• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ১০০ | অক্টোবর ২০২৫ | রম্যরচনা
    Share
  • রকবাজির কোলাজ: কোলকাতা ও ছত্তিশগড় (৩) : রঞ্জন রায়

    নায়কের প্রবেশ ও প্রস্থান (কোলকাতা পর্ব)


    আজ সন্ধ্যের আড্ডা শুরু হতেই ঠেকে খবরটা এল।

    আমাদের সুবীরদা গ্র্যাজুয়েট হয়েছে। দু’নম্বরের জন্য ফার্স্ট ক্লাস ফসকে গেছে। আমরা কোরাস গাই—দু’নম্বরটা কোন ব্যাপার নয়, তুমি ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছ। তোমার যা বিদ্যে তুমি অনেক ফার্স্ট কেলাসের ক্লাস নিতে পারো। নেহাত তোমার কলেজের নামটা চেরো কলেজ (চারুচন্দ্র), নইলে আরও ভাল নম্বর পেতে। বুঢঢা বুঢঢা এগজামিনার কলেজের পেডিগ্রি দেখেই—বুঝলে কিনা।

    তুমি এক কাজ কর। ফীস জমা করে খাতা ফের চেক করার দরখাস্ত দাও।

    আর আমাদের ঠেকের মধ্যে তুমিই প্রথম গ্র্যাজুয়েট, আমাদের হিরো! আমাদের সবার ছাতির মাপ এখন ছাপ্পান্ন ইঞ্চি। আজ আমরা সবাই মিলে চাঁদা তুলে তোমাকে খাওয়াব। আগামী মাসের গোড়ায় মাইনে পেয়ে তুমি আমাদের—

    —দুস্‌ শালা! আমি কি চাকরি পেয়েছি নাকি? এখনও দু’বছর বাপের হোটেলের ভাতের ভরসায় এম এ পড়তে কাটাকলে যাচ্ছি। তারপর চাকরি বাকরি।

    —এম এ পড়তে কাটা কলে যেতে হবে কেন? বেলেঘাটা ফেরত মাল বিশ্ব বকাটে পচার আপাত নিরীহ প্রশ্ন। ছোঁড়া এখনও স্কুলের বেড়া ডিঙোয়নি।

    সজল চটে গিয়ে বলে—ওসব তোর সিলেবাসের বাইরে, তুই বুঝবি না।

    —আহা, বলেই দেখ না! ঠিকমত বোঝালেই বুঝব।

    —শোন, সুবীরদার সাবজেক্ট হল ইকনমিক্স, আর ইউনিভার্সিটির ইকনমিক্স বিন্ডিং হল সিঁথির কাছে কাটাকল এলাকায়। এবার বুঝলি? যেমন রাজাবাজার সায়েন্স, তেমনি কাটাকল ইকনমিক্স।

    পচা এবার চট করে সুবীরদার পায়ে হাত দেয়।

    সবাই চমকে ওঠার আগেই ও গলা ছেড়ে যাত্রার বিবেকের মত গান জুড়ে দেয়—‘পায়ের ধূলো, দ্যাও গো দাদা! সময় যে আর না-আ-আ-ই! এবার আমি যাই’।

    —তোর কী হল? পেটব্যাথা করছে? যাবি কোন চুলোয়?

    —না বিজনদা, যাচ্ছি অধীরদার দোকানে। আজ সুবীরদাকে তোমরা খাওয়াবে বললে যে! আমি ছ’প্লেট ঘুগনি আর ছ’টা চা বাকিতে লিখিয়ে আনছি।

    সুবীরদা কিঞ্চিৎ হতভম্ব।

    —বুঝলাম, কিন্তু পায়ে হাত দিলি কেন? জানিস তো ওসব আমার পছন্দ নয়।

    —‘অতিভক্তি চোরের লক্ষণ’। নারাণ ফুট কাটে।

    —না গো দাদা! সুবীরদা আশীর্বাদ করুন আমিও যেন একদিন কাটাকল না খুড়োর কল, সেখানে গিয়ে এম এ পড়তে পারি।

    সুবীরদা লজ্জা পেয়ে বলে—আচ্ছা আচ্ছা, সে হবে’খন।

    কিন্তু বিজন ছাড়ে না।

    —এঃ পোঁদে নেই ইন্দি, ভজ রে গোবিন্দি! ক্লাসের পড়ায় মন নেই। কাটাকলে যাবে। হেলে ধরতে পারে না, কেউটে ধরার বায়না। শোন সুবীরদা, এ ছেলের কিস্যু হবার নয়। তোমার আশীর্বাদের কথা ছাড়, বাবা লোকনাথেরও সাধ্যি নেই ওকে ইউনিভার্সিটির দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়।

    বলব তোর গত সপ্তাহের কাণ্ড?

    পচার করুণ চাউনিতে নির্বাক মিনতি।

    কিন্তু আমরা কিসসার গন্ধ পেয়ে বিজনকে বলি—বলে ফ্যাল।

    আমাদের চোখে হিংস্র আনন্দ দেখে পচা ‘অধীরদার দোকানে যাচ্ছি’ বলে কেটে পড়ে।

    বিজন বলে— গত মঙ্গলবারে নাকতলা স্কুলের হেডস্যার পচার বাড়িতে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। ওর বাবা যেন স্কুলে এসে ওনার সঙ্গে দেখা করেন।

    —কেসটা কী?

    —বিনয় স্যার ইকনমিক্স পড়াতে দোতলায় ১১ বি ক্লাসরুমে ঢুকেছেন, একটু দেরি করে। ব্ল্যাকবোর্ডে চটপট শর্ট টার্ম মার্কেট ইকুইলিব্রিয়ামের গ্রাফ এঁকে ক্লাসের দিকে তাকিয়ে চশমা মুছতে মুছতে খেয়াল করলেন—তিন ব্যাকবেঞ্চার, পচা আর তার দুই স্যাঙাৎ — পেছনের জানলায় বসে খুব মন দিয়ে নীচের দিকে ঝুঁকে কিছু দেখছে। স্যার যে ক্লাসে ঢুকেছেন, গ্রাফ এঁকে ফেলেছেন—সে নিয়ে ওদের কোন হেলদোল নেই।

    স্যারের প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন। কিন্তু কৌতূহল হল কী এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য যা এদের পড়ার চেয়ে বেশি দরকারি মনে হচ্ছে?

    উনি চটপট জানলার কাছে গিয়ে হাঁক পাড়লেন—অ্যাই, তোরা কী দেখছিস রে?

    পচা অ্যান্ড কোং চমকে উঠে স্যারকে দেখে জানলা আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করল।

    —কিছু না স্যার, কিছু না।

    স্যারের সন্দেহ আরো বেড়ে গেল।

    ওদিকের দুটো একতলা বাড়িতে বাথরুমের ওপরে ছাদ নেই। বছরখানেক আগে দু’একবার কমপ্লেন এসেছিল যে দুপুরে মেয়েরা স্নানে গেলে স্কুলের কিছু ছেলে উঁকি দেয় এবং আওয়াজ দেয়। অপরাধী সনাক্ত হওয়ায় পত্রপাঠ টিসি ধরিয়ে দেয়া হয়। তার আগে স্টাফ রুমে আচ্ছা করে চাবকানো হয়।

    ফের ঝামেলা শুরু হল নাকি? এত সাহস!

    কিন্তু উনি গিয়ে দেখলেন নীচের একটা বাড়ির সামনের আঙিনায় একটি ছাগল বাচ্চা বিয়োচ্ছে। ছানাটার ঠ্যাং বেরিয়েছে, কিন্তু মাথা এখনও ভেতরে। ও বাড়ির কাজের মাসি এবং দুই গিন্নি মিলে ঠ্যাং টেনে দাইয়ের কাজে ব্যস্ত। আর তাঁর তিন ছাত্র এখন থেকেই গাইনি ও মিডওয়াইফ শাস্ত্রের প্র্যাকটিক্যাল পাঠ নিচ্ছে।

    স্যার ঠাস ঠাস করে তিন জনকেই চড় কষালেন। তারপর ঠেলতে ঠেলতে স্টাফ রুমে নিয়ে গেলেন।

    অবাক কাণ্ড, অন্য মাস্টারমশাইরা গল্পটা শুনে মিটিমিটি হাসছেন। একজন আবার সহানুভূতি দেখিয়ে বললেন—সামনে পরীক্ষা। বছর শেষ হয়ে এল। এবার ক্লাসের বাইরে নয়, ভেতরে মন দাও।

    বিনয় স্যার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে হেডস্যারের কামরায় গেলেন।

    অন্য স্যারেরা পচার কোচিং ক্লাস শুরু করলেন।

    শোন, হেডমাস্টার মশাই আসছেন। বুড়ো মানুষ, বাইরে কড়া, ভেতরে নরম। আসামাত্র পাকামি না করে সরি বলবি, বুঝেছিস।

    পচা কী বুঝল কে জানে!

    হেডস্যার (ছাত্রদের মুখে হেডু) এসে লম্বা লেকচার দিলেন। পচা অ্যান্ড কোং নাকি মাঝেমধ্যেই ক্লাস কাটে (উনি বললেন বাংক করে), টিফিন পিরিয়ড পনেরো মিনিটের, কিন্তু এরা আধঘন্টা বাইরে কাটিয়ে ফিফথ পিরিয়ডে ক্লাসে ঢোকে। গা থেকে সিগারেটের গন্ধ ভুরভুর করে। এসব কী হচ্ছে? নাকতলা স্কুলের আগে কত নাম ছিল।

    --এখন তোদের মত বেয়াড়া লক্ষীছাড়ার দল এসে —। যাকগে, শ্রীমন্ত (পচার নাম নাকি শ্রীমন্ত), তুমিই হচ্ছ নাটের গুরু। অমন গোবেচারা মুখ করে তাকিও না। আমি সব খবরই রাখি। বল, আমি কী করলে তোমরা শুধরে যাবে?

    —মানে, আমরা কী করলে আপনাদের বিশ্বাস হবে যে আমরা শুধরে গেছি?

    —এই ধর, ক্লাস বাংক না করা, টিফিনে ক্লাসে থাকা বা সময়মত ফিরে আসা, স্কুলে এসে সিগারেট না খাওয়া-–এইসব আর কি! সোজা কথায় স্কুলের রুলস্‌ অ্যান্ড রেগুলেশনস্‌ মেনে চলা। বল, আমরা কী করতে পারি ? বলে ফেল।

    কেউ কিছু বলছে না। পচা চোখ নামিয়ে কিছু একটা ভাবছে। মেঝেতে হাওয়াই চটি পরা পা ঘষছে।

    সবাই অপেক্ষায়।

    পচা মাথা তুলল। কোন একটা সিদ্ধান্তে এসেছে।

    —স্যার, আমি কিছু বলি? একটা উপায় আছে।

    —কী উপায় বল।

    —স্যার, আমি মূর্খ। আমার কম বুদ্ধিতে যা ভেবেছি সেটা নির্ভয়ে বলতে পারি?

    —অবশ্যই। ভয় পাওয়ার কী আছে? বল।

    —স্যার, আমার মনে হয় এটা নাকতলা বয়েজ স্কুল। শুধু ছেলেরা পড়ে। এটাকে কো-এড্‌ করে দিন। সামনের ভারতী বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েদের এখানেই ভর্তি করে দিন। ওদের বিল্ডিঙয়ে বড় ল্যাব হয়ে যাবে। আমাদের সায়েন্সের ল্যাব বড্ড ছোট, বিশেষ করে বায়োলজি আর কেমিস্ট্রি ল্যাব।

    আর ক্লাসে মেয়েরা আমাদের সহপাঠী হলে দেখবেন কেউ ক্লাস বাংক করবে না। টিফিনে বাইরে যাবে না। ছুটির দিনে এক্সট্রা ক্লাস বা টিউটোরিয়াল ক্লাস করবে। মেয়েদের ঝারি না করে ভাল রেজাল্ট দেখিয়ে ইম্প্রেস করবে।

    একবার স্কুল কমিটিকে বলে দেখুন না, স্যার!

    হেডু বেরিয়ে যাবার আগে বিনয় স্যারকে বললেন—শ্রীমন্তের বাবাকে অফিসিয়ালি চিঠি দিয়ে স্কুলে ডেকে পাঠান!

    আমাদের হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল। সুবীরদা বলল—পচা হচ্ছে একটি আনকাট ডায়মণ্ড। ও আমাদের পাড়ায় আসার পর থেকে ঠেকের জৌলুষ বেড়ে গেছে।

    নারায়ণ বলে—সেবারে ঘ্যান্টার বাবা আমাদের দারোগা মেশোর রোজ রোজ ইংরেজি ঝাড়ার উৎপাত থেকে ওই আমাদের বাঁচিয়েছিল। তবে একটা কথা। ব্যাটা এসেছে ফুলবাগান বস্তি থেকে। আমাদের মত নাকতলায় বড় হয়নি। কাজেই ও অনায়াসে বড়দের সম্মান টম্মানের তোয়াক্কা করে না। ফলে যখন যা মনে হয় বলে ফেলে। এটাই ওর ইউএসপি।

    এসব আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বড়রা আমাদের গুরুজন। কেউ বন্ধুর বাবা, কেউ মেয়েবন্ধুর বাবা হওয়ার সুবাদে আমাদের মেসোমশায়। আর আছেন মাস্টারমশাইয়েরা—যাঁদের কাছে কানমলা খেয়ে স্কুল পাশ করেছি।

    সজল উসখুস করছে।

    —সব বুঝলাম। কিন্তু পচা কোথায়? লজ্জা পেয়ে হাওয়া! সেরকম বান্দা তো পচা নয়। তাহলে ছ’প্লেট ঘুগনি আর চা আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন?

    বিজন বলে—সত্যিই তো! এত দেরি? অধীর ফের ধারে দিতে চাইছে না? ব্যাটা দোকান খুলে একেবারে ওয়ান-পাইস ফাদার-মাদার কেস হয়ে গেছে। ছোটবেলার ডাংগুলি, ক্রিকেট খেলা বন্ধুদের চিনতে চায় না। আমি গিয়ে একবার দেখে আসব?

    —যা যা। ফেরার সময় ছ’টা পানামা সিগ্রেট নিয়ে আসিস। আমার কাছে দেশলাই আছে।

    বিজনও যে গেল, আর ফেরে না। কিছু একটা হয়েছে ভেবে আমি আর সজল উঠি উঠব করছি—এমন সময় দুজনেই ফিরে এল। পেছন পেছন অধীরের দোকানের ছেলেটি। ও একটা মুখ ঢাকা সসপ্যান নিয়ে এসেছে, আর সেটাকে একটা মোটা কাপড় দিয়ে ধরে রেখেছে—বোধহয় পাত্রটা গরম তাই। পচার হাতে ছ’টা কোয়ার্টার প্লেট আর ছ’টা চামচ।

    সবার চেহারায় একদম দিলখুশ ভাব। পচা সবার হাতে প্লেট আর চামচ ধরিয়ে দিল। আর দোকানের ছেলেটা সসপ্যান থেকে একটা হাতা দিয়ে সবার প্লেটে ঘুগনি ঢেলে দিল। ধোঁয়া উঠছে।

    সজল নরম গলায় বলে-–হ্যাঁরে, অধীর কাঁচালংকা দেয়নি? নাকি লংকার দাম বেড়েছে বলে দুটো ফান্ডা ঝেড়েছে?

    পচা বিনা বাক্যব্যয়ে ওর হাফ প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে গোটা কয়েক কাঁচালংকা বের করে দেয়।

    শুধু তাই নয়, অন্য পকেট থেকে একটা ক্যাপস্টানের খালি প্যাকেটে ছ’টা পানামা বের করে বেঞ্চির উপর রাখে।

    —জানি, একটু পরে ফের আমাকে পাঠাবেন। তাই কাজটা আগাম সেরে রাখলাম। আধঘন্টা পরে চা আসবে।

    আমরা কোরাসে বলে উঠি—ল্লে পচা!

    তারপর আমি জিজ্ঞেস করি—হ্যাঁরে, ঘুগনি, চা, সিগ্রেট সব বাকিতে! কার নামে লিখিয়ে এলি?

    —কেন, নারাণদার। অধীরদা বলল শুধু ওনারই খাতা ক্লিয়ার আছে। বাকি সবার কিছু না কিছু বকায়া আছে। তাই শুধু ওনার নামেই দেয়া যাবে।

    নারাণের মুখ থেকে একটা আর্তনাদ বেরোনোর আগেই আমি হাত তুলে আশ্বস্ত করি। এটা সুবীরদাকে গ্রুপের থেকে খাওয়ানো। যার নামেই লেখানো হোক, আমরা সবাই মিলে শেয়ার করব।

    খানিকক্ষণ পরে সবার ঘুগনি সাঁটানো হয়ে গেলে সুবীরদা বলে—হ্যাঁরে, এত দেরি হোল কেন? সেটা বললি না তো! বিজন যাবার পরও এতক্ষণ?

    —আমি আগেই বলতাম। হেব্বি কেস। কিন্তু দোকানের ছেলেটার সামনে মুখ খুললে বিপদ ছিল। ও গিয়ে অধীরদার কাছে চুকলি খেলে—।

    —ইন্টারেস্টিং! কেসটা কী?

    —দাদা, একটা নয় দুটো কেস। একটা বাপের, আরেকটা ব্যাটার। প্রথমটা আমি বলব, পরেরটা বিজনদা। শুনে যদি হাসির চোটে পেটের ঘুগনি বেরিয়ে আসে তাহলে আমাকে দোষ দিও না।

    —উফ্‌ আজকাল বড্ড ভ্যান্তারা করিস। লাইনে আয়।

    পচা ফিচেল হাসিটা গিলে গম্ভীর মুখে শুরু করে। বিজন ফিক ফিক করে হাসছে।

    —এটা জান তো অধীরদা আজকাল দোকানের পেছনে মুরগি পালা শুরু করেছে। প্রথমে দেশি মুরগি, আজকাল গোটা তিরিশ লেগহর্ন। কিন্তু মোরগও রেখেছে দুটো। লোকে জেনে গেছে যে অধীরদার দোকানের ডিমে প্রাণ আছে, সরকারি পোলট্রির নিরিমিষ ‘বাওয়া’ ডিম নয়। মানে ওই ডিমে মোরগের কেরদানি আছে। তাই ওই ডিমে শক্তি বেশি।

    ইদানীং তাজা মুরগির ডিম খাবে বলে অনেকে এখান থেকে কেনা শুরু করেছে। ধান্ধা ভালই চলছিল। কিন্তু আজ হয়েছে হেব্বি কিচ্যেন।

    —কেন?

    —আরে ওকে বলতে দে। নইলে গল্পের রেলগাড়ি লাইন ছেড়ে মাঠে নামবে।

    —হয়েছে কি অধীরদা হোল —।

    —‘হারামির হাতবাক্স’। আমরা কোরাসে পাদপূরণ করি।

    —কেউ ডিম কিনতে এলে খদ্দেরকে জিজ্ঞেস করে—কেন চাই, খাবার জন্যে? নাকি বাচ্চা তোলার জন্যে? খাবার ডিম জোড়া দু’টাকা, বাচ্চা তোলার ডিম চার টাকা।

    —তাতে কী হয়েছে? দু’টাকা দিয়ে খাবার ডিম কিনে ঘরে এসে ডিম ফুটে বাচ্চা!

    —হুঁঃ অধীরদাকে খুব চিনেছেন? খাবার ডিম শুনলে অধীরদা দোকানে পেছনে মুরগির খাঁচায় গিয়ে ডিম বের করে আলপিন ফুটিয়ে দেয়, সুর্যের দিকে তুলে ধরে দেখে। তারপর কাউন্টারে এসে প্যাকেটে করে ডিম ধরিয়ে দেয়। ওই সূক্ষ্ম ফুটো খালি চোখে দেখা যায় না। কিন্তু ভেতরে রোদ্দুর ঢুকলে সেই ডিম থেকে আর বাচ্চা বের হয় না।

    আজকে ডিম কিনতে এসেছিল জোড়া বটতলার মাস্তান ছোটু আর ওর চ্যালা বীরু। ওরা বোধহয় ব্যাপারটা জেনে এসেছিল। অধীরদা ডিম নিয়ে এলে ছোটু মাস্তান একটা ডিম তুলে রোদের দিকে উঁচু করে ধরল আর বীরু পকেট থেকে একটা আতস কাঁচ বের করে ডিমের কাছে ঠেকাল।

    তারপর দু’জনে চেঁচাতে লাগল—এ ডিম খারাপ, ফুটোওলা ডিম নেব না। ভাল ডিম দাও, নইলে পয়সা ফেরত দাও।

    অধীরদা যত বলে—কোথায় খারাপ? কীসের খারাপ?

    ওরা বলে—ডিমে ফুটো কেন? তুমি করেছ? বেচার আগে তো বলনি –ফুটোওয়ালা খুঁতো ডিম দু’টাকা জোড়া! খদ্দের ঠকাচ্ছ? দোকান তুলে দেব।

    এতক্ষণ অধীরদা আর মেসোমশাই বাবা-বাছা করে কথা বলছিল, দোকান তুলে দেবার হুমকি শুনে ওদের বাঙাল রাগ জেগে উঠল।

    অধীরদার বাবা দোকানের এককোণে বসে দা দিয়ে চেঁছে বাটালি দিয়ে ঘষে ব্যাটের হ্যাণ্ডেল বানাতে থাকেন। সেগুলো শনিবারে গিয়ে রাসবিহারীর মোড়ের স্পোর্টস গুডসের দোকানে দিয়ে আসেন।

    এক মিনিটে হাওয়া বদলে গেল। মেসোমশাই বাগিয়ে ধরেছেন দা’ আর অধীরদা দোকানের পেছন থেকে নিয়ে এসেছে একটা তেলচুকচুকে বাঁশের লাঠি।

    —দোকান তুইল্যা দিব? কোন সুমুন্দির পোলার এত সাহস! আয় আগাইয়া আয়! ঘাড়ের থেইক্যা মাথাডা না নামাইছি ত আমিও কিশোরগঞ্জের কায়েতপাগলী গ্রামের সুধীর দাস নই!

    ছোটু এত কিছু ভাবেনি। আধবুড়ো মেসোমশাইকে হিসেবের মধ্যে ধরেনি।

    ওরা এক পা এক পা করে পেছোতে পেছোতে শেষে চোঁচা দৌড়। মাস্তানের প্রেস্টিজ পুরো পাংচার!

    —আহা হা! প্রাণ জুড়িয়ে গেল। এবার পরেরটা ছাড়।

    বিজন একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলতে শুরু করে।

    —বলছি। অধীর ও মেসোমশাই শান্ত হলেন। অধীর পেট্রোম্যাক্সে হাওয়া ভরে যত্ন করে জ্বালিয়ে সামনের কোনার দিকে বাবার সামনে রাখল। মেসোমশাই ফের আলোর সামনে চট বিছিয়ে বসে করাত, বাটালি, র‍্যাঁদা, শিরিষ কাগজ সাজিয়ে ব্যাটের হ্যাণ্ডল বানাতে লেগে গেলেন। ঘুগনি প্রায় হয়ে এসেছে। ছোকরাটা প্লেট ধুয়ে তৈরি হচ্ছে।

    এমন সময় দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটল।

    বেঞ্চের অন্য কোনায় বসে অনিমেষদা আর ওর চামচা বাঁকা পাউঁরুটি আলুর দম সাঁটাচ্ছিল। সেবার ভাসানের সময় আমাদের সঙ্গে মারামারি হয়েছিল। তখন থেকে কথা বন্ধ।

    তাছাড়া অনিমেষদা একটু ভাল রেজাল্ট করে মৌলানা আজাদ কলেজে ভর্তি হয়েছে। তখন থেকে আমাদের দেখলে একটু ঘ্যাম নেয়। আজ আমাকে দেখে শুনিয়ে শুনিয়ে বাঁকাকে বলছিল—বুঝলি বাঁকা। এই কলেজ ছিল নবাবের প্রাসাদ। ভেতরে একটা ছোট্ট মসজিদ আর বড়সড় অডিটোরিয়াম আছে। প্রত্যেক শুক্কুরবার মুশায়েরা হয়।

    —তাই নাকি গুরু! তুমি গেছ? একটা ভাল শের শোনাও না! লাস্ট যেটা মনে আছে!

    “নীদ আয়ে তো খোয়াব আয়ে,

    খোয়াব আয়ে তো তুম আও।

    পর তুমহারী ইয়াদ মেঁ

    ন নীদ আয়ে, ন খোয়াব আয়ে”।

    —এ তো খালিশ উর্দু! মানেটা বলে দাও গুরু।

    “ঘুম এলেই স্বপ্ন আসে,

    স্বপ্ন এলেই তুমি।

    কিন্তু তোমার কথা ভেবে ভেবে

    ঘুম আসে না, স্বপ্নও নয়।”

    —বাহ্‌ গুরু! ইরশাদ! ইরশাদ! বলে চামচাটা আমার দিকে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখে। ভাবলাম, চলে যাবার আগে শুনিয়ে দি’ ওই শের এক দশক আগে দেশ পত্রিকায় তরুণ কুমার ভাদুড়ীর ‘সন্ধ্যাদীপের শিখা” উপন্যাসে বেরিয়ে গেছে।

    কিন্তু আমি মুখ খোলার আগে ঘরের কোনা থেকে মেসোমশায়ের গলা—“তা হইলে কী খাড়াইল? ঘুমাইলেও তোমার জ্বালা, না ঘুমাইলেও তোমার জ্বালা?”

    আমি পচার হাতে এক হ্যাঁচকা দিয়ে বাইরে এসে জমে থাকা হাসি হালকা করি।

    হাজার হোক বন্ধুর বাবা!

    (চলবে)

  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments