দেহ্রাদুন
দেরাদুনে বড়মামার বাড়ি । হাতিবড়কলায় । বাড়ির একদিকে জঙ্গল । আর একদিকে জমিটা উঁচু হয়ে উঠে গেছে বড় রাস্তায় । সন্ধ্যে হলেই চারদিক নিঝুম অন্ধকার । অষ্টপ্রহর ডেকে চলেছে ঝিঁঝিঁ । শুনলাম শহরে ভূতের এমন আতঙ্ক হয়েছে যে রাতবিরেতে কেউ আর বাড়ি থেকে বেরোয় না । জঙ্গল, নালা, গাছের মগডাল থেকে পঞ্চাশ ষাট ফুট লম্বা হাত বেরিয়ে এসে আচমকা পথচারীর গলা টিপে ধরছে । বহু লোক পাগোল হয়ে গেছে । মরেছেও বিস্তর । বড়মামা বলল - অ্যাডমিনিস্ট্রেশনই রাস্তাঘাট খালি করাচ্ছে ভূতের ভয় দেখিয়ে । বিকেলের দিকে বিশ্রী জ্যাম হচ্ছিল । সেই সঙ্গে ধোঁয়া আর পলিউশান । সিধা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল একটু টেঢ়া করতে হয় ।
লোডশেডিংএর জন্য উঠোনে খাটিয়া পেতে গল্প হচ্ছিল । পানুদাদুর ছোট ছেলে পরাগমামার বউ কবিতামামি সবে এম-এস-সি পাশ করে এসেছে । সে জিজ্ঞেস করল - যে নিরীহ লোকগুলো মরল তাদের কী হবে ? বড়মামা বলল - অপঘাতে মৃত্যু । এর পরেও যদি সত্যিকারের ভূত না হয় তো আর কীসে হবে ? পার্ট অব দা প্ল্যান ।
পরাগমামা বলল - টুরিস্টদের জন্য আলাদা পলিসি নেই ?
- ভয় কী ? কজন আছিস তোরা ? পুরো বারো তো ? ধরে নে একজন ফিরে যাবে না । এগারোজন ফিরলেই ট্রিপ সাকসেসফুল ।
উঠোনেই খাবার এসে গেল । গরম গরম রুটি আর অমলেটের ঝোল । অন্তরামামি বলল - এর চেয়ে তো কলকাতাতেই ভালো ছিলাম । কতবার বললাম বেড়াতে যদি হয় তো সাউথে চলো । কেউ শুনল না । এখন মরো ।
কবিতামামি বড়মামাকেই ভর্ত্সনা করে বলল - আপনাদের নর্থ ইণ্ডিয়া যে কী হয়ে যাছে । কোথাও সিকিউরিটি নেই । মেয়েদের সাথে সবাই মিসবিহেভ করে । বাসে লেডিস সীট অবধি ছাড়ে না । ছাড়তে বললে অ্যাবিউস করে । এটাই কী রাজপুতদের দেশ ?
বড়মামা আমতা আমতা করে বলল - মেয়েগুলোও তো সেরকম । একবার কলকাতা থেকে তোদের এক নামকরা অভিনেতা এসেছিল । সত্যিকারের নাম বলব না - আমি ডাকি বিশু বলে । দুপুরে ট্যাক্সি পাওয়া যায়নি বলে বাসে করে ঘন্টাঘরে যাচ্ছি । ফাঁকা সীট পেয়ে গিয়েছিলাম । খানিক্ষণ পর বাসটা ভরে যায় এবং মাঝখানের একটা স্টপ থেকে একটা পাহাড়ি ফ্যামিলি ওঠে । সঙ্গে মেয়েলোক ছিল । আমরা লেডিস সীটে ছিলাম না - তবু বিশু সসম্ভ্রমে জায়গা ছাড়তে গেল । দুর্ভাগ্যবশত তখনই বাসে ব্রেক পড়ায় একটু ধাক্কা মত লেগে গেল সেই পাহাড়ি লেডিসের সাথে ।  তারপর সেই মহিলার হাতে যে মারটা খেল বিশু সে আজও মনে আছে । সেই সঙ্গে গালাগালি - মনে পাপ । নইলে সীট ছাড়ল কেন ? লেডিস সীটও ছিল না । অকাট্য যুক্তি ।
যারা লেডিস সীটে বসেছিল তারা নড়েচড়ে বসে বলল - জো হুয়া সো হুয়া । এবার হয় ছেড়ে দাও বা পুলিশে দাও । তো মহিলা আর তার আদমি মিলে বিশুকে আরো প্যাঁদাতে প্যাঁদাতে বলল - পুলিশের কটা হাত ? দুটো । সে তো আমাদেরও আছে । পুলিশের কটা লাত ? দুটো ? তাও আমাদের আছে ।
কবিতামামি সব শুনে বলল - ডিজগাস্টিং ।
ভূষণমামা বলল - বড়দা মরার আগে দুটো অরিজিনাল বাসমতী চালের ভাত খেতে পারব না ?
বড়মামা লাফিয়ে উঠে বলল - যা বলেছিস । কাল বিরিয়ানি হবে । কলাকন্দের পাঠিসাপ্টা করব বিকেলে । একটা দিন সবাই জিরিয়ে নে । আমার অফিসের দারোয়ান ভূপিন্দার বিষ্টকে দিচ্ছি । সবে রিটায়ার করেছে । এখনও জোয়ান । সে থাকবে তোদের বডিগার্ড হয়ে ।
পরের দিন পানুদাদুরা আমাকে ডিসমিস করে আমার আসা-যাওয়ার টিকিটগুলো বিষ্টকে দিয়ে দিল ।
পানুদাদুরা মসুরি চলে যাবার পর বড়মামা বলল - রিটায়ার করেছি তো । বেশি কথা বলছি । সেটা ওদের পছন্দ হচ্ছে না । কিন্তু কানুর কী আক্কেল, টোটোকে না পাঠিয়ে তোকে পাঠাল । যাই হোক - এসেছিস যখন ব্রিজটা শিখিয়ে দেব । বোনাফাইড র্যাশনাল ইনটেলিজেন্ট ডিডাক্টিভ গেম অব একসেলেন্স ।
বসে বসে আমার অবর্ণনীয় দুশ্চিন্তা হচ্ছিল । এই সঙ্গীন সময়েই আমাকে দিল্লী ছাড়তে হল ?
মামাতো দাদা-দিদিরা সব চাকরির জন্য দেরাদুনের বাইরে । বাড়িতে মামা আর মামি ছাড়া কেউ নেই । বড়মামা দিনে পাঁচবার করে কফি খাওয়াতে লাগল । ভূতের গল্প শোনালো কিছু কিছু । মনে আছে ভোরবেলা বাড়ির পিছনে চবুতরায় বেতের চেয়ার পেতে বসে চা খেতাম দুজন । বড়মামা বলছিল প্রাচীন সেনভূতের গল্প যে আমাদের পরিবারে বার বার পুনর্জন্ম পায় । লাস্ট দেখা গিয়েছিল দাদুর আমলে । বিক্রমপুরের গ্রামের কথা । দিদার প্রিয় দেওর একদিন বাবার হাতে চড় খেতে খেতে - ধুত্তেরি আর সয় না বলে হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল । দাদুর বাবা তখন ক্রোধে অন্ধ । - সলিড হ । সলিড হ হারামজাদা বলে ঘরময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন । সেই যে সূক্ষ্ম জগতের উপর রেগে গেলেন, বায়বীয় জিনিসের প্রতি, এমনকি শরতের মেঘ বা বসন্তের বাতাস হলেও, আর কোনোদিন ভরসা ফিরে পাননি ।
পরে রাত্রিবেলা জানলা দিয়ে সেই ভূতে দেওর দিদাকে বলে যায় - বৌদি তোমার বংশে আবার আসব । সবাইকে জানিয়ে দিও । সেই থেকে মামাদের বংশে কোনো ছেলের গায়ে হাত তোলা হয় না ।
- তুমি নিজে ভূত দেখেছো ? বড়মামাকে জিজ্ঞেস করলাম আমি ।
বড়মামা বলল - দেশের বাড়িতে দেদার দেখেছি । ভূত হল জীবানুর মত । ম্যান ইজ দা ভেক্টর । আমার সঙ্গেই তো কত দেশি ভূত চলে এসেছে নর্থ ইণ্ডিয়ায় । আসলে আমাদের সকলের মধ্যেই কিছু অলৌকিক আছে । কারো মধ্যে তিন আনা, কারো এক সিকে ।
- আমার মধ্যে ?
- বলিস কী ? তুই তো মনের জোরে মারতে পারিস । একবার একটা বিরাট দাঁড়কাক এসে বসেছিল বাড়ির ছাদে । তুই দেখতে এলি আর সেই ডাকাবুকো পাখিটা পা হড়কে পড়ে মরে গেল । আমার একটা পোষা গিরগিটি ছিল - তুই তার সাথে প্রথমবার কথা বলার পরেই সে খাওয়া বন্ধ করে দিল । বাঁচেনি । শুধু কি পশু-পাখি ? ভাণ্ডারিদের সেই পাগলা ছেলেটা - যার সাথে তোর মারামারি হয়েছিল । মনে নেই, তার দুদিন পরে কোনো রোগ বালাই ছাড়াই আল্লার পেয়ারা হয়ে গেল ?
- তবে যে শুনেছিলাম তার লিভারে সিরোসিস হয়েছিল ?
- বড়মামা একটু হেসে বলল - দাঁড়কাকটার কী হয়েছিল ? গিরগিটিটার ? তোর মধ্যে ফোর্স আছে । সেটাকে জাগিয়ে তোল ।
- কী ফোর্স ?
- সর্ষের তেলে যাকে পয়সা ছুঁড়ে দেয় । নজর যার কালো । ডার্ক ফোর্স ।
- শনি দেবতা ?
- দেয়ার ইউ আর ।
দুচারজন রিটাযার্ড বন্ধুবান্ধব আসত বড়মামার । একটা লম্বা ব্রিজের ম্যাচ শেষ করার কথা মনে আছে । লাস্ট গেমে আমি থ্রি নোট্রাম্প্সের খেলা করে ফেলতাম, বড়মামা হঠাৎ ফোর হার্টস্ ডেকে সব মাটি করে দিল । একটা পিওন এসে বাড়ির ভিতর সাইকেলের চাকা ঢুকিয়ে দিল কাঠের জাফরি ঠেলে । খেলা ছেড়ে আমিই উঠলাম । টেলিগ্রাম । কোথ্থেকে ? দিল্লী । সাইন করিয়ে নিয়েই লোকটা সাইকেল তুলে পালাল । বড়মামা উঠে এল কফির কাপ হাতে নিয়ে । টেলিগ্রামটা খুলল । পড়ল । তারপর বিড়বিড় করে বলল - এর মানে কী ?
বড়মামার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে দেখি তাতে দুটো মাত্র শব্দ ।
ঁণ্ণত্ষ্ ১২.
গোটা টেলিগ্রামে আর কোনো কিছু নেই । প্রেরকের নাম মেজর কলাশকর ।
বললাম - হয়তো মেজর কলাশকর বারো তারিখে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন । কী বল ?
- ঠিক । কিন্তু কে মেজর কলাশকর ? জিজ্ঞেস করল বড়মামা ।
মাথা চুলকে বললাম - হয়ত কোনো পুরোনো কলিগ । রিটায়ার করার পর একদম ভুলে গেছ ।
টেলিগ্রামটা যে বড়মামার জন্য নয় সেটা আর বলতে পারলাম না । এছাড়া আর কী । সন্ধ্যেবেলা পঁয়ত্রিশ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে উঠে পড়লাম দিল্লীর ডিলাক্স বাসে । বড়মামা বাসস্টপ অবধি এসেছিল সি-অফ করতে । ধোঁয়া আর ধূলোয় সত্যিই জায়গাটা নিশ্বাস নেওয়ার অযোগ্য । তার উপর অন্ধকার ।
বাস ছাড়ার আগে বড়মামা বলল - মনে পড়েছে । গুয়াহাটিতে পোস্টিংএর সময় একটা আর্মির মেজর রুমমেট ছিল বটে । কলাশকরই নাম হবে তার ।
কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম - একটা চোখ কী কানা ছিল ? কিন্তু জবাব আসতে না আসতেই `ভূত ভূত' বলে আধ ডজন লোক চারদিক থেকে দৌড়তে দৌড়তে এসে দুদ্দাড়িয়ে উঠে পড়ল বাসে । ড্রাইভারও দ্বিরুক্তি না করে টাইমের ছ-মিনিট আগেই গিয়ার ফেলে দিল । খুব লম্বা একটা হাত বের করে জানলার বাইরে থেকে আমাকে আশীর্বাদ করে দিচ্ছিল বড়মামা । আর ধোঁয়ায় ধূলোয় মিলিয়ে যাচ্ছিল দেরাদুনের সব অবয়ব ।
তাণ্ডব
বাস আড্ডায় যখন নামলাম তখন ঘড়িতে রাত প্রায় একটা । খানিক্ষণ ঘোরাঘুরির পর একটা শেয়ারের ভটভটিয়া পাওয়া গেল । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের পিছনে দুসারী সীট জুতে পাওয়ারফুল সওয়ারি । মলরোড অবধি এসে বাকিটা হেঁটে মেরে দিলাম ।
বাড়ির সামনে খাটিয়া পেতে মামা আর টোটোদা শুয়েছিল । কাঁধে কিটব্যাগ নিয়ে গভীর রাতের আগন্তুক । বারান্দায় জানলার গ্রিলের সাথে চেন দিয়ে স্পেয়ার খাটিয়াগুলো বাঁধা । কাউকে একটা না জাগিয়ে শোবার উপায় নেই । খুটখুট করে টোকা দিতে দরজা খুলে গেল । - জয় তুই ? এত রাত্রে ?
চাবি নিয়ে খাটিয়া একটা খুলে পাতলাম আকাশের নিচে । কোথাও কোনো গজল নেই । রাতবিরেতে সে কী আরাম । মামিমা ফিসফিস করে বলল - আলুর দম আছে, দেব ? কিন্তু রুড়কিতে নেমে খেয়ে নিয়েছিলাম । মাথার মধ্যে তখনও একটা বাস চলছিল । বড় বড় বোল্ডার ছড়ানো নদীর খাতের মধ্যে দিয়ে নেমে আসছিল পাহাড় থেকে নিচে । টোটোদা পাশ ফিরে শুল । আমিও । দেখি মনুদের বাড়ির সামনে কোনো খাটিয়া পড়েনি ।  
যদিও মরসুম খুব ভালো । ফুটপাথের ধার থেকে মামা বলল - জয় ফিরেছিস ? গুবগাব করে একটা জবাব দিয়েছিলাম । মামা আরো কী একটা বলতে শুরু করেছিল যা আর কানে ঢোকেনি ।
দেরাদুন থেকে ফেরার পর সেই শেষ শান্তির ঘুম ।
সকালে একটা অ্যাম্বাসাডর গাড়ি এসেছিল আমাদের নিতে । টোটোদা আর আমি চা ছেড়ে উঠে পড়লাম । ভেবেছিলাম ধূপেন্দ্র থাকবেন । তার বদলে দুটো কনস্টেবল
- মনু নেই কেন ? জিজ্ঞেস করলাম টোটোদাকে । টোটোদা ম্লান হেসে বলল - বাইরে গেছে ।
হু হু করে গাড়িটা যাচ্ছিল । টোটোদা জিজ্ঞেস করল - কী হয়েছে ভাইয়া ? কনস্টেবলদের একজন ঘুরে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল - কাণ্ড্ হো গয়া ।
- কীরকম কাণ্ড্ ?
- তাণ্ডব ।
টোটোদা গভীরভাবে মুষড়ে পড়ল । মনে হল জ্বরই এসে যাবে । দশ বারো মিনিটের মধ্যে আমরা সিভিল লাইন থানার চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকে পড়লাম । এই সকালেও দেখি অনেকগুলো জীপ । মোটরসাইকেলে সাব ইন্স্পেক্টাররা আসা যাওয়া করছে ।
সরস্বতী তোমর সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দুজন প্লেন ড্রেসের লোকের সাথে কথা বলছিলেন । আমাদের বললেন ভিতরে যেতে । গিয়ে বসলাম । দেখি আব্বাস বেগও হাজির । পরনে শাদা শার্ট আর প্যান্ট । আমাদের দেখে বললেন - ধূপেন্দ্র কোথায় ? আমি আর টোটোদা মাথা নাড়িয়ে বললাম - জানি না ।
- আর মহেন্দ্রবাবু ?
- তাও জানি না ।
সরস্বতী তোমর যখন ঘরে ঢুকলেন তখন তাঁর পিছনে একটা উর্দি পরা হবলদার । হাতে প্লাস্টিকের ব্যাগ । ভিতর থেকে একটা জামার হাতা বেরিয়ে ছিল । এক নজর দেখেই বুঝলাম তার কালচে লাল রঙটা আসলে কী বস্তু । হবলদারটা ভিতরে চলে গেল । সরস্বতী নিজের চেয়ারের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন । আব্বাস বেগ গলা বাড়িয়ে বললেন - হোয়্যার ইজ মহিন্দর রয় ?
অনেক্ষণ চুপ করে থেকে সরস্বতী বললেন - হসপিটাল ।
- ধূপেন্দ্র ?
এরপর যেটা হল তার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না । সরস্বতীর ঝাঁকড়া চুলগুলো আমাদের দিকে ঘুরে গেল । মুখটা জানলার দিকে । একটা হাত চেপে ধরল কপাল - যেন মাইগ্রেনের ব্যথা ।
আব্বাস বেগ ফ্যাকাশে হয়ে বললেন - জিন্দা তো হ্যায় ?
- আই অ্যাম অফরেইড নো ।
- সর্বনাশ ! কী করে হল ?
- দেখে মনে হবে জগিং করতে গিয়ে হার্ট অ্যাটাক । আসলে বালিশ চাপা দিয়ে স্মদার করে দেওয়া হয়েছে । যেভাবে গল্পের জে. কে. মরেছিল ।
গা গুলিয়ে বমি পেতে লাগল । বায়োলজি ল্যাবের মরা ইঁদুর আর ব্যাং দেখে যেমন হত । এটা কি ধূপেন্দ্রর নতুন কোনো জোক ? এরকম অসুস্থ সেন্স অব হিউমার ভগওয়ানিদের হওয়া সম্ভব ।  
টোটোদা জিজ্ঞেস করল - মহেন্দ্রবাবু ?
- একাই বাড়িতে ছিলেন । জানলা দিয়ে কেউ ঘরে ঢুকে পড়ে । পেটে বুকে চারটে গুলি । তারপর একটা রক্তাক্ত হাত গায়ে মুছে আততায়ী চলে যায় । ফরচুনেটলি মহেন্দ্রবাবুর জ্ঞান ফিরে আসে এবং তিনি ওই অবস্থাতেই নিজের হোমিওপ্যাথ ডাক্তারকে ফোন করে সাহায্য চান । আমরা যখন গিয়ে পৌঁছোই তখন নিজেই মেটিরিয়া মিডিকা কনসাল্ট করতে করতে আবার কোমায় চলে গিয়েছিলেন ।
- বাঁচবেন ?
- বলা যাচ্ছে না । সুরিন্দার ত্রিবেদীকেও ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না । তার কোনো খবর জানেন ? শেষ প্রশ্নটা আব্বাস বেগের জন্য ।
আব্বাস বললেন - তার তো লাদাখ যাবার কথা ছিল । কোনো খবর নেই ।
সরস্বতী হঠাৎ গিয়ার চেঞ্জ করে বললেন - কাল রাত্রে আপনি কোথায় ছিলেন ? আপনাকেও পাওয়া যায়নি বাড়িতে ।
আব্বাস বেগ আর কারো তোয়াক্কা না করে হঠাৎ তড়াক্ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন । সরস্বতী বাধা দেবার চেষ্টা করলেন না । খানিক্ষণ আমরা হতভম্ব । একটু পরে টোটোদা জিজ্ঞেস করল - ধূপেন্দ্রকে কোথায় পাওয়া গেছে ?
- কুদসিয়া গার্ডেনে । জগিংএর পোশাকে । বাড়ির লোকেদের খবর দেওয়া হয়েছে ।
আমি ভাবছিলাম মনু কোথায় ? কাল রাত থেকে তাদের কাউকে দেখিনি । সরস্বতী বললেন - আই হ্যাভ বীন এ ফুল । তোমার চিঠিটা পাওয়ার পর আরেকটু যদি সাবধান হতাম । টেলিগ্রাম পেয়েছিলে জয় ?
- পেয়েছিলাম । বারো জুলাই মানে কী ?
- সেদিন সাইকোপ্যাথটা কলাশকরের সঙ্গে দেখা করতে আসবে । গম্ভীর হয়ে বললেন সরস্বতী । - কথা আছে । বোসো ।
কিন্তু কোনো কথা শুরু হবার আগে দরজায় বুটের শব্দ । আব্বাস বেগ আবার ঢুকলেন ঘরে । মাথার চুলগুলো উস্কোখুস্কো হয়ে গেছে কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে । আমরা ভয়ে কেউ কোনো কথা বলতে পারছিলাম না । এমনভাবে এগিয়ে এলেন সরস্বতী তোমরের দিকে যে একবার মনে হল হাত ফাত উঠে যাবে । বিস্ফোরণ ঘটার ঠিক আগের মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার চেয়ারে বসলেন আব্বাস । চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন - ইউ নো হু রোট দ্যাট জোক অ্যাবাউট দা চিম্প ? মহিন্দর রয় । তারপর সে নিজেই তোয়ালে হয়ে গেল । ধূপেন্দ্র জে. কে.'র ডায়লগগুলো লিখত । ডোন্ট ইউ ফাইণ্ড ইট অ্যামিউজিং দ্যাট হি ডায়েড লাইক জে. কে. ?
সরস্বতী বললেন - না কিছুই অ্যামিউজিং নয় । এর থেকে এটাই প্রমাণ হচ্ছে যে কিলার ওঁদের দুজনকেই ভালোভাবে চেনে ।
- অথবা এই অপারেশনটাই পুলিশ পুরোপুরি ঝুলিয়ে দিয়েছে । পুলিশের কাছ থেকেই সমস্ত খবর পেয়ে যাচ্ছে সে ।
সরস্বতী বচসার মধ্যে না গিয়ে বললেন - একটা জিনিস ভাবছি । ধূপেন্দ্র বা মহেন্দ্রবাবুকে টার্গেট করল কেন ? আপনাকে বা সুরিন্দারকে নয় কেন ? রোজাম্মাকে নয় কেন ?
- কারণ সুরিন্দার ইজ ইন লাদাখ । রোজাম্মা হোস্টেল ছেড়ে বেরোন না । আর আমার সিকিউরিটি খুব স্ট্রং ।
- এটাও তো হতে পারে যে কিলার আপনাকে আর সুরিন্দারকে মারতে চায় না ? আর মেয়েদের খুন করাও তার স্টাইল নয় ?
- মনে হচ্ছে কিলারকে আপনি অলরেডি আইডেন্টিফাই করে ফেলেছেন । তো ধরে ফেলতে পারছেন না কেন ? আপনি তো সুপার কপ ।
- আমি নয়, আইডেন্টিফাই করেছে অন্য কেউ । আমার কাজ শুধু সন্দেহ করা । তবে একটা নতুন থিওরি চেক করে দেখা দরকার । হয়তো একটা ভীষণ ভুলই হয়ে গেছে আমাদের ।
- আপনাদের বিগেস্ট ব্লান্ডার হল গজলচিটা'কে ছেড়ে দেওয়া । এটা কি দেখতে পাচ্ছেন না যে হি ইজ অ্যাট দা সেন্টার অব দিস প।জ্ল্ ?
সরস্বতী যেন মেনে নিয়েছেন এরকম ভাব দেখিয়ে মাথাটা নাড়াতে লাগলেন ।
হাসপাতালে
লেডি হার্ডিঞ্জ হাসপাতালের এক নতুন মহিলা ডাক্তারের কাছে পরের দিন টোটোদাকে নিয়ে গেলাম । মনু সেখানেই ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছিল । ধুন্ধুমার জ্বর দিয়ে শুরু । আশার কথা জ্বরের কারণটা এতদিনে জানা গেছে । ডাক্তার ফিরোজা জাকারিয়া মনুর এক্স রে আর ব্লাড রিপোর্ট দেখিয়ে বললেন - মেরুদণ্ডের হাড়ে টিউবারকিউলার ইনফেকশান । সেভেন্থ আর এইট্থ ভার্টিব্রিকে পেনিট্রেট করেছে । স্ট্রেপ্টোমাইসিন আর আই-এন-এ'তে ফেলে দিয়েছি । দেরি হলে বাঁচত না ।
টোটোদার এক্স-রে, ব্লাড আর নীড্ল্ বায়োপসি একই দিনে হয়ে গেল জাকারিয়ার চিঠি দেখিয়ে দেখিয়ে । ওয়ার্ডে মনুর সাথে দেখা করতে গেলাম । কেউ ছিল না আর । বোধহয় ধূপেন্দ্রর ফ্যামিলিকে সামলাতে ব্যস্ত । মনু তখনও খবরটা জানে না দেখলাম । সে বলল - বিকেলে ইঞ্জেকশান দিতে একটা পাগলা ওয়ার্ড বয় আসে । দুটো করে অ্যাম্পিউল রোজ । একদিন বাঁদিকের পাছায়, একদিন ডানদিকের পাছায় নিচ্ছি । প্রচণ্ড ব্যথা । কিছু বলতে গেলে ভয় দেখায় মাথায় ফুঁড়ে দেবে ।
আমি আর টোটোদা বললাম - যা: তা হয় নাকি ? তো মনু কোনের বেডের একটা মোটা লোককে দেখিয়ে বলল - লালাজীকে দেখেছিস ? উপুড় হতে পারে না । ও তো মাথাতেই নেয় ।
লালাজী আমাদের দিকে হলুদ চোখে ড্যাবড্যাব করে চেয়েছিল । আমরা মনুকে তার ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে যাব ভাবছি এমন সময় ওয়ার্ড টুরে ঢুকলেন ফিরোজা জাকারিয়া । সঙ্গে হাতে ফলের টুকরি নিয়ে লতা আর পরভীন । নাটকের দৃশ্যের মত সব বেডের পাশে দুটো করে ফল রাখতে লাগল তারা । ফিরোজা লালাজীর বেড থেকে শুরু করলেন । লতা আর পরভীন মনুর বেডের দুদিকে এসে বসল । দুজনেরই মুখ একেবারে শুকিয়ে গেছে ।
লালাজী বোধহয় একটু কালাও । দূর থেকে শুনি ফিরোজা চেঁচিয়ে বলছেন - দু বোতল খুন চঢ়াতে হবে । কোনো আত্মীয় আছে ?
লালাজী ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়াল - কোই নেই ।
- তো আমি কি করব ? বকরার খুন চঢ়াব ?
- চঢ়ে তো চঢ়িয়ে দিন ।
মনু ফিস ফিস করে বলল - ইংল্যাণ্ড থেকে সর্জরি শিখে এসে এখন কী অবস্থা ।
লতা বলল - প্রমিস কর আর কখনো মারপীটের মধ্যে যাবি না ।
মনু বলল - মারব না প্রমিস করা যায় । কিন্তু মার খাব না প্রমিস করা যায় নাকি ?
টোটোদা লতাকে বলল - তার চেয়ে কথা নিয়ে নে `মরবি না' । ল্যাঠা চুকে যায় ।
পরভীন মুখ লাল করে বসে রইল । টোটোদা দূরের বেডে ফিরোজাকে গিয়ে কিছু বলল । ফিরোজা আবার চড়া গলায় বলতে লাগলেন - পাগল নাকি ? তোমার তো ত্রক্রনিক ফিভার । স্প্লীন প্যালপেবল । লিম্ফনোডও ফুলে আছে । তার চেয়ে বকরার রক্তই ভালো । আরে এর হাট্টাকাট্টা চারটে ভাই আছে । বৌ আছে, দুটো বড় ছেলেও আছে । রক্ত দিতে হবে শুনে সব পালিয়েছে ।
একে তো নিজের এই অবস্থা তার উপর আবার পরোপকার করতে গিয়েছে টোটোদা । পরভীন আক্রোশে প্রায় ফেটে পড়ে আর কি । টোটোদা ফিরে আসার পর সে জিজ্ঞেস করল - রক্ত দিতে গিয়েছিলে ? নিল না বুঝি ?
টোটোদা অম্লানবদনে বলল - টেম্পোরারিলি আনফিট । জয় দিতে পারে । তুমিও দিতে পারো ।
- ওই মোটার জন্য ? মদ খেয়ে খেয়ে এমন অবস্থা করেছে যে পেট জুড়ে আলসার । রক্তের ডায়ারিয়া হচ্ছে । ওর বৌ অবধি রক্ত দিতে হবে শুনে ভেগেছে । ওর জন্য ভাবতে হবে না । পয়সা দিয়ে প্রফেশনাল ডোনার নিয়ে আসবে । জয় বা আমার রক্ত না পেলেও চলবে ।
আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম মহেন্দ্রবাবুর কণ্ডিশান না দেখা অবধি কাউকে রক্ত দেব না । তাই পরভীনের কথায় সায় দিলাম । একটু পরে ফিরোজা এসে মনুকে একবার চেক করে গেলেন । মনু বাড়ি ফেরার জন্য নাছোড়বান্দা । ফিরোজা বললেন - জ্বরটা কমে গেছে । কাল চলে যেও । আরো কয়েকদিন রাখার কথা । কিন্তু ওয়ার্ডে একটা হেপাটাইটিস বি আসছে আজ । একটা ম্যানেনজাইটিস রয়েছে । তার উপরে পাগলের উপদ্রব । কখনো ডাক্তার, কখনো ওয়ার্ডবয় সেজে ঢুকে পড়ছে । এর চেয়ে বাড়িই সেফ ।
লতাকে উপরে রেখে আমরা তিনজন নিচে নামলাম । পরের গন্তব্য অল ইণ্ডিয়া ইনস্টিটিউট । যেখানে মহেন্দ্রবাবুর থাকার কথা । পরভীন বলল - আমি আর যাব না । মনুর বাবার আবার স্ট্রোক হয়ে গেছে । ধূপেন্দ্রর চৌথার ব্যবস্থা করবে কে ? তোমাদের দ্বারা তো হবে না ।
তবে পরভীন করিত্কর্মা । সেই সব পারবে জানতাম ।
আরো এক ঘন্টা বাদে এ-আই-আই-এম-এস'এ এসে পৌঁছলাম । তখন দুপুর । হাসপাতালের সামনে দাঁড়ানো ভ্যান থেকে কিনে কুলচা আর ছোলা খেয়ে নিলাম গোগ্রাসে । ভিতরে গিয়ে শুনলাম মহেন্দ্রবাবু তখনও কোমায় । অবস্থা সিরিয়াসলি ক্রিটিকাল । স্পেশালিস্টরা অপারেশন করবে বলে লাইন দিয়ে ঘরের বাইরে অপেক্ষা করছে । কে আগে করবে এই নিয়ে ঝগড়াও হয়ে গেছে । রিসেপশানিস্ট দাঁত বের করে হেসে বলল - নইলে আর আপ্রেশনের কম্রাকে থিয়েটর কেন বলে ?
রক্তের কথা জিজ্ঞেস করে শুনলাম বেশ কিছু রবীন্দ্রশিক্ষাভবনের ছাত্র-ছাত্রী এসে আগেই ব্লাড ডোনেট করে গেছে । ফ্রিজ খারাপ বলে অর্ধেক ফেলে দেওয়া হয়েছে । বাকি অর্ধেক কাল ফেলে দেওয়া হবে । তখন আরো লাগবে ।
হাসপাতালের গেটের কাছে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম । টোটোদারই বুদ্ধি । - একটু দাঁড়িয়ে যা । মহেন্দ্রবাবুকে যে গুলি মেরেছে সে যদি কাজ ফিনিশ করতে আসে ।
স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক দীনবন্ধুবাবু গেট দিয়ে আস্তে আস্তে ঢুকছিলেন । বয়েস হয়েছে । কাঁধে ঝোলা । চোখে ছানি কাটা পুরু লেন্সের চশমা । মনে হল চিনতে পারলেন না । টোটোদা বলল - পাস্ । আমরা সরে একটা থামের আড়ালে চলে গেলাম । একটু পরে আমার পিঠে টোকা । ঘুরে দেখি দীনবন্ধুবাবু চোয়াল বাড়িয়ে হাসছেন । বললেন - চিনতে পারছিস না ? পেন্সনের কাগজগুলো রিনিউ করতে হবে । মহেন্দ্র এ-বছর সাইন করেনি । আর তোরা ?
টোটোদা বলল - ওই সাইনেরই কেস । অলরুট বাসের পাস এক্সপায়ার করে যাচ্ছে । দাঁড়িয়ে যান লাইনে । কোমা থেকে বেরোলে আমাদের পর আপনি ।
দীনবন্ধুবাবু গিয়ে একটা বেঞ্চে বসে পড়লেন । আমরা থামের আড়ালে পায়চারি করছিলাম । একজন দুজন করে রবীন্দ্র শিক্ষাভবনের ছেলেমেয়েরা গেট দিয়ে ঢুকছিল । ছেলেরা উত্তেজিত । মেয়েরা সমাহিত । শিক্ষক-শিক্ষিকারা মাঝামাঝি । বহুদিন বাদে লোটাসকে দেখলাম । গায়ে নবযৌবনের সংবর্ধনা । হাতে এক তোড়া গোলাপফুল । কালো চশমা পরে ভাবলেশহীন মুখে ঢুকলেন ভূবনবাবু । আমাদের দেখতে পেয়ে একগাল হেসে এগিয়ে এল লোটাস ।
- বেঁচে গেছেন তাহলে এ যাত্রা ?
- আততায়ী আবার আসতে পারে । পাহারা দিতে হবে । বলল টোটোদা ।
লোটাস চোখ গোল গোল করে বলল - সেজন্যই তোরা এখানে ? ও: একথাটা মাথায় আসেনি । আচ্ছা ফুলগুলো বেডের পাশে রাখতে দেবে না ? ফুলের গন্ধে যদি কোমা ভঙ্গ হয় ?
টোটোদা লিফট দেখিয়ে দিয়ে বলল - উপরে চলে যান ।
তারও পরে ঢুকলেন প্রবুদ্ধর ঠাকুর্দা আর বাবা । পিছনে চোরের মত মাথা নিচু করে প্রবুদ্ধ । তিনটে জেনারেশন একসঙ্গে লিফটে উঠে উপরে চলে গেল ।
আরো খানিক্ষণ পায়চারি করলাম । দুপুরের ভিড়টা কমে আসছিল । সাড়ে তিনটের পর থেকে আর কোনো নতুন পেশেন্ট ঢুকছে না । গেটের বাইরে পাঁচিলের ধারে একটা জলের কল থেকে অনবরত টপটপ করে পড়ছিল জল । দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম ফুটপাথের উপর শনি-দেবতার টিনের কাট আউট বসানো বালতি । সিঁদুর মাখানো গাঁদাফুল । আমার ভিতর যে ডার্ক ফোর্সটা থাকার কথা সে আমায় ছেড়ে নিরুদ্দেশ । কোনো সাইকোপ্যাথকে ধরার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না । ভাবছিলাম পম্পার ঘরে এই সময় নিশ্চয়ই ফৌজি ভাইদের প্রোগ্রাম চলছে । সে কি আমাকে খুঁজতে একবারও বাড়িতে এসেছিল ? এই কথাটা টোটোদাকে জিজ্ঞেস করতে যাব এমন সময় হঠাৎ মনে হল যেন ধূপেন্দ্রকে দেখলাম দরজা দিয়ে ঢুকে মাথা হেঁট করে চলে যেতে ও-পি-ডি'র গলিতে । টোটোদাকে ধাক্কা দিয়ে বললাম - ধূপেন্দ্র !
- সে কী ? কই ?
টোটোদা আর আমি ছুটতে ছুটতে ও-পি-ডি'র করিডরে ঢুকে দেখি কেউ কোথাও নেই । ডানদিকে আরো একটা লিফট । এটা আগে চোখে পড়েনি । লিফটটা পাঁচতলা থেকে সবে নামতে শুরু করেছে ।
তাহলে কি আমার চোখের ভুল ? কিন্তু জলজ্যান্ত একটা লোক করিডরে ঢুকে এত তাড়াতাড়ি যাবে কোথায় ? তবে কি ভূত ? দৌড়ে খানিকটা দেখে আসব ভাবছিলাম । টোটোদা হাত ধরে থামাল ।
চার-তিন-দুই-এক ... টোটোদার ভিতর কোন ফোর্স আছে কে জানে । ... তিন-দুই-এক-শূন্য ।  
ঘ্যাচাং করে নেমে এল লিফটটা । কুর্তা পাজামা আর হাফ হাতা জ্যাকেট পরা একটা লোক বেরিয়েই উল্টোদিকের পথ ধরল । হতভম্ব টোটোদা আর আমি কিছু করার আগে সে যেন বেশ ধীরে সুস্থেই করিডর দিয়ে হেঁটে দূরের দরজা খুলে নেমে গেল রাস্তায় ।
এমন ঘাম ছুটে গেল আমদের যে লিফট দিয়ে ওঠার ধৈর্য রইল না । আমি আর টোটোদা ছুটতে ছুটতে পাঁচতলায় উঠে দেখি ইনটেনসিভ কেয়ারের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে লোটাস একটা মিলিটারি অফিসারের সাথে তর্কে পর্যুদস্ত হচ্ছে । আমাদের দেখে বলল - দ্যাখ কী মুশকিল । ডাক্তারের কাছ থেকে পারমিশান নিয়ে এসেছি কিন্তু এই লোকটা কিছুতেই ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে না ।
এক চোখ কানা নেপালি বা চিনে আদলের লোকটা আমাদের দেখে মুচকি হেসে বলল - নো ভিজিটর্স্ ফর মহিন্দর রয় ।
লোটাস হাতের গোলাপফুলগুলো দেখিয়ে বলল - এগুলো কি আমি তোমাকে দিয়ে যেতে এসেছি তাহলে ?
আব্বাস বেগের কানা ড্রাইভার ক্ষিপ্রতার সঙ্গে লোটাসের হাত থেকে ফুলগুলো তুলে নিয়ে বলল - গুড আইডিয়া । থ্যাঙ্ক ইউ ।
এই হল সে বছরের জুলাইয়ের তাণ্ডবের গল্প । এখানেই শেষ বলা যেতে পারে । অন্তত আমার কাছে এরপর আর কৌতুহলের কিছু ছিল না । সাইকোপ্যাথকে ধরার জন্য টোটোদা আর সরস্বতী তোমর যেসব ফন্দি-ফিকির বের করেছিলেন তাতে কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না আমার । এমনকি কোনো গোপন ইচ্ছে ছিল না সুরিন্দার ত্রিবেদী আর মেজর কলাশকরের রহস্য ভেদ করার । এসবই যা হবার হয়েছিল টোটোদার তদ্বিরে । সেই মুহূর্তে ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিটের বাইরে দাঁড়িয়ে এইটুকু বুঝতে পেরেই সুখী ছিলাম যে মহেন্দ্রবাবুর তখনো আশা আছে । বেঁচে যেতে পারে মনু । টোটোদার কী হবে এ নিয়ে একটু শঙ্কা ছিল মনে । ভাবছিলাম পরভীন, লোটাস আর পম্পার কী হবে । জানতাম সেই বছরের মধ্যে টোপাজের গল্পও শেষ করে তুলে রেখে দেব কোনো পাঠকের তোয়াক্কা না করে ।
সেই আমি, যে জনপ্রিয় থ্রিলার গল্পকারের লিস্টে নিজের নাম দেখার জন্য হয়ত খুন করতেও রাজি ছিল এককালে ।
ড্রাগনের যুগ
মধুমালার মত কোনো মেয়ে হয় না । ভূবনবাবুর মত হয় না কোনো বাংলার মাস্টার । এসবই আমরা জেনেছিলাম সুখী সেই ছেলেবেলায় । যখন সবাই বলত - ধুস্, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সেক্স ।
সবচেয়ে সুখী ও অসুখী হওয়া যেত একই দিনে ।  সম্বলপুরা থেকে আসা গুজ্জরদের হাতে পড়েছিল টোটোদা আর মনু । কালক্রমে দুজনেরই মেরুদণ্ডের হাড় ঝাঁঝরা । একই দিনে পাশাপাশি বেডে অপারেশন করাতে হল । একজন বেঁচেছিল । একজন বাঁচেনি ।
আমরা তখন চোদ্দ কি পনেরো । মাত্র দু এক বছরের মধ্যে অনেক কিছু পাল্টে যাচ্ছিল । জাট গুজ্জর অধ্যুষিত শিমলিপুরের নিয়মিত খুনোখুনিতে যা হয়নি সেটাই সম্ভব করে দেখাল যুবক কংগ্রেস । লোমশ পুলিশ হাত মেলাল যখন কুর্তা আর চটি পরা নেতাদের হাতে । লাহোর, সিয়ালকোট থেকে আসা দুর্ধর্ষ পাঞ্জাবী পরিবারের মেয়েরাও ছেড়ে দিল রাতের শিমলিপুরের দখল । শেষ পর্যন্ত দেখা গেল আমাদের পাড়ায় খাটিয়া পড়ছে শুধু সুখ্খা সিং আর মামার । পরের বছর গরমকালে আর্মি ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরোলো একটা নেকড়ে বাঘ । এক লোল ও জালিম লকড়বঘ্ঘা । জুনের কৃষ্ণপক্ষে এক সপ্তাহ ধরে তার দাঁত ও নখের নৈশ আক্রমণে হতাহত হচ্ছিল পুলিশ কলোনি, এ টাইপ কোয়ার্টারের ঘুমন্ত লোকজন । যারা বেঁচেছিল তাদের পেটে চোদ্দটা করে ইঞ্জেকশান দেবার পরেও দেখা গেল কম । জলাতঙ্ক হচ্ছে । তখন ভয়ের চোটে আরো চোদ্দটা নিয়ে নিল কয়েকজন ।  আর্তনাদ শোনা গেল আমাদের পাড়াতেও । এবং রাতারাতি সরিয়ে ফেলা হল আকাশের চাঁদোয়ার নিচে পাতা খাটিয়াগুলো । সুখ্খা সিং আর মামার খাটিয়া উঠে যাবার এই বৃত্তান্ত ।
কল্পনার অবাধ পরিণতিতে অভ্যস্ত ছিলাম না আগে । যা হবার তাই হত । যা হবার নয় তাও হতে শুরু করল এরপর । মনে আছে হাড় কাঁপানো শীতে অল ইণ্ডিয়া ইনস্টিটিউটের লবিতে দাঁড়িয়ে পরভীন ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল । যাকে দুর্বল ভাবতাম সেই লতা পাথরের মত স্থির । টোটোদা আর মনু পাশাপাশি বেডে অপারেশনের পর অজ্ঞান । মেরুদণ্ডের একটা করে হাড় সাবধানে কেটে বাদ দিতে পেরে তরুণ ডাক্তার ক্ষত্রি নিজেই হতবাক । তার থিসিস অ্যাডভাইসাররা ঘরের চারপাশে ঘুরঘুর করছে । এরকম অপারেশন নাকি ভূভারতে আগে হয়ইনি । আজ এক দিনে দুটো । আমার যখন দেখা করতে গেলাম ক্ষত্রি ফ্যাকাশে হয়ে বললেন - তবে যে স্যার বললেন যে ছেলেদুটো অরফ্যান । কাইফোসিস তো এখনো হতে পারে । অনেক বছর পর অ্যামেরিকা থেকে ফিরে এসে ক্ষত্রি আমায় বলেছিলেন যে প্রথমটার চেয়ে দ্বিতীয় অপারেশানটা একটু বেশি ক্লীন হবে জানতেন । জিজ্ঞেস করলাম - কোনটা আগে করবেন কী করে ঠিক করলেন ?
- টস্ করে । বলেছিলেন ক্ষত্রি । - তোমার মনে আছে তার আগের দিন ওয়েস্ট ইণ্ডিজের সাথে টেস্ট ম্যাচ শুরু হল ? আমি লয়েড আর বেদীর টসের রেজাল্টটাই ইউজ করেছিলাম ।
লয়েড থ্রো করেছিলেন । বেদী কল করেন । টোটোদা আর মনুর ভাগ্যের কলও তখন পড়ে যাবে কে জানত ।
সেই যে লেখা বন্ধ হল, পম্পা আর আমার মনের ক্রোমোসোম যে পরস্পরের থেকে দূরে চলে যেতে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক । চিত্রাঙ্গদায় আমার গল্পের দুটো কিস্তি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর আর লেখা দিতে পারিনি । তারাও বিরক্ত হয়ে একটা নোটিস ছাপিয়ে দিল যে লেখকের শরীর কোমরের উপর থেকে প্যারালাইজড হয়ে গেছে । এর যাই মানে হোক আমার কাছে একটা অন্য ইঙ্গিত ছিল । যেন পম্পার কাছে আমার দাম এখন শরীরের নিচের অংশের জন্যই ।
পম্পার ঘরে বসে অন্ধ দোয়েলের চলাফেরা দেখছিলাম । পম্পা নোটিসটা আমার সামনে রেখে বলেছিল - পারলে আমিই শেষ করে দিতাম । কিন্তু সবার মধ্যে গল্প থাকে না । যার মধ্যে থাকে তার মধ্যেই থাকে ।
সেদিন মেজাজ ভালো ছিল না । বললাম - প্যারালাইসিসই হয়ে গেছে ধরে নাও । বেকার হয়ে গেছি ।
কথাটা খুব মিথ্যেও নয় । কেননা চোখের সামনেই সুরিন্দার ত্রিবেদীর একের পর এক নভেল প্রকাশিত হয়ে চলেছে তখনও । বিল্লা, পাঠান, চাট্টান সিংরা তাইই গিলছে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দাঁড়িয়ে । রোজাম্মার হাতের গুণে রোম্যান্টিক একটা অ্যাঙ্গেল ঢুকেছে । আরো কত দরজার মাটি, ঘাটের জল আর মাথার খুশকি এসে মিশেছে সেই মহৎ মাস্টারপীসে তা শুধু সুরিন্দারই জানেন । সিনেমা হবে এরকম একটা কানাঘুষোও শুনছিলাম । এবং যতই এসব হচ্ছে ততই আমার বডির উপরের দিকটা যাচ্ছে পড়ে । সব লেখার মধ্যে যে লেখাগুলো সবচেয়ে শুদ্ধ আর স্বাবলম্বী বলে মানতাম সেই থ্রিলারের বই, যার মধ্যে কি জো ছিল থাকে কোনো পাণ্ডিত্যের বড়াই, আর তুলতেই পারছি না হাতে । শরীরের একটা দিক ডেকে বলছে - অবে তোল । কিন্তু আরেকটা দিক বলছে - নকল হইতে সাবধান ।
পম্পাকে বললাম - গল্প মানেই নকল । ফেক । ভেক সন্ন্যাসী আর যদি না হতে পারি তো আরেকটাকে জোগাড় করে নাও ।
তো পম্পা সেই প্রথম দরজাটা লক করে আমার চেয়ারে এসে বসল । মানে দুপা জোড়া করে একদিকে ঝুলিয়ে এবং সজ্ঞানে, সমস্ত জেনেশুনে, আমার কোলে । আমার শরীরে কোনো মাংস তো নেই, শুধু হাড় । পম্পা বলল - কীভাবে ফিট করব বল ? এই তো আমি উপরে । উ:, পকেটে আবার কী রেখেছিস জয় ?
আমি বসে বসে ভাবছিলাম এটা কী একটা গল্পের শুরু না শেষ ?
রবীন্দ্রশিক্ষাভবন থেকে যে বছর আমরা পাশ করে বেরোলাম সে বছর আমাদের বাড়িতে টিভি কেনা হল মায়ের তদ্বিরে । তখন রঙিন টিভি সবে এসেছে বাজারে । মা বলেছিল - তয় কি ব্ল্যাক অ্যাণ্ড হোয়াইটই কিনবো মেজদা ? মামা বোধহয় বলেছিল - রঙিনই কেন্ ।
দুর্ধর্ষ সত্তরের দশক শেষ হয়ে তখন আশির দশক । চোখের সামনেই আর একটা আশ্চর্য পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছিল হিন্দী নভেলের জগতে । চার পাঁচ বছরের মধ্যে ঘটল ব্যাপারটা । একটা অদ্ভুত জীব শিমলিপুরের ঘরে ঘরে নক করে বেড়াচ্ছিল । দরজা খুললেই মানুষগুলোর মাথার খুলি ফাঁক করে বুদ্ধিটা চেটেপুটে খেয়ে সাফ করে দিচ্ছিল সে । জন্তুটার নাম সিরিয়াল । এবং সেই ঘটনার পর থেকে বেঁচে থাকার ও নিশ্বাস নেবার একটা নতুন কারণ খুঁজে পেয়েছিল শিমলিপুরের লোকজন । এমনকি পঞ্জাবের পাখণ্ডী কিষাণ সুখ্খা সিং, যে একটা মূলতানী গরু তুলে ছুঁড়ে ফেলত এককালে - সিরিয়াল দেখে দেখে অ্যায়সা মোট্টা হয়ে গেল যে ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে দরজায় আটকে গেল একদিন ।
যেটা অনেকে লক্ষ্য করেনি সেটা হল এই যে সিরিয়াল নামের এই বিচিত্র জন্তু রাত্রিবেলা হুইলারের স্টল থেকে হিন্দী সামাজিক নভেল, ছোটদের ম্যাগাজিন এমন কি থ্রিলারের বইগুলোও চিবিয়ে সাফ করে দিয়েছিল । আস্তে আস্তে চাওড়ি বাজারের বুকস্টল, দরিয়া গঞ্জের ফুটপাথ, কমলানগরের দোকান আর এমনকি শিমলিপুরের পুরোনো বইয়ের লাইব্রেরি থেকে উধাও হয়ে গেল এই সব বই ।
এরও অনেক পরে - যেদিন আমার একুশ বছর বয়েস হয়েছে পুরো - পম্পা খুঁজে খুঁজে কলাশকরের পুরো সেট আমাকে প্রেজেন্ট করেছিল । সবই ছেঁড়া খোঁড়া - হদ্দ কাবাড়ির দোকান থেকে একটা একটা পাতা ধরে উদ্ধার করা কপি । যতগুলো সম্ভব মলাট যোগাড় করে আঠা দিয়ে বসে বসে জুড়েছিল বহুদিন ধরে । তার জিওলজিস্ট এক বন্ধু কিছু এনে দিয়েছিল দেরাদুন, হরিদ্বার, টেড়ি গঢ়ওয়ালের ফসিল সংগ্রহের ট্রিপ থেকে ফেরার পথে । সব মিলিয়ে দেখলাম পঁয়তাল্লিশটার পর আর বেরোয়নি ।
বসে বসে সেগুলো পড়ার সময় এবার আর সেরকম কোনো বিদ্রোহ আসেনি মনে । এমনকি শেষের পাঁচটাও মন্দ লাগল না, যেখানে কলাশকর এক খলনায়িকার প্রেমে পড়ে নিজের চরিত্রের সঙ্গে পুরোপুরি বিশ্বাসঘাতকতা করে দিবারাত্র মদ খেতে শুরু করেছে । লাস্ট বইটাতো বেশ জমজমাট ভাবেই শেষ হয়েছে । পরের ইশুর জন্য পাঠককে উসকে দিয়ে একটা বিজ্ঞাপনও রয়েছে তাতে । কিন্তু ইশুটা আর বেরোয়নি ।
তখন সেটটার প্রতি আমার একটা অন্যধরণের ভালোবাসা জন্মাচ্ছে দেখলাম । বিশুদ্ধ থ্রিলার বলে নয়, বিশুদ্ধ একটা সময় তার মধ্যে ধরা ছিল বলে । যখন হিন্দী বই কাটত । পম্পা অ্যাডিক্টেড ছিল ফৌজি ভাইদের প্রোগ্রামে । সুরিন্দার ত্রিবেদীর সই ও ছবি ভূভারতের লোকে চিনত এক নজরে । একটা হিন্দী থ্রিলারের জন্য লোকে প্রশংসা ও পুরস্কার পেত । পাগোল হয়ে যেত । কিম্বা আমার মত খুন করতে পিছপা হত না ।
এরও পর আছে । শিমলিপুরের ঘটনাগুলো অনেকটা অতীত বলেই তার ভিতর থেকে বলার মত অনেক কিছু পাওয়া যায় । আরও বছর পাঁচেক বাদে একদম বিদেশ বিভুঁয়ে বসে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ও অন্য এক ভাষায় শব্দের পর শব্দ ধরে ধরে ধানক্ষেতের পর ধানক্ষেত বুনতে শেখার মত লেখা শুরু করেছিলাম । হিন্দী সিরিয়ালের ড্রাগন তখন বাংলার কচি কচি বই ধরে খেয়ে লুকিয়েছে সুন্দরবনে । একদম অন্য পরিবেশে, বাংলায় শুরু করলাম - পুনর্লিখনই বলা যায় - চুরি করে নিজেরই আগের প্রকাশিত হিন্দী গল্প আবার ধপাধপ অন্য বোতলে চালান করার কাজ । তখন বুঝতে পারি যে সুরিন্দার কেন চিরকাল আমার হিরো । দশবছরেরও বেশি লেগেছিল বুঝতে । কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেশ ফেশ ছেড়ে একেবারে মহান অতলান্তিকের তীরে পেলাম এই বোধোদয়ের সকাল । কিছু এসে যায় না যে সুরিন্দার নিজে হয়ত কোনদিন গল্প লেখেনেনি । কী এসে যায় যদি তাঁর গোঁফটাও হয়ে থাকে মেকি আর সইটা হয়ে থাকে কোনো প্রেসের কেরানির ? একটা দশক জুড়ে এই সবই তো দাপটের সঙ্গে কলাশকরকে বাঁচিয়ে রেখেছিল । কলাশকর না থাকলে, হিন্দী থ্রিলারের সেই স্বর্ণযুগ না থাকলে আমি আমি থাকতাম না । টোপাজ টোপাজ থাকত না । এবং সত্তরের সেই যুগটাই হয়ত ড্রাগনে খেয়ে নিত - যখন পম্পা আর আমি অন্যরকম সমাজ গড়ব বলে ফুঁকে ফুঁকে নর্থ ইণ্ডিয়ার সমস্ত গাঁজা আর চরস শেষ করে ফেলছি ।
সে সব ঘটেছিল অনেকদিন আগে । তখন পম্পার পাল্লায় পড়ে নাবালক বয়সেই দেদার পোড়াচ্ছিলাম ঘাস । পম্পা তো আমাকে পাহারায় রেখে এক একদিন পারলে পুরো সাভানা পুড়িয়ে করে দিত ছাই । সেই সঙ্গে সাবধান করে দিত - দ্যাখ যদি শিগ্গির ছেলেপুলে চাস তো বারণ করে দে । অন্তত সাতবচ্ছর অক্সিজেন দিয়ে বডি না ধুলে এ বিষ যাবার নয় । সেই গোঁয়ার্তুমির দশকের পর ট্রেণ্ডটা চলে গেল । কিন্তু আমাদের শিক্ষা দীক্ষা যা হবার তা তো ততদিনে হয়ে গেছে সাবলিমিনাল ওই ধোঁয়ার জয়েন্টেই ।
আর এক ধাপ পিছোতে হবে । শেষবার । সুরিন্দার আর কলাশকর বা হিন্দী থ্রিলারের উপর বিশ্বাস - যা কিনা ধর্ম বিশ্বাসের মতই গুরুতর - ফিরে পাবার এই গল্প শেষ করতে হলে পুনরুদ্ধার করতে হয় বিশ্বাস হারাবার ঘটনাটাকে । পুনরুদ্ধার, কারণ হিন্দীতে পূর্বলিখিত । যদিও প্রকাশিত নয় ।
মহেন্দ্রবাবু গুলি খাবার দুদিন পর জুলাই মাসের বারো তারিখের রাত্রে এক পশলা বৃষ্টির পর আকাশ হয়ে গিয়েছিল একেবারে পরিষ্কার । আমি আর টোটোদা বাইরে শোবো বলে খাটিয়ার তালা খুলে চলে এসেছিলাম চত্বরে । ফুটপাথ থেকে তখন ভিজে ধূলোর গন্ধ । আকাশে শুকোচ্ছিল জ্যোত্স্নার শেমিজ । ঠিক বারোটার সময় ঘড়ি দেখে টোটোদা বলল - রেডি, স্টেডি, গো । আমরা বিছানায় বসে উত্কর্ণ হয়ে রইলাম দুজন । বেশ খানিক্ষণ পর একটা ময়ূরের চিত্কার শোনা গেল ক্যান্টনমেন্টের জঙ্গল থেকে । এ ছাড়া সমস্ত চুপ ।
একটা দুটো করে মিনিট গড়িয়ে যাচ্ছিল । টোটোদা বিড়বিড় করে বলল - ডুবিয়ে দিয়েছে মনে হয় । আমরা দুজনে খাটিয়া থেকে নেমে চটি গলিয়ে নিলাম । মনে মনে হয়ে নিচ্ছিলাম রেডি । গরম ছিল এত, চাদর নেবার প্রশ্নই ওঠেনি । কোথাও কোনো শব্দ নেই, টোটোদার ঘড়ির টিকটিক ছাড়া । উত্তেজনা অধীর করে দিচ্ছিল আমাদের । যদি কিছু না হয় ?
টোটোদা জিজ্ঞেস করল - ভয় করছে ?
আমি বললাম - হুঁ ।
রাতবিরেতের শেষ গজলগুলো শুরু হল রাত বারোটার ঠিক দশ মিনিট পর ।