• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৮ | এপ্রিল ২০২০ | গল্প
    Share
  • জাসুসনামা : ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত




    দ্বিতীয় ভাগ

    ছোটি-বেগম (আগের পর)


    || ৩ ||


    হামামবাড়ি

    বস্ত্‌-ও-দরের রাস্তা দিয়ে আধ ক্রোশ হেঁটে শহরের একটা প্রান্তে এসে পৌঁছেছিলো হরফন জাসুস। দুপুরের ঠা-ঠা রোদ থেকে বাঁচার জন্য সে মাথায় একটা পাগড়ি পরে নিয়েছে। চোখ দুটোও আড়াল করা গেছে তার ফলে।

    এই রাস্তার একদিকে বড়া ইমামবাড়া। অন্যদিকে ছোট হামামবাড়ি। মাঝখানে জামশিদ পালোয়ানের সরাইখানার সামনে একটা ছোট ভিড় হয়েছিল আফতাব আর খণ্ড্‌কে ঘিরে। তাদের দুজনেরই হাতে ফাঁস পরানো নারকেলের দড়ি, গায়ে নবাবজাদাদের মতো পোষাক। সরাইখানার বাঁধানো পাতকুয়োটা ঘিরে তারা গোল করে ঘুরছিল। আফতাব চিতার মতো আচমকা আক্রমণ করতেই খণ্ড্‌ দুর্ধর্ষ ডিগবাজি খেয়ে দাঁড়ানো একটা লোকের মাথায় উঠে গেল। ওয়াহ্‌, ওয়াহ্‌ করে উঠল সবাই।

    পাশে, মাটিতে ফেলে রাখা একটা ফেজটুপিতে টুকটাক সিক্কা ঢালছে পথচলতি লোক। একটা কলাও ফেলে দিয়ে গেছে কেউ। খণ্ড্‌ লোকটার চুল ঘেঁটে দুটো উকুন বের করে ফেলেছিল ততক্ষণে। সেগুলো উঁচিয়ে দেখাচ্ছিল সে। দুটো সিক্কা টুপিতে আরো পড়তেই খণ্ড্‌ উকুনদুটো মুখে ফেলে দিল। আফতাব আগের মতো ক্ষিপ্রতায় নিজের হাতের দড়িটা তাক করে ছুঁড়েছিল, উকুন খেতে ব্যস্ত খণ্ড্‌ একচুল মন্থর হওয়ায় ফাঁসটা আটকে গেল তার গলায়। আফতাব আচমকা টান দিতেই হুপ্‌ বলে একটা শব্দ করে খণ্ড্‌ মাথা ঘুরে পড়ল মাটিতে। দর্শকরা সভয়ে সরে যাচ্ছিল, এবং ততক্ষণে এক লাফে আফতাব এসে পড়েছে সেখানে। অচেতন খণ্ড্‌কে ল্যাজ ধরে তুলে নিয়ে সে কুয়োয় ফেলে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু জামশিদ পালোয়ানের ছেলেরা বারণ করল ইশারায়।

    লাঠি হাতে আধময়লা জামাকাপড় পরা একটা লোকের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল হরফন জাসুস।—বাঁদরদুটো এল কোত্থেকে? যেন কিছুই জানে না ভাব দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল সে।

    আড়চোখে হরফনকে দেখে নিয়ে লোকটা বলল—পশ্চিম থেকে এসেছে শুনছি। করতবী বন্দর। সরাইখানাতেই থাকে।

    —মানুষের মতো কথা বলে?

    —সেটা শুনিনি। কিন্তু কাজের আছে। শুনলাম ঠিকাদারির কাজও করে। সরাইখানায় একটা ভাট্টি বসিয়ে দিয়েছে। দেয়াল-টেয়াল মেরামত করেছে কিছু। খালি সময়ে করতব দেখায়।

    —এখন এই আধমরা উল্লুটার কী হবে? তার তো মনে হচ্ছে সব করতব শেষ।

    —আরে না, এসব তো সাজানো। একটু আধটু চোট অবশ্য তাও লেগে যায়। জামশিদ পহলওয়ান নিজে ভালো মালিশ করে। নইলে ওরাই চলে যাবে হাকীমের কাছে।

    —বাঃ! বুদ্ধি আছে তার মানে! ভালো কথা, হাকীমের বাড়িটা কোন দিকে বলতে পারো? আমারও একটা দরকার ছিল...।

    —সে আর আমায় বলে দিতে হবে না। ওই যে বুড়োকে দেখছ পালোয়ানের সঙ্গে কথা বলছে, দাড়িতে নীল আর লাল রঙ্গ্‌ দুটোই আছে? তিনিই হাকীম। পহলওয়ানকে ইউনানি তেল দিতে আসেন। পিছু নিয়ে বাড়ি অবধি চলে যাও। বেশি দূরও নয়।

    —তাই নাকি? মেঘ না চাইতেই জল। কিস্মৎ তো খুব ভালো দেখছি আজ!

    —সে আর বলতে। বন্দরের করতবও রোজ রোজ দেখা যায় নাকি? হাকীম এলে ওরা উত্সাহ পেয়ে দেখায়। তিনিই নাকি ইরান থেকে আমদানি করেছেন দুই মূর্তিমানকে। এরকম হাকীমও দ্বিতীয়টি পেতে গেলে ইস্পাহান অবধি খুঁজতে হবে। তো তোমার পেটের বিমারী না ফেফড়ার? বুখার উখার আছে নাকি?

    —ওসব কিছু নয়। মাথায় একটা ভয়ংকর খুজলি হয়েছে। যাচ্ছে না কিছুতেই।



    লাল-নীল দাড়িওয়ালা বুড়ো যে বাড়িটাতে ঢুকল সেটা হামামবাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। হরফন অবশ্য হামামবাড়িতেই থেমে গেল।

    তৈমুর বলে যে লোকটা হামাম চালায় সে একটা দানব। ঝোলানো মোচ। মুগুরের মতো দুটো হাত। মাথাটা নিখুঁতভাবে কামানো। সে হরফনকে বলল—শহরে নতুন বলে জানো না, দুপুরে লোক কম হয়, তাই হামাম বন্ধ থাকে। চম্পুর কাজটা খোলা আছে অবশ্য, সেটা করিয়ে নাও, তারপর বিকেলে চলে এসো। এখানে জেনানাদের স্নানের সুবিধে নেই, আর আয়তনে আমাদের হামাম একটু ছোট। নইলে কারিগরীতে ইস্তাম্বুলের বড়া আগা হামামকে হার মানায় আমাদের গরম-খানা আর ঠান্ডা জলের তালাব। আশেপাশের সবকটা নবাববাড়ির বাচ্চা থেকে বুড়ো সাত পুশ্ৎ ধরে গুসল করছে এখানে। গরম জলের ফোয়ারায় জিস্ম আর জানের সমস্ত গর্দ ধুলিয়ে চলে যাও ইমামবাড়ায়। সেখানে গুনাহগুলো কবুল করে একেবারে পাক-দিল আর তাজা-দম হয়ে চলে যাবে বাড়ি।

    হরফন বলল—বিকেলে এসে দেখে যাব বড়া আগার হামামকে হার মানানো তালাব কেমন। এখন হাকীমের বাড়ি যেতে হবে একটু। অবশ্য শুনছি সেখানে বাঁদরের উপদ্রব। আচ্ছা কোনো বিপদ নেই তো? আমার আবার জংলী জানোয়ারে ভয়।

    দানব তৈমুর বিকৃত মুখ করে বলল—বুড়ো হাকীমের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। নইলে কেউ বাঁদরকে দিয়ে হাজামত করায়? এখন তো শুনছি সেই দুটো উল্লু কা পঠ্ঠা মরীজদের বাড়িতে ওষুধ দিয়ে আসে। হাতে করে ডিব্বা-উব্বা নিয়ে যাতায়াত করতে আমিও দেখেছি।

    —হামামে এসে উত্পাত করছে?

    —আমিও সেই আশাতেই আছি। তাহলে নিজের হাতে দুটোর ঘাড় ভেঙ্গে দেবার মওকা আর ইজাজত দুটোই পাওয়া যাবে।

    —তুমি তাহলে এই হাকীমের কাছে আর যাও না?

    —আগেও যেতাম না। একে আমি একেবারেই বিশ্বাস করি না।

    —বলো কী? কোনো গড়বড় আছে নাকি? গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করে হরফন।—কিছু শুনেছ ওর নামে?

    —শুনেছি মানে? নিজের চোখে দেখেছি। এই বুড়োর সবচেয়ে নামকরা মরীজ ছিলেন বুড়ো নবাব। একদিন ব্যস্‌, গায়ব হয়ে গেলেন। ওরকম তন্দুরস্ত আর সখ্‌ত-জান মানুষটা একদিনের মধ্যে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন জনাব। কেউ কোনো খোঁজ পেল না কীভাবে ইন্তেকাল হল তাঁর।

    —সর্বনাশ। এরকম আরো হয়েছে নাকি মরীজদের সাথে? কেউ কিছু বলেনি? কাজী আছে তো শহরে?

    তৈমুর খানিকক্ষণ চুপ করে ভাবে। তারপর মাথা নাড়িয়ে বিড়বিড় করে বলতে শুরু করে—কাজী তো নবাবেরই চাচাতো ভাই ছিল। কিন্তু...। এরপর কী একটা বলতে গিয়ে তৈমুর নিজেকে সামলে নেয় এবং আচমকা আবিষ্কার করে যে তার বড্ড দেরী হয়ে যাচ্ছে। হামামের ভাট্টিতে আগুন দেবার ছুতো করে সে উঠে পড়ছিল। হরফন নাছোড়বান্দা বাচ্চার মতো তার জামার হাতাটা ধরে টেনে বলেছিল—আরে শোনো তৈমুর-ভাই, যেতে যেতে একটা হদিশ দিয়ে যাও। নতুন এসেছি শহরে, কাউকে চিনি না। তো একটা বাবুর্চী লাগবে, ভালো বিরিয়ানি বানাতে পারে এমন কেউ। আছে তোমার সন্ধানে?

    হরফন স্পষ্ট বুঝতে পারে যে দানো তৈমুরের ঘিঘ্‌ঘি বন্দ্‌, অর্থাৎ গলা দিয়ে আর স্বর বেরোচ্ছে না। অত বড় শরীর নিয়ে লোকটা তার দিকে একটা সন্দেহের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এক ঝটকায় হাতা ছাড়িয়ে পিঠটান দিতে পারলে বাঁচে।



    বিকেল হবার আগেই বুড়ো বুখারী হাকীমের ঘরে গিয়ে বসে পড়েছিল হরফন। দুরারোগ্য একটা অসুখ নিয়ে গম্ভীর আলোচনায় ডুবে গিয়েছিল দুজনে।

    —মর্জটা আপনার দিমাগের ভিতরে না বাইরে। আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন বুখারী হাকীম। তাঁর নিজেরই সামনের দাঁত দুটো নেই। ফলে ‘ত’গুলো ‘থ’-এর মতো, আর ‘দ’গুলো ‘ধ’-এর মতো শোনাচ্ছিল।

    —মর্জটা ‘ধিমাগের’ ভিতর। স্বীকার করল হরফন।—কিন্তু তার একটা কুফল, একটা নতীজা দেখা দিচ্ছে দিমাগের বাইরেও, সর-এর উপর। এই খুজলি। চুলকে চুলকে তো আমি নাস্তানাবুদ। জনাব এটাকে দূর করা যায় কীভাবে?

    —আগে দিমাগের ভিতরের ব্যাধিটা তো সারাবেন? সেটার কী লক্ষণ? বুখারী জানতে চাইলেন।

    —মারুন গুলি ভিতরের ব্যাধির, সেটা তো আর চুলকোতে হয় না। আপনি খুজলিটার কিছু করুন।

    —কী মুশকীল! মজর্টা কী না ধরতে পারলে তার ইলাজ হবে কী করে।

    হরফন সাহিবাবাদের বাদশার মাথার অসুখটা কী অনুমান করে সেটাই বোঝাবার চেষ্টা করে।—এই ধরুন, স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে গেছে। নিজের লোকেদের চিনতে পারছি না। এমনকি মাঝে মাঝে মনে করুন, যেন নিজেকেই চিনতে পারছি না। একটা ভূত সওয়ার হয়ে যাচ্ছে মাথার উপর, তার ইচ্ছেমতো কাজ করাচ্ছে। ভূতেই ধরেছে বলতে পারেন। যবে থেকে খুজলি, তবে থেকে ভুত।

    —ভূতাউ খুজলি! বদ্‌-নীয়ত ভূতের খতরনাক চঙ্গুল! জান-লেওয়া বিমারী এটা। দাড়ি চুমরে জানালেন হাকীম।—হুমমম... একটা উপায় হল সর-ভট্টি। চুলের উপর বারুদ মাখিয়ে একটা লম্বা পলতে লাগিয়ে দেব আমি। তারপর কোনো করীবী রিশতেদারকে চাই যে দূর থেকে সেটাতে আগুন দিয়ে সময় থাকতে সরে পড়বে। সও-ফিসদী ভূত ভাগবে কিন্তু বদকিস্মতী সে জানেরও খুব জোখম আছে।

    —কোনো অন্য রাস্তা বলুন মেহেরবানী করে। হাকীমের বাস্তববোধের অভাবে বিস্মিত হয়ে জানায় হরফন।

    একটা পুরোনো চামড়ায় বাঁধানো কেতাব ঘাঁটতে ঘাঁটতে বিড়বিড় করতে থাকেন হাকীম।—ভূতাউ খুজলি... ভূতাউ খুজলি... হ্যাঁ এই আরেকটা ইলাজ পাওয়া গেছে। চুলে গুড় আর ঘী মাখিয়ে বাচ্চা উঁট একটা ডেকে আনতে হবে। কাঁটা সমেত যেমন তারা ঝোপ উখড়ে খেয়ে নেয়, তেমনই ভূত সমেত চুল উপড়ে নেবে। কিন্তু খবর্দার, একটা চুলও যেন বাকি না পড়ে থাকে। দরকার হলে দুটো উঁট রাখতে হবে।

    —জনাব আপনি জান বাঁচাবার নুস্খা দিচ্ছেন না জান গঁওয়াবার? একটু সমঝে বুঝে দাওয়া দিন যাতে ভূতও যাবে আর প্রাণও বাঁচবে। উপরন্তু ব্যথাও লাগবে না। খরচ যা লাগে লাগুক।

    হাকীম খানিকক্ষণ শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললেন—খরচে ভয় নেই? আচ্ছা। দুটো দিন সময় দিন তাহলে। একটু চিন্তা করে দেখি।

    —ভালো করে চিন্তা করুন। জীবন মরণের সমস্যা।

    বেরোবার আগে হরফন একটা রূপোর সিক্কা ভেট করে দেয়। পায়ে জুতো গলাতে গলাতে জিজ্ঞেস করে—দুটো অকল্‌মন্দ্‌ বাঁদর নিয়ে এসেছেন শুনলাম। বেচবেন নাকি?

    —আরে না না। হাকীম হাত নেড়ে জানান।—বাঁদররা নিজেরাই কোত্থেকে এসে হাজির হয়েছে। ছোটখাটো কাজ করে দেয়, তাই সিকিটা, আনাটা দিই। কাজের লোক দরকার তো ওদের নিতে পারেন। ঠকবেন না।

    —বাবুর্চী খুঁজছি একটা। অমনি জানিয়ে দেয় হরফন।—আজে বাজে হলে চলবে না। অওয়ল দর্জার। খানদানী কাউকে পাই তো সঙ্গে নিয়ে যাই।

    —সেরকম কি আর এই মহল্লায় আছে আর? বহুদিন সেরকম কাউকে দেখিনি এপাড়ায়।

    —আগে ছিল বুঝি?

    —হ্যাঁ। এই পাড়াতেই ছিল।

    —কে বলুন তো?

    —গলির মোড়ে তৈমুরের হামাম দেখেছেন তো। তার একটা বড় ভাই ছিল। নবাবের বাড়িতে রাঁধত সে।

    —কী হল তার?

    —সে ব্যাটা কোতওয়ালের ভয়ে পালিয়েছে।



    হামামের প্রথম ঘরটাতে আলো আসছিল উপরের ঘুলঘুলি দিয়ে। সরু আর লম্বা ঘরটার দুদিকে কাঠের তক্তপোশ পাতা। মাঝখানে একটা ছোকরা ছেলে বসে কাঠিতে লাগানো মিঠাই চুষছিল। তার কবজিতে একগুচ্ছ রঙীন চাবি বাঁধা। হরফন একটা কাঠের বাক্স নিজের জন্য পছন্দ করে তাতে বিরাট পাগড়ি সহ জামা-কাপড়গুলো খুলে রাখল। ছেলেটা অমনি উঠে এসে সেটাতে চাবি দিয়ে তার রঙটা দেখিয়ে দিল হরফনকে।

    বুখারী হাকীমের পালা শেষ করে হরফন বিকেলের দিকে হামামবাড়িতে গিয়ে ঢুকেছিল। ঢুকে দেখে তখনো সে দিনের প্রথম খরিদ্দার।

    তৈমুরকে একবারই দেখা গিয়েছিল হামামে ঢোকার মুখে। সিক্কাটা নিয়ে সে হরফনকে একটা মোটা কাপড়ের তৌলিয়া, একটা পাতলা পেশ্‌থমল গামছা, আর ইত্র দেওয়া তেল ধরিয়ে দিয়ে ব্যাজার মুখ করে সরে পড়েছিল।

    দ্বিতীয় ঘরটাতে আলো কম হলেও উঁচু ছাতের বিরাট আয়তনের মাঝখানে শাদা সঙ্গমর্মরের চৌকো মেজটা দেখতে হরফনের অসুবিধে হয়নি।। পাথরের ফরাসে পা দিতেই সেটা কতটা গরম টের পেল সে। ঘরের দেওয়ালগুলোও পাথরের। চারদিকে ছোট ছোট স্নানের জায়গা। কেউ কোথাও নেই। একটা অদ্ভুত নৈঃশব্দ্যের মধ্যে কাঠ পোড়াবার শব্দ পাচ্ছিল হরফন। মাঝখানকার শ্বেত পাথরের মেজের উপর হাত ঠেকিয়েই সে বুঝল সেটা অসম্ভব গরম—নীচের কুলহন থেকে গরম হাওয়া তার মধ্যে দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে হরফনের সমস্ত শরীর ঘেমে উঠেছিল। সে একটা স্নানের জায়গায় ঢুকে মোটা তৌলিয়াটা পেতে পাথরের চৌকিতে বসে পড়ল। দেয়ালের আড়ালে তাকে কেউ দেখতে পাবে না। কুলহনের ভাট্টি থেকে গরম বাতাস এখানেও চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই গরমের মধ্যে বসে ঘামতে ঘামতে হরফন অপেক্ষা করছিল হামামের অন্য মেহমানদের।



    হরফন তিনদিন ধরে শহরে ঘুরছিল পুরোনো বাবুর্চীদের কাউকে খুঁজে পাবার আশায়। কোথায় গেল তারা? জাসুসের কাছে এটাই একটা রহস্য। নবাবজাদারা সবাই বহুদিন আগে হাদসায় মরেছে এটা জানে সবাই। কিন্তু বাবুর্চীগুলো কোথায় গেল? কেউ ভালো করে সেটা বলতে পারে না। বা বলতে চায় না। শহরের কোতওয়াল নাকি ধরেছিল কয়েকটাকে। কিন্তু হরফনের জাসুসী মন বলছিল, অন্তত দু-একজন পুরোনো লোক পাওয়া যাবে যারা বাবুর্চীদের খবর জানে।

    বেশ খানিকক্ষণ ধরে এই সব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়েই পড়েছিল প্রায় হরফন। কারো একটা পায়ের শব্দে তার চটকা যখন ভাঙল, তখন সে দেখে ঘামে তার তৌলিয়াটা একেবারে সপসপে হয়ে গেছে, আর বেশিক্ষণ বসলে অসুস্থই হয়ে পড়বে। উঠে গরমখানা থেকে বেরিয়ে পরের ঘরটাতে ঢুকল হরফন। সে ভেবেছিল যার পায়ের শব্দ তার কানে এসেছিল, তাকে এই ঘরটাতে দেখতে পাওয়া যাবে। কিন্তু নিকষ অন্ধকার সরু গলির মতো জায়গাটা আসলে কোনো স্নানের ঘর নয়, গরমখানা আর ঠান্ডাখানা দুটোকে আলাদা করে রাখার জন্য খানিকটা দূরত্ব বিশেষ। হরফনের মন বলছিল এগোলে বিপদ। কিন্তু তার তিনদিনের পরিশ্রমে পাকানো তহকীকাতের ঘুঁটিটাকে যদি সে এগিয়ে না নিয়ে যায় তাহলে সে কীসের জাসুস?



    ঘুঁটিটা পেকেছিল শহরে একটা খবর ছড়িয়ে দেবার পর। বাবুর্চী খুঁজছি ভাই। অওয়ল দর্জার! নবাববাড়ির খানা পাকাতে পারে এমন লোক। জানা চেনা থাকলে দয়া করে যোগাযোগ করুন।

    খবরটা শহরের লোকেদের দুদলে ভাগ করে দিচ্ছিল। একদল অবাক হয়ে তাকাচ্ছিল তার দিকে, যেন তার মতো আহাম্মক আর নেই। আর অন্যদল ভয়ের চোখে তাকাতে শুরু করেছিল। যেন তাদের কিছু লুকোবার আছে। হরফনের মনের ভিতরে পুষে রাখা সন্দেহের হলুদ কুকুরটা প্রথমে ইমামবাড়া থেকে সরাইখানার দিকে শুঁকতে শুঁকতে এগিয়েছিল। এবং শেষে হামামবাড়ির চারদিকে ঘুরছিল গোল করে।



    গলিটা পেরিয়ে পরের ঘরটাতে ঢুকে হরফন দেখে সেটাই হামামের সবচেয়ে বড় কামরা। গরম ঘরটা যেরকম গরম, ঠান্ডা ঘরটা সেরকমই ঠান্ডা। কীভাবে এতটা ঠান্ডা করা হল ভেবে তাজ্জব হতে হয়। মাঝখানের বিরাট চৌকো কালো জায়গাটা দেখে আন্দাজ করা যায় সেটা একটা জলের চৌবাচ্চা। কিন্তু কতটা গভীর বোঝা যাচ্ছিল না।

    ঠান্ডা-খানার দূরে অন্ধকার কোণে কেউ বসে থাকলেও হরফন তাকে দেখতে পাচ্ছিল না, কিন্তু দরজার মুখে দাঁড়ানো হরফনের পিছনে গরমখানার আলো থাকায় তাকে দেখতে কারো অসুবিধে হবার কথা নয়।

    হরফন ইচ্ছে করে শীষ দিতে দিতে ঢুকল এবং কালো পাথরের মেঝেটা পেরিয়ে চৌবাচ্চার জলে পা ডুবিয়ে বসল নিজেকে ঠান্ডা করার জন্য। কান তার খাড়া ছিল চৌবাচ্চার ওপারে অন্ধকার কোণগুলোর দিকে। খুব চেষ্টা করার পর যেন সে শুনতেও পেল একটা নরম কিন্তু ভারী পায়ের শব্দ। কিন্তু কোনদিক থেকে শব্দটা আসছে বোঝা যাচ্ছিল না। আরো খানিকক্ষণ বসে থাকার পরে হরফন কোনো আওয়াজ না করে কনকনে শীতল জলের মধ্যে নিজেকে নামিয়ে দিয়ে বুঝতে পারল সেটা আসলে এক মানুষের চেয়েও গভীর তালাব। জলের মধ্যে মাথা ডুবিয়ে হরফন নিজেকে গায়েব করে দিল। তারপর আস্তে আস্তে এগোতে থাকল তালাবের উল্টোদিকের পাড় লক্ষ্য করে।





    বুখারী হাকীম

    সন্ধ্যেবেলা দুই বাঁদরের কাঁধে চেপে হভেলীতে ঢুকছিল হরফন জাসুসের দেহ। ছোটি-বেগম এই দৃশ্য দেখে রুটি পাকানো ভাড় মে যায়ে বলে দুদ্দাড়িয়ে ছুটে এলেন।—সর্বনাশ! কী হয়েছে লোকটার? বেঁচে আছে?

    আফতাব আর খণ্ড্‌ হাতের ছুরি দিয়ে গলায় পোঁচ দেবার ভঙ্গী করল। অর্থাৎ হরফন অবশেষে আল্লার পিয়ারাই হয়েছে জাসুসী করতে গিয়ে।

    পরে উনুনের কাছে একটা গরম পানীয়ের পেয়ালার পাশে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল জাসুসকে, যার শ্বাস চলছিল না, কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে একটা কিছু ছিল যা দেখে ছোটি-বেগম বললেন—মুর্দা নয়, জিন্দা লাশ এটা। ছোটি-বেগম গরম জলের পেয়ালাতে একটা লাল পুরিয়া এনে ফেলে দিয়েছিলেন। তার বাষ্পের মধ্যে একসময় হরফন মৃত্যু থেকে দ্বিতীয়বার জিন্দা হবার তজুর্বা হাসিল করল। বে-হোশ হরফন উনুনের পাশে শুয়ে কখনো দেখছিল আফতাব আর খণ্ডের মুখদুটো স্বচ্ছ জলের পর্দার বাইরে থেকে তার দিকে বনমানুষের মতো বিকট চোখের সুড়ঙ্গ ধরে এগিয়ে আসছে। কখনো তার মনে হচ্ছিল তাকে গর্দন ধরে দুটো বিরাট আকৃতির লোক হামামের ঠান্ডা পানির তালাবের তলায় মেঝেতে পুঁতে ফেলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সে যখন লড়াই থামিয়ে ক্ষান্তকলরব জলের গভীরে ঘুমোবে বলে প্রস্তুত, তখন বুদবুদের জগৎ থেকে হরফন শুনেছিল গুড়গুড় করে কেউ বলছে—জাসুসী বার করছি তোমার।

    নিজেকে ঝাঁকিয়ে জিন্দা করে আরেকবার জাগাতে চায় হরফন। এক সময় মনে হয় মাত্র দুহাত দূরে বসে রুটি দিয়ে ডাল খাচ্ছে আফতাব। তার কবজিতে একটা সবুজ পান্না বসানো তাবীজ। হরফন এগিয়ে সেটা খুলে নেবে ভেবেছিল, কিন্তু নিজের কম্বখ্‌ৎ বেহুদা শরীরটাকেই নড়ানো সম্ভব হয়নি। আফতাব তাবীজটা খুলে তার চোখের কাছে নিয়ে দোলালো। হরফনের মনে পড়ল না তৈমুরের হাতে সেটা দেখেছিল কিনা। এটা কি তাহলে ছিল অন্য দানবটার কাছে? হরফন জানতে চাইছিল তাদের হল কী। কিন্তু দিমাগের অর্ধেকটা জলের নীচে তালাবের ঠান্ডা মেঝেতে পড়ে থাকার জন্য তার জবান দিয়ে কথা বেরোছিল না। আবার যে ছবিটা সে দেখতে পাচ্ছিল, জলের ভিতর থেকে সেটাই তার দেখা শেষ ছবি কিনা ভাবছিল সে। গলায় নারকেলের দড়ির আচমকা টানে কার যেন জিভ বে-লাগাম বেরিয়ে আসছে। খণ্ডের ঝকঝকে সাদা দাঁতের পাটির কামড়ে সেটা ক্রমশ আরো লম্বা হয়ে যাচ্ছে। হরফনের মনে একটা দৃঢ বিশ্বাস জন্ম নিচ্ছিল যে ইস্তাম্বুলের বড়া আগাকে হার মানানো ছোট হামামবাড়ি এখনকার মতো বন্ধ। কিন্তু কেন এই বিশ্বাসটা তার মনে বদ্ধমূল হয়ে বসেছিল সেটা সে বুঝতে পারল না।

    রাত আরো গভীর হবার সাথে সাথে যখন সে কিছুটা চিন্তার ক্ষমতা ফেরত পেয়েছিল তখন হরফন বুঝতে পারে যে হাওয়ামহলের উঠোন থেকে যে দুটো গলার স্বর সে শুনতে পাচ্ছিল তার মধ্যে নবাবের চেয়েও নীচু গলাটা বুড়ো বুখারী হাকীমের।



    দিন ও রাতের মধ্যে তফাৎ করতে পারত না যখন হরফন তখন ছোটি-বেগমের বানানো রুটি আর শরবৎ থেকে সে সময়ের একটা আন্দাজ করার চেষ্টা করত। কখনো মনে হত একই ঘটনা ঘটে যাচ্ছে দুদিন তিনদিন ধরে। কখনো মনে হত সে শীশমহলের একটা শুকনো ঘরে জ্বর নিয়ে পড়ে আছে মাসের পর মাস। একদিন নিজের নাম মনে করার চেষ্টা করে না-কাময়াব হয়ে সে বেগমকেই জিজ্ঞেস করল।

    —আমি কে?

    —না আদমী, না লাশ। নির্দ্বিধায় জানিয়েছিলেন ছোটি-বেগম।—তোমার নাম হরফন। তুমি সাহিবাবাদের জাসুস।

    —ও হ্যাঁ। তো বাবুর্চীগুলো কোথায় গেল?

    —সেটাই খোঁজ করতে গিয়েছিলে তুমি হামামবাড়িতে?

    —হামামবাড়ি? ফ্যাকাশে হয়ে গিয়ে কোঁৎ করে উগরে দিল হরফন।—সেখানে তো আমি একা একা গরমঘরে হামাম নিচ্ছিলাম।

    —তারপর কী হল? কৌতূহলে বিছানায় বসে পড়লেন ছোটি-বেগম।—কাউকে দেখলে সেখানে?

    —সেখান থেকে বেরিয়ে ফোয়ারায় স্নান করলাম। তাও একা। কেউ ছিল না কোথাও। শুধু জলের শব্দ আর হামামের তলায় ভাট্টি থেকে কাঠ পোড়াবার আওয়াজ।

    —কেউ একটা তো ছিল। হামামের কর্মচারী কেউ? কিচ্ছু মনে পড়ছে না?

    —একদম একা। ফোয়ারার পর একটা অন্ধকার জায়গা। তার ওপারে কম রোশনীর বড়া তালাবখানা। খুব ঠান্ডা। আমি গিয়ে সেই ঠান্ডা পানিতে নেমে পড়লাম।

    তারপর হরফন চুপ মেরে গেল। ছোটি-বেগম কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে পড়লেন, কারণ বাকিটা হরফনের মনে পড়ছিল না, বা সে গুছিয়ে বলতে পারছিল না।



    একদিন হরফনের মনে হল ছোটি-বেগমের সঙ্গে আর কেউ এসেছে। চোখ খুলে দেখে লাল-নীল দাড়ি-ওয়ালা বুখারী হাকীম। হাতে একটা তামার ডিব্বা। হরফনকে দেখিয়ে বললেন—তোমার মাথার রোগের ওষুধ।

    হরফন মাফী চেয়ে নিয়ে জানালো রোগটা আসলে তার নয়, সাহিবাবাদের বাদশার, যাঁর মাথায় খোশ্‌ক্‌ বিরয়ানের ভূত সওয়ার হয়ে আছে।

    —হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে সব জানি। ভয় নেই, এই ওষুধটা তোমারই। এটা নিলে তবেই তো ধিমাগটা তালাবের অন্ধকার থেকে বেরোবে। খোশ্‌ক্‌ বিরয়ানের জন্য একটা আলাদা ধাওয়াই দিয়েছি। কাজ হবে কিনা অবশ্য জানি না। মক্কেলটা হালালও হয়ে যেতে পারে।

    —তাহলে ভূতের কী হবে?

    —সেটার কাম আগেই তামাম হবে উম্মীদ রাখছি।

    —খুদা-কা-ওয়াস্তা, সত্যি কথা বলবেন, নইলে আপনার জন্নত নসীব হবে না। আমাদের বাদশার চুলে কি বারুদ দিচ্ছেন জনাব?

    —নাঃ, নাঃ। লজ্জিত হয়ে মাথা নাড়ান বুখারী হাকীম।—ইতমীনান রাখো। খারাপ কিছু দিচ্ছি না। শুধু একটু বিষ পিলাচ্ছি সুবো-শাম। বন্দরদের দিয়ে মুঁহ খুলিয়ে হলক মে জহর ডালিয়ে দিচ্ছি থোড়া থোড়া করে। রোজ বাড়াচ্ছি পরিমাণটা। চালিস রোজে মরে যায় পুরো আদমী। বীস রোজে অর্ধেকটা মরে। এখন সওয়াল হল কোন অর্ধেকটা আগে মরে? যে কিরদারটা নিজের বাপ পরদাদাদের কাছ থেকে পাওয়া না যেটা ভূতের কাছ থেকে পাওয়া?

    —যদি মানুষটা ভূতের আগে মরে যায়?

    —বুরা কেয়া হ্যায়? নিজের কুকর্মের ফল পাবে। সব্‌রঙ্গ্‌ মির্চীর মতো শরীফ ইনসানকে তো ও-ই খামখোয়া হালাল করালো। কিন্তু নাচীজকে হাকীম বলে। মানে বোঝো? যারা মানুষকে জিন্দা করার চেষ্টা করে। বুরা সে বুরা আদমীকেও আমাদের বাঁচাবার চেষ্টা করতে হয়। না যদি পারি, তো জাহির হ্যায় মরবে। প্রশ্ন হল, ভূতটা যাবে কোথায়? সেটাও মরবে। কিন্তু যদি ভূতটা আগে মরে, তাহলে মানুষটা বাঁচলেও বেঁচে যেতে পারে।

    কথার ফাঁকেই হরফনের মুঁহ ফাঁক করে তাম্বার ডিব্বা থেকে হলকে চার ফোঁটা ফুটন্ত তেল ফেলে দিলেন বুখারী হাকীম। মারাত্মক কাশতে কাশতে হরফন বলল—এটা কীসের জহর?

    —এটা জহর নয় মেরে বাপ! এটা তোমার নিজেরই পেশাবের ভিতরকার গুস্সা আর গুরূর। পিশাবী আগ বলে একে। তুমি মরতে তৈয়ার হয়ে গিয়েছিলে বলে তোমার লড়াই করার ইচ্ছেটা আগে মরে গিয়েছিল। এটা তোমার মধ্যে সেই খোয়াইশটা আবার পয়দা করে দেবে।

    —আমি তো জ্বরে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছি মালিক। আমার তিন রোজ পেশাবই হয়নি।

    —অ। তাই নাকি? যাহোক, অন্যদের তো হয়েছে। বলে বুখারী হাকীম তাড়াতাড়ি সরে পড়লেন কামরা খালি করে।



    আরো কত রোজ পরে কে জানে, যখন কনুইতে ভর দিয়ে বসতে পারছিল হরফন, একটু একটু হাঁটতে পারছিল, একদিন সন্ধ্যেবেলা জল মেশানো দুধের মতো শাদা আর ফ্যাকাসে হয়ে এসে ছোটি-বেগম বললেন—জাসুস তোমায় আসতে হবে আমার সঙ্গে।

    ছোটি-বেগমের হাত ধরে জাসুস বহুদিন পর আবার ঢুকেছিল শীশমহলের খাস বাবুর্চীখানার উঁচু ছাতের তলায়। ভালো চাল আর কেশরের মিহি গুঁড়ো আলাদা করে রাখা ছিল সেখানে।

    তৈরি ছিল অঙ্গুরী সিরকা, মাটির মসালাদানে গুলকন্দ-এ-আফরোজ, আনারের দানা, কিশমিশ আর মিশমিশ। তুলসীর কাঠ ভর্তি ছোট ছোট পাথরের হাঁড়ি।

    কোথায় খোশ্‌ক্‌ বিরয়ান?

    ছোটি-বেগমের হাত কাঁপছিল। তিনি জাসুসের হাতে একটা বড় খন্তা ধরিয়ে বলছিলেন—পারবে তুমি কোনোরকম জাসুসী টাসুসী করে বিরিয়ানিটা বানাতে?

    খন্তাটা ঠঙ করে ফেলে দিয়ে জাসুস ছিটকে গিয়েছিল।

    —জাসুসী করে বিরিয়ানি হয় নাকি? মুখে দেবার যোগ্য হবে না বেগম! ক্ষেপে যাবে সমস্ত অন্য বেগম আর তাদের বাচ্চারা। বাদশা কোথায়?

    —সে ব্যাটা সাহিবাবাদে চলে গেছে।

    —সুস্থ হয়ে গেছেন?

    —তাই বলতে পারো। বুখারি হকীমের কড়া দাওয়াইয়ের অসরে অবশ্য একটা চোখ গেছে, ডান হাতটাও কাজ করছে না। চুলগুলো আগেই পড়ে গিয়েছিল, এখন দেখলাম সারা গা-জুড়ে ফোস্কার মতো ঘা। আজ সকালে কাঁদতে কাঁদতে আমাদের নবাবকে বলেছে সে নাকি আসলে সাহিবাবাদের বাদশাও নয়, হম্‌শক্‌ল্‌ চাকর। বাদশা অসুস্থ হলে তার জায়গায় দেওয়ান-এ-আমে বসত। একদিন চাকরকে সেখানে বসিয়ে বাদশা নিজের পোষা কুমীরের ছানার সঙ্গে ছুপন-ছুপাই খেলতে যায়। কোথায় যে গিয়ে সে ছুপেছে তারপর আর তাকে পাওয়াই যায়নি। বেচারা কুমীরটাও খুঁজে খুঁজে হয়রান। ফলে হম্‌শক্‌ল্‌ চাকরকে এখন দুটো পরিবারের দেখাশোনা করতে হয়।

    —তিনি আর বিরিয়ানি বানাতে পারবেন না বললেন?

    —না, চুলের সঙ্গে ভূতাউ খুশকীটা গেছে। এখন উপায় কী তুমিই বলো হরফন।

    দুশ্চিন্তায় হরফন যখন ছটফট করছিল আর ছোটি-বেগম থরথর করে কাঁপছিলেন তখন বাবুর্চীখানায় উঁকি দিয়ে ঢুকল আফতাব আর খণ্ড্‌। খণ্ড্‌ উঁচু করে দেখালো তার হাতে একটা তামার ডিব্বা। আফতাব গলার সামনে হাত চালিয়ে সেই ভঙ্গীটাই করল যার অর্থ—খণ্ডের কথা শুনলে আর কাউকে বাঁচতে হচ্ছে না।



    রাত্রিবেলা হরফন একটা পাগড়ি বেঁধে সমাগত উঠোনভর্তি বেগম আর বাচ্চাদের গিয়ে বলল—নহীঁ, নহীঁ, নহীঁ!

    তারা সবাই ঘাড় দুলিয়ে বলে উঠল—হাঁ, হাঁ, হাঁ!

    বিরিয়ানি তৈরিই ছিল। খণ্ড্‌ আর আফতাব নিপুণ হাতে পরিবেশন করতে করতে ছোটি-বেগম আর হরফনকে ইশারায় বলল—সময় থাকতে ভেগে যান। হরফন ভালো করেই জানত, বাচ্চারা বা তাদের মায়েরা বেশি শোরগোল করলে দুই করতবী বাঁদরের হাতে ধরা ভারী লোহার হাতা আর কড়ছি তাদের মাথায় ধড়াধ্‌ধড় পড়ে যে করতবটা দেখাবে সেটা আমিনাবাদের ইতিহাসে কেউ দেখেনি। তাই সে বাঁদরদের ছেড়ে নড়তে পারছিল না।



    কিন্তু বাচ্চারা ভালোই খেল। মায়েরাও কোনো গণ্ডগোল করল না। দাওয়াত শেষ হলে সমস্ত থালা বাসন যখন তুলে ফেলা হচ্ছিল তখন ছোটি-বেগম এসে হরফনের কানে কানে বললেন—এবার তুমিও ফিরে যাও হরফন। এখানে থাকা তোমার পক্ষে নিরাপদ নয়।

    —কিন্তু এদের জন্য একটা ভালো বাবুর্চী না পেলে যাই কী করে? বিরিয়ানিটা বানাতে হবে তো?

    —বুখারী হাকীমের জঘন্য দাওয়ায় যদি বিরিয়ানি হয়ে যায় তো বাঁদরগুলোও পারবে সেটা বানাতে। ভুলে যেও না তুমি এসেছিলে শুধু জাসুসী করতে।

    —তো সে কাজটা শেষ হল কোথায়? হামামবাড়িতে গিয়ে আরেকটু জাসুসী করা দরকার। জানা উচিত নয় তৈমুর আর তার দেড়গুণ ভারী দানো সাঙ্গোটা আমায় তাদের নিজেদেরই বাড়িতে মারতে চেষ্টা করেছিল কেন? তারা কি বেঁচে আছে না আমায় তালাবী-মওৎ মারতে এসে উল্টে তাদেরই সলিল-সমাধি হয়ে গিয়েছিল সেদিন? আফতাব আর খণ্ড্‌ই বা কী করে সেখানে বিলকুল ঠিক ওয়ক্তে পৌঁছে গেল—সেটাও কী তাদের কোনো জাদুই কারনামা, না কোনো ঠান্ডা মস্তিষ্কের পূর্বপরিকল্পিত মতলব?

    ছোটি-বেগম একটা গুস্সার গরমা-গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সেখান থেকে বিদায় হলেন হরফনকে তার হাল পে ছেড়ে দিয়ে। সে মরে তো মরুক, আবার গিয়ে ঘুসুক হামামবাড়ি নামের সেই মনহূস আর বদ্‌নসীব মওৎ কা কুঁয়ায়! মরুক সব বেগম আর বাচ্চারা, মরুক নামাকুল বন্দরগুলোও! ছোটি-বেগমের তাতে কিছু এসে যায় না।

    হরফন বেগমের পিছু পিছু শীশমহলের বাইরে এসে দাঁড়ালো। অসুখের অনেকগুলি রাত ও দিন পার করে আজ প্রথম তার নিজেকে আবার মনে হচ্ছিল একটা সম্পূর্ণ সুস্থ আর সক্ষম জাসুস। কিন্তু কোত্থেকে একটা অদ্ভুত দর্দ তার দিলের মধ্যে এসে ঢুকে বসেছিল—বেগমের জন্য কেন তার মনটা দুঃখে ভরে ছিল সেটা সে ধরতে পাচ্ছিল না।

    শীশ আর হাওয়া মহলের মাঝখানের পাথরের জমিটাতে উঠে আসার পর একসময় কারণটা হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে গেল তার কাছে।

    আজ পূরণ মাসী। মাহ্‌-কামীল!





    পূরণ মাসী

    ছোটি-বেগম পাঁচিলের উপরে পা ঝুলিয়ে বসেছিলেন। তাঁর গোল চাঁদের মতো মুখটা হরফনের দিকে ফেরানো। হাওয়ায় বাদামী চুলগুলো উড়ছিল। হরফন ভাবল—ছোটি-বেগম অত উঁচু পাঁচিলের উপর উঠলেন কী করে?

    —একটা পান খেয়ে যান বেগম। মেহেরবানী করে নেমে আসুন দিওয়ার থেকে।

    —খোশ্‌ক্‌ বিরয়ান তো নেই। আজ আর নামার দরকার হবে না।

    —চাঁদ উঠে আসবে একটু পরে। জিন-পরীর শয়তানী কারখানা থেকে কী খেলার শুরুয়াত হবে কে বলতে পারে? আমার মন বলছে একটা কিছু অঘটন ঘটবে। আপনি আর নবাব দুজনেই আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ুন, বাইরে থাকবেন না।

    —আর তুমি?

    —আমি তো না আদমী, না লাশ। না জাসুস, না বিরয়ান। একবার মরে গিয়ে আবার উঠে চলতে শুরু করেছি। আজ রাতটা আমিও আর জাসুসী করব না। শুধু দেখব কারা কারা আসে।

    —তাহলে আমি এই পাঁচিলের উপর ওই মানুষখেকো চাঁদটার সঙ্গে বসে তোমাকে দেখব। বলে হা হা করে একটা অস্বাভাবিক হাসি হাসতে থাকেন ছোটি-বেগম।



    চাঁদটা আসতে চাইছিল না। হয়তো ছোটি-বেগমকে পাঁচিলের উপর দেখে সে সতর্ক হয়ে সরে গিয়েছিল। হাওয়ামহলের থামের আড়াল থেকে তাকে উঁকি মারতে দেখল হরফন। একটা কুতকুতে চোখ হভেলীর দিকে, অন্যটা ছোটি-বেগমের দিকে ফেরানো। যেন বাজীগরের আজব কেতাবের গজব কিস্সা সেখান থেকেই শুরু হবে।

    আর কিছু না পেয়ে হরফন তার বালিশের নীচে রেখে দেওয়া বহু পুরোনো জঙ ধরা ভাঙা তমঞ্চাটা হাতে নিয়ে বসল। যদি সেটা দেখিয়ে কাউকে ভয় পাওয়ানো যায়।

    রূপোর তবকের মতো ঝকঝকে মেঘের অনেকগুলি উজ্জ্বল জাহাজ উঠোনের উপর এসে ভীড় করেছিল। তার উপর থেকে জিন, হিন, ঘুল, মারীদ, ইবলিস, ইফরিত—আর কে এমন আছে রাতের আলোর জীব—যারা দূরবীন দিয়ে হভেলীর দিকে অপরিসীম কৌতূহলের সঙ্গে তাকিয়ে ছিল না। হাওয়াও থম মেরে তার চশমা খুঁজে বসে পড়েছে নির্দিষ্ট আসনে। ছোটি-বেগমের চুলগুলো উড়তে উড়তে স্থির হয়ে আঙুল বাড়িয়ে দিয়েছিল কালো আসমানের সেই জিন, হিন, ঘুল, মারীদ, ইবলিস, ইফরিত—আরো যত আছে রাতের আলোর জীব—বিন, তিম, রিম, সিলা, কুতরুব—তাদের দিকে। হরফনের মনে হল ছোটি-বেগম তাদের মাঝে মাঝে একটা করে হাসির এক্কা-গাড়িভর্তি পাঠিয়ে দিচ্ছেন খুচরো খাস-খবর বা টুকরো জাসুসনামা।



    কেন সে বাবুর্চী হল না? পাথরের মেঝের উপর, দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে এই প্রশ্নটা হরফন করছিল নিজেকে। কিম্বা কোনো বুড়ো হাকীমের ফুটফাট কাজের শাগির্দ? বাজীগর হয়ে সেও কি শহরে শহরে খেলা দেখিয়ে বেড়াতে পারত না? আর কিছু না হোক, একটা ঘোড়াওয়ালা কি টাঙ্গাওয়ালা হওয়ার মতো যোগ্যতা তার ছিল নিশ্চয়ই। মাসখানেক আগে তৈমুর আর তার দেড়া পাঙ্গো মিলে তাকে জলে ডুবিয়ে প্রায় মেরে ফেলেছিল মনে হয়। সেই ঘটনাটার শেষ কীভাবে হল মনে পড়ে না হরফনের—কিন্তু সে অনেকবার ভেবেছিল—এরকম শাস্তি কে পায়? এটা তার জাসুস হবারই ফল নয়? যদিও আফতাব আর খণ্ড্‌ তাকে কিছুই বলেনি, তবু তার মনে হয়, তারা না এসে পড়লে সেদিন জাসুসী সত্যিই সাঙ্গ হত তার।

    কেন সে সব ছেড়ে জাসুস হতে গেল? তাতে কি কোনো লাভই হয়েছে তার? না শুধু নুকসানই নুকসান?

    তার বাপ-দাদা সবাই অবশ্য সাত পুশ্‌ৎ ধরে জাসুসীই করে এসেছে। বাপের তো একটা চোখ কানা হয়ে গিয়েছিল গোয়েন্দাগিরি করে করে, তাও কোনোদিন বাবুর্চী কি তবলচী হবার চেষ্টা করেনি। ছেলেবেলা সে যখন বাপকে জিজ্ঞেস করেছিল—এ কাজে লাভটা কী, তখন বাপ বলেছিল—হরফন মিঁয়া, জাসুসদের ভূতে ধরে না, সাপে কাটে না, কুকুরে কামড়ায় না, বৃষ্টির জল তাকে ভেজাবে না বলে ছোট ছোট গুঁড়ো হয়ে হাওয়ায় উড়ে যায়। আর যেখানে সবাই পথ হারায়, একমাত্র জাসুসরা সেখানে পথ খুঁজে পায়।

    অথচ হরফনের দুঃস্বপ্নগুলোতে সে-ই পথ হারিয়ে বস্ত্‌-ও-দরের তহখানায় বাবুর্চীদের ছালায় ঢুকে বসে থাকে। জীবনের পথটিও কি কোনো সঠিক দিকে চলেছে তার?

    এইসব ভাবতে ভাবতে কখন হরফনের চোখ ঘুমের পুকুরে তলিয়ে গিয়েছিল কে জানে। তার ঘুমিয়ে পড়া অবধি বেগম তার দিকে মাঝে মাঝে নজর রেখেছিলেন। তারপর কী ঘটেছিল কেউ জানে না। বেগমের নীল বোরখার তলা দিয়ে পিল পিল করে দেয়াল বেয়ে নামছিল যখন ছায়ার পুতুলগুলো, তখনও হরফনের চোখ খোলেনি।



    ঘোড়ার খুরের শব্দে হরফন জাসুসের ঘুম ভাঙল। ধড়মড় করে উঠে সে দেখে পাথরের চত্বরের ঠিক মাঝখানে একটা গোল জায়গায় কোত্থেকে যেন ভোরের মতো নরম তিলস্মী আলো এসে পড়েছে। একটা পুতুল ঘোড়ার উপর সওয়ার হয়ে পুতলা নবাবজাদা পাহাড়ের পথ ভেঙ্গে উঠছিল। কেউ বলে দেয়নি, কিন্তু জাসুসের মনে হল যে দৃশ্যটা তার আগের দেখা পূরণ মাসীর ঘটনার পরের দিন সকালের। নবাবজাদার কাঁধে কোনো বন্দুক ছিল না, কিন্তু তার কোমর থেকে যে খেলনাটা ঝুলছিল সেটা যে হরফনের কোলে পড়ে থাকা ভাঙা তমঞ্চাটারই ভালো দিনের মূর্তি সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পাঁচিলের উপর বসে বেগমের চোখ দুটো রাতের প্রাণীর মতো ঝকঝক করে উঠে হরফনকে যেন বলল—দ্যাখো, আমার চিড়িমারকে! তার কোঠরির দরজাটা আমার খুলে দেওয়া উচিৎ হয়নি।

    ততক্ষণে হরফনের জাসুস দৃষ্টি ধরে ফেলেছিল ছোট রোগা মেয়ে পুতুলটাকেও, যে লুকিয়ে চিড়িমারের পিছু নিয়েছিল।

    পাঁচিলের পাশে হাওয়ামহলের আড়াল থেকে দুটো ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এসে থামে ঠেস দিয়ে বসল। আফতাব আর খণ্ড্‌। তাদের হাতে সরু কাঠির উপর পাথরের মতো শক্ত গুলকন্দের ডেলা। প্রাণপণে চুষছে দুজনেই। শহর থেকে নিয়ে এসেছে। হরফন একবার দেখেই ধরে নিল গুলকন্দে আফিম দেওয়া আছে। সাহিবাবাদের বাদশার কাছে আর ফেরেনি এরা। আমিনাবাদে এতকাল তো বিরিয়ানির জন্য টিকে ছিল। এখন এদের উদ্দেশ্যটা কী বুঝতে পারছিল না জাসুস।

    ছোকরা নবাবজাদা যে পাথরের চাঁইটার উপর গিয়ে বসেছে সেটা হরফনের চেনা। আফতাব হাতের কাঠি উঁচিয়ে হরফনকে সেটা দেখালো—অর্থাৎ, দেখলে তো, আমরা আগেই বলিনি? পাঁচিলের উপর বসে থাকা বেগমজানের চোখদুটো হঠাৎ বুজে গেছে। কিছু একটা ঘটতে চলেছিল। চিড়িমার নবাবজাদার হাতে শুধু একটাই তমঞ্চা আজ। যেটা সে আস্তে আস্তে নিজের কানপটিতে লাগিয়েছে। সভয়ে হরফন নিজের কোলের যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে দেখল সেটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। চিড়িমার ঘোড়াটা টিপতেই ...

    গুড়ুম্‌!

    এক ঝলক আলো আর বারুদের শব্দের সঙ্গে ধোঁয়ায় ঢেকে গেল তার শরীর।



    শাদা মেঘের বজরা থেকে উল্লাসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ইবলিস আর ইফরিতরা, যেন সেই মেয়েটাকে ধরেই ফেলবে, দুহাতে বোরখার ঘের হাঁটু অবধি তুলে যে তীরবেগে পাহাড়ের রাস্তা দিয়ে দৌড়ে নামছিল। তাদের চাঁদীর মতো চকচকে ধারালো আঙুলগুলো মাটি পর্যন্ত পৌঁছোবার আগেই অবশ্য তিলস্মী আলোর চাকতিটা ছোট হতে হতে আঙুলের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেল। অন্ধকারে মেয়েটাকেও আর দেখা গেল না।

    ফোঁস করে ওঠা হতাশ দীর্ঘশ্বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে বস্ত্‌-ও-দরের গাছপালার দিকটায় ইবলিসি আঁধী উঠল একটা। সেই ফাঁকে পাহাড়ের দৃশ্যটা মুছে দিয়ে বাজীগররা নতুন একটা খেলা শুরু করে দিয়েছিল পাথুরে চত্বরের আরেক অংশে। পূরণ মাসীর আলোয় হরফন দেখতে পাচ্ছিল শীশমহলের চেনা ঘরের ছবি। আরেক রাতের কাহিনী। বাবুর্চীরা সবাই ফিরে এসেছিল তাদের বাবুর্চীখানায়। খোশ্‌ক্‌ বিরয়ানকে হাকীমের বাড়ি পাঠাবার পর রাতের বিরিয়ানিটা তারাই বানাচ্ছিল আজ।

    কিছুটা দূরে অবিকল হাওয়ামহলের শরীফখানায় বুড়ো নবাব আর তার পুতুল নবাবজাদারা মিলে খেতে বসেছিল। একটা চাকাওয়ালা কাঠের তক্তায় চাপিয়ে বিরিয়ানিটা এনে রাখা হয়েছিল হাওয়ামহলের পাশে। দেখতে দেখতে আকাশভেলার জিন, মারীদ, ইবলিস, ইফরিতগুলো চাপা আনন্দে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করতে শুরু করেছিল। যেন এটাই তাদের প্রিয় ও সেরা দৃশ্য। সকালের ছোট মেয়েটাকেও দেখা যাচ্ছিল আবার। সে একবার পাঁচিলে বসা বেগমজানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে হরফনের দিকে চোখ ফেরালো। বহুদিন আগেকার সেই পুঁচকে ছোটি-বেগমের দিকে তাকিয়ে হরফন বুঝতে পারল যে বিকেলের দুঃখটা কোনো অনাহুত মুসাফিরের মতো রেগিস্তান পার করে এসে তার বুকের মেহমানখানায় পাকাপাকিভাবে তশরীফ রেখেছে। এখন তাকে সঙ্গ না দিয়ে নিস্তার নেই।

    সবার অলক্ষ্যে হরফনের চোখে চোখ রেখে মেয়েটা সেই বিরিয়ানিতে এক পেয়ালা শরবৎ মেশাচ্ছিল। কাজটা যে গর্হিত সে বিষয়ে যাতে কোনো সন্দেহ না থাকে তাই বাজীগরের তিলস্মী আলোটা নীলচে হয়ে এসেছিল। পুতুল নবাবজাদারা কাঠের খেলনার মতো টানটান হয়ে বসেছিল তাদের কলগুলো চালু হবার অপেক্ষায়। মেয়েটা সরে যাবার পর বাজীগরের অদৃশ্য ইশারা পেয়ে নবাবজাদারা বিরিয়ানি খেতে খেতে হঠাৎ সব্‌রঙ্গ্‌ মির্চীর নানারঙের পুতুল মেয়েদের কথা বলে হাসতে শুরু করল। নবাবজাদাদের হাসির হট্টরোলের মধ্যে আস্তে আস্তে গলা দিচ্ছিল দর্শক হিন, জিন, ঘুল, মারীদরা। সেই অন্তরীক্ষের অট্টহাসি ঘুরতে ঘুরতে আছড়ে পড়ল হাওয়ামহলের বাবুর্চীখানায়, যেখানে বাবুর্চীরাও তাদের হাতা-খন্তা ফেলে দুলে দুলে হাসতে শুরু করল। সবার শেষে তমঞ্চার গুলি খাওয়া হায়েনার মতো করুণ হাসি হাসতে লাগলেন পাঁচিলের উপর বসা ছোটি-বেগম। একটা জাসুসের পক্ষে যা দরকার তা দেখা হয়ে গিয়েছিল হরফনের।

    কিন্তু বাজীগরের হরকৎ বন্দ্‌ হতে তখনও একটু সময় বাকি ছিল।

    মঞ্চের উপর সকালের আলো ফুটে ওঠার সাথে সাথে বুড়ো নবাব হেঁচকি তুলে বেগুনী আঠার মতো রক্তবমি শুরু করলেন। নবাবজাদাদের কারো হাত, কারো পা, কারো মুণ্ডু, পুরোনো উই ধরা কাঠের মতো খসে পড়ে যেতে লাগল। ছায়াজগতের কাক ও শকুন, খসে যাওয়া নবাবী দেহের প্রত্যঙ্গ নিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। সবার বড় নবাবজাদা নিজের জিভ আর চোখ হাতে নিয়ে হাওয়ামহলের উঠোনে দাঁড়িয়ে বাবুর্চীদের সাহায্য চাইছিল। কিন্তু বাবুর্চীরা তখন ভয়ে বস্ত্‌-ও-দরের রাস্তা দিয়ে পালাতে শুরু করেছে।



    আরো অনেক রাতে, হরফন নিজের ঘরে চলে গিয়েছিল ঘুমোতে। ছোটি-বেগমকে সে দেখতে পায়নি। আফতাব আর খণ্ড্‌ বসে বসে অনেকগুলো গুলকন্দী চুষে শেষ করেছিল নিশ্চয়ই, সকালে তাদের ফেলে যাওয়া কাঠি ছাড়া আর কোনো চিহ্ন পড়ে ছিল না পূরণ মাসীর।

    হরফনের ফেলে যাওয়া ভাঙা তমঞ্চাটাও তারাই নিয়ে গিয়ে থাকবে সঙ্গে।





    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • প্রথম ভাগ | দ্বিতীয় ভাগ | দ্বিতীয় ভাগ - ২ | তৃতীয় ভাগ (শেষ)
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments