• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | গল্প
    Share
  • ছোটা থেকে ছুটি : অংশুমান গুহ



    বেশ কিছুদিন ধরেই মনে হচ্ছে কেউ একটা আমার পিছু নিয়েছে। কলকাতার রাস্তাঘাটে অলিতে গলিতে যখন হেঁটে যাই, মাঝে মাঝে মনে হয় কেউ যেন পিছন পিছন আসছে। কিন্তু যখনই পিছু ফিরে তাকিয়েছি সন্দেহজনক কাউকে দেখতে পাইনি।

    আজ রাতে লোকটার মুখ আমি এক ঝলক দেখলাম একটা স্ট্রীট ল‍্যাম্পের আলোয়।

    মনে হল অনেকটা শিশিরবাবুর মত দেখতে। শিশিরবাবু আমার স্কুলে অংক টিচার ছিলেন। ওনার মতনই লোকটার তীক্ষ্ন নাক। একই রকম সমবেদনাহীন চোখ। আর হুবহু সেই খরার মাঠের মত ফাটা ঠোঁট।

    খানিক পর, যখন বুঝতে পারলাম লোকটা হয়তো আমার পিছু নিয়েছে – হয়তো এই সব অন্ধকার ফাঁকা রাস্তায় আমার পিছন পিছনই আসছে – তখন আমি আমার হাঁটার স্পীড বাড়ালাম।

    একটু পর চট করে বাঁ-দিকে একটা গলিতে ঢুকলাম। পিছনে তাকালাম না।

    দু মিনিটে গলিটার শেষে পৌঁছে গেলাম। ডান দিকে আরেকটা গলিতে ঢোকার মুখে পিছনে তাকালাম। লোকটা তখনও আসছে। আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলাম।

    এমনি করে আরো কয়েকবার এ-গলি সে-গলি করে, কয়েকটা ধারালো বাঁক নিয়ে, দিক পরিবর্তন করলাম। কিন্তু যতবারই পিছন ফিরে তাকাই, দেখি লোকটা তখনো ঠিক আছে। কখনো কাছে, কখনো দূরে, ধীর গতিতে শান্তভাবে হেঁটে আসছে। বুঝতে পারছিলাম না সত‍্যিই আমাকে ফলো করছে কিনা। নাকিটা পুরোটাই কাকতালীয়? নিশ্চয় ফলো করছে।

    অনেক রাস্তা-গলি ধরে হেঁটে হেঁটে এইভাবে আধঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট কেটে গেল। হেঁটেই চলেছি। হঠাৎ ট্রাম লাইনের কাছে পৌঁছে গেলাম। দেখি অনেকটা দূরে একটা ট্রামস্টপে একটা ট্রাম দাঁড়িয়ে রয়েছে।

    আমি দৌড় লাগালাম ট্রামের দিকে। একবারও পিছনে তাকালাম না। কয়েক মিনিট ছুটে পৌঁছে গেলাম।

    লাফ দিয়ে যেই ট্রামে উঠেছি, ট্রামটা ঝাঁকুনি দিয়ে ছেড়ে দিল। আমি লোহার রডটা শক্ত করে ধরলাম যাতে পড়ে না যাই। তারপর রডটা ধরে ধরে আমি তাড়াতাড়ি ট্রামের মধ‍্যে এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। ট্রামটা প্রায় খালি। দু-একজন প‍্যাসেঞ্জার এদিক-ওদিক বসে আছে।

    লোকটা কি সত‍্যিই আমাকে ধাওয়া করেছে? কেন? কী চায়? আমি কি বিপদে পড়েছি? এইসব সাত পাঁচ ভাবছিলাম।

    এগিয়ে গিয়ে দেখি ট্রামের দ্বিতীয় রো-তে লোকটা চুপ করে বসে আছে। বসে বসে আমাকে দেখছে। কয়েক মুহূর্তের জন‍্য আমার একটা শিহরণ হল। শিরদাঁড়ায় একটা হালকা শীতের অনুভূতি। মাগো!

    আমি তাড়াতাড়ি ঘুরে গিয়ে, আবার উলটো দিকে মানে ট্রামের পিছন দিকে হাঁটতে লাগলাম। ট্রামের দৈর্ঘ্যের মাঝামাঝি এসে আমি দরজার কাছে, নেমে-যাবার পাদানিতে, নেমে দাঁড়ালাম। তারপর চট করে লাফ দিয়ে নেমে গেলাম চলন্ত ট্রাম থেকে। ট্রামটা চলে গেল তার স্বভাবগত মন্থর একঘেয়ে গতিতে।

    ক্রমাগত দূরবর্তী হওয়া সেই ধাতব সরীসৃপের দিকে আমি একবার তাকিয়ে দেখলাম। তারপর হাঁটতে শুরু করলাম। মাগো!

    ব‍্যাপারটা কী হল? ত্রাসের বোধটা আরেকবার শরীরে ফিরে এল। তারপর হাতদুটো ঝাড়লাম, যেন জোর করে অনুভূতিটা ঝেড়ে ফেলতে চাইলাম। তারপর বাড়ির উদ্দ‍েশে হাঁটা দিলাম।

    কে লোকটা? ওর উদ্দেশ্যটা কী?

    খানিকক্ষণ হাঁটার পর, আবার মনে হল কেউ একটা পিছু নিয়েছে। কিন্তু যখনই ফিরে তাকাই, দেখি কেউ নেই। প্রায় মাঝরাত। রাস্তাঘাট ফাঁকা।

    এখন আর ট্রাম-বাস পাব না। ট‍্যাক্সিও নেই।

    আমি শান্ত হতে চাই, কিন্তু কিছুতেই শান্ত হতে পারছি না। আবার ছুটতে শুরু করলাম।

    ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে গেলাম পাঁচ মিনিটে। হাঁটতে থাকলাম। না, পিছনে কেউ নেই।

    নিশ্বাস-প্রশ্বাস শান্ত হতে কয়েক মিনিট লাগলো। ক্রমাগত হেঁটে যাচ্ছি। পিছন ফিরে তাকালাম। রাস্তা ফাঁকা। একটা কুকুর ঘুমাচ্ছে। কিন্তু দূরে ওটা কী? কেউ হেঁটে হেঁটে আসছে? সেই লোকটাই কি? এ তো মহা জ্বালা হল!

    আবার ছুটতে শুরু করলাম। কয়েক মিনিট পর আবার হাঁপিয়ে গেলাম। কপালে ঘাম জমছে। পিঠের কাছে জামাটা ভিজে গেছে। ছুটতে ছুটতেই পিছন দিকে এক ঝলক তাকালাম। না, মনে হয় কেউ নেই। ছোটা থামালাম।

    এইভাবে কতক্ষণ কাটলো জানি না। কখনো ছুটছি, কখনো হাঁটছি। কখনো দেখছি পিছনে কেউ কোথাও নেই। কখনো দূরে একটা ছায়ার মত দেখছি। যেন একটা অস্পষ্ট কালো মূর্তি দূর থেকে এগিয়ে আসছে। অন্ধকার ফাঁকা রাস্তায় কোনো ভৌতিক চলাফেরা।

    ছুটতে ছুটতে হাঁটতে হাঁটতে ঘামতে ঘামতে হাঁপাতে হাঁপাতে চলেছি।

    ক্লান্ত। আরো ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি।

    অবশেষে এক সময় বাড়ি পৌঁছলাম।

    তাড়াতাড়ি দরজার তালা খুলে চট করে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। ভেতরে ঢুকেই তাড়াতাড়ি করে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। ছিটকিনি আর খিল দুটোই লাগিয়ে দিলাম। এবার হৃৎপিণ্ডের ওঠা-পড়া একটু সহজ হবে। বুক ধড়ফড় কমবে হয়তো।

    জামা কাপড় ছেড়ে, ধীরে সুস্থে ঠাণ্ডা জলে মুখ হাত-পা ধুলাম। পরিষ্কার পাজামা পাঞ্জাবি পরে মনে হল এই অশান্তিতে একটু সিন্‌গ্‌ল মল্ট দরকার।

    গেলাসে এক পেগ ঢাললাম। তারপর আলো না জ্বালিয়েই বসার ঘরে সোফায় গা এলিয়ে দিলাম। রাস্তার আলো থেকে অস্পষ্ট একটা আভা ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে ছিল।

    একটা সিগারেট ধরালাম। বাঁ হাতে গেলাসটা ধরে আর ডান হাতে সিগারেট নিয়ে, আমি সোফায় টানটান হলাম। সিন্‌গ্‌ল মল্টে চুমুক আর সিগারেটের ধোঁয়ায় টান দিতে দিতে চোখ বন্ধ করলাম।

    সারা শরীরের রক্ত জুড়ে একটা আরাম বোধ ছড়িয়ে গেল আস্তে আস্তে। আঃ।

    উইস্কি শেষ হবার পর, সিগারেট বুজিয়ে দিয়ে চোখ খুলে বসে থাকলাম খানিক ক্ষণ। ভাবছি এবার শুতে যাবো।

    হঠাৎ মনে হল যেন ঘরের অন্ধকার কোণে কিছু একটা নড়লো। চমকে গিয়ে চটপট উঠে সুইচ খুঁজতে দেয়াল হাতড়ালাম। একটা স্ট‍্যাণ্ডিং ল‍্যাম্প জ্বালালাম।

    দেখি লোকটা বসে আছে!

    শিশিরবাবুর মত দেখতে লোকটা জানলার কাছে পিঠ-সোজা চেয়ারে বসে আছে।

    সেই নাক! আমাকে ভয় পাওয়ানোর জন‍্য নাসারন্ধ্র যেন ফুলে রয়েছে। আমার মধ‍্যে অপরাধবোধ জাগানোর জন‍্য ভুরুদুটো যেন বেঁকে আছে। শুকনো ফাটা ঠোঁটের অভিব‍্যক্তি যেন আমার ভিতর উদ্বেগ উদ্রেক করতে চাইছে।

    “এ তো মহা জ্বালা!” আমি বলে ফেললাম। ভয় তো আছেই। খুব রাগও হয়ে গেছে।

    লোকটা বলল,

    কিন্তু বাবা, তুমি তো এখনো তোমার পাঠ শেখোনি।

    আমি তো থ।

    একটু থেমে লোকটা আবার বললো,

    তুমি সব সময় এত ছোটো কেন? একটু আমার সাথে বসো। আমায় কিছু শেখাতে হবে তোমাকে। সেটা কী - বোঝার চেষ্টা করো।

    “এ তো মহা,” আমি আবার বললাম।

    আস্তে আস্তে শান্ত কন্ঠস্বরে লোকটা বললো,

    জীবনে যখন একটা ভূত তাড়া করে, তখন বুঝবে তোমার কিছু একটা শেখার কথা ছিল। সেটা বাকি রয়ে গেছে।

    আমি চুপ।

    পক্ষাঘাতের মত একটা কোনো ভয় যখন তোমার হাত পা অনড় করতে চাইবে,
      তখন জানবে তোমার অসমাপ্ত পাঠ শেষ না হলে আমৃত‍্যু নিষ্কৃতি নেই।

    আমি দাঁড়িয়ে শুনছি।

    পালাবে কোথায়? পালাবে কতদিন? যে অশান্তি তোমাকে ধাওয়া করে চলেছে অক্লান্ত ভাবে, সে তো বাঘ নয় যে তোমায় খাবে।
       সে তোমার অতীতের এক অভিশপ্ত ছায়ামূর্তি।
        ও মুক্তি খুঁজছে।
    ও শুধু চায় তুমি চুপ করে বসে ওর কথা শোনো।

    আমি নির্বাক।

    তুমি যখন নিঃশব্দ স্থিরতায় ওর মুখোমুখি হয়ে তোমার নানান ব‍্যস্ততা বন্ধ করবে, যখন ওকে বুকে চেপে ধরবে,
        তখন ও কুয়াশার মত নিরাকার হয়ে যাবে।
      তখন ও শিশির হয়ে তোমার মুখের উপর পড়বে।
    হিম-ঠাণ্ডা ভয়ের মত।
      তোমার ভেজা গালে তখন পাবে জীবনের নরমতম স্পর্শ।
        তখন তুমি শুনবে
    এক অনাদি অসহ অশ্রুর আর্তি।

    আমি শুনে যাচ্ছি।

    সেই যন্ত্রণাটাকে আলিঙ্গন করবে।
        দেখবে যে সেটা যেমন প্রকাণ্ড, তেমনই নরম।
          সেটাই হল চিরকালের প্রাণের উৎস।
      আর তুমি যদি সেই ব‍্যথাটাকে আঙুল দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দাও,
        ভয়ে নয়, কৌতূহলে,
      আলতো করে,
        যুক্তির হ‍্যাণ্ড্‌শেকে নয়, সমর্পণের নম্রতায়,
      যদি সেই ব‍্যথাটাকে আলতো করে ছোঁও,
        তাহলে
         তার ঠিক পিছনেই পেয়ে যাবে
      অসীম আকাশের অবাধ অনুমতি।

    আমি বসে পড়লাম।

    ব‍্যাস! তখন তোমার ছুটি।

    খানিকক্ষণ আমরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কয়েকটা অর্থবহ ভারহীন মুহূর্ত।

    ভেবে দেখলাম সূর্যোদয়ের এখনো অনেক ঘন্টা বাকি। অন্ধকারের গাঢ় হৃৎপিণ্ডকে বিদ্ধ করার জন‍্য ভোরের তীক্ষ্ণ আলোর ফলা আসতে অনেক দেরি।

    “চা খাবেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments