• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৬ | অক্টোবর ২০২৪ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • ভ্রমণে ভূস্বর্গ – ২য় পর্ব : সুজাতা কুন্ডু
    পর্ব ১ | ২য় পর্ব


    রাস্তা জুড়ে ভেড়ার পাল

    ৩১শে মে

    আজ আমাদের গুলমার্গ যাওয়ার দিন। গুলমার্গ ছোট্টো একটা খুব সুন্দর উপত্যকা। এর আসল আকর্ষণ হল গন্ডোলা, যা কিনা রোপওয়ে কেবলকার। এই কেবলকারের তিনটে পর্ব আছে। প্রথমটা ফেজ ওয়ান, যা যায় কংডুরি পর্যন্ত, পরেরটা শুরু হয় এখান থেকে আফারবত পর্বত পর্যন্ত। তিন নম্বরটা সবার জন্য নয় শুধুমাত্র স্কি করবে যারা, তাদের জন্য। এই গন্ডোলার টিকিট শুধুমাত্র অনলাইনে পাওয়া যায়। আমাদের কাশ্মীর যাওয়ার প্ল্যানটাই হয়েছে অনেক দেরী করে, যখন আমরা গুলমার্গ যাব বলে দিন ঠিক করলাম, তখন গন্ডোলার টিকিট কাটতে গিয়ে দেখি ৩১শে মে পর্যন্ত সব টিকিট শেষ। এখন কী করি? আমার তো বেজায় ইচ্ছে গন্ডোলায় চড়ে আফারবত পর্বতের উপরে যাওয়ার। কারণ এই সময় ওখানে তাও একটু বরফ থাকে, ফেজ ওয়ানের অর্থাৎ কংডুরির সব বরফ গলে যায়। সুতরাং ঠিক হয় গুলমার্গ এর যখন আমরা একরাত থাকছি, তখন ১লা জুন সকালের টিকিট পাওয়া গেলে সেদিনই গন্ডোলা চড়া হবে। অতএব চাতক পাখির মতো সাইটের দিকে চোখ রেখে বসে থাকা কবে আবার অনলাইন টিকিট কাউন্টার খুলবে। জানা গেল ৬ই মে বিকেল সাড়ে চারটায় খুলবে। আমরা ও তৈরি হয়ে বসে, খুললেই টিকিট কেটে ফেলতে হবে। অবশেষে পাঁচটা পেরিয়ে খুললো এবং টিকিট কাটা হল। সেই গুলমার্গ চলেছি আমরা আজ।


    গুলমার্গের পথে

    শ্রীনগর থেকে গুলমার্গ এর দূরত্ব পঞ্চাশ কিমির মতো। গুলমার্গ ছোট জায়গা, আলাদা করে বিশেষ কিছু দেখার নেই, তাই একটু দেরী করেই আমরা বেরোলাম শ্রীনগর থেকে। এগারোটা নাগাদ পৌঁছলাম টংমার্গ বলে একটা জায়গায়। এতক্ষণ পর্যন্ত রাস্তায় খুব একটা ঘোরপ্যাঁচ ছিল না, মানে সোজা রাস্তা ছিল। এরপর থেকে শুরু হবে পাহাড়ী পথে ওঠা। এখানে একটা দোকানে কাওহা খেয়ে আমরা গেলাম আড়াই তিন কিমি দূরে দ্রাং জলপ্রপাত দেখতে। রাস্তাটা বেশ সরু, দুটো গাড়ি পাশাপাশি যাওয়া কষ্টকর। এর মাঝে উল্টো দিক থেকে বড়ো গাড়ি এলেই মুশকিল। দ্রাং জলপ্রপাতে অবশ্য জল তখন খুবই কম ছিল। তবে এই জল নাকি হঠাৎ করে বেড়ে গিয়ে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়, নড়বারও সময় দেয় না। আবার শীতের সময় এই জলপ্রপাত পুরোটাই জমে বরফ হয়ে যায়। যা হোক, আমরা সেখানে ঘোরাঘুরি করে চললাম টংমার্গ হয়ে গুলমার্গের পথে। টংমার্গ থেকে গুলমার্গের দূরত্ব ১৪ কিমি মতো, বেশি দূরে নয়। বরফের সময় অনেকে এখান থেকেই শীতের পোশাক আর জুতো ভাড়া নিয়ে গুলমার্গে যান। রাস্তায় একটু গিয়েই টোল দিয়ে চললাম। এখানে এই এক — টোল দিতে হয় কিছু! এক জেলা থেকে আরেক জেলায় ঢুকতে টোল, ট্যুরিস্ট স্পটে ঢোকার সময়, সেখানে আলাদা টোল, রাস্তার টোল, ব্রিজের টোল!! এদিকে দুই মেয়ের প্রবল মোশন সিকনেস রয়েছে। ওষুধ খাইয়ে গাড়ি চড়ালেও ছোটর এবারে একটু বেশিই অসুবিধা হচ্ছিল। পাহাড়ী পথে গাড়ি যতো বাঁক নেয় তার ততোই শরীর খারাপ লাগতে থাকে। একটু পরেই গাড়ি এসে থামে একটা জায়গায়, নাম হাব্বা খাতুন ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকে অনেকটা এলাকা খোলা, সামনে বরফেমোড়া পর্বতমালা, সরলবর্গীয় গাছের জঙ্গল, উপত্যকা সুন্দর দেখা যায়। এরপরেও আরেকটা ভিউ পয়েন্ট ছিল, কিন্তু আমরা আর থামিনি, সোজা গুলমার্গে পৌঁছে যাই। গুলমার্গ ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে সোজা যে রাস্তাটা গন্ডোলার দিকে চলে গেছে সেই রাস্তার পাশে রয়েছে কিছু JKTDC-র হাট (Hut)। কিন্তু আমাদের পেতে হবে তাদের রিসেপশন অফিস। পহেলগামের মত (এবং পরে দেখেছি সোনমার্গের মতও বটে) এখানেও JKTDC-র বাসাগুলি রাস্তা থেকে অনেক উঁচুতে – পৌঁছনো এক সিঁড়িভাঙা প্রকল্প। কর্তা আর আমাদের ড্রাইভার আহসান ভাই দুবার সিঁড়ি ভেঙে ওঠানামা করার পরে তৃতীয় বারে সফল হল, আমাদের হাটের নাম্বার পাওয়া গেল। ঘরের নাম্বার তো পাওয়া গেল, কিন্তু তখনই সেখানে ঢুকলে আবার নেমে আলাদা ট্যাক্সি নিয়ে বাকি গুলমার্গ ঘুরতে হবে। আমার আবার হরি সিং-এর প্যালেস দেখতে যাওয়ার ভারি ইচ্ছে। আহসান ভাই বললেন - চলুন ও দিকটা ঘুরে আসি, একবার বেরিয়ে গেলে আমি আর ঢুকতে পারবো না এখন। আবার ওখানের লোকেরা আমাদের এই গাড়িতে লোকাল সাইটগুলো ঘুরতে দেবে না। আমরা ওনাকে বললাম, আপনার নিজের অসুবিধে না করে যেটা ভাল মনে হয় করুন। উনি - চলুন দেখা যাক - বলে আমাদের নিয়ে চললেন। হরি সিং-এর প্যালেস তাঁরও জানা নেই, গুগল যে রাস্তা দেখালো তাতে এসে উঠলাম GDA (Gulmarg Development Authority)-র অফিসারের বাড়ির সামনে। তবে এখানে প্যালেস না থাক, একটু ঘুরে সামনে যেতেই অসাধারণ ভিউ। পুরো গুলমার্গটা আফারবত পর্বত নিয়ে দেখা যায়। পরে দেখলাম ওটা আসলে ভিউ পয়েন্টই। যাই হোক আরো এগিয়ে অবশেষে একজায়গায় দিকনির্দেশ দেখতে পেলাম। গিয়ে টিকিট কেটে ঢুকলাম, তবে সেরকম উল্লেখযোগ্য কিছু দেখলাম না। আমাদের সবারই যেটা মনে হচ্ছিল — এরকম জায়গায় কেন প্যালেসটা বানিয়েছিলেন, কারণ এখান থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সেরকমভাবে কিছু দেখা যায় না। এরপর আমরা চললাম আমাদের আস্তানার দিকে। গাড়ি থেকে নেমে ঘর পর্যন্ত উঠতে দম বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়! পরে গুণে দেখেছি, ষাটখানা মতো সিঁড়ি ছিল। এই এতগুলো সিঁড়ি ভেঙে, গুচ্ছের লাগেজ নিয়ে উঠে তো সবাই হাঁপিয়ে গেছি। তবে এই হাটটা বেশ সুন্দর। ছিমছাম একটা কাঠের বাড়ি, ঢুকেই বড়ো একটা বসবার ঘর, সোফাসেট রয়েছে, টিভি, ইনভার্টার, রুমহিটার সবই আছে। বসার ঘরের শেষ দিকে বড়ো ডাইনিং টেবল আর চেয়ার, তার পাশেই রান্নাঘর। রান্নাঘরে গ্যাস স্টোভ, বাসনপত্র, জলের অ্যাকোয়াগার্ড সব আছে। চাইলে নিজেরা রান্না করে খাওয়া যায়। বসার ঘরের একদিকে ছোটো প্যাসেজ, তার দুদিকে দুটো বেডরুম বাথরুম সহ, সুন্দর ব্যবস্থা। কম্বলে আবার ইলেকট্রিক হিটিং-এর ব্যবস্থাও আছে। তবে বাথরুমের আয়নাটা ভাঙা আর জামাকাপড় রাখার হ্যাঙ্গারগুলো মোটামুটি ছ'ফুটিয়া লোকেদের মাপে, আমার মতো সাড়ে চারফুটিয়ারা লাফিয়ে ও নাগাল পাবে না এমন জায়গায় করা। একজন কেয়ারটেকার থাকেন প্রতিটা হাটে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল কিছু খাবার দাবার পাওয়া যাবে কিনা। কারণ তখন প্রায় সাড়ে তিনটে বেজে গেছে, সবারই খিদে পেয়েছে। উনি বললেন ভাত তরকারি সবই পাওয়া যাবে JKTDC-র নিজের রেস্টুরেন্টে। সেই মতো খাবার বলা হল। আহসান ভাই ফিরে গেলেন শ্রীনগর। কেয়ারটেকার যিনি ছিলেন, রহিম ভাই, তিনি আধঘণ্টা পরে খাবার নিয়ে এলেন একটা বড়ো হটপটে করে, রান্নাঘরের থেকে বাসন পত্র ধুয়ে সব নামিয়ে রেডি করে রেখে গেলেন। আমরা খাবার পর আবার সব পরিস্কার করে ধুয়ে মুছে গুছিয়ে রাখলেন। রান্নাঘরে গ্যাস স্টোভ আর সসপ্যান দেখে আমার মনে হচ্ছিল ইস, যদি টি-ব্যাগ সঙ্গে আনতাম, চা করে খাওয়া যেতো। তাই শুনে তিনি বললেন - বাজারে পাওয়া যায় আমি এনে দিচ্ছি। শুধু তাই নয় একটা ইলেকট্রিক কেটলিও দিয়ে গেলেন। দুপুরে খেয়েদেয়ে দুই মেয়ে তো সোজা বিছানায় কম্বলের তলায় ঢুকে ঘুমের দেশে। আমরা দুজন বিকেলে একটু বাইরে হাঁটতে বেরোলাম। তখন পর্যটকদের ভিড় কমছে, ঘোড়াগুলো বাড়িমুখো, সূয্যিমামা পাটে বসেছেন। সন্ধ্যে নামলে আমরাও কটেজে ফিরে এলাম। একটু পরেই লোডশেডিং, তবে ইনভার্টার চলছিল, অসুবিধে হয় নি। পরদিন সকাল সকাল উঠতে হবে, গন্ডোলার জন্য লাইন দিতে হবে, তাই পরেরদিনের জন্য সব জামাকাপড় রেডি করে রাখলাম। রাত নটা নাগাদ খাবার এল, বিকেলেই বলা ছিল। এদিকে ঠাণ্ডাও বাড়ছিল। তাই খেয়ে দেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে গেলাম সব।

    ১লা জুন

    আজ আমাদের গন্ডোলা রাইডের দিন। সকাল সাড়ে ছ'টার সময় অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম। আমাদের টার্গেট ছিল সকাল আটটা নাগাদ বেরোনোর, মিনিট দশেক এদিক ওদিক হতে পারে। কয়েক বছর ধরে দেখছি, আমি যখনই অ্যালার্ম সেট করি, তার পাঁচ মিনিট আগে হলেও, আমি অ্যালার্ম বাজার আগেই উঠে পড়ি । এবারেও তাই। এমনিতে আমার মেয়েদের ঘুম ভাঙানো সহজ নয়, তবে আজ উঠে পড়লো তাড়াতাড়ি। এদিকে সকাল থেকে ফোনে কোন সিগন্যাল নেই, ভাবলাম একটু পরে এসে যাবে। তাই ওদিকে মাথা না ঘামিয়ে চটপট নিজেরা রেডি হয়ে নিলাম।আলাদা করে ব্রেকফাস্ট করতে গেলে দেরী হয়ে যাবে, তাই সঙ্গে থাকা কেক একটু করে খেয়ে নেওয়া হল। ছোট জন তাও খেলো না, তার সকাল থেকেই শরীর ঠিক লাগছিল না। ব্যাপারটা তেমন পাত্তা দিইনি। এমনিই ও সকালে খেতে চায় না, তায় আবার গাড়িতে ঘুরতে হচ্ছে বলে মোশন সিকনেসে ওর অসুবিধে হচ্ছে বেশি। তাই ভাবলাম ঠিক আছে না খেলে নাই খাক, পরে কিছু খাইয়ে দেওয়া যাবে। এদিকে ফোনের সিগন্যাল আর আসে না। কেয়ারটেকারকে ফোন করতে না পেরে তার বাড়িতে গিয়ে ডেকে এনে তাকে বলা হল আমরা গন্ডোলার থেকে ফিরে এখানে চেঞ্জ করে তারপর বেরোবো। আসলে দুপুর ১২টায় চেক আউটের সময়, যদি একটু দেরি হয়ে যায় তাই বলে রাখা। গন্ডোলার ওখানে গিয়ে দেখি, ততক্ষণে লাইন পড়ে গেছে। গেট খুলবে ন'টায়, তখন বাজে সাড়ে আটটার মতো। কিন্তু কী রোদ! ছোটজনের তখনো ভালো লাগছে না, তাই দুই বোনকে বললাম গেটের কাছে ছায়াতে গিয়ে বসতে, ঢোকার সময় ডেকে নেবো। লাইনে আমরা দুজন দাঁড়িয়ে, এদিক ওদিক রোদচশমা, টুপি, গ্লাভস, জল, চকোলেট, বিস্কুট এসবের পশরা নিয়ে লোকজন বিক্রির আশায় ঘোরাঘুরি করছে। কেউ কেউ গামবুট পরার জন্য জোরাজুরি দরাদরি করছে। আমরা বাইরে থেকে গামবুট পরেই এসেছিলাম। এর মাঝে একজন লোক , গাইড, ফেজ ওয়ানের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাবে বলে রীতিমতো ঝুলোঝুলি। আমি প্রথম থেকেই না করছিলাম, বললাম সময় হবে না, কিছুতেই ছাড়ে না। কত মাইল দূরের গ্রাম থেকে নাকি ঘোড়ায় চেপে এই কাজ করতে আসে। অবশেষে কর্তার মন গলে গেল, আমিও দোনোমোনো করে হ্যাঁ বললাম। তবে এটা পুরোটাই ফালতু, টাকাটা জলে গেল। আমাদের কোন প্রয়োজন ছিল না এটার । গেট খুলতেই আমরা ভিতরে গেলাম, সেখানে টিকিট এবং আধার কার্ড দেখে আমাদের উপরে যেখান থেকে গন্ডোলাটা ছাড়ছে সেখানে যেতে দেওয়া হল। এর মাঝে ছোটুর শরীর আরো খারাপ লাগছে, মাথা ঘুরছে। ভাবলাম লাইন থেকে বেরিয়ে যাব নাকি, তারপর বললাম আগে তো উপরে যাই, একটু পরেই নাহয় কেবলকারে চাপবো। যাই হোক, খানিক পরে কেবলকারে চেপে বসলাম। একটি কারে ছজন বসা যায়, বসার পর দরজা বন্ধ হয়ে যায়, কাঁচে মোড়া অংশ দিয়ে বাইরেটা দেখা যায় ভালো করে। ফেজ ওয়ান বা কংডুরিতে পৌঁছতে লাগে বারো মিনিট মতো। ওখানে পৌঁছনোর পরেই ছোটুর বমি হয়ে গেল। আমরা তো পড়লাম মুশকিলে! এ মেয়েকে নিয়ে ওপরে ফেজ টুতে কী করে যাব? এখানে একা রেখেও যেতে পারি না। ঠিক হল মেয়েকে নিয়ে তার বাবা এখানেই থাকবে, আমি আর বড়োজন যাব। অবশ্য সেই গাইড ভদ্রলোক বলেছিলেন তিনি মেয়েকে নিয়ে থাকবেন, কোন চিন্তা নেই, কিন্তু তা হয় না। এদিকে ফেজ টুয়ের গেট আর খোলে না। ওদিকে হালকা হালকা মেঘ দেখা যাচ্ছে। ফেজ টু আবার যখন তখন বন্ধ করে দেয়, একটু আবহাওয়া খারাপ হলেই। যাই হোক, গেট খুললো, ছোটুও আগের থেকে একটু ভালো লাগায়, উপরে যেতে চাইল। যদিও ও না গেলেই হয়তো ভালো করত। যেতে যেতে মাঝপথে গন্ডোলা বার দুয়েক থেমে গেল। আর হঠাৎ থামায় ঐ ঝুলন্ত অবস্থায় যা দুলুনি, তাতে আমারই কেমন একটা লাগছিল, ছোটুর তো কথাই নেই, খুব শরীর খারাপ করছিল।


    আফারবতের মাথায়

    অবশেষে এসে পৌঁছলাম আফারবত পর্বতের উপরে। গন্ডোলায় বসেই দেখেছিলাম নীচে মইয়ের মতো কিছু একটা নিয়ে কেউ কেউ পর্বতের উপরে হেঁটে আসছে। এখানে এসে বুঝতে পারলাম ওগুলো স্লেজ। ধন্য মানুষের ক্ষমতা!! ঐ ১৩০০০ ফুট উচ্চতায় ভারী কাঠের স্লেজ নিয়ে হেঁটে ওঠা কী কঠিন ব্যাপার, অথচ প্রতিদিন এই কাজ অনায়াসে করে চলেছেন এঁরা। বাইরে বেরিয়ে দেখি সামনেটা কাদা কাদা, পাথুরে, বরফ জমা জল মাঝে মাঝে, তার পরের অংশ শক্ত জমাটবদ্ধ বরফের। সেই অংশ কী ভীষণ পিচ্ছিল! একটু সাবধানে না চললেই ধপাস! কতবার যে আমরা পড়লাম তার ঠিক নেই। এদিকে পাহাড়ের উপরে তখন মেঘ ও রোদের খেলা চলছে। এই মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে, পরক্ষণেই রোদের ঝিকিমিকি। এতো পা পিছলে যাচ্ছিল যে বেশি ওপরে ওঠার সাহস হল না। তখন মনে হচ্ছিলো, নিজেদের স্নিকার্সগুলো পরে এলেই ভালো হতো, গামবুটগুলোর তলায় কোনো গ্রিপ নেই। এর মাঝেই দেখি কিছু মহিলা ফিনফিনে শিফনের শাড়িতে সেজেগুজে উপরের দিকে চলেছেন, বলিউড স্টাইলে রিল বানাবেন বলে। ধন্য অধ্যবসায় !! আমাদের ছোটকে নিয়ে একটু চিন্তা ছিলই, একে তার শরীর ঠিক নেই, তার উপর এতোটা উঁচুতে আছি, অক্সিজেন কম এখানে, তাই খুব বেশিক্ষণ আর থাকিনি। নেমে এলাম ফেজ ওয়ানে অর্থাৎ কংডুরিতে। এখানে অপেক্ষা করছিল সেই গাইড। মেয়েরা কোথাও যাবে না বলল, আর ওদের ছেড়ে আমরাও দূরে যাব না, তাই শুধু সামনের সেভেন স্প্রিং টা দেখে চলে আসবো বললাম। খিলান মার্গ নিয়ে যাবে বলেছিলো, কিন্তু সেটা আরো চার পাঁচ কিমি দূরে, ঘোড়ায় যেতে হবে। সেটা সম্ভব নয়। তাই গেলাম সামনেই সেভেন স্প্রিং দেখতে। এটা প্রাকৃতিক প্রস্রবণ, যেখানে মাটির নিচে থেকে জল উঠে আসছে। জায়গাটা বাঁধিয়ে চৌবাচ্চা মতো করে রাখা। শীতের সময় চারপাশ বরফে ছেয়ে গেলেও এই জল জমে না, এমনভাবেই বেরিয়ে আসে। ওখান থেকে এসে মেয়েদের নিয়ে নেমে আসলাম গুলমার্গে। সেখানে গামবুট ছেড়ে নিজেদের জুতো পরা হল। এতক্ষণে ফোনে সিগন্যাল পাওয়া গেল, ড্রাইভার আহসান ভাইকে ফোন করা গেল। উনি জানালেন আসছেন। আমরা কটেজে ফিরে ধড়াচূড়া ছেড়ে ব্যাগে গুছিয়ে রাখলাম। কারণ তখন প্রায় দুপুর বারোটা বাজতে যায়, ঠাণ্ডা প্রায় নেই। এখান থেকে আমরা যাব মানসবল, তা অনেক টাই নীচে, সেখানে গরমই হবে, সোয়েটার জ্যাকেটের প্রয়োজন পড়বে না। গাড়ি এলে, কেয়ারটেকার রহিম ভাই লাগেজ নামাতে সাহায্য করলেন। তাঁকে কিছু টিপস দিয়ে আমরা গুলমার্গকে টা টা করে চললাম মানসবলের দিকে।

    মানসবলের কাছেই রয়েছে ক্ষীরভবানীর মন্দির। স্বামীজী সেখানে গিয়েছিলেন। ঠিক হল যাওয়ার পথে আগে ওখানে যাব, তারপর মানসবলে JKTDC-র আস্তানায়। ক্ষীরভবানীর মন্দিরে যখন পৌঁছই, প্রায় দুটো বাজে। ওখানেই একজন মহিলার দোকান থেকে ডালা নিয়ে ঢুকি মন্দিরে, গেটে চেকিং হয়, আইডেন্টিটি কার্ড দেখাতে হয়। ভিতরে ছোট মন্দিরে মা ক্ষীরভবানীর মূর্তি আছে, কিন্তু সেখানে ঢোকা যায় না । সামনে জলের কুণ্ড, তার এপার থেকে দর্শন করতে হয়। পূজাপদ্ধতি বড়ো সরল। সঙ্গে আনা ডালায় থাকে ফুল, দুধ, নকুলদানা আর শুকনো নারকেলের প্যাকেট, প্রদীপ আর একটি লাল কাপড়। ডালা থেকে দুধ ঐ জলে ঢালতে হয়, ফুলও, প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখে দিতে হয় , একজন পুরোহিত বসে থাকেন, তিনি একটু মন্ত্র বলে কপালে টিপ দিয়ে দেন, ব্যস। পুজোর পর প্রসাদী ক্ষীর যেখানে পাওয়া যায়, সেখানে গিয়ে দেখি কাউন্টার বন্ধ। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও খুললো না দেখে আমরা মানসবলের দিকে চললাম। ক্ষীরভবানীর ক্ষীরপ্রসাদ আর আমাদের কপালে জুটল না।


    ক্ষীরভবানী মন্দিরপ্রাঙ্গণ

    মানসবল পৌঁছে JKTDC র অফিস খুঁজে কটেজের বুকিং দেখানো হল, তারা বললো একটু সময় লাগবে কটেজ রেডি করতে। ভাবলাম ঠিক আছে, এই সময় খাওয়াদাওয়াটা সেরে নি, সকাল থেকে এক টুকরো কেক খেয়ে আছি। প্রত্যেকটি JKTDC-র হোটেলের সাথেই জাইকা নামে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। এখানেও বোর্ড রয়েছে দেখছি। তাই এখানে রেস্টুরেন্টে কী পাওয়া যাবে জানতে চাইলে বলে রেস্টুরেন্ট বন্ধ, বাইরে খেতে হবে। অগত্যা সামনে এগিয়ে প্রথম যা দোকান পেলাম, সেখানেই ঢুকলাম। ডেকে হেঁকে তো তারা দোকানে ঢোকাল, কী পাওয়া যাবে জানতে চাইলে বলে ওয়াজ ওয়ান, বিরিয়ানি, ফ্রায়েডরাইস। ঐ চড়া রোদ আর গরমের মধ্যে সেসব কে খাবে? জিজ্ঞেস করি, ডাল ভাত সব্জি কিছু পাওয়া যাবে? তাই শুনে তাদের মুখ দেখে মনে হল এমন অদ্ভুত কথা তারা জীবনে শোনে নি। তারা ঐ বিরিয়ানি, কাবাব ওয়াজওয়ানই খাওয়াবে। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে সাদা ভাত আর ডাল দিতে রাজি হলেও ডিমের ওমলেটটা দিতে রাজি হল না। একটু আলুর তরকারি বলতে , কিসের থেকে একটু আলু আর ঝোল এনে দিল, তা তেলে চুপচুপে, মুখে দেওয়া গেল না। ডাল বলতে এলো রাজমা! দুপুর সাড়ে তিনটে পেরিয়ে গেছে,বেজায় গরম, তখন আর অন্য কোথাও খেতে যাবার অবস্থা কারোর নেই। কোনমতে ঐ রাজমা দিয়ে ভাত খেয়েই উদর পূর্তি করা! চমক তো ছিল এর পরে। দুই প্লেট সাদা ভাত, একটা ডাল মানে রাজমা আর একটি ঐ অখাদ্য আলুর ঝোলের দাম নশো টাকা!! এইবার কর্তা বলল কোনটার কতো দাম দেখান, মেনু কার্ড দেখান। কোন মেনু কার্ড নেই, যা খুশি দাম বলে টাকা নিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ঐ নশো নামলো সাড়ে সাতশো তে, সেটাও অত্যন্ত বেশী। ক্ষীরভবানীর মন্দিরে ক্ষীরপ্রসাদের অপেক্ষা করেও না পাওয়ায় যে বিরক্তিটা শুরু হয়েছিল আমার, সেটা এবার চরমে উঠল। কিন্তু পিকচার আভি বাকি হ্যায়!!! JKTDC-র কটেজে আসলে তারা বলে তাদের আরো সময় লাগবে, অপেক্ষা করতে হবে। বাইরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ, ৩৫°-র গরম, আর আমার মাথা টা যে তখন কতো ডিগ্রি তা ভগাই জানে!! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি তখনও জানালা দরজার ঝুল ঝাড়া হচ্ছে, ভিতরে ডাস্টিং চলছে। মিনিট দশেক পরে আমাদের ঢুকতে দেওয়া হল। আমাদের বলা হল কারেন্ট চলে যেতে পারে, তাই মোমবাতি রাখা আছে, এখানের ইনভার্টারটা খারাপ হয়ে গেছে। এই অসাধারণ ব্যবস্থাপনায় চমৎকৃত হয়ে আমি শুধু এটুকুই বলতে পেরেছিলাম মোমবাতি জ্বালানোর জন্য কি দেশলাই পাওয়া যাবে? কারণ টেবিলে মোমবাতি থাকলেও দেশলাই ছিল না। সে কথায় তারা হ্যাঁ হ্যাঁ সব দিয়ে যাচ্ছি বলতে বলতেই দেখি আহসান ভাই তাড়াতাড়ি আমাকে তাঁর লাইটারটা দিয়ে বললেন "আপ রাখ লিজিয়ে"। নিজের মুখটা তো দেখতে পাচ্ছিলাম না, তবে আহসান ভাইয়ের অমন সন্ত্রস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি লাইটার দেওয়া দেখে বাকিরাও যা বোঝার বুঝে তাড়াতাড়ি কেটে পড়ল। ঐ অবেলায় নেহাত মাথায় জল ঢাললে বিদেশ বিভুঁইয়ে অসুস্থ হয়ে যেতে পারি বলে জলটা ঢালতে পারলাম না। তাই এমনিই স্নান করে ঘুমিয়ে পড়া ছাড়া মাথাটা ঠাণ্ডা করার আর কোন উপায় নেই বলে আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। বিকেল ছ'টা বাজতেই লোডশেডিং শুরু। বাইরে তখনও বেশ আলো। তাই বাইরে গিয়ে বসলাম। সামনে মানসবল লেকের চিলড্রেনস পার্কে তখন চলছে বাচ্চাদের হুটোপাটি। বড় কন্যা বাবার সঙ্গে একটু ঘুরে এলো লেক থেকে, আমার মাথার তাপমাত্রা খানিকটা কমলেও কোথাও বেরোনোর ইচ্ছে হয়নি। বাইরে আগাছায় ভরা লনে বসে চা খেতে খেতে সন্ধ্যা নামল, আরেকটু অন্ধকার হলে মোমবাতি জ্বালিয়ে আমরা চারজন বসে রইলাম ভূতের মতো। বাড়িটাও ভূতের বাড়ির মতোই লাগছিল পুরো। চা যখন দিতে এসেছিল, তখন তাদের সাথে দুপুরের অভিজ্ঞতা বলে জানতে চাওয়া হয় রাতে তারা খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা করতে পারবে কিনা। তারা একটি রেস্টুরেন্টের সাথে ব্যবস্থা করে দেয়, এবং ওরা ঘরেই রাতের খাবার দিয়ে যাবে বলে। পৌনে ন'টা নাগাদ তারা দিয়ে যায়। আমরা ভূতুড়ে বাড়িতে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করতে শুরু করেছি এমন সময় বেরসিকের মতো কারেন্ট চলে এলো। ভাগ্যিস এল, নইলে আরো কতক্ষণ বসে থাকতে হত কে জানে! খাওয়া সেরে আমরাও পরদিনের জন্য গোছগাছ সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম।


    মানসবলের কটেজ


    ২রা জুন

    ঘুমটা ভেঙে গেল সকাল সকাল। উঠে মুখটুখ ধুয়ে নেমে এলাম। কটেজটা দোতলা, নিচে বেশ বড়ো একটা বসার ঘর। ঘরের শেষে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। সেখানে দুটো বেশ বড়ো বেডরুম বাথরুম সমেত। সিঁড়ির দেওয়াল পাথর দিয়ে সাজানো। রান্নাঘরও আছে একটা, কিন্তু সেটা দেখলাম ভাঙাচোরা আসবাবে ঠাসা, বন্ধ করা। কটেজটা সুন্দর কিন্তু বড়োই অযত্নের ছাপ সর্বত্র। সামনের লনে আছে বেশ কিছু গোলাপ ফুলের গাছ। কিন্তু আগাছায় ভরা। বুঝলাম এখানে সাধারণত কেউ এসে থাকে না। তাই নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ কিছু হয় না। আর কোন ট্যুরিস্টও ছিল না, আমরা ছাড়া। আমরা কাল আসায় এখানের কর্মীরা বেজায় বিপাকে পড়ে যায়। আরো যে দু তিনটি কটেজ আছে সেগুলোর অবস্থা বোধ হয় আরও খারাপ, এটা তবুও চলনসই বলে আমাদের থাকতে দিয়েছে। আর সত্যিই এখানে এসে থাকার মতো কারণ কিছু আমি অন্ততঃ পাইনি। শ্রীনগর থেকে মাত্র তিরিশ কিমি দূরে, এই লেক এসে দেখে চলে যাওয়া যায়। জায়গাটা যদি নিরিবিলি হতো তাও কথা ছিল, কিন্তু তেমন কিছু নিরিবিলিও নয়। শুধু শুধু এখানে থাকার কোন মানে নেই। আমাদের গাড়ি আসতে বলা হয়েছিল সাড়ে ন'টার সময়। এর মধ্যে মেয়েদের তুলে রেডি হতে বলে নিজেরাও স্নান সেরে রেডি হই। গাড়ি এলে আমরা রওনা হই দশটা নাগাদ। আজ আমাদের গন্তব্য সোনমার্গ বা সোনামার্গ।

    মানসবল থেকে সোনমার্গের দূরত্ব সত্তর কিমি মতো। দু ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায় যদি না রাস্তায় জ্যাম থাকে। কিন্তু এখন প্রচুর ট্যুরিস্ট, তাই গাড়িও প্রচুর রাস্তায়, এবং জ্যাম। সেই সঙ্গে বিভিন্ন টানেল তৈরির কাজ চলায় রাস্তাও মাঝে মাঝে বেশ খারাপ। আমরা যখন সোনমার্গ থেকে নয় কিমি মতো দূরে, একটা রেস্টুরেন্টে হালকা লাঞ্চ করে নিলাম। এরপরে বেশ কিছুটা যাওয়ার পর দেখি সার দিয়ে সব গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সিন্ধু নদী। লোকজন বেরিয়ে ছবি তুলছে। আমরাও বেরিয়ে একটু নদীর কাছে গেলাম। মিনিট পনেরো পর গাড়ি চলতে শুরু করলো। দুপুর দেড়টা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম JKTDC-র হোটেলে। আমাদের পুরো কাশ্মীর ট্রিপে শ্রীনগর ছাড়া বাকি সব জায়গায় আমরা জম্মু কাশ্মীর ট্যুরিজমের হোটেলেই থেকেছি। এখানেও কটেজ, লোকজন তখনই জিনিস পত্র নিয়ে চললো, আমরা পিছনে। ওরে বাবা, উঠছি তো উঠছিই...আরো কতো দূরে.... ইত্যাদি। অবশেষে ঘরে পৌঁছতে রীতিমতো জিভ বেরিয়ে পড়েছে। একটু বসতে না বসতেই আহসান ভাই তাড়া দিলেন, জিরো পয়েন্ট যেতে হলে এক্ষুনি বেরোতে হয়, দুটো পেরিয়ে গেলে আর যেতে দেবে না। ছোট কন্যার শরীর এমনিই খারাপ, বড়োজনেরও ভালো লাগছে না, তাই তাদের ঘরে রেখে আমরা কর্তা গিন্নি চললাম জিরো পয়েন্ট। জিরো পয়েন্ট যেতে এখান থেকে আলাদা গাড়ি নিতে হবে। একটা টাটাসুমো এলো, ভাড়া ছয় হাজার দিয়ে শুরু হল। আমি কিছুতেই চার হাজারের বেশি দেবো না, না গেলে যাব না তাও ঠিক আছে বলে রীতিমতো ঝগড়া শুরু করলাম। কর্তার আবার এতো দরদাম পোষায় না, যে যা বলে তাই দিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত ৪৮০০-তে রাজি হয়ে যান। যদিও আসলে ৪০০০ টাকাই ভাড়া। যাবার সময় সেনার লোকজন জিজ্ঞাসা করে, কত নিচ্ছে। গাড়ির লোক আমাদের বলেছিল প্লিজ বলবেন চার হাজার, বেশি বললে পরে ঐ টাকাটা নাকি ওরা তোলা নেবে। সত্যি মিথ্যে জানি না।


    সোনমার্গের পথে

    সোনমার্গ পুরোটাই সেনাবাহিনীর এলাকা। এখান থেকে রাস্তা চলে গেছে কার্গিল, দ্রাস হয়ে লেহ লাদাখ পর্যন্ত। সোনমার্গ থেকে খানিকটা দূরে বালতাল, সেখান থেকেও অমরনাথ যাওয়া যায়। পহেলগামের চন্দনওয়াড়ির মতো এখানেও অমরনাথ যাত্রী দের জন্য ক্যাম্প আছে। যে রাস্তাটা কার্গিল, লেহ, লাদাখ যাচ্ছে, সেই রাস্তা ধরেই আমরা চললাম। বালতাল পেরোনোর পর রাস্তা যথেষ্ট খারাপ। এক জায়গায় দেখলাম বেশ কয়েকজন মিলে একটা বড়ো পাথর রাস্তা থেকে সরাচ্ছেন, নইলে গাড়ি যেতে পারছে না। যত উপরে যাই, দেখি রাস্তার একদিকে বরফের দেওয়াল, অন্যদিকে গভীর খাদ। জায়গায় জায়গায় দেখলাম অমরনাথ যাত্রার বেসক্যাম্প তৈরি হচ্ছে, আর কদিন পরে যাত্রা শুরু হবে। জোজিলা পাস পার হয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম জিরো পয়েন্টে। যথারীতি এখানেও প্রচুর লোকজন, গাড়ি, মেলা বসে গেছে। বাতাসে স্নোবাইকের পোড়া তেলের গন্ধ। স্নোবাইক, স্লেজ, চা কফি ম্যাগির দোকান, জমজমাট ব্যাপার। আমার আবার এতো হৈচৈ ভালো লাগে না। এমনএকটি জায়গা, যার চারপাশটা এতো সুন্দর, সেখানে শান্ত হয়ে বসে একটু জায়গা টাকে অনুভব করার উপায় নেই। বিশেষতঃ স্নোবাইকের পোড়া তেলের গন্ধ আমার অসহ্য লেগেছে। তবে সবাই তো আর আমার মতো নয়, তারা এই অ্যাডভেঞ্চার গুলো করতে ভালোবাসে, তাই তো চলছে এসব। তবে এখানের বরফ আফারবতের মতো অতো পিচ্ছিল নয়। তাছাড়া আজ আমাদের নিজেদের স্নিকার্স, তাই হাঁটা যাচ্ছিলো। ঘন্টাখানেকের মতো থেকে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। কিন্তু রাস্তায় ভীষণ জ্যাম। একজায়গায় গাড়ি দাঁড়িয়ে রইলো আধঘণ্টার উপর। অবশেষে ফিরলাম। আহসান ভাই আমাদের কটেজের কাছেই ছিলেন। মেয়েরা ঘরে একা, ওনাকে বলেছিলাম একটু দেখবেন। তাই উনি ওখানেই বসেছিলেন এতক্ষণ। এটা আমাদের মন ছুঁয়ে গেছে। উনি নীচে থাকতেই পারতেন, কিন্তু তবুও যে ওদের যাতে কোন অসুবিধা না হয়, তাই জন্য থেকে গেলেন, তার জন্য আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ।


    জিরো পয়েন্ট


    সোনমার্গের কটেজ থেকে

    আমরা ফেরার পরেও আলো ছিল।সামনের ব্যালকনিতে বসে বসে দেখলাম সূর্য সামনের পাহাড়ের পিছনে চলে গেল। সন্ধ্যের দিকে সবারই খিদে পেয়ে গেল। চা আর টোস্টটা কটেজের কেয়ারটেকার ওখানেই বানিয়ে দিতে পারে, অন্য কিছু বললে নীচে গিয়ে নিয়ে আসতে হবে, সময় লাগবে। আমরা ঐ চা টোস্ট ই খেলাম, রাতের খাবার এদের রেস্টুরেন্টে ফোনে বলে দেওয়া হয়েছিল। এদিকে সূর্য ডোবার পরে যত সময় যায় ততো ঠান্ডা বাড়ে। একটা ঘরে রুমহিটার চালিয়ে সবাই বসি। জানালা দিয়ে আলো ঝলমলে সোনমার্গ দেখা যাচ্ছিল। এই কটেজটাও গুলমার্গের মতো, একটা বড়ো বসার ঘর, ডাইনিং টেবিলও ওখানেই, দুটো বেডরুম, একটা রান্নাঘর, আর একটা সুন্দর ব্যালকনি। মজা হল এর বেসমেন্টে কেয়ারটেকারের থাকার জায়গা। এটা অন্য কোথাও ছিল না। এখানেও পাওয়ার কাট হয়েছিল, কিন্তু ইনভার্টার ছিল, কোন অসুবিধা হয়নি। রাতে কটেজের কেয়ারটেকার হটপটে করে খাবার দিয়ে গেলেন, বাসনপত্র রান্নাঘরেই ছিল। খুব ঠান্ডা লাগছিল, তাই চটপট রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমের দেশে। পরদিন শ্রীনগর ফেরা।


    সিন্ধু নদ


    ৩রা জুন সকালে উঠে দেখি চারদিক রোদে ঝলমল করছে। দেখেই মনে হল আজ এখানে অনেক ছবি তুলব। কিন্তু কয়েকটা তোলার পরেই আমি কেমন হতাশ হয়ে পড়ি। এই এতো সৌন্দর্য ক্যামেরায় যেন ঠিক ধরতে পারি না। আমি প্রফেশনাল ফোটোগ্রাফার কেন কোনরকম ফোটোগ্রাফারই নই। মোবাইলে খিচিক করলেই তো আর ছবিতুলিয়ে হয় না! তাই দু চোখের লেন্স দিয়ে মন ক্যামেরাতেই সব তুলে রাখি।


    নরনাগ

    দশটা নাগাদ আমরা বেরিয়ে পড়লাম সোনমার্গ থেকে শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে। পথে কঙ্গন থেকে বাঁক নিয়ে আমরা যাব নরনাগ বলে এক জায়গায়। এখানকার কথা আমাদের বলেছিলেন আজাজ ভাই। কঙ্গন থেকে ডানদিকে বাঁক নিয়ে গাড়ি উঠতে লাগলো উপরের দিকে। পাশে ছোটো গ্রাম। একটু পরেই সঙ্গী হল পাহাড়ী নদী। পথে নদীর জলের, পাখির আর গাছের পাতার আওয়াজ ছাড়া বেশি কিছু শব্দ শোনা যায় নি। খুব একটা গাড়ি চোখে পড়ল না এদিকে, জায়গাটা এখনও তেমন ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে উঠতে পারে নি বোধ হয়, ভাগ্যিস! অবশ্য নরনাগ পৌঁছে কয়েকটা গাড়ি দেখতে পেলাম। এখানে আছে একটা প্রাচীন মন্দিরের ভগ্নাবশেষ। সামনে একটা শিবমন্দির, পাথরের তৈরী, এটা মনে হয় পরে বানানো। তার চারপাশে পাথরের তৈরী আরো কিছু ভাঙাচোরা মন্দির আছে। এখান থেকে আরো নিচের দিকে গেলে পাওয়া যায় একটা পাথুরে ধ্বংসস্তূপ। ভালো করে দেখলে বোঝা যায় এখানে একটা মূল মন্দির ছিল,তাকে ঘিরে অনেকগুলি ছোট শিবমন্দির, দুয়েকটিতে এখনও শিবলিঙ্গ রয়েছে। সামনে প্রবেশ তোরণ, নাটমন্দির, এগুলোর পাশে মশাল জ্বালিয়ে রাখার জায়গা করা আছে। সবই চৌকো করে কাটা পাথরের তৈরি। আরেকটু গেলে রয়েছে পাথরে বাঁধানো জলাধার, যেখানে সমানে একটা মুখ দিয়ে জল আসছে, আবার একটা নির্দিষ্ট লেভেলের পর অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। জল আসছে এখান থেকে বেশ কিছু দূরে অবস্থিত গঙ্গাবল লেক থেকে। শুনলাম এখান থেকে ট্রেক করে লোকে ঐ লেক পর্যন্ত যায়। জলটা বেশ ঠান্ডা আর মিষ্টি। ভাবতেও অবাক লাগে, কত কত বছর আগে কারা এরকম জায়গায় পাথরের পর পাথর দিয়ে এরকম মন্দির বানিয়েছিল ! লোকশ্রুতি, পাণ্ডবরা এসব বানিয়েছিল। অবশ্য কাশ্মীরের অধিকাংশ মন্দিরের ক্ষেত্রেই এরা বলে পাণ্ডবরা বানিয়েছিল। তবে যেই বানিয়ে থাক, যথেষ্ট সুন্দর পরিকল্পনা করেই বানিয়েছিল। আহসান ভাই বললেন – “আসলি জিন্দেগি উনহি লোগ জিয়ে থে, হামারা তো সির্ফ প্লাস্টিক জিন্দেগি হ্যায়।”


    নরনাগ


    শিবলিঙ্গ

    এখান থেকে আমরা চললাম শ্রীনগরের পথে। শ্রীনগর যেতে যেতে আহসান ভাই বললেন আজ তাঁর বাড়িতে আমাদের নেমন্তন্ন। কাশ্মীরীদের বাড়িঘর, জীবনযাপন নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল, তাই রাজি হয়ে যাই।

    এবার শ্রীনগরে আমাদের আস্তানা ছিল হোটেল ক্রেসেন্টে। কথা ছিল গাড়ি আমাদের ডাল লেকের একনম্বর ঘাটের কাছে নামিয়ে দেবে, ওদের লোক নিয়ে যাবে। ওদের লোক এল শিকারা নিয়ে। আমি তো হোটেল আর দেখতে পাই না। শিকারা থেকে নেমে আরো একটু হেঁটে গিয়ে অবশেষে পাওয়া গেল। এমনিতে হোটেলটা খারাপ নয়, কিন্তু এর অবস্থানটা ঠিকঠাক নয়, বেশ অসুবিধাজনক। একটা সরু হাঁটাপথ আছে, অনেকটা ঘুরে বড়ো রাস্তায় এসে মিশেছে। গাড়ি যাবে না সে পথে। আর ডাল লেকের ভিউটাও সামনের হাউসবোটের দৌলতে আটকে গেছে। আমি অন্ততঃ কাউকে ঐ হোটেলে থাকতে বলব না। হোটেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা তৈরি হলাম আহসান ভাইয়ের বাড়ি যাওয়ার জন্য। ছ'টা নাগাদ তাঁর আসার কথা, শ্রীনগরের ভয়ংকর জ্যামের কারণে আসতে সাড়ে ছ'টা বেজে গেল। পথে আমি টুকটাক একটু কেনাকাটা করলাম, তারপর গেলাম রামকৃষ্ণ মিশন। সেখানে ঢুকতে, আরতি শুরু হল। খানিকক্ষণ বসে আরতি দেখে প্রণাম করে চললাম নেমন্তন্ন খেতে।

    আহসান ভাইয়ের বাড়ি যখন পৌঁছলাম, তখন বাইরে লোডশেডিং চলছে। ওনার বাড়িতে অবশ্য ইনভার্টার চলছিল। ঢুকতেই দেখি দুটো ছোট্ট পুতুলের মতো বাচ্চা দরজার সামনে। একটি আহসান ভাইয়ের মেয়ে, আরেকটি ওনার ভাইয়ের ছেলে। এরপর বাড়ির সকলে এলেন, আলাপ পরিচয় হল। ওনার নানি, মা, বাবা, ভাই, ওনার স্ত্রী হেনা, ভাইয়ের স্ত্রী নিদা এবং ওনাদের বাড়ির সাহায্যকারিণী মেয়ে খুশবু যাকে ওনারা নিজেদের বোন বলেই পরিচয় দেন। বাড়িতে আরও দুটো পুঁচকে ছিল, আহসান ভাইয়ের বছর দেড়েকের যমজ দুই মেয়ে। আমাদের নিয়ে গিয়ে বসালেন ঘরে। ঘরে কোন আসবাব নেই, পুরো মেঝে কার্পেটে মোড়া, দেওয়াল ঘেঁষে ছোট ছোট তাকিয়া আর কুশন সাজানো। ওখানে মাটিতেই সবাই গোল হয়ে বসলাম। প্রথমেই আমাদের সামনে ছোট ছোট টেবিল ম্যাটের মতো কাপড় বিছিয়ে দিলেন, তারপর ট্রেতে করে ফলের রস, বাদামের শরবত আর এক বাটি করে ড্রাইফ্রুট মিক্স দিলেন প্রত্যেককে। একটু পরে দিলেন দুধ আর কেক। আমার তো ওতেই পেট ভরে গেছে। সেকথা বলতে ওনারা বলেন ডিনার দেরী আছে। এদিকে চারটে পুঁচকে মিলে দারুণ হৈচৈ করছে। বাড়িতে যে নতুন এতগুলো মানুষ, তাতে কোন জড়তা নেই, দিব্যি কোলে এল। হুটোপুটি করতে করতে একসময় ঘুমিয়েও পড়ল সব। আমার খুব ইচ্ছে ছিল সবকটা পুঁচকেকে নিয়ে ছবি তোলার,পরে তুলব করে আর তোলা হল না। আমরা সবাই বসে গল্প করছিলাম, বিয়ের অ্যালবাম দেখলাম, ওদের বিয়ের রীতিরেওয়াজ শুনলাম, আমাদেরও বললাম। এতো কথায় কখনো মনে হয়নি এই প্রথম আলাপ, সবাই এতো আন্তরিক ভাবে মিশে গিয়েছিলেন। রাত বাড়ছিল, সময় হল ডিনারের। প্রথমেই লম্বা করে কাপড় বিছানো হল, এবার একটা ঝারি দিয়ে বাটির উপরে হাতে জল দিয়ে হাত ধুইয়ে দিলেন। এরপর এলো একে একে সাদা ভাত, বিশাল শিককাবাব, রিস্তা, লাওহাবী কাবাব, পনীর, ধনিয়া চিকেন, ইয়াখনি চিকেন, রোগান জোশ। এতো কিছু খাবার খাওয়ার মতো পেটে তো জায়গা নেই। সবগুলো পদই খুব ভালো ছিল, কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা খেতে পারিনি, পেট ভরে গিয়েছিল। আমি সাধারণত খাবার নষ্ট করি না, তাই এত খাবার নষ্ট হওয়ায় আমার খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু সত্যিই আমরা অপারগ ছিলাম। যাইহোক, সবাইকে বিদায় জানিয়ে রাত্রি এগারোটা নাগাদ আমরা হোটেলে ফিরলাম।

    ৪ঠা জুন আজ আমাদের ইয়ুসমার্গ যাওয়ার কথা। কিন্তু রাত্রে ছোট জনের পেটের গোলমাল হওয়ায় তাকে নিয়ে বেরোনোর ভরসা হল না। ঠিক হল বাবা আর ছোট জন হোটেলেই থাকবে , আমি বড়ো মেয়েকে নিয়ে ঘুরে আসব। কিন্তু বড়োজন ঘুম থেকে ওঠার পর দেখা গেল তারও একই সমস্যা। একবার ভাবলাম যাওয়া ক্যানসেল করি। তখন কর্তাই বলল - আবার কখনো আসা হবে কিনা জানি না, যাও তুমি ঘুরে এসো, আমরা ছবিতেই দেখব। মেয়েরাও তাই বলল। অগত্যা আমি একাই চললাম, দুই মেয়ের জন্য ORS আর ওষুধ নিয়ে তাদের বাবা থাকল। যাব কি যাব না করতে করতে আমার বেরোতে একটু দেরীই হয় গেল।

    ইয়ুসমার্গ শ্রীনগর থেকে খুব বেশি দূরে নয়, পঞ্চাশ কিমি মতো। এখনও খুব জনপ্রিয় না হওয়ায় তেমন গাড়ির ভিড় চোখে পড়ল না। সত্যি বলতে কি, আমাদের গাড়ি ছাড়া ঐ পথে আর একটাও গাড়ি আমাদের আগে পিছে ইয়ুসমার্গ পর্যন্ত যেতে দেখিনি। ঘন্টা দেড়েক পর দেখি দূরে বরফঢাকা পর্বতশ্রেণী দেখা যাচ্ছে, যা পীরপঞ্জল রেঞ্জের। দুই পাশের সরলবর্গীয় গাছের মাঝখান দিয়ে যেতে যেতে পৌঁছে গেলাম ইয়ুসমার্গ। ওখানে গিয়ে অবশ্য বেশ কয়েকটি গাড়ি দেখলাম, লোকজন আছে, তবে কম।


    ইয়ুসমার্গ


    ইয়ুসমার্গ

    এখানে এসেই যেটা চোখে পড়ে,তা হল সবুজ, নানা রকম সবুজ। বিস্তীর্ণ ঢেউখেলানো তৃণভূমি তার চারিদিকে পাইন বন। সেই বনের মধ্যে দিয়ে সরু রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া যায় এক -দেড় কিলোমিটার দূরে দুধগঙ্গা নদীর তীরে। গাড়ি থেকে নেমে একটু এগোতেই ঘোড়া ওয়ালারা ছেঁকে ধরলো, প্রথমে নেবো না বললেও পরে আহসান ভাই বললেন - "একটা নিয়ে নিন , নইলে যেতে পারবেন না, আমি হেঁটে সঙ্গে যাচ্ছি ।" কিন্তু আরেকটি কম বয়সী ছেলে কিছুতেই ছাড়বে না, শেষ পর্যন্ত উনিও ঘোড়াতে চাপলেন। ঘোড়ার রেট এখানে ৩০০ টাকা করে। খানিকটা মাঠ, খানিকটা কংক্রিটের বাঁধানো রাস্তা, আর খানিকটা উঁচু নিচু এবড়োখেবড়ো জঙ্গুলে রাস্তা দিয়ে এসে পৌঁছলাম দুধগঙ্গা নদীর কাছে। অবশ্য ঘোড়া থেকে যেখানে নামলাম সেখান থেকে নদীর কাছে যেতে অনেকটা নামতে হবে। প্রথমে নামতে পারবো কিনা ভাবছিলাম, শেষ পর্যন্ত আহসান ভাইয়ের সাহায্যে নেমেই পড়লাম। জায়গাটা ভীষণ সুন্দর! শান্ত, নির্জন, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা পাহাড়ী নদী দুধগঙ্গা। খুব বেশি ট্যুরিস্টদের ভিড় নেই, তাই চিৎকার চেঁচামেচিও নেই তেমন। নদীর পাড়ে পাথরের উপরে বসে এই নির্জন প্রকৃতির মধ্যে থাকতে বেশ লাগছিল। এতদিন ধরে যে নির্জনতা, শান্ত পরিবেশ চাইছিল মন, সেটা এখানেই পেলাম। নদীর জলে কিছু কম বয়সী ছেলেপুলে হুটোপুটি করছিল, কিছু ছেলেমেয়ে স্কুল ড্রেস পরা অন্যদিকের জঙ্গলে, দেখে মনে হল কোন স্কুল থেকে ট্রেক করতে এসেছে। নদীর ধারে খান দুয়েক চায়ের দোকান, ম্যাগি, ডিম সেদ্ধ এসব ও পাওয়া যায়। একটা দোকানে চা, ম্যাগি খাওয়া হল। এরপর আবার উপরে উঠে এসে ঘোড়ায় চড়ে ফেরার পথ ধরা। ঘোড়ায় চড়া ব্যাপারটা যদিও আমার কাছে খুব একটা সুখকর নয়। এখানেও JKTDC র থাকার জায়গা আছে, কয়েকটি হোটেল, হোমস্টেও আছে দেখলাম। নির্জনতা পছন্দ করেন যারা, থাকতে পারেন, ভালোই লাগবে। মানসবলের চেয়ে এখানে এসে থাকলে আমি অনেক বেশি খুশি হতাম। তবে একটাই মুশকিল, ফোনে কোন সিগন্যাল নেই। ওখান থেকে বেরিয়ে আরো কিছুটা যাওয়ার পর সিগন্যাল এল।


    দুধগঙ্গা

    বিকেল চারটা সাড়ে চারটা নাগাদ শ্রীনগর পৌঁছে গেলাম। শ্রীনগরের সব মুঘল গার্ডেনগুলোর মধ্যে শালিমার বাগটা সেদিন আর যাওয়া হয়নি। ভাবলাম সময় আছে, আর মেয়েরাও সারাদিন ঘরে, এই বাগানটাই বা বাদ যায় কেন, ঘুরেই আসি। কিন্তু ছোট গেলনা, আমরা তিনজন গেলাম শালিমার বাগ। সম্রাট জাহাঙ্গীরের তৈরি এই বাগিচা ও অন্যগুলোর মতোই সুন্দর। দিনের আলো পড়ে আসছিলো, কোথা থেকে মেঘ এলো, সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া, টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা পড়তেই আমরা বেরিয়ে এলাম। আহসান ভাইয়ের সাথে আজই আমাদের সফর শেষ। কাল জম্মু নিয়ে যাবেন অন্য কেউ, উনিই ঠিক করে দিয়েছেন। আমাদের সঙ্গে থাকা ছোট একটা ডোকরার ময়ূর ওনাকে উপহার দিলাম। উনি বিদায় নেওয়ার সময় জানালেন কাল উনি নিজে না গেলেও ফোনে যোগাযোগ রাখবেন। রাতে হোটেলে ডাল ভাত আর আলুসেদ্ধ মানে ম্যাশড পোট্যাটো বলা হয়েছিল। তাই খেয়ে কিছু গোছগাছ করে ঘুমোতে গেলাম। কাল আমাদের ফেরার পালা।


    চিনার গাছ

    ৫ই জুন আজ আমাদের কাশ্মীরে থাকার শেষ দিন। আজ রাতে জম্মু থেকে ট্রেনে প্রথমে দিল্লি, তারপর দিল্লি থেকে কলকাতা। চিন্তার ব্যাপার হল শ্রীনগর থেকে জম্মু প্রায় ছয় ঘন্টার মতো পথ। অতটা রাস্তা মেয়েদের শরীর কীরকম থাকবে, তাছাড়া জম্মুতে বেশ গরম, প্রায় ৪৫° চলছে। আমাদের স্টেশনে বসে থাকতে হবে কয়েক ঘন্টা। যাই হোক শেষ মুহূর্তের গোছগাছ সেরে স্নান করে রেডি হয়ে গেলাম। ব্রেকফাস্টে হোটেলেই ব্রেড বাটার বলা হয়েছিল। ওরা যে পাঁউরুটিটা দিলো সেটা অনেকটা পিৎজা বেসের মতো দেখতে কিন্তু সুন্দর বেক করা, খেতেও খুব ভালো ছিল। সঙ্গে দিয়েছিল মাখন আর মধু। এরকম আমি আগে খাইনি কোন হোটেলে। ব্রেকফাস্ট করে আমরা সব লাগেজ নিয়ে বেরোবার, আবারও শিকারায় করে এক নম্বর ঘাটে আসলাম। তারপর গাড়ি এলে সব মালপত্র তুলে ডাললেক আর শ্রীনগরকে শেষবারের মতো টাটা বাই বাই করে চললাম জম্মুর পথে। শ্রীনগর থেকে পহেলগামের রাস্তাতেই বেশ খানিকটা গিয়ে, বিজবেহারা পর্যন্ত তো বটেই, তারপর রাস্তাটা আলাদা হয়ে যায়। অর্থাৎ আবার পম্পোর পড়লো পথে। আমার হঠাৎ মনে হল আগের দিন ওখানের দোকান থেকে কাওহাটা কিনলে হতো। কিন্তু দোকানটা ঠিক কোথায় ছিল ভুলে গেছি। পথে গাড়ি থামিয়ে একটা দোকান থেকে কাওহা চায়ের কৌটো কেনা হল, তারপর দেখি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে আগের দিনের দোকানটা। আকাশে মেঘ করছিল, তাপমাত্রা কমের দিকেই, আমরা এগিয়ে চললাম, পথে পড়লো বানিহাল । এরপরের অনেকটা রাস্তা বেশ খারাপ। চন্দরকোট বলে একজায়গায় দাঁড়িয়ে একটা ধাবায় আমরা লাঞ্চ করে নিলাম। মেয়েরা কিছু খেলো না, শুধু লস্যি ছাড়া। আমরা রুটি তরকারি আর লস্যি। এখানেই দেখি আকাশ কালো করে এল, মেঘ ডাকতে শুরু করল। আমরা ফের চললাম জম্মুর দিকে। রাস্তায় পড়লো বেশ কয়েকটি টানেল। টানেলগুলো কিন্তু ছোট নয়, অনেকটা। এদিকে বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেছে। মাঝে বড়োজনের শরীর খারাপ লাগে, যা খেয়েছিল, সব বের করে দিল। ছোটজনের শরীর খারাপ তো আছেই। ভেবেছিলাম যাওয়ার পথে যদি পাটনিটপটা ঘুরে যাওয়া যায়। কিন্তু এদের শরীরের অবস্থা দেখে, তার উপর বৃষ্টি হওয়ায় আর গেলাম না। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী টানেলের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়াতে হল জ্যামের জন্য। জম্মু ঢুকতেই দেখলাম তাওয়াই নদী, যার নামে জম্মু তাওয়াই স্টেশন। এই সময়ে আমাদের ড্রাইভারের একটা ফোন আসে, যার পর উনি বলেন গুলমার্গের মহারাণী মন্দির নাকি আগুনে পুড়ে গেছে। শুনে খারাপ লাগল। বৃষ্টি তখনও চলছে বেশ জোরেই। আমি ভাবছি এরকম বৃষ্টি চললে নামব কি করে, জিনিসপত্র নিয়ে ভিজে যাব তো পুরো। যখন স্টেশনে পৌঁছলাম, তখন অবশ্য একদম কমে গিয়েছিল, হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছিল। যেখানে গাড়ি থেকে নামলাম সেখান থেকে বেশ খানিকটা উপরে স্টেশন, মালপত্র টেনে স্টেশনে তো ঢুকলাম। কী ভিড়! স্ক্যান মেশিনের মধ্যে দিয়ে লাগেজ দিয়ে নেওয়া হল। প্ল্যাটফর্ম আরও উপরে। সেখানে যেতে কুড়ি পঁচিশটা সিঁড়ি ভেঙে যেতে হবে। একটি এস্কেলেটর ও আছে, কিন্তু সেটা বন্ধ এবং দড়ি দিয়ে ঘেরা। আমাদের সাথে চারখানা সুটকেস, তার দুটো বড়ো। উপায় নেই, নিজেদেরকেই সেসব টেনে টেনে সিঁড়ি বেয়ে ওঠাতে হল। যেতে যেতে শুনছি, বিভিন্ন ট্রেনের সময় বদলে গেছে, লেট। যখন ছাড়ার কথা তখন ছাড়বে না, কখন ছাড়বে তারও কোন উল্লেখ নেই। ফলে প্ল্যাটফর্মে তখন লোক থইথই করছে, পা ফেলার জায়গা নেই। স্টেশনের কর্মচারীরা দাঁড়াতে দিচ্ছেও না, মুহুর্মুহু হুইসল বাজিয়ে লোকজনকে খেদিয়ে চলেছে। এর মধ্যেই কর্তা গিয়ে একটা ওয়েটিং রুমের খোঁজ পায়। সেখানে ভিড় থাকলেও অত বেশি না, ঠেলেঠুলে কোনমতে একটা বসার জায়গা পাওয়া গেল। ভাগ্যিস বৃষ্টিটা হয়েছিল, নইলে গরমে কী করে যে ওখানে থাকতাম কে জানে! আমাদের ট্রেনের সময় ছিল রাত নটা পঁচিশে। কিন্তু ট্রেন প্ল্যাটফর্মেই এলো নটা চল্লিশ নাগাদ। একে প্লাটফর্মের সেদিকটায় আলোর ব্যবস্থা নেই, অত লোকজন, গুঁতোগুঁতি করে মালপত্র নিয়ে ওঠা যেন এক যুদ্ধ!! কোন রকমে উঠে নিজের জায়গায় বসে শান্তি। ট্রেন ছাড়তে ছাড়তে দশটা বাজল। একটু পরেই খাবার দিল, খেয়ে নিজের নিজের বার্থে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। কাল সকালে দিল্লি, তারপর বিকেল সাড়ে চারটার রাজধানী ধরে কলকাতা। জম্মু তাওয়াই স্টেশনটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটা স্টেশন, অথচ এত খারাপ অবস্থা কেন কে জানে! অব্যবস্থার চূড়ান্ত যাকে বলে! যাই হোক, এবারের মতো আমাদের কাশ্মীর ভ্রমণ শেষ হল। দু-একটি ছোটখাটো ঘটনা বাদ দিলে মোটের উপর আমাদের ভ্রমণ বেশ আনন্দের ছিল।



    অলংকরণ (Artwork) : লেখক
  • পর্ব ১ | ২য় পর্ব
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments