স্টকহোম সিন্ড্রোম
চণ্ডীমণ্ডপের বদলে সেই রকে বসেই মাদুর বা শতরঞ্চি পেতে তাস, দাবা, পাশা এবং হুঁকো চলত। তার সঙ্গে পাড়ার যত কেচ্ছা এবং খবরের আদানপ্রদান। তার সঙ্গে আড় চোখে পথ চলতি মেয়েদের দেখে রসালো মন্তব্য। এঁড়েদ’ বা আড়িয়াদহের পণ্ডিত পরিবারের ছেলেদের মুখে শুনেছি ভট্টপল্লী বা ভাটপাড়ার গঙ্গার ধারের চণ্ডীমণ্ডপেও সেই একই বেত্তান্ত। যদিবা একটু সন্দেহ ছিল সেটা দূর হল বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস- ইংরেজিতে লেখা ‘রাজমোহন’স ওয়াইফ’ পড়ে।
নদীর ঘাটে জল আনতে যাওয়া মেয়েদের লক্ষ্য করে উড়ো মন্তব্য করার গ্রাফিক বর্ণনা রয়েছে। পেত্যয় না হয়, নিজেরাই বইটা পড়ে নিন। হাতে পাঁজি মঙ্গলবার। আর পড়ার সময় মনে রাখবেন বঙ্কিমের জন্মস্থান কাঁটালপাড়া আর ভাটপাড়ার দূরত্ব কতটুকু। তাতেও সন্দেহ না গেলে বঙ্কিম সখা দীনবন্ধু মিত্তিরের লীলাবতী নাটকে হেমচাঁদ-নদেরচাঁদের ডায়লগবাজি দেখুন। আজকালকার ছেলেছোকরারাও লজ্জা পাবে।
আর একটু মনে ধরিয়ে দিই। রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গলায় ‘কাদের কুলের বউ গো তুমি’ গানটি সবাই শুনেছেন। এবার গানের সুরে ভেসে না গিয়ে কথাগুলো খেয়াল করুন। জল আনতে একলা যাওয়া ভদ্রঘরের বৌদের নিয়ে ‘ছেড়খানি’!
যাক, ভাটপাড়ার নিয়ে ভাট বকা ছেড়ে ফিরে আসি রকের আড্ডায়।
উত্তর কোলকাতার বিডন স্ট্রিট পাড়ায় এলোমেলো এ’গলি সে’গলি টোটো করে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে চোখে পড়েছিল কোন বাড়ির দরজায় একটা পাতলা টিনের টুকরো সাঁটা; তাতে লেখা- ‘গেরস্ত বাড়ি, ঢুকিবেন না’।
গেরস্ত এবং হাফ-গেরস্ত শব্দগুলো তখনই প্রথম শুনি।
আমার এই ভাট বকার কোলাজে ঘোরাফেরা করব কখনও কোলকাতায়, কখনও ছত্তিশগড়ে। আজ কোলকাতার পালা।
সময়ের সঙ্গে জমির দাম বাড়ল, স্থান অপ্রতুল। ফলে বাড়ির ডিজাইন থেকে বাহুল্য বোধে রোয়াক বাদ গেল। ফলে ষাটের দশকের শেষে আমাদের প্রজন্ম আড্ডা জমাতো বন্ধ প্রাইমারি স্কুলের বারান্দায়, সন্ধ্যেয় গোলপোস্টের ধারে অথবা পাড়ার মিষ্টির দোকানের সিঁড়িতে। টপিকের মধ্যে ইস্টবেংগল মোহনবাগান, নতুন সিনেমার গান ছাড়াও ঢুকে পড়ল রাজনীতির চর্চা এবং বিতর্ক।
নাকতলার বাসরাস্তার মোড়ে আমার বন্ধুর পিতৃদেবের চায়ের দোকান। সেখানে সারাদিন আসর জমিয়ে তর্কবিতর্ক চালান সিনিয়রেরা। তখন বাম রাজনীতিতে জোয়ারের ঢল, কংগ্রেসের ভাটার টান। তাই প্রৌঢ় এবং মাঝবয়েসিরাও অনেকেই বামপন্থার সমর্থক। আমরা বুড়োদের আড্ডাটার নাম দিয়েছিলাম পলিট ব্যুরো।
ওঁয়ারা শুধু কড়া চা এবং সিগ্রেট খান, বিস্কুট কদাচিৎ। ফলে টোস্ট, ওমলেট ঘুগনি বিক্রি বন্ধ। আর আমাদের ওই দোকানে প্রবেশ নিষেধ। তাই দোকান চলে টিমটিম করে।
মেসোমশাই সারাজীবন শুধু লুঙি আর গেঞ্জি পরে সসপ্যানে চা বানিয়ে বা গরম করে ওঁদের কাঁচের গেলাসে পরিবেশন করেই কাটিয়ে গেলেন। শুনেছি ওঁর হাতের চায়ে আলাদা স্বাদ ছিল। বিখ্যাত সরোদিয়া তিমিরবরণকে দেখেছি রোজ দু’বার রাস্তার ওপার থেকে চুপচাপ পায়ে হেঁটে এখানে এসে গম্ভীর মুখে ওই ল্যাঙট-চা সোনামুখ করে খেয়ে যেতে।
ল্যাঙট-চা শব্দটার সৃষ্টি কালচে-হয়ে-যাওয়া ন্যাকড়ায় চা পাতার পুঁটলি বেঁধে গরম জলে চুবিয়ে চা বানানো দেখে।
ফলে আমাদের মত ছেলেছোকরার দলের রকবাজি হত পাড়ার বেশ খানিকটা ভেতরে এমন একটা চায়ের বা মিষ্টির দোকানের সিঁড়ি বা রকে, অথবা কাঠের বেঞ্চিতে। আমরা তখন রক না বলে বলতাম ঠেক।
গড়িয়ার দীনবন্ধু এন্ড্রুজ কলেজের তখন দক্ষিণ কোলকাতার শহরতলির দিকে নতুন নাম হয়েছে। তার দুটো কারণ। একটা হল ম্যাথসের প্রফেসর মহেশ ঘোষ বা এমজি। তখন, মানে ষাটের দশকের শেষে, বলা হত কল্লোলিনী কোলকাতায় তিনজন আছেন যাঁদের অংকে সেরা বলা যায়।
তাঁরা হলেনঃ সেন্ট জেভিয়ার্সের ফাদার গোরে; গড়িয়া দীনবন্ধু এন্ড্রুজ কলেজের মহেশ ঘোষ আর বরানগর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলের সুব্রত ঘোষ স্যার।
গড়িয়া কলেজের নামডাকের দ্বিতীয় কারণ এক ছাত্র আন্দোলনের সময় ওখানকার ছাত্র ভূদেবের পুলিশের গুলিতে মৃত্যু। কলেজের সামনে তাঁর শহীদ বেদী তৈরি হয়েছিল। সেটা ষাট বছর পরে কি এখনও দেখা যায়? জানি না। ভবিষ্যতে ওদিকে গেলে খোঁজ নেব।
তার কাছে ছিল দুটো ঠেক। কলেজের ঠিক উল্টোদিকে একটি অল্পবয়েসি ছেলের চায়ের দোকান। দুটো চাটাই দিয়ে ঘেরা কুঁড়ে ঘরের মতন, তাতে একটা বেঞ্চিপাতা। পাওয়া যায় চারমিনার এবং পানামা সিগ্রেট, লেড়ো বিস্কুট এবং সেই ফুটিয়ে ফুটিয়ে কালো করা ল্যাঙট চা। ওখানে খালি আমরাই বসি। কলেজে ক্যান্টিন থাকলেও অধিকাংশ দিন পকেটে পয়সা থাকে না। একটা সিগ্রেট তিনজনে মিলে ফুঁকি। হাতে নিয়ে ধরে থাকা চলে না। চটপট অন্য জনকে দিতে হবে। জিভের ছোঁয়ায় ভিজিয়ে ফেললে খিস্তি শুনতে হবে।
তখন চারমিনার পাঁচ পয়সায় দুটো, পানামা পাঁচ পয়সায় একটা। কিন্তু ভেতরে ভীষণ গরম। রোদ্দূরে কাঠের বেঞ্চি তেতে থাকে। তাই ওর নাম ‘পোঁদে -গরম -ঠেক’। আর বাসস্ট্যান্ডের কাছে নতুন খোলা কাঁচের দরজা লাগানো গদি আঁটা বেঞ্চ পাতা ঠেকের নাম ‘পোঁদে -আরাম- ঠেক’।
নাকতলায় আমার আড্ডা ছিল তিনটে ঠেকে—জোড়াবাগান, সেকন্ড স্কীম, অষ্ট’র দোকানের সিঁড়ি এবং নাকতলা স্কুলের পেছনদিকের চাতাল।
নাকতলার ভেতর দিকে আমাদের আড্ডায় সন্ধ্যের মুখে প্রায়শই এসে দাঁড়াতেন ঘ্যান্টার বাবা। মাথায় একটা নীলচে টুপি এবং বগলে রুল। মেসোমশায় পুলিশে কনস্টেবল হয়ে ঢুকেছিলেন এখন প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় এসে দারোগা হয়েছেন।
ওনার ইংরেজি শেখার ঘাটতি নিয়ে একটু কমপ্লেক্স ছিল। এসেই আমাদের নতুন নতুন ট্রান্সলেশন ধরতেন। সুবীরদা আমাদের পাড়ার ভাল ছেলে। লেখাপড়ায় বেশ নাম। তাকেই বেশি করে ধরতেন।
—আচ্ছা সুবীর, তুমি তো ভাল ছেলে। বলত— ঝিরঝির করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে, ইংরেজিতে কী হবে?
সুবীরদা বিরক্ত মুখে বলল—ইট ইজ ড্রিজলিং।
—তাহলে টিপ টিপ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে কী হবে?
(বিরস বদনে)—ওই ড্রিজলিংই হবে।
তা কী করে হবে? টিপটিপ আর ঝিরঝির কি এক?
—মেসোমশাই, আমি অত জানি না।
সে কী! তুমি এত ভাল ছেলে, এত নামডাক। এই সামান্য ট্রান্সলেশনে আটকে গেলে! না, দোষ তোমার নয়। আজকালকার স্কুলে কিছুই শেখায় না। টিচাররা খালি পলিটিক্স করে। মজদুরদের মত লালঝাণ্ডা রাজনীতি করে। এতেই দেশটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে।
মেশোমশায়ের উৎপাত বেড়েই চলল। এনাকে কী করে ঠেকাই? রোজ রোজ অফিস থেকে কিছু কিছু অমূল্য জ্ঞান সঞ্চয় করে এনে আমাদের উপরে বমি করে দিতেন।
কখনও উৎকট সব গ্রামারের প্রশ্ন।
—কগনেট অবজেক্ট কাকে বলে? কজিটিভ ভার্ব কী? কোয়াসি প্যাসিভ ভার্ব কী? উদাহরণ দাও। কখন ‘আই’ পর ‘অ্যাম’ না হয়ে ‘আর’ বসবে?
এক যে ছিল পাগলা ছাগল এমনি সেটা ওস্তাদ,
গানের তালে শিং বাগিয়ে মারল গুঁতো পশ্চাত।’
সমস্যার সমাধান হল এক পাগলার হাতে। ছেলেটা বেলেঘাটার জিনিস, এ’পাড়ায় নতুন ভাড়াটে। ওর বাবা কোন আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। ইদানীং টালিগঞ্জ পাড়ায় কোন ব্র্যাঞ্চে বদলি হয়েছেন, অগত্যা!
একদিন আমাদের আড্ডায় ভালমানুষের মত গোবেচারা মুখ করে এল। দেখলে মনে হয় সদ্য হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট ধরেছে।
জিজ্ঞেস করলাম, কাদের বাড়ির ভাড়াটে? শীতল দত্তদের।
—ওহ্ ঠান্ডা দত্ত? হলদেটে দোতলা বাড়ি! তা’ কোন তলায় উঠেছ?
ছেলেটা ফিচেল হেসে বলল –নীচের তলায় না, ওপরের তলায়।
—এতে হাসির কী হল?
ছেলেটা থতমত খেল, যেন না জেনে কোন অপরাধ করেছে।
তারপর কিন্তু কিন্তু করে বলল—না মানে, আমাদের বেলেঘাটার ফুলবাগানের ঠেকে কোন প্রেগনান্ট মেয়েকে দেখলে বলা হত ‘ওর নিচের তলায় ভাড়াটে এসেছে’। তাই বলছিলাম, ভুল বুঝবেন না।
বিজন – এত মহা পোঁয়াপাকা ছেলে!
সজল—পেকে হলুদ হয়ে গেছে, এবার পচে যাবে।
তৎক্ষণাৎ ঠেকে ওর নামকরণ হল ‘পচা’। ও সেটা হাসিমুখে মেনে নিল এবং আড্ডার সিনিয়রদের ফুট ফরমাশ খাটতে শুরু করল।
পচা, যা তো নড়ার দোকান থেকে দুটো পানামা নিয়ে আয়। পচা, আমার জন্যে চারমিনার।
এবার অধীরের দোকানে বল চার প্লেট ঘুগনি দিতে, লেবু আর কাঁচালংকা আলাদা।
পচা মাথা চুলকে বলল—পহা দিন।
—থাপ্পড় খাবি, আমার নামে ওর খাতায় লিখিয়ে আয়।
—নারাণদা, গত সপ্তাহেই অধীরদা বলেছিল দুমাসের হিসেব বাকি পড়েছে। সেটা ক্লিয়ার না করলে আর নগদ ছাড়া দেবে না।
নারাণ মুখ বিকৃত করে বলে—এই অধীরটা না! একেবারে নির্লজ্জ। আমি কি মরে যাচ্ছি না পাড়া ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছি?
তারপর একটা দশটাকার নোট ছুঁড়ে দেয়—যা পালা!
পচা নোটটা কুড়িয়ে একটা মক স্যালুট মারে।
আমরা হৈহৈ করে উঠি। পেয়েছে, নারাণ নিঘঘাৎ শিকদার বাড়ি থেকে টিউশনির দু’মাসের বকেয়া মাইনে পেয়েছে। ওর টিউশনির বাজার গরম, পড়ায় ভাল। কিন্তু এই একটা বাড়ি ঠিকমত মাইনে দেয় না। মাসের গোড়ায় নাকি ভুলে যায়।
আমরা বলি—লাভস্ লেবার লস্ট! ওই বাড়িটা ছেড়ে দে। নারাণ বন্ধুদের কথা কানে তোলে না। কারণ, ওই বাড়িতে একটি ছাত্রী পড়ানোর কড়ারে গেছল। ছাত্রীর পড়ায় মন নেই। ওরা ধীরে ধীরে তার ছোট বোন ও ভাইকেও হোমটাস্কের খাতাবই শুদ্ধ বসিয়ে দেয়, একই মাইনেতেই। তবে রোজ চা এবং চিনি রুটি দেয়।
আর ও আধ ঘন্টা পড়াতেই ছেলেমেয়ের মা এসে মাস্টারমশাইয়ের পাশে বসে গল্প করতে থাকেন, যত রাজ্যের গসিপ এবং পদ্মশ্রী হলে আসা নতুন সিনেমা।
নারাণের মাথা ধরে যায়, তবু টিউশনিটা ছাড়ে না। বললে বলে—যাকগে, বাচ্চাগুলো আমার জন্যে পাশ তো করে যাচ্ছে, কোন রাজাগজা রেজাল্ট নাই হোক। এত কম টাকায় আর কোন টিউটর পায় না।
সবাই কোরাস গায়—তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার, ওরে ভীরু!
কিন্তু আসল কথাটা আমি জানি। একদিন আলাদা করে চেপে ধরায় নারাণ স্বীকার করেছিল যে ছাত্রছাত্রী-উদ্ধার-ব্রত নয়, আসল কারণ হল ওদের মা।
—তোর কি মাথা খারাপ? কালকেই ছেড়ে দে ওই বাড়ি। তোর ভদ্রতায় আটকালে আমি গিয়ে শিকদারবাবুকে বলে দিচ্ছি।
নারাণ চুপ করে থাকে, মাথা নিচু করে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে ধুলোয় আঁকিবুকি কাটে।
তারপর সোজা হয়ে বলে—ছাড়তে পারবো না রে। আমায় মাপ করে দে। আসলে বিনীতা বউদির গায়ে একটা বুনো গন্ধ আছে, পাগল করে দেয়।
আমি টের পাই, ভাল ছেলে এবং আদর্শ মাস্টারমশাই নারাণ ভেতরে ভেতরে পচে গেছে, ওই হল আসলি পচা!
সে যাকগে, আমাদের রেজিস্টার্ড ফচকে পচা ওই দারোগা মেসোমশাইয়ের ইংরেজির ভূত ছাড়িয়ে দিল, একদিনে।
সেদিন মাসপয়লা। দারোগাবাবু মাইনে পেয়ে খোস মেজাজে পাড়ায় ঢুকেছেন। জমজমাট আড্ডা দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মুচকি মুচকি হাসছেন; নির্ঘাৎ আজ অফিস থেকে কিছু প্যাঁচালো প্রশ্ন মুখস্থ করে এসেছেন। আমরা প্রমাদ গুনলাম।
কথা ঘোরাতে জিগ্যেস করি—মেসোমশায়, মাইনে পেয়েছেন?
উনি আমাকে পাত্তা না দিয়ে শুরু করলেন—বলত, ‘মস্মস্ করা নতুন জুতা’ এটার ইংরেজি কী হবে?
আমরা মুখ লুকোচ্ছি, সুবীরদার ফর্সা মুখ ক্রমশ লাল হচ্ছে।
হঠাত ওই রেক্টাম-রাইপ ছেলেটার পাতলা আওয়াজ শোনা গেল—আপনে কন তো, “কচকচ করা নতুন বাল”, এর ইংরেজি কী অইব?
শ্মশানের নিস্তব্ধতা!
দারোগার কালো মুখ বেগুনপোড়ার রঙ ধরল। হাতের রুল বাগিয়ে উনি পচার দিকে তেড়ে গেলেন, ‘হারামজাদা! আমি তর বাপের বয়েসি, আমার লগে ফাইজলামি করস্?’
ছেলেটা এক পা এক পা করে পেছোয়।
—বা রে। আপনে রাইগ্যা যান ক্যান? আমিও তো ইংরেজি জিগাইলাম। আপনে কইলেন -মসমস করা নতুন জুতা! আমি কইলাম কচকচ করা নতুন বাল!
আমরা সবাই মিলে পচাকে ডবল ডিমের ওমলেট খাওয়ালাম।
কিন্তু দারোগা মেসোর হাত থেকে ছাড়া পেলেও ওঁর ইঞ্জিরির ভূত আমাদের সুবীরদার ঘাড়ে সওয়ার হল।
সুবীরদা তখন চারুচন্দ্র ওরফে চেরো কলেজে পড়ে। সেখানের ইউনিয়নের নাম “ডায়না”। ইহা আদি এবং অকৃত্রিম। কলিকাতার অন্য কোন কলেজে ইহার শাখা নাই। এই নাম কী করে হল জানি না। অরণ্যদেবের প্রেমিকা সাঁতারে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন ডায়না পামার কি এই নামের উৎস? জানি না, আর বোধহয় জানা যাবেও না। শুনছিলাম, এখন কোলকাতায় ডায়না নামের কোন স্টুডেন্ট ইউনিয়ন নেই।
সুবীরদা ওদের কালচারাল সেক্রেটারি হয়ে আড্ডায় হেবি ঘ্যাম নিল। লাইব্রেরিতে বসে অনেক কিছু ইঞ্জিরিতে পড়ে আমাদের আড্ডায় ফাণ্ডা ঝাড়তে লাগল। ভাগ্যি ভাল, দারোগা মেসোর মত পড়া ধরত না।
একদিন শিখে এল “স্টকহোম সিন্ড্রোম”। সে কী কাণ্ড! আমাদের আড্ডায় আদ্দেক মেম্বার জানেই না স্টকহোম জায়গাটা কোথায়। ওদের ধারণা আমেরিকায়।
শেষে সুবীরদা খুব প্যাট্রিসিয়া হার্স্ট, কিডন্যাপিং, রেড আর্মি—এইসব ফান্ডা দিল। আমাদের মাথা ধরে গেল। পচাকে বললাম সবার জন্যে হাফ চা আর একটা করে লেড়ো বিস্কুট নিয়ে আয়। আর হ্যাঁ, সুবীরদার নামে লিখতে বলিস, ও মানা করবে না।
খালি পেটে এত জ্ঞান সইবে না।
চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম –একটু সহজ বাংলায় বুঝিয়ে বল না, ওই স্টকহোম না কোপেনহাগেন ব্যাপারটা কী? খায় না মাথায় দেয়?
সুদীপ খানিক পরে বলল, বুঝেছি—শোষিত অত্যাচারিত যখন প্রতিবাদ করার বদলে শোষকের পক্ষ নেয়, তার গুণগান করে—এই তো?
হতাশ সুবীরদা বলল—খানিকটা তাই বটে।
তখন আমাদের সভাগায়ক বিপুল বলল –আরে রবীন্দ্রনাথও এই নিয়ে গান লিখে গেছেন।
আমাদের তোল্লাই খেয়ে ব্যাটা দু’কলি গেয়ে দিলঃ
“আরও আরও প্রভু, আরও আরও;
এমনি করে, এমনি করে আমায় মারো”।
—অ্যাই, এটা কী করে স্টকহোম সিন্ড্রোমের উদাহরণ হল? তোরা কিস্যু বুঝিসনি।
—বুঝিনি বলছ? এটা তো মাত্র মুখড়া। আগে প্রথম অন্তরাটা শুনে নাও, তারপর কমেন্ট কর।
“লুকিয়ে থাকি আমি পালিয়ে বেড়াই,
ধরা পড়ে গেছি আর কি এড়াই!
আমার যা কিছু আছে সব কাড়ো কাড়ো”।
সুদীপ খেঁকিয়ে উঠল—এটা তোমার বালের সিন্ড্রোম? না ইয়ের মাথা? বড়জোর ম্যাসোকিজম্ ধরা যেতে পারে।
—আহাহা, রেগে যাচ্ছিস কেন? কোন নারী যদি বলে—ধরা পড়ে গেছি, এবার সব কেড়ে নাও! তার থেকে কী বুঝলি? এটা প্রকারান্তরে রেপকে মেনে নেয়া নয়? তাহলে স্টকহোম সিন্ড্রোমের আর বাকি কী রইল?
রবীন্দ্রভক্ত বিজন আরও এককাঠি।
—অ্যাই কবিগুরুকে নিয়ে ফালতু কথা না। তোদের আঁতলেমি থেকে ওনাকে ছাড়ান দে।
হাওয়া গরম দেখে আমি সন্ধির চেষ্টা করি। কিন্ত ভবি ভোলে না।
আবার সেই পচা এসে মাঝখানে দাঁড়ায়। সবার সামনে চায়ের গেলাস ধরিয়ে নিচু গলায় বলে –আমি নাদান; মাঝখানে কতা বললে মাফ করে দেবেন। যা বুঝছি ওই স্টকহোম নিয়ে এত টেম্পারের দরকার নেই। বেলেঘাটার ফুলবাগানের বুলটি ভাল পদ্য লিখত। আমাদের ক্লাবের দেয়াল বুলেটিনে ওর একটা পদ্য হেব্বি হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে ওই স্টকহোমের কথাই ভেবে লিখেছিল। শোনাই?
আমরা সোল্লাসে বলি—হয়ে যাক, চালাও পানসি বেলেঘাটা! ল্লে পচা!
ও একটু থেমে শুরু করেঃ
“ওরে বাছা, কাঁদিস কেন? তোর কী হয়েছে?
—বলব কী আর, ব্যাটা আমার পেছন মেরেছে।
কে দেখেছে, কে দেখেছে?- সবাই দেখেছে।
মুখটি বুঁজে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
চল্লি কোথায়? আগে ব্যাটার নামটা বলে দে?
—যাচ্ছি এখন ওরই কাছে, আবার ডেকেছে”!