললেই তোরা ভাবিস ইমোশনাল হয়ে পড়েছি। আসলে সকাল সকাল স্নান করে আমার গলা ধরে গেছে। এই বলে টনসিলটা একটু টিপে দেখাল।
দেবুদারা নিচু আখক্ষেত থেকে একটা আখ তুলে লুকিয়ে নিয়ে আসছে। আমি পলাশকে বললাম—আচ্ছা, আমার জন্য এসব করছিস কেন বলতো? তুই কি আমাকে ভালোবাসিস? তাহলে সেটা সোজাসুজিই তো বলা যায়। দেবুদাকে জড়ালি কেন?
পলাশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। দুটো হাত বিবেকানন্দের মতো বগলের ভিতরে। মাটির দিকে দেখছে। জুতো দিয়ে ঘাসের চাবড়া তুলছে। বলল—রাহুল, তোর প্রবলেমটা কি জানিস? এক নম্বর—ভালোবাসা কী সেটা তোর জানা নেই। দুই—যা জানিস না তা নিয়ে ভীষণ বড়ো বড়ো কথা বলার স্বভাব। তিন—মাথা এত পেঁচিয়ে গেছে যে মেয়েদের মতো করে জগৎটাকে দেখতে পারবি না।
আমি বললাম—অর্থাৎ ভালোবাসিস না, এই তো? করুণা, দয়া ইত্যাদি দেখাতে এসেছিস?
পলাশ মাটিতে গর্ত করে আবার বুজিয়ে দিয়ে বলল—ধুস, তাই বলেছি নাকি? ধর যদি বলিও, আই লভ ইউ, তুই কি বুঝবি?
আমি বললাম—আগে তো বল!
তখন পলাশ আস্তে আস্তে তিনবার সত্যি তাই বলে দিল এবং বলেই পুট করে গাড়ির ভিতর।
দেবুদা এসে বলল—আখটা ডিকির ভিতর যাবে? অনেক চেষ্টা করেও সেটা ঢোকাতে পারা গেল না, ভাঙাও গেল না। গাড়ির ভিতরেই ঢোকাতে হলো। জানলা দিয়ে বিপজ্জনক ভাবে অনেকটা বেরিয়েও রইল।
সবাই গাড়িতে উঠে পড়ার পরেও আমি সূর্যাস্ত দেখার ভান করে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। দেবুদা বলল—তুমিও বাথরুমে যাবে নাকি?
—নাঃ, বলে ডানদিকের দরজাটা খুলে ঢুকেছি ভিতরে, এমন সময় পলাশ নড়েচড়ে উঠে চোখ নাচিয়ে বলল—কাব্য আসছে মনে, রাহুল?...”
রাহুলের ডায়েরি থেকে:
“...আমাকে ছুঁয়েছে সে—ছুঁতে পারে আবার কখনো,
এখনি দিনের কাছে আলো কিছু আরো চেয়ে রাখি
যাতে সে আবার ছোঁয়া দেখে তবে ছুটি নিতে পারি—
আমিও বিপদ কিছু ছুঁয়েছি নিজের বুক দিয়ে।
যদি তারা আসে, যদি তাড়িয়ে কোথাও নিয়ে যায়—
একদিন আমি তাকে এইভাবে পিছু ফেলে যাব,
ভালোবাসা কাকে বলে বুঝি না তো—কীসে ভয় পাব?...”
অক্টোবরের মাঝামাঝি—বাঙলার আশ্বিন মাসে—দিল্লীতে কমলা রঙের রোদে বাহিত হয়ে কয়েকশো চিঠি গিয়ে পড়লো লম্বা গলার মোরগের মতো লাল ডাকবাক্স গুলোতে। রাহুল কিছু নিজে গিয়ে পোস্ট করে এল শেষ মুহূর্তে—কেননা বন্ধুদের অনেকেরই নাম কাটা গিয়েছিল। রাহুল জানতে পেরে সরাসরি শ্যামলীর মাকে গিয়ে ধরে—এরকম করলে তো মুখ দেখানো যাবে না! শ্যামলীর মা ধর্মভীরু—বা এমনি ভীরু মহিলা। সামাজিক লোকলজ্জার ভয় দেখালে একেবারে বশ হয়ে যান—এটা রাহুল জানত। তিনি বললেন—এরা তোদেরই বন্ধু? তাহলে পলাশ নাম বলল না কেন? রাহুল বলে—উত্তেজনায় ভুলে গেছে—আমি বলে দিচ্ছি আপনি এক্ষুনি নাম লিখে চিঠিগুলো আমায় দিন। দুর্ভাগ্যবশত শ্যামলী তখনই পাশের বারান্দা দিয়ে যাচ্ছিল। কিছু একটা আন্দাজ করে সে ঘরে ঢুকে পড়ে। চিরকালের সন্দেহবাতিক তার।
—ওকে কী দিচ্ছ, মা?
—বিয়ের চিঠি। তোদের অনেক বন্ধু মিস হয়ে গেছে। এক্ষুনি পোস্ট করে দিলে হয়তো পেয়ে যাবে।
—কোন বন্ধু মিস হয়ে গেছে দেখি!
এই বলে রাহুলের লিস্ট কেড়ে পড়ে যায় শ্যামলী—গৌতম অধিকারী, তরুণ সেন, ত্রিদিব হালদার। প্রসেনজিৎ বড়ুয়া ... এরা কবে আমার বন্ধু ছিল? ত্রিদিব হালদারের তো নামও শুনিনি!
—ওই প্রসেনজিতের বন্ধু। বলে রাহুল। বন্ধুর বন্ধু মানেই আমাদের বন্ধু, তাই নয়?
—কী রাবিশ! আমাদের বন্ধু? এরা কেউ আমার বন্ধু নয়। বখাটে, ফেল করা ছেলের দল। ক্লাসের পিছনে বসে কমেন্ট পাস করত। একবছর, ছমাস একসঙ্গে পড়েছি বলে কি বিয়েতে খাওয়াব?
—ভীষণ দুঃখ পাবে প্রসেনজিৎ।
—সে তো একটা লোফার। শুচিস্মিতাকে নোংরা চিঠি দিয়েছিল।
শ্যামলীর মা চিঠিগুলো রাহুলের হাতে তুলে দিতে গিয়ে থমকে যান।
—সে কী রে?
—নইলে কী? এদের সাথে সম্পর্ক রাখলে ভদ্রলোকেরা গায়ে থুতু দেবে।
রাহুল দু-হাত তুলে মা ও মেয়েকে নিবৃত্ত করে। —হোল্ড ইট, হোল্ড ইট। হাফটাইম, পিঁ পিঁ...এইভাবে ঝগড়া করলে কোনো সমাধান হবে না। বরং পলাশ তুই ওঘরে যা। আমি তোর সাথে আলাদা করে আলোচনা করব।
কিন্তু শ্যামলী মায়ের গায়ের সঙ্গে লেগে দাঁড়িয়ে ত্থাকে। যৌথ পরিবারের সিংহিনীর মতো।
—ফাইন। রাহুল কাঁধ ঝুলিয়ে হার স্বীকার করে নেয়। —প্রসেনজিৎ কিছু ভুল করেছে স্কুলজীবনে। এখন শুধরে গেছে অনেক। পলাশকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করে।
শুনে শ্যামলী হা হা করে হাসতে থাকে।
—শ্রদ্ধা করে না অন্য কিছু! তুই কি পয়সা খেয়ে এসেছিস রাহুল? বিয়েতে এসে গণ্ডগোল করবে? বাবাকে বলে পুলিশ প্রোটেকশন রাখব। এসবের মধ্যে জড়াস না রাহুল। বোকা বলে তুই আগে মরবি।
শ্যামলীর মায়ের কাছে আর রাহুলের প্রেসটিজ থাকে না। ভদ্রমহিলা ভাবেন কীরকম ছেলে রে বাবা! রাহুল শ্যামলীর পিছু পিছু তার ঘরে গিয়েই ঢোকে।
—প্লিজ শ্যামলী!
—আগে আসল ঘটনাটা বল।
রাহুল গড়িমসি করে শেষ পর্যন্ত বলে—এদের দলটাতে ঢোকার চেষ্টা করছি। কে ওদের বলে এসেছে আমার গার্লফ্রেন্ড-এর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আমি নাকি বুকে পাথর রেখে পরিবেশন করব। ওরা এসব দেখতে চায়। আসুক না। কোনো ঝামেলা করবে না।
শ্যামলী বলে ইম্পসিব্ল! মদ খেয়ে আসবে, গুরুজনদের সাথে বাজে ব্যবহার করবে। পণ্ড করে দেবে সব।
—তাঁদের একটু সরিয়ে রাখলেই হয়।
—শাট আপ রাহুল। আমার বিয়েতে আমার গুরুজনদের সরিয়ে রাখব? ভাবলি কী করে?
পরে কার্ডগুলো চুরি করেই পোস্ট করে দেয় রাহুল। কার্ড না পেলে আরো বেশি করে আসত। তখন সত্যি ঝামেলা হতো। কার্ড পেলে ধরে নেবে পুলিশ থাকবেই। ফাঁদ পাতা আছে একথাও ভাবতে পারে। এসব কথা মেয়েদের কে বোঝাবে?
শ্যামলীর কিছু মেয়ে বন্ধু সত্যি বাদ পড়ে গিয়েছিল। মেয়েরা মেয়েদের মনে রাখতে পারে না। রাহুল পুরো লিস্ট চেক করে বিস্মৃতদের নতুন লিস্ট তৈরি করে। —কে রিঙ্কি?
—ভালো নাম সুশান্তা। বলে রাহুল।
—ওহ, সেই মেয়েটা। সেও তো ফেল করল কতবার। তাকেও ডাকতে হবে?
—ডাকা উচিত। কী একটা কারণে তার বিয়ে হচ্ছে না। না ডাকলে ভাববে অ্যাভয়েড করছিস।
—ঠিক আছে নিয়ে যা চিঠি।
নিজের হাতেই নিয়ে গেল সেই চিঠিটা। রিঙ্কিকেও একবার দেখা হয়ে গেল। মোটা হয়ে গেছে বেশ। বাড়িতেই বসে আছে। ক্লাস নাইনে টিফিনের ঘণ্টায় যখন সবাই মাঠে খেলতে গেছে, তখন তিনটে ক্লাসের কিছু ছেলের সাথে রাদেঁভ্যু করে ক্লাসরুমে এসে দেখা করেছিল, এবং অদ্ভুত এক স্ট্রিপটিজ দেখিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে জামাকাপড় কিছু না খুলে শুধু স্কার্টের ঘের একটু একটু করে অনেকদূর অবধি তুলে। তারপর ক্লাস টেনের ছ-সাতটা ছেলে একসঙ্গে—বল্লে! বল্লে! বল্লে! বল্লে!—বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন রাহুলরাই সবাই মিলে বুক দিয়ে বাঁচিয়েছিল। মেয়েটা এখনো রাহুলকে শ্রদ্ধা করে সেই জন্য।
রিঙ্কি বলল—শ্যামলীর বিয়ে! কার সাথে? ও-মা দেবুদা!
রাহুলের খুব জানতে ইচ্ছে করে দেবুদাকে কখনো স্ট্রিপটিজ দেখিয়েছিল কিনা রিঙ্কি। রিঙ্কি রাহুলদের চেয়ে অন্তত বছর তিনেকের বড়ো। —যাব কিনা বলতে পারছি না রে। আমি বিশেষ বেরোই না আজকাল। কী হবে অত ঘুরে বল? দেবুদাকে জিগ্যেস করিস আমায় মনে আছে কিনা। আনমনা হয়ে বলে রিঙ্কি।
—সেটা অবশ্যই করব। মনে মনে বলে রাহুল।
—তুই কী করছিস রাহুল? চাকরি-টাকরি?
—কিছু না।
দুজনেই দুজনের দিকে চেয়ে হাসে। দুজনেই একটু খারাপ, নষ্ট প্রকৃতির ছেলে মেয়ে আর কি। বন্ড্ করে যায় তৎক্ষণাৎ।
—তুই যাবি শ্যামলীর বিয়েতে? জিগ্যেস করে রিঙ্কি।
—যাব।
—তাহলে আমিও যেতে পারি। না গেলে শ্যামলীকে আমার হয়ে কনগ্র্যাচুলেশনস বলে দিস।
রিঙ্কি এখন আর স্কার্ট পরে না বোধহয়। পা দুটো মোটা মোটা হয়ে গেছে। রাহুল মনে মনে বলে—আয় রিঙ্কি আমরা ফিরে যাই। চমৎকার দিন ছিল, তাই না? অন্তত আমাদের পক্ষে।
রিঙ্কি বলে—রাহুল তুই নিজে এলি কেন? তোদের বাড়ি তো অনেকদূর।
রাহুল বলে—কারণটা শুনলে বিশ্বাস করবি না, বলতে ইয়েও লাগছে।
রিঙ্কি বলে—আমায় দেখতে?
রাহুল একটা অন্য চোখে দেখে রিঙ্কি হাসতে হাসতে শাড়িটা তুলছে একটু একটু করে। ফরসা, মোটা-সোটা পা-জোড়া দেখা যাচ্ছে। মনে হয় এটাই যেন ক্লাসরুম। এক্ষুনি ভিপি এসে হাতের বেতটা দরজায় ঠুকে বলবেন এটা কী হচ্ছে? তোমাদের কাছ থেকে এসব আশা করিনি। এই বয়েসেও রাহুলের বুক দুরদুর করতে থাকে। সোফা ছেড়ে উঠে পড়ে দাঁড়ায়।
—চললাম। ভালো থাকিস।
—বললি না তো কেন এসেছিলি?
রাহুল একটু ভাবে—ধর যদি বলি, আই লভ ইউ, তুই কি বুঝবি?
রিঙ্কির মুখটা সিরিয়াস হয়ে যায়। —কী বলছিস এসব? বুঝব যে তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
রাহুলের হঠাৎ মনে হয় নিষ্ঠুরভাবে সে শ্যামলীর ঋণ এখানে শোধ করে যাবে। কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। আর কিছু বলে না। হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসে।
—টা টা, রিঙ্কি।
—টা টা, রাহুল।
সমস্ত চিঠি বিলি করে দিয়ে তার বুকের ভিতরটা সিঙ্গিং বিচ-এর মতো গম গম করে।
জলধরের বাড়ির কাছ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখে তার বাবাকে ছাদের উপর টিভির অ্যান্টেনা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে। জলধরের ভাইটা একেবারে অপদার্থ। একবার গিয়ে জিগ্যেস করলে হয়—কেমন আছেন? তারপর মনে হয়—ধুত্তোর কী হবে আবার সব মনে করিয়ে দিয়ে।
সারাদিন ধরে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে। বনমালীর বাড়িতে গিয়ে শোনে সে নেই। সেখান থেকে বেরিয়ে সন্ধেবেলা হাঁটতে হাঁটতে কলেজে। পিছনের একটা গেট আধখোলাই থাকে। বাগানের ঘাসে একটা দারুণ অন্ধকার ঘাপটি মেরে বসে আছে। সেখানেই গিয়ে ঘাসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শোয়, বসে আবার শোয়। এইভাবেই অনেকক্ষণ কেটে যায়। বাগানের পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে দু-একজন হেঁটে যায়। হোস্টেলের ছেলেরা। গলার আওয়াজে বুঝতে পারে অনেকেই তার চেনা। মেস-এ যাচ্ছে রাতের খাবার খেতে। সেও যেতে পারে। কারো সঙ্গে বসলেই খাইয়ে দেবে। মূল্য দিতে হবে দু-ঘন্টা বকর বকর। অমুকের সিনেমা, তমুকের গান এসব নিয়ে আলোচনা। তার চেয়ে খালিপেটে থাকাও ভালো।
অন্ধকারে একটা জ্বলজ্বলে চোখ। খুঁজে খুঁজে রাহুলের কাছে চলে আসে। দারোয়ানের ল্যাংড়া কুকুর। গন্ধটা চেনে। ঘেয়ো গায়ে একটা হাত রাখতেই কুঁই কুঁই শব্দ। সেটা-কে পাশে নিয়েই শুয়ে পড়ে রাহুল। অনুভব করে আকাশের তারা। তার মধ্যে একটা পথের নির্দেশ। স্পষ্টই দেখা যায়। এতদিন দেখল না কী করে? ব্যর্থতার মধ্যেই তো পুনর্জন্মের ইচ্ছে।
জলধর, পলাশ, রিঙ্কি, বনমালী, তভলীন, মা, দেবুদা ঘেয়ো কুকুর সকলে মিলেমিশে যে মরণশীল জগৎ তার মধ্যে চিত্রশিল্পীর মতো কেউ তাকে ফুটিয়ে তুলছে। একই নাম, একই মুখ। একটু আধটু নিজস্ব চরিত্র। এর বেশি কে চায়? এর বেশি কার লাগে?
রাহুলের ডায়েরি থেকে:
“... পুজোর ঠিক আগেই বিয়ের দিন পড়েছিল। পলাশের বিয়ের বাজার করতে ওরা সবাই হিমসিম। আমি একটা শার্ট পেয়ে গেলাম। সম্ভবত দেবুদাদের কারো জন্য কেনা হয়ে পরে পছন্দ হয়নি। আগে হলে সোজাসুজি জিগ্যেস করে নিতাম। এখন ভীষণ ভালো লাগল পেয়ে। বললাম-–বিয়ের দিন এটাই পরছি তাহলে।
কলেজে যাচ্ছি সময়মতো। ক্লাস আবার আগের মতো হই হই করে হচ্ছে। লেকচারার জিগ্যেস করলেন—তোমার মুখ তো দেখিনি আগে বাবা! কোথায় লুকিয়ে ছিলে এতদিন? বললাম—অসুস্থ ছিলাম, মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দেব।
বলেও দিইনি। কে কী করে পরে দেখা যাবে।
বনমালীর সাথে দেখাসাক্ষাৎ হচ্ছিল। একদিন কলেজ পাড়ায় একটা মোমের শিখার মতো সুন্দর মেয়ের সাথে ঘুরছে দেখলাম। কী করে জোটালো—আশ্চর্য! তখন আর ডিসটার্ব করিনি। পরে বিকেলে বাড়ি গিয়ে দেখা করতেই বলল—মোস্ট সাধারণ মেয়ে একটা। মোমের শিখা না উনুনের ধোঁয়া। ভয়ঙ্কর বোর করেছে।
অর্থাৎ বনমালী পাল্টায়নি। শুনে মনে শান্তি পেলাম।
একদিন পলাশের সঙ্গে বেরোলাম দেবুদার জন্য তত্ত্বের জিনিস কিনতে। —কাউকে বলিস না আমি কিনেছি, শ্যামলী বলে দেয়। লোকে খারাপ ভাববে।
আমাকে আর এসব বলে দিতে হয় না। এম্পোরিয়াম থেকে একটা কালো উলের কোট কিনিয়ে দিলাম চড়া দামে। পলাশ ইতস্তত করছে দেখে নিজেই পকেটে হাত ঢুকিয়েছিলাম, যদিও সেখানে বিশেষ কিছু ছিল না।
বাড়ি ফিরে একটা পুরুষদের আড্ডায় আটকা পড়ে গেলাম। পলাশের বাবার সাথে পাড়ার তিন ভদ্রলোক। চা খাচ্ছেন সবাই। কার জানি ইমারত মেরামত হচ্ছে, তার গল্প। ইচ্ছে হলো বসে একটু শুনি। একটা ক্রস-কালচারাল এক্সচেঞ্জ হোক।
পলাশের বাবা সবার কাছে বড়ো মুখ করে বললেন—এই হলো রাহুল। পলাশের ভাইয়ের মতো। একই স্কুলে পড়েছে, ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। ফার্স্ট ডিভিশন পায়। প্রচুর টিউশনি হাতে। কি বলো রাহুল?
স্কুলের পর ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে, কিন্তু পলাশের বাবা লেটেস্ট খবর জেনে করবেনই বা কী? সেখানে বসে বসেই একটা টিউশনির অফার পেলাম এবং সাড়ম্বরে প্রত্যাখ্যান করলাম—হাতে সময় নেই বলে। যদিও অন্য কোনো টিউশনি হাতে ছিল না এবং পেলে খুব ভালোই হতো। কিন্তু পলাশদের পাড়ায় আমি যা আমি তা-ই।
পলাশের বাবা বললেন—মেয়ের বিয়ে তো এদের জোরেই দিচ্ছি। এত কাজ কে করে?
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম—পুলিশের ব্যবস্থাটা কিন্তু আপনাকেই করতে হবে মেসোমশাই। আপনি গার্ডিয়ান।
শুনে সবাই খানিকক্ষণ চুপচাপ। একটু পরে পলাশের বাবা হাঁটু চাপড়ে হেসে-টেসে একাকার—এটা ভালো বলেছ রাহুল। সে ব্যবস্থা হয়েই আছে। থানার ওসি-কে কার্ড দিয়ে এসেছি।
ইমারতের আলোচনা আবার শুরু হয়ে যাবার পর আমি একসময় উঠে ঘরের ভিতর চলে গিয়েছি। প্রায় ঘন্টাখানেক পরে পলাশের বাবা ভিতরে এসে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছেন। ওঁর পিছু পিছু আবার বৈঠকখানায়। প্রতিবেশী ভদ্রলোকরা চলে গিয়েছেন বোধহয়। আমি ভাবলাম ইমারতের গল্প এবার আমার সাথেই হবে, কিন্তু পলাশের বাবা টুক করে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়েই বললেন—এসব কী বলছ তুমি রাহুল?
কী বিষয়ে জিগ্যেস করতে বললেন—ওই যে বললে পুলিশের ব্যবস্থা করতে হবে। কেন?
আমিও ওনার চোখে চোখ রেখে ভুরু নাচিয়ে বললাম—কেন যে-জন্য রাখতে হয় সে জন্য!
তখন উনি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বললেন—তা অবশ্য আমিও ভেবেছিলাম। ওসি-কে বলে রাখব নিশ্চয়ই আসেন যাতে। কিন্তু রাহুল, এই প্রশ্নটা সকলের সামনে না করলেই চলছিল না তোমার? আবার অকপটে বললাম—যত লোক জানে ততই ভালো নয় কি?
তখন উনি হঠাৎ যেন সব বুঝতে পেরেছেন এই ভাব দেখিয়ে হা হা করে হেসে বললেন—ও তাহলে তোমার প্রি-প্ল্যানড, বলো? ঘুঘু ছেলে তো তুমি! এই বলে স্নেহ করে কাঁধে হাত রাখলেন একটা।
প্রসেনজিতদের সঙ্গে ঘুরতে একটু ইয়ে লাগছিল ইদানীং। ব্যাপারটা ঠিক নিরাপদ নয়। এই ঘটনার পর বিয়ের দিনের জন্য নিজেকে মোটামুটি প্রস্তুত বলে মনে হতে লাগল আমার। যা হবে দেখে নেব, এরকম একটা ভাব...”
এত কাণ্ড করে তবে শ্যামলীর বিয়ে। অপেক্ষা করে করে দিনটা যখন এল, যেন আর ফুরোতেই চায় না। সকাল সকাল বেরোবে রাহুল। মাকে দেখিয়ে দিয়ে আসে কী ধরনের শাড়ির চল আজকাল। ওঁরা সবাই গরদ পরছেন, এমনি সিল্ক নয়।
রাহুলই আলমারি ঘেঁটে গরদ বের করে দেয়। ভালো করে ছবি এঁকে দেখিয়ে দেয় কীভাবে বিয়েবাড়ি যেতে হবে। রাহুলের মা বিকেলে একা যাবেন।
রাহুল কাজের লোক বলে সাব্যস্ত হয়ে যাবার পর তার আগেই তলব পড়েছে। যতক্ষণে গিয়ে পৌঁছয়, দুপুর হয়ে গেছে অবশ্য। মেয়েরা হলুদ মেখে নাচানাচি করছে। প্যান্ডেল খাটানো হয়ে গেছে বাড়ির সামনে।
শ্যামলীর ভাই চিত্ত, রাহুলকে কাজে বহাল করে দেয়।
—তত্ত্বের প্যাকেটগুলো লিস্ট দেখে মেলাও, এক্ষুনি গাড়িতে তুলতে হবে।
—ঠিক আছে।
এসব লিস্ট মহিলারা অনেকবার আগেই চেক করে রেখেছেন জানে রাহুল, চিত্ত চলে গেলে সে লিস্ট পকেটে নিয়ে বাইরে চলে যায়।
আমাকে ছুঁয়েছে সে, আবার কখনো ছুঁতে পারে...
ছাতের উপরে ঘুরছে কেউ, শ্যামলী হতে পারে, কিন্তু বিয়ের দিন কোনো মেয়ে ছাতে ঘোরে না। অন্য কেউই হবে। রাহুল মনে মনে বলে—আসলে আমি কাজের লোক নই। একটুও খাটতে পারি না। কষ্ট হয়। সকাল সকাল এলাম শুধু ঘুর ঘুর করব বলে। আমি কোনো কাজের নই পলাশ, আমি একটা ভূত।
একটা বাচ্চা ছেলে ঘুড়ি হাতে বেরিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে। শ্যামলীদের আত্মীয়। রাহুল তাকে ঘুড়িটা উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। চারদিকে ইলেকট্রিকের পোল আর গাছ। ভয় হয়। কোথাও আটকে না যায়। একটু পরে বাচ্চা ছেলেটাকে তার মা এসে ডেকে নিয়ে যান।
সন্ধের আগে রাহুলের বন্ধুরা কেউ আসবে না। বনমালী হাসতে হাসতেই আসবে, ভুলভাল কথা বলে লোকজনকে হাসাবে বা চটাবে। পলাশকে সকলের সামনে এমন কিছু বলে দেবে যাতে দুকান ঠিক লাল হয়ে যাবে তার। সব বিয়েতেই বনমালী এরকম।
রাহুল ঘরের ভিতর গিয়ে ঢোকে—পুলিশি ব্যবস্থার কি হলো সেটা খোঁজ নেবে বলে। সোজা পলাশের মায়ের মুখোমুখি।
—একী, তোমার নতুন শার্ট?
—বিকেলে মা নিয়ে আসবে, এখন পরলে—কাজের মধ্যে—ময়লা হয়ে যেতে পারে।
—ভালো। বলে মহিলা দৌড়ে পালান।
এড়াবো এড়াবো করেও আবার চিত্তর নজরে পড়ে যায় রাহুল। বর আনতে বেরোচ্ছে তারা। ধুতি-ফুতি পরে বাবু।
—রাহুলদা তত্ত্বগুলো লোড করতে হবে।
—কোথায় আছে?
—সে কী? উপরের ঘরে! লিস্ট দেখে মেলালে না?
—এই তো যাব!
উপরের ঘরেই উঠে যায় রাহুল। শ্যামলীর ঘরে। বা শ্যামলীর প্রাক্তন ঘরে।
একটু হুলুস্থুল হয়ে আছে। রাঙতা দিয়ে মোড়া প্যাকেট সাজানো একদিকে। অন্যদিকে শ্যামলীর আলমারি। যার গায়ে আমির খানের পুরনো কিন্তু অম্লান ছবি।
টানতেই খুলে যায় আলমারির পাল্লা। ভিতরে শুধু জামাকাপড়। রঙিন। সেন্ট-এর বেশ উগ্র গন্ধ। ঝপ করে পাল্লাটা বন্ধ করে দেয়। পিছনে সরে আসে।
রাহুল ভাবে—এই তো ছিলাম নাস্তিক—যে যা বলে মানতাম। এখন আবার দেয়ালে সেই বেলুড় মঠের ছবি। বলছে বোসো। এখানে একা একা কতবার বসে চা খেয়েছি। হারানো বিশ্বাস খুঁজে পেতাম। একবার পলাশ স্নান করে এসে ভিজে চুলে টুক করে একটা নমস্কার করল আমার দিকে পিছন ফিরে। মনে হয়েছিল তার পিছু পিছু আমিও যে দরজাগুলো বন্ধ সেগুলো পেরিয়ে যাব।
আলমারির রহস্যও ভেদ হয়ে গেল। এ কদিন খুলতে সাহস হয়নি। যদি কিছু মনে করে। এখন খুলে দেখেছি কোনো লুকোনো রাইফেল কিম্বা তাকভর্তি চিঠি নয়। শুধু মেয়েলি জিনিসপত্র। যা না দেখেও কল্পনা করে নেওয়া যায়।
তবু দেখে নেওয়ার মূল্য আলাদা।
মাঝে মাঝে যদি অন্তত এই ঘরটাতে এসে বসতে পারি? গাঙ্গুলীদের বাড়ির দিকে চেয়ে? পর্দাগুলো আর থাকার দরকার নেই—খুলেই রেখে দেব আমি। চেয়ারে বসে—খাটের উপর পা তুলে—হু হু বাতাস খাব।
বেলগাছটার ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভেবে রাখা যেতে পারে। একটা না একটা কিছু মাথায় এসেই যাবে। পলাশ চলে যাওয়ার পর তার বাবা-মায়ের ঘাড় থেকে কীরকম একটা বোঝা নামবে তাও কল্পনা করতে পারি। উচ্চপদস্থ জামাই বলে যেমন গর্ব, তেমনই মেয়েকে নিয়ে পুজোপার্বণে, সামাজিক উপলক্ষ্যগুলোতে আর উদ্ভট গল্পগুচ্ছ উপহার পেতে হবে না। চিত্তর ভাবগতিক সুবিধের নয়—তাকে নিয়ে তো ভুগতে হবেই—কিন্তু পুরুষের কলঙ্ক কিছু থাকলেও তা গোঁফ-দাড়ির মধ্যে ঠাহর পাওয়া কঠিন। আর যে-কটা অবজেক্শনেব্ল ব্যাপার আছে—বেলগাছের দুর্নাম তার অন্যতম—সেগুলো পলাশ বিদায় হবার পর এক এক করে সরিয়ে ফেললেই হবে।
উঠে গিয়ে জানলার পর্দাটা সরিয়েই দেয় রাহুল। মুক্তকন্ঠে স্বীকার করে যে সে-ই এতদিন সবার চেয়ে অপরিণতমনস্ক ছিল। সবার মুখাপেক্ষী। এমন কি এই জানলা দিয়ে গাঙ্গুলীদের সঙ্গে সাংকেতিক ভাষায় কথা বলার ও দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছে কতদিন! শ্যামলী জানতে পারলে কুরুক্ষেত্র হয়ে যেত। হয় রাহুলকে মেরে ফেলত নয় সে দরজা ভেঙে পালিয়ে আর এবাড়িতে ঢুকতে পেত না। বেলগাছের উপর সত্যি যদি কোনো অপদেবতা চেপে থাকে তাহলে সেও জানে রাহুল জানলার কাছে এসে মিথ্যে করেই বলেছে—ভালো আছেন স্যার? দেখতে পাচ্ছি কিন্তু!
তাহলে সেটাই ঠিক রইল। শ্যামলী প্রস্থান করলেই চুপচাপ এঘরে এসে ঢুকবে রাহুল। ভাড়া নেওয়া যায় কিনা সে বিষয়ে কথা বলে দেখতে হবে শ্যামলীর বাবা-মায়ের সাথে। ইউনিভার্সিটির কাছে একটা পড়ার ঘর থাকলে মন্দ হয় না—আসবাব কিছু পাল্টাব না, আলমারিটা বন্ধই রাখব। বলুন ভাড়া দিতে রাজি আছেন কিনা?
দূর তাও কি হয়? অবাস্তব!
তাহলে চলি! বলে রাহুল। একবার ফাইনাল চেক আউট। কিছু চুরি করে নিয়ে যাচ্ছি কি? বই টই? আরেকটু ছোটোবেলা শ্যামলী সত্যি দাঁড় করিয়ে যেমন দেখে নিত। অথচ এখান থেকে কিছু চুরি করেনি কোনোদিন। বরং অন্যত্র থেকে না বলে আনা বা নিজের রিস্কে সরানো লাইব্রেরির বই দিতে এসে প্রত্যাখ্যান পেয়েছে। ব্যাগ খুলে দেখা—বলতো শ্যামলী—যে চোর সে চোর!
আর যে ভুখা? যে ডাকু? যে ইচ্ছুক? যে শুধু ময়লা?
পিছনের দরজা খলার একটা ক্যাঁ-আ-আ-আ-চ করে শব্দ। ঘুরে দাঁড়াতেই শ্যামলীর মুখোমুখি।
নীল শাড়ি। শ্যামলা রং। সবে সাজতে শুরু করেছে। চুলটা বাঁধা হয়নি। ভুরুতে কালো রঙ। দেখাচ্ছে কালবৈশাখীর মতো। সুন্দর ও দুরন্ত। রাহুলকে দেখে না চেয়েও লাল হয়ে যায় শাঁখালুর মতো।
—এখানে কী করছিস?
—প্রহর গুনছি। উদাস ভাবে বলে রাহুল। —হলুদ মাখলে গায়ে জ্বালা হয়?
—যা: ভাগ। শ্যামলী এসে আলমারি ঘাঁটতে থাকে।
রাহুল তত্ত্বের দু-দশটা প্যাকেট তুলে নিয়ে যেতে উদ্যত। সে ইচ্ছুক? সে ময়লা? সে কি কৃতজ্ঞ?
শ্যামলী থামায়। —শোন পাগলা!
—কী?
—আমি যাবার পর এবাড়িতে আসবি তো?
—কেন বলতো?
—এমনি। আসিস। ভাইটাকে দেখিস একটু। তোদের চেয়ে ছোটো।
—স্মার্ট আছে। বুদ্ধিতে বড়ো।
—ছাই। আসিস তুই।
—ওকে। তুইও আসিস।
—ঠিক আছে, এখানেই দেখা হবে মাঝে মাঝে।
রাহুল খেপে খেপে তত্ত্বের প্যাকেটগুলো নামিয়ে গাড়িতে তুলে দেয়। চিত্ত রাহুলকে আরো কিছু কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়বে। চিত্ত বলে যায়, রাহুল শুনতে চেষ্টা করেও ধরতে পারে না কী বলা হচ্ছে। অনেকক্ষণ পর বলে—আরেকবার বলবে একটু চিত্ত?
চিত্ত আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে এমনিই চলে যায়। তাদের গাড়ি বেরিয়ে যেতেই সব যেন ফাঁকা ফাঁকা। মেয়েরা সব কোথায় গিয়ে লুকিয়ে পড়েছে।
সিঁড়ি বেয়ে ছাতে উঠে যায় রাহুল। কেউ কোথাও নেই। দূরে কোনো জায়গা থেকে বরযাত্রী রওনা হতে প্রস্তুত। ছাতে উঠে বেশ কিছুক্ষণ একলাই বসে থাকে। সম্বিৎ ফেরে বাচ্চা ছেলের গলার আওয়াজে। ঘুড়ি লাটাই নিয়ে উঠে এসেছে যে মূর্তিমান।
এবার মনের সুখে ঘুড়িটা উড়িয়ে দেয় রাহুল। হু হু করে বইছে বাতাস। সুতো ছাড়তে ছাড়তে যতদূর সম্ভব দূরে পাঠিয়ে দেয় সাদা কালো ঘুড়িটাকে। অন্ধকার আকাশে প্রায় দেখাই যায় না। অনেকক্ষণ ওড়ায়। যতক্ষণ না আওয়াজ পায় গাড়ির, যতক্ষণ না নিচে উলুধ্বনির শব্দ।
—ঘুড়িটা এবার নামাতে হচ্ছে পিকলু। বর এসে গেছে বোধহয়।
—আমার নাম পিকলু নয়, বাবলু।
ভুলের জন্য দু:খিত। আই অ্যাপলোজাইজ।
জোর টানে নামায় ঘুড়ি। চড়চড় করে আকাশ চিরে বেরিয়ে যেতে চাইছে, যেন নামাই কঠিন। টানতে টানতে সাদা সুতোতেই হাত কেটে যাবার উপক্রম।
—গোটাতে পারছ বাবলু?
—হ্যাঁ, এই দেখো না!
নিচ থেকে দেবুদার পিসির গলা। —এসে গেছি! এসে গেছি আমরা!
কে পাগলা? কে চালু? কে ময়লা? কে মিথ্যুক?
প্রশ্নগুলো শুনে চরকির মতো ঘুরে গিয়ে ডাইভ দেয় সাদা কালো পেটকাটি। এই রে: বলে কিছু করার আগেই হাতের এত কাছে এসেও বোঁ করে দুর্বিনীত বেলগাছের ডালে। মন:সংযোগ কিছু নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তাই বাঁচানো যায়নি। ডালে গিয়ে আবার চরকির মতো দুপাক ঘুরে ভালো করে জড়িয়ে বসে থাকে।
—হলো তো বাবলু?!
—গুড গড!
ছেঁড়ে নি কিন্তু। সিরিয়াস চোট নেই।
সুতোটা গোটাও—বলে ছাত থেকে বেলগাছের ডাল ধরে ঝুলে পড়তে হয় রাহুলকে। বাড়ির সামনের দিক থেকে তদানীন্তন আওয়াজে ব্যগ্র কান রেখে। শ্যামলীও ঝুলিয়ে রেখেছে এরকম, এই ভেবে। ভাবতে ভাবতে ঝুলতে ঝুলতে গাছের বলিষ্ঠ কাণ্ডের কাছে গিয়ে পৌঁছয়। হাত বাড়ায়। ঘুড়িটা খুলে নিয়ে ছেড়ে দেয়। বাবলুকে বলে—তুমি গুটোও, আমি নামছি।
বর বরণ হচ্ছে। হুলুধ্বনি আর শাঁখের শব্দ। ছুটোছুটির সরগরম আওয়াজ। অনেকগুলো গাড়ির দরজা খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে।
বেলগাছ থেকে নামা ততটা সহজ নয়, উপলব্ধি হয় রাহুলের। ডালের দুদিকে কাঁচির মতো পা ঝুলিয়ে অবস্থার মূল্যায়ন করে। শ্যামলীর ঘরের ভিতরটা পর্দার ফাঁক দিয়ে একটু দেখা যায়। দোতলায় আর কেউ নেই অবশ্য। হুড়োহুড়ি করে নেমে গেছে বর দেখতে। কান খাড়া করে সেই দূরাগত ধ্বনি শোনে। জাগতিক, পার্থিব সমস্ত সংস্কার। সবই তো ভাঙার চেষ্টা করেছে। ইচ্ছে হয় মাটিতে নামতে পারলে দাঁড়াবে গিয়ে সে-সবের মধ্যে।
একটা সিঁড়ি আনাতে হবে নাকি? লজ্জার ব্যাপার। ভাবতে ভাবতেই গাঙ্গুলীদের মেয়েটার সাথে লোকোত্তর দৃষ্টি বিনিময়। যার সাথে বহুবার সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলার চেষ্টা করেছে, সেই মেয়েটা বিস্ফারিত চোখে আজ চেয়ে আছে তার দিকে। সাজগোজ করা। ছাতে উঠে এসেছে কখন। বর দেখে নামবে এই ভেবে বোধহয়। গাছের ঘন পাতার আড়ালে একটু অন্ধকার। রাহুল বুঝতে পারে না তাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে কিনা। হাত নেড়ে ফিসফিস করে বলে—অন্যদিকে তাকান! অন্যদিকে তাকান!
কিন্তু মেয়েটার চোখ সরে না। দেখতে দেখতে দু-চোখের তারা উঠে যায় উপর দিকে। মুখ দিয়ে অস্ফুট গোঁ গোঁ শব্দ। রাহুল গাছে আটকে পড়ে গেছে একটু। বোঝে, এখন ধরা অসম্ভব।
ওদিকে অফুরন্ত উলু। এদিকে চোখ কপালে তুলে অসহায় মেয়েটা আস্তে আস্তে ও অনিবার্যভাবে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে থাকে।
(সমাপ্ত)