• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | গল্প
    Share
  • পঞ্চম অধ্যায় : অংশুমান গুহ
    ছোটা থেকে ছুটি | পঞ্চম অধ্যায়



    ভোর ছ’টা নাগাদ অতীন্দ্রনাথ মুখার্জির ঘুম ভাঙলো। চোখদুটো অল্প খুলে দেখলেন পাশে শুয়ে আছে এক যুবতী। মুখটা অন‍্য দিকে ফেরানো। উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। লম্বা কালো চুলে বিবস্ত্র কাঁধ ঢাকা। শরীরের নিচের দিকটা বেশিরভাগই পাতলা চাদরের তলায়। একটা পায়ের গোড়ালি চাদরের বাইরে বেরিয়ে আছে।

    মুখার্জি মেয়েটির শরীরের উপর দিয়ে ঝুঁকে মেয়েটির মুখটা দেখলেন। গভীর ঘুমের অচেতনে মেয়েটি তলিয়ে রয়েছে। মুখটা চেনা-চেনা লাগল, কিন্তু নাম মনে করতে পারলেন না। কি জানি, হয়তো নাম জানার সুযোগই হয়নি! তবে আজকাল স্মৃতিশক্তির যা অবস্থা হয়েছে, নাম শুনেও ভুলে যাবার সম্ভাবনা আছে।

    মুখার্জির বয়স তিপ্পান্ন। মাথার সামনের দিকে চুল পাতলা হয়ে এসেছে। পিছনের দিকে এক ভাগ কাঁচা, তিন ভাগ পাকা। টানাটানা চোখ, চোখের নিচে ফোলা। তীক্ষ্ণ গ্রীক নাক। একদিনের বাসি কাঁচাপাকা গোঁফ দাড়ি। শরীরে কিছুটা অতিরিক্ত মেদ। মাঝারি হাইট। শরীর দেখলে বয়স অনুমান করতে অসুবিধা হয় না।

    মেয়েটির উপস্থিতিতে মুখার্জির বিরক্তি হল। চাদরের নিচে থেকে বেরিয়ে, তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন। মাটিতে পা নামিয়ে, খাটে বসে, মেঝে থেকে তুলে নিলেন পরিত‍্যক্ত হাফ্ প‍্যান্ট। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে, প‍্যান্টে পা গলিয়ে, আলমারি থেকে মানিব‍্যাগ বার করলেন। সেখান থেকে টাকা নিয়ে, মানিব‍্যাগটা আবার আালমারিতে রেখে দিলেন। খাটের পাশ ঘুরে, ঘুমন্ত মেয়েটির দিকে গেলেন। খাটের পাশের টেবিলে টাকাটা রাখলেন গেলাস চাপা দিয়ে।

    তারপর মেয়েটির কাঁধ স্পর্শ করে ডাকলেন।

    “ওঠো। সকাল হয়ে গেছে।”

    “উঁ,” বলে একটা সাড়া পাওয়া গেল। মেয়েটি চোখ খুললো।

    মুখার্জি তাকিয়ে থাকলেন সেই আধখোলা চোখের দিকে। ধৈর্য ফুরিয়ে যাচ্ছে।

    “ওঠো, ওঠো। আমার মিটিং আছে। টাকাটা নিয়ে কাটো এবার।”

    মেয়েটি হাতে ভর দিয়ে উঠতে শুরু করলো। চাদরটা একটু নেমে এলো শরীর বেয়ে।

    ফরাসী নিউ ওয়েভ সিনেমার ক‍্যামেরার মত মুখার্জি তাকিয়ে দেখলেন মাঝ-পিঠে এসে চাদর থেমে গেল। পাতলা চাদরের মধ‍্যে দিয়েও সরু কোমর বোঝা যাচ্ছে। কোমরের নিচে যৌবন-সুলভ নিতম্ব। পিঠের উপরের দিকে যেখানে চাদরটা সরে গেছে সেখানে পাশ থেকে স্তনের একাংশ দেখা যাচ্ছে।

    সিনেমার ভাষ‍্যকারের মত মুখার্জি মনে মনে শ্লোক আওড়ালেন - তন্বী… মধ্যেক্ষামা… শ্রোণিভারাদলস… স্তোক-নম্রা স্তনাভ্যাং।

    মুখে বললেন, “আমি বাথরুমে যাচ্ছি। চটপট কাটো।”

    “হ‍্যাঁ, স‍্যার।”

    মুখার্জি বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন।

    মেয়েটি মাটিতে পা নামিয়ে তার ছাড়া জামাকাপড়ের স্তূপটা তুলে নিল। তারপর তাড়াতাড়ি পরে নিল সব। উঠে দাঁড়িয়ে দেওয়ালে লাগানো আয়নার সামনে দাঁড়ালো। আঁচল ঠিক করে নিল। হাত চালালো চুলের মধ‍্যে দিয়ে। তারপর খাটের দিকে ফিরে এসে গেলাস সরিয়ে টাকাগুলো তুলে নিল। না গুনেই টাকা গুঁজে দিল ব্লাউজের ভিতর।

    তারপর আরেকবার আয়নায় নিজেকে দেখে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।

    মুখার্জির ঘরটা বড়। যে দরজা দিয়ে মেয়েটি বেরোলো তার বাঁ-দিকে বড় আলমারি আর ডান দিকে একটা বইয়ের শেল্ফ। শেল্ফের উপরের তাকে কিছু ইংরিজি রোমান্টিক কবিতার বই, যেমন ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কীটস ইত‍্যাদি। তার পাশে রবীন্দ্রনাথের ‘রোগশয‍্যায়’ ও ‘শেষ লেখা’। মাঝের ও নিচের তাকগুলোতে কিছু ফাইল, কয়েকটা ইতিহাসের বই, গিরীন্দ্রশেখর বসুর ‘গীতা’ এবং দ‍্য কমিউনিস্ট ম‍্যানিফেস্টো। ডান দিকের দেওয়ালটা খালি, শুধু বাথরুমে যাওয়ার দরজা। তার পরের দেওয়ালে বড় খাট, গাঢ় ব্রাউন রঙের কাঠের। খাটের পিছনে চওড়া জানলা, পর্দা দিয়ে ঢাকা। খাটের দু’দিকে দুটো নাইট টেবিল। বাঁ-দিকের টেবিলের পাশে লম্বা আয়না দেওয়ালে লাগানো। ডান দিকের টেবিলের পাশে একটা ইজিচেয়ার। চতুর্থ দেওয়ালে গত বছরের একটা ক‍্যালেন্ডার – তাতে মা কালীর জিব বার করা ছবির নিচে ১৯৫৮ সালের এপ্রিল মাস।

    বিছানার বেড কভারটা খাটের পায়ের কাছে মেঝেতে লুটোচ্ছে। গায়ে দেবার চাদরটা বিছানার উপরেই পায়ের দিকে গুটিয়ে পড়ে আছে একটা পোঁটলার মত। ছাদে ঝুলছে ধুলোমাখা পাখা, চলছে না।

    খানিকক্ষণ পর চাকর নিতাই ঘরে ঢুকলো। বন্ধ বাথরুমের দরজার কাছে এসে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “বাবু, চা বানাবো?”

    কোনো উত্তর নেই। জল পড়ার শব্দ আসছে ভিতর থেকে।

    এক মিনিট পর জলের শব্দ একটু কমলে, নিতাই আবার ডাকলো, “দিদিমণি বিদেয় হয়েছে। আপনি চা খাবেন?”

    “হ‍্যাঁ, বানা।”

    নিতাই বাথরুম ছেড়ে অন‍্য দরজা দিয়ে ঘর থেকে বার হতে যাবে, এমন সময় বাথরুমের দরজাটা ফাঁক হল। মুখার্জি হেঁকে বললেন, “না থাক্। আমায় বরঞ্চ ওই ভালো উইস্কিটা দে। বড়ো। তিনটে বরফ।”

    অবাক হয়ে নিতাই বললো, “এই সকালে বাবু মদ খাবেন?”

    “হ‍্যাঁ, খাবো।”

    নিতাই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মুখার্জি তোয়ালে পরে উসকো-খুসকো সাদা-কালো চুলে বাথরুম থেকে বেরোলেন। গোঁফ দাড়ি কামানো। নিতাই তখনো দাঁড়িয়ে আছে দেখে বললেন, “উইস্কি খাবো। উইস্কি। আজ আমার পঁচিশতম মৃত‍্যুবার্ষিকী। বুঝলি?”

    নিতাই কিছুই বুঝলো না। শুধু বুঝলো যে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।

    নিতাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

    মুখার্জি একটা গান ধরলেন, প্রথমে গুনগুন করে, তারপর খোলা গলায় —

    এসো এসো আমার ঘরে এসো, আমার ঘরে
    বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছো অন্তরে
    এসো আমার ঘরে

    গান করতে করতে মুখার্জি আলমারি থেকে পাজামা পাঞ্জাবি ইত‍্যাদি বার করে পরলেন। তোয়ালেটা ছুঁড়ে ফেললেন বিছানার উপর। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ালেন।

    নিতাই উইস্কির গেলাস হাতে ঘরে ঢুকলো।

    “ওখানে রাখ্।”

    ইজিচেয়ার আর খাটের মাঝে যে নাইট টেবিল, সেখানে গেলাসটা ঠক্ করে রাখল নিতাই।

    “বোতলটাও নিয়ে আয়।”

    “কিছু খাবেন না?”

    “না।”

    খাটের উপর থেকে ভেজা তোয়ালেটা তুলে নিল নিতাই।

    “বিছানা পরে করিস। আমি ঘন্টা খানেক একা থাকব। আমাকে ডাকবি না। কেউ এলে - আমি ঘুমোচ্ছি বলে ভাগিয়ে দিবি।”

    নিতাই তোয়ালে নিয়ে বেরিয়ে গেল দরজা টেনে দিয়ে।

    মুখার্জি উইস্কি-রাখা টেবিলের পাশে খাটে উঠে বসলেন। বালিশটা টেনে পিঠের কাছে দাঁড় করিয়ে তাতে হেলান দিলেন। উইস্কিতে একটা চুমুক দিয়ে, টেবিলের উপর থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরালেন।

    মুখার্জি ভাবলেন - আহা, বড় ভালো উইস্কি!

    নিতাই ফিরে এল দামি বিলিতি উইস্কির বোতল নিয়ে। গেলাসের পাশে টেবিলের উপর রেখে, বিনা বাক‍্যব‍্যয়ে আবার বেরিয়ে গেল। দরজা বন্ধ হল।

    মিনিট দশেক নিঃশব্দে বসে মুখার্জি সিগারেটটা শেষ করলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “সেদিন চৈত্রমাস।”

    তারপর মুখার্জি চোখ বন্ধ করে আবৃত্তি করলেন —

    প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস
    তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ

    “কেমন আছো, অন্তু?”


    মুখার্জি চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলেন আরাম কেদারায় এলা বসে আছে। সে-ই চব্বিশ বছর বয়সের এলা। সে-ই বেগুনি রঙের খদ্দরের শাড়ি। লম্বা চুল খোলা। ধবধবে ফরসা গায়ের রং। ছিপছিপে টানটান শরীর। চোখেমুখে একটা এমন পরিণত বুদ্ধির ছাপ, যে তাতে শ্রদ্ধা অনুভব না করে উপায় নেই। গলায় সাধারণ একটা সোনার হার।

    সকাল থেকে এই প্রথম মুখার্জির মুখ একটা হাসিতে ভরে গেল। চোখদুটো উজ্জল হয়ে উঠলো।

    “আমি? আমি আছি ভালোই। একদিকে রাজনীতির শক্ত লাঠিটা ক্রমশ হচ্ছে লম্বা। অন‍্যদিকে স্মৃতিশক্তি প্রতিদিন খাটো হচ্ছে।”

    “এই বৃদ্ধি আর হ্রাস কি একে অন‍্যের পরিপূরক?”

    হা হা করে হেসে উঠলো অন্তু।

    “হ‍্যাঁ, তা যা বলেছো! রাষ্ট্রের মুঠো চোখে ধুলো ছুঁড়ে সৎ ইতিহাস ঢেকে দেয়। আর বিস্মৃতির সিমেন্ট গভীর গর্তের মধ‍্যে জমে জমে রাষ্ট্রের ভাঙা ভিত ভরাট করে।”

    “রাজনীতির কথা তুলে আমাকে ভুলিয়ো না অন্তু। তোমার কথা বলো।”

    “রাজনীতি আর আমার মধ‍্যে কি আর কোনো তফাত আছে? আমি তো পলিটিক্সের প্রতিমূর্তি। আমি আধুনিক।”

    “রাজনৈতিক নেতার মুখোশের পিছনে তুমি মানুষ। শুধু মানুষ নও, তুমি অসামান‍্য।”

    “হয়তো কখনো অসামান‍্য ছিলাম, এলা। কি জানি! ঠিক মনে পড়ে না। তুমি বরং আমাদের সেই ফেলে-আসা হারিয়ে-যাওয়া দু’একটা রঙিন দিনের কথা বলো। সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।”

    “সে কাজটা তো তোমার ছিল – কথার ফোয়ারা ছোটানো।”

    একটু থেমে এলা বললো, “বেশ, আজ আমিই বলি না হয়।”

    “আমি আছি নিচে, থার্ড ক্লাস ডেক্‌-এ। উপর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ চোখে তোমাকে দেখছি। তুমি ফার্স্ট ক্লাসে বসে আছো কোলোনিয়াল বেতের চেয়ারে। তোমার গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, কাঁধে মুগার চাদর। আমি চোখ ফেরাতে পারছি না। অচেতনের গভীরে হঠাৎ বিপজ্জনক ঢেউ উঠেছিল সেই লগ্নে। তার ধাক্কা চেতনা অবধি পৌঁছতে তখনো কয়েক দিন বাকি।”

    “আজ এত বছর পর যদি সেই আমি-র দিকে আবার ফিরে তাকাও, কী দেখতে পাও? কী দেখতে পেয়েছিলে সেদিন আমার শৌখিন অভিজাত অভিমানী ভদ্রলৌকিকতার পিছনে?”

    “স্বাতন্ত্র্য। বোধহয় তোমার স্বাতন্ত্র্যের একটা আভাস দেখেছিলাম। তুমি যে আর কারুর মত নও, তার ইঙ্গিত পেয়েছিলাম।”

    “ঘর-ঘেঁষা টগর ফুলের বাগানে একটা সভ‍্য গোলাপ যেমন আলাদা, একটা বন‍্য ঘেঁটু ফুলও সে রকম আলাদা। আমাকে কোন পর্যায়ে ফেলবে?”

    “তুমি হচ্ছো পিরামিডের উপর দিকের মানুষ।”

    “আর একটু খোলসা করে বলবে?” অন্তু উইস্কিতে চুমুক দিলো।

    “সোজা ভাষায় বলতে পারি, তবে কথাটা সোজা লাইনে হবে না। এখনকার আধুনিক বর্ণনায় – যাকে বলে পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়া্ল ভাবনার ঢঙে – মানুষকে একটা পিরামিড হিসাবে দেখা যায়। সবার নিচে খিদে, তেষ্টা আর বংশবৃদ্ধির পশুজীবন। তার উপরে প্রকৃতি। প্রকৃতির একটা বিবরণ ইউং (Jung) সাহেব দিয়েছেন তাঁর থিয়োরি অফ পার্সোনালিটিতে। প্রকৃতির উপর রয়েছে তথাকথিত শিক্ষা, মানে অক্ষর পরিচয় থেকে শুরু করে স্কুলের পাঠ। সর্বোচ্চ শিখরে ইন্টেলেকচুয়াল আড়ম্বর।”

    “ইন্টুইশন কোথায় গেল?”

    “ওটা পিরামিডের সব স্তরেই আছে। যুক্তির ধবধবে জানলার কাঁচে অবাঞ্ছিত ধুলোর মত। এইজন‍্যই বললাম যে বিবরণটা সোজা লাইনে হবে না।”

    “আর আধ‍্যাত্মিকতা?”

    “তুমি শোননি? ভগবান অক্কা পেয়েছেন — সভ‍্যতার শিখর থেকে নীঈচা (Nietzsche) মশাই স্বয়ং খবর এনেছেন!”

    বলে এলা শব্দ করে হেসে উঠলো।

    অন্তু বললো, “কোটি কোটি মানুষ ভগবানে বিশ্বাস করে। পথের পাশে মন্দির দেখলে মাথায় হাত ঠেকায়। সেটা অভ‍্যাস আর ভয় থেকে। সেটাকে আত্মিক বিশ্বাস বলা যায় কিনা জানি না, তবে আমার মতে সেটা পূজা বা প্রেম পর্যায়ে পড়ে না। তাতে নিঃস্বার্থ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ নেই। আঁজলা-ভরা জলে আচারের ব‍্যাঙাচি ধরা, জালে টান মেরে গভীরের রাঘব বোয়াল তোলা নয়। সেটাকে আমি আধ‍্যাত্মিকতা বলি না। মাঝে মাঝে মনে হয় সেটা একটা মেকি অন্তর্যামীর সাথে আদিখ‍্যেতা।”

    এলা বললো, “আসলে ঈশ্বর ন’ন। মরে গেছে পুরোনো গল্পগুলো — যেখানে মানুষ তার প্রাণের অবলম্বন খুঁজে পেত। শারীরিক বাস্তব ছাড়িয়ে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ‍্য যুক্তির সীমানা পেরিয়ে, হাজার হাজার বছর ধরে যে মিথলজিতে সে পেত আত্মার আশ্রয়, তার অন্তর্নিহিত সত‍্য এখন হারিয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস এখন… এখন…”

    অন্তু বললো, “বউ-পালানো যুবকের কোলবালিশ জড়িয়ে ধরার মত।”

    এলা বললো, “হ‍্যাঁ, ওই রকমই। ভগ্ন ভগবানের অভাগা ভক্ত এখন ভোগ-বান। বস্তুবাদে পরকাল নেই। কন্‌সিউমারিসম-এর আফিম নেশায় ইহকাল দিব‍্যি কেটে যায়।”

    অন্তু বললো, “আর যারা বিজ্ঞানের আশ্চর্য আগুন দেখেছে – যে আগুনে যেমন চোখ-ধাঁধানো আলো, তেমন পৃথিবী-পোড়ানো তাপ – সেই আগুন যারা দেখেছে, তারা ভাবছে তাতেই সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড ধরা রয়েছে, তার বাইরে আর কিছু থাকতে পারে না। বস্তুবাদী বিজ্ঞানের উপর তাদের সেই অহংকারের ধাক্কায় তাদের ভগবান বেঘোরে একঘরে হয়ে, শেষে বেঘর হয়েছেন। ধর্ম মানে যা ধারণ করে। বিজ্ঞান হল পৃথিবীর নতুন ধর্ম।”

    এলা বললো, “যাই হোক। আগের প্রসঙ্গে ফিরি। একটা মানুষের স্থাপত‍্য যেমন পিরামিড, পৃথিবীর সব মানুষকে এক সাথে নিয়েও একটা পিরামিড ভাবা যায়। তুমি হলে সেই পিরামিডের উপর দিকের মানুষ। বুদ্ধিতে, সত‍্যিকারের শিক্ষাতে এবং উপলব্ধিতে।”

    “সেই চূড়া থেকেই হয়েছে আমার পতন।”

    “তুমি সেই লাখে-এক মানুষ যে নিজের প্রকৃতি আর স্বভাব বুঝেছে। আবার তুমিই সেই কোটিতে-এক মানুষ যে সব জেনে বুঝেও স্বধর্ম থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে। তোমার যথার্থ যে তুমি, তাকে ব‍্যক্ত করে তুমি যথার্থ ব‍্যক্তি হয়ে উঠতে পারতে। কিন্তু তুমি প্রথমে হলে আত্মবিস্মৃত, তারপর আত্মবিরোধী।”

    “স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরোধর্ম ভয়াবহ,” বলে অন্তু উইস্কিতে আবার চুমুক দিলো।

    এলা বললো, “একজ‍্যাক্টলি। নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে যাওয়ার থেকে মৃত‍্যুও শ্রেয়।”

    “শেষবার আমাকে এই শ্লোকটা কে শুনিয়েছিল জানো?”

    “কে?”

    “তোমার অখিল।”

    “ওকে তো আমি বিপদ থেকে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম!”

    “পাঠিয়েছিলে বটে, কিন্তু সেই বনবাস তার টিঁকলো কই? কানাঘুষোয় শুনতে পেল তোমার… মানে… তোমার প্রস্থানের কথা। আরো গুজব শুনলো যে ঘটনাস্থলে আমি উপস্থিত ছিলাম। তার মন নিষ্পাপ হতে পারে, কিন্তু বুদ্ধির অভাব ছিল না। দুয়ে দুয়ে চার করে অখিল এসে পৌঁছলো আমার দরজায়।”

    “তারপর?”

    “দেখলাম চোখে তার কীচকঘাতী ভীমের ঘৃণা, কুঠারধারী পরশুরামের ক্রোধ। পাঞ্জাবির পকেট থেকে বার করে একটা চমৎকার রিভলভার দেখালো আমাকে।”

    “সে কি!”

    “আমি তাকে বোঝালাম। বললাম -- ভায়া, আমাকে মারলে তোমার পুণ‍্যের সাথে স্বার্থ-পাপের খাদ মেশানো থাকবে। বরং যদি আগে যত-নষ্টের-গোড়া মাস্টারমশাইকে মারো, সেটা নিঃস্বার্থ দেশের কাজ হবে। তবে বাপু, ধরা পড়ো নাকো! ওই কাজটা আগে সারো। আমি তো এখানেই আছি। আমি যাবো কোথায়? কিন্তু যদি আগে আমার রক্তপাত ঘটিয়ে ধরা পড়ে যাও, মহৎ কাজটা সম্ভব হবে না।”

    “আহা, আমার লক্ষ্মী ভাইটা! তারপর কী হল?”

    “অখিল আমার কথা বিশ্বাস করলো কি না জানি না, কিন্তু দেশের হিতের জন‍্য বৃহত্তর শিকার সন্ধানের যুক্তিটা উড়িয়ে দিতে পারলো না। আমাকে রেহাই দিয়ে চলে গেল। যাবার আগে অবশ‍্য আশ্বাস দিয়ে গেল যে আবার দেখা হবে।”

    “কী ভয়ানক! তারপর?”

    “দিন দশেক পর খবর পেলাম মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী ইন্দ্রনাথ নিহত হয়েছেন সন্ত্রাসবাদী আততায়ীর হাতে। পলিটিকাল অ‍্যাসাসিনেশন। অখিল অস্ত্র সমেত ধরা পড়েছে।”

    “অখিলের কী হল? সে এখন কোথায়?”

    “সে জেলে গেল। এখনো সেখানেই আছে। আমি বন্দোবস্ত করে দিয়েছি যাতে জেলের মধ‍্যে যথাসম্ভব আরামের জীবন পায়। এবং যাতে কোনোদিনও ছাড়া না পায়।”

    “যাবজ্জীবন কারাদণ্ড?”

    “হ‍্যাঁ। আমি যত দিন বেঁচে আছি, অখিলের ছাড়া পাওয়ার সম্ভবনা কম।”

    একটু থেমে অন্তু আবার বললো, “বুড়ো বয়সে নিজের প্রাণের উপর আমার খুব মায়া পড়ে গেছে।”

    “তুমি বদলে গেছো।”

    “বদলাইনি এলী! আমার চরিত্র একটা হীরের মত। জীবনসূর্যের আলোয় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এক একবার তার এক একটা পিঠে উজ্জ্বলতার প্রতিফলন ঘটাচ্ছি। জন্মানোর সময় ঈশ্বর পুরো স্ফটিকটাই বানিয়ে দিয়েছিলেন। আমি শুধু পিঠ পালটাচ্ছি।”

    “তোমার উপমাটা লাইফ ইন্সিয়োরেন্স সেল্সম‍্যানের জীবিকার মত। অন্তর্নিহিত সত‍্য হয়তো কিছু আছে, কিন্তু জাতে অসৎ।”

    অন্তু উত্তরে কিছু বললো না। চুপ করে বসে রইল। তারপর বাকি উইস্কিটা এক চুমুকে শেষ করে দিয়ে গান গেয়ে উঠলো –

    মনে করো
    মনে করো শেষের সে দিন কি ভয়ঙ্কর
    অন্যে বাক্য কবে কিন্তু তুমি রবে নিরুত্তর

    এক মিনিট নীরবতা।


    “অন্তু!”

    “উঁ।”

    “তুমি ভয়ংকর বলছো কেন? শেষের-সে-দিন তুমিই তো বলেছিলে মৃত‍্যুর ক্ষমার কথা। মনে আছে?”

    “না।”

    “বলেছিলে – উপস্থিতের গণ্ডিটা নিতান্ত ছোট, তার মধ্যে ভয়ভাবনা দুঃখকষ্ট সমস্তই প্রকাণ্ডতার ভান করে। বর্তমান সেই নীচ পদার্থ যার ছোটো মুখে বড়ো কথা। সে মুখোশ পরে ভয় দেখায় - যেন আমরা মুহূর্তের কোলে নাচানো শিশু। মনে পড়ছে?”

    “হয়তো।”

    “বলেছিলে - মৃত‍্যু মুখোশখানা টান মেরে ফেলে দেয়। মৃত‍্যু অত‍্যুক্তি করে না।”

    “না, করে না।”

    “বলেছিলে - যা প্রচণ্ডভাবে চেয়েছি, বর্তমানের কাছে তার অনেক দাম। যা প্রচণ্ডভাবে হারিয়েছি, বর্তমানের কাছে তার অপরিসীম দুঃখ। কিন্তু সেসবই মিথ‍্যে। জীবন অনন্তকালের সই জাল করতে চায়।”

    “তোমার এতটা মনে আছে?”

    “বলেছিলে - মৃত‍্যু এসে বর্তমানের বঞ্চনার দলিলটা দেয় লোপাট করে। মৃত‍্যুর হাসি শিবের শান্ত সুন্দর হাসি। সেখানে বিদ্রুপও নেই, নিষ্ঠুরতাও নেই। আছে শুধু স্নিগ্ধ মুক্তি আর চিরকালের ক্ষমা।”

    “বাঃ বাঃ, সুন্দর বলেছিলাম। তবু আজ বলি যে শেষের-সে-দিন আমার কাছে ভয়ংকর। সেদিন শুধু এলা তো মরে নি, অন্তুও মরে গেছে। এলা পেল মুক্তি – জীবনের সব গতিস্রোতের চরম সমুদ্রে, সব সত‍্যমিথ‍্যা ভালোমন্দর নিঃশেষ সমন্বয়ে। অন্তু মরেও বেঁচে থাকলো। একটা অদৃশ‍্য তলোয়ার এক মুহূর্তে আমার মধ‍্যে দিয়ে চলে গেল। মাথা থেকে পা পর্যন্ত আমি দ্বিখণ্ডিত। দুটো অর্ধাংশ গায়ে গায়ে লেগে আছে জড় পদার্থের মত। টেরও পায়নি যে তারা আলাদা। যে সর্বনেশে অসুখটা আমায় ধরেছে আশা করেছিলাম, সেটাও আমায় ছেড়ে গেল। মুক্তি পেলাম কই? অন্তু মরে গেছে, এলা।”

    “কিন্ত এলা তো এখনো আছে, অন্তু। নেই?”

    “তা আছে।”

    “তাহলে? এলা আছে মানে অন্তুও আছে। অন্তু না থাকলে এখানে এসে এই আর্ম চেয়ারে এলা কী করে বসতো?”

    “আমি কি নাবালক যে তুমি আমার মন ভোলাচ্ছো? নিজের স্বভাবকে নিজেই মেরেছি আমি। প্রথম দিকে নিষ্কামভাবে স্বধর্ম-বিরোধী কর্তব‍্য পালন করেছি, তারপর এক সময় কাম আর স্বার্থের ধুলো মেখেছি সারা গায়ে। সত‍্য হারিয়েছি। যেখানেই যাই, আমার মৃত আত্মার কালো ভূতটা পিছন পিছন ধাওয়া করে। মনে হয় অজস্র মৃত্যুকে পার হয়ে চলেছি…”

    “আমিও তো নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে গেছিলাম। কিন্তু আমি তো ফিরতে চেয়েছিলাম, অন্তু! তুমি কেন আমায় নিলে না? তোমাকে ভালোবেসেই তো আমি আমার হারিয়ে যাওয়া পথ খুঁজে পেয়েছিলাম।”

    “আর আমি তোমাকে ভালোবেসেই বেপথে গেলাম। তোমাকে এক সময়ে তার জন‍্য দোষ দিয়েছি। আজ জানি - ভুল শোধরাতে পারিনি আমারই অক্ষমতায়। প্রেমের প্রথম চমক আমার রোমান্টিক মনে ভূমিকম্প তুলেছিল। তোমার পলিটিকাল দলে যোগ দেওয়া ছাড়া তোমার কাছে যাওয়ার আর কোনো রাস্তা ছিল না।”

    “তাই বলে তোমার নিজস্বতাকে এইভাবে বিসর্জন দেবে? ধিক্ তোমার প্রেম!”

    “হয়তো শুধু প্রেম নয়। নিজেকে হারানোর অন‍্য কোনো কারণও ছিল হয়তো। একটা সুপ্ত দৈন্য ছিল শৈশব থেকে। একটা দুর্বোধ‍্য খিদে। হয়তো হৃৎপিণ্ডের গভীরে একটা অজানা ফুটো ছিল, যা দিয়ে হু-হু করে হাওয়া বয়ে আমাকে পথ ভুলিয়ে দিল। যেন মাছ ধরবার জন‍্য ছিপ ফেলেছিলাম, বঁড়শিটা আটকে গেল গভীর কোনো শিকড়ে। মাছ ধরার বদলে সেই অন্ধকার গহ্বরের সাথে আটকে গেলাম নিজেই।”

    “উপমাটা অদ্ভুত।”

    “তাহলে বলি – উপমাটা আমার একটা দুঃস্বপ্নে দেখেছিলাম। শেষের-সে-ভয়ঙ্কর রাতের কদিন পর। দেখলাম ছিপ ফেলেছি গভীর জলে। বঁড়শি গেছে আটকে। জলের অনেক নিচে, যেখানে জমাট অন্ধকার, সেখানে গান্ধারীর প্রসব করা সেই স্পন্দনহীন লোহার বলটা পড়ে আছে। কে ফেলেছে জানি না। আমার বঁড়শিটা আটকে গেছে সেই প্রাণহীন মাংসপিণ্ডে। আমি যত ছিপ ধরে টানছি, তত বঁড়শির আঁচড়ে বল থেকে একটা একটা করে ভ্রুণ খসে পড়ে, জলে ভেসে যাচ্ছে ছোট ছোট হাত-পা ছড়িয়ে। দুর্যোধন। দুঃশাসন। এক শত কৌরব।”

    “উঃ মাগো!”

    “তোমাকে আগেও বলেছি যে - পথ হারিয়ে যেখানে পৌঁছেছিলাম, সেখানেও দায়িত্ব ছিল। ফেরা অসম্ভব ছিল।”

    “তোমার স্বধর্মের উপর যে দায়িত্ব, তার চেয়েও বড়? নিজস্ব স্বভাব ও সত্তার উপর যে দায়িত্ব স্বয়ং বিধাতা তোমায় দিয়েছিলেন, তার চেয়েও বড়? তুমিই আমাকে বলেছিলে যে স্বধর্মের সাথে যে প্রতিজ্ঞার বিরোধ, সে প্রতিজ্ঞা বা প্রতিশ্রুতি ভাঙলেই সত‍্যরক্ষা হয়।”

    “ছেড়ে দেওয়া তীর ফিরে আসে না, এলা।”

    “ভুল! তীর লক্ষ‍্যভ্রষ্ট হলে ধনুর্ধর আবার শরসন্ধান করে। তুমি নিজেকে ঠকিয়েছো, অন্তু।”

    হঠাৎ দরজা খুলে ঝড়ের মত ঘরে ঢুকলো নিতাই।

    নিতাই-এর পিঠে ঠ‍্যালা দিতে দিতে পেছন পেছন আর একটা লোক। তার মাথা ভর্তি না-আঁচড়ানো লম্বা কালো চুল। মুখে খোঁচা খোঁচা গোঁফ দাড়ি। পরনে নোংরা সস্তা হাফ শার্ট, ফুল প‍্যান্ট। পায়ে চটি। বয়স চল্লিশ কি বেয়াল্লিশ। চেহারা দেখলেই বোঝা যায় গায়ে অনেক জোর।

    নিতাই বললো, “ইনি জোর করে বাড়িতে ঢুকে পড়লেন।”

    অন্তু লোকটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বললো, “অখিল?”

    অখিল কোনো জবাব না দিয়ে নিতাইকে একটা ঠ‍্যালা মারলো। নিতাই পিছ্‌লে আরো দু’পা এগিয়ে গেল।

    বিছানায় বসে বসেই অন্তু বললো, “ঠিক আছে। ঠিক আছে। তুই বরং বাজারটা করে আয় নিতাই।”

    নিতাই তবু দাঁড়িয়ে রইল।

    অন্তু আবার বললো, “যা যা। চিন্তার কোনো কারণ নেই।”

    দ্বিধাগ্রস্ত নিতাই আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। অখিল দরজার কাছে দাঁড়িয়েই ঘরের চার পাশে তাকিয়ে দেখলো। তারপর অন্তুর দিকে তাকিয়ে, দাঁড়িয়েই থাকলো। তার মুখ দেখে মনের কোনো কথা বোঝার উপায় নেই।

    অন্তু বললো, “এসো অখিল।” খালি ইজিচেয়ারের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো, “এইখানে বসো।”

    অখিল হেঁটে গিয়ে অন্তুর কাছাকাছি ইজিচেয়ারে বসলো। তার মুখে কোনো কথা নেই। চেয়ারে বসে সে সোজা অন্তুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

    অন্তু বললো, “তোমায় জেল থেকে ছেড়ে দিল?”

    “পালিয়েছি।”

    মৃদু হেসে অন্তু বললো, “বাঃ বাঃ বেশ বেশ। এখানে এসেছো পুরোনো প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন‍্য, তাই তো?”

    “আজ এলা দিদির পঞ্চবিংশতিতম মৃত‍্যুবার্ষিকী।”

    “জানি ভায়া। চা খাবে?”

    অখিল উঠে দাঁড়িয়ে প‍্যান্টের পকেট থেকে একটা ছোট পিস্তল বার করলো।

    অন্তু সোজা হয়ে বসে বললো, “তুমি কি সব সময়েই কম কথা বলো, নাকি আজকের দিনটা স্পেশাল?”

    অখিল এবার বন্দুকটা অন্তুর বুকের দিকে তাক করে, খুব আস্তে এক পা এগোলো।

    অন্তু বললো, “তাহলে আমি কিছু বলি? তুমি শোনো?”

    আরো এক পা স্লো মোশনে এগিয়ে অখিলের হাঁটুর কাছটা খাট স্পর্শ করলো।

    অন্তু বললো, “শেষ নিশ্বাসের আগে শেষ কথা বলার অধিকার তো মানুষের থাকে?”

    অখিল এখনো নিরুত্তর।

    আচমকা লাফ মেরে অন্তু উদ্যত পিস্তলের উপর দিয়ে অখিলের গায়ে হামলে পড়লো। টানাটানি ঠ‍্যালাঠেলি জড়াজড়ি করে দুজনে পড়ে গেল মেঝেতে। গড়াগড়ি চললো খানিকটা। দু-একটা ঘুষি, কুস্তির প‍্যাঁচ।

    তারপর গুলির শব্দ।

    দেহদুটো কয়েক মুহূর্তের জন‍্য নিথর হল। নিচে অন্তু চিৎ হয়ে। উপরে উপুড় অখিল।

    অখিলের প্রাণহীন শরীরটা আস্তে আস্তে ঠেলে সরিয়ে অন্তু উঠে বসলো। অখিলের হাতে এখনো পিস্তলটা আলগা ভাবে ধরা।

    অন্তু জোরে জোরে খানিকটা নিশ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। টেবিল থেকে বোতলটা নিয়ে গেলাসে উইস্কি ঢাললো। বোতল নামিয়ে রেখে, এক চুমুকে গেলাসের উইস্কিটা খেয়ে, মুখ বিকৃত করলো। তারপর বিছানায় আগের জায়গায় বসলো, পিঠে বালিশ গুঁজে।

    একটু পরে চোখ বুজে অন্তু গান ধরলো —

    যদি কোনো দিন তোমার আসনে
    আর-কাহারেও বসাই যতনে,
    চিরদিবসের হে রাজা আমার,
       ফিরিয়া যেয়ো না প্রভু
    যদি এ আমার হৃদয়দুয়ার
       বন্ধ রহে গো কভু



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • ছোটা থেকে ছুটি | পঞ্চম অধ্যায়
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments