বারণ করলাম । আমার যদিও জানতে ইচ্ছে করে খুব, কী হয়েছে ? কী এমন - যে লাবণ্যর মৃত্যু কামনা করেও ওর রোগ এমনকী অবিনাশকেও গোপন রাখতে হয় । কী এমন ? শেষ পর্যন্ত অতিরিক্ত আগ্রহ দেখালে হয়ত পেয়ে বসবে ভয়েই থামতে হয় । না জানতে চাইব না কিছু । বললাম, প্লিজ আমার ইন্টারেস্ট নেই এসবে, কথা দিয়েছি যখন, চেষ্টা করব ।
স্কুলের সিলেবাস প্রায় শেষ । বাকি থাকার মধ্যে শুধু ক্লাস ফাইভের । ওদের প্রশ্ন অবশ্য আমারই । আঠারো প্রশ্নমালা থেকে অঙ্ক দিইনি আর । ভয় ছিল, যদি শেষ না হয় । এখন অবশ্য শেষ না হলেও ঝামেলা হবে না তেমন । বড়জোর শেষ দিন প্রশ্নমালাটা ধরে দুটো অঙ্ক করিয়ে ছেড়ে দেব । বলব, পরীক্ষার জন্য করতে হবে না যাও- ।
ফাইভের বাচ্চাদের কাছে যেন ভেদাভেদ নেই কোনও । ভাল-মন্দ, সুন্দর-কুত্সিত, পাশ বা ফেল । সমস্যা ওদের মা-বাবাদের জন্যই । গতবার ফাইভের এক বাচ্চা ফেল করেও প্রণাম করে বসল আমাকে। ভাবলাম, পিঠ চাপড়ে দেব একটু । মার্কশিট খুলে দেখি `নট প্রমোটেড' । অপ্রস্তুতের একশেষ । তবুও পিঠ চাপড়ে হালকা করলাম একটু । কাকে যে করলাম বলা অবশ্য মুশকিল । সম্ভবত আমাকেই । টিচার্স রুমে সবার কী হাসি । বলল, সত্যি- ? বিশ্বাস করুন, অঙ্কে পাঁচ । সেকশান বি এর, রোল নাম্বারটা অবশ্য মনে নেই এখন । কালো মতো । নামটা কী যেন - এক মুহূর্তের জন্যই অবশ্য দেখা । মানে মার্কশিটটা । বোতাম নেই জামায় । চটিতে সেফটিপিন । ওরা অবশ্য কেউই চিনতে পারল না ছেলেটাকে । আমি যদিও খেয়াল রেখেছি ঠিক । মনে হয় চিনতে পারব । লম্বাটে মুখের । রোগা । ফেল করেছে যখন, এবার নিশ্চিত সি-তে । সুধাময় বলল, এদের আবার পাশ-ফেল !
নিজের কথা মনে পড়ছে ফের । হাফ ইয়ার্লির মার্কশিট পেয়েছি একবার, আমার তখন সেভেন কি এইট । সংস্কৃত বাদে ফেল সব বিষয়েই । রতন বলল, দেখাতে হবে না । দেখাতে হবে না মানে ? আমার তখন সেজকাকু, সেজকাকিমা । বললাম, মায়ের ভয় নেই আমার । রতন বলল, তাহলে নিয়ে যা । তবু, ওই নম্বর নিয়ে কাকেই বা দেখাতে ইচ্ছে করে । রতনকে বললাম, নম্বর বাড়ানো যাবে না ? ও ঘাড় নাড়ল । মার্কশিট দেখে বলল, দু বিষয়ে ফেল থাকবে তবু । সেজকাকু বলেছিল, অঙ্কে আর কটা নম্বর বাড়াতে পারলেই -। সেজকাকিমাও খুশি হয়েছিল খুব । সুবল সেবার যা বকা খেয়েছিল ! রতনের কাজ করা মার্কশিটে আর পাঁচটা নম্বর তুকতে পারলেই অঙ্কে লেটার - মানে আশি ।
কিছু ছেলে কিন্তু একটু আলাদা থাকেই । অন্তত কারও কাছে । যেমন ফাইভের সুব্রত। সেভেনের সমীরন বা প্রসূন- প্রসূন রাজবংশী ।
সেভেন বি-তে তো আজ বিরাট আবদার । প্রশ্ন বলে দিতে হবে স্যার । প্রশ্ন ? কীসের ? কেন ? `অঙ্কের' । অঙ্ক ? ওরা বলল, ফেল করে যাব স্যার ।
বললাম, না পড়াশুনা করলে -।
মনে পড়ল, আমাদের ছোটবেলার স্কুলের সেই গুহ স্যার ঠিক এই কথাটাই বলতেন । পড়াশুনা না করলে নিজের কবর -। উনি বলতেন, জীবনটা আসলে নিজের কবর নিজেই খোঁড়ার প্রতিযোগিতা । কে কত দ্রুত- । গুহ স্যার কষ্ট পেয়েছিলেন খুব । কেন যে মানিয়ে নিতে পারতেন না সবার সঙ্গে ? রিটায়ারমেন্টের পর পাননি কিছুই । স্ত্রী-ছেলের সঙ্গে তো স্কুলের চাকরি থাকাকালীনই গন্ডগোল । কী নিয়ে কে জানে ? একাই পড়েছিলেন । বাড়িতেই । দরজা ভেঙে বের করতে হয়েছিল । গন্ধ বেরিয়ে গিয়েছিল একেবারে । অন্তত আটচল্লিশ ঘন্টা নাকি পার হয়ে গেছে তখন ।
আমি কি কবর খুঁড়ছি সত্যিই ? আমরা ? গুহ স্যারের কথাটাকে কি সাধারণভাবে সত্যি বলা যাবে ? গুহ স্যার তবে ঠিকই খুঁড়েছিলেন । শেষ পর্যন্ত একা । প্রায় গর্তে ঢুকে পড়ার মতোই । তেমন করে বললে কবরে যাওয়াই ।
ওদের বললাম, খাতা না হয় নরম করে দেখব ।
- হবে না ।
ওরা বলল ক্লাস থেকেই নাকি বেরোতে দেবে না আমাকে ।
ওই যে বললাম, ভাল স্কুল নয় তেমন একটা । চারপাশে কলোনি । মিল ফ্যাক্টরি তো বন্ধই । ছেলেদের চেহারা দেখলেই বুঝবেন । আমাদের স্কুলে ছেলেদের বাবা মায়েরা আসে না খুব একটা । বা রিক্সা করে কোনও ছেলে এসেছে তেমনও মনে পড়ে না আমার । ওরা স্কুলে আসবে একা একাই - মানে দল বেঁধে যেমন স্কুলে যেতাম আমরা, ড্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম বা ঘুড়ির পিছনে দৌড় শুরু করে, কাদায় পড়ে গিয়ে নোংরা জামা প্যান্টসহ পুকুরে নামতাম- সেভাবেই । স্কুল ছুটি না হওয়া পর্যন্ত আমরা অবশ্য অপেক্ষা করতাম । সময়মতো বাড়ি ফিরে একটা মিথ্যেকে দাঁড় করাবার জন্য আমাদের অনেক কম কষ্ট করতে হত তখন !
অবিনাশ বলল, গভর্নিং বডিতে চেঞ্জ আসতে পারে ।
- কেন ?
- টের পাচ্ছেন না কিছু ?
- না তো- ।
- এম. এল. এ বলে পাঠিয়েছেন । মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানেরও তাই ইচ্ছে । নগেনবাবু প্রায় একঘরে ।
- তাই বলে এম. এল. এ. বললেই মানতে হবে ?
মুকুন্দদার কথাটা মনে পড়ল ফের । ঝামেলায় জড়াবে না সমীরন । নগেনবাবুও বলে দিয়েছেন, এমনকি ওর পক্ষ হয়ে কোথাও কিছু বলার দরকার নেই কোনও ।
অবিনাশকে শুধু বললাম, তাতে আমার কী ?
কখন অন্ধকার নামল কে জানে ! ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । বাইরে ভোঁ পড়ল কোথাও । ধড়মড় করে উঠে বসতে যেতেই টের পাই, কেউ বসে । আমার পাশেই । চৌকিতে । একেবারে গায়ে গায়েই । মলি । বললাম, কী হচ্ছে এসব ? তুমি কি পাগল হয়ে গেলে ?
অবিনাশ ডাক্তারখানা যাবে বউকে নিয়ে, বলা ছিল । তুলি বেরিয়ে গেছে কোথায় । আমারই ভুল হয়েছে ।
- মলি প্লিজ এখন নয়, পরে- কী হচ্ছে এসব, প্লিজ ।
- কেন, আমাকে ঘেন্না পান আপনি ?
- ছি:, কী বলছ এসব- ঘেন্না পাব কেন ?
- তবে ? লাবণ্যর সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা- লাবণ্য কি খুবই ভাল দেখতে ? ওকে দেখেছেন কোনওদিন দিনের আলোয় । নেহাৎ বদনাম হবে বাড়ির, এই আপনিও- এমনকী ওর কী হয়েছে শুনলে কালই বাড়ি ছাড়বেন- । কোনও ডাক্তার ওকে দেখতে আসবে না জানবেন । এমনকী কোনও হাসপাতাল- ।
হাত-পা কাঁপতে থাকে আমার । দরজা খোলাই । জানালাও । মলি আড়াআড়ি তাকাল একটু । আয়নায় মুখ রেখেই ! কোথাও কেউ গলা সাধা শুরু করল- নীচেই, একতলা কি দোতলায়, পাশের কোনও বাড়িতেই । ওকে কথা শেষ করতে দিতে ইচ্ছে করে না । যেন ওকে জিজ্ঞেস করতে না হয়, যেন নিজের থেকেই বলে, যেন বলে যেতে থাকে কী কারণে সুইসাইড করে লাবণ্যের স্বামী, আর লাবণ্যরই বা কী- ।
মলি চৌকির পাশে এসে দাঁড়াল । জিজ্ঞেস করল, চৌকিটা কার জানেন ?
- কার ?
মনে ছিল, তবুও ।
- দাদুর- মানে, বাবার বাবা- কী হয়েছিল বলুন তো ?
- কি করে বলব ?
- পচে গিয়েছিল একেবারে । গন্ধ -। সেন্ট ঢালতে হত প্রতিদিন । ঢোকাই যেত না ঘরে ।
বললাম, তোমার বাবা এলে কী ভাববে বলত ?
- কী হয়েছে, আমরা কি ছোট নাকি ? আপনি কি খেয়ে ফেলবেন আমাকে ?
ফের চৌকির উপর উঠে বসল মলি । বলল, এই ঘরে কে আসত বলুন তো ? সেই পচে যাওয়া লোকটাকে খাওয়াতে, সেই ঘ্রাণ সহ্য করে, পারবেন না বলতে । একা এই মলিই । তুলি বা বাবা বা মা কেউই নয় । আপনি না এলে এটা তো বাইরেই পড়ে থাকত । বাবা এমন সাংঘাতিক কিছু করে ফেলেনি আপনার জন্য । আর ভাড়াই বা কে আসবে এখানে ?
ডানহাতটা নিয়ে খেলা করে চলল মলি । আঙুল টিপল । ভাঁজ করল একবার । ফের খুঅলল । বলল, কী খসখসে রে বাবা ।
বললাম, চল বাইরে গিয়ে বসি হাওয়ায়- ।
-ধ্যাত্, আপনার লাবণ্যপ্রভা ঠিক হাজির হবেন ।
- বরং চা কর একটু, স্কুল থেকে এসে- ।
- সত্যি- বললেই হত- ।
মলি যেন গৃহিণী হয়ে গেল পুরোপুরি । বলল, চা পাতা কোথায় ? বলেই, `থাক থাক' করে উঠতে বারণ করল । আর খুঁজেও বের করল ঠিক । এমনকি চিনিও । দুধ গরম করল । বলল, একেবারে সাজানো সংসার যেন ।
চা খেতে খেতে ওকে তাকিয়ে দেখি । ও চোখ টিপল একবার । কী একটা শব্দ করল । যেন পোকার মতোই । দেওয়ালের ক্যালেন্ডারে খসখসে শব্দ হল । যেন টিকটিকিই । হাঁটছে । বা দেখছে কিছু দূর থেকে ।
- আপনার চোখটা না- চোখটা- এত সেক্সি- বিশ্বাস করুন- ইচ্ছে হয়- ।
মলি সত্যি সত্যিই যেনে চোখ টিপে দেবে আমার, যেন সত্যিই এই চোখ স্পর্শ করছে ওকে । আর এইভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়ল শেষ পর্যন্ত যে, চায়ের কাপ আর প্লেটে শব্দ হল খুব । আর এমনকি ওর গলায়ও ।
- কেন তুমি ? কেন তুমি ?
আর ওর সারাটা শরীর যেন পাল্টে যাচ্ছিল । একেবারে অন্যরকম । অন্য কেউ যেন । অন্য একরকমের ঘ্রাণ । হয়ত বলতে চেয়েছিলাম কিছু । বা বলার কিছু পাচ্ছিলামই না । শেষ পর্যন্ত একটা শব্দই । বা অনেক-অনেক, মন্দিরের সেই ঘন্টাধ্বনির মতোই । যেন হুড়মুড় করেই ছুটে আসে, যেন দরজার কাছে এসে থমকেই দাঁড়ায় ।
তুলি বলল, কোথায় ছিলেন এতক্ষণ । চিত্কার করে গলা ছিঁড়ে গেল প্রায় । জিজ্ঞেস করল, দিদি ? আমাকে `কি জানি', বলতে হল । বললাম, গেছে কোথাও । জানতে চাইলাম, বাইরে যাবে আর ? গেলে দরজা বন্ধ করে যাব । তুলি বলল, বাপ্টুদার সঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছে করছে খুব । বেশি দূরে নয়, বাদামতলা থেকে ঘুরে আসবে । বাইকে । জানতে চাইল, ওর বাবা ফিরলে বুঝিয়ে বলতে পারব কিনা । ঘাড় নাড়লাম ।
বেরিয়ে যাচ্ছে, এমনি সময় ফিরল ফের । দাঁড়াল । রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে । বাড়িটাকে দেখল একবার । উপর থেকে নীচ । ছাদ থেকে একতলা ।
- ভয় করে না আপনার ?
- কেন ?
- এমনি । মানে একা- এত বড় আর ভুতুড়ে- ।
- ভয়ের কী ?
আমি মুখ মুছলাম । হাত দিয়েই । জামা আর প্যান্টের দিকে তাকালাম । ঠিক আছে সব ? ঠিক আছে তো ?
- আপনি যে চৌকিটাতে ঘুমোন, জানেন তো কার ? কী হয়েছিল ?
- হ্যাঁ, তোমার দাদুর- ।
বাইকের শব্দ শোনামাত্র, তুলি রাস্তায় বাঁদিকে তাকাল । বলল, ফার্স্ট চান্সেই এ বাড়ি ছাড়ব আমি, দেখবেন । বাপ্টুদা ঠিকঠাক থাকলে, সামনের পুজোতেই- ।
বেশ ক-দিনের বৃষ্টি আর বৃষ্টির সম্ভাবনার পর আকাশটা আজ বেশ পরিষ্কার । অবিনাশ আজও তাগাদা দিল ফের । কি হল ? হয়েছে ? আমি বললাম, হয়ে এসেছে প্রায় ।
- প্রায় মানে ?
- প্রায় মানে, বুদ্ধি ঠিক করেছি একটা - মনে হচ্ছে হয়ে যাবে ।
অবিনাশ আমার উপর আস্থা রাখে খুব । স্কুলেও আড়াল করে যথেষ্ট । লোকটা প্রায় হাওয়া-মোরগের মতোই । ইদানিং নির্মলবাবুর সঙ্গে ভাব খুব । এই দু-বছরের অভিজ্ঞতায় একটা জিনিস বোঝা গেল, সমাজে অবিনাশের মতো লোকরাই আসল কর্মী । স্বরূপবাবুও পাত্তা দেন না আর কাউকে । স্টাফ কাউন্সিলের সেক্রেটারি সত্যবাবুও দেখি অবিনাশের কাছেই জানতে চান, চার কিস্তির ডি. এ. হবে কি এ মাসে ?
অবিনাশ বিনয় জানে খুব । একদম ওজন নেয় না । বলে, অসিতবাবু বলল আশা আছে একটা । তার মানে ডি. আই. অফিসের বড়বাবু । একদম ঘোড়ার মুখের খবর । অবিনাশের কথায় আস্থা রাখে সবাই । ওর কথা ধরলে, গভনির্ং বডির একটা পরিবর্তন হচ্ছেই । এমনকি পার্টি অফিসও চাইছে- ।
অবিনাশ বলল, হাওয়া কিন্তু ঘুরছে সমীরনদা- ।
- তার মানে ?
ফিসফিস করে জানতে চাই ।
আপনি বলতে যাবেন না কিছু । জাস্ট হ্যাঁ-হুঁ-, ব্যস । বাকিটা আমি দেখব আপনি শুধু লাবণ্যের ব্যাপারটা একটু দেখুন- ।
যেন শুধুমাত্র অবিনাশের কথাতেই সন্ধের পর চিলেকোঠার সামনে গিয়ে দাঁড়াই । পা কাঁপতে থাকে আমার । ডাকি, লাবণ্য- । ফিসফিস করেই । সাড়া না পেয়ে ফের । এরপর নামতে থাকি । একটার পর একটা ধাপ । ভাঙা, আধখাওয়া । ছাদ থেকে দোতলায় । লাবণ্যর ঘরের দরজায় । দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা আলো । হলুদ রেখাই একটা । দরজায় কান রেখে শব্দ খুঁজি । জুতোর খসখস, নাকি শাড়ির ? ঘড়ি শব্দ করে যাচ্ছে । কিছু একটা উল্টে গেল যেন ? দেওয়ালের ক্যালেন্ডার ? নাকি কাগজ ? বিছানায় বসে আছে কেউ ? নাকি চেয়ারে ? কে যেন ডাকল না ? চাপা গলাতেই । কোনও মেয়েই । লাবণ্য ? নাকি লিপি ? দরজায় টোকা দিই একটা । চুপ থাকি কিছুক্ষণ । অপেক্ষা করি । ফের শব্দ করি । পরপর দুবার । ফের শব্দ হল না ? কিছু একটা হেঁচড়ে গেল না ? যেন টানছে কেউ । যেন খাট থেকে নীচে । মেঝে বরাবর অনেকটাই । যেন উল্টোদিকের দরজায় গিয়ে থামল কিছু । আর ঠিক তখনই লোডশেডিং হয়ে গেল । একেবারে হঠাৎ । যা চমকেগেলাম আমি ! চমকে গিয়ে যা একটা কান্ড করে বসলাম ! একেবারে হুমড়িখেয়ে পড়লাম দরজার উপরেই । আর কি আশ্চর্য দেখ, দরজাটা খোলাই তখন । আগে থেকেই, নাকি ঠিক তখনই খুলছিল কেউ- ! কে যেন `মাগো'-, বলে উঠল । সেটা লাবণ্যও হতে পারে । ভয় পেয়ে যে কেউই `মাগো', বলে উঠতে পারে । সেটা কি লাবণ্য না কি লিপি ? নাকি অন্য কেউ । কোনো মেয়েই । ওদের আত্মীয়স্বজন হতে পারে কোনও । এরপর আর কি কি হয়েছে মনে নেই । দোতলায় নিজের ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি দেখি, অবিনাশ ।
- কী হল ?
- হবে আবার কী ? লোডশেডিং ।
- না, মানে বিপদের কিছু ?
লোকটাকে দেখে এত রাগ হচ্ছে আমার, এত রাগ-! ব্যাটা, মলি ঠিকই বলেছে, ধূর্ত কোথাকার, জোচ্চর- । একটা ঘরের জন্য যেন কিনেই ফেলেছে আমাকে ।
বললাম, যাও তো এখান থেকে, পারব না আমি ।
- প্লিজ রাগ করবেন না । আমি ভালোর জন্যই- মানে ভাবলাম বিপদে পড়লেন বুঝি ।
- কেন বিপদে পড়লে কী করতে তুমি ?
- দেখতেই পেতেন । নোংরা মেয়েছেলেটাকে অবশ্য ছাড়ব না আমি । ওর মরার জন্য অপেক্ষা করতে পারব না । ওকে এখানে কিছুতেই মরতে দেব না আমি ।
মলি হঠাৎ করে এসে জানাল, ওর মায়ের শরীর যেন কীরকম লাগছে ।
- কী রকম মানে ?
- আমি কি বুঝব ? শ্বাস নিতে পারছে না বলছে- ।
তারক ফার্মেসির অনিল ডাক্তার বলল, এ তো অনেকদিনের- । অক্সিজেন লাগবে । বলল, বড় হাসপাতালের দরকার নেই, নবীন দত্ত মেমোরিয়ালে নিয়ে গেলেই হবে । জাস্ট অক্সিজেনটাই ।
কাল একটা ছেলেকে ধরলাম । টুকছিল । ফার্স্ট বেঞ্চে বসেই । প্রশ্নটাকে খুলে খাতার ঠিক ওপরে এভাবে রেখেছে, যেন, খুঁটিয়ে দেখছে কিছু বা মাঝেমধ্যেই শুধু লেখার কারণেই প্রশ্নটাকে দেখতে চাইছে । বলতে কি, লেখার প্রতি ওর মনোযোগই আকৃষ্ট করল আমাকে । দেখি প্রশ্ন আর খাতার মাঝ বরাবর অল্প ফাঁক । প্রায় সুতোর মতোই । আর সেখানে যেন নীল রঙের অক্ষর । ছেলেটা পীড়াপীড়ি করল খুব । আর হবে না স্যার, আর হবে না স্যার- । ওর ভাগ্যটাও খারাপ । ঘরের পাশ দিয়ে তখন স্বরূপবাবু যাচ্ছেন । জানতে চাইলেন, কী হল ? বললাম । উনি অফিসে পাঠাতে বললেন ছেলেটিকে ।
পরীক্ষার শেষে ছেলেটার সঙ্গে দেখা হল ফের । বললাম, বিশ্বাস কর আমি ছেড়েই দিতাম । বললাম, হেডস্যার বললে আমার আর কিইবা করার থাকে । ইচ্ছে ছিল অবিনাশকে বলব কথাটা । কিসের থেকে যে কি হয় ?
এখন অবশ্য অবিনাশকে এসব কথা বলার সময় নয় । মুহূর্তগুলি এখন শুধুই যন্ত্রণার । আর আর্তনাদেরও। রাস্তার দুপাশ থেকে লোকগুলি দেখছে ।কেউ বা মুহূর্তের জন্য অল্প দাঁড়িয়ে ভাল করে বুঝে নিতে চাইছে । আন্দাজ করতে চাইছে কিছু । ভাবছে, শিওর কি মৃত্যুই, নাকি সাধারণ-, মানে ফিরবে হাসপাতাল থেকে । অবিনাশ জানতে চাইল, কষ্ট হচ্ছে খুব ? ওর বউ শরীর প্রায় ছেড়েই দিচ্ছে তখন । নি:সাড় । আমার কোলে তখন ওর কোমর, পা । রিক্সাওয়ালাকে তাড়া দিলাম ফের বললাম, প্লিজ- ।
নবীন দত্ত মেমোরিয়ালটা ঠিক সিনেমা হলের গা ঘেঁষেই । মূল বিল্ডিং অবশ্য পেছনেই অনেকটা । সামনের দিকে পুকুর । পুকুর পাড় ধরে সরু আর লম্বা রাস্তা একটা । মেন রোডের উপর একটু বাঁদিকে কলেজ থাকায় স্পিড-ব্রেকার । বললাম, দেখে একটু- । একটা দুটো নয় । অনেকগুলিই । পরপর । পাশে সাইনবোর্ডে বাংলায় লেখা, গাড়ি আস্তে চালান । উপরে একটি বালকের ছবি । পিঠে ব্যাগ । ছুটছে । স্কুলে যাওয়ার মতো করেই ।
ডাক্তারবাবু বললেন, ভরতি করতে হবে । অনিল সেন ঠিকই বলেছে । কী একটা ইঞ্জেকশন লিখে দিলেন খসখস করে । অবিনাশকে বললাম, নিয়ে আসছি আমি ।
রাস্তা পার হচ্ছি, দেখি মলি আর তুলি । চোখ ফোলা একেবারে ।
বললাম, চিন্তার কিছু নেই । ভরতি করে নিয়েছে । অতক্ষণে হয়তো বেডেই- ।
অক্সিজেন সম্বন্ধে আমার ধারণাই ছিল না একদম । স্রেফ বইয়ে যা পড়েছি । বর্ণহীন, গন্ধহীন, স্বাদহীন । স্যালাইন সম্বন্ধেও । জানতাম লবন জল । লবন ঘাটতি মেটাবার জন্যই । ডাক্তারবাবু নাকি জায়গাই খুঁজে পাননি অনেকক্ষণ ধরে । স্যালাইনের সূঁচ কোথায় যে ফোঁটাবেন ঠিকই করতে পারেননি । উল্টো করে বসানো একটা বোতল । নল । নল বেয়ে একটার পর একটা ফোঁটা ফের আর একটা বোতলে নামছে ।
বললাম, বেডের চারপাশে এত লোক, বকাবকি করবে না তো ?
পাশের বেডে চুপ করে বসে থাকা মহিলা বললেন, না না-, সারাদিন ধরেই- যে কেউ- । দেখুন না- ।
ওর বেডের পাশে, সবুজ রঙের একটা প্লাস্টিকের গামলা । জল, থুথু, কফ । ওর নাকি পেটে যন্ত্রণা হচ্ছিল খুব । `ভাল এখন- ?' জানতে চাওয়ায় মহিলা ঘাড় নাড়লেন ।
মলি বলে উঠল, মা-, মা এমন করছে কেন- সমীরনদা ?
বললাম, ঠিক হয়ে যাবে, প্লিজ ।
অবিনাশকে বললাম, এদের কী দরকার ছিল আসার ?
স্টেশন রোড ধরে সিনেমা হল পার হয়ে ডানদিকে তাকালেই চোখে পড়বে, নবীন দত্ত মেমোরিয়াল জেনারেল হসপিটাল । বাংলায় নয় অবশ্য । ইংরেজিতে । ঢোকার মুখে গেট আছে একটা । খোলাই থাকে সারাক্ষণ । মানে বন্ধ হওয়ার চিহ্ন নেই কোথাও । গেটের মাথায় `আর্চ'-এর ভঙ্গিতে চিত হওয়া লোহার পাতে এক একটা অক্ষর আটকে রাখা । প্রায় বিশ বছরের পুরোনো হাসপাতালের নামের প্রতিটি অক্ষর অবশ্য অটুট এখনও ।
অবিনাশকে বললাম, ওদেরকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলে হত না-। সারাটা রাত- ।
হাসপাতালের পেছনের চায়ের দোকান প্রায় ফাঁকাই তখন- বাঁশের খুঁটি, ভাঙা বেঞ্চ বা কাঠের তক্তাই শুধু, কুকুরও আছে দুটো- দাঁড়িয়ে নেই অবশ্য, শুয়ে । হয়তো ঘুমোচ্ছেই । দোকানের মালিক বা মালকিনই বলব বরং, জানতে চাইল, বিস্কুট দেব ? গলা বেশ ভারী বা কর্কশই যেন- ঘুমের জন্যও হতে পারে । বুড়ো মতো একটা লোক বেঞ্চের বাঁদিকে বসে ঝিমোচ্ছে তখন । বউটা ধমকালো একবার, কী হল ? লোকটা চমকে উঠে বলল, কটা ?
বললাম, দুটোই । চিনি কম ।
ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা তিনটে ছেলে কিছু একটা নিয়ে ইয়ার্কি করছে নিজেদের মধ্যে । অনায়াসে ঢুকে পড়ছে যৌনাঙ্গের বর্ণনা । মেয়েদের । ছেলেদের । এবং হাসিও ।
চায়ের গ্লাস হাতে দিয়ে বউটি জানতে চাইল, কার কথা বলছিস রে- ।
একটি মেয়ের । সুইসাইড কেস । আজ নিয়ে গেল । কেউ একজন বলল, নিজে দেখলাম, ডাক্তারও, কাপড় তুলে- । যা রক্ত- যে রকম ছিন্নভিন্ন- অন্তত বেশ কবার । শেষমেষ নাকি জানালা থেকে ঝুলিয়ে রেখেছে- ।
- বাবা -।
তুলি । বাল্বের হলুদ আলোয় বোঝাই মুশকিল, চোখে ধাক্কা মারছে বেশ । ছেলেগুলি দেখল একবার তুলিকে । চুড়িদার নয় । শাড়ি পরেই এসেছে তুলি । তাড়াহুড়োয় কাঁধের বাঁদিকে ব্রা-এর ফিতে বাইরে বেরিয়ে । কালো । ওর ফর্সা আর মসৃণ ত্বক দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে যেন ।
তুলি বলল, নার্স নাকি ডাকছে । বলল, রাত্রে একজনের বেশি থাকতে পারবে না । কে থাকবে ?
স্বাভাবিক হিসেবে আমাকেই- । আমার থাকাটাই সহজ । তুলি বা মলিকে একা রাখাটা বাজে দেখায় । পারবেও না ওরা । আর অবিনাশের মতো বয়স্ক লোককে একা রাখা- । বললাম, সে তোমাদের ভাবতে হবে না ।
রাত সাড়ে নটাতেও ওয়ার্ড ভরতি লোক । নার্স মনে করিয়ে গেছে বেশ ক-বার, বেরিয়ে যেতে হবে, রোগীদের ঘুম আছে কিন্তু- ।
পাশের বেডের মহিলা বললেন, ও কিছু হবে না- । বললেন, মেয়েরাও থাকতে পারবে । থাকেও । ওর কথায়, ওর বেডে শুয়ে বসে থাকতে পারবে যে কেউ । ও নিজে প্রায় স্বাভাবিকই । একদিক টেনে শুয়ে থাকলেই হল । হ্যাঁ, তুলি বা মলি যে কেউ । মহিলা বললেন, হাসপাতালে ঘেন্নার কিছু নেই । থাকে তো সবাই । বললেন, যেখানকার যা- ।
অবিনাশ দুর্বল হয়ে গেছে কিরকম । আমার দিকে তাকাল একবার । বললাম, এ হয় না, বিশ্রি ব্যাপার । বললাম, আমি থাকছি, চিন্তার কিছু নেই- ।
তুলি বা মলি হলে ওয়ার্ডেই থাকতে পারত । পাশের বেড বা ওর মায়ের বেডেই । হয়ত বসে থাকতে হত । কি দাঁড়িয়ে । মলি বলল, কী গন্ধ দেখছ ?
- হাসপাতাল এরকমই- গু-মুত, পুঁজ আর রক্ত ।
তুলি বলল, বাথরুমটা কি নোংরা ।বমি করার ভঙ্গি করল একেবারে । কি বলব, সমীরনদা, মরে গেলেও আমি- ।
- মরতে হবে না তোমাকে ।
যেন একটু রসিকতাই । মলির সঙ্গে চোখাচোখি হতেও ভয় । আবার শিহরনও আছে যেন একটা । মলি এখন অনেক সহজ । একটু আগে ধমকেও উঠল আমাকে । তুলি বলল, তুই কিন্তু থাকতে পারতিস । সমীরনদা একা- । আর ফিমেল ওয়ার্ড যখন- ।
শেষ পর্যন্ত তুলিই থেকে গেল । থেকে গেল মানে, ওদের ছেড়ে দিয়ে চায়ের দোকানে এসে বসেছি, শুনি, `সমীরনদা' !
দোকানের বউটি চেয়ে দেখল একবার । জানতে চাইল, একটা না দুটো ?
বললাম, আলুর দম খাবে ?
- নিন ।
দুটো পাউরুটি টুকরো করে সেঁকে দিতে বললাম ওকে ।
দোকানের বউটিকে বললাম, মেয়েদের থাকতে দেবে ?
বউটি তাকিয়ে দেখল একবার । আমাকে । তুলিকে । তুলির মুখ, গায়ের রঙ, শাড়ি । আর শাড়ি পরার কায়দাকেও যেন । বলল, থাকে তো সবাই- ।
দোকান থেকে বেরুচ্ছি, তুলি তখন রাস্তায়, পায়ে কী যেন লেগেছে, বউটি জিজ্ঞেস করল, কে হয় আপনার ?
কোন রাখঢাক নেই । সোজা । সহজভাবেই । যা বোঝানোর বুঝিয়ে দিল । বললাম, বোন, মানে বোনের মতোই ।
- কে ভরতি হয়েছে ?
- ওঅর মা । কেন বলুন তো ?
- না সারা রাতই আছি । কিছু লাগলে বলবেন ।
সে ঠিক আছে । চলে আসব ।
শুধু আমরা নই । অনেকেই । বিল্ডিং-এ ঢুকে ডানদিকে মেল ওয়ার্ডের সামনে তৈরি করা বারান্দায় এর মধ্যেই অনেকে কাগজ পেতে শুয়ে । বিড়ি ধরাচ্ছে কেউ । সিগারেট । তাস পড়ছে । টু স্পেড, থ্রি ডায়মন্ডস ।
কে যেন বলল, শালা এখানেও- ।
তুলির মা বেশ স্বাভাবিক । নার্স বলল, তেমন বিপদের কিছু নেই । স্যালাইন ভালোই টানছে । তুলি থাকতে পারবে কিনা জানতে চাইলে, বলল, নিজের দায়িত্বে । তবে বাথরুমের কথা তুলে বলল, একা যেন না যায়- ।
তুলিকে রেখে বেরিয়ে আসছি, বারান্দায় বসব, বা শুয়েও পড়তে পারি কাগজ পেতে, একটা লোক ডাকল । ইশারা করেই । কালো মতন রোগা । হাসপাতালেরই কেউ । বলল, ঘর লাগবে ?
বললাম, ঘর দিয়ে কী হবে ?
থতোমতো খেল একটু যেন । জানতে চাইল, দিদিমনি আছেন না একজন ?
- হ্যাঁ । তাতে কী ?
বলল, হাসপাতালেরই, ভালো । বলল, একশটা টাকা হলেই হবে ।
স্কুল আজ ফাঁকাই । স্বরূপবাবু আসবেন একটু দেরি করে । খেলার মধ্যে শুধু অফিস আর টিচার্সরুম । দোতলার । পরীক্ষা শেষ হওয়ায় বাকি ঘরগুলির মাস খানেকের জন্য আর খোলার ব্যাপার নেই । এমনিতে অবশ্য ঝামেলা নেই তেমন । চারপাশে উঁচু দেওয়াল । গেট । তাছাড়া মিশ্রজির নিজের বাড়িঘর বলতে স্কুলই । ওকে দারোয়ান না বলে বুকলিস্টে নৈশ প্রহরী বলেই পরিচয় দেয় দেখি ।
মিশ্রজি বিহারের । দুলু অবশ্য এখানকারই । মিশ্রজির ছেলে আছে দুটো । মেয়েও । নিজের বয়সও বলে পঁচিশ । পঁচিশ বছরেই তিন ? সত্যদা বলছিল, ওদের আর বয়স- । আমার এটা একত্রিশ । মিশ্রজি জিজ্ঞেস করছিল একদিন, বিয়ে করবেন না আপনি ? ভাঙা বাংলাতেই । ও ব্রাহ্মণ । পরিষ্কার পৈতে । ছোটো টিকি একটা । ভোরবেলা উঠে গঙ্গাস্নানে যাবেই । দেশে খেতি আছে । বাপ-মা-ভাই । বোনও । ট্রাক্টর আছে । অবস্থা খারাপ নয় মোটেই । লেকিন শান্তি কোথায় ?
- কেন শান্তি নেই কেন ?
বলল, গন্ডগোল আছে খুব । বন্দুক রাখতে হচ্ছে । যেতে ইচ্ছে হয় না একদম । বলল, মেয়েটার বয়স হচ্ছে ।
- তার মানে ?
- ওর তো নয় গিয়ে দশ, আমাদের তো ওরকমই- অবিনাশের মেয়েদের মতো হলে- ।
মলি আর তুলির কথা বলল । বললাম, তোমাদের বাড়ি কি বিহারে না ইউ. পি ।
- বিহার ।
বললাম, শিওয়ান নামে কোনও স্টেশন আছে ওদিকে ? ছোটো কি বড় জানি না । সব ট্রেন দাঁড়ায় কিনা কে জানে ? মানে দূরপাল্লার যেসব ট্রেন থাকে আর কি । বড়জোর জানালায় চোখটাই হয়ত রাখা । বা শুধু একটা ফাঁকা প্লাটফর্মই, কয়েকটা গাছ- সবুজ হলুদ পাতা, কাঠের বেঞ্চ, একটা দুটো লোকও থাকতে পারে । আবার রাত হলে একটা লন্ঠনও হতে পারে । হয়তো দোলাচ্ছে কেউ । সবুজ, লাল, সবুজ । আমি অবশ্য দিনের বেলার কথাই বলছি, না হলে তুমি দেখবেই বা কিভাবে । অন্তত যে-ই দেখুক কিভাবে সন্দেহই করবে একজনকে । যদি ডাকেও, অর্থাৎ নাম ধরে `সুধনদা-' বলে যদি ডাকতেও হয়, মুখখানা তো দেখতে হয়ই ।
মিশ্রজি বলল, পরেরবার খোঁজ নেবে । ধারে কাছে হলে পাওয়া যাবে ঠিক । অন্তত স্টেশনটা কোথায় সে জেনে দিতে পারবে ।
ওকে অবশ্য ব্যস্ত হতে বারণ করলাম । যাব হয়ত পরে । বললাম, অনেক কাজ এখন- ।
বিপিনের বাড়ি যাওয়া হল না আর । ওকে বললাম, যাব । পুজোর মধ্যেই । ও অবশ্য অষ্টমীর দিনের কথা বলল । বুঝিয়ে দিয়ে গেল ঠিকানা । বলল, ওই যে শহিদ বেদি দেখেন- মোড়ের, শোভন সান্যাল- ওর বাড়ির পাশের । ইলিয়াস রোডের ওপরই । বললাম, তাই ? আমার কথা শুনে বিপিন ভাবল চিনি বুঝি লোকটাকে । বলল, দেখেছেন ?
- তোমারও মাথা খারাপ, কোথ্থেকে দেখব- মোড়ে দেখি প্রায়ই- শহিদ বেদি- একাত্তর না বাহাত্তর সালের- বাড়িতে আছে কেউ ?
শোভন নাকি কবিতা লিখত ভাল । আমার অবশ্য কবিতায় আগ্রহ নেই কোনও । এ ধরনের পড়াশুনাকরিইনি দীর্ঘদিন । এমনকি গল্পও । `পুতুলনাচের ইতিকথা' পড়েছি সেই হায়ার সেকেন্ডারির সময় । কে যেন দিয়েছিল বইটা ? কে যেন ? মনে থাকার মধ্যে সেই শশী নামের লোকটা- যেন টিলার ওপর দাঁড়িয়ে থাকার ব্যাপার ছিল একটা । যেন সূর্য অস্ত যাচ্ছে । নিয়মের মধ্যেই । বহু বছর আগের পড়া বইয়ের গল্পও তেমন মনে নেই আর । কবিতা পড়ার মধ্যে ওই বাংলা বইয়েরই । ঠিক করে বলতে গেলে বরং নোট বইয়ের কথাই বলতে হবে ।
- কবিতা বোঝেন না আপনি ?
- না । লাইনের পর লাইন, শব্দের পর শব্দ- অর্থহীন আর বিরক্তিকর- ।
- শোভনদার লেখা পড়লে একথা বলতেন না । কি আগুন ! তেজ- কি বলবো- ওই বয়সে ভাবাই যায় না- মারা না গেলে- ।
বিপিন নাকি কবে একটা ম্যাগাজিনে ওর লেখা কবিতা পেয়েছিল কয়েকটা । ওর সঙ্গে কথা বাড়াতে ইচ্ছে করে না আর । শোভন সান্যাল মারা না গেলে বড় হোত । আমি নিশ্চিত । চাকরি নিত । বিয়ে করত একটা । বা নাও করতে পারত । হয়ত পার্টি করত ! না করলেও চাকরি করত ঠিক । বিয়ে করলে সুন্দর সংসার পাততো । হয়ত ছেলে, মেয়ে । বা বিরাট ল্খেক হতে পারত কোনও । কবিও । নাম হোত হয়ত বিরাট । কিন্তু তাতে কি ? কিছুই না । আমাকে সেই এরিয়ার ডি. এ.-র জন্য বসেই থাকতে হোত ভবিষ্যতের । আর যে কথাটা বলতে ইচ্ছে করে না আমার অর্থাৎ মুকুন্দদার কাছে ঠিকই যেতে হোত । মাত্র দশ হাজার টাকায় পাওয়া সার্টিফিকেট আর মার্কশিট আমাকে ঠিকই ব্যবহার করতে হোত ।
স্কুল থেকে যখন বেরিয়ে আসছি, আমাদের ছোটবেলার স্কুলের সেই হেডস্যারের কথা মনে পড়ল ফের । সেই নাগবাবু । মনীন্দ্রনাথ নাগ । মনে হল, সত্যিই যদি যুদ্ধ হয়, হতেও তো পারে । হয়ত সত্যি নেতাজী- । হয়তো আসছেনই । যদি আসেন ? আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি কালো হয়ে এসেছে বেশ । ভাদুড়ি বলল, যাবেন নাকি ? ট্রেনের কথাই । `না-'। বললাম, বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে । হয়ত শোনেনি । সাড়াই দিল না আর । হেডস্যার গল্প বলতেন খুব । বা সত্যি ঘটনাই । সেই একবার হিমালয়ের ওদিকে কোথায় যেন গেছেন, ওর কথায়, শুধু ফুল আর ফুল । বলছিলেন, ওখানে গেলে মন এমনিতেই ভাল হয়ে যায় । বলছিলেন এমনকি তোদের স্বপ্নও । আমরা কি গম্ভীর তখন । সেই স্বপ্নের কথা । আশ্চর্যজনক সেইসব স্বপ্নের কথা উনি তখন বলেন । আমাদের হেডসার । গৌরবর্ণ । লম্বা । এমনকি দু'বছর আগেও দেখে এলাম । হাঁটছেন । একেবারে সোজা । হিমালয়ের গল্পে ঠিক এমনিই সাধু ছিল এক । ওঁর কথায়, উনি নাকি দাঁড়িয়ে ছিলেন অনেকক্ষণ । নির্জন এক উপত্যকায় । সাধুর কথা নাকি জানে অনেকেই । এমনকি বইয়েও নাকি আছে তাঁর কথা । সেই উপত্যকায় সাধুর সামনে দাঁড়িয়ে তার একসময় মনে হল, কেউ যেন বসতে বলছে ওকে । কেউ যেন । কে ? যেন উনি শুনলেনও সেইসব কথা । কি সহজ আর সুন্দর সেইসব শব্দ । ওর গলায় আবেগ ছিল খুব । আর স্বরও । যেন মেঘ ভাঙে । যেন ছিন্ন হয় । জল যেন নামে । গল্পের শেষে জানতে চেয়েছিলেন, বলতো কে ?
আমরা জেনেও তখন কী যে বলি ? উনি সময় দিতেন না বেশিক্ষণ । বলতেন, থাক জানতে হবে না । তবে টের পাবি শিগগির ।
স্কুল থেকে বেরিয়ে, সত্যিই মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছেই, যেন মেঘ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে প্লেন । `ভট-ভট-ভট-ভট -' শব্দে নামবে হেলিকপ্টার । পাখা ঘুরছে । ঘুরছে । আমরা হাঁ করে তাকিয়ে । নামছে । নেমে আসছে হেলিকপ্টার । ছবি উড়ছে । অজস্র । পালকের মতো হালকা, আর পরিষ্কার আর নরম সেই ছবি ওল্টাচ্ছে হাওয়ায় । ডেকে উঠলাম , বাবা- ।
ভুল হয়েছিল । একেবারে বিশ্রি একটা ভুল । লোকটা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই দেখি গায়ের রঙটা কালো ঠিকই । সাধারণ হাইটেরই । বা নীল জামাটাও ঠিক আছে, ধুতি বা ধুতির কায়দাও । এমনকি কপালের বাঁদিকে সেই আঁচিলও । তবু বাবা নয় । একেবারেই অন্য একটা লোক । বছর ষাটেরই । হয়তো টিচার হবে কোনও স্কুলের । বা রিটায়ার্ড । বললাম, মনে করেননি তো কিছু ?
লোকটা বলল, না না মনে করার কি আছে ? বলল, সবাই নাকি এমনি ধরনের ভুল করতেই পারে । এমনকি উনি নিজেই নাকি কবে- ।
অবিনাশ বলল, মলি-তুলির মায়ের জন্য যা করেছেন জীবনে ভুলবো না । শুধু একটা কাজ একটু করে দিন যা হোক করে-, জাস্ট একটা কাজই । অবিনাশ বলল, রামরাজাতলার ওই সাধুর কাছে আর নাকি যেতেও হবে না আমাকে ।
লাবণ্য ঠিকই বলেছে । ধ্বংসেরও সৌন্দর্য আছে একটা । আলগা হয়ে পড়তে থাকার মধ্যেও যেন ছন্দ আছে । শুকিয়ে যাওয়া, ঝরে যাওয়া পাতার মধ্যেও নিপুণতা আছে কোথাও । যেন সেই সংখ্যার মধ্যেই, যেখানে, ত্রক্রমপর্যায়, এক-দুই-তিন-চার ।
একেকদিন ঘুম ভাঙে হঠাৎ । অনেক রাত তখন । জানালার বাইরে আকাশ । বাকি অংশে অন্ধকারই । দেওয়াল, দেওয়ালের ফাটল, ছাদ, দরজা, দরজার ভার তখন স্রেফ অন্ধকারেই । বাইরে আকাশের নীচে ছাদ, গাছপালা, নদী, ছলকে ওঠা ঢেউ । আমার তখন দাদুর কথা মনে পড়ে । সেই ঘোলাটে চোখ । আর সেজকাকুর কথাও । বাবা বলছিল, তোর দাদু আর বাঁচবে না রে সমু ! আমরা তখন ভিড়ের পেছনে একটু সরে দাঁড়িয়ে । ঘর ভর্তি লোক তখন । লক্ষ্মী জিজ্ঞেস করেছিল, সত্যি মরে যাবে ?
অনেক দূর দূর থেকে নাকি ডাক পড়ত দাদুর । হয়ত মাঝরাত্তিরেই, সেজকাকু নাকি শুনতে পেত, বুড়োকর্তা- । বাইরে ডাকছে কেউ । সেই দেশের বাড়িতেও । খোল করতালের লোক ছিল আলাদা । অনেকেই নাকি গাঁজা টানত খুব । চোখ তখন লাল একেবারে । দাদুর নাকি নেশা ছিল না কোনও ।
কীর্তনের গানগুলি দেখলে হোত একবার । কি লেখা থাকে সেই সব গানে ? রাধার রূপ বর্ণনা ? প্রেম ? ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য ? যে, আমি তোমারই- ! বা মাপ করে দিও গো আমায়- । দাদুর গোনা থাকতো । দাহ করা লাশের সংখ্যা গোনা থাকত দাদুর- মৃত মানুষের । এক-দুই-তিন-চার । সেজকাকুর কথায় একশো দশ তো হয়েছিলই । পালপুকুর দেশবন্ধু কলোনির যতীন সেনের মায়ের বেলায় স্পষ্ট মনে আছে, দাদু নাকি বলেছিল, আর হবে না গো, এরপর আমাকেই-, বলছিল, একশ দশ হয়ে গেল ।
অথচ এমন একটা সময় নাকি গেছে যে, দাদুই খোঁজ করত । কোনও মতে কানে গেলেই হল, দিদাকে খবরও পাঠাতো না । হয়ত পাঁচ-সাত গ্রাম ছাড়িয়ে । দাদু নাকি ঠিক হাজির । লাবণ্যপ্রভা অপেক্ষা করতেন । দিদিমা । ঠিকই, বাবার মা বা বাবাকে দিদিমা বা দাদু বলতেই অভ্যস্ত ছিলাম আমরা । হয়তো মায়ের দিককার কারুর কথা মনে না থাকাতেই ।
সেজকাকু সেদিন বলল, তুই কি বাবার মতোই বাউন্ডুলে হবি ? বিয়ে করবি না ?
- কেন দাদুও তো- মানে তোমরা তো দাদুরই- ।
একটু রসিকতা ছিল । তখনও খাওয়া ছেড়ে উঠে যাইনি । এর একটু পরেই সুবল সেই পুবের ঘরের কথা তুলল ।
আচ্ছা, মাকে নিয়ে এলে হোত না ? মানে মায়ের সেই ছবিটা ? এত ভুল হয়ে গেল সেদিন । একেবারে মনেই পড়ল না ।
দাদুর শেষের সেইদিন সেজকাকু বেশ স্বাভাবিকই ছিল । সেজকাকিকে ডেকে তাড়াতাড়ি রান্নার ব্যবস্থা করতে বলল । সেজকাকির সেই তাড়াহুড়োর কথা মনে পড়ে । আমাদের খাওয়ানো । ঘরগুলি তখনও পুরোপুরি কাঁচা । বাঁশের বেড়া । মাথার উপর টিন আর টালি । পেয়ারা, কুল আর কাঁঠাল গাছ ।
সেজকাকি বলতো, তখন অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটত কত । তোর দাদুই তো একেকদিন দরজা খুলে একাই বাইরে বের হোত । পাশের রাস্তা তখন কাঁচাই-স্রেফ মাটির । এঁকেবেঁকে যাওয়া সরু । একেকদিন মাঝরাত হলেই নাকি শব্দ শোনা যেত স্পষ্ট । আসছে কেউ । শুনতে পেত সবাই । খটখট-খটখট । হাঁটছে কেউ । তার মানে কাঠের খড়ম । আমাদের বাড়িটার সামনে এসেই নাকি থেমে যেত শব্দটা । কেউ ডেকে উঠত । বুড়োকর্তা-, বুড়োকর্তা- । সেজকাকিমার কথায়, আমরা বারণ করতাম । সবাই । তবু, দাদু নাকি ঠিক বেরিয়ে পড়তো । হাঁটতে হাঁটতে একেবারে পুকুড়পাড় পর্যন্ত ডাকতে ডাকতেই যেত । জিজ্ঞেস করতো, কে গো- কোথায় যাচ্ছ- ? এমনকি দাদুর গলাও নাকি শুনতে পেত সবাই । সেজকাকির কথায় এমনি এক রাত্রির পরই নাকি পাকাপাকি ভাবে বিছানা নিল দাদু । ধুম জ্বর ।
ফাঁকা ঘরে রাত্রিবেলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে এখনও ভয় । যেন থাকবে কেউ । ঠিক । যেন মাথা তুলবে এক্ষুণি । হাত নেড়ে ডেকে উঠবে । যেন `কি হল-', বলে ধমকে উঠবে । একটা হর্ণ পড়ল কোথায় । ভারী বেশ । অনেক দূর থেকেই । যেন হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে কেউ । যেন তবু অনেকটা পথ । গুরগুর শব্দ হচ্ছে । যেন গোপনেই । অন্ধকারে হানা দিচ্ছে কেউ । হয়ত গাদাবোটই । হয়ত মাল যাচ্ছে কোথাও ।
অন্ধকারে সত্যিই কি আসে কেউ ? এক পা এক পা করে সত্যিই কি সিঁড়ি দিয়ে ওঠে । ক্লান্ত হয় কেউ ? মা ক্লান্ত হয়েছিল খুব । একটা রাত্রেই সব শেষ । শরীর নাকি বিছানায় লেগে গিয়েছিল একেবারে । চোখ তখন অন্ধকার গর্তে । এখনকার দিন হলে, স্যালাইন চলত ঠিক । ওষুধ, ইনজেকশন । মোটকথা হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার মতো কোনও ব্যবস্থা থাকলেই বেঁচে যেতো মা ।
লাবণ্য বলছিল, আপনার মা সুন্দরী ছিল খুব ।
- কেন ?
- আপনার চোখ- এই চোখ কেবল মেয়েদেরই- যেন স্বপ্ন অনেকদিনের- যেন হিংস্রতাও আছে কোথাও- ।
- সত্যি ?
- হ্যাঁ, আপনি হিংস্র- মনে হয় আমার । আপনার মা কি জেদি আর একরোখা ছিলেন খুব ?
- কিভাবে বলব ? আমি তখন মায়ের কোলে । মনে রাখা বলতে মায়ের এক ছবিই । চার বছর আগে পর্যন্ত যা পুবের ঘরের বেড়ায় ঝুলতো । অল্প বয়সের মেয়ের মতোই । আর একটু হাসির আভাষও যেন । বক্রতা ।
লাবণ্য বলছিল, আপনার মা থাকলে শোধ তুলত ঠিক । `-কিসের ?' জানতে চাওয়ায় বলছিল, আপনার বাবার দায়িত্বহীনতার, পালিয়ে যাবার । ঠিকই, বাবার চলে যাওয়া, সে হয়তো, মায়ের জন্যই- মায়ের মৃত্যুর আঘাতেই, আর একে তো তুমি প্রেমও বলতে পার ।
লাবণ্য বলছিল, একজনের মৃত্যুতে আরেকজন পালায় কখনও ? মৃত্যু দেখেছেন তো কোনওদিন ? দেখেননি ? দেখতে ইচ্ছে করে না দাঁড়িয়ে ? শরীরের সেই ধুঁকতে থাকা, সেই আপ্রাণ চেষ্টা, শেষবারের মতো সেই হাঁ করা- শেষবারের সেই ঝাঁকুনি- ।
লাবণ্য জানতে চেয়েছিল, আপনার মাকে ভালবাসেন না আপনি ?
সন্তুর বাবা বলল, ঠাকুরের এইসব মূর্তির কিন্তু অর্থ আছে অনেক । শোনেননি ? বলেনি কেউ ?
না । বললাম, অঞ্জলিই দিইনি কোনওদিন । সরস্বতী পুজোর চাঁদা তুলে ফিস্ট করতাম । ঠাকুর কিনতাম একটা অবশ্য ।
- সেজন্যই ।
- সেজন্যই মানে ?
- কিছু না- এমনি- । মানে এসব আসলে সুর আর অসুরের- ভাল আর মন্দের দ্বন্দ্ব । সর্বত্রই, এমনকি আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই- হয় না আপনার ? দ্বন্দ্ব নেই ? ভাল আর খারাপের লড়াই হয় না ?
পুজোর সুভেনিরে বাপ্টুর বাবার হয়ে কিছু লিখে দিতে হল আমাকে । সভাপতির অভিভাষণ । যা যা লেখার বাদ দিইনি কিছু । কাশফুল । মেঘ । আলো আর রৌদ্রের আসা যাওয়া । গ্রামবাংলা । শেষ অব্দি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি দিয়ে শেষ করলাম । ভদ্রলোকের পছন্দ হয়েছে খুব । বললেন, লেখাপড়ার দাম আছে একটা । ভদ্রলোক অনুযোগ করলেন, একদিন দোকানে এলেন না ? দেখে যান একবার । বাপ্টুকে নিয়ে ওর আশা আশঙ্কার কথা বললেন অনেক ।
মৌখিক চেনা দীর্ঘদিনের হলেও, এই প্রথম অনেকটা সময় ধরে কথা বললাম দুজন । আমি আর বাপ্টুর বাবা । সুধাংশু হাজরা- নবারুণ সংঘের সভাপতি । নিজের দোকানের বিজ্ঞাপন ছাড়া বেশ কিছু বিজ্ঞাপন জোগাড়ও করে দিয়েছেন ।
- পাড়ার পুজো । কি বলেন ? দূরে থাকা যায় ?
বললাম, আপনার মতো এসব ব্যাপার সবাই যদি বুঝত- ।
এবারকার প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে বাঙ্গালোরের কোনও এক বিল্ডিং-এর অনুকরণে । একেবারে নাকি নিখুঁত । আশীষ মানে সেক্রেটারি ছেলেটা দেখাল । সত্যিই তাই । বিজয়া সম্মিলনীর নাটকের ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি । অর্থাৎ নাটক হবে না কোনও । সেই গান, আবৃত্তি আর নাচ । পাড়ার অনেকেরই নাম দেওয়ার কথা ।
মলি বলল, ঠাকুর দেখতে যাবেন না ?
- না ।
- একদিন অন্তত- ।
বললাম, বিশ্বাস কর, একদম ভাল লাগে না । জীবনে এমনকি ছোটবেলাতেও বেরিয়েছি কিনা সন্দেহ ।
- একটা দিন বের হলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হত ? মনে করুন আমাকে দেখাবার জন্যই ।
মলিকে বললাম, এখন `হ্যাঁ' বলে, পরে না যাওয়াটা কি ভাল হবে ? তার চেয়ে তুলিকে বল, তোমার মা বাবাকে ।
তুলি নাকি মলির সঙ্গে বেরতেই চায় না । তাছাড়া, ওর বাপ্টুদা রয়ে গেছে না । মলি বলল, আপনিই তো দূতের কাজ করছেন ?
- দূত মানে ?
- দূত মানে দূত । এর খবর ওকে । ওর খবর একে । আপনাকে ছাড়া তো তুলির এক পাও চলার নয় । একটু কিছু হলেই, সমীরনদা- । লজ্জাও করে না আপনার ?
বললাম, ফের ঝগড়া শুরু করলে, এটাই তো শেষ পুজো বাপু । এরপর তো বারুইপুর- দেখব তখন কিভাবে- ।
মলি বলল, বারুইপুর আসবে না আর ।
- কে বলল ?
- কে আবার বলবে ? ছেলে ছবি দেখতে চেয়েছিল । পাঠানো হয়েছে । ব্যস ।
- ব্যস মানে ?
- ব্যস মানে খবর নেই কোনও ।
এটা মলির পুজোর শাড়ি নয় । সম্ভবত গতবারের । হালকা সবুজ । ব্লাউজটাও ভাল লাগছে বেশ । সম্ভবত ঘুম থেকে উঠে এসেছে । শ্যাম্পু দিয়েছে মাথায় ।
বললাম, দুলটা কিসের ?
- বা, লক্ষ্য করেছেন তো ঠিক । পোড়ামাটির । স্টেশনে বিক্রি করছিল কাল । ভাল হয়েছে না ?
বারুইপুরের কথা আর তুলি না । ছেলেটির মা কিন্তু পছন্দ করেছিল । মোটামুটি সায়ও দিয়েছিল । বলেই গিয়েছিল, ছেলের আলাদা করে মত নেই কোনও । শুধু পাওনা-গন্ডা নিয়ে । তাও অবিনাশের কথায় গররাজি হওয়ার ব্যাপার শুনিনি কোনওদিন ।
মলিকে বললাম, একদম অন্যরকম কিছু ভেবো না প্লিজ । তুলিকে বলি আমি ।
- ঠিক আছে, আমি তো লাবণ্য নয়, থাক । তুলিকে বলতে হবে না । আমি কিন্তু আপনাকে ভালবেসেছিলাম । বিশ্বাস করুন । আজকের বিকেলে এই একটা কথা বলে রাখলাম আপনাকে ।
মলির প্রতি আমার কোনও আকর্ষণ নেই । ওর শরীরের দিকে মুহূর্তের জন্য কোনওদিন দুর্বল হয়ে থাকলেও, তা ভুলে যাওয়ার মতোই । তেমন কিছু নয় । তবু, ভালবাসা শব্দটাই এমন অদ্ভুত । আর এত সহজভাবেই উচ্চারণ করল শব্দটা । একদিক থেকে ভাল হল অবশ্য । মলি আর পীড়াপীড়ি করেনি কোনওরকম । তবে দুল দুটো খুলে রেখেছিল দেখেছি । সকালে বাইরে বেরুবার সময় পরদিন মুখোমুখি একেবারে, হাসলাম একটু । ও কিন্তু স্বাভাবিক । বলল, কোথায় চললেন ? আর বাইরে গিয়েই মনে পড়ল । তাইতো, কানের দুল দুটো দেখলাম না যেন ।
অবিনাশ বলল, বুঝে গেছি আপনার দ্বারা হবে না আর । বললাম, কিভাবে বুঝলে- । পুজোটা যেতে দাও ।
- দূর মশাই- একদিন দুদিন করে কদিন গেল বলুন তো ? ওদিকে বারুইপুর তো প্রায় না-ই করে দিচ্ছে ।
আমি যেন জানি না কিছু । বললাম, কী বলল ওরা ?
- কী আবার ? চল্লিশ হাজার চেয়েছিল ক্যাশ । ত্রিশে রফা হয়েছিল ওর মায়ের সঙ্গে । এখন তো মনে হচ্ছে ছেলে রাজি না ।
- ছেলের কথা বুঝলে কিভাবে । জানিয়েছে কিছু ?
জানায়নি, তবে অবিনাশ ধরে নিয়েছে । ছবি পাঠাবার পর নাকি কুড়িদিন হয়ে গেছে ।
- আপনি মশায় হিজড়ে আছেন, এতদিন হয়ে গেল - একটু চুমু অন্তত খেতে পারলেন না ? এক আধবার জড়িয়ে ধরলেই রোগ ধরে যায় নাকি ? জড়িয়ে ধরলে এমনকী চুমু খেলে বা একটু জড়াজড়ি করলে কিছু যাবে আসবে না । আমি জানি তো, প্রশান্তকে নিয়ে আমিই তো এক হাসপাতালে-, খুব গোপন বিশ্বাস করুন, ওই রোগের কথা জানাজানি হলে একেবারে সবশুদ্ধ উঠতে হত । সেই হাসপাতালের ডাক্তার প্রশান্তকে পরপর ক'দিন পরীক্ষার পর জানিয়েই দিয়েছিল, চিকিত্সা নেই কোনও, এমনকী ওখানেও নিয়ে যেতে বারণ করল, বলল, কাউকে কিছু না জানিয়ে চুপচাপ যেন অপেক্ষা করে মরা পর্যন্ত - আর আমাকে ভয় পেতে বারণ করে বলে দিয়েছিল, শুধু রক্তে রক্তে মিশলেই এ রোগ -।
অবিনাশকে বলতে ইচ্ছে করে, বিশ্বাস কর, আমি ভাবিইনি এতসব । বিশ্বাস কর- । আমার আসলে- । আমি আসলে ঠিক ঠিক বলতে পারি না । অবিনাশকে এই মুহূর্তে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে-, নেহাৎ ওর বাড়ি- ।
পুজোর কটা দিন সত্যিই উড়ে বেড়ালো তুলি । লাল রঙের বাইকে সওয়ারি তুলিকে কে না দেখেছে । নীল রঙের ওড়না ওর চুড়িদারে গা লেপটে আটকে আছে তখন । বাপ্টুদার কোমড় একবার জড়িয়ে ধরার পর আর ভয় নেই । পুজোর একটা সুবিধে আছে অবশ্য । দিনরাত চিত্কার আর মাইকের গানের নীচে সেই `ভটভট' করা শব্দ অনেকটাই ঢাকা পড়ে । ওরা অবশ্য বড় রাস্তা নেয় । বড় রাস্তা ধরে দক্ষিণে হেমন্ত সেতু হয়ে একেবারে শহর । শহরের কেন্দ্র ছাড়িয়ে, আরও দক্ষিণে, আরও- ।
তুলি বলে, আর ফিরতে ইচ্ছে করে না আমার, বিশ্বাস কর । বাপ্টু স্পিড দেয় ।
(পরবাস-৩৯, জুন, ২০০৭)