তৃতীয় ভাগ
জাসুস হরফন
বাদশার চিঠি - ৪
আশা করি এই চিঠির সঙ্গে তুমি মোহরের থলিটাও পেয়ে গেছো। আমিনাবাদের ভয়ঙ্কর ভূতটার হাত থেকে আমাকে বাঁচাবার চেষ্টায় তোমার ত্রুটি ছিল না। এটা তারই পুরস্কার।
আশা করি ওখানে তোমার কাজও শেষ। এবার সাহিবাবাদে ফিরে এসে কাজে লেগে যাও। আমার পোষা কুমীরছানাটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় সেটা?
ইতি সাহিবাবাদের বাদশা
প্রিয় জাঁহাপনা,
আপনাকে বাঁচাবার সম্পুর্ণ কৃতিত্ব এক বুড়ো হাকীমের। মোহরের থলিটা তাঁকেই দিয়ে এসেছি আজ।
এ ক'দিন নিজের খরচ চালানোর জন্য আমিনাবাদের চাকরি নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। এখন সেখানে বাঁধা পড়ে গেছি। এখানকার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ইস্তিফা মঞ্জুর হবে না। আশা করি আপনার হুকুমের তামিলে অক্ষমতার গুস্তাখী মাফ করবেন।
কুমীরছানাকে ভুলে যান। ওটা দরিয়ার জিন, বেহতর যে সে দরিয়াতেই ফিরে যাক।
ইতি হরফন
বাদশার চিঠিটা দুর্ভাগ্যবশতঃ আমিনাবাদের নবাবের হাথে লেগে গিয়েছিল। কমবখ্ৎ খণ্ড্ সেখানেই পেশ করেছিল কিনা। তিনি হরফনকে তলব করে হাতে চিঠিটা দিয়ে বলেছিলেন—নিজের বাদশাকে সামলাও গিয়ে। এখানে আবার এসে হাজির না হয় সেই বেওকুফ।
চিঠিটা পড়ার পর দ্বিতীয়বার কুর্নীশ করে হরফন বলেছিল—আমি না থাকলে রাতের বিরিয়ানিটা বানাবে কে? বছরের পর বছর জাসুসী করে করে আমার শরীরে জাহান্নুমের আগুনের মতো গুস্সা আর গুরূর জমা হয়ে গেছে। তাই দিয়ে খুশকীর কাজটা হয়ে যাচ্ছে। বিরিয়ানিটা না বনলে বেগম আর বাচ্চাদের কী হবে?
মুখ বিকৃত করে নবাব বললেন—বাচ্চাগুলো বড় হয়ে যাবে।
—বাচ্চারা বড় হয়ে গেলে কী হবে জনাব?
নবাব নিজের কুর্সী ছেড়ে উঠে দফা হয়ে গেলেন। হরফন এবার দেখল ডান দিকে টুপির নীচে খানিকটা জায়গায় নবাবের কোনো চুল নেই। মাথার উপরের চুলগুলোকে লম্বা হতে দিয়ে গুলির দাগটা ঢাকা হয়েছে। একটা পাও টেনে টেনে চলছিলেন। তাঁর সারাদিন বসে থাকার, আর অল্প কথা বলার কারণটা ধরতে পারছিল জাসুস। অনুমান করল যে বুখারী হাকীমের দাওয়ায় জানটা ফিরে এসেছিল কোনো একদিন। কিন্তু বোল আর চালটা পুরোপুরি মরম্মত হয়নি।
সন্ধ্যেবেলা তাম্বার ডিব্বা হাতে বাবুর্চীখানায় গিয়ে সে দেখল ছোটি-বেগম, আর দুই বাঁদর এসেছে তাকে সাহায্য করতে। কাজটা নিপুণভাবে শিখবে ভেবে হরফন নিজেই চাল বেছে ধুতে শুরু করে। মশলাগুলো বানাবার কাজে হাত লাগায়।
ছোটি-বেগম জাফরান কুটতে কুটতে বললেন—হরফন মিঞা তাহলে জাসুস থেকে বাবুর্চী হয়ে গেল?
আর হরফন মনে মনে ভাবল—তাই কি হয়?
পরে রাত্রে যখন সে পান সেজে নিয়ে এসেছিল ছোটি-বেগমের কাছে তখন তার মনে আর দর্দটা ছিল না। পাথরের উঠোনে বসে ছোটি-বেগম তাকে নিজের পরিবারের গল্পই শোনাচ্ছিলেন।—এই যে আমার বাপ, যাকে তোমরা বুখারী হাকীম বলে ডাকো, এর দাড়িতে লাল আর নীল রঙ লাগানো কেন জানো? দু-দিকে দুরকমের কেঁচুয়ার মিট্টি লাগানো আছে। দাড়ির মধ্যে তৈরি হয় ওষুধ। ওই দাড়ি শুঁকিয়ে মৃগীর রুগীকে ঠিক করে সে। বাচ্চা হবার পর যে মায়েরা মরতে বসে তাদের ওই দাড়ির একটা দিক চাটালে তারা চাঙ্গা হয়ে মোষের ঘী-এর মতো ঘন দুধ বের করতে থাকে।
—মাফ করবেন, কিন্তু আপনার আর নবাবের কোনো চাচ্চা-বাচ্চা হল না কেন? বুখারী হাকীম কিছু করতে পারলেন না?
—চিড়িমারের বাচ্চা হবে কী করে? গুলি লাগার পর তো সে মরেই গিয়েছিল। বুখারী হাকীম সেই লাশটাকেই মোরব্বার মতো রস মাখিয়ে আর শুকনো পাতার আগুনে গরম করে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর একটা তামাচা মেরে বলল—চল বেটা, হেঁটে দেখা। তখন সেই লকওয়া মেরে যাওয়া জিন্দা লাশ লোহার পুতুলের মতো পা ঘষে ঘষে হাঁটতে শুরু করল। আমরা বাপ বেটি মিলে রোজ সকালবেলা সেটাতে তুবড়ির মশলা ভরে কড়া রোদ্দুরে এপিঠ ওপিঠ সেঁকে আর তামাচা মেরে চালু করতাম। একটু একটু করে কত বছর লাগল ঠিক হতে। ওর যদি বাচ্চা হয় তো সেটা মানুষ হবে নাকি? চুহা কি ছুছুন্দর পয়দা হতে পারে। সেই ভয়ে আমরা বাচ্চা বানাইনি।
—নবাবাজাদাদের বিষ খাইয়ে মারার জন্য আপনাকে বুখারী হাকীম পাঠিয়েছিলেন?
এইবার ছোটি-বেগম হাসির বেগ সামলাতে না পেরে বিষম খেয়ে গড়িয়ে পড়লেন একেবারে।—আরেকটা পান দাও জাসুস। এমনই জাসুস তুমি যে কিছুই বুঝলে না আজও?
পান লাগাবার জন্য শীশমহলের নামতখানায় ঢুকে হরফন অবাক হয়ে দেখল দুজন বেগম তাদের গোটা চারেক বাচ্চা সমেত তহ্খানা থেকে বেরিয়ে এসে হাত পেতে আছে। তাদের জন্যও লাগিয়ে দিল সে একটা করে মীঠা পান।
উঠোনে ফিরে এসে ছোটি-বেগমের হাতে চাঁদীর বর্ক লাগানো ভারী-ভরকম্ বীড়াগুলো দিয়ে সে বলল—হাসবেন না। ওদিকে দেখুন, বেগমরা কিন্তু সবাই আর ঘুমিয়ে কাটাচ্ছেন না। বাচ্চারাও কেউ কেউ জেগে আছে।
ছোটি-বেগম ওদিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঠোঁট উলটে বললেন—ওরকম মাঝে মাঝে হয়। কাল থেকে ঘুমোবে আবার।
—এদের ঘুমের দাওয়াইটা আপনি কখন দ্যান?
হরফনের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে ছোটি-বেগম বললেন—বিরিয়ানিতে মাসে একবার দিলেই হয়।
—তার মানে খুশকীটার কাজ ছিল শুধু বিরিয়ানিটাকে লজীজ করে তোলার?
—খুশকীটা তো এদের নেশা, যেটাতে এরা বুঁদ হয়ে থাকে। আর যে জহরটা আমি মেশাই সেটার জন্য এরা বড় হতে পারে না। এদের বয়েস আটকে থাকে একটা জায়গায়। সারাজীবন ধরে এরা ছোটবেলার মজা নেয়।
—এই বিষটাই আপনি বুড়ো নবাব আর নবাবজাদাদের দিয়েছিলেন?
—নয়তো কী? এদের মাসে এক ফোঁটা দিই। ওদের সে-রাতে পুরো এক পেয়ালা দিয়েছিলাম। বুখারী হাকীমের কাছে চাইতেও যেতে হয়নি। এই বাড়িতেই ছিল সেই জহর। বলতে পারবে কোথায়, জাসুস?
—সেটাই কি মোহলিক সিরকা, যার এক ফোঁটা নিয়ে এক গামলা দুধে মেশানো হত? এবং তারপর সেই দুধের এক ফোঁটাকে এক গামলা গোলাপজলে গুলে তৈরি হত বুড়ো নবাবের ওষুধ?
—এইবার তোমার মাথা খুলেছে জাসুস!
ছোটি-বেগম আরাম করে একটা বীড়া খুলে সেটাকে অর্ধেক করছিলেন গালের একদিকে ঠুঁসবার জন্য। হরফনের মাথা কিছুই খোলেনি, কিন্তু সে যেটুকু বুঝতে পারছিল সেটা মোটেও সুবিধের মনে হচ্ছিল না।
—তো জনাবে-আলী, বিষ দিলেন আপনি আর ওদিকে কোতওয়াল বাবুর্চীদের ধরে নিল নবাববাড়ির সবাইকে বিষ দিয়ে মারার জুর্মে?
—সবাইকে নয়, নবাব আর নবাবজাদাদের মারার জুর্মে। হরফনকে শুধরে দিয়ে বললেন ছোটি-বেগম।—কাজী আর কোতওয়ালকে তো আমি আর বুখারী হাকীমই গিয়ে জানালাম সব। দুজনেই বুড়ো নবাবের বন্ধু ছিলেন। বাবুর্চীদের কোতল করার হুকুম জারি হতে দেরী হয়নি। এক এক করে প্রায় সবকটাকেই ধরা হয়েছিল পরে। তৈমুরের ভাইটা বোধহয় পালিয়ে যায়।
—এতগুলো খুনের জন্য নিজেকে কসুরবার মনে হয় না? খুদার কাছে কী জবাব দেবেন মুহতরমা?
এই প্রথম হরফনের মহসুস হয় যে ছোটি-বেগমকে একটু চেষ্টা করতে হচ্ছে তার প্রশ্নের জবাব খোঁজার জন্য। পানের অর্ধেক বীড়াটা হাতেই ধরা থাকে। মুখ অবধি পৌঁছোয় না তাঁর। হরফনের বে-অদব সওয়ালগুলোর আদৌ জবাব দেবেন কিনা ভাবছেন হয়তো মনে মনে। হয়তো জবাবটা বহু আগেই তৈরি ছিল, শুধু সওয়াল করার মতো লোক হভেলীতে আসেনি কোনোদিন।
—শোনো তাহলে জাসুসের জাসুস, তল্লাশীর মুখতার! বুঝবে কিনা জানি না। আমি যদি নবাবজাদা হতাম, তাহলে কী করতাম? হামামের গরম পানিতে সব গুনাহ ধুয়ে, তারপর ইমামবাড়ায় নামাজ পড়ে, বে-শরমের মতো শেষে হাজী হয়ে ফিরতাম। ঠিক কিনা? তো আমাদের জন্য হামাম টামাম নেই, তাই গুনাহগুলো জলে ধোলাতে পারি না। কিন্তু জিন-পরীদের সঙ্গে আমার কীরকম গভীর তাল্লুকাত সেটা তো দেখলে? রাতের আসমানের মেঘ আর অবার গুঁড়িয়ে তার রূপালী চুর্মা দিয়ে আমাকে তারা ছোটবেলা থেকে স্নান করিয়ে দেয়। চিড়িমার নবাব তো চিড়িও মারতে পারেনি কোনোদিন, শুধু নিজেকেই মারতে পারত। কতবার মরবে সে? আর কতবার বাঁচাব তাকে আমি? বাপ আর ভাইরা বেঁচে থাকলে ওর মরে যাওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না। যে দিন সে নিজের তমঞ্চা দিয়ে নিজেকেই মেরেছিল সেদিন রাতে এক আকাশ ভর্তি রিম-সিম হুরী পরীরা আমাকে ডেকে খোলসা করে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে কাদের কাদের আর কীভাবে ঠিকানা লাগাতে হবে।
—কী সব বলছেন খাতুন? দেওয়ালেরও কান আছে। যদি এ সব খবর কাজীর কাছে পৌঁছে যায় তাহলে কী কেলেঙ্কারী হবে ভেবেছেন?
হরফনের মুখে ‘কেলেঙ্কারী’ শব্দটা শুনে যারপরনাই মজা পেয়ে গেলেন ছোটি-বেগম।—হোক। কেলেঙ্কারী-ই হোক একটা। এই হভেলীতে যতদিন ছোটি-বেগম বেঁচে আছে, কোনো নবাবজাদার সিক্কা চলবে না। কাজী-কোতওয়ালের ফরমানও চলবে না। শুধু বেগমের দস্তুর চলবে। আসমানের যত রাতের আলোর জীব, তারা আমার শাগির্দ। এটা তুমি জেনে রাখছ তো?
—বেগমের দস্তুর-টা কী?
—নবাবজাদারা যতদিন ছোট আছে, বাঁচবে। বড় যদি হয়ে যায়, তাদের জন্য দাওয়াই আছে আমার। যখন আমার পনেরো বছর বয়েস তখন থেকে পুরুষদের নসল্-কে এই হভেলী-সে-বর্খাস্ৎ করে দিয়েছি আমি।
—আর আমি যে এখানে আছি?
—তোমার নসল্-ও তোমার সঙ্গেই শেষ। কোনো বাচ্চা-ওয়াচ্চা হবে না তোমার।
—আমার মধ্যে কী কোনো অল্লত্, কোনো বীমারী ভরে দিয়েছেন বুখারী হাকীম?
ছোটি-বেগম আবার হাসতে শুরু করলেন হরফনের শক্কী-মিজাজ দেখে।—আরে, এত করে তোমাকে বাঁচালো যে, তাকেই সন্দেহ তোমার? বুখারী হাকীম বুরা আদমীকেও জিন্দা করেন, কাউকে মারেন না। চিড়িমারের মতো তুমিও জিন্দা-লাশ হরফন। তোমার মওত্-ই হয়ে গিয়েছিল। এখন যেটা বেঁচে আছে, সেটা কোনো রাতের জীবের অংশ, সেটা না জিন, না ফেরেশতা, না মর্দ না অওরত্। তোমার মধ্যেই ছিল। মরে আবার জিন্দা হয়েছে। একদিন সেটা তোমাকে কোনো তালাবের কাছে নিয়ে যাবে, তারপর নিজের ইচ্ছেতেই তুমি ডুবে মরবে সেই পানিতে। তখন সেই না জিন, না ফেরেশতা আবার আকাশে উড়ে চলে যাবে সিতারাদের মাঝখানে। আমার কথা শোনো জাসুস। তুমি হামামবাড়ি থেকে নিজেকে দূরে রাখো।
—আমার সত্যিই একবার মওৎ হয়েছিল তাহলে? কিন্তু কীভাবে? হামামবাড়িতে আপনি বার বার যেতে বারণ করেন কেন? সেখানে ঠিক কী হয়েছিল সেদিন?
—এখনো সেটা মনে পড়েনি তোমার? ছোটি-বেগম জিভ দিয়ে চুঃ চুঃ শব্দ করে সমবেদনা জানালেন। —হুমম...। একটু আফিম নাও না কেন তাহলে? সমস্ত চোখ খুলে যায় তো তাতে মানুষের!
রাত্রে নিজের কামরায় ফিরে এসে হরফন দেখতে পেল তার বিছানায় ভাঙা তমঞ্চাটা রেখে গেছে বাঁদররা। দুটো গুলকন্দী চুষীকাঠিও পড়ে আছে তার পাশে।
অর্থাৎ ছোটি-বেগমের দস্তুরই চালাচ্ছে আফতাব আর খণ্ড্কে। হামামবাড়িতে যে তারা হরফনের পিছু পিছু গিয়ে ঢুকেছিল ছোটি-বেগমেরই নির্দেশে তাতে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
মিঠাই জিনিসটা ঠিক ধাতে সয় না হরফন জাসুসের। কিন্তু আজকের বাৎ-চিৎ-এর পর ছোটি-বেগমের পরামর্শ মানেই আদেশ বলে বুঝতে হয়। সেটা অগ্রাহ্য করা যায় অবশ্য। কিন্তু তারপর এই হভেলীতে থেকে যাওয়াটা শরীফ আদমীর মতো কাম হবে না।
একটা চুষীকাঠি মুখে পুরে খুব দ্রুত চিবিয়েই খেয়ে নেয় হরফন। তারপর জামাকাপড় পাল্টে শোবার জন্য প্রস্তুত হয়ে সে অন্যটা মুখে নিয়ে চুষতে থাকে।
খিড়কিটা খুলে শুধু একটু চাঁদের আলো আনবে ভেবেছিল হরফন। কিন্ত সেই সঙ্গে একটা আস্ত ছায়ামানুষ তার ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে পড়বে আশা করেনি। আকারে প্রকারে লোকটা তার মতোই হবে, যেন তার নিজের জিস্মেরই একটা ধুঁয়াই জুড়ওয়াঁ ভাই বেরিয়ে এসেছে। শুধু মাথার উপর উদ্ভট শিং দুটো দেখে বুঝতে বাকি থাকে না যে সে ছোটি-বেগমের শাগির্দদের একজন। হরফনকে আঙুলের ইশারায় সে বলছিল গুলকন্দীটা খেয়ে নিতে। সুতরাং হরফন দ্বিতীয় চুষীকাঠিটাও চিবোতে শুরু করে। দেখতে দেখতে ছায়ামূর্তিও ঘন হয়ে একটা জ্যান্ত মানুষের মতো বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছিল। গুলকন্দীটা খাওয়া শেষ করে হরফন জিজ্ঞেস করে—এবার? কিন্তু ততক্ষণে তার শোবার ঘরটা সে আর দেখতে পাচ্ছিল না। চাঁদের আলোটাও গায়েব হয়ে গিয়েছিল। একটা অন্ধকার শীতল জায়গায় বসে সে আর শিংওয়ালা না-জিন-না-পরীটা পা দোলাচ্ছিল।
পায়ে জল ঠেকার ফলে হরফন বুঝতে পারে যে জায়গাটা আসলে হামামবাড়ির ঠান্ডা-ঘরের তালাব-খানা।
খুব আলতো একটা পায়ের আওয়াজ। কেউ আসছিল। হরফন জলের মধ্যে নেমে যেতে চাইছিল, কিন্তু না-জিন-না-ফেরেশতাটা তাকে হাত ধরে বসিয়ে দেয়। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলে চুপ করে বসে থাকতে, এবং বলার পর নিজেই জলের মধ্যে নেমে যায় চুপচাপ। নেমে গিয়ে সে আস্তে আস্তে জলের তলা দিয়ে এগোবার চেষ্টা করে তালাবের মাঝ বরাবর। হরফনের মনে হল যেন তালাবের মধ্যেকার অবয়বটাই আসলে মানুষ, তার নিজেরই কোনো একটা বাজীগরী ছায়া। আর তালাবের পাড়ে বসা সে নিজে কোনো রাতের আলোর জীব এবং বেগমের ঘনিষ্ঠ শাগরেদ।
তালাবের পাশ দিয়ে একটা লোক লঘু পায়ে হেঁটে আসছিল। এটা যে ঘটবে, সেটা হরফন কী করে যেন জানত। যেটা সে আগে ভেবে পায়নি সেটা এবার চক্ষুগোচর হল। পায়ের শব্দটা আসলে একটা লোকের নয়। তালাবের দুদিক থেকে দুটো লোক এসে উপস্থিত হয়েছে। দুটোই দানব। একজনকে সে চিনেছিল তৈমুর বলে। অন্যজনের লম্বা শাদা চুল আর তৈমুরের চেয়েও অমানুষিক বিশাল শরীর দেখে ভয় পেয়ে যায় হরফন। অথচ তৈমুর আর তার সঙ্গী কেউই হরফনকে দেখতে পাচ্ছিল বলে মনে হয় না। যেন তার শরীরটা বাতাস আর আগুনের নরম আঁচ দিয়ে তৈরি। হরফনের খুব কাছ দিয়েই তারা জলের ধারে পা ঝুলিয়ে নিঃশব্দে বসে পড়ে।
না-জিনটা মাথা তুলছিল নিশ্বাস নেবে বলে। তৈমুরের দৈত্যের মতো সঙ্গীও প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় একটা অমানুষিক লম্বা হাত বাড়িয়ে সেই শিংওয়ালা মাথার পাতলা চুলের ঝুঁটি ধরে ফেলেছে। এক ঝটকায় না-জিন-না-ফেরেশতাকে সে টেনে নিয়ে আসে পাড়ের কাছে। আরেকটা প্রকাণ্ড ঝটকায় মাথাটা জোর করে আবার ডুবিয়ে দেয় জলের ভিতর। না-জিন-না-ফেরেশতার গলা দিয়ে ঘড় ঘড় করে একটা শব্দ আসছিল। তৈমুর সেটা শুনে হঠাৎ শিশুদের মতো হো হো করে হাসতে থাকে। হরফন দুই দৈত্যের ঠিক মাঝখানে ভয়ে সিঁটিয়ে বসেছিল। তার মাত্র একহাত দূরে বসে থাকা তৈমুরের সঙ্গী দাঁত কিড়মিড় করে বলছিল—জাসুসী বার করছি তোমার!
বার দশেক নাকানি চোবানি খাবার পর জলের ভিতরের প্রাণীটার হাত পা ছোঁড়া স্তিমিত হয়ে আসছিল। তৈমুর আর তার সঙ্গী কাজটা শীগ্গীর সমাধা করার জন্য বুকজলে নেমে যায়। না-জিন-না-ফেরেশতা একবার শেষ চেষ্টা করবে বলে যেন তৈমুরের দানো সাঙ্গোটার হাত জড়িয়ে ধরেছিল। দানোটা তাকে ডুবিয়ে দিতে চাইছিল, কিন্তু হঠাৎ সে চমকে উঠে বুঝতে পারে যে জল থেকে ওঠার চেষ্টা না করে তার শিকার উল্টে জলের গভীরেই তলিয়ে যেতে চাইছে। এবার দানোটা ভয়ে সেটাকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করতে থাকে। তৈমুর দানোটাকে সাহায্য করার জন্য একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। হরফনের মনে হয় তাদের দুজনের কেউই সাঁতার জানে না।
না-জিন-না-ফেরেশতা ক্রমশ ডুবে যাবার চেষ্টায় অসম্ভব শক্তির পরিচয় দিচ্ছিল। তার টানে দানোটা জলের অনেকটা নীচে চলে গিয়ে খাবি খেতে খেতে মরীয়া হয়ে তৈমুরের পা ধরে টানছিল এবার। ঘোর অন্ধকারের মধ্যেও কী করে যেন হরফন স্পষ্ট অনুভব করে কার লোহার মতো দুটো হাত দানোর গলা জড়িয়ে ধরে তাকে নিজের সঙ্গে মরতে নিয়ে যাচ্ছে।
তৈমুরের চোখে অকৃত্রিম আতঙ্ক! তার দুটো পা-ই ধরা পড়ে গেছে দানব সঙ্গীর হাতে। তালাবের মসৃণ পাথুরে দেয়ালে সে পাগলের মতো একটা খাঁজ খুঁজছিল আঁকড়ে ধরার জন্য।
হরফনের কৌতূহল ফুরিয়ে আসছিল। বাকিটা তার জানা না হলেও এর পর আন্দাজ করতে বেগ পেতে হয় না। শুধু লাশগুলো তালাব থেকে কে এবং কখন বের করল সেটাই যখন একমাত্র জিজ্ঞাস্য তখন তার গা ভেদ করে তীরের মতো একটা নারকেলের দড়ির ফাঁস এসে পড়ল তৈমুরের গলায়।
সেই সঙ্গে এক লাফে খণ্ড্ এসে হাজির। তৈমুরের গলা থেকে ফাঁসটা খুলে সেটা কুশলভাবে তার দুহাত গলিয়ে বুকের কাছে পরিয়ে দিল সে। হরফন পিছন ফিরে দেখে আফতাব দড়ির অন্য প্রান্তটাকে দরজার হাতলের সাথে বেঁধে ফেলছে। গলায় দড়ি পরানোর ফলে প্রথমে তৈমুরের জিভ খানিকটা বেরিয়ে এসেছিল, কিন্তু খণ্ড্ তার দুহাতে দড়িটা ধরিয়ে দেবার এক নিমেষের মধ্যেই তৈমুরের শয়তানী বুদ্ধি আবার চাগিয়ে ওঠে। পা ছাড়িয়ে নিয়ে না-জিন-না-ফেরেশতার শরীরটাকে সে লাথাতে শুরু করেছিল। এই বদ ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে খণ্ড্ তার বেরিয়ে আসা জিভটাকে কামড়ে বড় করতে শুরু করলে তৈমুরের দুচোখ এবার কপালে উঠে যায়। একটু পরে সে তালাবে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের মতো কাঁদতেও শুরু করে। কারণ আফতাব ততক্ষণে একটা ছোট ছুরি হাতে জলের মধ্যে ঢুকে তার পায়ের একটা রগ কেটে দিয়েছিল।
এই ঘটনাগুলো বাঁদরদের স্বভাবসিদ্ধ ক্ষিপ্রতায় ঘটলেও, বেশ কিছুক্ষণ লেগেছিল নিশ্চয়ই সবটা হতে। আফতাব আর খণ্ড্ যখন মাথার চুল ধরে না-জিন-না-ফেরেশতাকে তুলে আনে ততক্ষণে তার দিলের ধড়কন আর নিশ্বাস দুইই বন্ধ হয়ে গেছে। হরফনের মনে হয়, তৈমুর এ যাত্রা বেঁচে গেলেও, তার দানো ভাইটাকে আর তোলার সময় হবে না কারো। দুই ধেড়ে বাঁদর ততক্ষণে শিংওয়ালা লাশটাকে কাঁধে তুলে নিয়ে ছুটতে শুরু করেছিল।
হরফন জীবনে প্রথম দেখে আফতাব আর খণ্ডের মুখে ভয়ের ছাপ। ছোটি-বেগমের দস্তুর অনুযায়ী জাসুসকে, বা জাসুসের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা কোনো জুড়ওয়াঁ জিনকে, সব রকম খতরা থেকে বাঁচিয়ে রাখার নির্দেশটা তারা পালন করতে পারেনি।
তালাবের ধারে বসে তৈমুরকে দেখতে দেখতেই হরফনের ঘুম এসে যেত। কিন্তু পাঁজরে একটা গোঁত্তা পড়ায় তার সংবিৎ ফিরল। না-জিন-না-ফেরেশতাটা আবার কোত্থেকে এসে বসেছিল তার পাশে। কোথায় তালাব? কোথায় হামামবাড়ি? আবার তারা ঘরের বিছানার উপর ফিরে এসেছে দেখল হরফন। খিড়কি থেকে চাঁদের আলো এসে পড়েছিল দুজনের মুখে। না-জিন-না-পরীটা তার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। যেন বলছে—মরেছি তো আমি! তোর ভয় কী?
কিন্তু হরফন জানত—জিন-পরীরা মরে না।
জাসুসদের তিনটে জান থাকে। হরফনের মনে পড়ছিল, বহুদিন আগে তাকে বুঝিয়েছিল তার বাপ।
একটা জান থাকে তার বাড়িতে, বিবি-বাচ্চার কাছে। যে জানটাকে সে কখনো সঙ্গে নিয়ে ঘোরে না। যেটা তার ছেলে মেয়ের খেলার ঘরে বসে পা দোলাতে দোলাতে তাদের আলিফ-বে আর পাহাড়া শিখিয়ে যায় যতদিন না তার কাজ ফুরিয়ে যাচ্ছে।
আরেকটা হল তার জাসুসী করার জান। সেটা তার হাতের মুঠোর মধ্যে থাকে। বৃষ্টি তাকে ভেজায় না, সাপে কামড়ায় না, জিন-হুরীরা সমীহ করে চলে। পাহাড় থেকে ঝাঁপ দেবার সময় সেটা তার মাথায় কফনের মতো বাঁধা থাকে। এই প্রাণটা নিয়ে জাসুস জাসুসী করে। এটা না থাকলে সে কিছুই না, একটা সাধারণ মানুষ। তখন সে বাবুর্চী-ই হোক, কি তবলচী-ই হোক, কেউই তাকে জাসুস বলে চিনতে পারবে না।
আর তার তৃতীয় ও শেষ জানটা হল বাপ-পরদাদার কাছে পাওয়া পুশতৈনী জান। এটা লুকিয়ে থাকে, জিগরের খুব গভীরে কোনো গুহায়। কখনো কখনো সারা জীবনই বেরোয় না। জাসুস মরে গেলে এটা তার ছেলে মেয়েদের বুকের মধ্যে আপনা থেকে চলে যায়। এই পুশতৈনী জানটা মরতে ভয় পায় না। এই জানটা জাসুসকে তার পূর্বপুরুষদের কাছে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়।
হরফন জানত, মরেছে তার নিজেরই একটা জান। আরেকটা বেঁচে আটকে আছে শরীরে, ছোটি-বেগম আর তার বুখারী বাপের দাওয়ায়। এবার এই আটকে থাকা জানটাকে নিয়ে সে জাসুসী করবে, না পুর্বপুরুষদের কাছে ফিরবে, সেটাই তাকে খুঁজে বার করতে হবে জীবনের বাকি কটা দিন।
যতক্ষণ না পানির না-জিন-না-ফেরেশতা এসে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোনো হামামবাড়ির তালাবঘরে।
(শেষ)