“নীরা-তিল্লীর কেসটা কি বল্ তো? এত করে বললাম, কিছুতেই এলে না!” উপলা ব্যাজার মুখে এক টুকরো চিলি চিকেন মুখে চালান করল।
তারা তিনজন ‘গ্রাব-ক্লাব’-এ লাঞ্চ খেতে এসেছে। মৃণালিনী অবশ্য বাকি বন্ধুদের অনুপস্থিতিতে কিছুমাত্র বিচলিত নয়। ইতিমধ্যেই নিজের চাওমিনের বাটি অর্ধেক ফাঁকা করে এনেছিল।
খেতে খেতেই নির্লিপ্তভাবে বলল, “সাতদিনের হলিডে সেরে রিকু তো সবে গতকাল বাড়ি ফিরল। নীরা আজ ওর বাড়ির বাইরে পা দেবে ভেবেছিস? একেই তো শুনলাম মালটা নাকি ওকে ইন্ফর্ম না করেই সোজা দার্জিলিং চম্পট ... হেঃ হেঃ। না, আজ ওর বেরোবার কোনো সীন্ নেই।”
“সে বেশ কথা, কিন্তু তিল্লীর কি হল?”
“তিল্লীর যে কি হয় আর না হয়, সেটা বোঝা আল্লার অসাধ্য। তবে ওর বোধহয় শরীরটা ভাল নেই। আমি ফোন করেছিলাম প্রায় দশটা নাগাদ, তখনও নাকি সে ঘুমোচ্ছিল! বেশ জড়ানো গলায় বলল মাথা ধরেছে না ঠাণ্ডা লেগেছে, আজ পারবে না। সে হতেই পারে, কারণ এমনিতে তো তুই আর তিল্লী সকালে বেশ তাড়াতাড়িই উঠিস। আজ এত দেরি মানে নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে।”
উপলা খাওয়া থামিয়ে বলল, “সে আবার কি?”
“... সঠিক বলতে পারব না। তবে আমার কেন জানিনা মনে হয় যে আসলে ওর অসুখ-বিসুখ কিছু হয়না। অন্য কোনো একটা কারণ আছে যেটা আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে যায়।”
মৃণালিনী মুখ-ভর্তি চিলি-চিকেন নিয়েই বলে উঠল, “সে তো আলবাৎ লুকোয়। এটা কি আজকের ব্যাপার নাকি? যবে থেকে এই নতুন ইস্কুলের পাগলাগারদে ঢুকেছি তখন থেকেই এক চিত্র। আজকাল তাও মুখ দিয়ে দু-একটা শব্দ বার করে; আগে হলে তো ... হুঁ-হুঁ।”
এরপর বেশ কিছুক্ষণ কেউই কোনো কথা বলে না। শরণ্যা অবশ্য চামচ ঘুরিয়ে যেতেই থাকে। একটা সময় উপলা আর না পেরে বলল, “রন্, স্যুপটা অলরেডি রান্না হয়ে গেছে, বুঝলি? আর চামচ না নাড়লেও চলবে।”
শরণ্যা চটকা ভেঙে বলে, “আরে না ... আসলে নানারকম ভাবছিলাম।”
“কি ভাবছিলি?”
“ওই তো, রঙ্গীতদা মিসিং –”
মৃণালিনী তাজ্জব হয়ে বলে, “মিসিং আবার কী? হারিয়ে গেছে?”
“প্রায় তাই,” শরণ্যা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “কোনো ট্রেস নেই লোকটার। ফোনে তো নয়ই, অন্য কেউ খবরও দিতে পারছে না। আর দেবেই বা কে! ঋদ্ধিমানদা তো ব্রেক-আপ হবার পর থেকে বেদনার অতলে তলিয়ে আছে ...”
উপলা হাঁ হয়ে বলল, “তারও ব্রেক-আপ হয়ে গেছে? এটা কি ব্রেক-আপ সীজন চলছে নাকি রে? চারদিকে সবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাচ্ছে! সেদিন তিল্লীর ব্রেক-আপ হল, বেস্পতিবার তোর বাড়ি যাবার সময় বাসের সেই ছেলেটা নিজের ব্রেক-আপ নিয়ে কাঁদছিল, তারপর রাত্তিরবেলা আমার ব্রেক-আপ হয়ে গেল, এখন আবার শুনছি ঋদ্ধিমানদা –”
“এক মিনিট, এক মিনিট!” তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে শরণ্যা অবাকভাবে বলল, “কি বললি? কার ব্রেক-আপ?”
কথাটা বলে ফেলে উপলা একটু থমকে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিয়ে সুস্থিরভাবে বলল, “আমার ব্রেক-আপ।”
মৃণালিনীর হাত থেকে ঠঙাস করে কাঁটা-চামচদুটো প্লেটের উপর পড়ে গেল।
“মানেটা কি?” খাবি খেয়ে বলল, “কবে? কি করে? পাগল নাকি!”
“বললাম তো, বেস্পতিবার রাতে। রনের বাড়ি থেকে ফিরে এসেই গণ্ডগোল পেকেছিল, তারপর একেবারে ছড়িয়ে লাট।”
“এত কিছু হয়ে গেল আর তুই এতক্ষণে বলছিস, অপ্রকৃতিস্থ মাতাল?!” শরণ্যা আর মৃণালিনী একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল।
আশেপাশের লোকেরা আড়চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে নিল একবার। উপলা অপ্রস্তুতের একশেষ হয়ে ফিস্ফিস্ করে বলল, “ওরে গাড়লগুলো, উন্মাদের মতো চেঁচাচ্ছিস কেন?”
“উন্মাদ তো তুই, বে,” মৃণালিনী দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “না হলে পুরো ব্যাপারটা চেপে যাওয়ার তালে ছিলি কি করে? আ-মা-দে-র কাছে! এটাকে পাগলের আইডিয়া বলব না তো কি বলব?”
“সিরিয়াসলি পল্,” শরণ্যা গম্ভীরভাবে বলে, “তুই কি আক্কেলে এরকম একটা ঘটনা চেপে যাচ্ছিলি? আমাদের কি আজকাল আর কিছু বলা যায়না?”
“ওরে বাবা রে!” উপলা বিপন্ন, “শোন, কণিষ্কর জীবনে ক্রাইসিস হয়েছে, কেমন? ওর মা-বাবার ডিভোর্স নিয়ে এতরকম অশান্তি হচ্ছে যে ওর টেম্পোরারিলি মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। আমাকে রাতের বেলা এস.এম.এস করল যে ওর লাইফের লাফ্ড়া আমার ঘাড়ে চাপাতে চায়না, এমনিও আমি ওর সমস্যাগুলো বুঝতে পারব না কারণ আমার জীবনে কোনো ঝামেলা নেই; তাই দিস রিলেশানশিপ শুড এন্ড। এখন তুই বল্, আমার জীবনে এখন চাপ নেই বলে কি কোনোদিন হবে না? আর প্রবলেম হলে তো মানুষ বন্ধুদের কাছেই যায়, তাই না? সবচেয়ে বড় কথা হল, আমার আর কণিষ্কর লাইফে যদি একসঙ্গে আকাশ ভেঙে পড়ে, সেটা কি আমাদের দুজনের পক্ষে ভাল হবে? একজন ঠিক থাকলে তবেই তো অন্যজনকে হেল্প করতে পারবে, নাকি?”
মৃণালিনী হাঁ করে সমস্তটা শুনছিল; খানিকক্ষণ একইভাবে উপলার দিকে তাকিয়ে থেকে অবশেষে হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “এরকম ভাঁটের লজিক যে পৃথিবীতে হয় জানা ছিলনা বাবা।”
“এক্স্যাক্টলি। এইজন্যেই তো তোদেরকে বলিনি ব্যাপারটা – নেহাৎ এখন রেগেমেগে ফোন ধরছে না, কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে শিওর মিটমাট হয়ে যাবে। কটা দিন মাথা ঠাণ্ডা করুক, তারপর নিজেই বাড়ি এসে হাজির হবে। মালটা এরকমই ক্যারেক্টার।”
“কিন্তু ওর মা-বাবার মধ্যে গোলমাল তো অনেকদিন ধরে। হঠাৎ নতুন করে কি এমন ঘটল?”
“আরে, সে বিশাল কেলেঙ্কারি,” উপলা নীচু গলায় বলল, “এতদিন তো কণিষ্ক দেখে আসছে যে রবিন আঙ্কল অবন্তিকা আন্টিকে একেবারে টাইম দেন না, ঠিকঠাক ব্যবহার করেননা, অকারণে অশান্তি বাধান, এইসব। তাই কণিষ্ক এতদিন পুরোপুরি মাকে সাপোর্ট দিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন এদ্দিন বাদে হঠাৎ জানতে পেরেছে যে অবন্তিকা আন্টিরও কিছু ইন্পুট আছে এর মধ্যে। শি ইজ হ্যাভিং অ্যান অ্যাফেয়ার, তাও আবার খুব অল্পবয়সী একটা ছেলের সঙ্গে।”
“ওঃ বাবা!” মৃণালিনী চোখ বড় করে বলল, “সত্যিই তো কেলেঙ্কারি!”
“হ্যাঁ, কিন্তু,” শরণ্যা ভেবেচিন্তে বলে, “এ ক্ষেত্রে কি আন্টিকেও পুরো দোষটা দেওয়া ঠিক হচ্ছে? মেয়েবি শি হ্যাড্ বিকাম ভেরি লোন্লি অর্ সামথিং।”
“এই, এই!” উপলা উৎসাহিত হয়ে টেবিলে চাপড় মারল, “বিশ্বাস করবি না, ঠিক এই কথাটাই আমি কণিষ্ককে বলতে যাচ্ছিলাম। তাইতে ও পুরো বার্স্ট করল।”
মৃণালিনী বলল, “সেটাও খুব একটা আশ্চর্য নয়। যতই হোক, আমরা তো ব্যাপারটা বাইরে থেকে দেখছি। আমাদের পক্ষে আন্বায়াস্ড হওয়া যতটা সহজ, কণিষ্কর পক্ষে নিশ্চয়ই নয়। ও তো শক্ড হবেই। হার্ট-ও হবে।”
শরণ্যা আশ্বাস দিল, “তুই ঠিকই ভাবছিস। এটা বেশিদিনের ব্যাপার নয়। কণিষ্ক ক’টা দিন মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবুক, মায়ের সঙ্গে একবার বসে কথা বলুক, দেখবি তারপর আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।”
“হুঁ। আই জাস্ট হোপ শাক্যদার ফিরে আসার খবরটা সত্যি।”
“সেটা আবার কে?”
“ওই যে, কণিষ্কর দাদা। তার তো আমেরিকা থেকে পার্মানেন্টলি ফেরার কথা। অ্যাট লীস্ট কণিষ্ক তাই বলেছিল। সেটা হলে খুবই ভাল, কারণ ও শাক্যদার উপর খুব ডিপেণ্ড করে।”
সকলেই ভাবুক মুখে বসে থাকে খানিকক্ষণ। উপলা যতই হালকাভাবে কথাগুলো বলুক, ভিতরে ভিতরে যে সে মনে বেশ জোর একটা ধাক্কা খেয়েছে, তা ওর গলার স্বরেই বেশ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। সে নিজেও ব্যাপারটা আঁচ করে অন্য দিকে কথা ঘুরিয়ে দিতে চাইল।
“অনেক ভাঁট হয়েছে। রনের বোধহয় হোপফুল কিছু বলার নেই। তা লিনী, তোমার ঝোলায় কি পাতে দেওয়ার মতো নিউজ আছে?”
শরণ্যা নড়েচড়ে বসে বলল, “নিউজ যে আছে, সে তো লিনীর খাওয়ার বহর দেখেই মালুম হয়েছে।” মৃণালিনী অবাক হয়ে বলল, “তুই কি নতুন ধরণের অ্যাস্ট্রলজার? মানুষের খাওয়া দেখে তাদের লাইফ প্রেডিক্শান দিস?”
“না বে। ঝামেলায় পড়লেই তোর খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। অনেকদিন পর দেখলাম নর্মাল অ্যাপেটাইট নিয়ে ফিরেছিস। তার মানে ঝামেলা শেষ হয়েছে।”
মৃণালিনী ব্যাজারভাবে জানাল, “শেষ হয়নি, ঝুলিয়ে রেখে পালিয়ে গেছে। কুপিয়ে দিতে হয় মালটাকে।”
“আ-বা-র কি হল?” উপলা অধৈর্য্যভাবে মাথা নাড়ে।
মৃণালিনী সবিস্তারে বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যের ঘটনার ফিরিস্তি দিল।
“উরিশ্শালা!” উপলা উত্তেজিত হয়ে বলল, “পুরো নেক্সট লেভেল-এ চলে গেছে তো ব্যাপারটা! একেবারে হাগ্ করল? মানে, ফুল হাগ্?”
“অ্যাই, হাগ করার আবার ফুল-হাফ কি?” শরণ্যা বাধা দেয়।
“কেন, সাইড-হাগ আছে না? ওই যে, কাঁধে হাত দিয়ে পাশাপাশি করে – মানে একটা ছেলে আর মেয়ে ফ্রেণ্ডলি হলে ওইরকম হাগ করে আর কি।”
“ওঃ,” শরণ্যা বোকার মতো বলে, “আমার অত ক্যাটাগরির কথা জানা ছিল না।”
“থাকবে কি করে,” উপলা একপেশে হাসল, “বিলেতে সব চলে।”
শরণ্যা প্রতিবাদ করবার আগেই মৃণালিনী বলল, “আরে ফুল্-হাগ করেও কি ঘন্টা লাভ হয়েছে? শিল্দা তো ‘গুড্নাইট’ বলে আসাম চম্পট দিল!”
উপলা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “লিনী, প্লিজ। হ্যাংলামির লিমিট থাকে একটা। শিল্দাকে শান্তিতে বেড়াতেও দিবি না তুই? একেই তো ব্যাচেলার হিসেবে এটা ওর লাস্ট ট্রিপ।”
মৃণালিনী তাজ্জব হয়ে বলল, “ব্যাচেলার হিসেবে লাস্ট ট্রিপ? মানেটা কি? ফিরে আসার পরে আমি কি শিল্দাকে বিয়ে করে নিচ্ছি নাকি?”
“কিছু বলা যায় না বাবা,” শরণ্যা মিটিমিটি হাসল, “তোর যা তাড়া দেখছি, তাতে তো সেরকমটাই মনে হচ্ছে আমার।”
মৃণালিনী চোখ রাঙাতে গিয়েও হো-হো করে হেসে ফেলল। দেখাদেখি বাকিরাও। সেই হাসি চলল অনেকক্ষণ ধরে।
অত্রি ঘরে বসে বিরক্তভাবে পা নাচাচ্ছিল নীরা। সাতটা দিন প্রকৃত অর্থেই ছেলের টিকির দেখা পাওয়া যায়নি। নিজের থেকে তো নয়ই, এমনকি নীরা ফোন করলেও মিনিটদুয়েক ‘কেমন-আছিস-ভাল-আছি’ করে রেখে দিয়েছে। দার্জিলিং-এর বিষয়ে কিছু জানতে চাইলেও প্রত্যেকবার একই উত্তর, “ফিরে গিয়ে সব বলব’খন।”
কালকেই ফিরেছে অত্রি, তবু সেই দিনটা একটু ধাতস্থ হবার সময় দিতে নীরা আর ওকে ঘাঁটায়নি। আজ ভেবেছিল সকালেই দেখা করবে। সেই কারণে রন্-পল্-লিনীদের সঙ্গে খেতে যাওয়ার প্ল্যানটা অবধি বাতিল করল। এদিকে এসেই কী শুনছে? না, তিনি নাকি কোন এক বন্ধুর বাড়ি দৌড়েছেন! সাতদিনের কি সব পড়াশোনা মিস হওয়াতে নাকি তার রাতের ঘুম উড়ে গেছে, এক্ষুণি সেসব সম্পর্কে আপডেট্স না পেলে তাকে নাকি আর বাঁচানো যাবে না। কাকিমা অবশ্য নীরাকে যেতে দিলেন না।
“আরে, শুধু রিকুর ধান্দায় ঘুরে বেড়ালে চলবে? মাঝে মাঝে তো রিকুর মাকেও একটু পাত্তা-টাত্তা দিতে লাগে, নাকি? আজ এখানে খাবি। বিকেলে তিনি ফিরলে একেবারে দেখা করে বাড়ি যাস।”
তা কাকিমার সঙ্গে আড্ডা মেরে, লাঞ্চ খেয়ে, অত্রির ঘরেই একচোট ঘুম দিয়ে উঠে, তার বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে এখন বোকার মতো বসে আছে নীরা। বিকেল হতে বেশি দেরি নেই। অত্রি কখন ফিরবে কে জানে! বসে থাকতে থাকতেই একটু অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিল। গত পরশু সন্ধ্যেবেলার কথোপকথনটা সারাদিন ধরেই কেন যেন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
সেদিন রুদ্র এসেছিল দেখা করতে। পাড়ার ক্যাফেটাতে বসেই অনেকক্ষণ আড্ডা হল।
“তোমাদের পাড়াটা বেশ লাগে, জানো,” রুদ্র জানলার বাইরে তাকিয়ে বলল, “এখানে এখনও কত পুরোনো পুরোনো বাড়ি দেখা যায়। সরু গলি, উঁচু উঁচু চওড়া ফুটপাথ, কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো কত বড়-বড় – যেন কতদিন আগেকার সময়ে এসে ঢুকে পড়েছি। আর শীতের সন্ধ্যেটাও নামছে যেন টার্নারের ল্যাণ্ডস্কেপ। ধোঁয়াশা-জড়ানো, কি অদ্ভুত আলো-আঁধারি খেলা।”
নীরা হেসে উঠল। রুদ্র অবাক হয়ে বলল, “হাসছ কেন? ভুল বললাম বুঝি?”
“না না, ঠিকই বলেছ। আমি আসলে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, তুমি বোধহয় জীবনানন্দ দাশ-টাশ আওড়াবে, ‘শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা নামে’ ইত্যাদি ইত্যাদি।”
“ওঃ, ‘বনলতা সেন’? হাঃ হাঃ! কিন্তু ঘাবড়ে গিয়েছিলে কেন? জীবনানন্দ ভাল লাগেনা বুঝি?”
“আমার কবিতা বিষয়টাই খুব বেশি পড়া হয় না। এই কবিতাটা হয়তো খারাপ লাগত না, কিন্তু আমাদের ক্লাসের বাংলা-ম্যাম যা ভয়ঙ্কর ন্যাকাভাবে পড়িয়েছেন, যে বনলতার শ্রাদ্ধ হয়ে গেছে।”
“এঃ হে, হোয়াট আ শেম। আমার খুব ভাল লাগে কবিতাটা।”
“তুমি কবিতা পড়ো?”
“একটু-আধটু।”
“ভাল তো! অত্রি একেবারে কবিতা বোঝে না। এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে মিল আছে।”
রুদ্র হাসল, তারপর অন্যমনষ্ক মুখে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। নীরা একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে বলে উঠল, “অত্রির সঙ্গে তোমার যে অনেক মিল, তা নয়।”
নীরা বিস্মিতভাবে বলল, “তা কেন বলছ?”
রুদ্র একটু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে বলল, “না – সেরকম কিছু না – বাদ দাও।”
“না না, শুনিই না কি?” এবার সত্যিই কৌতুহল হয় তার।
রুদ্র একটু চুপ করে থেকে বলে, “কত বিষয়ে পড়াশোনা আছে তোমার। কত কিছু নিয়ে ভাবো। কত সুন্দর ছবি আঁকো। তোমার মধ্যে অনেক ডেপ্থ আছে।”
নীরা মজা পেয়ে বলল, “অত্রির নেই বুঝি?”
“ঠিক তা নয়। আসলে অত্রি মাঝে মাঝে ... ওর বোধহয় আরেকটু সিরিয়াস হওয়া দরকার। এমনিতে ও ভাল ছেলে। কিন্তু ভাল হলেই তো সব হয়না।”
শেষের কথাগুলো যেন নিজের মনেই বলছিল সে। নীরার অদ্ভুত লাগল। এমনিতে অত্রির ব্যাপারে কিছু বলতে গেলেই রুদ্র হেসে গড়িয়ে পড়ে। আজ হঠাৎ এতটা গম্ভীর হয়ে উঠছে কেন?
পরিস্থিতিটা একটু হালকা করতেই নীরা বলল, “আর্টিস্টের বয়ফ্রেণ্ড-এর বেশি ডেপ্থ না থাকাই ভাল। জানো তো, শিল্পীদের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করা খুব মুশকিল? ওটা তারাই পারে যাদের ইগো-টিগোর বেশি বালাই নেই, আঁতলেমি কম। এরকম লোকেরাই ভাল সাপোর্ট দেয়।”
“ভাল সাপোর্ট দেওয়ার জন্য সবার আগে দরকার বিশ্বাস।”
“সে তো নিশ্চয়ই –”
“বিশ্বাস জিনিসটা গাছ থেকে পড়েনা। ওটা অর্জন করতে হয়। আর একবার চলে গেলে তাকে ফেরানো প্রায় অসম্ভব।”
নীরা এবারে তাজ্জব হয়ে বলল, “কী ব্যাপার বলো তো? অত্রির সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে নাকি তোমার?” রুদ্র নিজেও বোধহয় টের পেল, যতটা বলতে চেয়েছিল তার থেকে বেশি বলে ফেলেছে।
লজ্জিত মুখে বলল, “না না, একেবারেই না। সরি, আমি বড্ড ভুলভাল বকছি।”
“কিছু হয়ে থাকলে আমাকে বলতে পারো কিন্তু।”
“না, সত্যিই কিছু হয়নি,” রুদ্র এবারে বেশ জোর দিয়ে বলে, “ওটা একটা থিওরেটিকাল ভাবনা ছিল।”
নীরার খুব একটা বিশ্বাস হয়না কথাটা। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলে, “দেখো, অত্রির আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই অনেক দোষ আছে, ঠিক যেমন আমার আছে। এটা ঠিক যে অত্রি ভুলো, মাঝে মাঝে দরকারের সময়ও সিরিয়াস হতে চায় না, তার গণ্ডির বাইরের পৃথিবীটার তেমন কোনও খবর রাখে না। সবই জানি – আমি জানব না তো কে জানবে! কিন্তু সব কিছুর পরেও আমি বলব অত্রি ইজ আ গুড্ পার্সন। ও হয়তো সাংঘাতিক আঁতেল নয়, কিন্তু ওর সঙ্গে আমি আমার সব কথা শেয়ার করতে পারি। ওকে কিছু বলা, আর নিজের ডায়রিতে কিছু লিখে রাখা আমার কাছে একই ব্যাপার। এই কথাটা শুনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমি অত্রিকে কতটা বিশ্বাস করি। আর অত্রিও এতদিন পর্যন্ত সেই বিশ্বাসটা ধরে রেখেছে। তুমি ঠিকই বলেছ, বিশ্বাসযোগ্যতা খুব কম মানুষেরই থাকে, সেটা অর্জন করাও কঠিন। অত্রি যে কতটা বিশ্বাসযোগ্য, তার প্রমাণ তো আমি এত বছর ধরে পেয়েই আসছি। তাই আমরা দুজন মানুষ যতই আলাদা ধরণের হই না কেন, আই থিংক হি ইজ পার্ফেক্ট ফর মী।”
“য়ু আর পার্ফেক্ট ফর এভরিবডি।”
রুদ্রর হাসিটা বিষন্ন দেখাল যেন। এই নিয়ে তারপর আর কোনো কথা এগোয়নি।
নীরা ভেবেছিল, দার্জিলিং-এর গল্প শোনার পর এই ব্যাপারটাও একটু আলোচনা করবে অত্রির সঙ্গে। রুদ্র যতই চাপা দেওয়ার চেষ্টা করুক, কোনো কারণে যে অত্রির উপরে অসন্তুষ্ট হয়ে আছে, সেটা খুবই স্পষ্ট। এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হতে চলল, অত্রি সেনের দেখা নেই! কি যে রাজকার্য করছে কে জানে! অধৈর্য্য হয়ে নীরা উঠে পড়তেই যাচ্ছিল, তখনই বাইরের ঘর থেকে কাকিমার আওয়াজ পেল।
“এই যে শাহেনশা এতক্ষণে ঢুকলেন। কখন থেকে মেয়েটাকে বসিয়ে রেখেছিস ধারণা আছে?” অত্রি ঘরে ঢুকেই হইহই করে উঠল, “আরে, আরে, আরে! কি ভাল টাইমে এসেছিস ভাবা যায় না! আমি তো এসে থেকেই ভাবছি –”
নীরা হাত-পা ছুঁড়ে বলল, “এটা ভাল টাইম, গাড়ল? নিকুচি করেছে তোর ভাল টাইমের। একে তো গোটা হপ্তাটা আমাকে ইগ্নোর মেরে কাটালি, তারপর আজ পাছে আমার সঙ্গে দেখা করতে হয়, সেই ভয়ে সাতসকালে বন্ধুর বাড়ি পালালি! একটা দিন পড়াশোনা করে পৃথিবী উলটে না দিলে চলছিল না, না?” অত্রি কাঁচুমাচু, “আরে সাতদিন কামাই করে একগাদা অ্যাসাইন্মেন্ট মিস করে গেছলাম; একেই তো সামনে সেমেস্টার –”
“তাই বলে এত দেরি!”
“দেরিটা অন্য কারণে হয়েছে,” অত্রি মাথা চুলকে বলল, “ল্যাপটপে আমার দার্জিলিং-এর ছবিগুলো ছিল, তা অর্ক আর রুদ্র সেই যে একবার দেখতে বসে গেল, আর ছাড়েই না! রুদ্র বোধহয় কয়েকটা ল্যান্ডস্কেপ-এর ছবি পেনড্রাইভে নিয়েও নিয়েছে। তুই রাগিসনি।”
নীরা গম্ভীরভাবে বলল, “রাগব কেন? রুদ্রর উপর আমার রাগ নেই। ওই ছেলেটা তো তোর মতো ক্যালাস নয়। তুই যে ক’দিন দার্জিলিং-এর বরফ ঘাঁটছিলি, সেইকটা দিন রোজ ফোন করে আমার খবর নিয়েছে, আমি বোর হলে এতটা রাস্তা ঠেঙিয়ে এসে আড্ডা দিয়ে গেছে। রুদ্র সত্যিকার ভাল ছেলে।” অত্রি পুলকিত মুখে বলল, “তবে? এবার তো মানবি আমি রুদ্রকে নিয়ে শুধু শুধু আদিখ্যেতা করি না? ওর মতো ছেলে –”
“বুঝেছি, বুঝেছি, তুই আবার শুরু করিসনা,” নীরা তাড়াতাড়ি বলে, “তা, তুই কি আদৌ ফ্রেশ হয়ে বসবি, নাকি আমি যাব?”
অত্রি হাঁ-হাঁ করে উঠল, “আরে, পাগল নাকি! বোস বোস – আচ্ছা, তুই বরং এক কাজ কর। দেখ, ব্যাগে আমার ল্যাপটপটা রয়েছে, ওটা বার করে দেখবি ডেস্কটপ্-এ দার্জিলিঙের ছবির ফোল্ডার আছে একটা। ওগুলো দেখ, আমি ততক্ষণ চান সেরে আসি।”
“এই শীতকালে এই অসময়ে চান কি রে!”
“আরে জানিসই তো বাবা আমার কলেজ থেকে একবার চান না করলে হয় না, জাস্ট যাব-আসব –” বলতে বলতেই কাঁধে তোয়ালে ঝুলিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল অত্রি। নীরা হতাশভাবে মাথা নেড়ে ব্যাগ হাতড়ে ল্যাপটপটা বার করল। ডেস্কটপেই ছিল ফোল্ডারটা। সেটা খুলে নীরা অবাক; এত ছবি তুলেছে অত্রি! ম্যালের ছবি, টয়-ট্রেন থেকে শুরু করে টাইগার হিল, মংপু – সব মিলিয়ে শ’দুয়েক ছবি তো বটেই! আসলে কাকু কিছুদিন আগেই বিস্তর টাকা দিয়ে সাংঘাতিক কেতার এক ক্যামেরা কিনেছেন। এতদিন তো ফিল্ম ক্যামেরা দিয়েই চলত। তাই এবারে ছবি তোলার এত উৎসাহ। ছবিগুলো বড় না করেই স্ক্রোল করে যাচ্ছিল নীরা। অত্রি বেরোলে একসঙ্গে দেখবে, তাতে করে ছবির গল্পগুলোও জানা যাবে।
স্ক্রোল করতে করতে একেবারে তলার দিকে চলে এসেছিল; হঠাৎ থমকে গেল। ফোল্ডারের ভিতরে আবার আরেকটা ফোল্ডার! তার নাম দেওয়া রয়েছে ‘য়ুনিভার্সিটি’। এটা এখানে কিভাবে এল? হয়তো অত্রি ভুল করে দার্জিলিং-এর ফটোর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। নীরা একটু কৌতুহলি হয়েই ফোল্ডারটা খুলে ফেলল। কে জানে, হয়তো রুদ্রর সঙ্গে কোনো ছবি আছে, অথবা অন্যান্য ক্লাসমেটদের সঙ্গে। প্রথম ছবিটা দেখেই বেশ হক্চকিয়ে গেল নীরা। বড় করতেই দেখল সে ভুল করেনি; শুচিস্মিতার এই ছবিটা তো অত্রি তাকে বহুদিন আগে দেখিয়েছিল। বোধহয় য়ুনিভার্সিটির ক্যান্টিনে তোলা হয়েছে – সঙ্গে রুদ্র আর অন্য একটা মেয়েও আছে। বাব্বাঃ, ছবিটা দেখানোর সময় অত্রি খুব নেচেছিল, “আরে ধূর, ওটা কেন হতে যাবে, ওই যে মাঝখানে বসে আছে, কি সুইট দেখতে বল্ ...”
ছবিটা এখনও রেখে দিয়েছে? অবশ্য, না রেখে দেওয়ারই বা কি আছে? এটা তো বন্ধুদের সঙ্গে আর পাঁচটা ছবির মতোই আরেকটা ছবি। নীরা ভেবেছিল, একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েই দার্জিলিং-এর ছবিতে ফিরে যাবে। কিন্তু কেন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। পর পর য়ুনিভার্সিটির ছবিগুলো দেখতে লাগল সে। এবং ক্রমশই যেন একটা অদৃশ্য হাত তার হৃৎপিণ্ডটাকে মুঠোর মধ্যে পুরে চাপ দিতে দিতে তার দম বন্ধ করে দিতে লাগল।
প্রথম প্রথম দলের সঙ্গেই যত ছবি। কিন্তু অ্যালবাম ধরে যতই এগোচ্ছিল নীরা, ছবিগুলোতে অন্তরঙ্গতার মাত্রা ততই বেড়ে যাচ্ছিল। অত্রির সঙ্গে হাত ধরে শুচিস্মিতা ঢাকুরিয়া ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে, য়ুনিভার্সিটির ঝিলপাড়ের রেলিং-এর উপর ঘনিষ্ঠভাবে বসে দুজন। কোনো একটা রেস্তোরাঁয় অত্রি শুচিস্মিতাকে খাইয়ে দিচ্ছে; কারো একটা ঘরের বিছানার উপরে দুজন ...
শেষ অবধি দেখতে পারল না নীরা। তার বুক ধড়ফড় করছে। শুচিস্মিতার সঙ্গে নিজের সম্পর্কের ব্যাপারে কোনোদিনই অত্রি খুব বেশি কিছু বলেনি। কিন্তু যেটুকু বলেছে, তার সঙ্গে এই ছবিগুলোকে কিছুতেই মেলাতে পারছিল না সে। আরও কয়েকটা ছবি বাকি আছে। একাধারে সেগুলো সেগুলো যেমন চুম্বকের মতো টানছিল, তেমনি অন্যদিকে তার সমস্ত অন্তরাত্মা চাইছিল ল্যাপটপ স্ক্রিনের সামনে থেকে ছিটকে সরে আসতে।
নিজের উপর অদম্য জোর খাটিয়ে অবশেষে ফোল্ডারটাকে ডিলিট করে দিল সে। ছবিগুলো কি করে এখানে এল তা জানে না, তবে এটা যে অত্রির একটা মারাত্মক ভুল সে বিষয়ে নিশ্চয়ই কোনো সন্দেহ নেই। অত্রির সামনে যে কোনো অবস্থাতেই এই বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলা সম্ভব নয়, তা বেশ বুঝতে পারছিল। আগের দিন রুদ্রর সঙ্গে কথোপকথনটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। সেদিন তো ওর অনেক কথাই হেঁয়ালির মতো ঠেকছিল, যেন কি একটা বলি-বলি করেও বলতে পারছে না। এখন যেন রুদ্রর কথাগুলোর একটা আবছা মানে দেখতে পাচ্ছে নীরা। যতই দেখতে পাচ্ছে, ততই যেন তার দমবন্ধ দশাটা আরও জোরালো, আরও দুর্বিসহ হয়ে উঠছে।
কি কুক্ষণে অত্রির ল্যাপটপ ঘাঁটতে গেল সে! আর অত্রিরও কি একবার মনে হল না, যে তার চোখে পড়ে যেতে পারে! নাকি সত্যি ছবিগুলোর কথা সম্পূর্ণভাবে ভুলে গেছে সে? এছাড়া তো আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু এখনও অত্রির উপর রাগ হচ্ছিল না নীরার। বরং সত্যিটা ভুল করে জেনে ফেলার জন্য দেওয়ালে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করছিল তার। রুদ্রর ইঙ্গিতটা যতই স্পষ্ট হয়ে উঠছে, ততই তীব্রভাবে নিজেই নিজের কাছে কথাটা অস্বীকার করতে চাইছিল সে। অত্রি আর সবার সঙ্গে যেমনভাবে মিশুক, যা ইচ্ছে করুক, তার কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু তার এতদিনের এত কাছের বন্ধু একটা সাধারণ ব্যাপার নিয়ে এত বড় মিথ্যেটা কি করে বলতে পারল? নীরা তো শুধু বন্ধুত্বেই খুশি ছিল! অত্রি কি সেটা জানে না? জেনেশুনে তাহলে কেন … না, না, কি উল্টোপাল্টা ভাবছে সে! নিশ্চয়ই ওগুলো অনেকদিন আগেকার ছবি, অত্রি ল্যাপটপ থেকে ডিলীট করতে ভুলে গিয়েছিল …
কিছুতেই পলিটিকাল সায়েন্সের ষোলো নম্বর চ্যাপ্টারটা মাথায় ঢোকাতে পারছিল না শরণ্যা। একেই তো ভারতীয় সংবিধানের বিশেষ কিছুই জানত না ক’দিন আগেও। তাছাড়া আজ দুপুরের আড্ডাটার কথা বারবার মনে পড়ছিল। স্কুলজীবনের শেষ সমবেত আড্ডা বোধহয় হয়ে গেল আজ। কি আক্কেলে যে নীরা-তিল্লি মিস করে গেল!
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে পড়ার টেবিলে বসে ঢুলছিল শরণ্যা। ফোনের আওয়াজে ঘুম ছুটে গেল। ঋদ্ধিমানদা! তাহলে কি শেষমেশ রঙ্গীতদার কোনো খবর পেল? তড়িঘড়ি ফোন ধরল সে।
“বলো, কেমন আছ?”
“কেমন আর! বেশ খারাপ।”
“এ বাবা!”
“না, মানে চিন্তার কিছু নেই। এখন একটু বেটার হয়েছে। কাল সত্যিই বেশ খারাপ অবস্থা ছিল। আসলে ... ঈশার ফোনটা আসার সময় আমি আবার এক বন্ধুর বাড়িতে ছিলাম – তো ওরকম একটা খবর শোনার পরে আমি দু’দিন ওখানেই পড়েছিলাম, এক পাও নড়তে পারিনি। তুই যখন ফোন করেছিলি তখন বাড়ি ফিরছিলাম। এখানে ফিরে অনেকটাই ধাতস্থ লাগছে।”
“হ্যাঁ, ব্রেক-আপ জাতীয় কেস হলে বোধহয় বাড়িতে থাকাই ভাল। যতই বন্ধু হোক, ওই সময়টা কারুর মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না।”
“তাছাড়া দা’ভাইয়ের কথা এক্ষেত্রে খুব কাজে দেয়। আমি বাড়িতে পা দেওয়া মাত্রই ওর মনখারাপ-চা বানিয়ে আনল –”
“মনখারাপ-চা মানে!” শরণ্যা তাজ্জব।
ঋদ্ধিমানদা হেসে উঠল, “ওটা হচ্ছে দাদার একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার। কারুর যদি মন খারাপ হয়, দিনটা ভাল না যায়, তখন ওই স্পেশাল চা খাওয়ায় তাকে। বিশ্বাস করবিনা, সত্যি সত্যি কাজ হয় ওতে। কী মেশায় কে জানে! আজ অবধি মাও ওর পেট থেকে রেসিপিটা বের করতে পারেনি।”
“এ তো বেশ মজার ব্যাপার!” শরণ্যা হাসল, “একদিন ধৃতিদাদার হাতের মনখারাপ-চা খেয়ে আসতে হবে দেখছি।”
“সে তো এলেই পারিস। তবে রিসেন্টলি কি তোর মন খারাপের কোনো কারণ ঘটেছে?”
শরণ্যা একটু থমকে গিয়েছিল। গত কয়েকদিনে তো নানা কারণেই মনটা অস্থির হয়ে আছে। সে কথা কি ঋদ্ধিমানদাকে বলা উচিৎ? সাত-পাঁচ ভেবে শেষ অবধি জবাব দিল, “আরে, পাঁচ তারিখ ইস্কুল খুলেই প্রি-বোর্ড। নতুন বছরটা কি ভাবে শুরু হবে ভাবো একবার।”
“হাঃ হাঃ! আহা রে, সত্যিই বেশ খারাপ অবস্থা তো! আমাদের সেকেণ্ড সেমেস্টার অবশ্য মার্চে। তারপর ... যাইহোক, কালকে যে হঠাৎ ফোনটা ওভাবে রেখে দিলাম তার জন্যে সরি।”
“আরে ধূর! আই কম্প্লিটলি আণ্ডারস্ট্যাণ্ড। এমনিও কিছু জরুরি কথা ছিল না।”
“কি বলতে ফোন করেছিলি বল্ তো? মনেও নেই।”
“ওই, রঙ্গীতদা হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে গেল কেন তার খোঁজ নিতে।”
“ওঃ হো! দেখেছিস আমার মাথার অবস্থাটা! রঙ্গীত কাল রাতে ফোন করেছিল।”
“ওঃ, তাই নাকি! সব ঠিক আছে তো ওদিকে?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, এমনি সবই ঠিকঠাক। আসলে সাগরিকার দিদার মাঝখানে কটাদিন খুব বাড়াবাড়ি যাচ্ছিল – অনেকদিন ধরেই তো ভুগছেন। তাই নিয়ে একটু ছোটাছুটি করতে হচ্ছিল আর কি। তবে এখন শুনলাম অনেকটা বেটার ...”
এরকম সাধারণ একটা কথা শুনে হঠাৎ বুকের মধ্যে হাতুড়ি পড়ল কেন? খানিকক্ষণের জন্য কি বলবে কিছুতেই ভেবে পেল না শরণ্যা। তারপর বুকের ধুকপুকুনিটাকে অবজ্ঞা করে স্বাভাবিক স্বরে জিজ্ঞেস করল, “সাগরিকা কে গো?”
“কেন, রঙ্গীতের গার্লফ্রেণ্ড তো! তুই চিনিস না? আলাপ হয়নি নাকি?”
চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছিল। যেন একরাশ কুয়াশার ভিতর পথ হারিয়ে ফেলেছে সে। চারিদিকে কোনো জনমানব নেই, সে একাই কোন এক গোলোকধাঁধার গহনে মিলিয়ে যাচ্ছে। শুধু অনেক দূর থেকে শুনতে পেল একটা স্বর, তার নিজেরই গলার স্বর, “... না – না তো ... আমি তো জানতামই না রঙ্গীতদার গার্লফ্রেণ্ড আছে ...”
“কি কাণ্ড, কোনোদিন বলেনি তোকে? সেই কবের থেকে – মানে গার্লফ্রেণ্ড না বলে ফিয়াঁসে বলাই ভাল; ওদের মধ্যে বহুদিন ধরে সব কিছু সেট্লড্। আমার মতো ফ্লপ কেস নয়, বুঝলি তো ...”
কতক্ষণ যে কথাবার্তা চলল, হুঁশ নেই। ফোনটা রেখে শরণ্যা টের পেল, কুয়াশা কখন যেন কেটে গেছে। তা এখন শিশির হয়ে ঝরে পড়ছে, ঝরেই পড়ছে।
সারাদিন ধরে উপলা নিজের বলা মিথ্যেগুলোকে নিজেই বিশ্বাস করবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু এবার তার সত্যিই ভয়-ভয় করছে। রন্দের বলেনি, কাল গভীর রাত অবধি সমানে কণিষ্ককে ফোন করে গেছে, কোনো উত্তর আসেনি। আজ বিকেলে বাড়ি ফিরবার পরেও কতবার যে চেষ্টা করেছে তার ঠিক নেই। মোবাইলে না পেয়ে ল্যাণ্ডলাইনে বার-তিনেক ফোন করল, কিন্তু কেউ ধরেনি। পড়াশোনা মাথায় উঠে গেছে তার। এটা কী করছে কণিষ্ক! যে সময়টায় একজন বন্ধুর সবচাইতে বেশি প্রয়োজন, ঠিক সেই সময়ে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে সে এইভাবে সরিয়ে দিচ্ছে কেন?
বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে কাটবার পর প্রায় মরিয়া হয়েই রবিন আঙ্কলের বাড়ির নম্বর ঘোরালো উপলা। আর কোনো পথই মাথায় আসছিল না তার। এবারে অবশ্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। দু-তিনবার রিং হওয়ার পরেই জবাব এল, “হ্যালো?”
গলাটা অচেনা ঠেকল তার। তবু, বেশি ভাববার সময় নেই এখন। ভণিতা না করে জিজ্ঞেস করল, “কণিষ্ক কি এখানে আছে?”
“কণিষ্ক!” ওপারের স্বরটা বেশ অবাক হল যেন। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অবশেষে বলল, “তুমি ... তুমি কে বলছ?”
“আমি উপলা।”
“উপলা! মানে উৎপল আঙ্কলের মেয়ে?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ – তুমি ... আপনি কে বলছেন?”
ওপারের আওয়াজটা এতক্ষণে যেন সহজ হল, “আমি শাক্য।”
“শাক্যদা!” উপলা চমকে উঠে বলে, “তুমি কবে এলে!”
“এই তো। ভোরবেলা ল্যাণ্ড করলাম।”
“আই সী ... কিন্তু তোমার তো ... ”
“জানুয়ারীতে ফেরার কথা ছিল, ঠিকই,” ওপার থেকে বিষন্ন হাসির শব্দ এল, “সময়টা বিনা নোটিসেই একটু এগিয়ে আনতে হল। আসলে বাড়ির যা সিচুয়েশান ... তুমি বোধহয় জানো।”
উপলা কি বলবে ভেবে পায় না। শাক্যদার গলা শুনে সত্যিই অনেকটা আরাম বোধ হচ্ছিল তার। কিন্তু পরিস্থিতি যে কতটা জটিল হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে কণিষ্ক কেমন আছে তার একটা খবর না পেলে কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না সে।
কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই অবশ্য শাক্যদা আশ্বাস দিল, “অপু এখানেই আছে, চিন্তা নেই তোমার। তবে ও বোধহয় এখন কারুর সাথেই কথা বলতে পারবে না। বুঝতেই পারছ, একে ছেলেটার স্বাস্থ খুব একটা ভাল নয়, তার ওপর ক’দিন ধরে যা চলছে। এত কিছুর মধ্যে আবার ওকে কতগুলো পরীক্ষায় বসতে হবে। এ অবস্থায় ওকে বোধহয় একা থাকতে দেওয়াই ভাল। তবে আমরা সবরকমভাবেই ওর খেয়াল রাখার চেষ্টা করছি। তুমি বেশি চিন্তা কোরো না।”
উপলা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “কণিষ্ক কাল রাতে একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল। তাতে লিখেছিল, আমার সঙ্গে আর বন্ধুত্ব রাখতে পারবে না।”
শাক্য নিঃশ্বাস ফেলল, “শুধু তুমি না, ও কারুর সঙ্গেই কথা বলতে চাইছে না। খুব শক্ পেয়েছে তো। আর আমি ছিলামনা ... দোষ অনেকটা আমারই।”
উপলা সাবধানী গলায় বলল, “না, না, তোমার কি দোষ –”
“আছে। নানা রকম আছে ... তবে যা হয়ে গেছে তা নিয়ে কথা বাড়িয়ে কি হবে। এখন শুধু ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা। ... তুমি কি করে জানলে অপু এখানে আছে? মা বলল?”
“না, আসলে ওবাড়িতে যতবারই ফোন করছিলাম, বেজে বেজে কেটে যাচ্ছিল। তাই মনে হল একবার এখানে খোঁজ নিয়ে দেখি।”
“আই সী।”
বেশ খানিকক্ষণ নিস্তব্ধ থাকার পর শাক্য বলে উঠল, “মায়ের ব্যাপারটা আমি যে একেবারে বুঝি না তা নয়।”
উপলা অবাক হয়ে বলল, “তুমি – কিন্তু কণিষ্ক যেটুকু বলল তাতে করে তো –”
“দেখো, অ্যাফেয়ার নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। নিজের মায়ের পার্সোনাল লাইফে মাথা গলাতে ফ্র্যাঙ্ক্লি আমার রুচিতে বাধে। কিন্তু যে ছেলেটার সঙ্গে ... মা নিজেই বহুদিন ধরে সাফার করছে। আমি অনেক বুঝিয়েছি, কিন্তু ...”
উপলার কৌতুহল হচ্ছিল ছেলেটার বিষয়ে জানতে। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করা তার পক্ষে অসম্ভব। সত্যি বলতে, শাক্যদা এতক্ষণ ধরে তার সঙ্গে এত স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে কি করে, তাই তো ঠাওর হচ্ছিল না!
যেন সেটা বুঝতে পেরেই শাক্যদা বলল, “আসলে তুমি কণিষ্কর অনেকদিনের বন্ধু, খুব কাছের বন্ধু। আমাদের তেমন আলাপ না থাকলেও, তোমার কথা ওকে সব সময়ই বলতে শুনতাম। তা ছাড়া তোমার ফ্যামিলির সঙ্গে আমার বাবা-মা দুজনেই ক্লোজ। তাই তোমাকে এই কথাগুলো বলছি। তোমার জেনে রাখা দরকার তো বটেই, আমারও বলা দরকার, কারণ অন্য কারুর কাছে আমি এ বিষয়ে মুখ খুলতে পারব না। অবশ্যই তোমার শুনতে আপত্তি থাকলে আমি বলব না।”
“না না। তুমি বলো।”
একটু থেমে থেমে শাক্যদা বলতে লাগল, “অপু যে কারণে আপ্সেট হয়ে আছে, সে কারণে আমার রাগ হয়নি। ইন্ ফ্যাক্ট, রাগ জিনিসটাই যে খুব একটা হয়েছে, তা নয়। কিন্তু আমার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে মাকে নিয়ে। ছেলেটা ভীষণ গোলমেলে ব্যাক্গ্রাউণ্ডের; ড্যামেজ্ড, অ্যাণ্ড কম্প্লিট্লি ওয়েস্টেড্। ওর সঙ্গে এরকম একটা জটিল সম্পর্ক তৈরি করে ফেলে মা এখন নিজের জাল থেকে নিজেই বেরোতে পারছে না।”
উপলা জিজ্ঞেস করল, “গোলমেলে ব্যাক্গ্রাউণ্ড মানে একজ্যাক্ট্লি কি রকম বলো তো?”
“মানে ... ও আগে মায়ের স্কুলেই পড়ত, তাই অনেকদিন আগে থেকেই চেনা। ছেলেটার ফ্যামিলি সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই, কিন্তু এইটুকু শুনেছি যে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে না। এর থেকে বেশি মা বলতেও চায়নি। গ্র্যাজুয়েশান্ করবার পরে নাকি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিল, এদিক-ওদিক অড্ জব্স করত। এদিকে কলেজে পড়বার সময় থেকেই অ্যালকোহল আর ড্রাগ্স প্রবলেম শুরু হয়েছিল; তার জন্য বোধহয় ওকে বেশ কিছুটা সময় রিহ্যাবেও কাটাতে হয়েছে। এসব জিনিসের লং টার্ম এফেক্ট কি হয় তা তো জানো। এই মুহূর্তে ও শারিরীক আর মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থই নয়। নর্থ কলকাতার খুব শেডী একটা জায়গায় একা একা থাকে –”
“অবন্তিকা আন্টি কি করে এর সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন! এরকম একটা লোকের সঙ্গে?” উপলা হতবাক হয়ে গিয়েছিল।
“সেটাও আমার কাছে একটা মিস্ট্রি। কোথায়, কবে, কিভাবে দেখা হয়েছিল, সেটার স্পেসিফিক্স আমি কিছুই জানি না। তবে শুনেছি, যখন দেখা হয়, তখন ছেলেটার নাকি ভয়ংকর খারাপ অবস্থা। রিহ্যাব থেকে পালিয়েছিল। মা বলেছিল যে ছেলেটার বাড়ির লোকেরা ওকে কন্ট্যাক্ট করেছিল, যেহেতু মায়ের পুরোনো স্টুডেন্ট্। মা শুরুতে ওকে হেল্প করতেই গিয়েছিল, কিন্তু ছেলেটা কী বোঝাল, আর মাই বা কি ভাবল, গড্ নোজ। এদিকে কিছুদিন পরেই ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে গেল। আমি হয়তো আমেরিকায় যাওয়ার জন্য অত মরিয়া হয়ে উঠতামনা, কিন্তু তখন আমি পালানোর একটা রাস্তা খুঁজছিলাম। অপুর কথা না ভেবেই ...”
“কি সাংঘাতিক!”
“সত্যিকারের সাংঘাতিক ব্যাপারটা হল যে মায়ের ফাইন্যান্শিয়াল ক্রাইসিস্টাও এর কারণেই শুরু হল। এই নিয়ে কি কম অশান্তি হয়েছে আমার আর বাবার সঙ্গে! আমি হাজারবার বলেছিলাম, ‘তুমি যা ইচ্ছে করো, অপুর কথাটা তো একবার ভাববে! ওই ছেলেটার হাউজ্-রেন্ট-এর অর্ধেক টাকা দিচ্ছ, ওর থেরাপির টাকা দিচ্ছ, আর তোমার নিজের ছেলের স্কুল ফিজ্ কে দেবে?’ মায়ের সেই এক কথা বলে কান্নাকাটি, যে পূজন ইজ ইন নীড্, পূজনের এত মেধা, এত ট্যালেন্ট শুধুমাত্র কেয়ারের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, মা ছাড়া ওকে হেল্প করার আর কেউ নেই – আন্বিলীভেবল্ –”
উপলার বুকটা ধড়াস করে উঠল হঠাৎ।
“কি – কি নাম বললে তুমি?” রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল সে, “ছেলেটার নাম কি বললে, আরেকবার বলো?”
“পূজন। পূজন মিত্র।”
“এ – এ কি ... লেখে?” উপলার গলা কাঁপছিল।
“হ্যাঁ, কবিতা লেখে। ওর নামটা চেনা লাগল তো? কাগজে, ম্যাগাজিনে ওর অনেক লেখা ছাপা হয়, দেখেছি আমি সে সব। ট্যালেন্ট্-এর ব্যাপারটা আদপেই মিথ্যে নয়। ওর মধ্যে ক্রিয়েটিভিটি, মেধা, এসব সত্যিই আছে। মা সেটা দেখতে পেয়েছিল। তবে, একজনের প্রতিভা বাঁচাতে গিয়ে এতগুলো লোকের জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনা কতটা ঠিক, তা অবশ্য বলতে পারব না,” শাক্যদা ক্লান্তভাবে হাসল।
ফোনটা রেখে সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের বেগে শরণ্যার নম্বর ডায়াল করল উপলা। রিং হয়ে হয়ে কেটে গেল – একবার, দু-বার, তিনবার। ঠিক যেমন কণিষ্কর সঙ্গে হয়েছিল। বাধ্য হয়েই উপলা হাল ছেড়ে দিল। রন্কে কাল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফোন করতে হবে। মেসেজ করতে পারত, কিন্তু তাতে করে এত জটিল ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বলা হবে না। যদিও ওর সঙ্গে পূজনের একবারই কথা হয়েছে, তবু, যাতে ওর সাথে ভবিষ্যতে আর যোগাযোগ না করে, তার জন্য ভাল করে সাবধান করে দিতে হবে। উপলার মনটা উত্তরোত্তর আশঙ্কায় ভরে উঠতে লাগল।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে যে কতক্ষণ বসেছিল, ঠিক নেই। নীরার মনের ভিতরে ঘোর যুদ্ধ চলছে। সে অবশ্য টের পায়, সেই যুদ্ধে এক পক্ষ ক্রমেই যেন বলিষ্ঠ হয়ে উঠছে, যেন কিছুক্ষণের মধ্যেই তার জিৎ হবে।
সারা সন্ধ্যেটা কি ভাবে কাটিয়েছে তা এখনও ভাল করে জানে না। অত্রি স্নান সেরে বেরোনোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নীরা উঠে পড়েছিল।
“ছবি তো দেখা হয়েই গেল। আজ আমি যাই, কেমন? কাল না হয় ...”
অত্রি অবাকভাবে বলল, “দেখলি মানে? এতগুলো ছবি সব এর মধ্যে দেখা হয়ে গেল? কিচ্ছু মন দিস্নি তার মানে। বোস্ বোস্, সবে তো সাড়ে পাঁচটা। এক রাউণ্ড চা খেয়ে –”
“অত্রি, পাঁচ তারিখ থেকে আমার প্রি-বোর্ড মনে আছে তো?”
“কি মুশকিল, মনে থাকবে না কেন! কিন্তু আধ ঘন্টায় কি এমন পড়াশোনা করে উলটে দিবি তুই? এমনিই তোর সব তৈরি আছে। বোস্ তো চুপচাপ! সারা হপ্তা তো আমার মুখ দেখতে হয়নি, এখন একটা দিনও সময় দিবি না?”
নীরা আর কিছু বলল না। অত্রির প্রতিটি কথা তাকে শেলের মতো বিঁধছে। ইচ্ছে করলে করলে সেই মুহূর্তেই ওকে ছবিগুলোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে পারত। কিন্তু একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারছে না! কোনো কথা না বলে সে দার্জিলিং নিয়ে অত্রির উচ্ছসিত গল্প শুনে গেল। কাকিমা ইতিমধ্যে চা-জলখাবার দিয়ে গেলেন, ছবি দেখা কখন যেন শেষও হয়ে গেল; খেতে খেতে অত্রি অনর্গল বকে গেল – কোনো কিছু তার মাথায় গাঁথতেই পেল না! কি করে এতটা সময় ধরে এমন স্বাভাবিক অভিনয় করে গেল নীরা? আর অত্রিও কিছু বুঝতে পারল না? যদি একবারের জন্যেও তাকে জিজ্ঞেস করত, তৎক্ষণাৎ সব কিছু বলে দিত সে।
তবু কিছুতেই আর মনের মধ্যে অশান্তিটাকে চেপে রাখতে পারছিল না। সত্যিটাকে না বোঝার ভান করলেই যদি তা মিথ্যে হয়ে যেত, তাহলে এভাবে এতক্ষণ ছট্ফট্ করতে হত না তাকে। নিজের চোখকে কিভাবে অবিশ্বাস করবে! কিন্তু মাঝে মাঝে সব বুঝেও মানুষের মিথ্যে আশ্বাসের প্রয়োজন হয়। তাই শেষ পর্যন্ত রুদ্রকে ফোনটা করেই ফেলল নীরা। তার হৃৎপিণ্ডের আওয়াজে রিং হবার শব্দটাও যেন ডুবে যাচ্ছিল।
“নীরা! কি ব্যাপার! অত্রি বাড়ি ফেরেনি এখনও?” ওপার থেকে রুদ্রর বিস্মিত স্বর ভেসে আসে।
“ফিরেছে। দেখা হয়েছিল।”
“ওঃ, যাক! আমার এখান থেকে তো অনেকক্ষণই বেরিয়েছিল, আমি ভাবলাম ... এনিওয়ে, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে, আমারও তাহলে তোমাকে এন্টারটেন করবার কাজ ফুরিয়েছে –”
“রুদ্র, তোমার কাছে একটা কথা জানবার আছে আমার। অনেস্টলি উত্তর দিতে হবে, কিছু গোপন করবার চেষ্টা করলে চলবে না।”
“হ্যাঁ – মানে – শিওর – কিন্তু এভাবে বলছ কেন, কি হয়েছে?” রুদ্র হক্চকিয়ে যায়।
নীরা আর একটুও ভাববার চেষ্টা না করে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল, “অত্রির সঙ্গে শুচিস্মিতার রিলেশানটা ঠিক কতদূর গিয়েছিল?”
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার পর ওপার থেকে আওয়াজ এল, “আমাকে হঠাৎ এই কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?”
“রুদ্র, প্লিজ, আমি শুরুতেই বলেছি –”
“জানি,” রুদ্র থামিয়ে দিয়ে বলে, “আমি মিথ্যেও বলব না, কিছু চেপেও যাব না। আমি জাস্ট এইটুকু শুনতে চাই যে তুমি আমার কাছে এ ব্যাপারে কেন জানতে চাইছ। অত্রি কিছু বলেছে?”
“আমি ... অত্রির ল্যাপ্টপে কয়েকটা ফটো ছিল, সেখানে ...” নীরার গলা বুজে আসছিল।
“কার ছবি?”
“ওদের ... ওদের দুজনের ... আমি দেখতে চাইনি ... ভুল করে হঠাৎ ... ”
“অত্রিকে জিজ্ঞেস করোনি এ ব্যাপারে?”
“না না! আমি সঙ্গে সঙ্গে ফোল্ডারটা ডিলীট করে দিয়েছিলাম ... আমি কোনো অবস্থাতেই ওকে এই নিয়ে ... প্লিজ রুদ্র, জাস্ট আন্সার মী! হাউ ফার্ ডিড্ দে গো?”
“অল দ্য ওয়ে।”
নীরার মাথাটা ঘুরে উঠল হঠাৎ। তবু সে শেষ চেষ্টা করল একবার, “তুমি সেদিন বলছিলে ...”
“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিলাম,” রুদ্রর স্বর কঠিন হয়ে ওঠে, “আই অ্যাম সরি, নীরা। অত্রি যে এরকমটা করবে আমি ভাবিনি। শুচিস্মিতার সঙ্গে আগে যা ছিল, ছিল। কিন্তু এখন কি করে ... কলেজের কেউ কেউ আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল যে অত্রি নাকি কন্ফিউজড্ -- কিন্তু এটাকে কন্ফিউশান্ বলে না। এটাকে অন্যায় বলে।”
“কবে থেকে এরকম ... জানো?”
কথাগুলো বলতে যে রুদ্রর খুব খারাপ লাগছিল, সেটা মনের এই অবস্থা সত্ত্বেও বুঝতে পারছিল নীরা। কিন্তু সত্যি কথাটা তাকে শুনতেই হবে। তাতে যদি তার হৃৎপিণ্ডটা চুরমার হয়ে যায়, যাক। এখন আর এ ছাড়া অন্য পথ নেই।
ওপার থেকে বেশ থেমে থেমে উত্তর এল, “বেশিদিনের ব্যাপার নয়। কয়েক সপ্তাহ ধরে শুচিস্মিতা হঠাৎ অত্রির সঙ্গে আবার মেলামেশা করার চেষ্টা করছিল। এ কথা ঠিক, যে অত্রি প্রথমটায় পাত্তা দেয়নি। কিন্তু ক’দিনের মধ্যেই দেখলাম ব্যাপারটা বদলে যাচ্ছে। ওরা আবার একসঙ্গে ক্যান্টিন যাচ্ছে, ঝিলপাড়ে আড্ডা দিচ্ছে, লাঞ্চে যাচ্ছে। তারপর দার্জিলিং যাওয়ার ঠিক আগে আগে ...”
নীরা ভাঙা গলায় বলল, “এই জন্যেই কি যাবার আগে আমাকে ফোন করে গেল না?”
অপ্রতিভ গলায় উত্তর আসে, “আসলে ... দেখো, অত্রি ইজ নট্ আ ব্যাড্ পার্সন। বিশেষ করে ও তোমাকে কখনোই হার্ট করতে চাইবে না, নো ম্যাটার হোয়াট হ্যাপেন্স। ও হয়তো ভেবেছিল, এই ট্রিপের পরে একটু ধাতস্থ হয়ে তারপর ভাববে কি করা উচিৎ। আমার মনে হয়না ও রিলেশান্টাকে ভাঙতে চেয়েছিল। ইট্ ওয়াজ আ মিস্টেক। একটা সাংঘাতিক ভুল, কিন্তু, আমার মনে হয়না অত্রি ডেলিবারেট্লি এটা করতে চেয়েছিল।”
নীরা কোনো উত্তর দেয়না। তার কাছে সবটাই পরিষ্কার এখন। ওই ছবিগুলো অত্রিই রেখে দিয়েছিল অন্য ফোল্ডারের মধ্যে। সেই কারণেই ওকে ল্যাপ্টপটা বার করতে বলে নিজের স্নানের ঘরে চলে গিয়েছিল। শুচিস্মিতার ব্যাপারটা জানানোর একটা পথ খুঁজছিল অত্রি। অর্থাৎ ... এতক্ষণ নীরা ভাবছিল সারা সন্ধ্যেটা তাকে অভিনয় করতে হয়েছে। কী বোকা! এই পুরো সময়টা অত্রিও নিখুঁতভাবে অভিনয় করে গেছে তার সঙ্গে, আর সে কিছুই বুঝতেই পারেনি! না বলে দার্জিলিং চলে যাওয়া, সেখানে থাকতেও তাকে ফোন করার অনীহা, সব কিছুর মানে স্পষ্ট, খুব স্পষ্ট এখন। একরাশ অন্ধকারের মধ্যে থেকেই অস্পষ্টভাবে শুনতে পেল রুদ্র বলছে, “নীরা ... অত্রি ডাজন্ট নো হাউ লাকি হি হ্যাজ বিন্। আমি যদি ওর মতো লাকি হতাম, তাহলে ... যাক। আমি জানি যে এটা বলার কোনো মানে হয় না, তবু বলছি, প্লিজ বী স্ট্রং। আমি তোমার অনেকদিনের বন্ধু নই, খুব কাছের বন্ধুও নই। কিন্তু তোমার যদি কখনও কোনোরকম দরকার হয়, প্লিজ ডোন্ট হেজিটেট্ টু কল্ মী। ওকে?”
“থ্যাঙ্ক্স রুদ্র।”
ফোনটা রেখে কাঁপা হাতে অত্রিকে মেসেজ করল নীরা: ‘এক্জ্যামে ব্যস্ত থাকব কিছুদিন। ডোন্ট্ কন্ট্যাক্ট নাও, ওকে? পরে কথা হবে।’
একটু পরেই উত্তর এল, ‘শিওর। ভাল করে পরীক্ষা দে। অল দ্য বেস্ট্।’
নীরার অনুমানই ঠিক। অত্রি নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। তাকে কি সোজাসুজিভাবে জানাতে এতই বাধছিল তার? ফোনটা মাটিতে আছড়ে ফেলে দিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল নীরা, কিন্তু শব্দহীনভাবে।