।। ১৪ ।।
ব্লু-ফিল্ম কেলেঙ্কারিতে যে একচল্লিশজন ছাত্র-ছাত্রীদের তিন সপ্তাহের জন্য সাস্পেণ্ড করা হয়েছিল, তারা এদ্দিনে আবার ইস্কুলের মুখ দেখার ছাড় পেয়েছে। এই নিয়ে অন্যান্য ক্লাসগুলোতে একটু হইচই হচ্ছিল আজকে। শরণ্যা ঢুকেই শুনতে পেল, রোমিলাদের গ্রুপটা জোর গলায় আলোচনা শুরু করেছে। তিলোত্তমা ছাড়া এখনও বিশেষ কেউ এসে পৌঁছায়নি। শরণ্যাকে দেখে যেন ওর ধড়ে প্রাণ এল।
“তখন থেকে উলটো-পালটা কথা শুনে যাচ্ছি, ভাগ্যিস ঢুকলি,” তিলোত্তমা চাপা গলায় বলল।
শরণ্যা বসতে বসতে বলে, “ব্যাপারটা কি, এত এক্সাইটমেন্ট কিসের?”
উত্তরটা অবশ্য তিলোত্তমাকে দিতে হল না।
“... আর ওই যে শ্রদ্ধা সোম?” রোমিলা বিষাক্ত গলায় বলছিল, “শি ইজ দ্য বিগেস্ট স্লাট অফ দেম অল। আই অ্যাম শিওর ওই বাকিদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল — নট দ্যাট দে আর এনি বেটার — ”
“প্লিজ ডোন্ট কল হার দ্যাট,” তিলোত্তমার মুখ দিয়ে যেন না চাইতেই কথাটা বেরিয়ে পড়ে।
“হোয়াট?” রোমিলা অবাক।
“তুই ওকে স্লাট বললি না একটু আগে? ওটা বলিসনা।”
ওদের গ্রুপের সকলেই এই আচমকা কথায় একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল। রোমিলা অবশ্য সবার আগে সামলে নিল।
“ক্লাসরুমে ছেলেদের সঙ্গে বসে পর্ন দেখছিল, অ্যাণ্ড য়ু আর আস্কিং নট টু কল হার আ স্লাট?” তীর্যকভাবে জানতে চায় সে।
“দেখ্ স্কুলে বসে পর্ন দেখাটাকে আমি কখনোই সাপোর্ট করছি না। যারা এটা করেছে তারা নিশ্চয়ই অত্যন্ত নিম্ন রুচির পরিচয় দিয়েছে। বাট দ্যাট্স নো রীজন টু কল্ হার দীজ নেমস।”
রোমিলা বাঁকা হাসল, “তোর আরো সাংঘাতিক কোনো রীজন লাগবে?”
তিলোত্তমা বলল, “আচ্ছা, তুই নিজেই একবার ভেবে বল্ ক্লাসে তো এতগুলো লোক ছিল; তুই বেছে বেছে মেয়েগুলোকেই অ্যাকিউজ করছিস কেন? আসল কাণ্ডটা তো ছেলেরা ঘটিয়েছে। অথচ ওদের বিষয়ে একটাও মন্তব্য না করে তুই সমানে মেয়েগুলোর পিছনেই পড়ে আছিস। শ্রদ্ধা মাইট বী স্টুপিড, কিন্তু স্লাট কেন হতে যাবে?”
রোমিলা একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে বলল, “ওঃ প্লিজ, ডোন্ট অ্যাক্ট সো নাইভ, ওকে? ছেলেরা যে এই ধরণের নানারকম করেই থাকে সেটা সবাই জানে। এগুলো ওদের স্বভাব। তার মানে এই নয় যে মেয়েরাও গিয়ে —”
“শাট দ্য ফাক আপ, অলরাইট?” তিলোত্তমা হঠাৎ ভীষণ উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, “আমাকে নাইভ বলছিস তুই? হোয়াট দ্য হেল আর য়ু? হাজার হাজার বছর ধরে এই একটা ডায়লগ মেরে ছেলেদের সাত খুন মাফ হয়ে গেল — রেপ, মার্ডার, এনিথিং। আর্গ্যুমেন্টটা কি? না, ছেলে তো, ওরা ওসব করেই থাকে! করবে কেন? কে রাইট দিয়েছে ওদের এসব করার? কোন আইনে লেখা আছে যে ছেলেদের স্কুলে বসে ব্লু ফিল্ম দেখা অ্যালাওড্? মেয়েরা দেখলে স্লাট, আর ছেলেরা দেখলে দে আর জাস্ট বয়েজ! চমৎকার!”
পি.এস. চিন্তিত মুখে বললেন, “ওঃ হো! ঠিকই তো, তোমাকে দেখে সত্যিই ভাল মনে হচ্ছে না। ডু য়ু ওয়ান্ট টু গো ব্যাক হোম?”
“না... আমি সিক্ রুমে যাই? আমার মনে হয় আই উইল বী অলরাইট আফ্টার আ হোয়াইল।”
“আর য়ু শিওর?”
“ইয়েস ম্যাম।”
তিলোত্তমা আর বাক্যব্যয় না করে সিকরুমের দিকে হাঁটা দিল। নীরা, উপলা আর মৃণালিনী এতক্ষণ তাজ্জব হয়ে ব্যাপারটা দেখছিল। এবারে যে যার সীটের দিকে পা বাড়াল। উপলা ফিস্ফিস করে শরণ্যাকে জিজ্ঞেস করল, “কেস্টা কী? হাওয়া জটিল মনে হচ্ছে?”
শরণ্যা চাপা গলায় বলল, “পরে বলব। কুরুক্ষেত্র হয়ে গেছে একটু আগে।”
পুরো হিস্ট্রি ক্লাসটাই অন্যমনষ্ক হয়ে ছিল শরণ্যা। সোমবার আবার মিসেস দত্ত-র ব্লক পিরিয়ড থাকে; কোনোদিনই যদিও পুরো সময় অবধি ক্লাস হয় না। আজও হল না। প্রথম পিরিয়ডে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন পড়িয়েই ম্যাম চলে গেলেন। সকালের ওই কাণ্ডের পর এমনিতেই কারুর বিশেষ মনোযোগ ছিল না। শরণ্যা অবশ্য সম্পূর্ণ অন্য কথা ভাবছিল।
কাল অনেক রাত অবধি নিজের ঘরে ইন্টারনেট ঘাঁটছিল সে। সেদিনের সংক্ষিপ্ত ফোনালাপের পর থেকেই পূজন মিত্র সম্পর্কে একটা অদম্য কৌতুহল জেগে উঠেছিল মনের ভিতরে। সব কবিরই তো একটা বিশেষ ধরণের অন্তর্জগত থাকে; সেই জগতটাই তার কবিতাকে প্রভাবিত করে সবচেয়ে বেশি। অনেক ধরণের কবিতা পড়েছে শরণ্যা, কিন্তু পূজন মিত্রের কবিতার মতো কোনো কিছু পড়েনি কখনোও। ওর অন্তর্জগতটা কিরকম, তা ঠাওর করাও মুশকিল। কোথাও কি এলিয়টের সঙ্গে মিল আছে? শরণ্যার চোখে তো সেরকম কিছু ধরা পড়েনি, কিন্তু পূজনের কবিতা যেন একই রকম জোরালোভাবে ধাক্কা দিয়ে গিয়েছে ওকে।
ইন্টারনেটে পূজনের একটা অনলাইন ব্লগ আবিষ্কার করেছিল শরণ্যা। বেশ নিয়মিত লেখা আপলোড করে দেখা গেল। প্রায় পাঁচ বছর ধরে এখানে লিখছে! বিষয় অবশ্য শুধুই কবিতা। শরণ্যা অবাক হয়ে ভাবছিল, পূজনের এত ভাবনা আসে কোথা থেকে? কই, সে নিজে তো এত লিখতে পারে না! অথচ প্রতিটি কবিতার পিছনেই যে অশেষ যত্ন নেওয়া হয়েছে, এটা ঠিকই বুঝতে পারে সে। মোহগ্রস্তের মতো একটার পর একটা কবিতা পড়েই চলেছিল শরণ্যা।
কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে বারবার এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল তার। থেকে থেকেই যেন অন্য কারুর বা অন্য কিছুর উপস্থিতি টের পাচ্ছিল; যেন ঘরে সে একা নয়। পাশের ব্যালকনির খোলা দরজা দিয়ে একটুখানি রাস্তা দেখা যাচ্ছিল। শরণ্যা তাকিয়ে দেখল, স্ট্রীটল্যাম্প-এর হলদে আলো রাস্তাটাকে যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কৌতুহলী হয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখল, বাইরে কেউ নেই।
এই রাস্তাটারই কি তাহলে প্রাণ আছে? লক্ষ লক্ষ মানুষের পায়ের চাপে, গাড়ির চাকার তলায় নিরন্তর পিষে যেতে যেতে এক সময় কি কেঁদে ওঠে রাস্তা? হয়তো সেই কান্না মানুষের মনের মধ্যেও জানান দিতে চায় মাঝে মাঝে; তারা শুনতে পায়না। কিংবা হয়তো শুনতে ভয় পায়, ভুলে থাকতে চায়। এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই শরণ্যার চোখে পড়ে যায় একটা কালো কুকুর; স্ট্রীটলাইটের আলোর নীচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। শরণ্যার মনে হয়, রঙ্গীতদা যেন এক টুকরো সূর্যের রশ্মি। জীবনে এত দুঃখ সত্ত্বেও কী প্রাণবন্ত ছেলেটা! পূজন কিন্তু আলাদা। ও যেন অন্ধকারের জীব; কী একটা রহস্যময় আকর্ষণ আছে। কে জানে, মানুষের মনে কতরকম রঙ থাকে? নাকি সে শুধুই সাদা-কালোর মিশেল? পূজনের চোখদুটো যে আশ্চর্য ধূসর রঙের, তা মনে পড়ে গেল। সে কি ওর মনেরও রঙ?
রাস্তার কালো কুকুরটা হঠাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে। সতর্কভাবে কান খাড়া করে কি একটা যেন শোনে, তারপর আচমকাই ছুটতে ছুটতে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। শরণ্যার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। স্ট্রীটল্যাম্প-এর আলো বাঁচিয়ে যে সব ঘুপ্চি অন্ধকার টিকে আছে এখনও, সেখানে কোনো ছায়া দেখা গেল কী?
“রাকা!”
হঠাৎ দরজার কাছ থেকে গলার আওয়াজ পেয়ে শরণ্যা চমকে উঠে পিছনে তাকাল। কখন যেন ড্যাড এসে দাঁড়িয়েছিল।
“জল খেতে এসে দেখলাম তোর ঘরে আলো জ্বলছে। ঘুমোসনি এখনও?”
“নাঃ... পড়ছিলাম।”
ড্যাড্-এর সঙ্গে ঠিক কী কথা বললে যে স্বাভাবিক হয়, শরণ্যা জানেনা। এই দেড় বছরে একসঙ্গে কটা কথা বলেছে একে অপরকে? কলেজ না থাকলে ড্যাড্ যে সারাদিন কি করে সময় কাটায় সেটাই তো শরণ্যা জানে না! এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই দেখল ড্যাড্ কম্পিউটারের স্ক্রীন-এর উপর ঝুঁকে পড়ে কবিতাগুলো দেখছে।
“সেই যার পোয়েম পড়লাম কাগজে তার লেখা নাকি?” ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করে ড্যাড্।
“হ্যাঁ,” শরণ্যা একটু অবাক হয়, “তুমি কি করে জানলে?”
“স্টাইলটা দেখে।”
“... একটা পোয়েম পড়েই ওর স্টাইলটা ধরে ফেললে তুমি!”
ড্যাড্ হাসল, “কিছু কিছু কবি আছেন, যাদের লেখার ধরণটা পুরো য়ুনিক। এদের লেখা পড়লেই ধরে ফেলা যায়। যেমন ধর্, টি.এস. এলিয়ট। আবার বাংলায় জীবনানন্দ দাশ, তারপর বিষ্ণু দে প্রথম দিকে যেসব — তুই বোধহয় বিষ্ণু দে পড়িসনি।”
ড্যাড্-এর মুখে আচমকা এতগুলো কবির নাম শুনে শরণ্যা একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। প্রথমে পূজন, আর এখন আবার তারই বাড়ির লোক!
ড্যাড্ অবশ্য আপনমনে বলেই যাচ্ছিল, “সেদিন একবার পড়েই বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছিল আমার। কিরকম একটা... গথিক ব্যাপার ছিল না কবিতাটায়? চাঁদটাকে রোম্যান্টিসাইজ না করে বরং একটা ভয়ংকর রাক্ষস-জাতীয় প্রাণীর সঙ্গে তুলনা... আজকাল অনেকেই কবিতার ব্যাপারটা ভাল না বুঝেই লেখার চেষ্টা করে। এর লেখাগুলো সেরকম নয়; এর মাথায় একটা স্পষ্ট ল্যাণ্ডস্কেপ আছে, আর ভাষাটাও আয়ত্তে।”
শরণ্যা এতক্ষণে কথা খুঁজে পেয়ে বলল, “তুমি আজকালকার কবিদের লেখা পড়ো?”
“সব কি আর! তোদের মতো অত ইন্টারনেট ঘাঁটার অভ্যেসও নেই। ওই খবরের কাগজে, ম্যাগাজিনে যে দু-একটা বেরোয়... তবে তার সবই যে কবিতা হয় তাও না। অনেক অ-কবিতাও থাকে।”
“অ-কবিতা!”
“হ্যাঁ... মানে কবিতার মতো লেখবার চেষ্টা করলেও সেটা শেষমেশ ঠিক কবিতা হয়ে ওঠেনি।”
“আই সী... বাট হাউ ডু য়ু ইভেন নো? কবিতা কী সেটা কি ওরকমভাবে ডিফাইন করা যায়?”
ড্যাড বেশ কিছুক্ষণ কথাটার কোনো উত্তর দিল না; অন্যমনষ্ক হয়ে কি যেন ভাবতে লাগল। শরণ্যার মনে হচ্ছিল হয়তো প্রশ্নটা ড্যাডের কানেই আদৌ পৌঁছায়নি, এমন সময় হঠাৎ যেন আপনমনেই ড্যাড বলে উঠল:
যে কথাটা সোজাসুজি বলা যায়,শরণ্যা বলল, “এটা আবার কার লেখা?”
তাকে ইচ্ছাকৃত দুর্বোধ্যতা দিয়ে ঢেকে দিতে হয়।
আসলে কবিতা
সৃষ্টিসুখের উল্লাসে রোমাঞ্চিত হৃদয়ের
নিঃশব্দ স্বগতোক্তি।
ড্যাড্ কি যেন ভেবে তারপর আলতোভাবে হেসে বলল, “নিবারণ চক্রবর্তী।”
শরণ্যা ভুরু কোঁচকাল, “হু ইজ দ্যাট?”
ড্যাডের ঠোঁটে এক বিচিত্র হাসি খেলা করছিল; শেষ কবে তার মুখে এরকম অভিব্যক্তি দেখেছে, বা আদৌ দেখেছে কিনা, তাই শরণ্যা মনে করে উঠতে পারল না!
“নাম শুনিসনি? ফেমাস পোয়েট। এনিওয়ে, চললাম। ঘুমিয়ে পড় এবার, কাল স্কুল আছে না?”
ড্যাড চলে যাবার পর বেশ কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে ছিল শরণ্যা। পরপর এসব কী ঘটে চলেছে কে জানে! এতদিন তো পারিবারিক সমস্যা, তার গানবাজনা-লেখালেখি, আর মাঝে মাঝে রঙ্গীতদা ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ভাবারই সময় ছিল না তার। হঠাৎ কোথা থেকে এক কবিতা-লেখা ছেলে উড়ে এসে জুড়ে বসে তার চিন্তাভাবনাগুলো ওলট-পালট করে দিচ্ছে। তার মাঝখানেই হঠাৎ ড্যাড মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য উদয় হয়ে এমন সব কথাবার্তা বলে চলে গেলা যে তার সম্পর্কে শরণ্যার এতদিনের তৈরি হওয়া ধ্যান-ধারণাগুলো নড়তে শুরু করেছে। বিছানায় উপুড় হয়ে লেখার খাতাটায় অন্যমনষ্কভাবে হিজিবিজি কাটতে লাগল সে। ভিতরে ভিতরে একটা অস্বস্তি হচ্ছে, যেন কি একটা কথা মনে পড়তে গিয়েও পড়ছে না। এক সময় দেখতে পেল, হিজিবিজিগুলো কখন যেন কতগুলো লাইনের আকার ধারণ করেছে:
আমি এই মুহূর্তে নাম দিতে পারিলাইনগুলো মন দিয়ে পড়বার সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুতের মতো মনে পড়ে গেল শরণ্যার। নিবারণ চক্রবর্তী… ‘শেষের কবিতা’! তাই নামটা কেবলই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল এতক্ষণ। শরণ্যা খানিকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে থেকে তারপর বিড়বিড় করে বলল, “ড্যাড্ রাইট্স পোয়েম্স!”
জীবনের যা কিছু বেনামি
এবং শব্দের ফাঁকে
যেসব অপূর্ণ ভ্যাকুয়াম
আমার এই প্রচ্ছন্ন অহংকারে
তোমার চাপা হাসি পেলাম উত্তরে
যার নাম নেই
কালকের এই ঘটনাটার কথা ভাবতে ভাবতে কোনোদিকে খেয়াল ছিল না শরণ্যার। হঠাৎ বেশ জোর একটা গোলমালের আওয়াজে হুঁশ ফিরতেই দেখল, উদিতার সঙ্গে নীরার ঝগড়া বেধে গেছে। সকালের ঘটনাটা নিয়েই কথা হচ্ছিল।
“তুই যতই তোর বন্ধুকে ডিফেন্ড্ করবার চেষ্টা করিস না কেন নীরা, ক্লাসসুদ্ধ লোক জানে তিলোত্তমা ঠিক কতটা অ্যারোগ্যান্ট। সিরিয়াসলি, ও ভাবেটা কি নিজেকে? বড়লোকের সুন্দরী মেয়ে, না চাইতেই সবটা পেয়ে বসে আছে বলে কি ধরাকে সরা জ্ঞান করবে? রোমিলার সঙ্গে ওইভাবে কথা বলবার সাহস হয় কি করে? এমন ভাব যেন রোমিলা ওর মা-বোনকে টেনে কথা বলেছে! কেন রে, কমার্স সেকশানের মেয়েগুলোর সঙ্গে এত কিসের পিরিত? নাকি সেদিন তিলোত্তমাও ওই ঘরে বসেছিল, কোনটা? ইলেকটিভ ইংলিশের চারজনকেও তো সেদিন ডিটেইন করা হয়েছিল শুনেছি,” উদিতা বাঁকা চোখে শরণ্যার দিকে তাকায়।
এমনিতে তাদের মধ্যে নীরাই সবচেয়ে ঠোঁটকাটা। এমনকি মৃণালিনীও বিড়বিড় করে চারটে গালাগাল দিয়েই ক্ষান্ত দেয়; অবশ্য তেমন কিছু হলে ওর মুখের বদলে হাত চলার সম্ভাবনাই বেশি। তবে নীরা দরকার মতো উচিৎ কথাটা শুনিয়ে দিতে ছাড়ে না। কিন্তু আজ সে অবধি কোণঠাসা হয়ে গেছে। শরণ্যা দেখল, বাকি কারুরই অভিব্যক্তি বিশেষ বন্ধুসুলভ নয়। হঠাৎ করে সে টের পেল, এরা কোনোকালেই তিলোত্তমাকে পছন্দ করত না। একে তো ওই চেহারা, তার উপর পড়াশোনায় ভাল; ওর মতো মেয়ের প্রতি হিংসে না হওয়াটাই তো অস্বাভাবিক। কিন্তু তাদের আজকের এই উগ্রতাটা খুবই দৃষ্টিকটু মনে হল শরণ্যার। সে বেশ বুঝতে পারল, আড়ালে-আবডালে এরা তিলোত্তমাকে নিয়ে কম কথা বলে না, এবং সেসব খুব ভাল ভাল কথা নয়।
শরণ্যা বলল, “উদিতা, সেদিন আমরা চারজন কোথায় ছিলাম, সেটা এ.গাঙ্গুলী. ম্যাম্কে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবি। উনি লাস্ট বেল পড়বার পরেও কিছুক্ষণ ক্লাস নিয়েছিলেন। তিলোত্তমাও ওই ক্লাসে ছিল। এই ধরণের বাজে অ্যালিগেশান দেওয়ার আগে প্লিজ ফ্যাক্ট্গুলো জেনে নে।”
কথাটা শুনে উদিতা একটু দমে গিয়েছিল, কিন্তু পরক্ষণেই সোমদত্তা শুরু করল, “বেশ, মানছি, কিন্তু তাহলে সকালবেলা ওই নাটকটা করারই বা কি দরকার ছিল? আমরা কি ওকে কিছু বলেছি? আমরা শ্রদ্ধা সোম আর তিয়াসা বিশ্বাসের কথা বলছিলাম। ওরাও কি ধোয়া তুলসীপাতা?”
“ওরা ধোয়া তুলসীপাতা একথা কেউই বলেনি। তবে কথা যখন উঠেই গেল তখন বলছি। শ্রদ্ধা কি করেছে আমি জানিনা, কিন্তু তিয়াসা তখন বয়েজ সেকশানের রুমে ছিল না। গোলমাল যখন শুরু হয়েছে, তখন ও আমাদের রুমে এসে কথা বলছিল, সেটা এ.জি-ও দেখেছেন।”
“তাহলে ও সাস্পেণ্ড হল কেন?” তানিয়া তীক্ষ্ণভাবে প্রশ্ন করে।
“অদ্ভুত তো,” নীরা ইতিমধ্যে ধাতস্থ হয়ে উঠেছিল, “কমার্স সেকশানের সবাইকেই তো সাসপেণ্ড করে দেওয়া হয়েছিল। তাই বলে কি ওই ক্লাসের সবকটা মেয়ে ভিডিও দেখছিল নাকি? ছেলেদের ঘরে সেদিন বড় জোর চার-পাঁচজন ছিল; পরে টিচাররাই বলাবলি করেছেন। আর অ্যারোগ্যান্ট-এর ব্যাপারটা তো জাস্ট যা-তা। তিল্লী যদি সত্যিই অ্যারোগ্যান্ট হত, তাহলে আমাদের সঙ্গে কথা বলে কেন? আমরা কোথাকার কোন হনু?”
রোমিলা এতক্ষণ গোঁজ হয়ে ছিল, এবার অম্লরসাক্ত হাসি হেসে বলল, “এটা নিয়ে দয়া করে স্টার্ট করিস না। তোরা কে কোন ক্লাসে বিলং করিস, এইটুকু না জানার মতো বোকাও আমরা নই।”
এরকম একটা কথা শুনে নীরা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। জেস্ আজও জিওগ্রাফি ক্লাস কেটে লাইব্রেরীতে বসেছিল। রোমিলার মন্তব্য শুনে তার চোখ গোলগোল হয়ে উঠল। সে অস্ফুটে বলে উঠল, “হোয়াট দ্য হেল…?”
“আমি কেন ইন্ডিয়াতে চলে এসেছি জানিস?”
একটা অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়েছিল তাদের মধ্যে। শরণ্যার কথা শুনে সবাই একটু সচকিত হয়ে উঠল। তার গলার স্বর যেন আগের থেকে অনেকটাই আলাদা শোনাচ্ছে।
“আমি চলে এসেছি বিকজ মাই ড্যাড লস্ট হিজ জব ইন অ্যান্ অ্যাক্সিডেন্ট। হি হ্যাড আ হার্ট অ্যাটাক অন সী। আমাদের সেভিংস ছিল না, এদিকে ড্যাড্ ওয়াজ ডিক্লেয়ার্ড অ্যাজ আনফিট টু ওয়ার্ক। উই হ্যাড নো আদার অপ্শান বাট টু কাম ব্যাক।”
ঘরে একটা আলপিন পড়লেও তার শব্দ শোনা যেত। নীরার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যেন মাথায় বাজ পড়লেও এতটা স্তম্ভিত হয়ে যেত না। সে কিছু একটা বলবার চেষ্টা করতে শরণ্যা তাকে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলল, “এই তো গেল আমার কথা। উপলার প্যারেন্স ব্যাঙ্কে চাকরী করেন, মৃণালিনীর বাবা হিস্ট্রির প্রফেসার, নীরার বাবা পাবলিশিং হাউজের সাব-এডিটার। তোদের থেকে খুব একটা আলাদা কিছু কী? মনে তো হয় না। তিলোত্তমার বাড়ির লোকেরা বড়লোক হতে পারে, কিন্তু তার মানে সব কিছু রুপোর থালায় পেয়ে গেছে, দিস কুড্ নট বী ফার্দার ফ্রম দ্য ট্রূথ। তোরা তিল্লিকে কতটুকু চিনিস বল তো? জীবনে ওকে কি কি ফেস করতে হয়, তার কতটুকু জানিস? ওর চেহারা নিয়ে সকাল থেকে কমেন্ট করে যাচ্ছিস, ওর কি নিজের সেই চেহারার উপর কোনো হাত ছিল? ডু য়ু থিংক শি ইভেন লাইক্স লুকিং দ্যাট ওয়ে? শোন্ রোমিলা, লাইফ ইজ্ন্ট ইজি ফর এনি অফ আস। তিল্লী তোকে যে কথাটা বলার চেষ্টা করছিল, দ্যাট ওয়াজ আ ফেয়ার পয়েন্ট। তুই যদি ওর কথাটা রেস্পেক্টফুলি শুনতিস, তিলোত্তমা মেজাজ হারাতো বলে আমার অন্ততঃ মনে হয় না। উদিতা, তুই তো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটাই শুনেছিলি; তিলোত্তমা কি প্রথম থেকেই রূড্লি কথা বলেছিল, নাকি চেঁচিয়েছিল?”
উদিতা কিছু বলার আগেই জেস একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল, “সিরিয়াসলি ইয়ার! তুম্লোগ কমাল করতে হো! খুদ্ লড়কী হোকর দূসরী লড়কিয়োঁ কো তো অ্যায়সে জাজ করতে হো কি ভগবান ভী নেহী করতা হোগা! রোমিলা, তুই তো কিছু বলিসই না; ইয়ে নৌটঙ্কি তো তুনে স্টার্ট কিয়া হ্যায়। আমি ওখানে বসেছিলাম, আই হার্ড এভরিথিং। রন্ ইজ অ্যাবসোলিউটলি রাইট; অগর তু উসকে সাথ ঢঙ্গ সে বাত করতী তো উও ভী নেহী ভড়কতী।”
বাকিরা আর কথা না বাড়িয়ে নিজেদের মধ্যে গুজগুজ করতে লাগল। নীরা নিঃশ্বাস ফেলে জেসের পিঠে চাপড় মেরে বলল, “থ্যাংক্স জেস।”
“আরে পাগল, কুছ মৎ বোল্। রন্ সে পূছ, ম্যায়নে উন্ লোগোঁ কী পূরী বক্ওয়াস সুনী থী। যে কারুর রাগ হয়ে যেত। এনিওয়ে, চল্, ম্যায় যাতী হুঁ; এখানকার লোকদের রাগিয়ে দিলাম তো!”
জেস্ চোখ টিপে হেসে অন্য টেবিলে চলে গেল। নীরা আর শরণ্যাও অন্য কোথাও গিয়ে বসা বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করল। কোণের জানলার ধারের টেবিলে গিয়ে বসে পড়ল ওরা।
“তিল্লীর হয়ে কি মারাত্মক কেস লড়লাম বল্ আমরা!” নীরা এবার বলে।
শরণ্যা হাসল, “যা বলেছিস। আসলে একটা আমি আগেই বুঝেছিলাম, ক্লাসের কেউ তিল্লীকে সহ্য করতে পারে না। আর সেই সূত্রে আমাদেরও কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখে। কিন্তু তিল্লী হঠাৎ এতটা টেম্পার লুজ করল কেন, সেটাও বুঝতে পারছি না। এর আগে কখনও কোনো ব্যাপারে এভাবে তো রিঅ্যাক্ট করতে তো দেখিনি ওকে।”
নীরা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর অন্যমনষ্কভাবে বলে ফেলল, “শনিবারের ঘটনাটা নিয়ে কিছু কিনা কে জানে!”
শরণ্যা অবাক হয়ে বলল, “শনিবার আবার কি হল?”
নীরা গোপনীয়ভাবে বলল, “আরে এটা ওর সেই বয়ফেণ্ডের গল্প।”
“কি গল্প? আমি তো কিছু শুনিনি!”
“ওর তো রাহুলের সঙ্গে অনেকদিন ধরে বাওয়াল চলছে,” নীরা চাপা গলায় বলতে থাকে, “আমাকে সেদিন ক্লাসে একটু একটু বলেছিল। বোধহয় ওর সঙ্গে ব্রেক-আপ করে দেবে। ছেলেটা নাকি ভাল নয়।” “ওঃ... কিন্তু তার সঙ্গে শনিবারের কি সম্পর্ক?”
“আরে এর মধ্যে আরও একটা অ্যাঙ্গেল আছে। শি হ্যাজ মেট সামওয়ান এলস।”
শরণ্যা চোখ গোলগোল করে বলল, “অ্যাঁ! তুই কি করে জানলি?”
নীরা তখন সবিস্তারে ঘটনাটা বলল। শরণ্যা শুনতে শুনতে অন্যমনষ্ক হয়ে গিয়েছিল।
“কি নাম বললি ছেলেটার?” শরণ্যা জিজ্ঞেস করে।
“ধৃতিমান চ্যাটার্জী — এই, না না! ‘ধৃতিমান’ বললেই মুখ দিয়ে ‘চ্যাটার্জী’ বেরিয়ে যায় – ওর নাম ধৃতিমান রায়চৌধুরী।”
শরণ্যা বলল, “ফানি! আমিও ওই নামে একজনকে চিনি।”
“কে রে?”
“ওই... তুই চিনবি না। ... কিন্তু তিল্লীর রাগের কারণটা তো এখনও পরিষ্কার হল না?”
নীরা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আসলে ওরা স্লাট-ফাট বলছিল না? আমার কেন জানি না মনে হল তিল্লী ব্যাপারটাকে পার্সোনালী নিয়েছে। ও টু-টাইমিং-এর কেসে ফেঁসে গেছে কিনা কে জানে?”
শরণ্যা স্তম্ভিত হয়ে বলল, “নীরা!”
“আরে আমি জাজ করছি না রে বাবা!” নীরা তাড়াতাড়ি বলে, “দেখ, অনেক সময় এমনও তো হয়, যে একটা লোক অসহ্য, তার সঙ্গে ডীল করা যায় না, আর তখন একটা খুব ভাল লোকের সঙ্গে দেখা হল, এদিকে যে পুরনো লোক তাকে কিছুতেই ব্যাপারটা বলতে পারছে না। এটা তো ইচ্ছাকৃত নয়, এরকম মাঝে মাঝে ঘটে। কিন্তু সেটা নিয়ে হয়তো তিল্লী গিল্টি ফীল করছে। হতে পারেনা এরকম?”
শরণ্যা হঠাৎই মনের ভিতরে একটা অসম্ভব টানাপোড়েন টের পেল। সেটা তিলোত্তমাকে নিয়ে নয়। তবে বাইরে কিছু প্রকাশ করল না সে। শুধু চিন্তিত মুখে বলল, “আই জাস্ট হোপ শি ইজ অলরাইট্।”
সিক্ রুমের কেঠো বিছানাতে শুয়ে শুয়েও কখন যেন একটু তন্দ্রা মতো এসে গিয়েছিল। বাড়িতে এমনিতেও ঘুম হয় না। তার উপর পরশুদিন যা ঘটল, তারপর থেকে তো বলতে গেলে পুরো সময়টাই জেগে জেগে কেটেছে।
ঘুরেফিরে একটাই স্বপ্ন দেখছিল তিলোত্তমা। সে যেন একটা গোলোকধাঁধাঁর ভিতর হারিয়ে গিয়েছে সে, আর পাশের গলি থেকে সমানে কেউ ডেকে চলেছে, ‘মিঙ্কু! মিঙ্কু!’ সেই ডাকটা লক্ষ্য করে বারবার ছুটে যাচ্ছে, কিন্তু প্রত্যেকবার সেই একই চোরাগলিতে এসে পড়ছে। সেখানে অন্ধকারের মধ্যে মিশে আছে দুজন মানুষ, যারা বারবার তার আবির্ভাবে বিরক্ত।
এক সময় রাহুল বলে ওঠে, “ফর গড্স সেক, তিলোত্তমা, হোয়াই দ্য হেল আর য়ু বিয়িং সো পজেসিভ?” পাশ থেকে মেয়েটার খিল্খিলে হাসি ভেসে আসে, “গেট্ লস্ট, ইথিরিয়াল বিউটি!” ...
এক ঝট্কায় ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখ খুলে অনেকক্ষণ সীলিং-এর দিকে চেয়ে রইল তিলোত্তমা। কাল থেকেই মনের মধ্যে একটা আশ্চর্যরকম স্বস্তি টের পাচ্ছিল সে। সত্যিই তো, কত সহজে মিটে গেল ব্যাপারটা। ভেবে দেখলে, তাকে তো নিজের থেকে তেমন কিছুই করতে হল না। তাহলে আজ খামখা এত চেঁচামেচি করবার কি দরকার ছিল? ওরা তো নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল, তাতে তিলোত্তমার কী! নিজের ব্যবহারে সে নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু, রোমিলার কথাগুলো কেন তার নিজের গায়ে দগ্দগে ফোস্কার মতো জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিল?
সেদিন সন্ধ্যেবেলা ওই দৃশ্য দেখবার পরে কোনও মতে বাড়ির দরজার সামনে এসেই ধপ্ করে বারান্দার সিঁড়ির উপর বসে পড়েছিল তিলোত্তমা। ধৃতিমান অনেকক্ষণ ধরে কী বলবে তা ভাবার বৃথা চেষ্টা করে গেল। অবশেষে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “রাত হয়ে গেছে। য়ু শুড্ প্রবাবলি গো ইন্সাইড নাও। আপনি ঢুকে গেলে আমি তারপর যাব।”
“ভিতরে আসবেন না?”
“আজ থাক। অন্য কোনোদিন।”
তিলোত্তমা হঠাৎ টের পেল, তার মাথার ভিতর আস্তে আস্তে আবার আগুনের হল্কাগুলো ধিকধিক করে জ্বলে উঠছে। সে ধৃতিমানের চোখের উপর চোখ রেখে বলে উঠল, “কেন? ফাঁকা বাড়িতে একটা মেয়ের সঙ্গে ঢুকলে বদনাম হবে বলে?”
ধৃতিমান অবাক হয়ে দেখল, তিলোত্তমার দৃষ্টি ছুরির ফলার চাইতেও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। সে চোখ না সরিয়েই ধীরভাবে বলল, “আমার মনে হল, এরকম একটা ঘটনার পর হয়তো আপনি একা থাকতে চান। আর কোনো কারণ নেই। চলুন, লেট্স গো ইন্সাইড।”
এর পর যা হল, ভাবতে গিয়েও তিলোত্তমার মাথা ঘুরে উঠছিল। শুধু কি রাহুলের সঙ্গে ব্রেক-আপ-এর কারণেই এমন অস্বাভাবিক আচরণ করল সে? এরকমটা যে একদিন না একদিন হবারই ছিল, তা তো আগেই জানত। তবে কেন এমন করল?
এরকম আকস্মিক আক্রমণের জন্য ধৃতিমান একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। হুম্ড়ি খেয়ে তিলোত্তমার গায়ের উপর পড়ে যাচ্ছিল। তিলোত্তমাও তখন আষ্টেপৃষ্ঠে ওর গলা জড়িয়ে ধরেছে। নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে ধৃতিমান চেঁচিয়ে উঠল, “হোয়াট দ্য হেল আর য়ু ডুয়িং! পাগল হয়ে গেছেন নাকি!”
বেশ খানিকক্ষণ ধস্তাধস্তি চলল পরস্পরের মধ্যে। তারপর যেমনভাবে ওকে জড়িয়ে ধরেছিল, ঠিক ততটাই আচমকা ধৃতিমানকে ছেড়ে দিল তিলোত্তমা। ভীষণ জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছিল তার। তার মধ্যেই অদ্ভুত হিসহিসে গলায় বলে উঠল, “আর য়ু গে?”
ধৃতিমান মেঝের উপর উপুড় হয়ে পড়ে গিয়েছিল। প্রশ্ন শুনে তিলোত্তমার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলে উঠল, “হোয়াট?”
“য়ু হার্ড্ মী। আপনি গে? ডু য়ু স্লীপ উইথ মেন?”
ধৃতিমান আরও কিছুক্ষণ একই অবস্থায় হাঁপিয়ে নিল। তারপর সোজা হয়ে বসে বলল, “না। আই অ্যাম স্ট্রেট। আই অ্যাম অ্যাট্রাক্টেড টু উইমেন। কেন বলুন তো?”
“তাহলে হোয়াট দ্য হেল ইজ ইয়োর ডীল উইথ মী!” তিলোত্তমা রাগের চোটে মেঝেতে পা ঠুকতে থাকে। ধৃতিমান খানিকক্ষণ তিলোত্তমার এই অদ্ভুত মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর যেন তাকে শান্ত করবার জন্যই বলে, “দেখুন, আপনি শক্ পেয়েছেন। আই গেট ইট। কিন্তু নিজের ডিস্-অনেস্ট বয়ফ্রেণ্ডের উপর ক্ষেপে গিয়ে তার শোধটা আমার থেকে তুলছেন কেন?”
এই কথায় সত্যিই যেন কাজ হল; তিলোত্তমার অসম্ভব রাগটা এক নিমেষেই পড়ে গেল। সে খানিকক্ষণ অবিশ্বাসের চোখে ধৃতিমানের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর নিজেও মেঝেতে বসে পড়ে বলল, “একটা পুরুষ লোকের কাছ থেকে কোনোদিন এই কথা শুনতে পাব এটা জাস্ট ভাবিনি।”
“মানে?”
“মানে... মানে কী আমি নিজেও জানিনা।”
ধৃতিমান আরও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর বলে, “অন্যায়ের প্রতিকার কিন্তু অন্যায় দিয়ে হয় না। আপনার বয়ফ্রেণ্ড চীট করেছে, আপনি হার্ট হয়েছেন; সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে আপনি আমাকে কিস্ করতে যাবেন? তাহলে আর ওই ছেলেটার সঙ্গে আপনার তফাৎটা কোথায় রইল? সবচেয়ে বড় কথা, আমি তো কন্সেন্ট দিইনি। আপনার সঙ্গে কেউ এরকম ব্যবহার করলে আপনি কি করতেন? মলেস্টার বলে তাকে টেনে এক থাপ্পড় কষাতেন না?”
তিলোত্তমা কোনো উত্তর দেয় না। আস্তে আস্তে মাথার ভিতর ধোঁয়াশাটা কেটে যাচ্ছিল। আর সেই সঙ্গে ক্রমশই আরও বেশি করে মাটির ভিতর ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছিল তার। সত্যিই তো, আজকের এই ঘটনার পরে কাকানের মতো লোকেদের থেকে নিজেকে কিভাবে আলাদা করবে সে?
ধৃতিমান সহানুভূতির গলায় বলল, “আমি জানি, আপনার কোনো খারাপ ইন্টেন্শান ছিল না। ইট্ ওয়াজ টেম্পোরারি ইন্স্যানিটি অন্ ইয়োর পার্ট। তাও বলব, মাঝে মাঝে এক মুহূর্তের দূর্বলতার কারণে মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারে। ক্রাইসিসের সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখবার চেষ্টা করতে হয়। এরকম বয়ফ্রেণ্ড কত আসবে যাবে! এখন আপনার খারাপ লাগছে ঠিকই, কিন্তু ইন দ্য লং রান অফ থিংস এগুলো ম্যাটার করে না। আমার বয়সে এসে পৌঁছাবেন যখন, এসব ভেবে হাসি পাবে আপনার।”
তিলোত্তমা দুহাতের মাঝে মাথা রেখে বসেছিল। সেই ভঙ্গিতেই বলল, “ইট্স নট্ দ্যাট্।”
ধৃতিমান অবাক হয়ে বলল, “তাহলে? সমস্যাটা কি?”
তিলোত্তমা নিঃশ্বাস ফেলল, “বলতে গেলে মহাভারত। আপনাকে... আপনাকে তো আবার বাড়ি ফিরতে হবে। সাড়ে নটা বাজল।”
ধৃতিমান একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “সত্যি করে বলুন তো, আপনি আজকে একা থাকতে পারবেন?”
তিলোত্তমা একটু দুর্বলভাবে হাসল, “আর কোনো উপায় আছে কী?”
“আমি যদি থেকে যাই, আপনার আপত্তি আছে?”
তিলোত্তমা কিছু না বলে মাথা নাড়ল। ধৃতিমান ফোন বার করে বোধহয় বাড়িতে মেসেজ পাঠাল। তারপর পা দুটো সামনে ছড়িয়ে দিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে বলল, “শুনি, কি সমস্যা?”
কী বলবে, কতটা বলবে, ভেবে পেল না তিলোত্তমা। তার মনের গভীর অসুখের কথা কি একজন প্রায়-আগন্তুককে অবলীলায় বলে দিতে পারবে সে? কিছু কিছু কথা থাকে যেগুলো কাছের মানুষদের বলা খুব কঠিন। কখনো কোনো ট্রেনে বাসে চলতে চলতে হঠাৎই পাশে বসা লোকটাকে বলে দিয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য হালকা হওয়ার মতো কথা সে সব। তার সামনে যে বসে আছে, সে তো ঠিকই তেমনই একজন লোক! তিলোত্তমার জীবনের বিন্দু-বিসর্গও সে জানেনা। হয়তো এরকম একটা ঘটনার পরে সে একেবারেই হারিয়ে যাবে। তার আগে একে কথাগুলো বলে দেওয়া কি খুব কঠিন? ...
তিলোত্তমা শুধু বলল, “আচ্ছা আমাকে দেখতে ঠিক কী রকম বলুন তো?”
ধৃতিমান কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার মুখ দেখে কিছু বুঝতে পারল না তিলোত্তমা, তবু মনে হল, যেন ভিতরে ভিতরে কিছু একটা টের পেয়েছে সে। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে অবশেষে ধৃতিমান বলল, “আপনি যেমন, আপনাকে ঠিক তেমনই দেখতে; একজন সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের মতো। যারা অন্যরকম দেখছে, সমস্যাটা তাদের। সেসব লোকেদের কথা ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেই বোধহয় ভাল করবেন।”
তিলোত্তমা কিছু বলবার আগেই সে বলে উঠল, “আমার না, ভয়ংকর চা-তেষ্টা পেয়েছে। রান্নাঘরটা কোন দিকে বলতে পারেন?”
তিলোত্তমা ব্যস্ত হয়ে লাফিয়ে উঠল, “তাই তো, এতক্ষণ এভাবে আপনাকে বসিয়ে রেখে — ছি ছি, দাঁড়ান, আমি বানিয়ে আনছি, আর আপনার ডিনারটাও তো —”
“রাখুন মশাই,” ধৃতিমান ধীরে-সুস্থে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনি হাতে মুখে জল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন্ তো আগে। চা খাবেন? আমি কিন্তু খুব ভাল চা বানাই।”
তিলোত্তমা আর আপত্তি না করে মাথা হেলাল। আজকের পুরো দিনটাই কেমন যেন হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর ছেলেটাই বা কী! এরকম একটা অস্বাভাবিক, অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে এতটা সহজভাবে কথা বলছে কি করে! কিংবা হয়তো সহজ হবার ভান করছে। যাই করুক, তিলোত্তমা নিজের কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবটা কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। ধৃতিমান রাতের বন্দোবস্ত যদি নিজে করে নিতে পারে তাহলে এক হিসেবে ভালই। ওকে রাতে থাকতে বলাটা কতটা নিরাপদ কে জানে। কিন্তু আজ তিলোত্তমা কেমন যেন হাল ছেড়ে দিয়েছিল।
“ডিনার নিয়ে ভাববেন না, তৈরি হয়ে যাবে। আগে জমিয়ে চা খাই। তারপর ... এক সেট পাঞ্জাবি-পাজামা পাওয়া যাবে? আচ্ছা বেশ, শৌর্য্যর ঘরে গিয়ে দেখে নিচ্ছি।”
এই বলে ভিতরের দিকে পা বাড়াল ধৃতিমান। তিলোত্তমাও খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর নিজের ঘরের দিকে গেল।
এই ঘটনাটা যদি রোমিলাদের কানে যায়, তাহলে ওরা কী বলবে? যদি শরণ্যারাই শোনে? অথচ পরশু রাতের ওই কাণ্ডের পর আর নাটকীয় কিছুই ঘটেনি। চা খেয়ে, নিজের নিজের রাতের খাবারটা নিয়ে যে যার ঘরে চলে গিয়েছিল দুজনে। ধৃতিমানের কথা জানে না, কিন্তু তিলোত্তমার এমন গভীর ঘুম বহুদিন হয়নি। সকালে বেশ দেরি করে ঘুম ভাঙল। তিলোত্তমা বিছানায় শুয়ে শুয়েই ভাববার চেষ্টা করছিল যে কাল রাতের ঘটনাগুলো সবটাই স্বপ্ন কিনা। দরজার দিকে চোখ পড়তেই অবশ্য দ্বিধা কেটে গেল। দরজার তলা দিয়ে কখন যেন এক খণ্ড কাগজ ঢুকিয়ে দিয়েছে। উঠে গিয়ে কাগজটা কুড়িয়ে নিয়ে দেখল, পরিষ্কার হাতের লেখায় একটা দু-লাইনের চিঠি:
একটু ভোরেই বেরোচ্ছি। আশেপাশে তেমন কোনো লোকজন না থাকলেও, কারুর চোখে পড়লে অহেতুক জল ঘোলা হবে। মাইক্রো-আভেনে ব্রেকফাস্ট রাখা আছে। যদি কখনো দরকার হয়, নীচের নম্বরে ফোন করবেন।তিলোত্তমার বেশি ভাবার সাহস হচ্ছিল না। ফোনটা নিয়ে মনোযোগ দিয়ে নম্বরটা সেভ করে রাখল শুধু। কাকানের এই আজব বন্ধুর আবির্ভাবের আগেও জীবনটা যা হোক একরকম ছিল। এ আসার পর থেকেই পরপর এমন সব কাণ্ড ঘটছে যে তিলোত্তমা দিন দিন আরও দিশেহারা বোধ করছে। এসব কথা মাথায় এলোমেলোভাবে ঘুরছিল; এমন সময় দেখে রাহুলের ফোন।
কাল সন্ধ্যেবেলার সেই দৃশ্যটা আরও একবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। কিন্তু আশ্চর্য, এবার আর কোনোরকম অনুভূতিই হল না তার। রাহুল যেন সম্পূর্ণ অপরিচিত এক ব্যক্তি; তার ভাল-মন্দ কোনো কিছুতেই তার কিছু এসে যায় না। সে ফোন ধরে নির্লিপ্ত গলায় বলল, “হ্যালো।”
“এতক্ষণ লাগল ফোন ধরতে? ঘুমোচ্ছিলে নাকি?” রাহুল বিরক্ত।
“কী বলবে বলে ফেলো।”
“আজ তো সান্ডে। লেট্স মীট আপ।”
“না।”
“... মানে?” রাহুলের স্বরটা হক্চকিয়ে যায়।
“মানে, আমি যাব না। শুধু আজ কেন, আর কোনোদিন তোমার ধারেকাছেও যাব না আমি। আই অ্যাম ব্রেকিং আপ উইথ য়ু।”
“হোয়া... হোয়াট দ্য হেল!” রাহুল খাবি খেয়ে বলে, “ইজ দিস আ জোক? কি বলছো কি তুমি? হোয়াই?” “বিকজ য়ু আর আ চীটিং বাস্টার্ড।”
রাহুল এতটাই ঘাবড়ে গেল যে মুখ দিয়ে ভাল করে কথা বেরোল না। তিলোত্তমা একইভাবে বলল, “রিয়ার সঙ্গে মেক্-আউট যদি করতেই হত, অন্য কোথাও গিয়ে করলেই পারতে। আমার বাড়ির রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা সীন না করলে চলছিল না, তাই তো?”
রাহুল বোধহয় ততক্ষণে প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিয়েছে। একটু ধাতস্থ হয়ে বলল, “তুমি – আর য়ু টকিং অ্যাবাউট লাস্ট নাইট?”
“ইয়েস, আই অ্যাম। যদিও কাল রাতেই যে এটা প্রথম ঘটেছে তা বলছি না।”
“লিস্ন তিলোত্তমা, আই ক্যান এক্সপ্লেন দ্যাট্।”
“তুমি এখনও ফোনটা ধরে আছো কি করে আমি বুঝতে পারছি না।”
“জাস্ট লিস্ন টু মী গড্-ড্যামিট!” রাহুল অধৈর্য্যভাবে চেঁচিয়ে উঠল, “বোঝার চেষ্টা করো ব্যাপারটা! রিয়ার সঙ্গে যেটা হয়েছে দ্যাট্স — দ্যাট্স অ্যাবসোলিউটলী নাথিং! ইট্ হ্যাপেন্স সামটাইমস্। আমি তো কখনও তোমার সঙ্গে ওই ধরণের কিছু ... আই মীন —”
“আই নো হোয়াট য়ু মীন।”
তিলোত্তমার এতক্ষণে একটু কৌতুহলের উদ্রেক হয়। পুরোনো প্রশ্নটা আরও একবার খোঁচা দিয়ে উঠল মনের মধ্যে। এবার কি উত্তরটা পাওয়া যাবে?
“হোয়াই ডিড্ন্ট য়ু?” তিলোত্তমা জিজ্ঞেস করে, “তুমি আমাকে নিজের গার্লফ্রেণ্ড বলো, তোমার সমস্ত বন্ধুরা আমাকে ‘সুন্দরী’ ‘সুন্দরী’ বলে পাগল করে দিয়েছে, তুমি নিজে আমার কাছে অনেকদিন ব্র্যাগ করেছ যে কলেজের সবাই তোমাকে হিংসে করে। তো এতকিছুর পরেও হোয়াই ডিড্ য়ু হ্যাভ টু মেক-আউট উইথ অ্যানাদার উওম্যান? তুমি এই এক বছরের মধ্যে কখনও আমার হাতটাও ধরোনি। হোয়াই ইজ দ্যাট?”
“বিকজ... বিকজ... আই ডিড্ন্ট ওয়ান্ট টু স্পয়েল য়ু!” রাহুলের গলার স্বরে মনে হয় যেন কথাটা বলাই বাহুল্য, “লুক তিলোত্তমা, রিয়ার মতো মেয়েরা... দে আর ইজি। কিন্তু তোমার ব্যাপারটা আলাদা, তুমি —”
“স্পয়েল্ড নই। সেই জন্য রিয়ার থেকে আমার দামটা একটু বেশি। মানে বাজারে নিয়ে গিয়ে রিয়াকে বিক্রি করলে হয়তো একশো টাকা পাওয়া যাবে, আমাকে বিক্রি করলে পাঁচশো। রিয়লি ফ্ল্যাটার্ড টু নো দ্যাট।”
“কাম অন্, তুমি কথাটাকে এভাবে —”
“তো আর কিভাবে বলব? আর য়ু ইভেন লিসনিং টু ইয়োরসেল্ফ? আমি একটা মানুষ; কোনো খাবার জিনিস নই যে বাসী হয়ে যাব, কি নষ্ট হয়ে যাব। হু দ্য ফাক্ আর য়ু টু স্পয়েল মী? কি ভাবোটা কি তুমি নিজেকে? গুড্ থিং যে আজ আমাদের দেখা হয়নি; সামনে থাকলে এতক্ষণে দু-তিনটে চড়-থাপ্পড় খেয়ে যেতে।”
রাহুলের স্বরটা হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে হিংস্র হয়ে ওঠে।
“এই, বেশি ফড়ফড়িও না, বুঝলে? তোমার এই মরাল হাই-হর্স-এ চড়া বের করে দেব। আমাকে যে লেকচার দিচ্ছ, তুমি নিজে কী করে বেড়াচ্ছিলে এই ক’দিন? তুমি কি ভাবো, আমি জানি না হোয়াট য়ু আর আপ্ টু?”
তিলোত্তমা এতটাই অবাক হয়ে গিয়েছিল যে উত্তর দিতে বেশ খানিকটা সময় লাগল।
“আফটার এভরিথিং দ্যাট হ্যাজ হ্যাপেন্ড, তুমি এখনও আমাকে অ্যাকিউজ করার চেষ্টা করছ?”
“আলবাৎ করছি। সেদিনের সেই ছেলেটা, দ্যাট টল্ গাই অ্যাট দ্য কফিশপ, তার সঙ্গে তোমারই বা কী রিলেশান? কাকুর বন্ধু মাই ফুট! কাল রাতে রুদ্ররূপ টোল্ড মী যে ও তোমাদের দুজনকে হাত-ধরাধরি করে গোলপার্কে ঘুরতে দেখেছে। আই নো হোয়াট দিস ইজ অ্যাবাউট, ওকে? তুমি শুধু ব্রেক্-আপ করার একটা এক্সকিউজ খুঁজছিলে কারণ আমাকে দিয়ে আর তোমার চলছে না। চলবে কি করে, য়ু আর ওনলি আফ্টার দ্যাট ওয়ান থিং! য়ু আর আ ফাকিং স্লাট!”
তিলোত্তমা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। তার মনে হয়েছিল যে অন্ততঃ এই একটিবার রাহুল তার সঙ্গে উদ্ধতভাবে কথা বলবার সাহস পাবে না। কিন্তু চোরের মায়ের গলায় যে এত জোর হয়, সে রাহুলকে না দেখলে বিশ্বাস করত না।
“য়ু আর রাইট,” হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা গলায় কেটে কেটে বলল সে, “আই অ্যাম ওনলি আফ্টার ওয়ান থিং। কিন্তু তাও আমি রাস্তাঘাটে চৈত্র মাসের কুকুরের মতো ব্যবহার করি না। আনলাইক য়ু, আমার একটা ক্লাস আছে। এনিওয়ে, আশা করি আমাকে ভবিষ্যতে কন্ট্যাক্ট করবার চেষ্টা করবে না। বাই।” ...
তিলোত্তমা সিক-বেডের উপর উঠে বসল। বুঝতে পারছে, রাহুলের বলা কথাগুলো তার মনে গভীর ক্ষত রেখে গেছে। হয়তো এরকম হত না, যদি না তার আগের রাতে ধৃতিমানের সঙ্গে ওই ঘটনাটা না ঘটত। কেন এরকমটা করে বসল সে? পরীক্ষা নেবার জন্য? সে কি দেখতে চাইছিল, যে ছেলেটার এই আপাত-নির্লিপ্ত স্নেহের ভাব আসলে কতটা খাঁটি, সত্যি সত্যি তার সংযমের দৌড় কতটা? নাকি ভিতরে ভিতরে সে নিজেই ধৃতিমানের কাছ থেকে অন্যরকম কিছু প্রত্যাশা করছিল? সে কি চাইছিল না, যে অন্ততঃ একজন কেউ তাকে প্রকৃত রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে দেখুক? ...
তিলোত্তমা আবার শুয়ে পড়ল। একেবারে ইলেক্টিভ ইংলিশ ক্লাসে ঢুকবে। আজ আর রোমিলা-উদিতাদের মুখ দেখতে চায় না সে।
মৃণালিনী ইকনমিক্স ক্লাসে একটা নোটও লেখেনি। লাস্ট বেঞ্চের পাশের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে তো আছেই। ফোর্থ পিরিয়ড শুরু হয়ে গেল, তাতেও কোনো হেলদোল নেই। উপলা অনেকক্ষণ ধরেই ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিল; এবারে আর থাকতে না পেরে এক খোঁচা দিয়ে বলল, “এই, এই, তোর ব্যাপারটা কী?”
মৃণালিনী চট্কা ভেঙে বলল, “অ্যাঁ! কী? ক্লাস শেষ হয়ে গেল?”
“না, এখনও এক পিরিয়ড বাকি। এরকম লস্ট কেস হয়ে বসে আছিস কেন?”
“কই, আমি তো ...”
উপলা নীচুস্বরে বলল, “এক থাবড়া মারব শালা! পি.এস-এর ক্লাসনোট লিখতে গিয়ে আমার পেনের রিফিল শেষ হয়ে গেল, আর তুই খাতায় একটা দাগও কেটেছিস? তখন থেকে এমনভাবে জানলার বাইরে তাকিয়ে আছিস যেন শিল্দা বসে আছে ওখানে। কি হয়েছেটা কী, অ্যাঁ?”
মৃণালিনী ফোঁস করে একটা দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে বলল, “কি আর হবে! শিল্দাই হয়েছে আর কী!”
“যাব্বাবা,” উপলা হাত নাড়ল, “এই তো শুনলাম দুজনে মিলে রোজ রোজ ডেট-এ যাচ্ছিস। এখন আবার নতুন কি নাটক?”
“আরে নতুন কেন হবে? আজ তিন সপ্তাহ ধরে তো একই নাটক চলে আসছে! রোজ বিকেলে অফিস থেকে ফিরে, নয়তো ছুটির দিনে কোথাও না কোথাও ঘুরতে বেরোচ্ছি। নিদেনপক্ষে ঘরে বসে আড্ডা মারছি। নিজের যাবতীয় হাঁড়ির কথা বলে দিয়েছি এতদিনে। শিল্দাও বলেছে।”
“তো প্রবলেমটা কী?”
“আরে আসল জিনিসটাই তো বলছে না!”
“আসল জিনিস মানে?”
“মানে — মানে — আমাকে নিয়ে ওর ফিলিংস।”
“আরে বাবা, নিশ্চয়ই পছন্দই করে, না হলে আর —”
মৃণালিনী হঠাৎ উপলাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বেশ জোরের সঙ্গে বলে, “অফ্ কোর্স লাইক করে। আমাকে ও বারবার বলেছে যে আমি ওর লাইফে সবার চেয়ে আলাদা, আমি স্পেশাল। ও আমার সঙ্গে যে সব কথা শেয়ার করেছে, আর কোনোদিন কারুর সঙ্গে করেনি।”
মৃণালিনী এতটাই গলা তুলে কথা বলছিল যে সামনের বেঞ্চে বসা শিরিন আর সঙ্গীতা পিছন ঘুরে আড়চোখে তাকাল। উপলা বিপন্নভাবে বলল, “ওরে মা, আস্তে, আস্তে! কেস খাওয়াতে চাস নাকি পি.এস-এর কাছে? নোট লিখছিসনা দেখলে চাটনি বানিয়ে দেবে!”
“চাটনি বানানোর আগে আমি ওর খুলি হাতে ধরিয়ে দেব।”
উপলা এবার প্রশংসার ভঙ্গিতে বলল, “বাঃ, এটা তো বেশ নতুন শোনাচ্ছে! কিন্তু সিরিয়াসলি, তোর প্রবলেমটা কী নিয়ে বল্ তো? নিজেই যখন শিল্দার ফিলিংস টের পেয়েছিস, তাহলে আবার এত উতলা হবার কি আছে?”
“হব না?” মৃণালিনী চোখ গোলগোল করে বলে, “আমরা দুজনেই জানি উই লাভ ইচ্ আদার। কিন্তু সেটা পষ্টা-পষ্টি কেউই কিছু বলছি না। দুজনে যেন কানামাছি খেলে বেড়াচ্ছি শালা! এরকম আবার হয় নাকি?” উপলা একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “লাভ ইচ্ আদার? দেখ ভাই, লাভ ইজ আ স্ট্রং ওয়ার্ড।”
মৃণালিনী ভুরু কোঁচকাল, “মানে কী?”
“মানে হল গিয়ে ... যেমন ধর ভাল-লাগা আর ভালবাসার মধ্যে একটা বেসিক ডিফারেন্স আছে বুঝিস তো?”
“অফ কোর্স বুঝি! তুই কি গাড়ল পেয়েছিস আমায়? এই ক’মাস আগেই তো তোরাই গলা ফাটাচ্ছিলি যে আমি নাকি প্রেমে পড়েছি।”
উপলা বিশদ করে বোঝানোর চেষ্টা করে, “আরে বাবা, হ্যাঁ। কিন্তু প্রেমে পড়াটাও ভালবাসার থেকে আলাদা জিনিস। অনেকটাই।”
মৃণালিনী এবার স্তম্ভিত হয়ে বলে, “যাঃ শালা!”