• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৯ | জুলাই ২০২৫ | রম্যরচনা
    Share
  • রকবাজির কোলাজ: কোলকাতা ও ছত্তিশগড় (২) : রঞ্জন রায়
    পর্ব ১ | পর্ব ২

    ছত্তিশগড় পর্ব

    রায়পুর শহরের সন্ধ্যে। বাজে আটটা। কিন্তু এখানকার বোলচালের ভাষায়--সবে কলির সন্ধ্যে, রাত মাত্র যৌবনে পা দিয়েছে। আসলে এখানে সূর্য ডোবে কোলকাতার চেয়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে। আজ হয়েছে মুশকিল। একটা জিনের বোতল এবং বাদামভাজার প্যাকেট এসেছে বটে, কিন্তু বসব কোথায়? দলের আদ্দেক ব্যাচেলর, তো বাকিরা বাপমায়ের সঙ্গে সংযুক্ত পরিবারে। কারও বাড়িতে বোতল খুলে আড্ডা মারার জায়গা নেই।

    হয়ত শালিমার নামের শস্তা বারে বসা যায়। তবে গত সপ্তাহে ওখানকার মালিকের ছেলের সঙ্গে পঙ্গা হয়ে গেছে।

    সেদিন ছিল শনিবার। আমরা চার ইয়ার গেছি শালিমার বারে। মে মাসের আগুনঝরা গরম। সন্ধ্যেবেলা স্নান করে বেরলে ভাল হত। সেটা না করায় ফল হল যা তা! দু’পেগ হুইস্কি পেটে পড়তে না পড়তেই সবার তৃতীয় নয়ন খুলে গেল।

    তারপর একজন শুরু করল শের-শায়েরি। খানিকক্ষণ গালিব, হাফিজ, মীর তকী মীর হয়ে আমরা চলে এলাম ইকবাল এবং ফৈজ আহমেদের নগমায়।

    একজন হিন্দুত্ববাদী বন্ধু বলল—না, না; ওই দুই পাকিস্তানি শায়র চলবে না। গোড়াতে আল্লাহের কাছে নালিশ করে লিখেছিলেন “ফরিয়াদ”, নাকি “শিকওয়া”? কিন্তু গেলেন তো সেই পাকিস্তানের লাহোরে!

    আমরা যতই বলি--ওরে, কবিতায় অত খোঁচাখুঁচি করলে রসভঙ্গ হয়। আর ওঁর “সারে জহাঁ সে আচ্ছা, হিন্দোস্তাঁ হমারা” তো আজও সারা ভারতে গাওয়া হয়। সে কিছুতেই শুনবে না। সে বলে আমরা ওটা শুধরে নিয়েছি—হিন্দোস্তাঁ নয়, হিন্দুস্তাঁ। এখন আর “হিন্দি হ্যায় হম, বতন হ্যায় হিন্দোস্তাঁ হমারা” নয়, গাওয়া হয় “হিন্দু হ্যায় হম, বতন হ্যায়—হিন্দুস্তাঁ হমারা”।

    হার মেনে বলি—ফৈজ তো ১৪ই অগাস্ট ১৯৪৭ সালে, মানে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে, লাহোরের জেলে বন্দী ছিলেন। সেখানে বসে কবিতা লিখছিলেন। ও প্রবলবেগে মাথা নাড়ে।

    এবং আমরা চটপট চলে আসি ভারতের সব নামজাদা শায়েরদের শের বা কবিতার দুনিয়ায়। যত লুধিয়ানভী, মোরাদাবাদী, আজমী, সুলতানপুরী, ফিরাক গোরখপুরী-- কেউ বাদ যান না। বন্ধুটি খুশি। ওরা যে হিন্দি ফিল্মের জন্যে এন্তার লিরিক লিখেছেন। আর ফিরাক তো আসলে গোরখপুরের হিন্দু কায়স্থ—রঘুবীর সহায়।

    কিন্তু নেশা চড়তে থাকলে জিভ মোটা হয়, আলগা হয়। অপশব্দের বান ডাকে। সুধীর জিদ ধরে—আমিও আজকাল শের লিখছি, তোরা শোন।

    “কাশ তেরে চেহরে পে চেচক কী দাগ হোতে,
    চাঁদ তো তু হ্যায় হী, সিতারেঁ ভী সাথ হোতে।”

    “হায়, তোর গালে যদি গুটিবসন্তের দাগ হত,
    চাঁদপানা ওই মুখখানিতে তারার মেলা জমে উঠত।”

    সবাই আপত্তি জানায়—এটা চুরি করা শের! তায় আজকের নয়, দু’দশক আগের।

    ও রেগে যায়, কসম খায় তারপর কেঁদে ফেলে। ফোঁস ফোঁস করে নাক টানে আর বলে—কেমন দোস্ত তোরা! কবে থেকে স্বপ্ন দেখছি শায়র হব, দিলি তো জল ঢেলে!

    শওকত বলে—

    না তুম কোই শায়র হো, না শায়র কে ভাতিজে হো,
    তুম সির্ফ অপনী মা-বাপ কী মনোরঞ্জন কে নতীজে হো।

    ‘তুমি তো বন্ধু/ নও কোন কবি/ অথবা কবির/ ভাইপো।
    তুমি শুধু তব/ পিতা ও মাতার/ কিৎকিৎ খেলা/ মালপো।।’

    হো হো হাসি। প্রায় সবাই দাদ দেয়—ইরশাদ! ইরশাদ!

    কিন্তু সুমন হাসেনি। কেন রে?

    --এগুলো কোন কবিতা হল? এদের কি শের বলে? খালি তুকবন্দী (অন্ত্যমিল) করলেই কবিতা হয়? তায় অমন বাপ-মা তুলে ফুহড় বা নিম্নরুচির? আমি এতে নেই। আমার কাছে কবিতা বল, শের বল –বড় পবিত্র জিনিস, যা আমাদের দৈনন্দিন ধুলোমাটির দুনিয়া থেকে অন্যলোকে নিয়ে যায়।

    আমি আওড়াই—

    “বরং নিজেই তুমি লেখোনাকো একটি কবিতা,
    বলিলাম ছায়াপিণ্ড দিল না উত্তর।”

    --এর মানে? ফের কোন বাঙালিপনা?

    --ওসব ছাড়। বলছি তুই নিজেই একটা শোনা দিকি—কোনটা তোর শের মনে হয়।

    --না, আমি কোন কবি বা শায়র নই। খালি শের বলতে যা বুঝি তার একটা নমুনা পেশ করতে পারি।

    --তবে তাই কর বাপধন। কেন মিছে ল্যাজে খেলাচ্ছিস!

    সুমন কিছু ভাবে। গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ায়। ফের বলা নেই কওয়া নেই আমার হুইস্কির গেলাস তুলে নিয়ে দুই চুমুকে শেষ করে। পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে মুখ মোছে। তারপর ধীর লয়ে আবৃত্তি করেঃ

    ‘শের-শায়েরি করনা কোই আসান কাম নহী হ্যায়।
    এক শের জব নিকলতী হ্যায়, --- জব নিকলতী হ্যায়,
    তো শায়র কে গাঁড় ফট্‌ জাতী হ্যায়।।'

    ‘শের লেখা বড়/ সুকঠিন কাজ/ সবার কম্মো?/ তা তো নয়।
    একখানি শের/ যবে জন্মায়/ --শায়রের পোঁদ/ ফেটে যায়।'

    দশ সেকেন্ডের সন্নাটা। তারপর টেবিল চাপড়ানো, উচ্চগ্রামে হাসি। একজন সুধীরকে বলে—এখন বুঝলি তুই কেন শায়র হতে পারবি না। শের বেরয় শায়েরের পেছন ফাটিয়ে। যেদিন তোর পেছন দিয়ে শের বের হবে সেইদিন, ততদিন শায়র হওয়ার তপস্যা কর। অন্যের শস্তা বাজার-চালু ছড়াগুলো না আউড়ে নিজের কথা বল। তাহলে হয়ত কোনদিন--।

    সুধীর আগেই খার খেয়েছিল। ওর দোষ নেই, শুধু ওকে প্লেজিয়ারিস্ট বলা হয়েছে তাই নয়, ওর মা’বাপ তুলে সড়ক-ছাপ তুকবন্দী শোনানো হয়েছে। এবার পলিতায় অগ্নিসংযোগ হইল।

    ফলে ওর মুখ থেকে খিস্তির ফোয়ারা ছুটল—তোরা কেউ মাতৃজঠরে জন্মগ্রহণ করিস নাই। নিজ নিজ পিতৃদেবের গুহ্যদ্বার হইতে নির্গত হইয়াছিস!

    প্রায় হাতাহাতির উপক্রম। সবাই নিজেকে ইনসাল্টেড অ্যাণ্ড হিউমিলিয়েটেড ভাবছে। এমন সময় শালিমার বারের মালিকের পুত্রের প্রবেশ। একেবারে খেপচুরিয়াস্‌!

    --মশাইরা! এবার গা’ তুলুন। অনেক হয়েছে। অন্য কাস্টমারদের অসুবিধে হচ্ছে।

    --আমরা তোমার বাবার বন্ধু। উনি কখনও এভাবে কথা বলেন না। তুমি বোধহয় আজ নতুন।

    --সেইজন্যেই এতক্ষণ রেয়াৎ করেছি। কিন্তু আর নয়। এবার আপনারা লক্ষ্মণরেখা পার করেছেন। অন্য গ্রাহকদের অসুবিধে হচ্ছে। আপনাদের কথায় কিছু অপশব্দ বারবার শোনা যাচ্ছে। কাউন্টারে এসে বিল ক্লিয়ার করুন আর কেটে পড়ুন।

    অজয় এই পাড়ারই ছেলে। গলার আওয়াজ মোটা করে বলে—কালকেই তোমাদের শালিমার বার এপাড়া থেকে তুলে দেব। আমাদের পাড়ায় ধান্ধা করতে এসে আমাদেরই সঙ্গে----, হিক্‌!

    ছেলেটার ইশারায় দু’জন বাউন্সার এগিয়ে আসে। অজয়ের কাঁধে হাত রেখে গেটের দিকে ঠেলতে থাকে। আমরা সুড়সুড় করে লক্ষ্মীছেলের মত চলে আসি।


    এক সপ্তাহ পরের শনিবার। আমাদের দলে দু’জনের মাইনে হয়েছে। তা ভারি পকেট কিছু হালকা করতে হয়। কিন্তু দল থেকে চালিয়াৎ-চন্দর গজানন বাদ। ওর জন্যে আমাদের নাককাটা গেছে। সেবার ও একটা বাজি ধরে হেরে গেছল। ডিডি নিউজের একজন খবরপাঠিকা সলমা সুলতান কখনও হাসেন না। ও বলল-- উনি আগামী রোববার সন্ধ্যেয় নিউজ পড়ার পরে একটু মুচকি হাসবেন।

    ও জানল কী করে? সলমা সুলতানকে দিল্লি দূরদর্শনের ঠিকানায় চিঠি লিখেছিল। তারপর ফোন করেছিল। উনি অনুরোধটি শুনে খুশি হয়ে জানিয়েছেন।

    শওকত বলল—গজানন ব্যাটা কঞ্জুষ মক্ষিচুষ। ও চিঠি লিখবে? নিঘ্‌ঘাৎ পোস্টকার্ডে লিখেছে। আর ওকে সলমা রিপ্লাই দিয়েছে? ও কি রিপ্লাই-পোস্টকার্ড লাগিয়ে পাঠিয়েছিল? যত্তো গুলবাজি!

    গজানন কিছুতেই মানবে না যে ও গুল মেরেছে। আমি বলি--বেশ, তাহলে বাজি হয়ে যাক। সলমা যদি না হাসে ও আমাদের সবাইকে আনন্দ হোটেলের বারে এক এক পেগ হুইস্কি খাওয়াবে।

    রোববার এল এবং চলে গেল। না, সলমা হাসেননি। গজাননের মুখ শুকনো। আমরা ওকে বাইকে বসিয়ে একরকম কিডন্যাপ করে আনন্দ হোটেলের বারে নিয়ে গেলাম।

    গজানন অর্ডার করল। ওর কপাল ভাল, সেদিন আমরা মোট চারজনই ছিলাম, -- গজাননকে ধরে। বিল দেবার সময় ও কাউন্টারে গিয়ে সবচেয়ে গোবেচারা বাচ্চামত ছেলেটাকে বলল—ডায়েরি নিয়ে এস।

    --ডায়েরি? স্যার, বিল তো ৯১১ টাকা হয়েছে।

    গজানন ধমকে উঠল—আমি তোমাদের মালিকের বন্ধু, আমার পেমেন্ট ডায়েরিতে লেখা হয়। নিয়ে এস, নইলে বলজিৎ গ্রোভারকে ফোন করছি। সে এসে—

    ছেলেটি হয়ত অল্পদিন চাকরিতে ঢুকেছে, ভয়ের চোটে একটা নতুন খালি ডায়েরি নিয়ে এল। গজানন সেদিনের তারিখের পাতা খুলল, সাদা পাতা। তারপর বলল—কত হয়েছে?

    --নয়শ’ এগারো টাকা স্যার।

    গজানন গম্ভীর মুখে দুটো পাতা জুড়ে এই কোনা থেকে ওই কোনা অব্দি একটা বিশাল সই করল। তারপর ডায়েরি ফেরত দিয়ে আমাদের ইশারায় বলল—চল্‌।

    আমরা হতভম্ব। তাই নড়তে দেরি হল। ইতিমধ্যে সিনিয়র স্টাফ মালিককে ফোন করল। বলজিৎ বলল—আমার দোস্ত বলছে? তাহলে ওদের বসিয়ে রাখ, খবরদার বেরোতে দিবি না। আমি আসছি।

    আমরা পানমশলা চিবুতে চিবুতে গেট পেরিয়ে পার্কিং প্লেসে গিয়ে বাইক স্টার্ট করছি, এমন সময় দুই গার্ড দৌড়তে দৌড়তে এল।

    --স্যার, স্যার! আপনারা যাবেন না। ভেতরে চলুন। মালিকের হুকুম, উনি আসছেন।

    আমরা গিয়ে রিসেপশনের সোফায় বসলাম। বলজিৎ এসে স্টাফের কাছে জানতে চাইল --হয়েছেটা কী? আর সেই ভদ্রলোক কোথায়? আমার বিশেষ বন্ধু গজানন?

    সত্যিই তো, গজানন ব্যাটা কোথায়? কোন ফাঁকে সিগ্রেট টানতে টানতে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেছে।

    বিলাসপুর ছোট শহর। সবাই সবার মুখচেনা। বলজিৎও তাই, তবে কস্মিনকালেও আমাদের বন্ধু নয়। শুনেটুনে বলল- আপনারা ঘাবড়াবেন না। বন্ধুটি প্র্যাকটিক্যাল জোক্‌ করেছে। তা ওরকম একটু-আধটু হয়েই থাকে। এক কাজ করুন, এখন যা পারেন দিয়ে যান। বাকি টাকা ধীরেসুস্থে আগামী রবিবার নাগাদ দেবেন, কোন তাড়া নেই।

    তবে আপনাদের বন্ধুটি, ষড়ানন না কী যেন, সে আজ থেকে আমার রেস্তোরাঁয় পার্সোনা নন-গ্রেটা! ওকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন না।


    আজ আমরা পঞ্চপাণ্ডব—সুধীর, শওকত, সুমন, অজয় ও আমি। অজয় ও আমি মাইনে পেয়েছি, আমাদের মাসের শেষে মাইনে হয়। আর শওকত বড়ঘরের ছেলে। ওর নানাজি ছিলেন ভারি রঈস, খানদানি জমিদার। তাঁর ছিল শিকারের শখ। ওদের বাড়িতে নানারকমের বন্দুকের সংগ্রহ, এবং সবক'টার লাইসেন্স আছে।

    কিন্তু একজনের দুঃখের গেলাস বারবার উপচে পড়ছে--অজয়। সেই আজ খাচ্ছে এবং খাওয়াচ্ছে।

    সংক্ষেপে, যাকে ভালবাসে তাকে বিয়ে করতে পারবে না। ছেলেটা নামজাদা কায়স্থ পরিবারের বড়ছেলে। সংযুক্ত হিন্দু পরিবার। বোনেদের সময় হলে বিয়ে দিতে হবে। মেয়েটি ব্রাহ্মণকন্যা। স্কুল টিচার পিতার বড় মেয়ে। হিন্দিতে মাস্টার্স করছে, তবে পড়াশুনোয় মন নেই।

    সুন্দরী মেয়ে, কিন্তু চাঁদেও কলঙ্ক থাকে। ওর মাতা ঠাকুরাণী যৌবনের মধ্যযামে বাড়ির কায়স্থ ভাড়াটের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আগুন আর প্রেম চাপা থাকে না। একদিন অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি হতে হল। পাথরে পাথরে ঠোকাঠুকিতে আগুনের ফুলকি ছিটকে উঠল। অবশেষে মহিলা তিন মেয়ের হাত ধরে সেই যুবকের বাড়িতে উঠলেন।

    ভালই চলছিল।

    ইতিমধ্যে তার মা শেষ যৌবনে ফের গর্ভবতী হলেন। একটি প্রাইভেট নার্সিংহোমে ভর্তি। বড় মেয়েটি সারাক্ষণ দেখাশোনা করছে। ওদের সৎবাবা অফিস-ফেরত সন্ধ্যের সময় আসেন। নিচের তলায় গিয়ে নার্সদের সঙ্গে কথা বলা, ফার্মেসি থেকে ওষুধ আনা, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা সবই বড় মেয়ে সীমা সামলায়।

    একই সময়ে ওই নার্সিং হোমের একটি প্রাইভেট কেবিনে অজয়ের বাবা ভর্তি হয়েছেন—হার্ট অ্যাটাক। তবে সামলে উঠেছেন। অজয় ওখানে একটি চেয়ার নিয়ে কম্যান্ড পোস্ট বসিয়েছে। ও নড়বে না, ওর ভাইয়েরা এবং পাড়ার বন্ধুর দল ওর আদেশ মেনে দৌড়ে গিয়ে ডাক্তারকে আনা, কোন দুষ্প্রাপ্য ওষুধ কারও ব্যক্তিগত স্টক থেকে নিয়ে আসা –ইত্যাদিতে ব্যস্ত।

    এইসময় নার্সিংহোমের করিডোরে সীমা আর অজয়ের চারিচোখের মিলন হল। ব্যস্‌ সীমার মাথা গেল ঘুরে।

    একেবারে ‘প্রদীপ ধরিয়া দেখিল তাহার নবীন গৌরকান্তি’। হ্যাঁ, অজয়ের চুল এবং দাড়ি সবই সোনালী, আর গায়ের রঙ কাঁচা সোনার। আর সীমাও চোখে পড়ার মত সুন্দর। অজয় প্রথমে ব্যাপারটা হালকাভাবে নিয়েছিল। প্রথম দর্শনে প্রেম-ট্রেমে ওর বিশ্বাস ছিল না। ও প্রেমে পড়ত মেপেজুকে অংক কষে। আর শরীর এবং হৃদয়কে দুটো আলাদা কূঠুরিতে তালা লাগিয়ে রাখত। এবার সব গোলমাল হয়ে গেল। অংক হল ভুল।

    মেয়ের মা এবং ছেলের বাবা সবাই একদিন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল। কিন্তু অজয় যে সীমাকে রোজ একবার না দেখে থাকতে পারে না। আর সীমার অবস্থা?

    ‘কানু সে জীবন জাতি প্রাণধন ও দু’টি নয়নতারা’!

    ছোট শহর, দেখা করা যেমন সহজ, লোকের চোখে ধরা পড়াও তেমনই। কথা ছড়িয়ে পড়ল। মেয়েটি সৎ-বাবার হাতে উত্তম-মধ্যম পেল। ঘর থেকে একা বেরনো নিষেধ, সঙ্গে কোন না কোন ছোটবোন থাকবে। কিন্তু এম এ প্রথম বর্ষের ছাত্রীটির মধ্যে জেগে উঠল সেই চিরন্তন অমীমাংসিত প্রশ্নঃ

    “নারীকে আপনভাগ্য জয় করিবার, কেন নাহি দিবে অধিকার
    হে বিধাতা”!
    পরের দিন বাবা অফিসে গেলে মা ও বড়মেয়ের মধ্যে একচোট হল। প্রথমে কথাবার্তা, ফের ঝগড়া, কান্নাকাটি এবং তারপরে বৃষ্টিশেষের শান্তিবার্তা। শেষে মা বললেন—আমি কোলের ছেলে এবং ছোটমেয়েকে নিয়ে এই বাড়িতেই থাকব। তোরা দুইবোন ফিরে যা তোদের বাবার কাছে, জন্মদাতা বাপ। ফেলে দিতে পারবে না। আর হ্যাঁ, বাবাকে বলিস—সব দোষ তোদের মায়ের। আমার আর ফিরে যাবার মুখ নেই, তোরা চলে যা!

    ওরা ভয়ে ভয়ে গেল জন্মদাতা পিতার কাছে, প্রায় তেরো বছর পরে।

    কী আশ্চর্য, উনি বকাঝকা বা কোন নাটক করলেন না।

    "বেশ, থাক আমার সঙ্গে। আমি স্বপাকে খাই, হাত পুড়িয়ে। এখন তোমাদের দুই মেয়েকে ধরে আমার সংসারে তিনটে মুখ। একবেলা আমি রাঁধব, আর এক বেলা তোমরা দু’বোনে মিলে রাঁধবে। পড়াশুনো চালিয়ে যাও। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট হলে বিয়ে দিয়ে দেব। আর যদি বল পড়ায় মন নেই, বই নিয়ে বসতে ভাল্লাগে না—তাহলে অন্য কথা।

    শেষকথা, এ বাড়িতে তোমার মায়ের নাম নেয়া চলবে না। আমি ওকে ভুলে গেছি, তোমরাও ভুলে যাও।”

    অজয়ের বাড়িতে গোপন মিটিং বসল। না, সদ্য হাসপাতাল থেকে ফেরা বাবা এবং ছোট দুই বোন বাদ। তিন ভাইয়ের মিটিং, সব ভাইয়ের এক সুর—ভাইয়া, তুই সবচেয়ে বড়। ওই পরিবারের মেয়ে আমাদের ভাবী হবে না। ওদের মাকে নিয়ে শহরে রসালো গল্প চলে। শেষে ওকে নিয়েও শুরু হলে ‘হমলোগ মরনে মারনে উতারু হো জায়েঙ্গে।’

    একেবারে হয় মারব, নয় মরব! ফৌজদারী মামলা চলবে। আমাদের ছোট দুই বোনের বিয়ে দেয়া মুশকিল হবে। এবার তুই ভেবে দেখ।

    বর্ষা নেমেছে। ভ্যাপসা গরম। আমি আর অজয় একই ব্যাংকে কাজ করি। সেদিন শনিবার। ব্যাংক বন্ধ হয়েছে। শহর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরের ওর ব্যাংকের দোতলায় বসে আমি একটা ফিল্ড স্টাডি রিপোর্ট বানাচ্ছি। খালি গা, পরনে একটা বক্সার। পাশের টুলে একটা জিনের বোতল, আদ্দেক শেষ হয়ে এসেছে।

    এমন সময় ছন্দপতন।

    সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছে তিনজন। অজয়, ওর নায়িকা সীমা এবং তার কিশোরী বোন।

    অজয় গম্ভীর মুখে সীমাকে নিয়ে পাশের ঘরে গেল। উদ্ভিন্নযৌবনা পঞ্চদশী ছোটবোন হাসিমুখে আমার সামনে। আমি এমন হামলার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। প্যান্ট খুঁজে না পেয়ে হাতের কাছে একটা বাথ টাওয়েল টেনে নিই। আমার লজ্জা নিবারণের অসহায় প্রয়াস দেখে মেয়েটি হেসে ওঠে।

    --ঘাবড়াইয়ে মৎ বঙ্গালী দাদা! হম কোই শের ইয়া ভালু নহীঁ। আরাম সে!

    তারপর নীচু গলায় বলে দিদি এসেছে পাশের ঘরে অজয় ভাইয়ার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে। আমাকে বলল—তুই ততক্ষণ বঙ্গালী ভাইয়ার সঙ্গে বসে গল্প কর।

    --সে ঠিক আছে। কিন্তু কেসটা কী?

    --কালকে বাবা স্কুল থেকে এসে দিদিকে মেরেছে। স্কুলে কেউ বাবাকে জানিয়েছে যে অজয় নামের কোন ব্যাংকওলা কায়স্থ ছোকরার সঙ্গে দিদির লটঘট চলছে। বাবার কথা হল আমরা সম্মানিত ব্রাহ্মণ পরিবার। তোদের মা এক কায়স্থের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে আমাদের নাক কেটেছে। এবার তুইও আমার মুখে চুনকালি লেপে দিবি?

    দিদি খুব কাঁদছিল।

    আজ সকালে বাবা স্কুলে রওনা হতেই দিদিকে বললাম—চল অজয় ভাইয়ার কাছে, ও যদি বিয়ে করতে রাজি হয়, তাহলে সব দিক দিয়ে ভাল হয়। তোকে আর দুমুঠো ভাতের জন্যে মার খেতে হবে না। তাই জমানো পয়সা খরচ করে অটো বুক করে চলে এসেছি।

    --বাহ্‌ তোমার তো যেমন বুদ্ধি, তেমনই সাহস। ফিরে যেতে দেরি হলে?

    --আবার দু’বোনে ঠ্যাঙানি খাব। তবে ভাইয়া বিয়েতে রাজি হলে মার গায়ে লাগবে, মনে লাগবে না।

    আমি শব্দকল্পদ্রুম, আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়! আমি জাড্যাপহ! আমি জনস্থান-মধ্যবর্তী-প্রস্রবণগিরি!

    আশকথা পাশকথায় আধঘন্টা কেটে গেল। পাশের ঘরের দরজা খুলে গম্ভীর মুখে অজয় আর লজ্জা-লজ্জা মুখে সীমা বেরিয়ে এল। ছোটবোনের হাত ধরে বলল—চল্‌ বাড়ি ফিরতে হবে।

    বিকেলে অজয়কে বললাম—তাহলে তোর বিয়ে ঠিক? গায়েহলুদ কবে হচ্ছে?

    অজয় মাথা নাড়ে।

    --এ বিয়ে হয় না। আমি বাড়ির বড়ভাই। বাবা অসুস্থ, মা নেই। বোনেদের বিয়ে দিতে হবে। আমাকেই---।

    --মেয়েটাকে কীরকম ভুজুংভাজুং দিলি?

    --বললাম, এখন তুমি আমাকে তড়িঘড়ি বিয়ে করতে চাইছ ঘরের উৎপাত থেকে মুক্তি পেতে। এটা ঠিক প্রেম কিনা এখনই বোঝা যাবে না। পরে তোমার আফশোস হলে সারাজীবন সেই গ্লানি বয়ে বেড়াতে হবে। তার চেয়ে এক কাজ করো। মন দিয়ে পড়ে হিন্দি সাহিত্যে এম এ পাশ কর। আমি তোমাকে হেল্প করব। নোটস্‌ এনে দেব। পাশ করলে মিউনিসিপ্যালিটির স্কুলে চাকরি লাগানোর মত সোর্স আছে, নিজের বোনের লাগিয়েছি।

    এইভাবে তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াও। স্বাধীন হও। তখনও যদি আমাকে বিয়ে করার ইচ্ছে থাকে তো বিয়ে হবে। আমি অপেক্ষা করব। মাত্র একটা বছর তো!


    তারপর ছ’মাস কেটে গেল। সীমার পিতাঠাকুর ওর বিয়ে ঠিক করেছেন ধমতরী শহরের এক সিভিল ঠিকেদারের সঙ্গে—দুটো বাড়ি, দুটো গাড়ি।

    আজ বিয়ে, অজয় কার্ড পেয়েছে। এতক্ষণে বরযাত্রীর দল পৌঁছে গেছে।

    আর অজয় আমাদের সঙ্গে আনন্দ হোটেলের বারে বসে হুইস্কির গেলাসে কেঁদে ভাসাচ্ছে। একবার জাতপাতকে গাল পাড়ছে, একবার ওর চার ভাইকে। ফের কীর্তনের মত আখর দিয়ে বলে বলে কাঁদছে।

    আমরাও দোহার দিচ্ছি। অর্থাৎ শুকনো চোখে হা-হা করে কাঁদছি আর খালি গেলাসের দিকে ইশারা করছি।

    বন্ধু হলে কী হবে, ছোটলোক তো বটি!



    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • পর্ব ১ | পর্ব ২
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments