অদ্ভুত একটা মনমরা বিকেল হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল অর্ণব। দরজা বন্ধ করতে গিয়ে মনে হলো ঘরটা একটু বেশি অন্ধকার লাগছে। দক্ষিণ দিকের জানালার পর্দা গোটানো, মাত্র সাড়ে চারটে বাজে। তবু মনে হচ্ছে সন্ধে যেন আগেভাগে এসে আসন পেতে বসে আছে ঘরটায়। বর্ণহীন শান্ত কুহকের মতো তার আঁচল ছড়িয়ে পড়েছে সোফায়, ডিভানে, দেয়ালের পেইন্টিংগুলোতে, মার্বেল মেঝেতে। ঘরের চারপাশটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সোফার ওপর পড়ে থাকা প্যাকেটটা তুলে নিলো অরুণিমা।
রোজ এতক্ষণে জানালাগুলো বন্ধ করে দেয়, নাহলে ভীষণ মশা ঢোকে। আজ অর্ণবের সঙ্গে কথা বলতে বলতে খেয়াল ছিল না। এখন দেখছে ঘরের ভেতর প্রচুর মশা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সুপ্রিয় আজ আবার ফিরে এসে চেঁচামেচি করবে। মশা নিয়ে ওর এক ধরনের ম্যানিয়া আছে।
জানালা বন্ধ করতে গিয়ে অন্যমনস্কভাবে গ্রিলে গাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। জানালার মাঝ বরাবর উঠে আসা কদম গাছটায় একটা পাখি বাসা বেঁধে ছিল কিছুদিন থেকে। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দু’তিনদিন আগেও লক্ষ্য করেছে ডিম ফুটে ছোট ছোট বাচ্চা বেরিয়েছে। পাখিটা কতবার উড়ে যাচ্ছে, আবার ঠোঁটে করে খাবার এনে বাচ্চাদের মুখে দিচ্ছে। আজ দেখে মনে হচ্ছে বাসাটা খালি।এতদিন গাছটাও ফুলে ফুলে ঢাকা ছিল। এখন বাতাসে শিউলির গন্ধ ভেসে আসতেই কদমের দিন শেষ।। এই ক’দিনে বেশিরভাগ ফুলই ঝরে গেছে। ফুলভর্তি গাছের মাঝখানে পাখির বাসাটার ছবি তুলে পাঠিয়েছিলো টিটোকে। ও খুব খুশি।
কাছাকাছি কোনো শিউলি গাছ নেই, তবু আজ ক’দিন ধরে সকালবেলায় জানালা খুলতে এসে শিউলির গন্ধ পায় অরুণিমা। চারপাশে উঁকিঝুঁকি মেরে খুঁজতে চেষ্টা করে। উল্টো দিকে সামন্তদের ছাদ ঝাঁপিয়ে ঝুলে থাকা মাধবী, আর স্থলপদ্ম গাছে চোখ আটকে যায়। স্থলপদ্ম ফুটতে শুরু করেছে। আর তেরোদিন পর পুজো। এবারও পুজোয় আসবে না টিটো। এই সময় সবার প্রবাসী ছেলেমেয়ে ঘরে ফেরে। আসল উৎসব তো ওটাই। উৎসবের এই আনন্দটুকু অরুণিমারও তো পেতে ইচ্ছে করে।
হঠাৎ কী হলো! টিটো যদিও নিজে কিছুই জানায়নি। কাল রাতেও প্রায় পঁচিশ মিনিট কথা হলো। এবার পুজোয় কোন্নগরের বাড়িতে যাওয়া হবে কি না, কার জন্যে কী কেনা হলো, সব খুঁটিয়ে জানতে চাইলো। কই একবারও তো বললো না যে ও আসবে না। সিদ্ধান্তটা যদি কাল রাতের পর নিয়ে থাকে তাহলে অর্ণব জানলো কী করে? ওর সঙ্গে আজ দু’দিন নাকি ফোনে কথা হয়নি। কিন্তু ও বেশ নিশ্চিতভাবেই বললো, টিটো তো এবার পুজোয় কলকাতায় আসছে না।
শুনে অব্দি ভেতরে ভেতরে মনটা খারাপ হয়ে আছে। সেটা টিটো আসছে না বলে শুধু নয়, অর্ণবের কাছ থেকে খবরটা পেতে হলো সেজন্যেও কিছুটা। আর খানিকটা টিটো কিছু লুকোচ্ছে এই সন্দেহে। এটা ঠিক যে খুব ছোটবেলা থেকে অর্ণবের সঙ্গে বন্ধুত্ব ব’লে টিটো নিজের সব গোপন কথাই ওকে বলে। কিন্তু পুজোয় বাড়িতে আসবে না এটা তো কোনো গোপন কথা হতে পারে না যা মাকে বলা যাবে না। না কি এর নিচে অন্য কিছু লুকিয়ে আছে। আসবে না যে, আগেই নিশ্চয় সেটা ঠিক হয়ে আছে। অর্ণব দিল্লি থেকে ফিরেছে দু’দিন আগে। এর মধ্যে ওর সঙ্গে যখন কথা হয়নি, ওখান থেকেই জেনে এসেছে নিশ্চয়। তাহলে কাল কেন বললো না টিটো?
পুজোয় চাইলে এক সপ্তাহের ছুটি পেতেই পারে, টিটোই বলেছে। বিশেষ কোনো অফিসিয়াল কাজ এসে গেলে সেটা আলাদা কথা। বলেনি যখন, কারণ নিশ্চয় সেটা নয়। তাহলে? টিটোর সঙ্গে কথা না বলা পর্যন্ত মনটা খুঁতখুঁত করছে। আজ রাতে ফোন করবে না বলেছে। টিম ডিনার আছে। ইচ্ছে থাকলে সেখান থেকে ফিরে করতেই পারে। বললে অরুণিমা নাহয় জেগে থাকতো। কোনো পার্টি থাকলে সেদিন কিছুতেই ফোন করতে চায় না টিটো। সুপ্রিয় বলে, এসব পার্টিতে সবাই এক আধটু ড্রিঙ্ক ফ্রিঙ্ক করে, তোমার পুত্রটি হয়তো সেজন্যেই কথা বলতে সঙ্কোচ বোধ করে। যাই হোক কাল সকালে অরুণিমা নিজেই ফোন করবে। দুশ্চিন্তা নয়, এক ধরনের অস্বস্তি,অস্থিরতা। যা অন্যকে বোঝানো যায় না। সুপ্রিয়কেও না।
বলতে গেলে বলবে, আদিখ্যেতা। কী করে ওকে বোঝাবে যে, পুজোয় আসবে না সেটা কোনো বড় ব্যাপার না। শুধু মনে হচ্ছে টিটো কিছু লুকোচ্ছে, এই প্রথম।ও তো এরকম ছিলো না। এমন কি ইলেভেনে পড়ার সময় বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিকে গিয়ে প্রথম সিগারেট খেয়েছিল, সেটাও এসে বলেছিল ওকে। কলেজে ঢোকার পরও তো খুঁটিনাটি সব গল্প করতো। শুনতে না চাইলেও পিছন পিছন ঘুরে ঘুরে বলে যেতো। মা ছেলেতে মিলে মজাও করতো সেসব নিয়ে। সেই সব ছোট ছোট ঘটনা মনে পড়তেই মন খারাপের মধ্যেও হেসে ফেললো।
সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে একদিন কলেজ থেকে ফিরে কফি খেতে খেতে বললো, জানো মা আজ একটা মজার ব্যাপার হয়েছে।
--কী হয়েছে?
--আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে, তুমি চেনো।
--কে সে?
--সেই যে সমীক্ষার কথা বলেছি না?
--তুই তো কলেজে ঢোকার পর সারাক্ষণ মেয়েদের কথাই বলিস, মনে হয় যেন মেয়েদের কলেজে পড়িস। যাই হোক, মনে নেই। আবার বল।
--তার মানে তুমি কখনো ভালো করে আমার কথা শোনো না।
--শুনি। মুখস্ত করে রাখি না। একই মেয়ের কথা বারবার যখন বলছিস, এবার তো মন দিয়ে শুনতেই হবে।
--সেই যে কানপুর থেকে এসেছে।
--নো ডিটেলস। আজ নতুন কী ঘটেছে শুধু সেটা তাড়াতাড়ি বলে চলে যা, আমার কাজ আছে।
--ও না ভীষণ সুইট। দেখলেই মনে হয় গাল টিপে দিই।
অরুণিমার প্রায় বিষম খাওয়ার জোগাড়। তবু বুঝতে দিল না। নিজের কাজ করতে থাকলো।
--আমরা এক গ্রুপে প্র্যাকটিকাল করি। আজ প্র্যাকটিকাল ক্লাসে, তখনও ল্যাব-এ বেশি কেউ আসেনি। আমাদের গ্রুপের আমরা তিনজন আর তিতিরের গ্রুপের দু’জন। আড্ডা হচ্ছে, তখন...
--দিলি ওর গাল টিপে?
--হ্যাঁ তো।
--টিটো,তার পরের ঘটনা আর বলিস না, শুনতে খারাপ লাগবে আমার। বুঝে নিয়েছি।
--কী বুঝলে?
--ঠা----স।
--উঁহু...চকাস।
--মানে?
--সমীক্ষা আমার গালে চুমু খেলো। সত্যিকারের চুমু।
--আর পাবলিক?
--পাবলিক এনজয় করল। এক পাবলিক শুধু আমাকে চোখে ভস্ম করে দিচ্ছিল।
--তিতির?
--আবার কে? জেঠিমা তো আমার।
--বকলো?
--তখন কিছু বলেনি।কলেজ থেকে ফেরার সময় বললো, বন্ধু হিসেবে আমাকে টলারেট করার জন্যে ওকে প্রাইজ দেওয়া উচিত।
--ঠিকই বলেছে। এবার এলে আমি ওকে প্রাইজ দেবো।
--তুমি সবসময় ওর পক্ষ নিয়ে কথা বলো কেন বলো তো?
--ও খুব লজিকাল বলে।
এই পর্যায়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি চলতো মা ছেলেতে। টিটো তো মায়ের সঙ্গে এতটাই খোলামেলা। হঠাৎ কী হলো? অর্ণব কিছু জানলেও টিটোর নিষেধ থাকলে কিছুতেই বলবে না। টিটোকে ও খুব ভয় পায়। তিতিরের সঙ্গে টিটোর সম্পর্ক মারামারি লাঠালাঠির হলেও তিতিরই একমাত্র বন্ধু যে ওর সব কিছু জানে, আর টিটোকে বিন্দুমাত্র পরোয়া করে না। কটকট করে কথা শোনায়। তবু টিটো নিজের সব কথা ওকে না বলে থাকতে পারে না, অরুণিমা জানে।পুজোয় ওর কলকাতায় না আসার কারণটা তিতিরকে জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয় জানা যাবে। বোঝা যাবে আসল ব্যাপারটা কী। কিন্তু তিতিরকে এখন পাবে কোথায়, সে তো বাঙালোরে। ফোন করে এসব জানতে চাওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। ও তো নিশ্চয় পুজোয় আসবে।
এই সময়টা চারপাশে একটা ছুটি ছুটি আমেজ ছড়িয়ে থাকে। ঘরে ফেরার হাওয়া। অরুণিমার মনে আছে ছোটবেলায় যখন ওরা বাংলাদেশে ছিল, আশ্বিন মাস পড়তে না পড়তেই প্রত্যেকদিন ভোরবেলায় সুদামদা রাস্তা দিয়ে আগমনী গাইতে গাইতে যেত। সেই গানের সুরেই ওরা শরতের আগমন বুঝতে পারতো। মণ্ডপে খড়ের কাঠামোতে মাটির প্রলেপ পড়তো। শারদীয়ার সূচনা হতো। এখন টেলিভিশান আর খবরের কাগজে কেনাকাটার বিজ্ঞাপন দেখে বুঝতে হয় শরৎকাল এলো, পুজো সঙ্গে নিয়ে।
চারতলার চক্রবর্তী-মাসিমা সকালে ফোন করে বললেন, এবার পুজোয় দুই ছেলেই সপরিবারে আসছে। সেজন্যে মেশোমশাই এখন থেকেই নাকি বাজার করে ফ্রিজ ভরছেন। মর্নিংওয়াক থেকে ফেরার সময় অরুণিমাকে বারান্দায় দেখে সংগীতা হেসে হেসে বললো, ‘এবার পুজোয় আমি গৃহবন্দী।কানাডা থেকে মেয়ে জামাই আসছে তাদের তিন মাসের বাচ্চা নিয়ে।’
বৌদি সেদিন ফোন করেছিল, শনিবারে শপিং এ সঙ্গে যাওয়ার জন্যে। সবার মনে উৎসবের প্রস্তুতি। ভাবতেই আরো মন খারাপ হয়ে গেল। অরুণিমা ভেবে রেখেছিল এবার টিটো এলে ওর বন্ধুদের নিয়ে একটা গেট-টুগেদার অ্যারেঞ্জ করবে। এমনিতে ও এলে বাড়িতে হইহুল্লোড় লেগেই থাকে। তবু এত ভালো চাকরিটা পেলো, একটা ভালো ট্রিট তো বন্ধুদের প্রাপ্য ছিল, এতদিনে সেটা আর হয়ে উঠলো না। ভেবে রেখেছিল তো আরো অনেক কিছু। নির্বিকার জানালার গায়ে বুক খালি করে সবটুকু দীর্ঘশ্বাস ঢেলে দিয়ে কপাট বন্ধ করলো অরুণিমা।
ওর চাকরি করাকে কোনোদিনই ভালো ভাবে নেয়নি টিটো। যখন স্কুলে নিচু ক্লাসে পড়তো,তখন মা ওকে স্কুল থেকে নিয়ে যেতেন, অনেকটা সময় দিদার বাড়িতে ও মজাতেই থাকতো। বিকেলে ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরতো। সমস্যা হতো না। আর যখন উঁচু ক্লাস হলো, তখন তো স্কুলের পর প্রাইভেট পড়ে তারপর বাড়ি ফিরতো। ও ফেরার অনেক আগেই চলে আসত অরুণিমা। সমস্যা হলো কলেজে ঢোকার পর। যেদিন টিটোর কম ক্লাস থাকতো, বাড়ি ফিরে নিজেকেই তালা খুলে ঘরে ঢুকতে হতো। এটাই ছিল ওর খুব অপছন্দের ব্যাপার। বলতো, বাড়ি ফেরার পর তুমি দরজা খুলে না দাঁড়ালে খুব খারাপ লাগে মা। আমার বাড়িতে ঢুকতেই ইচ্ছে করে না। কথাটা খুব মনে লেগেছিল অরুণিমার। তখন থেকেই মাঝে মাঝে ভি আর এস নেওয়ার কথা ঘুরপাক খেতো মাথায়। কলিগদের কাছে বললে উড়িয়ে দিতো, ওয়ার্থলেস সেন্টিমেন্ট বলে। বলতো, ছেলে নিশ্চয় এখনও প্রেমট্রেম করে না। তুমি ভি আর এস নিয়ে ঘরে গিয়ে বোসো, তারপর দেখবে ছেলে প্রেম নিয়ে এতই মশগুল, মাঝরাত্তিরে বাড়ি ফিরছে, আর তুমি তার জন্যে পথের দিকে চেয়ে জানালায় বসে আছো। বুঝবে তখন ।
চাকরি ছাড়ার পর প্রথম প্রথম খুব আরাম লাগতো। কাজ আর সময় নিয়ে হিমসিম খেতে হয় না। সকালে উঠে আয়েস করে অনেকক্ষণ ধরে চা খাওয়া, সুপ্রিয়র সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করা, মেজাজটা বেশ ফুরফুরে লাগতো।
দশটা নাগাদ সুপ্রিয় বেরিয়ে গেলে দুই হাত উপচে পড়া অবসর। খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়া, শোভাদিকে রান্নার মেনু ঠিক করে দেওয়া, গাছের পরিচর্যা করা, ফোনে আড্ডা মারা, গল্পের বই পড়া, মাঝে মধ্যে ভালোমন্দ দুই এক পদ নিজে রান্না করা। তার পরও হাতে অঢেল সময়। অতএব প্রায় কুড়ি বছর পর আবার তানপুরা নামলো। গাইতে গিয়ে বুঝতে পারলো গানটা ভেতরে আছে ঠিকই, কিন্তু গলা দিয়ে সে গান ঠিকঠাক সুরে বেরোয় না। উৎসাহ নিবে গেল।
বিয়ের পর বছর তিনেক, টিটোর জন্মের আগে পর্যন্ত গানে গানে ভরে থাকতো ঘর। উৎসাহটা সুপ্রিয়রই বেশি ছিল। বাড়িতে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিলেও বউ যে খুব ভালো গান করে সেটা জানান দেয়ার জন্যে গান শোনানোর ডাক পড়তো অরুণিমার। তারপর ছোট্ট টিটো, চাকরি, আর সংসার-– এই তিনের আড়ালে চলে গেল গান। ছোটবেলায় টিটোকে গান শেখানোর অনেক চেষ্টা করেছে অরুণিমা। কিন্তু ও কিছুতেই গাইতে চাইতো না। ফলে ও পাট উঠে গিয়েছিল।ওর পিছনেই অনেকটা সময় চলে যেতো। অফিস যাওয়ার আগে নিজে রেডি হয়ে, ওকে রেডি করেমায়ের বাড়িতে নামিয়ে দিতো। আবার ফেরার সময় তুলে আনতো। কখনো কখনো মা নিজে এসে দিয়ে যেতেন। গানের আর জায়গা কোথায়। তিতির মাঝে মাঝে খুব জেদ করে গান গাওয়ার জন্যে। কখনও সখনও তিতিরের নাছোড়বান্দা আবদারে ওর সঙ্গে গায়ও। টিটোই নাকি ওকে বলেছে, জানিস মা একসময় খুব ভালো গাইতো। তোর চেয়ে ভালো।
এখন মাঝে মাঝে মনে হয় ভালো গান গাইতে পারে এমন একটা মেয়ের সঙ্গে টিটোর বিয়ে দেবে। কিন্তু ও কি আর মা বাবার পছন্দ করে দেওয়া মেয়েকে বিয়ে করবে? কে জানে করতেও পারে। কারো সঙ্গে ওর কোনো ইমোশনাল সম্পর্ক আছে বলে তো মনে হয় না। সমীক্ষা নামের মেয়েটার কথা বললেও সেটা যে প্রেমের মতো সিরিয়াস কিছু নয় সেটা বোঝে অরুণিমা। ওকে নিয়ে গপ্পোগুলো বানানো কি না কে জানে। কোনো মেয়ের সঙ্গেই কখনো খুব একটা ঘনিষ্ঠ হয়নি টিটো। ঘনিষ্ঠতা বলতে তিতিরই একমাত্র মেয়ে যার সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই টিটোর এই ঝগড়া মারপিট, এই ভাব। দুজন দুজনের কাছে এতটাই সহজ যে ওদের সম্পর্কের মাঝে ইমোশনাল কিছু আছে বলে কখনও মনে হয়নি। অন্তত প্রেম তো নয়ই।
তিতিরকে খুব পছন্দ করে অরুণিমা সুপ্রিয় দুজনেই। ও খুব ভালো গান করে, তাও যেমন তেমন গান না। টপ্পা, পুরাতনী, অতুলপ্রসাদ। পড়াশুনায় ভালো, স্ট্রেট-ফরোয়ার্ড, ন্যাকামিবর্জিত। খুব সুন্দরী না হলেও বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। ওর প্রসঙ্গ উঠলে অরুণিমা প্রায়ই বলে এটা। শুনলেই টিটো ঠোঁট বাঁকায়। ওর সবকিছুরই সমালোচনা করে। হাজার গণ্ডা দোষ খুঁজে বার করে।
টিটোকে একটু বাজিয়ে দেখার জন্যে একদিন কায়দা করে বলেই ফেললো, হ্যাঁ রে টিটো, তিতির কারো সঙ্গে প্রেমট্রেম করে না?
টিটোর তখন লাস্ট সেমেস্টার চলছে। কলেজ থেকে ফিরে টিফিন করছে, চোখের সামনে হ্যারি পটার খোলা। কোনো উত্তর দিলো না। এই সময় ছেলের সঙ্গে হালকা গল্পগুজব চলে অরুণিমার। এই সময়টুকু দুজনেই খুব এনজয় করে।
--ভারি মিষ্টি মেয়েটা, দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। না রে টিটো?
বইএ চোখ রেখে চুপচাপ আপনমনে খেয়েই চলেছে টিটো।
--কি রে, আমার কথা কানে যাচ্ছে না তোর?
--যাচ্ছে, বলে যাও।
--কিছু বলছিস না যে? মনে হচ্ছে আমি যেন দেয়ালের সঙ্গে কথা বলছি।
--এখানে এখন তোমার নেয়ারেস্ট আমিই। দেয়ালগুলো অনেক দূরে। কাজেই কথাগুলো যে আমাকেই বলছো, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
--তাহলে উত্তর দিচ্ছিস না যে?
--অদ্ভুত কথা! তিতির প্রেম করে কিনা সেটা আমার জানার কথা নয়। তিতিরকে জিজ্ঞেস করলেই সেটা জেনে নিতে পারবে, সেটাই উচিত। ও তো কিছু লুকোয় না। আর কি যেন বললে, হ্যাঁ ওকে দেখলেই তোমার ভালোবাসতে ইচ্ছে করে, তা বাসো না। কে তোমাকে বাধা দিচ্ছে। এর মধ্যে আমার কী ভূমিকা?
এবার বই বন্ধ করে একপাশে সরিয়ে রাখলো টিটো। প্লেটের বাকি খাবারটুকু মুখে দিতে দিতে একবার তাকালো অরুণিমার দিকে। অরুণিমা এবার একটুও দ্বিধা না করে বললো, তোর কেমন লাগে ওকে?
টিটো খুব মজা পেয়েছে এমন মুখ করে বললো, আরে বাবা ভালো লাগে বলেই না ছোটবেলা থেকে বন্ধুত্বটা টিঁকে আছে আজও, মানে সহ্য করছি। তাই বলে তোমার মতো ওকে দেখলেই আমার মোটেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে না। বরং মাঝে মাঝে বেশ ইরিটেটিং লাগে।
--ইরিটেটিং লাগে !
--হ্যাঁ তাই। বেশি বেশি গার্জেনগিরি করা তো আছেই, তার ওপর যখন তখন ওর ওই কালোয়াতি কপচানো, ওহ হরিবল...
টিটোর কথা শেষ হওয়ার আগে ওর মাথায় একটা চাঁটি মারলো অরুণিমা।
--তা বটে, তোর মতো অ-সুরের কী করে ভালো লাগবে ওর মতো সুরেলা মেয়েকে?
এবার টিটো হো হো করে প্রাণ খুলে হাসলো। তারপর বললো-- মা, এতক্ষণ ধরে এত কায়দা করে তুমি যা বলতে চাইছো, দ্যাট ইজ সিম্পলি ইম্পসিবল। তোমার কথা শুনলে তিতিরও অট্টহাসি হাসবে। তুমি চেনো না ওকে ।
এ নিয়ে আর কখনও কিছু বলেনি। অরুণিমা ধরেই নিয়েছিল ও এখন নিজের কেরিয়ার নিয়েই ভাবছে, ওসব দিকে মন নেই।
বি টেক-এ খুব ভালো রেজাল্ট করেছিল। সুপ্রিয়র ইচ্ছে ছিল ও এম টেক করুক। টিটোও সেটাই ভাবছিল প্রথমে। তার পর কী হলো, ‘আমার বন্ধুরা সবাই চাকরিতে ঢুকে যাবে, আর আমি স্টুডেন্ট হয়ে পড়ে থাকবো?’ --এই ছিল ওর আক্ষেপ। হঠাৎ খুব ভালো অফার পেয়ে চাকরিতে জয়েন করলো। সেও দেখতে দেখতে প্রায় তিন বছর হয়ে গেল।
মাঝে মাঝে ভাবতে অবাক লাগে যে টিটো চাকরি করছে। ও কাছে থাকে না বলেই কি না কে জানে, আজকাল টিটোর ছোটবেলার কথা খুব বেশি করে মনে পড়ে। মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। অরুণিমা খবরের কাগজ পড়ছে, ছোট্ট টিটো দেখতে পেয়েই ছুটে এসে কাগজ আড়াল করে নিজের মুখটা অরুণিমার চোখের সামনে রেখে বলছে--মা তুমি কাগজ দেখো না, আমাকে দ্যাখো। মনে পড়তেই নিজের মনে হাসলো। চোখে জল চলে এলো। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেলে একটু একটু করে দূরত্ব তৈরি হয়। নিজস্ব আলাদা জগৎ নিয়ে তারা কিছুটা অচেনা হয়ে যায়। এটা বাস্তব। আর এই জায়গাটাতেই অবুঝ অরুণিমা। কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে টিটোর একটা আলাদা জগৎ থাকতে পারে, যা ওর অজানা। মা বলেন, একটা মাত্র সন্তান হলে ওই রকম হয়। তোদের দু’ভাইবোনকে নিয়ে কোনোদিন আমার মাথাব্যথা ছিল না। নিজেদের মতো বড় হয়েছিস। টিটোকে এবার একটু ছাড়। ও যথেষ্ট বুদ্ধিমান। কতকাল আর আগলে বেড়াবি?
তাই তো, কতকাল আর আগলে রাখা যাবে? এবার ও নিজেই আগল খুলে নিয়েছে হয়তো।
সুপ্রিয় বিকেলে ফোন করে জানিয়েছে, ফিরতে রাত হবে। ওর কলেজ জীবনের এক বন্ধু প্রবাল অসুস্থ। অফিস থেকে বেরিয়ে তাকে দেখতে দমদম যাবে। এখন অনেকটা সময় অরুণিমার একার। শোভা চলে যাওয়ার পর নিজের ঘরে এলো। একগাদা পুজোসংখ্যা পত্রিকা কিনেছে সুপ্রিয়। রিটায়ার্ড বউএর কথা ভেবে। তারই একটা নিয়ে বিছানায় উঠলো। শুয়ে শুয়ে ছাড়া পড়তে ভালো লাগে না। দু’চার পাতা পড়ে সরিয়ে রাখলো। মন বসছে না। নানারকম জল্পনা ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার মধ্যে। সবই টিটোকে ঘিরে। টিটো কি নিজেকে আড়াল করতে শুরু করেছে মায়ের কাছ থেকে? কিন্তু কেন? ও তো চিরকাল মায়ের সঙ্গে শেয়ার করে নিজের খুঁটিনাটি সব কথা? তাহলে হঠাৎ হলোটা কী? নিশ্চয় প্রেম করছে, তাতেই লুকোছাপা।
নিজেই একটা করে সম্ভাবনা সাজাচ্ছে মনে মনে, নিজেই তা নাকচ করে অন্যভাবে ভাবছে। অদ্ভুত একটা অস্থিরতা পেয়ে বসেছে। এত ভাবারই বা কী আছে, নিজেই নিজেকে বললো তারপর উঠে গিয়ে সামনের বারান্দায় দাঁড়ালো।
আজ ক’দিন বাড়ির সামনে রাস্তার আলোটা জ্বলছে না। সামনে ডানদিক ঘেঁসে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে। ফ্ল্যাটগুলো থেকে চলকে আসা আলোয় ওখানে একটা অদ্ভুত আলো আঁধারি তৈরি হয়েছে। তার নিচে দুটো ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। সেই বিকেল থেকে ওদের ওই একই ভাবে দেখছে অরুণিমা। এখান থেকে মুখ দেখা যাচ্ছে না, তবে ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে দুজনের মাঝে। কী ওদের সমস্যা কে জানে। কী ধরনের সমস্যা থাকে এখনকার এই বয়েসের ছেলেমেয়েদের জানতে খুব ইচ্ছে করছে অরুণিমার। টিটোর কি কোনো ইমোশনাল সমস্যা আছে? সম্প্রতি তেমন কিছু তৈরি হয়েছে?
রাস্তার উল্টো দিকের ফ্ল্যাটের মিসেস গুপ্ত জানালা দিয়ে লক্ষ্য করার চেষ্টা করছেন অরুণিমাকে। ও বারান্দার আলো জ্বালেনি বলে হয়তো ঠিকমতো বুঝতে পারছেন না। নাহলে এতক্ষনে জিজ্ঞেস করতেন--পুজোর কেনাকাটা হলো কি না, ছেলে কবে আসবে ইত্যাদি। সব সময় সব প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না। ঘরে চলে এলো। পাখার হাওয়ায় পাতা উড়তে থাকা খোলা পত্রিকাটা হাতে নিয়েও সেট আবার বন্ধ করে রেখে দিয়ে টিটোর ঘরে এলো।
শোভা তার রুটিন ঝাড়ামোছা করে যাওয়ার পরে অরুণিমা রোজ নিজের হাতে টিটোর পড়ার টেবিল, কমপিউটার আবার মোছে। নিয়ম করে ক’দিন অন্তর অন্তর বেডকভার পালটায়। সকালে নিয়ম করে জানালা খোলে সন্ধেয় আবার বন্ধ করে। কোনো কোনোদিন দুপুরবেলায় যখন বইটই পড়তে আর ভালো লাগেনা, তখন এসে কমপিউটারে বসে। নেট সার্ফিং করে। টুকটাক রান্নার রেসিপি দেখে। একবার বসলে কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যায়। এই নেশাটা টিটোই ঢুকিয়ে দিয়েছে ওর মধ্যে।এখন ইন্টারনেট খানিকটা বন্ধুর মতো হয়ে গেছে। যে কোনো সমস্যায় পড়লে টুক করে তার সমাধান মিলে যায়।
মাঝে মধ্যে রাতেও বেশ খানিকটা সময় কাটায় নেটে। সুপ্রিয় এক একদিন কিছুক্ষণ উঁকিঝুঁকি মেরে ‘প্রেমট্রেম করছো না তো?’ জাতীয় দু’চারটে টিপ্পনি কেটে শুতে চলে যায়। আজকে নিজের মানসিক সমস্যা নিয়ে একবার নেটের দ্বারস্থ হবে অরুণিমা। ফেসবুকের কথা মনে হলো। সারা পৃথিবী জুড়ে সম্পর্কের ডালপালা ছড়ানো। একটা ডালে হাত রাখলে হাজারটা পাতা কথা বলে।এখানেই খুঁজবে। জাল ফেলে ফেলে ছেলের মনের হদিস পেতে চেষ্টা করবে। টিটোর যেখানে যত কানেকশানস আছে, সব হাতড়ে বেড়াবে। মনটা বড় অস্থির হয়ে আছে। এই অস্থিরতার কথা সুপ্রিয়কে বললে পাগলামি বলে হেসে উড়িয়ে দেবে। ছেলে নিয়ে আদিখ্যেতা বলে ঠাট্টা করবে। ও কী করে বুঝবে ছেলেমেয়েকে ঘিরে মায়ের ছোট ছোট দুর্বলতা বাড়তে বাড়তে কখন গভীর উদ্বেগে পরিণত হয়। কেবলই মনে হচ্ছে হঠাৎ করে টিটো যেন অনেক দূরের হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে চোখের সামনে একটা হালকা পর্দা বিছিয়ে আছে, টিটোকে ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না। পর্দাটা সরানো দরকার।
অনেকদিন আগে টিটোপ্রথমে ওকে অরকুট চিনিয়েছিল।তখন ও ইলেভেন বা টুয়েলভ এ পড়ে।
--নিজেকে একটু আপডেট করো না কেন?
--থাম তুই, আমি যথেষ্ট আপডেটেড ।
--অফিস আর গল্পের বইএর বাইরে তোমার আর কোনো কিছুতেই ইনটারেস্ট নেই। তুমি ছাড়া পৃথিবীর সব মানুষ এখন ইনটারনেট-এর সঙ্গে যুক্ত।
--কী আছে ইন্টারনেটে?
--এভরিথিং। যা চাও সব পাবে। এমন কি বন্ধুও। গল্প, আড্ডা কী চাও? নতুন বন্ধু তো হবেই, এমন কি তোমার কোনো পুরোনো হারিয়ে যাওয়া বন্ধুরও দেখা পেয়ে যেতে পারো।
--কী করে?
--নেট তোমাকে খুঁজে দেবে। দেখো দারুণ ইনটারেস্টিং লাগবে।কোথা থেকে সময় কেটে যাবে টেরই পারবে না।বুঝলে?
--এটা বুঝলাম তুই পড়ার নাম করে সারাক্ষণ কমপিউটারে বসে আড্ডা দিস।
জড়িয়ে পড়লো অরকুট জালে। প্রোফাইলে ওর একটা অল্পবয়েসের ছবি দিয়ে টিটো বললো, দেখো না কত লোক প্রোপোজ করে তোমাকে। প্রথম প্রথম বেশ মজা লাগতো। অফিস থেকে ফিরে টিটো না ফেরা পর্যন্ত অরকুট। নিজের চেয়ে টিটোর প্রোফাইলে ঢুকে ওদের বন্ধুদের কথাবার্তা পড়তেই মজা লাগতো। সব কথা বুঝতেও পারতো না। ওদের নিজেদের কিছু কোড ল্যাঙ্গুয়েজ আছে। কখনও মাথা ঘামায়নি তা নিয়ে। অরকুটের মাধ্যমে অনেক নতুন মানুষের সঙ্গেও পরিচয়, কয়েকজন ভালো বন্ধুও পেয়েছে। সে বন্ধুত্ব এখন প্রায় আত্মীয়তার পর্যায়ে চলে এসেছে। ভুবনগ্রামের স্বজন সব। আর টিটোর কথামতো সত্যি সত্যি বহুদিন পরে, হারিয়ে যাওয়া একজন প্রিয় মানুষকেও ফিরিয়ে এনেছিল অরকুটই।
রুবি। বিভাসমামার মেয়ে। বিভাসমামা মায়ের খুড়তুতো দাদা।অরুণিমার মামারা দেশভাগের পরই এক্সচেঞ্জ করে এপারে চলে এসেছিল। কৃষ্ণনগরে প্রচুর গাছপালা ঘেরা অনেকটা জমি নিয়ে মামাদের বেশ বড় বাড়ি। ছোটবেলায় বছরে অন্তত দু’বার কৃষ্ণনগরে মামাবাড়িতে বেড়াতে আসতো অরুণিমা। বাবার কলেজ ছুটি থাকলে সঙ্গে আসতেন, নাহলে ওদের দু’ভাইবোনকে নিয়ে মা একাই। তখনই একবার আসার পর ওর দাদা অনির্বাণকে আর ফিরে যেতে দেননি মামারা। কৃষ্ণনগরের স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন।
রুবির সঙ্গে তখন অরুণিমার গলায় গলায় ভাব। হইচই, খেলা, একসঙ্গে গল্পের বই পড়া। দু’জনে মিলে ছাদের ঘরে শুয়ে সেই প্রথম লীলা মজুমদারের ‘হলদে পাখির পালক’ পড়ে আপ্লুত হওয়া। রুবিও গল্পের বই পড়তো খুব। তখন কত আর বয়স হবে, বড়জোর দশ এগারো। অরুণিমার তুলনায় রুবি একটু বেশি পাকা ছিল। অনেক অ্যাডাল্ট বিষয় নিয়ে কথা বলতো ও। শুনে অরুণিমা লজ্জা পেতো বটে, কিন্তু আকর্ষণও বোধ করতো। বয়ঃসন্ধির অনেক টুকটাক ব্যাপারও বলতো রুবি। বড় হলে মেয়েদের যে প্রতিমাসে একটা বিশ্রী কষ্টের দিন আসে, সেটা রুবির কাছেই প্রথম জেনেছিল। ওর চেয়ে কাছের মানুষ তখন আর কেউ ছিল না অরুণিমার। বিভাসমামা কোলইন্ডিয়ায় চাকরি করতেন। চাকরির কারণেই ওরা জব্বলপুর চলে গেল।
এর পর থেকে মামাবাড়ি গেলেও রুবির সঙ্গে আর দেখা হতো না। তখন থেকেই যোগাযোগটা বিচ্ছিন্ন হয়েগিয়েছিল। সত্যি বলতে কি রুবি ধীরে ধীরে অরুণিমার ভাবনাবৃত্তের বাইরে চলে গেল। ওর ছবিটাও ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল।
তারপর বহু বছর পর অরকুট-এ আবীরা পিল্লাই নামে একজনের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করেছিল অরুণিমা। একদিন একটা মেসেজ পেল। আবীরা লিখেছে, তুমি কি আমার জয়পুরহাটের ইরাপিসিকে চেনো? আগে খুব একটা গা করেনি, কিন্তু মেসেজটা পেয়ে ‘জয়পুরহাট’ আর ‘ইরাপিসি’ এই শব্দদুটো বুকের ভেতর বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা স্পর্শ দিলো। বুঝলো, পিল্লাই হলেও আসলে ও বাঙালি। কিন্তু বুঝতে পারছিল না আবীরা কে? মাকে ফোন করলো, তুমি আবীরা বলে কাউকে চেনো? মা-ও বলতে পারলেন না।
অগত্যা অরুণিমা লিখলো--আমি জয়পুরহাটের একজন ইরাকে চিনি, যিনি আমার মা। কিন্তু আমি তো কোনো আবীরাকে চিনি না।
এবার উত্তর এলো--আবীরার নাম যদি রুবি হয়, আর অরুণিমা যদি ঝুমুর হয়,তাহলে নিশ্চয় চিনতে অসুবিধা হবে না।
উত্তেজনায় অরুণিমা কী করবে না করবে ভেবে পাচ্ছিল না। প্রাথমিক ঘোর কাটিয়ে লিখলো--তা হবে না, কিন্তু তুই পিল্লাই হলি কী করে? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর-–সেই কথা বলবো বলেই তো খুঁজে বেড়াচ্ছি তোকে। আবার সেই পুরোনো ভালোলাগা নিয়ে আবীরার পোশাক ছেড়ে প্রায় আটত্রিশ বছর আগের রুবি এসে সামনে দাঁড়ালো। ওর যে একটা পোশাকী নাম ছিল কোনোদিন খেয়াল করেনি। রুবি অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। ভালোবেসে ওর চেয়ে ষোলো সতের বছরের বড় এক মালয়ালি ভদ্রলোককে, বাড়ির ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও বিয়ে করেছিল বলে বাড়ির সঙ্গে, আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে দীর্ঘদিন কোনো যোগাযোগ ছিল না ওর। দুই ছেলে মেয়ে আর বরকে নিয়ে দিব্যি আছে। কথাবার্তায় বোঝা গেল বেশ আহ্লাদেই আছে। এখন ফোনেই মাঝে মাঝে কথা হয় রুবির সঙ্গে। এবার পুজোয় রুবিও আসছে কৃষ্ণনগরে। বলেছে দেখা করতে আসবে। টিটোকে দেখার জন্যে আকুল।ওর সঙ্গে নেটেই পরিচয় করে নিয়েছে রুবি।
তারপর তো অরকুট ছেড়ে সবাই এসে দাঁড়ালো মুখোমুখি, ফেসবুক-এ। অরুণিমাও। ভি আর এস নেওয়ার পর ফেসবুকটা প্রায় প্রতিদিনের অভ্যেসের মতো হয়ে গেছে।
ফেসবুক অ্যাকাউন্টও টিটোই খুলে দিয়েছিল।
--এবার পাসওয়ার্ড দাও।
--তুই কিছু একটা দিয়ে দে।
--পাসওয়ার্ডটা সবসময় খুব প্রাইভেট হয় মা। নিজের অ্যাকাউন্টের প্রিভেসি রাখো।
--তোর কাছে আমার আবার প্রিভেসি কিসের?
--ঠিক আছে পাসওয়ার্ড একটা দিয়ে দিচ্ছি আমি, তুমি পরে চেঞ্জ করে নিও।
টিটোই পাসওয়ার্ড ঠিক করে দিলো। কী করে পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করতে হয় শিখিয়ে দিলো। টিটোর পাসওয়ার্ডও জানে অরুণিমা। কারণ ওর সামনেই নিজের অ্যাকাউন্ট খোলে টিটো। দেখে দেখে মুখস্ত হয়ে গেছে। টিটোর বিশ্বাস মা ওর অ্যাকাউন্ট খুলে পারসোনাল মেসেজ পড়বে না। অরুণিমার কখনও মনেও হয়নি দেখার কথা। আজ মনে হচ্ছে। আজ দেখবে। কাজটা ঠিক না বেঠিক, তা নিয়ে আজ ভাববে না। যদি না পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে থাকে। অন্তর্জাল দিয়ে ছেঁকে তুলবে টিটোর মনের খবর।
অরুণিমা বুঝতে পারছে না সুপ্রিয় প্রবালের বাড়ি থেকে খেয়ে দেয়ে ফিরবে কি না। কিছু তো বললোও না সেভাবে। বন্ধুর সঙ্গে এতদিন পরে দেখা। অসুখটা সিরিয়াস কিছু নয়। আসলে গেট টুগেদার। আরও দু’চারজন বন্ধুও আসবে। ভাবলো ফোন করে জিজ্ঞেস করবে, পরক্ষণে মনে হলো, এখন ফোন করে খোঁজ নিতে গেলে বন্ধুরা ওর পিছনে লাগবে। বন্ধুরা এমনিতে সারাক্ষণ বলে, তোদের তো জন্ম থেকে প্রেম। প্রেমটা ওদের স্কুল জীবন থেকেই। দু’ক্লাস উঁচুতে পড়তো সুপ্রিয়। পাশাপাশি বাড়ি ছিল। ছোট থেকে একসঙ্গে খেলাধুলো, মারপিট করে বড় হয়েছে।
বিয়ের আগে পর্যন্ত বছর তিনেকের বিচ্ছিন্নতা। সুপ্রিয় পিএইচডি করতে ইউএসএ তে। সেখান থেকে চাকরি নিয়ে সিঙ্গাপুর।এক বছর পর বিয়ে। বিয়ের পর আরো দু’বছর সেখানেই দুজনের ঘরকন্যা। তারপর কলকাতায় ফিরে সেটলড। বছরখানেক সুপ্রিয়দের কোন্নগরের বাড়িতে, তারপর এই যোধপুর পার্কের ফ্ল্যাট। অরুণিমা তখন ব্যাঙ্কের চাকরিতে জয়েন করেছে। ফ্ল্যাটটা যখন সবে তৈরি হচ্ছে, প্রতিদিন অফিসের পর দুজনে দেখতে আসতো। কমপ্লিট হওয়ার পর একটু একটু করে সাজাতো। দিনগুলো স্বপ্নের মতো ছিল। টিটোর জন্ম এবং নতুন ফ্ল্যাটে গৃহপ্রবেশ প্রায় একই সঙ্গে।
ন’টা বাজে। আজ সুপ্রিয় একটু দেরি করে এলে কিছু মনে করবে না অরুণিমা।
তিতির ছাড়া আরও অনেক মেয়ে আছে ওর ফ্রেন্ডলিস্টে। অনেককেই শুধুই নামে চেনে। চোখ বোলাতে বোলাতে একটা নামের পাশে আটকে গেল অরুণিমা, তমা। যে নাম কখনও টিটোর মুখে শোনেনি। ছবি নেই। নামের পাশে রবীন্দ্রনাথের আঁকা নারীমূর্তি। মেসেজ বক্স খুললো। টিটোর সঙ্গে ওর কথাবার্তা অন্যদের থেকে একটু আলাদা। ওর ভাষা নরম, ভেতরে কোথাও একটা লুকোনো সুর আছে, একটু অন্যরকম সুর। ওর লেখা প্রত্যেকটি শব্দে কান পাতলে আপাত বাক্য বিনিময়ের নিচে অন্য কিছু শুনতে পাচ্ছে অরুণিমা। সঙ্গে সঙ্গে নিজের বুকের ভেতরও তিরতির করে কিছু বইছে টের পেলো। টিটোকেও অন্যরকম লাগছে। বাক্যগুলো গোগ্রাসে গিলছে অরুণিমা। নতুন কিছু আবিষ্কারের উত্তেজনায় নিশ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত বইছে। শঙ্কা আর আনন্দ মেশা একটা অদ্ভুত অনুভূতি...ডোরবেলের আওয়াজে ঘড়ির দিকে তাকালো। ন’টা দশ। সুপ্রিয় কি ফিরতে পারবে এত তাড়াতাড়ি?
আইহোল-এ চোখ লাগিয়ে দেখলো, পুজোর চাঁদা চাইতে এসেছে এপাড়ার কয়েকজন। দরজা খুললো। সবাই পরিচিত। ওপরের ফ্ল্যাটের মিঃ দত্তগুপ্তও আছেন এদের সঙ্গে। হাসিমুখে চাঁদার রসিদটা বাড়িয়ে দিল একজন। রসিদটা হাতে নিয়ে অরুণিমা দেখলো টাকার অঙ্ক লেখা নেই। এপাড়ায় এটাই দস্তুর। চাঁদার জন্যে কোনো জুলুম নেই। অরুণিমা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভদ্রতা করলো,
--ভেতরে এসে বসুন না আপনারা।
--না না তার দরকার নেই। আপনাকে আর তালা খুলতে হবে না।
শোভা চলে যাওয়ার পর কোলাপসিবল গেটে তালা লাগিয়ে দেয় অরুণিমা। কথা না বাড়িয়ে ভেতরে গেল। ব্যাগ থেকে একশ টাকার দুটো নোট বার করে নিয়ে ফিরে এলো। টাকা হাতে নিয়ে মিঃ দত্তগুপ্ত জিজ্ঞেস করলেন, টিটো আসছে তো পুজোয়?
--এখনও জানায়নি।
সত্যিই তো কিছু জানায়নি টিটো।
--করপোরেট চাকরিতে তো পুজোর ছুটি বলে কিছু নেই। ম্যানেজ করতে হয়।
দরজা বন্ধ করে এসে আবার কমপিউটারে বসলো।
মাস দেড়েক আগের মেসেজ। তমা লিখছে--কাল দুপুরে একটা বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দরজায় শব্দ শুনে ঘুম ভাঙলো। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখি কেউ কোথাও নেই। বাইরে ঝোড়ো হাওয়া এসে দরজার কড়া নাড়ছে। একদিন এমনি শব্দে দরজা খুলে তোমাকে দেখতে চাই। আসবে তো উপল?
উত্তরে টিটো লিখছে--যাবো। গেলে কিন্তু ঝোড়ো হাওয়ার মতোই তোমাকে উড়িয়ে নিয়ে ফিরে আসবো।
--বেশ তাই হবে। ছিন্ন করে কাছি, আমি ডুবতে রাজি আছি। না না ডুবতে নয়, উড়তে রাজি আছি।
গা শিরশির করে উঠলো অরুণিমার। এসব কি টিটোর জীবনে ঘটছে? টিটো কি এই ভাষায় কথা বলছে? বলতে পারে? কী করে শিখলো ! অদ্ভুত লাগছে, কিন্তু পড়তে ভালো লাগছে। নিজের কথা মনে হলো, সুপ্রিয় তখন ইউ এস এ-তে, অরুণিমা রাজশাহীতে। রেগুলার চিঠি লিখতো দুজনে। ওর নিজের চিঠিও এমনি রবীন্দ্রনাথের গানের টুকরো দিয়ে ভরা থাকতো।
ভালো লাগছে মেয়েটাকে,টিটোর জীবনে জুড়ে আছে ভেবে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু শুধু একটা নামকে কী করে ভালোবাসবে? কিছুই তো জানে না। টিটোর কাছে জানতে চাইবে? মায়ের কাছে কখনো তো কিছু লুকোয় না টিটো। নতুন কারো সঙ্গে পরিচয় হলেও এসে অরুণিমার সঙ্গে গল্প করে। এই প্রথম মনে হচ্ছে একটা আড়াল তৈরি হয়েছে। হয়তো লজ্জা পাচ্ছে তাই কিছু বলছে না। জানতে চাইলে বলবে নিশ্চয়। ওর যদি কারো সঙ্গে প্রেম হয়েই থাকে সেটা অরুণিমার কাছে লুকোনোর কী আছে? অরুণিমা তো চায় অন্য একটি মেয়ে ভালোবাসুক, আগলে রাখুক টিটোকে। তাকে অরুণিমাও ভালোবাসবে। কিন্তু ওকে আড়াল করে টিটোর একটা অন্য পৃথিবী গড়ে উঠেছে, যা ও জানে না, কিংবা টিটো ওকে জানাতে চায় না--এটা ভাবলেই অস্থির লাগছে। কিছু কি হারিয়ে যাচ্ছে ওর? কষ্ট হচ্ছে অরুণিমার।
হঠাৎ খেয়াল হলো অনেকক্ষণ থেকে ল্যান্ডফোন বাজছে। উঠে গিয়ে অন্যমনস্কভাবে ফোন ধরলো। ওপাশে সুপ্রিয়।
--কী ব্যাপার ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি? মোবাইলে কল করলাম, ধরলে না।
--টিটোর ঘরে ছিলাম। মোবাইলটা আমাদের বেডরুমে।
--তুমি খেয়ে নাও। প্রবাল না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়বে না। আমি খেয়ে নিয়েই বেরিয়ে পড়বো। চিন্তা কোরো না।
--ঠিক আছে। বেশি রাত কোরো না। সাবধানে এসো। সংক্ষেপে কথা সারলো।
রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দিয়ে খানিকক্ষণ বসে থাকলো ফোনের পাশে। তারপর আবার তুললো রিসিভার। অর্ণবের মোবাইল ফোনে কল করলো। ওপাশে রিং হচ্ছে।
--বলো কাকিমা।
--তোর খাওয়া হয়েছে?
--হ্যাঁ জাস্ট খেয়ে এলাম। কিছু বলবে?
--হ্যাঁ রে অর্ণব, টিটো তোকে সব কথা বলে?
--মোস্ট প্রোবাবলি।
--তমা কে রে?
--ওর বন্ধু।
--তোর আর তিতিরের মতো বন্ধু? সত্যি কথা বলবি।
--হ্যাঁ...না...মানে...হ্যাঁ।
--তোতলাচ্ছিস কেন?
--না, মানে...ধরে নাও ওইরকমই।
--তাই ধরে নিলাম। কিন্তু কোথায় থাকে, দিল্লিতে?
--না না, বাংলাদেশে।
--বাংলাদেশে! কী করে পরিচয় হলো টিটোর সঙ্গে?
--ফেসবুকে। তারপর গত মাসে তমা দিল্লি এসেছিল।
--টিটোর সঙ্গে দেখা করতে?
--সেই রকমই ধরে নিতে পারো। ওর নিজেরও কী সব কাজ ছিল। তারপর আমাদের সঙ্গে একদিন দিল্লি ঘুরে দেখলো।
--তোদের দিল্লির ওই ছবিগুলোর মধ্যে তমা আছে?
--টিটো তোমাকে কোন ছবিগুলো পাঠিয়েছে আমি জানি না। ছবিগুলোর বেশিরভাগ তমার তোলা। তাই ও খুব কম ছবিতেই আছে। আমি গোটা চারেক ছবি তুলেছিলাম সেগুলোতে তমাকে দেখতে পাবে। ও দুধসাদা সালোয়ার কামিজ আর একটা নীল রাজস্থানী ওড়না পরেছিল। কাকিমা প্লিজ আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস কোরো না, তুমি টিটোর কাছে জেনে নিও। ও বলবে।
--মেয়েদের আউটফিটের ব্যাপারে তো খুব ভালো জ্ঞানগম্যি আছে তোর। ভালো বর্ণনা দিলি। ঠিক আছে। এবার বল টিটো পুজোয় আসবে না কেন? ওর অফিসের কাজের জন্যে?
--সম্ভবত বাংলাদেশে যাবে।
বুকের মধ্যে টান করে বাঁধা তারে আচমকা খুব জোরে কারো আঙুল ছুঁয়ে গেল। অর্ণবের কাছে আর কিছু জানার নেই। টিটোর সামনে এখন দুটো গন্তব্য। অরুণিমার কেন যেন মনে হচ্ছে টিটোকে কিছুতেই ছুঁতে পারছে না।এ যেন অন্য কেউ। যেন কোনো গল্পের চরিত্র। যেন নতুন পুজোসংখ্যার কোনো গল্প পড়ছে অরুণিমা।
ফোন রেখে টিটোর পাঠানো ছবিগুলো আর একবার মেলে ধরলো। না দুধসাদা সালোয়ার-কামিজ আর নীল রাজস্থানী ওড়না পরা মেয়েটি নেই। কোথায় পাবে তাকে, যে এমন তীব্রভাবে টানছে টিটোকে? যে অরুণিমার রক্তগ্রন্থিকে এভাবে চ্যালেঞ্জ করছে। যার জন্যে পুজোয় ছুটি নিয়ে টিটোর গন্তব্য কলকাতা নয়, বাংলাদেশ। আর সেই কথাটা মাকেও জানানোর প্রয়োজন মনে হয়নি ওর। কাল টিটো ফোন করবে। কিন্তু মাঝখানে এই কয়েক ঘন্টা অরুণিমাকে অস্থির করবে ওর কৌতূহল। নিজেরই বাড়াবাড়ি লাগছে, কিন্তু নিজেকে কনট্রোল করতেও পারছে না।
ফেসবুক লগ আউট করে টিটোর ‘মাই ফেভারিট’ ফোল্ডারটা খুললো। মাত্র পনেরটা ছবি। বেশিরভাগ টিটোর ছোটবেলার। অরুণিমার কোলে ওর একুশদিন বয়সের ছবিও আছে। আছে সুপ্রিয় আর অরুণিমার বিয়ের ছবিও। শুধু দুটো ছবিকে চেনে না অরুণিমা। একটা ক্লোজআপ, সম্ভবত স্টুডিওতে তোলা, অন্যটা কোনো নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ওই একই জনের ছবি। অরুণিমার মাথার ভেতর ফ্রিজ হয়ে থাকা দুধসাদা সালোয়ার কামিজ আর নীল রাজস্থানী ওড়না নয়। এ ছবিও দিল্লির নয়। অন্য কোথাও, কোনো এক নদীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চুল খোলা। নীল তাঁতের শাড়িতে। ক্লোজআপ ছবিটিতে মেরুন টি-সার্ট, দুই ভ্রুর মাঝখানে শুধু ছোট্ট একটা মেরুন টিপ।চোখের পাতা দীর্ঘ আর এত ঘন যে মনে হয় কাজল পরে আছে। ভারি মিষ্টি মুখখানা। এই কি তাহলে তমা? টিটো ওর বিশেষ প্রিয় ছবির তালিকায় রেখে দিয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে দেখলো অরুণিমা, অনেকক্ষণ। ছবিটার দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছে। অন্য কিছু, কিন্তু সেটা ঠিক স্পষ্ট নয় ওর নিজের কাছেও। খুব আবছা ভাবে যেন অন্য একটা ছায়া ভেসে আসছে ভাবনার ওপর। অন্য কোনো ছবি কি? অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে অরুণিমা।
ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে খাবার টেবিলে এলো। অনেক রাত হয়ে গেছে। সুপ্রিয় ফেরার আগে যাহোক কিছু খেয়ে না নিলে ও এসে বকাবকি করবে। খেতে ইচ্ছে করছে না একদম। তবু খাবার নিয়ে বসলো। দু’মিনিটে খাওয়া শেষ। বেসিনে মুখ ধুতে এসে চোখে জলের ঝাপটা দিতে দিতে হঠাৎ মনে হলো ওই মুখটা ওর চেনা। কোথাও দেখেছে আগে। কোথায় সেটা এই মুহূর্তে মনে করতে পারছে না।কোনো কোনো মানুষকে দেখলে মনে হয় একে আগে কোথাও দেখেছি, সেটাও হতে পারে। বিকেল থেকে নানাভাবে এত বেশি ভাবছে আরমেয়েটাকে ভালো লেগেছে বলেই মনে হচ্ছে চেনামুখ। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রায় পৌনে এগারোটা বাজে। এমনিতে পাড়াটা বেশ জমজমাট। অনেক রাত অব্দি সামনের রাস্তায় লোক যাওয়া আসা করে। পাড়ার ছেলেরা আড্ডা দেয় মোড়ে। তবু সুপ্রিয় না ফেরা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছে না। যে কোনো কথা ওকে না বলে পারে না অরুণিমা। কিন্তু টিটোর এই ব্যাপারটা এখনই বলবে কি না ভাবছে। অন্তত টিটোর সঙ্গে কথা বলার আগে কিছু বলাটা উচিত হবে কি না। সুপ্রিয় সব কিছুই খুব সহজভাবে নেয়। ও হয়তো গুরুত্বই দেবে না। তবু বলতে তো হবেই। এই ভার একা বহন করা যাচ্ছে না।