• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭২ | সেপ্টেম্বর ২০১৮ | উপন্যাস
    Share
  • কোথাও জীবন আছে (২) : শাম্ভবী ঘোষ


    রণ্যা হেসে ফেলল। সত্যি, বই হাতে থাকলে উপলার বাহ্যজ্ঞান খিড়কি দোর দিয়ে কেটে পড়ে। খানিকক্ষণ বিড়বিড় করে আবার বইয়ে চোখ নামাল উপলা।

    খানিক পর শরণ্যা ডাকল, “পল্‌?”

    “উঁ।”

    “কী বই পড়ছিস?”

    “হুঁ।”

    “তাই নাকি? তা, রাইটার কে?”

    “ইয়ে...”

    “বাঃ নামটা বেড়ে তো!”

    “অ্যাই, কি বলছিস বল্‌ তো তখন থেকে?” উপলা এতক্ষণে খেয়াল করে।

    “বলি, কি বই পড়া হচ্ছে?”

    “অ। ওই তো, ‘টিউজ্‌ডেজ উইথ মোরি’। ব্যাপক লিখেছে মাইরি।”

    “সে তো তোর অবস্থা দেখেই বুঝতে পারছি।”

    এমন সময় দড়াম্‌ করে দরজা খুলে গিয়ে ঝড়ের বেগে মৃণালিনী এসে ঢুকল। দুমদাম করে নিজের ব্যাগ আর হাতের ফাইল একটা চেয়ারের উপর ফেলে দিয়ে নিজের সীটে ধপাস করে বসে পড়ে বলল, “শা-ল্‌-লা।”

    উপলা হাঁ করে মৃণালিনীর দিকে তাকিয়েছিল। তাকে একটু ধাতস্থ হবার সময় দিয়ে তারপর প্রশ্ন করল, “সাতসকালে এই মধুর বচন কেন?”

    “চোপরাও। বিশ্ব সংসারকে কুপিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে,” মৃণালিনী গর্জন করে উঠল।

    “আরে হয়েছেটা কী?”

    “বাবা ঝেড়েছে।”

    “কেন?”

    “কেন আবার! ‘সাতসকালে ‘ঝিন্দের বন্দী’ মুখে করে ইয়ার্কি মারা হচ্ছে’ বলে গাল দিয়েছে। না খেয়ে বেরিয়ে এসেছি।”

    শরণ্যা আর উপলা মুখ তাকাতাকি করল, তারপর শরণ্যা গলা খাঁকরে বলল, “তাহলে তো ব্যাপার গুরুতর। কিন্তু তুইই বা সাতসকালে ‘ঝিন্দের বন্দী’ মুখে করে বসেছিলি কেন?”

    “বেশ করেছি। কার ইয়ের কী?”

    শরণ্যা আর ঘাঁটালনা। ইতিমধ্যে অন্যেরা ক্লাসে ঢুকতে আরম্ভ করেছে। রোমিলা এসে কোনওমতে ব্যাগটা নামিয়ে রেখেই বইখাতা বার করে পড়তে লেগে গেল। উদিতাদের পুরো গ্রুপটা রীতিমতো কলরব করতে শুরু করে দিয়েছে এতক্ষণে। ওদিকে শিরিন, কঙ্কনা, নীলাঞ্জনারাও এককোণে জটলা বেঁধে গুজগুজ করছে। একটু পরে জস্‌দীপ, ওরফে জেস্‌ ঢুকেই হাঁক পাড়ল, “হ্যালো পল্‌ল্‌ল্‌!”

    উপলা অবশ্য আবার বইয়ের মধ্যে ডুবে গেছে, শুনতেও পেলনা। খানিক বাদে নীরা লম্বা ঝুঁটিটা দোলাতে দোলাতে ঢুকল, “বাবা, স্কুল নয়তো, বৃন্দাবন একটা!”

    জেস্‌ কথা বলার লোক খুঁজছিল, জিজ্ঞেস করল, “কেন, আবার কী হল?”

    “কী হল? বাইরে গিয়ে একবার দেখে এসো রাসলীলা কাকে বলে।”

    শরণ্যা বলল, “কী করছে? ভেঙে বল্‌না।”

    “ভেঙে কেন, আস্তই বলছি,” চেয়ারে ব্যাগ রাখতে রাখতে নীরা বলল, “করিডোরে শুটিং চলছে। ছেলেদের কমার্স সেক্‌শনে বজ্জাতিয়া নামে কে একটা আছে না, কাকতাড়ুয়ার মতো চেহারা? সে মাল ক্যামেরা নিয়ে চলে এসেছে, আর কমার্স সেক্‌শনের যত কটা রাধা-কেষ্টর জুটি আছে, সবগুলোর ভিডিও তুলছে দাঁত কেলিয়ে। কী ব্যাপার, না, এ বছর ইস্কুল শেষ কিনা! এইসব বাঁদরামির স্মৃতিগুলো ধরে রাখতে হবে তো।”

    জেস চোখ গোলগোল করে বলল, “সাচ্‌ বোল রহী হ্যায়?”

    নীরা গম্ভীরমুখে জবাব দিল, “বিশ্বাস নেই হোতা, তো বাইরে যাকে দেখ্‌।”

    “কে, কে বলল রে কথাটা?” উপলার কানে কি করে যেন এই অংশটা চলে গেছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে নীরাকে দেখতে পেয়ে বলল, “ওঃ, তাই বলো। এমন অপূর্ব হিন্দি তোর মুখ দিয়ে ছাড়া আর কার মুখ দিয়ে বেরোবে?”

    নীরা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব হয়েছে।”

    এতক্ষণে প্রায় সবাই চলে এসেছে। ক্লাসরুমে প্রচণ্ড হট্টগোল। মৃণালিনী চারদিকটা দেখে নিয়ে বলল, “তিল্লী এলনা?”

    শরণ্যা বলল, “তাই তো। আজকে অ্যাবসেন্ট করবে বলেছিল নাকি?”

    নীরা হাত উলটে বলে, “আমাকে তো বলেনি।”

    উপলা বলল, “ইন ফ্যাক্ট আমাকে তো কাল সোশিওলজি-র হোমওয়ার্ক জানতে ফোন করেছিল। নাই যদি আসবে, তাহলে আর হোমওয়ার্ক জেনে কী করবে?”

    এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ক্লাস টিচার পল্লবী সিকদার, ওরফে পি.এস. ঘরে ঢুকলেন, হাতে ফাইলের পর্বত; তার আড়ালে মুখ প্রায় ঢাকা। আর তাঁর ঠিক পিছন পিছন তিলোত্তমা এসে ঢুকল। সবাই পি.এস-কে নিয়ে হাসাহাসি করছিল, একমাত্র শরণ্যার চোখ আটকে রইল তার বন্ধুর মুখের উপর।

    মানুষ যে এত সুন্দর হয়, তা তিলোত্তমাকে না দেখলে বুঝি বিশ্বাস করা যায়না। ও যেন ভগবানের এক নিঁখুত সৃষ্টি। ছোটবেলায় রূপকথার রাজকুমারীদের চেহারার বর্ণনা পড়েছিল; প্রথম দিন তিলোত্তমাকে দেখে মনে হয়েছিল যেন সেরকমই কোনও গল্পের পাতা থেকে উঠে আসা এক মেঘবরণ চুল কুঁচবরণ কন্যা। এই সৌন্দর্যই সবার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। তাই হয়তো ওর মুখের আড়ালে আবছা এক বিষন্নতা কেউ দেখতে পায়না। তবে শরণ্যা অবাক হয়ে দেখল, আজকে যেন তিলোত্তমার ওই নিখুঁত মুখটাও কি কারণে অন্ধকার হয়ে উঠেছে। দু চোখের কোলে কালি, চোখের দৃষ্টি তার স্বাভাবিক স্বচ্ছতা হারিয়ে ফেলেছে, প্রতিটা পদক্ষেপে প্রচ্ছন্ন ক্লান্তির চিহ্ন। তবে শুধু ক্লান্তি নয়, তার সঙ্গে অন্য কী এক অদ্ভুত ভাব ঠিক্‌রে বেরোচ্ছে তার চোখ-মুখ দিয়ে। ...

    শরণ্যা চমকে উঠল। তিলোত্তমাকে এত হিংস্র দেখাচ্ছে কেন?

    তিলোত্তমা অবশ্য বাক্যব্যয় না করে শরণ্যার পাশে বসে পড়েছে ততক্ষণে। সে না জিজ্ঞেস করে পারেনা, “তিল্লী, কিছু হয়েছে নাকি রে তোর?”

    তিলোত্তমা চম্‌কে ঘুরে তাকাল। তার চোখে এক মুহূর্তের জন্য একটা সতর্কতার ভাব ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। তারপর যেন বেশ অবাক হয়েই পালটা প্রশ্ন করল সে, “কেন রে?”

    “না, আসলে তোকে বেশ টায়ার্ড দেখাচ্ছে তো, তাই...”

    “ওঃ,” তিলোত্তমা হাসল, “আর বলিসনা, কাল এক ফোঁটা ঘুমোতে পারিনি। মাঝরাতে কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেল। এই গরম তার উপর, ভাবতে পারছিস?”

    শরণ্যা আর কথা বাড়াল না। তিলোত্তমা হয়তো সত্যি কথাই বলছে। কিন্তু ওই হিংস্র অভিব্যক্তি সে ভুলতে পারল না কিছুতেই। ইতিমধ্যে ক্লাসের ঘন্টা পড়ে গেল।


    *

    সিক্সথ্‌ পিরিয়ড শুরু হতে না হতেই চারজন দুদ্দাড় করে এসে থার্ড ফ্লোরের দশ নম্বর ঘরে এসে জমা হয়। এই ক্লাসটার জন্য সারাদিন অপেক্ষা করে থাকে ওরা। এই একটি ঘন্টা ঠায় বসে বসে বিরক্তিকর লেক্‌চার শুনতে হয়না; ক্লাসে বসেই পৃথিবীর কত দেশে কত শহরে মানসভ্রমণ করে আসা যায়। কত কী নতুন উপলব্ধি হয় শুধু এইটুকু সময়ের মধ্যে। মাত্র সাতজন ছাত্রী থাকার ফলে অন্যান্য ভিড় ক্লাসের দমবন্ধ আবহাওয়াটাও থাকেনা। ইলেক্‌টিভ ইংলিশ ক্লাস সেইজন্য শরণ্যা, উপলা, মৃণালিনী আর তিলোত্তমার বিশেষ প্রিয়।

    তাদের এই ইস্কুলে ইলেক্‌টিভ সাব্‌জেক্টের ক্লাসগুলোর জন্য ফাঁকা ঘর পাওয়া আর হাতে চাঁদ পাওয়া একই ব্যাপার। প্রথমদিন যখন শরণ্যা ইস্কুলে পা রেখেছিল, তখন সে এমন অবাক হয়েছিল যে মুখ দিয়ে কথা সরেনি। এত কম জায়গার মধ্যে এতগুলো ছেলেমেয়ে যে ঢুকে পড়াশোনা করতে পারে এ তার ধারণার বাইরে ছিল। তাও যদি ইস্কুলের চেহারাটা একটু ভদ্রস্থ হত! প্রত্যেকটা ক্লাসরুমের দরজা ভাঙা, ফাটা ব্ল্যাক্‌বোর্ড, ধূলিধূসরিত করিডোর। জায়গার অভাবে অর্ধেক ডেস্ক সরিয়ে ফেলা হয়েছে, শুধু সারি সারি চেয়ার রাখা; কোনোটা ভাঙা, কোনোটা আস্ত। এক একটা সেক্‌শানে জনা পঞ্চাশেক ছাত্র। ব্যাপার দেখে কান্না পেয়ে গিয়েছিল শরণ্যার। এই এক বছরে তবু অনেকটাই অভ্যেস হয়ে গেছে। ভাগ্য ভাল, ইলেক্‌টিভ ইংলিশের পিরিয়ডে ফাঁকা ঘরের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়না। অমৃতা গাঙ্গুলী ম্যাম নিজের ক্লাসের জন্য এই ঘরটা সবসময় বুক করে রাখেন। অন্য স্টুডেন্ট্‌রা ক্লাস দখল করবার চেষ্টা করলেই ওঁর তাড়া খেয়ে পালায়।

    “আজ এ.জি. এসেছেন কিনা দেখেছিস?” উপলা ক্লাসে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করল।

    “ওঁর না এসে উপায় আছে নাকি?” মৃণালিনী বলল, “দিনে কটা ক্লাস নিতে হয় ওঁকে জানিসনা?”

    বোকা নীলাঞ্জনাও ইলেক্‌টিভ ছাত্রী। সর্বত্র একটা জগদ্দল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘোরে, বোকা বোকা প্রশ্ন করে ক্লাসসুদ্ধ লোককে জ্বালিয়ে মারে। তাছাড়া একটা কথা উচ্চারণ করার আগে পাঁচশোবার হোঁচট খায়। হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকে বলল, “অ্যাব্‌ - অ্যাব্‌সেন্ট করবার প্রশ্নই নেই। আজ ন-নতুন কবিতা শুরু করবেন বললেন না?”

    উপলা চোখ উলটাল। ইতিমধ্যে শিরিন আর কঙ্কনা এসে ঢুকল। কঙ্কনা সর্বদাই ইঙ্গিতে সবাইকে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যে তার মতো দুঃখী দুনিয়া খুঁজলে দুটো মিলবে না। অথচ এরকমটা হওয়ার কোনো কারণ নেই। বাড়ির একমাত্র মেয়ে বলে সে মুখ থেকে খসানো মাত্র যা চায় অমনি হাতে পেয়ে যায়। তার জন্তু-জানোয়ারপ্রীতির কারণে তো তার মা-বাবা বাড়িটাকে একটা চিড়িয়াখানা বানিয়ে ফেলেছেন। কুকুর-বেড়াল-খরগোস-গিনিপিগ থেকে শুরু করে সাপ-ব্যাং-বিছে-বাদুড়, মায় একখানা কাকাতুয়া পাখি অবধি আনা হয়েছে। এত সবের পরেও কিন্তু সে বেদনার অতলে তলিয়ে থাকে। এইতো আজকেও থমথমে মুখ নিয়ে ঢুকে কারুর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা না করে নিজের সীটে বসে পড়ল।

    উপলা খানিক পর জিজ্ঞেস করেই ফেলল, “কিছু হয়েছে নাকি রে কঙ্কনা?”

    কঙ্কনা কিছুক্ষণ ড্যাব্‌ড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর গম্ভীর গলায় উত্তর দিল, “কাল রাতে চার্লি দ্য জুনিয়র পালিয়ে গেছে।”

    কিছুদিন আগে সে কাঁচের জারে এক জোড়া শামুক পুষেছিল; নাম দিয়েছিল চার্লি দ্য সিনিয়র আর চার্লি দ্য জুনিয়র। তারই একজন পালিয়েছে! তিলোত্তমা আজ সারাদিন একটাও বাড়তি কথা খরচ করেনি, কিন্তু এই নিদারুণ সংবাদে সেও কিছু একটা বলা কর্তব্য মনে করল।

    “সেকি রে! কি করে পালাল?”

    “সেটা জানলে পালাতে দিতাম না।”

    এই বলে সে সিড্‌নি শেল্ডনের একখানা থ্রিলার বার করে পড়তে লেগে গেল। অন্যান্য দিনের মতো আজকেও সে কবিতার বইটা নিয়ে আসেনি। তিলোত্তমা আর উপলা মুখ তাকাতাকি করে মুচকি হাসল।

    “গার্ল্‌স, আর য়ু অল্‌ হিয়ার?” বলতে বলতে এ.জি. ক্লাসে এসে ঢুকলেন। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে একবাক্যে ‘গুড্‌ আফটার্‌নুন ম্যাম’ বলে উঠল। শুধুমাত্র কঙ্কনা একাগ্রচিত্তে বই পড়েই চলল; এ.জি. যে ক্লাসে ঢুকেছেন তা বোধহয় ও টের পেলনা। তিনি ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেও কিছু বললেন না, কারণ ঘটনাটা মোটেই নতুন নয়।

    “আফ্‌টারনুন তো নিশ্চয়ই, গুড কিনা বলতে পারছি না,” এ.জি. চেয়ারে বসতে বসতে উত্তর দিলেন।

    “কেন ম্যাম্‌, কি হয়েছে?” শিরিন প্রশ্ন করে।

    “কেন আবার! হেড্‌মিস্ট্রেসের অফিস থেকে এইমাত্র খবর পেলাম যে স্কুলের পরে বোর্ড অফ গভর্‌নর্স-এর মিটিং বসবে আর আমি নাকি টিচারদের অন্যতম প্রতিনিধি! ভেবেছিলাম আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরব, তা আর হল না!” এ.জি. দুঃখের নিঃশ্বাস ফেললেন, “যাই হোক, এলিয়ট শুরু করার কথা ছিল না আজকে?”

    “ইয়েস ম্যাম।”

    “এলিয়টের কবিতা পড়ার সময় কয়েকটা কথা মনে রাখা দরকার,” এ.জি. বলতে লাগলেন, “তাঁকে কিন্তু টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরির সবচেয়ে বড় কবি বলা হত এক সময়। হি ওয়াজ অফ কোর্স আ পায়োনিয়র অফ দ্য মডার্নিস্ট মুভমেন্ট। এখনও পর্যন্ত তোমরা যে ধরনের কবিতা পড়েছ, এলিয়টের কবিতা তার থেকে অনেকটাই আলাদা। বলতে পারো, তাঁর কবিতা দিয়ে একটা নতুন যুগের সূত্রপাত ঘটছে। তার থেকেও বড় কথা, সব ভাল কবিতার মতোই এঁর কোনো কবিতার ওপরেই একখানা করে ব্যখ্যা চাপিয়ে দেওয়া যায়না। এভ্‌রি পোয়েম অফ এলিয়ট হ্যাজ মেনি লেয়ার্স অফ মীনিং, লাইক অ্যান অনিয়ন,” এ.জি. হেসে বই খুললেন। প্রথম কবিতার নাম ‘Preludes’।


    *

    স্কুলের গেট দিয়ে বেরোতেই আধ ঘন্টা লেগে যায়। ঢোকার পথটা একফালি সরু কানা গলির মতো — প্রত্যেকদিন সেখান দিয়ে শ’য়ে শ’য়ে ছেলেমেয়েদের বার করা কি চারটিখানি কথা! কোনো মতে সামনের রাস্তায় বেরিয়ে এসে শরণ্যা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। তার পিছনে একে একে উপলা, মৃণালিনী আর তিলোত্তমাও এল, অবশেষে নীরা।

    “প্রত্যেকবার গেট দিয়ে বেরোবার সময় মনে হয় এই শেষ, আজই ভিড়ের তলায় চাপা পড়ে অক্কা পাব,” নীরা চুল ঠিক করতে করতে বলে। সে ছোট্টখাট্ট চেহারার মানুষ, কথাটা বলে মোটেও অত্যুক্তি করেনি। মৃণালিনী শরণ্যার পিঠে চাপড় মেরে বলল, “এরকম বুঝভুম্বুল মেরে গেলি কেন?”

    শরণ্যা হাসল, “কিছু না রে। আসলে এলিয়ট লোকটা বেশ ভাবিয়ে তুলেছে।”

    উপলা বলল, “সত্যি বাবা, মাল ঘোরালো।”

    নীরার ইলেক্‌টিভ ইংলিশ নেই; ও আর্ট ক্লাস করে। কথাবার্তার কিছুই না ধরতে পেরে জিজ্ঞেস করল, “কোন মাল? কার কথা বলছিস বল্‌ তো?”

    “আরে ইলেক্‌টিভ ইংলিশ ক্লাসে নতুন পোয়েট শুরু করেছে, তার নাম টি. এস. এলিয়ট। হেভি চাপের কবিতা লেখেন ভদ্রলোক, মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।”

    “ওঃ, তাই বল্‌। এমনভাবে বলছিস যেন লোকটা তোদের ইয়ার দোস্ত।”

    তিলোত্তমা বলল, “এলিয়ট নিয়ে বেশি ভাবিস না রে রন্‌, মাথা ঘুরে উলটে পড়ে থাকবি। যাক্‌গে, আমার আবার একটু তাড়া আছে, বুঝলি? আমি এগোই, টাটা।”

    অন্যরা মোড়ের মাথায় তাদের প্রিয় ফুচ্‌কাকাকুর কাছে চলল।

    “বাঃ, আজ বেশ ফাঁকা আছে তো রে,” মৃণালিনী দূর থেকে জরীপ করে নিয়ে হৃষ্ট হয়ে বলে। ফুচ্‌কাকাকুর কাছে পৌঁছে উপলা গম্ভীরভাবে ফরমাশ করল, “কাকু, ঝাল-ছাড়া হবে। আর বেশি করে আলু দেবে কিন্তু, কঞ্জুসী করবে না একদম।”

    “না না, তাই হয়,” ফুচ্‌কাওয়ালা দাঁত বের করে বলল, “সবাইকে পাঁচ টাকার তো?”

    শরণ্যা আর উপলা মুখ তাকাতাকি করে দুষ্টুমির হাসি হাসল। শরণ্যা উত্তর দিল, “আমাদের দুজনকে দশটাকার দেবে।”

    উপলা শরণ্যার কানে কানে বলল, “তেঁতুলজলে গন্ধরাজ লেবু দেয়, দেখেছিস?”


    *

    বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে গিয়ে খানিকক্ষণ বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে রইল শরণ্যা। মনটা কেমন যেন অস্থির লাগছে। এলিয়টের কবিতা সে আরও ছোটবেলায় পড়েছিল, মনে আছে। সেগুলো প্রত্যেকটাই এক এক ধরনের বেড়াল নিয়ে লেখা। কি যেন নাম ছিল বইটার? … হ্যাঁ হ্যাঁ, The Old Possum’s Book of Practical Cats। তখন পড়ে খুব মজা পেয়েছিল। কিন্তু আজকে ক্লাসে যেটা পড়ানো হল তা একেবারেই অন্যরকম। নিজের অজান্তেই সেটা মনের কোনো একটা জায়গায় নাড়া দিয়ে গেছে। এ.জি-র কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল যেন কবি তার কথা ভেবেই কবিতাটা লিখেছেন। সত্যিই তো; একটা উদাসীন, কঠোর শহরের বুকের মধ্যে বন্দী হয়ে থাকা হৃদয়, যা বারে বারে আকাশের দিকে তাকিয়ে উত্তর খোঁজে, সে শরণ্যা ছাড়া আর কার? আগে তো কখনও কোনো কবির লেখা পড়ে তাঁকে এমন কাছের লোক বলে মনে হয়নি। খানিকক্ষণ পর সে নিজের অজান্তেই বলে উঠল, “ছোটমাসিকে চিঠি লিখতে হবে।”


    *

    দরজার সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল তিলোত্তমা। বেলটা বাজাতে কিছুতেই হাত উঠছিল না। দিনের শেষে মানুষ যখন বাড়ি ফেরে, তখন তার ক্লান্তির মধ্যেও নিজের ঘরে গিয়ে আসন্ন বিশ্রামের কথা চিন্তা করে একটা আরাম বোধ হয়। তিলোত্তমার জীবনে কোনো আরাম নেই, স্বস্তি নেই। থাকবে কেমন করে; তিলোত্তমার তো বাড়িই নেই। বাধ্য হয়ে তাকে এদের সঙ্গে এক ছাদের তলায় থাকতে হয় ঠিকই, কিন্তু সে তো কোনো উপায়ান্তর না থাকায়। কতবার মনে হয়নি কি, ফেরার পথে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে? ...


    শেষ পর্যন্ত বেল না বাজাতেই দরজা খুলে গেল। কাকান কোথাও একটা বেরোচ্ছিল, তাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল; চোখে অবাক দৃষ্টি। অবশ্য মুহূর্তের মধ্যেই মুখের ভাব বদলে গেল তার। আলতোভাবে হেসে বলল, “কতক্ষণ?”

    তিলোত্তমা উত্তর না দিয়ে কর্কশভাবে বলল, “সরো।”

    কাকান বাধ্য ছেলের মতো সরে দাঁড়াল। ভিতরে ঢুকতে ঢুকতেই ওর তীরের মতো চাহনি নিজের উপর অনুভব করছিল সে। এই চাহনি কোথাও তাকে এক দণ্ড হাঁফ ছাড়তে দেয়না। মনের ভিতর ছট্‌ফট করতে করতে সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েছিল সে। প্রথম ধাপটা উঠতে না উঠতেই শুনতে পেল কাকান ডাকছে, “মিঙ্কু, শোন্‌।”

    “আমার সময় নেই।”

    তিলোত্তমা আর দাঁড়াল না। একটার পর একটা সিঁড়ি টপকে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।


    ।। ৩ ।।


    জ একটা বিশেষ দিন। আগে হলে সানাকে ডেকে কিছু পরামর্শ নেওয়া যেত। সানা বরাবর পোষাক-আশাকের ব্যাপারটা ভাল বোঝে, ফিট্‌ফাট থাকতে পছন্দ করে। তাছাড়া ও বেশ সুন্দরীও; মম্‌ ড্যাড দুজনেরই ভাল জিনিসটা পেয়েছে। শরণ্যা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলল। অন্য দিন কখনোও এসব নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। আজকে কিছুই যেন ভাল লাগল না! বিরক্ত হয়ে আয়নার সামনে থেকে সরে এসে আলমারির দিকে এগোয়। দেরি হয়ে যাচ্ছে। য়ুরোপিয়ান পাংচুয়ালিটি অভ্যেসটা জায়গা বদল হওয়া সত্ত্বেও তাকে ছেড়ে যায়নি। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নীচে নেমে এল সে। মম্‌ বাইরের ঘরেই ছিল। শরণ্যাকে দেখে বলল, “কোথায় বেরচ্ছিস রাকা?”

    “রঙ্গীতদার বাড়ি।”

    “ওমা, ও কবে কলকাতায় এল? বলিসনি তো!”

    “এসেছে প্রায় হপ্তাখানেক।”

    “তোকে ডেকেছে নাকি?”

    “হ্যাঁ, ওর অন্য বন্ধুগুলোও তো যাবে।”

    “আচ্ছা। বেশি দেরি করিসনা কিন্তু।”

    “একটু দেরি হতে পারে। সেরকম হলে রঙ্গীতদা পৌঁছে দেবে।”

    “ও। তাহলে ঠিক আছে। সাবধানে যাস, ওকে?”

    “ইয়া। বাই মম্‌।”

    রঙ্গীতদার বাড়ি এখান থেকে বেশ কিছুটা দূর। শরণ্যা তাও হেঁটেই যায়, বাস অটো ধরা পছন্দ করে না। এই রাস্তাটুকু নিজের ভাবনাগুলো একটু গুছিয়ে নেওয়া যায়। এবার যেন কতদিন পর? তা অনেকদিন, বছরখানেক প্রায়। শরণ্যার আবার দিনক্ষণ, সাল-তারিখ মনে থাকে না। আসলে রঙ্গীতদা তো কলকাতায় আসতেই চায় না। কাকুই যান শান্তিনিকেতনে ছেলের কাছে। তবে ওর ছোটবেলার বন্ধুরা বেশিরভাগই এখানে। শরণ্যা অবশ্য ঠিক সেই দলে পড়ে না। কিন্তু মম্‌-ড্যাড কাকুকে অনেকদিন ধরেই চেনে।

    রঙ্গীতদার বাড়ির গলিতে বড় রাস্তার আওয়াজ আসে না খুব একটা, যদিও একেবারে নির্জন নয়। শরণ্যা বুকের মধ্যে ধুক্‌পুকুনির আওয়াজ টের পেল, আবার পরক্ষণেই হেসে ফেলল। কার জন্যে এত চিন্তা ওর? রঙ্গীত সিন্‌হারয় তেমন বান্দাই না! নিজের এক জগতে বাস করে সে; মাঝে মাঝে কাছের মানুষদেরই খোঁজখবর নিয়ে উঠতে পারে না, তো শরণ্যার মতো একজন অর্ধপরিচিতের খবর! রঙ্গীতদার দৈনন্দিন চিন্তাজগতে যে তার কোনও জায়গা নেই, তা শরণ্যা জানে। সত্যি বলতে কি, রঙ্গীতদা যদি হঠাৎ করে শরণ্যার দিকে একটু বেশি নজর দেওয়া শুরু করে, তাহলে সে যে কি বিব্রত হবে, তা বলার নয়। তবু, অনেকদিন বাদে বাদে যখন আচমকা ফোনটা বেজে ওঠে, আর ওপার থেকে সেই প্রিয় আওয়াজ ভেসে আসে, তখন সে নিজের অজান্তেই ভাবে, ‘আই উইশ য়ু নিউ মি বেটার।’

    এত সব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ওদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তা টের পায়নি শরণ্যা। বেশ বড় বাড়িটা, সামনে এক চিলতে বাগানও আছে; তাদের ফ্ল্যাট-বাড়ির মতো বীভৎস এক খাঁচা নয়। ভাব দেখে মনে হল এখনই কেউ এসে পৌঁছায়নি। বন্ধ দরজার সামনে শরণ্যা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। ধুক্‌পুকুনিটা বাড়ছে। কে আসবে দরজা খুলতে? কাকু, না...

    মনের ভিতরে একটা আওয়াজ হঠাৎ খ্যাঁক করে উঠল, ‘ন্যাকামি হচ্ছে? কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি উজবুকের মতো?’

    অমনি হাতটা বাধ্য ছেলের মতো উঠে গিয়ে বেলটা বাজিয়ে দিল। কতক্ষণ কাটল শরণ্যা জানে না। তারপর দরজা খুলে একটা ছেলে বেরিয়ে এসে হাসল।

    ভাগ্যিস ড্যাড এখন জাহাজে নেই। শরণ্যা জানে এই মুহূর্তে অ্যাটলান্টিকে প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে।


    *

    উপলাকে আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। বাড়িসুদ্ধ লোক ওর হাবভাব দেখে চিন্তিত। বিকেল পর্যন্ত বেশ সুস্থ ছিল মেয়েটা। সন্ধেবেলার দিকে কাকে যেন একটা ফোন করেছিল। তা, ফোন করাটা কিছু বিচিত্র নয়। উপলা তো সাধারণ মেয়ে নয়, ও তো কর্পোরেটের সি.ই.ও-র চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। চব্বিশ ঘন্টা হয় ফোন করছে, নয় ফোন ধরছে। কিন্তু লক্ষ্য করা গেল যে ফোনটা করবার পর থেকেই উপলার আচার-আচরণ সব কিছু পালটে গেছে। রেগে কাঁই হয়ে এঘর-ওঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে, নয়তো দুমদাম করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করছে। তিন-চারবার নিজের ঘরে গিয়ে আরও গোটা দু-তিন ফোন করে তারস্বরে কাকে কি যেন বলল। ছোটকাকীমার নির্দেশে উপলার ছোট ভাই পুলু গিয়ে আড়ি পাতার বৃথা চেষ্টা করে কানমলা আর গাঁট্টা খেয়ে ফিরে এল।

    বাড়ির সবাই ভাবনায় অস্থির। উপলার দুজন জেঠিমা এবং দুজন কাকীমা একেবারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। মা এখনও অফিস থেকে ফেরেনি। ভাগ্যিস ফেরেনি! তাহলে মুশকিল ছিল আর কি। ওদের এই বড়সড় যৌথ পরিবারটিতে কেউ যদি উপলাকে শাসন করার থাকে তো সে মা। তার মতে, ‘অন্যদের লাই পেয়ে পেয়েই তো পলাটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে’। অবশ্য এও সত্যি যে উপলার অনর্গল বক্‌বক করার সঙ্গীও ওই মা-ই; তার জীবনের যাবতীয় তথ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তা যেমনই হোক, মা আপাততঃ অনুপস্থিত, এবং জেঠিমা-কাকীমারা গভীর চিন্তায় মগ্ন। হল কি মেয়েটার?

    উপলার মামান দিল্লী থেকে সাতদিনের ছুটি নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন সপরিবারে। সান্ধ্যভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরে এসে দেখেন হুলুস্থুল কাণ্ড। পুলু তার মামাতো ভাই পিক্‌লুর সাথে মুখ চুন করে বসে আছে। মামী বারবার উপলার ঘরের দরজায় গিয়ে কান পেতে আসছেন, জেঠিমা-কাকীমারা উদ্বিগ্নভাবে বলে উঠছেন, “কিছু শুনতে পেলে গো?”

    মামী গম্ভীরমুখে চেয়ার দখল করে বললেন, “কি বলছে ভাল শুনতে পাইনি। মনে হল কোনো মেয়েকে চুটিয়ে গাল দিচ্ছে। কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলছে আর চেঁচাচ্ছে, ‘হাউ কুড শি! হাউ কুড শি! আমি কি ওর বন্ধু নই! এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করল আমার সঙ্গে!’”

    মামান পুরো ব্যাপারটার ল্যাজা-মুড়ো কিছুই ধরতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে? কে কার সঙ্গে কী বিশ্বাসঘাতকতা করেছে?”

    মামানকে সবিস্তারে ঘটনার বিবরণ দেওয়া হল। তিনি সবটা শুনে গম্ভীর হয়ে বললেন, “হুঁ।”

    বড়জেঠিমা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু বুঝতে পারলে?”

    “সবই বুঝেছি।”

    জেঠিমা-কাকীমা-মামীমারা আরও ঘাবড়ে গিয়ে মুখ তাকাতাকি করতে লাগলেন। মামানই হঠাৎ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললেন, “একবার এঁচে আসি যা সন্দেহ করেছি তা ঠিক কিনা।”

    পা টিপে টিপে দরজায় কান পেতে কি সব শুনে এসে আবার চেয়ারে বসে বললেন, “হুঁ, যা ভেবেছি।”

    সবাই সমস্বরে প্রশ্ন করে উঠলেন, “কী, কী?”

    মামান ডিটেক্‌টিভের কায়দায় সবার মুখের উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে ঘোষণা করলেন, “ব্রেক আপ।”

    বড়কাকীমা হাঁ হয়ে বললেন, “কীঃ?”

    মামান শ্বাস ফেলে মামীকে বললেন, “বাচ্চাদুটোকে নড়া ধরে ভিতরে পাঠিয়ে দাও তো। বড়দের মাঝখানে বসে ইয়ার্কি মারছে সব।”

    আর কিছু বলার দরকার হল না। পুলু সঙ্গে সঙ্গে পিক্‌লুকে বগলদাবা করে ভিতরের ঘরে হাওয়া হয়ে গেল। কানমলা আর গাঁট্টা সে অনেক আগেই খেয়েছে; এখন ঘাড়ধাক্কা খাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে প্রকাশ করল না। ছোট হলে কি হয়, তার একটা মান-সম্মান তো আছে!

    মামান গুছিয়ে বসে বললেন, “কেস জলের মতো পরিষ্কার। পলার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ব্রেক-আপ হয়েছে। তাও আবার চরম নাটকীয় কায়দায়। অন্য কোনো একটা মেয়ে, খুব সম্ভব পলারই কোনো এক বন্ধু ছেলেটাকে হাত করে ফেলেছে।”

    বড়জেঠিমা বিড়্‌বিড় করে বললেন, “পলার আবার বয়ফ্রেন্ড আছে...”

    মামান তাচ্ছিল্যভরে বললেন, “হাসালেন বড়দি। আজকাল কোন ছেলেমেয়ের একটা করে থাকে না বলুন দেখি। এটা টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি! আর ভাববেন না যে আপনার ছেলেদুটি কিছু কম। এই তো সেদিন চিন্টুকে দেখলাম মোড়ের মাথায় কার সঙ্গে যেন দাঁড়িয়ে ফুচ্‌কা খাচ্ছে –”

    “আহা, কিন্তু পলার যে ব্রেক-আপই হয়েছে তা বুঝলে কি করে?” বিপদ বুঝে মামী তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে দেন।

    “বুদ্ধি খাটালেই বোঝা যায়। তুমিও তো শুনছিলে ও কি বলছিল। আমিও যা শুনলাম তা থেকে দুইয়ে দুইয়ে চার করা এমন কিছু শক্ত নয়।”

    “কী শুনলে তাই বলো না!”

    “সবটা শুনতে পাইনি। দু-তিনবার একটা ছেলের নাম করল, রঞ্জিত না রঙ্গীত না কী যেন। একবার শুনলাম বলল, ‘শালা, ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে মুখ দেখে টের পেয়েছিলি? ভাবখানা যেন ভাজা মাছটা উলটে খেতে জানে না! স্কুলে আসুক, দেখাচ্ছি মজা। এমন বৃন্দাবন দেখাব যে রাসলীলা বেরিয়ে যাবে। আমার পিঠপীছে এই সব চলছে আর আমি কিছুই বুঝতে পারিনি —’ এই সব আর কি। তা, এর থেকে কী অনুমান করা যায়?”

    বড়কাকীমা একটু কাতর কন্ঠে বললেন, “নতুন স্কুলে গিয়ে একি ভাষা শিখল মেয়েটা! বরাবর পলাকে দেখে আসছি, যেমন নম্র তেমনি মিষ্টি স্বভাব –”

    মামান বরাভয়ের হাত তুলে বললেন, “রিল্যাক্স্‌ জয়িদি। আজকালকার ছেলেমেয়েদের এটাই ভাষা। দিনে পঞ্চাশটা গাল না দিলে হজম হয় না। ফ্রাস্‌ট্রেশানে ভোগে তো সব! তা ছাড়া এ সব ভাষা আবার বন্ধু-বান্ধবদের সামনে ছাড়া আর কোথাও ব্যবহারও করে না, কম চালাক নাকি?”

    হঠাৎ ছোটকাকীমা ভয় পাওয়ার মতো শ্বাস নিয়ে বললেন, “ও ভাস্করদা!”

    “আবার কি হল?” মামান অবাক।

    “পলার তো ব্রেক-আপ হয়েছে বললেন! ঝোঁকের মাথায় কিছু করে-টরে বসবে না তো?”

    মামান ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, “করে-টরে বসবে মানে? কি বলছেন কী?”

    ছোটকাকীমা প্রায় কেঁদে ফেললেন, “আজকাল কাগজ-টাগজ পড়েন না নাকি? দেখছেন না, ছেলেমেয়েগুলো কিরকম ক্ষেপে গেছে? এই তো কিছুদিন আগে একটা ছেলের ব্রেক-আপ হয়ে গেছে বলে সিলিং-ফ্যানের সঙ্গে লট্‌কে –”

    মামী হাঁউমাউ করে উঠলেন, “ওমা গো, এ সব কি বলছ গো দীপা! বাড়িতে এখন দিদি-জামাইবাবু কেউ নেই, এই সময় – ”

    মামানের মুখ শুকিয়ে গেছে। চাপা গলায় বললেন, “এটা তো ভেবে দেখিনি!” এই বলে উপলার ঘরের সামনে ছুটে গিয়ে দুমদুম করে দরজায় কিল মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভিতর থেকে তীব্র চিৎকার, “কে বে?”

    আওয়াজ শুনে সবাই কিছু ধাতস্থ হলেন। মরার আগে লোকে যাই করুক, ‘কে বে’ বলে চেঁচায় না। মামান খুব সাবধানী গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “পলা, ঘুমিয়ে পড়েছিস মা?”

    “ওঃ মামান তুমি? হে হে। সরি, আমি ভেবেছিলাম পুলু। কিছু বলবে?”

    “না, মানে ইয়ে — দরজাটা কি খুলে রাখবি?”

    “খুলে রাখব? পড়াশোনার সময় দরজা খুলে রাখব? কেন বল তো?” উপলার গলায় সন্দেহের রেশ।

    মামান তাড়াতাড়ি বললেন, “ওঃ, তুই বুঝি পড়ছিস? তাহলে পড়, আমি ভাবলাম কি না কী করছিস। আমি যাচ্ছি, টাটা।”



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ | পর্ব ১১ | পর্ব ১২ | পর্ব ১৩ | পর্ব ১৪ | পর্ব ১৫ | পর্ব ১৬ | পর্ব ১৭ (শেষ)
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments