• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৩ | ডিসেম্বর ২০১৮ | উপন্যাস
    Share
  • রাহুলের ডায়েরি থেকে : ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত





    || ৮ ||

    রাহুলের ডায়েরি থেকে:

    “...বর্ষা এসে পড়েছে দিল্লীতে। একদিন বলা নেই কওয়া নেই প্রচণ্ড আঁধি হয়ে রাস্তা ঘাট একেবারে ধুলোয় বোঝাই হয়ে গেল। পকেটে, দাঁতের ফাঁকে বালি কিচকিচ করছে। থু-থু করে যতই ফেলি, যায় না। অনেকদিন মামাবাড়ি যাওয়া হয়নি। হারু কলকাতায়। খোঁজখবর নেওয়া দরকার। মা বলল—যা গিয়ে দেখে আয়।

    রবিবার সকালে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। মোটা মোটা শিলা পড়ছে হাতুড়ির মতো। মাটিতে পড়ে আছড়ে ভাঙছে, গড়িয়ে যাচ্ছে ন্যাপথার বল। বাটার চটিটা ভিজে নরম হয়ে গেল। হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে বাস ধরলাম। টিমারপুরের রাস্তার ধার দিয়ে নদীর মতো জল ছুটছে। নিচু জমি। আটাত্তরের বন্যার সময় কোনোমতে ভেসে ছিল। মামাবাড়ির সামনে একটা বহমান খাল। ওইখানে একসময় অনেক কাগজের নৌকো আর জাহাজ ভাসিয়েছি।

    খিড়কির দরজায় ভূতের মতো কে দাঁড়িয়ে আছে। বুড়ি, থুত্থুড়ি। শণের মতো চুল। আমি পিছনে গিয়ে বললাম—কেমন আছ বউ? কাহারের বউ ঘুরে তাকিয়েই প্রথমে ঠিক চিনতে পারে না। তারপর ফোকলা দাঁত বের করে হেসে বলে—খোকাবাবু, ক্যায়সে হো? আমি বললাম—আর বোলো না বউ। বড্ড বুড়ো হয়ে গেছি। কোমরে ব্যথা। তোমার কোনো দাওয়াই আছে নাকি?

    কাহারের বউ খনখনে গলায় পেত্নীর মতো হাসছে তো হাসছেই।

    কোনো একটা সময় কারো একটা বউ ছিল। চিরাৎ্‌ মামাবাড়ির কাজে বহাল। তার ছানাপোনারাও কাজ করত। যখন যে আসত খেয়ে যেত। কবে থেকে এই অদ্ভুত ব্যবস্থা জানি না। হয়তো দাদুর সময় থেকেই। কিম্বা মামিমা আসার পর। হারু ঠাট্টা করে বলে—এ আমাদের বাড়ির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।

    মামাবাড়ির অনেক বন্দোবস্তই একটু আলাদা ধরনের। হিসেবী লোক শুনলে আঁতকে উঠবে, তাই বাড়ির খবর বাড়িতেই চেপে রাখা হয়।

    যেমন কাহারের বউয়ের কথাটা। দুদিন পরে রিটায়ার করবে মামা। হারুর চাকরি হতে দেরি আছে। পেনশন থাকবে অবশ্য, কিন্তু সঞ্চয় কিছুই নেই। এরই মধ্যে বাড়িতে দুটি স্থায়ী কাজের লোক তো আছেই, উপরন্তু তাদের ছেলেপুলে, নাতিনাতনিরা প্রায়ই খেতে-টেতে আসে। কাহারের বউকে এই দুর্দিনের বাজারে একটি মাসিক পেনশন দেওয়া হয়। অর্থাৎ মামাবাড়িতে চাকরি প্রায় সরকারি চাকরির মতো। এসব জেনে যে দুর্জনে মামিমাকে কুইন ভিক্টোরিয়া বলবে তাতে আর আশ্চর্য কি?

    খুব সম্ভবত সেই মাসোহারা নিতেই কাহারের বউয়ের আসা। মেয়েকে বা নাতিকে পাঠায় না। পয়সাটা তারা মেরে দেবে বলেই বোধহয়। খিড়কির দরজার পাশে বসে গ্লাসে করে গরম এক কাপ চা খাবে এখন। সুখ-দু:খের কথা বলবে মামিমার সাথে। তারপর টাকাটা নিয়ে বিদায় হবে। কাহারের বউ এখন আর কোনো কাজ করতে পারে না।

    বছর পাঁচেক আগেও বাজার-টাজার করত। রবিবার রবিবার এককিলো মাংস হতো বাড়িতে। কাহারের বউ লাইন দিয়ে মাংসটা আনতে যেত। পরে কষাই মামাকে ডেকে বলল—আচ্ছা আপনাদের বাড়ি থেকে ন’শো গ্রাম করে মাংস আনানো হয় কেন? মামা আকাশ থেকে পড়ে।—কেন স্লিপ দিয়ে পাঠানো হয় তো! এক কিলো মাংস। সেই দামই তো নাও। কষাই মাথা নেড়ে বলে—স্লিপ ফ্লিপ পাই না। ঝগড়া করে ঠিক ন’শো গ্রাম মাংস নিয়ে যায়...”

    **********

    রাহুলের ডায়েরি থেকে:

    “...ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই বৃষ্টিটা ধরে গেল। পিছনে পিছনে বুড়ো মুসলমান মাছওয়ালা এসে হাজির। মামিমা বলল—রাহুল খুব পয়া ছেলে। সঙ্গে মাছ নিয়েই এসেছে।

    টিমারপুরে কোনো মাছের দোকান নেই। জুম্মা মসজিদের বাজার থেকে মাছ কেনা হয়ে ওঠে না। মাসে দু-একবার মাছওয়ালা কৃপা করে এসে হাজির হলেই মাছ হয়। কখনোই তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। ইলিশ, মৃগেল, রুই যা পাওয়া যায় রেখে দেওয়াই নিয়ম।

    লোকটা ভালো। যদিও মেজাজ খুব তিরিক্ষে। মামিমার উপর চটে থাকে সবসময়। মাছটা আমিই গিয়ে পছন্দ করে দিলাম। মামিমা ছুঁয়েও দেখে না। শুচিবাই। পেট টিপে টিপে আমি শক্ত সলিড গোছের একটা কাৎলাই তুলেছি। মাছবুড়োর সাফ কথা। পুরোটাই নিতে হবে। দাঁড়িয়ে থেকে কাটাতে হলো। বুড়ো মাঝে মাঝে পিত্তি গালিয়ে ফেলে। সে কথা বলতেই বঁটি দেখিয়ে বলল—নিজেই কেটে নাও বাপু। কুটে নাও। সবজান্তা। মামিমা তাড়াতাড়ি এসে আমাকে বাঁচায়—মাফ করে দাও ছোকরাকে। অর্বাচিন ছেলে। কি জানে? পিসগুলো বেশি ছোটো কোরো না কিন্তু।

    মামাবাড়িতে অভাবেরই সংসার। কিন্তু অভাবে কারো স্বভাব নষ্ট হয়নি। বড়ো বড়ো পিস ছাড়া মাছ হয় না এবাড়িতে। অভাবের ব্যাপারটা ছোটোবেলা আমি বা হারু কোনোদিন আঁচ পাইনি। পাওনাদাররা এলে খিড়কির দরজার ফাঁক দিয়ে কিছু কড়কড়ে টাকা তাদের বের করে সাময়িকভাবে ভাগিয়ে দেওয়া হতো।

    একদিন এমন অবস্থা—তখন হারু আর আমি খুবই ছোটো—রেশন থেকে তোলা কেরোসিন তেল আর কয়লা দুইই নি:শেষ। কোনো কারণে টাকার অভাবেই সম্ভবত—ব্ল্যাক-এর বাজার থেকে কিছু কেনা সম্ভব হচ্ছে না। মামা গম্ভীর হয়ে বসে আছে। তদানীন্তন গৃহভৃত্য গুলাব সিং আমার কানে কানে বলে গেল—আজ বেশি দৌড়োদৌড়ি কোরো না। তাহলে বেশি খিদে পাবে।

    আমিও বোকার মতো বললাম—বেশি খিদে পেলে বেশি খাব। তাই তো ভালো।

    গুলাব সিং মুচকি হেসে বলল—রান্না হবে কী দিয়ে? আজ রাতে সবার উপোস। বেশি করে জল খেয়ে নিও বরং।

    রাতে আমাদের উপোস করতে হবে এরকম চিন্তা স্বপ্নেও আসেনি কোনোদিন। উঠোনের আনাচ-কানাচ থেকে বড়োদের হাবভাব দেখে মনে হলো কথাটা সত্যি হলেও হতে পারে। মামা বিষণ্ণ মুখে বসে আছে। উনুন ধরানো হয়নি। সন্ধে হয়ে এল প্রায়। গুলাবটা নিশ্চয়ই বাইরে থেকে ওমলেট খেয়ে এসেছে!

    মামিমার কাছে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ভয়ে ভয়ে বললাম—আজ নাকি রান্না হবে না? কয়লা নেই!

    —ওমা রান্না হবে না কেন? মামিমা অবাক হয়ে বলে। —কাঠ আছে তো?

    গুলাব সিং হ্যা হ্যা করে হেসে বলে—কোথায় কাঠ? একটা চেলা পর্যন্ত নেই।

    মামিমা নিজের নতুন পিঁড়িটা দেখিয়ে বলল—ওটা কি?

    তারপরের দৃশ্যাবলী আজও চোখের সামনে ভাসে। কাঠ চেরার কুড়ুল দিয়ে গুলাব সিং উঠোনে বসে পিঁড়িটাকে টুকরো টুকরো করে কাটছে। গেঞ্জি পরা। ঘাম-ঘামে গা চকচক করছে। আমরা সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। একটা পিঁড়ির কাঠেই হয়ে গেল দশজন লোকের ভাত আর ডিমের ঝোল। যতদূর মনে পড়ে উত্তেজনায় অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশিই খেয়েছিলাম। মামিমা দাঁড়িয়ে থেকে সব তদারক করল। পিঁড়ির জন্য কোনো দু:খ নেই। সবই প্রপঞ্চ তো! মায়া...”

    ***********

    রাহুলের ডায়েরি থেকে:

    “... বড়ঘরে টিভি চালিয়ে বসে আছে মামা। হাতে খবরের কাগজ। আমায় দেখে বলল—রাহুল, এসেছিস? বোস। সমোসা খাবি?

    মামিমা বলল—মটরের কচুরি বানিয়ে দিচ্ছি, সমোসার চেয়ে ভালো, কি বল?

    টিভিতে রবিবারের বাঁধা প্রোগ্রাম হচ্ছে একের পর এক। একটু পরে মহাভারত শুরু হবে। মামা বলল—শকুনির অভিনয় খুব ভালো লাগছে। তাই খুলে রেখেছি। নইলে এসব চেঁচামেচি কে দেখে? আমি জিজ্ঞেস করলাম—হারু কবে ফিরছে?

    —কে জানে! কোথায় যায়, কি করে কিছুই তো বলে না। এখন শুনছি ল পড়বে।

    —ভালো লাইন তো!

    —সেরকম কূটবুদ্ধি আছে? শকুনির মতো হতে পারবে? মক্কেলরাই ওকে চরিয়ে না খায়।

    ওদিকে কাহারের বউয়ের জন্য চায়ের জল চাপানো হয়েছে। মামা দেরাজ খুলবে বলে চাবি খুঁজছে। কিছুদিন পরে নিজের পেনশন থেকে কাহারের বউকে পেনশন দেবে। মাঝে মাঝে কাহারের বউ ইনক্রিমেন্ট চায়। কখনো-সখনো মঞ্জুর হয়। এই পরিবেশের মধ্যে থেকে কি হারু ঝানু উকিল হয়ে বেরোতে পারবে? পারলে হারুরই ক্রেডিট।

    —মামা হলো শকুনি। ওরকম মামা তোরা পেলি না। কিছুই করতে পারলাম না তোদের জন্য। দু:খ করল মামা।

    সোফার উপর স্টেট্‌সম্যান পড়ে আছে। এই বাড়িতে ইংরিজির টেক্সট বই হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। মামা দু:খ করে বলে—এডিটোরিয়ালে আর আগের মতো ধার নেই। ইংরেজরা যে সত্যি দেশ ছেড়ে চলে গেছে তা বোঝা যায়। এত বড়ো এক একটা সেনটেনস্‌ লেখে, ছ’-সাতটা ক্লজ। শেষে ওদের নিজেদেরই গ্রামার গুলিয়ে যায়। আমি নেসফিল্ডও চেক করে দেখেছি।

    মামাকে দেখলে মনে হয় সময় থেমে আছে। গত দশবছর ধরে ঠিক একই রকম। গরমে ক্রিম রঙের শার্ট আর খয়েরি প্যান্ট। বাটার অ্যাম্বাসাডার জুতো। সকালে উঠে চেরি-ব্লসম দিয়ে পালিশ করে হারকিউলিস সাইকেল নিয়ে অফিস। হারকিউলিসটা চুরি হবার পর এখন অবশ্য অ্যাটলাস।

    শীতকালে কম্বল-কোট। গরম কাপড়ের প্যান্ট। ভি-নেক সোয়েটার। টাই। টাই ছাড়া কোনোদিন কোট পরতে দেখিনি। উইল্‌স নেভিকাট ছাড়া সিগারেট খেতে দেখিনি। চুলে বেঙ্গল কেমিক্যালের ক্যান্থারাইডিন ছাড়া কিছু মাখতে দেখিনি। একসময় খুবই শৌখিন ছিলেন, বলে লোকে। সোনালী ফ্রেমের চশমা, গরদের ধুতি-পাঞ্জাবী পরা ছবি অ্যালবামে দেখেছি। মা বলে তখন মেজদা লুচি ছাড়া ব্রেকফাস্ট খেত না। ফাঙ্কশন-টাঙ্কশন-এ অনেক অনুরোধ করলে মিহি গলায় দুটো কি তিনটে অসাধারণ গান গেয়ে শোনাতো।

    রেকর্ড কোম্পানিরা নাকি সাধাসাধিও করেছিল। কিন্তু দাদু এসব ললিতকলার ঘোরতর বিরুদ্ধে ছিলেন। বাড়িতে চাপা গলায় রবীন্দ্রনাথকেই বাঙলার অর্ধপতনের জন্য দায়ী করা হতো। কি সব লিখছেন রবিবাবু? ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে আমার নামটি রেখ তোমার মনের মন্দিরে! ছোঃ! রবিবাবু কি পুরো বাঙলার পুরুষদের এইভাবে মেয়েলোক বানিয়ে ছাড়বেন? দাদু বেঁচে থাকতে মা-মাসিদের বিয়ের কোনো চেষ্টাও করা হয়নি। দাদু শুধু আক্ষেপ করতেন। কার সাথে দেব? দেশে একটা পুরুষ-লোক কোথায়?

    দিদিমা ভীষণ চটে, নিষ্ফল ক্রোধে মুখঝামটা দিয়ে বলতেন—হ, পুরুষ বলতে শুধু আস তুমি আর তোমার পোলারা!

    উঠোনে একদিকে মুগুর, অন্যদিকে ডাম্ববেল নিয়ে দাদু মাসকুলার গায়ে সরষের তেল মেখে যেতেন আর হিটলার গোঁফে তা দিতেন। নিজের ছেলেদের উপর তাঁর ভরসা ছিল....”

    ***********

    কচুরি, মাছের ঝোল, ভাত। তারিফ করে করে খেল রাহুল। কাজ শেষ হয়ে গেলে মামিমা রাহুলের সাথে গল্প করতে বসে—রাহুল তুইই জানবি। ঠিক করে বল তো, রবি-ঠাকুর বিয়ে করার পরেই কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করলেন?

    মামিমা রবি-ঠাকুর, অতুলপ্রসাদ, নজরুল-এর ভক্ত। কবিতা গানের ততটা নয়। জীবন চরিতের। ঘুমে রাহুলের দু-চোখ বুজে আসে।

    —ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল বইটা খুলে দেখে নাও না!

    —দেখলাম। ওদের খাওয়ার মেনু কি দিয়েছে দেখেছিস? বাপ রে এত খাবার লোকে খেতে পারে?

    —সেইজন্যেই তো ওরকম লেখা বেরোত ওঁদের হাত দিয়ে। সোফায় শুয়ে শুয়ে বলে রাহুল। রবীন্দ্রনাথ লন্ডনে গিয়ে ডিনারে এক একটা আস্ত গরু সাবাড় করে দিতেন। ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। ইংরেজদের তাড়ালো কে?

    মামিমা চটে গিয়ে বলে—বাজে বকিস না রাহুল। গুরুদেব বিফ খেতেন নাকি?

    —হুঁ? রাহুল ততক্ষণে একেবারেই ঘুমিয়ে কাদা। পাশ ফিরে শোয় সে। —ব্রাহ্মরা হিন্দু নাকি?

    মামিমা বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আনমনা হয়ে যায়। একটু পরে বলে—সত্যি বলছিস রাহুল? সত্যি নাকি?

    ************

  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ (শেষ)
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments