বাঁধানো বেঞ্চে ঠিক সেই বুড়ো । শুয়ে । চোখে ভাঙা চশমা । প্রায় ফাঁকা মাথায় সাদা চুল কয়েকটা । যেন লেগেই আছে । ছেঁড়া চাদর । কাঁথা । মাথার উপর পাখাটা ঝুলছে এখনও । স্থির । দেওয়াল জুড়ে যাত্রার বিজ্ঞাপন । রঙিন । লাল, নীল, সবুজ রঙের মুখ । একটু কোনাকুনি নেমে আসা । বড় থেকে ছোট হয়ে ত্রক্রমে নামের অক্ষরে মিশে যাওয়া ।
বললাম, দারুণ তো - ।
অনিতদা বলল, তোমাদের পাড়ার - দেশবন্ধুর । লাগিয়ে গেল সেদিন । হঠাৎ করে একটা হর্নের শব্দে চমকে উঠতে হয় । একটা ট্রেন কখন যেন দাঁড়িয়েছে এসে । চা নিলাম একটা । সিগারেট । এরপর যেমন হয়, জানতে চাইলাম, আসে কেউ ? অর্থাৎ আমাদের আড্ডার সেইসব ছেলেরা ।
- নাহ্ - চম্পক ছাড়া সবাই তো করছে কিছু । আসার মধ্যে এক চম্পকই । তবে মাঝে মাঝে । চুপচাপ দাঁড়ায় কিছুক্ষণ, চা নেয় - ।
আগের মতো আর কেউ তাস খেলে না । বেলা বারোটা-একটা পর্যন্ত বিড়ি আর চায়ের উপর ভরসা করে আর কোনও গ্রুপ চিত্কার চেঁচামেচি করে না ? অনিতদা বলল, মরে গেছে স্টেশনটা ।
পালপুকুরে আসতে হল ফের । সেজকাকু লিখেছিল, সুবলকে পাঠাতে ভরসা হয় না । পুরো টাকা হাতে পড়বে কিনা সন্দেহ । বিশ হাজারই আনলাম । ব্যাংকের সাতের সঙ্গে স্টাফদের নিজস্ব ফাণ্ড মানে কো-অপারেটিভ থেকে লোন হিসেবে বাকি তেরো নিয়ে বিশ করা । সত্যদাই ব্যবস্থা করে দিল সবকিছুর । বলল, আমাকে নিয়ে নাকি ঝামেলাই নেই কোনও । বলতে গেলে অনেকটা বেআইনিভাবে টাকা তোলা । আমার মতো নতুন একজনের এতটা পাওয়ার কথা নয় । সত্যদা বলল, তোমার বেলা না করবে না কেউ । আর নিজেদের মধ্যে বোঝাবুঝি ঠিক থাকলে -। জানতে চেয়েছিল, নগেনবাবুকে বলেছ কিছু ? একটু মিথ্যে করেই বলতে হল, হ্যাঁ, নগেনবাবু আপনার প্রশংসা করলেন খুব । বললেন, মতের অমিল থাকলেও আপনি লোক হিসেবে দারুণ ।
রাস্তায় খোকাদার মায়ের সঙ্গে দেখা হল হঠাৎ - খোকাদার মানে সেই শহীদ তুষার চক্রবর্তীর । ফিরছিলেন কোথা থেকে । হাতে ছোট একটা ব্যাগ । বললাম, কোথায় গেছিলেন ?
তখন অবশ্য মাসিমা বলেই ডাকতাম । বয়স্ক মহিলাদের আপনি আর কি ভাবেই বা ডাকবেন ? মাসিমা বুঝে উঠতে পারলেন না প্রথমে । বললাম, সমু - সুধনের ছেলে, চিনতে পারছেন ?
মাত্র দুটো বছর । এমন কিছু বেশি কি ? বললাম, চিনতে পারলেন না ?
কেমন থতমত খেলেন । যেন লজ্জাও পেয়েছেন খুব । বললেন, আমার কি মাথার ঠিক আছে বাবা ? সুধনের ছেলে ? মানে রাখালের দাদার- ?
মিউনিসিপ্যালিটি থেকে নাকি কি একটা ভাতা পাচ্ছেন এখন । মাসে একশ টাকা । আর মেয়ে পাঠায় একশ করে । বললাম, যাবো পরে ।
ঠিক করে নিয়েছিলাম পুবের ঘরের দিকে তাকাবোই না । একবেলা থেকেই চলে আসব । এমনকি মায়ের ছবির কথাও জানতে চাইব না ।
সুবল বাড়ি ছিল না । লক্ষ্মী কান্নাকাটি করল খুব । বলল, দাদা বলতে তো তুমিই- ।
তাকাবো না তাকাবো না করেও চোখ পড়ে গেল । বারান্দার বেড়া এখন আর নেই । দেওয়াল উঠেছে একটা । টানা । একেবারে পুরো ঘর নিয়ে, এমনকি ঘর ছাড়িয়ে সেই কুয়োটার আড়াল করেই । ভেতরে কারা কথা বলছে । ছাউনির টিনে তাপ্পি পড়েছে । আলকাতরার পোঁচও দেখা যাচ্ছে । কাপড় রঙ করার লাল জল গড়িয়ে পড়েছে এদিক ওদিক । সরু ড্রেন প্রায় ভর্তিই ।
সেজকাকিই বলল, তোর মায়ের ছবিটা কোথায় যে গেল ? সতীর কাছেও নেই । এসেছিল সেদিন, জিজ্ঞেস করলাম, বলল, এত বছর আগেকার ছবি- ।
বললাম, থাক- ।
আসলে আমি শুনতে চাই না আর । বাড়িটার গন্ধই পাল্টে গেছে একেবারে । বাড়ি, বাড়ির পাশের মাঠ । মাঠের জমে থাকা জল, এমনকি আকাশও ।
সিন্দুকটার কথা জানতে চাইলাম । সেজকাকু বলল, আছে ।
- কোথায় ?
- বারান্দায় । ওই যে- ।
এতবড় সিন্দুকটা রাখা সোজা কথা ? জায়গা কোথায় ? রাত্রিবেলা কাজের মেয়েটা নাকি ঘুমোয় । সেজকাকু বলল, কে একজন লোক নাকি খুব পীড়াপিড়ি- স্রেফ আমার কথা ভেবেই রেখে দেওয়া ।
কেমন একটু অভিমানী হয়ে গেলাম । কার ওপর যে এই অভিমান কে জানে ? বলে বসলাম, তাহলে রেখে লাভ কি, বিক্রিই করে দিও । সেজকাকু অবশ্য বুঝতে পারল ব্যাপারটা । অপ্রস্তুত হল খুব । বলে উঠল, কী যে বলিস ? আমার কি খারাপ লাগবে না ? বাবা-মার স্মৃতি বলতে তো এটাই- ।
কাপড় তুলতে গিয়েছিল তুলি । ছাদেই । আমার ঘরের উপর টাঙানো তারে । বড়জোর দশ মিনিট । উপরে থাকতেই কড়াইয়ের কিছু একটা পোড়া লাগার গন্ধ পেয়েছে তুলি । দরজা বন্ধ দেখে ভেবেছে বাইরে ডাকছে কেউ । হয়তো বাবা বা সমীরণদা । ভেবেছে হয়তো দরজা খুলতে গেছে মলি । নীচে নেমে রান্নাঘরে কাউকে না দেখে উনুন থেকে কড়াইটা নীচে নামিয়ে মলি কোথায় দেখার জন্য পাশের ঘরের দরজায় চাপ দিতেই টের পায় । টের পায় দরজা ভিতর থেকে বন্ধ । জানালার পর্দটা সরাতেই দেখে, ও মাগো- শরীরটা তখনও কাঁপছে । পাখার ব্লেড নাকি অল্প ঘুরছে তখনও । তুলি তখন পাগল । আছড়ায় । লাথি মারে দরজায় । আর চিত্কার করে- মাগো- দ্যাখো দিদি- ।
এরপর সে অজ্ঞান হয় ।
ক্লাবের ছেলেরা দরজা ভেঙেছিল । শরীর তখনও গরম । ডাক্তারের কথায় অন্তত মিনিট দুই তিন আগে হলেও বেঁচে যেত । সুশান্ত-উত্তমরাই রান্নাঘর থেকে দা নিয়ে দড়ি কেটেছে ।
আফশোস হচ্ছিল খুব । অন্তত ঘন্টাখানেক আগে চলে আসতে পারতাম । স্রেফ বাপ্টুর সঙ্গে দেখা করার জন্যই দেরি হয়ে গেল । স্টেশন থেকে সরাসরি বাড়ি এলে এগারোটার মধ্যে ঢুকে পড়তে পারতাম । স্কুল না গেলেও বাড়িতেই থেকে যেতাম সেক্ষেত্রে ।
তুলির জ্ঞান ফেরেনি এখনও । ওর মা-ই চিত্কার করে ডেকেছে সবাইকে । ওকে নবীন দত্ত হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে । উত্তম আর তরুণ নিয়ে গেছে । অবিনাশ এই এলো । আমি আসার মিনিট পাঁচ আগে । ও নাকি আজ একটু আগেই বেরিয়েছে । তখন এগারোটা বাজতে দশ । ঘটনা ঘটেছে প্রায় সাড়ে এগারোটায় ।
লাশ এখনও পাশের ঘরে । মানে অবিনাশের বড় ঘর আর রান্নাঘরের মাঝের ঘরে । অবিনাশ বলল, সকাল থেকেই খুব চুপচাপ ছিল মেয়েটা । একটু অন্যরকম । ও ভেবেছে, কতদিনই তো হয় এরকম । তুলির সঙ্গে ঝগড়া, বা মায়ের কোনও কথায় খেপে যাওয়া, তাই বলে- ।
আশপাশের বাড়িগুলির প্রায় সবাই এখন এখানে । ছেলেদের মধ্যে অনেকেই অবশ্য বাইরে দাঁড়িয়ে । ক্লাবঘরে বসে আছে কেউ । পার্টি অফিসে খবর গেছে । এম. এল. এ. নিজে নাকি ফোন ধরেছিলেন । উনিই ফোন করেছেন পুলিশকে । ।
কে একজন জানতে চাইল, দড়িটা আছে তো ?
- দড়ি ? সে তো ডাক্তারই খুলে ফেলেছে ।
- ছেঁড়া দড়িটাই- লাগবে । দেখতে চাইবে ।
মুখগুলি যেন পাল্টে গেছে সবার । সন্তুর বাবা মলিকে দেখে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখে ফেলল আমাকে । বলতে শুরু করল, আমি তখন খেয়ে দেয়ে শুয়েছি একটু- । বলল, মলি তো খুব একটা খারাপ মেয়ে ছিল না । ওর বোন হলে না হয়- ।
বাইরে গিয়ে সিগারেট ধরাই একটা । অমিত বলল, পুলিশ নাকি ঘরের কোনও কিছুতে হাত দিতে বারণ করেছে । আমাকে বলল, আপনি তো প্রায় ওদের ঘরের লোকই-, আপনি যদি বলেন, বারণ করেন একটু । ওকে বললাম, প্লিজ, বরং তোমরাই- ।
ছেলেটা অপ্রস্তুত হয়ে `ঠিক আছে, ঠিক আছে', বলল ।
পুলিশ ডাকল আমাকে, জানতে চাইল, কী করেন ?
- টিচার, হরনাথের- ।
- ও- ।
যেন সব বোঝা হয়ে গেল । পেছনের জমে থাকা ভির্ড়েঅ দিকে তাকাল একবার । জানালা দিয়ে এখন অজস্র মুখ । অবিনাশকে ডেকে বলল, জানো কিছু মেয়ের সম্বন্ধে ? আমার সামনেই । জিজ্ঞেস করল, কোনও প্রেম-ট্রেমের -।
অবিনাশ ঢোঁক গিলল । বলল, ওর তো বিয়ের কথা চলছিল । ছেলের মা দেখে গেছে- কথাবার্তা প্রায় পাকা- হঠাৎ করে কী যে হল, ছেলে নাকি রাজি হচ্ছে না ।
- ঘটনার সময় তো বাড়ি ছিলেন না আপনি ?
অবিনাশকে জিজ্ঞেস করলেন অফিসার ভদ্রলোক । ঘাড় নাড়লো অবিনাশ ।
- কী ব্যাপার- মানে -।
- ধরুন অন্য কিছুও তো হতে পারে- কারও মানসিক অত্যাচারে গলায় দড়ি দিতে বাধ্য হল মেয়েটা- মানে হয়তো এরকম- তেমন কিছু হলে বলতে পারেন ।
বিমলবাবু নিজেই এসেছিলেন । এম. এল. এ. মানুষ । সঙ্গে নির্মলদা । আমাকে দেখে হাসলেন একটু । বিজনবাবু আসায় সবকিছু বেশ দ্রুতই মিটে গেল । ভ্যান ডাকতে বললেন একটা । সাইকেল ভ্যান । বিছানার চাদরটা দিতে হল । প্রায় আড়াইটা নাগাদ সাইকেল ভ্যানটাকে আগে পাঠিয়ে স্টার্ট দিল জিপটা ।
বিজনবাবু ডাকলেন অবিনাশকে । নির্মলদাকে বললেন, ওকে যেন কিছু করতে না হয় ।
লাবণ্য ঠিকই বলেছিল, আমাদের আসলে ভালবাসা আছে একটা । মৃত্যুর প্রতি । বা, মৃত্যুর ভয়াবহতার প্রতিই । পচা গলা শরীরের বীভত্সতা আমাদের ভাল লাগে খুব ।
মর্গের ডাক্তার বারবার বলছিল, ভিড় করবেন না সরে যান । লাঠি হাতে একটা পুলিশ ধমকাচ্ছিলও । তবু অন্ধকার সেই ঘরের শীতলতা যেন নেশা ধরায় তখন । সেই ঘ্রাণ । মাছির সেই উড়ে যাওয়া, রক্ত আর রসের সেই দলা হওয়া, মেঝের সেই পিচ্ছিলতা অদ্ভুত এক ত্রাস সৃষ্টি করে কোথাও । এই ত্রাস দাঁড়িয়ে পড়ার । হিম শীতলতার, শব্দহীনতার । এই ত্রাস মিলনেরও । দীর্ঘস্থায়ী কোনও সঙ্গমের ।
`শ্যামপুর- শ্যামপুর থানা' - বলে চিত্কার করা মাত্র, ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা চোয়াড়ে মার্কা লোকটা বলতে শুরু করল, মলি ব্যানার্জী- বাবার নাম অবিনাশ -। এক ঝটকায় চাদরটাকে দেওয়ালের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে শরীরটাকে ল্যাংটো করে দিল একেবারে । দুটো পা ধরে টানতে শুরু করল ।
কেউ ফিসফিস করে বলল কিছু । ভির্ড়েঅ মধ্যে কে যেন জানতে চাইল, প্রেগনেন্ট ? পাশের ছেলেটা সিগারেটে আগুন দিতে দিতে বলল, রেপড হলে ধরা পড়বে ঠিক ।
আসবো না আসবো না করেও চলে আসতে হল । প্লাটফর্মে পা দেওয়া মাত্র হর্ন পড়ল হঠাৎ । ট্রেন ছাড়ল কোনও । যেন সত্যিই ধমকে উঠল কেউ, কী হল ? নগেনবাবুর ঘরের কথা মনে পড়ল হঠাৎ ।
ঘর, ঘরের দেওয়ালে ঝুলে থাকা ছবি । জানালা । জানালার বাইরে চোখে পড়া পুকুর । বাড়িঘর । অটো থেকে নেমে রাস্তায় পা দিতেই বুঝি, যা ভেবেছিলাম ঠিক তা নয় । বেশ অন্যরকম । বরং আগের দিনের চেয়ে বেশি লোক । একটা গাড়ি । সত্যি কথা বলতে কি, ঢুকবো কি ঢুকবো না ভাবছিলাম । ঘরের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা কুড়ি বাইশের কয়েকটি ছেলে দেখলাম চেনে আমাকে । বলল, প্রবাল সেন এসেছেন- মানে মন্ত্রী । ওদের কথার ভাব দেখে বোঝা গেল, ঘরে ঢোকা না ঢোকার ব্যাপারে সিদ্ধান্তটা আমাকেই নিতে বলছে । অর্থাৎ নগেনবাবুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিয়ে একটা ধারণা আছে ওদের মনে ।
বললাম, পিসি কোথায় ?
ওদের মধ্যে একজন হাসল একটু । বলল, কোথায় আর থাকবে, ভিড় দেখে রান্নাঘরে বসে আছে ।
একটা ছেলে বলল, বসুন না আপনি ।
কে যেন ফিসফিস করে, `হরনাথ' নামটা উচ্চারণ করল ।
বললাম, যাই পিসি কী করছে দেখি ।
নগেনবাবুর ঘরে খুব বেশি লোক নেই । প্রবাল সেনের ছবি কোথাও দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না । কম গুরুত্বপূর্ণ কোনও দপ্তরই হবে । তবে নাম শুনেছি । পার্টিতে গুরুত্ব আছে হয়ত ।
রান্নাঘরে গিয়ে দেখি বাটিতে জল গরম করছে পিসি । বললাম, চা করছ ?
পিসি এ-বাড়িতে কাজ করছে প্রায় ত্রিশ বছর । এটা অবশ্য হিসেব করে পাওয়া । ওর কথায়, যেবার পাড়ায় ফিরল সব, ধরে নিতে হল সাতাত্তরের ইলেকশনের ঠিক আগে তার মানে, সাতাশ-আটাশ বছর । পিসির ছেলে ছিল একটা শ্যামল । বাহাত্তরের কোনও এক সকালে বাড়ি থেকে বের করে- । ত্রিশ-একত্রিশ বছর আগে । ছেলেবেলার সেই পালপুকুর স্কুলের হেডস্যারের মতো করে বলতে গেলে, থার্টি ইয়ার্স অ্যাগো- । আমার বয়স তখন এক কি দুই । মা মারা গেছে আগেই । বাড়িতে শুধু বাবা, সেজকাকু, পিসি । হ্যাঁ, দাদুও । সেই সিন্দুকের পাশে বিছানা ।
বললাম, মন্ত্রী খেতে চাইবে এই চা ?
পিসির কথায়, কত বড় বড় লোক এলো -!
মন্ত্রী চলে যাওয়ার পর নগেনবাবু নিজেই এলেন । জানতে চাইলেন, তেমন দরকার আছে নাকি কোনও । ঘাড় নেড়ে না করলাম । ঘরের ভেতর এখন অনেক লোক, মানে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেরা সব । শনিবার আসতে বললেন । পিসিকে বললেন, ভাল করে বাজার করতে বলবে তো একটু, সমু আর আমি একসঙ্গে খেয়ে বেরুবো সেদিন । বেরিয়ে আসার সময় ডাকলেন ফের ।
- অবিনাশের মেয়ের কী হয়েছিল ?
একটা অটো শব্দ তুলল । মাইক বাজছে কোথাও । নাকি টেপই । দোকানেরই হয়তো । হিন্দি গান । নিশ্চিত নাচের কোনও দৃশ্য ।
বললাম, সুইসাইড করেছে, গলায় দড়ি -। ঘরের মধ্যেই ।
বারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন, কোনও ব্যাপার ট্যাপার ছিল ? জানো কিছু ?
- না, মর্গের ডাক্তারও তো বলেনি, মেয়েটা তো ভালই -।
নগেনবাবু বললেন, বাড়িটাতে ঝামেলা আছে অনেক । বদনামও । বরং অন্য কোনও জায়গায় ঘর নিতে বললেন উনি, চেষ্টা করতে বললেন । নগেনবাবুর কথায়, পুরো বাড়িটাই- ।
- অবিনাশের সঙ্গে ওই বাড়ির এক বউয়ের ঝামেলা চলছে ।
- লাবণ্য ?
- চেন তুমি ?
বললাম, চিনি না, তবে নাম শুনেছি অবিনাশের মুখে । মাঝে মধ্যে ছাদে দেখেছি ।
বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলেই হাত দেখিয়ে থামালো । ফাঁকা অটোই । ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, নগেনদার ভাইপো । এরপর যা হওয়ার- সে কিছুতেই ভাড়া নেবে না । নগেনবাবু নাকি অটো ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট । স্টেশনে পৌঁছে বলল, যা দু'পয়সা করে খাচ্ছি তা এই লোকটার জন্যই ।
এখনও স্কুলে যাওয়া যেতে পারে ইচ্ছে করলে । এখনও অন্তত চল্লিশ মিনিট । রিক্সা নিলে স্টেশন এখান থেকে দশ মিনিটের । বাসে দুটো স্টপেজ । বাড়ি হয়ে স্কুলে আসার কথা ভাবলে, বড় জোর মিনিট দশের দেরি হতে পারে ।
বাসে উঠে বললাম, হাসপাতাল, নবীন দত্ত ।
একদিক থেকে ভাবলে সেই তান্ত্রিকের মাদুলিতে কাজ হয়েছে ঠিক । বলেছিল, মাস দুয়েকের মধ্যেই ফল হবে । অবিনাশকে অবশ্য আর কী বা বলতে পারতাম । কুসংস্কারগুলি হয়ত এভাবেই জন্ম নেয় । অবিনাশ অবশ্য জানতে পারবে না কোনওদিন, ওর বউও নয় । মাদুলিতে তবু মলির একটা চুল থেকে গেল । পৃথিবীতে একটা চিহ্ন । ওর শরীরের একটা কিছু । ওর মায়ের হাতেই । কালো সুতো দিয়ে বাঁধা ।
লাবণ্য জানতে চাইল, ভয় করে না আপনার ?
- কেন ?
- মলির জন্য । এই একেবারে পাশেই খুব পরিচিত কারওর মৃত্যুর পর একা একটা ঘরে- ফাঁকা ।
বারবার জানতে চাইল, গলায় দড়ি দেওয়ার কী এমন কারণ ছিল ?
বলল, আমিও দেব দেখবেন । আমাকেও - । হয়তো আপনাকেই বের করতে হবে ।
ওর মতে গলায় দড়ি নাকি বিশ্রি । জানতে চাইল, জিব বেরিয়েছিল ? চোখ ? চোখ কি একেবারে ঠেলে বেরিয়ে আসা ?
লাবণ্য বলল, আমি তখন স্নান করছি -।
ওর মতে, আত্মহত্যার ব্যাপারটা প্রায় নেশার মতোই । ও দেখেছে অনেক । কবে নাকি কে গায়ে আগুন লাগিয়েছিল নিজের । রেলের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে কে যেন বেঁচেও গিয়েছিল সে দিনের মতো । পরে শেষ পর্যন্ত সেই গায়ে আগুন দিয়েই -। প্রশান্ত- মানে ওর স্বামীর সুইসাইডের কথা কি ইচ্ছে করেই ভুলে গেল ? প্রশান্তর মৃত্যু নিয়ে কিছু তুলল না দেখে আমিও ওর সুইসাইড নিয়ে জানতে চাই না আর ।
বললাম, তোমার ইচ্ছে করেছে কোনওদিন ?
তাকিয়ে রইল চুপ করে । দেখল আমাকে । বাঁদিকে ভাঙা জানালা । কুয়াশা । আড়ালের চাঁদ । চাঁদের চারপাশের হলুদ ।
লাবণ্য বলল, সব ইচ্ছের কথা কি সবাইকে বলা যায় ? আপনি বলতে পারেন ?
প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্যই যেন জিজ্ঞেস করতে হল, লিপিকে গান গাইতে দিলে না কেন ?
- ক্লাবের ফাংশানে ? আসলে ওকে নিয়ে একটা ভয় আছে আমার ।
বললাম, মেয়ে বলে ?
লাবণ্য চুপ করে রইল । অনেকক্ষণ । যেন কী বলবে ঠিক করে উঠতে পারছে না । নাকি এটা ঠিক উত্তর দেওয়ার মতো কোনও প্রশ্নই নয় । নীরবতা বেশ বিপজ্জনক, দেখেছি আমি । তখন কোথায় কী যে রাখব ঠিক করা যায় না । চোখ, হাত, পা । হাতের আঙুল, এমনকি আবেগও । সেই ছোটবেলায় কৃষ্ণার ঠোঁট টিপে দেওয়ার কারণও হয়ত সেই নীরবতাই । সেই চুপ করে থাকা । কৃষ্ণা পরে বলেছে, ও নাকি আন্দাজ করেছিল । একবার চোখ খুলে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার মুখ দেখেই টের পেয়েছিল । মেয়েরা নাকি টের পায় সব । সহজ হওয়ার জন্যই রসিকতা করতে চাইলাম একটু, বললাম, মেয়ে বলে তোমার কোনও অসুবিধা হয়েছে ?
- অসুবিধা ? তা কেন ? আপনার মতো পুরুষরা আছেন না ?
- কেন, আমি আবার কী করলাম ?
লাবণ্য এরপর অদ্ভুত একটা কথা জিজ্ঞেস করল, আপনি এখানে কেন আসেন বলুন তো ?
কদিন ধরেই কানে বাজছে কথাটা । আসেন কেন ? এখানে কেন আসেন বলুন তো ? কেন ? আমি কি তখন ওকে ভালবাসার কথা বলতে পারতাম ? ভাল লাগার কথা । বলা যেত, আসতে ভাল লাগে তাই । ওর কথা জিজ্ঞেস করা যেত । তুমিই বা কেন- ?
সন্ধ্যাবেলা লিপি পড়তে যায় । পড়তে যাওয়া নিয়ে কোনও ভয় নেই লাবণ্যর । পাশের বাড়ির মুখার্জিদা ব্যাংকের কেরানি । লিপি ওর মেয়ের বন্ধু । একই স্কুলের । ভদ্রলোক নাকি ইংরেজিতে ভাল খুব । অফিস থেকে এসে বাড়িতেই বসে পড়ান ।
অবিনাশ অনেক কিছু হারালেও ওদের পরিবারের ঐতিহ্য নিয়ে একটা দুটো ব্যাপারে আটকে আছে এখনও । অন্তত প্রশান্ত সম্বন্ধে কোনওদিন খারাপ কিছু বলেনি । লাবণ্য নাকি নোংরা । খারাপ মেয়ে একেবারে । সে না হয় রাগ করেই- মানে, জমি বাড়ির ব্যাপারটাই হয়ত কাজ করছে তখন ।
একটা কথা, অবিনাশের বউয়ের মাদুলিতে সত্যি সত্যি লাবণ্যর চুল থাকলে লাবণ্যর কি সত্যিই ক্ষতি হোত, এটার সত্যতা বোঝার মতো কোনও রাস্তা এখন আর অবশ্য নেই ।
দরজা বন্ধ করে বাইরে বেরুতে গিয়ে দেখি, লাল পিঁপড়ের বিশাল একটা সারি । ঘরের ভিতর, মানে দরজার ডানদিক থেকে বাইরে বেরিয়ে আসছে । তালাটা খুলে দরজার পাল্লা ঠেলতেই দেখি, টিকটিকিটা মরে আছে । সেই ধূসর পিঠওয়ালা । লম্বা লেজের । লাল চোখ তখনও খোলা । লেজটা শরীর থেকে অনেকক্ষণই আলাদা । শরীর থেকে প্রায় ইঞ্চি খানেক দূরে । খুব ঘন একটা ঝাঁক লেজটা নিয়ে দরজার দিকে আসছে । বাইরে বেরোবে ।
অবিনাশকে বললাম, আর ভাল লাগছে না, ভাবছি অন্য কোথাও- ।
ও অবাক হল না একটুও । বলল, কটা দিন বাদ দিয়ে গেলে হয় না ?
তুলিকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিয়েছে । ও বাড়ি ফিরেছে সকাল দশটা নাগাদ । ওর বাবার সঙ্গেই । অবিনাশকে বললাম, আমি গিয়েছিলাম তো ! ফাঁকা বেড দেখে- । অবিনাশ কোন এক ডাক্তারের কথা বলল, ডাক্তার নাকি বলেছে, স্রেফ ভয়েই- । তবু সেই ভদ্রলোকের কথায় সাহসের পরিচয় দিয়েছে মেয়েটা- ওরকম দৃশ্য দেখলে যে কেউ হার্টফেল করতে পারে । গলায় দড়ি দেওয়া লোকের নাকি দারুণ কষ্ট, হাত নাকি তখন দড়িটাকে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে । ওঠে না যদিও । ঘাড় নাকি ভাঙে । ফাঁসির আসামীর জন্য নাকি আধঘন্টা সময় থাকে । কুয়োর মধ্যে নেমে যাওয়া শরীরটা নাকি কাঁপে অনেকক্ষণ । ডাক্তারের মতে অন্তত পাঁচ-সাত মিনিট কষ্ট পায় খুব ।
বারান্দায় ঢুকেই ডাকলাম, পিসি- ।
রান্নাঘরে টুকটাক শব্দ শুনে বুঝি, আছে ওখানেই । পিসিকে ভাল লাগে খুব । পুরনো কোনও ঘ্রাণের কথা মনে পড়ে, যে ঘ্রাণ ছিল কোথাও হয়তো বা স্মৃতিতেই- এখন মনে পড়ছে না ।
নগেনবাবুর শরীর খারাপ খুব । জ্বর । শরীরময় নাকি ব্যথা । শুয়ে আছেন । দেখে, বসতে বললেন । জ্বর আর ব্যথা শুনেই কেন যেন লাবণ্যর কথা মনে পড়ে । লাবণ্য, ওর স্বামী প্রশান্ত । কী এমন হয়েছিল প্রশান্তর । দিনের পর দিন জ্বর, গায়ে ব্যথা, দিন দিন রোগা হয়ে যাওয়া । কী এমন অসুখ ছিল যে ডাক্তার কোনও বাঁচার চান্স না থাকার কথা বলবে ? কী এমন অসুখ ?
- ডাক্তার দেখাননি ?
আগের দিন হয়তো লক্ষ করিনি ভাল করে, দেখি, মুখের দু-এক জায়গায় কেমন কালশিটে । মাত্র কয়েকটা দিনের মধ্যেই কেমন পাল্টে গেছে লোকটা ।
ঘরের একদিকে মেন রোড আরেকদিকে পুকুর একটা । জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া পুকুরের ওপার । ওপারের বাড়িঘর । রাস্তা । খেলতে থাকা ছেলেরা ।
কোনও দরকার আছে কিনা জানতে চাইলেন । স্কুলের কথাটা বলব কিনা ঠিক করে উঠতে পারি না । ওর জ্বর বা শরীর খারাপের জন্য নয়, চারপাশের কেমন একটা শূন্যতার জন্যই যেন এই ফাঁক আর ভরাট হওয়ার নয় । ওর গলার আওয়াজেও এক ধরনের যেন কষ্ট ।
বললেন, স্কুলের কিছু ?
কথা শুরু করার জন্যেই যেন বিপিনের দিদির প্রসঙ্গটা টানতে হল । `বাচ্চা একটা ছেলের সঙ্গে-।' বললাম, কদিন আসছে না স্কুলে । ওর সঙ্গে সত্যদার তর্কের কারণটা বললাম । ওটা আসলে ঠাট্টাই ছিল, আর গত মাধ্যমিকে অংকে সত্যিই খারাপ রেজাল্ট হয়েছে । বিপিনের দিক থেকে বলার মতো ব্যাপার হল, টেনে ক্লাস ছিল না ওর । বা, নতুন রুটিনে ক্লাস না থাকার জন্য ক্ষোভও হতে পারে । বললাম, এমনকি আমারও মনে হচ্ছে, এত বড় কথা ও না বললেই পারতো ।
জানালার বাইরে ডালিম গাছটা প্রায় মরাই । রোদ লাগছে । ডালগুলির ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে যত্ন নেই তেমন ।
বললাম, একজন সিনিয়র টিচারকে পার্টি করার ব্যাপার নিয়ে না বললেই ভাল করত ।
- তোমাকে কি বলল ? মানে সত্য- ।
সার্টিফিকেট দিতে বলল, অবশ্য ওটা নাকি আমার জন্য নয় । স্রেফ বিপিনের জন্যই-, উনি নাকি কনফার্ম, ওর এম. এস. সি-র মার্কশিটে কারচুপি আছে- । জালই- ।
- নির্মল যায় না স্কুলে ?
- নির্মলদা ? হ্যাঁ ।
- ও নাকি তোমাদের পাড়ায় গিয়েছিল দুদিন- তোমাদের মানে অবিনাশের বাড়িতেই- ।
বলতে পারলাম না । শুনিইনি । এমনিতে মলির সুইসাইডের দিন ধরলে অবশ্য গিয়েছিল ঠিকই । তাও একদিনই ।
জানা কথাটাই বললাম । অর্থাৎ গিয়ে থাকলে আমি দেখিনি ।
পিসি চা দিয়ে গেল । শুধু আমার জন্যই । বললাম, খাবেন না আপনি ? উনি ঘাড় নাড়লেন । ভাল লাগছে না একদম । জিবের টেস্ট নাকি নষ্ট হয়ে গেছে । বললাম, হয়তো ঠাণ্ডার জন্যই । দুম করেই যেন পড়ে গেল শীতটা । কথা শুনে উনি শুধু জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন একবার । কালো রঙের একটা পোকা উড়ছিল । জানালার বাইরেই । সেই ডালিম গাছের পাতায় একদিক থেকে আরেক দিকে । ডালিম গাছ ছাড়িয়ে কিছু রোদ তখন নগেনবাবুর জানালায় ।
মার্কশিট আর সার্টিফিকেট উনি ওর কাছেই নিয়ে আসতে বললেন- সেই মুকুন্দদার দেওয়া, অংকে অনার্স আর এম. এস. সি. । জানতে চাইলাম, অরিজিনাল না জেরক্স ?
- অরিজিনালটাই ।
- স্কুলে দেব না ?
- দিতে হবে না এখন । সত্য যখন বলেছে স্রেফ বিপিনের জন্য, তখন তোমার কাগজপত্রের জন্য খুব একটা জোর দেওয়ার কথা নয় । বলবে, পালপুকুরে রয়ে গেছে, নিয়ে আসতে হবে ।
সাড়ে নটা নাগাদ উনি নিজেই উঠে পড়তে বললেন আমাকে । বললেন, শরীরের জন্য যাবেন না কোথাও । আর, পিসিও বাজারের কথা বলতে ভুলে গেছে । আগের দিনের একসঙ্গে খেয়ে বেরুবার কথা তুলে একটু হাসার চেষ্টা করলেন । এত অপ্রস্তুত হলাম ! বললাম, আজ তো শনিবার, শনিবার স্কুলে যাওয়ার সময় প্রায় দিন না খেয়েই - চারটে মাত্র পিরিয়ড ।
অবিনাশদাকে নিয়ে ওর কথার মধ্যে বেশ অভিমান আছে । ক্ষোভও আছে খুব । ওর কথায়, অবিনাশ যদি নির্মলকে ভগবান মনে করে থাকে, তবে ভুল করবে খুবই । বাড়িঘর হোক এটা সবাই চায়, তাই বলে নিয়মকানুন না মেনে ? কোনও অসহায় মহিলাকে ঠকিয়ে ? ওর কথায় পাশের ঘরের ভদ্রমহিলার সঙ্গে ওরা সবাই দুর্ব্যবহার করেছে খুব । হতাশাও প্রকাশ করলেন, বললেন, এই তো সব লোক - । এদের নিয়েই চলতে হবে আমাদের ।
অটো ধরব বলে দাঁড়িয়ে আছি । দূর থেকে আসা ভট-ভট শব্দও শুনছি । হাতে সিগারেট । ভাবছি, দোকানে বসে চা খেয়ে নিলে হোত একটা, বা টোস্ট করা পাউরুটি । বাড়ি ফিরব না আর । সরাসরি স্কুলেই ।
পেছন থেকে ডেকে উঠল কেউ, স্যার -।
মুখ চেনা লাগলেও ঠিক মনে করতে পারলাম না । ছেলেটার বয়স অন্তত পঁচিশ-ছাব্বিশ । তার মানে আমার ছাত্র নয় । হয়তো কোনও ছাত্রের দাদা বা প্রাইভেট টিউটরই হবে । বললাম, কি ব্যাপার ?
ছেলেটা ডাকল, যেতে বলল ওর সঙ্গে । কাছেই । জিজ্ঞেস করল, আপনি তো হরনাথ স্কুলেরই- নগেনবাবুর ভাই তো ?
- ভাই মানে, উনি আমার বাবার বন্ধু - কাকুও বলতে পার ।
কাল নাকি ফের গণ্ডগোল হয়েছে খুব । ওরিয়েন্টালে । ছেলেটা বলল, ঘন্টাখানেক আগে এলে নাকি ঝামেলায় পড়তে হত । প্রায় সাত আটজনকে তুলে নিয়ে গেল ।
ছেলেটা নাকি দূর থেকেই লক্ষ করেছে । বললাম, নগেনবাবু তো বললেন না কিছু ।
- উনি আর কি বলবেন । ভেবেছেন জানেন হয়তো । ওদের টার্গেট ছিল ওকে শেষ করা ।
উনি নাকি কাল শুধুমাত্র দাঁড়িয়েছেন । ওরিয়েন্টাল গেটে । দাঁড়ানো মাত্রই- । ছেলেটা বলল, আমরা না থাকলে- ।
কাল সারারাত ধরেই নাকি পাহারা চলছে । এখনও সবাই লক্ষ রাখছে ঠিক । কত ধরবে ওরা ? ওর মতে মূল দ্বন্দ্বটা এম. এল. এ. বিজনবাবু আর নগেনদার । নির্মলদা জাস্ট বিজনবাবুর হয়ে- ।
স্টেশনে যাওয়ার জন্য একটা রাস্তা ধরিয়ে দিয়ে ছেলেটা বলল, ভয়ের কোনও কারণ নেই । এখানকার গণ্ডগোলের কথা রাজ্য-কমিটিও জানে । তবে, বিজনবাবু যেভাবে পুলিশকে কাজে লাগাচ্ছেন- ।
তুলি এখন একেবারেই চুপচাপ । অবিনাশকে বললাম, বরং ওর জন্য একটা টিভি কি অন্য কিছু নিয়ে আসো । টেপ হলেও হবে । এতবড় একটা বাড়ির এই অসহ্য নীরবতার চেয়ে দুই বোনের ঝগড়া ভাল ছিল । অনেক সময় উপভোগেরও । ওদের একজনের আরেকজনের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ- এমনকি আমার নাম জড়িয়েও, কোনও কোনও সময় কান পেতে শুনেছি । এখন এক জল তোলার শব্দ- সেই প্রাচীন আর শ্যাওলা ধরা চাকে ভর দিয়ে তুলি যখন কুয়োতে বালতি ফেলে, যখন সেই বালতি জলে ধাক্কা খায় আর উপরে ওঠে, টের পাই তুলি আছে, আছে এখনও । এক একদিন বালতি থেকে উথলে পড়া জল অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়ায় । অনেকটা । আগে হলে মলি চিত্কার করতো ঠিক । ঠিক বলত, এটা সুধাংশু হাজরার বাড়ি নয় ।
লাবণ্য নাকি ধ্বংস দেখতে চায় । এই ফ্যামিলির । ওর কথায় ব্যানার্জিবাড়ির লোকগুলি কোথায় নেমেছে দেখুন - সিগারেটের গুমটি, টেলারিং-এর দোকান, স্কুলের ফোর্থ ক্লাস । তিন পুরুষ আগেকার হাইকোর্টের এক বিচারপতির কথা উল্লেখ করেছিল লাবণ্য । গণনাথ ব্যানার্জি । বলছিল, ভাবুন একবার ।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় তুলি শুধু বলল, বাবা দেখা করতে বলেছে । ব্যস । আর কিছু নয় । এরপর যেন রেডিওর সুইচ শুধুমাত্র ঘুরিয়ে দেওয়া ।
অবিনাশ জিজ্ঞেস করল, নগেনবাবুর বাড়ি গিয়েছিলেন ?
- হ্যাঁ ।
অবিনাশের বউ সুস্থ হলেও পুরোপুরি হাঁটাচলার মতো হয়ে ওঠেনি । তুলি রান্নাঘরে । অবিনাশ বলল, আমার কথা বলল কিছু ? মলির কথা জানে ?
ওর কথায় নগেনবাবুর কাছে এখন না গেলেই নাকি ভালো । খুলে বলতে চাইল না কিছু । বলল, একসময় ওকে প্রায় গুরুর আসনে বসিয়েছি । উনসত্তর সত্তরে ওর মতো সাহস কজন দেখাতে পেরেছে ? কেউ অস্বীকার করবে না । একা পাঁচ-সাত জনের মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখতেন । ওর জন্যই এলাকার নকশালরা বেড়ে উঠতে পারেনি তেমন । ওর কথায়, আমাকে সব কথা এখন বলা যায় না । আফটার অল, নগেনবাবুর লোক হিসেবেই সবাই চেনে আমাকে । বাবার বন্ধু । বলতে গেলে বাবাই । বললেন, তোমার জন্য করেছেন অনেক কিছু ।
নগেনবাবুর শেষ দু-তিন বছরের জীবনযাত্রা নাকি সবাইকেই হতাশ করেছে । পার্টি বোঝাবার চেষ্টা করেছে অনেক । এমনকি গত এক বছর ধরে ওকে বুঝিয়েও দেওয়া হচ্ছে, সরিয়ে দেওয়া হবে সব পোস্ট থেকে ।
মোট কথা প্রচুর অভিযোগ আছে অবিনাশদের । হয়তো আমাকে বলা যাবে না । বা বলতে পারছে না কোনও কারণে ।
কটা দিন বাদ দিয়েই যাব বলে ঠিক করেছিলাম । ছেলেটা যাই বলুক আমারও বিশ্বাস ছিল ঠিক হয়ে যাবে । রাজনীতিতে এসব তো হয়ই । ব্যক্তিগত কুত্সা নতুন কোনও ব্যাপার নয় । হয়তো উনি কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন । আর এটাই তো নিয়ম । এটাই সেই সময়, যখন বাকিরা চিত্কার করে ঝাঁপিয়ে পড়বে, ছিন্নভিন্ন করে দিতে চাইবে ।
যা ভেবেছিলাম, তাই । বেশ ভাল । চেয়ারে বসে কাগজ পড়ছিলেন । পার্টির কাগজই । জানতে চাইলেন, এনেছি কিনা । অর্থাৎ সেই মার্কশিট, সার্টিফিকেট । ওর কথায়, মুকুন্দ খুব একটা কাঁচা কাজ করে না । অনেক বড় বড় লোকের কাজই নাকি করে দিয়েছে ও । তবু শুধুমাত্র সতর্কতার জন্যই উনি নাকি জিজ্ঞেস করতে চাইছেন মুকুন্দকে । একটু দেখিয়ে নেওয়া । বললেন, এমনিতে ভয়ের কিছু নেই । উনি খোঁজ নিয়েছেন । সত্যদা নাকি স্রেফ জেদাজেদির জন্যই করেছে এটা, ওর ধারণায়, ইয়ারকিটা বিপিনের গায়ে এতটাই আঘাত করেছে যখন, কিছু থাকলেও থাকতে পারে । আর দীর্ঘদিন বিপিনের স্কুলে না আসাটা নাকি সত্যদার সেই সন্দেহটাকে বাড়িয়ে দিয়েছে । সত্য রায়ের কথায়, বিপিনের দিদি চলে গেছে তো কি হয়েছে ? ওর দিদি কি নাবালিকা ? তাছাড়া ছেলেটা ছোট হলেও নাবালক তো নয় । বরং একটা অশান্তির হাত থেকে বেঁচেছে বিপিন । আর শুধুমাত্র এজন্য এতদিন কামাই করে কেউ ?
দাগগুলির কথা জানতে চাইলাম । বললাম, সেদিন বললেন না কেন ?
জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন ভদ্রলোক । বাসন মাজার আওয়াজ আসছে জানালা দিয়ে । পুকুর । পুকুরের বাঁধানো ঘাট । কাপড় কাচা । ঘাটের দুপাশে গাছ । অল্প বাতাসে সাদামাটা কাপড়ের পর্দাটা নড়ছে তখন ।
বললেন, ডাক্তার বলেছে মুছে যাবে- ।
টিচার্স রুম স্বাভাবিক অনেকটাই । এমনকি বিপিনও । সত্যদা নিজেই ডাকখোঁজ করলেন । না আসার কারণ জানতে চাইলেন । শরীর খারাপ কিনা জিজ্ঞেস করলেন । বিপিন দিদির কথাই বলল । ওর কথায় ছেলেটা দীর্ঘদিনের চেনা । বয়স অল্পই । তবে যত কম বয়সের বলছে ততটা নয় । ওর দিদির সমবয়সী প্রায় । এক আধ বছরের ছোট হতে পারে ।
ওর কথায় সায় দিল সবাই । এমনকি সত্যদাও । ওর পরিচিত কোনও মেয়ের উদাহরণ দিলেন একটা । বললেন, ভালই আছে তো । এক ছেলে, এক মেয়ে এখন নাকি ভরা সংসার । কথা প্রসঙ্গে স্বরূপবাবুই সার্টিফিকেট মার্কশিটের কথা বললেন । জানালেন, ইতিমধ্যে নাকি দিয়েও দিয়েছে অনেকে । বিপিন বলল, ওর দেরি হবে কদিন- । কারণ বলল না কোনও ।
টেস্টের রেজাল্ট নিয়ে মিটিং হল আজ । অংকে ফেল করেছে খুব, ভৌতবিজ্ঞানেও । বাইরের প্রশ্ন । বললাম, যা ছেলে আছে এবার সাতের বেশি ফার্স্ট ডিভিসন হবে না । কিছু ছেলে তো এ প্লাস বি হোলস্কোয়ারের ফর্মুলাই জানে না । স্বরূপবাবুর কথায়, আপনারা যা ঠিক করবেন করুন । অ্যালাউ ডিজ-অ্যালাউ-এর ব্যাপারটা আমাদের উপরই চাপিয়ে দিলেন ।
ফেল করা ছেলেদের পাশ করবার ব্যাপারে আমার কোনও আলাদা আগ্রহ নেই । অর্থাৎ ওদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য আমার আলাদা কোনও দায় নেই । সুধাময়ের আছে । সুধাময় বলল, শুধু ছেলেদের উপর দোষ দিলে তো হবে না ? আর এটা তো শতকরা একশ জনের ফার্স্ট ডিভিসনে যাওয়ার স্কুলও নয় । ওর কথায় যারা ফেল করেছে তাদের অনেকেই বেরিয়ে যাবে । হল ম্যানেজ করবে অনেকেই । অমিত সায় দিল ওকে । গত বছরের উদাহরণ টানল । টেস্টে অংকে পাঁচ পাওয়া ছেলে শেষ পর্যন্ত আটান্ন পেয়েছে । কে যেন নাম জানতে চাইল ছেলেটার । অমিত বলল, সেকেণ্ড ডিভিসন পেয়েছে শেষ পর্যন্ত । বিপিন বলতে ওঠার সময় অনেকেই চঞ্চল হয়ে উঠল বেশ । সত্যদা হাতে কলম নিয়ে তাকাল ।
- তার মানে ওদের হল ম্যানেজ করার ব্যাপারটাকে সাপোর্ট করছি আমরা ।
- সাপোর্ট নয়, যা হচ্ছে তা শুধু স্বীকার করে নেওয়া ।
ক্লাস ফাইভে ক্লাস ছিল আজ । সি-তে । ওদের যা স্বভাব, নালিশের লিস্ট । মনিটারের ডায়েরিতে অন্তত কুড়িজনের নাম । বললাম, সত্তর জনের ক্লাসে কুড়িজন ? কথা শেষ না হতেই থার্ড বেঞ্চের মাঝের দিকের একটা ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার, পিন্টুকে দেখলাম সেদিন ।
- কোন পিন্টু ?
- ওই যে বললেন না- গতবার ফেল করেছিল- প্রণাম করেছিল আপনাকে ভুল করে ।
কে একজন বলে উঠল, না স্যার- পিন্টু তো আমাদের ওখানে থাকে, ওটা বাপি । ধমকে উঠলাম, থাম- একজন বল ।
- ওর নাম স্যার, বাপি- আমি দেখেছি ।
আগের ছেলেটা আমাকে গ্রাহ্য না করেই ধমকে উঠল পরের ছেলেটাকে, বেশি জানিস ? প্রথম ছেলেটিকে বলতে বলে পরের ছেলেটিকে বসতে বললাম । জানতে চাইলাম, কোথায় ?
- চায়ের দোকানে । কাজ করছিল, আমাকে দেখে লুকিয়ে পড়ল ।
- কোন চায়ের দোকানে ?
- সিনেমা হলের পাশে, টেপ বাজে যে দোকানে- কোল্ড ড্রিংকস ।
ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে এবার মনিটর ছেলেটাই চিত্কার করে উঠল, তার মানে সিনেমায় যাও তুমি ।
- না স্যার, মায়ের সঙ্গে বেরিয়েছিলাম- ঠাকুরের বাসন কিনবে তাই ।
- ঠাকুরের বাসন ?
- ওই যে ঠাকুর খাবে না ? গ্লাস, থালা ।
এদের কথা সত্যি হয়ে থাকলে, ছেলেটাকে নিয়ে ভেবে লাভ নেই । নির্ঘাত পরীক্ষাই দেয়নি । কিন্তু ছেলেটার নামটা তাহলে কি ? বাপি না পিন্টু ?
স্কুল-মাস্টারির সবচেয়ে ঝামেলা হল, ইচ্ছে করলেই যেখানে খুশি যাওয়া যাবে না । ইচ্ছে করলেই সিনেমা দেখতে যেতে পারব না । আর হিন্দি হলে তো কথাই নেই । নাচ আর গানের সময় সেই শিস আর হাফটাইমের আলো জ্বলে উঠলে পিছন দিক থেকে অবাক হয়ে কারও ডেকে ওঠা, স্যার ।
হলের উল্টোদিকে রাস্তায় বেশ কটা দোকান । দুটোতেই গান বাজছে । বক্স । কাউন্টারে বেশ ভিড় । বেশ বিজ্ঞাপন । বিশাল হোর্ডিংটা হলের গেটের দিকে আটকানো । আকাশ আর বনের প্রেক্ষাপটে এক পুরুষ আর এক নারী শুয়ে । পুরো হোর্ডিং জুড়ে । ঠোঁটের উপর ঠোঁট রাখারই ইঙ্গিত । চারপাশে প্রায় কুড়ি বাইশজন ছেলে আর মেয়েরা নাচতে থাকা একটা দল । মেয়েটির পোষাক স্নানের । ছেলেটিরও । ওদের একজনের পা আর একজনের উরুতে । ছেলেটি দুই হাত দিয়ে মেয়েটিকে আঁকড়ে ধরে হাসছে ।
প্রথম দোকানটিতে মালিক ছাড়া আর আঠারো উনিশের ছেলে একটা । বলল, দশ বছর ধরে কাজ করছে । দ্বিতীয় দোকানটিতে মালিক আছে বলে মনে হল না কাউকে । দুটোই ছোট ছেলে । বড়টির বয়স বড়জোর ষোল সতের । বললাম, ছিল কেউ ? মানে বছর দশের ।
পেছন থেকে একটা লোক এসে কাউকে খুঁজছি কিনা জিজ্ঞেস করল, ছেলেটার কথা জানতে চাইল । বলল, কে হয় আপনার ?
- আমার ? কিছু হয় না, চেনা ।
- চেনা ? তো আপনি এসেছেন কেন ?
লোকটা ডাকল কাউকে, চিত্কার করে বলল, মনা ।
- ওই ছেলেকে দিয়ে আপনার ইন্টারেস্ট কিসের ?
- কেন বলুন তো ? এমনকি পাশের বাড়ির হলেও জানতে চাইতে পারি না ?
- পারেন, যদি আপনার ইন্টারেস্ট থাকে কোনও ।
সিনেমার ভিড় থেকে দু-একজন বেরিয়ে এসে না চিনতে পারলে মুশকিল ছিল খুব । কিছুতেই ছাড়বে না । ছেলেটার নাম নাকি মুন্না । বলল, ক্যাশ থেকে নাকি টাকা সরিয়েছে । একশ আঠারো ।
- কিন্তু ও তো এমন ছেলে নয় । জানতে চাইলাম, দেখতে কেমন বলুন তো ?
চেহারার মিল খুঁজে পেয়ে নামের কথা বলাতে লোকটা গালি দিল একটা । বলল, ওদের আবার নাম । এরপর আমি হরনাথ স্কুলের টিচার শুনে বসতে বলল । কিছু খাব কিনা জানতে চেয়ে বলল, আপনারা মাস্টার মানুষ । আপনারা কতটুকু চিনবেন, এর আগেও নাকি কোন দোকান থেকে চুরি করে পালিয়েছে । ওকে নাকি কেউ দেখেইনি কাল সকাল থেকে । বাড়িতেও নেই । বাড়িতে অবশ্য থাকার মধ্যে ওর মা । কোন বাড়িতে যেন কাজ করে । লোকটা বলল, কমবয়েসী মেয়েছেলে, বুঝলেন ? ভাবলাম মানুষ হোক ছেলেটা, পয়সা জমাক, মাকে দিক ।
লোকটাকে হতাশ মনে হল খুব । এমনিতে অবাক হয়েছে বোঝা যায় । বলল, ছাত্রের খোঁজ নিতে আপনি এতদূর এসেছেন, দেখে ভালই লাগল । এখনকার দিনে এমন মাস্টার দেখা যায় না । লোকটা ওর ছেলেবেলার এক মাস্টারের কথা বলল, গত বছর নাকি মারা গেছেন । বলল, সন্ধের পর বাড়ি বাড়ি ঘুরে খোঁজ নিতেন ।
ছেলেদুটো দোকানটাকে চালু রেখেছে ঠিক । অর্ডার নেওয়া, চা তৈরি করা, দেওয়া । খটখট শব্দ তৈরি করে চামচ দিয়ে মেশানো । বক্সে তখন আওয়াজ হচ্ছে খুব ।
লোকটা বলল, মুখ দিয়ে খারাপ কথা বেরল বলে কিছু মনে করবেন না কিন্তু । বলল, এর মধ্যে কোনও খোঁজ পেলে জানাব । ওর মতে, ছেলেটা কোথাও স্থির হয়ে থাকার নয়, ফিরে পাওয়া মুশকিল ।
তুলি বই নিতে আসে না আর । ওরা বলল, বাড়ি থেকে বেরুতেই দেখি না তো । লাইব্রেরির নতুন বই আনবে কিছু । নতুন সেক্রেটারি অনিমেষ বলল, তুলি কিন্তু নিয়মিত বই নিত । গল্প উপন্যাসই । নতুন বইয়ের জন্য ওর কাছে নাম চাওয়া হত । অনিমেষ বলল, ওর কিন্তু রুচি ছিল । ওর নামে যে বইগুলি ইস্যু হয়েছে, দেখতে বলল । অনিমেষের মতে শুধু মলির মৃত্যুই নয়, অন্য কিছু কারণও আছে । ও বাপ্টুর কথা বলল । ছেলেটা ঠকিয়েছে ।
নবারুণ সংঘের লাইব্রেরি বেশ পুরনো । এলাকাটার মতোই । অনিমেষ বলল, পুরনো আমলের অনেক বইপত্র এমনকি মাসিক বা সাপ্তাহিকও আছে ।
লাইব্রেরি ঘরটা ক্লাবের লাগোয়াই । রাস্তার উপর । ঘর আর লাইব্রেরির জায়গা নাকি ব্যানার্জিবাড়িরই দেওয়া । তার মানে তুলির পূর্ব-পুরুষদের । বলল, ওই বাড়ির ছেলেমেয়েদের মধ্যে এক তুলিই যা একটু আলাদা । বাকিদের তো দেখছেন ।
বয়সের দিক দিয়ে অনিমেষ আমার সমানই । ব্যাংকে কাজ করে । সন্তুদের পাশের বাড়ির । আগেকার অতুলদা বা সুমনরা লাইব্রেরিতে আসা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে । ওরা বড়জোর ক্লাবে- যেখানে সন্ধের পর থেকে ক্যারাম, আঙুলের সেই টোকা, শুধুই পতনের শব্দ ।
আগেকার অতুল ঘোষ বা সুমনরা বাপ্টুদের ব্যাচের পছন্দসই ছিল খুব । অনিমেষ আসার পর থেকে লাইব্রেরির মুখ থেকে সুশান্তদের আড্ডাটা উঠে গেছে । ওরা এখন ক্লাবঘরের মুখে । বলা যায় হইচই এর ব্যাপারটা কমেছে অনেকটা । বয়স্করা আসছেন । বসার জায়গাও পাচ্ছেন মনোমতো । দুটো গ্রুপের ব্যাপারটা অবশ্য পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ।
পুরনো কাগজপত্র ঘেঁটে শ্যামপুরের ইতিহাস লেখার ইচ্ছে আছে অনিমেষের । বলল, আমরা জানি না তাই, এখানে দেখার মতো জায়গাও আছে অনেক । জিজ্ঞেস করল, সত্যসুন্দর প্রাইমারি স্কুলে গেছেন কখনও ? জানালাম, গেছি পাশ দিয়ে তবে ঢুকিনি । অনিমেষ বলল, ঢুকবেন । গেটের বাঁদিকের দেওয়ালের গায়ে নাকি পাথরের একটা ভাঙা মূর্তি আছে । মাটিতেই পড়ে আছে নাকি । হেলাফেলায় । বড়জোর কোনও পুজোআচ্চায় কেউ ফুল দেয় দু-একটা । বলল, ওটা একটা বুদ্ধমূর্তিই । বহু বছর মানে কয়েকশো বছর আগে এখানে নাকি বৌদ্ধ ছিল অনেক । এখন নেই । অনিমেষের মতে, ওই মূর্তিটা রীতিমতো গুরুত্বপূর্ণ । মিউনিসিপ্যালিটিকে বলে মূর্তিটাকে লাইব্রেরিতে আনার ইচ্ছে আছে ওর ।
ছেলেটার পড়াশোনা আছে অনেক । কিছু করতেও চায় । শুধু ব্যাংকের হিসেব নিকেশের মধ্যেই আটকে রাখতে চায় না নিজেকে । কিছু বইয়ের নাম দিতে বলল আমাকে ।
- আমি ? আমি তো পড়ি না তেমন কিছু, ওই খবরের কাগজ ।
অনিমেষ অবাক হল না একটুও । বলল, সাহিত্যের পাঠক এখনও মেয়েরাই । তুলির এক বৌদিও নাকি বই পড়ে খুব ।
- লিপির মা ?
- হ্যাঁ, লিপিও- সেদিন `পথের পাঁচালী' নিয়ে গেল বিভূতিভূষণের ।
- লিপি আসে এখানে ?
- মাঝখানে বন্ধ করেছিল, কিছুদিন হল আসছে ফের ।
অনিমেষ নাকি নিজেই গিয়েছিল । লিপির মার তো শরীর খারাপ । বেরোয় না বাড়ি থেকে খুব একটা । অনিমেষ বলল, লোকে ওর সম্বন্ধে যাই বলুক, কথা বললে কিন্তু একদম অন্যরকম মনে হবে ।
অবিনাশের কাছে অনিমেষের কথা তোলায় ও বলল, অনিমেষ ? ও কতটুকু জানে ? বললাম, ও তো তোমাদের ফ্যামিলির অনেক কিছু বলল । হাইকোর্টের বিচারপতি গণনাথ ব্যানার্জির কথা, ক্লাবঘর বা লাইব্রেরির জায়গার কথা । বলল, এই এলাকায় ভাল যা কিছু তার অনেকখানিই নাকি তোমাদের ফ্যামিলির জন্য ।
রোববার হলেও, অবিনাশকে স্কুলে যেতে হবে আজ । স্বরূপবাবু ডেকেছেন । ইংরেজির টিচার নেবে একটা, টেম্পোরারি পোস্টে, তার জন্য কীসব কাজ আছে । বলল, নগেনবাবুর বাড়িতেও যেতে হবে আজ । সই করাতে হবে ।
স্নান করার সময় দেখা হল তুলির সঙ্গে । দূর থেকে দেখতে পেয়েই চলে যাচ্ছিল । কি করতে আসছিল কে জানে ? ভেজা লুঙ্গিটাকে আড়াল করে ডাকলাম, তুলি- । ও তাকাল । বলল, আমাকে ? গোটা বাড়িতে এখন ও আর আমি ছাড়া ওর অসুস্থ মা । কুয়োপাড় থেকে ওদের বড়ঘর এইটুকু দূরত্বে ওর অন্তত আমার ডাক শোনায় কোনওরকম ভুল হওয়ার কথা নয় । বললাম, খাওয়ার পর একবার দেখা করতে পারবে ? ও শুধু বলল, দেখি- ।
স্বীকার করতেই হবে । শুধুমাত্র ওর দোকানের জন্যই জায়গাটা পাল্টে গেছে অনেক । গেট থেকে সাদা আলো ফেলেছে দোকানের ওপর, রাস্তা থেকে দোকানের ভেতরটা একেবারে পরিষ্কার । বাঁকুড়ার ঘোড়া, পোড়ামাটির হাতি, গণেশ । হরেক ডিজাইনের আয়না । ঘড়ি । সেরামিক্স । আর মুখোশ । মুখোশ যে এতরকম হতে পারে আমার ধারণাই ছিল না কোনও । মুখোশের জন্য শুধু বাচ্চাদের ভিড় নয়, বড়দেরও । পৌরাণিক চরিত্র থেকে শুরু করে জন্তু জানোয়ার পর্যন্ত ।
লোক রেখেছে একটা । ভাল ছেলে । পড়াশোনা জানা । হাতের কাজ জানে অনেক কিছু । বাপ্টু বলল, কদিনের মধ্যেই নেশা ধরে গেছে একরকম । এম. এল. এ. আর চেয়ারম্যান নাকি দারুণ প্রশংসা করে গেছেন ।
প্ল্যানটা ওর বাবার এক বন্ধুর । ওর নিজেরও আর্ট মেটেরিয়েল এর দোকান । শান্তিনিকেতনে । এখানে ঘুরতে এসে নতুন গড়ে উঠতে থাকা টাউনশিপ, সুপারমার্কেট, ফ্লাইওভার দেখে ভদ্রলোক বলেছিলেন, বাজার আছে । বেশি সংখ্যায় নিম্ন মধ্যবিত্ত এখানে উপরের দিকে উঠেছে ।
প্রথম পনেরো দিনেই ওর নাকি মাসের ভাড়ার টাকা উঠে গেছে । নতুন আইটেমের দোকান হিসেবে এটা নাকি যথেষ্ট । বলল, ঝামেলা যা পোহাবার বাবার উপর দিয়েই গেছে । প্রথমদিকে ওর তেমন উত্সাহই ছিল না ।
শুধু কেনার জন্য নয়, অনেকে দোকানে ঢুকছে স্রেফ দেখার জন্যই । হাউসিং এস্টেটের মেয়েরা বা নতুন করে গড়ে উঠতে থাকা টাউনশিপের একটা-দুটো পরিবার । একটা বছর আটের বাচ্চা, সেরামিক্সের একটা ডিজাইন করা ভাস দেখিয়ে, জিজ্ঞেস করল, প্রাইস ? ওর মায়ের সে কি খুশি । বাঁকুড়ার ঘোড়া দেখিয়ে জানতে চাইল, হোয়াট ইজ ইট, বাবি ?
চা খাওয়ার কথা বলল বাপ্টু । একটা জিনিস অবশ্য বোঝা যাচ্ছে, দোকানের পেছনে সময় দিচ্ছে ছেলেটা । হয়তো সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে ।
বললাম, মলির খবর তো জানো ।
ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েই একটু অপেক্ষা করতে বলল । এক ভদ্রলোক সঙ্গের এক ভদ্রমহিলাকে নিয়ে ডাকছেন ওকে । একটা মুখোশের দিকে আঙুল তুলে নামাতে বলছেন । একটি বালক । মানে বালকের মুখ । ভদ্রমহিলা, মুখোশটাকে ভদ্রলোকের মাথায় আটকে দিতেই, কি অভিমানি সে । বালকের মুখ । যেন ঝির ঝির করা বৃষ্টিই ।
ফের মলির কথা তুললাম । সেই দুপুরের কথা বললাম । সেদিন আর কয়েক মিনিট আগে ওদের দোকান থেকে বের হলেই হয়তো বাঁচাতে পারতাম মলিকে । পাড়ার ছেলেদের কথা বললাম । তুলির হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা ।
অনেক কিছুই জানে বাপ্টু । বলল, আপনি থাকতে চিন্তার কি ? ওর নাকি উপায় নেই কোনও ।
- তাই বলে তুলিকে একবার- ।
বাপ্টু বলল, প্রচুর কাজ । নতুন ব্যবসা ছাড়া অন্য কাজেও জড়াতে হচ্ছে ওকে । ওর বাবাকেও । বলল, নির্মলদার কথায় বিশ্বাস করে ওরিয়েন্টালে অনেক টাকা ঢুকে গেছে ?
- মানে ওরিয়েন্টাল ফ্যাক্টরিতে ?
বলল, বিশ্বাস করে বলে ফেললাম কথাটা । নির্মলদাকে ওখানে নগেনদার সঙ্গে লড়তে হচ্ছে ।
- আপনি প্লিজ এসব নগেনদাকে বলতে যাবেন না ।
বললাম, ঠিক আছে । কিন্তু তুলির সঙ্গে একদিন অন্তত দেখা কর, বল, কোথায় থাকবে ।
দোকানে খরিদ্দার না থাকায় আমরা তখন দোকানের বাইরে । বাগানের রেলিঙে দাঁড়িয়ে । তুলির জন্য কোথাও অপেক্ষা করার মতো একদম সময় নেই বাপ্টুর । তুলিকে পারলে যেতে বলল দোকানে । অনেকেই নাকি যায় ।
তুলি হয়তো অপেক্ষা করছে খুব । কদিন হল ওর মুখ দেখেই টের পাই স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখা হয় রোজ । তার মানে সময় ধরে লক্ষ রাখছে তুলি । ওকে হতাশ করতে ইচ্ছে করে না । আজকালের মধ্যে ওকে বলব কিছু । হয়তো মিথ্যে করেই । বানিয়ে । বলব, তোমার ব্যাপারে অনেক কথা বলল বাপ্টু, বলব, মলির সুইসাইডের দিন না আসতে পারার জন্য খারাপ লাগছে, দেখা করতে ভয় পাচ্ছে । বলব, ও বলল, তুলি নিজে একবার আসতে পারেনি দোকানে ? যদি বলি, তোমার সঙ্গে এতদিন দেখা করতে না পারায় বাপ্টু ঝগড়া করেছে ওর বাবার সঙ্গে । যদি বলি, আমার কাছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তোমার সম্বন্ধে হাজার কথা জিজ্ঞেস করছিল সেদিন ।
তুলি অবশ্য আমার কথা শোনার জন্য আগ্রহ দেখাল না কোনও, একথা সেকথার পর বলল, নতুন টাউনশিপের একটা বাড়িতে নাকি খুব যাচ্ছে বাপ্টু । মেয়েটা নাকি স্কটিশের । ইংরেজি নিয়ে পড়ছে ।
বিপিন ওর কাগজপত্র জমা দিয়েছে । সার্টিফিকেট, মার্কশিট । জেরক্স সহ । স্বরূপবাবু নাকি, অরিজিনালের সঙ্গে মিলিয়ে ওর শুধু জেরক্সটাই জমা রেখেছেন । সত্যদাকে ফের মনে করিয়ে দিলাম, আমারটা দিতে দেরি হবে কিন্তু । সত্যদা আমল দিলেন না । বললেন, ঠিক আছে ।
জানুয়ারির কয়েকটা দিন বেশ ভালই ঠাণ্ডা পড়ল এবার । কাগজে লিখল, আর সামান্য একটু নামলেই নাকি রেকর্ড হত । শতাব্দীর সেরা ঠাণ্ডা । শীতলতম দিন । স্কুলের ক্রিকেট টিমটা খেলতে গিয়ে এবার প্রথম খেলাতেই হেরে বসল । দীপক বলল, ভাল ছেলে ছিল না এবার । জাফরপুর স্কুল নাকি সব বাইরের ছেলে খেলিয়েছে । বললাম, তুমিও তো পারতে । ও আগ্রহ দেখাল না তেমন । বলল, ভাল লাগে না আর । জানুয়ারি মাসটা প্রায় ছুটির মাসই । সরস্বতী পুজোও এবার জানুয়ারির শেষে পড়ে গেল । নেতাজির জন্মদিন, সাধারণতন্ত্র দিবস, অ্যানুয়াল স্পোর্টস আর স্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবস মিলে, পনেরো তারিখের পর থেকে কার্যত ছুটিই । আর একটা মাত্র মাস । তারপরই পরীক্ষাপর্ব । ফেব্রুয়ারি মাসটাতে অবশ্য একদম ছুটি নেই । রবিবার বাদে কোনওদিনই নয় । সিলেবাস প্রায় শেষ । এ সময়ের আর একটা সুবিধা হল, ক্লাস কমে যাওয়া । টেন নেই । সুধাময়, বিপিনদের খুব চাপ এখন । সুধাময়ের শুধু মাধ্যমিকের ছাত্র । বিপিনের হায়ার সেকেণ্ডারির । অল্প কদিনের মধ্যেই বিপিনের নাম হয়েছে খুব । জাফরপুরের ছেলেরা পর্যন্ত বিপিনের কাছেই পড়ছে । সুধাময়ের হিসেব অনুসারে স্কুলের মায়না ছাড়া ওর অন্তত হাজার দুয়েক আয় । সুধাময়ের নিজের বড়জোর হাজার । রেট কম, ছাত্রও বেশি নয় ।
ছোটবেলা এই জানুয়ারি মাসটা ছিল ক্রিকেটের । ব্যাট হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, টেনিস বলে ম্যাচ খেলা । সেদিন স্কুলের ছেলেদের প্র্যাকটিস দেখে ইচ্ছে হচ্ছিল খুব । বললাম, ছাত্র শিক্ষক ম্যাচ হোক না একটা । বিপিনও উত্সাহ দেখাল খুব । শেষ পর্যন্ত হল না অবশ্য । প্রথম খেলাতেই স্কুল টিম হারায় দীপক উত্সাহ হারিয়ে ফেলল । বলল, থাক মাধ্যমিক পরীক্ষা আছে ওদের অনেকের ।
নগেনবাবু আগের থেকে ভাল অনেক । বাড়িতেই । পার্টির কাজও শুরু করেছেন ফের । তবে দাগগুলি যায়নি এখনও । স্কুলের গভর্নিং বডিতে উনি পি-আই ক্যাটাগরির । পার্সোনাল ইন্টারেস্ট । মনোনীত । সামনের বার আর মনোনয়ন পাচ্ছেন না । নির্মলবাবুই আসছেন । নগেনবাবুর রাজনীতির অবস্থা নাকি খুব খারাপ । পরের মিউনিসিপ্যাল ইলেকশনে মনোনয়ন পাওয়ার আর কোনও সুযোগ নেই । অবিনাশ বলছিল, পার্টিতে থাকতে পারে কিনা দেখুন ।
নগেনবাবুর ব্যাপারে অবিনাশ এখন আর কোনও রাখঢাক রাখছে না । আগে অন্তত আমার সামনে ওর ব্যাপারে মুখ খুলতো না তেমন । সেদিন বলল, নগেনবাবু একদম বাজে হয়ে গেছেন । একদম । কিভাবে যে শেষ বয়সে এমন কেলেঙ্কারিতে জড়ায় মানুষ ? জানতে চেয়েছিলাম, টাকা পয়সা ? টাকা-পয়সা হলে নাকি ভালই ছিল । ম্যানেজ করার একটা সুযোগ অন্তত থাকত । অবিনাশ বলল, বাজে ব্যাপার । মেয়েলি । আর শুনতে চাইনি । অবিনাশও থেমে গিয়েছিল । ওখানেই । এসব ব্যাপারে আমি অবশ্য ঘাবড়াই না তেমন । রাজনীতির সঙ্গে চরিত্র হননের সম্পর্ক আছে একটা । নতুন কিছু নয় । বোঝা গেল নগেনবাবুর অবস্থা সত্যই খারাপ । বা পার্টি হয়তো বের করার সময় এমন কোনও কারণই দেখাবে । এসব প্রচার শুধুমাত্র তার প্রস্তুতি ।
ওরিয়েন্টাল ফ্যাক্টরির এখনও কোনও কিনারা হয়নি । বাপ্টু সেদিন বলল, হয়ে যাবে । ওর কথায়, নতুন করে ফ্যাক্টরি খোলার আর কোনও চান্স নেই । বলল, আমার অবশ্য বিশেষ কোনও ইন্টারেস্ট নেই । শুধু কিছু টাকা আটকে থাকার জন্যই ।
নির্মলদা ইদানিং এ বাড়িতে আসছেন খুব । তুলি চা করে দিচ্ছে । অবিনাশের ধারণায় আর বেশি দিন নয় । বাড়ির ওয়ারিশের মধ্যে এক লাবণ্য বাদে সবাই রাজি আছে এখন । লাবণ্যও ম্যানেজ হয়ে যাবে । রাস্তা নাকি বেরিয়েছে একটা ।
রোববারের দুপুরগুলিতে মাঠে গিয়ে দাঁড়াই । শাল দিয়ে শরীর ঢেকে একসময় বসে পড়ি । আমার মতো আরো অনেকেই । খেলা দেখি । পাড়ার ক্রিকেট । দেখতে দেখতে ঘুম পায় । কখন যেন ঘুমিয়েও পড়ি । সেই হিম হিম রোদে হঠাৎ করেই কোনও চিত্কার ওঠে । হাউজ দ্যাট । থতমত খেয়ে চোখ খুলে দেখি, আউট হল কেউ । আম্পায়ার আঙুল তুলে দাঁড়িয়ে ।
এমনি একটা রোববারেই, মাঠ থেকে ফিরছি, দেখি অনিমেষ । সিগারেট ধরাচ্ছে । বলল, ধরাবেন ? ঘাড় নাড়াতেই দিল একটা । খেলার রেজাল্ট জানতে চাইল । বললাম, কারা যেন হারল তিরিশ রানে । এমনকি জেতা টিমের নামও বলতে পারলাম না ।
অনিমেষ জানতে চাইল, ঘাটের দিকে যাব কিনা । ওর হাঁটা আর কথা বলার মধ্যে একটা নতুন কিছু টের পাচ্ছি তখন । একটা ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরা । বারো মন্দিরের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছি, ও তখন ডানদিকে তাকাতে বলল । সেই বাচ্চা মেয়েটা । শ্বেতপাথরের । চারপাশে ফোয়ারার আয়োজন । জল নেই যদিও । বলল, লোকগুলির কথা ভাবুন ।
- কোন লোকগুলি ?
- যারা করল । ঠাকুরের মন্দির- গঙ্গার ঘাটে কোথায় লোকে ঈশ্বরচিন্তা করবে- তো এইরকম একটা মূর্তি ।
ওর মতে, মেয়েটা চমত্কার সন্দেহ নেই । এমনকি চোখের মধ্যে কোথায় যেন নীরব বিষণ্ণতা । কিন্তু নগ্নতা ?
ওর কথায়, প্রায় ফুলের পাপড়ির মতো দুই স্তন, হালকা, যেন ভোরের কোনও স্বপ্নের মতোই- আর নীচ থেকে উঠে আসা সেই লতা ? ওর মতে লজ্জা ঢাকার জন্য নয়, যেন নেশাগ্রস্ত একটা সাপ- প্রবল আকর্ষণে উঠে আসা, মাটি থেকে, মেয়েটার পা বেয়ে জড়িয়ে ।
অনিমেষ বলল, মেয়ে দেখতে গেছেন কোনওদিন ?
- মেয়ে ?
- হ্যাঁ, বিয়ের জন্য ।
ওর বিয়ের পাকা কথা হল আজ । সকালে । ওদের পক্ষে দাবিদাওয়া নেই কিছু । মেয়েটি চাকুরে । স্কুলের । অনিমেষ বলল, মূর্তিটির যৌন আকর্ষণের দিকটা লক্ষ করেছেন কোনওদিন ? ও নাকি একদিন আদর করেছে মেয়েটিকে । বারো মন্দির ঘাটের উঠোনের এই শ্বেতপাথরের বালিকাকে অনিমেষ নাকি চুমু খেয়েছে একদিন ।
- কি যা তা বলছো ?
- মাইরি বলছি । আপনার মনে হয়নি কোনওদিন ? স্পর্শ করতে ইচ্ছে করেনি ?
অনিমেষ জানতে চাইল, বিয়ের কথা ভাবছেন না কেন ? করবেন না কোনওদিন ? ওকে শুধু ঝামেলার কথাই বললাম । অনেক ঝামেলা । একের পর এক ঝামেলাগুলি মিটলেই জীবনটা ইয়ে ভাবতে শুরু করব ।
সেজকাকু লিখেছে, তুই কি একেবারেই ভুলে গেলি ? লক্ষ্মী তোকে এত ভালবাসে যেখানে- । তুই কি ভাবলি সম্পর্কটা শুধু টাকা নিয়েই, তোর বাবা থাকলে, তোর বাবার কথামতোই করতে হোত সব । সেজকাকি লিখেছে, লক্ষ্মীর বড় ভাই বলতে তো তুইই । আর একবারের জন্য আসতে পারলি না । লিখেছে, যাদের বাড়ি থাকিস তাদের সবাইকে নিমন্ত্রণ কর । মনে করলে স্কুলের কাউকে বা সবাইকে বলে দে ।
কৃষ্ণা বলত, লক্ষ্মীকে বলে দেব কিন্তু । একটা সময় কৃষ্ণাকে দেখলে এত ভয় করত আমার । ও কিন্তু খাওয়াত অনেক কিছু । ওদের বাড়ির তৈরি করা আচার । ভাঙা বাসনের বিনিময়ে পাওয়া বদল বিস্কুট । অথচ, সেবার স্টেশনে দেখা হওয়ার পর মনেই পড়ল না কোনও কিছু । একদিক থেকে লক্ষ্মীর বিয়ের দেরি হওয়ার জন্য হয়ত আমিই দায়ী । ব্যাংকের টাকাটা আমাকে দিয়ে না দিলে সেজকাকু অনেক আগেই একটা ব্যবস্থা করত ঠিক । লক্ষ্মীর বর নাকি ভালই । নৈহাটির ওদিকে কোন একটা ছোট ফ্যাক্টরিতে কাজ করে । রাজনীতির মধ্যে নেই একদম । ওদের ফ্যাক্টরিতেও নাকি ইউনিয়নের তেমন বাড়াবাড়ি নেই । শ্রমিকরাই নাকি চাইছে না তেমন করে । ছেলেটার নাম নাকি পরেশ - শ্রী পরেশ চন্দ্র সেন । বাবার নাম শ্রী হীরক চন্দ্র সেন । আদি বাড়ি ওপারে । নৈহাটিতে নিজেদের বাড়ি । লক্ষ্মীর ননদ আছে একটা । তবে, ছোট একেবারে । নাইনে পড়ছে ।
স্কুলে কি বলব কাউকে ? সত্যদা, বিপিন । নাকি নগেনবাবুকে । নগেনবাবুকে তো একবার বলা দরকার । আর অবিনাশ, অবিনাশের বউ আর তুলি ?
তুলি সেদিন অদ্ভুত কথা বলল একটা । সকালে বের হচ্ছি । অবিনাশই ডাকল । দেখি, নির্মলদাও । গল্প করছে । হয়তো পার্টি কি বাড়ি নিয়েই । বলল, চা খেয়ে যাও ।
নির্মলদা স্কুল সম্বন্ধে জানতে চাইলেন । রেজাল্ট কেমন হতে পারে এবার । আমার প্রশংসা করলেন খুব । বললেন, আপনার মতো কয়েকজন লোক পেলেই আর কোনও চিন্তা থাকত না । স্কুল সার্ভিস হয়ে এই হয়েছে মুশকিল । সব অচেনা । বাইরের । স্কুল বা এলাকা নিয়ে কোনও অনুভূতি নেই । আসবে, চাকরি করবে, চলে যাবে । বিপিনের কথাই তুললেন । বিপিনের বাবা নাকি বিপিনকে পাঠিয়েছিলেন । বলেছিলেন, স্কুল সার্ভিসে লেখায় পাস করবে ঠিক । বাকিটা পার্টি যেন দেখে । ওর বাবা পার্টিরই লোক ছিলেন একসময় । বসে গেছেন অনেকদিন । বাহাত্তরে ওর বাবাকেও নাকি পালাতে হয়েছিল । নির্মলদার কথায়, আমি তো অবাক, ওর মতো ছেলে যদি আজ সত্যকে চ্যালেঞ্জ করে ।
তুলি ঘরে ঢুকতেই অবিনাশ হা হা করে উঠল একবারে ।
- চিনি দিয়েছিস তো ঠিক করে ? আগের দিন যা- ।
নির্মলদা বললেন, তুলির হাত নাকি এমনিতেই মিষ্টি, চিনি না দিলেও চলবে ।
তুলি দেখল আমাকে একবার । চা খাওয়ার পর বাইরে বেরোতে গিয়েই হঠাৎ করে মলির কথা মনে পড়ল ফের । পাশের জানালা । পর্দাটা এখনও সেই অবস্থাতেই । নীচের দিকটা ছেঁড়া । হলুদের উপর খয়েরী । বৃত্তাকার নকশা । একাধিক লতা যেন আঁকশি ছাড়তে ছাড়তে কোনও একটা কেন্দ্রের চারপাশে পাক খাচ্ছে । দরজাটা ঠেলে দেখি খোলাই । ঘরের ভিতরটা প্রায় অন্ধকার । তুলি রান্নাঘরে । শব্দও হল কিসের । মাথার উপর সেই ইলেকট্রিকের পাখা, পাখার মোটর । এখন স্থির । কোনও উত্তেজনা নেই । গতির বাড়াবাড়ি নেই । এমনকি ঘরের সেই ঘ্রাণ অটুট এখনও । দেওয়াল । দেওয়ালের বের হওয়া ইট । ইটের লাল মাটি, গুঁড়ো ।
খুট করে একটা শব্দ হতেই দেখি তুলি ।
- নির্মলদা চলে গেছেন ?
- না । ডেকে দেব ?
- না, না- আমি তো এমনিই- ।
খাটের দুদিকে সূক্ষ্ম কারুকাজ । পুরনো আমলের । আর আয়নাও আছে একটা । একটা দড়িতে ঝুলতে থাকা শাড়িগুলির সবকটা নিশ্চয়ই তুলির একার নয় । মলিরও আছে নিশ্চিত । দেওয়ালের গায়ে আটকে থাকা ভারি একটা ঘড়িকে লক্ষ করিনি এতদিন । রোমান হরফে লেখা সংখ্যা । বন্ধই অবশ্য । কাঁটার হিসেব মতো একটা ছত্রিশ । মিনিটের কাঁটা সাত-এর ঘরে ছাড়িয়েছে মাত্র ।
তুলি জানতে চাইল, কী দেখতে এলেন ?
- এমনি । ভাবলাম ঘরটাই দেখি একটু ।
- কি হবে ঘর দেখে ? এটা তো দিদি থাকলেও এমনিই থাকত ।
বেরিয়ে আসছি, প্রায় ফিসফিস করেই বলল তুলি । ফিসফিস করেই । যেন দেওয়ালের সুর.কি খসে পড়ছিল । বলল, লজ্জা করে না আপনার ? একটা মৃত্যুর জন্য- ওর মৃত্যুর জন্য তো আপনি- ইচ্ছে করলেই তো বাঁচাতে পারতেন ওকে ।
পোস্টকার্ডের উল্টোপিঠে, সেজকাকির লেখার পর, `পুনশ্চ' লিখে সেজকাকু জানিয়েছে, সিন্দুকটা বিক্রি হয়ে গেছে । লিখছে, রাখব কোথায় ? জায়গাই নেই । এতবড় একটা সিন্দুক এখনকার যুগে চলে ?
লিখলাম যা করার করেছ । সিন্দুকে থাকা দাদুর পঁংউটলি আর সেই খাতাটাকে অন্তত রেখে দিও । লাগবে । চাইলেই পাই যেন ।
রাত সাড়ে আটটা নাগাদ একটা ছেলে এসে বলল, আপনাকে ডাকছে ।
খবরের কাগজটা পড়ছিলাম । নপুংসক বা আমরা যাদের হিজড়ে বলি তাদের উপর একটা রিপোর্ট । ওদের জীবনের নানান অজানা দিক । আর অবাকও হচ্ছিলাম খুব । ওরা নাকি অনেকেই জন্ম থেকে হিজড়ে নয় । পড়ছিলাম, কিভাবে ওদের অনেকেই জন্ম থেকে হিজড়ে নয় । পড়ছিলাম, কিভাবে ওদের অনেকেই ছেলে চুরি করে । কিভাবে নেশা করায় ওদের । প্রায় তান্ত্রিকদের মতোই কিভাবে মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে লিঙ্গচ্ছেদ হয় কোনও বালকের । শরীর কেঁপে ওঠে আমার ।
বললাম, কোথায় ? কে ?
ছেলেটা বলল, অবিনাশদা । রাস্তায় । বাইরে এসে দেখি অবিনাশ । কিছু যেন উত্তেজিত । বললাম, কি হয়েছে ? বলল, আসতে পারবেন একবার ?
- কেন ?
- দরকার আছে, একটা জিনিস দেখাব ।
ওর গলায় বেশ সন্ত্রস্ত ভাব ছিল একটা । বলল, ভাবছিলাম লুকিয়েই রাখব । বলব না । আফটার অল নিজেদের পরিবারের কেচ্ছা ।
বললাম, লাবণ্য ?
- শুধু লাবণ্য নয়- দেখবেন মানুষ কিভাবে- থাক, নিজের চোখে না দেখলে- । আমাকে নিয়ে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে একেবারে ছাদেই উঠল সে । নিজের থেকেই ছাদের দরজাটা বন্ধ করল । বলল, যেতে পারবেন ?
- কোথায় ?
- লাবণ্যর ঘরে ।
- কেন ?
- আগে থেকে বলব না । ঘুরে আসুন একবার ।
অবিনাশ ঠেলতে শুরু করল আমাকে । ঠেলতে ঠেলতে একেবারে সেই চিলেকোঠায় । সেই নদী চোখে পড়ে । ছোট ঢেউ । বাতাস । ওপারের আলো । যেখান থেকে ট্রাকের হর্ন কানে আসে । বললাম, এটা কি ঠিক হবে ? একদম বাজে ব্যাপার ।
- কিছু বেঠিক হবে না । এক আপনি গেলেই যদি মুহূর্তের জন্য হলেও দরজা খোলে ।
- কেন, কী এমন ।
`কান রাখুন, রাখুন না', বলে নিজেই কান পাতে দরজায় । লাবণ্যর সেই ভারি আর প্রাচীন দরজায় । ফিসফিস করে ডাকল আমাকে । ইশারায় ।
- আসুন, আসুন না ।
লাবণ্য কথা বলছে । ঠিক কথা নয়, গোঙানির মতোই । পুরুষ আছে কেউ । বয়স্ক । বাচ্চা নয় । খসখস শব্দ হল পায়ের । ঘুরতে থাকা পাখাটা নিশ্চয়ই দরজা বা ঘরের মতোই প্রাচীন । শব্দ করছে । কে যেন ফিসফিস করে বলছে কিছু ।
লাবণ্যও কিছু বলল যেন । ঠিক কথা নয়, গোঙানিই ।
দরজা ছেড়ে পিছিয়ে ছাদে এসে দাঁড়াই । অবিনাশকে জিজ্ঞেস করি, কী এসব ?
- বুঝতে পারছেন না ?
বললাম, কী বুঝব ?
অবিনাশ একটা এসপার ওসপার চাইছে । বলল ছাড়ব না কিছুতেই । অনেক সহ্য করেছি । বলল, লোকটাকে ইচ্ছে করছে না দেখতে ?
বুক কাঁপছে আমার । না করতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব । লাবণ্যদের ঘরের মুখ এদিকে হলেও, আলাদা দরজা আছে একটা । পেছন দিকে । লিপিও পেছনের দরজাই ব্যবহার করে । মণ্ডপের সামনে দিয়ে যাওয়া ঝোপজঙ্গল-কাটা সরু রাস্তাটা একতলার ওদের জন্যই ।
অবিনাশ বলল, ছাদের ওপর থেকে চিনতে পারবেন ? বরং নীচে গিয়েই- । আমার কিন্তু সত্যিই হাত-পা কাঁপছে তখন । বললাম, ছাদ থেকেই- । অবিনাশ বলল, একটা সত্য তাহলে ভাঙছি আপনার কাছে । বলবেন না কাউকে । হাজার হোক আমাদের পরিবার । প্রশান্তর বউ ।
লাবণ্য নাকি সত্যিই ভাল মেয়ে নয় । ওর কথায়, খারাপ মেয়ে কথাটা শুধু কথার কথা নয় । সত্যি । প্রশান্তেরও চরিত্র খারাপ ছিল । নেশা ছিল, কিন্তু পয়সা ছিল না । লাবণ্যকে ও পায় চন্দননগরে । ওখানকার বেশ্যাপট্টিতে । কিভাবে বাইরে নিয়ে এসে বিয়ে করে । অবশ্য সত্যিই বিয়ে করেছে কিনা বলতে পারল না অবিনাশ । এখনও প্রমাণ দেখাতে পারেনি কোনও । না, রোগটা লাবণ্যর নয় । পরের দিকে প্রশান্তরই বয়ে আনা । ও বলল, ধরা পড়েছে তো অনেক পরে । তাছাড়া আগে ধরা পড়লেও লাভ নাকি কিছু হত না । অবিনাশের কথায়, প্রশান্তর যাতায়াত ছিল একদম সস্তা জায়গায়, নোংরা । চন্দননগর, টিটাগড় । লাবণ্যকে বিয়ে করেও নেশা কাটাতে পারেনি প্রশান্ত ।
- ওই যে, দেখুন- দেখতে পাচ্ছেন ? হাঁটছে । লোকটাকে দেখতে পাচ্ছেন ?
একটু যেন বয়স্কই । পাঞ্জাবী আর ধুতি । একটু খুঁড়িয়েই হাঁটছেন যেন । পেছনে বাচ্চা মেয়েটা কে ? লিপি না ? লিপি কি তখন ঘরে ? ও কি জানে এতসব ? বললাম, লাবণ্যর আত্মীয় হতে পারে কোনও ।
- আমি জানব না ? লাবণ্যর আত্মীয় তো আমারও আত্মীয় । আর হাঁটার কায়দা চেনা লাগছে না ? দেখেননি কোনওদিন ?
- ওর বাপের বাড়ির দিককার কেউ ।
- বাপের বাড়ির ? বড় জোর সেই বেশ্যাপট্টির মাসি বা ওর মতো কোনও বেশ্যাই । কিন্তু এই বয়সের পুরুষমানুষ কোথায় ? ঠিক আছে, দেখবেন লোকটাকে ? ধরা যাবে এখনো ।
উত্সাহ না দেখিয়ে `থাক' বললাম । যেন বুঝতে পারছি, আর তাই দেখতেও চাইছি না ভাল করে ।
অবিনাশকে জিজ্ঞেস করলাম । তুমি কি তাই বলে, লাবণ্যের মৃত্যু কামনা করবে ? সামান্য একটু জায়গার জন্য- এই বাড়িটার জন্য লাবণ্যকে কি চলে যেতেই হবে ।
ও বলল, উপায় দেখান আর একটা- আর ওর যা হয়েছে ওকে তো মরতেই হবে- অনর্থক অন্য লোককে কষ্ট দেবে কেন ? আর ওর মৃত্যু হলে ওর মেয়ের দায়িত্ব কে নেবে বলুন ? ভাবুন একবার । নেবেন ওই মেয়েকে আপনি ?
সেই তান্ত্রিকের কথামতো চুল আনতে গিয়ে, ঠিক কি কি করেছিলাম, জানতে চাইল অবিনাশ, বলল, আমি কিন্তু বারবার বলেছিলাম, বড়জোর জড়িয়ে টডিয়ে ধরা- এক আধটা চুমু- ব্যস । জানতে চাইল, আর কিছু হয়নি তো ?
(চলবে)
(পরবাস-৪১, মে, ২০০৮)