• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | উপন্যাস
    Share
  • শিকড় (১০) : কৌশিক ভট্টাচার্য





    ।।২৪।।

    দাদুর ঘরের স্মৃতি যেটুকু রয়েছে শমীকের সেটুকু বেশ আবছা। শুধু মনে আছে একটা ছোট মিটশেফ রাখা থাকত ঘরটাতে। সেই মিটশেফের থেকে মিষ্টি বের করে খেতে দিত ঠামি। বেশির ভাগ সময়েই বর্ধমানের মিহিদানা আর সীতাভোগ, কখনো কখনো শক্তিগড়ের ল্যাংচা বা অন্য মিষ্টি। মিটশেফ ছাড়া আর যেটা নজরে পড়ার মতন ছিল সেটা হল চেয়ার সমেত একটা বড় কাঠের টেবিল আর একটা বিশাল বড় আর উঁচু খাট।

    মিটশেফটা এখন আর এঘরে নেই। তবে চেয়ার-টেবিল আর খাটটা আছে।

    চেয়ারটা খুব সাধারণ ডিজাইনের, টেবিলটা কিন্তু ঠিক সাধারণ টেবিলের মতন নয়। এই টেবিলটা শমীকের দেখা অন্য সব টেবিলের মতন চার পায়ের নয়। দুপাশে দুটো মাত্র চওড়া পায়া টেবিলটার। পায়া দুটো একটি করে মোটা আর পুরু কাঠের ভিতের উপর দাঁড়িয়ে। এই ভিতটি চওড়ার দিক থেকে টেবিলের সমান, কিন্তু উপরের দিকে সরু হয়ে আরও উপরে আবার চওড়া। উঁচুর দিকে মাঝ বরাবর পায়াদুটো তাই সরু, কিন্তু আরো উপরে উঠে আবার টেবিলের সমান চওড়া হয়ে গেছে। পাশ থেকে দেখলে তাই পায়াদুটোকে শিকড়বাকড় সুদ্ধ দুটো গাছের মতন লাগে।

    এই দুটো পায়া আবার টেবিলের নিচের দিকে সংযুক্ত হয়েছে আর একটি চওড়া কাঠ দিয়ে। দিব্যি বোঝা যাচ্ছে এই কাঠটি রাখার উদ্দেশ্য হল, টেবিলে বসে যে কাজ করবে তার পা রাখতে যাতে কোন অসুবিধে না হয়। উদ্দেশ্য যাই হোক, দেখে মনে হয় নিচের এই কাঠটি যেন দুটি গাছের নিজস্ব দুটি শিকড়ের সংযোগকারী সেতু।

    তিনটে ড্রয়ার টেবিলে। টেবিলের সামনে দাঁড়ালে দুপাশের দুটো ড্রয়ারকে দুটো বর্গক্ষেত্র আর মাঝের ড্রয়ারটিকে আয়তক্ষেত্র মনে হয়। এরকম বর্গক্ষেত্রর মতন ড্রয়ার শমীক এর আগে অন্য কোনো টেবিলে দেখে নি। ঐ ড্রয়ার দুটো যেন গাছের শাখাপ্রশাখার অংশ, দেখলে মনে হয় দুপাশে দুটি গাছ তার শাখাপ্রশাখার গভীরে অসংখ্য রহস্য নিয়ে উপস্থিত। মাঝের আয়তক্ষেত্রাকার ড্রয়ারটির প্রস্থ অর্থাৎ সামনে থেকে দেখলে উচ্চতা দুপাশের দুটি ড্রয়ারের প্রায় অর্ধেক। যিনি টেবিলটি বানিয়েছিলেন তিনি জানতেন এই অংশটি, টেবিলে যে বসবে, তার উরুর উপরে থাকবে।

    টেবিলের উপরে পিছনের দিকটিতে একটি তিন ইঞ্চি উঁচু পুরু কাঠ লাগিয়ে পাঁচিলের মতন করে দেওয়া হয়েছে। বাকি তিনপাশে পাঁচিল নেই। এই তিনপাশের শেষ এক ইঞ্চি ক্রমশঃ নিচের দিকে ঢালু হয়ে গেছে।

    টেবিলের মতন খাটখানাও খুব সাধারণ নয়। প্রচুর কারুকার্য করা খাটটার গায়ে, আর মশারি টানানোর জন্য খাটের চারপাশে চারটে স্ট্যান্ড। এই খাটটাকে নিয়ে বর্ধমানে একবার খাবার সময় একটু কৌতূহল প্রকাশ করেছিল শমীক। বড়দাদু তখন বুঝিয়ে বলেছিল যে ওই ধরনের খাটকে নাকি পালঙ্ক বলা হয়। এইসব চেয়ার-টেবিল আর পালঙ্ক নাকি অনেক পুরোনো। বর্ধমানের বাড়ি তৈরি হবার পরে পরে বানানো হয়েছিল বাড়িতে ছুতোর ডেকে।

    পালঙ্কের উপর দুটো পাশবালিশ রেখে তার উপর সামান্য হেলান দিয়ে বসে রয়েছে দাদু। খোলা জানলা দিয়ে অল্প রোদ আসছে। তবে এত বড় ঘরের তুলনায় জানলাগুলো ছোটো ছোটো বলে বিছানাটুকু বাদ দিলে ঘরের বাকি সব জায়গা কেমন যেন অন্ধকার। এরকম অন্ধকার ঘর শমীকের একেবারে ভালো লাগে না। দাদুর সাথে কথা বলাটা এখন খুব জরুরি, নইলে এরকম ঘরে থাকত না শমীক, বাইরে বারান্দাতে বসত গিয়ে।

    দাদুর সাথে এর আগে শেষ দেখা হয়েছিল প্রায় পাঁচ বছর আগে, বোম্বেতে। এই পাঁচ বছরে আগের চেয়ে আরও অনেক বেশি রোগা হয়ে গেছে দাদু। এটা কি শুধু বয়সের জন্য শুকিয়ে যাওয়া না ক্যান্সারের জন্য সেটা এতদিন পরে দেখলে বোঝা মুশকিল। মুখেও একটা ধূসর, রক্তশূন্য ভাব এসে গেছে দাদুর। তবে চোখদুটো এখনো আগের মতনই উজ্বল। এর আগেও শমীকের মনে হয়েছে যে ওই চোখদুটো যেন খুব অনায়াসে অন্যের মনের ভিতরটা পড়ে নিতে পারে। এর আগে শমীক তাই দাদুর সামনে কেন জানি না ঠিক স্বচ্ছন্দ বোধ করত না। এখন কিন্তু ওই চোখ দুটো হাসিতে ঝলমল করছে।

    -- কি নিয়ে পড়াশুনো করছিস এখন?

    -- আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে। মেশিনদের বুদ্ধিমান করার চেষ্টা করছি।

    হো হো করে হেসে ওঠেন তমালবরণ।

    -- নকল বুদ্ধি নিয়ে কাজ করছিস? মানুষের আসল বুদ্ধিরই এত অভাব! মানুষের বুদ্ধি একটু বাড়িয়ে দে দেখি, তবে বুঝব তুই গবেষক হয়েছিস বটে!

    হেসে ফেলে শমীক-ও।

    -- না, সেটা বোধ হয় এজন্মে আর হল না! মানুষের মগজ এত জটিল একটা যন্ত্র যে তাকে আরও ভালো করতে আমাদের অনেক দিন লাগবে। হয়তো কোনোদিনই হবে না!

    দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তমালবরণ।

    -- ঠিক-ই বলেছিস। মানুষ জিনিসটাই বড় জটিল।

    চা নিয়ে ঘরে ঢুকল পিন্টুদা। সাথে একটা প্লেটে ওমলেট আর দু তিন রকমের মিষ্টি।

    -- এসব আবার আনলে কেন পিন্টুদা, আমি তো সকালে খেয়ে এসেছি।

    আবার হাসলেন তমালবরণ।

    -- প্লেনের ব্রেকফাস্ট তো? সে তো অনেক আগে। এখন যতটা পারিস খা, দুপুরে না হয় ভাত কম খাবি একটু।

    ওমলেটটা মুখে দিয়েই শমীক বুঝল দাদুর কথাটা কতখানি সত্যি। বেশ খিদে ছিল পেটে। ওমলেট আর মিষ্টিগুলো মিলিয়ে গেল দেখতে দেখতে। জল তেষ্টাও পেয়েছিল বেশ। ঢকঢক করে পুরো এক গ্লাস জল খেয়ে নিলো খাবার পর।

    এতক্ষণ ধরে শমীকের খাওয়া দেখছিলেন তমালবরণ। ভালো কিছু খেতে আর খাওয়াতে যত আনন্দ, অন্য আর কিসে? তাঁর নিজের খাওয়ার দিন গেছে, বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই তাঁর। অনেক খেয়েছেন এ জীবনে। খাবার পর পেট যদি তা সহ্যই করতে না পারে, তবে কি হবে খেয়ে? খাওয়ানোটা যে কেউ কেড়ে নিতে পারে নি এটাই যথেষ্ট।

    -- হ্যাঁ, বল এবার। আর কি কি করছিস? বাবুন বলল, তুই নাকি জার্মানি যাবার কথা ভাবছিস?

    -- ইচ্ছে তো আছে। দেখা যাক।

    -- বাঃ। ভালো জায়গায় রিসার্চ করার মজাই আলাদা।

    সত্যিই খুব ভালো লাগছে তমালবরণের। এই একটা ছেলে, কারো সাতে নেই, পাঁচে নেই, কখনো কারো ভালো বই মন্দ করার কথা ভাবে না। অথচ সব কিছু জানবার আর বুঝবার আর নতুন কিছু করে দেখাবার কি আগ্রহ। দীর্ঘ অধ্যাপকজীবনেও ছাত্র হিসেবে এরকম ছেলে খুব কমই পেয়েছেন তমালবরণ। এমন ছেলেকে আর পাঁচজনের কাছে নিজের নাতি বলে পরিচয় দিতে সত্যিই আনন্দ হয়।

    -- পাসপোর্ট বানিয়ে ফেলেছিস?

    -- হ্যাঁ। সে তো স্কুলে থাকতেই বাবা করিয়ে দিয়েছিল। মা এমন পিছনে পড়েছিল বাবার! সেটা এই গত বছর এক্সপায়ার করল। নতুন পাসপোর্ট হাতে পেয়েছি মাস তিনেক আগে।

    অতসীর পিছনে লেগে থাকবার ক্ষমতা যে কি রকম তা তমালবরণের অজানা নয়। এই পাসপোর্টের ব্যাপারটা নিয়ে বর্ধমানের বাড়িতেও সবার সামনে কিংশুকের সাথে ঝগড়া করেছিল অতসী।

    -- ও, হ্যাঁ। ভুলে গিয়েছিলাম। কতবার যেন তোর মা বাবাকে মনে করিয়েছিল? ডাবল সেঞ্চুরি ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তাই না?

    -- হ্যাঁ, বাবা ক্লান্ত হয়ে পাসপোর্টটা নেহাত তাড়াতাড়ি করিয়ে দিলো। নইলে মা’র ট্রিপল সেঞ্চুরি বাঁধা ছিল!

    বেচারা বাবা! শমীকের পরিষ্কার মনে আছে, সেই সময় সকাল, বিকেল বাবা পাসপোর্ট শব্দটা কানে গেলেই আপনমনে শুধু দাঁত কিড়মিড় করতো।

    -- এবার তো ভিসা করাতে হবে?

    -- হ্যাঁ, সেজন্যই তো দিল্লি গিয়েছিলাম। ভিসা পেয়ে গেছি, কিন্তু আরো অনেক কাজ এখনো বাকি। কিন্তু আমার কথা থাক এখন, বরং তোমার কথা বলো। বাবার সাথে এর মধ্যে কথা হয়েছে কি তোমার?

    -- হ্যাঁ, তোর বাবা তো এখন রোজ-ই ফোন করে একবার করে।

    -- বাবা তোমাকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চাইছে।

    -- আর তুই? তুই কি চাইছিস? আমি যাই?

    শমীক হঠাৎ করে এই প্রশ্নের জন্য তৈরী ছিল না, একটু থতমত খেয়ে গেল।

    -- আমি? সত্যি কথা বলবো? আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না কি করা উচিত হবে।

    হাসলেন তমালবরণ।

    -- আমার আজকাল কোথাও যাবার নাম শুনলেও গায়ে জ্বর আসে। কি হবে বল তো বোম্বে গিয়ে?

    -- আমাদের কারুর একটা কাছে তো থাকবে তবু!

    -- কেন রে, কেউ একটা কাছে থাকবে, এটা কি খুব জরুরি? জানিস, বনের কোনো বড় প্রাণী যখন মরে, তখন ওরা একটা নির্জন জায়গায় চলে যায়।

    -- যাঃ, কি বলছো! আমরা কি তোমাকে জলে ফেলে দেব তাই বলে?

    আবার হাসলেন তমালবরণ, মৃত্যু যত এগিয়ে আসছে, তাঁর চোখ তত অন্তর্ভেদী হয়ে উঠছে। শমীকের এই দরদ একশ শতাংশ খাঁটি, কোথাও কোনো দ্যাখনপানা নেই এর মধ্যে। হয়তো বয়েসের সাথে সাথে এই গুণটা আর থাকবে না, তবু ছোটদের মধ্যে এটা দেখলে মনটা আপনা থেকেই খুব ভালো হয়ে যায়।

    -- না, না, জলে ফেলবি কেন? তোদের তো খারাপ লাগবেই। তবে আমার কি মনে হয় জানিস? একটা লোক মরছে, তুই জানিস সে মরবে, তুই তার সামনে দাঁড়িয়ে অথচ কিছু করতে পারছিস না, এটাই কি খুব ভালো? মৃত্যু তো কম দেখলাম না সামনে দাঁড়িয়ে। আমার তো মনে হয় ঘনিষ্ঠ কারুর মৃত্যু চোখের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখার মতন যন্ত্রণা খুব কম রয়েছে। তার চেয়ে দূরে দূরে থাকা বরং ভালো।

    শমীক অবাক হয়ে দাদুর মুখের দিকে তাকাল। দাদুর চিন্তাগুলো কিরকম যেন, ঠিক সাধারণ লোকেদের মতন নয়।

    তমালবরণকে হঠাৎ যেন কথায় পেয়েছে। মনের মধ্যে জমে থাকা সব চিন্তাগুলো বেরিয়ে আসছে আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোতের মতন। আশেপাশে যারা আছে, জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবে সেই স্রোতে।

    -- ওখানে গেলেও বাবুন তো সবসময় আমার কাছে থাকতে পারবে না। ওকে অফিসে যেতে হবে, মাঝে মাঝে হয়তো ট্যুরেও যেতে হবে। বিছানায় যখন পড়বো, লোক রাখতে হবে। তাতে খরচা আছে, ঝামেলা আছে। কতদিন ভোগাব সবাইকে তারও তো কোনো ঠিক নেই। এখানে পিন্টু তো সবই করছে আমার জন্য, এখন অবধি খুব খারাপ তো সামলাচ্ছে না আমাকে!

    কথাটা নিষ্ঠুর হলেও সত্যি। কিন্তু বাবা কি সেটা মানবে?

    কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে দু জন্যেই। নীরবতা ভাঙেন তমালবরণ।

    -- তোকে এইমাত্র বললাম না, আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। কথাটা আসলে মিথ্যে কথা। শুধু একটা জায়গাতেই যেতে খুব ইচ্ছে করে এখন, মাঝে মাঝে।

    -- কোথায়?

    -- সাতবেড়িয়ায়, আমাদের দেশের বাড়িতে।

    -- বাংলাদেশে?

    -- হ্যাঁ। যখন ছেড়ে এলাম তখনো তো বুঝি নি এ একেবারে চিরদিনের মতন ছেড়ে দেওয়া। সাতবেড়িয়া ছেড়ে আসার সময় ভেবেছিলাম এত ঝগড়া-বিবাদ এসব কি আর চিরকাল থাকবে? এর আগে আমাদের গ্রামেও তো কত ঝগড়া হয়েছে – ভায়ে-ভায়ে, পরিবারে-পরিবারে, কখনো কখনো দুই পাড়ায়, তাই বলে কি আসা-যাওয়া কখনো বন্ধ হয়েছে চিরকালের মতন? ভেবেছিলাম বর্ধমানে চলে গেলেও যখন অবস্থা একটু ভালো হবে, প্রতি বছর কয়েকদিনের জন্য আবার গ্রাম থেকে ঘুরে আসবো। সে আর হল না।

    -- গেলেই পারতে।

    -- দূর, যাওয়া কি অত সোজা! একাত্তর সালের পরে ইচ্ছেটা আবার একটু চাগিয়ে উঠেছিল, কিন্তু বর্ধমান থেকে কলকাতা গিয়ে পাসপোর্ট-ভিসা করানো, ফরেন এক্সচেঞ্জের ঝামেলা সামলানো সেসব কি সোজা কথা?

    -- কেন? এই তো আমি যে জার্মানি যাবো, আমাকেও তো সব ঝক্কি-ই সামলাতে হবে।

    -- সেটা ঠিক-ই বলেছিস। তবে তুই তো পড়াশুনো করতে যাচ্ছিস। আমি গেলে তো বেড়াতে যেতাম শুধু।

    -- বাঃ, কত লোক তো বেড়ানোর জন্যই বিদেশে যায়!

    -- তা যায়। আসলে কি জানিস, অল্প বয়সে ভিতরে ভিতরে একটা ভীষণ অভিমান-ও কাজ করতো। আমার দেশ আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমি কেন শুধু শুধু ভিখারির মতন তার পিছনে পিছনে ঘুরবো? থাকার জন্য তো আর আমার সেই দেশে যাব না, দু দিনের অতিথির মতন যাবো, তাও কিনা অন্যের অনুমতি নিয়ে যেতে হবে? এখন অবশ্য মনে হয়, যা করলাম দেশের তো কিছু যাবে আসবে না তাতে, মাঝের থেকে নিজেরই ক্ষতি করলাম শুধু।

    -- বাংলাদেশে গেলেও কি তোমার ভালো লাগতো? যদি দেখতে সব পাল্টে গেছে, তাহলে হয়তো আরও মন খারাপ হয়ে যেত!

    -- সে কথা ঠিক। ভিটেবাড়িটা যতদূর জানি, এখনো অবধি খুব একটা পাল্টায় নি। তবে গেলেও সেই বাড়িতে তো আর থাকতাম না, বাইরে থেকে দেখতাম শুধু। আমার আসলে খুব দেখতে ইচ্ছে করে ছোটবেলায় যে জঙ্গলটায় আমি আর আমার দাদু শিকার করতে যেতাম সেটা এখনো আগের মতন রয়েছে কিনা।

    -- তুমি শিকার করতে?

    -- কেন? তুই জানিস না?

    -- না তো!

    অবাক হয়ে শমীকের দিকে তাকালেন তমালবরণ।

    -- তাই তো, তুই জানবিই বা কি করে! কটা কথাই বা তোর সাথে হয়েছে আমার যে তোকে বলবো!

    ভিতরে এক ধরনের অপরাধবোধ -- শমীকের মুখটা একটু লাল হয়ে ওঠে। দাদু কি বলতে চাইছে ওর আরও বেশি দাদুকে সময় দেওয়া উচিত ছিল?

    তমালবরণ বোঝেন অস্বস্তিতে পড়েছে শমীক।

    -- না, না, তোর কোনো দোষ নেই। এসব গল্প তো লোকে বাচ্চা অবস্থাতেই বড়দের থেকে শোনে। তোরা যদি বর্ধমানে থাকতিস তাহলে কবে এসব তোর জানা হয়ে যেত।

    -- তোমার হাতে বন্দুক? জাস্ট ভাবতে পারছি না!

    -- হাসছিস? জানিস বন্দুকে অব্যর্থ টিপ্ ছিল আমার। NCC-তে ট্রেনিংএ থাকার সময় কোনো প্র্যাকটিস ছাড়াই ওখানকার টুর্নামেন্টে ফার্স্ট হয়েছিলাম, আর্মির অফিসারদের হারিয়ে। রেগুলার প্র্যাক্টিসে থাকলে কে বলতে পারে কি করতাম!

    হাঁ হয়ে গেল শমীক। দাদু র এই দিকটা একেবারেই জানা ছিল না ওর।

    -- তোমাকে কে শেখাল বন্দুক চালানো?

    -- আমার দাদু। ওরকম লোক আর দেখলাম না এ জীবনে।

    -- ওনার এই গল্প আগে তো কখনো শুনি নি।

    আবার একটু মন খারাপ হয়ে গেল তমালবরণের। তাঁর বন্দুক চালানোর গল্পটা এবাড়ির ছেলেমেয়ে, ভাইপো-ভাগ্নেরা সকলেই শুনেছে। একসময়ে এ বাড়িতে হাসির খোরাক ছিল সেই গল্প। ছেলেমেয়েরা একটু বড় হবার পর, যখনই গল্পটা শুরু করতে যেতেন তমালবরণ ছেলে-ভাইপো-ভাইঝি-ভাগ্নী -- সবাই মিলে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে ভয়ের অভিনয় করতো, “ভাগ্গিস তোমার হাতে আর বন্দুক পড়ে নি। পড়লে আমরাই খোরাক হতাম সবার আগে।” বৌদি আর কৃষ্ণা মিটিমিটি হাসত কথাগুলো শুনে। বন্দুক বা শিকারের গল্প কেন জানি না দাদাও পছন্দ করত না একদম। তমালবরণ লক্ষ্য করেছেন যে দাদুর প্রসঙ্গ উঠলেই পলাশবরণ কৌশলে কথা ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করতেন। কয়েকবার এরকম হবার পর, কিছুটা রাগে, কিছুটা অভিমানে, এই সব গল্প বলা বন্ধ করেছিলেন তমালবরণ। কিছু কিছু স্মৃতি থাকে সেগুলো এত পবিত্র যে তার বিন্দুমাত্র অপমান-ও সহ্য করা যায় না। রাগ করেই বা কি হবে? তার চেয়ে যা তাঁর একান্ত নিজের, তা নিজের কাছেই থাক।

    এখন যখন ডাক এসেছে, তখন এইসব অভিমান-ও ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেছে।

    প্রায় ফিসফিস করে তমালবরণ শমীককে বললেন, “একটা স্মৃতিকথা লিখেছি নিজের। দাদুর সব কথা, সব গল্প রয়েছে তাতে। পড়বি?”

    ***<

    -- স্মৃতিকথা?

    এবারে সত্যিই একটু অবাক হয়ে গেল শমীক। তারপর একটু দ্বিধার সাথে জিজ্ঞাসা করল, “বাংলাতে?”

    -- হ্যাঁ, বাংলাতে। আমি তো আর তোদের মতন ভালো ইংরেজি জানি না।

    -- এটা কিন্তু বাজে বিনয় করছো, দাদু। রিসার্চ পেপার তো তুমিও লিখেছো ইতিহাস নিয়ে। সেসব নিশ্চয়ই বাংলায় লেখো নি!

    -- দূর! সেই লেখা মানে কি আর ইংরেজি জানা। আমরা তো আর তোদের মতন ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ি নি। তবে হ্যাঁ, স্কুলে আর কলেজে মাস্টারমশাইরা সকলেই লোক খুব ভালো ছিলেন, যত্ন করে পড়াতেন তাই উৎরে গেছি। কিন্তু আজও ইংরেজি লিখতে গেলে আর্টিকেল আর প্রিপোজিশন গুলিয়ে যায়। ওটাকে জানা বলে না।

    -- কিন্তু বাংলা লেখা তো …

    -- পড়তে পারবি না, তাই তো?

    শমীকের মুখে লজ্জার আভা দেখে তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন তমালবরণ, “না, না, তোর লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। বড় হয়েছিস বাংলার বাইরে, একসাথে কটা ভাষাই বা লিখতে-পড়তে শিখবি? বলতে যে পারছিস ঠিকঠাক , এটাই তো যথেষ্ট আমার কাছে।”

    -- একেবারে পড়তে পারি না তা নয়.। অভ্যাস নেই খুব একটা, একটু থেমে থেমে ধরে ধরে পড়তে হয়। ছাপা লেখাতে অসুবিধে হবে না, তবে হাতের লেখা কতটা পড়তে পারব জানি না।

    একটু থেমে তমালবরণ বললেন, “এক কাজ কর। ওটা তুই নিয়ে যা। বাবুনকে দিস। ইচ্ছে হলে তোর নিজের কাছেও রাখতে পারিস। পরে কখনো যদি ভালো করে বাংলা পড়তে শিখিস, চেষ্টা করিস পড়ার …”

    মনে মনে একটু প্রমাদ গুনল শমীক। কাজ বাড়ল আরও একটা। বাবার সাথে মাসখানেকের আগে দেখা হচ্ছে না। শমীকের এখন এত পড়ার চাপ যে এসব ব্যাপার ভুলে যেতেই পারে। নিজের কাছে রাখলেও, কারুর বাংলা হাতের লেখা পড়বার মতন যোগ্য হয়ে উঠবার সময় ওর হাতে নেই।

    এক লহমার জন্য দাদুর দিকে তাকিয়েই শমীক হঠাৎ বুঝে গেল কি বললে দাদু সবচেয়ে খুশি হবে।

    -- একটা কাজ কর না! পড়ে শোনাও না আমাকে।

    -- পড়ে শোনাব কি রে? সে তো বিশাল লেখা। দু’শ পৃষ্ঠার বই হয়ে যাবে একটা।

    -- বাঃ, পুরোটা পড়তে কে বলেছে? কোনো একটা অংশ পড়! বইয়ের মার্কেটিং করার নিয়ম হল কিছু কিছু ভালো অংশ খবরের কাগজে ছাপানো বা ইন্টারনেটে ঢেলে দেওয়া। যাতে সেটা পড়ে পাঠকেরা চ্যাং মাছের মতন টোপটি গেলে!

    -- আরে, ভালো ব্যবসা শিখেছিস তো তুই! শুধু নকল বুদ্ধির-ই চর্চা করছিস না তাহলে!

    দাদুর সাথে এইবার একটু মিষ্টি মিষ্টি দুষ্টুমি করার ইচ্ছে হচ্ছে শমীকের।

    -- দ্যাখো, ওই অংশটা যদি ভালো হয় তাহলেই কিন্তু তোমার বইটা কিনবো!

    -- কিনবি? কিন্তু আমি তো কোনো বিক্রির জন্য লিখি নি, ছাপিয়ে বই করিয়েই বা কি করবো? আজকাল তো কিছু টাকা দিয়ে অনেকেই নিজের বই ছাপায়। ইচ্ছে হলে তো আমিও অমন করতে পারতাম!

    দাদুর গলায় স্পষ্ট অভিমানের সুর। তাড়াতাড়ি শমীক বলে ওঠে, “না, না, তুমি বিক্রির জন্য লিখবে কেন? আমি ঠাট্টা করছিলাম! কোথায় তোমার স্মৃতিকথা?”



    টেবিলের উপরেই রাখা ছিল পাণ্ডুলিপি। আলগা কাগজে লেখা, তবে কাগজগুলো খুব যত্ন করে একটা ফাইল-এ সাজিয়ে রাখা।। ফাইলের মধ্যে এক একটা চ্যাপ্টারের লেখা আবার আলাদা করে স্টেপলার দিয়ে আটকানো।

    -- উঃ, অনেক লিখেছো। অনেকদিন ধরে লিখছো নিশ্চয়ই?

    -- শুরু করেছিলাম অনেকদিন আগে। তারপর যা হয় আর কি, কিছুটা লেখার পর পড়ে রইল সব। তারপর আবার মাস তিনেক আগে ফের শুরু করলাম। কি ভাগ্য দেখ, আজ সকালে শেষ হয়েছে লেখাটা আর তুইও চলে এলি!

    -- এত যে লিখেছ, তোমার কষ্ট হয় নি? একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখেছি জানো, আমার কম্পিউটারে টাইপ করতে কষ্ট হয় না, তবে হাতে লিখতে বেশ কষ্ট হয়!

    -- লিখতে কষ্ট তো আছেই। হাতের আঙুলে জোর পাই না আর আগের মতন .. ,

    -- যাক, শেষ যে করতে পেরেছো সেটাই মস্ত ব্যাপার!

    -- মস্ত? কে জানে? মাঝে তো ভাবিই নি যে লেখাটা শেষ করে যেতে পারবো! মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগতো, মনে হত কেন যে কষ্ট করে এত সব লিখছি ...,শেষ করতে পেরেছি হয়তো লিখতে ভালো লাগত বলে। যতক্ষণ লিখতাম, হাত অবশ হয়ে গেলেও মনে হত যে বেঁচে আছি!

    দাদুর চোখ দুটো আবার অস্বাভাবিক উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। যেন শমীক এই ঘরে নেই, কেউ নেই সামনে, নিজেরই মনের সাথে আলাপচারিতা চলছে দাদুর।

    -- কেন লিখছি অনেক ভেবেছি তাই নিয়ে, জানিস! মনে হল লেখাটা খুব দরকার। কেন জানিস?

    -- কেন?

    -- আমার একটা কথা খুব মনে হয়। মগজের মধ্যে হাজার হাজার কোষ যেমন একসাথে মিলে আমাদের বুদ্ধি তৈরী করে, আমাদের সমাজটাও যেন অনেকটা সেই রকম। হাজার হাজার লোক মিলে একসাথে যে জিনিষটা তৈরী করছে তার-ও যেন বুদ্ধি রয়েছে, সেই সমাজটাও যেন একটা জীব, প্রাণী!

    হঠাৎ নড়েচড়ে বসে শমীক। কোনো রিসার্চ পেপার না পড়ে দাদু কিভাবে একেবারে বিজ্ঞান আর দর্শনের এই সীমারেখায় পৌঁছে গেল একেবারে? হিউম্যান কনশাসনেসের উৎসটা ঠিক কোথায় সেটা আজও তো আমরা ভালো জানি না।

    -- কত কিছু তো ছিল আমাদের সেই সমাজ বলে প্রাণীটার, যে সমাজটায় আমরা বেড়ে উঠেছি। সবাই মনে করে সেই প্রাণীটা মরে ভূত হয়ে গেছে। কিন্তু আমি তো জানি সেটা সত্যি নয়। সে আছে, আজও বেঁচে আছে। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো, আমার মনের মধ্যে সে-ও বেঁচে থাকবে। মনে হল, আমি তো মরতে চলেছি, যদি কাগজে কলমে তার সম্বন্ধে আমার লেখাটা শেষ করে যেতে পারি, তাহলে হয়তো ওই প্রাণীটা বেঁচে থাকবে আরো কিছুদিন!

    বলতে বলতে দাদু দম নিলো একটু। শমীকের মুখে কোনো কথা নেই।

    -- তোর কাছে রেখে গেলাম ওকে। যদি একটু কথা বলার চেষ্টা করিস ওর সাথে, হয়তো বুঝবি প্রাণী হিসেবে কতটা উপকারী ও। আমাদের চারপাশটা না মাঝে মাঝেই অন্ধকার হয়ে আসে। আমার হয়েছে, বাবুনেরও -- তোরও হবে। চারপাশটা যখন অন্ধকার হয়ে আসবে, তখন যদি ওর কাছে যাস, দেখবি ওর গায়ের থেকে আলো ঠিকরোচ্ছে। আলো হয়ে গিয়ে তোকে অন্ধকার পার করে নিয়ে যেতে পারে ওই প্রাণীটা, এত ক্ষমতা ওর!

    যেন কোন ঘোরের মধ্যে আছেন তমালবরণ।

    -- আমার এই এত বছরের জীবনে খারাপ সময় তো খুব কম আসে নি! যখন এসেছে, আমি ওই প্রাণীটার কাছেই গিয়েছি আর লড়াই করার শক্তি খুঁজে পেয়েছি নিজের মধ্যে। তাই ভাবলাম, তোদের কাছে ওকে রেখে যাই .. . .

    কথা বলতে বলতে একদৃষ্টে শমীককে দেখছিলেন তমালবরণ। বোর হচ্ছে কি ছেলেটা? অল্পবয়সী ছেলে, বুড়োদের এত বেশি লেকচার ভালো লাগবে না ওদের। কিন্তু মুশকিল হল, বুকের মধ্যে যে কথাগুলো জমে আছে আজ যদি সেটা না বলেন তাহলে আর কোনোদিন সেগুলো বলা হয়ে উঠবে না…

    -- আসলে কি জানিস, আমি তো ইতিহাসের ছাত্র, সেজন্যই হয়তো মনে হয়েছিল যে আমি যা দেখেছি, যেটুকু জেনেছি সেটা লিখে রেখে যাওয়াটা খুব দরকার।কত কি যে আমাদের হারিয়ে গেছে শুধু এই কাজটুকু আমরা করি নি বলে!

    -- হ্যাঁ, খুব ভালো করেছ লিখে।

    -- তোরা তো সবাই আজকাল বিজ্ঞান পড়িস, ইতিহাস আর কজন ভালোবেসে পড়ে? তবু মজাটা কি জানিস, বিজ্ঞানেরও ওই ইতিহাস নামে বস্তুটার হাত থেকে রেহাই নেই। এই যেমন তোর কথাই ধর না! তুই গবেষণা করছিস নকল বুদ্ধি নিয়ে, যন্ত্রকে বুদ্ধি দিবি তোরা, কিন্তু সেই বুদ্ধি তো আর আকাশ থেকে পড়বে না, যন্ত্রকে ট্রেনিং দিতে হবে আর এই ট্রেনিং দিতে হবে আগে ঘটে যাওয়া কিছু সত্যিকারের ঘটনার মাধ্যমে। যত বেশি ঘটনা, যত বেশি যত্ন করে সেই তথ্য জোগাড় করা আর সাজিয়ে রাখা, যন্ত্রের বুদ্ধিও তত বাড়বে, তাই না?

    আরও একবার অবাক হল শমীক। কি পরিষ্কার, স্বচ্ছ চিন্তা দাদুর, অথচ কোনো বড় বড় কথা নয়, সহজ সরল কথ্য ভাষা। কি বলতে চাইছে বুঝতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় না।

    -- আরিব্বাস! একদম ঠিক কথা বলেছো। যন্ত্রকে বুদ্ধিমান করতে গেলে এসব কিছু তো লাগবেই।

    -- তবেই দেখ! আমার কেন জানি না মনে হয় জানিস, একটা যন্ত্রের বেলা যা হবে, মানুষের বেলাও তাই। মানুষ জিনিসটাও তো একটা যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়! হয়তো খুব জটিল একটা যন্ত্র, যার কলকব্জাগুলো ঠিক কিভাবে কাজ করে তার সব আমরা জানি না এখনো। আমার তাই মনে হয় সত্যিকারের বুদ্ধিমান হতে গেলে নিজেদের অতীতটাকে খুব ভালো করে জানতে হবে আমাদের। সমাজ বলে প্রাণীটা যত আমাদের সক্কলের এই অতীতটাকে জানবে, মুক্তমনে তাকে বুঝবার চেষ্টা করবে, তত বেশি আর তত তাড়াতাড়ি সে বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে, একই ভুল বারবার করবে না। তাই ভাবলাম লিখেই যাই সবকিছু! আর কেউ করুক বা না করুক, আমার কাজটা আমি অন্তত করে যাই।

    অনেক বেশি কথা বলা হয়ে গেছে একসাথে। বেশি কথা বলতেও শক্তি খরচ হয়।

    বিছানা থেকে নেমে একটু টেনে টেনে হেঁটে টেবিলটার কাছে এসে মাঝের ড্রয়ারটা খোলেন তমালবরণ।

    – গতবার বাবুনকে টাকাপয়সা, কাগজপত্র সব কোথায় কি আছে বুঝিয়ে দিয়েছি। একটা কথা অবশ্য ওকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম তখন। বাবুনকে বলিস আমাদের পুরোনো অ্যালবামগুলো সব রাখা আছে এই টেবিলটার মধ্যে। এত সব তো আর নিয়ে যেতে পারবি না আজ। এই খামটা বরং রাখ নিজের কাছে।

    হলুদ রঙের একটা পুরোনো বিবৰ্ণ খাম এগিয়ে দিলেন তমালবরণ।

    -- দশ-বারোটা পুরোনো ফটো রয়েছে এটার মধ্যে । আমার বাবা, দাদু, আর সাতবেড়িয়ার আরও অনেকের, পিছনে নাম লেখা আছে সবার, তারিখ সমেত। সবই প্রায় আমার দাদুর তোলা। দাদুর নিজের ছবিটা অবশ্য আমার তোলা। ওগুলো-ও তোর কাছেই রাখ এখন থেকে।

    আবার আস্তে আস্তে টেনে টেনে হেঁটে বিছানায় ফিরে গেলেন তমালবরণ, তারপর এলিয়ে পড়লেন একেবারে।

    – আমি একটু শুই এবার?

    ২৫

    -- সে কি! বাঙালির ছেলে তুমি, বাংলা পড়তে জানো না?

    খুব লজ্জা হয়েছিল সেদিন শমীকের, অনীশ স্যারের প্রশ্ন শুনে। কম্পিউটারকে দিয়ে সমস্ত ভারতীয় ভাষার অক্ষর চিনিয়ে তাকে দিয়ে সেই সব ভাষার বই, ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র ইত্যাদি পড়ানোর প্রজেক্ট। অন্য সব ভারতীয় ভাষার সাথে বাংলাও রয়েছে।

    মাথা নিচু করে, একটু বোকার মত হেসে, জবাব দিয়েছিল শমীক, “শেখা হয়ে ওঠে নি, স্যার”

    -- মা বা বাবা বলেন নি কখনো শিখতে?

    একদম ছোটবেলায় বাবা কিছু বাংলা ছড়া শিখিয়েছিল। তারপর সকাল-সন্ধ্যে অফিস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় আর সময় পায় নি। মা দিল্লি যাবার পর আবার একটা সুযোগ এসেছিল। অফিস থেকে ফেরার পর তখন শমীককে বেশ কিছুটা সময় দিত বাবা। সেই সময়ে একবার দুবার শমীককে বাংলা শেখার কথাটা বলেছিল বাবা, কিন্তু শমীক খুব একটা আগ্রহ দেখায় নি বলে বাবা আর এই নিয়ে খুব জোর করে নি।

    এই বাংলা-জানার ব্যাপারটা নিয়ে খুব আলোচনা হোক তা চাইছিল না শমীক, কিন্তু অনীশ স্যারকে কি সেটা বলা যায়? সত্যি কথাটাই বলল শমীক।

    -- বাবা একবার দুবার বলেছিলেন। আমিই শিখি নি।

    -- কেন?

    -- আসলে স্কুলের পড়া সামলে আর ইচ্ছে করত না।

    একটু বড় হবার পর সত্যিই আর আলাদা করে বাংলা বর্ণমালা শেখার চাড় ছিল না শমীকের। গাদা গাদা হোমটাস্ক স্কুলে, খেলাধুলো করারই বেশি সময় জোটে না, তার উপরে আবার একটা আস্ত নতুন ভাষার সব অক্ষর চিনে পড়তে শেখা! কটা বাংলা লেখা পড়বে শমীক যে ওকে বাংলা অক্ষর চিনতে হবে?

    ছোটবেলায় বাবা এই সব নিয়ে কোনো অনুযোগ করলে কয়েকদিন বাবাকে এড়িয়ে থেকেছে ও। আশ্চর্য এই যে মায়ের সাথে বাবার তুলনায় অনেক বেশি সময় কাটালেও মায়ের দিক থেকে কখনো কোনো চাপ আসে নি এই ব্যাপারে আলাদা করে।

    মা অনেক বেশি জোর দিত ইংলিশের উপর, এমনকি হিন্দির উপরও।

    -- আর এখন? এখন তো এটা তোমার পড়ার বিষয়ের মধ্যেই পড়ছে। এখন শিখবে তো?

    নাছোড়বান্দা হিসেবে অনীশ স্যারের একটা দুর্নাম রয়েছে আই আই টি কানপুরে। ছাত্রদের যদি কিছু শেখানো দরকার মনে করেন অনীশ স্যার তাহলে ঘন্টার পর ঘন্টা সময়ে দিয়ে তাদের শিখিয়ে তৈরি করে নেবেন। প্রথমদিকে, যখন আই আই টি তে অতটা ভালো করতে পারছিল না শমীক, তখনও ওর পিছনে নাছোড়বান্দার মতন লেগে ছিলেন অনীশ স্যার। এই লেগে থাকার একমাত্র কারণ, অনীশ স্যারের পরীক্ষাতে একটা খুব শক্ত প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পেরেছিল শমীক, ক্লাসের অন্য কোনো ভালো ছেলে সেটা পারে নি।

    “বই বা ক্লাসনোটস পড়ে উত্তর দেওয়া তো অনেক সোজা, শমীক, কিন্তু সে সবের বাইরে থেকে প্রশ্ন এলে, মগজটা কার কেমন সেটা বোঝা যায় পরিষ্কার! মাথাটা রয়েছে তোমার, এখন দরকার শুধু একটু লেগে থাকা!”

    সেই অনীশ স্যারকে কোনো ব্যাপারে “পারব না!” কি বলা যায়?

    মাথা নিচু করে শমীক অনীশ স্যারকে তাই কথা দিয়েছিল, “শিখে নেব তাড়াতাড়ি!”

    চেষ্টা থাকলে কি না হয়? মাত্র কয়েকদিনের চেষ্টায় সব বাংলা অক্ষর শিখে নিয়েছিল শমীক। গড়গড় করে একটুও হোঁচট না খেয়ে অনীশ স্যারকে পড়ে শুনিয়েছিল বাংলা বই আর খবরের কাগজ থেকে। গবেষণার কাজ উৎরে দিতে সেইজন্য বিন্দুমাত্র সমস্যা হয় নি!

    শমীকের প্রোগ্রেস দেখে খুশি হয়েছিলেন অনীশ স্যার।

    -- নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতিটা জানা কেন এত জরুরি জানো, শমীক? আমার যেটা ভয় ছিল তোমাকে নিয়ে, কেউ না কেউ হয়তো তোমাকে এসব নিয়ে অপমান করবে কখনো। যদি সব না জানো, খুব খারাপ লাগবে তখন। জবাব দিতে পারবে না, মনে দ্বিধা আসবে। নিজেকেই ছোটো মনে হবে। যারা অপমান করেছে শেষে হয়তো তাদের মতনই হয়ে যেতে চাইবে নিজের অজান্তে।

    -- কেন? অপমান করবে কেন, স্যার?

    হাসলেন অনীশ স্যার।

    -- তুমি এখনো অনেক সরল আছো, শমীক। আসলে তুমি নিজে কি? হিন্দু না মুসলমান, বাঙালি না অবাঙালি এসব তো তুমি নিজে ঠিক করবে না, ঠিক করবে অন্য সকলে। আর পৃথিবীতে যত লড়াই, তার এক বিরাট অংশ এই আইডেন্টিটি নিয়ে। নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতিকে জানা তোমার সেই লড়াইয়ের একটা প্রস্তুতি মাত্র। যেহেতু তোমার মা-বাবা বাঙালি আর যেহেতু তোমার পদবী চ্যাটার্জী, লোকের চোখে তুমি বাঙালি। বাংলাটা যদি ভালো করে শেখো, বাংলার ইতিহাস, তার ঐতিহ্য যদি জানো, তাহলে সেটা হবে একটা বর্মের মতন, কেউ এইসব নিয়ে তোমাকে আঘাত করলে আঘাত সেই বর্মে ছিটকে বেরিয়ে যাবে, মনের অন্দরে ঢুকে তোমাকে রোজরোজ অকারণে খোঁচাবে না!

    প্রফেসর অনীশ বোস শমীককে আরো অনেক কিছু শিখিয়েছেন, তার মধ্যে একটা হল কিভাবে কোনো বড় বই খুব দ্রুত পড়তে হয়।

    -- পৃথিবীতে অসংখ্য বই, শমীক। ভালো বইয়ের সংখ্যাও অগুনতি। সব বই খুঁটিয়ে পড়ার মতন সময় আমাদের কারুর হাতে নেই। তাই নতুন বই পেলে প্রথমে উল্টে পাল্টে দেখো বইটা কাজের কিনা, দরকারে কিছুটা বাদ দিয়ে দিয়ে পড়ো। পুরো বইটা লাইন ধরে ধরে পড়বে একমাত্র যদি ওই প্রথম দেখায় বইটাকে খুব ভালো আর কাজের মনে হয়।

    আজ মনে হচ্ছে সময় এসেছে এই শিক্ষাটাকে একটু অন্য ক্ষেত্রে কাজে লাগাবার। দেখা যাক ঘণ্টাপিছু একশ পৃষ্ঠা শমীক পড়ে উঠতে পারে কিনা!

    ***

    ঠিক কতক্ষণ ধরে স্মৃতিকথাটা পড়ছে সেটা নিজেও জানে না শমীক।

    একেবারে কোনোই অসুবিধে হয় নি শমীকের। পরিষ্কার হাতের লেখা দাদুর, বড় বড় গোটা গোটা অক্ষরে। আর ঝরঝরে সহজ, সরল, কথ্য বাংলা।

    দেখতে দেখতে প্রথম চারটে চ্যাপ্টার পড়া হয়ে গেল। যত পড়ছে তত অবাক হচ্ছে শমীক। পূর্বপুরুষ শব্দটা বড় গ্রাম্ভারি শব্দ, কিন্তু ওই শব্দটাই যেন ইতিহাসের সাথে নিজের ব্যক্তিজীবনের একটা সেতু।

    কিন্তু এত জটিল কেন ইতিহাস?

    এতদিন শমীক জেনেছে মায়ের দিকের থেকে ওর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন জমিদার। কুকম্ম ছাড়া ভালো কোনো কাজ খুব সম্ভবত পৃথিবীতে তাঁরা কেউ করে রেখে যান নি। জেনে পাপবোধ বেড়েছে শুধু। নিজেকে এক সময় নোংরা, অপবিত্র মনে হয়েছে। মনে হয়েছে নিজের রক্তের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে খুব দূষিত কিছু কণা ...

    বাবার দিক থেকেই বা ভালো কি পেয়েছে শমীক? দাদুর বাবার পাগলামি নিয়ে বাবাকে মা এক সময় ক্রমাগত খোঁটা দিয়ে এসেছে পাগলের বংশ বলে। বয়ঃসন্ধির সময়টাতে যখনই সেই খোঁটা শুনেছে তখনই এক নিদারুন আতংকে ভুগেছে শমীক। যেন এই পাগলামির বীজও সে বয়ে বেড়াচ্ছে নিজের শিরায় শিরায় …

    এই স্মৃতিকথা যে আবার অন্য গল্প শোনাচ্ছে!

    ওর নিজের পূর্বপুরুষ লড়াই দিয়েছে জমিদারকে। প্রাণ দিতেও দ্বিধা করে নি মেয়েদের সম্মান, পরিবারের সম্মান বাঁচাতে। বাবার উপর অভিমান হচ্ছে খুব। কেন এইসব গল্প বাবা বলে নি ওকে? মা যখন বাবাকে পাগল বলে অসম্মান করেছে, তখন কেন এই সমস্ত গল্প শুনিয়ে প্রতিবাদ করে নি বাবা? অঘোরনাথের কথা বাবা কি জানত না? সবচেয়ে বড় সমস্যা হল ও নিজে তাহলে কি? ও কি মুম্বাইকর নাকি বাঙালি? বোম্বেতে আগাগোড়া মানুষ হয়ে এই শহরকে ও অস্বীকার করে কি করে? কত বন্ধু ওর এই শহরে। এই শহরের শিবাজী পার্ক, মেরিন ড্রাইভ, জুহু বিচ ওর প্রাণ। নিজে ক্রিকেট না খেললেও, কত গর্ব ওর এই শহরের ক্রিকেট ঐতিহ্য নিয়ে।

    এই স্মৃতিকথাটা আবার এমন একটা জায়গার কথা লিখছে যেটা এখন আর আমাদের দেশের অংশ নয়। ও কি তাহলে বাঙালি, নাকি বাংলাদেশী, নাকি আরও সূক্ষ্মভাবে দেখলে বরিশালি অথবা ফরিদপুরি? ঠিক কিভাবে দেখবে ও ওর পারিবারিক অতীতকে? ও কি লজ্জা পাবে অত্যাচারী জমিদার ওর পূর্বপুরুষ বলে, নাকি গর্বে ওর বুকটা ফুলে উঠবে জমিদারের অত্যাচার রুখে দিতে ওর পূর্বপুরুষের ভূমিকার কথা ভেবে?

    তিন নম্বর চ্যাপ্টারের একটা জায়গায় অঘোরনাথের ছেলেবেলার গল্প শুনিয়েছেন তমালবরণ। শুনিয়েছেন খোদ অঘোরনাথের মুখ দিয়েই। ছোটবেলায় রোগা দুবলা ছিলেন অঘোরনাথ। তাঁর কুস্তি আর শরীরচর্চার শুরু গ্রামের একটি ছেলের হাতে মার খাবার পর। নিষ্করুণ বর্ণনা দিয়েছেন সম্পূর্ণ একা একা তাঁর নিজের পথ নিজে তৈরি করে নেবার। একবার নিজের শরীর আর মনের দখল নেবার পর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয় নি তাঁকে। কিন্তু এই দখল সহজে আসে নি। প্রথম দিকে সমবয়সীদের প্রচুর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ হজম করতে হয়েছে তাঁকেও।

    পাঁচ নম্বর চ্যাপ্টারটা পড়তে গিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল শমীকের। তমালবরণ নিষ্করুণ বর্ণনা দিয়েছেন দেশভাগের পরে তাঁদের পারিবারিক লড়াইয়ের -- বাবার পাগল হয়ে যাওয়া, মায়ের শুকনো মুখ আর মাথায় পাকাচুলের সংখ্যাবৃদ্ধি আর দুই ভাইয়ের অনেক সময় দাঁতে দাঁত চেপে ক্লাস করার পরে কোনো কিছু মুখে না দিয়ে টিউশনি করতে ছোটা। বুঝতে অসুবিধে হয় না কিভাবে দিন কেটেছে তাঁদের। পাড়ার রসিক ছেলেরা কয়লা দিয়ে বাড়ির বাইরের পাঁচিলে লিখে রেখে গেছে, “এই বাড়িতে বাঙাল ভূতেরা থাকে!” পাড়ার একমাত্র বাঙাল বাড়ি, আর সেই বাঙাল ভূতেদের বাড়িতে আবার এক পাগল ডাক্তার। পাড়ার সকলের খোরাক। সেই পাগল ডাক্তার কেন পাগল হয়েছে পৃথিবী সেই বিচার করে নি সেদিন। পরেও কি করেছে?

    একটা নতুন দেশে নিজেকে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা করার পিছনের যে লড়াই তা কি সব সময়েই এত শক্ত?

    শমীক-ও নতুন একটা দেশে যাচ্ছে।

    নদীর ভাঙনে সর্বহারা হয়ে নয়, জমিদারের অত্যাচারে ভিটেমাটি ফেলে নয়, দেশভাগের ফলে উদ্বাস্তু হয়ে নয়, ও যাচ্ছে নিজের ইচ্ছেতে, মাথা উঁচু করে। তবু মনে হচ্ছে বিশাল বড় লড়াই সামনে। শমীকও কি তাহলে হাল ছেড়ে দেবে আনন্দমোহনের মতন? কিন্তু শমীক তো আবার অঘোরনাথের-ও উত্তরপুরুষ, এত সহজে তাহলে হার মানবে কেন শমীক? সাতবেড়িয়ার মতন জায়গাতে থেকে সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে নিজেকে কলকাতার মতন শহরে একজন অসাধারণ ডাক্তার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন অঘোরনাথ। কত সময় লাগত তখন সাতবেড়িয়া থেকে কলকাতা যেতে আসতে? রেল, স্টিমার আর নৌকোর দীর্ঘ যাত্রাপথ। এখন বোম্বে থেকে প্লেনে উঠে জার্মানি যেতে যত সময় লাগে তার চেয়ে কম কিছু নয়। আর ভাষা? বাঙাল ভাষায় কথা বলা নিয়ে কি কম হাসাহাসি শুনতে হয়েছে কলকাতাতে?

    গ্লোবালাইজেশন।

    শব্দটার সাথে পরিচিত না হয়ে উপায় আছে আজ? গ্লোবালাইজেশনের ফলে, পৃথিবী নামে মহাবিশ্বের এই ছোট্ট অকিঞ্চিৎকর গ্রহটায় ইউরোপ আর আমেরিকার দেশগুলোই আজকাল শহরের মতন। গ্রাম থেকে যারা শহরে যেত সেই সব দিনে কজন আবার গ্রামে ফিরত তাদের মধ্যে?

    মনে হচ্ছে এই ফেরার ব্যাপারটা নিয়ে এখনই মাথা ঘামিয়ে কোনো লাভ নেই। অনেক দূরের ব্যাপার সেসব। পি এইচ ডি শেষ হলে তখন বরং এসব নিয়ে ভাবা যাবে। আপাততঃ অর্জুনের পাখির চোখের মতন, লক্ষ্য স্থির করতে হবে নিজেকে ভালো বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। সেজন্য দরকার পড়লে ভারত থেকে জার্মানি তো যেতেই হবে, গ্রামের ছেলের শহরের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়ার মতন।

    না, যেভাবেই হোক জার্মানিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেই শমীক, দরকার পড়লে দিনে আঠার ঘন্টা কাজ করে। তারপরের কাজ: সারা পৃথিবীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। বাবার মতন শুধুমাত্র একটা শহরে একটা চাকরি আঁকড়ে পড়ে থাকবে না ও। পৃথিবীর সব দেশ ঘুরবে, দেখবে, জানবে সবকিছু। অবশ্যই সহজে আসবে না কোনোকিছু। লড়াই করতে হবে দাঁতে দাঁত চেপে, বছরের পর বছর।

    আপাতত লড়াই থাক, সেসব পরের কথা। দাদু শুয়ে পড়েছে পাশের ঘরে। শমীক-ও এখন ঝিমিয়ে নেবে একটু আধ ঘন্টার মতন। বর্ধমান আসতে হবে বলে প্রায় মাঝরাতে উঠতে হয়েছে গতকাল। আগের দু’রাতও অনেকটা সময় জেগে পেপারের কাজ করতে হয়েছে। প্লেনে ঘুম এসেছিল খুব অল্প সময়ের জন্য। এখন আবার দু’চোখ ঘুমে ভেঙে আসছে।

    স্মৃতিকথার বাকি অংশগুলো কলকাতার বাসে যেতে যেতে পড়বে বরং।

    ***

    বারো কিলোমিটার লম্বা একটা অ্যাসটারয়ড আসছে মহাকাশের গর্ভ থেকে পৃথিবীকে আঘাত করতে। এত বড় অ্যাসটারয়ড ডাইনোসররা ধ্বংস হয়ে যাবার পর থেকে আর কখনো পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ে নি।

    লেজার রশ্মি দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে এই অ্যাসটারয়ডটাকে। আর এই লেজার গান-কে চালিত করবে প্রফেসর আর্নস, অনীশ স্যার আর শমীক -- এই তিনজনের সৃষ্ট অ্যালগরিদম। নাসার হেডকোয়ার্টার থেকে এখনই ছোঁড়া হবে সেই লেজার গান, কম্পিউটারএর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে এর গতিপথ। উৎকণ্ঠায় একটা বিশাল বড় টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে হল ভর্তি বিজ্ঞানীরা।

    দেখতে দেখতে কয়েকশ টুকরো হয়ে গেল সেই অ্যাসটারয়ড। বিপদমুক্ত হয়েছে পৃথিবী। আনন্দে উচ্ছল হয়ে হাততালি দিতে থাকলেন হল ভর্তি বিজ্ঞানীরা। সকলেই জানেন প্রোবাবিলিটির সূত্র মেনে বেশির ভাগ ছোট টুকরোই আছড়ে পড়বে বিভিন্ন মহাসাগরে। মানুষের বা অন্য প্রাণীদের বড় কোনো ক্ষতি হবে না সেই সব আঘাতে।

    শমীকের চোখ অবশ্য লক্ষ্য করেছে যে বিপদ পুরোপুরি কাটে নি। একটা বড় চাংড়া, প্রায় আধ কিলোমিটার লম্বা, তবু দ্রুতবেগে ধেয়ে আসছে পৃথিবীর দিকে। শমীকদের অ্যালগরিদম এই ধরনের বড় টুকরোগুলোর গতিপথ কি হবে বলে দিতে পারলেও, এত তাড়াতাড়ি দ্বিতীয়বার সেই সব টুকরোগুলোকে আঘাত করার মতন টেকনোলজি এখনো মানুষের হাতে নেই।

    পৃথিবীর যে কোনো বড় শহর ধ্বংস করে দিতে পারে মহাশূন্যের এই পাথরের চাংড়া। টিভি স্ক্রিনে শমীক দেখতে পাচ্ছে, অ্যাসটারয়ডটা আছড়ে পড়ছে একটা বড় নদীর গায়ে। নদীর এক পারে ঘন জঙ্গল। অন্য পারে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে একটা গ্রাম। নদীর ধারে একটা রাস্তা। রাস্তার একধারে পথের নির্দেশ দেওয়া একটা বোর্ড, যার উপরে বড় করে তীরচিহ্ন সমেত বাংলাতে লেখা, “সাতবেড়িয়া”।

    পাশ থেকে অনীশ স্যার শমীককে বললেন, “বাংলা লেখাটা পড়তে পেরেছো তো, শমীক? কোথায় এই জায়গাটা খুঁজে বের করতে হবে আমাদের।”

    ***

    পিন্টুদার ডাকে ধড়মড় করে উঠে বসল শমীক।

    ইস! একঘন্টা হয়ে গেল এর মধ্যে? Nap না বলে একে ঘুম বলাই ভালো।

    অভ্যাসবসে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সময় দেখতে গিয়ে চমকে উঠল শমীক। আটখানা মিস্ড কল। ছটা মায়ের, দুটো বাবার। প্লেনে সেই যে ঘুমোনোর সময় সাইলেন্ট মোডে রাখা ছিল মোবাইলটা পরে সেটা আর ঠিক করা হয় নি। এমনকি বর্ধমানে পৌঁছনোর খবরটাও দেওয়া হয় নি মা আর বাবাকে।

    থাক, এখন কথা বলতে গেলে আবার দেরি হয়ে যাবে। পিন্টুদা ভাত বেড়ে ফেলেছে।

    ***

    তিনটে বেজে গেল খাওয়া শেষ হতে হতে।

    শমীক মাংস খেতে ভালোবাসে বলে সাইকেল ঠেঙিয়ে মানিকের দোকান অবধি গিয়ে মুরগি নিয়ে এসেছিল পিন্টুদা। বেশি খিদে ছিল না শমীকের, তবে মাংসটা দিব্যি রেঁধেছিল পিন্টুদা, সঙ্গে ছিল ঝুরি-ঝুরি সরু করে কাটা আলুভাজা। তাই নয় নয় করেও খাওয়া হয়ে গেল অনেকটা।

    দাদু সেই যে শুয়ে পড়েছিল আর ওঠে নি। দাদু নাকি দুপুরে খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। বেলা পড়লে কখনো কখনো এক মুঠি ভাত একটু ডাল বা আলুসেদ্ধর সাথে মুখে তোলেন। এ বাড়িতে এখন মাছ বা মাংস হয় কালেভদ্রে।

    আজকে কিন্তু পিন্টুদা তুলে দিতে চেয়েছিল দাদুকে, শমীককে বারবার বলেছিল যে দাদু চাইবেন ওর খাবার সময়টাতে কাছে থাকতে। কিন্তু শমীক-ই বারণ করেছে পিন্টুদা কে।

    ওর জন্য দাদুর ঘুমের ব্যাঘাত হোক, শমীক চায় না।

    ***

    চিলেকোঠা নামটাতেই কেমন একটা রহস্যের গন্ধ লুকিয়ে আছে।

    ছোটবেলায় লুকোচুরি খেলার সময় এ’বাড়ির চিলেকোঠাটা ছিল ওদের প্রিয় একটা লুকোনোর জায়গা।

    দরজার দিকের দেওয়ালের পাশে একটা উঁচু তক্তপোষ রাখা থাকত ওই ঘরটাতে। তক্তপোশের নিচে ছিল বেশ কিছু ট্রাঙ্ক। একবার ওই ট্রাঙ্কগুলো সরিয়ে তার আড়ালে লুকিয়েছিল শমীক। কেউ খুঁজে পায় নি ওকে সেবার। কিন্তু জামা-কাপড়ে ধুলো আর মাথায় মাকড়শার জাল দেখে পরে খুব চটে গিয়েছিল মা।

    তক্তপোষ ছাড়া ফার্নিচার বলতে এ ঘরে থাকত শুধু একটা কাঠের চেয়ার আর টেবিল। পুরোনো আমলের জিনিস। দুটোই বেশ ভারি, সেগুন কাঠের। দুটোই বার্নিশ করা, কালো রঙের। বাবার কাছে শমীক শুনেছে ভালো কাঠ নিয়ে খুব খুঁতখুঁতেমো ছিল দাদু আর বড়দাদু দুজনেরই। দুজনেই নাকি কাঠ ভালো হবে না খারাপ, একবার দেখলেই বুঝে যেত।

    এই সেই চিলেকোঠার ঘর। চেয়ার, টেবিল তক্তপোষ -- সব সেই আগের মতনই সাজানো। তক্তপোশের উপরে পাতলা একটা তুলোর গদি আর একটা বেডশিট পাতা। তক্তপোষের গা ঘেঁষে সেই চেয়ার আর সেই টেবিল।

    ছোটবেলায় খুব ভালো করে এসব লক্ষ্য করে নি শমীক। তখন চিলেকোঠায় এলেও বেশির ভাগ সময়ে অন্তু-সন্তু বা আর কেউ সাথে থাকতো, তাই পুরো মনটা পড়ে থাকত হৈ-হল্লার দিকে। আজ একবার ভালো করে সব কিছু দেখল শমীক।

    এতদিনেও চেয়ার আর টেবিলের বার্ণিশের জৌলুশ কমে নি খুব একটা। টেবিলের উপরে পুরু ধুলোর একটা আস্তরণ রয়েছে বলে শুধু উপরটা দেখলে বোঝা যায় না, কিন্তু পায়া বা পাশের কাঠগুলোতে ধুলো তেমন নেই বলে সেগুলোর চকচকে ভাবটা এখনো পুরোপুরি মুছে যায় নি। ধুলো রয়েছে বেডশিটেও। চাদর-টাদর বোধ হয় নিয়মিত বদলানো হয় না বিছানাটার। দেয়াল থেকে প্লাস্টার খসে খসে পড়ার জন্য চাদরে ধুলো জমেছে অনেকদিন ধরে। সামনের দেয়ালে প্লাস্টার খসে চীনের ম্যাপের মতন একটা অংশ তৈরি হয়েছে।

    কেন এল শমীক এই ঘরে? শুধুমাত্র লুকোচুরি খেলার কথা ভেবে? নাকি অজানা কোনো রহস্যের টানে?

    ছোটবেলায় টের পায় নি শমীক, কিন্তু আজ এই ঘরে ঢুকে ওর মনে হল এত বড় একটা বাড়ির ছাতের উপর এই ঘরটা যেন শুধুমাত্র লুকোচুরি খেলার জন্যই তৈরি হয়েছে। যেন শুধু নিজের শরীরটা নয়, নিজের যে ভাবনাগুলো সবার সামনে চেপে রাখতে হয়, এই ঘর সেই লুকোনো ভাবনাগুলোকে মুক্তি দেবার ঘর। মনের সব গোপন ইচ্ছেগুলো যেন এই ঘরে এসে ডানা মেলে।

    ঘরটার তিনদিকে দুটো করে ছোটো ছোটো শিকের জানলা। তাই আলোর অভাব নেই। জানলাগুলো খুললে ঘরে হাওয়াও ঢুকবে যথেষ্ট। তবু যেন বহুদিনের বহু লোকের রাশি রাশি ভাবনা জমে রয়েছে ঘরটাতে – অজানা সব ইচ্ছে, অজানা দুঃখ, অজানা সাধ-আহলাদ। এতদিন তারা অন্য কোনো শরীর পায় নি, মন পায় নি। আজ শমীককে কাছে পেয়ে নিজেদের উজাড় করে দেবে শমীকের কাছে।

    অজান্তেই গায়ে কাঁটা দিলো শমীকের।

    জানলার নিচ থেকে প্রায় মেঝে পর্যন্ত তিন দিকে প্রায় সারা দেওয়াল জুড়ে তিনটে দেওয়াল আলমারি রয়েছে এই ঘরে। আর এই আলমারিগুলো ভরে রাশি রাশি বই।

    এক সময়ে অর্থনৈতিক অবস্থা একটু ভালো হবার পর তমালবরণ আর পলাশবরণ, দুজনেই অজস্র বই কিনেছেন। দুজনের পড়ার বই বা একান্ত ব্যক্তিগত সংগ্রহ বাদ দিলে, বাকি বাংলা বইগুলো ঠাঁই পেয়েছে এই চিলেকোঠায়।

    ছোটবেলায় বাংলা পড়তে পারত না বলে এই বইগুলোর প্রতি আলাদা করে কোনো আকর্ষণ বোধ করে নি শমীক। আজ এত বই একজায়গায় দেখে ওর মনে হল এত সব বই পড়ার জন্য এই চিলেকোঠার চেয়ে ভালো জায়গা আর কিছু হতে পারে না।

    বাংলা বইগুলোর লেখকদের নাম প্রায় সব-ই অজানা শমীকের। তবে এত বই যে বা যারা কিনেছে তাদের বুকের ভিতরে কোথাও যে একটা গভীর ভালোবাসা লুকিয়ে ছিল সেটা এখন পরিষ্কার। শুধু ইংরেজি নয়, নিজেদের মাতৃভাষাটাকেও প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত তারা। অজান্তেই কানপুর আই আই টি তে অনীশ স্যারের বসার ঘরটার ছবি ভেসে উঠল শমীকের। একই রকম তিনদিকের দেওয়াল জুড়ে রাশি রাশি বই অনীশ স্যারের। তার মধ্যে অন্তত দুটো আলমারি ভর্তি বাংলা বইয়ে। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও ইংরেজি আর বাংলা সাহিত্যের প্রবল অনুরাগী অনীশ স্যার। মাঝে মাঝে বাংলার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা বেরোয় বিজ্ঞান গবেষণাপত্রের পাশাপাশি।

    তিনটে দেয়াল আলমারির একটাতে নিচের তাকে অবশ্য কিছু ইংরেজি বই রয়েছে। যেমন, চার্লস আর মেরি ল্যাম্বের টেলস ফ্রম শেক্সপিয়ার, রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ট্রেজার আইল্যান্ড বা জুলে ভার্নের টোয়েন্টি থাউসেন্ড লীগস আন্ডার দি সি। এসব বই শমীকেরও আছে বোম্বেতে। তবে এই বইগুলো একটা ব্যাপারে আলাদা। মলাট খুললে পরের পৃষ্ঠাতে একটা করে লেবেল সাঁটা। সব লেবেলেই জ্বলজ্বল করছে ক্যালিগ্রাফির মতন ইংরেজি অক্ষরে লেখা একটা নাম। নামটা খুব চেনা শমীকের: কিংশুক চ্যাটার্জী।

    এগুলো সব স্কুলের প্রাইজের বই। শুধু ইংরেজি নয়, অনেক বাংলা বইয়ের ভিতরেও ওই এক লেবেল সাঁটা। একটা পুরো আলমারির আধখানা এই পুরস্কারের বইগুলোতে ভর্তি। একটু লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে যত্ন করে ক্লাস অনুযায়ী সাজানো রয়েছে সব। এতদিন হয়ে গেলেও পোকায় কাটে নি বইগুলো। উপরে সামান্য ধুলো জমেছে শুধু।

    বেশির ভাগ ইংরেজি বই শমীকের পড়া। অনেক বই পড়া না হলেও, নাম শুনেছে আগে। একটা বই অবশ্য শমীক এর আগে দেখে নি, নামটা দেখে কৌতূহল হল খুব। অদ্ভুত নাম -- “Why I am like dad”। রাশিয়ান লেখক। জেনেটিক্সের বই।

    বইটার বিভিন্ন পাতার বেশ কিছু লাইন খুব যত্ন করে লাল কালি দিয়ে দাগানো, দেখে মনে হয় দাগানো হয়েছে স্কেল ব্যবহার করে। একটা দুটো পাতায় মার্জিনের পাশে ইংরেজিতে কমেন্ট লেখা, হাতের লেখাটা চেনা শমীকের। বাবার হাতের লেখা, তবে এখনকার মতন কাঁপা-কাঁপা নয়, আরও স্পষ্ট আর বলিষ্ঠ লেখা। বোম্বেতেও বাবাকে লক্ষ্য করেছে শমীক বইয়ের পছন্দের জায়গাগুলোতে দাগ দিতে। তবে দাগ দিতে হলে বাবা সবসময় স্কেল ব্যবহার করে, যাতে লাইনগুলো বেঁকে না যায়। বইয়ের মধ্যে বাবা কমেন্ট লেখে খুব কম। ইকনমিক্সের বই ছাড়া অন্য বইয়ে শমীক বাবাকে কোনো কমেন্ট লিখতে দেখে নি। তাছাড়া ঐসব বইয়ের কমেন্টগুলো লেখার সময় বাবা আজকাল পেন্সিল ব্যবহার করে, পেন নয়।



    বইটা রাখতে গিয়ে একটা পুরোনো ছেঁড়া কাগজ পড়ল মেঝেতে। কিছু একটা লেখা রয়েছে সেই কাগজে, বাংলাতে। লাল কালি ব্যবহার করে লেখা। এতদিনে অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে এসেছে। কাগজটা তুলে জানলার সামনে ধরল কিংশুক।

    দু লাইনের একটা বাংলা ছড়া লেখা কাগজটাতে।

    “হিংসুক কিংশুক
    বেবুনের মত মুখ!”

    একটা ছোট বেবুনের মুখ-ও আঁকবার চেষ্টা করা হয়েছে কাগজটাতে, তবে সেটা বেবুন না বেড়াল বোঝা যাচ্ছে না।

    বাবার ডাকনাম বাবুন। ওই নামে বাবাকে বর্ধমানের বাড়িতে কেউ ডাকলে ছোটবেলায় খুব হাসি পেত শমীকের। বাবার মতন মুশকো চেহারার পাকাচুলো ভুঁড়িওয়ালা একটা লোক যে অন্য কারুর বাবুন হতে পারে সেটা শুনলে না হেসে থাকা যায়?

    সেই বাবুন থেকে বেবুন!

    নির্ঘাত জেঠু, পিসি বা বাবার আর কোনো ভাইবোনের কীর্তি। বাবার পড়ার বইয়ের মধ্যে এই কাগজ ঢুকিয়ে রেখে দিয়ে বাবাকে রাগানোর জন্য করা।

    ছোটবেলার কিছু কিছু গল্প বাবা বলেছে শমীককে, কিন্তু এই বেবুন বলে ডাকার ব্যাপারটা কখনো বলে নি। এতদিন পরেও যখন বাবা এই সব বলে নি তখন ধরে নেওয়া অন্যায় হবে না যে এই নামটা বাবার পছন্দ নয়, মানে বাবা চায় না বাবাকে এই নামে কেউ ডাকুক। কে জানে, হয়তো এই নামটার সাথে বাবার কিছু খুব দুঃখের স্মৃতি জড়িয়ে আছে।

    এই কাগজটা যখন লেখা হয়েছে তখন কত বছর বয়স ছিল বাবার? বারো? চোদ্দ? নাকি আরও বেশি? ছোটবেলায় কতবার এই বেবুন ডাক শুনতে হয়েছে বাবাকে?

    হঠাৎ করে বাবার জন্য খুব মায়া হল শমীকের। দুবার এর আগে কল করেছে বাবা। শমীক তখন কথা বলতে পারে নি। এখন একবার ফোন করা দরকার বাবাকে।

    এই ঘরের সমস্ত জমে থাকা ভাবনাগুলো ডানা মেলে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিতে পারে।

    শমীকের কেন জানি না মনে হল এখন একবার বাবাকে ফোন করলে, ওর মোবাইলের মধ্যে ঢুকে যাবে ওই সব ভাবনারা। তারপর প্রজাপতির মতন ডানা মেলে উড়ে যাবে আকাশে।

    বাবার মন যদি কোনো কারণে খারাপও থাকে এখন, একবার ফোন করলে ঠিক মন ভালো হয়ে যাবে আবার।

    শমীক যেন দেখতে পেল ও ফোনে কথা বলছে বাবার সাথে আর আস্তে আস্তে ওর হাতের মুঠোয় ধরা কাগজটা থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে লেখাটা।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments