পরদিন বিকেলের দিকে অরুণিমাই ফোনটা করলো। প্রথমবার উত্তর মিললো না। আবার ডায়াল করলো, প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করা অপেক্ষার পর ফোনের ওপাশে সাড়া পাওয়া গেল–হ্যালো!
--আমি কি তমার মায়ের সঙ্গে কথা বলছি?
--হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কে বলছেন?
--বল তো কে?
--গলা শুনে চিনতে পারছি না।
--যদি বলি আমি ঝুমুর? অরুণিমা।
--তবু বুঝতে পারছি না। মানে নামটার সঙ্গে আমি পরিচিত না।
--ইয়ার্কি হচ্ছে? খুব রেগে আছিস আমার ওপর না রে?
--আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।
--এবার কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে রুমা।
অন্যপ্রান্ত চুপ। চার পাঁচ সেকেন্ড। তারপরই লাইনটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। অরুণিমা বুঝতে পারলো ফোনটা ইচ্ছে করে কেটে দিলো। কিন্তু কেন? অরুণিমাকে হতভম্ব লাগলো।রুমা আচমকা ওভাবে ফোন কেটে দিল কেন? এত অভিমান? ঠিক আছে,অভিমান হতেই পারে। তা বলে কথাও বলবে না? কোথাও কিছু ভুল হলো না তো? ভুল কী করে হবে, তমা তো কাল রাতে বললো ওর বাবার নাম ইকবাল, ফিজিক্স নিয়ে রাজশাহী ইউনিভারসিটিতে পড়তো। আর ওর নিজের মুখে তো রুমার মুখ বসানো। সুপ্রিয়ও ত কাল দুজনের ছবি মিলিয়ে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, দুটো মুখ একদম একইরকম।অঙ্ক তো সব মিলে গেছে। কাল রাত থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে ভাবছিল এবার শুধু ছেঁড়া সুতোটা জুড়ে নেওয়া। সব হিসেব তো ঠিকই আছে।
কিন্তু কোথায় ঠিক আছে। নিশ্চয় কোথাও একটা ছন্দপতন আছে রুমা আর ইকবালের গল্পে, যেটা ঠিকমতো বুঝতে পারছে না। ওরা কি আর একসঙ্গে থাকে না? তমা শুধু বাবার কাছে থাকে? তাই কি রাজশাহী প্রসঙ্গে মায়ের কথা বললো না? আবারও এক ঝলক কুয়াশা এসে ঘিরে ধরলো। ভেতরে ভেতরে অস্থির লাগছে।
সন্ধেবেলায় সুপ্রিয় বাড়ি ফিরে অরুণিমার মুখের দিকে চেয়ে একটু অবাক হলো। ওর তো উৎফুল্ল থাকার কথা, এতক্ষণে রুমাবৃত্তান্ত শুরু করার কথা। সুপ্রিয়ও সেই কৌতূহল নিয়েই বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু এত অন্যমনস্ক আর গম্ভীর কেন? কিছু জিজ্ঞেস করলো না। ফ্রেশ হয়ে এসে বসার ঘরের সোফায় বসে খবরের কাগজের পাতা ওলটাতে লাগলো। একটু পরে দুকাপ চা নিয়ে ঢুকলো অরুণিমা। ম্রিয়মাণ গলায় ফোনের ব্যাপারটা বললো। সব শুনে সুপ্রিয় বেশ অবাক হলো।
--তুমি নম্বর ভুল করোনি তো?
--না, না। নম্বরটা যে ভুল হয়নি, এ ব্যাপারে আমি শিওর। প্রথমত তমা আমাকে ফেসবুকের মেসেজবক্সে টাইপ করে নম্বর পাঠানোর পর আমি ফের ওর কাছেই কনফারম করে নিয়েছি। দ্বিতীয়ত আমি যাকে ফোন করেছিলাম, প্রথমে তো বললোই সে তমার মা। এমন তো হতে পারে, রুমা ভয়ঙ্কর রকম অভিমান করে আছে, আজকের ঘটনা তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। হতে পারে কাল ও নিজেই ফোন করবে। ও ওইরকমই। আমি যখন বললাম,‘এবার কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছিস রুমা’-- ও যদি রুমা নাই হবে, তাহলে ফোন রাখার আগে আমি রুমা নই গোছের কিছু একটা বলতো। কিচ্ছু না, আচমকাই কেটে দিলো লাইনটা।
--কেটে দিলো ভাবছো কেন, এমনিও তো কেটে যেতে পারে লাইনটা।
--আমি তারপর আরো তিনবার কল করেছি। প্রথম বার ‘নো রেসপন্স’, তারপর থেকে সুইচড অফ। তার মানে আমার ফোনটা ধরতে চায় না। তমা এরপর যখন ফেসবুকে আমাকে মিট করবে, ওকে কি বলবো এই ফোনের ব্যাপারটা?
সুপ্রিয়কেও বিচলিত লাগলো। ভ্রু কুঁচকে কিছ ভাবলো চুপচাপ। তারপর বললো,
--তমা নিজে থেকে যদি জানতে চায় তবেই, তুমি আগ বাড়িয়ে এখনই কিছু বোলো না। তুমি শুধু কায়দা করে ওর মায়ের নামটা জানতে চাইবে।
--মায়ের নাম তো ওর মুখেই লেখা আছে।
--সে তো আমিও দেখেছি।তবুও। এটা টিটোও করতে পারে।
--না, এখন আর সেটা হয় না। আমার সঙ্গে অলরেডি ইন্ট্রোডিউস করিয়ে দিয়েছে তমার। এখন টিটোর পক্ষে ‘তোমার মায়ের নাম কী’ এসব ফালতু কথা জিজ্ঞেস করা খুব বাজে হবে! আর তাছাড়া টিটো একদম কায়দা করে কথা বলতে জানে না। দেখা যাক তমার সঙ্গে ফেসবুকে আবার কথা হলে ব্যাপারটা কী ভাবে হ্যান্ডেল করা যায়, তখন ভাবা যাবে।
সুপ্রিয়র মনে হলো ও নিজেও ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলছে নিজেকে। ওরও কৌতূহল বাড়ছে।
স্তব্ধ হয়ে বসে আছে কান্তা। নিজের হৃৎস্পন্দন নিজের কানেই আঘাত করছে। প্রায় ছাব্বিশ বছরের ওপার থেকে যেন তীক্ষ্ণ সিসের টুকরোর মতো কানে এসে লাগলো একটা দু’অক্ষরের শব্দ। আরএকটা আবছা ভয়ের ডানা ছায়া ফেললো ওর ওপর।
কান্তার পৃথিবীতে ওই শব্দটা নিষিদ্ধ ছিল এতদিন।ও নিষিদ্ধ করে রেখেছিল ছাব্বিশ বছর ধরে। ওর শর্ত ছিল, ওই নাম উচ্চারিত হবে না।ওদের তিনজনের পৃথিবীতে তার কোনো চিহ্ণ রাখা চলবে না। কারণ রুমা থাকলে তমাকে ও সবটুকু পাবে না। ইকবালকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল ওই একটি শর্তে।
নিজের প্রবল আপত্তি ছিল। পরিজনদের প্রবল চাপে তাদের ওপর তীব্র অভিমান নিয়ে নিরুপায়ের মতো সম্মতি দিয়েছিল। বিয়েটাকে আত্মহত্যার নামান্তর মনে হয়েছিল সেদিন। তবু সম্মতি দিতে হয়েছিল। তখন দিনের পর দিন লুকিয়ে চোখের জল ফেলেছে। যুদ্ধ করেছে নিজের ব্যক্তিগত স্বপ্নের সঙ্গে। তারপর এগারো মাস বয়েসের শিশুটি যখন ‘মা মা’ বলে গলা জড়িয়ে ধরেছিল, মুহূর্ত কুমারী মেয়ের বুকের মধ্যে একজন মাকে জেগে উঠতে দেখেছিল।একটু একটু করে রূপান্তর ঘটছিল কান্তার। তখন থেকেই স্বার্থপরের মতো বুকে আগলে রেখেছে তমাকে। এমন কি ইকবালের কাছেও খুব একটা ঘেঁষতে দিতো না ওকে।
ইকবালও অবশ্য মেয়ের প্রতি খানিকটা উদাসীন ছিল।এই ছাব্বিশ বছর রুমার প্রসঙ্গ কোনোদিন কেউ উচ্চারণ করেনি তমার সামনে। এমনকি ইকবাল একবারের জন্যেও নিজে থেকে কান্তার কাছেও রুমা সম্পর্কে একটি শব্দও বলেনি। দৃশ্যত নামটা সমেত মানুষটা মুছে গিয়েছিল। অবচেতনে থাকলেও কখনো মনেও পড়েনি।
অরুণিমাকে খুব ভালোভাবেই চেনে কান্তা। অনেকবার শুনেছে। শুধু চেনা নয়, ইকবালের সঙ্গে ওর নিজের এই অবাঞ্ছিত দাম্পত্যের মাঝখানে কোথাও না কোথাও লেগে আছে অরুণিমার নামটা, এটাও জানে। কিন্তু এতদিন পর ও হঠাৎ ফোন করলো কেন? ও যে সব ঘটনা জানে না, সেটা তো বোঝা গেল। কিন্তু তমা কী করে পৌঁছে গেল ওদের কাছে? তমার কথা জানলো কী করে? ওকে চিনলো কী করে? কান্তার ফোননম্বরই বা পেলকীভাবে? তাহলে কি ইকবালের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে? তা যদি হয়ে থাকে, ইকবাল কি কিছু বলেনি ওকে? সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। মাথার ভেতরটা জট পাকিয়ে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে।
--মা, কে ফোন করেছিল?
--রং নাম্বার। অন্য কাউকে খুঁজছিল।
তমা একটু থমকে গেল,মনে মনে ভাবলো উপলের মা নয় তো?
--কী নাম বললো বলো তো?
--কি যেন একটা বললো, ঠিক মতো বুঝতে পারলাম না। নাম জিজ্ঞেস করছিস কেন?
--একজনের ফোন করার কথা ছিল তোমাকে, তাই।
--কে সে?
--উপলের মা। আমার কাছ থেকে তোমার নম্বর নিয়েছিলেন কাল।
--আমাকে বলিসনি তো?
--ভদ্রমহিলা বলেছিলেন তোমাকে সারপ্রাইজ দেবেন। সেইজন্যে নামটা জানতে চাইলাম, উনিই কি না।
--কী নাম তার?
--অরুণিমা।
চমকে গেল কান্তা। পরমুহূর্তে মনে হলো চারপাশটা দুলে উঠলো। এবার কি তাহলে চুরচুর হয়ে ভেঙে যাবে ওর দালানকোঠা! তমা এ কোন ঘূর্ণি টেনে আনলো! সারা শরীরে একটা অস্বস্তি, মনে হলো হাত পা কাঁপছে। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই। দৃশ্যত কান্তাকে বিধ্বস্ত লাগছে। তমা অবাক, অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে আছে কান্তার দিকে। তবে কি ফোনটা উপলের মায়েরই ছিল? তবে কি অপ্রীতিকর কিছু কথাবার্তা বিনিময় হয়েছে? কিন্তু কাল রাতে ভদ্রমহিলার কথাবার্তায় আব্বু আর মায়ের প্রতি উষ্ণ আন্তরিকতাই তো মনে হয়েছিল। মায়ের পাশে গিয়ে বসলো তমা। জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ রেখে বলল,
--কী হয়েছে মা?
--শরীরটা ভালো লাগছে না। এক গ্লাস পানি দে।
--দিচ্ছি,একটু চা খাবে? আমি মনিরাকে বলছি চা দিতে।
--না। চা খাবো না, শুধু পানি আন।
তমা দ্রুতপায়ে গিয়ে এক গ্লাস জল নিয়ে এসে কান্তার মুখের কাছে ধরলো। ওর পেছন পেছন মনিরা এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে।
--আম্মার কী অইছে গো আপা?
--কিছু না। তুই যা।
কান্তা তমার হাত থেকে জলের গ্লাসটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে ঢকঢক করে জলটা খেয়ে নিয়ে তমার দিকে তাকালো।
--তুই কোথাও বেরোবি?
--ভেবেছিলাম তোমাকে নিয়েই বেরোবো। কিন্তু তোমাকে আজ আর বেরোতে হবে না। একটু শুয়ে থাকো। কে জানে প্রেশারটা ঠিক আছে কি না। আমি কি ডাক্তার চাচাকে একবার আসতে বলবো মা?
--না। এমন কিছু হয়নি। কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি বলেই হয়তো...তুই নিজেই ঘুরে আয় না।
--না থাক, আজ আর বেরোবো না। তুমি একা থাকবে...
--আমি তো একাই থাকি রে। এর চেয়ে শরীর খারাপ হলেও ওই মনিরাকে নিয়েই একা থাকি। টায়ার্ড লাগছে, অন্য কিছু না। ঘুম না হলে আমার এমন হয় মাঝে মাঝে। তুই ঘুরে আয়। আমি একটু খানি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি, তুই ফিরে এসে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।
--ঠিক বলছো তো? আমি বরং নীপাদের বাসায় যাই। ও রাজি হলে ওকে নিয়েই আমার একটু টুকটাক কেনাকাটা সেরে আসবো।
তমা বেরিয়ে যাওয়ার পরই ইকবালকে ফোন করলো কান্তা। জানে ইকবালের এসময় অফিসে বেরোনোর ব্যস্ততা থাকে, তবু। ওর যে জীবন মরণের সঙ্কট। ইকবালের সঙ্গে কথা না বললেই নয়। ইকবাল খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন ধরলো।
--কী ব্যাপার, এসময় হঠাৎ ফোন করছো? সব ঠিক আছে তো?
--না ঠিক নেই। আমি কী করবো বুঝতে পারছি না। তুমি যেভাবে হোক ওই ছেলেটার এখানে আসা আটকাও।
--কার কথা বলছো?
--কাল বললাম না তমা বলেছে? সেই ইন্ডিয়ার ছেলেটা।
--ও আচ্ছা। কেন কী হয়েছে?
কান্তা ভেঙে পড়া আতঙ্কিত গলায় বললো, ও অরুণিমার ছেলে। কাল অরুণিমা এখানে ফোন করেছিল।
--অরুণিমার ছেলে! কী সব যা তা বলছো? অরুণিমা তোমাকে ফোন করেছিল!
--না আমাকে না। অরুণিমা ফোন করেছিল তাকে।
--তুমি কী বললে?
--বললাম রংনাম্বার।
-ওর নম্বরটা আমাকে দাও।
--আমার একদম ভালো লাগছে না ইকবাল। দম বন্ধ হয়ে আসছে। কিছু একটা করো।
--শান্ত হও। তুমি এ নিয়ে চিন্তা কোরো না। আমি দেখছি।
প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল, তখনই ফোন বাজলো। বিরক্ত ও হতাশ অরুণিমা ফোনটা নিয়ে অচেনা নম্বর দেখে রিসিভ না করেই আবার শুয়ে পড়লো। সুপ্রিয় আলো নেবাতে নেবাতে বললো, ফোনটা ধরলে না?
--অচেনা নম্বর, রং নাম্বার হবে। সারাদিন অদ্ভুত অদ্ভুত নম্বর থেকে ফোন আসে। চাকরির অফার, ইনভেস্টমেন্ট...
--এত রাতে নিশ্চয় সেসব ফোন আসবে না, ধরলে পারতে।
--ছেড়ে দাও না বাবা। আমার ভালো লাগছে না।
--বাংলাদেশের কেউ নয়তো?
--তুমি ভাবছো রুমার ফোন? এখন রাত বারোটার বেশি বাজে। ওদের রাত আরো আধঘন্টা এগিয়ে গেছে। এত রাতে কোনো ভদ্রলোকের বাড়িতে কেউ ফোন করে না। আর তুমি যে ফোনের কথা বলতে চাইছো, সেই নম্বরটা সেভ করা আছে আমার ফোনে।
ওদের তর্কের ভেতর আবারও ফোনটা বাজলো। এবার সুপ্রিয় হাত বাড়িয়ে অরুণিমার ফোনটা নিয়ে আলোটা জ্বাললো।
--এটা লং ডিসট্যান্স কল ঝুম। সম্ভবত ইউএসএ।
--ধরো তো।
--হ্যালো!
--সরি, আমি অরুণিমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছি। বুঝতে পারছি না নম্বরটা ভুল হলো কি না।
--না, ভুল হয়নি। কথা বলুন।
ফোনটা চট করে অরুণিমাকে ধরিয়ে দিলো সুপ্রিয়। অরুণিমা একটু শঙ্কিত গলায় বললো,
--অরুণিমা বলছি।
--আমি ইকবাল। এবার উত্তেজিত ভাবে উঠে বসলো অরুণিমা।
--সত্যি !
--হ্যাঁ নির্মম সত্যি।
--আমার নম্বর তোকে কে দিলো?
--আজ তুই বাংলাদেশে যাকে ফোন করেছিলি, সে দিয়েছে। আগে বল তুই কেমন আছিস?
--ভালো না।
--কেন, কী হয়েছে?
--তার আগে বল রুমার কী হয়েছে? ও এমন বিশ্রী ব্যবহার করলো কেন আমার সঙ্গে। অভিমান হতেই পারে, মানছি আমার দোষ আছে। যোগাযোগটা আমিই আগে ডিসকনটিনিউ করেছি। তাই বলে......।
উত্তেজিত অরুণিমা ঝড়ের গতিতে বলে যাচ্ছিল, ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিল ইকবাল – অরুণিমা, শান্ত হয়ে আমার কথা শোন। অনেক অনেক কিছু জানানোর আছে তোকে। তুই এখন আর কিছু বলিস না, শুধু চুপ করে শোন।
পাশে উৎকর্ণ হয়ে শুয়ে আছে সুপ্রিয়। অরুণিমা ফোনের লাউডস্পিকার অন করে দিলো।
--তুই চলে যাওয়ার পর অদ্ভুত রকম ডিপ্রেশানে ভুগছিল ও। আমাদের দেখা হলেই একই কথা--‘ঝুমুরের সঙ্গে আর দেখা হবে না?’ কিম্বা ‘ঝুমুরকে আর দেখতে পাবো না?’ আমাদের মধ্যে যেসব কথাবার্তা হত, ইনফ্যাক্ট ও বলতো, যার বেশিটাই তোকে কেন্দ্র করে। এটা ঠিক যে আমিও তোকে মিস করতাম, সেজন্যেই ওর কষ্টটা শেয়ার করার চেষ্টা করতাম। ওর পাগলামিকে প্রশ্রয় দিতাম, ক্ষমা করে দিতাম। আমাদের বিয়ের পরও খুব একটা পরিবর্তন হলো না। একদিন কাঁদতে কাঁদতে বললো,ইকবাল আমি ঝুমুরকে পাগলের মতো ভালোবাসি, ওকে ছেড়ে থাকতে আমার কষ্ট হয়। এমনভাবে বললো, শুনে আমি শকড। ওর কথার মধ্যে এমন কিছু ছিল, তোকে বোঝাতে পারবো না। তখন থেকে ব্যাপারটাকে খুব বাড়াবাড়ি মনে হতো। শেষ দিকে অসহ্য লাগত। সিম্পলি অসহ্য। তোকেও। দুঃখ পাস না, আজ স্বীকার করছি সহ্য করতে পারতাম না তোকেও। তোর নাম শুনলেও অসহ্য লাগতো। তারই মধ্যে তমা এলো। ভেবেছিলাম ও পালটাবে। কোথায় কী? মেয়ের দিকেও খুব একটা মনোযোগ ছিল না। শেষ অব্দি কাউন্সেলিংএর জন্যে ওকে এক সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছেও নিয়ে গিয়েছিলাম...।
ফোনের ওপাশে একটু নীরবতা। সুপ্রিয় উঠে বসেছে। ওর চোখে মুখে রীতিমতো উত্তেজনা। লক্ষ্য করছে অরুণিমার নীরক্ত মু্খ। পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে।
--এক বাড়িতে থাকা ছাড়া ওর সঙ্গে আক্ষরিক অর্থেই আর কোনো সম্পর্ক রইলো না। আলাদা ঘরে ঘুমোতো। ও আমাকে সহ্য করতে পারতো না, চাইতো না আমি ওর কাছে আসি। যত দিন যাচ্ছিল, এটা বাড়ছিল। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে বড্ড অপমানিত লাগতো। তবু আমি অনেক চেষ্টা করেছি, বিশ্বাস কর। অসহনীয় সেই দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাল লাগে না। তবু তোকে জানানো দরকার, তাই বলছি। তমার যখন আটমাস বয়েস তখন রুমা নিজেই নিজেকে শেষ করে দিলো। একটুখানি চুপ করে থেকে ইকবাল বললো,
--রুমা আর কোথাও নেই অরুণিমা।
অরুণিমার গলা দিয়ে নিজেরই অজান্তে একটা আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এলো। সুপ্রিয় পাশ থেকে জড়িয়ে ধরলো ওকে। অরুণিমার খেয়াল হলো এত কথার মাঝে ইকবালের মুখ থেকে প্রথম রুমার নামটা শুনলো। মনে হলো কোনো নিষিদ্ধ নাম উচ্চারণ করলো।
--অরুণিমা, তুই যার সঙ্গে কথা বলেছিস সে রুমা নয়।
--তাহলে !
--কান্তা। রুমার খালাতো বোন। রুমার মা তার বছর খানেক আগে মারা গেছেন। আমার আম্মা তো প্যারালাইজড, তোর মনে আছে কি না জানি না। তমাকে দেখার কেউ ছিল না। আমি তখন কিছু ভাবতে পারছিলাম না। রুমার মৃত্যুর তিন মাস পরে আত্মীয় স্বজনের পীড়াপীড়িতে তমার দায়িত্ব নিতে রাজি হলো কান্তা। ওর একটাই শর্ত ছিল, তমার জীবন থেকে রুমার অস্তিত্ব মুছে ফেলতে হবে। সমস্ত চিহ্ন, এমন কি ওর নামটাও কেউ উচ্চারণ করবে না এ বাড়িতে। অরুণিমা, তোরা এটাকে নিষ্ঠুরতা কিংবা স্বার্থপরতা ভাবতে পারিস, আমি ভাবি না। কারণ আমি জানি কান্তা কতটা স্যাক্রিফাইস করেছে। এই বিয়েটা থেকে ও তমাকে ছাড়া আর কিছু পায়নি। নেয়নি।
--আমি কিছুই ভাবছি না ইকবাল, আমার ভাবার মতো কিছু রেখেছিস?
--আমি রাখার কে? আমার মতো অবস্থায় পড়লে তোরা কী করতিস আমি জানি না। আমিতো মেয়েকে অরফানেজে পাঠাবো ভেবেছিলাম। এই বিয়েটায় আমার মত বা অমত কোনোটাই ছিল না। শুধু চাইছিলাম মেয়েটাকে একটা কেউ বুকে তুলে নিক। কান্তা সেটাই করেছিল। ‘একটা খণ্ডিত সম্পর্ককে গ্রহণ করেছি, অন্যটা সম্পূর্ণ চাই’--এই ছিল ওর দাবী। আমি সে দাবী মেনে নিয়েছিলাম। অরুণিমা, তোর ফোন পেয়ে কান্তা অসহায়ের মতো আমাকে ফোন করেছে। পাগলের মতো করছিল। ওর মনে হচ্ছিল অদৃশ্য রুমা তমাকে এবার কেড়ে নেবে ওর কাছ থেকে। তমা জেনে যাবে রুমার কথা। জেনে যাবে কান্তা ওর মা নয়। ওকে অনেক বোঝালাম যে তমার কাছে রুমা বলে কারও অস্তিত্ব নেই। ওকে আশ্বস্ত করেছি যে তুই ওর আবেগকে বুঝবি। রুমাকে ফিরিয়ে আনবি না তমার জীবনে।
--আমি ফিরিয়ে আনার কে? রুমা তো তমার রক্তের ভেতর আছে, সেটা ভুলে যাস না।
--ভুলতে চাই, সত্যিই সেটা ভুলতে চাই। ভুলতে পারলে আমি বেঁচে যেতাম। কিন্তু তুই কী চাস বলতো? আগে বল, উপল তোর ছেলে?
--হ্যাঁ। কিন্তু তোরাই বা আমাকে ভিলেন ভাবছিস কেন?
--তমার সঙ্গে তোর ছেলের যোগাযোগ হওয়াটা অলৌকিক ঘটনার মত লাগছে আমার কাছে। আমি জানি না ওদের সম্পর্কটা কী, আর কতখানি। শুধু তোকে এটা জানানো দরকার যে কান্তা চায় না ওদের মাঝে কোনো যোগাযোগ থাক। ইনফ্যাক্ট বলতে খারাপ লাগছে সমস্যাটা তোর ছেলেকে নিয়ে নয়, তোকে নিয়ে। কান্তা চায় না তুই আমাদের জীবনে ফিরে আসিস। প্লিজ অরুণিমা। ওর ভয়, তুই আসা মানে রুমার ফিরে আসা।
--আমার কাছে কী আশা করিস?
--তুই আপাতত তোর ছেলের বাংলাদেশে আসাটা আটকা। তারপর আমি দেখছি কী করা যায়।
--এ ভাবে কি দুটো মানুষকে বিচ্ছিন্ন করা যায়? সারা পৃথিবী জুড়ে ইন্টারনেট বিছানো,কার থেকে কাকে আড়াল করবি তুই?
--এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি কী করতে পারি আমি জানি না, তুই একটু হেল্প কর প্লিজ। আমি এখন অফিসে। তোকে পরে আবার ফোন করবো, এখন রাখছি।
ইকবাল ফোনটা কেটে দিলো। আচমকাই সুপ্রিয়কে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো অরুণিমা। কিছুতেই থামাতে পারছে না নিজেকে। সুপ্রিয়র মনে হলো এই কান্নাটা রুমার জন্যে যতটা, তার চেয়ে বেশি এমন একটা বিশ্রী ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ার কারণে।
ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল সুপ্রিয়র। অভ্যেসবশত পাশ ফিরে অরুণিমাকে জড়াতে গিয়ে দেখলো অরুণিমা বিছানায় নেই। ও সচরাচর এত ভোরে ওঠে না। ওর বিছানা ছাড়ার সময় সাতটা থেকে সওয়া সাতটা। সুপ্রিয় আরো দশ পনের মিনিট পরে ওঠে। অন্যদিন হলে ভাবতো হয়তো বাথরুমে গেছে। আজ সেটা মনে হলো না। অরুণিমাকে দেখতে না পেয়ে নিজেও ঝটপট উঠে পড়লো। রাস্তার দিকের ব্যালকনির দরজা খোলা। বারান্দায় বেতের দোলনাটায় চুপ করে বসে আছে অরুণিমা। সুপ্রিয় জানে সারারাত ঘুমোয়নি ও। যখনই ঘুম ভেঙেছে সুপ্রিয়র, দেখেছে এপাশ ওপাশ করছে।
সুপ্রিয়কে দেখে অরুণিমা বললো, এত সকালে উঠেছ কেন?
--ঘুম ভেঙে গেল।
--ঘুম ভাঙলেই যেন ওঠো রোজ?
ম্লান হাসলো অরুণিমা। সুপ্রিয় মোড়া টেনে ওর পাশে বসলো। হাত দুটো নিয়ে নিজের দুই গালে চেপে ধরলো। অরুণিমা আস্তে করে নিজের হাত দুটো টেনে নিয়ে বললো,
--যাও ব্রাশ করে নাও। আমি চা বসাচ্ছি।
--বোসো, তাড়া কিসের? শোভাদি আসুক।
--শোভাদি তো আসবে সেই কখন, আমার একটু চা খেতে ইচ্ছে করছে।
--তুমি বোসো, আমি চা করবো আজ।
--আমি জলটাতো বসিয়ে আসি।
--ভোরবেলায় চোখ খুলে অ্যাডাল্ট দৃশ্য দেখলে ঘাবড়ে যাবে পাড়া প্রতিবেশি।
--যাও তুমি চোখ মুখ ধুয়ে এসো।
জল বসিয়ে চায়ের সরঞ্জাম সাজিয়ে রেখে সামনের কোলাপসিবল গেটের তালা খুললো। তারপর খবরের কাগজটা নিয়ে ডাইনিং রুমে এসে বসলো অরুণিমা। নিজের সমস্ত ভাবনার ওপর একটা কুয়াশা বিছিয়ে আছে, কোনোদিকেই কিছু যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। টিটোকেও না। সামনে শুধু রুমার একটা আবছা অবয়ব। প্রায় মুছে যাওয়া পেন্সিল স্কেচের মতো।
চা করে নিয়ে এসে সুপ্রিয় দেখলো, খবরের কাগজ যেমনকার তেমনি পড়ে আছে, অরুণিমা পাতা ওলটায়নি। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে চুপচাপ। একটু শব্দ করেই কাপদুটো রাখলো সুপ্রিয়। অরুণিমা ফিরে তাকালো। নিঃশব্দে কৌটো থেকে বিস্কুট বার করে একটা বাড়িয়ে ধরলো সুপ্রিয়র দিকে। বিস্কুটটা হাতে নিয়ে সুপ্রিয় বললো – আজ যাদবপুর যাবে ঝুম? আমি অফিস যাওয়ার আগে তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবো।
অরুণিমা চায়ে আলতো চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রাখলো টেবিলে। সামান্য হাসার চেষ্টা করলো।
--আমি ঠিক আছি। তুমি চিন্তা কোরো না। আসলে কাল থেকে যা সব ফেস করছি, তার পুরোটা এখনও আত্মস্থ করতে পারিনি। ভাবছি...
--একা ভেবো না। তোমার যা মনে হচ্ছে, মানে যা ভাবছো, আমার সঙ্গে সেটা শেয়ার করো ।
--আমার শুধু মনে হচ্ছে চরিত্রগুলো আমার চেনা বটে কিন্তু ওদের মধ্যে নিজেকে আইডেন্টিফাই করতে পারছি না।
--কী করে করবে? ওই অরুণিমাকে পিছনে ফেলে তুমি আজ অন্য একজন মানুষ, টিটোর মা, শ্রীমতী সুপ্রিয় বোস। সময় আর বয়স তো মানুষের রূপান্তর ঘটায়।
--আর রুমা? রুমার ওই রূপান্তর? অস্বাভাবিকতা-–তাও আমাকে ঘিরে! ভাবলেই কেমন লাগছে।
--রুমার রূপান্তর বলছো কেন, বাই নেচার ওটাই রুমা। তুমি বুঝতে পারোনি। তোমাকে কি কখনো অস্বস্তিতে ফেলেছে ও?
--না,তা ফেলেনি। আসলে আমি ব্যাপারটাকে অন্যভাবে ভাবিইনি কখনও। ভাবতাম পাগলামি, আবেগের বাড়াবাড়ি।
--এখনও তাইই ভাবো। নতুন করে রুমাকে জাজ কোরোনা, ও যখন নেই। আর জেনো এর মধ্যে তোমার কোনো ভূমিকা নেই। এটা ইকবাল আর কান্তার প্রবলেম।
--রুমা যদি আজ বেঁচে থাকতো, তাহলে তাই ভেবে ঝেড়ে ফেলতাম ব্যাপারটা। তুমি বুঝতে পারছো না, আমাকে রুমা কী বিশ্রী একটা গ্লানির মধ্যে ফেলে দিয়ে গেছে। আমার দিকে আঙুল তুলছে ইকবাল, ওর বউ। সব কিছু জানতে পারলে তমাও তুলবে, তারপর টিটো। ওদের সব জটিলতার কেন্দ্রে আমি, এটা কী করে মেনে নেবো যে আমার কারণেই আত্মহত্যা করেছে রুমা? ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো অরুণিমা।
সুপ্রিয় ওকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা মেয়ের মতো আদর করলো।
--এমন কোরো না। ভেবে দেখ ইকবাল যা বললো তার সবটাই নিজের সাপোর্টে। এর একটা অন্যদিকও তো থাকতে পারে। ইকবালের সব কথা বিশ্বাস করছি না আমি। আমাকে একটু ভাবতে দাও। উঁহু, আর না। প্লিজ ঝুম, খানিকক্ষণ ভুলে যাও ওদের কথা। আমাদের অনেকটা সময় ওরা নিয়ে নিয়েছে কাল থেকে, ইনফ্যাক্ট ক’দিন থেকে। এবার নিজের কথা ভাবো।
সুপ্রিয় বেরিয়ে যাওয়ার পর শোভাকে টুকটাক কাজের নির্দেশ দিয়ে খবরের কাগজটা নিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো অরুণিমা। মনের সঙ্গে শরীরটাও বিধ্বস্ত লাগছে। শোভা স্নান করতে যাওয়ার জন্যে তাড়া দিচ্ছে। কারণ এই সময় অরুণিমা রোজ স্নান করে নেয়, শোভা সেইমতো গিজার চালিয়ে দিয়েছে। অরুণিমার বারোমাস ইষদুষ্ণ জলে স্নান করা অভ্যেস। ওর মুখ চোখ দেখে শোভা বুঝতে পারছে কিছু একটা হয়েছে। জিজ্ঞেস করতে সাহস পাচ্ছে না। বাথরুমে ঢোকার বদলে ঘরে গিয়ে বিছানায় শুতে দেখে কাছে গেল।
--বৌদি কী হয়েছে তোমার?
--রাতে ঘুম হয়নি ভালো। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে।
--আদা গোলমরিচ দিয়ে আমার চা-টা একটু করে দেবো?
--মন্দ হয় না। দাও তো।
‘আমার চা’ বলতে শোভা সিটিসির গুঁড়ো চা-এর কথা বোঝাতে চেয়েছে। অরুণিমারা খুব ভালো ফ্লেভারড দার্জিলিং চা খায়। শোভার ওতে পোষায় না। বেশি করে দুধ চিনি দিয়ে ফুটিয়ে সারাদিনে প্রায় পাঁচ ছ’বার চা খায় ও। কাজেই ওর জন্যে আলাদা চায়ের ব্যবস্থা। সুপ্রিয় বাড়ি না থাকলে অরুণিমা মাঝে মধ্যে আদা দিয়ে শোভার ওই চা-টা খেতে ভালোবাসে।
শোভা রান্নাঘরে যাওয়ার একটু পরেই ল্যান্ডফোন বাজলো। উঠতে ইচ্ছে করলো না। ভাবলো শোভা ধরবে। ফোনটা বেজে বেজে থেমে গেল। আবার রিং হলো। নিজে উঠবে কি উঠবে না ভাবতে ভাবতেই অরুণিমার হঠাৎ মনে হলো এটা টুপুর নয় তো? ও কেন যেন বেশিরভাগ সময় ল্যান্ডফোনে ফোন করে। ওর সব অদ্ভুত যুক্তি, ‘যখন খুব রিল্যাক্স করে কথা বলার জন্যে তোমাকে ফোন করি, ল্যান্ডলাইনে কল করতেই ভালো লাগে। কথা বলতে বলতে তোমার ঘরদোর সমেত তোমাকে দেখতে পাই মনে মনে। মোবাইলটা হলো মেসেজ দেয়া নেয়ার জন্যে, কোথায়, কোন অবস্থায় আছো কিছুই আন্দাজ করা যায় না।’
উঠে ফোন ধরতে যেতে যেতেই ফের কেটে গেল। আবার বাজলো। ঠিকই ধরেছে, টুপুর।
--পিসি স্নান করতে গিয়েছিলে?
--না রে।ও ঘরে ছিলাম, আসতে আসতে কেটে গেল। বল।
--আমি একটু আসছি, তোমার কোথাও যাওয়ার নেই তো?
--না। কিন্তু তোর আজ ক্লাস নেই?
--একটা ছিল সকালের দিকে। আর নেই। আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে লাঞ্চ করবো।
অরুণিমার মনে হলো প্ল্যানটা নিশ্চয় সুপ্রিয়র। আজ অরুণিমা যদিও একা থাকতে চাইছিল, তবু টুপুর আসবে জেনে ভালো লাগছে। ওর সঙ্গে সব কথা শেয়ার করা যায়। ফোন রেখে শোভাকে ডাকলো।
--কী রান্না হয়েছে আজ?
--পেঁপে দিয়ে মুগডাল, বাঁধাকপির ডালনা আর পারসে মাছের ঝাল।
--ও তো আবার পারসে মাছ খায় না। ফ্রিজে চিকেন আছে তো?
--আছে, কেন?
--তুমি সেই যে সাদা চিকেন কর, ওটা খুব ভালোবাসে টুপুর। একটুখানি করে রাখো।
--ও, টুপুরদিদি খাবে, তা আগে বলোনি তো।
--এই তো ফোন করে বললো।
--ভেবো না। ও কী ভালোবাসে আমি জানি। একটু পোস্তোর বড়াও করে দেবো। তুমি চা খেয়ে নিয়ে চট করে স্নানটা করে নাও তো এবার।
সুপ্রিয় খুব উদ্বেগ নিয়ে অফিসে গেছে আজ। ওর যাওয়ার আগে অরুণিমা নিজেকে যথাসাধ্য স্বাভাবিক রেখে হেসেছে, সন্ধেবেলায় তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছে। তবু সুপ্রিয় বেরোনোর সময় ওকে আদর করে বলে গেছে, একা কিছু ভেবো না, আমি ফিরলে দুজনে মিলে ভাববো। আমাকে ফোন কোরো, একটা পর্যন্ত আমার মিটিং, তারপর ফ্রি।
--তাই হবে। তুমি নিশ্চিন্তে এবার এসো তো। আমি কি বাচ্চা মেয়ে নাকি?
নিশ্চিন্ত যে হয়নি, তার প্রমাণ টুপুরের হঠাৎ আগমন। নিজের ঢাউস ব্যাগ ছাড়াও একটা পলিব্যাগ হাতে ঢুকলো টুপুর। দুটো ব্যাগই বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে থাকলো দু’তিন মিনিট, তার পর উঠে বসলো। প্যাকেট থেকে দুটো শাড়ি বার করে অরুণিমার সামনে রাখলো।
--দেখো কোনটা নেবে?
--আমার শাড়ি তো বরাবর তুই পছন্দ করিস।
--করি, দুটো শাড়িই যেহেতু আমার সমান পছন্দ, তাই তোমাকে বলছি একটা বেছে নিতে।
--অন্যটা কী করবি? এই সরু পাড় শাড়ি তো তোর মা নেবে না।
--আমি নেবো। মাকে টাকা দিয়ে দিয়েছি, বাবার সঙ্গে গিয়ে কিনে নেবে।
--শাড়ি কিনতে তুই নিয়ে গেলি না কেন মাকে?
--মাফ করো। দোকানে গিয়ে মা আমার সবচেয়ে অপছন্দের শাড়িটা খুঁজে বার করবে,এটা সহ্য করা যায়?
--আর তোর মা তো বলে, তুই দোকানে গিয়ে সবচেয়ে ম্যাটমেটে শাড়িটা পছন্দ করিস।
--বলে বুঝি?
টুপুর উঠে গিয়ে রান্নাঘরে একবার উঁকি দিয়ে এলো। ফিরে এসে অরুণিমার দুটো হাত নিজের হাতে নিয়ে বললো, তুমি এমন অফ কেন পিসি? কী হয়েছে? বরাবর তোমাকে দেখলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়, আজ মন খারাপ লাগছে। কারণটা কি আমি? গতকালের কনভার্সেশান?
ওর প্রশ্ন এড়িয়ে গেল অরুণিমা।
--তোর পিসে তোকে ফোন করেছিল?
--কেন বলো তো?
--না হলে এমনি এমনি তুই শাড়ি পছন্দ করাতে চলে এলি ক্লাস বাদ দিয়ে !
--কে বললো ক্লাস বাদ দিয়েছি?
--সপ্তাহে তোর পাঁচদিন তিনটে সাড়ে তিনটে পর্যন্ত ক্লাস থাকে, আমি জানি।
অরুণিমা চুপ করে গেল। টুপুরও আর কথা বাড়ালো না।
আজ সাড়ে নটায় একটা ক্লাস করে সবে বেরিয়েছে, তখনই সুপ্রিয়র ফোন – টুপুর আজ একবার তোর পিসির কাছে যেতে পারবি দুপুরের দিকে?
--কেন বলো তো?
--ও ভালো নেই।
--টেনশানে ফেলে দিও না, কী হয়েছে সেটা খুলে বলবে তো?
--ফোনে এখন সবটা তো তোকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না। খুব ডিপ্রেসড হয়ে আছে, তুই ওর কাছে জেনে নিস পুরো ব্যাপারটা।
--তুমি ভেবো না, আমি দশটা পনেরর ক্লাসটা নিয়ে চলে যাবো।
ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে একবার বাড়ি গেল। শাড়ির প্যাকেটটা নিয়ে সোজা এখানে।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর দুজনে টিটোর ঘরে এসে বসলো। রুমার গল্প টুপুর আগে অনেকবার শুনেছে অরুণিমার কাছে। নিজের কলেজ, ইউনিভারসিটি, হস্টেল, বন্ধুবান্ধবের কথা গল্পচ্ছলে শর্মিলা, টুপুরকে অনেকবার বলেছে অরুণিমা। নিজের মানসিক সঙ্কটের কথা বোঝাতে গিয়ে আজ আবার বহুদিন আগের পুরোনো কথারা টুকরো টুকরো হয়ে ফিরে এলো। টুপুর মন দিয়ে সবকিছু শোনার পর বললো – দেখ পিসি ওদের তিনজনের জটিলতার মাঝখানে ‘অরুণিমা’ এই বায়বীয় শব্দটাই শুধু ছিল, কোনোভাবেই তুমি ছিলে না। মানে তোমার কোনো ভূমিকা ছিল না,এটা তো মানবে? তুমি কেন গিল্ট ফিল করছো? ওদের জীবনে যা কিছু ঘটেছে তোমার অজ্ঞাতসারেই ঘটেছে। ওরা নিজেরাই ঘটিয়েছে। তোমার কোনো দায় নেই। কেন মিছিমিছি নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো?
--কিন্তু এখন আমি তো ওদের কাছে বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছি। এটা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না।
--তুমি নও, তোমার নামটাই শুধু। আসল সমস্যাটা ওদের নিজেদের। সরে দাঁড়াও।অ্যাভয়েড করো ওদের।
--অ্যাভয়েড করো বললেই কি এত সহজে তা করা সম্ভব? সমস্যা শুধু ওদেরই বা বলি কী করে? সেটা এখন আমার ঘরেও ঢুকে পড়েছে যে। টিটো জড়িয়ে গেছে ওদের সঙ্গে। ইনফ্যাক্ট সমস্যাটা টিটোর জন্যেই হয়েছে। নাহলে তো আমি জানতে পারতাম না। রুমা তো মুছে গেছে।
টুপুর দুইহাতের মাঝে চিবুক রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলো। অরুণিমার মুখের দিকে একবার দেখে নিয়ে বললো,
--তুমি টিটোর ওই বাঙলাদেশের বন্ধুর কথা বলতে চাইছো তো? কী যেন নাম মেয়েটার?
--তমা। জানিস তুই ওর কথা?
--হ্যাঁ টিটো বলেছে আমাকে। খুব গুরুত্ব দিইনি আমি। ওটাকে প্রেম ভাবছো কেন? মেয়েটাকে ওর ভালো লেগেছে। ওর সঙ্গে কথা বলে নাকি এক ধরনের মজা আছে। খুব সুন্দর কথা বলে। ওর চারপাশের চেনা মেয়েদের থেকে একদম আলাদা। এইটুকুই বুঝেছি টিটোর কথা থেকে।
--তমাকে নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। খুব চমৎকার মেয়েটা, আমারও খুব ভালো লেগেছে। যদিও আমার সঙ্গে যেটুকু কথাবার্তা হয়েছে, তা দিয়ে কাউকে বোঝা যায় না। কিন্তু টিটো আর ওর কথাবার্তা থেকেই বেশ লেগেছে আমার। কেন জানি না একটা টান অনুভব করছি।
--সে তো ও রুমার মেয়ে বলে।
--তোর কি মনে হয় টিটোর সঙ্গে ওর সম্পর্কটা প্রেমের?
--না মনে হয় না। দুটো ছেলেমেয়েতে একটু অন্তরঙ্গতা হলেই তাকে প্রেম ভাবতে হবে, এই সেকেলে বস্তাপচা ধারণাটা ছাড়ো তো। ওর যদি সত্যিকারের প্রেম কারো সঙ্গে থেকে থাকে সে তিতির।
হঠাৎ কিছু মনে পড়েছে সেইভাবে বললো, আচ্ছা তিতিরের কী খবর বলো তো? অনেকদিন দেখিনি ওকে।
--ও তো এখন বাঙালোরে থাকে। কলকাতায় এলেই আসে আমাদের কাছে। সবসময় দেখা করতে না পারলেও ফোনে খবর নেয় আমাদের।
--আমার কিন্তু ওকে বেশ লাগে।
--আমারও তো। আমি অনেকবার ঘুরিয়ে জানতে চেয়েছি তিতিরের কথা, টিটো এমন উড়িয়ে দিয়েছে ব্যাপারটা। এমনিতে দুজনে খুব ভালো বন্ধু। ও অর্ণব আর টিটো সেই স্কুল থেকেই তো একসঙ্গে।
--আমি শিওর টিটোর সঙ্গে ওর অ্যাফেয়ার আছে, শুধু বন্ধুত্ব না।
--ধ্যাৎ, ওদের দুজনকে দেখলে আর তিতির প্রসঙ্গে টিটোর কথাবার্তা শুনলে তুই একথা বলতিস না।
--ওইতো মজা, তোমরা বুঝবে না ওসব।
--সেটা হলে আমরা দুজনেই খুশি হতাম। তিতিরকে তোর পিসেও খুব পছন্দ করে।
--আচ্ছা বেশ তোমার কথামতো আপাতত তিতিরের কথা ছেড়ে দিলাম। তমা মেয়েটা দেখতে কিন্তু ভারি মিষ্টি ।
--দেখতে তো ঠিক রুমার মতো। কিন্তু তুই কী করে দেখলি ওকে?
--টিটো আমাকে দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় ওদের বেড়ানোর কিছু ছবি পাঠিয়েছিল হোয়াটস আপে। তাতে ওর বন্ধুদের যাদের আমি চিনি না, তাদের সব্বাইকে মার্ক করে দিয়েছিলো। টিটো বলেছে, তমার স্বভাবটা অনেকটা তোমার মত, সেজন্যেই ওর ভালো লাগে ওকে।
--কম্পিউটারটা খোল।
টুপুর অরুণিমার কথামতো কম্পিউটার অন করে তমার ছবি দুটো বার করলো।
--আরে তাই তো। সেই যে দিদানের ঘরে ছোটো কাঠের আলমারিটার ওপর একটা ফটোস্ট্যান্ডে তোমার আর তোমার বন্ধুর একটা ছবি থাকতো আগে, তমাকে একদম একই রকম দেখতে। টিটোর পাঠানো ছবিতে খেয়াল করিনি, গ্রুপ ছবি দেখে অত কিছু মনে হয়নি।
শোভা চা নিয়ে ঢুকতেই অরুণিমা ঘড়ির দিকে তাকালো, পাঁচটা বেজে গেছে। অন্য সময় এখানে এসে বিকেল হলেই উঠি উঠি করে টুপুর। আজ নিশ্চিন্তে গড়াচ্ছে। উঠে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে শোভাকে বললো, শোভাদি মুখরোচক কিছু খাওয়াও তো। শোভা খুশি হয়ে বেরিয়ে যেতেই অরুণিমা বললো,
--টিটো সম্পর্কে ইকবালের কথা তো শুনলি।
--হুঁ, লোকটা খুব সুবিধেবাদী।
--আগে কিন্তু এইরকম ছিল না। সে যাকগে, প্রেম হোক, বা শুধু বন্ধুত্ব ওরা চায় না টিটোর সঙ্গে ওদের মেয়ের কোনোরকম যোগাযোগ থাকুক। কারণ টিটো আমার ছেলে। আমি কী করে আটকাবো টিটোকে বল তো? এত কথা এত কাণ্ডের পর মা হয়ে আমিই বা কী করে চাইব ও যাক ওদের কাছে, এমন অবাঞ্ছিত হয়ে? ইনফ্যাক্ট এখন আমিও চাই না তমার সঙ্গে ওর যোগাযোগ থাক, সে বন্ধু হোক আর প্রেমিকাই হোক। ইকবালদের ওইসব জটিলতার ভেতর আমি কিছুতেই যেতে দেবো না টিটোকে।
--তমা কী দোষ করলো? ও তো এসবের বিন্দু বিসর্গও জানে না।
--টিটো ছাড়া অন্য কারো কথা আমি ভাবতে চাই না।
--আমাকে টিটোর ব্যাপারটা হ্যান্ডল করতে দাও।সম্পর্কটা যদি প্রেমেরও হয়, সব কিছু ওর জানা দরকার। কীভাবে জানাবো সেটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। তোমার বন্ধু ইকবালের কথা আমি ভাবতে রাজি নই। চাইলে ব্যাপারটা ওরা অন্যভাবে ট্যাকল করতে পারে। ও শুধু নিজের বউএর কথা ভাবছে, কেমন বাবা!
টুপুর লক্ষ্য করলো এসে যেমন দেখেছিল, অরুণিমার মুখের সেই জমাট বাঁধা মেঘ অনেকটাই হালকা হয়েছে। টুপুর সুযোগটা নিলো, পিসি আমি কিন্তু একটু পরেই কাটবো।
--আর একটু থাক, তোর পিসে আসা অব্দি।
টুপুরের মায়া হলো, আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তাহলে একটা ফোন করে নিই। উঠে বারান্দায় গেল টুপুর। ফিরে এসে একটু অন্যমনস্কভাবে বললো, পিসি আমি কাল পরশু আবার আসবো। এখন আমাকে বেরোতে হবে গো। যাওয়ার আগে অরুণিমাকে জড়িয়ে ধরে একটু আদর করলো।
--তুমি এতটা ভেঙে পড়েছ কেন বুঝতে পারছি না। দেখ পিসি আসল সমস্যাটা কিন্তু ইকবালের, তোমারএকটাই চিন্তা ওদের ওই জটিলতার মাঝখানে টিটো যেন জড়িয়ে না পড়ে,তাই তো? আমার ওপর ভরসা রাখো।
(ক্রমশ)