শীতের কলকাতা। সুনীলের বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতেই আমি আর পারমিতা একটু বেশী সাহসী হয়ে উঠলাম। ভাবলাম একটা সাক্ষাৎকার নিয়ে ফেলতেই হয়। আমার ইচ্ছে ছিল কবি সুনীলকে অল্প কথায় ধরে ফেলা। তার সাথে গদ্য ঘেঁষা কৌতূহল জুড়ে দিল পারমিতা। কিন্তু সাক্ষাৎকারের পাঁচ মিনিট আগেও আমরা ভাবিনি সুনীলের মুক্তহৃদয়ী কথকতা পরবাসের এক সংখ্যার সমস্ত বঞ্চিত মেগাবাইটকে ছাড়িয়ে যাবে।
এই ভাবে চিনতে চিনতে আমরা পেয়ে যাই আকরিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে। মূলত কবি সুনীলকে।
আর্যনীল: প্রথম প্রশ্নটা হলো আপনার ওই পূর্ববঙ্গ থেকে প্রথম আসার ব্যাপারটা নিয়ে। আপনার অনেক লেখায় সে কথা পেয়েছি। আমরা এও জানি যে প্রথম দিকের লেখালিখির অনেকটা আগেই, ষোলো বছর বয়সে আপনার প্রথম কবিতা “দেশ” পত্রিকায় বেরোয়. . . আপনার সেই প্রথম দিকের লেখালিখি এবং আপনার পূর্ববঙ্গ থেকে আসা, সেই প্রথম কয়েক বছরের কথা আপনার কাছ থেকে কিছুটা জানতে চাই।
সুনীল: আসলে আমার পূর্ববঙ্গ থেকে আসার ব্যাপারটায় একটু ভুল বোঝাবুঝি আছে। আমার ‘অর্জুন’ উপন্যাসটা পড়লে মনে হয় আমি যেন উদ্বাস্তুদের মতো পায়ে হেঁটে পূর্ববঙ্গ থেকে এখানে এসেছি। ঘটনাটা তা নয়। কথাটা হলো দেশভাগের আগেই বাবা কলকাতায় চাকরি করতেন। উনি স্কুল শিক্ষক ছিলেন। ফলে আমরাও এখানেই থাকতাম। কলকাতায়। আমি পড়াশোনা করেছি কলকাতায়। তবে আমরা মাঝে মাঝে পূর্ববঙ্গে যেতাম। স্মৃতি আছে একটা বছর টানা আমরা ওখানে ছিলাম, কলকাতা ছেড়ে যুদ্ধের সময়। বোমা পড়ার ভয়ে বহুলোক কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলো।
আর্যনীল: সেটা কত সাল?
সুনীল: সেটা তেতাল্লিশ সাল।
(হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে; এই প্রথম, আমাদের বার্তালাপে যতি পড়ে। কর্ডলেস তুলে খানিকটা ইতস্তত সুনীল।)
সুনীল: বন্ধ করবে?
পারমিতা: হ্যাঁ।
(আবার কথাবার্তা হয়। এরপর আরো একবার অন্তত দূরভাষ জ্বালিয়েছে দু ঘন্টায়। )
সুনীল: যুদ্ধের সময়। তখন ওই বহু লোক শহর ছেড়ে চলে যায়। স্কুল-কলেজ সব বন্ধ হয়ে যায়। তো, বাবা যে স্কুলে পড়াতেন, প্রাইভেট স্কুল, তখন নিয়ম ছিলো, স্কুল বন্ধ হলে আর মাইনে পাওয়া যেতো না। বাবা বেকার হয়ে গেলেন। তো, আমাদের সংসার টানার ক্ষমতা ছিলো না তখন আমারা দেশের বাড়িতে ফিরে গেলাম। অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে সেখানে, সে অনেক ঘটনা। তারপর যখন দেশ বিভাগ হলো, মনে আছে বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।
আর্যনীল: তখন আপনাদের দেশের বাড়ীতে কারা ছিলেন?
সুনীল: আমাদের দেশের বাড়ী খুব সাধারণ বাড়ী। গরীবের বাড়ী। আমরা খুব গরীব ছিলাম। একটা ঠাট্টা আছে যে পূর্ববঙ্গ থেকে যারা এসেছিলো তারা সবাই জমিদার। আমরা কিন্তু জমিদার ছিলাম না। ঠাকুর্দা ছিলেন টোলের পণ্ডিত। খুব সাধারণ মাটির বাড়ী, টিনের চাল। আমার কাকা, জ্যাঠামশাই, এরা থাকতেন, কিন্তু আমার মা আমাদের নিয়ে খুব বিপদে পড়েছিলেন। বিপদ মানে, একটা সময় ছিলো যখন পয়সা থাকলেও তখন চাল পাওয়া যেতো না। ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের একটা পলিসি ছিলো, যুদ্ধের সময়, জাপানীরা যাতে চাল না পায়। জাপানীরা ভাত খায়, তো সব চাল সীজ করে দিয়েছিলো। কলকাতা শহরে তবু ব্ল্যাকে চাল পাওয়া যেতো, কিন্তু পূর্ববঙ্গের গ্রামে আর কিভাবে পাওয়া যাবে? তো আমার মনে আছে, আমরা আলুসেদ্ধ খেয়ে থাকতাম। চুরিডাকাতি খুব বেড়ে যায়। সাম্প্রদায়িকতা তখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। এ সমস্ত। কিন্তু দেশ বিভাগের সময় আমরা ছিলাম এখানেই। সিদ্ধান্ত আমরা এখানেই পেলাম। তারপর দেখলাম দাঙ্গা-হাঙ্গামা হচ্ছে, ফলে আস্তে আস্তে আমাদের যাওয়া বন্ধ হলো… এভাবেই আমাদের গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হলো। কিন্তু দলে দলে যখন উদ্বাস্তুরা এসেছে, জোর জবরদখল কলোনীতে বা শেয়ালদায় থেকেছে, তাদের মধ্যে তো যেতাম… মানে স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন স্বেচ্ছাসেবক হয়ে তাদের মধ্যে যেতাম, খাবারদাবার দুধ দেওয়া, এসব করতাম, মাঝে মাঝেই আমার মনে হতো ওদের মতোও তো আমি হতে পারতাম। কলকাতায় আছি বলে একটা ভাড়া বাড়ীতে আছি কিন্তু আমার অবস্থাও ওদের মতো হতে পারতো। ‘অর্জুন’ উপন্যাসে ওদের কথা আছে। যেন আমিও ওদেরই একজন।
আর্যনীল: তারপর যখন আপনি এখানে ফিরে এলেন, মানে, আপনার একদম প্রথমদিকের কবিতা লেখালিখি, সেই সময়টা কখন?
সুনীল: আমি সে ব্যাপারেও অনেক জায়গায় লিখেছি। আবার সংক্ষেপে বলি। একদম স্কুল জীবনে যে কবিতা লিখবো সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমার একেবারেই ছিলো না। বই পড়তাম, মানে প্রচুর বই পড়তাম। কিন্তু …
আর্যনীল: তাহলে লেখালিখি শুরু করেন কবে?
সুনীল: সেটা বেশ মজার ব্যাপার। আমি যখন ম্যাট্রিক পরীক্কা দিলাম, আমরাই শেষ ম্যাট্রিক, তারপর স্কুল ফাইনাল চালু হয়ে যায়। তা পরীক্ষা শেষ হবার পর তিন মাস ছুটি থাকে, কলেজ যাওয়ার আগে।
আর্যনীল: সেটা কত সাল? ১৯৫০?
সুনীল: সেটা ১৯৫০ সাল। বাবার ধারণা ছিলো ওই সময়েই ছেলেরা নষ্ট হয়ে যায়। তো আমার ওপর হুকুম ছিলো একদম দুপুরবেলা বাড়ী থেকে বেরোনো যাবে না। বাঙাল পরিবারে, জানোতো, বাবারা হচ্ছে ভয়ংকর, মানে একেবারে হিটলারের মতো। একদম তাদের কথার প্রতিবাদ করা যায় না। আজকাল আর সেরকম নেই. . .
পারমিতা: হ্যাঁ, আমার রাগী বাঙাল দাদুদের দেখেছি তো।
সুনীল: (হেসে) হ্যাঁ। অন্য বন্ধুরা খেলতে যেতো, সিনেমা দেখতে যেতো, আমরা বাড়ীতে বসে থাকতাম। শুধু তাই নয়, আমাদের কষ্ট দেবার জন্য বাবা মাথা থেকে একটা ফন্দি বের করলেন। বললেন, ইংরেজি শিখতে হবে। কবিতা অনুবাদ করতে হবে। তাতে ইংরেজি শেখাও হবে বাংলা শেখাও হবে। তা উনি আমাকে টেনিসনের কবিতার অনুবাদ করতে দিলেন। রোজ একটা করে কবিতা। সে কি কষ্টকর ব্যাপার। আর টেনিসনকে যে কি অভিশাপ দিতাম, কেন যে লোকটা জন্মেছিলো, কেন যে লোকটা কবিতা লিখেছিলো। তখন ছুটি, বাবা দুপুরে ঘুমোতেন। বিকেলে উঠে বলতেন, নিয়ে এসোতো দেখি। তা সব কবিতা মিলিয়ে মিলিয়ে দেখতেন না, প্রথম কয়েকদিন দেখেছিলেন, পরে দেখতেন সাইজ ঠিক আছে কি না, অর্থাৎ আঠারো লাইনের কবিতা আঠারো লাইন আছে কি না। দেখে টিক্ মেরে দিতেন। তখন মাথা থেকে দুষ্টুবুদ্ধি বেরোলো যে কষ্ট করে অনুবাদ করে আর কি হবে, নিজে একটা আঠারো লাইনের কবিতা লিখে দিলেই হয়। তা শুরু করলাম, পেরে যাচ্ছি, প্রথম মকশো করা সেটাই। তো ওরই মধ্যে একটা কবিতা তখনকার আমার যে বাল্যপ্রেমিকা. . . বন্ধুর বোনের সঙ্গে প্রেম হতো তখন… তাকে উত্তর দিলাম। তখন তো বন্ধুর বোনকে নিয়ে কবিতা লিখে ফেললাম আর তার হাতে গিয়ে এলাম, এটা সম্ভব ছিলো না, পোস্টেও পাঠানো যেতো না। বাড়ীতে যদি কেউ পড়ে ফেলে। তখন আমাদের বাড়ীতে ‘দেশ’ পত্রিকা আসতো, তো ‘দেশ’ পত্রিকার দপ্তরে পাঠিয়ে দিলাম। সেটা ছাপাও হয়ে গেলো।
আর্যনীল: ‘দেশ’ পত্রিকার মাধ্যমে তার কাছে পৌঁছলেন?
সুনীল: হ্যাঁ, মনে হলো ও তো ‘দেশ’ পড়বেই। কবিতাটার নামও ছিলো ‘একটি চিঠি’। মেয়েটি পড়লোও বটে। কিন্তু বিশ্বাস করলো না আমার লেখা। (হাসতে হসতে) বললো, তোমার নামের সঙ্গে নাম মিলিয়ে একজন লিখেছে… তারপর তখন আমার এক বন্ধু ছিলো. . .
আর্যনীল: তখন আপনারা কোথায় থাকতেন? পাইকপাড়ায়?
সুনীল: না। উত্তর কলকাতায় গ্রে স্ট্রীট বলে একটা রাস্তা আছে, আমরা ওখানেই. . . তখন আমার এক বন্ধু ছিলো। দীপক মজুমদার। দীপক কিন্তু আমার চেয়েও অল্প বয়সে কবিতা লিখতো। ছাপা হতো। দীপককে নিয়ে সবাই দেখতাম বেশ মাতামাতি করে কারণ সে কবিতা লেখে। অন্যেরা পারে না। আমার তখন মনে হলো দীপক যখন কবিতে লেখে তখন আমিই বা পারবো না কেন। কবিতা লেখা এমন কি শক্ত ব্যাপার। দীপক আর আমি কবিতার বই বের করবো ঠিক করেছিলাম। তো সেই বই বার করার ব্যাপারটাও খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী। ওয়ার্ডসওয়ার্থ আর কোলরিজ জীবনের প্রথম কবিতার বই একসঙ্গে বের করেছিলেন। আমি আর দীপক যেন সেই ওয়ার্ডসওয়ার্থ আর কোলরিজ।
(আমরা তিনজনেই হাসতে থাকি)
সেই বই বের করা নিয়ে অনেক মজার ব্যাপার ঘটেছিলো। দীপক সব ব্যাপারেই খুব বড়ো চিন্তা করতো। ও নিজেই নির্বাচন করলো বই কে বের করবে, মলাট কে আঁকবে। তখনকার দিনে সবচেয়ে নামকরা প্রেস হলো সিগনেট প্রেস। ওরা তখন জীবনানন্দের কবিতা বের করতেন।
আর্যনীল: দিলীপ গুপ্ত?
সুনীল: হ্যাঁ। ডি কে গুপ্ত। দীপক ঠিক করলো সিগনেট থেকেই বের করবে এই বই। তখন সবচেয়ে নামকরা মলাটশিল্পী ছিলেন সত্যজিৎ রায়। দীপক তাঁকে নির্বাচন করলো। ওঁরা রাজী হলেন কিনা সে নিয়ে দীপকের মাথাব্যথা নেই। ও যে নির্বাচন করেছে ওঁদের সেটাই যেন বড় (হাসি)। এই করে সত্যজিতের বাড়ীতে গিয়েছিলাম মলাট আঁকাবার জন্য। উনি খুব ভদ্রভাবে বলেছিলেন--‘হ্যাঁ। করবো। তবে কবিতাগুলো তো আমাকে পড়তে হবে. . . আর আগে প্রকাশক ঠিক করুন, তারপর…।’ উনি খুব ভদ্রভাবে আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর দিলীপ গুপ্তর কাছে গিয়েছিলাম। দীপকই অগ্রবর্তী, আমি পিছন পিছন। দীপকই কথা বলতো। আমি তখন লাজুক ছিলাম, খুব একটা কথা বলতে পারতাম না। তা, এটাও খুব আশ্চর্য ব্যাপার যে দিলীপ গুপ্ত অতবড় একটা প্রকাশনার মালিক এবং কলকাতার উচ্চমহলে বিশিষ্ট ব্যক্তি একজন, কিন্তু রোগা রোগা, উত্তর কলকাতার ধূলিমাখা পায়ে চটি পরা দুটি ছেলেকে ফিরিয়ে দিলেন না। উনি আমাদের অনেক প্রশ্ন করলেন--কি লিখছো, বন্ধুবান্ধবরা কি লিখছে, অর্থাৎ আধুনিক প্রজন্মের ছেলেরা কি লিখছে. . . এসমস্ত. . . সব শুনে বললেন এখনই কবিতার বই বের করে কি হবে তার চেয়ে এমন একটা কিছু করুন (উনি আমাদের সঙ্গে আপনি আপনি করে কথা বলতেন) যাতে আপনাদের বয়সী সকলের, তরুণ প্রজন্মের লেখালিখি ছাপা হতে পারে। তখনই ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা বার করার পরিকল্পনা হলো।
আর্যনীল: বই থেকে সেটা পত্রিকায় গেল কি করে?
সুনীল: ওই যে উনি বললেন সকলের লেখালিখি. . . অনেকের কবিতা নিয়ে তো আর ভালো সংকলন হয় না, পত্রিকা হতে পারে। সেজন্যে আমরা পত্রিকাই বের করলাম। এবং কৃত্তিবাস পত্রিকার একেবারে গোড়ার দিকে মলাটে লেখা থাকতো ‘তরুণতম কবিদের মুখপত্র’। তরুণদের কবিতা ছাপা হতো। বয়স্কদের নয়। অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতো কেউ কেউ ভুল করে আমাদের দপ্তরে কবিতা পাঠিয়েছেন, আমরা সবিনয়ে তা ফেরত পাঠিয়েছি। বলেছি, বয়স্কদের কবিতা আমরা চাই না। বয়স্কদের প্রবন্ধ ছাপতাম। যেওমন অম্লান দত্ত বা কেউ কেউ… তাদের কাছে প্রবন্ধ চাইতাম। কৃত্তিবাস এইভাবে শুরু হয়।
আর্যনীল: আচ্ছা।
পারমিতা: একদম শুরুতে কে কে ছিলেন?
সুনীল: একদম প্রথমে ছিলাম দীপক আর আমি আর আনন্দ বাগচী। তিনজন সম্পাদক। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলো আনন্দ বাগচী। সে খুব অল্পবয়স থেকে কবিতা লিখতো এবং ওর মধ্যে একটা চ্যালেঞ্জ ছিলো যতগুলো পূজো সংখ্যা বেরোবে প্রত্যেকটাতে ওর কবিতা থাকবে। এরকম একটা ব্যাপার ছিলো। দীপকও কবিতা লিখতো। লেখক মহলে লোকে ওকে চিনতো। আমি ছিলাম একেবারে…
আর্যনীল: আনকোরা?
সুনীল: হ্যাঁ, মানে কি বলে, যাকে বলে কেউ চেনে না।
আর্যনীল: কৃত্তিবাস পত্রিকার এই যে গোড়ার দিক, তখন কোন সাংগঠনিক কাঠামো ছিলো? আপনারা তিনজনেই দেখতেন?
সুনীল: না। আর এই তিনজনের ব্যাপারটা খুব তাড়াতাড়িই ভেঙে যায়। আনন্দ বাগচীকে নেওয়া হয়েছিলো কারণ নামকরা কবি, তাছাড়া দীপকের সঙ্গে এক কলেজেই পড়তো. . .. কিন্তু ও কৃত্তিবাসের জন্য কোন পরিশ্রম করেনি। যা করার দীপক আর আমিই করতাম। কিন্তু দীপক হচ্ছে অত্যন্ত চঞ্চল স্বভাবের মানুষ। সারা জীবনই সেই পরিচয়ে পাবে. . . কোন জিনিসই সে কোনদিন ধরে রাখতে পারেনি। তিনটে সংখ্যা বেরোনোর পরেই দীপকের ধৈর্য নষ্ট হয়ে যায়। তারপর থেকে কৃত্তিবাস আমি একাই চালিয়েছি। বলতে পারো যাকে বলে one man show. আমারই বাড়ীতে অফিস, লোকজন আসছে আমারই বাড়ীতে, আমি প্রুফ দেখছি, আমিই প্রেসে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে আরো কয়েকজন ছিলো। তারা সাহায্য করতো।
আর্যনীল: সেই সময়ে আপনার লেখকবন্ধুরা কেউ সঙ্গে ছিলেন না?
সুনীল: হ্যাঁ কেউ কেউ ছিলেন। যেমন উৎপল কুমার বসু। আর যারা ছিলেন তারা কেউ লেখেন না। পাঁচ ছ সংখ্যা পরে শক্তি চট্টোপাধ্যায় এলো।
আর্যনীল: আচ্ছা সুনীলদা, শক্তি- শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় ইত্যাদি এঁদের সঙ্গে আপনার আলাপ কিভাবে?
সুনীল: শক্তির সঙ্গে কফিহাউসে। আমাদের মধ্যে অবশ্য ব্যবধান ছিলো। দুটো টেবিলের। ও গদ্য লিখতো তখন। গদ্যকারদের সঙ্গে বসতো। দাড়ি রাখতো, বিড়ি খেতো, আর বিড়ি খাওয়া নিয়ে অনেকরকম কথা বলতো। তারপর আস্তে আস্তে আমাদের টেবিলে ওর যাওয়া আসা শুরু হলো। কবিতা তখন লিখতে শুরু করেছে।
আর্যনীল: শোনা যায়, শক্তির প্রথম বই ‘অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি অন্ধকারে’ বেরোনোর পর বইটা আপনাকে দিলে আপনি বলেছিলেন জীবনানন্দের প্রভাব সাংঘাতিক।
সুনীল: হ্যাঁ। অন্যদের মধ্যেও প্রথমদিকের লেখায় সেটা আছে। আসলে রবীন্দ্রনাথের পরে তখন অত বড় আকারের একজন কবিকে আমরা আবিষ্কার করছি… সেই প্রভাব এড়ানো শক্ত। আর এতে লাভও হয়েছে।
আর্যনীল: বন্ধুদের সাথে প্রথম আলাপের কথা হচ্ছিলো।
সুনীল: হ্যাঁ, বলছি। যেমন একদিন স্যুট পরা এক সুবেশ যুবক কবিতা নিয়ে এলেন। দেখলাম কবিতার নীচে নাম, নমিতা মুখোপাধ্যায়। বললাম নমিতা মুখোপাধ্যায় কে? বললেন, আমি। শুনলাম ওর নাম শরৎকুমার, ইংল্যান্ডে বেশ কিছুদিন ছিলেন। আমি বললাম, ওসব হবে না, ওই সব মেয়েদের নাম চলবে না। তারপর একদিন একটি ছেলে এলো, তারাপদ রায়। প্রথম আলাপেই আমার খাটে উঠে দাঁড়িয়ে দেখি প্যান্ট খুলছে। আমি তো প্রায় কোনরকমে থামাতে যাই. . . তারপর দেখি প্যান্টের নীচে পাজামা পরা… একটাই প্যান্ট তার, ক্রীজ নষ্ট হয়ে যাবে তাই এসেই ছেড়ে রাখছে। এইরকম সব।
পারমিতা: আপনি কি মনে করেন কবিতা লেখায় আপনার পরিতৃপ্তি বেশী না গদ্যে?
সুনীল: আসলে এই কৃত্তিবাসের সময় একটা অন্য জীবনযাপন ছিলো। বন্ধুবান্ধবেরা একসঙ্গে হৈহুল্লোড় করছি, কবিতা লিখছি। তখন গদ্য লেখার কথা মনেই আসতো না। কিন্তু আমার জীবনে একটা পরিবর্তন আসে। অল্পবয়সে বাবা মারা যায়। তখন একটা সংসার চালানোর দায়িত্ব এসে পড়ে। দ্বিতীয়ত তখন চাকরি পাওয়া ছিলো শক্ত। এখনো শক্ত। তখন আরো শক্ত ছিলো। আমি গ্র্যাজুয়েট হই ১৯৫৪-এ। পঞ্চাশের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাকলাশ চলছে তখনো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বহুলোককে চাকরি দেওয়া হয়েছিলো। এখন তাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। প্রচুর ছাঁটাই চলছে, নতুন লোক তো আর নিচ্ছেই না। ফলে ইন্টারভিউ দিচ্ছি, চাকরি পাচ্ছি না। আমি বহু ইন্টারভিউ দিই। সেই নিয়েই ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ লিখি। তারপর আরেকটা ব্যাপার হলো আমি তেষট্টি সালে বিদেশে চলে যাই। তার আগে অবশ্য পরীক্ষাটরীক্ষা দিয়ে চাকরি একটা পেয়েছিলাম। গভর্নমেন্টের চাকরি। সেসব ছেড়েছুড়ে দিয়েই চলে যাই। আমি যখন বিদেশে যাই (মানে একটু বড় করে বলতে হচ্ছে ব্যাকগ্রাউন্ডটা বোঝাতে গিয়ে) তখন আমেরিকায় থেকে যাওয়াটা খুব সহজ ছিলো। আমাকে যিনি আইওয়ায় (আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়েটিভ রাইটিং ওয়ার্কশপে) নিয়ে গিয়েছিলেন, পল এঙ্গেল, ভীষণ ভালো লোক উনি। প্রায়ই বলতেন থেকে যাও। থেকে যাওয়াটা খুব সহজ ছিলো। থেকে গেলে আমার অবস্থাটা সচ্ছল হতো, তখনো আমি বিয়ে করিনি, ফলে কোন পিছুটানও ছিলো না। এতদিনে বাড়ী, গাড়ী তো হতোই, একটা মেম বিয়ে করে কতগুলো ফর্সা ফর্সা ছেলেমেয়েও হতো।
(তিনজনেই হাসিতে গড়িয়ে পড়েছি)
ওইখানে গিয়েই আমি সিদ্ধান্ত নিতে চাই যে আমি কি করতে চাই। যখন একা থাকতাম তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করতাম নিজেকে- আমি কি করতে চাই। তো বুঝতে পারলাম যে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে বাংলা ভাষায় কবিতা লিখতে, একটা দারুণ আনন্দ হয়. . . তখন আমার বান্ধবী ছিলো, প্রচুর মদ ছিলো, এখানে ওখানে ঘোরাফেরা করার টাকা ছিলো, মানে আনন্দ করার যা যা উপকরণ, কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগে রাত জেগে একটা কবিতা লিখতে। তো কবিতাই যদি লিখবো, বাংলায়, তো এইদেশে থাকার কোন মানে হয় না, যে দেশে এই ভাষা বলে সেখানেই থাকা উচিত। সিদ্ধান্ত নিলাম। দেশে ফিরে এলাম। এখন হলো কি, চাকরি ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিলাম, যখন ফিরে এলাম, বেকার। আর তখন ভেবেছিলাম আর তো বিদেশে যাওয়া হবে না, তখন বাইরে যাওয়াও খুব শক্ত ছিলো। তাই ফেরার সময় আমি নানা জায়গায়. . .
আর্যনীল: ফ্রান্সে গিয়েছিলেন।
সুনীল: ফ্রান্স তো বটেই, সুইজারল্যান্ড, কায়রো যা যা দেখা যায়, যখন দমদমে নামি আমার দশ টাকা ছিলো। তো বেকার। সংসার আমার ওপর নির্ভর করে। কবিতা লিখে তো সংসার টানা যায় না। তো ‘দেশ’ পত্রিকার সাগরময় ঘোষ তখন বললেন- তুমি একটা ফিচার লেখো। তো, ‘অন্য দেশের কবিতা’ নামে একটা ফিচার লিখলাম, এখন বই হিসেবে পাওয়া যায়। ফিচার তো শেষ হয়ে গেল একদিন, এবার? বললেন- তুমি একটা গদ্য লেখো। ওখানে থাকতে থাকতে আমি দু একটা গদ্য লিখেছিলাম। পাঠিয়েছিলাম। উনি পড়ে খুশি হয়েছিলেন, তাই এবার গদ্য লিখতে বললেন। তখন আমি ভাবলাম অন্য নামে লিখি। তখন ‘নীললোহিত’ নামটা বের করলাম। প্রথম উপন্যাস লিখলাম ‘আত্মপ্রকাশ’। এইভাবেই গদ্যের সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম।
আর্যনীল: ‘নীললোহিত’ নামে প্রথম গদ্য কি ‘নীললোহিতের চোখের সামনে’?
সুনীল: না। তারও আগে ‘বিশেষ দ্রষ্টব্য’ দেশ পত্রিকায় বেরিয়েছিলো। ‘চোখের সামনে’ বা অন্যান্যগুলো আনন্দবাজারে বেরিয়েছিলো। তখন এইরকম নানা পত্রিকায় গদ্য লিখে আমাকে সংসার চালাতে হতো। খুব শক্ত ছিলো। বাংলায় লিখে বেশী পয়সা পাওয়া যায় না। ইংরেজিতে দেয়, বাংলায় দেয় না। তো, এইভাবে চার বছর চালানোর পরে. . .
আর্যনীল: তখন আপনি আনন্দবাজারে পুরোপুরি কর্মী নন?
সুনীল: না। তখন মানে আমি. . .
আর্যনীল: ফ্রী-ল্যান্সার?
সুনীল: হ্যাঁ। ফ্রী-ল্যান্সার। তখন আনন্দবাজার কোম্পানী আমাকে চাকরি দেয়। ওদেরও স্বার্থ ছিলো এতে। ওরা দেখলো এ লোকটা ফ্রী-ল্যান্সিং করে বেশী পয়সা পেয়ে যাচ্ছে। একে কর্মচারী করতে পারলে আমাদেরই লাভ।
(আমরা অট্টহাসির জালে…)
আমিও ভাবলাম খানিকটা নিশ্চয়তা এলো। এর মধ্যে আমি বিয়ে করি। যখন বিয়ে করি তখন চাকরি ছিলো না। ৬৭’ সালে আমি বিয়ে করি। চাকরি পাই ৭০ সালে। এর মধ্যে প্রচুর গদ্য লিখতে হতো। এখন গদ্যটা যদি সার্থক না হতো লোকে যদি না নিতো তো বেঁচে যেতাম, কবিতায় ফিরে আসতাম। কিন্তু গদ্য পাঠক নিলো, অনেকে ভালো বললেন। তারপর সত্যজিৎ রায় একটা ছবি করে ফেললেন, ফলে গদ্য লেখার চাপটা আমার ওপর খুব বেশী পড়তে লাগলো। কিন্তু কবিতা তো ভোলা যায় না, এখনো কি ভুলতে পেরেছি?
পারমিতা: কিন্তু আপনার নিজের কাছে কোনটা বেশী আনন্দের?
সুনীল: হ্যাঁ এখনো. . . একটা ব্যাপার… (এটা মিথ্যে বলা হবে যদি বলি গদ্য লিখে একেবারে আনন্দ পাই না।) একটা গদ্য যখন শেষ হয় তখন ভালো লাগে। মনে হয়, যাক, বাঁচা গেলো। আর কবিতা? ছোট্ট একটা কবিতা লিখলাম. . . ম্যাজিক থাকে তো। কোথায় ছিলো? কি ব্যাপার? হঠাৎ কি করে লাইনটা মাথায় এলো? এই মুগ্ধতাটা সবসময় কবিতার মধ্যে থেকেই যায়।
পারমিতা: আপনি ‘সেই সময়’-এর শেষে লিখেছেন তথ্য সংগ্রহের একটা আলাদা রোমাঞ্চ আছে, সে সম্পর্কে কিছু বলুন।
সুনীল: হ্যাঁ। সেটা তো আছেই। চেষ্টা করি তথ্যটা ঠিক রাখতে। কল্পনাও মেশাই না হলে উপন্যাস হবে কি করে? প্রবন্ধ হয়ে যাবে। এই করে অনেক বই পড়াও হয়ে যায়। এমনকি ‘প্রথম আলো’ লেখার সময়ে আমি ইংল্যান্ডেও গিয়েছিলাম। সেখানে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরী আছে। সেখানে অমন কিছু তথ্য আছে যা দেশে নেই। যেমন ‘কার্জন পেপার্স’ ওখানে রয়ে গেছে। তারপর যেমন ধরো, ঢাকায় গিয়ে পড়তে হয়। এই পড়ার একটা আলাদা রোমাঞ্চ আছে। তবে তথ্য সংগ্রহ করতে করতে একসময় তথ্যভারাক্রান্ত হয়ে যায়, তখন নিজেকেই ঠিক করতে হয় কোনটা দেবো কোনটা দেবো না। না হলে লেখার রস নষ্ট হয়ে যায়।
আর্যনীল: আচ্ছা সুনীলদা, এই কৃত্তিবাস নিয়ে আরেকটা প্রশ্ন করি। সেই সময়ে আপনারা কবিতা নিয়ে খুব হুল্লোড় করতেন, দামামা বাজাতেন, এইভাবে কবিতা ব্যাপারটা খানিকটা জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
সুনীল: হ্যাঁ। এটা যে খুব পরিকল্পনা করে করতাম তা নয়। আমাদের একটা গোষ্ঠী মতো হয়ে গিয়েছিলো। ছুটে বেড়াতাম। শ্মশানে গিয়ে বসে থাকতাম, নেশাটেশা করতাম আর জায়গা না থাকলেও যেখানে সেখানে বেরিয়ে পড়তাম- এটা একটা মিথ তৈরী হয়ে যায়। গল্প ছড়িয়ে দেয়। সত্যি নয় এমন গল্পও রটেছে... যা হয় আর কি...
আর্যনীল: সেইসব কবিবন্ধুরা ছাড়াও গদ্যলেখক কেউ কেউও আপনাদের সঙ্গে ছিলেন যেমন সন্দীপনরা।
সুনীল: হ্যাঁ, গদ্যলেখকরাও ছিলো আমাদের দলে। এমন কেউ কেউ ছিলো যারা লিখতো না। যেমন ভাস্কর দত্ত, যে কোনদিন লেখারও চেষ্টাও করেনি। গদ্যলেখকদের মধ্যে যারা ছিলো তাদের মধ্যে সন্দীপন তো ছিলোই, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, মতী নন্দী ছিলো।
আর্যনীল: আপনাদের থেকে বয়োঃজ্যেষ্ঠ কেউ কেউ, সন্তোষকুমার ঘোষ, এঁরা কি কখনো আপনাদের দলে ভিড়তেন?
সুনীল: না। ওনার সঙ্গে মেলামেশা ছিলো। একসঙ্গে বসে কখনো হয়তো পানাহারও হয়েছে। কিন্তু উনি ঠিক গোষ্ঠীতে ছিলেন না।
আর্যনীল: আপনারা যখন বেরিয়ে পড়তেন, উনি কখনো আপনাদের সঙ্গে যেতেন না?
সুনীল: তাছাড়া উনি খুব ব্যস্ত লোক ছিলেন। যেমন বুদ্ধদেব বসু। তখন অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখক ছিলেন- তারাশঙ্কর, বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র। কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগটা বেশী হতো। ওঁর সঙ্গে কবিতার ছন্দ নিয়ে ঘোরতর তর্ক হতো। আমরা কখনই ঠিক প্রশংসা করতাম না ওঁকে। ওঁরা পুরনো ছন্দে লিখতেন। উনি বলতেন, তোমরা ছন্দ ভুল করছো, আর আমরা বলতাম আপনাদের ছন্দটা এলানো ছন্দ। আমাদের ভাষা মুখের ভাষার অনেক কাছাকাছি। বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে নানারকম কথাবার্তা হতো।
আর্যনীল: আরেকটা প্রশ্ন। কৃত্তিবাসের আর্থিক দিকটা বজায় থাকতো কি করে?
সুনীল: এই প্রশ্নটা খুব অস্বস্তিকর, কেননা সত্যি বলতে কি টাকাটা আমাকেই জোগাড় করতে হতো। আমরা কবিতার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন পেতাম না। প্রথমদিকে দিলীপ কুমার গুপ্ত আমাদেরর বিজ্ঞাপন দিয়ে (সিগনেট প্রেসের), ছাপার কাগজ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞাপন চাইতে যাওয়া, কবিতার কাগজের জন্য- এই নিয়ে দু একটা কথা বলি। দু একটা জায়গায় আমরা ফাঁকিও দিয়েছি। আরো একটা ঘটনা, সেটা বলতে হয় আমার জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট। আরো একটা প্রেস থেকে কৃত্তিবাস বেরোতো যেখানে আমাদের টাকা বাকী পড়ে গিয়েছিলো। সেই প্রেস থেকে ‘জলসা’ বলে একটা সিনেমার কাগজ বেরোতো। ওরাই বের করতো, ওরাই মালিক। তা ওরা বললো, আপনি আমাদের পূজো সংখ্যায় একটা লেখা দিন ওতেই কৃত্তিবাসের ধার কাটাকুটি হয়ে যাবে। আমি ভাবলাম, এ তো দারুণ ব্যাপার, আমাকে যে পয়সা দিতে হবে না এই-ই অনেক। তো সেই জলসাতেই আমি ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ লিখি আর সেটা পড়েই সত্যজিৎ রায় আকৃষ্ট হন এবং ফিল্ম করতে চান। ফলে উনি আমায় এই গল্পের জন্য আবার টাকা দিলেন… (হাসি)।
আর্যনীল: কৃত্তিবাস বন্ধ হয়ে যায় কেন?
সুনীল: সেটা… তুমি যদি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত-র ‘কল্লোল যুগ’ বইটা পড়ো, তাহলে দেখবে সব লিট্ল ম্যাগাজিনেরই একটা স্বাভাবিক আয়ু আছে। খুব বেশী ড্র্যাগ করলে সেটা একটা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়ে নেয়। যেমন কৃত্তিবাসটা আমরা পঁচিশ সংখ্যা বের করার পর দেখলাম বন্ধুরা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে। লেখা দেবার ব্যাপারে প্যাশনটা কমে গেছে। লেখা চাইলে একটা ‘কাল দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি’ ব্যাপার চলে আসছে। তখন আমার মনে হলো পত্রিকার স্বাভাবিক আয়ু শেষ, মৃত্যুই এর ভালো। এই মৃত্যুটা অনেকে মেনে নেয়নি। বেলাল চৌধুরী কয়েকটা সংখ্যা চালায়। তারপর সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত বের করতো। তারপর আবার বন্ধ হয়ে যায়। তখন বন্ধুরা আবার বললো- না, আমাদের একটা কাগজ ছিলো এটা থাকা দরকার। বেশ বড় আকারে, মাসিক পত্রিকা হিসেবে বের করার পরিকল্পনা হলো। গল্প-উপন্যাসও থাকবে কবিতা ছাড়াও। একটা সুবিধেও ছিলো। এক প্রেসের মালিক আমাদের খুব ভালোবাসতেন। তিনি একটা ঘরও দিলেন। বললেন- ভালোভাবে করুন এবার, মানে, লেখকদের টাকা দিতে হবে।
আর্যনীল: এটা কত সালের ঘটনা?
সুনীল: এটা উনিশশো ছিয়াত্তর… না পঁচাত্তর… না চুয়াত্তর সাল। তখন হরলিকস কোম্পানীর হয়ে আমি অনেকগুলো রেডিও সিরিজ লিখে দিয়েছিলাম। তা ওরা আমায় আট হাজার টাকা দেয়। আমি বললাম- এই আট হাজার টাকা দিয়ে কৃত্তিবাসটা শুরু করা যাক। শুরু হলোও। সাংঘাতিক চাহিদাও লক্ষ্য করা গেলো। আমি ভাবতাম, কৃত্তিবাস একটা ছোট পত্রিকা হবে, তা নয়, সবাই বলতে লাগলো, লোকে লাইন দিয়ে কাগজের অফিসে ভীড় করবে, কৃত্তিবাস থেকে আমরা একটা জীবিকা অর্জন করতে পারবো। শ্যামলও তখন তাই ভাবতো। তারপর একটা কনফ্লিক্ট এলো- এই যে আমরা নিজেদের লেখা লিখবো না কাগজ করবো। কাগজ করতে গেলে দু একজনের ওপরেই চাপটা বেশী পড়ে, সেটা শ্যমলের ওপর আর আমার ওপর পড়তো। তাই আমি বললাম, কৃত্তিবাস থাক, আমরা বরং নিজেদের নিজেদের লেখাটাই লিখি। এখন আবার আমাদের বন্ধু ভাস্কর দত্ত, লন্ডনে থাকে, ও বলছে কৃত্তিবাস আবার বের করি, অন্তত বছরে একটা সংখ্যা। আবার হয়তো পয়লা বৈশাখ থেকে কৃত্তিবাস বেরোবে। কিছুতেই [মরব মরব] করেও মরছে না।
আর্যনীল: আচ্ছা সুনীলদা, আপনাদের পরের প্রজন্মে চলে যাই। ষাট দশকের কবিদের মধ্যে আপনাদের যথেষ্ট প্রভাব ছিলো। ওঁরা সেটা বুঝতে পেরে তার থেকে বেরিয়েও এসেছিলেন কিন্তু ষাট দশকে নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য, বিরোধ, নানারকম মতবাদ, একে অন্যের প্রতি বিষোদ্গার খুব বেশী লক্ষ্য করি। আপনাদের মধ্যে একটা একদম লক্ষ্য করা যায় না। পঞ্চাশের কবিদের মধ্যে একরকমের একটা অটুট বন্ধুত্ব লক্ষ্য করি। এ সম্বন্ধে. . .
সুনীল: হ্যাঁ। আমরা তাই চেয়েছিলাম। মতবিরোধ থাকে, ছিলো। ব্যক্তিগত সংঘর্ষও ছিলো। কিন্তু নিজেদের যে একটা সংঘবদ্ধতা সেটা বাইরে প্রকাশ হোক সেটা চাইনি। আরেকটা ব্যাপার হলো যে লেখার ব্যাপারে আমরা প্রত্যেকেই আলাদা, কিন্তু নিজেদের একতাটা ধরে রাখতে চাইতাম। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ষাটে হয়তো কেউ তেমন সিদ্ধান্ত নেয়নি। কোন একটা পত্রিকাকে কেন্দ্র করে কোন দলও গড়ে ওঠেনি। তাই হয়তো বিচ্ছিন্নতাবোধ. . .
পারমিতা: এই সিদ্ধান্তটা কি খুব ফর্মালি নিয়েছিলেন?
সুনীল: আমি একদিন বলেছিলাম. . . আমাদের মধ্যে মতবিরোধ ছিলো, হাতাহাতিও হতো. . . তো আমি বলেছিলাম যে বাইরে এসব আমরা করবো না। আর আমি ঠিক করেছি, এখনও, যে যতদিন বেঁচে আছি, আমার বিরুদ্ধে যদি কেউ লেখেও, বন্ধুবান্ধব, আমি কারো বিরুদ্ধে লিখবো না, কখনোও না।
আর্যনীল: পঞ্চাশ দশকের কবিদের মধ্যে একটা স্ট্যামিনা, একটা হার-না-মানা রোখ, কবিতা লিখে পনটিয়াক চাওয়া- কত জেদ ছিলো, এতদশক ধরে এত কবি আর কখনো কবিতা লিখেছেন বলে জানি না। আমার মনে হয়েছে, আপনাদের পরবর্তী আর কোন প্রজন্মতে এইটা দেখা যায় না।
সুনীল: পঞ্চাশ দশক নিয়ে আমি খুব বেশী গর্ব বোধ করতে চাই না। পরের প্রজন্মে এটা ঠিকই এসে যাবে।
আর্যনীল: আপনার কি মনে হয় না এটা আপনাদের সময়ের প্রভাবও?
সুনীল: আমাদের সময়ে একটা র্যাডিকাল ব্যাপার ঘটে; আমাদের আগের কবিরা, যেমন ধরো ধুতি পাঞ্জাবী পরতেন। তাঁরা অল্পবয়স থেকেই খুব সাংঘাতিক ধরণের লোক ছিলেন। আমরা সেখানে প্যান্ট-শার্ট পরতাম। তোমাদের বললে মজা পাবে, প্যান্ট-শার্ট পরাটা তখন খুব সহজ ব্যাপার ছিলো না। এই নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। ১৯৬১ সালে যখন রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী হয়, মহাজাতি সদনে একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়- কবিরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবে। তা আমাদের মধ্যে কেউ কেউ গাইতো যেমন আমি, শক্তি এবং শরৎ- তা আমরা গান শুরু করলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম দর্শকদের মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠছে। সেটা ক্রমশ বাড়ছে। আমি ভাবলাম, এমন কিছু ভুল সুরে তো আমরা গাইছি না। এরপর বেশ চেঁচামেচি শুরু হলো, দর্শকরা ক্ষেপে উঠলো- আমরা তখনো বুঝতে পারছি না- আমাদের দোষটা কি! পর্দা ফেলে দেওয়া হলো, কর্তৃপক্ষ আমাদের পেছনের দরজা দিয়ে বের করে দিলেন। আমাদের দোষটা কি? আমরা প্যান্ট-শার্ট পরে গাইছিলাম। রবীন্দ্রসঙ্গীত প্যান্ট-শার্ট পরে গাওয়া হবে- এটা তখনকার দর্শকরা মেনে নিতে পারেননি। তা এইসব মূল্যবোধগুলো আমার কাছে হাস্যকর মনে হতো।
আর্যনীল: আপনারা যে স্বাধীনতাউত্তর ভারতে লিখতেন সেটা কি আপনাদের একটা জোর দিতো?
সুনীল: হ্যাঁ। আমাদের একটা শ্রদ্ধা এসে গিয়েছিলো স্বাধীনতার ওপর। একটা প্রতিবাদী মনোভাব তৈরী হয়ে যায়। তবে একটা পার্থক্য আছে। আজকাল যেমন অ্যান্টি-এসট্যাবলিশমেন্ট কথাটা খুব শোনা যায়। অনেকে ভালো করে বোঝেও না। এসট্যাবলিশমেন্ট হচ্ছে চারটে জিনিস- সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়, সংবাদপত্র আর গির্জা। যারা অ্যান্টি-এসট্যাবলিশমেন্ট মনোভাবাপন্ন তারা এই চারটের ধারেকাছে থাকবে না। কিন্তু এখন দেখি অনেকে সরকারী কাজ করে কিন্তু আনন্দবাজারে লেখাটাকে মনে করে এসট্যাবলিশমেন্ট ঘেঁষা আবার আনন্দবাজারটা এসট্যাবলিশমেন্ট কিন্ত আজকাল পত্রিকাটা নয়। এরকম আর কি! স্পষ্ট ধারণা নেই। আমরা তা ভাবিনি। আমরা কৃত্তিবাস করতাম ঠিকই। কিন্তু আমরা চাইতাম বড় বড় সমস্ত পত্রিকাগুলো আমরাই দখল করে নেবো, নিয়ে আমাদেরই কবিতা ওখানে. . . মানে আমরাই ওদের চেঞ্জ করে দেবো। হয়েছেও তাই। আমাদের আগে দেশ পত্রিকায় এক ধরণের ম্যাড়ম্যাড়ে, নিরীহ কবিতা ছাপা হতো, আমরা যাবার পরই প্রকৃত আধুনিক কবিতা এসেছে।
আর্যনীল: আপনার যখন কৃত্তিবাস করছেন তখন উল্লেখযোগ্য কাগজ আর কি কি ছিলো?
সুনীল: কৃত্তিবাস ছাড়া তখন. . .
আর্যনীল: শতভিষা ছিলো কি?
সুনীল: শতভিষা তারও আগে থেকে ছিলো, চটি পত্রিকা, তবে ওরা একটু রক্ষণশীল ছিলেন। বরং তার চেয়ে বলবো ‘পরিচয়’ পত্রিকা বেশ জোরালো ছিলো।
আর্যনীল: কে সম্পাদনা করছেন তখন ‘পরিচয়’?
সুনীল: সুভাষ মুখোপাধ্যায় তো? তাই না? নাকি গোপাল হালদার? ‘পরিচয়’-এর সম্পাদনা অবশ্য বহুবার পালটেছে। এছাড়া ছিলো ‘অগ্রণী’ বলে আরো একটা কাগজ। ভালো কাগজ, একটু বাম ঘেঁষা।
আর্যনীল: সুনীলদা, আপনারা পঞ্চাশের কবিরা যখন ষাটের দশকে লিখছেন, তখন আপনারা অনেক রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। সে সম্বন্ধে একটু বলুন।
সুনীল: হ্যাঁ। পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো কবিতায় করতেই হবে। নতুন শব্দ, ছন্দ ভাঙা, গড়া। শক্তি এসব অনেকে করেছে। প্রথম থেকেই ওর লেখার মধ্যে ব্যাপারটা ছিলো। আমার ক্ষেত্রে বলতে পারি বিশ্বসাহিত্য নিয়ে আমার একটা নিজস্ব দৃষ্টি ছিলো। আমেরিকায় থাকাকালীন পৃথিবীর নানা প্রান্তের অনেক কবিদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকার হয়, আলোচনা হয়, অনেক বিদেশী কবিতা পড়ি, এর ফলে এটা খুব সহজেই হয়। অনেকে বলেন- সুনীলের কবিতা খুব গদ্য ঘেঁষা, স্ট্রেট কাহিনী থাকে- কিন্তু এগুলোই তখন পৃথিবীর কবিতার ট্রেন্ড। লিরিক ভেঙে বেরিয়ে আসা। মিল দেওয়া বা ধ্বনিবহ্বল কবিতা তখন অন্য ভাষায় লেখা হচ্ছে না। এগুলোই আমি নিজের কবিতায় করেছি।
আর্যনীল: সুনীলদা, আমরা জানি না আইওয়ায় বসে আপনি বাংলা কবিতা লিখেছিলেন কিনা!
সুনীল: হ্যাঁ। আমার যেটা উল্লেখযোগ্য কবিতার বই ‘আমি কি রকম ভাবে বেঁচে আছি’ তার অধিকাংশ কবিতাই আইওয়াতে বসে লেখা। আমার ফরাসী বান্ধবী (মার্গারেট ম্যাথিউ) আমাকে ত্রিস্তান-এর গল্প পড়তে দিয়েছিলো। সেটা এতো ভালোলাগে যে, তোমরা জানো কিনা জানি না, ‘সোনালী দুঃখ’ বলে একটা বই আমি লিখি. . .
আর্যনীল: ওটা আমার প্রথম পড়া বাংলা বই।
সুনীল: হ্যাঁ। (হেসে) তো সময় ছিলো তাই ওটাও লিখি। কিন্তু ‘আমি কিরকমভাবে…’-র বোধহয় তিন-চতুর্থাংশ কবিতাই আইওয়াতে বসে লেখা।
আর্যনীল: আইওয়াতে যখন আপনি প্রচুর বিদেশী কবিতা পড়ছেন তখন কোন বিশেষ দু একজন কবির কবিতা কি আপনাকে প্রভাবিত করেছিলো?
সুনীল: তখন ধরো, দুটো পরিষ্কার ট্রেন্ড ছিলো মার্কিন কবিতায়। একটা হলো বিটনীক কবিদের ধারা। অ্যালেন গিন্সবার্গ, গ্রেগরী করসো, লরেন্স ফের্লিংগেটি বা ওদের বন্ধুরা সেই ধারায় পড়ে। আরেকটা হলো রবার্ট লে, বা মনে পড়ছে না, অন্যান্যরা…
আর্যনীল: টেড হিউস?
সুনীল: টেড হিউস। টেড হিউস? না, ও তো ব্রিটিশ। রবার্ট লে’র সঙ্গে আরো কয়েকজন ছিলেন। এদের মধ্যে বীট্ কবিদের সংগেই আমাদের মিল ছিলো। এই যে ওদের বিক্ষিপ্ত জীবনযাত্রা, নিজের দেশকে আক্রমণ করতে ভয় পায় না, পূর্ব প্রজন্মকে নস্যাৎ করে দেয়- এ সবের সঙ্গে আমার অন্তত মিল ছিলো। ফলে আমি ওদের কবিতাই বেশী পড়তাম।
আর্যনীল: কিন্তু আইওয়ায় থাকার সময় কি গিন্সবার্গের সঙ্গে আপনার আলাপ ছিলো?
সুনীল: হ্যাঁ। গিন্সবার্গ কলকাতায় আসে ৬২ সালে। আর আমি আইওয়ায় যাই ৬৩ সালে। এরপর গিন্সবার্গের নিউইয়র্কের ডেরায় আমি কিছুদিন ওদের সাথে থেকেছিলাম এবং ওদের জীবনযাত্রা একেবারে চোখের সামনে দেখে আসি।
আর্যনীল: ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’-তে সেই কথা আছে।
সুনীল: হ্যাঁ, পরেও ওর সাথে দেখা হয়েছে। বারবারই দেখা হতো। যেমন ধরো এঙ্গেল। খুব ভালো লোক। কিন্তু খুব প্রাচীনপন্থী কবি। আমি ভাবলাম গিন্সবার্গের সাথে পলের আলাপ করিয়ে দিই। ওদের কিন্তু আগে আলাপ ছিলো না। তা কথা বলছে দুজনে, কিন্তু একেবারে দুরকম। কোন মিল নেই। ভদ্র ব্যবহার করছে। কিন্তু কথাবার্তা সম্পূর্ণ দুধরণের।
আর্যনীল: দেখা যাচ্ছে তাহলে প্রধানত আপনার সমসাময়িক মার্কিন কবিরাই আপনাকে প্রভাবিত করেছিলো।
সুনীল: না, শুধু তা নয়। আমি স্প্যানীশ কবিতা পড়তাম, ফ্রেঞ্চ কবিতা, ইতালিয়ান কবিতা। তখন সারা পৃথিবী জুড়েই লিরিক ভাঙার একটা চেষ্টা চলছিলো। সেটাই আমার কবিতায় এসেছে।
আর্যনীল: এই প্রসঙ্গে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি। আপনি ‘অন্যদেশের কবিতা’য় এক জায়গায় সিম্বলিস্ট কবিতা সম্বন্ধে লিখেছেন যে ওঁরা কবিতায় একটা শব্দ ব্যবহার করতেন যার চলতি অর্থ এবং ব্যুৎপত্তিগত অর্থ আলাদা। কিন্তু দুটো অর্থই প্রযোজ্য কবিতায় ব্যবহারে। পরে আপনার কিছু কবিতা পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে এরকম একটা প্রচেষ্টা লক্ষ্য করেছি। যেমন ‘উনিশে বিধবা মেয়ে / কায়ক্লেশে ঊনতিরিশে এসে গর্ভবতী হলো’- এখানে ‘কায়ক্লেশে’ শব্দটা।
সুনীল: ‘কায়ক্লেশে’ শব্দটা তো? ঠিক। এগুলো তো করতেই হয়। সিম্বলিস্ট মুভমেন্টটা ১৯২৫-৩০-এর মধ্যে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আসলে কোন আন্দোলনই শেষ হয় না। একটা প্রভাব থেকেই যায়।
আর্যনীল: এটা কি আপনি খুব সচেতনভাবে করেছেন?
সুনীল: কবিতার প্রথম লাইনটাই কিভাবে আসবে কেউ জানে না। আকাশ থেকে আসে, ম্যাজিকের মতো। কিন্তু শব্দ নির্বাচনের ব্যাপারে কবির একটা সচেতনতা তো থাকবেই। ‘আমি কিরকম ভাবে…’-র যে লেখা, একেবারে নরম শব্দ হাতের মধ্যে না আসে সেই চেষ্টা করতে হয়েছে।
আর্যনীল: আপনি একটু আগে নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলছিলেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় নানা সময় নানা জায়গায় বলেছেন- সুনীলই আমার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। আপনিও কি তাই মনে করতেন?
সুনীল: (হেসে) না, না। আমি যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলছিলাম সেটা অন্যরকম। কেউ ভালো একটা কবিতা লিখলেই অন্যরা মনে করতো আমিও ওইরকম একটা লিখে দেখবো। শক্তির একটা স্বভাব ছিলো নানা জায়গায় উগ্র ধরণের কথা বলা। যেমন বলতো- আমি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আমিই একমাত্র কবিতা লিখতে পারি। অন্যেরা পারে না। তারপর নিজেকে একটু সংশোধন করে বলতো- একমাত্র সুনীল ছাড়া আর কেউ পারে না।
(আমরা সুনীলের বন্ধুকে নকল করার ভঙ্গি দেখে হাসতে থাকি। সিগারেট বুজে দিয়ে সুনীলও। )
আর্যনীল: আপনি বুদ্ধদেব বসুর কথা বললেন। ‘কবিতা’ পত্রিকা তরুণ কবিদের অনেকটা এগিয়ে দিতে পেরেছিলো। আপনারা প্রায় প্রত্যেকেই প্রথমদিকে ‘কবিতা’য় লেখালিখি করেছিলেন। কিন্তু ‘কবিতা’র পর আর কোন কাগজ কবিতা নিয়ে সিরিয়াস কাজ করেছিলো?
সুনীল: বুদ্ধদেব বসু অসাধারণ কাজ করেছিলেন। সেটা আমরাও পারিনি। প্রথম কথা ওঁর কাছে লেখা পাঠালে দুদিনে উত্তর চলে আসতো। কবিতা পাঠালে সংশোধন করতেন। আমার একটা কবিতা উনি একবার তিনবার সংশোধন করেন। আমি সেটা মানিনি। ফেরত পাঠিয়েছি। তারপর ছেপেছেন। কে আর পরে এত সময় কবিতাকে দিতে পেরেছেন।