গত সংখ্যায় সাক্ষাৎকারে ধরা পড়েছিলেন তাঁর গদ্যের মতোই সাবলীল ও বৈঠকি মেজাজের এক সুনীল। এই সংখ্যাতে তাঁর সেই সপ্রতিভ কথকতার বাকি অংশ। আলোচনা হচ্ছিল, বুদ্ধদেব বসুর “কবিতা” পত্রিকা সম্পাদনা নিয়ে।
সুনীল: কৃত্তিবাসে প্রথম প্রথম করতাম, সব কবিতার উত্তর দেওয়া। কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর মতো অতোটা পারতাম না। অবশ্য পরে কবিদের সংখ্যা অনেক বেড়েও যায় এবং আমরা এতো লেখা পেতাম যে সব লেখার উত্তর দেওয়া আমার একার পক্ষে সম্ভব হতো না। আমি এখনো ওই ব্যাপারে বুদ্ধদেব বসুকে নমস্য মনে করি। ওই সময় আরেকটা পত্রিকা ছিলো- ‘পূর্বাশা’, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সম্পাদনায়। তিনিও উত্তর দিতেন, কবিদের ডেকে পাঠাতেন। তাঁর চিঠি পেয়েই আমি প্রথম পূর্বাশা অফিসে যাই। এখন তো আর এরকম দেখি না।
আর্যনীল: কবিতা নিয়ে একটা সিরিয়াস স্টাডি কোন্ কবিতার কাগজ করছে বলে আপনার মনে হয়?
সুনীল: সেটা বললে এখন অনেকে চটে যাবে। এখন এই কাজটা করছে একটা প্রাতিষ্ঠানিক কাগজ- দেশ পত্রিকা। দেশ পত্রিকায় যত নতুন কবিদের কবিতা ছাপা হয়, অন্য কোন পত্রিকাতে তা বেরোয় না। ধরো, প্রতি সংখ্যায় দেশ পত্রিকায় কুড়ি থেকে পঁচিশটা কবিতে বেরোয়, মানে মাসে পঞ্চাশটা। আর কোন পত্রিকা আছে যেখানে মাসে পঞ্চাশটা কবিতে বের হয়? নেই তো! থাকলে ভালো হতো। দেশ পত্রিকার মতো আরো দু-চারটি পত্রিকা থাকা উচিত ছিলো। সলিড কয়েকটা লিটল ম্যাগাজিন থাকা উচিত ছিলো যেগুলো নিয়মিত- নিয়মিত না হোক্, বছরে তিন-চারটে সংখ্যা অন্তত বার করবে, বছরের পর বছর ধরে। দানা বাঁধতে হবে তো। কয়েক বছর না চললে একটা পত্রিকা দানা বাঁধে না। পত্রিকার চরিত্র গড়ে ওঠে না। বা কেউ এতোটা সময় দিতে পারছে না।
আর্যনীল: দেশে যারা আপনার কাছে চিঠি পাঠায়, আপনার পক্ষে কি তাদের চিঠি দেওয়া সম্ভব হয়?
সুনীল: আমরা তো মনোনীত চিঠির উত্তর দিই, কিন্তু অমনোনীত চিঠির উত্তর দিতে পারি না। বুদ্ধদেব বসু যেমন করতেন, অমনোনীত হলেও উত্তর দিতেন- তোমার এখানে এই একটা খুঁত আছে, এই আছে- আমরা সেটা পারি না।
আর্যনীল: এই প্রসঙ্গে বলি, নব্বই সালে আমি আপনাকে দুটি কবিতা পাঠিয়েছিলাম আপনার পড়ে কেমন লাগলো তা জানার জন্য।
সুনীল: আমি বোধহয় তার উত্তর দিয়েছিলাম, না? সে তুমি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে লিখেছিলে বলে।
আর্যনীল: আমি তো মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
সুনীল: যারা ব্যক্তিগতভাবে লেখে তাদের অনেক সময় উত্তর দেবার চেষ্টা করি। সবসময় সেটাও সম্ভব হয়ে ওঠে না।
আর্যনীল: আপনার সমসাময়িক কবিদের পাশাপাশি আপনার কবিতা রাখলে যেটা আমার প্রধান বৈশিষ্ট্য বলে মনে হয়, তা হলো, আপনার কবিতায় বিষয়বৈচিত্র্য খুব বেশি। বিদেশী সাহিত্যের প্রতি আপনার অনুরাগই কি এর কারণ?
সুনীল: আমার মনে হয় সেযুগের কবিতার মকশটা আমার কবিতার আঙ্গিকের মধ্যে পড়ে। বিষয়বৈচিত্র্য তো ওইভাবে হয় না, যেটা যখন মাথায় আসে- কিছু করার নেই। আমার জীবনযাপন অনেক বিচিত্র বলে হয়তো বিচিত্র বিষয়বস্তু… আমার জীবন থেকেই তো বিষয় নিই।
আর্যনীল: যদি শক্তির কবিতা কিংবা শরৎকুমারের কবিতে দেখি, প্রেম-প্রকৃতি- ভ্রমণের বাইরে আর বিষয় নেই। কিন্তু আপনার কবিতায় যে নানারকমের বিষয় আছে, এর দুটো কারণ হতে পারে। এক হচ্ছে, আপনার বিদেশী সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক, দ্বিতীয়, আপনার জীবনযাপনের বৈচিত্র্য। এছাড়া আপনার সাংবাদিক জীবনও কি আপনার কবিতাকে কখনও প্রভাবিত করেছে?
সুনীল: না, আমি সেই অর্থে সাংবাদিক কখনোই ছিলাম না। যারা সংবাদ সংগ্রহ করে, তাদের দলে আমি কখনো ছিলাম না। আমি অফিসে বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, যাকে বলে ‘ফিচার’ লিখতাম। আর কখনও-সখনও, ধরো, চাসনালার খনিতে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, আমায় পাঠিয়ে দিয়েছে। সেটা এই জন্য নয় যে আমি চাসনালা খনিতে কেন দুর্ঘটনা হলো, কি হলো, না-হলো লিখবো। তার জন্য অন্য রিপোর্টাররা যায়। আমি শুধু ঘুরেফিরে আমার যা অনুভূতি, তাই লিখেছি। বা গঙ্গাসাগর মেলা। বা যখন ইন্দিরা গান্ধী মারা গেলেন, তখন আমায় পাঠিয়েছিলো।
আর্যনীল: একবার মনে হচ্ছে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বলেছিলেন, আজকের সাংবাদিকতা পাল্টাচ্ছে। এবং উদাহরণ দিয়েছিলেন যে আপনি গঙ্গাসাগর মেলার বর্ণনায় লিখেছেন যে সেখানে ইন্দিরা গান্ধী বক্তৃতা দিচ্ছেন এবং সেটা শোনার জন্য নাগা সন্ন্যাসীরা ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছেন।
সুনীল: হ্যাঁ, এটা আমার দৃষ্টিভঙ্গির রচনা, সংবাদপত্রের রচনা এটাকে বলা যায় না। তো সংবাদপত্র এটা ব্যবহার করে, অনেক সময় রিপোর্টারের তথ্যমূলক লেখা পড়তে পড়তে লোকেরা ক্লান্ত হয়ে যায়। যেমন মার্কোয়েসও তো কিছু কিছু সাংবাদিকতা করেছেন।
আর্যনীল: রবীন্দ্রনাথের কবিতায় একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, উনি হয়তো বিদেশে বসে লিখেছেন, কিন্তু প্রবাসজীবনের কোনো অনুষঙ্গ ওঁর কবিতায় নেই। মানে বুয়েনস এয়ার্সে বসে লিখছেন, কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে না ওটা বুয়েনস এয়ার্সে বসে লেখা। সেইরকম আপনিও যখন আইওয়াতে ছিলেন, আপনার প্রবাসজীবনের ছায়া আপনার লেখাতে একেবারেই পড়েনি।
সুনীল: ঠিকই। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে ওটা খুবই বিস্ময়কর। বহু দেশে ঘুরেছেন, দক্ষিণ আমেরিকায় বসে লিখেছেন বাংলার বর্ষার কথা। এটাই বোধহয় একটা ট্র্যাডিশন। আমিও প্রায় লিখিনি। গদ্যে কিছু কিছু আছে, কবিতায় প্রায় লিখিইনি।
আর্যনীল: কিন্তু আপনি যখন ঘরে বসে কবিতা লিখেছেন, আর জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছেন, সেখান থেকে দু-একটা অনুষঙ্গ আপনার মনে আসেনি?
সুনীল: আমি রবীন্দ্রনাথের মতো অতোটা strict ছিলাম না। রবীন্দ্রনাথ ওটা ইচ্ছে করেই করেছেন। তবে আমারও মনটা যেহেতু এখানেই পড়ে থাকতো তাই কবিতায় খুব কম এসেছে ওটা। আমি তো লিখেছিলাম যে আইওয়াতে আমি জানালা দিয়ে কলকাতা দেখতে পাই। তবে গদ্যে কিন্তু ওখানকার অনেক কথা এসেছে।
আর্যনীল: নব্বই সালের পরে, কয়েকটা ছোটখাটো পত্রিকায়, যেমন নির্মল বসাকের ‘ইন্দ্রাণী’ পত্রিকায় আপনার একটা কবিতা দেখি। এবং ঐ সময় ৯০ থেকে ৯৪-এর মধ্যে দেশে আপনার কবিতাও দেখি- কবিতাগুলোকে আপনি খুব সাংকেতিক করে তুলতে চাইছেন। এক একটা লাইনে এক একটা অস্পষ্ট চিত্র থাকছে। আপনি খুব পরিষ্কার ছবি আঁকেন, কিন্তু এই কবিতাগুলোয় ছবি অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো।
সুনীল: সব নয়। আমার কবিতা লেখার ব্যাপার হচ্ছে কি, আমি নানারকম কবিতা লিখি। তাতে আমার কোনো লজ্জা নেই। অনেকে যেমন মনে করেন যে বর্ণনামূলক কবিতা লেখা উচিত না। কিন্তু আমি মনে করি আজ যদি দেশে একটা দাঙ্গা লাগে, তাহলে আমি স্টেটফরোয়ার্ড দাঙ্গার একটা বর্ণনামূলক কবিতা লিখে দেবো।
আর্যনীল: সেপ্টেম্বার অন্ যশোর রোড্ …
সুনীল: হ্যাঁ, যেমন বাবরি মসজিদ যখন ধ্বংস হলো, তখন ‘হায় ধর্ম’ বলে একটা কবিতা লিখেছি, তাতে ঠিক এখানে কী ঘটছে, ওখানে কী ঘটছে, এইসব লিখেছি। ‘সেই মুহূর্তে নীরা’ বইটার শেষের দিকে একটা কবিতা আছে একেবারে গদ্যের নতো। সোনাগাছির একটি বেশ্যা তার মাকে চিঠি লিখছে, তার যেরকম ভাষা হওয়া উচিত, সেই ভাষাতে আমি লিখেছি। সে ভাষাটা দুর্বল, কাঁচা কাঁচা- সে তো আর ভালো বাংলা লিখবে না। এগুলো আমার লিখতে ইচ্ছে করে। আবার কখনো কখনো হয়তো পুরো সিম্বলিক লেখা লিখলাম।
আর্যনীল: সুনীলদা, ‘স্মৃতির শহর’ বলে আপনার যে কবিতার সংকলন, তার নেপথ্যের কথা কিছু বলুন।
সুনীল: এক সময় কলকাতা শহরে ছেলেবেলা নিয়ে নস্টালজিয়া এসে আমায় ভর করেছিলো। তখন দুটো-তিনটে কবিতে লেখার পর মনে হয় যে এটা নিয়ে সিরিজ লেখা যেতে পারে। কিংবা বলা যেতে পারে কবিতায় স্মৃতিকথা লেখা।
আর্যনীল: ‘স্মৃতির শহর’-এর প্রথম কবিতা কবে লেখা?
সুনীল: ওটা আমার মনে হয় আশিতে লেখা। বেশিরভাগটাই আশিতে লেখা।
পারমিতা: দিকশূন্যপুরের কনসেপ্টটা কীভাবে এলো আপনার কাছে?
সুনীল: দিকশূন্যপুর তো নীললোহিতের। নীললোহিত একটা রোম্যান্টিক ধরনের চরিত্র। নীললোহিত কিন্তু আমি নয়। সেই চরিত্র অনুযায়ী সে মাঝে মাঝে পালিয়ে যেতে চায়। গিয়ে সে একটা জায়গা আবিষ্কার করেছে- দিকশূন্যপুর। যেখানে টাকাপয়সা নেই। এটা আমাদের অনেকসময় ভাবতে তো ভালো লাগে। টাকাপয়সার চিন্তাই তো আমার জীবনটাকে নষ্ট করে দিলো। জীবনটা হয়তো সুন্দর করা যেতে পারে এমন একটা জায়গায় যেখানে টাকাপয়সা নেই। সবাই বিনিময় করছে- ভালোবাসা বিনিময় করছে, জিনিসপত্র বিনিময় করছে। একধরনের ইউটোপিয়া বলতে পারো। তা ও’রম দিকশূন্যপুর আমি সৃষ্টি করেছি। অনেকে জিগেস করে- ঠিকানাটা কোথায়? কী করে যাওয়া যায়? আমি বলি, ওটা নিজেকে আবিষ্কার করতে হয়।
আমি এর উল্টো একটা জায়গা নিয়ে দু-তিনবার লিখেছি- সেটা হচ্ছে গড়বন্দীপুর। সেটা দিকশূন্যপুরের ঠিক উল্টো। যেখানে মানুষেরা সামান্য স্বার্থ নিয়ে মারামারি করে, যেখানে লোকে লোককে ঠকায়, যেখানে মেয়েদের ওপর অত্যাচার হয়- আমাদের দেশে যেটা আছে, নিষ্ঠুর বাস্তব। দুটো দিক নিয়েই আমি লেখবার চেষ্টা করেছি, দিকশূন্যপুরটাই আমার একমাত্র অবলম্বন নয়। বাস্তব থেকে আমি চোখ ফেরাইনি। গড়বন্দীপুর থেকে পালিয়ে যাবার জন্য মাঝে মাঝে দিকশূন্যপুর ব্যবহার করি।
পারমিতা: কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ কি দিকশূন্যপুরের আইডিয়ার পেছনে সচেতনভাবে কাজ করেছে?
সুনীল: না। এটাকে তুমি বলতে পারো একধরনের খুব প্রাইমারি সোশালিজম। আমার মনে মনে এই ঝোঁকটা আছে, যে আমাদের দেশের পক্ষে একধরনের সোশালিজম দরকার। যে সোশালিজমের পরীক্ষাটা হয়েছে, যেটা ভেঙে পড়লো, সেটা নয়। অন্য একধরনের সোশালিজম আবিষ্কার করতে হবে হয়তো। যেখানে কেউ কারো ওপর জবরদস্তি করবে না, যেখানে পার্টির লোকেরাই সর্বেসর্বা হবে না। সোশালিস্ট দেশগুলো আমি ঘুরে ঘুরে দেখেছি, আমার একটা বই আছে ‘ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ’ বলে। কেন এর পতন হলো। দেখা যাচ্ছে যে সিস্টেমের মধ্যে একটা গোষ্ঠী তৈরি হয়ে যায়। চীনেতে এখনো মেয়েরা বলে, বিবাহের জন্য সবচেয়ে যোগ্য পুরুষ কারা? হয় যার পার্টি মেম্বারশিপ আছে, অথবা যার বিদেশে কেউ আছে। এ হচ্ছে চীনের এখনকার অবস্থা। এটা তো খুব দুঃখের ব্যাপার।
আর্যনীল: সুনীলদা, এই সময়ের কবিতা, অর্থাৎ নব্বই দশকের কবিতা আপনার কেমন লাগে?
সুনীল: ভাষা পাল্টে গেছে অনেকটা। পরিষ্কার বুঝতে পারি আমরা যে ভাষায় কবিতা লিখেছি, তার তুলনায় এখনকার কবিতার ভাষা অন্য। যেমন ধরো জয় গোস্বামীর কবিতা। জয়ের কবিতার মধ্যে বাস্তবতাও আছে, কথ্যভঙ্গিও আছে, আবার একটা উদ্দাম কল্পনাও আছে। আরেকটা দেখেছি, একদম নতুন প্রজন্মের কবি যাঁরা, তাদের ভাষায় অনেকটা রহস্যময়তা থাকলেও তারা কিন্তু মুখের ভাষাই ব্যবহার করছে। সেটা ভালোই। এটা কিন্তু trend, বিশ্বকবিতার শক্ত ব্যাপার এটা, মুখের ভাষা বজায় রেখে তার মধ্যে কবিত্ব আনা। একটা বর্ডারলাইন আছে, একটু এদিক-ওদিক হলেই গদ্যের দিকে চলে যাবে। গদ্যতে লেখা হলেও কবিতা হয়, কিন্তু সব কবিতাই কবিতা হয় না, গদ্যের দিকে চলে যায়।
আর্যনীল: সেইজন্যই আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যে কবিতাগুলো আর কবিতা হচ্ছে না, কতগুলো কথা হয়ে যাচ্ছে, স্কুলের দিদিমণিদের নিয়ে লেখা কবিতার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।
সুনীল: এখন তো কবিদের সংখ্যা অনেকে বেড়েছে, প্রচুর কবিতা লেখা হচ্ছে। এতো কবিতা তো সার্থক হতে পারে না। একটা সময়ে যতো কবিতা লেখা হয়, তার শতকরা দশটা কবিতা যদি ভালো হয় তো বুঝতে হবে যথেষ্ট। এতো যে কবিতা লেখা হচ্ছে দেখা গেলো তার মধ্যে থেকে পরবর্তীকালে অল্পকিছু কবিতে থেকে গেল। কাজেই লেখা হোক্ না।
আর্যনীল: আপনার একটা উপন্যাসের কথা মনে পড়লো প্রথমদিকের ‘যুবকযুবতী’-
সুনীল: ‘যুবকযুবতীরা’- আমি নামটাকে একটু আধুনিক করার জন্যে ‘যুবকযুবতীরা’ করে দিয়েছিলাম।
আর্যনীল: আচ্ছা, তো সেই যুবকযুবতীরা উপন্যাসের চরিত্রগুলো যেন মনে হয় যে আপনার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে লেখা।
সুনীল: হ্যাঁ, তবে প্রোটোটাইপ নয়। ঠিক এর মতো এই চরিত্র, ওর মতো ওটা, সেরকম নয়। মিলিয়ে মিশিয়ে করা।
আর্যনীল: হ্যাঁ, তবে লক্ষ্য করি যেটা, যে বিশেষ করে পুরুষচরিত্রগুলোর মধ্যে, এবং মহিলাচরিত্রগুলোর মধ্যেই যেন একটা আপাতনিষ্ঠুরতা আছে। এবং সেটা আপনার সমসাময়িক লেখক-কবিদের মধ্যে আমি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু আপনার মধ্যে কখনো দেখিনি।
সুনীল: নিষ্ঠুরতা একটা বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে আসে। বিচ্ছিন্নতাবোধে তো আমরা সবাই ভুগি। এখনো ওটা রয়ে গেছে। সবই আছে, বন্ধুবান্ধব সবকিছুই আছে, কিন্তু মাঝেমধ্যে এক ভীষণ নিঃসঙ্গতা পেয়ে বসে। কেউ এলেও তখন মনে হয়, না, এ নয়, একে দরকার নেই।
আর্যনীল: একটা গল্পের কথা মনে পড়লো, সন্দীপনের ‘চাইবাসা, চাইবাসা’- চারটে চিঠি- আপনার, শক্তির, সন্দীপনের। আমি সন্দীপনকে এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেছি, তবু আপনাকেও জিগেস করি, ঐ গল্পের চিঠিগুলো কি সত্যিকারের চিঠি?
সুনীল: খুব সম্ভবত। আমার চিঠিটা সম্ভবত সত্যিকারের।
আর্যনীল: সন্দীপনের বক্তব্য হচ্ছে চারটে চিঠিই সত্যি।
সুনীল: আমারটা বোধহয় সত্যি চিঠি ব্যবহার করেছে, শক্তিরটা আমি বলতে পারছি না। আরেকটা ব্যাপার জানো তো, সন্দীপনের লেখা থেকে একটা মিথ ছাড়িয়ে দেবার দরকার আছে। এই যে অরণ্যের দিনরাত্রি লেখা হয়েছিলো, আমরা কয়েকজন বন্ধু গিয়েছিলাম, সেই নিয়ে উপন্যাস, সেই দলের মধ্যে কিন্তু সন্দীপন ছিলো না। কিন্তু ও অনেক লেখাতে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে ও ছিলো। হয়তো ও মনে মনে ছিলো, বা পরবর্তীকালে ভেবেছে ওর থাকার দরকার ছিলো, আসলে কিন্তু ও ছিলো না।
আর্যনীল: চাইবাসাতে সন্দীপন একবার শক্তির সঙ্গে যান, সেটাতে আপনি ছিলেন না।
সুনীল: আমি পরে যোগ দিয়েছিলাম।
আর্যনীল: সেটা নিয়েই ‘জঙ্গলের দিনরাত্রি’ লেখা।
সুনীল: জঙ্গলের দিনরাত্রি কিন্তু অরণ্যের দিনরাত্রির একেবারে সমান্তরাল। সন্দীপন যে ঘটনাগুলো লিখেছে, তা প্রায় অরণ্যের দিনরাত্রিরই মতো। শক্তি আর সন্দীপন যেখানে ছিলো, সেখানকার কথা কিন্তু লেখেনি।
আর্যনীল: একটা জায়গায় সন্দীপন লিখেছেন, শক্তি একটা বাংলোয় গিয়ে উঠেছেন এবং সেখানে আদিবাসী একটি মেয়ে সেখানে তাঁদের কাছে খাবার চায়। আসলে ঠিক তার উল্টোটাই ঘটেছিলো। ওঁরা গিয়েই আদিবাসী এক মহিলার কাছ থেকে…
সুবীল: খাবার চেয়েছিলেন।
আর্যনীল: তো সেই ‘চাইবাসা, চাইবাসা’র চিঠিগুলো যদি সত্যি হয়ে থাকে, সেগুলো পড়তে পড়তেও আমার সেই কথা মনে হয়- বাকি দুজনের মধ্যে একটা নিষ্ঠুরতা দেখতে পারি। আপনার মধ্যে কিন্তু কোমলতাটা বেশি লক্ষ্য করা যায়।
সুনীল: তা হয়তো হতে পারে।
আর্যনীল: পার্থসারথী চৌধুরী, কৃত্তিবাসের, একবার আমায় বলেছিলেন, “সুনীল ছিলো ন্যাচারাল লিডার-- কিন্তু আপনার লেখালিখি থেকে ও আপনার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়, আপনি বরাবরই একটু লাজুক প্রকৃতির। তবে আপনার কৃত্তিবাসের বন্ধুরা তা বলে না।
সুনীল: না, আমি সর্দারি করি না। এটা হয়তো ঠিক, আমাকে কেন্দ্র করে দলটা গড়ে ওঠে। তার মানে এই নয় যে আমি লোকজনের মাথার ওপরে লাঠি ঘোরাতাম। আমি ওদেরই একজন, সকলেরই একজন।
আর্যনীল: হ্যাঁ, উনি তো খুব ভালোবাসা নিয়েই কথাটা বলেছিলেন।
পারমিতা: আপনি যখন লেখেন, তখন এতো ধরনের লেখার মধ্যে নিজের মানসিক প্রস্তুতি ও সময়টাকে কীভাবে বন্টন করে দেন? ধরুন, শারদীয়ার লেখা লিখছেন, উপন্যাস, কবিতা, গল্প, ছোটদের লেখা- কীভাবে নিজেকে ভাগ করে দেন?
সুনীল: আমি মনে করি, আমার চারটে সত্ত্বা আছে, বুঝেছো? অনেক সময় লোকের যেমন অল্টার ইগো থাকে, আমার সেরকম চারটে সত্ত্বা। আমি যখন ছোটদের উপন্যাস লিখি, তখন আমার বয়স হয়ে যায় বারো বছর। তখন আমি বারো বছরের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে জগৎটাকে দেখি। সেই যে কৌতূহল, সেই যে বিস্ময়বোধ, সেইটা নিয়ে ছোটদের উপন্যাস লিখি। যখন নীললোহিত নামে লিখি, তখন আমার বয়স হয়ে যায় সাতাশ। আরেকটা, সনাতন পাঠক বলে একটা ছদ্মনাম ছিলো আমার একসময়, সেটা দিয়ে আমি বিশ্ব-পরিপ্রেক্ষিত দেখার চেষ্টা করতাম। আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যে নামটা, সে কখনো কবিতা লেখে, কখনো উপন্যাস লেখে। বিভিন্ন বয়স তার মধ্যে খেলা করে।
এটায় একটা মজা আছে। আমি গদ্যগুলো সাধারণত লিখি সকাল বেলা। আমার লেখার সময় হচ্ছে নটা থেকে একটা। বলতে গেলে প্রায় নিয়মিতই আমি আমার লেখার টেবিলে বসি এবং ওগুলো লিখি। কিন্তু হঠাৎ একদিন হয়তো রাত্তির একটার সময় একটা কবিতার লাইন মাথায় আসে এবং উঠে বসে কবিতা লিখি। তখন নিজেই ভাবি, একি, এখন লিখছি কেন! কিন্তু তখন কবিতা এমন তাড়া করে যে প্রথম দুটো লাইন না লিখলে হয়তো কবিতাটি হারিয়ে যাবে।
পারমিতা: সেটা শুধু কবিতার ক্ষেত্রে হয়?
সুনীল: শুধু কবিতার ক্ষেত্রে। গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে ওরকম হয় না।
আর্যনীল: আপনাকে দেখেছি, অফিসে বসে…
সুনীল: অফিসে বসে আমি সাধারণত অফিসের লেখা লিখি। সম্পাদকীয় লিখতে হয়, বা কখনো হয়তো উপন্যাসের ইনস্টলমেন্টও লিখেছি। যখন আর সময় নেই, লিখতে হয়েছে। অফিসে বসে কবিতা সাধারণত লিখি না। দু-একটা যে লিখি নি তা নয়, লিটল ম্যাগাজিনের কেউ হয়তো অনু্রোধ করেছে, লিখে দিয়েছি। অনেকে বলেছে, কী করে লেখেন? এতো লোক যে কথা বলছে এর মধ্যে লেখেন কী করে? তখন মাথার মধ্যে যেন অনেকগুলো কম্পার্টমেন্ট হয়ে যায়… অন্য লোকেরা কথা বলছে, আমি শুনছি, কথা বলছি, কিন্তু সেটা ভেতরে যাচ্ছে না।
অনেকেই বলেন একসঙ্গে ছোটদের উপন্যাস, বড়দের উপন্যাস, আবার একটা কবিতা লেখেন কী করে? আমি বলি, মাইকেল মধুসূদনের জীবনীতে আছে না, তিনটে লেখা একসঙ্গে ডিক্টেট করছেন? তখন আমার খুব বিস্ময়কর মনে হতো। এখন মনে হয়, সেটা হয়তো শক্ত নয়, পারা যায়।
আর্যনীল: কিন্তু সেটা কি সত্যি ছিলো?
সুনীল: কিছুদিনের জন্য। সেটা ওঁর জীবনীতেও আছে। সারাজীবন হয়তো করেননি, একবার দুবার করেছেন। আমিও তো অনেকসময় করি, সকালে একটা ছোটদের উপন্যাস খানিকটা লিখলাম। লিখেই মনে হয়, আরে, অন্যটাও তো খানিকটা লিখতে হবে। তো আগেরটা থামিয়ে দিয়ে অন্যটা লিখলাম। ঐগুলোর জন্য মাথার মধ্যে বিভিন্ন খোপ আছে।
আর্যনীল: কিন্তু আপনার কি কখনো মনে হয় না যে এতো লেখা..
সুনীল: হ্যাঁ, আমার প্রায়ই একটা অনুতাপ হয় যে, এতো লেখা কেন আমাকে লিখতে হলো? আমাকে আবু সৈয়দ আইয়ুব একবার বলেছিলেন, আসলে আমাকে বলেননি, একজনকে চিঠিতে লিখেছিলেন, সে আমায় দেখিয়েছিলো- সুনীল এতো বেশি লিখে ওর গ্রেটনেসের সুযোগ হারাচ্ছে। কিন্তু তখন বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই আমাকে লিখতে হচ্ছিলো। তখন ভেবেছি গ্রেট হবার আমার কোন দরকার নেই। আমার বাঁচতে তো হবে। আমার ভাইবোনদের খাওয়াতে হবে। তখন লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম। তারপর ঐ চক্র থেকে আর বেরোতে পারছি না। এখন হয়তো, এই বয়সে, আস্তে আস্তে লেখাটা কমিয়ে দিচ্ছি। মাঝখানে কুড়ি-পঁচিশ বছর গেছে, পাগলের মতো গদ্য লিখতে হয়েছে। সেইজন্য আমার এখন অনুতাপ হয় যে, কেন এতো লিখলাম। না লিখলেও তো হতো। সেটা ঠিক।
পারমিতা: বাংলাদেশেও আপনার লেখা সমান জনপ্রিয়। সেখানকার অভিজ্ঞতার কথা বলুন।
সুনীল: বাংলাদেশে যেভাবে ওরা আমার লেখা পড়ে, তাতে অভিভূত হয়ে যেতে হয়। যেভাবে ওরা চিঠি লেখে, তাতে মনে হয় লেখা সার্থক হলো। নোবেল প্রাইজ পাওয়ার দরকার নেই, লোকে ভালো বলছে, তাই যথেষ্ট। কিছুদিন আগে, আমেরিকাতে জ্যাকসন হাইটস বলে নিউইয়র্কে যে রাস্তাটা আছে, যেখানে বাংলাদেশী অনেক দোকান-টোকান আছে, বাংলায় বিজ্ঞাপন দেখে, বাংলায় সাইনবোর্ড দেখা যায়, বাংলা পত্রিকা বার করে- ওখানে একটা বইয়ের দোকানে আমাকে একজন ডাকলো যে আমি কিছুক্ষণ বসবো, লোকেরা এসে বই কিনবে, আমি সই করে দেবো। দেখি যে দলে দলে ছেলেমেয়ে আসছে, বেশিরভাগই বাংলাদেশী। পশ্চিমবাংলার বাঙালিরা কিন্তু এতো বই পড়ে না। অনেকে এসে বলছে, তাদের চাকরি আছে, ওখানে সন্ধেবেলাতেও অনেকের চাকরি থাকে তো, সেই চাকরি নষ্ট করে তারা চলে এসেছে। আর একটি ছেলে আমার সামনে অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিলো। তাকে আমি বললাম, তুমি কিছু বলবে না? সে বললো, আমি দেখছি। আমি বললাম, তুমি বইটই পড়ো? সে একগাল হাসলো। সে বললো, আপনার একটা লেখাও আমার বাদ নেই এবং আপনার পূর্ব-পশ্চিম অতোবড়ো উপন্যাসখানা সে ছবার পড়েছে, আমি বললাম, তোমার তো গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে নাম উঠে যাওয়া উচিত। ও সত্যিই শেষে মুখস্থ বলতে আরম্ভ করলো, আমি থামিয়ে দিলাম। এই আন্তরিকতাটা, আবেগটা বাংলাদেশীর কাছ থেকেই বেশি পাওয়া যায়।
আর্যনীল: আসলে বাংলাভাষার প্রতি ভালোবাসা…
সুনীল: আমি যেখানেই যাই, কেনিয়াতেও গেলাম কি জাপানেই গেলাম, দেখেছি পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের তুলনায় বাংলাদেশীরা আমার কাছে আসে বেশি। টানাটানি করে। আমি একবার ফ্রাংকফুর্ট রেজিস্ট্রেশন থেকে বেরিয়ে আসছি, দেখি দুটো ছেলে দৌড়ে এসে বললো, আপনার নাম কি এই? বললো আমরা বাজি ফেলেছিলাম আপনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় না অন্য কেউ। বাজিতে জিতেছি, এখন আপনাকে আমাদের সংগে যেতে হবে। আমি বললাম, কোথায়? না, আমাদের বাড়িতে গিয়ে থাকতে হবে। আমি বললাম, সে কি, আমি তো হোটেলে উঠবো। ‘হোটেল-ফোটেল জানি না’ বলে জোর করে জিনিসপত্র তুলে বাড়িতে নিয়ে গেল, তারপর খাওয়াদাওয়া, বিরিয়ানি-টিরিয়ানি কত কি!
এবার বাংলাদেশের বিপক্ষে একটা কথা বলি। সবই তো ভালো বললে চলবে না। সেটা হচ্ছে কি, আমাদের সমস্ত বই ওরা জাল করছে। আমি তোমাদের পরে দেখাতেও পারি। জাল মানে, আগে করতো কি, রিপ্রিন্ট করতো। এখানে যে বইটা বেরোচ্ছে, ওখানেও ছাপা হচ্ছে। কাজেই তফাৎ বোঝা যেতো। এখন টেকনোলজির উন্নতির ফলে হুবহু ওই বইটা নকল করে ফেলছে। প্রথম আলো এখানে বেরোবার সাতদিনের মধ্যে বাংলাদেশে বেরিয়ে গেলো, একই কভার, একই ছাপা-- সব। ফলে বাংলাদেশে এখন আমরা খুব জনপ্রিয়, কিন্তু তাতে কোন উপার্জন নেই, পয়সা পাই না।
পারমিতা: এর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবার কোনো উপায় নেই?
সুনীল: আইনি ব্যবস্থা নেবে কী করে? নাম নেই তো কারো। আনন্দ পাবলিশার্সের বইটা আনন্দ পাবলিশার্সের নামেই নকল হয়ে যাচ্ছে। মলাট থেকে আরম্ভ করে অন্য সব নকল। ভেতরে আনন্দ পাবলিশার্সের নাম, ঐ দাম, ঐ সবকিছু। পাঠকরা বুঝতেই পারবে না যে এটা নকল। আমরা কয়েকজন লেখক ও প্রকাশক গিয়েছিলাম, শেখ হাসিনা, প্রধান মন্ত্রী, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। দেখালাম, পাশাপাশি দুটো বই। একটা আনন্দ পাবলিশার্সের, একটা জাল। জালটা আমরা কী করে ধরলাম? আমরা ধরতে পারি না, প্রকাশকরা, তাঁরা ঐ কাগজের কোয়ালিটি-টোয়ালিটি দেখে বুঝতে পারেন। দেখে শেখ হাসিনা হাসতে হাসতে বললেন, দেখেছেন? আমরা কী ভালো জাল করতে পারি? একদম ধরা যায় না? তারপর নিজেই বললেন, এটা যে বন্ধ করবো, কী করে বন্ধ করবো? আপনারাই বলে দিন না। আমরা বললাম, দেখুন এটা দেখে বোঝা যাচ্ছে না কে ছাপিয়েছে। কিন্তু এখানে তো অনেকেই অনেককে চেনে, নিশ্চয়ই জানে এটা কারা করছে।
আর্যনীল: র্যাকেটের লোকজন।
সুনীল: র্যাকেটের লোকজন। তা উনি বললেন, সে কি এরা বলবে? কেউ ভয়ে বলবে না। আর পুলিশ লাগালে তো পুলিশ ঘুষ খাবে। আরেকটা ওদের মনে কাজ করে যে, আমাদের বই ওখানে বিক্রি হলে টাকা এদেশে পাঠাতে হবে। আর জাল হলে তো তা হচ্ছে না, ওদের দেশের টাকা ওখানেই থেকে যাচ্ছে।
আর্যনীল: এর পাশাপাশি তো আনন্দের বইও আছে?
সুনীল: এখন আর যাচ্ছে না। আগে তো যেতই।
পারমিতা: তার মানে এখন যদি ওখানে নতুন বই বেরোয়, সবই জাল?
সুনীল: সবই জাল। এখান থেকে বেরোবার সাতদিনের মধ্যে জাল হয়ে যাচ্ছে। ওখানকার পাঠকরা কিন্তু জেনুইন বই কিনতে চায়। আগে ওরা যখন রিপ্রিন্ট করতো, তখন তফাৎ হতো বলে পাঠকরা বলতো, না ওটা চাই না। ইন্ডিয়ান অরিজিনাল এডিশানটা চাই। এখন তারা আর ধরতেই পারছে না। তা আনন্দ পাবলিশার্স জাল আটকাবার জন্য নানারকম টেকনিক করলো, গোল্ড দিয়ে এমবস করে প্রথম আলোর নামটা লেখা হলো। ওরাও সঙ্গে সঙ্গে ওখানে করে ফেললো।
পারমিতা: তবে একটা কথা, অনেক ভালো ভালো কাজও হচ্ছে, যেমন বাংলা ফন্টের অনেক ভালো কাজ বাংলাদেশীরাই করছেন।
সুনীল: তা তো আছেই। বাংলাভাষা নিয়ে চর্চাটা ওদের অনেক বেশি।
আর্যনীল: পারমিতা, তোমরা যে ফন্টটা ব্যবহার করো, সেটা কি আনিসুর রহমানের ফন্ট?
পারমিতা: না, ওটা আমাদের দেশের। অভিনাশ চোপড়ে বলে একজনের করা।
সুনীল: এখন তো প্রচুর বাংলা ফন্ট বেরিয়ে গেছে। বিদেশেও ভালো কাজ হচ্ছে।
পারমিতা: সুনীলদা, যেকোন নতুন পত্রিকা, ধরুন, আমাদের এই যে পত্রিকা পরবাস, যেটা এখনো পর্যন্ত একটা ছোটো প্রচেষ্টা, একে টিকিয়ে রাখতে গেলে কি কোন প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতেই হবে বল আপনার মনে হয়?
সুনীল: না, তা কেন হবে? ‘এক্ষণ’ পত্রিকা তো অনেকদিন চলেছে। নিয়মিত ছিলো না, শেষের দিকে শুধু শারদীয়া সংখ্যাই বের করতো, তবু তো তার একটা চরিত্র গড়ে উঠেছিলো। তার সংগে তো এস্ট্যাবলিশমেন্টের কোন সম্পর্ক ছিলো না? এক্ষণের সম্পাদক মারা গেছেন বলে ওটা বন্ধ হয়ে যায়।
আর্যনীল: কমল চক্রবর্তীর কৌরব।
সুনল: কমল চত্রবর্তীও কৌরব বার করে চলেছেন জামশেদপুর থেকে। তার তো আলাদা একটা চরিত্র আছে। তবে ধৈর্য লাগে। অন্তত দশটা বছর পত্রিকা টানা না চালালে তাকে ঘিরে কোন লেখকগোষ্ঠীও গড়ে ওঠে না, বা তার চরিত্র গড়া যায় না।
পারমিতা: আর একজন কি দুজনের full-time involvement দরকার হয়।
আর্যনীল: হ্যাঁ, দুজন কি তিনজন লোককে কেন্দ্র করে চক্র গড়ে ওঠে।
সুনীল: শেষ পর্যন্ত একজনই হয়। কমল চক্রবর্তী বলতে গেলে তো একাই সব করেন। ওঁর বন্ধুবান্ধব আছে যদিও। কৃত্তিবাসও বলতে গেলে, বন্ধুবান্ধবরা যদিও অনেক সাহায্য করেছে, কিন্তু মূল দায়িত্বটা আমাকেই নিতে হয়েছে।
আর্যনীল: সুনীলদা, একটা শেষ প্রশ্ন। আপনার পরবর্তী প্রজন্মের পাঁচজন কবির নাম করুন যাঁদের লেখা আপনার ভালো লাগে।
সুনীল: পাঁচজনের নাম করা খুব শক্ত নয়। যেমন ধরো, জয় গোস্বামীর নাম আমি প্রথমেই বলবো।
আর্যনীল: আপনাদের ঠিক পরেই যাঁরা লেখালিখি করেছেন।
সুনীল: তাদের মধ্যে ছিলো ভাস্কর চক্রবর্তী, শামসের আনোয়ার, পবিত্র মুখোপাধ্যায়- এরকম অনেকেই। দেবারতি মিত্রও ভালো লিখেছে। তারপর এখনো যারা লিখছে, তাদের মধ্যে জয়, সুবোধ সরকার, মল্লিকা সেনগুপ্ত। কৃষ্ণা বসু- সেও ভালো লেখে। তারপর ব্রত চক্রবর্তী বলে একটি ছেলে, তারও লেখা বেশ ভালো।
আর্যনীল: ভাস্কর চক্রবর্তী কি এখন আর লিখছেন না?
সুনীল: লেখে, কম লেখে। হয়তো আড়ালে থাকতে ভালোবাসে।
আর্যনীল: আপনাদের প্রজন্মের একটা ব্যাপার হচ্ছে যে, আপনারা কুড়ি-পঁচিশ তিরিশ বছর ধরে টানা লেখালিখি করে গেছেন। কিন্তু তাও আপনাদের জেনারেশানের কয়েকজন কবি খুব বেশি লেখালিখি করেননি, যেমন উৎপল, বিনয়। এটা কেন হলো বলে আপনার মনে হয়?
সুনীল: উৎপলও তো একসময় সিগনিফিক্যান্ট কবি হিসেবে গণ্য হয়েছিলো। মাখখানে বিলেতে গিয়ে বহুবছর বিশেষ কিছু লেখেনি। ফিরে এসে আবার লিখছে। এবার দেশ পত্রিকায় একটা কবিতা বেরিয়েছে।
আর্যনীল: সেই একই ব্যাপার বিনয় মজুমদারের ক্ষেত্রেও খাটে? বিনয়ের শেষের দিকের লেখা আপনার কেমন লাগে?
সুনীল: বিনয়ের নামে তো আমি একটা মজার লেখা দেখলাম- ‘রবীন্দ্র-বিনয়-সংগীত’। করেছে কি, রবীন্দ্রনাথের একটা গান, তার দুটো-তিনটে শব্দ মাত্র বদলেছে। নাম দিয়েছে রবীন্দ্র-বিনয়-সংগীত।
আর্যনীল: বিনয়ের মধ্যে কি, মানে, এই পাগলামিটা “ফিরে এসো চাকা”-র দিনগুলো থেকেই ছিলো?
সুনীল: না, না। আগে তো কফিহাউসে বসে থাকতো, রাশিয়ান ভাষা শিখেছিলো ভালো, অংকে ভালো ছাত্র ছিলো। তারপর একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে আস্তে আস্তে পাগল হতে শুরু করে। বংশে ছিলো কি না জানি না। জ্যোতির্ময় ওকে অনেক সাহায্য করেছে।
বিনয়ের সম্বন্ধে একটা মজার গল্প বলে শেষ করি। বিনয় কোথায় থাকবে, একটা সময় সেটাই ছিলো আমাদের সমস্যা। জ্যোতির্ময় দত্তের বাড়িতে নিয়ে রাখলো। কিন্তু বিনয় তখন মেয়েদের দেখলেই মারতে যেতো, ছেলেদের কিছু বলতো না। তা একদিন জ্যোতির্ময় দত্তের বৌকে মারতে গেলো। তখন ঠিক হলো যে, সবাই মিলে চাঁদা দিয়ে ওকে আমরা একটা হোটেলে বা মেসে রাখার ব্যবস্থা করবো। কলেজস্ট্রীটের একটা মেসবাড়িতে ওকে রাখা হলো। হঠাৎ একদিন শুনলাম যে, বিনয়কে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। মেসের ঠাকুরকে ও লাঠি দিয়ে মেরেছে, ওকে নাকি মাছের টুকরো কম দিয়েছিলো, তাই। তখন জ্যোতির্ময় দত্ত এসে আমায় আর তারাপদ রায়কে বললো, খুব ভালো হয়েছে, ওকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, এখন তো কোর্ট কেস উঠবে। আপনারা কোর্টে গিয়ে বলুন, ওর তো মাথার দোষ আছে, ওকে জেলে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। তো আমি আর তারাপদ গেলাম কোর্টে। দেখি যে সব চোরডাকাতের মধ্যে বিনয় দাঁড়িয়ে আছে, আমাদের দেখে খুব খুশি, চোখটা জ্বলজ্বল করছে। আমার কোর্ট ইনসপেক্টরকে বললাম, উনি কবি, কিন্তু মাথার গণ্ডগোল আছে, ওকে আপনারা রেখে দিন, চিকিৎসার ব্যবস্থা করান। ইনসপেক্টর বললো, পাগল? তাই নাকি? বলে সে তখন জজের কানে কানে কী বললো জজ “বিনয় মজুমদার খালাশ” বলে ছেড়ে দিলো। আমরা হতবাক। কী করবো বুঝতে পারছি না। এদিকে বিনয় বেরিয়ে এলো, ভাবলো আমরা ওকে উদ্ধার করতে এসেছি। আমাদের দারুণ জড়িয়ে-টড়িয়ে বললো, তোমরা এসেছো?
সুনীল হাসতে থাকেন ঘটনাটি স্মরণ করে।
আর্যনীল: তারপর যে সময়টা উনি হাসপাতালে ছিলেন, দেশে ওঁর তিনটে কবিতা বেরিয়েছে।
সুনীল: মাঝখানে আমরা যখন মাসিক কৃত্তিবাস করি, তখনও বেশ কিছু কবিতা বেরিয়েছে। সেগুলো অসম্ভব রকমের আদিরসাত্মক। তখন ওর মাথায় ওইটা ঢুকেছে। আমাদের অনেকে বললো, এগুলো কি ছাপছেন? কেস হয়ে যাবে। তারপরও অসুস্থ অবস্থায় দেশে কয়েকটা কবিতা বেরিয়েছে। কিন্তু এখনকার কবিতাগুলো দেখছি একেবারেই এলোমেলো।
সাক্ষাৎকার একসময় শেষ হলো, তার পরেও কিছুক্ষণ গল্পগুজব হলো- উপস্থিত ছিলেন স্বাতী, “ছবির দেশে”-র অসীম রায়। ইন্টারনেট সারা বিশ্বে যে আলোড়ন তুলেছে, দেখা গেল সুনীলও তাতে আক্রান্ত। “কমপিউটারে একদিন বসে একটা কবিতাই লিখে ফেললাম, কোন অসুবিধে হলো না। শুধু দেখলাম, আপনা থেকেই যুক্তবর্ণ বাদ দিয়ে সোজা সোজা শব্দ লেখার প্রবণতা আসছে!”
“হাসন রাজার বাড়ি” ইন্টারনেটেই ধরা রইলো এই দীর্ঘ, নিবিড় সাক্ষাৎকারটি।