আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র-পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত একাধারে কবি ও 'কথাকার'। গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের বাংলা কবিদের মধ্যে বুদ্ধদেব অগ্রগণ্য। যদিও চলচ্চিত্র ক্রমশ ভাগ বসিয়েছে তাঁর কবিতার সাধনায়, বুদ্ধদেবের কাছে কবিতা আর চলমান চিত্রমালায় বিরোধ নেই কোনো। বুদ্ধদেব-প্রণীত চলচ্চিত্র সম্মানিত হয়েছে দেশে ও বিদেশের নানান চলচ্চিত্র উৎসবে। আথেন্স এবং স্পেন-এর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পেয়েছেন ‘লাইফ-টাইম অ্যাচিভমেন্ট’ পুরস্কার। একাধিকবার ভারতের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালকের 'স্বর্ণকমল পুরস্কার' লাভ করেছেন। পালন করেছেন সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালকের পদ। সাম্প্রতিক সময়ে যেমন প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নতুন কবিতার বই ‘ভূতেরা কোথায় থাকে’, তেমনি মুক্তি পেয়েছে নতুন ছবি ‘টোপ(*)’। দুই মাধ্যমে এখনও সমান সক্রিয় বুদ্ধদেবের কাছে ‘পরবাস’ হাজির হয়েছিল এই গ্রীষ্মের এক সন্ধ্যায়। সামান্য দু-এক কথায় লক্ষ্য ছিল শিল্পী-বুদ্ধদেবের চেতনাজগতের স্পর্শ পাওয়া। কিন্তু সেদিন তিনি উজাড় করে দিয়েছেন তাঁর স্বপ্ন-সময়-ভালোবাসা। পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হবে সে কথকতা। আপাতত প্রথম পর্ব।
পরবাস : আপনার ছোটবেলার কথা, বেড়ে ওঠার দিনগুলি, সেই সময়ের কথা একটু বলুন…
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : আমার বাবা ছিলেন সরকারি ডাক্তার। আমাদের আদি বাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গ, বিক্রমপুর। বাবা মেডিকেল কলেজে পড়তে এখানে চলে আসেন। তারপর দেশভাগের পর আমার মামাবাড়ি চলে আসে কলকাতার হাজরা রোডে। তখন হাজরা রোড অদ্ভুত এক রাস্তা ছিল, বুঝেছো! আমাদের ছোটবেলায় গরুও যেত ওখান দিয়ে। আর বিভিন্ন সব জিনিস বিক্রি করতে করতে ফেরিওয়ালা যেত। এবং ওই ফেরিওয়ালাদের ডাক শুনে আমরা বুঝতে পারতাম কটা বাজে। তখন পূর্ববঙ্গের অনেক ধরনের খাবার বিক্রি করত ফেরিওয়ালারা। যেমন বাখরখানি। তোমরা নাম শুনেছো, খাওনি কখনো। এখন তৈরি হয় না। ওখানকার লোকজনেরা এসে বাখরখানি তৈরি করতেন, বাখরখানি বিক্রি করতেন। বিনিময়ে কি নিতেন? এইভাবে ছোটবেলাটা কেটেছে। কিন্তু ছোটবেলা আমার কাছে অসামান্য এ-কারণে... আমার বাবার দৌলতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থেকেছি। সেখানকার মানুষজন, সেখানকার সংস্কৃতি, পরিবেশ আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। আমার মনে হয় আমার ছোটবেলা যদি ওরকম না হোত আমার খুব সমস্যা হোত। যদি কলকাতায় বড় হতাম, ভাগ্যিস কলকাতায় বড় হইনি! আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি যে আমি কলকাতা শহরে জন্মাইনি। কলকাতা শহরে আমি বেড়ে উঠিনি। আমার জন্ম পুরুলিয়া থেকে দূরে আনারা বলে একটা গ্রামে। ওটা তখন গ্রাম ঠিক ছিল না একটা রেলওয়ে কলোনি ছিল, বসতি ছিল। সেখানে লাইনের এক ধারে সাহেবরা থাকতেন, আর এক ধারে ভারতীয় কর্মচারীরা। তো সেখানে ডাক্তার বলতে মূলত একজন, বাবা। বদলি হয়ে এলেন। তারপর বিভিন্ন জায়গায় থেকেছি আর আমি ভেতরে ভেতরে ভয়ঙ্কর ঋদ্ধ হয়েছি। প্রত্যেকটি জায়গায় আমি দেখেছি তার নিজস্ব একটা সংস্কৃতি আছে। মানুষজনের ভাষা পাল্টে গেছে জায়গা বদলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে। শুধুমাত্র তাই নয়, সংস্কৃতি বদলেছে। জীবনচর্চা বদলেছে। এগুলো আমি দেখেছি খুব কাছ থেকে। দেখেছি প্রকৃতিকে। প্রকৃতিকে ভয়ংকর ভাবে ভালবাসতে। যেমন ধরো, আমরা থাকতাম বিন্ধ্যপর্বতমালার খুব কাছে মনীন্দ্রগড় বলে একটা শহরে।
পরবাস : খড়গপুর থেকে আপনার বাবা ওখানে বদলি হয়েছিলেন?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ। খড়গপুর থেকে বাবা ওখানে বদলি হয়েছিলেন। মনীন্দ্রগড়ে বাঘ ডাকত। ওখানে বাঘের ডাক শুনেছি। আমাদের খাঁটি দুধ খাওয়াবেন বলে মা একটা গরু কিনলেন। আর সেই গরু পালন করার জন্য একজনকে নিয়োগ করা হল। সুখলাল ছিল তার নাম। তো সুখলালের কাছে গল্প শুনতাম নানান ধরনের। মাঝে মাঝে বিন্ধ্যপর্বতে আগুন ধরে যেত। জঙ্গলের যে আগুন। আমার ছোটবেলা ওইরকম না হলে আমার খুব অসুবিধে হত। আমরা খেলতাম। তখন তো খেলার কিছু ছিল না। খেলনা নিজেদের তৈরি করতে হত। কী খেলব সেটা নিজেরাই ভেবে নিতাম। এখন ভাবতে হয় না। এখন ক্রিকেট আছে, আরও অনেক ধরনের খেলা আছে। আমাদের সময় সেসব ছিল না। ভেবে নিতে হত আমরা কি খেলব। যেমন ধরো মনীন্দ্রগড়ে ওই জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো একটা খেলা ছিল আমাদের। আলো ছিল না। বাবা ডাক্তার ছিল বলে বাবার জন্য দুটো পেট্রোম্যাক্স একজন কর্মচারী এসে দিয়ে যেত। আর অন্যান্য ঘরগুলোতে মা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে দিতেন। কখনো কোন কিছুর অভাব বোধ করিনি। মানে ইলেকট্রিসিটি নেই বলে খারাপ, ফ্যান ঘুরছে না বলে খারাপ মনে হয়নি। কিন্তু ভয়ংকর ভালো লাগত ছোটবেলাটা। ছোটবেলাটা ওরকম হয়েছিল বলেই এটা হত। আর একটা ছিল ছোটবেলায় একা থাকা। আমার কাছে একা থাকাটা, মানে একা জীবনযাপন করার কথা বলছি না, সেটা পারতাম না আমি। কিন্তু মাঝে মাঝেই একা হয়ে যেতাম। একা থাকতাম। এখন তো একা থাকা যায় না। ফোন আসে, সেলফোন বাজে, টেলিভিশন চলে, লোকজন আসে। তখন ওসব ছিল না। ওই একা থাকাটা আমার কাছে একটা অদ্ভুত অনুভূতির রাজ্যে পৌঁছে দিয়েছিল। যেমন ধরো আমার মা কবিতা পড়তেন। আবার গান বাজাতেন। বাজিয়ে বাজিয়ে আমাদের শোনাতেন। সুর শোনাতেন, গান শোনাতেন। আমি চোখ বুজে সুর শুনতাম। চোখ বুজে কবিতা শুনতাম, মা পড়তেন। তো ইমেজগুলো ওখান থেকে আসতো। এই ইমেজ তৈরি করার একটা খেলাঘর ছিল আমার ছোটবেলা। চোখ বুজে শোনাটা আমার অভ্যাস হয়ে গেল। এখনো চোখ আমার বুজে যায় সুর শুনলে। এই যে ইমেজগুলো আসে সেগুলো একদম আমার নিজের। তার সঙ্গে যোগাযোগ আছে আমার ছোটবেলার অনেক কিছুর। যেমন ধরো ‘লাল দরজা’ বলে ছবিতে একটা পোকার গল্প আছে। সেটা আমাদের খেলা ছিল।
পরবাস : আপনার আর আপনার দিদির?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত :
হ্যাঁ। আরও সঙ্গীসাথীরা ছিল। ‘ছোটি মোটি পিপড়া বোটি তেরে মামা লাড্ডু লায়া লাল দরজা খোল দে, লাল দরজা খোল দে’। তারপর ধরো চিঠির বাক্সে কান দিয়ে, এটা ‘উত্তরা’য় তুমি দেখবে, ঐ কথাগুলো শোনা।
ওটা একটা খেলা ছিল। …ওরকম বাক্স-ঝুলতো গাছে। সেখানে চিঠি ফেলত সমস্ত লোকজন। আর আমরা কান দিয়ে শুনতাম। কি বলছেন? আমরা বানিয়ে বানিয়ে নানারকম কথা বলতাম। ওই খেলাগুলো এসেছে ‘উত্তরা’ ছবিতে। তারপর যেমন ধরো বাঘ নাচ। আমাদের সময় খড়গপুর শহরে প্রথম দেখি বাঘ নাচ। ওরা এক মহল্লা থেকে আর এক মহল্লায় ঘুরে ঘুরে বেড়াত। সে সাংঘাতিক নাচ, ওর সঙ্গে বাজনা। ওরাই ছিল আমাদের হিরো তখনকার সময়। এই বাঘ নাচের কথাও এসেছে আমার ছবিতে। তা এইভাবে আমার ছোটবেলার গল্প শেষ হয় না।
পরবাস : মানে একটা নিবিড় অনুভূতির রাজ্য ছিল……
বুদ্ধদেবদাশগুপ্ত : হ্যাঁ, যেটা never ending ব্যাপার একটা
পরবাস :এবং যেটা আপনার সবচাইতে বড় স্টোরহাউসও…
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ। স্টোরহাউস সিনেমার জন্যে। কবিতার জন্যে। ওটা না থাকলে খুব মুস্কিল হত। ফলে আমার ছোটবেলা যখন বড়বেলায় এসে মিশল তখন অনেক কিছু ছেড়ে যেতে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এইগুলো সঙ্গে চলে এসেছিল। এবং এগুলোর সঙ্গে আমি আজও বড় হচ্ছি।
পরবাস : কলকাতায় কলেজে যখন পড়তে শুরু করলেন স্কটিশে তো পড়তেন আপনি। ইকনমিক্স পড়তেন। স্কটিশচার্চ কলেজ তো সাংস্কৃতিক দিক থেকে খুব সমৃদ্ধ একটা জায়গা ছিল।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, হ্যাঁ স্কটিশচার্চ সেইসময় খুব ভালো কলেজ ছিল। ভীষণ ভালো।
পরবাস : কেয়া চক্রবর্তী কি আপনাদের সিনিয়র ছিলেন?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, কেয়া চক্রবর্তী আমাদের সিনিয়র ছিল। বেশ খানিকটা সিনিয়র। আমি দেখিনি। আমি গল্প শুনেছি। কিন্তু আমার সময়েও স্কটিশচার্চ সাংস্কৃতিক দিক থেকে খুবই উজ্জ্বল পড়াশোনার কেন্দ্র ছিল। যেখানে আমরা শুধু পড়াশোনাই করতাম না, এগুলো নিয়েও কথাবার্তা বলতাম।
পরবাস : নাটকের একটা ব্যাপার ছিল…
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, নাটকের ব্যাপার ছিল। আর ইকনমিক্স আমি পড়তে গিয়েছিলাম যেহেতু বাবা আমার পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পড়ার বিষয়ে সম্মতি জানান নি।
পরবাস : লিটারেচার পড়তে আপনার ইচ্ছে করেনি?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : না। বাংলা বা ইংরেজি সাহিত্য পড়তে আমার ইচ্ছে করেনি। এই কারণে যে এগুলো আমি পড়তেই পারি। আমাকে লিটারেচার পড়াবে কে? আমি তো নিজেই পড়বো এগুলো। এগুলো তো পড়তেই হয়। কিন্তু বিষয় হিসেবে আমি বেছে ছিলাম ইকনমিক্স। প্রেসিডেন্সিতে আমাকে নেওয়া হয়নি এই কারণে, নিতে গেলে আমাকে অঙ্ক নিতেই হত।
পরবাস : ও, সাবসিডিয়ারি সাবজেক্ট হিসেবে।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : সেটা আমি নিলাম থার্ড ইয়ারে উঠে, স্কটিশে। সেই সময় তরুণদা আমাকে খুব হেল্প করেছিলেন।
পরবাস : তরুণ সান্যাল ?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ। তরুণ সান্যাল ছিলেন আমাদের স্ট্যাটিস্টিকসের টিচার। তরুণদা স্ট্যাটিস্টকস এত সুন্দর পড়াতেন! আর তরুণদার ক্লাস মানে অসামান্য ক্লাস। পড়াতে পড়াতে কোথায় কলেজের ওই ঘর থেকে আমরা বেরিয়ে পড়তাম, ক্লাসের মধ্যে থেকে আমরা বুঝতে পারতাম না। উনি ফিজিক্স পড়াতেন। ফিজিক্সের বিভিন্ন থিওরি নিয়ে গল্প করতেন। আর বলতেন ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের কথা। সংগীতের প্রতি আমার কিছুটা ভালোবাসা ছিল। নিজে না চর্চা করলেও সংগীতের প্রতি একটা আজন্ম ভালোবাসা ছিল। স্কটিশের গা ঘেঁষে ছিল তরুণদার ফ্ল্যাট। সেই ফ্ল্যাটের কোণায় ছিল ডাঁই করা রেকর্ড। ছোট্ট দুটো ঘরের ফ্ল্যাটে যেমন ছিল তরুণদার বই, তেমন ছিল রেকর্ডের কালেকশন।
পরবাস : তখন কি উনি ওই হস্টেলের ইনচার্জ হিসেবে...
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : না, তারও আগে।
পরবাস : মিউজিক সেই অর্থে আপনি কখনো সরাসরি চর্চা করলেন না, কিন্তু আপনার মায়ের সূত্রে তো আপনার মধ্যে একটা সাংগীতিক গুণ তো প্রবাহিত হয়েছে। আবার মাস্টারমশাই হিসেবে তরুণ সান্যাল আপনাকে উদ্বুদ্ধ করলেন। এবার কি একটু মিউজিক নিয়ে চর্চা শুরু হল?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : মিউজিক নিয়ে মানে ঘন্টার পর ঘন্টা ওখানে বসে মোৎসার্ট, বেটোফেন, বাখ্ তরুণদা আমাকে শোনাতেন। বোঝাতেন। প্রত্যেকটা সুরের সঙ্গে যে গল্পগুলো জড়িয়ে আছে সেটা বলতেন। এইসব বলতে বলতে শুনতে শুনতে আমি একেবারে ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের পোকা হয়ে গেলাম। তখন পয়সাকড়ি তো থাকত না, ফলে নিজের সংগ্রহ করার কোনও কথাই ওঠে না। কিন্তু শোনার কোনও বাঁধা ছিল না। বিশেষ করে রোববার রোববার দুপুরবেলা ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের একটা আসর এবং আলোচনা বসত রেডিওতে। সেগুলো আমি কিন্তু শুনতাম। আসলে সুরকে ভালোবেসেছিলাম ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু আমার টানটা ছিল ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের ওপর বেশী। ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিকাল মিউজিকও যেমন ভালো লাগত, কিন্তু ভালোবাসাটা নিবিড় হল ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল মিউজিক শুনতে গিয়ে। সে যে কী অসম্ভব এক আবেশের মধ্যে আমি থাকতাম, কল্পনা করা যায় না। এবং আমার যেটা কাজ পরবর্তী জীবনে হল — ইমেজ তৈরি করা , সেই ইমেজ তৈরি করতে গিয়ে আমার প্রথম যেটা মাথায় এসেছিল, যে আমার ইমেজগুলো আমার হবে। ম্যানিপুলেট করা ইমেজ হবে না। ম্যানিপুলেটেড ইমেজ হলে সেই ইমেজটার মধ্যে খাঁটি জিনিসটা থাকে না। আর এখানে ম্যানিপুলেট করার কোন সুযোগ ছিল না, সবটাই আমার ছোটবেলা থেকে আহরণ করা। আমার সঙ্গে বেড়ে ওঠা। একটা কবিতা লিখতে গিয়েও ইমেজের দরকার হত। আমার কবিতা ইমেজসর্বস্ব। সর্বস্ব না হলেও বিশেষ একটা অংশ হয়ে আছে। এবং তার জন্য আমি ভীষণভাবে ঋণী আমার ইমেজের কাছে। আজও আমার সময় কাটে মিউজিক শুনে।
পরবাস : ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : এখনও।
পরবাস : আপনার পছন্দের সুরকার কারা? বাখ্, মোৎর্সাট এঁরাই ?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : সবচেয়ে বেশী পছন্দ আমার মোৎর্সাট। বাখ্ও আমার ভীষণ পছন্দ। হল কি জান, এটা খুব অদ্ভুত ব্যাপার যে এই ভালোবাসাটা আর একবার নতুন মোড় নিল। সেটা অনেক বড় হয়ে। অনেক পরে। যখন সিনেমা আমার জীবিকা। আমি হনলুলু শহরে গিয়েছিলাম। ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। অনেকবার গেছি ওই শহরে। অনেকবার। হনলুলু আমার প্রিয় জায়গা ছিল। ওদের ফেস্টিভ্যালটা ছিল খুব ভালো। ওইখানে আমি একদিন হাঁটতে বেরিয়েছি। একটা বাজারের মতো জায়গা। যেমন এখন আমাদের মলগুলো হয়েছে। ওইরকম একটা জায়গায়, সেখানে একটা দল বাজাচ্ছে। আমি শুনেই বুঝতে পারলাম কী বাজাচ্ছে। কিন্তু বাজানোটা অদ্ভুত! এরকম আমি শুনিনি কখনো! বাখ্ বাজাচ্ছে। কিন্তু এইভাবে বাখ্ বাজানো আমি শুনিনি কখনো।
পরবাস : মানে, একদম নতুন ইন্টারপ্রটেশন মনে হচ্ছে?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ। আমি একটু ওয়েট করলাম। সবাই চলে যাবার পর ওদের সঙ্গে কথা বললাম। ওরা বলল যে আমরা যেটা করতে চাইছি এই ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল মিউজিকটাকে আমরা ফিরিয়ে আনতে চাইছি। এবং ফিরিয়ে আনতে গেলে আজকের জেনেরেশানের কাছে রিদমটা খুব দরকার। বীটে ওরা ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল মিউজিক বাজাচ্ছে বুঝতে পেরেছো। এবং ওদের এই প্রোগ্রামটার নাম ছিল ক্ল্যাসিকস্ অন দ্য হুকস্। এরপর ওরা এটা রেকর্ড করে বের করে। ক্যাসেট। এখন তো ওসব দেখা যায় না, বিক্রিও হয় না। তার তিনটে সংগ্রহ করেছিলাম। সে অদ্ভুত সুন্দর। তোমার ভালো না লেগে যাবে না। এত সুন্দর।
পরবাস : স্কটিশে যখন আপনি এই ওয়েস্টার্ন ক্ল্যসিকাল মিউজিকের সঙ্গে আরও বেশী ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ছেন তখন তো আপনার সতেরো-আঠারো-উনিশ বছর বয়েস। কবিতাও লিখছেন?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ। আমি কবিতা লেখা শুরু করেছি বহু আগে। আসলে আমার কবিতার অনুপ্রেরণাই এসেছে আমার মামার কাছ থেকে।
পরবাস : সমরেন্দ্রবাবু?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত।
পরবাস : মানে হাজরা রোডের যে বাড়ির কথা আপনি বললেন, সেখানে উনিও থাকতেন?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : উনিও থাকতেন। ছোট্ট দুটো ঘরে মামাবাড়ি উঠে এল।
পরবাস : সেটা দেশভাগজনিত কারণে?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : একেবারেই দেশভাগজনিত কারণে। বাবা চলে এসেছিলেন আগেই। কিন্তু মায়ের পরিবার মায়ের বিয়ের পর। যখন ছেচল্লিশের রায়ট হল, দেশভাগ হল তখন আমার মামারা চলে এসেছিলেন রাতারাতি। বিশাল বাড়ি ছিল আমার মামাবাড়ি। সেটা পরে জার্মান কনস্যুলেট হয়েছিল পরে ঢাকাতে। ঢাকা শহরে। পরে আমি গেছি সেখানে। সেই বাড়িতে।
পরবাস : ওই বাড়িতে আপনার কোন ছোটবেলার স্মৃতি আছে?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমার আর আমার মামার স্মৃতি অনেক আছে। এই ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের পাশাপাশি আমি অদ্ভুত আরেকটা ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়েছিলাম। কবিতা তো ছিলই। কবিতা, মিউজিকের পাশাপাশি ওই বয়েস থেকেই সিনেমার পোকা হয়ে গেলাম। ফিল্ম সোসাইটির মেম্বার ছিলেন মামা। ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি তখন ভীষণ অ্যাকটিভ। সত্যজিৎ রায়রা তৈরি করেছেন। তাঁরাই চালান, তাঁরাই অফিসে বসেন। আমি ছবি দেখতে শুরু করলাম। দূর থেকে তাঁদের দেখতে শুরু করলাম।
পরবাস : হরিসাধন দাশগুপ্ত, সত্যজিৎ রায়, বংশীচন্দ্র গুপ্ত এঁরা সব আসতেন...
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, এঁরা সব। ঋত্বিক ঘটক, মৃণালদা। সে একটা অদ্ভুত সময় ছিল। এবং সে যে কী মোহের মধ্যে দিয়ে আমার সময় কেটেছে। একসময় একসঙ্গে সিনেমাকে ওইভাবে ভালোবাসছি, আবার পড়ছি ইকনমিক্স, লিখছি কবিতা। আমাদের মাস্টারমশাই ছিলেন অসীম দাশগুপ্ত। এম. এ. পড়তে যখন গেলাম তখন আমাদের মাস্টারমশাই অসীম দাশগুপ্ত।
পরবাস : পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ। ওরকম মাস্টারমশাই আমি পাইনি আমার জীবনে।
পরবাস : তখনও ইকনমিক্সে এম.এ কি কাঁটাকল ক্যাম্পাসে পড়ানো হত?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, কাঁটাকলে পড়ানো হত। এখনো পর্যন্ত ইকনমিক্সে পাওয়া অসীমদার রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারেনি। Such a brilliant student. আর ওনার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। তখন আমার ইকনমিক্স পড়তে খুব ভালো লাগে। মানে পাঠ্য হিসেবে। কিন্তু তিনটে পেপারে আমার মুস্কিল হোত খুব। আমার স্পেশালাইজেশন ছিল ইকনোমেট্রিক্সে। ম্যাথামেটিক্স ইকনমিক্সে। সেটাতে আমার একটু অসুবিধে হয়েছিল। কিন্তু অসীমদা যেভাবে পড়াতেন তাতে একটা প্রাণহীন বস্তু, দেওয়ালও ইকনমিক্স বুঝতে পারতো। ওরকম মাস্টারমশাই আমি দেখিনি। He was a brilliant teacher. তখন থেকেই ইকনমিক্সে ম্যাথামেটিক্যাল অ্যাপ্রোচ শুরু হয়ে গেছে।... থিওরি
পরবাস : ক্রমশ বিমূর্ত হচ্ছে আর কি--
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ভেক্টর, ম্যাট্রিক্স আর অঙ্ক ভীষণভাবে না জানলে ওই তিনটে পেপারে সুবিধে করা মুস্কিল ছিল। তো সেটা অসীমদার দৌলতে হয়েছিল। আমাদের অনেকেরই হয়েছিল। আমার তো বিশেষ করে হয়েছিল। কারণ আমি দুর্বল ছিলাম ম্যাথামেটিক্সে। ম্যাথামেটিক্স নিয়েছিলাম নাহলে আমি আর ম্যাট্রিক্সটা নিতে পারতাম না। তখন আর একটা স্বপ্ন শুরু হল যে আমি ইকনোমেট্রিক্স নিয়ে পড়াশোনা করব। হার্ভার্ডে যাব। গিয়ে পড়াশোনা করব। তখন অনেক ধরনের স্কলারশিপ পাওয়া যেত। প্রচুর স্কলারশিপ ছিল। কিন্তু মুস্কিল যেটা হল আমি ফার্স্টক্লাশ পেলাম না। আমাদের ব্যাচে আমি থার্ড। যেটা ঘটল তাতে মুস্কিল হল হার্ভার্ড যাওয়ার স্বপ্নটা ওই কারণে নিজে নিজেই ত্যাগ করলাম। কিন্তু পরে দেখলাম ত্যাগ করার দরকার ছিল না। চাইলে আমি পড়তেই পারতাম হার্ভার্ডে। স্কলারশিপ পেতেই পারতাম। কিন্তু তখন আবার তীব্র আর একটা ভালোবাসা সিনেমার প্রতি। আমি বুঝতে পারছিলাম সিনেমা ছেড়ে আমি একেবারেই বাঁচতে পারবো না। পড়াতাম, কিন্তু পড়াতে ভালো লাগত না।
পরবাস : আপনি বর্ধমানে শ্যামসুন্দর কলেজে পড়াতেন...
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : পড়াতাম। আবার সিটি কলেজেও পড়াতাম।
পরবাস : আমি একটু পিছিয়ে আসতে চাইছি, আপনি যখন কবিতা লিখছেন, নানা জায়গায় আপনার কবিতা বেরোতে শুরু করল যখন, সেই সময়ের কথা একটু শুনতে চাইব। মানে আপনাদের ঠিক আগে যাঁরা কবিতা লিখছেন বাংলাতে তাঁদের নানারকম গোষ্ঠী। নানারকম পত্রিকাকেন্দ্রিক গোষ্ঠী। মূলত পত্রিকাকেন্দ্রিক গোষ্ঠীই বলতে চাইবো আমি। যেমন কৃত্তিবাস আপনাদের একদম সামনে। শক্তি, সুনীল, শরৎ এঁরা সব ছিলেন। তো সেখানে আপনারা কিভাবে কবিতা লেখার ক্ষেত্রে এগিয়ে এলেন বা কোন পত্রিকায় লিখতে শুরু করলেন? আপনাদের নিজেদের কোন পত্রিকা ছিল কিনা?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : না, আমাদের কোন পত্রিকা ছিল না। আমি ‘অন্তর্জলি’ নামে একটা কাগজ বার করেছিলাম। একটা সংখ্যা বেরিয়েই তার শখ মিটে যায়। দ্যাখো আমাদের সময়ে লেখালিখির ব্যাপারটার মধ্যে একটা মজার বিষয় ছিল। সেটা হল দূরত্ব। মানে এখনকার কবি কবিতা হয় গিয়ে দেন ‘দেশে’র অফিসে বা অন্যপত্রিকার অফিসে। আমাদের সময় আমরা পোস্টে পাঠিয়ে দিতাম। এবং অধিকাংশ সময়ে বিফলমনোরথ হতে হত। ছাপা হত না। কিন্তু আমার যখন ছাপা হতে শুরু করল, তখন আমার বয়স ছিল চোদ্দ।
পরবাস : তখন আপনার ম্যাট্রিকুলেশন হয়নি!
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : না না ম্যাট্রিকুলেশন তখন ছিল না। মাধ্যমিক। উচ্চমাধ্যমিক। হায়ার সেকেন্ডারী ছিল। যখন ক্লাশ নাইনে পড়ি তখন বিভিন্ন কাগজে আমি কবিতা লিখে ফেলেছি। ক্লাশ টেন-ইলেভেনে বোধহয় ‘দেশ’-এও কবিতা লিখে ফেলেছি। তারপরে একটু একটু করে দেখতে শুরু করলাম, চিনতে শুরু করলাম। কাগজকেন্দ্রিক থাকলেও আমি দেখেছি যেমন কৃত্তিবাস ছিল। তেমন শতভিষা-ও ছিল। তার একটু পরে প্রণবেন্দু দাশগুপ্তর ‘অলিন্দ’। শতভিষা খুব গোষ্ঠীকেন্দ্রিক হয়ে উঠতে পারেনি। শতভিষাকে ঘিরে যে গোষ্ঠীটা ছিল তারা মানুষ হিসেবে কিছু কম ছিলেন না। যেমন আলোক সরকার ছিলেন শতভিষা-র সম্পাদক। ওরকম অসামান্য মানুষ, কবি তো বটেই, আমি খুব কম দেখেছি। ওইসময় প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, সুনীলদা, শক্তিদার সঙ্গে একটা দূরত্ব ছিল। কিন্তু এঁরা যেখানেই কবিতা পড়তেন মামা আমাকে নিয়ে যেতেন। মামার কাছে আমি ভান করিনি। এইভাবে কবিতার গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে একদিন ওদের গায়ের গন্ধ শুঁকতে শুরু করে দিলাম। এত কাছাকাছি চলে এলাম। আমার যখন সতেরো আঠারো বছর বয়স তখন শক্তিদার তিরিশ। সুনীলদার তিরিশ একত্রিশ বছর বয়স। দশ-বারো বছরের তফাত ছিল। কৃত্তিবাসে নিয়মিত লিখতে শুরু করলাম। এই লিখতে লিখতে আমার সমবয়সী কবিদের সঙ্গে আলাপ হল। যারা আমার সময়ের কবি। তাদের মধ্যে আমরা চারজন খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম।
পরবাস : আপনাকে একটু থামাবো। একটু পেছনে যেতে চাইছি। আপনি যে কবিতা লেখায় সম্পূর্ণ ইনভল্ভড হয়ে যাচ্ছেন ক্রমশ, আপনার পূর্বতন যারা কবি, আমাদের বাংলা সাহিত্যে, কার কবিতা পড়তেন আপনারা খুব বেশি?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : সবার কবিতা পড়তাম। আমাদের সময় ওরকম বাছবিচার ছিল না। অন্তত আমার তো ছিল না। নিজস্ব গোষ্ঠীর কবিতাই পড়ব। তার বাইরে পড়ব না, এটা ছিল না। আর গোষ্ঠী ঠিক সেভাবে ছিল না। আমি, শামসের, ভাস্কর, সুব্রত এই চারজন আমরা ভয়ংকর বন্ধু ছিলাম। এই যে বন্ধুত্বের বলয় তার পাশে ঘুরে বেড়াতেন দেবাশিস বন্দোপাধ্যায়, মানিক চক্রবর্তী। এবং ঐ খালাসীটোলায় যেতে শুরু করলাম তখন সবে হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষা দেব বা দিয়েছি এইরকম সময়। সুব্রত আমার চেয়ে বয়সে বড়। ভাস্কর আমার সমবয়সী। বোধহয় একবছরের ছোট। ভাস্কর, শামসের--আমাদের নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল। খুব ভালো বন্ধু ছিলাম আমরা পরস্পর পরস্পরের। সেই বন্ধুত্ব শুধু কবিতায় আটকে ছিল না। সেই বন্ধুত্ব সামাজিক এবং ব্যক্তিজীবনের মধ্যেও ঢুকে পড়েছিল। তবে ভাস্কর, সুব্রত এবং শামসের এদের সঙ্গে আমার একটা তফাত ছিল এই কারণে যে এদের কবিতাসর্বস্ব জীবন। সুব্রতর কাছে কবিতা ছাড়া জীবন ছিল না। ভাস্করও তাই। শামসেরও তাই এবং ওরা আর কোনকিছুকে জড়িয়ে ছিল না। ওরা খুব সহজেই অনেককিছু ছেড়ে দিতে পারত। গা থেকে মাছের আঁশের মত। আমার পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল না। আমি খুব জড়িয়ে ছিলাম। মানে আমার বাবা, মা, ছোট ভাইবোন। আমি তৃতীয় সন্তান। আমরা ন’জন ভাইবোন। ভাইবোনদের প্রতি অসীম ভালোবাসা। এইগুলো সব ছিল, বুঝতে পেরেছো। কিন্তু এটা ভাস্করের মধ্যে ছিল না। ভাস্কর, সুব্রত এবং শামসের-এর সুবিধে বা অসুবিধে যাই বলো না কেন ওরা একক মানুষ ছিল। ভাস্করের এক বোন ছিল। আর সুব্রতরও বোধহয় এক না দুই দিদি আর ভাই ছিল। শামসের-এর ভাই-বোন কেউই ছিল না। কিন্তু ওই আরকি ভাস্কর সুব্রতর দিদি ভাই-বোন ছিল মানে থাকা। আমার মনে আছে ভাস্করের সেই বরানগরে তেতলার ঘরে যেতাম। সেখানে মাঝে মাঝে খট্খট্ আওয়াজ হত। ভাস্কর আমায় ডাকত বুদ্ধদেব, দেখবেন আসুন। দেখতাম তলা দিয়ে গেরুয়া গায়ে, খড়ম পরে চলে যাচ্ছেন একজন। ভাস্কর বলল উনিই আমার বাবা। কিন্তু বাবার সঙ্গে কোনদিন আমায় আলাপ করিয়ে দেয়নি। আমি ওর বাবার সঙ্গে কোনোদিন কথা বলিনি। ভাস্কর যখন আমার বাড়িতে এসেছে আমার মার সঙ্গে ভাস্করের আলাপ ছিল। সুব্রতর সঙ্গে ভীষণ আলাপ ছিল মার।
পরবাস : সুব্রত চক্রবর্তীর কি কলকাতাতেই বাড়ি ছিল?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : সুব্রত তখন কলকাতার হস্টেল ছেড়ে, সবে ও ফিজিক্সে এম. এস. সি পাশ করে, ওরা ওপার বাংলার লোক, পরে চাকরীসূত্রে বর্ধমানে স্থায়ী বাড়ি করেছিল। কিন্তু সুব্রত, ভাস্কর, শামসের কখনো ওদের এই গল্পগুলো বলত না। ওদের এই গল্পগুলো ছিলও না। ভাস্করের বাবার মতো ভাস্কর কিন্তু দূর থেকেই বাবাকে দেখত। বাবা কোনদিন কাছে আসতে পারেনি। ও কোনদিন বাবার কাছে যায়নি।
পরবাস : মানে আপনিও যেমন দূর থেকে দেখলেন ভাস্কর চক্রবর্তী নিজেও বাবাকে দূর থেকে দেখতেন?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ। আমি কোনদিন ভাস্করকে এবং ভাস্করের বাবাকে একসঙ্গে দেখিনি। তিনতলার ছোট্ট ঘরটায় ভাস্কর থাকত। বাবা একতলায় থাকতেন। আমরা নেমে যেতাম একসঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে। বাইরে বেরিয়ে পড়তাম। কোনদিন বাবার সঙ্গে কথা বলতে দেখিনি। ভাস্কর বাবার সঙ্গে কথা বলছে, ভাস্করের সঙ্গে প্রায় আমি তিরিশ বছর একসঙ্গে কাটিয়েছি, আমি দেখিনি। বাড়িতে গেছি তিরিশ বছরের মধ্যে বহুবার। সুব্রতরও তেমনটা দেখিনি।
শামসের তো বটেই। কিন্তু শামসের-এর মা ছিলেন। যে বাড়িতে আমরা যেতাম। কিন্তু এরা একটা জিনিস খুব সহজে পেরেছিলেন--যে নিজেকে একদম বের করে আনতে। আমি পারিনি। মানে I was very much involved with my family. এই জিনিসটা আমার মধ্যে ছিল ভীষণভাবে। সেটা যেমন আমাকে একদিক দিয়ে খুব সাহায্য করেছে। আবার কোথাও হয়ত আমাকে বেঁধেও রেখেছিল। আর আমাদের বন্ধুত্বে মুস্কিল হচ্ছে কেউ এখন বোধহয় আর বেঁচে নেই। আমাদের এই চারজনের মধ্যে আমিই আছি। এমনকি মানিকও নেই, দেবাশিসও চলে গেল।
পরবাস : সবার আগে তো সুব্রত চক্রবর্তী চলে গেছেন।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : সুব্রত ছিল আমার অসম্ভব ঘনিষ্ট বন্ধু। ঘনিষ্টতা আরও বেড়ে গেল সুব্রত যখন চাকরি নিয়ে চলে এল বর্ধমান শহরে। তার আগে মহিষাদলে পড়াত। সেখানে আমি গেছি, থেকেছি। আর তখন আমাদের বন্ধুত্ব এমন ছিল যে ওর কাছে পয়সা আছে মানে ঠিক আছে। আমাদের চলে যাবে। যেটা এখন আর হয় না। কোনরকমে কষ্ট করে সুব্রতর কাছে মহিষাদলে চলে গেলাম, তারপর সুব্রত আছে। এমনকি ফেরার টিকিটটাও সুব্রত করে দেবে। মদ প্রতি রাত্রিবেলা সুব্রতই জোগাড় করে আনত।
পরবাস : আপনারা তো একসঙ্গে বেড়াতেও গেছেন। টেবো বেড়াতে যাওয়াটা--
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : সে তো পরে। সেবার অরণিও (কবি অরণি বসু) ছিল সঙ্গে।
পরবাস : আপনার তিন বন্ধু। এদের সম্পর্কে যদি জিগ্যেস করি আপনি কি বলবেন, কার কবিতা আপনার সবচেয়ে বেশী ভালো লাগত বা এখন লাগে? নিস্পৃহ হয়ে কি বলা যাবে?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ বলা যাবে। আমি মনে করি ব্যক্তিগতভাবে একজন বন্ধুর মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল সুব্রত। সবচেয়ে ভালোবাসতাম বোধহয় সুব্রতকে। কেমন একটা দায়িত্ব বোধ করতাম। ও একসময় লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছিল। যখন বর্ধমানে গেল তখন একদম লিখত না। প্রায় তিন-চার বছর কিছু লেখেনি। ওর মনে হচ্ছিল ও লিখতে পারে না। কবিতা ওর বিষয় নয়। পড়ত অনেক, লিখত না। ওই সময় আমি ওকে বুঝিয়ে, বলে, নানান কৌশল করে তারপর কবিতায় ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। তারপর ও কবিতাকে আঁকড়ে ধরলো। সে সময়ের কবিতার মধ্যে কিছুটা আমার প্রভাব থাকলেও পরে সেটা ও খুব দ্রুত কাটিয়ে উঠে নিজের মতো লিখতে শুরু করে।
পরবাস : এগুলো কি ওই ‘বালক জানে না’ পর্যায়ের?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : তারও আগের পর্যায়ে। যেমন আমার প্রথম কবিতার বই বেরলো উনিশ বছর বয়সে। বইটা হল কিন্তু কবিতাগুলোর মধ্যে আমার কবিতার যে ভঙ্গী তা তখনও ফুটে ওঠেনি। সময় লাগে। শামসেরও তাই। খুঁজে বেড়িয়েছি আমরা সবাই। নিজের মতো করে কবিতা বলা, লেখা, আর ভঙ্গী তো ছিলই। একমাত্র ভাস্কর, ভাস্করের বাড়িতে জানি না ওর বউ বাসবী রেখেছে কিনা, ভাস্করের বাড়িতে বেশ কিছু কবিতার খাতা ছিল। পুরনো মক্সো করা কবিতা। কিন্তু ও ছাপত না। আমাদের সমস্যা ছিল আমরা লিখলেই ছেপে দিতাম। আমি তো অন্তত তাই করতাম। ভাস্কর ছাপতে দেয়নি।
পরবাস : একটা অনুশীলনের ব্যাপার ছিল--
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত :ও অনুশীলন করছি বলে নয়, ভাস্কর এমন একটা লোক ও জেনেশুনে কিছু করত না। ওর লিখে হয়ত কোথাও এই লেখাগুলো নিজের বলে মনে হয়নি। কিন্তু যখন ও লেখা ছাপাতে শুরু করল, আমার তো মনে হয় ভাস্কর হচ্ছে প্রথম কবি আমাদের মধ্যে যে দশ-বারোটা কবিতা লেখার পরেই লোকের নজর কেড়েছে। এবং ভাস্কর ওর সময়ের পরে জনপ্রিয় হয়েছে। আমি অনেক পরে পেলেও ভাস্কর ও সুব্রত জীবিতকালে কোন কবিতা পুরস্কার পায়নি। ওরা তার তোয়াক্কাও করেনি। শামসেরই একমাত্র পুরস্কার পেয়েছিল, কৃত্তিবাস পুরস্কার। ভাস্করও পায়নি। সুব্রতও পায়নি। কিন্তু আমার মনে হয় এরা আমাদের সময়ের মধ্যে ষাটের দশকের দুজন ভীষণ উজ্জ্বল কবি। আমরা সবাই চেয়েছিলাম আমাদের মতন করে কবিতা লিখতে। আমার নিজের শুরু হয়ে গেল আমার মতো করে লেখা। এবং সবচেয়ে যেটা ভালো লাগতে শুরু করল যে তখন আমার এবং ভাস্করের লেখালিখি নিয়ে আলোচনা হতে শুরু হয়ে গেছে। প্রণবেন্দুদা আমাদের দুজনের কবিতা নিয়ে প্রবন্ধ লিখছেন। আরো দু-একজন লিখতে শুরু করলেন। প্রণবেন্দুদা প্রথমে কয়েনেজটা শুরু করলেন অ্যান্টি পোয়েট্রি। আমার ঠিক একটু পরেই প্রায় গা ঘেঁষে বেড়ে ওঠে অরণিরা। সমবয়সী নয় অথচ সমমনস্ক বন্ধুত্ব। এবং আমাদের একটা গোষ্ঠীই তৈরী হয়ে গেল। চারজনের সঙ্গে বিশেষ করে সুব্রত আমি আর ভাস্কর এবং অরণি। এবং অরণি সে সময় অসম্ভব ভালো লিখতে শুরু করল। অরণি ভাস্করের মতনই খুব অল্প বয়সেই নজর কেড়েছিল। ওর সময় অনেকেই ভালো কবিতা লিখত--অরণি, রণজিৎ দাশ আরো অনেকে ছিল।
পরবাস : বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের দিক থেকে বলছি, তাঁদের একটা বক্তব্য আছে আপনাদের ষাট দশকের কবিদের নিয়ে। সেটা হল আপনারা যখন কবিতা লিখতে শুরু করলেন, পুরোদস্তুর কবির মতো কবিতা লিখছেন, শুধু কবিতাই লিখছেন। কিন্তু আপনার ৬৩ সালে কবিতার বই বেরলো। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম কবিতার বই বেরিয়েছে বোধহয় ১৯৬১ সালে। কৃত্তিবাসের যারা কবি যাদেরকে আমরা পঞ্চাশের কবি বলি তাদের বেশিরভাগেরই কবিতার বই বেরচ্ছে এসে ষাটের দশকে। মানে তারা যখন ইভলভ্ করে কবি হিসেবে একটা হ্যালো পাচ্ছেন। মাথার চারধারে একটা অরা তৈরী হচ্ছে সেই সময় আপনারা কবিতা লিখতে শুরু করেছেন, তাতে আপনাদের কোন ক্ষতি হয়েছে? অসুবিধে হয়নি?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : না, না ক্ষতি হয়নি। অসুবিধে হয়নি এই কারণে যে যখন আমরা কবিতা লিখতে শুরু করলাম তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, উৎপল বসু, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত আলো করেছিলেন বাংলা কবিতার জগৎ। তুমি যেটা বললে হ্যালো ওটাই ছিল। ওদেরকে ঘিরে নানা গল্প, নানা নতুন নতুন সব কথা। আমি আমার কথা বলতে পারি। ভাস্কর, সুব্রতর কথা কিছুটা বলতে পারি সেটা হচ্ছে এরা কেউই এতে আকৃষ্ট হয়নি। আমাদের সঙ্গে অসম্ভব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেল সুনীলদা শক্তিদা প্রণবেন্দুদা তারাপদদার সঙ্গে। শঙ্খ ঘোষ চিরকালই খুব চুপ করে থাকা মানুষ ছিলেন। এই বৃত্তের মধ্যে থাকতেন না। উৎপল বসু ছিলেন। উৎপল বসুর পুরী সিরিজ বেরলো, প্রথম বই। উল্লসিত আমরা। সেলিব্রেশনের পর সেলিব্রেশন চলছে। রাতের পর রাত খাইয়েছেন আমাদের। কিন্তু আমি যখন লিখতে শুরু করলাম, আমাদের কবিতায় কোথাও শক্তি ছিলেন না, কোথাও উৎপল ছিলেন না। সুনীল গাঙ্গুলী একধরনের কবিতা লিখেছেন। তারও একটা প্রভাব ছিল। সেটা আমাদের ওপরে কিছুই ছিল না। আমরা আমাদের মতন করে লিখেছি। একদম আমাদের মতন করে। ষাটের দশকের বোধহয় সবচেয়ে বড় সাফল্য এইখানে যে ষাটের দশকের কবিরা তারা সুনীল, শক্তিদের পঞ্চাশ দশকের বৃত্ত আলো করে থাকতেন যে সব কবিরা তাদের গা ঘেঁষে বেড়ে উঠেছে।
পরবাস : না, মানে ওঠাবসা তো প্রায় একই সঙ্গে--
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : খালাসীটোলায় তো বিশেষ করে। কিন্তু তাদের প্রভাব কখনো আমাদের ওপর পড়েনি। তুমি ভাস্করের কবিতা পড়ো, শামসের-এর কবিতা পড়ো, সুব্রতর কবিতা পড়ো, আমার কবিতা পড়ো, ভালো লাগতে পারে, কোন কবিতা ভালো নাও লাগতে পারে। কিন্তু কখনোই মনে হবে না এটা সুনীল গাঙ্গুলী বা শক্তি চট্টোপাধ্যায় বা উৎপল বসুর মতো। এটা হয়নি। আর একটা যেটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল, যেটা একটা মজার ব্যাপার ছিল আমাদের সময়ে ছিল, সেটা সত্তরের কয়েকজন কবির মধ্যে ছিল, বাকিদের মধ্যে নয়। তা হল প্রতিষ্ঠানিক যেসব ব্যাপার তার থেকে দূরে থাকা।
পরবাস : ঠিকই, আপনাদের কেউই তো বড় বাণিজ্যিক কাগজে চাকরী নিলেন না।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : না, নিইনি। আমাদের সহপাঠী ছিলেন অভীক সরকার। আমরা একসঙ্গে পড়েছি।
পরবাস : আপনি যেরকম বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছেন তাতে খবরের কাগজে সহজেই চাকরী পেতে পারতেন?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, ভালো চাকরী পেতে পারতাম। আমার পড়াশোনা যে ধরনের ছিল তাতে খবরের কাগজে চাকরী পেতাম। আমি নিইনি। ভাস্কর নেয়নি। সুব্রত নেয়নি। শামসের নেয়নি। এদের যথেষ্ট যোগ্যতা ছিল কাগজে চাকরী করার।
পরবাস : এটা কি কোন কিছুর প্রতিক্রিয়া?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : সবার প্রতিক্রিয়া একইরকম ছিল। ভাস্করের মতো ভাবতাম, যে আমরা নষ্ট হয়ে যাব। কবিতা লিখতে পারব না। ভাস্করের তখন খুব চাকরীর দরকার ছিল। আমি অভীককে বলেও ছিলুম একটা চাকরী দে না। ও বলেছিল ঠিক আছে নিয়ে আয়। কিন্তু আমি নিয়ে যেতে পারিনি। ভাস্কর শুনে বলেছিল—‘আমি যাব না’। দরকার ছিল ওর অর্থের। কিন্তু শেষপর্যন্ত ওই যে আমার কবিতাকে নষ্ট করে দেয় যদি আনন্দবাজার। এই ভয়ে ও আর যায়নি। এবং আনন্দবাজারে লিখে নষ্ট হয়ে গেছেন তো অনেকেই। সুনীল গাঙ্গুলী পপুলার হয়েছেন। কিন্তু সুনীল গাঙ্গুলীর সাহিত্যের খুব কম কিছু লেখা বেঁচে থাকবে। শক্তির অনেক বেশী লেখা বেঁচে থাকবে নিশ্চয়ই। কিন্তু এদের সমস্যা হয়েছিল প্রাতিষ্ঠানিক যে দায় তার দাবী মেটাতে এরা চটজলদি লেখা শুরু করেছিলেন। আমার মনে আছে আমাদের সময়ে শীর্ষেন্দু অসামান্য সব গল্প লিখেছেন। এখন শীর্ষেন্দুর লেখা আমি পড়েও দেখি না। এত খারাপ লিখছেন, কি করে এত খারাপ লিখতে পারছেন শীর্ষেন্দু! ভাবলে অবাক হতে হয়। সুনীল গাঙ্গুলীর প্রথম দিকের তিন-চারটে উপন্যাসের পর আমার খারাপ লাগা শুরু হয়ে যায়। ভালো লাগত না ওর লেখা। পড়তাম, কিন্তু বুঝতে পারতাম লেখাগুলো থাকার জন্য আসেনি। কিছু কিছু কবিতা খুব ভালো লাগত। কিন্তু দুটো জিনিস তোমাকে মাথায় রাখতে হবে সুনীলদাই প্রথম, মানে একদম প্রথম, রবীন্দ্রনাথ থেকেই বলছি আমি, পপুলিস্ট কবি যেটাকে বলে। এটা কিন্তু সুনীল গাঙ্গুলীই প্রথম।
পরবাস : মানে জনরুচি অনুযায়ী কবিতা লেখা?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : না, জনরুচি না। পপুলার হওয়া। কবিতা লিখে পপুলার জীবনানন্দ দাশও হতে পারেননি তাঁর জীবদ্দশায়। বুদ্ধদেব বসুও পারেননি। যদিও জনসংযোগটা খুব ভাল ছিল। পপুলার কবিতা লেখা ষাটের দশকে আমাদের কারো মধ্যেই আর ছিল/এল না। আমরা কিন্তু সে অর্থে কেউই পপুলার নয়। ভাস্কর মৃত্যুর পর তার পাঠক বেশি পেয়েছে। কিন্তু সে অর্থে আমরা কেউই পপুলার কবি নই। আমি নই, ভাস্কর নই, সুব্রত নই, শামসেরও নই। কিন্তু আমরা চোরাগোপ্তাভাবে বুঝতে পারতাম যে আমাদের পাঠক বাড়ছে। কিন্তু সেটা সুনীল গাঙ্গুলীর নীরার কবিতা লিখে নয়। সুনীল গাঙ্গুলীর নীরার কবিতা সরিয়ে নাও, আরও দু-একটা কবিতা সরিয়ে নাও--সুনীল গাঙ্গুলীর পপুলারিটি ধপাস্ করে মাটিতে পড়ে যাবে। এগুলো একেকটা খুঁটি যা সুনীল গাঙ্গুলী তৈরি করেছিলেন। এবং সেগুলো উনি সাকসেসফুলি তৈরী করেছিলেন। তারপর সেটা তৈরি করেছিলেন জয়, জয় গোস্বামী। জয় গোস্বামী আরেকজন কবি যে খুবই পপুলার। বোধহয় সত্তর দশকের কবি হিসেবে সবচেয়ে বেশি পপুলার হয়েছিল। ও এটা বুঝতে পেরেছিল। ও এটা ভয়ংকরভাবে বুঝতে পেরেছিল এবং ও ওর কবিতাকে সেইভাবে ঘুরিয়েছে। জয়ের অনেক কবিতাই ভালো এবং ওর সবচেয়ে যেটা বড় ব্যাপার যেটা সত্তর দশকের আর কোন কবির মধ্যেই আমি দেখিনি সেটা হচ্ছে ছন্দ, শব্দ প্রয়োগ। এসবে এত দক্ষতা। যেমন সুব্রত অসম্ভব দক্ষ ছিল ছন্দে। অসামান্য দক্ষতা অর্জন করেছিল নিজে নিজে। আমরা সবাই নিজে নিজেই এগুলো করেছিলাম।
পরবাস : সুব্রত চক্রবর্তীর ‘দুটো জীবন’ বলে যে কবিতাটা আছে ওর মধ্যে অসম্ভব সুন্দর একটা ছন্দ আছে।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ। আরো অনেক কবিতা। আমরা অনেকেই শ্বাসাঘাতে সুন্দর কবিতা লিখেছি। সত্তর দশকের মধ্যে এ জিনিসটা ছিল না। আমার খারাপ লাগে সত্তর দশকের অনেক কবিই সে অর্থে খুব বড় জায়গায় যেতে পারেননি। কয়েকজনকে বাদ দিয়ে। আর এখানে জয় যেভাবে প্রতিষ্ঠানিক সাহচর্য পেয়েছিল পঞ্চাশের কবিদের মতো। যেটা ও খুব ভালোভাবে ব্যবহারও করতে পেরেছিল ওর কবিতাও সত্তর দশকের কবিদের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষ।
(* পরবাসে প্রকাশিত 'টোপ'-এর ইংরেজি অনুবাদ, The Bait-এর জন্য এইখানে ক্লিক করুন।)
(পরবাস-৬৭, জুন ২০১৭)
ছবিঃ রাজীব চক্রবর্তী ও অরণি বসুর সৌজন্যে