বাইরে এসে দেখি সারাটা আকাশ জুড়েই অসংখ্য নক্ষত্র । রুপোর চাদর যেন, ঝক ঝক করছে একেবারে । চাঁদটা পুরো নয় । আধ খাওয়া । শব্দ একটা জেগে উঠছে ঠিকই । দূরের ভাঙা দেওয়ালে এখন দেখা যাচ্ছে না । আর কুয়াশাই । আম গাছ, কাঠমালতি, নিম, নিমের সেই ঝির ঝির করতে থাকা পাতা ।
আকাশের পূব দিকে কোনও প্লেন নির্ঘাত । দেখা যাচ্ছে না যদিও । প্লেনটা তার মানে নক্ষত্রের ঔজ্জ্বল্যের ভিড়েই । হয়তো বুঝতে পারছি না, নাকি সুপারসোনিক ? শব্দের চেয়ে দ্রুতগামী কিছু । হয়তো চোখের বাইরে এখনও । আসার মধ্যে শুধু তার শব্দই -- প্লেনটা নিজে এখনও বহু দূরেউ । হয়তো বা দিগন্তের আড়ালেই -- অসংখ্য ছবি ছড়িয়ে দিচ্ছে আকাশ থেকে । এটা কি হতে পারে কখনও ? সত্যি ? হেডস্যারের সেই গল্প বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে খুব । হয়ত সত্যিই । আসবে কেউ । মিলিয়ে নিতে হবে ছবি দেখে । সেজকাকার চিঠিতে লেখা পালপুকুরের সেই লোকটা কিভাবে চিনল সুধন মজুমদারকে ? কিভাবে ডাকল `সুধনদা --' বলে ? আমি চিনতে পারব ? যদি মুহূর্তের জন্য দেখি কোথাও, ডেকে উঠতে পারব ?
বাবার এখন অন্তত ষাট । অন্তত । বেশিও হতে পারে । নগেনবাবুর কত হবে ? ষাট-বাষট্টিই ।
অবিনাশ নিজেও টের পেয়েছে । বা হয়তো জানতই, নামটা মুখে আনেনি । ও আসলে আমার কাছ থেকে শুনতে চাইছিল । আমার মুখের উচ্চারণ । বলল, রেগুলার । শেষ বয়সে নাকি লোকটা পুরো ক্যারিয়ারের বারোটা বাজল । অবিনাশের মতে, একটা সুস্থ মানুষ কিভাবে এমন একটা নোংরা মেয়েছেলের পক্ষ নেয় ? ভাবুন একবার যে মেয়েছেলে হয়তো মৃত্যুকে বহন করছে, প্রশান্তর বেলায় সেই হাসপাতালের ডাক্তার বলেছিল, এই রক্ত কারও শরীরে ঢুকলেই -- একেবারে রক্তের কণা হলেও --। পার্টিকে কি ভোটের কথা ভাবতে হবে না ? মানুষ জানতে চাইবে না ? কেন একজন কমিশনার বা কমিশনার শুধু নয়, বলা যায় জেলার একজন গুরুত্বপূর্ণ পার্টিকর্মী কেন এক নোংরা মেয়েছেলের ঘরে আসবে ? ওর কথায়, নিজের ওয়ার্ডের হলে তবু বলার ছিল কিছু ।
কেউ যেন উঠে আসছে । উপরে -- দোতলার এই ছাদের দিকেই । সিঁড়ি দিয়ে এক, দুই, তিন, চার । শব্দ হচ্ছে ঠিক । কে ? নিজের গলার আওয়াজ হঠাৎ করেই কি অদ্ভূত শোনায় দেখ । যেন ধোঁয়ার মতোই -- ছড়িয়ে পড়তে থাকা, ত্রক্রমে হালকা আর পাতলা হয়ে মিলিয়ে যাওয়া । সিঁড়ির দরজার কাছে দাঁড়াই । নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি । আকাশের আলো যেন গড়িয়ে নামে তখন । দোতলা, দোতলার মেঝে, সিঁড়ি । ফের, একতলা, উঠোন । অস্পষ্ট যদিও । তবু একটা অস্তিত্ব অন্তত । কেউ থেমে গেছে যেন । অবিনাশ ? নাকি তুলি । সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকি । দোতলার ভাঙা দেওয়াল, ছাদ । ছাদের কংকাল । বিম আর পিলার । আর আমার ঘর । দরজাটা হা হা করছে । কেউ কি ঢুকল ? আলোটা জ্বালি । চৌকি, চৌকির নীচ । দেওয়াল, প্রাচীন সেই ছবির পাশে একটা টিকটিকি । নতুন নিশ্চিত । নাকি স্ত্রী । কোনও প্রেমিক । নাকি প্রেমিকা । লাল চোখে তাকিয়ে দেখছে । জিবটা লকলক করে উঠল একবার । ছবির লোকটা অন্তত একশ বছরের প্রাচীন । চেয়ারের উপর বসে থাকা । অলংকরণহীন । পেছনে জানালা । দেওয়ালও একটা । এইটুকুই । আর লোকটার মুখ । ভাল করে লক্ষ্য করলে মনে হবে, একটু হাসিও আছে যেন । মুখের কিছুটা জুড়ে একটু যন্ত্রণাও । শরীরের অর্ধেকটা হলুদ । পাংশুটে । সম্ভবত একশো বছরের জল আর বাতাসের চিহ্নই ।
সকালবেলা অবিনাশ বলল, কাল রাতে কে যেন এসেছিল । ও নাকি নিশ্চিত, কেউ সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করেছে । আমাকে জিজ্ঞেস করল, টের পাননি আপনি ?
বললাম, ছাদে গিয়েছিলাম একটু । ঘুমটা ভেঙে গেল হঠাৎ ।
-- একতলা পর্যন্ত নামেননি তো ? নেমেছিলেন ?
-- না, ওই দোতলার সিঁড়িই ।
-- কিন্তু স্পষ্ট শুনলাম -- মনে হল, নীচে -- ঘরের সামনেই যেন ।
অবিনাশ জানতে চাইল, আকাশের শব্দটা শুনছিলেন ? যেন খেয়ে ফেলবে একেবারে । ও বলল, ওই শব্দ শুনেই নাকি ওর ঘুম ভেঙে ।
সুপারসোনিক জেট হবে । শব্দের চেয়ে বেশি গতিতে । বললাম, আমিও তাই প্লেনটাকে খুঁজলাম খুব । হয়তো আসেনি তখনো । শুধু শব্দই ।
ভৌতবিজ্ঞানের দীপক বলল, হয় এরকম, শব্দ ধাক্কা খায় দেওয়ালে, কিছু টানেও । কিছু কণা আলগাও হয় দেওয়াল থেকে । তেমন হলে, ইটও । জিজ্ঞেস করল, খুব নিচু দিয়ে যাচ্ছিল ?
-- না, না--। দেখতেই তো পেলাম না ।
-- তাহলে জেট-- সাংঘাতিক ভাইব্রেশন-- মানে কম্পন ।
-- তাই বলে, এত ভুল-- অবিনাশেরও ।
হরিশ, সুধাময়রা টের পায়নি কিছু । বললাম, যেন গোটা আকাশটাই নেমে আসছে তখন ।
সিক্সথ পিরিয়ডে সুধাময় বলল, ছুটির পর একসঙ্গে যাব । খবর আছে একটা ।
বিপিনের দিদি নাকি ফিরে এসেছে, বলল, কপালে সিঁদুরের চিহ্নমাত্র নেই । কেমন উস্কোখুস্কো । দিন সাতেক হল ।
-- বিপিনকে দেখে তো মনে হচ্ছে না কিছু ।
-- সবাইকে দেখে কি সবকিছু টের পাওয়া যায় ?
-- অন্য কোনও কারণও তো হতে পারে । হয়তো এমনি এসেছে । বাপের বাড়ি যেমন আসে-- কিংবা ছেলেটা গেছে কোথাও ।
সুধাময় বলল, সে নাকি এমন কিছু কাঁচা ছেলে নয় । জবা-- মানে, বিপিনের দিদিকে দেখলেই নাকি টের পাওয়া যাচ্ছে । ও নাকি বাড়ি থেকে প্রায় বেরুচ্ছেই না ।
মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবার গণ্ডগোল হল একটু । ছেলেদের সিট পড়েছিল সেই ভবময়ীতে । ভাল স্কুল । আমাদের ছেলেরা নাকি বাড়াবাড়ি করেছে কিছু । এরপর যা হয়, চারটে ছেলের খাতা কেড়ে ওদের কোনও টিচার নাকি প্রায় একঘন্টা বসিয়ে রেখেছিল । স্বরূপবাবুকে যেতে হল । ওই যে বললাম, আমাদের স্কুলটা একেবারে সাধারণ । ভবময়ীর ছেলে বা মাস্টারমশাইদের কেউই হরনাথের ছেলে বা মাস্টারদের পাত্তা দেয় না । রাস্তাঘাটে দেখা হলে ভাব করবে এমন, যেন আমাদের সঙ্গে পড়াশোনা নিয়ে কথাই বলা যাবে না । ভবময়ী অবশ্য খুব পুরনো স্কুল । অবিনাশ বলছিল, সেই গণনাথ ব্যানার্জির আমলের । ভবময়ীর প্রথমবারের প্রেসিডেন্ট নাকি গণনাথ ব্যানার্জিই । ছবি আছে ওই স্কুলে । লাইব্রেরি রুমেই । যেমন চেহারা তেমন ব্যক্তিত্ব । সাহেবরাও নাকি কাঁপতো তখন ।
রাতে ফেরার সময় দেখি অবিনাশ রাস্তায় দাঁড়িয়ে । লাইটপোস্টের গা ঘেঁষে নিজেদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে । বললাম, কি দেখছ ?
-- বাড়িটা । কি অদ্ভুত লাগছে না ? সত্যিই সময় হয়ে এসেছে ।
-- সময় মানে ?
-- ভাঙতেই হবে । এরপর আর ভেঙেও লাভ হবে না ।
-- তার মানে ওদিকটা ঠিকঠাক সব । নির্মলদা ব্যবস্থা করে দিলেন তাহলে ।
লাইব্রেরি বন্ধ হলে, ক্লাবের আলো নিভলে, এ পাড়া প্রায় নিঝুমই । কোনও শব্দ নেই তখন । স্রেফ, জানালার ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসা টিভি-পর্দার চকমক । দুটো একটা মিউজিক, কোনও হাসি বা গাড়ির ইঞ্জিনের স্টার্ট নেওয়া ।
অবিনাশ জিজ্ঞেস করল, নির্মলবাবুর বয়স কত হতে ও পারে বলতে পারেন ?
-- কেন ?
--এমনি-- লোকটা কিন্তু ভালোই বেশ-- যথেষ্ট বুদ্ধিমান-- দেখলাম তো অনেক । ভালো হোল্ড পার্টিতে ।
অবিনাশ বলল, লাবণ্যর ব্যাপারটা নাকি নির্মলদা প্রায় ম্যানেজ করে ফেলেছেন ।
তুলিকে আজ অনেকদিন পর হাসতে শুনলাম । প্রথমে ভাবলাম অন্য কেউ, মানে পাড়ার । ওর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে অবিনাশের নাম ধরে ডাকলাম । দেখি, দরজা খোলাই । ডাক শুনে বের হল তুলি । সেই হাসিমুখ । হাতে চায়ের কাপ । বলল, চা খাবেন ? জানতে চাইলাম, বাবা কোথায় ? ঘরে ?
অবিনাশ নাকি বেরিয়েছে অনেকক্ষণ । বাজারেই । ও বলল, কখন আসে দেখুন । ঘরে আর কে আছে দেখার ইচ্ছে করছিল খুব । বিশেষ করে এতদিন পর ওর হাসি । শেষমেষ তুলিই বলল, আসুন । তুলি যেন বুঝতে পেরেছিল ঠিক, বা ওর ইচ্ছেও যেন ছিল, বসি একটু । বলল, নির্মলকাকু ।
-- কে সমীরন ? এসো ।
ভদ্রলোককে আগের চেয়ে স্মার্ট লাগছে অনেক । পাঞ্জাবী পাজামা । পাকা চুলগুলিকেও যেন ম্যানেজ করেছেন সুন্দর । চেয়ারে বসে । বললেন, অবিনাশের কাণ্ড-- আমাকে বসিয়ে রেখে-- । তুলির কি হাসি । বলল, বেশ করেছে বাবা, এখানে এলেই শুধু উঠি, উঠি ।
তুলিকে অনিমেষের কথা বললাম । হয়তো সহজ হওয়ার সুযোগ পেয়েই । বললাম, লাইব্রেরিতে যাচ্ছ না কেন ? ওরা নতুন বই কিনবে, লিস্ট করছিল, বলল, তোমার কাছ থেকে নাম নেবে ।
ওর দেখলাম আগ্রহ নেই কোনও । বলল, আমি কী করব ? সময় কোথায় বলুন ?
ও নাকি বি. এড পড়বে । নির্মলদাই বললেন, অহেতুক না বসে থেকে বি. এড'টা কমপ্লিট করে এলে তবু চেষ্টা করা যাবে ।
পাখাটা কম স্পিডে ঘুরছে । ঘরটা এমনিতেই ঠাণ্ডা বেশ । দরজাটা ঠিক করেছে অবিনাশ । মলির সুইসাইডের দিনে ভেঙে ফেলা সেই পাল্লা আর নেই । জানালার পর্দাটাও বেশ অন্যরকম । তুলি জিজ্ঞেস করল, খাবেন কিছু ?
-- না, আমাকেও যেতে হবে একটু ।
এমনিতে প্রতিদিন বাজার যাওয়ার দরকার হয় না কোনও । খাওয়ার ব্যাপারে আমার খুব একটা বাছ বিচারও নেই কোনওদিন । স্কুল থেকে ফেরার সময় একেকদিন ব্যাগের মধ্যেই কিছু আলু বা লংকা, পেঁয়াজ বা ঢেঁড়স নিয়ে নিই । ডিম রাখি কিছু । রাতে স্রেফ সেদ্ধ-- ডিম বা ডালের, আর ঘি । বললাম, মাছ আনব একটু ।
আগে হলে অবিনাশকেই বলা যেত, গোটা পনেরো টাকা দিয়ে বলে দেওয়া যেত, স্রেফ মাছ ।
বিশ বছর আগেও এটাই নাকি ছিল বড়বাজার । সকাল সন্ধ্যা গমগম করত একেবারে । এসব অবশ্য লোকের মুখে শোনা । অবিনাশ, সন্তুর বাবা । স্টেশনের পাশে হাউসিং এস্টেট গড়ে ওঠার পর থেকে ওখানকার বাজারটাই আসল বাজার হয়ে গেছে । দামও নাকি সস্তা । অবিনাশ বলল, মাছের বাজার এখন তো খাঁ-খাঁ, আগে বাজার ঢোকার সময়ই শোনা যেত, গলদা সত্তর- গলদা । হ্যাঁ, সেই বিশ-ত্রিশ বছর আগেকার । গলদা এখন চোখে দেখা যায় নাকি ? বাজারে ঢুকতে ডানপাশের আশুতোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার দেখেও নাকি বোঝার উপায় নেই কোনও । তখন বড় রাস্তায় গাড়ি দাঁড়িয়ে যেত । কলকাতা থেকে অর্ডার আসত । ওদিকে বারাসাত ।
-- কত বয়স হল জানো দোকানটার ?
আশুতোষের বাবার দেওয়া দোকান । আশুতোষ মানে এখন যে বসছে তার বাবা । আশু ঘোষ বেঁচে এখনও । তবে হাঁটাচলার ক্ষমতা নেই আর । ওর ছেলে বিনয়বাবু-- ওই যে বুড়ো মতো যে ক্যাশ বাক্সের পাশে বসে-- ওর হাতেই শেষ হল দোকানটা । স্টেশন রোডের হাজরা-- মানে সুধাংশুবাবু, আসলে বিনয়বাবুরই ভাগ্নে । কাজ শিখে এখন নিজেই-- হ্যাঁ, এ পাড়ারই ।
বাজার সেরে চায়ের দোকানে একটা চা নিয়ে বসেছি । দেখি কতগুলি ছেলে হাসাহাসি করছে খুব । বাচ্চাই, হাতে ছেঁড়া চট, বস্তা । বেশ কায়দা করে ধরা, বস্তাটাকে বাঁ হাতের কনুইয়ে আটকে আর একটা প্রান্ত মুঠো করা । কিছু একটা পেয়েছে একজন । দেখছে । আয়না । হ্যাঁ, ভাঙা আয়নাই হবে, রোদ একবার এমনকি আমার চোখেও চমকাল যেন । কাঁচ । কি কায়দা দেখ । মুখেই কি চেকনাই । একজন কি মনে করে যেন তাড়া করলো আরেকজনকে । ধরতে গিয়ে পা পিছলাল । খেলাই । হা-হা । কুকুরটা কেমন ঘেউ ঘেউ করছে দেখ । অশ্বথ্থগাছের তলায় বসে চুল কাটাতে থাকা বিহারি লোকটাও চমকে উঠল খুব-- ।
পাশের রাস্তায় বাস যাচ্ছে হু হু করে । রড ধরে ঝুলে থাকা হেল্পার চিত্কার করছে, শ্যামপুর শ্যামপুর । জানালায় একটি মুখ-- কোনও মেয়ে, হলুদ রোদ পড়া-- মুহূর্তের জন্যই আমাকে তাকিয়ে দেখল যেন । একটা ট্রাকের মাথায় বসা কেউ, সাদা কাপড়ের একটা টুকরো পতাকার মতো টাঙিয়ে-- যেন পতাকাই । প্রবল সেই গতি তখন বাতাসে ধাক্কা দেয় খুব । কাপড় যেন পতাকাই-- কি টান তখন । সম্ভবত ভেজাই । শুকোচ্ছে হয়ত ।
ছেলেগুলি জঞ্জাল ঘাঁটছে ফের । ভাঙা বাক্স । টিনের টুকরো । প্লাস্টিক । জামার বোতাম নেই কোনও । যেন লাগেও না । শুকনো চুলের মতো, জামা-- যেন পতাকাই, স্বাধীনতার পতাকা হয়ে ওড়ে তখন । উজ্জ্বল হলুদ সেই রোদে ধাতব শব্দ হয় । ওদের একজন টিনের একটা টুকরো ভাঙবে । হয়তো ভাঁজ করবে ঠিক । বস্তার সাইজমতোই । কেউ একজন তাকাল এদিকে, দেখল । যেন কিছুই না, বা ভয়ও হতে পারে । ধমকের । যেন, কী হচ্ছে ?
বললাম, এই-- ।
ছেলেগুলি চুপ করে গেল হঠাৎ । ওদের হাত, পা নীচু হওয়া মাথা, মুখ, চুল, চোখ নিমেষেই থ । অবশ্য মুহূর্তের জন্যই ।
-- এই, এই পিন্টু, শোন ! পিন্টু নাকি মুন্না-- এই-- ।
পাশে বসা লোকটা চমকে উঠল । যেন অবাক হল খুব । জানতে চাইল, চেনেন ? বাড়িতে কাজ করত আপনার ?
বললাম, না--না, আমার স্কুলের ?
-- ছাত্র ? তার মানে হরনাথের ?
ঘাড় নাড়লাম ।
লোকটা বলল, আপনি কি টিচার ? মানে মাস্টার ?
চায়ের পয়সা দিয়ে উঠে দাঁড়াই । ছেলেগুলি পুরোপুরিই চোখের বাইরে এখন । কুকুরটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে । বাতাসে শুঁকছে কিছু ।
লোকটা বলল, এদের সবকটা চোর, হরনাথের ছেলে অবশ্য এর চেয়ে ভাল কোথায় ?
হরিশ মুখার্জি রোডের মুখে এসে দেখি ওরা নয়া বস্তির মুখে । ছেলেগুলির কেউ একজন রাস্তার কলে মুখ রেখে জল খাচ্ছে । জানি লাভ নেই, তবু, সেই হরিশ মুখার্জি রোডের মুখ থেকেই ডেকে উঠলাম-- চিত্কার করেই । `মুন্না--' ।
লাবণ্যর সঙ্গে দেখা হয়নি আর । হয়ত একটা ভয়ই । কাউকে বলা যাবে না ঠিক । নগেনবাবুকেও নয় । যেন সবাই মিলে হই হই করে উঠবে । তুমি, তুমি ? একজন টিচার হয়ে ! নগেনবাবু বলবেন, তুমি জানলে কি করে ? চিনতে আগে থেকে ? অবিনাশ হয়তো বলবে, মেয়েছেলেটার উপর একটা সফট করনার তাহলে এজন্যই ।
লাবণ্যকে সেই শব্দের কথা জিজ্ঞেস করা যেত । সেই রাত্রির । সেই ঝিম ঝিম করা । অসংখ্য নক্ষত্রের মধ্যে কোনও একটি বিন্দু । চলমানই । লাবণ্য কি সেই গতির অনুমান করতে পারতো ? অসংখ্য বিন্দুর মধ্যে থেকে একটি মাত্র বিন্দুর অস্থিরতা কি টের পেত লাবণ্য ?
নাগবাবু বলতেন, হেলিকপ্টারের পর হেলিকপ্টার । ফাইটারও । দিগন্ত জুড়ে শুধু যন্ত্রের পাখি । নতুন কোনও খবর নিয়ে আসা । পাখিগুলি যেন বড় হচ্ছে ত্রক্রমে । উজ্জ্বলতা বাড়ছে । স্থির তাকিয়ে থাকা সেই পাখিরা ত্রক্রমে মাটির কাছেই । নতুন যুগের আবির্ভাব ঘোষণা করবে কেউ । নতুন সময়ের । এই টান পড়বে দড়িতে । এই পতাকার ভাঁজ খুলতে শুরু করবে । ফুল, ফুলের পাপড়ি আর ঘ্রাণও । এই ধাক্কা খেল বাতাসের-- জনগণমন শুরু হয়ে গেল, এখন শুধুই হাতজোড় করা আর আকাশের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করা ।
একটা অদ্ভুত নেশা ধরানো ভঙ্গি ছিল হেডস্যারের, হাই পাওয়ারের চশমার পেছনে চকচক করতে থাকা চোখ ।
নগেনবাবু একবার বলেছিলেন, তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে খুব । মাঝে মধ্যে যেতেও তো পারো । বাবার বন্ধু তো বাবার মতোই । কিন্তু নগেনবাবুর ক্ষেত্রে কি অদ্ভুত শোনায় না কথাটা । কোনও শিশু নিশ্চিত ওর হাত ধরে টানেনি কোনওদিন । কোনও বালক কি ওর কাছে আবদার করেছে কিছু নিয়ে ? ওর বুকের উপর কোনও বালক কি মাথা রেখে ঘুমোতে চেয়েছে কোনওদিন ? আমি নিশ্চিত, ওর কাছে গল্প শুনতে চায়নি কেউ ।
নগেনবাবু দেশের বাড়ির গল্প ভালবাসেন । দেশের বাড়ির । সেই মাঠ--ঘাট । আর নদী । বাগান । আর সুধন । সুধন মজুমদার । জঙ্গলবাড়ি নামের এক গ্রামের । নগেনবাবুর কাছে বাবার বয়স তখন বড়জোর দশ কি এগারো ।
একটা সময় যে ওদের মতের অমিল হয়েছিল এটা পরিষ্কার । নগেনবাবুর কথাতেই তা ফুটে ওঠে । একটা সময়ের পর থেকে দুজনের বিশ্বাস দুরকমই । বাবার যখন খদ্দর বা চরকা, নগেনবাবুর তখন লালের পবিত্রতা । রক্তের বিপ্লব ।
নগেনবাবু একসময় বিপ্লবের কথা ভাবতেন । রক্তের স্রোতের বয়ে যাওয়া কথা । উনসত্তর--সত্তর নাগাদ ওদের সম্ভবত শেষবারের মতো দেখা হয়ে থাকবে । মানে সেই দুই বন্ধুর । বাবা আর নগেনবাবুর ।
অবিনাশের কথায় তখন পশ্চিমবাংলা লালে লাল । খদ্দরের চিহ্ন তখন কোথায় ? খদ্দরের কথা ভাবাটাই তখন নাকি লজ্জার । সংকোচের । ভয়েরও । ওর কথায়, আঠারো--বাইশ--পঁচিশের সবাই তখন দুটো দিকে দাঁড়িয়ে । লাল পতাকার নীচেই । নকশাল আর সিপিএম ।
সেই শ্যামপুরেও নকশালরা কোনওদিন দাঁত ফোটাতে পারেনি, নগেনবাবু নাকি তাদেরই একজন ।
নগেনবাবুর সেই দৃঢ়তা এখন আর নেই । অবিনাশের মতে ভদ্রলোক এখন অনেক দুর্বল । সত্যিই । নিজেই টের পাচ্ছি । বাবার প্রতি স্রেফ সেন্টিমেন্টেই আমাকে চাকরিতে ঢোকানো । এই হরনাথ । শুধু যেন চোখের সামনে আমাকে রেখে দেওয়ার জন্যই । স্রেফ বাবার জন্যই এই মিথ্যে সার্টিফিকেট জোগাড় করা । অংকে অনার্স আর এম. এস. সি । শুধুমাত্র বাবার জন্যই কোনও মন্ত্রী বা বড় নেতা ধরে সার্ভিস কমিশনের লিস্টে নাম তোলা, এরপর মৌখিক পরীক্ষায় পার করানো, প্যানেলের ত্রক্রম উলটে পালটে দেওয়া ।
নগেনবাবু নিজেই ব্যানার্জি বাড়ির কথা তুললেন । লাবণ্যর কথা । অবিনাশ আর নির্মলদার কথাও । বললেন, তোমাদের পাড়ায় যেতে হল বেশ কদিন ।
যেন অবাক হলাম খুব । জানতে চাইলাম, কেন ? বললাম, আমাকে বললেই তো হোত ।
ঘরটা আজ আর অন্য দিনের মতো ফাঁকা নয় । বরং মেঝেতে ছ--সাতজন । বাইরেও । মেঝেতে বসে থাকা লোকগুলির ছবি দেখে অবশ্য কোনও মিল ফ্যাক্টরির শ্রমিক বলেই মনে হবে ।
পিসি চা খাবো কিনা জানতে চাইল । পরিষ্কার `না' করলাম । পিসির যা বুদ্ধি তাতে হয়ত এতগুলি লোকের সামনে একটা মাত্র কাপ এনেই হাজির হবে । লোকগুলি দেখবে হাঁ করে ।
কথার মাঝখানেই রিং বেজে ওঠায় নগেনবাবু আমাকে বসতে বললেন একটু । মেঝেতে বসে থাকা লোকগুলি নিজেদের মধ্যে কি নিয়ে ফিসফিস করছিল । দূরের দু--তিন জনই । টেবিলের উপর পড়ে থাকা কাগজটা নিলাম । প্রথম পাতার রাজনৈতিক সংবাদ । কোনও দুর্ঘটনা নেই । ধর্ষণ বা ডাকাতির চেষ্টারও খবর নেই । বিরাট একটা জনসমাবেশের ছবি ।
-- আপনি কি হরনাথের ?
বসে থাকাদের মধ্যে একজন । যা হয়, নগেনবাবু না থাকায় আমিই এখন ওদের কৌতূহলের বিন্দু । ঘাড় নাড়লাম । এমনিতে গুরুত্ব দিলাম না কোনও ।
কে যেন বলল, আমার ছেলে-- ।
-- ও, কোন ক্লাসে ।
-- এইট ।
-- ওদের বিজ্ঞান নিই । কী নাম যেন ।
বলল, চিনতে পারলাম না একদম তবু, `হ্যাঁ' করলাম । জানতে চাইলাম, পড়াশোনা করে তো ঠিকঠাক ? এরপর যা হয়, একগাদা নালিশ । বলল, ভাবছি এইট পাশ সার্টিফিকেট নিয়ে ছাড়িয়ে দেব স্কুল থেকে, যদি হয় কিছু ।
এককথায়, হ্যাঁ বা না কিছুই বলতে পারি না । অবশ্য ঠিক কি যে বলা উচিত বুঝেও উঠতে পারি না । ছেলেটাকে চিনতে পারলেও না হয় বোঝা যেত কিছু ।
চলে যাওয়ার আগে ওদের মধ্যে দুজন, `চলি মাস্টারমশাই' বলল ।
নগেনবাবু কিছু বলার আগে আমিই বললাম, এরা কি ওরিয়েন্টালের ?
ওর কথায়, এতদিনে লড়াই শুরু করলে আর হয় কিছু ? তবু স্রেফ এতগুলি লোক বলায় ।
-- হবে কিছু ? মানে আটকাতে পারবেন ?
-- আটকাতে না পারলেও অন্তত পয়সাকড়িটা যেন ঠিকঠাক পায় সেটা তো দেখা যাবে ।
নগেনবাবু বললেন, খেয়ে যাবে আজ । সেদিন বাজার করতে পারিনি । একা লোক । জানতে চাইলাম, আজ কে করল ?
-- কেউ না । পিসি যাবে ।
এবারের ব্যাচ কি রকম জানতে চাইলেন । মানে ফার্স্ট ডিভিসন কটা হতে পারে বা স্টার ।
-- স্টার পাবে না কেউ, তবে ফার্স্ট ডিভিসনটা বাড়তে পারে । তবু বড়জোর আট কি নয় । টেস্টে তো ছেড়ে দিতে হল সবাইকে ।
ওর কথায়, রেখেই বা কি হবে, তার চেয়ে যাক, চেষ্টা করুক ।
সেক্রেটারি হিসেবে নিশ্চিত ভাবেই এটা ওর লাস্ট টার্ম, ব্যাপারটা ওর অজানা থাকার কথাও নয় । হয়তো অন্যরকম কিছু ভেবেও থাকতে পারেন এ ব্যাপারে । একটা জিনিস অবশ্য বোঝা যাচ্ছে, নির্মলদা যতই চেষ্টা করুক, নগেনবাবুকে পুরোপুরি মেরে ফেলা কঠিন ।
-- লাবণ্যর কথা তোমাকে নির্মল বা অবিনাশ বলেনি কিছু ?
-- কি বলবে ?
-- এই খারাপ মেয়ে বা রোগ আছে শরীরে বা আমাকে ।
উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে আমার ইতস্তত ভাব দেখেই উনি বুঝে যান ঠিক ।
-- ওরা চাইছে লাবণ্যের পেছনে যেন কেউ না দাঁড়ায়, যেন ওদের এক ধমকে মেয়েটা-- আসলে অশিক্ষিত লোকের ভিড় বাড়লে যা হয় । সব সাতাত্তরের পর ঢোকা । সত্তরের দিনগুলি হলে-- ।
-- কেন অবিনাশ বা নির্মলদা কি-- ?
-- ওদের চিনতো কেউ ?
-- ওরা কিন্তু বলে-- ।
-- কী ?
-- আপনার কথা-- আপনার নাকি দাপট ছিল খুব ।
বাইরে, `আউট--আউট', করে চিত্কার করে উঠল বাচ্চারা । ওরা পিং--পং খেলছে । ঢোকার সময় দেখলাম গোল ঘর তৈরি করছে, একটা দড়ির মাথায় লাঠি আটকে মাটিতে বৃত্ত তৈরি করছে । রবারের বলটা তখনও কারুর পকেটেই ছিল নিশ্চিত ।
আমার কথা শুনে নগেনবাবু হাসলেন একটু ।
-- তোমার বাবা কিন্তু ছিলেন ঠিক তোমার মতই-- এই তুমি যেন ভয় পাচ্ছ-- নির্মল আর অবিনাশকে ।
-- আমি কিন্তু ভয় পাই না, আসলে ভালই লাগেনি কোনওদিন । তাছাড়া আপনিই তো বারণ করলেন । ওদের সঙ্গে তর্কে যেতে আপনি বা মুকুন্দদা সবাই তো না করলেন ।
-- না না সেজন্য নয় । এতদিন এত লোক দেখলাম, বুঝি না কিছু ? তোমার বাবা সেই তোমার মতই-- একটু দুর্বল ।
ওঁর মতে, লাবণ্যর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে উনি সময় নেননি এতটুকু, এক অসহায় মানুষের উপর এতবড় অন্যায় । লাবণ্যকে নিয়ে বাজে কথার ব্যাপারটা নাকি জানা ছিল ওর । এমনি করে বাষট্টি সালেও উনি নাকি দ্বিধা করেননি কোনও । কমিউনিস্ট পার্টি তখন কার্যত বেআইনিই । চীন--ভারত যুদ্ধ ।
-- আমরা হলাম গিয়ে তখনকার ।
আমার বাবা নাকি ডিসিশনই নিতে পারতো না । সারা জীবন ধরেই, ওর কথায়, ওই সময় চরকা কাটাদের দলে যায় কেউ ? তবে সত্তরের মুখে বাবা নাকি পার্টি করত না আর । `ভোট নিশ্চয়ই আমাদের দিত না--', নগেনবাবুর কথায়, তোমার বাবার ভোট ওদের বাক্সেই জমা পড়তো ।
জিজ্ঞেস করলাম, বাবার বিরুদ্ধে যদি লড়তে হোত-- ধরুন নির্মলদার জায়গায় ।
-- মাথা খারাপ হয়েছে তোমার । এইসব অপদার্থদের সঙ্গে তোমার বাবা ? তর্কের কথা বললে, সেই তর্ক হোত একটা বিশ্বাসের ভিত্তি থেকে, তাতে আদর্শ থাকত ।
ছেষট্টির খাদ্য আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়া লোকগুলির ব্যাপার নিয়ে বাবা নাকি যা তা বলেছিল নগেনবাবুকে । একেবারে বাজে । অন্য কেউ শুনলে নির্ঘাত পাগল ভাবত । বাবার কথামতো, জীবন নাকি একটিবার মাত্র পায় মানুষ । একটিবার মাত্র । যে কোনওভাবেই অস্বাভাবিক মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করা যাক না কেন, তা নাকি আসলে খুনই । জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া । একটা লোককে উত্তেজিত করে যারা মৃত্যুর মুখে পাঠায় তারা আসলে খুনীই ।
নগেনবাবুর কথায় বাবার প্রতি একটু শ্লেষ, একটু বিদ্রুপ থাকে যেন । একটু যেন করুণাও ।
ওর মুখের কালচে দাগ চোখে পড়ে আমার । জানালার বাইরে ছেলেদের আচমকা উল্লাস টের পাই ফের । ভয়ও । কেউ যেন মরে গেল । খেলার নিয়মেই । হঠাৎ করেই ধরা পড়ল কেউ । সুধন মজুমদারের পক্ষে আমার দিক থেকে একের পর এক যুক্তি তৈরি হতে থাকে । মনে মনেই অবশ্য ।
বললাম, মরতে কারই বা ইচ্ছে করে খুব, ভয় তো করেই । এরপর সেই রাত্রির কথা উল্লেখ করলাম । সেই গ্রাস করার মতো শব্দ । অসংখ্য উজ্জ্বল বিন্দুর মধ্যে একটি মাত্র বিন্দুকে খোঁজার চেষ্টা । সেই ছাদ । হলুদ আলো । সেই চিলেকোঠা । আর সেই সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করতে থাকা কোনও কিছুর । বললাম, অবিনাশেরও শোনা । ভৌতবিজ্ঞানের দীপকের কথাও উল্লেখ করলাম । ওদের মতে, দূরের শব্দ নাকি আলগা করে দেয় সবকিছু চুন, শুড়কি এমনকি ইট পাথরের চেয়ে শক্ত কোনও কাঠামোও ।
অনিমেষকে, তুলির সেদিনের বলা কথাগুলি বললাম । নির্মলদার নাম উল্লেখ না করেই অবশ্য বললাম, ওর নাকি সময় নেই । হয়ত আসবেই না আর ।
-- কেন ?
-- এমনিই, ওকে দেখে মনে হল ওর আর আগ্রহ নেই ।
অনিমেষ অবাক হয়ে তাকাল একবার । দেখল আমাকে ।
সব মিলিয়ে গোটা দশেক ডেস্ক । বেশ পুরনো । ডেস্কের কায়দা কিছুতেই এখনকার দিনের মতো নয় । কিছু বেঞ্চ, হাইবেঞ্চও ।
লাইব্রেরির দুটো অংশ । একটা শুধুমাত্র দৈনিক খবরের কাগজ পড়ার জন্যই । আর একটায় বাদবাকি অন্যসব । বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, এখানে বসে পড়ার জন্যও বই চেয়ে নেয় কেউ । সন্ধে ছ'টা থেকে রাত ন'টা । গোটা বারো আলমারি ছাড়াও, আলমারির পাশে বা মাথায় স্তূপ করে রাখা হাজার ম্যাগাজিন বা বইপত্র । জানতে চেয়েছিলাম একদিন, এসব কি হিসেবের বাইরে ?
-- বাইরে নয়-- এগুলির আসলে এন্ট্রিই হয়নি ।
অনিমেষের কথায় চেষ্টা করলে প্রত্যেকেই যে কোনও কাজের অনেকটাই করতে পারে-- আসলে কাজ শেখা বা করার ইচ্ছে আছে কিনা সেটাই-- ।
বললাম, তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে না বললে সেদিন, সময় দিতে পারবে আর ?
অনিমেষ যেন দমে গেল একটু ।
প্রদীপ শুনেছে কথাটা । আড়চোখে তাকিয়ে হাসল একটু । অনিমেষের উত্তর দেওয়ার আগেই বলল, আমাদের কি এমনি তৈরি করছে অনিমেষদা ?
-- তাই ? তাহলে আমার নিজের জন্যই তোমাদের দিয়ে-- ।
অনিমেষ ধমকে উঠল প্রদীপকে, বলল, তেমন মনে হলে আসবি না কাল থেকে, দেখবি চলে কিনা ।
ওর কথায়, এই পাড়ায় আছে কি আর ? গর্ব করার মতো কোনও লোক পর্যন্ত নেই । এক এই লাইব্রেরিটাই, একটা ভাল মাঠ পর্যন্ত নেই । সেই কোন ছেলেবেলায় এখানে পা দিয়েছিল অনিমেষ, এই ঘরের প্রতিটা কোণের ঘ্রাণ আলাদা করে মনে করতে পারবে সে । বলল, আগের ইলেকশনে মেম্বাররা তো এমনি এমনি ভোট দেয়নি আমাকে ।
পৌনে নটার সময় প্রদীপকে যখন ছেড়ে দিল অনিমেষ তখন ভিতরে আর কেউ নেই । শুধু বাইরের সিঁড়ির দুপাশে সন্তুর বাবারা বসে । নিজেদের মধ্যে গল্প করছে কিছু নিয়ে ।
অনিমেষ বলল, পাড়াটার কি হাল হয়েছে ভাবতে পারেন ? একসময় উকিল, ব্যারিস্টার, ডাক্তার কি না ছিল । ওর দাদুই নাকি নামকরা ডাক্তার ছিল খুব । শ্যামপুর ছাড়িয়েও নাম ছিল ওঁর । অনিরুদ্ধ সেন । কোলকাতা থেকে লোক আসত । বিধান রায় পর্যন্ত চিনতেন । রাজনীতিতেও নাম ছিল খুব । কংগ্রেস থেকে দাঁড়াতে বলেছিল একবার । রাজি হননি । অনিমেষের কথায় এখন সেখানে কারা থাকে দেখুন ।
লাবণ্যর কথা তুলল । বলল, কিছু অন্তত সত্যি তো বটেই । ওকে রাস্তায় বেরুতে দেখেছেন কোনওদিন ? বড়জোর দুর্গা বিসর্জনের দিন, তাও কিছুক্ষণের জন্যই । এখন নাকি একেবারে বিছানায় । খারাপ রোগ নাকি । আর ছোঁয়াচেও । ওর কথায়, লোকে যত বাজে বলে হয়ত তত বাজে নয়, হয়ত এখন ভালোই, মানে এখানে এই পাড়ায় এসে-- ।
শ্মশানঘাট থেকে বাঁদিকে বাঁক নিয়ে ব্যানার্জিবাড়ির দিকে ঘুরবো, দেখি মেয়েটা দাঁড়িয়ে । সেই শ্বেতপাথরের একেবারে একা । খুব চেনা লাগছে না ? কার মুখ যেন ? একটা টপ আর স্কার্ট পরালেই লিপি ? মন্দিরগুলির মাঝখান দিয়ে এক এক টুকরো আকাশ । ঘাটের মাথার উপর একটু সাদাটে ভাব । অল্প ধোঁয়া যেন । মেয়েটা কি যে করবে যেন বুঝে উঠতে পারছে না । যেন ফোয়ারার জলে তার শরীর ভিজে একশা--, পিচ্ছিল । মাটি থেকে উঠে আসা লতা যেন সত্যি সাপের মতোই তাড়া করছে ওকে । অনিমেষ ঠিকই বলেছিল । সাপই একটা । ঠাণ্ডা । ইচ্ছে করছিল খুব, সত্যি বলছি, ওর শরীর ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছেই বা ওর নাম ধরে-- । আর ঠিক তক্ষুণি খুব কাছ থেকেই কেউ ডেকে উঠল, স্যার ।
একটা সতেরো আঠারো বয়সের ছেলে । সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ।
--আপনি এখানে ?
-- এমনি, বাড়ি ফিরছিলাম, ভাবলাম ঘাট থেকে-- ।
ছেলেটার নামটা যেন কী ? কোন ইয়ারের যেন ? সাইকেল নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার পাশে এসেই দাঁড়াল ।
-- এটা কি পরী ?
-- না না-- পরীদের তো ডানা থাকে ।
-- পরীই হবে, ডানা হয়তো ভেঙে গেছে, ছেলেটা ঘাটের দিকে হাঁটতে শুরু করে ।
-- কোথায় যাচ্ছ ?
-- এখানেই-- এক বন্ধু আসবে ।
-- এত রাতে ?
-- আসি তো আমরা । দশটা --সোয়া দশটা পর্যন্ত গল্প করি বসে ।
ছেলেটা কি মনে করল কিছু ? ও কি ভাবল স্রেফ এই নগ্নতার জন্যই আমি দাঁড়িয়ে এখানে । ওই লতা কি লতানো গাছের নরম আর মসৃণ উরু জড়িয়ে কোথাও পৌঁছনোর চেষ্টার জন্যই ?
সাড়ে ন'টা বেজে গেছে তখন । প্রাইভেট পড়ে লিপি ঘরে ফিরে এসেছে নির্ঘাত । শ্বেতপাথরের সেই বালিকা--মূর্তির কথা মনে পড়ে । বাইরের ঘোরানো সিঁড়ি ধরে দোতলায় না থেমে সরাসরি ছাদে-- একেবারে চিলেকোঠার জানালায় গিয়ে দাঁড়াই । সামনে ভেঙে পড়তে থাকা রেলিং । ছাদ । ছাদের প্রান্ত । দূরে প্রায় অদৃশ্য হতে থাকা দেওয়াল । অন্ধকারে গাছগুলির পার্থক্য তখন অবশ্য আর নেই । সিঁড়ির দরজার গায়ে কান পাতি । আঙুল দিয়ে শব্দ করি । যেমন করতাম । ফিসফিস করে ডাকি, লাবণ্য-- এই-- । কোনও শব্দ আছে ? হচ্ছে কি ভেতরে ? হ্যাঁ-- আসছে যেন কেউ । নাকি অন্য কিছু । বুক দিয়ে গড়ানো । কোনও টিকটিকিই, নাকি সাপ বা সাপের মতোই শীতল আর পিচ্ছিল অন্য কিছু ।
উপর থেকে নীচে কি একটা পড়ল যেন । বা পড়ছে যেন এখনও ঝুর ঝুর করেই, বালি বা শুরকি । যেন ক্ষয় যাচ্ছে কিছু ।
--লাবণ্য-- এই লাবণ্য ।
একটু জোরেই শব্দ করি আমি । জোরেই । সত্যিই কিছু যেন ভেতরে । যেন উপর থেকে নীচেই । একটা শূন্যতা তৈরি হয় কোথাও । ফাঁকা এবং নৈ:শব্দও । হু হু করা বাতাস ঢুকতে থাকে । আবার বেরোয় । যেন জমে থাকছে না কিছুই । কার নাম ধরে ডাকব ? কার নাম ধরে ডাকলে সাড়া পেতে পারি ?
-- লিপি-- এই লিপি-- ।
নগেনবাবু বলছিল একদিন, ভয় আসলে মৃত্যুর আতংকই ।
দরজায় ধাক্কা মারা মাত্রই কেঁপে ওঠে দেওয়ালটা । বেশ জোরেই । একটা ইটের টুকরো প্রায় পায়ের উপরই পড়ল যেন । ভাঙাই । বাবা নাকি এটা পিঁপড়ের মতো করে হলেও বেঁচে থাকতে চাইতো । গলা শুকিয়ে আসে আমার । বুক । হাওয়া কি সত্যিই থাকে না কোথাও ।
-- লিপি, আমি-- লিপি, শুনতে পাচ্ছিস ?
শীতের জন্য এখন আমার একটা শাল, জহর কোট, এমনকি গলা অব্দি ঢাকা গেঞ্জি । ছোটবেলার কথা ভাবলে অবাক লাগে খুব । স্রেফ সস্তার একটা চাদর । পুজোর পরপরই আসত সেই চাদরঅলা । কাঁধে করে নিয়ে ফিরি করত লোকটা-- দরজায় দাঁড়িয়ে ডাক পাড়তো-- শীত এসে গেল গো মা । আর সাড়ে চার টাকা দামের চাদর নিয়ে কি বাছাবাছি তখন ।
ঘাসের উপর এখনই জল জমছে কিনা টের পাওয়া মুশকিল । আমরা বলতাম, ওশ । ওশের জল । ওশের জল অসুখ করত খুব । বছরের প্রথম ঠাণ্ডা লাগা-- তা নাকি এই ওশের জন্যই ।
কুয়াশা জমা শুরু হয়ে গেছে অবশ্য । জলের উপর । গাছের ডালে । আর দূরের শব্দ কি স্পষ্ট আসে এখন ! নদীর গাদাবোট বা ওপারের ট্রেন । এক একবার প্রায় চমকে ওঠার মতো করেই । এমন কি মাঝরাতে অবাকই হতে হয় । এত স্পষ্ট ? সতিয কি ট্রেন ? যেন একটা একটা করে কামরা পা টিপে টিপেই এগুতে থাকে । যেন ইচ্ছে করলেই গুনে নিতে পারব, এক দুই, তিন, চার ।
তখন শীতকালটা শেষ হতো সরস্বতী পুজোয় । সেজকাকি ট্রাংক থেকে কাপড় নামিয়ে দিত একটা । আর একটা চাঁদোয়া । ভারী সুন্দর ছিল সেটা । থাকত সেই সিন্দুকেই । সেজকাকির কাপড়টা দিয়ে দিয়ে তিনদিকে ঘিরে দেওয়া হত । উপরে চাঁদোয়া । সাদার উপর লাল । লাল রঙের ফুল । ঠিক মাঝামাঝি । ফুলের চারপাশে বৃত্ত একটা । লাল রঙেরই । আর স্কুলের কার্ডের কথাও মনে পড়ে । আমরা বলতাম, অজন্তা স্টাইলের । হাতে বীণা নিয়ে বসে থাকা সেই ঠাকুরের ছবি । যেন নারীমূর্তি নয় । যেন সেই স্তনদ্বয়ের কোন যৌনতা নেই । নগ্নতা নেই কোথাও । বা সেই কোমরের অন্য কোনও তাত্পর্য নেই । পালপাড়ার অর্ডার দিতে গিয়ে আমরা বলতাম, অজন্তা স্টাইলের কিন্তু । কি নাম ছিল যেন, সহদেব পাল, সহদেব পালই তো বলত । বলত, অ্যাডভান্স না করে গেলে বলতে পারছি না ।
বিপিনের মায়ের হাঁফানি । বলল, যা কষ্ট সমীরনদা । শীতকাল এলেই মাথা খারাপ হয়ে যায় আমার । সারাটা রাত বিশ্বাস করুন, সারাটা রাত জেগে কাটাতে হবে কাউকে ।
ও নাকি ওর দিদিকে নিয়ে এসেছে এইজন্য । খুব বাড়াবাড়ি হচ্ছে কদিন ধরে । গত বছর নাকি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল একবার । টানা তিনদিন অক্সিজেন দিতে হয়েছিল ।
বললাম, তোমার দিদি ভাল আছে তো ?
বিপিন অবাক হল যেন, বলল, ভালই তো-- মানে ওকেই তো দেখতে হচ্ছে মাকে । বোন দুটো তো ছোট খুব । নাইন আর সেভেন । বাড়িতে নাকি বিয়ের কথা বলছে । বিপিনের । ওর দিদিই নাকি বলছে বিশেষ করে । বিপিন বলল, বড়জোর এই বছরটাই ।
সুধাময় সব শুনে বলল, গুল মারার আর জায়গা পেল না । পেয়েছে আপনাকে ভালমানুষ । ওর মাকে হাসপাতালে দিলে পাড়ার মানুষ জানবে না ? আর ওই মেয়েটা সারারাত জাগবে ? হয় কখনো ? ওর মায়ের কাতরানো আর কারুর কানে যাবে না ? সুধাময়ের কথায়, সেসব না হয় ঠিক আছে । কিন্তু ছেলেটা আসবে না একবার ।
বললাম, ও নাকি বম্বে গেছে ।
-- বম্বে ?
হাসল সুধাময় । বেশ শব্দ করেই । স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ায় এই হাসি অবশ্য কেউ শুনল না । কেউ মানে ছাত্ররা । বিশেষ করে সুধাময় স্যারের । ওকে যা ভয় পায় ছেলেরা । বেত হাতে ওর যা দাপট ।
বললাম, যেতে পারে না ?
-- যাবে না কেন ? গান শুনেছেন ওর ? কি গান গায় জানেন ?
-- কি গান ?
-- সস্তা মার্কা, কিশোর কন্ঠ ।
-- গাইতেও তো পারে ভাল । হয়তো ভাল লাগছে অনেকরই ।
ছেলেটার সম্বন্ধে বিপিন সেদিন বলেছিল, কষ্ট করছে খুব । চিঠি দিয়েছে নাকি এর মধ্যেই । লিখেছে, বেশ ক'জন সুরকারের সঙ্গে কথা বলেছে । লিখেছে, ওখানে নাকি রেকমাণ্ডেশানের দাম নেই কোনও । শুধু কাজ । ওর জন্য বিপিনের দিদির জোগাড় করা দেওয়া চিঠি নাকি খুলেও দেখেনি কেউ । লিখেছে, ভাল আছে । চিন্তা করতে বারণ করেছে । সুধাময়কে বললাম, ওদের ভাড়াবাড়ি নাকি রেখে দিয়েছে এখনো । বিপিনের দিদি নাকি একগুঁয়ে খুব । সবাই মিলে বলেছে, ছেলেটা যদি কিছুদিনের জন্য বম্বেতেই থেকে যায়, সেক্ষেত্রে জবা-- মানে বিপিনের দিদি অনর্থক পয়সা খরচ করবে কেন ? বিপিনের কাছে চলে আসতেই তো পারে । ছেড়ে দিক ঘরটা ।
ছেলেটা নাকি লিখেছে, ঘরে ফিরে তোমার কথা মনে পড়ে, তোমার চোখ--, ছবিটা আমি জামার পকেটেই-- । সুধাময়কে বললাম, এসব কথা অবশ্য বিপিন অন্যকে বলতে বারণ করেছে । বিপিন অবশ্য স্বীকার করেছে, চিঠিটা পড়া উচিত হয়নি ওর, হাজার হোক স্ত্রীকে লেখা এক স্বামীর ইনল্যাণ্ডই--, তবু ইচ্ছের বাইরে গিয়ে একবার মুহূর্তের জন্যই নাকি ওর দেখে নেওয়া ।
নগেনবাবুর আর নির্মলদার রেষারেষিতে নাকি ভুগতে হবে অনেককেই । সত্যদা নাকি এখন ফের পুরোপুরি নগেনবাবুর । নির্মলদা কমিটিতে ঢুকুক উনি নাকি আর চাইছেন না । বিপিন বলল, কি নোংরামি দেখুন, আমার অরিজিন্যাল মার্কশিট অ্যাডমিট কার্ড নিয়ে স্কুলের রেকর্ড নাকি মিলিয়ে দেখবে । ইউনিভার্সিটিতে নাকি ভেরিফাই করতে পাঠাবে । সার্টিফিকেটগুলি নাকি জাল বলে সন্দেহ করছে । স্কুলের ক্লার্ক শিবেন সমাদ্দার বিপিনকে বলেছে এসব, শুধু বিপিনেরটাই নয় অবশ্য । আরও দু--একজনের । শিবেন নাকি বলেছে, ভেরি কনফিডেনসিয়াল ।
অন্যদিন ঘন্টা পড়ার পর অনেকটা সময় পর্যন্ত সুধাময় স্কুলে থাকে, আজ কখন বেরিয়ে গেছে কে জানে ? তেমন মাথাওয়ালাদের মধ্যে আজ হেডমাস্টার স্বরূপবাবু ছাড়া শুধু সত্যদা ছাড়া কেরানি শিবেন, ফোর্থ ক্লাসের অবিনাশ । এ সময় নাকি চা--মুড়ি আসে, গল্প হয় । ছুটির এত পরে আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে স্বরূপবাবু অবাক খুব । টেবিলের অন্যদিকে মুখোমুখি সত্যদা বসে ।
-- তোমার কাগজপত্র হয়েছে ?
সত্যদা জানতে চাইলেন ।
-- আমারটা ও বাড়িতে, মানে পালপুকুরে ।
আর কিছু নয় । এরপর মুড়ির ঠোঙা এগিয়ে দিয়ে বললেন, নাও ।
স্বরূপবাবুর পেছনে জানালার পর্দা উঠিয়ে রাখা । ওখানে পুরনো ফ্যাক্টরি একটা । ভাঙা দেওয়াল । আর পুকুরও । কচুরিপানার ফাঁকফোকর দিয়ে মাছ ধরছে ছেলেরা । আলো কমে এসেছে বেশ । ঘরের আলো অবশ্য অনেক আগেই জ্বালিয়ে দিয়েছে কেউ । পাখা এখন বন্ধই । শোঁ শোঁ-- করতে থাকা শব্দ এখন আর নেই ।
-- কী ভাবছ ?
স্বরূপবাবুই জানতে চাইলেন ।
-- না মানে বাড়ি যাচ্ছি ।
-- কী করবে বাড়ি ফিরে ? আছ কে ? বিয়ে করো তো এবার, খাওয়া যাক-- কী বল সত্য-- ওর জন্য-- ।
-- কেন বিপিন তো বলেছিল-- তাও তো দেখুন-- হা-হা ।
হাসল লোকটা, আমিও । বোকার মতো হলেও-- এমনকি পাশের ঘরে টাইপ করতে থাকা শিবেন সমাদ্দারও শব্দ করে উঠলো ।
নগেনবাবুর শরীরের কথা জানতে চাইলেন সত্যদা । হঠাৎ করেই । বললেন, লোকে যাই বলুক, উনি কিন্তু লোক খারাপ নন । অন্য সবার সঙ্গে ওঁর তুলনা করাটা একেবারে বেঠিক ।
পাশের ঘর থেকে টাইপের `ঠক--ঠক--ঠক--ঠক' করা শব্দ । কি টাইপ করছে শিবেন ? কোনও অ্যাপ্লিকেশন ? মানে আবেদনপত্র ? কিছু নাম ? পর পর-- বিপিন কুমার দাস, সমীরন মজুমদার । হয়তো লেখা হচ্ছে, ইফ ইয়ু প্লিজ ভেরিফাই দ্য রেকর্ডস সাপ্লায়েড বাই-- ।
গোপন কিছু টাইপ করার হলে এটাই অবশ্য উপযুক্ত সময় ।
সত্যদা বলল, তোমাকে সেদিন মার্কশিট, সার্টিফিকেটের কথা বলায় কিছু মনে করোনি তো ? আসলে, একা বিপিনেরটা পাঠালে ভবিষ্যতে কথা উঠতে পারে, তাই । তোমার ওসবের একটা করে কপি অবশ্য স্কুলেই রাখা আছে । অরিজিনাল না হলেও চলবে ।
-- তেমন হলে অবশ্য বিপিনের কাগজের সঙ্গে তোমারটা না পাঠিয়ে প্রলয় আর দেবাশীষেরটাই পাঠানো যাবে । ওরা দুজন তো বিপিনের একই সময়ের ।
সুধাময়ের কথার উপর ভিত্তি করেই স্কুল ছুটির ঘন্টাখানেক পরও আমার এই থেকে যাওয়া । ও বলছিল একদিন, স্কুল রাজনীতি বুঝতে হলে, থাকতে হবে । ছুটির অন্তত ঘন্টাখানেক পরও । বলছিল, রাস্তাঘাটের আলো জ্বলে ওঠার পরও স্কুলের অফিসে শব্দ থাকে । একেবারে ফাঁকা উঠোনে বারান্দার আলো গিয়ে পড়ে । আর সেই বারান্দাও কি চুপচাপ তখন ।
সুধাময় না থাকা সত্ত্বেও চলে আসার ইচ্ছে করছিল না একদম । এই ফাঁকা বারান্দা আর উঠোন সত্যিই অদ্ভুত লাগছিল খুব । যেন এক্ষুনি চিত্কার করে উঠবে সবাই । যেন ক্লাস রুমের দরজা এক্ষুনি হাট করে খুলবে, ফাইভ আর সিক্সের ছেলেরা এক্ষুনি হল্লা শুরু করবে ।
সার্টিফিকেটগুলি নগেনবাবু ফেরত দেননি আর । চাওয়াও হয়নি । কী করছেন ভদ্রলোক কে জানে ? মুকুন্দদার বাড়ি গেলে হত একদিন । সেই দোতলা, বারান্দার গ্রিল, সেই কুকুর । আর সেই মেয়ের `বাবা'--', বলে ডেকে ওঠার কথাও মনে পড়ে অবশ্য । সত্যদার কাছে স্বীকার করলে হয় না ? লোকটা আমাকে ভালবাসে খুব । নতুন রুটিনে ওর কথাতেই ক্লাস টেন পাওয়া । যদি ওকে বলি, উপায় ছিল না কোনও, বিশ্বাস করুন । যদি বলি, আমাকে বরং ছেড়ে দিন, যদি চলেই যাই, ছেড়ে দেবে না ? হয়তো অবাক হবে খুব । হয়তো বলবে, তুমি ? তুমি তাহলে পাশ করনি ?
নগেনবাবুর অবশ্য স্বীকার করার কথা নয় । সত্যদা হয়তো ওর বাড়ি গিয়েই জানাবে । আর, সব শুনে নগেনবাবু ভাল করবেন অবাক হওয়ার । হয়তো বলবেন, সত্যি--? সমীরণের কাগজপত্র তার মানে জাল !
চলে আসছি এ সময় স্বরূপবাবুই জিজ্ঞেস করলেন কথাটা । সাধারণভাবেই । `ছুটির পর এতটা সময় তো থাকো না তুমি-- কি ব্যাপার ?'
হয়তো বিশ্বাসযোগ্য হল না একেবারে, তবু--, বললাম, এমনি, সুধাময় থাকবে বলেছিল ।
নীচে নেমে বারান্দায় দাঁড়ালাম একবার । দোতলার বালবের আলো উঠোনময় ছড়ানো । উপর নীচে সার দেওয়ার ক্লাসঘর । গোলাপি রঙওয়ালা ফুলের লতানো গাছটা উপরে উঠে যাওয়া । দুটো--একটা লতা এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে । যেন ওঠার রাস্তা পাচ্ছে না কোনও । যে কোনও একটা নাম ধরে ডেকে উঠতে ইচ্ছে করছে খুব । এমনি । যেন একটা চিত্কারে হুড়মুড় করে জেগে উঠবে সব । যেন একটা মালগাড়ি আড়ামোড়া ভেঙে এক্ষুনি রওয়ানা দেবে, স্রেফ সিগন্যাল পোস্টের আলো জ্বলে ওঠার অপেক্ষায় ।
বারান্দা ধরে সামনের দিকে হাঁটছি, নিজের পায়ের শব্দটাই কেমন অদ্ভুত লাগছে তখন, দেখি, ছোট গেটের বাইরে থেকে উঁকি মারল কেউ । একটা বাচ্চাই তো । কালো বা আলোর অভাবের জন্যও মনে হতে পারে সেটা । যেন কোনও একজনকে খুঁজছে কেউ । `এই--' । নিজের গলা হঠাৎ করেই কি অচেনা লাগে দেখ । কেমন কাঁপে । ফিরে ফিরে আসে । যেন এক, দুই, তিন, চার । ফের ডেকে উঠলাম, এই-- । একবার, দু--বার, তিনবার ।
বাড়ি ফিরে সেজকাকাকে লিখলাম, কিছুই বুঝতে পারছি না বিশ্বাস কর । লিখলাম, ভাল লাগছে না কিছু, আর ফিরব না । পুবের ঘর বা জমির ভাগ নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে না কিছু । লিখলাম, সিন্দুক বিক্রি হয়ে গেছে, ঠিক আছে, ওর ভেতর খাতা ছিল একটা, আর পুঁটলি । রেখে দিও কিন্তু -- আর কিচ্ছু না, শুধু এই দুটো জিনিসই চাইলে পাই যেন । লাগবে ।
অবিনাশ বলল, ঝামেলা মিটে গেছে সব । বলল, শোনেননি ? কেউ বলেনি আপনাকে ?
অবিনাশ বলল, নির্মলবাবুই ব্যবস্থা করেছে সব । নিজেই খবর পাঠিয়েছে । সেই চন্দননগর । সেই বেশ্যাপট্টির যে মাসির আণ্ডারে ছিল লাবণ্য সেই মাসি নাকি বেঁচে এখনও । অবশ্য বড়জোর বছর চৌদ্দরই তো তফাৎ । লিপির বয়স এখন বার কি তেরো । চন্দননগর থেকে লাবণ্যর চলে আসার এটা বড়জোর চৌদ্দ বছরই । মাসি প্রথমে নাকি রাজি হয়নি একেবারেই । বলল, একবার যে বেরিয়ে গেছে--, তাছাড়া কাজেও তো লাগবে না কোনও । মাসির কথায়, পুরো অকেজো, খাওয়াবে কে ?
লাবণ্যও নাকি রাজি হতে চায়নি প্রথমে । সেই কদিন আগে মাসিই লোক পাঠিয়েছিল বলেছে, যা রোগ, এর চিকিত্সা এখানে মানে শ্যামপুরে হওয়ার কথা নয় । ওখানে নাকি বড় ডাক্তার আছে অনেক । ঐসব রোগেরই । গভর্মেন্টের লোক, আর নানান ব্যবস্থাও । অবিনাশ বলল, শেষ পর্যন্ত মাসি নিজে আসায় নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি লাবণ্য । কেঁদেছে । মাসির কাঁধে মাথা রেখে -- প্রায় মা-মেয়ের মতোই ।
-- আর লিপি ?
-- সে মাথা ব্যথা ওদের ।
লাবণ্যকে সেই মাসির হাতে গছানোর জন্য পাক্কা দশ হাজার ক্যাশ নাকি ঢালতে হয়েছে অবিনাশকে । আর লিপির জন্য কেউ কোনও দাবি করতে যাবে না লিখে দিতে হয়েছে । অবিনাশ নাকি লিখে দিয়েছে ।
পাঁচটা দিনের মতোই রাত যেমন নামে, নেমেছে । তুলি ফিরে এসেছে একসময় । গাড়িতেই । সম্ভবত ট্যাক্সি । একা তুলিই । কোনও লোকের গলা কানে আসেনি আর । এখন ইচ্ছে করলেই তুমি ছাদে গিয়ে বেড়াতে পার । ভাঙা কোনও রেলিংয়ে হাত রেখে দাঁড়াতেও পারো । সেই চিলেকোঠা আর তার জানালার কথা ভাবতে পারো । যত রাতই হোক, সেই জানালার ফাঁক দিয়ে নদীর ওপারের সেই ওঠানামা লক্ষ্য করতে পারো তুমি । লাবণ্য আর প্রশান্তর বিয়ে নিয়েই নাকি সন্দেহ আছে । তার মানে, লিপি আইনত এ বাড়ির কেউ নয় । স্রেফ লিপিকে দেখিয়েই নাকি মাসিকে রাজি করানো হয়েছে ।
আমার কথা মনে রেখেছে অবিনাশ । নির্মলবাবুকে নাকি বলেছে, আমার জন্য একটা ঘর অন্তত থাকছেই । তাছাড়া, সেই তান্ত্রিকের কথামতো লাবণ্যর মাথা থেকে একটামাত্র চুল নিয়ে আসার কথাও নাকি জানে নির্মলবাবু । ভদ্রলোক নাকি আমার উপর খুবই প্লিজড ।
সরস্বতী পুজোর আগের দিন বিপিন টেপ নিয়ে এল একটা । স্কুলেই । বলল, গান শোনাবে । সরস্বতী পুজোর ঝাড়পোছ চলছে । ছেলেরা যে যার ক্লাসঘরে । সারাটা স্কুল জুড়ে ধুলো উড়ছে । এত ধুলো জমল কি করে কে জানে ? ছেঁড়া কাগজ, সিগারেটের প্যাকেট, বিড়ি আধপোড়া, এছাড়া দেওয়ালময় পোস্টারও টেনে ছিঁড়তে যাচ্ছিল কেউ কেউ । বাধা দিতে হল । পার্টির সঙ্গে কোনওরকম কথা না বলে কাজটা করা ঠিক হবে না ।
স্বরূপবাবুই বললেন । তাছাড়া পোস্টারের সংখ্যা তো তেমন কিছু নয় ।
-- কার গান ?
সুধাময় জানতে চাইল ।
-- প্রসেনজিতের ।
-- প্রসেনজিতের মানে ?
-- জবার বর, মানে ওই যে বম্বেতে ।
সিনেমার গান নয় । হিন্দিও নয় । বাংলাই । তবে বম্বের কোনও এক কোম্পানিই বের করেছে । অবিকল কিশোর । বিপিন বলল, দারুণ চলছে । বলল, মাইকে কিশোরের গান মনে করে যা শুনছেন, তার মধ্যে অনেকগুলি ওরই ।
শব্দ কমিয়ে শুনলাম সবই । প্রথমদিকে গ্রাহ্য করছিল না কেউই । একটু হেসে ওঠার জন্য তৈরি হচ্ছিল যেন । `এক দিন পাখি উড়ে'-- গানটা শুনতে শুনতে অমিত ধর বলে উঠল, আমার মোস্ট ফেবারিট । বলল, মরার সময় ও নাকি এটাই শুনতে চাইবে । অমিত ধর বুঝতেই পারেনি কিছু । ভেবেছিল সত্যি কিশোর মানে কিশোরকুমারই ।
সুধাময় বলছিল, নকল গলা শেষ পর্যন্ত টেঁকে না ।
-- কিন্তু কিশোরও তো প্রথমদিকে সায়গলের গলা-- ।
বিপিন নাকি ওর দিদিকে ছেড়ে দিয়েছে । ওর মা এখন বেশ ভাল । জবা মানে ওর দিদি এখন নিজের সেই ভাড়া বাড়িতেই । কলকাতার দুই সঙ্গীত পরিচালক এর মধ্যেই খোঁজ নিয়ে গেছে । ওদের ইচ্ছে নাকি বিপিনের দিদি আর প্রসেনজিত-- দুজনের গান নিয়ে একটা অ্যালবাম বের করবে । ওদের মধ্যে একজন নাকি ফোনে প্রসেনজিতের সঙ্গে কথাও বলে নিয়েছে । প্রসেনজিত নাকি বলেছে, এ ব্যাপারে জবা যা বলবে তাই ।
সুধাংশু হাজরা এ বাড়িতে এসেছিল কদিন আগে । অবিনাশের কাছেই । অনিমেষ অবাক হল খুব, বলল, সত্যি জানেন না ?
অনিমেষ বলল, বাপ্টুর দোকান নিয়ে নাকি ঝামেলা আছে অনেক । কাগজপত্রের অনেক কিছু নাকি পরিষ্কার নয় । এখন অবিনাশ যদি নির্মলদাকে ধরে করে দিতে পারে কিছু । বাপ্টু নাকি ওরিয়েন্টালের ব্যাপার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে অনেকদিন । ওর বাবাও । ওরা নাকি আর টাকা ফিরে পাওয়ার আশাও করছে না । অনিমেষ বলল, হয়ত ওইসব ব্যাপারেও ক্ষুব্ধ হতে পারে কেউ । এমনকি বাপ্টু নিজেও না কি এমন একটা কথা কাকে যেন বলেছে । এক নির্মলদাই নাকি ঝামেলাটা মিটিয়ে দিতে পারে ।
অবিনাশের বাড়িটা ছাড়িনি এখনও । ভাবছি, ঘর ভাঙা শুরু হলেই চলে যাব । অবিনাশ বলছিল কাজ শুরু করার মাস তিনেকের মধ্যেই নাকি হয়ে যাবে । অর্থাৎ মাস তিনেক অন্য কোথাও কাটিয়ে আসতে পারলেই-- । ও নাকি আমার কথা ভোলেনি ।
তুলির সঙ্গে এখন আর তেমন কথাবার্তা হয় না । দেখাই হয় না । পাড়ার ক্লাবের সঙ্গে জুড়ে গেছি । বিকেলটা মাঠে কাটিয়ে দিই । খারাপ লাগে না কিন্তু । ভেবে দেখতে গেলে নগেনবাবুই ঠিক । একটা কিছুর মধ্যে নিজেকে গুঁজে দেওয়া । রাজনীতি হোক কি ক্লাব হোক । লাইব্রেরিও হতে পারে । নগেনবাবুর বলা কথাটা শুনে অনিমেষ জিজ্ঞেস করেছিল একদিন, ভদ্রলোক বিয়ে করেননি তো ? অনিমেষের কথায় রাজনীতি বা ক্লাবের সঙ্গে সংসারও জুড়ে দিতে পারো ।
দিনগুলিকে এখন আর আলাদা করে টের পাচ্ছি না । ক্লাবের ফুটবল টিমের হারা জেতা, জেতার চেষ্টা করা, এর কাছে যাওয়া, ওকে ধরে ম্যানেজ করা, দিনগুলি যেন অন্ধকার কোনও সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে পড়ছে । সেকেণ্ড, মিনিট, ঘন্টা । দিন আর মাস । বছরটাও গড়িয়ে যায় একদিন ।
তুলির যে নির্মলবাবুর সঙ্গে বিয়ে ঠিক হবে এটা আর কোনও নতুন খবর নয় আমার কাছে । নগেনবাবু বলল একদিন, নির্মলকে নাকি যেতেই হবে ওর কাছে । তুলির ব্যাপারটা নিয়ে নাকি কথা উঠেছে ।
যদিও উচিত নয় তবু তুলিকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, এটা কি ঠিক হল ?
বাপ্টুর ব্যাপারটা মিটে গেছে শেষ পর্যন্ত । পাড়ার ছেলেদের ধারণায়, তুলিই বলেছে নির্মলদাকে । তার মানে, তুলির জন্যই বেঁচে গেল বাপ্টু-- সুধাংশু হাজরার ছেলে । এটা অবশ্য স্রেফ ধারণাও হতে পারে । তবে টাউন হলের পাশে দোকানটা খুলেছে ফের । সেই আলো । দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখা আয়না, বাঁকুড়ার ঘোড়া আর মুখোশ । বড় রাস্তা থেকে দেখা যায় সব ।
এবারের রেজাল্ট কিন্তু আগের থেকে ভাল হল বেশ । দশটা ফার্স্ট ডিভিশন গেল । ফেল মাত্র পাঁচ । রেজাল্টের পরদিন ছুটি হয়ে গেল । অংকে তিনটে লেটার । সত্যদা একদম টিচার্স রুমের মধ্যেই প্রশংসা করে বসল । বলল, নতুন রুটিন নিয়ে অনেকেরই ক্ষোভ ছিল তখন, অনেকেই বলছিল, সমীরন মজুমদার ঠিক যোগ্য লোক নয় ।
বিপিন ফের অ্যাবসেন্ট । আসছে না বেশ কিছুদিন । সুধাময় ফুট কাটল, দেখ বোম্বে গেছে কিনা ।
রেজাল্টের পর স্টাফ কাউন্সিলের মিটিং--এ স্বরূপবাবু ফের সেই কাগজপত্রের কথা মনে করিয়ে দিলেন । ওর কথায়, কাগজপত্রগুলি সত্যিই লাগবে । সেই ফাইলটাই নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । বললেন, অনেকদিন আগে নোটিশ করা সত্ত্বেও বিপিনেরটা ছাড়া অন্য কারুরটাই জমা পড়েনি । ফাইল হারিয়ে যাওয়া নিয়ে অমিত ধর বা সুধাময় কথা তুলল খুব । সত্যদা মিটিয়ে দিলেন সব । ওর কথায়, সবার কাগজপত্র আর একবার জমা দিতে অসুবিধে হওয়ার তো কিছু নয় । ওর কথায়, জেরক্স এর পয়সা না হয় স্কুলই দেবে ।
প্রায় মাস দুয়েক পর ফের চিঠি এল একটা । আমার নামেই । তুলি নিজেই নিয়ে এল । বলল, এখনও লিখছে কেউ ?
হাসলাম । নীল কাগজের ইনল্যাণ্ড নয় এবার । সাদা খাম । হাতের লেখায় একটা মেয়েলি ধরণ । বললাম, কোথ্থেকে পাঠিয়েছে দেখ তো ? ও বুঝতে পারল না । বলল, স্ট্যাম্প মেরেছে এমন ।
মেয়েটা পাল্টে গেছে খুব । অনেকদিন পর ওকে সামনাসামনি দেখে বুঝলাম, পাল্টানোর পরিমাণটা আমার আন্দাজেরও বাইরে অনেক । বলল, বয়সটা কোনও ব্যাপার নয়, নির্মলদার মন আছে একটা । হৃদয়ও । ওর কথায়, আমার পক্ষে নাকি আর কোথাও যাওয়া সম্ভব নয় । আমাকে নাকি এখানেই থাকতে হবে । ও নিশ্চিত । বছরের পর বছর । বুড়ো হওয়া পর্যন্ত । এমনকি মৃত্যু পর্যন্তও নাকি আমি এখানেই থেকে যাব ।
-- কেন ? আমি কি যেতে পারি না ? ঘর কিন্তু সত্যিই খুঁজছি ।
-- ও আপনি যতই খুঁজুন । যাওয়া হবে না কোনওদিন । সারাটা জীবন আপনাকে এখানেই--, এই বাড়িতেই, আর দেখবেন, এটা ঠিক ভেঙেও পড়বে একদিন । শিওর । সব নিয়েই ।
-- কেন, বাড়ি তুলবে তো নতুন করে । নির্মলদা নাকি লোক ঠিক করেছে-- তুলে দিল লাবণ্যকে ।
তুলি বলল, ওর বাবা নাকি জানে না এখনও । পার্টিতে ঝামেলা হয়েছে খুব । নির্মলদাকে নাকি হাত গুটিয়ে থাকতে হবে । চেয়ারম্যান লক্ষ্য রাখছেন সব । নির্মলদাকে স্পষ্টই নাকি বলে দিয়েছেন ।
-- তার মানে সত্যি ভাঙবে না ? থেকে যাবে ?
ওর কথায় আমাকে ভুগতে হবে খুব । শুধু মলির জন্য নয় অবশ্য । লাবণ্যর জন্যও । ও বলল, নির্মলদার কাছে সব শুনে ও নাকি অবাক । বলল, আপনার মতো লোক ওইসব তন্ত্রমন্ত্রে বিশ্বাস করলেন ? একটা মাত্র ঘরের জন্য লাবণ্যকে ঠকালেন ? ওর মেয়েটাকে বিক্রি হতে দিলেন ? সব জেনেশুনে ? মেয়েটাকে ভালবাসতেন না আপনি ? ভালবাসা নেই আপনার মনে ?
চিঠিটা পালপুকুরের । দেশবন্ধু কলোনি থেকে সেজকাকির লেখা । লিখেছে, সুবল বিয়ে করেছে । হঠৎ করেই । লিখেছে, চিঠিতে যে হাতের লেখা দেখছিস ওটা সোনালীরই, মানে সুবলের বউয়ের । একবার এসে অন্তত আশীর্বাদ করে যা ।
ওই খাতা আর পুঁটলির কথা উল্লেখ করে লিখেছে, পুঁটলিতে নাকি কয়েকটা কড়ি আর তামার পয়সা ছিল । সেজকাকু নিজের চোখে নাকি দেখেছে । অনেক আগে অবশ্য । সোনালীর হাতের লেখায়, সিন্দুক বিক্রির সময় ওটা কোথায় যে থেকে গেছে কেউ মনে করতে পারছে না আর । খাতাটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল একেবারে । তখনকার কাগজ এতদিন প্রায় মুচমুচে । খুলতে গেলেই ভেঙে যাচ্ছিল । দরকারী জিনিস সেজকাকা নাকি টুকে রেখেছে । বংশতালিকা-- একেবারে সাত পুরুষ পর্যন্ত ।
উত্তর লিখতে গিয়ে জানতে চাইলাম, আর ? আর সব ? সেই অ--আ--ই--ঈ ? সেই হালকা নীলের রেখা । হলুদ কাগজের উপর সেই কাঁপা হাতের স্পর্শ ? সেই উত্তাপের অবশেষ ? মৃত লোকগুলির সেই নাম ? সংখ্যা ? সেই শবদেহগুলির ঠিকানা ? লিখলাম, অন্তত খাতাটা ? সোনালীকে আমি দেখিনি কোনওদিন । দেখা হবে কিনা জানি না, তবু, ওর জন্য আলাদা করে চারটে লাইন যোগ করলাম । লিখলাম, খাতাটাকে একটু ভাল করে খুঁজে দেখো, ছেঁড়া হোক বা মুচমুচে-- একেবারে গুঁড়ো হয়ে যাওয়া পৃষ্ঠাগুলোর অবশেষ হলেও চলবে ।
বিপিন বলেছিল, শহীদ বেদির সেই শোভন সান্যালের বাড়ি বাদ দিয়ে ডানদিকের তিন নম্বর ।
একজন দুজনকে জিজ্ঞেস করতেই শোভন সান্যালের বাড়ি পেয়ে গেলাম । বিপিনকে বললাম, লোকটাকে মনে রেখেছে এখনো এত লোক ?
যেন অন্য এক বিপিন । লুঙি পরা । খালি গা । শুয়ে ছিল বিছানায় ।
-- বললাম না, ভাল কবিতা লিখত । তাছাড়া সম্ভবত শহীদ বেদীর জন্যই । বছরে একবার করে অনুষ্ঠান হয় শোভন সান্যালের নামে । আঁকা প্রতিযোগিতা, বিতর্ক । এসব অবশ্য পাড়ার ক্লাবের জন্যই ।
আগের সাতটা দিন বিপিন ছিল না এখানে । অর্থাৎ হঠাৎ করে এসে ওকে পেয়ে যাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপারই বলতে হয় । গিয়েছিল যেন কোথায় ? বলতে গেলে আড়াইখানা ঘর । বছর পনেরোর একটি মেয়ে উঁকি দিয়ে ডাকল ওর দাদাকে ।
বিপিনের ঘরময় বই খাতা ছড়ানো, আলমারিতে তাক ভর্তি শুধু অংকের বই নয়, নানান গল্প আর কবিতার বই এমনকি উপন্যাসও । মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের `পুতুল নাচের ইতিকথা' ছাড়া সতীনাথ ভাদুড়ির `ঢোঁড়াই চরিত মানস', গৌরকিশোর ঘোষের `প্রেম নেই' ।
বিপিন বলল, বাড়িওয়ালা ঘর ছাড়তে বলছে অনেকদিন এমনকি ঘরও সারাতে দিচ্ছে না কিছুতেই । ছাদটা দেখালো বিপিন । বলল, দুর্ভোগের একশেষ । দেওয়াল জুড়ে ফাটল, প্লাস্টারের চিহ্ন নেই কোথাও ।
-- পড়তে আসবে না ছেলেরা ?
-- কাল থেকে । যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলাম ।
বিপিনের যেন বলার মতো কথা নেই কোনও । বোঝাই যায় । একসময় এত আগ্রহ ছিল আমাকে নিয়ে, কতবার অনুরোধ করেছে, একবার তো বলল, স্বরূপবাবু বললে না গিয়ে পারতেন ?
বললাম, তোমার প্রসেনজিতের গান শোনাও । দিদি আছেন ঘরে ?
বলল, আছে, শরীর খারাপ, বিছানায় শুয়ে ।
কাগজটা টেনে নিয়ে `অরণ্যদেব' পড়লাম । পড়া যদিও । `গোয়েন্দা রিপ' । খেলার পাতা । আমেরিকা সম্ভবত পাকিস্তানকে শেষ পর্যন্ত অস্ত্র দেবেই । লাদেন সম্ভবত ধরা পড়ছে না আর । গ্লোবালাইজেশনের ঢেউ একেবারে গ্রামে-গঞ্জে আছড়ে পড়ছে ।
বিপিনের মা এলেন । একটা প্লেটে কিছু মিষ্টি । রোগে ভুগছেন বোঝা যায় ।
চলে আসার সময় হঠাৎ করেই মনে হল, প্রসেনজিতের গান তো শোনা হল না । ক্যাসেটটা নিলে হয় না ? পরে শুনে নেব কোথাও ।
বাস স্ট্যাণ্ড অব্দি পৌঁছে দিল বিপিন । বলল, সব কথা সবাইকে বলার মতো নয় । স্কুলের কোনও লোক নাকি এই প্রথম ওর বাড়িতে পা দিল । বলল, কেন যে সবার সঙ্গে এত দূরত্ব ঠিক বুঝি না । ও বলল, বিশ্বাস করুন, আমাকে নিয়ে কেন যে এত সন্দেহ ? বেঁচে থাকতেই নাকি ওর আর ভাল লাগছে না ।
বিপিন কাল বোম্বে থেকে ফিরল । মাস দুয়েক নাকি প্রসেনজিতের কোনও খবর ছিল না । কোনও চিঠি বা টেলিগ্রামও না । স্কুলের কাউকে বলতে বারণ করল এসব । যাওয়ার আগে ছেলেটা নাকি ফোন নাম্বার দিয়েছিল একটা । পরে ফোন করে জানা গিয়েছিল, বাজে । ফলস ।
বিপিনের ইচ্ছে ছিল জায়গা কিনবে নিজেদের জন্য । দেখেও ছিল একটা কদমতলার দিকে । আর হবে না । বলল, আমাকেও আপনার মতোই থেকে যেতে হবে ।
প্রসেনজিতের সব ক্যাসেট নাকি নষ্ট করে দিয়েছে জবা । বাড়িতে যা ছিল সব । ওকে বাধা দেয়নি কেউই । বলল, সব মিথ্যে । দিদির জোগাড় করে দেওয়া সেই চিঠিতেই কাজ পেয়েছে প্রসেনজিত । ক্যাসেটের গান না কি সেই যোগাযোগেই । প্রসেনজিত নাকি বিপিনকে বলেছে, জীবনটা এই রকমই ।
-- কি রকম ?
-- কে জানে ? কোন এক সুস্মিতা ভার্মার সঙ্গে আছে ।
-- তার মানে সেদিন তুমি স্কুলে যা কিছু বললে সব মিথ্যে-- তুমি কি ইচ্ছে করেই-- নাকি না জেনে-- ?
আমাকে বাসে উঠিয়ে দিয়েও বিপিনের যেন ফিরতে ইচ্ছে করছিল না । যেন ভয় করছিল খুব । বাসের জানালায় চোখ রেখে অনেকক্ষণ সময় পর্যন্ত ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি । যেন আমার মতোই অপেক্ষা করছে । শোভন সান্যালের শহীদ বেদীর রেলিংয়ে হাত রেখে আমাকে যেমন করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় প্রত্যেকটা দিন, ঠিক তেমনি করেই । কি ভাবছে কে জানে, চণ্ডীতলার মোড়ে বাসটা বাঁক নেওয়ার সময় পর্যন্ত দেখি বিপিন তখনও ঠিক তেমনি করেই রাস্তার দিকে তাকিয়ে ।
-- কেন ?
-- নগেনবাবুই তো অল--ইন--অল এখন । জেলা কমিটিতে ঢুকছেন তো । শোনেন নি ?
আমাকে সত্যিই বলেনি কেউ । স্কুলে অবশ্য কদিন ধরে রাজনীতির আলাপ নেই । তবে সত্যদাকে দেখে টের পাই নগেনবাবুর অবস্থা ফিরে আসছে ফের । নির্মলদার দিন যে নেই আর, সেটাও বুঝতে কষ্ট করতে হচ্চে না । তুলির সঙ্গে নির্মলদার বিয়ের ব্যাপারটা অনেক হিসেব নিকেশই পাল্টে দিয়েছে একেবারে ।
-- লাইব্রেরির একটা বড়সড় গ্র্যান্টের কথা ভাবুন না একটু । ওকে বললেই হবে-- মিনিস্টারকে তো উনি নাম ধরে ডাকেন শুনলাম ।
অনিমেষ বলল, অনেকেই আসবে দেখবেন । সামনের ইলেকশনে পার্টি নাকি ওকে নমিনেশন দিয়ে বিধানসভায় নেবে, সেক্ষেত্রে ওর মন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনার কথাই নাকি ভাসছে হাওয়ায় ।
মাধ্যমিকের রেজাল্ট স্কুলের ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে নীলাদ্রি, স্টার মার্কসের চেয়ে দশ নম্বর কম । নীলাদ্রির পরের ছেলেটাকে প্রথম দিন চিনতেই পারেনি কেউ । কোনও এক প্রদীপ রায় । আর তিনটে নম্বর পেলেই নীলাদ্রিকে ছাড়িয়ে যেত । সুধাময় বলল, বাঁদিকের ফোর্থ বেঞ্চে নাকি বসত । স্কুলে প্রায় আসত না বললেই চলে । আমি অবশ্য মনে করতে পারলাম না কিছুতেই । বিপিন বলল, কিছু ছেলে থাকতেই পারে এমন ।
-- তাই বলে চিনতে পারব না ? স্কুলের অন্য পরীক্ষায় রেজাল্ট থাকবে না কোনও ? ফার্স্ট সেকেণ্ড না হলেও, অংকে বা ইংরেজিতে অন্তত ভাল নম্বর ।
-- হয়তো ভাল লাগত না স্কুলে বা আমরাই ব্যর্থ বলতে হবে ।
বিপিনের কথায় তাকালো সত্যদা । সুধাময় বা অমিতও ।
কে যেন বলল, টোকার সুযোগ পেয়েছে হয়ত খুব ।
সত্যদা বলল, বিপিন হয়ত আত্মসমালোচনা করছে কিন্তু আমরা সবাই কি খারাপ ? আমরা কেউ কি কিছুই বুঝি না ? স্কুলের কোনও পরীক্ষাতেই কোনও ভাল নম্বর থাকবে না ? আর ফাইনালে দুটো লেটার ।
সত্যদা তাকালো আমার দিকে । সমর্থন চাইল । যেন বলি কিছু । ছেলেটা অংকে পেয়েছে একানব্বই । নীলাদ্রির চেয়েও বেশি । অংকের টিচার হিসেবে ওকে আমার চেনা উচিত ছিল ।
বিরোধী দলের ডাকা বাস ট্রেন অবরোধের জন্য ইস্কুল ছুটি হয়ে গেল আজ । ছাব্বিশজন মাস্টারমশাইয়ের মধ্যে বেলা বারোটা পর্যন্ত মাত্র এগারোজন । দু--পিরিয়ডের বেশি স্কুল চালানো গেল না । চা এসেছে । সঙ্গে দুটো করে বিস্কুটও । রোদের তেজ বাড়ছে বেশ । আবহাওয়া নাকি ফের আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে আছে । কাগজে লিখেছে, আগের বছরগুলির সেই পাগলামো নাকি আর থাকছে না । প্রশান্ত মহাসাগরের উপর কোথায় যেন কোনও সমুদ্র স্রোত দিক পরিবর্তন করেছে । অন্য দিন হলে এটা নিয়ে ভূগোলের কানাইদাকে ধরা যেত । ওর দেওয়া উত্তর নিয়ে হাসি ঠাট্টায় কাটানো যেত কিছু সময় । আজ বিপিনের একটিমাত্র কথায় টিচার্সরুমের রঙটাই পাল্টে গেল যেন । দুটো বাজতে এখনো মিনিট খানেক । তার মানে দেওয়ালের ঘড়িতে এক্ষুণি সেই মিউজিক শুরু হবে । আর দুটো বাজার সংকেতও । বাইরের পুকুরে কারা যেন সাঁতার কাটছে । দাপাদাপি করছে খুব । অশ্বথ্থ গাছের ভাঙা ডাল থেকে ঝাঁপ দিল কেউ ।
সেই ছেলেটির কথা মনে পড়ল হঠাৎ । বিপিনের কথা টেনে বলেও ফেললাম । বললাম, হতেও পারে, একটা ছেলেকে দেখলাম, ওর ক্লাসেরও কেউ চিনতে পারছে না ।
-- কে ? কোন ছেলেটা ?
গত বছরের আগের বছরের রেজাল্ট বের হবার দিনের সেই মজার ঘটনাটার কথা তুললাম আমি । সেই ফেল করা ছেলের হাসিমুখে প্রণাম করার কথা । মার্কশিট খুলে লাল কালির দাগ চোখে পড়ার কথা ।
বললাম, নাম বলেছিল যেন কি একটা । দেখলাম, ফাইভ সি--র ছেলেরা কেউই চেনে না ।
সিনেমা হলের পাশের চায়ের দোকানের কথা বললাম ।
-- তিন চারদিন দেখলাম ওকে রাস্তায় । কাগজ কুড়োচ্ছে । কী বলে যে ডাকি ! ছেলেরা কেউ বললে পিন্টু । কেউ বাপি, আবার চায়ের দোকানের মালিক বলল, মুন্না ।
-- আমাদের স্কুলের ? আমাদের ছেলে কাগজ কুড়োচ্ছে ?
বিপিন বলল, রাস্তায় যখন নেমে পড়েছে, বলতে যাবেন না কিছু-- কি বলতে কি বলবে ?
বললাম, পাত্তাই দিল না একেবারে, এতটুকু ছেলে । সত্যি বলছি ।
ছাদে ওঠার সিঁড়ি এখন বেশ বিপজ্জনক । মাত্র একটা বছরের মধ্যেই কেমন পাল্টে যায় সব । লাবণ্যদের জানালাও নিশ্চিত আগের মতো নেই আর । হয়তো সেই ফ্রেম নষ্ট হয়ে গেছে । ঘুণপোকা কুরে কুরে শেষ করে দিয়েছে । হয়তো শুধু ইট-ই -- সঙ্গে শুড়কির গুঁড়ো । বট বা অশ্বথ্থের চারা । ইটের ফাঁক দিয়ে বের হতে থাকা শিকড় । বা একটা দুটো কাঠবেড়ালি, ব্যস । আর কিছু নয় । বড়জোর আলপটকা বাতাস । হু হু করা । দূরের নদী-- তাও শুধুমাত্র ঠিক জায়গায় দাঁড়ালেই ।
লাবণ্যকে হাসপাতালে ভর্তির কথা বলেছিল সেই মাসি । ওকে কি সত্যিই ভর্তি করেছিল ? ও কি বেঁচে এখনো ? হয়তো সত্যি হাসপাতালে । বেঁচে থাকলে অন্তত সেখানেই থাকার কথা ওর । সেই চন্দননগর বা অন্য কোথাও । হয়তো জানালায় পাশের কোন বেড । তারজালি দেওয়া ছোট আলমারি । প্লাস্টিকের গামলা । গামলায় জল, বমি আর পুঁজ । হয়তো বা রক্ত । আর মাছি । আর বাথরুম ভাসানো জল । জলের তীব্র ঘ্রাণ । লাবণ্য হয়তো অচেতন । হয়তো বা ঘুমই । স্বপ্নও হতে পারে । এমনকি নগেনবাবুও জানেন নির্ঘাত । হয়তো ভেবেছেন লাবণ্যর ভালোর জন্যই । ওর কথায়, স্রেফ ওদের অসহায়তার কথা ভেবেই ওর পেছনে দাঁড়ানো । ওদের পাড়ার লোকের কথায় । লাবণ্যর বাড়ি নগেনবাবুর যাওয়ার কথা অনিমেষের অন্তত জানা উচিত ছিল । হয়তো বা জানেও । সম্ভবত নগেনবাবুর সঙ্গে আমার সমপর্কের কথা ভেবেই বলেনি আর । কিন্তু লাবণ্যকে কি কেউ ভাল না বেসে থাকতে পারবে ? বিশেষ করে সেই নির্জনতায় । যখন ঘরে শুধু লাবণ্য । আর দেওয়াল জোড়া কিছু ধূসর ছবি, ছবির ফ্রেম । আর প্রাচীনতার ঘ্রাণ । যখন দূরের নদীর ছোট ছোট ঢেউয়ের মাথায় রোদ । আর ওপারের বাস বা ট্রেনের হর্ণ যখন কানে আসে । আর লিপি ? সেই শ্বেতপাথরের নারীমূর্তি । লাবণ্য কি ওকে আমার হাতে শুধুই দিয়ে যেতে চেয়েছিল ? শুধুই হাতবদল ? আমি কি সত্যই বিশ্বাসযোগ্য ? কীসের বিশ্বাস ? আমি কি লিপিকে--? ও কি জানত ? লাবণ্য কি কোনওদিন বলেছে লিপিকে ? ও কি এখন এক হাত থেকে আরেক হাত--? আমার চারপাশে পৃথিবী ত্রক্রমে স্থির হতে থাকে । ঘূর্ণনহীন, শব্দহীন । ভেঙে পড়ার আগে তুমুল এক স্তব্ধতা ।
অবিনাশ বলল, একটা লোক নাকি দেখা করতে আসবে, একটু যেন অপেক্ষা করি ।
বেশ কিছুদিন ধরেই পালপুকুরের কথা মনে পড়ছে । মাঝখানে স্বপ্নও দেখলাম একদিন । সেই শহীদ বেদীর । মাটি থেকে উঠে আসা সেই বেদী যেন উপরে উঠছে খুব । উঠে আসছে । ত্রক্রমে সরু হয়ে আসছে স্ট্রাকচার । সেই শীর্ষবিন্দু । তার মানে আমি তখন উপরে কোথাও । যেন আকাশ থেকেই দেখছি । পতাকা উড়ছে বেশ শব্দ করেই । অর্থাৎ বাতাস । কারা যেন স্যালুটের ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে । আমি তখন বাতাসের সেই শব্দ শুনি যেন । মাইকে গান বাজছিল কিছু । খুব চেনা সুর । খুব চেনা, অথচ মনেই পড়ছে না একদম । ভয়ংকর শব্দ হয়েছিল একটা । যেন আকাশ থেকে নামবে কেউ । কারা যেন ছুটতে শুরু করেছিল । ধুলো । অসংখ্য মাথা । আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা চোখ । আর পায়ের শব্দও । কে যেন, সমীরন কাকু বলে ডেকেও উঠেছিল । কোনও মেয়ে । হলুদ স্কার্ট । আর কি হাসির ব্যাপার দেখ-- মনে হয়েছিল, তবে কি আমিই, আমাকেই ? জেগে উঠেও বিশ্বাস হচ্ছিল না কিছুতেই, যেন সেই শোঁ শোঁ শব্দ শুনছি তখনও । যেন পতাকাই উড়ছে । বা লিফলেটের কাগজ । যেন সত্যিই সেই কাগজের গায়ে ছাপা আছে কোন ফটোগ্রাফ । যেন ছোটবেলার স্কুলের সেই নাগ স্যারের গলা পাচ্ছি তখনও, দেখে নাও -- দেখে নাও সবাই, মিলিয়ে নিতে হবে । আর জানালার পাল্লাটা তখন ধাক্কাও খেয়েছিল জোর । পরে দেখি, ফ্রেমের গোড়ায় রেখে দেওয়া ইটের টুকরোটা আর নেই । কখন পড়ে গেছে কে জানে ।
সকাল থেকেই পালপুকুর ঘুরে আসার কথা ভাবছিলাম । সুবলের বউকে দেখে আসি একবার, পারলে লক্ষীর শ্বশুরবাড়িও । ও নির্ঘাত অবাক হবে খুব । ওর বরও । হয়তো বলবে, আপনার কথা এত শুনেছি ! সেজকাকি হয়তো কাঁদবে খুব । সেজকাকুও । `তুই একেবারে ভুলে গেলি ? একেবারে ?' লক্ষ্মী হয়তো বলবে, কেন এলে ? অভিমান করেই । হয়তো কথাই বলতে চাইবে না প্রথমে ।
অবিনাশের বলে রাখা সেই লোক এল একসময়, নাম বলল পরিমল ঘোষ । বলল, অনেক টাকা ঢুকে গেছে সমীরনবাবু । ও না বললে লাবণ্যর ব্যাপারেও অনেক কিছু জানা যেত না । বলল, লাবণ্য চলে গিয়ে নাকি নগেনবাবুর উপকারই সবচেয়ে বেশি হয়েছে । ওর কথায়, নগেনবাবু হয়তো লাবণ্যকে একা দেখে অসহায়ই ভেবে থাকবেন । অথচ রাজনীতির দিক থেকে এতে নাকি নগেনবাবু শেষ হয়ে যেতেন আরেকটু হলে । যতই যাই হোক, পার্টির ওজনদার কোনও নেতা যদি কোনও খারাপ মেয়েছেলের ঘরে দিনের পর দিন যায়-- । বলল, হয়তো নগেনবাবু বুঝতে পারছেন এখন । লাবণ্য চলে যাওয়ার পর আর নাকি ভদ্রলোক এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি কোনও ।
-- তাতে আমি কি করতে পারি ?
-- নগেনবাবুকে বলে একটু বুঝিয়ে বলুন ।
-- কী ?
-- ওরা যেন কাজটা অন্তত করতে দেন । এ বাড়ির । মানে অনেক টাকা-- অবিনাশবাবুর কথায় শুধু চন্দননগরের সেই মাসিকেই হাজার দশেক দিতে হল-- ওই রোগ নিয়ে ওই বয়সের একটা মেয়েছেলেকে কে নেবে বলুন ?
-- আমার কথাই বা শুনবেন কেন উনি ? শুনলে বরং নির্মলদা, অবিনাশ-- ওদের পার্টির লোক ।
পরিমল ঘোষের সঙ্গে নির্মলদার সম্পর্কে আমার অবশ্য না বোঝার কথা নয় । শ্যামপুর হাউজিং কোম্পানি তৈরির পেছনের আসল লোকটা যে নির্মলদাই সেটা এখানকার লোকদের জানা । আর লাবণ্যর পাশে সে সময় নগেনবাবুর দাঁড়ানোর মূল কারণ হয়তো ওদের দুজনের মধ্যেকার গ্রুপিংই ।
পরিমল ঘোষ বলল, আপনিও ঘর পাবেন একটা, আপনারও তো লাগবে-- বিয়ে করবেন না আপনি ? আর বিয়ে না করলেও মেয়েছেলে লাগে না আপনার ?
লোকটার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না কোনও । তবু, অন্তত একটা কথা জানতে ইচ্ছে করে খুব । আর বলেও ফেলি । জানতে চাই, লাবণ্যর ব্যাপারে নগেনবাবু জিজ্ঞেস করেননি কিছু ? মানে আপনাকে বা নির্মলদা কি অবিনাশকে ? জানতে চাননি কোথায় গেল লাবণ্য বা ওর মেয়ে ?
এসব কথা নগেনবাবু নাকি পার্টি অফিসেই শুনেছেন । এম. এল. এ. বিজনবাবুই নাকি তুলেছিলেন কথাটা । উনি অবশ্য নির্মলদার কাছেই জানতে চেয়েছিলেন । নগেনবাবু এমনকি নির্মলদার জবাব শুনতেও নাকি আগ্রহ দেখাননি কোনও ।
জানতে চাইলাম, কবে থেকে বাড়ি ভাঙার কাজ শুরু করতে চান ?
-- বর্ষাটা কমলেই । এই ধরুন নভেম্বর ।
খবরের কাগজের ছেলেটার গলা শুনতে পাচ্ছি । নীচ থেকে ডাকছে । `মাস্টারমশাই' । নিয়ম করেই । ওই একবারের জন্যই । অর্থাৎ কাগজটা রেখে গেল । একতলার সিঁড়ির পাশে । অর্থাৎ এবার আমার নামার ব্যাপার । যেন ঘুম থেকে উঠে দরজাটা খুলব । নীচে নেমে কাগজটা তুলে নেব মাটি থেকে । নিয়মমাফিক দুর্নীতি আর পার্টি সম্মেলন নিয়ে ওদের নিজেদের মধ্যে মারপিটের কথা তুলব, আর উত্তর না পেলেই অবাক হব খুব । বলব, এত ডিসিপ্লিনড দল তোমাদের, তবু-- । বলব, ইলেকশনের একটা মাত্র দিনের জন্য এত গুণ্ডা মাস্তান-- ।
কথা দিতে হল । পরিমল ঘোষ বলল, ওর তুলি--বৌদিও নাকি আসতে চেয়েছিল । তুলি নাকি বলেছে, ওর নাম করে বললেই আমি নাকি না করতে পারবো না । পরিমল ঘোষের কথা শুনে হাসলাম । যেন সত্যিই, শুধু তুলির কথাতেই ।
লোকটাকে সামনের রোববার আসতে বললাম ।
দিনগুলি ফিরে এসেছে আবার । সেই ভিড় । বারান্দার বাইরে অপেক্ষায় থাকা মানুষজন এমনকি পিসির হাসিও । নগেনবাবুর ভরাট গলার আওয়াজ টের পাওয়া গেল রাস্তা থেকেই । আমাকে দেখে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কেউ যেন ফিসফিস করে বলল কিছু । আঙুল তুলে দেখাল যেন কেউ । জানি, তবু দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলির কাছে নগেনবাবু আছেন কিনা জানতে চাই । ওরা হাঁ হাঁ করে ওঠে । জায়গা করে দেয় ।
পিসিকে বললাম, এত ভিড় ? পিসি হাসল । বলল, যা ঝামেলা-- । পিসির উচ্চারণৈ কিছু তৃপ্তি লুকিয়ে থাকে ঠিক । বললাম, ইলেকশানে দাঁড়াচ্ছেন নাকি এবার-- এম. এল. এ ?
-- কী জানি ? জিজ্ঞেস কর ওকে ।
-- তার মানে তো তুমি এম. এল. এ.-র পিসি-- গাড়ি, লাল আলো ।
-- আমার আর কি-- শেষ বয়সে তোমাদের ভাল কিছু দেখলেই খুশি ।
নগেনবাবু নিজেই এলেন একসময়, ওরা তখনও ঘরে বসে । কিসের আলোচনা কে জানে ?
বললাম, ইলেকশন তো এখনো অন্তত ছ'মাস ।
-- তাতে কি ? ইলেকশন ছাড়াও কি ঝামেলার কম আছে কিছু ?
সেই বিজন মজুমদার নাকি ঘোঁট পাকাচ্ছে খুব । এখনকার এম. এল. এ ।
-- এ সব নিয়ে অবশ্য তোমাকে ভাবতে হবে না । স্কুলে কেউ জিজ্ঞেস করলেও মুখ খুলবে না । কোনও ঝামেলা নেই তো আর ?
নগেনবাবু রসিকতাও করলেন পিসির সঙ্গে । পিসিরও সে কি হাসি । আর সত্যিই যেন খুশি খুব । যেন এসব নিয়ে একপ্রস্থ আলোচনা আগেই সারা । নগেনবাবু কোথায় নাকি কোন মেয়ে দেখে রেখেছেন । আমার নাকি বুঝতে হবে না কিছু । শুধু পিসিকে নিয়ে একবার দেখে আসবেন নিজে । ব্যস ।
পরিমল ঘোষের কথা পাড়তেই ভদ্রলোক ছিটকে উঠলেন একেবারে ।
-- তোমাকে ধরেছে এবারে ।
-- এবারকার মতো মিটিয়ে নিন-- নির্মলদা তো বসেই গেছেন প্রায়-- সেই ভদ্রলোকের নাকি অনেক লস-- আর অবিনাশেরও-- বাড়িটা কিন্তু সত্যিই ভেঙে পড়বে একদিন ।
-- তোমাকে কি তুলিকে দিয়ে বলিয়েছে ?
-- না--না ।
রান্নাঘরের দরজা ফাঁক করে ভেতরে বসে থাকা ভদ্রলোকদের `আসছি একটু' বলে, ফের তাকালেন আমার দিকে । খেয়ে এসেছি কিনা, জানতে চাইলেন ।
-- অবিনাশই বলল, তাছাড়া ভাঙছে সত্যিই-- আমিই ভরসা পাচ্ছি না আর । লাবণ্যও তো চলে গেছে ।
শেষের কথাটা যেন ওর জন্যই বলা । হ্যাঁ, যেন শুধুমাত্র ওর প্রতিক্রিয়া দেখার ইচ্ছেতেই মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে আমার ।
নগেনবাবুর যেন কানেই যায়নি কথাটা । বা গিয়ে থাকলেও তা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয় এভাবেই জানতে চাইলেন, ওদের ঘর কি তালাচাবি দেওয়া ? বন্ধ একেবারে ? বললেন, পরিমলবাবুকে বল তোমার নামে অন্তত দুটো ঘর লিখে দিক ।
-- দেবে তো বলেছে ।
-- কথা নয় । লিখে দিক । দেখছি ।
ফিরে আসার সময় সেই কালো দাগগুলির কথা মনে পড়ল । লক্ষ্য করলাম না তো ? আছে আর ? হয়তো ডাক্তার দেখিয়েছেন কোনও । ডাক্তার হয়তো ধরেছে ঠিকঠাক । হয়তো বলবে এই বয়সে যেখানে সেখানে-- । কিন্তু সত্যিই কি ? নাও তো হতে পারে । হয়তো এমনিই । অন্য কোনও কারণ । হয়তো সত্যিই মারধরের দাগ । সেই ওরিয়েন্টালের ধস্তাধস্তিই । নিজেদের মধ্যেকার দলাদলি ।
রাতে, লাইব্রেরি হয়ে ফিরছি, শুনি আওয়াজ হচ্ছে ফের । সেই ভট্--ভট্--ভট্ ভট্ ভট্ । বাপ্টু হাজরাই । লাম্পপোস্টের একশ পাওয়ারের আলোয় একটা শরীর ছিটকে বেরিয়ে গেল । অনিমেষ শুধু বলল, পুরো ড্রাঙ্ক-- একেবারে বেহেড ।
-- গাড়ি চালাচ্ছে যে ।
-- ওরা পারে, অভ্যাস-- হয়তো স্বাভাবিক অবস্থায় এত ভাল চালাতেও পারবে না ।
বাপ্টুর ব্যবসা নাকি ভালই চলছে । ট্রাকে করে মাল আসছে । গোডাউন নিয়েছে একটা । অনিমেষ বলল সেন্ট পারসেন্ট লাভ । বলল মহারাষ্ট্রের গণেশের মূর্তিতে একেবারে ডবল দাম নিচ্ছে । গণেশ নাকি দারুণ চলছে এখন ।
-- আর ওই যে কার সঙ্গে মিশত-- স্কটিশের কোন মেয়ে ?
সাইকেলের প্যাডেলে পা রেখে হেসে উঠল অনিমেষ ।
-- এদের আবার প্রেম । দেখুন গিয়ে কোথায় কী জুটিয়েছে ।
স্কটিশের মেয়েটা নাকি নেই আর । মানে বাপ্টুর সঙ্গে নেই ।
অনেকদূর পর্যন্ত বাপ্টু হাজরার বাইকের সেই শব্দটা আমার সঙ্গে থেকে যেতে থাকে । খেয়াঘাটের সেই সতীদাহ ফলকের পাশে দাঁড়িয়েও টের পাই ভট্--ভট্--ভট্--ভট্ । যেন সত্যিই আসছে কেউ । কোথাও ভয়ংকর এক তীব্রতা । এলোমেলো হাওয়া । আকাশটা একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার, তবু । শ্বেতপাথরের মেয়েটি এখন একা, বারো মন্দিরের ঘাট এখন নির্জন বেশ । একটু দূরে সিমেন্টের ষাঁড় । দুপাশে ছ'টা করে মন্দির । মন্দিরে পাথরের লিঙ্গ একটা করে । কালো । একেবারে অন্ধকারের মতোই । যেন দেখতে পাবে না কেউ । সোডিয়াম বাষ্পের হলুদ আলোয় বালিকা বড় জীবন্ত । রক্তমাংসের । যেন আঙুল ঠেকানো মাত্রই বসে যাবে । যেন নরম আর তুলতুলে সেই শরীরে রক্তপাত ঘটবে ঠিক । ঢেউয়ের মাথায় আলোর চমকে ওঠার মতো করেই নগ্ন সেই পা জড়িয়ে উঠতে থাকা লতা আর ফুল যেন অবাক । এই থেমে থাকা যেন মুহূর্তের জন্যই । যেন এক্ষুণি শব্দ হবে ঠিক । বাতাস ধাক্কা দেবে । যেন গাল টিপে দিলেই মেয়েটি হেসে উঠবে বা কুঁকড়ে যাবে লজ্জায় । উন্মুক্ত সেই শরীর নিয়ে কি যে সে করবে যেন ঠিকই করে উঠতে পারবে না ।
মেয়েটির পায়ের পাতায় ঠোঁট ছুঁইয়ে চুমু খেতে যাব, ঠিক এমনি একটা সময়ে ভোঁ পড়ল । দূরেই । যেন অনেক দূরেই কোথাও । গুব-গুব করা একটা শব্দ একবার ভেসে উঠেও ডুবে যায় ফের । হয়তো গাদাবোট-- ওপার ঘেঁষেই চলতে থাকা । হয়তো ওপারের ফ্যাক্টরির লাইটে একটু পরেই ধরা পড়বে ঠিক । কে যেন বলে উঠল, লাস্ট ট্রাই, লাস্ট ট্রাই । একেবারে পালপুকুরের সেই মেলার মতো । যেন একটা করে রিং ঠিক জায়গায় ছুঁড়ে মারার এটাই শেষ সুযোগ । সাদা কাপড় পেতে রাখা চৌকির ওপর চিরুনি, আয়না, সাবান, সিনেমার মেয়েদের প্যাকেট ভরা ছবি ।
কাল সকালেই পালপুকুর যাবো বলে ঠিক করি ।
ক্লাস ফোর--এর ফাইনাল পরীক্ষাকে তখন বলা হত বৃত্তি । বৃত্তি পরীক্ষা । সেই প্রথম নিজের স্কুলের বাইরে বড় স্কুলে যাওয়া । পরীক্ষার দিন সেজকাকি নিশ্চয়ই তাড়াতাড়ি রান্না চাপিয়েছিল । মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আমি নিশ্চয়ই হাত বাড়িয়েছিলাম । সেই অল্পবয়সী মেয়েটির পায়ে-- ছবিতে হাত দিয়ে আমি নিশ্চয়ই মনে মনে বলেছিলাম কিছু ।
বাবার আমাকে নিয়ে গর্ব ছিল খুব । লোকটা যেন জানতই ওর ছেলে খারাপ রেজাল্ট করার নয় । বৃত্তি পরীক্ষার সময় বাবা অবশ্য নেই । সবাই তখন আশা করছে । ভাবছে, যাবে কোথায় লোকটা ।
সেই ব্লাকবোর্ড, সেই বেঞ্চ, সেই চেয়ার আর পাখার ব্লেডের কথা মনে পড়ে । আর পাখার ব্লেডের সেই শব্দও । এখনও । কান পাতলেই যেন শুনতে পাব । সেজকাকার হাত ধরে পরীক্ষা দিতে যাওয়া, ওর সাইকেলে রডের উপর বসে দূর থেকে দেখতে পাওয়া স্কুল আর স্কুলের সামনেকার সেই জমে থাকা ভিড়ের কথাও মনে পড়ে আমার । গেট তখনও অবশ্য বন্ধ । দূরের বারান্দা তখনও ফাঁকা । বারান্দা, বারান্দার পিলার, আর দোতলায় ঝুলিয়ে রাখা পেতলের ঘন্টার ধারেকাছেও তখন কেউ নেই । সেজকাকা বলেছিল এখানেই আসতে হবে কিন্তু পরে । নাগস্যারকে সেদিন দেখতে পেয়েছিলাম কিনা মনে নেই, তবে দোতলার বারান্দা থেকে দেখা পরিষ্কার এক আকাশের কথা মনে পড়ে ।
বেশির ভাগ ছেলের মতোই আমি ফার্স্ট ডিভিশনেই পাশ করেছি সেবার । রেজাল্ট জেনে বাড়ি ফিরে দাদুর পায়ে হাত দিতেই দাদু অবাক । কি হয়েছে ? সেজকাকু জানিয়েছিল, পাশ করেছে সমু-- ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে পরীক্ষায় ।
দাদু তখন পুরোপুরি শোয়া । আমার হাতটা চোখের সামনে টেনে নিয়ে সে কি কান্না । কেন কাঁদল দাদু ? কান্না মানে চোখের জলই শুধু । শব্দ নয় কোনও । বা শুধু জলও নয় । জল আর পিচুটির সেই গড়িয়ে পড়া । সিন্দুকের সেই পুঁটলি বের করে দিতে বলল সেজকাকুকে । সেই পুঁটলি হাতে নিয়ে দাদু অবশ্য কি যে করবে ঠিকই করে উঠতে পারছিল না । কিভাবে যে খুলবে বুঝেই উঠতে পারছিল না । সিন্দুকের মধ্যেকার খাতা সেই প্রথম চোখে পড়ে আমার । লাল রঙের শক্ত কাগজে বাঁধাই । ভিতরের কাগজ তখনই হলুদ আর মুচমুচে । কেমন ফ্যাকাশে নীল রঙের লাইন । পরপর, আর সমান্তরালও ।
শেষ দিকের একটা পাতায় পুরো লাইন জুড়ে গোটা অক্ষরে `অ আ ই ঈ--' লেখা দেখিয়ে সেজকাকু জানতে চেয়েছিল, এটা কার বলতে পারবি ?
ঠিক সেজকাকুর মতো করেই সোনালীকে বললাম, এখানে কাঁঠাল গাছ ছিল একটা । ওখানে কি ছিল বলতে পারবে ? পারবে না তো ? কুলগাছ । কুলগাছ ছিল একটা, এতবড়-- নারকেল কুল । লম্বা । একবার কারা যেন কুলগাছটাতে স্বর্ণলতা ছড়িয়ে দিল, হলুদ-- প্রায় সোনার মতোই ঝকঝকে সেই স্বর্ণলতা গাছের কথাও বললাম সোনালীকে । কুয়োপাড়ে সেজকাকির সেই বাসন মাজা-- আর ছড়িয়ে থাকা ছাইরঙা ছাতার পাখিদের কথাও ।
পুবের ঘরটা এখন সোনালী আর সুবলের । কাপড় ছাপার কাজটা অনেকদিন আগেই উঠে গেছে । সেই টিনের ছাউনি, বাঁশের বেড়া আর নেই । বাঁশের বেড়ার গায়ে লটকে থাকা সেই অল্পবয়সী মেয়েটির মুখের কথা মনে পড়ল ফের । আমার মা । সম্ভবত সোনালীর এখনকার বয়েসেরই হবে ।
ঘরটাতে চমত্কার গন্ধ দিয়েছ একটা । সম্ভবত নতুন হওয়ার জন্যই । চুনকাম করা দেওয়াল । মেঝে আর ছাদ দরজা আর জানালার সংখ্যা বা ডিজাইনের জন্যই সম্ভবত ঘরের মধ্যে আলোও খেলছিল বেশ । বা ড্রেসিং আয়নায় ধাক্কা খাওয়া আলোর জন্যও তেমন মনে হতে পারে অবশ্য । ওকে বললাম, তোমাদের ছবি নেই কেন ?
-- কিসের ?
-- মানে তোমার আর সুবলের ।
মেয়েটি লজ্জা পেল খুব । চুপ করেই থাকল কয়েক মুহূর্ত ।
সন্ধের পর চলে যাব । যাওয়ার আগে খোকাদার মায়ের সঙ্গে দেখা হলে ভাল লাগত । শহীদ তুষার চক্রবর্তী । বেঁচে থাকলে অন্তত কমিশনার হতেন নিশ্চয়ই । হ্যাঁ অনুমানই । লোকটা নাকি আমাকে ভালবাসত খুব । সেজকাকির কথায়, কম্পাউনডারির কাজ থেকে ফিরে খালি গায়ে বাইরে থেকে `সমু' বলে হাঁক মারতো । তখন ওই ডাক বোঝার মতো নই হয়ত, তবু-- । সেজকাকির কথায়, মায়ের কোল থেকে ওই একটা লোকের কোলে যাওয়ার জন্য আমি নাকি হাত বাড়াতাম । আমি নাকি ওই ডাকের জন্যই অপেক্ষা করতাম ।
সেজকাকুকে বললাম, আমি তো সবই ছেড়ে দিয়েছি-- সব, এই বাড়িঘর, কুয়োপাড়, বাথরুম, পায়খানা, এমনকি সিন্দুকটাও । সিন্দুকটাও তোমরা বিক্রি করে দিয়েছ ।
পাশের ঘরে টিভি চলছে । ওখানে সেজকাকি আর সোনালী । সোনালী কি কাজে যেন পুবের ঘর থেকে এখানে এসেছে । ওদের চুপ করে বসে থাকা টের পাই আমি । টিভি-র শব্দ হচ্ছে শুধু । কোনও সিরিয়াল । হিন্দির ।
বললাম, যখন যা চেয়েছ দিয়েছি । মাসে দু হাজার করে টাকা-- হ্যাঁ, হিসেব করে দেখ চার পাঁচ বছরে-- হিসেব কর, তোমার দেওয়া দশ হাজার-- ।
গলা চড়ছিল টের পাচ্ছিলাম । তবু, লোকটাকে এত ধূর্ত মনে হচ্ছিল তখন, এত ধান্দাবাজ ।
-- তোমরা দিনের পর দিন ঠকিয়েছো আমাকে-- আমার সরলতার সুযোগ নিয়েছ-- বারবার লিখে পাঠিয়েছি-- সিন্দুকটা-- অন্তত সিন্দুকটা রেখে দাও তোমরা-- নাহলে স্রেফ খাতাটাই-- আর সেই পুঁটলি-- কিছুই না-- একটা চিহ্ন-- চিহ্নমাত্রই ।
সোনালী বলছিল ওর বাবার বুকে নাকি যন্ত্রণা হয় খুব । মানে শ্বশুরমশায়ের । সেজকাকার । হাসপাতালে দেখিয়েছে ওরা । ডাক্তার, নার্স । এমনকি লোকটা নাকি হাসপাতালে থেকেছেও কদিন । মাঝেমধ্যেই শ্বাসকষ্ট হয় খুব । সেজকাকির জেদাজেদিতেই নাকি বাড়ি নিয়ে আসা । ওর ধারণায়, হাসপাতাল থেকে নাকি ফিরে আসে না কেউ ।
চৌকির উপর বসে থাকা লোকটার যেন সত্যিই কষ্ট হচ্ছে এখন । যেন আমার আর এসব নিয়ে কিছু বলা উচিত নয় । যেন এক্ষুনি থেমেই যাওয়া উচিত । লোকটা হাঁফাচ্ছে খুব-- আমার সেজকাকু । বলতে ইচ্ছে করে, এই ঘর, এই দেওয়াল, মেঝে, বাথরুম সর্বত্র-- সুখের সবকটা আয়োজনের পিছনে আমার পরিশ্রম-- আমি-- হ্যাঁ, আমিই ।
শেষ পর্যন্ত ওরা ডাকেনি কেউ । এমনকি সেজকাকিও নয় । সোনালী আর সুবল তখন ঘরে, হয়তো দরজার আড়ালেই । আকাশে তখন অল্প মেঘ । চাঁদের আলো পড়ে চারপাশটা একেবারে ঝকঝক করছে তখন । চারপাশের বাড়িঘর, দেওয়াল, ছাদের অ্যান্টেনা ।
চলে আসার সময় পেছন ফিরে তাকাইনি একবারও । শুধু রাস্তায় পা দিয়ে বললাম, যাই ।
সেজকাকু বলল, এই খাতা, এই সিন্দুক আর বাড়ি নিয়ে নাকি অযথা সেন্টিমেন্টে ভুগছি । বলল, ওর মনে দ্বিধা ছিল খুব । তবু, আমাকে রাগারাগি করতে দেখে ওর নাকি মনে হয়েছে সত্যি কথাটা বলে দেওয়াটাই ভাল । ওর নাকি মনে হয়েছে মৃত্যুর আগে আমার সঙ্গে আর নাও দেখা হতে পারে ।
আমার মা-- মানে ছেলেবেলায় দেখা ছবির সেই ছোট বউটি নাকি কলেরায় মারা যায়নি-- । ছবির অল্পবয়সের সেই মেয়েটি নাকি আত্মহত্যা করেছিল । টিক-টোয়েন্টি খেয়েছিল-- কীটনাশক । বিষ । সেজকাকু বলল, একরাত্রে বমি পায়খানায় মরে না কেউ-- অন্তত কলেরা হলে একটু অন্যরকম-- তাছাড়া, মা নাকি সেজকাকুর হাত ধরে বলেছিল, ওর নাকি আর কিছু করার ছিল না । সেজকাকু বলল, এসবের জন্য বাবার এক বন্ধুই-- ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুই নাকি দায়ী । অন্তত ওর ধারণায় । সেজকাকুর কথায়, আমার জন্ম নিয়ে নাকি সন্দেহ ছিল সবার । বাবা হয়ত এই একটি মাত্র কারণেই-- । এই পরিবারের সঙ্গে আমার নাকি রক্ত সম্পর্কই নেই কোনও ।
আমি তবু স্বাভাবিক থাকতে পেরেছিলাম । বাবার সেই বন্ধুর নাম শোনার জন্য কণামাত্র আগ্রহ হয়নি । চেয়ারে বসে সেজকাকুর মশারির গায়ে হাঁটতে থাকা মশাগুলিকে লক্ষ্য করছিলাম । রক্ত খেয়ে ওদের মধ্যে একটা তখন লাল টুকটুকে । হাঁটতেই পারছিল না একেবারে ।
চেয়ারটা ওর কথামতো মশারির খুব কাছে না নিয়ে গেলে অবশ্য সেজকাকুর বলা কথাগুলি তখন শুনতে পাওয়ার মতো নয় । একেবারে ফিসফিস করা ।
আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাহলে-- আমি তবে-- ।
এসব কথার আর কোনও উত্তর ছিল না ।
পৃথিবী এরপরও ঘুরতে থাকে । সূর্য মহাকাশে অবস্থান পাল্টায় । ছায়াপথের দূর--প্রান্তের এক অত্যন্ত সাধারণ নক্ষত্র পরিবারের অন্তর্গত এই গ্রহটিকে আকাশ থেকে তবু নীলই দেখায় । হয়তো বা শুধুমাত্র সমুদ্রের জলের জন্যই । আবার আকাশের জন্যও হতে পারে । অনেক তথ্যই একসময় ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হবে । আকাশের রঙ তবুও হয়তো নীলই থেকে যাবে । সভ্যতার পর্যটনে কোনও এক ভ্রান্তি থেকে হয়তো নতুন কোনও ভ্রান্তির দিকেই আমাদের ছুটতে হবে । আমাকেও ।
তুলির বাচ্চা হবে-- অবিনাশ বলল, সামনের মাস থেকে তুলি নাকি এখানেই । হাসপাতালের কার্ড করাতে হবে । নবীন দত্ত হাসপাতালে তুলিকে নিয়ে নাকি যেতে হবে একদিন ।
বিপিন বলল, ওর দিদি নাকি গান বাজনা শুরু করছে ফের । কোন কোম্পানিতে নাকি ক্যাসেট করাচ্ছে । বাড়ি যেতে বলল একদিন । গানগুলি শুনিয়ে নাকি মতামত নেবে । ওর দিদি নাকি খুব করে বলেছে ।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেদিন দেখি গোঁফের এখানে ওখানে দুয়েক জায়গায় সাদা । চুল আর দাড়ি মিলিয়ে আয়নার লোকটার দিকে তাকিয়ে অবাক লাগছিল খুব । লাবণ্য কি বেঁচে এখনও ? আর লিপি ? ওর বয়স এখন তের কি চৌদ্দ । কী করতাম আমি ওকে নিয়ে ? ও যদি থাকত, আমি কি ভালবাসতে পারতাম ? পারা যায় ?
নগেনবাবুর কাছে সেদিন ফের চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার কথা তুললাম । মা বাবা আর আমাকে নিয়ে সেজকাকুর কথাগুলি ওকে বলা হয়নি আর । বলার কথা অবশ্য ভাবিইনি কোনওদিন । নগেনবাবুর কথায়, প্রত্যেকের জীবনই কিছু না কিছু মিথ্যে দিয়েই তৈরি । সার্টিফিকেট আর মার্কশিটের কথা আমাকে ভুলে যেতে বললেন পুরোপুরি । সত্য আর মিথ্যের সীমানার একটা জায়গা নাকি অন্তত সুক্ষ্মই । বাবার কথা তুলে একদিন শুধু বলেছিলাম, উনি কি একেবারে আমার মতোই, মানে আমি কি-- ? ওর কথায়, এসব মিল খোঁজার চেষ্টা অর্থহীন, খুঁজলে নাকি যে কারুর সঙ্গেই এমনকি ওর সঙ্গেও আমার কিছু মিল পাওয়া যেতে পারে ।
বাড়িটা ভাঙা হয়নি আর । নতুন করে কথাবার্তাই হয়নি কোনও । লাবণ্যর চিলেকোঠার জানালাটা সেদিন তুমুল শব্দ করে নীচে পড়ল । পরে মনে হল ওটা তো জানালা নয়, শুধু ফ্রেমই । এরপর তাহলে বাকি রইল কিছু স্মৃতি । জলের । আর চিকচিক করতে থাকা ঢেউয়েরও । বা ওপার থেকে এপারে উড়ে আসতে থাকা ক্লান্ত কাক আর ট্রেনের হর্ণ আর সেই গাদাবোটের শব্দও । গুব--গুব আওয়াজের সেই গোপনীয়তা ।
সেই ছেলেটিকে শেষ পর্যন্ত সত্যিসত্যিই পেয়ে গেলাম একদিন । ওর নাম নাকি পিন্টু । তবে বাপী বা মুন্না নামেও কাজ নিয়েছে দু-এক জায়গায় । ওকে বললাম, ভয়ের কি আছে তোর ? ভারী বস্তাটা তখনও ওর বাঁহাতের কনুই থেকে ঝোলানো, বেশ ওজনেরই । পায়ে হাওয়াই চটি । সম্ভবত কুড়িয়ে পাওয়াই । আলাদা রঙ । বললাম, আমি কিন্তু মাস্টার থাকছি না আর-- মাস্টারি ছেড়ে দিচ্ছি । ছেলেটা কী বুঝল কে জানে । একবার ঘাড় কাত করল । বললাম, যাবি, স্কুলের খাতায় নাম তুলে দেব ফের ?
ছেলেটা আসলে সুযোগের অপেক্ষাই করছিল । ওর বন্ধুরাও । ওরা তখনও বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে । ট্রাক ছুটছিল । আর সেই কাপড়ও হাওয়ায় উড়ছিল পত পত করে । যেন জনগণমন শুরু হবে এক্ষুণি । আটাত্তর নম্বর বাসের হেল্পার ছেলেটা রড আঁকড়ে বাতাসে শরীর ভাসিয়ে চিত্কার করছিল, বারিকপুর, বারিকপুর ।
হাত থেকে ছিটকে পালিয়ে যাওয়া ছেলেটার তখন কি হাসি ।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরও ছেলেগুলির কথা মনে পড়ে । সেটা অবশ্য স্বপ্নও হতে পারে । যেন নাগ স্যারের বলা সেইসব হেলিকপ্টার । নামছে, নেমে আসছে । গুমগুম করা সেই ধ্বনি । যেন আকাশ জুড়ে আলোর একটা ছটা । যেন এক্ষুণি কাগজ উড়তে শুরু করবে । এক্ষুণি ফ্ল্যাগের মাথায় আলতো প্যাঁচ দিয়ে আটকে রাখা ঠোঙার সাদা ফুলগুলি ছড়িয়ে পড়বে । এক্ষুণি অচেনা একটা মুখের হাজার হাজার ফটোগ্রাফ বাতাসে ভাসতে শুরু করবে । ছেলেদের শিস শুনতে পাই যেন । আকাশের দিকে মুখ করে ছুটতে থাকা শরীরগুলির তখন কি উল্লাস । বাঁ হাতের কনুইয়ে আটকে থাকা চট-- প্রায় পতাকার মতোই । আর সেই ফটোগ্রাফ-- ফটোগ্রাফের কাগজ তখন রঙিন ঘুড়ির মতোই নেমে আসছে ।
কেউ যেন চিত্কার করে উঠল । বা কোনও নাম ধরে ডেকে উঠল কেউ । কোথায় ভোঁ পড়ল একটা । গুব গুব করা কোনও শব্দ । একদল ছেলে হেসে উঠল কোথাও `এই-এই--' ছেলেটির নাম মনে করতে চাই । কী যেন, কী যেন নাম ছিল ওর ?
আমি কি স্বপ্ন দেখছি কোনও ? নাকি জেগেই ? কী যেন নাম ছিল তোমার ? আমি যেন কী ? ফের মনে করতে চাই । আমি কি সত্যিই জেগে ? কোথাও কিছুর শব্দ হল যেন । যেন অনেক উপর থেকে গড়িয়ে পড়ছে কিছু । যেন ভাঙনেরই । যেন ছাদ, দেওয়াল, সিঁড়ি । কোনও একটা নাম অন্তত মনে করতে চাই আমি । দম আটকে আসে আমার । একজন অন্তত কেউ । অন্তত একজন । নিরেট আয়তকার কালো এক সিন্দুকের কথা মনে পড়ে । সেই পুঁটুলি । জীর্ণ খাতা । অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া নীল কালিতে কিছু নাম । মৃতদেরই । আমি তবুও চেষ্টা করতে থাকি । জীবিত কোনও একজন অন্তত । প্রাণপণ চেষ্টাতেও পৃথিবীতে বেঁচে থাকা একজন কোনও মানুষের নাম আমি আর কিছুতেই মনে করতে পারি না ।
(শেষ)
(পরবাস-৪২, ডিসেম্বর, ২০০৮)