প্রারম্ভিক
২০২২-এ সিকিম থেকে বেড়িয়ে আসার পর ভেবেছিলাম ২০২৪-এ দুই মেয়ের বোর্ড পরীক্ষা হয়ে গেলে বাইরে কোথাও বেড়াতে যাব। অবশ্য এই ভাবনাটা আমার মনে মনেই ছিল। এবছর সেকথা কর্তাকে বলতেই তিনি তো অসম্ভব বলে এক কথায় নাকচ করে দিলেন। বাইরে কোথাও তো দূরস্থান, দেশের মধ্যেও কোথাও যাওয়ার আশা নেই। অবশ্য কারণও ছিল। তিনি তো আর আমার মতো হাওয়ায় ভেসে বেড়ান না, মাটিতে পা রেখে চলেন। বাস্তবে বড়ো জনের বোর্ড শেষ হতে এপ্রিল, তার পর অমুক ইউনিভার্সিটির অ্যাডমিশন টেস্ট, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির পরীক্ষা, কলেজের ভর্তি সব মিলিয়ে বেজায় ভজকট অবস্থা। কবে কী হবে কিছুই জানা নেই, এই অবস্থায় বেড়াতে যাবার কথা আমার মতো পাগলরাই ভাবে। যাই হোক, বোর্ড পরীক্ষা শেষ হল, অন্যান্য কাণ্ডকারখানার দিনক্ষণও ক্রমে ক্রমে জানা গেল। দেখা গেল ২১শে মে পরীক্ষা শেষ। এদিকে আমিও এবছর কপাল গুণে ২৬শে মে থেকে বারো-তেরোদিনের মতো গরমের ছুটি পাচ্ছি, যা ছোট জনের ছুটির সাথে মিলে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এক সপ্তাহের জন্য কোথাও যাওয়াই যায়। কিন্তু আবার কে বলবে! তাই নিজের মনেই বকে যাই তেনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে আর বিভিন্ন ট্রাভেল ব্লগ দেখতে থাকি। শেষে তিতিবিরক্ত হয়ে তিনি বলেন— কোথায় যাবে? এখন কোথাও যাবার ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাবে না। আমিও সুযোগ বুঝে বলি— কাশ্মীর, ফ্লাইটের টিকিট নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে, ভোটও শেষ হয়ে যাবে ওখানে ২০শে মে (মানে তখনও তাই ঠিক ছিল)।
আসলে আমার সব খোঁজখবর আগেই সারা ছিল। তিনি বুঝলেন সবই, ২৭শে মের সকালের এয়ার টিকিটও কাটা হল, বাকি খোঁজ খবর নেওয়া শুরু হল। ইতিমধ্যে দুজনেরই রেজাল্ট বেরিয়ে গেল। কর্তার অফিসের একজনের মাধ্যমে পাওয়া গেল আজাজ ভাইয়ের খোঁজ। তাঁর সাথে যোগাযোগ করতেই তিনি বললেন তাঁর নিজেরই হাউসবোট আছে। গাড়িও তিনিই ঠিক করে দেবেন। অন্যান্য হোটেল বুকিং, গণ্ডোলার অনলাইন টিকিট সবই প্রায় ঠিক। কিন্তু আমার কপাল!!! কখনো কোনকিছু সুস্থ ভদ্রভাবে আমার কপালে হয় না। ঠিক এক সপ্তাহ আগে থেকে শুরু হল নিম্নচাপ আর ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস। প্রথমে মনে হয়েছিল ২৪-২৫শের মধ্যে যা হবার হয়ে যাবে। কিন্তু প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল আমার কপাল পুড়িয়ে এল সেই ২৬শের মধ্যরাতে। ফলে ২৭ সকালের ফ্লাইট বাতিল। পরিবর্তে ২৭ তারিখ রাত্রি সাড়ে দশটার ফ্লাইটে দিল্লি, এবং সেখান থেকে ভোর সাড়ে পাঁচটায় শ্রীনগরের ফ্লাইট।
২৭শে মে
২৬শের রাত্রি থেকে যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, সে তো থামেই না। বৃষ্টিও বাড়ে, আমার টেনশনও বাড়ে। রাস্তায় জল জমলে যাব কী করে, ফ্লাইট যদি দেরি করে— এমন হাজারো চিন্তা! অবশেষে বৃষ্টিদিদি যদি বা থামলেন, বিদ্যুৎবাবু উধাও হলেন। একখানা ব্যাটারির আলো জ্বালিয়ে কোনমতে শেষ মুহূর্তের গোছগাছ করা। তাতে অর্ধেক জিনিস খুঁজে পাইনা, কিছু জিনিস নিতে ভুলে গেলাম, সব মিলিয়ে বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড! যাই হোক সংসারের ঊনকোটি কাজ সেরে অবশেষে সন্ধ্যে ৭:১৫ নাগাদ দুগ্গা দুগ্গা করে বেরোলাম এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। ফ্লাইট একটু দেরী করলেও রাত দেড়টার মধ্যে দিল্লি পৌঁছে গেলাম।
এয়ারপোর্টের ভিতর টা কী ঠান্ডা রে বাবা!! ঠাণ্ডার চোটে ঘুমোতে পারছি না, এদিকে এক কাপ কফির দাম ২০৮ টাকা, চা ১৪৮ বোধ হয়। দাম শুনেই খাওয়ার ইচ্ছে উড়ে গেল। ঘুম তাড়াতে তাই রাত আড়াইটের সময় লিখতে শুরু করলাম, যদিও সরকারিভাবে এখন ২৮ তারিখ হয়ে গেছে।
শেষপর্যন্ত আবার চেক ইন করে গেলাম শ্রীনগরের ফ্লাইট ধরতে। অবশেষে সকাল সাতটা নাগাদ পৌঁছলাম শ্রীনগরে। প্লেন থেকেই দেখা গেল বাইরে বরফচূড়া ঝকঝক করছে। নেমে মালপত্র নিতে যাওয়্যার পথে দেখি এয়ারপোর্টে বড় বড় করে লেখা— Welcome to the heaven on earth. তবে মিলিটারি এলাকা, তাই সেখানকার ছবি তোলা মানা।
২৮শে মে
লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে এসে ফোন করা হল গাড়ির ড্রাইভারকে। আহসান ভাই এসে আমাদের জিনিসপত্র তুলে বললেন— সকাল সকাল আগে শঙ্করাচার্যের মন্দির টা চলুন, পরে ভিড় হয়ে যাবে। তবে সকালবেলাতেও ভিড় কম নয় সেখানে। সেখানে সিকিউরিটি চেকিং এর পর প্রায় আড়াইশো সিঁড়ি ভেঙে উঠলাম মন্দিরে। তারপরেও মূল মন্দিরে উঠতে আরো খান কুড়ি সিঁড়ি। অতো উপর থেকে পুরো শ্রীনগর শহরটা পাখির চোখে দেখা যায়। লাইন দিয়ে মন্দিরে শিবলিঙ্গ দর্শন করে, শঙ্করাচার্যের তপস্যাস্থল দেখে আমরা নেমে এলাম।
শঙ্করাচার্য মন্দির
এবার আমাদের গন্তব্য হাউসবোট সাংগ্রিলা। বিখ্যাত ডাল লেকের পাশে এক এক করে নম্বর দেওয়া ঘাট রয়েছে। ১৬ নম্বর ডাল গেটের কাছে আজাজ ভাই অপেক্ষা করছিলেন। ওঁর সঙ্গে এবার মুখোমুখি পরিচয় হল। আহসান ভাই আমরা তৈরি হয়ে ওনাকে ফোন করলে চলে আসবেন বলে বিদায় নিলেন। আমরাও শিকারায় করে গেলাম হাউসবোটে। সুন্দর সাজানো গোছানো হাউসবোট, বাইরে দাওয়া মতো, তারপর বসার ঘর, ডাইনিং পেরিয়ে প্যাসেজের পাশে তিনটে ঘর পরপর। আমাদের দুটো নেওয়া ছিল। একটায় আবার ঝাড়লণ্ঠন টাঙানো। মেয়েরা দারুণ খুশি, বিশেষ করে ছোটজন তো স্পষ্ট বলেই দিল— আমি এখানেই থাকবো, আর কোথাও যেতে চাই না। কিন্তু তা বললে তো চলবে না, বেড়াতে এসে ঘরে বসে থাকলে হয়? অতএব স্নান সেরে চা টোস্ট খেয়ে আমরা বেলা ১১টা নাগাদ বেরোলাম শ্রীনগর শহরটা দেখতে। কিন্তু কী রোদ্দুর! ঝলসে দিচ্ছে পুরো, সাথে গরমও ছিল বেশ। আমরা মনে মনে ভাবছি তখন এ কোন কাশ্মীর!!
হাউসবোটের সারি
প্রথমেই আমরা গেলাম চশমে শাহী। খুব সুন্দর সাজানো ফুলের বাগান, মাঝখানে একটি পাহাড়ী ঝর্ণা স্রোত। মুঘল সম্রাট শাহজাহান এই বাগানটি তৈরী করেছিলেন। তবে সবকটি মুঘল গার্ডেনের মধ্য এটিই সবচেয়ে ছোট। এতো সুন্দর বাগান, বেশ মন ভরে যে ছবি তুলবো সে উপায় নেই। এতো রোদে তাকানোই যাচ্ছে না। আর আমাদের পাতি মোবাইল ক্যামেরা, তায় খুব কিছু কারিকুরি ও জানি না। সুতরাং কোন মতে ছায়ায় গিয়ে কিছু ছবি তোলা।
চশমে শাহী
এখান থেকে বেরিয়ে জলের বোতল কিনে আমরা চললাম পরীমহল। পরীমহল আসলে ছিল কোন বৌদ্ধ বিহার, পরে শাহাজাদা দারাশিকো এখানে তাঁর নিজস্ব লাইব্রেরি তৈরি করেন, এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান এর চর্চা করতেন। এর সাতটি তলা হলেও আমরা তিনটিই দেখলাম, গরমে রোদে নাজেহাল হয়ে আর দেখার মতো অবস্থা ছিল না, তাছাড়া তখন তিনটে বেজে পেরিয়ে গেছে, খিদেও পেয়েছিল সবার। কর্তা সিঁড়ির আধিক্য নিয়ে গজগজ শুরু করে দিয়েছিলেন— খোদ হুমায়ুন সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা যাবার পরেও মুঘলদের এত সিঁড়ি বানানোর শখ হয় কী করে?
পরীমহল
সেখান থেকে বেরিয়ে আমরা খেতে গেলাম ডাল লেকের পাশেই ‘স্ট্রিম’ বলে একটি রেস্টুরেন্টে। লাঞ্চ ব্রেকের পর আমাদের গন্তব্য ছিল নিশাতবাগ। কিন্তু বুলেভার্ড রোডে কিছু মারাত্মক জ্যাম হয়!! যানজট ছাড়িয়ে অবশেষে যখন নিশাতবাগ পৌঁছলাম ঘড়িতে তখন সাড়ে পাঁচটা প্রায়। তখনও কী রোদ্দুর! নিশাতবাগ বানিয়েছিলেন নূরজাহানের ভাই আসিফ খান, যাঁর কন্যা মমতাজ ছিলেন সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী। যথারীতি মুঘল স্থাপত্যের সুন্দর বাগান, পিছনে পাহাড়ের ঢালে বেয়ে নেমে এসেছে বাগানটি, মাঝখানে রয়েছে জলধারা, ফোয়ারা। তবে সেখানে খুব কিছু ঘোরাফেরার মতো অবস্থা আমাদের ছিল না। একটুক্ষণ সেখানে ছায়ায় বসে হাত পা ছড়িয়ে জিরোলাম। দু-একটা টুকটাক ছবি তুলে বেরিয়ে এলাম। এই সবকটি জায়গাতেই ঢোকার জন্য টিকিট কাটতে হয়।
নিশাতবাগের পর শালিমার বাগ যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের ড্রাইভার আহসান ভাই বললেন, শালিমার বাগ একই রকমের, আলাদা কিছু নয়। তার চেয়ে চলুন হজরতবাল আর জামা মসজিদ দেখবেন। চললাম সেখানে। আমি যেতে যেতেই বললাম, এসব জায়গায় কি আমাদের ঢুকতে দেবে? আমার কাছে ওড়না নেই মাথা ঢাকার। উনি বললেন— চলুন তো দেখি। কিন্তু হজরতবালে প্রথমেই আমার দুই মেয়েকে ঢুকতে দিলো না, কারণ তাদের একজনের স্লিভলেস টপ, আরেকজনের শর্ট ফ্রক। আমরা দুজন ঢুকলাম, ওখানে এক জায়গায় ওড়না রাখা ছিল, সেখান থেকে নিয়ে মাথা ঢাকতে বললো, ঢেকে আমরা একটু ঘুরে দেখলাম। মসজিদের একদম ভিতরে ঢুকিয়ে, বাইরে এক জায়গা থেকে আহসান ভাই আমাদের হজরত মহম্মদের রেলিক কোথায় থাকে দেখালেন।
সেখান থেকে বেরিয়ে জামা মসজিদ যাওয়া বাতিল করলাম, কারণ সেখানেও কন্যাদের একই সমস্যা হতে পারে। সুতরাং আমরা চললাম বাদামওয়াড়ি। সাজানো বাগান, কাঠবাদামের গাছ আছে কিছু, দুটো মুঘল স্থাপত্যের গেট আছে, দ্বিতীয় গেটের পরে একটা গ্যালারি আর স্টেজ রয়েছে দেখলাম, সবই পাথরের তৈরি। এদিকে আকাশে মেঘ কালো করে আসছে, আমি তাড়া দিকে থাকি ফেরার জন্য।
ফিরতে তো শুরু করি, কিন্তু শ্রীনগরের যানজট!! বুলেভার্ড রোডে গাড়ি এক পা এক পা করে এগোয়। এত গরম, জ্যাম সব মিলিয়ে আমার শরীরে অস্বস্তি হতে শুরু করে, মাথা যন্ত্রণা আগেই শুরু হয়েছিল। যাই হোক রাত আটটা নাগাদ হাউসবোটে ফিরেই আমার বমি হয়। আসলে আগের রাতে ঘুম নেই, জার্নি, সারাদিন কড়া রোদে ঘোরাঘুরি, বাইরের খাবার, এতো ধকল আমার আলটুসি মার্কা শরীর আর নিতে পারে নি। ফলশ্রুতি আমার চিরসখা মাইগ্রেনের আগমন। আমি ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লাম, সকালের আগে আর উঠিনি। পরে শুনলাম রাত্রে ওরা নাকি হাউসবোটে দারুণ খাওয়াদাওয়া করেছে। কাবাব বানিয়ে কাবাব কারি করেছিল, যা নাকি ওখানকার বিয়েশাদিতে অবশ্যখাদ্য।
২৯শে মে আজ আমাদের যাওয়ার কথা পহেলগাম। শ্রীনগর থেকে পহেলগাম প্রায় ৯০ কিমি রাস্তা, যেতে সময় লাগবে তিন ঘন্টার মতো। সেদিন যেহেতু পহেলগামেই থাকার কথা, তাই আমরা একটু ঢিমেতালেই চলছিলাম। ধীরে সুস্থে রেডি হয়ে বেরোতে বেরোতে প্রায় এগারোটা বেজে গেল। শ্রীনগর থেকে কিছুটা যাওয়ার পর এক জায়গায় আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়লো। সেখানে আমাদের মতো আরও অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। বেশ কিছু সেনা রাস্তায় পাহারা দিচ্ছেন, তাঁরাই গাড়ি এলে একদিকে দাঁড়াতে বলছেন। শুনলাম কোন সেনা কনভয় গেলে এরকম ভাবে সাধারণ গাড়িগুলো কে একদিকে দাঁড় করিয়ে রেখে কনভয় পার করানো হয়। পুলওয়ামায় সেনা কনভয়ে হামলার পর থেকে নাকি এই ব্যবস্থা।
শ্রীনগর থেকে পনেরো কুড়ি কিমি যাওয়ার পর আসে পম্পোর বা পঁপোর বলে একটি জায়গা, যেখানে চাষ হয় জাফরান বা কেশরের। রাস্তার দুই পাশে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে কেশরের চাষ হয়। বিশ্বের নব্বই শতাংশ কেশর নাকি এখানেই উৎপন্ন হয়। এখন অবশ্য ধানচাষ হয়ে ধান কাটা চলছিল। পম্পোর পেরিয়ে প্রচুর দোকান আছে রাস্তার পাশে যেখানে কেশর বিক্রি করা হয়। শক্তিগড়ে হাইওয়ের ধারে ল্যাংচা মহল, ল্যাংচা কুটির, আদি ল্যাংচা ভবন ইত্যাদি সার সার দোকান যাঁরা দেখেছেন তাঁরা সহজেই অনুমান করে নিতে পারবেন।
আরো খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার পর দেখি রাস্তার দুই পাশের বাড়ি দোকানের সামনে, ছাদের উপরে প্রচুর কাঠ জমা করা, কিন্তু ডাঁই করে নয়, একটা বিশেষ প্যাটার্নে, বর্গাকারে। বর্গক্ষেত্রের চারটে বাহুতে চারটে সমান মাপের কাঠ, কোণের জায়গাগুলোতে একটার উপরে আরেকটা চাপানো, এইভাবেই একের পর এক কাঠ জমা করা। আহসান ভাই বললেন এগুলো সব ব্যাট তৈরি হয়। এখানে অবন্তীপোরায় ইংলিশ আর কাশ্মীরী উইলোর ব্যাট তৈরির কারখানা রয়েছে। আমারও মনে পড়লো, কিছুদিন আগে শচীন তেন্ডুলকর কাশ্মীরে এসে এই ব্যাট তৈরির কারখানায় এসেছিলেন এরকম একটা ভিডিও দেখেছিলাম। অর্থাৎ ঐ কাঠগুলো সব উইলো কাঠ, শুকনো হচ্ছে, ব্যাট তৈরি হবে বলে। শুনলাম কাশ্মীর উইলোর ব্যাট নাকি একটু ভারি হয়, ইংলিশ উইলোর ব্যাট হালকা।
অবন্তীপোরা, বিজবেহারা পেরিয়ে আমরা আরো এগিয়ে চললাম। খানিকটা যাওয়ার পর আহসান ভাই বললেন,আপনাদের মাটন-এর সূর্য মন্দির টা ঘুরিয়ে নিয়ে যাই। কিন্তু কথায় কথায় ওনার পরিচিত রাস্তাটি ততক্ষণে পেরিয়ে এসেছি। তখন অন্য রাস্তা ধরে চললাম, মাঝে মাঝে একে তাকে জিজ্ঞেস করে পথের হদিশ জেনে। শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছলাম মাটন, যার আসল নাম মার্তণ্ড। সেখানে রয়েছে এক প্রাচীন সূর্য মন্দির। সূর্য দেবের মূর্তি রয়েছে সপ্তাশ্বের রথে।এছাড়াও আছে রাধাকৃষ্ণের মন্দির, শিব পার্বতী, গণেশ এবং রাম মন্দির। পাশেই রয়েছে একটি গুরুদ্বারা। এখানে একটা বাঁধানো পুকুর আছে, তাতে অজস্র মাছ। লোকে মাছের জন্য দানা কিনে খেতে দেয়। অমরনাথ যাত্রার বেসক্যাম্প এখানে হয় শুনলাম।
এখান থেকে বেরিয়ে আমরা পহেলগামের দিকের রাস্তা ধরলাম। চারপাশে যেদিকে তাকাই আপেল বাগান। এরকম একটা আপেল বাগানে গিয়ে আমরা সবাই আপেলের রস খেলাম। সামনেই একটা মেশিনে আপেল গুলো দিয়ে একটু থেঁতো করে দিচ্ছে, তারপর মেশিনের হাতল ঘুরিয়ে পেষাই করে রস বের করা হচ্ছে। কী যে অপূর্ব খেতে! না জল না চিনি, একদম সত্যিকারের আপেলের রস— তার স্বাদই আলাদা! ভীষণ রিফ্রেশিং। এক গ্লাস ৫০ টাকা দাম, কিন্তু ঐ এক গ্লাস বানাতে পাঁচ ছয়খান বোধহয় আপেল লেগেছে।
এবার চললাম পহেলগাম, সাথী লিডার নদী। চারিদিকটা ভারী সুন্দর, যেদিকে তাকাই পাহাড়, জঙ্গল, নদী সব মিলিয়ে বড়ো মনোরম দৃশ্যপট। পহেলগাম ঢোকার একটু আগে আমরা দাঁড়ালাম। অনেকেই সেখানে নেমে লিডার নদীর পাশে ছবি তুলছিল, আমরাও তুললাম। একটু নদীর জলে হাত দিলাম, বেশ ঠাণ্ডা জল। এরপর গিয়ে পৌঁছলাম পহেলগাম।
বেলা তখন আড়াইটে বেজে গেছে। আমরা খেতে ঢুকলাম একটা রেস্টুরেন্টে। সেখানে মেয়েরা নিলো মশলা দোসা আর আমরা রুটি আর আলুকপির তরকারি। বাইরে বেড়াতে গেলে আমি হালকা আর নিরামিষ খাবার খেতেই পছন্দ করি। সঙ্গের ভদ্রলোকের ব্যাপারটা খুব একটা পছন্দ না হলেও দোকানে কোন আমিষ পদ পাওয়া যায় না বলে সেদিন রুটি তরকারিই অর্ডার দিলেন। দোকানে বেশ ভিড়, প্রচুর লোকের বিভিন্ন অর্ডার, সেসব ওয়েটাররা দিয়ে যাচ্ছেন এদিকে ওদিকে। আমাদের টেবিলে মেয়েদের দোসা এসে গেল একটু পরেই। আমাদের আর আসে না। মেয়েদের খাওয়াও যখন শেষ প্রায়, তারপর এল। এদিকে বাইরে তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমি তো চিন্তায় পড়ে গেলাম। যাহ, এবার কী করে কী করব!! পহেলগামের ABC মানে, আরুভ্যালি, বেতাবভ্যালি এবং চন্দনওয়াড়ি যাওয়াটা আজ আর হবে না। এদিকে শুনেছি বৃষ্টি হলে বৈশারণ ভ্যালি যাওয়াটা ও বিপজ্জনক। তার মানে আজ আর কিছুই হবে না, আপাতত JKTDC র হোটেলে গিয়ে উঠি। এদের হোটেলটার নাম আলপাইন। একটু পরে বৃষ্টি থামলো, আমরা হোটেলের দিকে চললাম। JKTDC র হাটগুলো তো দেখতে পেলাম, কিন্তু কোনখান দিয়ে ঢুকবো বুঝতে পারি না, গেট আর খুঁজে পাই না। গেটগুলো অদ্ভুত রকমের, দেখে মনে হয় বন্ধ, যাওয়ার রাস্তা নেই, আসলে তা নয়। গেট থেকে হোটেল অনেকটাই উঁচুতে, অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হল। গাছপালার মধ্যে নির্জন হোটেলটাকে দেখে মনে হয় ভূতের সিনেমার শুটিং-এর পক্ষে আদর্শ জায়গা।
যাই হোক হোটেলের ঘরে জিনিসপত্র রাখার সময় দেখি দিব্যি ঝকঝকে রোদ উঠেছে, তখন বাজে প্রায় দুপুর সাড়ে তিনটে। আমরাও চললাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে। ওখানে একটা মারুতি ওমনি ভাড়া করা হল আরু, বেতাব আর চন্দনওয়াড়ি যাবার জন্য। ভাড়া নিলো ২১০০টাকা। যাই হোক, প্রথমে গেলাম আরুভ্যালি। চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা অপূর্ব সুন্দর জায়গা। রাস্তার একদিকে চলছে লিডার নদী, পাহাড়, জঙ্গল সব মিলিয়ে দারুণ অভিজ্ঞতা। কিন্তু এতো লোক আর এতো দোকানপাট, মেলা বসে গিয়েছে মনে হচ্ছিল। তার মাঝেই ছাগল, বিড়াল, খরগোশ এসব নিয়ে ছবি তোলার জন্য সমানে লোকজনের ঝুলোঝুলি। অবশেষে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বড়ো মেয়ে খরগোশ কোলে নিয়ে ছবি তুলল একটা। সেখান থেকে ফেরার সময় এক জায়গায় দাঁড়ালাম, জায়গাটা এতো সুন্দর, ছবি তুললাম কিছু। কিন্তু কোন ক্যামেরার সাধ্যি নেই ঐ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ধরে রাখার । তাই দুচোখ ভরে শুধু দেখলাম, আর মনের মধ্যে রেখে দিলাম।
এবার গাড়ি চললো চন্দনওয়াড়ির দিকে। চন্দনওয়াড়ি বেশ উপরে। এখান থেকেই অমরনাথ যাত্রা শুরু হয়। রাস্তায় যেতে যেতে চোখ লেগে গিয়েছিল, হঠাৎ চোখ খুলে দেখি সামনে বরফে মোড়া সাদা পাহাড়, এমনি পাথুরে পাহাড়ের গায়ে নেমে এসেছে বরফ হয়ে যাওয়া জলের ধারা। চন্দনওয়াড়িতে বেশ ঠাণ্ডা ছিল। বরফের উপরে এত লোকজন যাচ্ছে যে তার সাদা রঙে পড়েছে কাদার প্রলেপ। তাতেই বড়োকন্যেকে নিয়ে তার বাবা বেশ খানিকটা গেল, আমি আর ছোটোজন একটু গিয়ে আর যাইনি, পা পিছলে যাচ্ছিল। ওখান থেকে যখন বেরোলাম বাজে প্রায় ছটা মতো। এমনিতে এই গরমে কাশ্মীরে সন্ধ্যা হয় সাতটা পেরিয়ে, অন্ধকার হতে হতে রাত আটটা বেজে যায়। কিন্তু মেঘ করছিলো বলে আলো কমে আসছিল।
এবারের গন্তব্য বেতাবভ্যালি। রাস্তার উপরের এক জায়গা থেকে পুরো বেতাব ভ্যালিটা দেখা যায়। জায়গা টাতে কতোদিন আগে বেতাব সিনেমার শুটিং হয়েছিল বলে নামটাই বেতাব ভ্যালি হয়ে গেছে। সুন্দর সাজানো জায়গা, বড়োসড়ো পার্কের মতো। । ভিতর দিয়ে একটা নদী বয়ে গেছে। ড্রাইভার বলেছিলো নিচে যাওয়ার কথা, কিন্তু আমাদের তখন এনার্জি শেষ, তাছাড়া বৃষ্টি ও পড়ছিলো টিপটিপ করে। উপর থেকেই কিছু ছবি তোলা হল। আমরা ফিরে গেলাম পহেলগাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে, সেখান থেকে হোটেলে। রাতে ওখানেই খাওয়া দাওয়া করা হল। ঠাণ্ডা বেশ বাড়ছিল, পরিশ্রান্তও ছিলাম। খেয়ে দেয়ে সোজা বিছানায়, ঘুমের দেশে।
৩০শে মে সকালে উঠে দেখি চারপাশে ঝকঝকে রোদ। প্রথমেই যে কথাটা মনে হল— আবহাওয়া ভালো, অতএব আমরা আজ বৈশারণ ভ্যালি যেতে পারি। সকাল সকাল তৈরি হয়ে মেয়েদের তাড়া দিয়ে তৈরি করে জলখাবার খেয়ে একেবারে বেরিয়ে পড়ব। ডাইনিং হলে আমরা ছাড়াও আরো দুটি পরিবার ব্রেকফাস্টের জন্য বসেছিল। বাঙালী নয়, অন্য কোন রাজ্যের। তখন আমার মনে হচ্ছিল কী অদ্ভুত ব্যাপার, এই যে আমরা কাশ্মীরে বেড়াতে এসেছি, আমাদের মতোই কতো লোক বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে, বিভিন্ন রাজ্যের, তাদের ভাষা সংস্কৃতি, খাওয়াদাওয়া সব আলাদা। প্রত্যেকের নিজস্বতা রয়েছে, আবার আমরা সবাই একটাই দেশের মানুষ। ঠিক সেই সময় পাশের টেবিলে বসতে আসা এক মহিলা জানতে চান আমরা কোথা থেকে আসছি। তাঁরা আসছেন মহারাষ্ট্র থেকে, এর আগে আমাদের এক গুজরাটি পরিবারের সাথে কথা হয়েছিল। উনিও বললেন, বেড়াতে এলে কত জায়গার লোকের সাথে দেখা হয়। বেশ আলাপী মানুষ। আমাদের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, সব বিল মিটিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম বৈশারণ ভ্যালির উদ্দেশ্যে।
বৈশারণ যেতে হলে ঘোড়াতে চেপেই যেতে হবে। সুতরাং ঘোড়াওলাদের সাথে দর কষাকষি করতে হবে। এ কাজটি আমার কর্তা একেবারেই পারে না। আমি এসবে মাথা ঘামাতে চাইনি, তাই ওদের কথায় ছিলাম না, পরে বুঝেছি খুব ভুল করেছি। চারটে না পাঁচটি স্পট দেখাবে বলে জন প্রতি ২৫০০ টাকা করে নিয়েছে, যা অত্যন্ত বেশি। আমি পরে বলেছিলাম পুরো টাকা না দিতে, কিন্তু তিনি অত্যন্ত ভালোমানুষ। কথার খেলাপ করবেন না। সেই দশহাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে এলেন। এটা আমার খুব গায়ে লেগেছে। খুব বেশি হলে ২০০০ পর্যন্ত ওঠা উচিত, এর বেশি এক পয়সাও নয়। কান্নি ভ্যালি দেখানোর নাম করে ওর কাছে আরও ৩০০ টাকা করে বাড়তি নিয়েছে, অথচ সেটা কিচ্ছু না, যাওয়ার পথে দূর থেকে একটা জায়গায় কিছু পাথর ছড়ানো আছে দেখিয়ে বলে ওটি কান্নি ভ্যালি। আমি বলেছিলাম দরকার নেই, কিন্তু ঐ— এসেছি যখন দেখেই যাই। এভাবেই ঠকে যাওয়া। যাই হোক, বৈশারণ ভ্যালি যাওয়ার দুটো রাস্তা আছে, একটা শর্টকাট— যেটা অত্যন্ত খারাপ, আরেকটায় অনেকটা রাস্তাই পিচ রাস্তা দিয়ে যাওয়া— একটু ঘুরপথ, কিন্তু ভালো। একজায়গায় এসে ওরা বললো,এটা দেবীয়ান ভ্যালি,এখানে রাজা হরি সিং শিকার করতে আসতেন। এরপরই শুরু হল যে রাস্তা, তাকে রাস্তা বলা যায় না। বড়ো বড়ো গাছগুলোর শিকড়ের পাশে পাশে একটু করে মাটিতে কোনরকমে ঘোড়ার পা রেখে চলা, খাড়া চড়াই! সে যে কি ভয়ংকর! প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল এই বুঝি পড়ে গেলাম! প্রাণ হাতে করে চলা কাকে বলে পদে পদে বুঝতে পারছিলাম।
অবশেষে অনেক কষ্টে এসে পৌঁছলাম বৈশারণ ভ্যালি। সামনে অজস্র ঘোড়া, আমরাও নামার পর ঘোড়ার লোক দুজন ওদের নিয়ে গেল। আমরা টিকিট কেটে ঢুকলাম। তবে জায়গাটা সত্যিই অসাধারণ! যেদিকে তাকাই সে দিকটাই অপূর্ব! তবে ঐ — প্রচুর ট্যুরিস্ট আসে বলে হাজারটা দোকান, অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের পসরা সাজানো। জিপলাইনিং ছিল, অনেকেই করছিলেন। এতো সুন্দর প্রকৃতি কিন্তু বড়ো হট্টগোল। এতো হৈ হট্টগোলে আমার বড্ড অসুবিধা হয়। আমার মনে হয় যেন এই অপার সৌন্দর্যকে শান্ত ভাবে অনুভব করতে হয়। এত গোলমালে তা ব্যাহত হয়, অন্ততঃ আমার ক্ষেত্রে। আমরা একটু ঘোরাঘুরি করে, একটু পা ছড়িয়ে বসলাম, ছবিটবি তুললাম।
এবার বেরিয়ে এসে আর ঘোড়াওলাদের খুঁজে পাই না। খানিক পরে আমি একজনকে দেখতে পেয়ে ডাকি, সেও অন্যজনের খোঁজ জানে না। সে বলে— আমি অন্য জনকে কোথায় খুঁজব, আমার দুই ঘোড়ায় দুজন চলে চলো। আমি তো এভাবে যাব না, সবাই একসাথেই যাব। শেষে আমাদের ড্রাইভারকে ফোন করতে বলি কর্তাকে, কিন্তু ফোনে সিগন্যাল নেই। কী জ্বালাতন! ঐ অজস্র লোক আর ঘোড়ার মাঝে সেই ছেলেকে তো দেখতেই পাচ্ছি না, বোকার মতো তার ফোন নম্বর নিইনি বলে আফশোস হচ্ছে। আমি তো রেগে গিয়ে যাকে পেয়েছি তাকে ঝেড়ে যাচ্ছি। আমার মেয়েরা অবশ্য এতে বেজায় বিব্রত হয়, এগুলো ঠিক ভদ্র ব্যবহার নয় কিনা, তাদের এটিকেটে বাধে। যাইহোক একটু পরে সিগন্যাল পাওয়া যায়, ড্রাইভারকে ফোন করে জানানো হয়, তারপর ছেলেটি আসে। এসে বলে— আপলোগ ইতনে জলদি আ গয়ে? — আসলে আমাদের আজ তাড়াতাড়ি শ্রীনগর ফেরার ইচ্ছে, কারণ ২৮ তারিখ আমাদের শিকারায় করে ডাল লেকে ঘোরা হয়নি। আজও আমাদের হাউসবোটে থাকার কথা, আর ঐ শিকারাভ্রমণ হাউসবোট থেকেই করানোর কথা। নইলে আবার অন্যদিন নিজেদের করতে হবে। তাড়াতাড়ি না পৌঁছলে সূর্যাস্তের সময় যদি পেরিয়ে যায়! তার সাথে গোদের উপর বিষফোঁড়া শ্রীনগরের বিচ্ছিরি জ্যাম। আর বৈশারণের হৈচৈয়ের মধ্যে বসে থেকেই বা কী করব? যাই হোক আসার সময় ঘোড়াওলারা বাজে রাস্তা দিয়েই নিয়ে এল যদিও, দেখা হয়ে গেলো দুটো রাস্তাই।
এবার চললাম শ্রীনগর। খেতে বসে যাতে বেশি সময় না যায়, তাই রাস্তায় একটা ছোট্ট নিরিবিলি রেস্তোরাঁ থেকে স্যান্ডউইচ প্যাক করে নিলাম। পম্পোরে একটা দোকান থেকে জাফরান কিনলাম। কিন্তু তাড়া থাকলেই হবে কী! হঠাৎ আমাদের গাড়ির সঙ্গে আরেকটা গাড়ির ধাক্কা লাগল, ফলে দুই ড্রাইভারের বচসায় খানিক সময় গেল। শ্রীনগর ফিরে হাউসবোটে জিনিস পত্র রেখে একটু ফ্রেশ হয়ে আমরা শিকারা চড়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছি, এদিকে শিকারাচালককে আবার পাওয়া যায় না! আমি তো ভাবলাম গেল সব ,হাউসবোট থেকেই সূর্যাস্ত দেখতে হবে। অনেকক্ষণ পর তিনি এলেন, আমাদের নিয়ে চললেন ডাললেক ঘোরাতে। এটা একটা দারুণ অভিজ্ঞতা। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক থেকে অন্য শিকারায় করে লোকজন কাছে এসে এটা ওটা বিক্রি করতে চাইছে। আমি শিকারায় বসেই কাওয়াহ (ওখানকার চা) খেলাম। ইতিমধ্যে সূর্যাস্তের আলো পড়েছে ডাললেকের জলে। শিকারায় বসে দেখতে কী যে অপূর্ব লাগছে বলে বোঝানো যাবে না। শিকারায় করে চললাম ভাসমান বাজার দেখতে। এখানে শিকারায় চা, কাবাব, পকোড়া , ম্যাগির মতো খাবারের জিনিস, গয়না, ছোট ছোট কাঠের জিনিস, জামাকাপড়, শাল সোয়েটার সব বিক্রি হচ্ছে। আমরা টুকটাক কিছু জিনিস কিনলাম, পকোড়া খেলাম। তারপর সন্ধ্যা হলে ফিরে এলাম হাউসবোটে।
আজাজ ভাই, যাঁর হাউসবোটে আমরা ছিলাম, তাঁর শাল তৈরীর কারখানা আছে। বহুবছর ধরে পুরুষানুক্রমে তাঁরা প্রতি শীতকালে কলকাতা যান শাল নিয়ে। তিনি নিয়ে এসেছিলেন তাঁর শালের সম্ভার। কী যে অপূর্ব সুন্দর সব শাল— যা দেখি, সবই ভালো লাগে। তবে তিনি বললেন নতুন প্রজন্ম এই কাজে উৎসাহী নয়, কারিগরের সংখ্যা ক্রমশঃ কমছে। ওনার কাছেই দেখি শাহতুষ শাল যার দাম তিন লক্ষেরও বেশি। গরম অথচ খুব পাতলা, আংটির মধ্যে দিয়ে গলে গেল। এই শাল যে জন্তুর পশম দিয়ে তৈরি, তারা হিমালয়ের অনেক উঁচুতে থাকে। তারা বিপন্ন প্রজাতিতে পরিণত হওয়ায় এখন আর এই শাল বানানো নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। সারা সন্ধ্যা জুড়ে চললো এসব, কয়েকটা কিনলাম সাধ্যমতো। এরপর খেয়েদেয়ে ঘুম। পরেরদিন আমরা যাব গুলমার্গ।