অফিসে বেরোনোর আগে কী মনে হতে কফির কাপটা নামিয়ে রেখে ফোনটা হাতে নিলো টিটো। অর্ণবকে একটা ফোন করা দরকার। গতরাতে ঘুমোতে যাওয়ার ঠিক আগে, রাত প্রায় সাড়ে বারোটায় বেশ উত্তেজিতভাবে ফোন করেছিল অর্ণব।
--ঘুমিয়ে পড়েছিলি?
--না। কিন্তু ঘুম পাচ্ছে। একটু সংক্ষেপে বল।
--কাকিমা একটু আগে ফোন করেছিলেন।
--কেন?
--তমার কথা জানতে চাইছিলেন।
--তমার কথা! কী বললি তুই?
--আমি তেমন কিছু বলিনি। তোর কোর্টে বল ঠেলে দিয়েছি। আমি শুধু বলেছি ও তোর ফেসবুকের বন্ধু।
কাল রাতে সত্যি ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল, মাথায় কিছু ঢুকছিল না। আর কথা বাড়ায়নি টিটো। তেমন কিছু জরুরিও মনে হয়নি। সকালে অফিসে বেরোনোর আগে ব্যাপারটা মনে পড়তেই একটা খটকা লাগলো, মা তমার কথা জানলো কী করে? ও নিজে তো কখনো বলেনি কিছু। অর্ণব নিশ্চয় এমন কিছু বলেছে, যাতে মায়ের বাড়তি কৌতূহল হয়েছে। কৌতূহল ওরও হচ্ছে। একটু জানা দরকার। অর্ণব ঘুম জড়ানো গলায় ফোন ধরলো।
--এত সকালে ফোন করছিস কেন? ঘুমটা ভেঙে গেল।
--কাল তুই অত রাতে আমার ঘুম আটকে একটা বিশেষ নিউজ দিয়েছিলি বলে আমাকে এত সকালে তোর ঘুম ভাঙাতে হলো। সরি।
--তুই এখনও অফিস যাসনি?
-এই বেরোবো। হ্যাঁ রে, মা তমার কথা জানলো কী করে?
--বিশ্বাস কর আমি কিছু বলিনি। আমি তো বিকেলে গিয়ে খামটা দিয়ে চলে এসেছি। তারপর রাত প্রায় সাড়ে দশটার দিকে কাকিমা আমাকে ফোন করে জানতে চাইলেন তমা কে?
--ঠিক আছে, আমি এখন রাখছি।
অফিসে গিয়েও একটা অস্বস্তি ঘিরে রাখলো টিটোকে। মায়ের সঙ্গে প্রায় সবকিছু শেয়ার করে, করা যায়। মা যেন একটা বাচ্চা মেয়ে। কিছু শুনলে বিস্ময় প্রকাশ করে অকপটে, রাখঢাক না করে সহজভাবে প্রশ্ন করে নিজের কৌতূহল মেটায়। যুক্তি দিয়ে বোঝালে মেনে নিতে দ্বিধা করে না। আগে থেকে তমার কথা বললেই হতো মাকে। অর্ণবের কাছ থেকে শোনার আগে। আসলে ব্যাপারটা এমন কিছু সিরিয়াস ছিল না, অন্তত টিটোর দিক থেকে। ইনফ্যাক্ট শুধু নেট-এর বন্ধু ছাড়া বেশি কিছু ভাবতো না ওকে। তমা দিল্লি আসার পর কিছুটা আবেগ জমেছে। মনে মনে খানিকটা কাছাকাছি চলে এসেছে। কিন্তু সেটাকে এক্ষুনি ঠিক প্রেম বলে ভাবছে না। মেয়েটা এমন যে ওকে কাছে থেকে দেখলে এক ধরনের মায়ায় জড়িয়ে যেতে হয়। একটা অন্যরকম আকর্ষণ আছে ওর। পরিচয় হলে মায়েরও ভালো লাগবে তমাকে।
কিন্তু ও নিজে বলার আগে মা জানলো কী করে? হঠাৎ মনে পড়লো, বাড়ির কমপিউটারে একটা ফাইলে তমার দুটো ছবি আছে। মা কখনও সেটা দেখেছে? হয়তো দেখে থাকবে। কিন্তু ছবির সঙ্গে নামটা এলো কী ভাবে? অর্ণব নিশ্চয় কিছু না কিছু বলেছে। এখন বকুনি খাওয়ার ভয়ে স্বীকার করছে না। ভেবেছিলো বাংলাদেশ যেতে হলে মাকে তো বলতেই হবে, তার আগে তমার কথা বলবে।
আসলে এই যাওয়ার ব্যাপারটা খানিকটা অপ্রত্যাশিতভাবে দ্রুত ঘটে গেলো। তমা যে অমন হুট করে দিল্লি চলে আসবে, ভাবতে পারেনি টিটো। চ্যাট করতে করতে টিটো কথার ঝোঁকে বলেছিল, মানে কী-বোর্ড লিখে ফেলেছিল, ‘এসো জ্বেলে দিয়ে যাও প্রদীপখানি, মোর বিজন ঘরের কোণে ...।’ কী করে যে লিখেছিল নিজেই জানে না। গানটা মা বা তিতিরের গলায় কখনও শুনেছে। কিন্তু সেটা এভাবে প্রয়োগের কথা ভাবতেই পারেনি। তমা-ই লিখিয়ে নিয়েছিল যেন। ও পারে। ওর সামনে বসলে কী যেন ভর করে টিটোর ওপর। এটাকে ফ্লার্ট করা বলে কিনা কে জানে। নিজের মনে হাসলো। তমা সারাক্ষন রবীন্দ্রনাথের গানের লাইন কোট করে। কী করে এত গান মুখস্ত থাকে কে জানে। ঠিক মায়ের মতো, ভাবলো টিটো। মায়ের সঙ্গে কোথায় যেন একটা মিল খুঁজে পায়, বলেই আরো ভালো লাগে তমাকে। অরুণিমাও মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথের গান কোট করে। এখন আর গানটান তেমন না করলেও প্রচুর গান ঠোঁটস্থ। আপন মনে গুনগুন করে। তিতির মাঝে মাঝেই গানের রেফারেন্সের জন্যে অরুণিমাকে ফোন করে, লক্ষ্য করেছে ও।
এই মুহূর্তে মায়ের সঙ্গে একবার কথা বলতে খুব ইচ্ছে করলো টিটোর। কিন্তু কল করতে গিয়েও ফোন রেখে দিলো। অনেক কাজ। রাতে ফিরেই কথা হবে। ইতিমধ্যে মানসিকভাবে ঠিকঠাক প্রস্তুত করে নেবে নিজেকে। মনে মনে হাসলো। এত প্রস্তুত হওয়ারই বা কী আছে? নেটে একটা মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব, সামান্য ভালো লাগা বইতো নয়।
যাদবপুর থেকে অন্যদিন খুব ফুরফুরে মন নিয়ে বাড়ি ফেরে দুজনে। সুপ্রিয় লক্ষ্য করলো আজ অরুণিমার মুড অফ। ব্যাপারটা বোধগম্য হলো না। কাল রাত থেকে কিছু একটা হয়েছে ওর। সকালবেলায় অফিস যাওয়ার আগে অব্দি খুব সিরিয়াস কিছু মনে হয়নি। খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। কাল রাতে ওর পুরোনো বন্ধুদের নিয়ে কি সব স্বপ্নটপ্ন দেখেছে, সেগুলো তো হালকা চালেই বললো। কিন্তু এখন ওকে বেশ টেন্সড লাগছে। ঘরে ঢুকে আগেই ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জলের বোতল নিয়ে ঢকঢক করে গলায় ঢাললো, তারপর সুপ্রিয়র দিকে বড়িয়ে দিল অরুণিমা। সুপ্রিয় ওর হাত থেকে জলের বোতলটা নিয়ে এক ঢোঁক খেয়ে রেখে দিল। ও বাড়িতে খাওয়াটা বেশ চাপের হয়ে যায়। এখনও এত বছর পরেও জামাই-আদরটা বেশ জম্পেশ করেই হয়। কিছু জিজ্ঞেস করবে কি না ভাবছে, তখনই অরুণিমার ফোন বাজলো। নিশ্চয় টিটো। সাধারণত এই সময় ফোন করে ও। সুপ্রিয় লক্ষ্য করলো অরুণিমা ফোন রিসিভ করলো নিস্পৃহ গলায়।
--বল?
--পিসি, বেশি চাপ নিও না। আমার ওপর ভরসা রাখো।
--এত রাতে ভরসা দেয়ার জন্যে ফোন করলি?
--না। বেরোনোর সময় অন্য দিনের মতো আমাকে আদর করলে না তো, তাই মনে হলো একটু বেশি চাপে ফেলে দিয়েছি তোমাকে। তোমার চেহারা পড়তে পারি আমি।
খুব খারাপ লাগলো অরুণিমার। টুপুরের কষ্ট হয়েছে নিশ্চয়। এত বড় মেয়ে এখনও আদর নেয়ার জন্যে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী যে হলো আজ।
--সরি সোনা। এখন করছি আদর। নে। যাই হোক আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না, তোর মায়ের সঙ্গে কথা বল। ইন ফ্যাক্ট তোর মা খুব মানসিক চাপে আছে। আর হ্যাঁ, নানা ঝুটঝামেলায় তোকে একটা কথা বলা হয়নি। আজ খুব এলিগ্যান্ট লাগছিল তোকে। সেজন্যে আর একটা আদর।
--থ্যাঙ্কস। গুডনাইট।
অরুণিমা ফোন রেখে সুপ্রিয়কে বললো, তুমি চেঞ্জ করবে না? বোঝা গেল টুপুর ছিল ফোনে। কথাবার্তার ধরনে সুপ্রিয়র মনে হলো কিছু তো একটা ব্যাপার আছে, যা খুব স্বাভাবিক নয়। ও বাড়িতে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। কিন্তু জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। যা বলার যতটুকু বলার ও নিজেই বলবে তেমন মনে করলে। উঠে চেঞ্জ করতে গেল সুপ্রিয়। বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে শুনতে পেল আবার ফোন বাজছে। এবার নিশ্চয় টিটো। এখানেও সচরাচর ওর কোনো ভূমিকা থাকে না। মা ছেলের দীর্ঘ কথাবার্তা হয়, তারপর তার সারাংশটুকু সুপ্রিয়কে জানায়।
--মা, তোমরা দিদার বাড়ি গিয়েছিলে?
--হ্যাঁ, তোকে কে বললো?
--দিভাই। তোমরা বেরিয়ে আসার পর ও ফোন করেছিল। বললো অনেকদিন পর খুব হৈচৈ আড্ডা হলো সবাই মিলে। শুনে আমার খুব হিংসে হলো।
--পুজোয় একটু বেশি ছুটি নিয়ে আয়, তাহলে পুষিয়ে যাবে।
অরুণিমা অপেক্ষা করছে টিটো কখন বলবে ওর বেড়াতে যাওয়ার কথাটা। নিজে কিছু জিজ্ঞেস করলো না।
--মা, তোমার সঙ্গে একজনের পরিচয় করিয়ে দেবো।
--কোথায় সে?
--নেটে।
--নেটে! কে সে?
-আমার খুব ভালো একজন বন্ধু। জানো মা ও অনেকটা তোমার মতো। খুব সুইট।
--আবার সুইট মেয়ে, সেই সমীক্ষার মতো?
-দূ-উ-র। তোমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালে অ্যাকসেপ্ট কোরো।
--রোজ গণ্ডা গণ্ডা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে। নাম না বললে বুঝবো কী করে?
--ওর নাম তমা।
অরুণিমা জানে, তবু টিটোর মুখে শুনে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো। তমা নামটা টিটো কী সহজ এবং অভ্যস্ত ভাবে উচ্চারণ করলো। আরো কিছু শুনতে চাইছে অরুণিমা। কিন্তু নিজে থেকে জানতে চাইবে না।
--তোর টিকিট কাটা হয়ে গেছে?
--কীসের টিকিট?
--প্লেনের টিকিট।
--হ্যাঁ, হয়ে গেছে।
--কবে আসছিস? এবার কিন্তু কোন্নগরে যেতেই হবে, তোর বড়মা বারবার করে ফোন করে বলছেন। ফোনের ওপাশে সামান্য নীরবতা। তারপর কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত গলা টিটোর।
--মা, আমার প্লেনের টিকিট দিল্লি টু ঢাকা।
--মানে?
--তোমাকে বলা হয়নি। মানে বলতে ঠিক সাহস হচ্ছিল না। আমি বাংলাদেশে যাচ্ছি।
--সত্যিই তুই এবারও পুজোয় বাড়িতে আসবি না? --এই জন্যেই বলতে পারছিলাম না। বাড়ি আসবো, পরে। ঢাকা থেকে কলকাতা হয়ে তারপর দিল্লি ফিরবো। তখন নাহয় একবার কোন্নগর যাওয়া যাবে।
--ক’দিন থাকবি ঢাকায়?
--চারদিন, ঢাকায় ঠিক না, খুলনায়। তমাদের বাড়ি।
--একদম অচেনা একটা বাড়িতে থাকতে তোর অস্বস্তি হবে না?
--গেলে আর অচেনা থাকবে না বাড়িটা।
--ওর বাড়ির লোক জানে তুই কে?
--জানে নিশচয়। তমা নাহলে যেতে বলবে কেন?
কী জানে তমার বাড়ির লোকেরা? এরই মধ্যে ওর পরিবারের সঙ্গে জানাজানিও হয়ে গেল! অথচ অরুণিমা কিচ্ছু জানে না। অভিমান দানা বাঁধছে ভেতরে। পাশাপাশি বাড়ছে কৌতূহল। কৌতূহলটা টিটোর একজন গার্লফ্রেন্ড হয়েছে, ঠিক সেজন্যে যতটা না, তার চেয়ে অনেক বেশি অন্য একটা কারণে। এক ধরনের চেহারা দ্বিতীয় কারো হতেই পারে। কিন্তু এতটা মিল! ওর ধারণাটা যদি সত্যি হয়? সত্যিই যদি ও রুমার মেয়ে হয়...। এই মুহূর্তে টিটোর চেয়ে ওকে অনেক বেশি টানছে তমা।
একটা ফ্রেন্ড-রিকোয়েস্ট এর অপেক্ষা নিয়ে ঘুমোতে গেল অরুণিমা।
অন্যদিনের চেয়ে একটু আগেই অফিস থেকে ফিরেছে সুপ্রিয়। আজ সারাদিন মনে হয়েছে অরুণিমা কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে মানসিক অস্থিরতার মধ্যে আছে, বিষয়টা সুপ্রিয় ঠিক আন্দাজ করতে পারছে না। ও সবসময় এত সহজ আর প্রসন্ন থাকে, ঘরে ফিরে ওর মুখের দিকে তাকালে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। অথচ সেই মানুষ পরশু রাত থেকে কেমন অস্থির হয়ে আছে। গতকাল রাতে মায়ের বাড়ি থেকে ফেরার পর খানিকটা মনমরাও বটে। কিছুই বুঝতে পারছে না সুপ্রিয়। কাল অফিস যাওয়ার আগেও অনেকগুলো নাম জড়িয়ে একটা কিছু বলছিল, ঠিক পরিষ্কারভাবে বোঝাতে পারেনি। এখন ব্যাপারটা নিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলতে হবে।
চায়ে চুমুক দিয়ে সুপ্রিয় রিল্যাক্স করে সোফায় বসলো।
–-ঝুম, এবার বলো।
--কী? ও হ্যাঁ। কোনটা আগে বলবো ভাবছি।
--পরশু রাত থেকে শুরু কর।
--আগে টিটোর ঘরে চল।
--এখানেই বল না।
--এখানে হবে না। শুরুটা ওর কমপিউটার থেকে করতে হবে।
অনেকগুলো পুরোনো ছবি বিছানার ওপর ছড়ানো। কাল মায়ের বাড়ি থেকে এগুলো নিয়ে এসেছে। কম্পিউটার আর স্ক্যানার অন করা। সারাদিন বসে হয়তো ছবিগুলো স্ক্যান করে কমপিউটারে সেভ করেছে। ছবিগুলোর অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। প্রায় সব ছবিগুলোতেই কোনো না কোনো ভাবে রুমার উপস্থিতি। সুপ্রিয় একটা ছবি হাতে নিল। এ ছবি ও আগেও দেখেছে, বহু বছর আগে। অরুণিমার সঙ্গে রুমা। অরুণিমার মুখে রুমার সমস্ত অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা, আচার আচরণের গল্প শুনতে শুনতে ওদের বন্ধুত্বকে নিয়ে তখন খুব ইয়ার্কি করতো সুপ্রিয়। গা করতো না অরুণিমা।
কমপিউটার স্ক্রিনে তমার ছবি। সেইদিকে ইঙ্গিত করলো অরুণিমা।
--রুমার ওই ছবিগুলো তো দেখলে, এবার এটা দেখো।
--কে এটা?
--তোমার কি মনে হচ্ছে?
--দুজনের মুখের আদল একই রকম। রুমা...না, রুমার বোন... কে বলো তো...
--রুমার মেয়ে হলে কোনো আপত্তি আছে তোমার?
--সেটা হতেই পারে। ছবিটা তো খুব পুরনো নয়। কোথায় পেলে তুমি একে?
--আমি পাইনি, তোমার ছেলে পেয়েছে। তোমার ছেলের গার্লফ্রেন্ড। খুব আশ্চর্য লাগছে ব্যাপারটা, মজাও লাগছে। ভাবছি রুমা কি জানে? না বোধহয়। তাহলে এতদিন যোগাযোগ করতো, যা পাগল! ও তো এটাই চাইতো। আমার কাছাকাছি থাকার একটা যোগসূত্র।
এবার সুপ্রিয়কে বেশ এক্সাইটেড লাগলো। মন দিয়ে খুঁটিয়ে শুনলো সব।
--ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। ইনফ্যাক্ট বেশ এক্সাইটিংও বটে।
--সত্যিই এক্সাইটিং।
--মেয়েটির কাছ থেকে ফোননম্বর নিতে বলো টিটোকে। তুমি ইকবাল আর রুমার সঙ্গে যোগাযোগ করো। আর ইউ শিওর, ইকবালের সঙ্গেই বিয়ে হয়েছিল রুমার?
--হ্যাঁ রে বাবা, কার্ড পাঠিয়েছিল তো। তুমি তখন সিঙ্গাপুরে। তোমাকে বলেছিলাম তো ফোনে। বেশ অদ্ভুত লাগছে। পৃথিবীটা কত ছোট হয়ে গেছে। সবাই সবার ধরা ছোঁয়ার বৃত্তে চলে এসেছে। সবই অন্তর্জাল, মানে নেটএর সৌজন্যে।
রুমাকে নিয়ে সুপ্রিয়র আদৌ কোনো মাথাব্যথা নেই। অরুণিমার খুব কাছের বন্ধু, সেই হিসেবে যতটুকু আগ্রহ থাকার কথা সেটুকুই। অরুণিমাও যে এই এতগুলো বছর রুমার জন্যে খুব একটা আকুল ছিল, সেটা বললে ভুল বলা হবে। প্রসঙ্গক্রমে কখনও সখনও বলেছে। এটা ঠিক যে নামটা উচ্চারণের মধ্যে ভালোবাসা মেশানো থাকতো। কিন্তু অরুণিমার নিজের বৃত্তকে ছাপিয়ে রুমা কখনও সামনে আসেনি। এখন সুপ্রিয়কেও বেশ কৌতূহলী লাগলো। অদ্ভুত একটা ঘটনার ভেতর দিয়ে মানুষটার অস্তিত্ব সামনে এলো বলে। তাও কি না টিটোর মাধ্যমে। বিছানায় শুয়ে আজ আগ্রহ নিয়ে আবার রুমার গল্প শুনলো সুপ্রিয়। অরুণিমাও নিজেকে উজাড় করে টুকরো টুকরো স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিলো। সুপ্রিয় খুব ঘুম কাতুরে। প্রায়ই গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে যায়। আজ শুনতে শুনতে একটা অন্য অরুণিমাকে দেখছিল, প্রবল আগ্রহ নিয়ে সবটুকু আত্মস্থ করলো।
অন্যপারে............
সন্ধে ছ’টার মধ্যে তমার চলে আসার কথা। এতদিন পরে মেয়ে আসছে, ভেবেছিল ছুটি নেবে আজকের দিনটা। সকালে প্রিন্সিপালকে ফোনও করেছিল। কিন্তু কী ভেবে ছুটির কথা না বলে বললো –-আমি তিনটে পঁয়তাল্লিশের সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাসটা নেবো না। ওটা যদি শাহীনকে দিয়ে ম্যানেজ করে নিতে পারেন, খুব ভালো হয়।
নতুন প্রিন্সিপাল বয়েসে অনেকটা বড় হলেও ব্যবহার বন্ধুর মতো। হাল্কা গলায় বললেন, মেয়ে আসছে আজ?
উত্তর পাওয়ার আগে নিজেই আবার বললেন, আপনি কাল শাহীনকে বলছিলেন, কানে এলো।
--হ্যাঁ। জানেনই তো ওর আব্বু বাইরে থাকেন। আমাকেই সবটা সামলাতে হয়।
--মেয়েকে নিয়ে একদিন বাসায় আসুন। গান শুনবো। কী ভালো গায় আপনার মেয়ে।
গতকাল সন্ধেবেলায় তমার ঘরে নতুন পর্দা লাগিয়েছে। আজ সকালে কলেজে যাওয়ার আগে বেডসিট, বেডকভার সব পালটে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে ঘরটা। চাকরিতে জয়েন করার পর প্রায় পাঁচ মাস পরে বাড়ি আসছে তমা।
নিজের ঘর নিয়ে একধরনের পাগলামি আছে মেয়ের, কতভাবে যে সাজায় নিজের ঘরকে। আগে তো এখানে থাকতে প্রায় প্রত্যেক সাত আটদিন অন্তর ঘরের কিছু না কিছু পরিবর্তন করতো। আর কিছু না হলে এ দেয়ালের ছবি ও দেয়ালে সরিয়ে দিতো।
কলেজ থেকে ফিরে ওর জন্যে জলখাবার বানিয়ে রেখে আর একবার তমার ঘরে ঢুকলো। ফুলদানিতে একগোছা হলুদ রঙ্গন রাখলো। তমা পছন্দ করে।
--ফুলের সাথে পাতা রাখলেন না আম্মা? আপায় পছন্দ করে।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো মনিরা একটা কামিনী ফুলের ছোট ডাল হাতে নিয়ে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। একটু হেসে ওর হাত থেকে ডালটা নিয়ে ফুলদানিতে গুঁজে দিলো। একগাল হাসি নিয়ে মনিরা তাকালো ফুলদানির দিকে। এটাকেই কত রঙ চড়িয়ে তমার কাছে গল্প করবে মনিরা।
ঘড়ির দিকে তাকালো--সাড়ে পাঁচটা। এর আগে মাকে ছেড়ে এতদিন থাকেনি তমা। নিজে মেয়েকে ছেড়ে থাকতে পারবে না বলে ঢাকাতেও পড়তে পাঠায়নি। তা নিয়ে তমার কত রাগ।
--তুমি তো পারলে আমাকে আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখো। খুলে রাখলে যেন আমি উবে যাবো। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মনে মনে বলেছিলো, কি জানি বড্ড ভয় করে !
বাড়িতে পা দেওয়ার পর থেকে গল্প আর শেষ হয় না তমার। এই প্রথম মাকে ছেড়ে একা একটা অন্য শহরে থাকা। ইকবালের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে একটা রুম নিয়ে নিজের মতো থাকে তমা। একার সংসার গুছিয়ে আবার চাকরি সামলানো, এ যেন ওর কাছে প্রায় রূপকথার মতো। ও যে খুব সাজিয়ে গুছিয়ে পরিপাটি হয়ে থাকে মাকে এটা বিশ্বাস করানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে এসে অব্দি। এমনকি দু’একটা রান্নার রেসিপিও শেখাচ্ছে মাকে।
অনেক রাতে তমাকে প্রায় জোর করে শুতে পাঠিয়ে বাইরের ঘরের দরজা জানালা ঠিকঠাক বন্ধ আছে কি না দেখে নিয়ে সামনের ব্যালকনিতে এসে বসলো। ইকবাল রোজ এই সময় ফোন করে। আজ এখনও করেনি। ইকবাল জানে আজ তমার আসার কথা। ফোনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে অপেক্ষা করছে। সাড়ে এগারোটা বাজে। তমার ঘরের দরজা ভেজানো। ও ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়। এতটা সময় বাস জার্নি করে এসে ক্লান্তি উপেক্ষা করে সন্ধে থেকে যথেষ্ট হইচই করেছে। নিজের ঘরে যাওয়ার আগে মেয়ের ঘরে একবার উঁকি দিলো।নিজের ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় বসে কিছু করছে তমা। ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো।
--কীরে ঘুমোসনি এখনও?
--ঘুমোবো একটু পরে।
--কী করছিস রাত জেগে?
--বিশেষ কিছু না। মা, এদিকে এসো, তোমাকে একটা জিনিস দেখাবো।
কাছে গিয়ে বিছানায় বসতেই, ল্যাপটপ সরিয়ে রেখে তমা ওর কোলে মাথা রাখলো।
--কী দেখাবি?
--দেখাচ্ছি। দেখানোর আগে তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা আছে।
--বল।
--আমার একজন গেস্ট আসবে এই অক্টোবরে।
--কে সে?
--তুমি চেনো না।
--কোথায় থাকে সে?
--ইন্ডিয়ায়।
--ইন্ডিয়ায়! বুঝেছি, সেবার দিল্লি গিয়ে পরিচয় হয়েছে। তাই না?
--না। পরিচয় আগেই ছিল, ফেসবুকে। দিল্লি গিয়ে দেখা হলো।
--নাম কী? কী করে?
--নাম উপল। ওর মা বাবার জন্ম এখানে। তাই বাংলাদেশ সম্পর্কে ওর খুব কৌতূহল। সেজন্যেই আসতে বললাম। এবার তোমার সঙ্গেও পরিচয় হবে।
একটা অন্য আবেগ তমার গলায়। তমা উঠে বসে আবার ল্যাপটপটা কোলে তুলে নিলো।
--মা, তুমি গিয়ে শুয়ে পড়। আমার একটু দেরি হবে শুতে।
--কী দেখাবি বললি যে?
--কাল হবে সেসব।
বুঝলো তমা এখন ঘুমোবে না। কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে এলো। একটা অচেনা ছেলে বাড়িতে আসবে, ইকবালকে কি বলবে কিছু? ভাবতে ভাবতেই ইকবালের ফোন এলো।
--তমা এসেছে?
--হ্যাঁ। জেগে আছে এখনও। কথা বলবে একটু?
--না এখন থাক। কাল ওকেই কল করে নেবো। তুমি আজ কলেজে গিয়েছিলে?
--হ্যাঁ। তিনটেয় চলে এসেছি।
--ও ঢাকায় ফিরবে কবে?
--জিজ্ঞেস করিনি এখনও। শোনো, ও বলছে ওর একজন বন্ধু এখানে আসবে বেড়াতে। আমাদের বাসায় থাকবে।
--তো?
--ছেলেটার বাড়ি ইন্ডিয়ায়।
--ছেলে! ইন্ডিয়া! তাকে হঠাৎ বাড়িতে আনার কী হলো! ওর সঙ্গে পরিচয় কী ভাবে?
ইকবালের গলায় সামান্য কি বিরক্তি?
--বললো তো ফেসবুক-এ পরিচয়। তারপর গতবার ওদের এনজিওর কাজে সেই যে দিল্লি গেল না, তখন নাকি দ্যাখা ট্যাখা হয়েছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না বন্ধুত্বের ধরনটা কেমন। কী বলি বল তো?
--আসবে, এটা যখন ঘোষণা করা হয়ে গেছে, মতামতের অপেক্ষা রাখে কি তোমার মেয়ে? আর আমার তো কিছু বলার প্রশ্নই ওঠে না।
--ওভাবে বলছো কেন?
--বলছি, কারণ তোমাদের মা মেয়ের মাঝখানে আমাকে কখনও ঢুকতে দিয়েছো তোমরা?
--কথাটা অর্ধসত্য। তুমিই কোনোদিন তমার কোনো ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চাওনি।
--এ তর্কের শেষ হবে না, ছাড়ো ওসব। এই ব্যাপারটাই আমার ভালো লাগছে না। চেনা নেই জানা নেই বাড়িতে আসতে বলা। আমি থাকি না।
--ও তো বললো দেড় বছর ধরে ওদের চেনা জানা।
--ওই আবার চেনা জানা! নেটে কোনো মানুষকেই চেনা যায় না। বেশিরভাগ ভুলভাল আইডেন্টিটি নিয়ে বসে থাকে। তাও অন্যদেশের একজন।
মেয়েকে একটু বেশিই প্রশ্রয় দেয় ও। ইকবাল সেটা জানে। তমাও মাঝে মধ্যে খানিকটা অন্যায়ভাবে সুযোগও নেয়। সেটা অপছন্দ হলেও মেনে নেয়।
তমা লক্ষ্য করেছে সারাদিন অফলাইন ছিল উপল।সেদিন বলছিল খুব কাজের চাপ। নিজেকে প্রশ্ন করলো তমা, উপলের জন্যে তুমি কি ব্যাকুল হয়ে আছো?ভালো লাগাটা কতটা আবৃত করেছে? এটাকে প্রেম বলা যায় কি? ভেতর থেকে কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। শুধু চোখে মুখে একটা প্রসন্নতা ছড়িয়ে পড়লো।
উপল নিশ্চয় অপেক্ষা করছে ওর মায়ের সঙ্গে তমার পরিচয় পর্বের ডিটেলস জানার জন্যে। ও বলেছিল, আমার মাকে তোমার ভালো লাগবে। আশা করি তোমাকেও মায়ের খুব পছন্দ হবে। এই পছন্দ শব্দটা বেশ ধন্দে ফেলে দিয়েছে তমাকে। উপল ওর মায়ের কাছে কী বলেছে, ভাবতে ভাবতে ভাবতে তমা লক্ষ্য করলো, ওর ফ্রেন্ড-রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্টেড। অরুণিমার নামের পাশে সবুজ আলো দেখে ক্লিক করলো।
--হ্যালো ...
--হ্যালো। তুমি ঘুমোওনি এখনও?
--এই ঘুমোবো এবার। থ্যাঙ্কস, আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করার জন্যে। আপনার কথা এত শুনেছি উপলের কাছে, খুব ইচ্ছে ছিলো আলাপ করার।
ভেতরে চাপা উত্তেজনা থাকলেও খানিকটা নির্বিকারভাবে অরুণিমা জিজ্ঞেস করলো,
--কী কর তুমি?
--সোসিওলজি নিয়ে পড়াশুনা করেছি। এখন একটা এনজিও-তে চাকরি করি।
--কোথায় থাকো?
--এখন ঢাকায় থাকি। কিন্তু আমাদের বাড়ি খুলনাতে।
--ঢাকায় একা থাকো?
--না, আমার এক আত্মীয়ের বাসায় থাকি।
আসলে এই মুহূর্তে এসব জানার যে খুব আগ্রহ আছে অরুণিমার, তা নয়। কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্যেই... কিন্তু বুঝে উঠতে পারছে না ঠিক কীভাবে ওর মাবাবার পরিচয় জানতে চাইবে।
--মা বাবা কোথায় থাকেন?
--আব্বু তো ইউএসএ–তে থাকেন, মা খুলনায়। কলেজে পড়ান। উপল বলেছে রাজশাহী ইউনিভারসিটিতে পড়তেন আপনি?
--হ্যাঁ।
--আমার আব্বুও কিন্তু রাজশাহী থেকে পাশ করেছেন। হার্টবিট দ্রুত হলো অরুণিমার।
--কী নাম তোমার আব্বুর?
--ইকবাল হায়দার।
--ফিজিক্স?
--হ্যাঁ-হ্যাঁ, আপনি চেনেন আমার আব্বুকে?
--হ্যাঁ চিনি।
তবে তো সব ঠিকই অনুমান করেছে অরুণিমা। আব্বুর নাম ইকবাল আর মায়ের নাম তো ওর মুখে লেখা আছে। ও ইকবাল আর রুমার মেয়ে। নিশ্চিন্ত হলো। একটা দারুণ সারপ্রাইজ দেবে রুমাকে। ওর আর তর সইছে না।
--মাকে দাও। কথা বলি। মা জেগে আছে?
--দেখছি। আপনি আমার মাকেও চেনেন?
--সেটা মাকেই জিজ্ঞেস কোরো। না থাক, মাকে এখন কিছু বোলো না। আমার সঙ্গে যে তোমার কথা হয়েছে এটাও ওকে জানিও না। ওকে সারপ্রাইজ দেবো। তুমি শুধু তোমার মায়ের নম্বরটা দাও। আজ অনেক রাত হয়ে গেছে। আমি বরং কাল ফোনে কথা বলবো।
--নম্বরটা মেসেজ করে দিচ্ছি।
--গুডনাইট।
--গুডনাইট।