• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ২৮ | নভেম্বর ২০০২ | উপন্যাস
    Share
  • রাতবিরেতের গজল : ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত






    ॥ মনসুন ॥

    মনসুন সেবার একটু দেরি করে এসেছিল । কিন্তু যেদিন এল সেদিন বাজ বিদ্যুৎ পড়ে হোল নর্থ ইণ্ডিয়া একাকার । জিটি-করনাল রোডে একটা ক্লাউডবার্স্ট আর দুটো ট্রাকের টায়ার বার্স্ট হওয়ার ফলে মল রোড পুরো জ্যাম । শিমলিপুরের মত নিচু জায়গাগুলোতে দাঁড়ানো জলে আটকে গিয়েছিল পুরোনো ফিয়েট আর অ্যাম্বাসাডারগুলো । মামা ঝড় জল মাথায় করেই অফিস যায় । লিফ্ট্‌ চাইলাম ।

    বৃষ্টিটা ততক্ষণে ধরে এসেছিল । শিমলিপুর রোড ধরে বেরিয়ে মল রোডে গিয়ে পড়ব । মামা বলল - হ্যাঁ রে বাস স্টপে দাঁড়িয়ে কে ভিজছে ? তোদের মহেন্দ্র মাস্টার নাকি ?

    সত্যিই একটা ডাকব্যাকের ওয়াটারপ্রুফ আর টুপি পরে দাঁড়িয়ে মহেন্দ্রবাবু । হাতে - যা বুঝলাম দেখে - একটা ওষুধের বাক্স । মামা বলল - শিমলিপুর মোড়ে মিনি আটকে ছিল । তার মানে রাস্তা তো বন্ধ । তুলে নেব নাকি ? তুই রডে চলে আয় তাহলে ।

    ক্যারিয়ার থেকে নেমে আমি রডে । মহেন্দ্রবাবু আমাদের দেখে বললেন - স্কুল অ্যাডভাইসারি বোর্ডের আর্জেন্ট মিটিং । না গেলে সমূহ ক্ষতি । বেনেডিকশানের মিস রোজাম্মাকে চেনেন নিশ্চয়ই ? উনি প্রস্তাব এনেছেন রবীন্দ্র শিক্ষাভবনকে ইংলিশ মিডিয়াম করে দেবার । পরপর পাঁচ বছর ধরে স্কুল থেকে পর্যাপ্ত ফি না ওঠায় ডেফিসিট বাজেট চলছিল । বেনেডিকশানের ম্যানেজমেন্ট আমাদের এক লাখ অনুদান হিসেবে দিতে চাইছে । তার বদলে স্কুলটাকে ইংলিশ মিডিয়াম বলে ঘোষণা করতে হবে । নামটাও পাল্টে হেরিটেজ ইন্টারন্যাশনাল করতে চায় । কী বিপদ !

    - এ তো ভালো কথা ! আপনি আবার বাগড়া দেবেন নাকি ? জিজ্ঞেস করল মামা ।

    মহেন্দ্রবাবুর চশমা বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল । মুখ তুলে বললেন - আসল প্ল্যানটা কিন্তু রবীন্দ্র শিক্ষাভবনকে বেনেডিকশানের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার । তখন শুধু মেয়েদের রেখে ছেলেগুলোকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে । বাঙালি ছেলেদের জন্য একটা আলাদা স্কুল করার জমি এই এলাকায় এখন পাব কোথায় ?

    মামা ওমনি গৎ পাল্টে বলল - উঠে পড়ুন তাহলে ক্যারিয়ারে । খবরদার যেন স্কুল ইংলিশ মিডিয়াম না হয় । এখন কোন মিডিয়ামে পড়ান আপনারা ?

    মহেন্দ্রবাবু বললেন - বাংলা, হিন্দী আর ইংলিশের মিশ্র মাধ্যম । শুধু ইলেভেনের ইকনমিক্স ক্লাসটা হয় তামিলে । ভদ্রলোক অবশ্য বাংলা শিখছেন । কিন্তু তাও তো প্রায় বারো বছর হয়ে গেল ।

    ক্যারিয়ারে বসার পর মহেন্দ্রবাবু বললেন - একটু তাড়াতাড়ি প্যাডেল মারুন স্যার । টাইম অ্যাণ্ড টাইড ওয়েট ফর নান । মামা একটু রেগে গিয়ে বলল - নিজে তো ছটা পকেট আর দুটো গামবুটের গামলা ভর্তি করে টাইডের জল নিয়ে উঠেছেন । তার উপর সাইকেল চালাচ্ছি না ইউ বোট তাও বুঝতে পারছি না । আচ্ছা আপনি কোন আক্কেলে দুটো ক্রিমিনালকে বেইল করিয়ে দিলেন ? বিবেক কি বিড়ি খেতে গিয়েছিল ?

    মহেন্দ্রবাবু বললেন - সাধ করে নাকি ? চাপে পড়ে মশাই, চাপে পড়ে । প্রথমে মৈত্রেয়ী সারাভাইয়ের মত মহিলার টেণ্ডার রিকোয়েস্ট । তারপর ধরলেন রোজাম্মা । স্কুলের ফাণ্ডে লাখখানেক টাকার ব্যাপার । না বলার জো নেই ।

    সামনের বার থেকে আমার প্রায় পড়ে যাওয়ার উপক্রম । কিন্তু মামা `ও' বলে অম্লানবদনে খবরটা হজম করে গেল । যেন কিছুই হয়নি । একটু পরে মহেন্দ্রবাবু বললেন - এসব আবার ভীষণ গোপনীয় কথা । কাউকে বলবেন না কিন্তু । আমি আর থাকতে না পেরে বললাম - রোজাম্মা নিজেই বেইল করালেন না কেন ? তো মহেন্দ্রবাবু খুশি হয়ে বললেন - গুড কোয়েশ্চন । এটাই আমিও জিজ্ঞেস করেছিলাম । উত্তর হল - স্কুলের বদনাম হবে এই ভয়ে ।

    এর পরেও মামা নির্বিকার এবং খাপুর খুপুর করতে করতে আমরা রবীন্দ্র শিক্ষাভবনের সামনে চলে এলাম । সেখানেই মিটিং । মহেন্দ্রবাবুকে নামিয়ে দিয়ে মামা বলল - গুড লাক । মহেন্দ্রবাবু স্কুলে ঢোকার ঢালু রাস্তায় হাঁটু জল ভেঙে অন্যমনস্কভাবে ও দ্রুতপায়ে চলে গেলেন ।

    স্কুলের মাঠের উপর মনসুনের কালো মুখোশের মত মেঘ এক এক করে জড়ো হচ্ছিল । মনে হল আরেকটা ক্লাউডবার্স্ট হবে । মামা সাইকেলটাকে পার্কটাউনের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল - টোটো কোথায় বলত ? তাকে দেখছি না সকাল থেকে ।

    মনে আছে সেদিন পম্পা মুখার্জির জন্মদিনের আগের দিন । আমার বিশেষ নেমন্তন্ন ছিল । সেজন্যই ঝড় জল মাথায় করেও বেরোনো । টোটোদা বেরিয়ে গিয়েছিল সেই সকাল বেলা নকল নাম নিয়ে । রবীন্দ্র শিক্ষাভবনের মাঠে দেখলাম চেনা চেনা কয়েকটা গাড়ি । না থেমে আমরা যাচ্ছিলাম । মামা বলল - মনুর কাকাও কি অ্যাডভাইসরি বোর্ডের মেম্বার ? আমি বললাম - না । তাছাড়া সে তো আবুধাবিতে । মামা বলল - তোদের স্কুলের দ'ংউতলার জানলা দিয়ে উঁকি মারছিল । নাকও ঝাড়ল একবার । দেখিসনি ?

    গা'টা একটু শিরশির করছিল মনসুনের হাওয়ায় । পার্কটাউনের মোড়ে নামিয়ে দিয়ে মামা জিজ্ঞেস করল - কোন বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছিস জানিয়ে রাখ ।

    - পম্পা মুখার্জি । বললাম আমি ।

    - খুব সাবধান । বেশি কথা বলিস না । বলে সাইকেল নিয়ে চলে গেল মামা ।

    আমার মনে হচ্ছিল মনসুনের সঙ্গে একটা লোক চলতে শুরু করেছে । এখন যেখানেই যাই - কোনো নিরাপত্তা নেই । লোকটা যত না অবাস্তব তারও চেয়ে বেশি অবাস্তব তার লক্ষ্য । মেজর কলাশকর । কলাশকরও খুঁজছে তাকে । পুরোনো দিল্লীর এই ডিস্ট্রিক্ট ঘিরে সে, মনসুন আর মেজর কলাশকর পরস্পর পরস্পরকে ফলো করে একটানা গোল হয়ে ঘুরবে যতক্ষণ না একজনের মুখোশ যায় খুলে ।

    বড় রাস্তার উঁচু ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে পম্পাদের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলাম । বাগীচা তখন পরিণত হয়েছে বিলে । পম্পাই নেমে এসেছিল দুতলা থেকে । তাদের কাজের লোকটা আমাকে খেদিয়ে দেবার আগে সে ছুটে এসে বলল - উপরে যাবি ? না হাঁটবি ?

    বৃষ্টিতে পম্পা একটা ফিকে গোলাপি রঙের বর্ষাতি পরে আসত স্কুলে । স্কার্ট আর বর্ষাতি দুটোই শেষ হত হাঁটুর ঠিক মাঝখানে । বর্ষাতিটা দেখার লোভে বললাম - হাঁটব । পম্পা একটা স্লেট রঙের বর্ষাতি আমাকেও এনে দিয়ে বলল - বৃষ্টির পর আমার মাথা খারাপ হয়ে যায় । ইচ্ছে করছে সারা শহর চষে বেড়াই । কাউকে ধরে ঝাঁকাই । তোকে ঝাঁকাবো ?

    - কেন ?

    - এমনি ! নিতে পারবি না ?

    বুঝতে না পেরে বললাম - নিতে পারি । কিন্তু কেন নেব ? পম্পা বলল - মানে কিছু মনে করবি না তো ? তোরা কনজারভেটিভ পরিবারের ছেলে ।

    এগুলো আমাকে রাগাবার জন্য বলা কিনা জানি না, কিন্তু বৃষ্টির মরসুমে আমারও যে কী হয়েছিল । রাগ তো হলই না, উল্টে সাহিরের একটা কাব্য চলে এল মুখে ।

    আপ বেওয়জহ পরেশান সি কিঁউ হ্যাঁয় ম্যাডাম
    লোগ কহতে হ্যাঁয় তো ফির ঠিক হী কহতে হোঙ্গে
    মেরে এহবাব নেঁ - তহজীব না সিখী হোগী
    মেরে মাওহল মেঁ ইনসান না রহতে হোঙ্গে ॥

    বেকার কেন হচ্ছো পরেশান ম্যাডাম
    লোকে যেসব বলছে সে কি মিথ্যে হবে ?
    আমার এই বন্ধুরা তো আদব কী তাই কেউ শেখেনি
    আমাদের পাড়ায় আবার মানুষ দেখা দিচ্ছে কবে ?

    পম্পা খানিক্ষণ হাঁ করে থেকে বলল - এহবাব মানে কী ? আমি বললাম - ফ্রেণ্ড সার্কল । পম্পাদের পাড়াটা তখনও ছাড়াই নি । ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছিলাম । তার ধারে লাগানো বাবলা আর কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর তলায় ভিজে রাস্তার উপর মিহি পাতার আস্তরণ । পম্পা এদিক সেদিক দেখে নিয়ে বলল - লোকে কী বলে আমি তার তোয়াক্কা করি নাকি ? দরকার হলে শিমলিপুরের পুরো এহবাবকে ধরে চুমু খেতে পারি । দেখবি ?

    - দেখলে তো কীরকম এহবাব । প্রীতপাল সিং বানা আর ভূপিন্দর সিং জগ্গি তাদের নাম । ওরা কী আর মানুষ হবার ? ওদের যে চুমু খাবে সে-ই ব্যাং হয়ে যাবে ।

    - আর তোকে যে খাবে তার কী হবে ? হা: হা: হা: । বলে পম্পা আবার একটা পুরুষালি হাসি হাসতে শুরু করে দিল ।

    আমরা মলরোডটা পার হচ্ছিলাম এবং নিচু রাস্তার ধারে প্রায় হাঁটু অবধি ডুবে যাচ্ছিল পরিষ্কার যমুনার বালি ভাসানো বৃষ্টির জলে । পম্পা বলল - সাহিরের আর কী গজল আছে শুনি । আমি বললাম - কমলানগরে একটা বইয়ের দোকানে চলো, পাওয়া যাবে । অনেক লেখাই তো হিন্দী সিনেমার গান হয়েছে ।

    কমলানগরের দিকে যেতে যেতে আমি পরিবেশের উপযুক্ত একটা গজল খুঁজবার জন্য মনের পাতা উল্টোচ্ছি এমন সময় পম্পা হঠাৎ বলল - তুই কি সত্যি আমাকে ভালোবাসিস জয় ?

    এ কী বিড়ম্বনা ! কাশতে কাশতে বললাম - ওই শব্দটা আমার ভোকাবুলারিতে নেই ।

    পম্পা বলল - উল্টো ন্যাকামো ! সেজন্যই তোর গল্পেও কোথাও নেই, না ?

    - বোধহয় । মরলেও কারো কারো মুখে মানায় না কিছু কথা ।

    - একে তো বয়সে ছোট, তার উপর কোনো প্লেজেন্ট কথা বলতে পারিস না । একটা কারণ দে যাতে তোকে টলারেট করা যায় । এদিকে টোটো বলে গেল যে ...

    - স্টপ, স্টপ, স্টপ । আর কিছু বোলো না । জবান কো লাগাম দো । আই অবজেক্ট ... । অনেকভাবে থামাতে চাইলাম । কিন্তু পম্পা হল সেই ধরনের ধানুকী যার বুড়ো আঙুলে ব্রেক নেই । সে বলল - টোটোকে তুই নাকি বলেছিস যে একদিন আমার ঘরে ধপাস করে এসে পড়বি এবং আর ফিরে যাবি না ?

    সেরেছে । স্বীকার করতে হল যে ওই ধরনের কথা আমার ভোকাবুলারিতে পড়তে পারে । কিন্তু তাতে কী ?

    হু হু করে হাওয়া এসে পম্পার চুল উড়িয়ে আনছিল তার মুখের উপর । সেসব সরিয়ে ভাবতে ভাবতে সে বলল - একটাই তো ঘর আমার । সারাক্ষণ এরকম প্যাসিভ হয়ে থাকলে দুজনে ফিট করব কী করে ?

    - কেন ? তুমি উপরে, আমি নিচে । ফট করে বেরিয়ে গেল মুখ দিয়ে ।

    পম্পা `এ কী অনাচার !', `তাও হয় নাকি ?' বা `সত্যি ! যা: !' টাইপের এমন একটা কমিক মুখ করে দাঁড়িয়ে গেল যে আমিও অন্য কোনো উপায় না দেখতে পেয়ে `আর কোনো পজিশান অ্যাকসেপ্টেবল নয়' এরকম একটা মুখ করতে যাচ্ছিলাম । এমন সময় ভটভট করে একটা মোপেড কমলানগরের চওক থেকে আমাদের দিকে চলে এল । অর্ধেকটা জলের তলায় । উপরে কালো চশমা আর জিন্সের জ্যাকেট পরা প্রবুদ্ধ । তখন অন্তত মনে হয়েছিল যে প্রবুদ্ধই বাঁচালো এবার । সে আমাদের দিকে চেয়ে একবার ম্লান হেসে `হ্যালো' বলেই মোপেডটা সোজা ঢুকিয়ে দিল একটা দাঁড়ানো চাটওয়ালার পিছনে ।



    ॥ প্রবুদ্ধ ॥


    যতক্ষণে আমি আর পম্পা গিয়ে তার মোপেডটা ধরলাম, চাটওয়ালা আর তার হেল্পার মিলে প্রবুদ্ধকে টেনে তুলেছে । উল্টোদিক থেকে চাটওয়ালার যমজ ভাই ছুটে আসছিল ভুট্টা পোড়াবার ভাট্টি ছেড়ে । প্রবুদ্ধ বিনা বাক্যব্যয়ে লম্বা হাতের একটা ঘুঁষি ঝাড়ল চাটওয়ালার নাকে । চাটওয়ালা খানিক্ষণ টলমল করার পর ঝপাং করে ফুটপাথের ধারে জলের উপর বসে পড়ল । হেল্পার একটা বড় খন্তা খুঁজে এনেছিল কোথা থেকে । আমি প্রবুদ্ধকে বাঁচাবার জন্য হেল্পারকে পিছন থেকে জাপটে ধরলাম । যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব দেখিয়ে প্রবুদ্ধ বলল - ধরিস না জয় । আসতে দে । আমার হাত ঢিলে হবার এক সেকেণ্ড পরেই তার মাথায় পড়ল ভারি খন্তা এবং সে চোখ কপালে তুলে পড়ে গেল মাটিতে । ছেলেটার সাথে ধস্তাধস্তি করার সময় আমি ভাবছিলাম - শহরটা এরকম হয়ে যাচ্ছে কেন ? কার অভিশাপে পুরোনো দিল্লীটা ক্রিমিনালে আর কালুষ্যে ভরে গেল ? ভুট্টাওয়ালার হাত থেকে আমাকে বাঁচাবার জন্য পম্পা হাত দুটো মুঠো করে কী একটা আবেদন জানাচ্ছিল । মাটিতে শুয়ে শুয়েই প্রবুদ্ধ ঠ্যাং চালিয়ে সে লোকটাকেও পেড়ে ফেলল । আমি পেটে একটা ঘুঁষি এবং কানপটিতে লপ্পর খেলাম । তারপর কিছুক্ষণের জন্য সব অন্ধকার ।

    জ্ঞান হতে দেখি সেই মূর্তিমান কালুষ্যই আমায় জুতো শোঁকাচ্ছে । গায়ের গেঞ্জিটা তার-তার করে ছেঁড়া । অকুস্থলে না আছে প্রবুদ্ধ না পম্পা । আমি কল্মষটাকে জিজ্ঞেস করলাম - ছোকরি কহাঁ গই ? লোকটা কিছু বলতে চাইছিল, পারল না । দেখি তার মুখ দিয়ে কষ গড়াচ্ছে । একটা দাঁত নেই । হঠাৎ কারো স্টিলের কড়া পরা লোমশ হাত তাকে চুলের ঝুঁটি ধরে পিছন থেকে তুলে নিল । ভূপিন্দার সিং জগ্গি । গালে গালপাট্টা বেঁধে খালি গায়ে একটা কেড্স্‌ আর শর্টস্‌ পরে বসেছে ফুটপাথে । আমাকে পেয়ার সে জড়িয়ে ধরে বসিয়ে দিয়ে সে বলল - কী খাবি ? ঠাণ্ডা না গরম ?

    জানি ঠাণ্ডা বললে ঠাণ্ডা জলে ফেলে লাথাবে আর গরম বললে মারবে কানপটিতে গরমা-গরম ঝাপড় । আমি বললাম - যে মেয়েটা ছিল আমার সঙ্গে, সে কোথায় ? ভূপিন্দার দাঁত বের করে হেসে বলল - আমাকে দেখে পালিয়েছে । পাগল বোধহয় ।

    পরে অনেক সাধাসাধি করেও আমাকে ফ্রি-তে চাট খাওয়াতে না পেরে হতাশ ভূপিন্দার বলল - আরে মেয়েটাকে তুই যতটা প্য়োর ভাবছিস ও ততটা নয় । চালু । সেদিন আমাকে চোখ দিয়ে চেটেছে । আজ হাথ মেরেছিল । যেই বললাম, `পকল্লে, পকল্লে', তো রাগ দেখাতে লাগল ।

    ওই বদের বন্দর থেকে লঙ্গর তুলে ছুটলাম পম্পার খোঁজে । বইয়ের দোকানগুলো খুঁজে দেখব বলে তেমাথার মোড় থেকে গলিতে ঢুকেছি এমন সময় খপ করে কেউ হাতটা চেপে ধরল পাশ থেকে । প্রবুদ্ধ । তার ঠোঁট ফেটে রক্ত । পাশে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে পম্পা ।

    প্রবুদ্ধকে বললাম - তিনটে লোকের সাথে একা লড়তে গেলি ? গুনতে ভুলে গেছিস নাকি ? এই মারের পর আর ভুলবি না আশা করি ।

    প্রবুদ্ধ বলল - আমার কিছুই হত না । তোর ওই সর্দার কোচ এসে সব ভণ্ডুল করে দিল । মুখটা তো ওই ফাটাল ।

    আমি নাকি সেমিকনশাস অবস্থায় মাটিতে শুয়ে ছটফট করছিলাম । তখন কোথ্থেকে ভূপিন্দার দৌড়ে এসে প্রবুদ্ধকেই প্যাঁদাতে থাকে । অনেক কষ্টে পম্পা যখন তাকে ধরে বোঝাতে গিয়েছিল যে প্রবুদ্ধ আমার বন্ধু তখন সে পম্পার হাতে এমন কিছু একটা ধরিয়ে দেয় যে প্রবুদ্ধ বাধ্য হয় পম্পাকে নিয়ে সভা ত্যাগ করতে ।

    প্রবুদ্ধ বলল - আমরা দূর থেকে নজর রাখছিলাম । দেখি সর্দারটা সমানভাবে সবাইকে পিটছে । নাকফাটার পর ওরা তিনজনই নরম হয়ে হাত জোড় করে ফেলল ।

    পম্পা বলল - আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে তুই এখনো এই বাস্টার্ডটার সঙ্গ ছাড়িসনি ?

    আমি বললাম - আমি ভিলেন নই, ভিক্টিম । সঙ্গ ওরাই ছাড়েনি । যতদিন শিমলিপুরে আছি ওদের বন্ধুত্ব থেকে মুক্তি নেই ।

    পম্পা প্রচণ্ড জোর করা সত্ত্বেও প্রবুদ্ধ আমাদের ডাক্তারখানায় যেতে দিল না । বলল - আমি নিজেই হাফ ডাক্তার । এইসব বুড়ো বি-এম-এস-দের চেয়ে ঢের ভালো । কেমিস্টের দোকান থেকে নিজের জন্য সে একটা ব্যথার ওষুধ কিনে নিল । আমার কানের পাশে একটা ঘুঁষি পড়েছিল লাস্ট । সেইজন্যই ব্ল্যাকআউট । প্রবুদ্ধ আমাকে দুটো ব্যথার, দুটো হজমের আর দুটো ঘুমের ট্যাবলেট এবং একটা পেনিসিলিনের ক্যাপসুল গিলিয়ে বলল - এর বাইরে কিছু থাকলে সেটা মেয়েলি রোগ । পম্পা আবার তর্ক শুরু করেছিল । কিন্তু প্রবুদ্ধ তাকেও বুঝিয়ে দিল যে এরকম একটা ঘটনার পর নার্ভাস হয়ে পড়া স্বাভাবিক । এই বলে দুটো নীল রঙের এমন বড়ি সে পম্পাকে খাওয়ালো যে বেচারা লিমকার বোতল শেষ হবার আগেই কেমন ঝিমিয়ে শান্ত হয়ে পড়ল । সাবধান করে বলতে গেলাম - বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়ো না । তার জবাবে একটা বোকা বোকা হাসি দিয়ে পম্পা বলল - লিমকার মধ্যে ঝিমকা । আবে ঘুমোতে চাইলেও বদনাম দিবি ? তোরা ছেলে না মেয়েছেলের অধম ?

    এর পর আর কে কথা বাড়াবে ?

    আমরা তিনজন একটা মিষ্টির দোকানে বসেছিলাম জলযোগ করার জন্য । সাহিরের লেখা খুঁজছি শুনে প্রবুদ্ধ নিজের মোপেডের পাশে বাঁধা ক্যাম্বিসের ব্যাগ থেকে যে বইটা এনে পম্পাকে দিল তার এক কপি আমারও আছে । `মাফ কীজীয়ে মীর্জা' । প্রবুদ্ধ বলল - সব খবর এতেই পাবি ।

    পম্পা বলছিল - লম্বু এসবেও তোর ইন্টারেস্ট আছে ? আমরা তো জানতাম তুই ডাক্তারি ছাড়া আর কিছু বুঝিস না ।

    কথা নেই বার্ত্তা নেই প্রবুদ্ধ আচমকা বলল - গায়নোকোলজিটা আমার বাবার পেশা নয় নেশা ।

    ভাবছিলাম বলি - সে আর বলতে । কিন্তু পম্পার দেখি ঘুম চটে গেছে । সে হাঁ হয়ে গিয়ে বলল - তার মানে ?

    প্রবুদ্ধ বলল - বাবা দিনে দেড়শোটা করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিচ্ছিল গত মাসে । ঘন্টায় দশটা । শেষ পর্যন্ত বাল্ব ফিউজ । গেল হপ্তা থেকে নার্সিং হোমে । আমি আর দাদু দেখাশোনা করছি । মেয়েদের মুখ অবধি দেখা নিষেধ । প্রথম দিন একটা কেরালাইট নার্স এসেছিল । পরে জানা গেল সেও বাবার একজন প্রাক্তন পেশেন্ট । বাবার বেডেই শুয়ে একফাঁকে ফ্রি এগজামিন করিয়ে গেছে । তার পর থেকে দাদু আর কারো উপর ভরসা করতে পারছে না । চব্বিশ ঘন্টা পাহারায় । আমি দুপুরে বেরোই । সন্ধ্যেবেলা দাদুর জন্য রুটি নিয়ে যাই । দাদু প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছে মর্দানা রুগি ছাড়া আর কাউকে যেন কোনোদিন না ঘাঁটি ।

    এই বলে প্রবুদ্ধ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল ।

    পম্পা ঝিমোতে ঝিমোতে একসময় বলল - তাহলে তুই বড় হয়ে কী করবি ? তোর তো চলতি গাড়ি বেলাইন হয়ে গেল ।

    প্রবুদ্ধ বলল - সেকেণ্ড চয়েস বলেছি অ্যাক্টিং । পুনেতে শিখতে যাব । ওই একটা জিনিসকে আবার দাদরু মেয়েলি রোগের চেয়েও ভয় ।

    ইতিমধ্যে আমি `মাফ কীজীয়ে মীর্জা' খুলে সাহির আর ফৈজের ছবি দেখব বলে পাতা ওল্টাচ্ছিলাম । হঠাৎ পাতাগুলোর মধ্যে কেউ যেন ঘুরে আমার দিকে বসল । আকাশে বিদ্যুতো ঝলসেছিল বোধহয় । মনের মধ্যে কড়কড় করে পড়ল একটা বাজ । তখন পম্পা প্রবুদ্ধকে বলছিল - শোন লম্বু, কেরিয়ার ফেরিয়ার বাদ দে । তুই সব ছেড়েছুড়ে সন্ন্যাসী হয়ে যা । আমাদের জেনারেশানে কেউ সন্ন্যাসী হয় না । লজ্জার কথা ।

    প্রবুদ্ধ বলল - সন্ন্যাসী ? তুমি হয়ে দেখাও না ?

    আমি সেই ছবিটা দেখছিলাম । হাতকাটা জ্যাকেট, তার নিচে কুর্তা । ঠিক যেমন টিভিতে দেখেছিলাম । সাইড থেকে আমার দিকে পাশ ফিরছে । যেন এক্ষুনি বলবে - `হ্যালো' ! চিনেও ফেলতে পারে । সর্বনাশ ! ফটাস্‌ করে বইটা আমি বন্ধ করে দিলাম ।

    পম্পা বলল - আমি পারব না । আমার বাচ্চা চাই ।

    প্রবুদ্ধ বলল - আমিও পারব না । যা খরচের হাত । ভিক্ষে করে আর কত জুটবে । জয়টার হতে পারে । ওর কোনো পিছুটান নেই । মাছ মাংসও ছেড়ে দিয়েছে । জানো ?

    পম্পা আঁত্কে উঠে বলল - সত্যি ছেড়েছিস ? বাঙালির ছেলে হয়ে ... । কেন ?

    প্রবুদ্ধর দিকে কটমট করে তাকাতে গেলাম । প্রবুদ্ধ বলল - আমিষ খেলে ওর মাথায় খুন চেপে যায় । রাত্রে ঘুম হয় না । শুধু স্বপ্ন দেখে রক্ত আর রক্ত ।

    পম্পা বলল - পেট গরম হয় বল ।

    বইটা আবার খুললাম । সেই মুখ । `হ্যালো' । `হাউ ডু ইউ ডু' । সরস্বতী তোমরকে একটা ফোন করা দরকার । কেন হঠাৎ ঝড় বাদলের দিনে কাউকে না জানিয়ে স্কুল অ্যাডভাইসরি বোর্ডের মিটিং হতে যাবে ? সরস্বতীর জিপ আর ধূপেন্দ্রর সাদা অ্যাম্বাসাডারই কি দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে ? আর আব্বাস বেগ ? তিনিও কী স্কুল বোর্ডের মিটিংয়ে যোগ দিচ্ছেন আজকাল ? কিন্তু কেন ?

    প্রবুদ্ধ বলল - যেদিন ওদের বাড়িতে আমিষ রান্না হয় সেদিন ওর মা'কে ওর জন্য স্পেশালি শাক সব্জি কিছু রাঁধতে হয় ।

    পম্পা বলল - বুঝতে পারিনি তুই এরকম মেন্টাল, জয় । তাহলে তোর সাধু হয়ে যাওয়াই উচিত ।

    আমি বললাম - আমিষ ছাড়লেই সাধু হতে হবে ? খাওয়া নিয়ে একটা অবসেশান আছে তোমাদের । অনেক বাঙালি মেয়েদের যেমন বিধবা হলে বৈরাগী বানাবার চেষ্টা করা হয় । একটা মানুষ কী এত সহজে পাল্টায় ?

    পম্পা বলল - স্বপ্নটপ্ন সব গুল । নিশ্চয়ই কেউ তাপ্পি দিয়ে কিছু বুঝিয়েছে । কোনো গুরু ধরেছিস নাকি ? আরে অহিংসা করতে গিয়ে কী না খেয়ে মরবি ? মানুষকে বাঁচার জন্য একটু স্বার্থপর হতেই হয় পাগল !

    আমি বললাম - দ্যাখো ডালরুটি খেয়েও অনেকদিন বাঁচা যায় কিন্তু ।

    তো পম্পা ঢুলু ঢুলু চোখে বলল - সেই বাঁচাটাও কি একটা বাঁচা, লল্লু ?

    আমি পম্পা আর প্রবুদ্ধকে স্কুল অ্যাডভাইসরি বোর্ডের মিটিংএ নেমন্তন্ন করলাম ।



    ॥ মিটিং ॥


    প্রবুদ্ধর মোপেডে ঠেসেঠুসে উঠে যাচ্ছিলাম আমরা । মাঝখানে পম্পা । তার দুটো পা-ই একদিকে । বোরোলিনের গন্ধে আমার মর্দানা রোগটা ফিরে আসছিল । পম্পা নিষ্পলক চোখে দশ সেকেণ্ড চাইতেই সব রক্ত জল । সঙ্গে সঙ্গে সে হাসতে হাসতে এত কাছে ঘেঁষে এল যে আমার পড়ে যাবার উপক্রম ।

    প্রবুদ্ধ ড্রাইভ করার সময় কোনো কথা বলে না । প্রচণ্ড স্পীডে জলের উপর নিচ আশপাশ দিয়ে হারপুনের মত চলেছি আমরা । পম্পা আমার কলার ধরে বলল - কী চেপে যাচ্ছিস সেটা বলে দে । নইলে ধাক্কা মেরে ফেলে দেব ।

    বাকি পথটা পম্পার বর্ষাতি ধরে ঝুলতে ঝুলতে চলে এলাম ।

    রবীন্দ্র শিক্ষাভবনের মাঠের ধারে চার পাঁচটা গাড়ি আর একটা মোটর-সাইকেল । পার্ক করে প্রবুদ্ধ বলল - সত্যি সত্যি বোর্ডের মিটিং হলে বাবাকে ডাকত না ? আব্বাসের কনভার্টিবলও আছে দ্যাখ । সে তো বোর্ডে ছিল না । আচ্ছা প্ল্যানচেটের অধিবেশন নয় তো ?

    পম্পা বলল - মহেন্দ্রবাবু আব্বাস বেগ আর রোজাম্মাকে নিয়ে ছুটির দিনে স্কুলের বিল্ডিংএ সিক্রেটলি মীট করছেন । হাইলি ইমপ্রপার । জানতে পারলে ম্যানেজিং কমিটি শো-কজ নোটিস দেবে ।

    প্রবুদ্ধ বলল - না জানলেই ভালো । ছুটির দিনে বিল্ডিংটা মহেন্দ্রবাবু বাবাকেও বেশ কয়েকবার ধার দিয়েছেন অপারেশনের জন্য । বায়োলজি ল্যাবে শুধু ব্যাংই মরেনি । এসব নিয়ে নাড়াঘাঁটা করলে বাবার তো নির্ঘাৎ জেল ।

    প্রবুদ্ধর পিছু পিছু আমরা অফিস ঘরের সামনে এসে দেখলাম দরজাটা ভেজানো । প্রবুদ্ধ ঠোঁটে একটা আঙুল ঠেকিয়ে টেনে খুলল দরজাটা ।

    পরে আমি সরস্বতী তোমরকে চিঠিতে লিখেছিলাম - পুলিশের লোক হয়ে ধূপেন্দ্র দরজাটা লক করেননি ! এমনকি আপনিও ?

    সরস্বতী আমাকে বলেছিলেন - আরো তিনজনের আসার কথা ছিল যে । শেষ পর্যন্ত আসেননি । ভাগ্যিস !

    তার বদলে ঢুকে পড়লাম আমরা । কালো পর্দার পিছনে লম্বা করিডর । শেষ হয়েছে প্রিন্সিপালের ঘরে । তার দরজায় সেলুনের মত সুইং ডোর - মহেন্দ্রবাবুর ঘরের সব ফার্নিচারই কেন সেলুনের সে নিয়ে আমাদের কৌতুহলও কোনোদিন শেষ হয়নি । কেউ কেউ এও বলত যে দেখে নেবে একদিন । ছুটির পর পুরো পঁচিশ টাকা নিয়ে ঢুকে । কিন্তু অত পয়সাই বা কার ? কিট কিট কিট কিট করে একটানা শব্দ হচ্ছিল একখানা । ভিতর থেকে রোজাম্মার চড়া গলা ভেসে এল হঠাৎ । - ইয়েস উই আর অল মার্ডারারস । আমরা সবাই খুনী । গড আমাদের কাউকে ক্ষমা করবেন না ।

    শুনে এমনকি প্রবুদ্ধও টলে গেল । আমি আর পম্পা তো ভয়ে জুজু । একটা ছোট পজ । করিডরের দুপাশে দেয়ালে সেঁটে আমরা পরবর্তী ঘটনার অপেক্ষা করছি । স্কাইলাইট দিয়ে অশুভ ফ্যাকাশে রঙের একটা আলো আসছিল । প্রিন্সিপালের ঘরের বাইরে দেয়ালে পড়েছিল কার কার ছায়া । যেমন যেমন সেই ছায়াগুলো নড়তে চড়তে আর কথা বলতে লাগল, তেমন তেমন আমরা যেন ছায়া হয়ে মিলিয়ে যেতে লাগলাম । আমি, পম্পা আর প্রবুদ্ধ একসাথে ভয়ে এবং শীতে কোনঠাসা হয়ে যেন এক ভৌতিক কার্যকলাপের সাক্ষী । যেমন মহেন্দ্রবাবু কাকে `স্যার, স্যার' বলে কথা বলছিলেন । - আপনাকে পারতেই হবে । কলাশকর তো অপারেশনের টেবিলে । যেমন রোজাম্মা খ্যান খ্যান করে বেজে উঠে বলছিলেন - শেমফুল, শেমফুল । হাউ ডিগ্রেডিং । যেমন আব্বাস বেগ গমগমে গলায় বললেন - ভাও বাড়াবেন না মাই লর্ড । ছ হাজার টাকাও আছে এই বাজারে । নখরা রেখে টোকরাটা তুলুন । যেমন সেই শান্ত, অন্য গলাটা বলছিল - যদি `না' বলি ? এটা কি ব্ল্যাকমেল ?

    যেমন সেই একটানা কিট কিট কিট কিট শব্দ । সিনেমার রীল চলার মত । প্রবুদ্ধ ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে তারপর সেটাকে দুবার ঘোরালো বাতাসে । ধূপেন্দ্র ভগওয়ানির স্পষ্ট গলা পেলাম একবার - ইনকাম ট্যাক্সের ঝুটঝামেলা আর বাড়াবেন না স্যার ।

    পরে সেই কথাবার্ত্তাগুলো আস্তে হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছিল । ছায়াগুলোও একটা আরেকটার মধ্যে ঢুকে, ব্লেণ্ড করে, হাতে হাত মিলিয়ে, কিম্বা একঝাঁক ভুতুড়ে পাখির মত আমাদের চোখের সামনে একডাল থেকে অন্যডালে চরে বেড়াচ্ছিল । তারা বলল - শহীদ কে নয় ? টাকাটা তো হাণ্ড্রেড পার্সেন্ট হোয়াইট । রোজাম্মা কেন জয়েন করেছেন জানেন ? না করলে ওঁর থরোলি রিসার্চ করা জীবনী প্রকাশের জন্য রেডি হয়ে আছে । নামও রেডি । `এ রোজাম্মা ইজ এ রোজাম্মা' । মহেন্দ্রবাবুর কৃতিত্ব । এরকম একটা টিম গড়ে তুললেন এত কম সময়ে । নিজে, ধূপেন্দ্র, রোজাম্মা, আব্বাস বেগ এবং আরো তিনজন । ব্রিলিয়ান্টলি সামলে দিচ্ছেন । কিন্তু একজন অভিজ্ঞ সার্জেন চাই । আমিই আপনার নাম সাজেস্ট করলাম ।

    প্রবুদ্ধর চোয়াল ঝুলে পড়ে লম্বা মুখটা একেবারে হাঁ । ওদিকে পম্পার চোখ । স্বাভাবিক হতে গিয়ে আমি হাইপার ভেন্টিলেট করতে লাগলাম । প্রবুদ্ধ পালাবার পথটা খোলা আছে কিনা দেখে এল । আমি কালো পর্দাটা টেনে নিলাম, যাতে মুখটা অন্তত ঢাকা পড়ে যায় । ভিতরের ঘরে তখন ফাঁদে পড়েছে বাঘ । ছায়াগুলো ঘনিষ্ঠ হয়ে এল সেই ভয়ংকর চেনা চেনা গলাটার কাছে । শান্ত গলায় উদ্বেগ । - আরো তিনজন ? তারা কারা ? - বলা যাবে না নাম । ভুলে যাবেন না কতটা বিপদের ঝুঁকি নিতে হচ্ছে আমাদের সবাইকে । আপনার কেসটা আলাদা । যার থেকে ভয় সে তো আপনার উপরেই সবচেয়ে খাপ্পা স্যার । জবাবটা তাহলে কী ? `হ্যাঁ' না `না' ? কী ? কপিরাইট ? আচ্ছা আপনি আদমি না আদমখোর ?

    ফেরার পথে আকাশের মেঘ কেটে একটুখানি রোদ বেরিয়েছিল । ভাবছিলাম আব্বাস বেগ আর ধূপেন্দ্র একদিকে হয়ে গেলেন কবে থেকে ? আর মহেন্দ্রবাবুর টিমে কী করে ঢুকে পড়লেন রোজাম্মা ? কপিরাইট কার ? সে-ই কি আদমখোর ? শহরের এক প্রান্ত থেকে একজন সাইকোপ্যাথ হাঁটতে শুরু করেছিল । আমার মনে হল সে একজন অত্যন্ত উঁচুদরের ক্ষমতাওয়ালা লোক ।

    পম্পা দুদিকে পা ঝুলিয়ে বসেছিল এবং আমাকে ঠেলে দিচ্ছিল আরো পিছনে । স্লিপ করতে করতে কীরকম সঙ্গীনভাবে ঝুলেছিলাম সেটা টের পাওয়া গেল যখন মলরোডের মোড় থেকে টার্ন করার সময় রাস্তার ধারে কাদার উপর হঠাৎ পড়ে গেলাম এবং পম্পা বা প্রবুদ্ধ কেউই আওয়াজ শুনতে না পাওয়ায় মোপেডও তীরের মত বেরিয়ে গেল পার্কটাউনের দিকে ।

    পিঠ আর পায়ের যন্ত্রণায় ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বাড়িতে ঢুকে দেখি আরেক বিপত্তি । কলকাতা থেকে মায়ের পানুকাকা এবং আমার দূর সম্পর্কের দাদু তাঁর এক ডজন পরিবারের সদস্য নিয়ে সদলবলে উত্তরভারত সফরে এসে পড়েছেন । কালীবাড়িতেই ওঠার কথা ছিল কিন্তু `বহুদিন তোমাগো লগে দেখা সাক্ষাৎ নাই, তাই'... । মামা অফিস থেকে ফিরে দেড় ডজন ডিম কিনে এনেছে । হট্টগোলের মধ্যে অমলেটের ঝোল । আমাকে দেখেই মায়ের পানুকাকু লাফিয়ে উঠে বললেন - আসছে । গাইড আসছে । অ্যাট লাস্ট !

    জানতে পারলাম সেদিন রাতেই দুন এক্সপ্রেসে রওনা হতে হবে পুরো পল্টনকে নিয়ে । মসুরী, হরিদ্বার, হৃষীকেশ ইত্যাদি । বললাম - ব্রেক জার্নি তো ? কয়েকদিন পিছোনো যায় না ? আমার একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে । মাথায়, পিঠে চোট লেগেছে একটু । ডাক্তার দেখালে ভালো হয় ।

    মামা হাতে দুটো দশ টাকার নোট দিয়ে বলল - যা: ছুটে যা । মসুরী না পাঠাতে পারলে এই নিয়েণ্ডারথালের গুষ্টিকে রাতে শুতে দিতে হবে । অত জায়গা কোথায় ? টোটো যখন আসেনি তখন তুইই ভরসা ।

    টাকাগুলো নিয়ে বেরোলাম । পোস্ট অফিস থেকে একটা ইনল্যাণ্ড কিনতে হল । টোটোদার জন্য একটা চিরকুটও লিখে রাখতে হল বাড়িতে । রাত আটটা নাগাদ যখন আমরা রওনা হচ্ছি তখনও তার কোনো পাত্তা নেই ।

    ইনল্যাণ্ডটা পোস্ট করলাম স্টেশান থেকে । সরস্বতী তোমরকে সব জানিয়ে । সাবধানের মার নেই । যদি আমরা কেউ না ফিরি ?

    কারণ দুর্যোগের রাত । একটা সাইকোপ্যাথ ধরা দিতে এসেছে ।

    তাকে ফেরানো যায় ?
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments