দেশ ছাড়ার পর থেকে বোধের মধ্যে লালিত একটা দেশকে খুঁজতে নানান বিশ্বাসে নানা পথ ঘুরেছি । এখন বেলাশেষে, সাম্প্রতিক সমাজগতি দেখে মনে হচ্ছে প্রাচীন আপ্তবাক্যের `স্বপ্ন নু, মায়া নু, মতিভ্রম নু' কথাটিই বোধহয় সত্যের কাছাকাছি । অথবা `সত্য' বলে আদৌ কিছু নেই । সবই শুধু ঘটনামাত্র । আজকে যখন ফ্যাসিবাদি দম্ভীরা শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষক বা সমাজহিতৈষীর ছদ্মবেশে সমাজের মঞ্চগুলো একে একে দখল করতে তত্পর হয়ে উঠেছে, তখন ধৈর্য ধরে ইতিহাসকে মন্থন করা এবং তার থেকে অমৃত আহরণ করার চেষ্টা করা ছাড়া অন্য উপায় কী ? সংসারের তাবৎ দার্শনিকদের সুভাষিত বক্তব্য এবং বিচার জড়ো করলেও কী পরিচ্ছন্ন এবং নির্ভুল কোনো পথ পাওয়া যাবে ?
এবারে এই প্রব্রজ্যার কাহিনী শেষ করতেই হবে । তখনকার পূর্বপাকিস্তান এবং আজকের বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এক অঞ্চল থেকে চলে এসেছিলাম নির্ভয়তা এবং নির্ভরতার সন্ধানে এই ভূমিতে । তার পরের কাহিনীও বলা হয়েছে । প্রব্রজ্যার নানান বাঁকে ঘুরতে ঘুরতে নির্ভয়তা এবং নির্ভরতার মরিচীকাই শুধু দেখেছি । বাস্তবে তার সাক্ষাৎ মেলেনি । সেই ইতিহাসও কেন একটু না বলি ? সেখানে রয়েছে এক সংগ্রামের প্রচেষ্টার বিবরণ, অবশ্য ইতিপূর্বে তার বেশিটারই আভাস দিয়েছি । এখানে থাকছে সেই সময়কার কিছু বিচার ও আত্ম সমালোচনার কথা ।
সেই নির্ভয় নির্ভরতার কাঙ্খিত ভূমিতে তখন যে ঘোর অমানিশার এক কাল অনন্ত প্রহরে নিশ্চল হয়ে বিরাজ করছিল, তার ইতিহাস রচনা করি এমন সাধ্য আমার নেই । ভুক্তভোগী অনেকেই তা নিজের নিজের মত এবং অভিজ্ঞতা অবলম্বন করে লিখেছেন । আমি শুধু আমার এই অকিঞ্চিত্কর স্মৃতিরোমন্থনে, সেই সময়ের সামান্য দুচারটি কথা লিখবো, যেহেতু ঐ অবস্থাটা পার হতে হয়েছিলো আমাকেও । পার হতে হয়েছিলো বলছি, কিন্তু গায়ে আঁচ না লাগিয়ে নয় ।
যাঁরা ষাট সত্তরের স্মৃতিচারণের দু:খময় অবস্থা আজও করে চলেছেন, তাঁরা প্রায় সবাই কোনো না কোনো বামপন্থী দলের সদস্য ছিলেন, কেউ কেউ বসে গিয়েছেন, কেউ সরাসরি দক্ষিণপন্থী অবস্থানে সরে গেছেন, আবার কেউ বা পুরোনো রাস্তাকে এখনো অভ্রান্ত মনে করে তাতেই সংলগ্ন আছেন । তাঁদের স্মৃতিচারণ বা তত্কালীন ঘটনা দুর্ঘটনার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তাঁদের আজকের দলীয় মত ও আদর্শ অনুযায়ীই তাঁরা লিখেছেন এবং সেটাই স্বাভাবিক । আমি কোনোদিন কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হইনি । তার মানে এই নয় যে আমি রাজনৈতিক বিচারে নিরপেক্ষ । কথাটা বহু উচ্চারণে জীর্ণ হলেও সত্য যে কোনো মানুষই নিরপেক্ষ হতে পারে না । আমিও নই । মানসিক পক্ষপাতিত্বটা রাজনৈতিক দলীয় কার্যক্রমে একমাত্র ভোট ছাড়া অন্য কোনো কাজে লাগে বলে আমার মনে হয় না । কোনো একটা বিশেষ দলীয় মতের বা কার্যকলাপের নৈতিক সমর্থনে আদপেই যে কিছু যায় আসে এমন আমার কখনোই মনে হয়না । কিন্তু সেকথা বিচারে দরকার নেই । আমি ঐ সময়টা পরিক্রমার অর্থাৎ আমি নিজে কেমন করে তা পার হয়ে এসেছি, সেই কথা বলি ।
যখন গোবরা গোরস্তানের বাসা ছেড়ে আমরা বিরাটির কল্যাণ-কো-অপারেটিভ কলোনির ভাড়াটে হয়ে আসি তখন দাদারা কেউই বেশ কিছুকাল ধরে কম্যুনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে ছিল না । মানসিকতার দিক দিয়ে অবশ্যই মার্কসবাদি মতবাদে তাদের পক্ষপাতিত্ব ছিল, কিন্তু মিটিং মিছিলে খুব একটা অংশগ্রহণ করার সুযোগ আমাদের কারুরই ছিল না । তখন ১৯৬৪ সাল । দেশ থেকে মা বাবা ভাইবোনেরা সবাই এসে গেছে । আমাদের তখন পরিবারকে সংহত করে একটা মোটামুটি স্থায়িত্ব দেবার সমূহ সমস্যা । এতগুলো লোকের অন্নবস্ত্র বাসস্থান, চিকিত্সা এবং ছোটদের ইস্কুল ইত্যাদির ব্যবস্থা মোটামুটি ভাবে করতেই দাদা এবং সেজদার নাভি:শ্বাস । আমি নিজেও তখন ছাত্র । এটা একটা ব্যাপার । তার উপর পার্টি তখন প্রকাশ্যেই সরাসরি দ্বিভক্ত । চিন ভারত যুদ্ধের উপলক্ষ্যে পার্টির দুই অংশের মধ্যে কুত্সিৎ তরজা এবং কংগ্রেসীদের, তথা ছোটবড়ো বাম, অবাম দলগুলির অনেকেরই দেশপ্রেমের নামে তখনকার বাম কম্যুনিস্ট বা সি. পি. আই (এম) এর উপর অকথ্য ও অমানুষিক অত্যাচার উত্পীড়ন । কম্যুনিস্ট শব্দটার তখন একটাই প্রতিশব্দ, সেটা দেশদ্রোহী । তারা সবাই দেশের শত্রু । কারণ তারা মনে করে না ১৯৬২র চিন-ভারত সংঘর্ষে চিন আক্রমণকারী । বস্তুত পার্টির মধ্যে অনেকদিন আগে থেকেই দুটি বিভাজন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল । চিন-ভারত সংঘর্ষ শুরু হলে তা তুঙ্গে পৌঁছোয় এবং শেষতক ১৯৬৪তে আনুষ্ঠানিক বিভাজন ।
যুদ্ধের সময়ে আমি দেশের বাড়ি থেকে এদেশে আসিনি । ব্যাপারটা নিজের মতো করে তখন রেডিও খবরের কাগজ ইত্যাদির মাধ্যমে ভাসা ভাসাই জানতাম । এ বিষয়ে কোনো আকর্ষণ ছিল না । ১৯৬৩ সালে এখানে আসার পর প্রথমে দাদাদের সঙ্গে তাদের বন্ধুদের আলাপ আলোচনায় পার্টি, চিন ভারত সংঘর্ষ ইত্যাদি বিষয়গুলোর প্রতি একটু একটু করে আকৃষ্ট হতে থাকি । তখনো কম্যুনিস্ট মনোভাবাপন্নদের প্রতি কুত্সিত এবং অশ্লীল আচরণ, যত্রতত্র তাদের উপর লাঙ্ছনা, সরকারি এবং বেসরকারি মহলে বেশ তেজের সঙ্গেই চলছিল । যেহেতু দাদারা সবাই বাম মানসিকতার মানুষ এবং দল হিসাবে বাম কম্যুনিস্ট অংশের প্রতি পক্ষপাতি সে কারণে আমার মানসিকতাও ও ভাবেই গড়ে ওঠে । কিন্তু তাত্ত্বিক ভাবে যেহেতু কম্যুনিস্ট দর্শন এবং পার্টির মতাদর্শ ইত্যাদি বিষয়ে এবং তথ্যগতভাবে চিন ও ভারত কে আক্রমণকারী সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না, তাই দেশপ্রেমিক নামধারী কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের বক্তব্য ও কাজকর্মের ধারার সঙ্গে দাদাদের বক্তব্য, বিতর্ক ইত্যাদির বিরোধ আমার মনে ভীষণ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছিল । সেই দ্বন্দ্বে আমার মানসিক শান্তি ব্যাপক ভাবেই ব্যাহত হয়েছিল । আমার এখানে আসার আগে চিন্তা ও মননের জগতটা ছিল একটা বদ্ধ জলাশয়ের মতো, ঐ সময়কার পরিস্থিতির বহুমূখিনতা এবং জটিলতা শুধুমাত্র দাদাদের তর্কবিতর্কের মাধ্যমে বুঝে ওঠা সম্ভব ছিল না । মানসিক অস্থিরতা এবং অশান্তি সেই কারণেই । যে সব কবি সাহিত্যিকদের মনে মনে পূজা করতাম, তাঁদের কম্যুনিস্ট-বিদ্বেষ দেখে খুবই বিমর্ষ বোধ করতাম ।
বরিশাল জিলা সদরে থাকাকালে কিছু কম্যুনিস্ট ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসেছিলাম । কিন্তু সে এমন কিছু উল্লেখনীয় সাহচর্য নয় । তথাপি তাঁদের কয়েকজনের নাম এ প্রসঙ্গে জানাই । প্রথম যে ব্যক্তির সঙ্গে এ বিষয়ে সম্পর্কিত হয়েছিলাম তিনি আজ আর নেই । ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ফৌজের গুলিতে তিনি নিহত হন । তাঁর বিষয়ে বিস্তারিত আমার বিষাদবৃক্ষে লিখেছি । তাঁর নাম যতীন কর্মকার । এছাড়া মনোরমা গুহ, যিনি `মাসিমা' নামে এপার ওপারে অনেকের কাছেই পরিচিত, রফিকুল ইসলাম সাহেব, যিনি বি. এম কলেজে আমাদের বাংলা পড়াতেন, পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হীরেন ভট্টাচার্য এবং তাঁর স্ত্রী রাণিদি । এঁদের কেউই আজ আর নেই । রাণিদি কিছুদিন আগে মারা গেছেন । তিনি অবশ্য বিয়ের আগে মার্কসবাদী ছিলেন না, ছিলেন ঘোরতর হিন্দু । হীরেনদার সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার অনেক পরেই নাকি তিনি মার্কসবাদে বিশ্বাসী হন । তাঁর সঙ্গে সর্বশেষ আমার দেখা হয় ২০০০ সালে । তখনো আমার `বিষাদবৃক্ষ' প্রকাশিত হয়নি । আমার `সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম' বইটি পড়ে তিনি খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং অকুন্ঠ সাধুবাদ করেছিলেন ।
কিন্তু এঁদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাজকর্মের বিষয়ে তখন আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় কিছুই বিশেষ জানতে পারিনি । পরে নানাজনের কাছে শুনে এবং বই পুস্তকের মাধ্যমে যেটুকু যা জেনেছি । এঁরা ছাড়া আর দুএকজন, যাঁদের কথা মনে পড়ে তার মধ্যে দেবেন ঘোষ এবং সতু সেনের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করতে পারি । কিন্তু কারো সঙ্গেই গভীরভাবে পরিচয়ের সুযোগ হয়নি । দেবেন ঘোষ মশাইকে ১৯৫৪ সালের এসেম্ব্লি নির্বাচনের কর্মকাণ্ডের সময় দেখেছিলাম । তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি, এরকম স্মৃতি আছে । পরে, বরিশাল থাকাকালীন সময়ে সভায় বা তাঁর কাউনিয়া রোডস্থ বাসভবনে অনেকবার দেখেছি । তিনি শতবত্সর অতিক্রম করেও বেশ কিছুকাল পর্যন্ত বেঁচেছিলেন । তবে চিরকুমার এবং আজীবন প্রতিবাদী সমাজকর্মী এই মানুষটির জীবনের কতবছর যে পাকিস্তানি কারাগারে কেটেছে তার হিসাব বোধকরি তিনি নিজেও জানতেন না । তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল অনুশীলন সমিতির মাধ্যমে । আন্দামানের সেলুলার জেলেও তাঁর দীর্ঘকাল কেটেছিল । শেষ তিনি আওয়ামি লিগে যোগ দিয়েছিলেন । যতদূর জানি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ কালেও তিনি দেশত্যাগ করেননি এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন । তাঁর সুদীর্ঘ সংগ্রামকালে জীবনের অবসান হয় ২০০৮ সালে, যখন তাঁর বয়স হয়েছিল ১০৮ বত্সর ।
সতুসেন মশাইও কম্যুনিস্ট হিসাবে বরিশালে খুবই বিখ্যাত ছিলেন । তাঁর সঙ্গেও আমার যোগাযোগ খুবই সামান্য, যদিও তাঁর পরিবারের সঙ্গে আমার পরিবারের একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল । আমার বাবা, জেঠামশাইকে তিনি দাদা বলতেন । ১৯৭২ সালে দেশে গিয়ে যখন স-বরযাত্রি বিয়ে করতে যাচ্ছিলাম, তখন আমাদের নৌকোর গলুইয়ে দাঁড়িয়ে জেঠামশাই সতু সেন মশাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সতু, তুমি এখানে ? কোন পক্ষে ? মুখ বাড়িয়ে দেখি সতুসেন মশাই । তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, এতক্ষণ তো কন্যাপক্ষের আমন্ত্রণেই যাচ্ছিলাম, এখনতো দেখছি দুপক্ষেই । ব্যাপারটা আমি পরে জেনেছি । খুব যে নিকট আত্মীয়তা তা নয় । সতুবাবু আমাদের বুড়ি পিসিমার অর্থাৎ পিসিঠাকুমার ভাসুর অথবা দেওরপো । সম্পর্কটা সে অর্থে তেমন কিছুই না । তবে বুড়ি পিসিমা যেহেতু কিশোরীকাল থেকে বিধবা এবং পিতৃগৃহবাসী, সে কারণে এবং বৈদ্যজাতীয় স্বভাববশত, বরিশালি ভাষায় আমরা `ঘোনো আত্মীয়' । তার ওপর মণিকুন্তলা সেন ছিলেন সতুসেন মশায়ের পিসিমা । দাদাদের কাছে শুনেছি তিনি আমাদের পার্কসার্কাসের যৌথ সংসারে বুড়ি পিসিমার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন । সতুবাবুর ছেলেমেয়ে বা ভ্রাতুষ্পুত্র কন্যাদের কারুর কারুর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল । ৭২ এ বিয়ের পরও তাঁদের বাসায় আমি সস্ত্রীক গিয়েছি । সত ংউসেনের বিষয়ে এসব কথা বলার বিশেষ প্রাসঙ্গিকতা নেই, তবে কম্যুনিস্ট হিসাবে তাঁর উপর নির্যাতনের কথা আমার জানা ছিল, দেখেছিও কিছু কিছু ।
ঐ সময়ের বামপন্থী কর্মীদের মধ্যে আর দুজনের নাম করবো যাঁরা আজও বেঁচে আছেন, একজন নিখিল সেন, অপরজন দ্বিজেন শর্মা । দুজনেই আশির ঘরে । নিখিলদা এখনও বরিশালবাসীই আছেন, দ্বিজেনদা কখনো ঢাকা, কখনো মস্কো । তাঁদের সঙ্গে আমার আজও মোটামুটি যোগাযোগ আছে । নিখিলদা আর.এস.পি র লোক ছিলেন ।
কিন্তু যাঁদের বিষয়ে এত কথা বললাম, তাঁদের কাছ থেকে ঐ সময় মার্কসবাদ বা রাজনীতি বিষয়ে কোনো পাঠই নেবার সুযোগ আমার হয়নি । এখানে আসার পর যখন এইসব তর্কবিতর্ক দেশের মধ্যের নানান বাক্বিতণ্ডার আবর্তে পড়লাম তখন আমার সঙ্কটটা অতি তীব্র হলো । অন্য আর দশজন সমবয়সীর মতো ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না আমার পক্ষে । কিন্তু যে উপায়ে একজন রাজনীতির দিক থেকে অজ্ঞ মানুষ নিজেকে তৈরি করতে পারে সে রকম উপায় কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না । এক্ষেত্রে এ প্রশ্নটা ওঠা স্বাভাবিক যে আমার এরকম একটা সঙ্কটে ভোগার বাস্তব কারণটা কী ছিল ? আমি না ছিলাম পার্টি পলিটিক্সের বিষয়ে সর্বক্ষণের কর্মী, না ছিল আমার এ বিষয়ে কোনো তাত্ত্বিক ধারণা । তাছাড়া বয়সের দিক দিয়েও আমি আদৌ পরিণত ছিলাম না । পরবর্তী কালে এ নিয়ে অনেক চিন্তা করে দেখেছি যে এর পিছনে ছিল আমার চরিত্রের একটা বিশেষ প্রবণতা, যেটাকে সস্তা বাতেল্লাবাজির প্রবণতা বলেই একমাত্র উল্লেখ করা সঠিক । এর ফলে আমি বহুকালই নানাস্থানে নিজেকে হাস্যাস্পদ অবস্থায় ফেলেছি এবং অনেক কষ্টে খুব দেরিতে হলেও অনেকটা সংশোধন করতে পেরেছি নিজেকে । তবে একথাও ঠিক যে এরই জন্য কিছু বইপত্র পড়া আমার সম্ভব হয়েছিল । আর বিচিত্র কিছু মানুষের সংশ্রবেও আসতে পেরেছিলাম । তার ফল সবটাই খারাপ হয়নি । ঐ বয়সে নিজেকে তৈরি করতে এটার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না ।
বিরাটিতে যেখানটায় থাকতাম, পার্টির লোকাল কমিটির একটা নতুন অফিস খোলা হয়েছিল । মনে আছে, সেই কাজের উপলক্ষ্যে ওখানকার সম-মনোভাবাপন্ন বিভিন্ন জনেদের সঙ্গে দাদা, সেজ এবং আমিও উত্সাহ সহকারেই যোগ দিয়েছিলাম । এর আগে, আলাপ আলোচনা ইত্যাদির জন্য এর তার বাড়ির কোনো একটা ঘর বা বারান্দা ব্যবহার করা হতো । সেখানে নেতাদের কেউ কখনো আসলে, জনাধিক্যের কারণে খুবই অসুবিধে হতো । স্থানীয় সংগঠন ত্রক্রমশ বড়ো হচ্ছিল, তাই পার্টি অফিসের একটা পাকাপাকি বন্দোবস্ত । যতদূর মনে আছে সেটা ১৯৬৫ সাল । আমাদের ওখানকার সংগঠনের প্রাথমিক কেন্দ্র ছিল বণিক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার নামের একটি চা-মিষ্টির দোকান । তাদেরই একটি মুদি দোকানের অর্ধনির্মিত দোতলায় পার্টি অফিস হলো ।
মনে আছে জ্যোতি বসু পার্টি অফিসটির উদ্বোধন করেছিলেন । দাদার নেতৃত্বে একটি গণসঙ্গীতের দল উদ্বোধনী সঙ্গীত গেয়েছিল, `এসো মুক্ত করো, মুক্ত করো অন্ধকারের এই দ্বার ।' সেই প্রথম অনুভব করেছিলাম অনেক মানুষের সঙ্গে একত্রিত হয়ে সংগ্রামের শপথে উদ্দীপ্ত বোধ করা । সেই থেকে প্রথম যুক্তফ্রন্ট গড়ার সময় পর্যন্ত (১৯৬৭) একটানা সি.পি.আই-এম পার্টির সমর্থনে কিছু কিছু কাজকর্ম করেছি । এর কিছুকাল পরই নকশালবাড়ির ঘটনা । সেই পর্বটা এতই অস্থির যে তার বিবরণ দিতে গেলে তাও হবে একটা ঘোর এলোমেলো আলেখ্য । কিন্তু কথাগুলো পুরোটাতো বলতেই হবে, নচেৎ সেই সময়টা এবং নিজেকেও পরিষ্কার ভাবে উপস্থিত করতে পারব না । সুতরাং মূল কথার ধারায়ই ফিরি । এইসব আশ পাশ ঝোপঝাড় পিটোলে ফেউ এর সঙ্গে বাঘ টাঘেরও বেরিয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে । কোলকাতায় আমার চাকরি এবং তথাকথিত রাজনৈতিক কার্যকলাপ অর্থাৎ উগ্র বাত্তেল্লাবাজি চলেছে মধ্যষাট থেকে মধ্য সত্তর পর্যন্ত । এতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক কোনোদিক দিয়েই যে সদর্থক কিছু লাভ হয়েছে, সে কথা আজ আর বলতে পারি না । এর সাহায্যে গভীর কোনো প্রত্যয়েও উপনীত হতে পারিনি । বরং উগ্রতার ফল হিসাবে সেই সময়কার নিত্য অস্থিরতা, অশান্ততা, পারিবারিক এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, বন্ধুবিচ্ছেদ ইত্যাদির দুর্ভোগই ব্যাপক হয়েছে । আজ মনে হয়, জীবনের এই শ্রেষ্ঠ অনধিক একটা দশককে আমি কোনো কাজেরই উপযুক্ত করে নিজেকে গড়ে তুলতে পারিনি । কোনো দিক দিয়েই না । উপরন্তু নিতান্তই বেকার নানা বিপদ এবং ঝঞ্ঝাটের মধ্যে নিজেকে নিয়ে ফেলেছি । এই ছেলেখেলা এবং একান্ত একটা লুম্পেন হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতাটা শেষ হলো ১৯৭৬এ অ্যারেস্ট হবার পর । ইতিপূর্বে এ নিয়ে কিছু বলেছি বিক্ষিপ্ত ভাবে হলেও । এখানে আরো কিছুটা করা অযৌক্তিক হবে না বোধহয় ।
(পরবাস-৪৪, ডিসেম্বর, ২০০৯ )