• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭১ | জুন ২০১৮ | উপন্যাস
    Share
  • রাহুলের ডায়েরি থেকে : ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত





    || ২ ||

    রাহুলের ডায়েরি থেকে:

    “...শিমলার রাস্তায় ছাতাবাবু আমরা দুজন,
    আর গলিতে কালো পাদ্রী, গামবুটেতেই কেমন লাগে
    চমৎকার তাহাকে আজ, ছুটতে ছুটতে শরণার্থী
    মহুয়াবনে খোলা এক বিপ্রলব্ধার ভ্যানিটি ব্যাগ-এ।

    আকাশ দৈত্য, বাতাস দৈত্য—দ্যাখো তাহাদের কাণ্ডটা কী!
    যখন মন্মথ দিশে-হারা, গড্ডলিকার নিয়মবিরুদ্ধ
    সান্ধ্য এই সভা গোপনীয় জেনেও ক্ষান্তবৃষ্টি বিকেলবেলা
    একটি আষাঢ়ে জনশ্রুতি কিনা রটিয়ে দিলে বিশ্ব-শুদ্ধ!

    সত্য-মিথ্যায় বাহবা দে বনমালী, হায় মনের শক্ত জ্বরে
    রূপ লিখাইল—আমার সই নিল ছন্দে—শিখাইল ভালোবাসতে।
    কিন্তু কী লাভ? শুনেছিস কি, এসব কথায় হাসতে হাসতে,
    সাহেব স্কুলের প্রগল্‌ভ ছাত্রীরা গা টেপাটেপি করে?


    শিমলা, মানালী, কুলুতে, শীতের মধ্যে বনমালীকে সব কথা বলে ফেললাম। দেখতে দেখতে কথাটা ছড়িয়ে গেল। হারু, শ্যামল, জলধর, পোদ্দার। অনেক ডালপালা গজালো তার। পরে আমিই চিনতে পারি না। এই নাকি ঘটেছিল আমার আর পলাশের মধ্যে? আমি পিকনিকের দিন পলাশের হাতে বাঁ-গালে, সিঁড়িতে পলাশের মায়ের হাতে ডান-গালে আর গেট-এর কাছে ওর বাবার হাতে আবার বাঁ-গালে চড় খেয়েছি?

    বনমালী ভালো কাউন্সেলর। নিজের পয়সা খরচ করে মোমো খাওয়ালো, ডিমসেদ্ধ আর মাল খাওয়ালো। দুঃখটুঃখ ভুলেই যাচ্ছি সব। বৃষ্টির মধ্যে পলিয়েস্টারের ঘুড়ি কিনে এনে ওড়ালাম।

    বনমালীদের বাড়িটা দিল্লীর একেবারে পুরনোস্য পুরনো পাড়ায়। লাল পাথরের শহরে। রাত্রিবেলা দেয়াল থেকে রক্ত পড়ে। ফতেহপুরীর মসজিদের উপর আকাশ-আগ্রাসী চাঁদ। ঘুড়ি ওড়ে সবসময়। আর ছুহারাওয়ালা দুধ-এর গলি দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে কারা যেন সাইকেল চালিয়ে চলে যায়। বনমালী আমাকে রাস্তার ধারে ঠেলে দেয় নিরাপত্তার জন্যে। চোখ কান খোলা রেখে চলে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সিগারেট ধরাতে যখন জ্বলন্ত দড়ির মুখ খুঁজতে থামের ওধারে গিয়েছে তখন পাজামা পাঞ্জাবি পরা সুশ্রী একটি লোক আমাকে পটিয়ে-পাটিয়ে সিঁড়ির উপর এক ধাপ তুলে দেয়। সুন্দর তার কথাবার্তা। পান খাওয়া হাসিও মধুর।

    এই বাড়িগুলোও কয়েকশো বছর পুরনো। তলায় মোটর পার্টস-এর দোকান। বাথরুম ফিটিং-এর দোকান। উপরের ঘরগুলো থেকে ঘুঙুর আর হারমোনিয়ামের আওয়াজ আসে গভীর রাতে। দিনের বেলা মালগাড়ির আওয়াজে সব চাপা পড়ে যায়। বনমালী এগুলোকে বলে নার্সিং হোম। বিকেলবেলা কতো লোককে দেখেছি রাস্তার ওধারে হাঁ করে নার্সিং হোমের দিকে চেয়ে আছে।

    বনমালী সিঁড়ি দিয়ে উঠে চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। জানো আমি কার ছেলে? আমার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নামায়। এ পাড়ায় এসব কাজ কক্ষনো নয়। আরেকটু হলে বাবার নামটা বলে ফেলেছিলাম। সিঁড়ির উপর থেকে ধ্বক ধ্বক করে আগুন জ্বলে ওঠে। কেউ আমাদের গালাগাল করে। আমরা তাড়াতাড়ি অন্ধকার রাস্তা দিয়ে ফরাসখানা, হনুমানের গলি পার করে চলে যাই।

    জিলিপি ভাজা হচ্ছে মদের দোকানে। এত রাতে কে জিলিপি খায় রে? বনমালী শুনে অবাক হয়। এখানে কখনো রাত হয় না। চারশো বছর ধরে শুধু দিন। দিনের বেলাতেই অন্ধকার। তোকে সব চিনিয়ে দেব। জালের মতো পাতা আছে। কত সাপের গর্ত, কত গলি! মিষ্টি খাবি?

    বনমালী নিজে মিষ্টি খায় না। ছোট্ট ছোট্ট জাপানি সিঙাড়া, গজক, এসব খায় ওদের বাড়িতে। আমরা গলির মাথা থেকে গজকই কিনি। কোনোদিন দেখিনি এ-জিনিস। চিনতে হবে। বনমালীরা এই এলাকার পুরনো লোক। সত্তর বছর ধরে আছে। আর তিরিশটা বছর যদি থাকতে পারে... তাহলে একটা ঐতিহ্য হয়ে যাবে মনে হয়। কতদিন থাকবি তোরা এই বাড়িতে? জিজ্ঞেস করলে হাসে বনমালী। ফরএভার। মির্জা গালিব-এর বাড়িটা দেখেছিস? কয়লা বিক্রি হয়। গালিব বেঁচে থাকলে হাসতেন। খুশিই হতেন। এমনই তো লোক ছিলেন তিনি। গলির লোক। জুম্মা থেকে কাশ্মীরী গেট, বরফখানা থেকে আজাদ মার্কেট শুধু গলি দিয়েই ঘুরে আসা যায়। একবারও বড়ো রাস্তায় নামতে হবে না। প্রত্যেকটা গলির গন্ধ আলাদা। চোখ বুজে শুধু গন্ধ শুঁকেই হাঁটা যায়। ধর যদি সদর বাজার থেকে হাঁটতে শুরু করিস। প্রথমে ঘোড়ার গন্ধ। সেটা পেরিয়ে ঢুকে পড়লি মশলার গলিতে। হিং, জয়িত্রী আর এলাচের কক্‌টেল একটা গন্ধ। তারপর বাতাসা-ওয়ালা গলি, চিনি চিনি গন্ধ, নয়া বন্‌স-এ ঢুকে পেলি পান শুপুরির আড়ত। তার একটা হালকা ঝাঁঝালো পাতা পাতা গন্ধ। ছুহারাওয়ালা দুধ-এর মিষ্টি রাবড়ির গন্ধটা পাওয়া মাত্রই ডানদিকে দুটো সিঁড়ি পাবি। আমি তো এভাবে গন্ধ শুঁকে কতোবার বাড়ি ফিরেছি।

    বনমালীকে বললাম—চ আমরা দেবুদার সঙ্গে কথা বলে আসি একদিন।

    বনমালী আমাকে আড় চোখে দেখে।—ঠিক আছে যাব। ক্লিন ব্রেক করলেই ভালো হত না? বেশ তো উঠে যাচ্ছিলি নার্সিং হোমে। যেতে দিলেই পারতাম।

    যেতে দিলেই পারত! আমার আর কি আছে, যা বাঁচিয়ে রাখব? মির্জা গালিব যেতেন না? বনমালীকে সেকথা বললে ও বলবে—গালিবের মতো লিখতে পারবি?

    ক্লিন ব্রেকই করব। কিন্তু এভাবে পালিয়ে পালিয়ে নয়। এতে আমার শরীর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জ্বর জ্বর লাগে সবসময়। বনমালীকে বললাম। খুবই করুণ শোনাচ্ছিল নিশ্চয়। নিজেকে করুণ করে ফেলতে একেবারেই ভালো লাগে না আমার।

    সে বললো—ভালো করে ঘুমো। আজ আর বাড়ি যেতে হবে না। থেকে যা। একটা ফোন করে দিচ্ছি... বুঝলি...?”


    **********

    রাহুলের ডায়েরি:

    “... বনমালীর কুকুরটা গভীর রাত্রে একবার ভুক ভুক করে। বনমালী আমাকে আশ্বাস দেয়। চোর নয়, পানের গুদামে লোক ওঠানামা করছে। তখনই আশ্চর্য ভাবে পানের গুদামের লোকের সাথে আমার চোখাচোখি হল।

    ওদের বাড়ির চালে শাজাহানের পায়রা। দোতলার এক চিলতে আকাশে ম্যাজিক কার্পেট-এর মতো ভেসে আসে মেঘ...

    ... আমি কে?

    আমি একটি শাপভ্রষ্ট যক্ষ। সমস্ত মহিমা আমার অস্তগত। দুটো টিউশনি ছিলো, দুটোই গেছে। একদিন গিয়ে দেখলাম একটা মাদ্রাজী লোক পড়াচ্ছে আমার ছাত্রীকে। চা আর চানাচুর খাইয়ে বিদায় করে দেওয়া হল।

    বাড়িতে গিয়ে পাঁচ দিনে পঁচিশটা কবিতা লিখলাম। সাগরিকা, শকুন্তলা, আর লাজুকলতা নাম্নী মহিলাদের উদ্দেশ্যে। আসলে পলাশকে উদ্দেশ্য করেই লেখা। একটাও ভালো হয় নি। বনমালী বলল—আগুনে দে। জলধর বলল—সহমরণে যা। শিমলা যাবার আগে একটা নতুন খাতা কিনলাম। নতুন করে সব শুরু করব বলে। কুফরিতে গিয়ে বরফ ছোঁড়াছুঁড়ি করলাম। গোবিন্দার স্যুটিং দেখলাম। চমরী গাই দেখলাম। কিমি কাতকারকে দেখব বলে সারাদিন হাঁটাহাঁটি করলাম মল-এ। রাতে কালিবাড়িতে ফিরে নোংরা বিছানায় গা দিতেই ঘুম। সেরে যাচ্ছিলাম। একদিন সকালে ওরা বলল—দ্যাখ আমরা দিল্লী ফিরে যাচ্ছি। তুই যতদিন থাকবি থাক...”


    **********


    রাহুলের ডায়েরি:

    “... বেস্ট মানে কি? আমি অনেক ভেবেছি এ নিয়ে। বনমালীকে জিজ্ঞেস করলাম। তোর কি নিজেকে কোনো বিষয়ে বেস্ট বলে মনে হয়? বনমালী ভেবে চিনতে বলল—আমি নয়া বন্‌স-এর বেস্ট প্রাইভেট টিউটর হলেও হতে পারি। সম্প্রতি একটি ভীষণ বোকা ছেলেকে ক্লাস সেভেন থেকে এইট-এ তুলে দিয়ে ওর দারুণ আত্মবিশ্বাস হয়েছে।

    এই শ্রেষ্ঠতা নিয়ে তুই কতদূর যাবি বনমালী? পলাশের মতো মেয়েরা কি প্রেম করার জন্য প্রাইভেট টিউটর খুঁজছে?—তোর আর কোনো যোগ্যতা আছে?

    —নেই, কিন্তু আস্তে আস্তে হবে। গ্র্যাজুয়েট হব। ব্যাংক-এর পরীক্ষাগুলো দেব। একটা না একটায় লাগিয়েই ফেলব। বস-কে বোঝাব আমি কত বুদ্ধিমান। এইভাবে উঠতে থাকব। শ্রেষ্ঠ থেকে শ্রেষ্ঠতর।

    কিন্তু যেখানেই যাবি, তোর একটা বস থাকবে। তার উপরে বস-এর বস। তিমির উপরে তিমিঙ্গিল। কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে কে জানে। পলাশ তাকিয়ে আছে ইনফিনিটির দিকে। শ্রেষ্ঠতর বলে কিছু হয় না। বেস্ট মানে বেটার নয়। বেস্ট মানে বেস্ট।

    —সেরকম বেস্ট আমাদের পাড়া থেকে বেরোয় না।

    বনমালী কথাটা বলেই বুঝতে পেরেছে কত বড়ো ভুল। গালিব বেরিয়েছিলেন। হানিফ মুহম্মদও এখানেই কোথাও থাকতেন। এখন সব কয়লার দোকান হয়ে গেছে অবশ্য। কিন্তু শ্রেষ্ঠরা সব জায়গাতেই আছে বা ছিল। এড়াবার উপায় নেই।

    মেয়েদের মনে শ্রেষ্ঠদের জন্য একটা আলাদা ফুটপাত থাকে। গাভাস্কার, অমিতাভ, আমজাদ আলিদের জন্য সংরক্ষিত। যাতে এঁদের পায়ে ধুলো না লাগে। শ্বেতপাথরের তৈরি। গোলাপজল দিয়ে ধুয়ে মুছে তকতকে করা। মুখ দেখা যায়।

    বনমালী আমায় বলল—পলাশের এত শ্রেষ্ঠতার বাতিক কেন? একটু কম্প্রোমাইজ তো সকলেই করে? আমরা করছি না?

    তখনই বুঝলাম যে বনমালী আর আমার খাটিয়ার মাঝখানেও একটা অতল খাদের ব্যবধান রয়ে গেছে। পলাশকে তো আমি শ্রেষ্ঠ বলেই দেখি। বেস্টরা বেস্টদের চাইবে না? ...”


    **********


    শ্যামলীকে সোজাসুজি জিজ্ঞেসও করেছিল রাহুল। শ্রেষ্ঠতার বত্রিশটা লক্ষণ কি কি? গাভাস্কারও তো বেঁটে।

    —আমির খানের মতো?

    —ফিল্মের লোক হলে চলবে না। বলেছিল শ্যামলী। ওদের কোনো ক্যারেক্‌টার নেই।

    —তাহলে কি রকম?

    —তুই বুঝবি না। এসব বোঝানো যায় না। আমি ঠিক চিনে নেব।

    রাহুলের একটু অভিমান হয়েছিল। বেস্ট কিরকম সেটা ঠিকঠাক বোঝা গেলে সে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখত সেরকম হওয়া যায় কিনা। ইচ্ছে করেছিল শ্যামলীকে খোঁচা দিয়ে কিছু বলে।

    —‘না’ বলে দিয়েছিস যখন, তখন এই ছবিগুলো রেখেছিস কেন, বল তো? জিজ্ঞেস করেছিল রাহুল। যাদের ফুটিয়ে দিয়েছিস তাদের অ্যালবাম বানাবি নাকি?

    চটে গিয়েছিল শ্যামলী। কিন্তু রাগ করেনি।

    —তোর এত জেনে কি হবে? ছবিগুলো ফেরৎ চায়নি ওরা, তাই রেখেছি। অফিসিয়ালি এখনও না বলা হয় নি। আমার মত নেই।

    —বাহ:। ভেরি গুড। তারিফ করেছিল রাহুল। —ভালো খেলছিস। বুদ্ধি হয়েছে তোর।

    —তোকে জ্ঞান দিতে হবে না। ওরাই যেচে ছবি পাঠিয়েছে। আলাপ করতে চেয়েছিল। আমি রাজি হইনি। এখনো ঝুলোঝুলি করছে। দাঁড়া আরেকটা ছবি আছে।

    শ্যামলী বাদামী খামের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে কি যেন খুঁজতে থাকে। একটু পরে আরেকটা ছবি বেরোয়। সেটা হাতে পেয়ে হাসি ফোটে শ্যামলীর মুখে।

    —এটা একটু ইন্টারেস্টিং কেস। বলতো ছবিটা কার?

    রাহুল হাত বাড়িয়ে ছবিটা নিয়েছিল। ছোট্ট পাসপোর্ট সাইজ ছবি। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট। এরকম ছবি শ্যামলীর কাছে এল কি করে?

    ছবিটা দেখে আরো চমকে গিয়েছিল রাহুল। লম্বাটে মুখ। ছোটো ছোটো করে কাটা চুল। একটু অস্থির দৃষ্টি। ক্যামেরার দিকে নয়।

    —দেবুদা না?

    মুখ টিপে হেসেছিল শ্যামলী।

    —এবার বল!

    রাহুল বেশ নাড়া খেয়েছিল। ছবিটা হাতে করেই সে খানিকক্ষণ বসে থাকে। কিছুক্ষণ কথা ফোটেনি তার মুখে। শ্যামলী কি দেবুদাকেও প্রত্যাখ্যান করবে?

    —ওর বিষয়ে যা জানিস সব বল আমায়। কিছু লুকোবি না। শ্যামলী গ্যাঁট হয়ে বসেছিল খাটের উপর। উৎসুক মুখে।

    রাহুলের মনে হয়েছিল হঠাৎ অনেক কিছু নির্ভর করছে তার উপর। শ্যামলী অনুরোধ করা সত্ত্বেও সে আর মাছের ডিমের বড়া খেতে পারেনি। খিদে ছিল না।

    কিংবা অন্য কিছুও হতে পারে।


    **********


    দেবুদারা ওদের চেয়ে পাঁচ-ছ বছরের সিনিয়র। স্কুলের মাঠে লম্বা একটা ছেলে ছক্কা মেরে বল গায়েব করে দিত। দূর থেকে তাকেই দেবুদা বলে চিনেছিল রাহুল। তখনও তার হাফ-প্যান্ট। ক্লাসের একটি দুটি ধাড়ি মেয়ে সবে ব্রা পরতে শিখেছে। কোত্থেকে এসব খবরও পেত রাহুলরা। সম্ভবত মেয়েরাই গর্ব করে জানান দিয়েছিল। তাদের কাছেই খবর পেয়েছিল যে পলাশ এখনও ‘গেঞ্জি-পরিয়ে’দের দলে। ক্লাসের কিছু খচ্চর ছেলে একদিন টিফিনের সময় জলধরকে নিয়ে ডেস্ক-এ ডেস্ক-এ ঘুরছে। জলধর তখন নতুন এসেছে এবং একেবারে ধোপার গাধার মত সরল। অসম্ভব ঢোলা হাফ-প্যান্ট পরে স্কুলে আসত। আর দুই নাক দিয়ে ক্রমাগত ঝোল গড়াত তার।

    জলধররা ছিল যমুনা পারের বাসিন্দা। যেসব উদ্বাস্তু বাঙালরা চিত্তরঞ্জন পার্কে জায়গা পায়নি, তাদের অনেকে ওখানে বাড়ি করেছিল। বলতে গেলে তারাই রাহুলদার স্কুলটাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। গরীবদের স্কুল বলে খ্যাতি ছিল তখন স্কুলটার।

    জলধরকে নিয়ে সেই খচ্চরদের দলটি ডেস্ক-এ ডেস্ক-এ যাচ্ছে আর বলছে—জলধরের জন্য চাঁদা তুলেছি। বই-টই কিনে দিতে হবে। ওর বই নেই? জিজ্ঞেস করলে বলছে—কেনা হয়নি, ওরা গরীব আছে একটু। জলধরও হাঁ করে সব শুনছে আর সায় দিচ্ছে।

    পলাশদের বেঞ্চ-এর কাছে গিয়ে চাঁদা চাইল। ঠিক কি কথা হল কেউ জানে না। রাহল পরে শুনেছিল ডি-সুজা, মাইতি এরা নাকি পলাশকে বলছে—তোর গেঞ্জি ছোটো হয়ে গেলে জলধরকে দিতে পারিস। ও পরতে পারে।

    ব্যাপারটা প্রিন্সিপাল স্যার অবধি গড়িয়েছিল। ডি-সুজারা বেতের বাড়ি খেয়ে এসে বুক চিতিয়ে বলল—লোকের ভালো করতে গেলে এর’মই হয়।

    জলধর নতুন ছেলে বলে সেবার ছাড়া পেয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে সে ক্লাসের মেয়েদের যমের মতো ভয় পেত।


    **********


    শ্যামলীর গেঞ্জি কবে ছোটো হয়ে গিয়েছিল সে খবর পায়নি রাহুল। হয়তো একদিন মাঠে দাঁড়িয়ে দেবুদার ছক্কা দেখতে দেখতেই টপ করে হয়ে গিয়েছিল কাণ্ডটা। হয়তো কোনো শব্দ হয়েছিল। হয়তো রাহুল যেতে যেতে সেই শব্দ শুনেছিল এবং ভেবেছিল তারই শার্ট-এর বোতাম ছিঁড়ে গেল একটা।


    **********


    রাহুল এই নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে বড়ো হবার পর। ইউনিভার্সিটি থেকে কদাচিৎ হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরার পথে স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখেছে দু-এক দিন। তখন এইসব অ্যাডাল্ট চিন্তা মাথায় আসত তার। আস্তে আস্তে দৌড়ে গিয়ে গোলপোস্ট-এর মাঝখানে ক্রসবার-টা ধরে ঝুলে পড়ত রাহুল।

    এই মাঠেই অনেক গোল খেয়েছে তারা। দিয়েছেও ততোধিক। বাঁদিক দিয়ে জলধর খ্যাপা গণ্ডারের মতো বল নিয়ে এগোত। নিচু ক্লাসের কত বাচ্চাদের মাড়িয়ে যেত তার ঠিক নেই। একেবারে গোল লাইন-এ গিয়ে সেন্টার করার আগেই হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে পড়ে যেত—উফ... বলে। রাহুল খেলত রাইট ইন। খেলার মাঠে সে বেস্ট হবার চেষ্টাই করেছে চিরকাল। কিন্তু ফুটবলে কোনোদিনই পুরোপুরি পেরে ওঠেনি। তীর্থ সেন বলে একটা ছেলে ছিল। অদ্ভুত পায়ের কাজ। পরে বড়ো টিমের হয়ে খেলেছে। সেইই ছিল বেস্ট।

    দেবুদাকে স্কুলের বাইরে দেখেছে ফুটবল খেলার মাঠেই। আম্বেদকর স্টেডিয়ামে ডিসিএম বা ডুরান্ড-এর খেলায়। বিরাট দলবল নিয়ে আসত ওরা। সব ইস্ট বেঙ্গলের সার্পোটার। পাঁড় বাঙাল। দু-টাকার গ্যালারির একটা অংশ দখল করে বসত। তখন পাঞ্জাবের দলগুলো এতটা ওঠেনি। কেরালার টিমের নামই শোনেনি কেউ। ফুটবল মানেই বাঙালি। দর্শকদের মধ্যে ছিল তিনটে দল। জুম্মা মসজিদ থেকে মাংসের দোকানের মালিকরা আসত মোহামেডান স্পোর্টিং-এর খেলা দেখতে। তাদের কোর্তার ঢোলা পকেটে হাজার হাজার টাকা অনায়াসে ফেলা থাকত। কোন দল জিতবে তাই নিয়ে বাজি রাখত এরা। দ্বিতীয় দলটা ছিল পাঞ্জাবীদের। পাঞ্জাব পুলিশের বা জেসিটি-র সার্পোর্টাররা। সিট-এ বসা ইস্তক অকথ্য গালাগাল করত সমস্ত খেলোয়াড়দের। নিজের টিমকেও ছাড়ত না। তারপর শেষের দিকে চেয়ার-ফেয়ার তুলে একটা মারামারি। তৃতীয় ও বৃহত্তম দলটা ছিল বাঙালিদের। মোহনবাগানের চেয়ে ইস্ট-বেঙ্গলের সমর্থকই বেশি। রাহুল ছিল মোহনবাগানের সার্পোটার। মোহনবাগানের সার্পোটাররা বেশি লম্ফঝম্প করত না।

    কলকাতার টিম জিতলে দু-টাকার গ্যালারি ফেটে পড়ত। ইস্ট বেঙ্গল হলে তো কথাই নেই। ডিসিএমের সেমি ফাইনালে জেসিটি-কে ইস্ট বেঙ্গল হারাবার পর গ্যালারির উপর জেসিটি মিল্‌স-এর বিরাট সাইনবোর্ডটাই জ্বালিয়ে দিল ইস্ট বেঙ্গলের ফ্যানরা। অধিকাংশই যমুনা-পারের বাঙালি। চিত্তরঞ্জন পার্ক-এর পয়সাওয়ালা বাঙালিরা এরকম আগুন নিয়ে খেলবে না। দূর থেকে এদের তাণ্ডবনৃত্য দেখেছে রাহুলরা। পুজোর সময় যমুনার তীরে মাইক লাগিয়ে এই নাচই আবার নাচবে তারা। দিল্লী গেট-এর বাইরে রাস্তার উপর আধমাইল এলাকা তখন কাঁপিয়ে দিত বাঙালি ছেলেরা। পুলিশ ডাকতে হত।


    **********


    রাহুলের ডায়েরি থেকে:

    “...ডিসিএমের ফাইনালে মোহনবাগানকে তিন গোলে হারালো ইস্ট বেঙ্গল। দুর্দান্ত খেলেছিল ভাস্কর গাঙ্গুলী, পিন্টু ব্যানার্জি। মামা পুরনো ফুটবল-প্রেমিক। দিল্লীতে একটা ছোটো টিম নিয়ে বহুদিন খেলিয়েছে। শিমলা ইয়ং-এর কাছে আট দশ গোলে সে টিম যেদিন হারত সেদিন মামার মুখে এরকম একটা ভাব দেখেছি। নির্বিকার অথচ কেমন গম্ভীর। বাড়িতে এসে কড়া এক চা খেত চুপচাপ বসে। তারপর ঝোলা থেকে স্পেয়ার মোজা, অ্যাংক্‌লেট, এসব বের করে তুলে ফেলত একটা কাঠের দেরাজে।

    রক্তের ভিতর ফুটবল থাকলে এরকম হয়। দাদু মোহনবাগানে খেলতেন। চোখে দেখিনি তাঁকে কোনোদিন। বাইরের ঘরে একটা বড়ো ছবি দেখেছি। হিটলার-কাট গোঁফ। সারাদিন ডাম্ব-বেল আর মুগুর ভাঁজতেন। মামারা কেউ ওদিকে যায়নি। মুগুর-দুটো ছোটোবেলা আমি দু-একবার ঘুরিয়েছি। আপাতত সেগুলো মামাবাড়ির রান্নাঘরের এক কোণে বসে ধোঁয়া থেকে তেল খাচ্ছে।

    মামা নিজে ফুটবল খেলতে পারেনি, তাই খেলোয়াড় তৈরি করার দিকে মন দিয়েছে। এর বাড়ি ওর বাড়ি থেকে ছেলে ধার করে খেলানো হয়। সমস্ত সরঞ্জাম নিজের পকেটের পয়সায়। আমি মামাকে বহুবার বলেছি আমায় টিমে নিতে। চান্স পেলে দেখিয়ে দেব। কিন্তু আমার রোগা পায়ের শট দেখে মামা স্রেফ না বলে দিয়েছিল।

    শীতকালে অফিস থেকে ফিরে মাঝে মাঝে মা টিমের মোজা চাইত একটা।

    —মেজদা, তর ওই টিমের মোজা একটা আমায় দিবি? হাঁটু অবধি ঢাকলে বড়ো আরাম হইব।

    কিন্তু টিমের জিনিস মামা কাউকে দেয়নি। আমরা মাঝে মাঝে নতুন মোজা, জার্সি, হাফ-প্যান্ট এসব হাতে নিয়ে নাক ডুবিয়ে গন্ধ শুঁকতাম। লোহার লম্বা হুইসেল-এ ফুঁ দিতাম। ছোটো ছোটো পুরনো কিছু কাপ আর শিল্ড পড়ে ছিল, সেগুলো দেখতাম ।

    —ক্যান দিবি না? তর ওই প্লেয়ারদের সেয়ে আমি ভালো খেলি। উত্তেজিত হয়ে বলত মা।

    মামার কিন্তু নিজের প্লেয়ারদের উপর ভরসা ছিল। দশের বদলে সাত গোল খেলে সেটাকে অনেক সময় জয় বলেই ধরা হত।

    —ভালোই খেলসে রে ওরা আজ। ইমপ্রুভ করতাসে।

    মা মোজা না পেয়ে চটে গিয়ে বলত—রাখ তর ইমপ্রুভ করতাসে। আমি যদি পোলা হইতাম তাহলে দেখতিস টিমরে কোথায় লইয়া যাইতাম।

    আসলে মা ফুটবলের কিছু বোঝে না। দাদুর কাছ থেকে অদ্ভুত একটা ব্যাক পাস শিখেছিল যদিও ... ফুটবলে বলতে গেলে ওইটুকুই আমার উত্তরাধিকার। মনে করে পরবর্তী জেনারেশনে ফরওয়ার্ড পাস করে দিতে হবে।

    মোহনবাগান যেদিন তিন গোল খেল, আমি আর মামা আম্বেদকর থেকে বেরিয়েছি। মামা বলল—প্যাটিস খাবি? আমরা বাইরে স্টল থেকে চিকেন প্যাটিস কিনে খাচ্ছি। মাঠের ওইদিকটাতে অনেকক্ষণ ধরেই হই হই হচ্ছে। আমরা ভিড়টা একটু কমলেই বাস ধরে ফেলব। এমন সময় দেখি রায়ট পুলিশের একটা বড়ো দল মার মার বলে কাদের তেড়ে যাচ্ছে।

    নিরাপদ দূরত্ব থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখি বাঙালি ছেলেদের সাথে কাদের লড়াই থামাতে না পেরে পুলিশ নেমে পড়ে এলোপাথাড়ি লাঠি চালাচ্ছে। আমরা অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছি পুলিশের একজন বড়োকর্তা প্লেন ড্রেস-এ পুরো অপারেশনটাই ডিরেক্ট করছেন। মারামারিটা এখানে বন্ধ হয় তো ওখানে শুরু হয়। বাস-ফাস থেমে গেছে। রাস্তার মাঝখান দিয়ে দুদ্দাড় করে লোক ছুটছে।

    এমন সময় স্টেডিয়ামের ভিতর থেকে একদল ছেলে উর্ধশ্বাসে দৌড়ে বেরিয়ে এল। বাঙলায় কাঁচা খিস্তি করছে তারা। তাদের পিছু পিছু লাঠি-পুলিশ। প্লেন ড্রেস-এ যে বড়োকর্তাটি ছিলেন তিনি একটু এগিয়েছেন ছেলেগুলোকে ভড়কে দেবার জন্য, এমন সময় ওদের মধ্যে থেকে লম্বা মতো একজন ছুটে এসে ক্যাঁৎ ক্যাঁৎ করে তাঁর পাছায় জুতো পায়ে লাথি কষাতে শুরু করল। বড়োকর্তা আর সঙ্গীরা এরকম অভাবনীয় ঘটনা ঘটতে পারে আশাই করেনি। দু-চার মুহূর্ত হতভম্ব সকলেই। ছেলেটা ততক্ষণে লাথি মারা শেষ করে সন্তুষ্ট মনে একবার অন্য একজনকে মারতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বেশিদূর যেতে হল না অবশ্য তাকে। আধ মিনিটের মধ্যে ছ-সাত জন পুলিশ গিয়ে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে এল। অতগুলো লোকের মধ্যে শুধু তার হাতেই হাতকড়ি পরিয়ে ভ্যানে তুলে দেওয়া হল।

    মামা আর আমি হাঁ করে দেখছি। মামা বলল—ছেলেটা কে? আমি বললাম—দেবুদা। আমাদের স্কুলের ছেলে। মামা বলল—রেকলেস। কেরিয়ারটা নষ্ট করে ফেলল। পুলিশকে কখনো মারতে হয়? আমি বললাম—দারুণ ব্রিলিয়ান্ট। সব জায়গায় নাম ডাক। কোনো একটা বড়ো কোম্পানিতে চাকরি করে। ইউনিভার্সিটির টপ স্কোরার। রেকর্ড করেছে নাকি। মামা বলল—এবার পুলিশ রেকর্ড করে আর সব রেকর্ড ভেঙে ফেলবার তাল করছে!

    একে মোহনবাগানের শোক। তার উপরে এই ঘটনা। খুবই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বাড়িতে ফিরলাম আমরা দুজন...”


    **********


    রাহুল একমনে সেই দেবুদার ছবি দেখছে। ডিমের বড়া খাবে না। মুখেও কোনো কথা নেই।

    পুলিশ রেকর্ডটা হয়নি যতদূর জানা গিয়েছিল। বাংলা স্কুলেরই ভাইস প্রিন্সিপাল তারাদাসবাবুও মাঠে ছিলেন। মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের স্কুলের ছেলেদের।

    —কিছু বল গবেট। চোখ ফেরাতে পারছিস না! তুইই প্রেমে পড়ে গেলি নাকি? শ্যামলী অধৈর্য হয়ে পড়ছে।

    অনেকক্ষণ সময় নিচ্ছে রাহুল। অনেক দায়িত্ব তার। একটি শ্রেষ্ঠ মেয়ের পাত্র খোঁজার ভার তার উপর। মেয়েটির প্রতি নিজের ভালোবাসা যেন ভালো জাজমেন্ট-এর অন্তরায় না হয়।

    ছবি থেকে চোখ তুলে একটিবার দম নিয়েছে রাহুল। আর অপেক্ষা করেনি। করমর্দন করবে বলে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে সে।

    —হি ইজ দ্য বেস্ট। কনগ্র্যাচুলেশনস, পলাশ!


    **********



    || ৩ ||

    রাহুলের ডায়েরি থেকে:

    “... ক্লাবটা বোধহয় আর মামার হাতে থাকবে না। লক্ষ্মীনগর, গান্ধীনগর, সীলামপুরের ছেলেরা নিয়ে নেবে। মামা বলল—আপদ যাবে, আমি তো বাঁচবো।

    কিন্তু আমাদের সবার মনে একটু একটু দু:খ আছে। আসল কথা, দিনকাল পালটাচ্ছে। অনেক রকম ভাবে টের পাওয়া যায়। যানবাহন বাড়ছে। কত লোক গাড়ি কিনে ফেলল গত বছর। আগে স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখতাম ওল্ড সেক্রেটেরিয়ট থেকে লাইন করে সাইকেল চলেছে। অ্যাটলাস আর হিরো। মামার সাইকেলটা ছিলো একটু পুরনো। ছাব্বিশ ইঞ্চি হারকিউলিস। বেশ ভারি। এখন সেই জায়গায় বাজাজ, হিরো হন্ডা, মারুতি।

    লোকজন পালটে যাচ্ছে। আগে পাঞ্জাবীরাই বেশি ছিল। পাড়ায় দোতলা জেড টাইপ কোয়ার্টারের মাঝখানে একটু খোলা জমি। তাতে রাত্রিবেলা সার সার খাটিয়া পেতে দেওয়া হত। জল ছিটিয়ে ভেজানো হতো পাথরের শান। একটু ঠান্ডা হয়ে গেলে স্ত্রী-পুরুষ ছেলে-মেয়ে সবাই বাইরে খোলা আকাশের নিচে শুতাম। একটা টিমটিমে ল্যাম্প-পোস্ট ছিল। কত তারা ছিল আকাশে। পাশের বাড়ির সিন্ধিদের কালো কুকুরটা ঘুরে পাহারা দিত। তাও চেয়ে বড়ো ভরসা ছিল সর্দার জার্নেল সিং। তার খাটিয়ার পাশে বাঁধা থাকতো একটা মোষ। সকালে উঠেই একটা বালতি পেতে দুধ দুয়ে নেওয়া হতো তার। মা বলতো—আমিও পারি। আমাদের ছাগল ছিল তো সি কোয়ার্টারে থাকতে! নিজের হাতে দুধ দুইয়ে খেতাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের কথাই বলছি। মার্কিনিরা এসে সেই যে ডিডিটি ছড়িয়ে গেল বুঝলি, তারপর তিরিশ বছর কোনো মশা দেখিনি এখানে। তারপর জনতা পার্টি পাওয়ারে এল। এখন আর কোথাও সেফটি আছে?

    সেই ছাগল দোয়ানোর আরো গল্প শুনেছি। অর্থাৎ প্রত্যেক দিন একটু একটু করে কি ভাবে একটা শহর পালটে যায়। মা বলতো—দ্যাখ তখন এত পাঞ্জাবী ছিল না এখানে। পার্টিশনের পর ওরা হুড় হুড় করে ঢুকে পড়ল। কোত্থাও থাকার জায়গা নেই। পয়সা নেই। তার মধ্যেই আশ্চর্য হিকমতি লোকগুলো। দোকান-ফোকান করে ঠিক দাঁড়িয়ে গেল কয়েক বছরের মধ্যে। আমরা বাঙালিরা সেই সরকারি চাকরি নিয়েই পড়ে আছি। মা গল্পটা ভালো বলে। মেজদার একটা পাঁঠা ছিল। বুঝলি। তার নাম কালু। একেবারে কুচকুচে কালো পাঁঠা। তার মার বাঁটে থলি বাঁধা থাকত। লোক এসে বেড়িয়ে আনত ছাগলগুলোকে। ফিরে এলে দুধ দোয়াতাম। তারপর কালুকে ছেড়ে দেওয়া হতো। লাফাতে লাফাতে গিয়ে মায়ের পেটে ঢুঁ মেরে নিজের বরাদ্দ দুধটা সে বের করে নিত।

    যাই হোক, ঠিক করা হল, কালু বড্ড বড়ো হয়ে যাচ্ছে। অতো বড়ো পাঁঠা সামলানো মুশকিল। মুসলমান কষাইকে বলা হলো কালুকে তুমি নিয়ে যাও। আর কি। একদিন মেজদা বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরে—আমার কালু কই, বলে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করে তুলল। কোথায় কালু? পুরোটা আর নেই। তবে কিছুটা আছে ওই হাঁড়ির মধ্যে। মেজদা হাঁড়ির ঢাকনা তুলে দেখল কোর্মা হয়ে পড়ে আছে কালু। সে কি কান্না!

    রাত্রিবেলা সবাই যখন খেতে বসেছে, দেখা গেল মেজদাও বসে পড়েছে মুখ মুছে। কোনো বিকার নেই। একসময় শুধু বলল—আমার কালুর মাংস, আমি বেশি খাব!

    মামা এসব শুনে মৃদুমন্দ হাসে। এরকম অনেক গল্প আছে মার স্টকে। চোখের সামনে সেই দিল্লীকে দেখতে পাই। লুত্যেন-এর দিল্লী। দৃষ্টিপাত-এর দিল্লী। নেহেরুর দিল্লী। বাঙালিদের তিনটে পকেট। গোল মার্কেট। কাশ্মীরি গেট। আর টিমারপুর। কটা পুজো হতো? মাত্র দুটো—নিউ দিল্লী কালিবাড়ি তখনও হয়নি। তিস হাজারির কালিপুজোটা কি ছিল? ইতিহাসের বই ঘেঁটে দেখতে হবে। দুর্গাপুজো হতো কাশ্মীরী গেট আর টিমারপুর-এ। বলদ-টানা গাড়িতে করে প্রতিমা বিসর্জনের শোভাযাত্রা বেরোত। এই একটা ব্যাপার এখনও বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। আর সমস্ত প্রতিমা আসে ট্রাক-এ। কাশ্মীরী গেট এখনও জোড়া বলদের গাড়ি আনে। গরীব বলে টিমারপু্রের অবশ্য একটাই বলদ।

    সেসব দিন চলে গেল বলে মাকে কক্ষনো আক্ষেপ করতে শুনিনি। জিজ্ঞেস করলে বলবে—দ্যাখ ছেলে-মেয়ে হয়ে যাবার পর আর ছেলে-মেয়ে হবার আগের দিনগুলো ততটা ভালো বলে মনে হয় না। মা যে একটু অদ্ভুত টাইপের সেটা অনেক ছোটবেলা থেকেই লক্ষ করেছি...”


    **********


    রাহুলের ডায়েরি:

    “... সে ছিল এক সময় আর এখন এক সময়। চোখের সামনেই দেখেছি লোকজন কি রকম পালটাচ্ছে। কাশ্মীরী গেট-এর পুজোয় বনমালী আর আমি গেছি। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আড্ডা দিচ্ছে। স্কুলফাইনাল দিয়েছে কি দেয়নি। বনমালী বলল—লক্ষ করে দেখেছিস ওদের সবার হিপ পকেটে একটা করে চিরুনি আছে? চিরুনি দিয়ে সারাক্ষণ দু কানের ওপর চুল আঁচড়াচ্ছে। বলে দেখিয়ে দিল আঁচড়াবার কায়দাটা—ডান হাতে চিরুনি। বাঁ হাতটা তার পাশে কাপ-এর মতো সেঁটে চলবে। আমি লক্ষ করে দেখলাম সত্যিই ওরা পাঁচ মিনিটে একবার করে চুল আঁচড়ে নিচ্ছে। এসব তো আমাদের দেখে শেখেনি! শিখল কোথায়?

    আরো আছে। কিছু ছেলে গম্ভীরমুখে ধুতি পাঞ্জাবী পরে হাঁটাহাঁটি করছে। কাশ্মীরী গেট-এর বনেদি লোক এরা। বেশ একটু ব্যস্ততার ছাপ।

    আমি বনমালীকে বললাম—তোরা তো এখানকার সবচেয়ে পুরনো লোক। তুই এসব ব্যাপারে উৎসাহ নিস না কেন? বলতে না বলতেই ওদের একজন চলে এল আমাদের কাছে। মুখে এক গাল হাসি—এ কি রে, তোরা বাঙালির ছেলে হয়ে পুজোর দিনে একটা ধুতি পরতে পারিসনি?

    বনমালী এসব কথা নি:শব্দে হজম করে। আমি পারি না। এই বাঙালির বাচ্চাটি বস্তুত ভালোভাবে বাংলা লিখতে বা পড়তে জানে না। বাংলা স্কুলে পড়েও ওর যুক্তাক্ষরে অসুবিধে হয় আমি জানি। পাঁচ-খানার কম ‘ড’-এ শূন্য ‘ড়’ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বানান করে দেখাতে বললে সাধের ধুতিটি ভিজিয়ে শপশপে করে ফেলবে। এবং একটু আগে ওরা নিজেদের মধ্যে হিন্দীতে কথা বলছিল।

    অগত্যা তার সামনেই বনমালীকে ভীষণ ধমকে দিই আমি। তুই আবার বাঙালি? প্যান্ট শার্ট পরে বাঙালি হওয়া যায়? ধুতি পরবি আর হিন্দীতে কথা বলবি। প্রতিজ্ঞা কর!

    এইভাবে আমার শত্রুবৃদ্ধি হতে থাকে। দিনকালের সাথে ফিট করতে পারছি না। দিল্লীর বাঙালিরা কোথায় চলেছে? আমরা চলেছি কোন দিকে? আর দশ বছর পরে আমরা ওদের চিনতে পারব? দেবুদাকে? পলাশকে? মাধ্যমিকের ছেলেমেয়েদের?

    নিজেকে আর বনমালীকে মনে হয় কাশ্মীরী গেট-এর জোড়া বলীবর্দ। ফি বছর মুখ দেখাতে আসি। বদলে যাচ্ছে সব কিছু। আমরা কয়েকজন বলদের মতো ঐতিহ্যবান হয়ে পড়ে আছি... ”


    **********


    রাহুলের ডায়েরি থেকেঃ

    “... কাল সারারাত ধরে শিলাবৃষ্টি হয়েছে রাস্তায়। বারান্দা থেকে দূরে হিরের মতো আলো বসানো কালো পাহাড় দেখলাম অনেকক্ষণ। সকালে উঠে সমস্ত শান্ত। কোথাও কিছু নেই। পকেট খুঁজে শুধু একবেলা খাবার মতো পয়সা পাওয়া গেল। তাই আমরা ঠিক করলাম দিল্লী ফিরে যাব।

    এবার পাহাড়ে গিয়ে অনেক কিছু শিখেছি। আমূলে বদলে গেছি। সম্ভবত: আর কখনো যাব না পলাশদের বাড়ি। কাজ করব মনোযোগ দিয়ে। বিদেশী সিনেমা দেখব বেশি করে। মদ খাব, কিন্তু মাত্রা রেখে। বনমালী, জলধর, হারু। এদের সাথে বেশি সময় কাটাব। কবিতা লিখব একটু আধটু। কিন্তু অন্যরকম।

    সারা-রাত শিলাবৃষ্টি হয়ে গেছে শিমলা পাহাড়ে।
    মল-এর উপরে পড়ে ফেটেছে অমল মুক্তোমালা,
    সগর্জন বাতাস এসেছে দূর উত্তর-কিন্নর
    রোহতাং পাস থেকে আদ্যোপান্ত বিবরণ নিয়ে।

    বনমালী একা শুধু নিরন্তর গালাগাল দিল
    আমাদের, কেন আমরা ভোর রাতে বেরিয়ে পড়ছি না,
    হই হই করছি না কেন, চুরি করে সাহেব বাগানে
    ঢুকে স্নোম্যানের সাদা গলা থেকে খুলে নিয়ে টাই...?

    দফায় দফায় ঘুম, ভাড়া করা তোশক বালিশে
    মেয়েলী রক্তের দাগ, স্বপ্নের ভিতরও জেগে থাকি…”


    **********


    শিমলা থেকে ফেরার পর কলেজ আর বাড়ি করে যেমন-তেমন ভাবে দিনগুলো কাটছিল। রাহুল ভাবল—“আমি এরকমই। অপরিণত মন নিয়ে হই হই করে কাটিয়ে দেব। বেশি চিন্তাভাবনা করব না। দুর্গাপুজোয় ধুনুচি নিয়ে নাচব।” এমন সময় শ্যামলী আর থাকতে না পেরে ফোন করেছে তার বাড়িতে।

    —এরকম বদলে গেছিস কেন রাহুল?

    —মানুষ কি আর চিরকাল এক থাকে? তুইও একটু মোটা হয়েছিস আগের চেয়ে।

    —বেশ করেছি। কিন্তু তোর পাত্তা পাই না কেন? তুই কি আমাকে অ্যাভয়েড করছিস?

    —আসলে তা নয়। নতুন একটা টিউশনি পেয়েছি। কাজের একটু চাপ আছে।

    —মিথ্যে বলিস না রাহুল। আমি লীলা, জাহ্নবীদের কাছে সমস্ত খবর পাই। তোরা আলাদা করে আড্ডা দিস। আমাদের কলেজের দিকে আসিস না।

    পলাশ কি দু:খ পেয়েছে? ভাবে রাহুল। সহজেই দু:খ পায় পলাশ।

    —যাব একদিন। শিগগিরই। বলে রাহুল।

    —কাল?

    —কাল? কাল হবে না। একটু অন্যদিকে যাবার আছে।

    —পরশু তাহলে? আসবি তো? ল্যাংচা নিয়ে আসব তোর জন্য…


    **********


    শ্যামলীর প্রায় করুণ অবস্থা দেখে আর রাহুল এড়াতে পারেনি। যাবে বলেই কথা দিয়েছিল। শ্যামলীর কলেজের পিছনে ক্যাফেটেরিয়ায় দেখা করা যায়। বেশ কিছু ছেলেমেয়ে আড্ডা দেয় দুপুরবেলা। অথবা ইউনিভার্সিটির দিকে হেঁটে গিয়ে মাঠের পর্যুদস্ত ঘাসে আলোকিত হয়ে বসা।

    আগে প্রায়ই যেত রাহুল। দুপুরবেলা স্টিফেন্স-এর পিছনের লোহার ছোট্ট গেটটা পেরিয়ে অশ্বত্থ গাছের তলা দিয়ে ভিজে মাটির গন্ধ নিতে নিতে শ্যামলীদের কলেজের দিকে। চিরকাল ধরে আছে এসব। ওই মাঠে বসে রাহুলের মা-ও চিনেবাদাম খেতেন এক কালে।

    তখন প্রায়ই দেরি হয়ে যেত রাহুলের। ঘড়িটা একবার দেখে নিয়েই জোরে পা চালাত সে। কোনো কোনো দিন পিঠে ব্যাগ নিয়ে ছুট।

    ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট-এর পাশে সুখেনবাবু ধরলেন একদিন। সাইকেলে করে যাচ্ছিলেন। মাথায় শোলার টুপি। এরকম লোক দিল্লীতে একজনই আছে।

    —হোয়াট’স দ্য হারি ইয়ং ম্যান?

    —ভালো আছেন? রাহুল থমকে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

    —নিশ্চয়ই। তুমি কেমন আছ?

    —আজ্ঞে ভালোই।

    সাইকেল থামিয়ে নেমে পড়লেন সুখেনবাবু। শোলার টুপির তলায় চশমা। বয়েস হয়েছে। চশমার কাচগুলো একটু ঘোলাটে।

    —আমার সঙ্গে একটু কথা বলতে আপত্তি আছে তোমার? আমি একজন ফেলো স্টুডেন্ট খুঁজছি কথা বলার জন্য।

    —ফেলো স্টুডেন্ট?

    —সংস্কৃতে এম,এ, ক্লাসে ভর্তি হয়েছি। অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল। রিটায়ার করার পর অরিজিনাল কালিদাস পড়ব। এটা শেষ হয়ে গেলেই ফার্সিতে এম,এ, করব। স্টিফেন্‌সেও ক্লাস হয়। সুতরাং তুমি আর আমি সহপাঠী এখন। সতীর্থ। এত রোগা হয়ে গেছ কেন?

    —আমাদের বাড়ির ধাত। বাবার দিকে সবাই রোগা।

    —কিন্তু তোমার দাদু রোগা ছিলেন না। খালি পায়ে সাহেবদের সাথে খেলতেন। লড়তেনই বলা চলে। বললেন সুখেনবাবু। —হাইট বেশি ছিল না। অসম্ভব স্পিরিট। অনমনীয় মনোবল। দুর্দান্ত সাহস। এগুলো তোমার ধাতে আছে?

    মাথা নিচু হয়ে যায় রাহুলের। ভোর রাতে উঠে দশ বারো মাইল হেঁটে অল ইন্ডিয়া রেডিওয় চাকরি করতে যেতেন দাদু। সাহেবদের সঙ্গে ওঠা-বসা। হিটলার-কাট গোঁফ রেখেছিলেন ওয়ার টাইমে। সুভাষচন্দ্রকে স্নেহ করতেন। হিটলারকে বলতেন মরদের বাচ্চা। আবার ইংরেজদেরও ভীষণ ভালোবাসতেন। ওদের মদ খাওয়াটাও সহ্য করে নিয়েছিলেন। রাত্রিবেলা গা ম্যাজম্যাজ করলে হঠাৎ উঠে গিয়ে দু-পাঁচশোবার ডাম্ব-বেল ভেঁজে নিতেন।

    —আজ্ঞে দিদি এসব পেয়েছে কিছু কিছু। আমি বাবাদের দিকেই গিয়েছি বোধহয়। বলে রাহুল।

    —তোমার প্রিয় রঙ হল নীল আর মেরুন। তুমি রসের মিষ্টি খেতে ভালোবাস। ঠিক বললাম?

    চমকে যায় রাহুল—ঠিক।

    —তোমার সর্দির ধাত আছে। বয়েস হলে কিডনি খারাপ হয়ে যাবে। কাঁচকলা আর এঁচোড় খাবে বেশি করে।

    সুখেনবাবু মাথাটা নামিয়ে কাছে এসে ষড়যন্ত্র করার ভঙ্গিতে কথা বলছেন।

    —আর শোন। এত ছটফট কর কেন তুমি?

    —কই না তো!

    —করো। মানুষের ভিতরে লুকোনো ক্ষমতা থাকে। সেটাকে গতি দাও। বি এ ভেক্টর। ভেক্টর বোঝ তো?

    রাহুল মাথা নাড়ে।

    —স্কেলার হয়ো না। ভেক্টর হও। সায়েন্স একাডেমির লাইব্রেরিটা দেখেছ?

    —দেখেছি।

    —গিয়ে পড়াশোনা কর। ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিটাও ভালো। অনেক ইতিহাস জানতে পারবে ওখানে। পড়তে থাক। পড়তে পড়তে তলিয়ে যাও গভীরে। দেন গিভ ইয়োরসেল্‌ফ এ ডাইরেকশন। বুঝলে কিছু?

    হ্যাঁ, না কিছুই বলেনি রাহুল। হাসি-হাসি মুখ করে তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়েছিল। তারপর ভেক্টরের মতো অব্যর্থভাবে ছুটে গিয়েছিল শ্যামলীদের কলেজে।


    **********


    তখন প্রায়ই যেত। গেলেই খরচা হত। কফিতে, কাটলেট-এ। শ্যামলী প্রচুর ধার দিত। মাসের শেষে টিউশনির টাকা গুনে গুনে সবার ধার শোধ করত রাহুল। এবার আর খরচ হয়নি। নিজের পয়সা খরচ করেই শ্যামলী চা খাইয়েছিল। টিফিন-বক্স খুলে লুচি আর ল্যাংচা পরিবেশন করেছিল হাসিমুখে।

    —এত যত্ন কেন পলাশ?

    —কারণ আছে। একটা কাজ করে দিতে হবে তোকে। আগে খেয়ে নে।

    —দেবুদাকে আমি কনট্যাক্ট করতে পারিনি।

    —জানি। সে যা ব্যবস্থা করার আমিই করেছি।

    —কথা পাকাপাকি করে ফেললি? মুখে লুচি নিয়ে চিবোতে চিবোতে বলেছিল রাহুল।


    **********


    রাহুলের ডায়েরি থেকে:

    “…পলাশ শেষ পর্যন্ত দেবুদাকেই সিলেক্ট করল। কিন্তু বিয়ে করতে অনিচ্ছুক। এদিকে দেবুদাদের বাড়ির লোকেরা চাপ দিচ্ছে। আমাকে বলল—রাহুল, একটা মিটিং অ্যারেঞ্জ কর। দেবুদার বাড়ির লোকেরা থাকবে না। শুধু আমি আর তোর দেবুদা। আমি দু'বছর টাইম চাইব। ততদিনে এম.এস.সি-টা হয়ে যাবে।

    আমি বললাম—দু'বছর ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে তোকে পাবার জন্য? দেবুদার কথাটাও ভাব। বয়েস তো কম হলো না...

    পলাশ গম্ভীর মুখ করে বলল—ব্রহ্মচর্য পালন করতে এত কষ্ট হলে করতে হবে না। আমি কি বেঁধে রাখছি কাউকে?

    তারপর মিষ্টি করে হেসে বলল—কেন, আমরা তিন বছর প্রেম-ট্রেম করতে পারি!

    এই কথাটা দেবুদাকে বলতে হবে আমায়। দেবুদা কেমন আছেন? আমাকে চিনতে পারছেন? রাহুল। হাফ-প্যান্ট করা অবস্থায় দেখেছেন। আপনাদের বল কুড়িয়ে দিতাম...

    সেই রাহুল আজ আপনার কাছে এসেছে দূত হয়ে। দূত অবধ্য জানেন তো? ভেরি গুড। এবার বলুন, আপনি কি আগামি তিনবছর শুকনো প্রেম-ট্রেম করে কাটাতে পারবেন?

    পরে পলাশ বোঝাল। বেশি কিছু বলতে যাস না। কাব্য-টাব্য নয়। কাঁচিয়ে দিবি তুই। ভয় পেয়ে যাবে লোকটা। কিম্বা ভাববে আমি একটা শস্তা মেয়ে। তুই শুধু বলবি, শ্যামলী আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়। একান্তে। ব্যস্‌ এইটুকুই। বাকিটা আমি ম্যানেজ করব।

    শুনে একটু ঈর্ষাই হয়েছিল। সাদা ফুল-প্যান্ট পরে দেবুদারা ক্রিকেট খেলত। আমি শুধু বল কুড়িয়েছি। কাছে গিয়ে কথা বলারও সাহস হয়নি। এখন কত অনায়াসে পলাশ বলে দিতে পারে যে দেবুদাকে সে ম্যানেজ করে নেবে।

    মনে এরকম একটা ব্যথার ভাব নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলাম। ফিরে দেখি বনমালী আমার ঘরে আলো জ্বালিয়ে গল্পের বই পড়ছে। দুজনে আবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্লাজা অবধি চলে গেলাম। ওখান থেকে বনমালীর বাড়ি যতদূর আমারটাও ততটাই। প্লাজার সামনে নাইট শো-এর লাইন পড়েছে বিশাল। পিছন দিকে একটা হিসি করার জায়গা আছে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হিসি করছি। সিগারেট খাচ্ছি। এমন সময় বনমালী বলল—শিমলা যাবি? আমি বললাম—পয়সা আনিনি। বনমালী বলল—কাল নিয়ে আয়। তোর তিনশো আমার তিনশো জলধরের তিনশো, হারু কিছু দিতে পারবে না। আমি বললাম—আর কোথায় কোথায় যাব? বনমালী বলল—কুলু, মানালী তো যাবই। রোহতাং পাস যদি খোলা থাকে তাহলে চলে যাব রোহতাং অবধি। সেখান থেকে তিব্বতে যাবার গোপন সব রুট আছে। আমি বললাম—আর টিউশনি? বনমালী বলল—কাল বিকেলে চার ঘন্টা পড়িয়ে কোর্স শেষ করে দে। এগারোটায় কালকা।

    অন্ধকারে ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরলাম। কালো আকাশে উজ্জ্বল সব সাইনবোর্ড। নিজেকে মনে হচ্ছিল জিম করবেট-এর চিতা বাঘের মতো। বিপন্ন। কিন্তু স্বাধীন...”


    **********


    রাহুলের ডায়েরি:

    “…দেবুদাকে কনট্যাক্ট করতে পারিনি। শিমলা থেকে ফিরে এসে শুনলাম পলাশ নিজেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করে ফেলেছে। আমাকে কলেজে ডেকে ল্যাংচা খাওয়াল। বলল একটা কাজ করে দিতে হবে।

    অ্যাপয়েন্টমেন্ট তো হয়েই গেছে। আবার কি কাজ?

    বলল—আগে খেয়ে নে। পরে বলছি।

    চারটে বড়ো সাইজের ল্যাংচা খেয়ে যখন নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছি তখন পলাশ বলল—রাহুল, তুই শুক্কুরবার বিকেলে আমার সঙ্গে যাবি? আমি বললাম—কোথায়? পলাশ বলল—একটা রেস্টুরেন্টে। শুনেই আমি ঘাবড়ে গেলাম। বললাম—আর কিছু শুনতে চাই না। আমি তোদের প্রাইভেট ব্যাপারে নেই। তখন পলাশ মুখ নিচু করে বলল—আমার এখন বেশ ভয় করছে রে। তাই তোকে বললাম।

    দেখি পলাশের ঠোঁট কাঁপছে। ঘামে ভিজে গেছে কপাল। কামিজের পিঠটা ভিজে লেপটে গেছে গায়ের সাথে।

    আমি বললাম—আমারও খুব ভয় করছে। বরং বনমালীকে নিয়ে যা। ও দেবুদাকে আমার চেয়ে ভালো চেনে।

    পলাশ বলল—তুই কি সবাইকে এসব বলে দিয়েছিস নাকি?

    আমি বললাম—না তো!

    পলাশ গম্ভীরভাবে বলল—এক্ষুনি ব্যাপারটাকে বিশ্বময় চাউর করতে চাই না। গেলে, তোকেই যেতে হবে।

    আমি বললাম—দেবুদার মনে একটা সন্দেহের বীজ ঢুকে যেতে পারে। হয়তো ভাববে আমি তোর প্রেমিক। দেখেশুনে বর ঠিক করে দিচ্ছি।

    পলাশ ঠাট্টাটা বুঝল না। বলল—সে নিয়ে তুই ভাবিস না। ওটাও আমি ম্যানেজ করে দেবো...”


    **********


    রাহুলের ডায়েরি থেকে:

    “...ইতিমধ্যে একদিন বিকেলে সময় করে মামাবাড়ি গেলাম। কোর্টে শুনানি ছিল। টিম নিয়ে মোকদ্দমা। মামা এই বয়েসে দুপুর রোদে কোর্ট-কাছারি করে মরছে। আমি আর হারু কোনো খবরই রাখি না। একদিন শুনি হারু মামাকে বকঝকা করছে। তোমার এসব ব্যাপারে জড়াবার কি দরকার বাবা। যাদের টিম তারাই যদি গা না করে তাহলে তোমার কি?

    মামা খেতে খেতে বলল—আমার কি? কিছুই না।

    তখন হারু আর আমি দুজনেই চুপ।

    মামা রাস্তায় দেখা হলেই লোকজনকে ডেকে বলবে—পরশু তিস হাজারি কোর্টে শুনানি আছে। আমি যেতে পারছি না। তোমরা কেউ গিয়ে অন্তত দাঁড়াও একবার।

    দু-একবার অন্যরা গেল। তারপর আর কেউ যায় না। টিমের খেলোয়াড়রা এখন সবাই গান্ধীনগর, লক্ষ্মীনগরের বাঙাল ছেলেরা। তারা টিমটাই কেড়ে নিতে চায়। মামা বলল—টিমারপুরের ছেলেদের আর চান্স দিতে পারব না তাহলে, শেষ চেষ্টা করে দেখা যাক।

    যেদিন রায় দেওয়া হবে সেদিন বিকেলে মামাবাড়ি গিয়েছি। সন্ধের পর বাড়ি ফিরল মামা। হারু বাড়ি নেই। আমি বললাম—কি হলো?

    মামা বলল—বাপরে কি জাজ রে! কী ধমক ধমকাল ওদের!

    কোর্টরুম ভর্তি লোক ছিল। লক্ষ্মীনগরের ছেলেরা নিজেদের সমস্ত সাক্ষীসাবুদ নিয়ে এসেছিল, অন্যদিকে শুধু মামা। প্রশ্নটা জটিল। টিমটা মামার কিন্তু খেলোয়াড়রা এখন টিমের নিয়ন্ত্রণ চায়। হয়তো তারা নাম পালটে দেবে টিমের। এতদিনের একটা ঐতিহ্য ভেঙে যাবে।

    জাজ বাঘের মতো গর্জে বললেন—সেনবাবুর টিম কে নিতে চায়?

    দু-একটি ছেলে এগিয়ে এসে মিনমিন করে কিছু বলতে চাইল। তাদের এক ধমকে চুপ করিয়ে দিয়ে জাজ বললেন—যাও তোমরা গিয়ে ওনার পা ছুঁয়ে প্রণাম কর আগে।

    বলা মাত্রই সুড়সুড় করে সবাই এসে মামাকে প্রণাম করে যাচ্ছে। মামা সবাইকে আশীর্বাদ করছে।

    জাজ-সাহেব মামাকে বললেন—সেনবাবু, কি করবেন আপনি টিম দিয়ে?

    মামা বলল—কিছুই না। আমি যাদের জন্য টিম বাঁচিয়ে রেখেছিলাম তারাই এখানে নেই।

    জাজ বললেন—এই ছেলেগুলো আপনাকে শ্রদ্ধা করে। এদেরকেই দিয়ে দিন টিমটা।

    মামা বলল—তথাস্তু!

    শিগগিরই রিটায়ার করবে মামা। চিত্তরঞ্জন পার্কে গিয়েই থাকবে ওরা। অতদূর থেকে আম্বেদকরে খেলা দেখতে আসাও ঝঞ্ঝাট। সবাই বলল—খুব ভালো হয়েছে। বোঝা নামলো একটা মাথা থেকে।

    আমি জানি মামার ড্রয়ার ভর্তি এখনো সেই ছোট ছোট কাপ আর শিল্ড আছে। পড়ে আছে দু-একটা লোহার বাঁশি। মামার বিরাট ভারি হারকিউলিস সাইকেলটা ঝরঝরে হয়ে গেছে। বসবার ঘরে দাদুর ছবিটা সাফসুতরো করে রাখা হয়। স্মিত হাসছে দাদু। অক্ষয় হাসি। এছাড়া, আর সবই পালটাচ্ছে। পালটে যাবে।

    রাতে হারু আর আমি এক ঘরে শুয়ে ঘুমোচ্ছি। জানলা খোলা। সামনের পাথর বসানো চত্বরে এখন আর কেউ শোয় না। রাত্রে খুব পুরনো একটা ভয়ের স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল। অদ্ভুত একটা জানোয়ার ঘুরে বেড়াচ্ছে রাস্তায়। তাই সবাই খাটিয়া তুলে চলে গেছে ঘরের ভিতরে। আমি বালিশটা তুলে দৌড়ে এসে দেখি দরজা বন্ধ। কিছুতেই টোকা দিতে পারছি না দরজায়। এদিকে পিছনে কিছু একটা এসে পড়েছে। আস্তে আস্তে। পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি তার।

    আমি মানে সেই ছোটোবেলার আমি। কেননা দরজাটা প্রকাণ্ড। আর হাতলটা আমার মাথার চেয়ে উঁচুতে। প্রায় নাগালের বাইরে…”


    **********


  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ (শেষ)
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments