• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৭ | মার্চ ২০০৬ | সাক্ষাৎকার
    Share
  • "হারানো ঘটনাবলীর প্রতিলিপি" -- গিরীশ কারনাড - সাক্ষাত্কার : অঞ্জলি নেরলেকার
    translated from English to Bengali by অংকুর সাহা
    প্রথম অংশ | দ্বিতীয় অংশ





    অঞ্জলি : এবার আপনার নিজের লেখালিখির বিষয়ে আসতে পারি? তিনটি নাটিকা গ্রন্থের ভূমিকায় আপনি লিখেছিলেন যে স্ট্রিন্ডবার্গের মিস জুলি নাটকটির অভিনয় দেখে আপনি নতুন পথের দিশা পেয়েছিলেন, যেমন আগে কখনো হয়নি। তা হলে আপনি আগে যক্ষগণ দেখেছেন, তার পরে স্ট্রিন্ডবার্গ?

    গিরীশ : আমার শৈশব কেটেছে শিরসি নামে পশ্চিমঘাট পাহাড়ের কোলে ঘন অরণ্যে ঘেরা এক মফস্বল শহরে। সেখানেই দেখি যক্ষগণের প্রযোজনা এবং অন্যান্য কোম্পানি নাটক, যেগুলো পার্সি থিয়েটারের মারাঠি সংস্করণের কন্নড় অনুকরণ।

    অঞ্জলি : আপনি যে যক্ষগণ বা অন্যান্য লোকনাট্য থেকে উপাদান ছেঁকে নিয়ে জুড়ে দিয়েছেন আপনার আধুনিক নাট্যচিন্তায় এবং সৃষ্টি করেছেন এক নতুন নাট্যশৈলির। আমার প্রশ্ন হল যে আপনাদের প্রজন্ম নাটকের জগতে এমন কি পরিবর্তন আনতে পেরেছেন যা আগের প্রজন্মে সম্ভব হয়নি? সত্যি কথা বলতে কি স্ট্রিন্ডবার্গ হলেন উনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে। তা হলে ৫০ বা ৬০ এর দশকে এমন কি ঘটেছে যে গভীর পশ্চিমী প্রভাব সত্ত্বেও আপনাকে প্রবলভাবে ফিরে আসতে হল প্রাচ্যকে খুঁজে আপন করে নিতে?

    গিরীশ : আমার কাছে স্ট্রিন্ডবার্গ এবং আনুই হল বিয়োগান্ত নাটকের দিগন্ত এবং মানবমনের অন্তর্নিহিত জগতের অনুসন্ধান। কিন্তু এসো আগে তোমার সামনে মঞ্চ প্রস্তুত করি। আমাদের নাটকে যে পশ্চিমী প্রভাব কেবলমাত্র বিংশ শতাব্দীতেই এসেছে তা নয়। আমরা যাকে ভারতবর্ষের আধুনিক নাট্যধারা বলি তার শুরু উনবিংশ শতাব্দীতে.... অনেক আগেই, প্রথম সহস্রাব্দের শেষ নাগাদ সংস্কৃত ভাষায় নাটক লেখার পাট চুকে গেছে। সেখান থেকে মহতী নাট্যসৃষ্টির সমাপ্তি, কিন্তু আঞ্চলিক ভাষাগুলির রমরমার শুরু। যাকে আমরা বলি লোকনাট্য বা আধা-ক্ল্যাসিকাল নাট্য। কিন্তু প্রায় এক হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষে বিশেষ কোন লিখিত নাটক নেই।

    অঞ্জলি : তার কারণ কি সেগুলি দেশজ, লৌকিক ভাষায় লেখা?

    গিরীশ : এ ব্যাপারে আমার একটা থিওরি আছে—সংস্কৃত নাটকগুলি লিখে রাখতে হত কারণ অভিনেতাদের বেশিরভাগ ছিলেন অব্রাহ্মণ। শুধু তাই নয়, অনেক সময় তাঁরা ছিলেন নিচু জাতের, অন্তেবাসী সমাজের মানুষ। তাঁদের বেশিরভাগেরই ছিল না কোন সংস্কৃত জ্ঞান, অক্ষরজ্ঞান পর্যন্ত ছিল না অনেকের এবং নিজেদের সংলাপের জন্যে তাঁদের নির্ভর করতে হত অন্যের মুখে বার বার আউড়ে যাওয়া লাইনগুলি শুনে শুনে কন্ঠস্থ করার ওপর। তার মানে নাটকের লিখিত প্রতিলিপির প্রয়োজন। যখন রাজদরবারে অভিনীত সংস্কৃত নাটকের সমাপ্তি ঘটলো, হু হু করে বাড়তে লাগলো আঞ্চলিক ভাষায় রচিত নাটকের সংখ্যা—অর্থাত্‌ মানুষের মুখের ভাষায় রচিত সংলাপ, যদিও সেই সব নাটকের শৈলি ছিল আড়ম্বরে ভরা এবং পোষাকি—সংলাপে এল বিরাট পরিবর্তন। সত্যি কথা বলতে কি, ভালো জাতের অভিনেতা মাত্রেই সংলাপে আনতেন বেশ খানিকটা তাত্ক্ষণিক উদ্ভাবন। সেটাই ভারতীয় শিল্পভাবনার মূল ধারা, তাই না? তাত্ক্ষণিক সংগীত, কবিতা, শিল্প। সংগীত এবং দেহভঙ্গির ভাষা চলে আসত বংশানুক্রমে। সংস্কৃতে তাত্ক্ষণিক উদ্ভাবনের সুযোগ নেই। আঞ্চলিক ভাষায় অগ্রগতির ফলে অভিনেতাদের সামনে এল সুবর্ণ সুযোগ।

    হাওয়াইতে অধ্যাপনারত অরিন্দম চক্রবর্তী এই সংস্কৃত নাটকে লিখিত রূপের আরেকটি কারণ দেখিয়েছেন। তাঁর মতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন আঞ্চলিক করদ-রাজ্যগুলির দরবারে ও রাজসভায় প্রবল আগ্রহ ছিল নাটক প্রযোজনা করার—রাজার হুকুম হলেই যে লেখকরা সঙ্গে সঙ্গে নতুন নাটক লিখে হাজির করবেন তা তো সম্ভব নয়। তাই পুরানো নাটকের পুঁথিগুলির ধুলো ঝেড়ে শুরু হয় তাদের প্রতিলিপি বানানো এবং বিভিন্ন রাজদরবারে পাঠানো। এ ছাড়া অন্য কোন ভাবে রত্নাবলী নাটকটি কাশ্মীরে এবং কেরালায় পাঠানো সম্ভব নয়। এটা সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা।

    অতএব, ঠিক যে সময় সংস্কৃত থিয়েটার ঘাটে উঠলো, ঠিক সেই একই সময়ে ধীরপায়ে আবির্ভাব হল আঞ্চলিক ভাষার সাহিত্যের। আঞ্চলিক ভাষাগুলি, মানুষের মাতৃভাষাগুলি সংস্কৃতকে ঠেলে সরিয়ে দিল মঞ্চ থেকে। কারণ যাই হোক, প্রায় হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষে কোন নাটকের লিখিত পাণ্ডুলিপি নেই—নবম শতাব্দী থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত।

    দলে দলে নাটক লেখা শুরু হল উনবিংশ শতাব্দীতে, মূলত: ব্রিটিশ প্রভাবে—শেক্সপিঅর ও গোল্ডস্মিথ, আর অবশ্যই উত্কট ভাবালুতার নাট্যকার স্ক্রাইব এবং সার্দো। ভিক্টোরিয়ান নাটকের দলগুলির ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে সফরের ফলে তাদের অনুকরণে তৈরি হল এক নতুন ভারতীয় থিয়েটার। এর আগে অব্দি উচ্চ বর্ণের ও উচ্চ শ্রেণীর মানুষেরা থিয়েটারকে ভালো চোখে দেখতেন না। কিন্তু একদিকে শেক্সপিঅরের বিশ্বজোড়া খ্যাতি, অন্যদিকে যেহেতু ব্রিটিশ প্রভুরা থিয়েটারকে সংস্কৃতিবান মানুষের যোগ্য বিনোদন বলে গণ্য করেন—দুই মিলে ভারতীয় শহুরে উচ্চ-মধ্যবিত্তেরা যাঁরা ব্রিটিশভজনা করেন, তাঁদের কাছে ধীরে ধীরে থিয়েটার গ্রহণযোগ্য হয়ে দাঁড়ালো। কির্লোস্কার, গাদকারি, গিরীশ ঘোষের মতন অভিজাত বুদ্ধিজীবীরা নাটক লিখতে শুরু করলেন এবং নাটকের দল খুললেন। কিন্তু তাঁরা আবার এই ব্রিটিশ ধারণার উত্তরসূরি যে থিয়েটারকে সফল ব্যবসা হতে হবে। এমন ভাবে নাটক প্রযোজনা করতে হবে যাতে দলে দলে দর্শক এসে প্রেক্ষাগৃহে জমা হন, নাটকের প্রচার বাড়ে এবং লগ্নীকৃত টাকা পয়সা উঠে আসে প্রযোজকদের হাতে। অর্থাত্‌ অর্থ উপার্জন। পশ্চিম ভারতে পার্সি থিয়েটার যখন বাণিজ্যিক সফলতা পেল, সারা ভারতে শুরু হল তার অনুকরণ। কিন্তু বাণিজ্য নিয়ে এতটা মাথাব্যথা থাকলে, নাটকে গুণগত দিকগুলোতে মনোনিবেশ করা অসম্ভব। অতএব যেসব নিরেস মাল লেখা হতে থাকলো তারা ফাঁপা, অসার অথচ চটুল আনন্দদায়ক। উনবিংশ শতকে এবং বিংশ শতকের প্রথমদিকে নাটক কোম্পানির মঞ্চস্থ করা নাটকগুলি, মারাঠি, বাংলা, গুজরাতি, কন্নড়—যে ভাষাতেই হোক না কেন, নাট্যরসের দিক থেকে অযোগ্য ও মূল্যহীন।

    গত শতকের তিরিশের দশকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষেরা আগ্রহী হলেন থিয়েটারে, প্রযোজনা শুরু হল রাজনীতি সচেতন, সমাজ ভাবনায় ভরপুর নাটকের—তারা মূলত: বার্নাড শ' ও ইবসেনের প্রভাবিত। বাণিজ্যিক নাটকের বদলে সাহিত্যের নাটক। সমাজ সংস্কার তাদের উদ্দেশ্য।

    ১৯৫৮ সালে বি এ ডিগ্রি শেষ করে আমি বোম্বাই গেলাম রাশিতত্ত্বে এম এ করতে। থিয়েটার দেখা হল প্রচুর, তাদের মধ্যে ইব্রাহিম আলকাজি নামে এক তরুণ পরিচালক আমায় প্রভাবিত করলেন সবচেয়ে বেশি। তাঁর ঝোঁক ছিল কম্পমান নায়িকা সমেত দুর্বোধ্য, রহস্যময়, তীব্র অনুভূতির নাটকের দিকে। জীবনের ট্র্যাজিক সংস্করণ। স্ট্রিন্ডবার্গ, আনুই, গ্রীক নাট্যকারেরা। বিশেষ করে আনুই এর আন্তিগোনে ও ইউরিডাইস। নাটকগুলির অভিনয় দেখে আমার সামনে নতুন দরজা খুলে গেল : মিথ নিয়ে কিভাবে কাজ করা উচিত .... এবং রামানুজন সব সময় তর্ক করতেন এই বলে যে ভারতবর্ষের ভাঁড়ারে যত বিভিন্ন কাহিনীর রতন, মহাকাব্য এবং লোককথায় উভয়ত—তাদের ব্যবহার না-করে উপায় নেই। অবশ্য প্রথম থেকেই বর্তমান আমাদের পৌরাণিক নাটকের ঐতিহ্য—কিন্তু সেখানে ভাবের মূল ধারাটি হল ভক্তি। ঈশ্বরের মহানুভবতায় গভীর বিশ্বাস এবং দেবতার দয়ার কাছে ভক্তিপূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে অন্তিম মুক্তি। আঞ্চলিক ভাষাগুলিতে সঙ্গীত ও নাটকের পুনর্জাগরণ আসলে চরমপন্থী ভক্তি আন্দোলনের কাছে অনেকটাই ঋণী; সেটা আবার সংস্কৃত নাটকের গঙ্গাজল ধোয়া পূত আচার-আচরণের ভণ্ডামির সম্পূর্ণ বিপরীত। কিন্তু পরে আবার সেই আন্দোলনকারীরাই প্রচার শুরু করলেন যে যেসব নাটক ঈশ্বরের মহিমার গুণকীর্তনের সঙ্গে জড়িত নয় তাদের মহামারীর মতন বর্জন করা হোক। সুতরাং পৌরাণিক মানে দাঁড়ালো আবেগপ্রবণ এবং ধার্মিক। যেমন রামায়ণের নাট্যরূপ দেবার সময় তুমি বুঝতেই পারবে যে দর্শক শ্রোতারা ভক্তিরসে আপাদমস্তক সিঞ্চিত এবং তাঁরা আগেই মনস্থির করে বসে আছেন—সেখানে তোমার নতুন কোন বক্তব্য রাখার সামান্যতম সুযোগ পর্যন্ত নেই। কিন্তু আনুই এর নাটক দেখে আমার টনক নড়লো যে ভক্তিরসকে পুরোপুরি বাদ দিয়েও ভারতীয় পুরাণের চরিত্র ও কাহিনী নিয়ে কাজ করা সম্ভব, যেমন ধর, যযাতির গল্প। কিংবা যবকৃতের কাহিনী, যাকে আমি পঁয়ত্রিশ বছর ধরে লালন-পালন করেছি আমার অন্তরে, তারপর নাটক লিখেছি আগুন ও বর্ষণ (অগ্নি মাত্তু মালে)। তুমি তাঁর উরুভঙ্গম এবং কর্ণাভরম নাটকে বিয়োগান্ত ভাষা ব্যবহারের সুপ্রযুক্ত উদাহরণ পেয়ে যাবে। কিন্তু আমি ওই নাটকগুলি পড়েছি অনেক পরে।

    অঞ্জলি : আপনি ইংল্যন্ড থেকে ভারতবর্ষে ফিরে এলেন, তখনো রামানুজন কিন্তু থেকে গেলেন আমেরিকায়। আপনার কি মনে হয় যে আপনার মাতৃভূমি, দেশ এবং নিজস্বতার ওপরে আপনার বাসস্থানের কোন প্রভাব রয়েছে?

    গিরীশ : আমরা বেশিরভাগ যারা তখনকার দিনে ইংল্যাণ্ডে গিয়েছিলাম, প্রায় সকলেই ফিরে এসেছিলাম দেশে। আমার সঙ্গে যে-কজন রোডস বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র ছাত্রী ছিলেন, সকলেই ফিরে এসেছিলেন। আমাদের ফিরে আসার কারণ তখন স্বাধীন দেশটির বয়েস মাত্র দেড় দশক এবং সব ধরনের কর্মক্ষেত্রেই তৈরি হচ্ছিলো নতুন কিছু করার উদ্যোগ ও সুযোগ।

    অঞ্জলি : কিন্তু রামানুজনের ব্যাপারটা কি?

    গিরীশ : তিনি বিদেশ যাবার আগেই এখানকার শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন এবং তাঁর অভিজ্ঞতা একেবারেই সুখকর নয়—তাই তিনি আর ফিরলেন না। তুমি কি তাঁর কর্ণাটক বিশবিদ্যালয়ে চাকরির সন্ধানে আসার গল্প শুনেছো?

    অঞ্জলি : না তো, শুনিনি।

    গিরীশ : এটা তাঁর আমেরিকায় যাবার আগের ঘটনা। বরোদা থেকে তাঁকে ধারওয়াড়ে ডাকা হয়েছিল ইংরেজি বিভাগের একটি চাকুরিতে ইন্টারভিউ এর জন্যে। ধারওয়াড়ে আসার সময় ট্রেনে এক সহযাত্রীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়, যিনি তাঁকে বলেন যে তিনি ওই চাকুরির জন্যে আগেভাগেই নির্বাচিত হয়ে আছেন এবং ইন্টারভিউটি একটি লোক দেখানো সাজানো ঘটনামাত্র। শুনে রামানুজন অসম্ভব হতাশ হয়ে পড়েন। তিনি ইন্টারভিউ বোর্ডকে বলেন, "দেখুন, আমাকে এই ইন্টারভিউতে না ডাকলেই পারতেন। আমাকে ট্রেনের টিকিট কিনতে হয়েছে নিজের খরচে, অথচ অপচয় করার মতো একটি পয়সা আমার নেই। উপাচার্য, যিনি ইন্টারভিউ বোর্ডের মাথা, তিনি অন্যদিকে তাকিয়ে না শোনার ভান করলেন। একদিক থেকে বলতে গেলে তাঁর ভাগ্য ভালো তিনি চাকরিটা পাননি। মার্কিন শিক্ষা ব্যবস্থায় তাঁর নিজস্ব প্রতিভা সহজেই স্বীকৃত হয় এবং বিকাশ হবার সুযোগ পায়। আমাকে এসব ঝামেলা পোহাতে হয়নি, কারণ আমি তখন ছাত্র ছিলাম। অবশ্য যদিও তিনি আমেরিকায় চাকরি করেছেন, তিনি নিজের ক্ষমতার ব্যবহার করে এমন সব কাজ হাতে নিয়েছিলেন, যা ভারতবর্ষের সঙ্গে যুক্ত। সত্যি কথা বলতে কি চিকাগোতে শিক্ষকতার সময় তিনি ক্ষেত্র অনুসন্ধানের সূত্রে অনেকটা সময় ভারতে কাটাতে পেরেছেন। ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করলে তিনি এই ধরনের গবেষণার জন্যে অর্থ, সময় বা উত্সাহের সংস্থান করতে সক্ষম হতেন না।

    অঞ্জলি : আপনার তিনটি নাটিকা গ্রন্থের ভূমিকার শেষদিকে আপনি লিখেছেন, ভারতীয় থিয়েটারের প্রধান সমস্যা হবে তার ভারতীয়ত্বের সংজ্ঞা নির্ধারণ। ঠিক কি বলতে চেয়েছেন আপনি?



    গিরীশ : অন্তত: ষাটের দশকে সেই ছিল আমাদের চিন্তাভাবনা। স্বাধীনতার পর আমরাই প্রথম প্রজন্ম যারা প্রাপ্ত বয়েসে পৌঁছেছি। এখনকার তরুণ নাট্যকারদের মনের ভাব আমি ঠিক বোঝাতে পারবো না। আর সত্যি-সত্যিই স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে ভারতীয়ত্বের পরিচয় নিয়ে আর মাথা ঘামানোরই কোন প্রয়োজন দেখি না। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে তখনো আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতির জগতে ব্রিটিশ চিন্তাভাবনার রমরমা আর ব্রিটিশ মঞ্চে তখন জর্জ বার্নাড শ'র প্রাধান্য। ভারতবর্ষে যাঁরা তাঁর অনুকরণ করতেন তাঁদের কাছে নাটক বলতে ছিল বুদ্ধিদীপ্ত, রসময় সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক এবং উদারনৈতিক আদর্শকে তুলে ধরা। তুমি যদি আধুনিক হও, তুমি শ'এর মতো লিখবে, তোমার নাটকের ঘটনা ঘটবে বসবার ঘরে তিনটি সোফা আর একটি টেবিলকে কেন্দ্র করে। মামা ভারেকার, আদ্য রঙ্গাচার্য এই মডেলকে ভিত্তি করে বাস্তবতার নাটক লিখেছিলেন; এঁদের নাম বলছি কারণ এঁরা সিরিয়াস এবং ভালো মানের নাট্যকার। সঙ্গীত, রং, গতিময়তা—সব কিছু যেন ধুয়ে মুছে বাদ দেওয়া হয়েছে। আর তুমি তো জানবেই, এমন কি লন্ডনেও শ' এর প্রভাববৃত্তের বাইরে আসার প্রয়াসে যখন ক্রোধের নাটক বা খিচুড়ি নাটকের অভিনয় শুরু হল, সেখানেও কিন্তু দৃশ্যের সেট বসানো হল অন্দরমহলে এবং অনেক কষ্ট করেই দৈনন্দিন জীবনের ভাষাবাচন এবং তুচ্ছ ডিটেল পর্যন্ত তুলে ধরা হল—জামা ইস্ত্রি করা থেকে শুরু করে রান্নার বাসনকোসন। এবং তাদের বাস্তবতার প্রকাশ মন খারাপ করে দেবার মতন—আমার তো দম আটকে আসতো। শেক্সপিঅর দেখতে ভালো লাগতো খুব। আমার জীবনে তখন পর্যন্ত কলেজে ভালো করে ইংরেজি শেখার জন্যে বোরিং টেক্সটবই ছাড়া শেক্সপিঅরের কোন উপস্থিতি ছিল না। মঞ্চে আমি তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার করি আমার `সমসাময়িক নাট্যকার' হিসেবে। ব্রেখ্ট পড়ি এবং (এখন বুঝতে পারছি যে) বদহজম করি, সেটা অবশ্য দুর্ভাগ্যের ব্যাপার না। বাতাসে তখন ভাসছে অস্তিত্ববাদ।

    আমি নতুন কিছু সৃষ্টি করার জন্যে মরিয়া ছিলাম। ডোভারে যাবার জন্যে জাহাজে ওঠার আগে যযাতি লেখা শেষ করি—পুরো নাটকটা বেরিয়ে আসে স্রোতের মতন, যেন আনুই রচিত আন্তিগোনের নির্দেশ মেনে। তিন বছর পরে ঘরে ফিরছি যখন, আমার পেটের ভেতর গজগজ করছে তখন ম্যাকবেথ, গ্যালিলিও, ক্যালিগুলা, ইভান দা টেরিবল। বলতে পারো, ভারতীয় পথ্য নয়। কিন্তু আমি তখন মহম্মদ তুঘলককেও আবিষ্কার করেছি, যা ভারতীয় তো বটেই, অথচ উজ্জ্বল, প্রথাবিরোধী, বাতিকগ্রস্ত, উদাসীন। আর সেখানে কোন বসবার ঘর নেই!

    অঞ্জলি : তাহলে আপনার প্রথম দিকের রচনায় দেশ ও জাতির অস্তিত্ব কোথায়?

    গিরীশ : আমি অক্সফোর্ডে যাই ১৯৬০ সালে। দেশ স্বাধীন হয়েছে সবেমাত্র বারো বছর। আমরা কয়েকজন ভারতীয় মাত্র, প্রাক্তন উপনিবেশের সবেমাত্র স্বাধীন হওয়া মানুষ, রোমান্টিক নাগরিক; সেই স্বাধীনতা আবার এসেছে এক নতুন উপায়ে—অহিংসা, যা মানুষের ইতিহাসে প্রথম। নেহরু তখন তৃতীয় বিশ্বের অবিসম্বাদিত নেতা এবং তাঁর গোষ্ঠী নিরপেক্ষতার নীতি উচ্চ-প্রশংসিত। আর একথাও মনে রাখতে হবে যে পাঞ্জাব থেকে আসা প্রথম দফা অভিবাসীর দলকে বাদ দিলে ব্রিটেনে তখন ভারতীয়ের সংখ্যা খবই কম। তাই আমরা যেকজন ভারতীয় সেখানে ছিলাম, নিজেদের আমরা দেশ ও জাতির প্রতিনিধি বলে ভাবতাম। আমি অক্সফোর্ড ইউনিয়নে সক্রিয় ছিলাম এবং তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলাম। সেসব খুব উন্মাদনার দিন। আবার অন্য দিকে ছিল কাশ্মীর। চীনযুদ্ধে মহা দুর্যোগের পর এল গোয়া মুক্তির অভিযান। ভারতবর্ষের কথা ছিল সর্বত্র।

    ১৯৬০ এর দশকে অক্সফোর্ডের ব্রিটিশ সমাজেও ঘটছিল নানান চমকপ্রদ ঘটনা। পাবলিক স্কুলের সেরা সেরা ছাত্রছাত্রীরা এসে অক্সব্রিজের মতন সম্ভ্রান্ত প্রতিষ্ঠানে এসে ঢুকবে, এই বিশ্বাসটাই মুছে যাচ্ছিল মানুষের মন থেকে। বেশিরভাগ নতুন ছাত্র তখন আসছিল গ্রামার স্কুল এবং বুনিয়াদি বিদ্যালয়গুলি থেকে; খেটে খাওয়া মানুষের পরিবার থেকে—গুণের কৌলীন্যে, বংশের কৌলীন্যে নয়। বাধ্যতামূলক জাতীয় (অর্থাত্‌ সামরিক) সেবার আইনটি উঠে গেছে, অতএব ব্রিটিশ কলেজের ছাত্রদের লেখাপড়া শুরুর বয়েস একুশ থেকে কমে আঠেরো হয়েছে। যারা তাদের যৌবনের তিন বছর অকালে হারিয়েছে, তাদের মনে প্রচণ্ড রাগ। বিভিন্ন দলের মধ্যে মানসিক উত্তেজনা বেশ প্রবল। আমি বিদেশি, কিন্তু স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতির সংগে আমার যোগাযোগ গভীর—বিভিন্ন সভায় ও মানুষজনের গৃহে আমার ছিল অবাধ যাতায়াত, যা কোন কোন ব্রিটিশ ছাত্রের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ইওরোপে তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরাজিত জাতিরা, যেমন জার্মানি, হু হু করে চালিয়ে যাচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নতি, পিছিয়ে পড়ছে ব্রিটেন। সেখানে থেকে কোনমতেই মাতৃভূমির থেকে দূরে যাওয়া সম্ভব নয়। স্বভাবতই এসব আলোচনা থেকে ভারতের কোন পথে এগোন উচিত, তা নিয়ে অনেক নতুন পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয়।

    অঞ্জলি : আর আপনি ছিলেন ....?

    গিরীশ : ম্যাগডালেন কলেজে।

    অঞ্জলি : আপনার সাহিত্য রচনায় কি তার প্রতিফলন দেখতে পান?



    গিরীশ : আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ সেখান থেকেই, বলতে গেলে আমার পুরো জীবনদর্শন। আমার অভিজ্ঞতার অন্য দিকটাও বলা উচিত। অক্সফোর্ডে ওই তিন বছর আমার জীবনের খুব প্রিয় সময়। রাজনৈতিক তত্ত্বে ও দর্শনে যে কঠোর তাত্ত্বিক শিক্ষণ আমি পেয়েছিলাম, আমার দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারে তা খুব কাজে লেগেছিল পরে। সেখানে তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শ্রেণীর ছাত্র—অভিজাত বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর অংশ—কিন্তু কখনোই ব্রিটিশ বা ভারতীয় হিসেবে পরিচিত নও। এরকম সচেতন জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনা আমি বহুদিন করিনি—পরে করেছিলাম ১৯৯৭ সালে টিপু সুলতানের স্বপ্ন লেখার সময়—বিবিসি'র কমিশান পেয়ে নাটকটির জন্ম হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে। সেখানে দেশ ও জাতির কথা সবিস্তারে রয়েছে। কিন্তু দুর্দৈব এই যে তার লক্ষ্য দক্ষিণপন্থী হিন্দুসমাজ, ব্রিটিশ সমাজ নয়।

    অঞ্জলি : আবার তাহলে ভারতের পরিবেশে ফিরে আসা যাক। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ভারতীয় নাটকের এই হঠাৎ বিকশিত হবার কারণ কি?

    গিরীশ : ৫০ এর দশক থেকে শুরু করে ৮০র দশক পর্যন্ত অনেক তরুণ লেখকেরা নিজের প্রচেষ্টায় নাটক রচনা করছিলেন—ব্যবসায়িক নাটকের সঙ্গে কোন সম্পর্কই ছিল না তাঁদের। সেইসময় থেকেই সিরিয়াস নাট্যসাহিত্যের উদ্বোধন—কারণ তাঁদের কাছে নাটক একটি বিশেষ শিল্পমাধ্যম, যার নতুন সম্ভাবনায় তাঁরা যারপরনাই উদ্দীপ্ত, কিন্তু অর্থোপার্জনের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই তার। আমার সৌভাগ্য যে আমি সেই প্রজন্মের অন্যতম। যেমন ধর, তেণ্ডুলকার—পেশায় সাংবাদিক কিন্তু অ্যামেচার নাট্যগোষ্ঠীর জন্যে নাটক লিখতে কলম ধরেন; মোহন রাকেশ, তখনও পর্যন্ত তাঁর পরিচয় ছোটগল্পের শক্তিশালী লেখক; বাদল সরকার, পেশায় এঞ্জিনিয়ার। এঁরা সবাই কিন্তু কোমর বেঁধে নাটক লেখার কাজে লাগলেন। প্রথম আধুনিক ভারতীয় নাটক, আমার মতে হল অন্ধ যুগ, সাংবাদিক এবং হিন্দি ছোটগল্পের লেখক ধর্মবীর ভারতীর ১৯৫৪ সালের রচনা। নাটকটি একেবারেই মঞ্চের জন্যে লেখা হয়নি, হয়েছিল রেডিওর জন্যে। এমনকি আদ্য রঙ্গাচার্য, যিনি ৩০ এর দশক থেকে কন্নড় ভাষায় নাটক লিখে চলেছেন, তার দুটি সেরা নাটক, কাত্তালে-বেলাকু এবং কেলু জন্মেজয়—দুটোই এই সময়কালের রচনা। এই নবনাট্য আন্দোলন তার অনেক কুশীলবের কাছেই ছিল জীবনের ব্রত। শুধু নাট্যকাররাই নন, নাট্য পরিচালকেরা (যেমন সত্যদেব দুবে, অরবিন্দ দেশপাণ্ডে, বি ভি করন্থ, শ্যামানন্দ জালান), অন্যান্য শিল্পী (যেমন শিবপুরী, সুলভা দেশপাণ্ডে, ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা-র ছাত্রছাত্রীরা)—সবাই ছিলেন উত্সাহে ভরপুর।

    অঞ্জলি : এই আন্দোলনে তাহলে লোকনাট্যের কোন ব্যবহারই ছিলো না?

    গিরীশ : না, এঁদের বিশেষ কেউ সংস্কৃত নাটক পড়েননি, লোকনাট্য নিয়েও কোন গভীর জ্ঞানগম্যি ছিলো না। ৫০ এর দশকে দিল্লীতে সঙ্গীত নাটক একাদেমির এক সেমিনারে একদল তর্ক জুড়েছিলেন, যাঁরা বাস্তবকে নিয়ে নাটক লেখেন না, তাঁরা প্রকৃত অর্থে আধুনিক নন; এবং লোকনাট্য নিয়ে যারা হৈচৈ করেন তাঁরা পশ্চাদগামী। তারপর ৬০ এর দশকের শুরুতে প্রাচীন নাটক ও লোকনাট্য নিয়ে আরেকটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু এই সব নাট্যশৈলি নিয়ে কারুর বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না।

    তোমাকে বলি, হয়বদন নাটকটি কিভাবে মাথায় এলো। কথা হচ্ছিল বি ভি করন্থের সঙ্গে টমাস মান রচিত মস্তক বিনিময়ের কাহিনী নিয়ে—কথাসরিৎসাগরের গল্প। আমি বলছিলাম যে উপন্যাসটি নিয়ে একটি উপভোগ্য চলচ্চিত্র হতে পারে। করন্থ বললেন, "না, তার থেকেও ভালো হবে নাটক।" ব্যস, বিদ্যুচ্চমকের মত পুরো নাটকটি ভেসে উঠলো চোখের সামনে। মস্তক বিনিময় দেখাতে হলে মুখোশের ব্যবহার প্রয়োজন। আর প্রয়োজন সঙ্গীত ও মূকাভিনয়ের। আমরা দুজনেই ভীষণ উত্তেজিত। করন্থ বললেন, "আমি জানি তুমি লিখতে বসে যাবে এখনই", এবং আমি গেলামও। করন্থ তার শৈশব কাটিয়েছেন যক্ষগন দেখে আর কৈশোরে দেখেছেন গুব্বি নাটক কোম্পানির প্রযোজনা, তিনি কিভাবে সঙ্গীত ও কোরিওগ্রাফি পরিচালনা করতে হবে, বিশেষভাবে জানতেন। লোকনাট্যের উপাদান ও পদ্ধতিগুলি নিয়ে সম্ভব হয়নি গভীর গবেষণা— যা ছিল আমাদের শৈশবস্মৃতিতে সুপ্ত, তাই লেগে গেল নাটকের কাজে। দুবে এবং করন্থ দুজনে আলাদা আলাদা করে হয়বদন প্রযোজনা করেছিলেন, তাঁদের পদ্ধতি ছিল একে অন্যের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সৃষ্টির উত্সমুখটিকে যেন হাঁ করে খুলে দিল হয়বদন—একে একে স্রোতে ভেসে এল—ঘাসিরাম কোতোয়াল, চরণদাস চোর এবং আরো অনেকগুলি নিরীক্ষামূলক নাটক।

    আমি কথাটা তখন বুঝতে পারিনি, কিন্তু এখন অতীতের দিকে তাকিয়ে মনে হয় আমার জীবনে একটা বড় সুবিধে ছিল সিরসি শহরে শৈশব কাটানো। সেখানে আমার ১৪ বছর বয়েস পর্যন্ত শহরে বিদ্যুত্‌ আসেনি। এখন উপলব্ধি করা প্রায় অসম্ভব ভারতবর্ষে বিদ্যুতের আবির্ভাবের ফলে মানুষের জীবন গুণগতভাবে কতটা পরিবর্তিত হয়েছে।

    অঞ্জলি : ঠিক কথা। আমার যেখানে দেশের বাড়ি সেই কাডেকোডি গ্রামেও বিদ্যুত্‌ ছিল না, সন্ধের পর তেল দিয়ে বাতি জ্বালানো হত।

    গিরীশ : সাড়ে ছটা বাজলেই দিনের সমাপ্তি, রাত আটটা নাগাদ পৃথিবী শুনসান; সাড়ে আটটায় ঘুমিয়ে পড়বে পরিবারের সবাই। যখন ছাত্ররা ক্লাসে এসে মিলতো সবাই যে যার নিজের কাহিনী শোনাতো কারণ আর তো কিছু করার ছিল না। আমাদের মধ্যে যারা বেশি বুদ্ধিমান, তারা খুঁজে পেতে নানান গালগপ্পো সংগ্রহ করতো এবং পরের দিন তাক লাগিয়ে দিত ক্লাসের অন্যদের। আমার এখনো মনে আছে ক্লাসের সবচেয়ে সেরা গল্প-বলিয়ে ছেলেটিকে এবং তার অনেক গল্পের কথাও। রাত্রিগুলি ছিল ভূত প্রেতাত্মায় ভরা, চাভাণ্ডির মত পেত্নিরা পিঠে চড়-চাপড় মারতো হয় রাস্তার মোড়ে, না হয় সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার সময়; অস্থির আত্মহত্যায় ছায়াময় কাহিনী, অবাধ্য নদীতে ব্রিজ বানানোর আগে গাঁথুনি শক্ত করার জন্যে নাকি এক গর্ভবতী মহিলাকে সেখানে বলি দেওয়া হয়েছিল, এইসব। আরো নানা ভয়ংকর রসের গল্প—এক বালকের পক্ষে তা অস্বাভাবিক নয় মোটেই—এই ছিল আমার প্রথম জীবন।

    আমার পরবর্তী জীবন কাটে তোমাদের সমাজেই, হাভ্যক সমাজ, সবচেয়ে শিক্ষিত এবং সংস্কৃতিমনা গোষ্ঠী, ওই এলাকার মধ্যে। ওইসব মানুষের মধ্যে নাটক ভীষণ জনপ্রিয় ছিল। তাঁরা যক্ষগণ মঞ্চস্থ করেছিলেন, সামাজিক নাটকে অভিনয়ও করতেন। নাটক লিখতাম ও মঞ্চস্থ করেছি আমরা সবাই। আর আমাদের স্কুল—মারিকাম্বা হাই স্কুলে ছাত্রদের উত্সাহ দেওয়া হত নাটককে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করার জন্যে। হাভ্যক ব্রাহ্মণ সমাজের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল তাদের জীবনে কবি লক্ষ্মীশা রচিত মধ্যযুগের মহাকাব্য জৈমিনি ভারত এর মুখ্য ভূমিকা—সেখান থেকেই মধ্যযুগের কন্নড় ভাষা ও পুরাণে আমার আজীবন আগ্রহের শুরু।

    তেণ্ডুলকার আমাকে বলেছেন, তিনি যখন যযাতি মঞ্চে প্রথমবার দ্যাখেন (সত্যদেব দুবের পরিচালনায়), তিনি ভীষণ অবাক হয়েছিলেন, তিনি এর আগে কখনো পৌরাণিক চরিত্রগুলিকে রক্তমাংসের মানুষের মত ব্যবহার করতে দেখেননি। সাধারণত তারা চড়াসুরে চেঁচায় এবং সুযোগ পেলেই আউড়ে যায় নীতিবাক্য—কিন্তু আমার নাটকে এরকম মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ একেবারেই অনুপস্থিত। আমি বাস করতাম সেই পৌরাণিক রাজ্যে।

    এবং ফরাসি নাট্যকারদের প্রতি আমার সচেতন আকর্ষণ ছিল—আনুই, সার্ত্রে, ককতো, জিরাদো ও অন্যেরা। আমি প্রায় সবসময়ই ফরাসি থিয়েটারের একটা মডেল বেছে নিয়ে গভীরভাবে তাকে অনুধাবনের চেষ্টা করতাম।

    অঞ্জলি : পুরাণের এই ব্যবহারের অন্য একটা দিক নিয়ে আমার প্রশ্ন রয়েছে। পাউন্ড চিনে গেলেন, তারপর প্রভঁসে গেলেন তাঁর পুরাণকে খুঁজতে। পেলেন এক ইতিহাস ও পুরাণ যা তাঁর নিজের নয়। সেইরকম এলিয়ট আর বেদ। কিন্তু আপনি যা করলেন অথবা রামানুজন যা করেছিলেন তা হল নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও পুরাণকে সাহিত্যসৃজনে ব্যবহার করা। সেটা কিভাবে আলাদা, যদি আদৌ আলাদা হয়?

    গিরীশ : খুব খাঁটি কথা। কিন্তু অনেক সময় যা তোমার সামনেই রয়েছে, সবার চোখের নাগালে পড়ে রয়েছে উঠোনে—কিন্তু অন্য কেউ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে তার কদর বোঝা যায়। রামানুজনের ক্ষেত্রে এই ঐতিহ্যের অনুসন্ধান খুব স্বাভাবিকভাবেই এসে যায় আমার তুলনায়। তিনি শুরু করেছেন মৌখিক কাহিনীর সংগ্রহ দিয়ে—সঙ্গে সঙ্গে লোককথা এবং শব্দের খেলা। এই বিষয়গুলি মোহিত করতো তাঁকে এবং তিনি মন ঢেলে দিতেন তাতে। তিনি জানতেনও না যে এইসব লোককথার পেছনেও রয়েছে বিজ্ঞান। আমি তাঁকে অনুসরণ করেই এগিয়েছি।

    তিনি ছিলেন কবি ও ভাবুক; আমার জগত ছিল নাটকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। "প্রভাবের উদ্বেগ" নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন হ্যারল্ড ব্লুম। ভাগ্যের বিষয় সেরকম কোন উদ্বেগ আমার কাজে বাধার সৃষ্টি করেনি। আমাকে প্রভাবিত করেছেন অনেক পূর্বসূরি, কিন্তু রামানুজন সবার থেকে আলাদা; তিনি সেই অল্প কয়েকজনের দলে যাঁরা সম্পূর্ণ নতুন পথ দেখিয়েছেন আমাকে। তা হলেই দ্যাখো, যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে এসেই শেষ করলাম আবার।



    টীকা :

    -হারানো ঘটনাবলীর প্রতিলিপি—নামটি এসেছে আদারাল্লু ইডু নামে রামানুজনের কন্নড় ভাষায় রচিত একটি কবিতা থেকে। কবিতার বিষয়বস্তু মানব জীবনের প্রতিটি বাস্তব অভিজ্ঞতার ছিদ্রময়তা এবং কিভাবে ভেঙে ফেলা যায় বিভিন্ন পার্থিব ও তাত্ত্বিক সীমারেখা। যেভাবে কারনাডের নিজের কথা বলতে গিয়েও চলে আসে রামানুজনের কথা, যেভাবে তাঁদের দুজনের জীবন ও সাহিত্যের টানাপোড়েন ও সম্পর্ক এগিয়ে চলে, তাতে এই কবিতাটির তাত্পর্য হয়ে ওঠে আরো জীবন্ত।

    -বচন—অন্য নাম কন্নড় উপনিষদ; সংস্কৃতের বদলে স্থানীয় চলিত ভাষায় লেখা। কবিদের বলা হয় বচনকার—তাঁরা বীরশৈব আন্দোলনের সাধক কবি।

    -বীরশৈব—দক্ষিণ ভারতে লিঙ্গায়ত গোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস। মহীশূর অঞ্চলে দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে ভক্তি আন্দোলনের সুবাদে এই ধর্মবিশ্বাসের সৃষ্টি। বাসব হলেন এঁদের সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ধর্মগুরু।

    -সঙ্গম সাহিত্য—তামিল ভাষার এক প্রাচীন সাহিত্য য়্য়াকাদেমি, যাঁরা যৌথভাবে সৃষ্টি করেছিলেন আদিমতম তামিল ভাষার সাহিত্য যা একাধারে লৌকিক, ধর্মনিরপেক্ষ আবার অন্যদিকে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। খ্রীষ্টিয় প্রথম শতাব্দীতে রচিত এই গ্রন্থ খুব সম্ভবত পৃথিবীর প্রাচীনতম সেকুলার সাহিত্য।

    [সমাপ্ত]
  • প্রথম অংশ | দ্বিতীয় অংশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments