আমি কথা-সাহিত্যিক বলতে যা বোঝায়, তা নই । তা হবার ক্ষমতাও আমার নেই, ইচ্ছাও নেই । আমি যা লিখি, শাস্ত্রসম্মত ভাবে তাকে যে কোন্ বিভাগে ফেলা যায়, তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে । কিন্তু সেসব আলোচনায় যাব না । আমি যা হয়েছি, এখানে সেই হয়ে ওঠার বিষয়ে কিছু তথ্য বলব । তবে একথাও বলে নি যে, অনেক কথা বলার পরেও হয়ত আসল কথাটা অনুক্তই থেকে যাবে । এইসব বৃত্তান্ত বলে খোল্সা করা যায়না বলেই মনে হয় ।
প্রথমেই বলে রাখছি, সাহিত্য সৃষ্টি করব বলে কলম হাতে নিইনি । সাহিত্যের ক্ষেত্র বড় বিশাল বিস্তৃত ব্যাপার । সেখানে যাঁরা বিচরণ করেন, ক্ষমতা, গুণ এবং কর্ম অনুসারে, তাঁদের অঞ্চল বহুধাবিভক্ত । সামান্য দুএকজন ঐ বিশাল বিস্তার ক্ষেত্রটি আনুপূর্ব কর্ষণ, বপন, রোপণ ইত্যাদি করার ক্ষমতার অধিকারী, তথা তদুনযায়ী ফসল উত্পাদনে সক্ষম । বাকি বেশিরভাগ ছোট বড় অংশে তাঁদের প্রচেষ্টা এবং ক্ষমতা অনুসারে সাহিত্য সেবা করেন । আমার ক্ষেত্রে, যেহেতু কোনও পূর্বনির্দিষ্ট ক্ষেত্রাংশ ছিল না, সুতরাং প্রথামত তাকে কর্ষণোপযোগী করে তৈরি করাও হয়নি । সব কিছুরই একটা প্রস্তুতিপর্ব থাকে । আমার প্রস্তুতি পর্বটি বড় ধূসর, কারণ তা প্রকৃতই অসম্পূর্ণ এলোমেলো এবং অনুশীলন রহিত । ইংরাজি ভাষায় যাকে home-work বলে, তা আমার ক্ষেত্রে এতই অকিঞ্চিত্কর যে তার বর্ণনা দেওয়াও লজ্জাজনক । অনেকেই হয়ত এই যুক্তির সঙ্গে সহমত হবেন না, অথবা একে নিতান্ত খঞ্জ যুক্তি বলে আখ্যা দেবেন, কিন্তু `আলস্য দোষের আকর' এই সত্যের ব্যত্যয় নেই জেনেও আমি তার থেকে নিবৃত্তি যাচ্ঞা করিনি । এই অনুশীলনহীনতার পিছনে আরও একহাজার একটা, বা তারও অধিক কারণ হয়ত আছে । কিন্তু সেসব মনুষ্যজীবনের স্বাভাবিক অনুষঙ্গ মাত্র । তার ব্যাপক বিবরণী আমার রচনায় লভ্য, অতএব, পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন ।
তথাপি আমি লিখি, আর তারজন্য বেশ নাম যশও হয়েছে । অর্থ হয়নি । দুএকজন প্রকাশক ছাড়া বই এর রয়ালটি দেবার ঔদার্য বাংলা সাহিত্যের জগতে দূর্লভ, অবশ্য এখানে বক্স অফিস, বেস্ট সেলার ওয়ালা লেখকদের কথা স্বতন্ত্র । যশ ব্যাপারটা অর্থের চাইতে কম ক্ষমতাশালী নয়, যদিও সাহিত্যজগতের পিতামহ বঙ্কিম উপদেশ করেছিলেন, যশের জন্য লিখিবেন না । কিন্তু সে কথা শোনে কে ? লোকে আজকাল জ্যান্ত প্রতাপশালী বাপের কথাই গেরহ্যি করেনা, তো মরে ভূত হওয়া ঠাকুর্দ্দার কথা শুনবে । যশ বড় মাহেঙ্গা বস্তু, আবার তা যদি ছাপার অক্ষরে নামীদামি পত্রিকায় প্রচারিত হয়তো কথাই নেই । যশ অর্থের চাইতে দীর্ঘস্থায়ী এবং তার স্বাদ পুরোনো মদের তুল্য । আধমড়া মানুষকে পর্যন্ত চাঙ্গা করে দেয় । সমালোচনার ক্ষুদ্র বৃহৎ কন্টকের চাইতে যশের স্নিগ্ধতা অবশ্যই অধিক উপভোগ্য । নচেৎ ওই মহদ্বাক্য বলার পরেও বঙ্কিম লোক-কটাক্ষে বিদ্ধ হতেন না । রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, `কন্টক ক্ষুদ্র হইলেও, তাহার বিদ্ধ করিবার ক্ষমতা আছে ।' কথাটি বঙ্কিম প্রসঙ্গেই । এর জন্য বোধহয় স্বয়ং ঈশ্বরও বুভুক্ষু কুত্তার মত দেড়হাত জিভ বের করে লালা ঝরান । মনুষ্য তো ষড়রিপুর ত্রক্রীতদাস । আবার একথাও তো মানতে হবে যে মনুষ্য সমাজের অধিকাংশ সদস্যই গীতার নিষ্কাম কর্মের আদর্শকে অনুসরণ করতে সক্ষম হয়না । সুতরাং যেটুকু নাম যশ হয়েছে, তার জন্য আমার কিছুমাত্র হেলদেল নেই, একথা জজে মানবে না । শুধু এটুকু বলতে পারি যে যশের জন্য ঢাক ঢোল পিটানোর হ্যাংলামিটা এখনও স্বভাবে আশ্রয় করেনি । প্রশংসা প্রশস্তি শুনে অস্বস্তি বোধ করাটাই তার প্রমাণ । অস্বস্তিটা নিজের অক্ষমতা সম্পর্কে সম্যক ধারণার কল্যাণেই । সেখানে "সুখেষু বিগত স্পৃহ:, দু:খেষু নিরুদ্বিগ্নমনা:" এরকম মহৎ তত্ত্বদর্শন নেই ।
তাহলে এ লাইনে এলাম কেন এবং কীভাবেই বা ? সেই গল্প বলতেই এতক্ষণের ঝোপঝাড় পিটোনো । আমার লেখালেখির জীবন বড় বেশি দিনের নয় । যদিও এর আগে বলেছি যে আমার কোনো প্রস্তুতি পর্ব নেই, কিন্তু সেটা আংশিক সত্য । একধরনের প্রস্তুতি ভেতরে ভেতরে তো চলছিলই, নাহলে
ছোট বয়স থেকে পিতৃদেবের কাব্যচর্চার প্রচেষ্টা অবশ্যই আমার মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছিল । ভদ্রলোক সাংসারিক সর্বব্যাপারে ছিলেন অনবদ্য অলসতা এবং উদাসীনতার প্রতিমূর্তি । শুধু একটি ব্যাপারে তাঁর নিরলসতা দেখেছি, তা এই পদ্যরচনা । রচনান্তরে তাঁর সাংসারিক, বৈষয়িক অকর্মণ্যতার কথা এন্তের লিখেছি, তাই বিশদে যাবনা । শুধু এই পদ্যরচনায় কথা খানিক বলি । আমার স্মৃতিতে, সেকালের দারিদ্র দু:সময় দিনগুলি যে আনন্দের সংবাদ আজও বহন করে, তার চিত্রকল্প বড় মধুর, যদিও সেই মধুরতা অসম্ভব বিষণ্ণতা-মণ্ডিত । ঘরে চাল বা কোনোরকম খাদ্যবস্তু নেই, ছোট ভাইবোনেরা হয়ত খিদেয় কাঁদছে, বাহুল্যবোধে মা উনুন জ্বালেননি । বাইরে অঝোর বৃষ্টি, বাবা পদ্যের মিল খুঁজছেন । যে প্রায় রবিঠাকুরের `পুরস্কার' কবিতাটির শুরুয়াতের ছবিটি -
অভিজ্ঞান শকুন্তলম নাটকটি তাঁর খুব প্রিয় ছিল । বস্তুত ধ্রুপদী সব নাটকই, ইংরাজি, বাংলা এবং সংস্কৃত, তাঁর আদরণীয় পাঠ-বিষয় ছিল । তার মধ্যে থেকে কোনও বিশেষ সংলাপ কখনও কখনও তাঁর পদ্যরচনায় স্ফূলিঙ্গ হতো । সেইসব একটা খসড়া খাতায় লিখে রাখতেন তিনি পড়ার সময় । এরকম একটি কবিতার উল্লেখ করছি উদাহরণ হিসাবে । দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার মধ্যে সাক্ষাৎ হওয়ার পর প্রাথমিক পর্যায়ে, রাজা শকুন্তলাকে বলছেন, ননূ কমলস্য মধুকর: সন্তুষ্যতি গন্ধ মাত্রেণ । শকুন্তলা সরলা আশ্রমবালা । নাগরিক চাতুর্য জানেন না । রাজার সংলাপের উত্তরে খুব সরল প্রতিপ্রশ্ন তাঁর, অসন্তোষে ঊণে কিং করেদি ? - মধুকর কমলের গন্ধ মাত্রেই সন্তুষ্ট হয়না । রাজার এই কথাটি যদি বর্তমান নারী স্বাধীনতার যুগে কোনো স্বাভিমানী নাগরিকা সুন্দরীকে তিনি করতেন, অথবা গ্রামীণ ললনাকেও, তবে তা যে যৌন কুপ্রস্তাব হিসাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হতো সে বিষয়ে সন্দেহ নেই । কেননা, মধুকরেরা যে ফুলে ফুলে মধু খায় এ সত্য এখন সর্বজ্ঞাত । শকুন্তলার প্রশ্নটি এতই সরল যে তিনি আশ্রমপালিতা, অরণ্যদুহিতা হলেও তা যেন রাজার পক্ষে মিলনের আমন্ত্রণই । একথা আমাদের আজকের ব্যাখ্যা । এর অন্য ব্যাপক ব্যাখ্যা রবীন্দ্রনাথ করেছেন । কিন্তু বাবার ক্ষেত্রে এই সংলাপ দুটি প্রেমের সহজতায় ধরা দিয়েছিল । তার কবিতাটি রচিত হলো এই সংলাপদুটিকে শিরোনাম করে । কবিতাটি উদ্ধৃত করছি -
.... রাশি রাশি মিল করিতেছ জড়ো
অবশ্যই মা এমত বাক্য ব্যবহারের সাহস ধরতেন না । ততক্ষণে হয়ত পদ্যটি মাত্রা, ছন্দ এবং পঙ্ক্তির অক্ষরসাম্যে আঁটো সাঁটো হয়ে দিব্য নিটোলটি হয়েছে । বাবা ভূমানন্দে ভোঁ হয়ে আছেন । `পোলাপানের' কান্না তাঁকে স্পর্শ করছে না । মা স্বভাবগত ভাবে এসব সমস্যায়, নিরর্থকবোধে বাক্শূন্য । জানেন, কিছু বললে কবিসুলভ বাণী শুনতে হবে, একদিন না খেলে মানুষ মরেনা । তার চেয়ে কী লিখেছি শোনো । অগত্যা তাঁকে শুনতে হতো এবং পেটে গোখরোর ছোবল সহ্য করে দশ এগারো বছর বয়সী আমাকেও । তখন বুঝতাম না বটে, তবে বোঝার বয়স হলে ঐ খাতার কবিতা বা পদ্য, যাই বলিনা কেন, কাব্যের চাইতে অধিক আনন্দ দিয়েছে, পথ দেখিয়েছে এমন এক দেশের যেখানে প্রসন্নতা - প্রফুল্লতার ঋতু প্রাকৃতিক নিদাঘ, হিম অথবা বর্ষণের তীব্রতাকে অক্লেশে উপেক্ষা করে । ক্ষুধা, নিদ্রা ইত্যকার শারীরিক ক্লেশও সেখানে তুচ্ছ হয়ে যায় । আর সেইসব স্মৃতির সূত্রই আমার মধ্যে গড়ে তুলতে থাকে এক প্রস্তুতিপর্ব । এর সঙ্গে আরও থাকে একান্ত নিজস্ব নি:সঙ্গ যাপিত কৈশোর । সেইসময় অর্থাভাব এবং উদ্যমহীনতা অভিভাবকদের নিস্পৃহ রেখেছিল আমার মত কিশোরদের শিক্ষা বিষয়ে । এর ফল হয়েছিল দ্বিবিধ । প্রথমটা মারাত্মক ক্ষতিকর । ইস্কুলে পাঠানো হয়নি বলে প্রথাসিদ্ধ ভাবে পড়াশোনা করতে না পারা । জীবন গঠনের প্রাথমিক স্তর থেকেই বিশৃঙ্খলভাবে বড় হওয়া সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বেড়ে ওঠার সুযোগ না হওয়ার জন্য স্বভাবে চিরস্থায়ী নি:সঙ্গতা এবং মেলানকোলিয়ার প্রকোপ । এই যেমন একটা দিক, অপর দিকটা ভালোয় মন্দয় মেশানো । বয়সের তুলনায়, বুঝে না বুঝে গোগ্রাসে, বয়সের অনুপযোগী গ্রন্থপাঠ এবং সেখানেও শৃঙ্খলার অভাব । অল্প বয়সে এই বিশৃঙ্খলার প্রকোপ ততটা অনুভূত হয়নি, বরং ইস্কুল কলেজে যখন পড়াশোনা করছিলাম, তখন এই সময়কার পড়াশোনার জন্য মনে বেশ একটা অহংকার পোষণ করতাম । সহপাঠি, পাঠিনীরা, এমন কী শিক্ষক অধ্যাপকেরা অনেকেই আমার সমতূল্য পাঠের ব্যাপকতায় ছিলেন না, এরকম প্রমাণ পেয়ে । তাঁরাও আমার বয়স অনুপাতে অধ্যয়নের ব্যাপকতায় মুগ্ধতা প্রকাশ করতেন । পরে বুঝেছি এটা যতটা আমাকে উপর-চালাকিতে দস্তুর করেছে ততটা শিক্ষিত করেনি । লেখালেখির জীবনে এর ভাল মন্দ প্রভাব দুটোই পড়েছে । রুটিনসম্মত পড়াশোনা বা লেখালেখির অভ্যাস বাবার মধ্যেও ছিল না । তিনিতো আবার তাঁর লেখার এক বর্ণও কোনোদিন ছাপার জন্য কোথাও উদ্যোগ নেননি । লিখতেন, প্রথমে মাকে শোনাতেন, পরে গ্রামের দুএকজন বোদ্ধাকে । ব্যাস্ ঐ পর্যন্ত । তাঁর সব লেখাই ছিল পদ্যে । ছন্দের উপর অসামান্য দখল । শব্দচয়নের দক্ষতা ঈর্ষণীয় । তবে রচনা নির্মাণরীতি প্রাগাধুনিক । আধুনিক কবিতা বলতে তখন যা বোঝানো হতো, তার উপর অপরিসীম বিতৃষ্ণা ছিল তাঁর । এমনকী যে কল্লোল যুগ বিষয়ে তাঁর কাছে এত এত গল্প শুনেছি, যে গোষ্ঠীতে তাঁর দুএকজন কলেজজীবনের বন্ধুও ছিলেন, সেই কল্লোল গোষ্ঠীর বাঘা কবিদেরও তিনি একসময় আর পছন্দ করতেন না । রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে শেষকথা । কল্লোলী কবিদের ব্যবহৃত উপমা, উত্প্রেক্ষা, অনুপ্রাস এবং ছন্দ নিরীক্ষার পদ্ধতি তাঁর মতে রীতিমত অসুন্দর তথা অ-কাব্যোচিত ছিল । মাঝে মাঝে মনে হতো তিনি বোধহয় ব্যাপারগুলো ঠিক বুঝতেন না । পরে ভুল ভেঙেছে । বুঝেছি, বুঝতেন তিনি ঠিকই, তবে নতুনত্বকে গ্রহণ করার নাগরিক ঔদার্য তাঁর রপ্ত ছিল না । গ্রামীণ নিস্তরঙ্গ জীবনে দীর্ঘদিন এক বদ্ধতায় কাল কাটিয়ে, কলেজজীবনের দুচার বছরের নাগরিক বোধ আর বিকশিত হয়নি । ব্যাপারটা অনেকটা কবি কায়কোবাদের মত আর কী । তিনি রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করতে পারেননি । হেম, নবীন যুগের আচ্ছন্নতা তাঁকে তাঁদের জগতে আটকে রেখেছিল । বাবার এই ব্যাপারটার গভীর প্রভাব, তাঁর কবিজীবনের অর্ধশতাধিক বছর পরে লেখালেখি করতে গিয়ে আমাকে প্রভাবিত করেছে বলে মনে হয়, যদিও কবিতা আমার লেখার বা রচনার মুখ্য বাহন নয় । এই যে কথাটি বললাম, তাও যে সর্বার্থে সঠিক তা নয় । পাঠকরা জানেন আমার রচনায় গান এবং আঞ্চলিক পদ্যের ব্যবহার কতটা ব্যাপক । এটাই হয়ত পৈত্রিক উত্তরাধিকার । তবে এই সময়ে আমি যতটা পড়েছি, লিখিনি প্রায় কিছুই । একটা খাতায় বেশ কিছু পদ্য লেখার কসরৎ করে বাবাকে দেখিয়েছিলাম । চোখ বুলিয়ে তিনি খাতাটা ফেরৎ দিয়েছিলেন । কিছু মন্তব্য করেননি । বুঝেছিলাম, ওসব আমার হবার নয় । তখন বয়স বারো তেরো । যৌবনকালে আবার চেষ্টা করেছি । তবে তাতে পূর্বোক্ত বিশ্বাসটা পাকাই হয়েছে । ছাপার প্রচেষ্টা করে আর লোক হাসাইনি । এইসব ঘটনাকে যদি আমার পরবর্তীকালীন লেখালেখির প্রস্তুতিপর্বের প্রাথমিক প্রয়াস ধরা যায় তবে তাই । ততদিনে প্রাচীন আপ্তবাক্য বেশ পাকাভাবেই রপ্ত হয়েছে `শতং বদ মা লিখ' এবং `শতং লিখ মা ছাপো' । দ্বিতীয় আপ্তবাক্যটিই এক্ষেত্রে অধিক কার্যকরী থেকেছে । তবে একটা কথা অবশ্যই সত্য যে ভালমন্দ যা কিছুই হোক, জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা । সঞ্চয়ে যা কিছু ছিল, তার টুক্ড়ো টাকড়া পরবর্তীকালের লেখালেখিতে যথেচ্ছ কাজে লাগিয়েছি । এ ব্যাপারটা সম্পূর্ণই বাবার অভ্যাস থেকে রপ্ত করা । তিনি মাঝে মাঝে, হঠাৎ খেয়ালে এক আধ লাইন এখানে ওখানে লিখে রাখতেন, পরে সেগুলো প্রয়োজন মত ব্যবহার করতেন ।
রচিতেছ বসি পুঁথি বড় বড়
মাথার উপরে বারি পরো পরো
তার খোঁজ রাখ কী ?
. . . . . . .
. . . . . . .
ওগো ফেলে দাও পুঁথি ও লেখনী
যা করিতে হয় করহ এখনি
এত শিখিয়াছ এটুকু শেখোনি
কীসে কড়ি আসে দুটো !
এই যে শ্যামল সুষমায় ভরা
বলা বাহুল্য, কালিদাসের সঙ্গে ওমর খৈয়মের ভাব-সংমিশ্রণ এখানে এক চমত্কার মাধুর্যের সৃষ্টি করেছে । আমার সংস্কৃত সাহিত্য প্রীতি, অক্ষমণীয় কম পড়াশোনা এবং অশুদ্ধ উদ্ধৃতি ব্যবহার সত্ত্বেও অনেকাংশেই পিতৃপ্রভাব প্রবল । প্রাথমিক প্রস্তুতি পর্ব বিষয়ে এটুকুই আপাতত বক্তব্য । এর তাত্পর্য যে আমার জীবনে কতটা তা যৌবন কালে কোনোদিন ভেবে দেখিনি । সামান্য লেখালেখির আবর্তে এসে যখন অসামান্য সমাদর, অযাচিত, অহৈতুকী, অলৌকিক কৃপা-বৃষ্টির মত লাভ হচ্ছে, তখন ফেলে আসা দিনের `কণা' টুকুর জন্যও `প্রাণ করে হায় হায়' । কিন্তু আমার সেইসব দিনতো `ভেসে গেছে চোখের জলে' । আজ ছাই পাশ যা লিখছি তা তো সেইসব দিনের ছায়াঘন ভিজে মেঘের ছবিমাত্র ।
        
স্নিগ্ধ শীতল তটিনী ধার
     ধীরে সখা হেথা চরণ ফেলিও
     কিশলয়ে যেন বাজেনা ভার ।
     হয়ত উহারা উঠেছে দলিয়া
         কুসুমিত কোনো তরুণীকায়
     হয়ত তাদের অধর কোনবা
         রূপসী অধর পরশি ধায় ।
     তারা বলে সুখ স্বর্গেরও দূরে
         আমি বলি সুখ মদিরে বঁধু
     বাকি ত্যাজি আজ নগদ যা লহ
         দূরের ঢোলক শুনিতে মধু ।
অভিজ্ঞতার কথা বলছিলাম । মানুষের জীবনের সবটাই অভিজ্ঞতার উপাদান । এমনকী কড়িকাঠ গোনাও । সেক্ষেত্রে জীবনের খুঁটিনাটি অনুষঙ্গ কোন্টাকেই বা আমরা সঞ্চয় হিসাবে কদর না করে পারি ? তবে কথা হচ্ছে সঞ্চয়কে কারা মূল্য দিই বা সম্মান করি ? জীবনের অভিজ্ঞতার সঞ্চয়কে যাঁরা গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে, মূল্যবান মনে ক'রে গ্রহণ করেন এবং সেসবের বিচিত্র রসায়নকে উপলব্ধি ক'রে সাহিত্যে প্রকাশ করতে সক্ষম হন, তাঁরাই লেখক পদবাচ্য । অভিজ্ঞতার সঞ্চয় এবং তার সারাত্সারের সুচারু তথা শৈল্পিক পরিবেশনটাই ব্যাপার । নিজেকে সেই ক্ষমতার আধিকারিক মনে করার স্পর্ধা আমার নেই ।
তথাপি যা যেটুকু লিখেছি তার প্রস্তুতিপর্বকে অস্বীকার করতে পারি না । একটা জীবন তো কম কথা নয় । তার বিচিত্র আয়োজনকে অস্বীকার করব কী করে ? জীবনের প্রাথমিক পর্বের ভৌগোলিক অবস্থান যৌবনের শুরুতেই পরিবর্তন করতে হলে আমার জীবনের মৌল রসায়নের ক্ষেত্রে একটা বড় রকমের রদবদলের সূচনা হলো । নিস্তরঙ্গ পল্লী-কেন্দ্রিকতার স্থানে একটা তরঙ্গক্ষুব্ধ নাগরিক আবর্তে পড়ে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম তখন । বৌদ্ধিক মাপটা মধ্য মেধারও নয় । অনুকরণ ক্ষমতাটাও রপ্ত নেই । ফলে লেখালেখির একটা মোটামুটি আবহের মধ্যে থেকেও ভেতর থেকে কোনো প্রেরণা বোধ করিনি । সবচেয়ে বড় কথা ফেলে আসা পল্লীজীবনের নিস্তরঙ্গতাটার প্রকোপ একেবারে মজ্জায় মিশেছিল । নাগরিক জীবন সেকারণে কোনোদিন আমাকে আকর্ষিত করতে পারেনি । বই পড়া আবাল্য নেশা হলেও নাগরিক জীবনের আলেখ্যে আমার রুচি উল্লেখযোগ্য ভাবে নিম্নমানের এবং তা অদ্যাবধি ।
আমার তৃতীয় অগ্রজ অত্যন্ত ছোট বয়স থেকেই সাহিত্যচর্চা করত । আমরা দুজন পিঠাপিঠি ভাই । যে সময়টার কথা বলছি, তখন সে এবং তার সমমনস্ক বন্ধুরা কবিতা নিয়ে কিছু কিছু চর্চা করত, লিখতোও কখনো সখনো । সেই বয়সটা এবং ষাটের দশকের শুরুয়াতের সেই সময়টা কবিতারই প্রাবল্যের যুগ । রথীমহারথীরা তখন মধ্য গগনে । বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব, প্রেমেন প্রমুখদের প্রেরণায় নবীনরা ভীষণভাবে চঞ্চল । কিন্তু নবীনদের আলোচনার আসরে সম্পূর্ণ নির্বাক শ্রোতা হিসাবে আমার উপস্থিতি প্রায় নিয়মিত হওয়া সত্বেও তারা যে কবিতা পড়ত বা লিখত তার কিছুই আমার মগজে ঢুকত না । একমাত্র জীবনানন্দ ছাড়া অন্য কবিদের রচিত কাব্য কবিতা আমার কাছে ধাঁধাঁর মত মনে হতো । মনে হতো, তাঁরা যেন শব্দ নিয়ে, ছন্দ নিয়ে লুকোচুরি খেলছেন । সেই খেলায় আমি যেন চোর, ধরা পড়ে যাওয়া । তাঁদের এবং অগ্রজের ও তার বন্ধুদের রচিত কবিতার ধরতাইটাই থাকত আমার নাগালের বাইরে । এই সময়টা আমার খুব কষ্টের সময় ছিল । কবিতার প্রতি আকর্ষণ ঐ বয়সে থাকেই । কবিতা বুঝতে না পারা বা লেখার অসামর্থ্য, দুটো ব্যাপারের জন্যই প্রচণ্ড হীনমন্যতায় ভুগতাম । অনুভূতির যে রননে স্পর্শেন্দ্রিয় থেকে বৌদ্ধিক স্তর পার হয়ে অন্তরিন্দ্রিয়ে অলৌকিক আবেশের সৃষ্টি হয় তার দিশা খুঁজে পেতাম না । জীবনানন্দ বোধহয় প্রথম আধুনিক নামধারী কবি, যিনি তাঁর রূপসীবাংলার পঙ্ক্তিগুলোকে প্রায় ফেলে আসা অবস্থানের নির্জন ধান ক্ষেতের আলপথের মত সহজতায় আমাকে হাত ধরে কবিতার এক ভিন্ন উপত্যকায় নিয়ে গেছেন । অন্যথায় জীবিত বা মৃত কবিরা কেউই আমার সঙ্গে সেই সময় কোনো সেতুসংযোগ করেননি । অনেক হীনমন্যতার আগুনে পুড়ে, দগ্ধ হয়ে, তবে বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত, অজিত দত্ত, বুদ্ধদেব ইত্যাদিদের কিছু কিছু নাগাল পেয়েছি । কিন্তু আজও মনে হয়, আধুনিকতা বা উত্তর আধুনিকতা, যা আজকের বৌদ্ধিক যুযুত্স্যু, তার জটিলতা আমার জন্য নয় । সে-সবের বোধগম্যতায় প্রবেশের প্রস্তুতিপর্বের শ্রম এবং সাধনা আমি করিনি । সেক্ষেত্রে ত্রুটিটা আমারই, কবিদের নয় । আমার অভিজ্ঞতা বা বোধে আধুনিকতা, উত্তর আধুনিকতা ইত্যাদি ব্যাপারগুলোর যে কোনো গ্রাহ্য সংজ্ঞার্থ নেই তার জন্য আমার বোধ এবং মানস গঠনতন্ত্রই সম্ভবত দায়ী । স্বল্প অনুশীলনতো বটেই ।
অগ্রজ জীবনের নানান সরল এবং জটিল আলগুলি ঘুরে বিগত শতকের ষাটের দশক থেকে লেখালেখিকেই একমাত্র কর্ম হিসাবে অবলম্বন করেছে এবং অদ্যাবধি তা সচল । সম্ভবত একটা পর্যায়ে তাঁর মনে প্রতীতি জন্মেছিল যে, `গদ্যং নিকষাংকাব্যমংঅ'- কথাটি এক মহৎ সত্য । তদবধি তাঁর সাধনা তদনুসারী । এই সময় থেকেই আমি তার প্রায় সর্বক্ষণের তল্পিবাহক । পাঠক হিসাবে যেমন অন্ধ সমর্থক, লেখার স্বার্থে তথ্যের খুঁটিনাটি সরবরাহের কাঠবেড়ালিগিরি করার অহংকারও আমার ষোলআনা । তাতে তার কোনো লাভ হয় কী না জানা নেই, তবে আমার উপকার ঢের আর আনন্দও অপরিসীম । ওর সাহিত্যিক খ্যাতি আজ আর গল্প কথা নয় । এপারে ওপারে তার গুণমুগ্ধ পাঠক পাঠিকার সংখ্যা যে কোনো সমসাময়িক লেখক, গল্পকারের কাছে ঈর্ষার ব্যাপার । ব্যক্তি এবং সাহিত্যিক অভিজিৎ সেনের সঙ্গে আমার সহোদরত্ব ছাড়াও এমন একটা সম্পর্ক আছে যা সে বা আমি কখনোই খোল্সা করে কাউকে বোঝাতে পারব না । একটা হাল্কা কথা শুধু বলতে পারি, আমি তার ছায়া অনুসারী । তার লেখার প্রথম পাঠক যদি সে হয় দ্বিতীয়জন আমি । অন্তত, গত শতকের ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি । ঐ বছর থেকে আমার লেখালেখির বুড়ো বয়সের ছেলেখেলার শুরু, যা এখনও চলছে । কিন্তু অভিজিতের সামান্য দুএকটা ছোটগল্প ছাড়া, পাণ্ডুলিপির খসড়া থেকে ছাপা হয়ে বেরোনোর পর পর্যন্ত নাগাড়ে পড়িনি এমন একটা লেখাও পাওয়া যাবে না । এই সময়টা থেকেই আমার লেখার মানসিকতার বায়ু, পিত্ত, কফ ইত্যাদি কূপিত হওয়ায়, আমি আর আগের মত দ্বিতীয় পাঠক নেই । তবে তেমন কিছু বিচ্ছিন্নতাও নেই ।
বড় ভাই বড় মাপের লেখক হলে ছোটর পক্ষে লেখক হওয়া মুশকিল । বড়র প্রভাব প্রায় অনিবার্যভাবে, সেক্ষেত্রে, ছোটর ওপর পড়েই । সে কারণেই শুরু থেকে আমি তার ধারায় লিখতে চেষ্টাই করিনি । করলেও যে তা হাস্যকরই হতো, সে বিষয়ে আমি নি:সন্দেহ ছিলাম । সে ক্ষমতাই আমার হতো না । একারণেই কথাসাহিত্যের নির্ধারিত বিধি আমার লেখার ক্ষেত্রে রাখিনি । সেটা আমার মৌলিকতা না স্বতন্ত্রতা, তা নিয়ে বিচার পাঠকদের ।
আশির দশকের গোড়ার দিকে, একেবারে শুরুতে, আমি চাকুরিসূত্রে ছিলাম ঝাড়খণ্ডের নানান জঙ্লা এবং খনি অঞ্চলে । বেশির ভাগটা কেটেছিল তোপচাঁচি এলাকায় । তখন কাজ কম ছিল বিভিন্ন আরণ্যক জনজাতিদের উন্নয়ন-বিষয়ক । দীর্ঘদিন তাদের সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ হয়েছিল তখন । প্রখ্যাত সমাজকর্মী এবং লেখক মহাশ্বেতা দেবীর আদেশে ঐ সময় বেশ কিছু নিবন্ধ লিখেছিলাম, যেগুলো তত্কালীন `বর্তিকা' পত্রিকায় তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল । পরে নয়ের দশকে `কালান্তর' পত্রিকাতেও ধারাবাহিক বেশ কয়েকটা বেরিয়েছিল । আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় এবং শুভানুধ্যায়ী প্রয়াত সুনীল সেনশর্মা এবং শ্রী সুনীল মুন্সীর ইচ্ছায়ই ব্যাপারটা ঘটেছিল । ২০০৭ এর বইমেলায় `টাঁড় পাহাড়ের পদাবলি' নামে একটি ছোট বই গাঙচিল-এর প্রকাশনায় বের করা হয় । এছাড়া আদিবাসী / জনজাতিদের নিয়ে আর কিছু লেখার চেষ্টা করিনি । `কম্পাস' পত্রিকায় টাঁড় পাহাড়ের কড়চা নাম নিয়ে এই বইএর লেখাগুলি ধারাবাহিক বেরিয়েছিল । সেটা সম্ভবত ১৯৯৭ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত । এ সবই পরের কথা । বইয়ে বিষয়টি পুণ:বিন্যাসিত করা হয়েছিল ।
![]() অভিজিৎ সেন |
ওর সবচাইতে উল্লেখযোগ্য লেখাগুলো বের হয় এক্ষণ, প্রস্তুতিপর্ব, প্রমা ইত্যাদি কোলকাতা কেন্দ্রিক পত্রিকাগুলিতে । নিজের লেখালেখির প্রস্তুতির কথা বলতে গিয়ে অভিজিতের কথা এত বলার কারণ এই যে ওর একজন সফল লেখক হয়ে ওঠার এই পথপ্রস্তুতিটার সঙ্গে নিরন্তর যুক্ত থাকায় আমারও যেন একটা পরোক্ষ প্রস্তুতি ঘটে চলেছিল । তখন অবশ্য সেটা সজ্ঞানে আমি উপলব্ধি করিনি । আমি যদিও সে অর্থে কিছুই হয়ে উঠিনি । তথাপি যেটুকু যা হয়েছি, তার মিথোস্ক্রিয়ার স্বরূপটা এরকমই । অভিজিতের ধারার সঙ্গে আমার লেখালেখির ধারার কোনোরকম মিলই যে নেই, একথা আমার পাঠকেরা সবাই জানেন, কিন্তু তার মানে অবশ্যই এ নয় যে আমি তার কাছে আদৌ ঋণী নই । সে ঋণ আমার উপর তার লেখার প্রভাব জনিত নয় বটে, তবে তার স্বরূপটা যে মিথোস্ক্রিয়ার কথা বলেছি তার মধ্যে নিহিত, অথবা তা যে কী সেকথা আমি পরিস্কারভাবে নিজেই বুঝিনা, অথচ অনুভব করি ।
অভিজিতের লেখা আমার অসম্ভব ভাল লাগে । কিন্তু এরকম কখনোই আমার ইচ্ছে হয়নি যে ওইরকম লেখা মক্সো করি, অন্তত চেষ্টা করি । তার কারণ বোধহয় এই যে, আমি নিশ্চয় করে জেনেছি ব্যাপারটা সেরকম আদৌ হবার নয় । আমার এরকম একটা অনুভব আমার মধ্যে যেন অন্তর্লীন ছিলই যে তার উপলব্ধি, অভিজ্ঞতার অংশী আমিও এবং যেহেতু তার উপস্থাপনা চমত্কার, তাই আমার আলাদাভাবে প্রচেষ্টা সেক্ষেত্রে অধিকন্তু এবং অর্থহীন । কথাটা হয়ত হাস্যকর মনে হতে পারে, তবে কোনোমতেই তা অন্যের গৌরবে নিজেকে গৌরবান্বিত করার নির্বোধ অহংকার নয় ।
লেখালেখির জগতে আমার ঢুকে পড়াটা এতটাই আকস্মিক যে আমার পাঠকেরা কেউ বিশ্বাসই করতে চান না এর পিছনে আমার আদৌ কোনো প্রস্তুতি ছিল । এই আকস্মিক অনুপ্রবেশ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত কথা সাহিত্যিকেরা কেউ কেউ প্রায় সামনা সামনিই নানারকমভাবে `ডিম্ব' করার প্রয়াস পান, যদিও সেইসব প্রয়াস আমাকে প্রায় স্পর্শই করেনা, বলা যায় । তার কারণ এই নয় যে আমি তাঁদের ক্ষুদ্র বৃহৎ শব্দ কীলকের দ্বারা বিদ্ধ হইনা । তার কারণ এই যে, আমি প্রকৃতই তাঁদের ক্ষমতাকে শ্রেষ্ঠতর বলে বিশ্বাস করি, কেননা তাঁদের লেখা আমি পড়ি এবং তাতে মুগ্ধ হই । পক্ষান্তরে আমার নিজের লেখার দীনতা আমাকে সদা ম্রিয়মানই রাখে । সে যাহোক, এই সরস্বতীর পদ্মবনে মত্তমাতঙ্গের মত আকস্মিক অনুপ্রবেশের কথাটি এবার বলি ।
১৯৯২ এর শারদীয়া দেশ পত্রিকায় শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক তপন রায়চৌধুরী মশাইয়ের `রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিত চর্চা' নামক রচনাটি প্রকাশিত হয় । তার বাকি অংশ পরবর্তী রবিবাসরীয় সাহিত্যের পাতায় প্রকাশিত হয়ে সম্পূর্ণতা লাভ করে এবং যথাসময়ে পুস্তকাকারে পাঠকমন মোহিত করে । দেশ এর রচনাটি পড়ে আমি এবং আমার পরিবারস্থ জনেরা অসম্ভব পুলক এবং উত্তেজনা বোধ করি । সেবার পূজায় বাংলাদেশের বরিশালে গিয়েছিলাম । সেখানে এখনও আমার ভাঙাচোরা পৈত্রিক ভদ্রাসন এবং এখনও দাপুটে শ্বশুরালয় বর্তমান । এর আগে দীর্ঘ প্রবাসবাসের পর ১৯৮৬ সাল থেকে পূজায় ওখানে যেতে শুরু করেছিলাম । ১৯৮৬, ১৯৮৮, ৯০ এবং ১৯৯২ এই চার বছরের শারদী ভ্রমণই আমার কাছে বড় উত্তেজনাময় এবং প্রগাঢ় নস্ট্যালজিক হয়েছিল । এই সময়ের অভিজ্ঞতা ও মহার্ঘচেতনা উত্তাল করেছিল আমাকে । তাই তপনদার লেখা, আর সেই লেখার ভৌগোলিক অবস্থানে পায়ে হেঁটে ভ্রমণ আমার মধ্যে এমন এক আলোড়ন তুলেছিল যে তার পরিণতি মূককে বাচাল করল । অনতি-বিলম্বে আমি এক দীর্ঘ, প্রায় আশি পৃষ্ঠার পত্র লিখে, তপনদার অক্সফোর্ডের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম । সঙ্গে তাঁর পিতৃপুরুষের প্রাসাদ এবং মন্দিরাদির ফোটোও পাঠালাম । সেটা সম্ভবত ১৯৯৩ এর জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি হবে । কিছুদিন বাদে অত্তবড় চিঠিটার উত্তর এলো একখানা এযারোগ্রাম মারফৎ সামান্য কয়েকটি লাইনে । আর কী বিচ্ছিরি তার অক্ষরের চেহারা, যেন খেতে না পাওয়া ফড়িং ছবি হয়ে এযারোগ্রামটার গায়ে লেপ্টে আছে । চিঠির বিষয় বস্তুও সেইরকম - আমি কোন্ বাড়ির ছেলে, কোথায় থাকি ইত্যাদি । অমন চিঠিখানার এই জবাব ! শুধু একটা কথা ছিল শেষ লাইনে, আগামী জুন মাসে কোলকাতা আসছি । দেখা হবে । ভাবলাম, এটা ডাহা গুল । দেখাটা কীভাবে হবে ? উনিতো আর নিজে আমার কাছে আসবেন না । কোলকাতায় এলে আমাকেই তাঁর কাছে যেতে হবে । কিন্তু তিনি উঠবেন কোথায়, তা কী জানি ? ঠিকানাইতো জানাননি কিছু । অত্তবড় একটা রসালো পত্তর দিলাম ! মনে আশা ছিল বেশ সরেস একখানা জবাব পাব । যাঁর অত চমত্কার একখানা বই বাজার মাৎ করেছে, তার চিঠি না জানি কত্তো সুন্দর হবে । ভীষণ দমে গেলাম । মনে বেশ ভয়ও হলো একটু । ভয়টার কারণ, অধ্যাপক মানুষ, আমার ঐ ছ্যাব্লা বাচালতায় (বাখোয়াজিতে) যদি রুষ্ট হন । এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে জুন মাসের কথাটা ভুলেই গিয়েছিলাম । কিন্তু তিনি এসেছিলেন । তখন লিণ্ড্সে স্ট্রীটে আমার আপিস । ঠিকানাটা চিঠিতে দেওয়াই ছিল । সে কাহিনী আমার পাঠকেরা জানেন । আমার সেই আশি পৃষ্ঠার চিঠিই আমার লেখোয়াড়ত্বের প্রকৃত হাতেখড়ি । এবং সেটা তাঁরই অনুজ্ঞায় । পরে কিছু বর্ধিত আকারে একখানি কৃশ পুস্তকে তার পরিণতি, ততোধিক কৃশ মহাশয়ের একটি ভূমিকাসহ । পরবর্তীকালে `রোমন্থণ' ইত্যাদি রচনার একটি সংকলন বের হলে তিনি মূল পত্রটি সেখানেও ঠুঁসে দিয়েছিলেন । তো ওখান থেকেই শুরু বলা যায় । লেখাটি জনপ্রিয় হয়েছিল, যদিও তার মধ্যে ভুলের পরিমাণ ছিল লাগামছাড়া এবং আনন্দ পাবলিশার্সের দক্ষতাও তার বিহিত করেনি ।
এই অভিজ্ঞতাটা আমাকে সাহসী করলে আমি বরিশাল বিষয়ে আরও ছটি বই, ছোট বড়, পরপর লিখে ফেললাম এবং বন্ধুরা বলতে শুরু করল, `তাইলে এযাদ্দিনে ল্যাখক হইলা ?' এর নাম যদি `ল্যাখক' হওয়া হয়, তবে `হইলাম' । শুধু মনের মধ্যে একটা খচ্খচানি যেন কোথায় কী একটা ভুলভাল কিছু হয়ে গেছে । আমার পাঠকেরা বোধহয় আমাকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিয়ে ফেলছেন । নচেৎ সর্বমোট ছোটবড় দশখানা বই এর একখানাও লেখক হিসাবে আমার নিজের তৃপ্তির কারণ হলো না কেন ? যে বিষাদবৃক্ষ এবং সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম অগণিত পাঠক পাঠিকার ভালবাসা এবং প্রশংসায় আমাকে অভিভূত করেছে, পুরস্কার এনে দিয়েছে, তারও একটা পাতা ওল্টাতে ইচ্ছা করে না কেন ?
এই সব নিয়ে এখন যা লিখছি, আমার অন্যান্য লেখার মত তাও স্মৃতিচারণাই । আসলে স্মৃতি-আলেখ্য ছাড়া, অন্যকিছুই আমার মগজে বা কলমে আসেনা । সম্বলই নেই কিছু ।
(পরবাস-৪১, মে, ২০০৮)