• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৮ | এপ্রিল ২০২০ | প্রবন্ধ
    Share
  • নিতাই জানার কবিতা : দেবায়ন চৌধুরী

    ঘরের ভেতর ঘুরে বেড়ায় অসীম নিস্তব্ধতা।
    উঠোনেও কেউ নেই, এমন কী পায়ের ছাপও।
    কেবল মাঝে-মধ্যে ভেসে আসে জল পড়ার শব্দ আর
    মাকড়শার জাল কেঁপে উঠলে ভাবো, বাতাস
                        এবং তার চলাচল—দুটোই আছে।

    বি নিতাই জানার ‘পুরোনো পৃথিবীর কবিতার অনুকরণে’ লেখাটির প্রথম অংশ উদ্ধৃত করে শুরু হল আমাদের সহজপাঠ। আলোচ্য কবিতার দ্বিতীয় ভাগে পাই খাবারের খোঁজে মানুষের সমুদ্রে ভেসে যাবার কথা। ‘সুস্বাদু মাছের গন্ধ’ তাদের চঞ্চল করে। তারপর কবি নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করার সূত্রে বলছেন— “কেয়াপাতার নৌকো/ উত্তাল ঢেউয়ে ডুবে গেল : ওই ভেসে উঠছে আবার... ”। জীবন ও কবিতার সম্পর্কও কি তবে ডুবে যাওয়া আর ভেসে ওঠার? আমাদের চারপাশের পৃথিবী মনের মধ্যে যে আলোড়ন তোলে, তার শিল্পিত প্রকাশ খুব সহজসাধ্য নয়। দেখা ও দেখানোর সূত্রে অনিবার্যভাবেই এসে যায় কবির ব্যক্তিত্বের সন্ধান। আবহমান বাংলা কবিতার প্রাণস্পন্দনকে সার্থকভাবে আত্মস্থ করেই কবি নিজস্ব স্বরসন্ধানের চেষ্টা করেছেন। এবং সার্থকভাবে দার্শনিক প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন তাঁর অক্ষরপ্রয়াসকে। আরেকটি কবিতা পড়ি। কবিতার নাম—‘ভোররাতে’।

    ভোররাতে নিঃশব্দ শিয়রে এসে বসলেন বাবা।
    শেষ যাত্রাকালের তুলনায় কিঞ্চিত মোটাসোটা, প্রফুল্ল এবং শান্ত, তোমার
    মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে চাপাগলায় বলেন: খোকা
    বৌমার হাতের বাঁশকোঁড়ের রান্না এখনো আমার মুখে লেগে আছে, তুই
    অযথা কষ্ট পাচ্ছিস; বরং করিরগুলোয়
    শীত-গ্রীষ্মের দিনে নিয়ম করে জল দিবি।
    ভোরবেলার স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়! বাবার মৃত্যুর পর ছেলে স্বপ্ন দেখছে। চলে যাবার সময় আর স্বপ্নে বাবার শরীরে-মনেও পরিবর্তন এসেছে। সংসারের নানাবিধ গ্লানি আর নেই, দিনযাপনের ক্লান্তিও নেই। তাই বুঝি ‘প্রফুল্ল এবং শান্ত’? অদ্ভুত এক বিষাদ জড়িয়ে আছে কবিতায়, কিন্তু তা অভিভূত করেনি বক্তব্যকে। ‘বৌমার হাতের বাঁশকোঁড়ের রান্না’-র সংবাদ মূলত কাব্য। গ্রামীণ খাদ্যসংস্কৃতির নিদর্শন ধরা রইল লেখায়। ‘তুই অযথা কষ্ট পাচ্ছিস’—একথার মধ্যে ধরা পড়ে কপট রাগ কিংবা অনুচ্চার ভালোবাসা। বাঁশের কুঁড়িতে জল দেবার আদেশে মনে পড়ে বাঁশ শব্দটি এসেছে বংশ থেকে। বাঁশ গাছ সহজে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এই গাছের ছায়া যেমন সুনিবিড়, তেমনি তার উপযোগিতাও প্রচুর। বাঁশগাছে জলসিঞ্চনের মধ্য দিয়ে বংশপরম্পরাকেই বাঁচিয়ে রাখতে চান বাবা।


    || ২ ||


    আশির দশকের কবি নিতাই জানার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রিমথ’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। ‘লুব্ধক’ (১৯৯০), ‘বঙ্গাল’ (১৯৯২), ‘প্রাকৃতজনের পাণ্ডুলিপি’ (২০০১), ‘আমার কবিতা’ (২০০৬), ‘সুলেমানকে লেখা চিঠি’ (২০১১), ‘এক যে ছিল চাপা পড়া গাছ’ (২০১৭) এবং সাম্প্রতিকতম বই ‘আলোকপ্রাপ্তি’ (২০১৯) মিলে গড়ে উঠেছে তাঁর কাব্যভুবন। ‘প্রাকৃতজনের পাণ্ডুলিপি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি ২০০৫ সালে বীরেন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঙ্গভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর, পেশাগত জীবনে শিক্ষকতার ব্রতে দীক্ষিত কবি নিতাই জানা রাজনৈতিক বীক্ষায় গান্ধীবাদী। ‘দূর মফস্বলে বসে, প্রচারমাধ্যমের অবলম্বনকে কোনোরকম তোয়াক্কা না করে’ নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। তিনি একাধারে কবি ও প্রাবন্ধিক। ‘পোস্টমডার্ন ও উত্তর আধুনিক বাংলা কবিতা পরিচয়’ (২০০১) গ্রন্থটি তাঁর বিদ্যায়তনিক গবেষণার ফসল। ‘দক্ষিণ-পশ্চিম বাঙ্গলা ভাষা এবং’ (২০১৭) ও ‘বঙ্গাব্দ’ (২০১৭) বইদুটি বিষয় ও প্রকাশে অনন্য হয়ে উঠেছে। সংকলন করেছেন — ‘পোস্টমডার্ন বাংলা কবিতা’ (২০০৭)। বোঝাই যাচ্ছে, নিতাই জানার কবিতার নন্দন দীক্ষিত পাঠকের মনোযোগ দাবি করে। ‘আমার কবিতা’ বইয়ের ব্লার্বের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করতে ইচ্ছে করছে—

    হৃদয়সংবাদী এসব কবিতা যেন একটি ভ্রমণ। গল্প গল্পাভাস নাটক কবিতার বয়ানে যেমন ধরা রইল, বহু পাঠপ্রসঙ্গ ঘোষণাহীন প্রখরতায় তেমনি সহৃদয় সামাজিক। আর গড়ে উঠেছে এক বহুস্বরিক আনন্দ। স্বপ্ন কল্পবাস্তব এখানে স্থান পরিবর্তনে অনলস উৎসাহী। কী বলছে নয়, বরং কীভাবে কথনটি পরিবেশিত—সেই বুনন এ লিখনে তুমুল। ...
    ‘সুলেমানকে লেখা চিঠি’ বই সম্পর্কে বলা হয়েছিল—
    এ সব কবিতার পাঠপ্রসঙ্গ যেন ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকা এক আনকো জগৎ, লোককথার মতোই সুপ্রাচীন। অতিকল্পনা এবং বাস্তব, প্রি-হিস্টোরিক, হিস্টোরিক আর সাম্প্রতিক, হিউমার টেরর সামাজিক সপ্রাণ জীবনের মতো পরিবর্তনশীল, গতিময় হয়েও আনুভূমিক কাণ্ডের মতো স্থায়ী। এখানে কবিতা কিছু বলতে চায় না, কেবল বহুস্বরিক দৃশ্যের ভিড়ে একলা ব্যক্তির কথন কখন যেন অনির্দেশ্যতায় অথবা আয়রনির নৈঃশব্দ্যে সচকিত করে।
    ‘আলোকপ্রাপ্তি’ বইয়ের ব্লার্বে এসেছে কবির অনুপস্থিতির প্রসঙ্গ—
    প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষ উল্লিখনে এ গ্রন্থের কবিতাগুলি পাঠকের জ্ঞান আর অভিজ্ঞতার সমোত্তলে উঠে গিয়ে নেমে দাঁড়ানোর ইচ্ছায় তুমুল। কবি কোথাও নেই! এমনকি, তাঁর ছায়া কিংবা প্রচ্ছায়াও অনুপস্থিত। আসলে, কিংবদন্তি অথবা পুরাণ-ইতিহাসের বর্মে এ সব কবিতা একালের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ। অসেতুসাধ্য মানসিক দ্বীপান্তরে পাঠককে না পাঠিয়ে আলোকপ্রাপ্তি আকস্মিক পাওয়া প্রসঙ্গের পর প্রসঙ্গে হিউম্যান সারভাইভালের আশ্বাসে আনাগারিক। পাঠক, আসুন, আমরা এখন কবিতা পাঠ করি।

    || ৩ ||

    আনন্দ

    সুগতর দুঃখ ছিল একটাইঃ আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও সমস্ত হিংসা এবং যুদ্ধের নিরোধ হল
    না। হয়তো সুদত্তরও অনুতাপ ছিল : স্বর্ণখণ্ড বিনিময়ে জেতবন না কিনে পৃথিবীর সকল
    অনাথকে চিরকাল পিণ্ড দিতে পারলে নিভে যেত দীপ। কিন্তু অগ্রধৃতিমান আনন্দ সারারাত
    বৈশালী নগরীর চতুর্দিক ঘুরে কমণ্ডলু থেকে জল ছড়াতে ছড়াতে প্রার্থনা করেন রতনসুত্ত।
    একসময়, ভোরের আলো আঁকড়ে বিকিরণে মেতে উঠল বৃষ্টিভেজা গাছের পাতারা।
    কবিতার কি শেষ হয় আদৌ? নাকি যতটুকু না বললে নয়, সেখানে থেমে যাওয়াই কবির অভিপ্রায়? গৌতম বুদ্ধ, শ্রাবস্তী নগর, যুবরাজ জেতের স্বর্ণমুদ্রার প্রসঙ্গ ছুঁয়ে এই কবিতা যেখানে শেষ হয় সেখানে সকল দ্বন্দ্ব বিরোধের মধ্যে জেগে ওঠে প্রবল প্রাণশক্তি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আশ্বাসবাণী’ লেখাটির কথা মনে পড়ে। তিনি অভয় দিচ্ছেন—সভ্যতার অনবরত ধ্বংসলীলা, মৃত্যুর হাহাকারের মধ্যেও মানুষের কল্পনা যে স্বর্গ খুঁজে পাবে, তা হয়ত ‘একটা কোথাও শান্তির পথ নির্দেশ করছে।’

    শালবনে বৃষ্টি হয়ে গেছে রাতে। সকালবেলায় কবি জেগে উঠে দেখছেন, ‘অরুণ আলোর সঙ্গে মালতীবনের প্রচুর সখ্য চলছে... এই রূপের ধারায় বিচ্ছেদ নেই।’ সংসার দুঃখময়। দুঃখের মূল কারণ বিষয়তৃষ্ণা। তৃষ্ণা থেকে আসে আসক্তি। আসক্তি থেকেই জন্ম এবং রোগ-শোক-দুঃখভোগ। জন্মের বন্ধন থেকেই মুক্তি পেতেই হবে। বৌদ্ধদর্শনে নির্বাণের প্রস্তুতি হিসেবে আমরা পাই অষ্টাঙ্গিক মার্গের কথা—সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্মান্ত, সম্যক আজীব, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি। ‘সর্ববিষয়ের যথার্থস্বরূপ সম্পর্কে স্মৃতিকে জাগ্রত রাখা’ যদি সম্যক স্মৃতি হিসেবে কথিত হয়, তবে কবিতার দৃশ্যাবলী নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করে।

    ‘আলোকপ্রাপ্তি’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘ভারতকথা’য় কবি লিখছেন—

    ভারতকথার জরাসন্ধ হয়ে যেতে যেতে মনে পড়ে তোমার
    রোহিণী নদীর জলের দাবীতে যুযুধান
    কোলিয় আর শাক্যগণ।
    হঠাৎ কোথা থেকে এসে দুটি হাত ঊর্ধ্বে তুলে ঠিক মাঝবরাবর
    দাঁড়িয়ে পড়লেন মৌন
    তথাগত!
    আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের একাধিক কবিতায় বুদ্ধের জীবনের কথা এসেছে। ‘এক আত্মমগ্ন ধ্বনির অনুভব’ হিসেবেই নৈঃশব্দ্য রচিত হতে থাকে। এরই সূত্র ধরে মনে পড়তে পারে জেন-কবিদের জীবনসত্যের মরমিয়া পরিশ্রমী অন্বেষণ। চলুন আমরা পড়ি ‘শিলালিপি’ কবিতাটিকে—
    ধীমান তুমি
    বুঝে উঠতে চাইছিলে প্রাচীন শিলালিপি।
    এমন সময় তোমার পিঠে হাত রাখে কেউ।
    পেছন ঘুরে দ্যাখ, রাজা অশোক!
    আলো চলে গেল হঠাৎ।
    অন্ধকারে ভেসে এল চাপাপড়া ক্ষীণ স্বর :
    রাখাল গরু চরায়। কিন্তু,
    গরু কি রাখালের?
    এই কবিতাটিকে নির্দিষ্ট কোনো বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করতে পারব আমরা? বাংলা কবিতার রোম্যান্টিক ঘরানা থেকে, ছন্দের টুংটাং-নস্টালজিয়া-বিষাদ-প্রেম-সম্পর্কের একঘেয়ে পরিসর থেকে সচেতন প্রস্থানের মধ্য দিয়ে কবি তাঁর মতো করেই এক জগৎ নির্মাণ করেন। যেখানে আমাদের অস্তিত্বকে বারবার প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করানোর খেলা চলে। ইতিহাসচেতনার সঙ্গে যুক্ত হয় পুরাণ। বর্তমানের আয়না হয়ে ওঠে সত্তার গভীর থেকে উঠে আসা জীবনবোধ। জীবন যন্ত্রণাময়। কিন্তু তার ভেতরেও শান্তি আছে। ধুলোখেলার মধ্যেই অনন্ত স্বর্গের সিঁড়ি। বুদ্ধের অহিংসা নীতিকে আন্তরিকভাবে লালন করা কবি, গান্ধীবাদের প্রায়োগিক দিকের মধ্যেই যে খুঁজে নেবেন তাঁর নিজস্ব পথ — এ যেন পূর্বনির্ধারিতই ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামী পিতার উত্তরাধিকার সার্থকভাবে বহন করে নিতাই জানা শুধু কবি নন, কর্মীও বটে। তাঁর কবিতার রাজনীতি নিয়ে স্বতন্ত্র আলোচনা হতে পারে, আমরা কেবল দু-একটি প্রসঙ্গ ছুঁয়ে যাচ্ছি।


    || ৪ ||


    ‘সুলেমানকে লেখা চিঠি’ কাব্যগ্রন্থের ‘বঙ্গদর্শন’ কবিতার শুরু হচ্ছে এইভাবে—

    যেদিন এম এল এ সাহেবকে এক কোমর জলে হাঁটিয়ে
    কাদা মাখিয়ে এলোমেলো করে দিল হিঙ্গলগঞ্জের আইলা পীড়িত মানুষ, সেইদিন
    সন্ধ্যার নির্মল আকাশে ভেসে উঠল একাদশীর চাঁদ
    ‘পোস্টমডার্ন বাংলা কবিতা’ সংকলনে মন্তাজের আলোচনায় কবি নিতাই জানার বক্তব্য এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক মনে হয়—
    আধুনিক কবিতায় ইমেজ বা কল্পচিত্র বিশেষ একটি ভাবনাকে বিচ্ছুরিত বা সঞ্চারিত করতে তৎপর ছিল। কিন্তু তাতে বিরোধ বা সংযুক্তি ছিল না। তুলনায় মন্তাজ পাশাপাশি বসে থাকা ছবিগুলির সংযোগ কিংবা দ্বন্দ্বে বিরোধকে প্রকট করে যে ভাবনায় উত্তরিত হয়—তাতে ঘাতের পরিবর্তন ঘটে। তাই মন্তাজ ‘a particular process in creative assemblage of shots from which the greatest, finest and furthest result comes out.’ (বাণীশিল্প, ২০০৭, পৃ: ১২৮)
    ‘প্রতিমুহূর্তে বিরোধময়’ মন্তাজের দেখা আমরা পাই এই কবিতাটিতেও। নান্দনিক বহুত্ব কবির অভিপ্রেত, আর এই বহুস্বরিক কাব্যভুবনে সংশ্লেষ ঘটেছে পুরাণ, ইতিহাস, রাজনীতি... বিভিন্ন বিষয়ের। কখনো কবিতা সংলাপ চালিয়েছে অন্য কবিতার সঙ্গে। আমাদের কবিতাপড়া নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছে। যেমন ‘খোঁজ’ কবিতাটি—

    সুভাষ মুখোপাধ্যায়-এর স্বাগত কবিতা-পড়ানো শেষ হতেই
    দশম শ্রেণীর লাস্ট বেঞ্চ থেকে মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুলের শীর্ণ কালো ছেলেটি
    ক্ষীণ অথচ প্রতিবাদী কণ্ঠে সবিনয়ে বলে, স্যার,
    বীজ বুনে-জমি ফেলে রেখে চলে গেলে ধান নয়; ঝাড়া-ঘাসের জঙ্গল হয়!
    ধান অনেক মেহনতের ফসল।
    আমি একজন মজুরের ছেলে, নিজেও মজুর খাঁটি;
    বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, জনহীন গ্রাম-জমির
    পাকা ফসলের যে ভরা-ছবি কবি দেখছেন—তা নিতান্ত শহুরে কল্পনা।

    কবিতার ক্লাসে আচমকা আঘাত শুধু কথককেই নয়, আমাদের মধ্যবিত্ত মননকে পীড়িত করে। ‘পিরিঅড শেষের ঘণ্টাধ্বনি’ আপাতভাবে পালাবার পথ করে দেয় শিক্ষককে। কিন্তু সারাদিন ধরে ছেলেটির উজ্জ্বল চোখ আর ‘বিনীত শ্লেষ’ কিছুতেই স্বস্তি দেয় না। ছাত্রের কথার কোনো সমাধান তন্ন তন্ন করেও উঠে আসে না পাঠ্য কবিতার শরীর থেকে। ছুটির বাঁশি বাজে। রাস্তার দু-পাশে সবুজ ধানের ক্ষেতে তখন পড়ন্ত সূর্যের আলো খেলা করছে, কথক স্টেশনের পথে যেতে যেতে দেখেন—

    অল্প জলের ওপর ঋজু পুরুষ্টু কালো কালো ধানের গোছা।
    যেন সেই ছেলেটির রোগা আঙুলগুলি
    এই মাত্র ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে রেখে গেছে ফলের আশায়।
    সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতাটি শেষ হয়েছিল ‘মাঠের সম্রাট’-এর মুগ্ধ নেত্রে ধান আর ধান দেখার মধ্য দিয়ে। আর এই কবিতায় সোনালি ফসল নয়, বরং তার প্রস্তুতিই বড়ো হয়ে উঠল। কালো কালো ধানের গোছাকে সেই ছেলেটির রোগা আঙুল বলে সংশয় হচ্ছে। সম্ভাবনাবাচক শব্দের উপস্থিতি রয়েছে। বুঝতেই পারছি এটি বাচ্যোৎপ্রেক্ষা অলংকার। যেন ধান দেখছি না, দেখছি রোগা আঙুলগুলি—কবিতাটি সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেল ভাবনার দিক থেকে। কবিতার শিক্ষক ও ছাত্র আসলে কবি ছাড়া আর কেউ নন। অনুভবকে ব্যক্ত করার জন্যই হয়ত এই সংলাপের আয়োজন। মধ্যবিত্ত লেখকদের শ্রেণীগত অবস্থান ও অভিজ্ঞতার অভাবে বাংলা সাহিত্যে মাটির কথা বাস্তবসম্মতভাবে উঠে আসেনি, এটা সত্য। জীবনের অভিজ্ঞতা না থাকলে সেই ফাঁক পূরণ করতে হয় কল্পনা দিয়ে; এবং সেখানে অনিবার্যভাবেই বিচ্যুতি গ্রাস করে। সাহিত্যে বাস্তবতা সেক্ষেত্রে একান্তই আরোপিত। ‘পূর্বমেদিনীপুর থেকে ধৃতিকণাকে লেখা চিঠি’ কবিতায় কবি লিখছেন— “… এও কি সেই গত শতকের গ্রাম দিয়ে শহর/ ঘেরার নতুন কোনো গল্প! অনুভূতিহীন, অদীক্ষিত আমি বুঝতে পারি না।” না বোঝার যন্ত্রণা নিয়ে তিনি ‘উইডো পোয়েট’ ধৃতিকণাকে চিঠি লেখেন। যার স্বামীকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছিল। তবু ভিটে আগলে থেকেছেন সাহসিনী। তাঁর স্কুলে এখনও বাচ্চারা অতুলপ্রসাদের গান গেয়ে প্রার্থনা করে—‘হও ধরমেতে ধীর…’। ইতিহাসকে নিরাসক্ত ভাবে দেখতে চাইছেন কবি। ছবির পর ছবি, গল্পের পর গল্প— কিন্তু কোনো মত চাপিয়ে দিতে চাইছেন না তিনি। বিনম্র উচ্চারণে শুধু বুঝতে চাইছেন অস্তিত্বের জটিল বিন্যাসকে। ‘জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের নিহত মানুষ-জনের স্মৃতির প্রতি’, ‘স্বপ্নে পাওয়া শান্তি মিছিল’, ‘কাল্পনিক’ প্রভৃতি কবিতার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে নন্দীগ্রাম—এক বিস্তৃত সময়পট উঠে আসে তাঁর লেখায়। প্রতিরোধের শান্তিমিছিলে বন্দুকের নলের উপস্থিতি বাস্তবতার এক আশ্চর্য বয়ান হাজির করে। কবিকে শেষপর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্বাসেই আটকে রাখা যায় না। সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘আলোকপ্রাপ্তি’-র নাম কবিতায় এসেছে মুক্ত একক প্রাণের কথা— ‘আমার অনুভব আমার কাছে।’ প্রায় দশ বছর আগে লেখা ‘আত্মকথা’ কবিতাটির শেষ অংশ এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে—
    নিজের মতো বাঁচবো,
    মুক্ত, সহজাত একক দক্ষতায়, এক হতচ্ছাড়া সাংসারিক
    ভারতীয়, এবং ককুদ-ঝোলা বৃষ
    মানুষের পায়ে চলা পথে...

    || ৫ ||


    কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত সম্পাদিত পত্রিকায় একাধিক কবিতা ছাপা হয়েছে কবি নিতাই জানার। ‘অলিন্দ’-র শেষ সংখ্যায় (শীত ১৪০০) সম্পাদক তাঁর সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন—

    যা আত্মগত, মগ্ন, কম্পমান, প্রতীক-চিত্রকল্পের কম্পমান আলোছায়া, তাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় ক’রে যে টানটান শুকোতে দেওয়া চামড়ার মতো কবিতা তৈরী হয়, তা-ই কিন্তু উত্তর-আধুনিক কবিতা।
    প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই সংকলনে ‘ছোটনাগপুরের ভোর’ শীর্ষক একটি কবিতা লিখেছিলেন কবি এবং যা উৎসর্গ করা হয়েছিল কবি-পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে। লেখাটির শুরু হয়েছিল এইভাবে—
                     মুখোশের মতো তবু মুখ
                     যে রকম আয়নায় আমি
       ভেসে উঠছি অবিকল ভেসে উঠছে একটি মানুষ
         অথবা একটি বাঘ অথবা একটা গোটা দেশ
              খিদে পেটে নেচে যায় যেন ঝুমঝুমি
    আরেক গ্রহের থেকে আলো এনে সাজিয়েছে হারানো স্বদেশ
    ‘হারানো স্বদেশ’ অনুসন্ধানের সূত্র ধরেই তাঁর কবিতা আত্মস্থ করে চলে লোকায়ত চেতনাকে। চর্যাপদ থেকে মঙ্গলকাব্য, প্রাকৃত রচনা থেকে উনিশ শতকের উপন্যাস, বুদ্ধ থেকে রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ থেকে আখতারুজ্জামান— সংশ্লেষ ও সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে গড়ে তোলে তাঁর কাব্যভুবনকে। শব্দের থেকেও যেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে নৈঃশব্দ্য। আকাশের তারার মতো মুক্ত টেক্সট লিখনের মধ্যে সযত্নে লালন করে অজস্র কূটাভাস। অক্ষরের সমুদ্রে ডুবতে ডুবতে পাঠকের ‘তখন মনে হয় কোথায় পূর্ব/ কোন দিকেই বা পশ্চিম!’
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments