• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩০ | মে ২০০৩ | গল্প
    Share
  • জনৈক গণপতি : অয়ন

    অনেকেই গণপতিকে পাগল বলবেন । আমি কিন্তু তা বলব না, আমার মতে গণপতি অদ্ভুত - তার মতো অদ্ভুত লোক আমি আগে দেখিনি, ভবিষ্যতেও দেখব কিনা সন্দেহ । সে যে ছিটগ্রস্ত তাতে কোনো সন্দেহ নেই, মানে এই ধরনের লোকদেরই আমরা ছিটগ্রস্ত বলে থাকি - তবে তার `ছিট' যে বেশ অসাধারণ তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে না । তার সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছিল বাসে, অল্প সময়ের জন্য । এ ধরনের পথচলতি পরিচয় হামেশাই ঘটে থাকে - পথ শেষ হলেই তারা চলে যায় বিস্মৃতির অতলে । গণপতির ক্ষেত্রে সে ব্যাপারটা হয়নি, এটাই বোধহয় তার অসাধারণত্বের পরিচায়ক ।

    আমি তখন ব্যাঙ্গালোরে । ব্যাঙ্কের ট্রেনিংএর জন্য দু'সপ্তাহ থাকতে হচ্ছে । ব্যাঙ্গালোরের কাছাকাছি বেশ কিছু বেড়ানোর জায়গা আছে । একটা শনিবার দেখে আমি, রাজীব আর সুগত বেরিয়ে পড়লাম মাদিকেরির উদ্দেশ্যে । ব্যাঙ্গালোর থেকে আড়াইশো কিলোমিটার দূর মাদিকেরি । হিল স্টেশন উটির মতো ভিড়. হয়ে যায়নি । তিনদিন থাকব । সোম-মঙ্গল ছুটি ছিল, আমরা ব্যাঙ্গালোর ফিরব মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ।

    গণপতির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল ফেরার সময় । মঙ্গলবার সকালে একটা বাসে চেপে বসেছি - চমত্কার একটি `সুপার ডিলাক্স' । তিনজনে তিনটি জানালার ধার নিয়েছি, আমি ওদের দুজনের পেছনে । বাসে দশ-মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া ওদের অভ্যাস, আমার রাস্তা -টাস্তা দেখতেই ভালো লাগে, মাদিকেরির থেকে কিছুদূর অবধি পাহাড়ের কোলের মধ্যে রাস্তা, পাশে খাদ সেখানে ঘন জঙ্গল । বেশ কিছু চুলের-কাঁটা বাঁকও আছে । পাহাড়ি জায়গাটা পেরিয়ে এলে অবশ্য চারপাশের দৃশ্য কিছুটা বিরক্তিকর হয়ে যায় - লালচে মাটি, ছড়ানো-ছেটানো গাছ, কলকারখানা, দোকানপাট, একইরকম চেহারার মানুষ, সেইসময় আমারও ঘুম পায় । ঘুম-ঘুম ভাবটা তখন সবে আসছে, তখনই সে আমাকে ডাকল ।

    লোকটিকে আমি আগেই লক্ষ করেছিলাম । আমার পাশের জানলার ধারের সীটটায় বসেছে - মাথায় একটা অ্যামেরিকান "বেসবল ক্যাপ", চোখে সানগ্লাস, কানে ওয়াকম্যান, মাঝারি উচ্চতার, মোটা গোঁফওলা পুরুষালি চেহারা, দক্ষিণী সিনেমার আধুনিক নায়কদের মতো দেখতে অনেকটা । পরণে জীনস আর চামড়ার জ্যাকেট । এপ্রিল মাস প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তখন, পাহাড়ি জায়গা হলেও মাদিকেরিতে একটুও ঠাণ্ডা নেই । সাড়ে দশটা-এগারোটার সূর্য তো বেশ গায়েই লাগে । তা-সত্ত্বেও কি করে কেউ জ্যাকেট পরে থাকে যখন ভাবছি, তখনই দেখলাম সেটা খুলে ফেলে পাশের সীটে রেখে দিয়েছে । আমার মতো তারও পাশের সীটটা খালি ।

    বাস ছাড়ার আগে লোকটির দিকে আর একবার চোখ পড়েছিল । একটি ছেলে বাসে উঠেছিল একখানা বন্দুক নিয়ে । লোকটি সেটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বেশ বিজ্ঞের মতো বলল, "বা:, বেশ ভালো এয়ারগান ।"

    বাসযাত্রাটা সব মিলিয়ে ঘন্টা-ছয়েক মতো হবে, আড়াই ঘন্টার মাথায় পেছনের চাকা পাংচার হলো । পেছনের চাকাগুলো সবই জোড়া টায়ার, ফলে একটা ফাটলেও বাস চলে । কাছাকাছি একটি ছোটোখাটো শহর ছিল, সেখানকার সার্ভিস স্টেশনে বাসটা ভিড়ল । সকলে নেমে এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগলাম । দুপুরবেলা ক্ষিদে ক্ষিদে পাচ্ছে, কাছাকাছি কোনো হোটেল-রেস্তোরাঁও চোখে পড়ল না । বাসটা অবশ্য পরে খাওয়ার জন্যে দাঁড়াবে, কিন্তু সে কখন ! এখনই বাজে দেড়টা ।

    সামনে একজন শসা বিক্রি করছিল । আমাদের কাছে কলা, বিস্কুটও ছিল, তাই দিয়ে পেট ভরানো গেল । সেই লোকটিকে তখন কাছাকাছি দেখিনি ।

    বাসে উঠেই অবিশ্যি তার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হলো । কালো চশমা পরে ছিল সে, তবু আমার বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে আমি যখন তার দিকে তাকিয়েছিলাম, সে-ও আমার দিকেই চেয়েছিল ।

    চোখাচোখি হওয়ার আধঘন্টা পরই লোকটি আমাকে ডাকল ।

    "হ্যালো" শব্দটা পাশ থেকে ভেসে আসতেই আমি তাকালাম, এদেশে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এই শব্দটাই ব্যবহৃত হয়ে থাকে ।

    দেখলাম পাশের সীটটায় চলে এসেছে সে । কানে ওয়াকম্যান নেই তবে সানগ্লাস আর টুপি এখনও আছে । জ্যাকেটটা জানালার দিকের সীটটায় রাখা ।

    তার ইশারায় আমিও আমার পাশের ফাঁকা সীটটায় সরে এলাম ।

    "আপনার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে - আমি গণপতি, এক্স ফ্লাইট লেফটেনান্ট ।" বলেই হাত বাড়িয়ে দিল । কিছু লোকের স্বভাবই হচ্ছে নিজেদের দুর্দান্ত ব্যক্তিত্ব প্রকাশের ইচ্ছায় যাবতীয় শক্তি দিয়ে অপরের হাত পেষণ করা । এক্স ফ্লাইট লেফটেনান্ট তো আরও সেরকম করবে ভেবে হাতটা শক্ত করে নিয়ে বাড়িয়েছিলাম - আবিষ্কার করলাম যে গণপতির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা খাটল না, ওর হ্যাণ্ডশেক বেশ মোলায়েম ।

    "আমার নাম উদয়ন", বললাম । তখন অবধি যে-ক'জন দক্ষিণ ভারতীয়দের নাম বলেছি, কেউই প্রথমবার কিছু বোঝেনি, হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকেছে, এবারও তাই দ্বিতীয়বার বলার জন্যে তৈরি হলাম । পুনরায় আমাকে অবাক করে গণপতি বলল "উদয়ন । বেংগলি । কি করেন ?"

    জবাবে আমি ফট করে একটা মিথ্যে কথা বলে দিলাম । জীবনে অনেক কিছু হওয়ার ইচ্ছে ছিল আমার, সাহিত্যিক থেকে শুরু করে বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, স্যুট-টাই পরা ঝাঁ-চকচকে এক্সিকিউটিভ, ইত্যাদি ইত্যাদি (মায় আরণ্যক পড়ে জঙ্গুলে এস্টেটের একাকী ম্যানেজার হওয়ারও সখ হয়েছিল এককালে) কোনোটাই বাস্তবায়িত হয়নি । তবু এখন কোনো অচেনা লোক জিজ্ঞেস করলে যা খুশি একটা বানিয়ে বলে দিই । মজা লাগে বেশ । নিজেকে কেমন যেন অচেনা মনে হয় - লোকেও কখনো অদ্ভুত কাজ শুনে অবাক হয়ে যায় । এখন অবিশ্যি উদ্ভট কোনো কাজ নয়, বললাম যে ব্যাংগালোরের ইণ্ডিয়ান ইনিসটটিউট অফ সায়েন্সে পিএইচডি করছি ফিজিক্সে । এমনিতে এমএসসি-টা ফিজিক্স নিয়েই করেছি, ডক্টরেট করতেও পারতাম, কিন্তু রিসার্চ লাইনের অনিশ্চয়তা ও সর্বোপরি নিজের যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ থাকায় আর ব্যাপারটা নিয়ে এগোইনি, ব্যাঙ্কে ঢুকে পড়েছি । ভালো চাকরি, ভালো মাইনে । তবে আমার কয়েকজন বন্ধু রিসার্চ করে, তাদের মধ্যে ব্যাঙ্গালোরের আই আই এস সিতেও আছে একজন ।

    "বা: বা: খুব ভালো, আপনার মতো একজনকেই আমি খুঁজছিলাম । ইউনিভার্স নিয়ে আমার কিছু প্রশ্ন আছে ।"

    ইউনিভার্স ! ওরে বাবা, সে যে ভারি গোলমেলে বস্তু ।

    "ইউনিভার্সের সঙ্গে অবশ্য আমার কাজের কোনো সম্পর্ক নেই ।"

    "তা হলেও, ফিজিক্সএ ডক্টরেট করছেন যখন, কিছু নিশ্চয়ই জানবেন ।"

    ইচ্ছে করছিল "না জানি না" বলে দিতে, কিন্তু তাহলে প্রেস্টিজ বলে কিছু থাকে না । তাছাড়া এমএসসিতে অ্যাস্ট্রোফিজিক্স সংক্রান্ত একটা পেপারও ছিল । যদিও ওসব তিনবছর আগেকার জিনিস, সবই প্রায় ভুলে গেছি, তবু এই ধরনের অর্ধেক-জানা লোককে ভুজুং- ভাজুং দিয়ে দিতে পারব বলেই মনে হলো ।

    "হ্যাঁ, পড়েছি তো বটেই । বলুন কি প্রশ্ন আপনার ।"

    "হ্যাঁ, আপনারা বলেন যে ইউনিভার্সের জন্ম হয়েছিল "বিগ-ব্যাং" নামক মহাবিস্ফোরণে, তাই তো ?

    ঘাড় নাড়লাম, "আমরা" তাই বলি ।

    "আর শেষ হবে বিগ-ক্রাঞ্চ-এ, ঠিক ?"

    বা:, এই তো চমত্কার সুযোগ পাওয়া গেছে ওকে গোড়াতেই থামিয়ে দেওয়ার । স্মিত হাস্যে বললাম, "না"।

    এই উত্তরটা আশা করেনি গণপতি, কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বলল, না মানে ?

    "মানে এখন অবধি যা তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে তাতে বিগ ত্রক্রাঞ্চের সম্ভাবনা যথেষ্ট কম ।"

    "কিন্তু আমি যে কিছুদিন আগেই পড়লাম ...."।

    "ভুল লিখেছে সেখানে । বিগ ব্যাং-এ স্পেস-টাইম তৈরি হয়েছিল । স্পেসের তিনরকম জিওমেট্রি সম্ভব । প্রত্যেকটার ক্ষেত্রে জেনারেল রিলেটিভিটির ইকোয়েশন লাগিয়ে তিনটে কণ্ডিশনে পৌঁছনো যায় । সেই অনুযায়ী মহাবিশ্বের তিনখানা ডেসক্রিপশন আসে, তার মধ্যে এখনকার তথ্যপ্রমাণ যেটাকে সবচেয়ে বেশি সমর্থন করছে সেটা ইনফাইনাইটলি এক্সপ্যাণ্ডিং মডেল, অর্থাৎ যার অনুসারে মহাবিশ্ব চিরকাল বেলুনের মতো ফুলতেই থাকবে, থামবে না । একটা পর্যায় অবধি বেড়ে তারপর বিগ ত্রক্রাঞ্চ হয়ে ছোটো হতে-হতে আবার সেই বিন্দুতেই ফিরে যাওয়া এই থিওরিটা ঠিক নয় বলেই ধরে নেওয়া হয়েছে । "

    বেশ মন দিয়ে শুনল গণপতি । তারপর মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল "চিরকাল শুধু বেড়েই যাবে, কখনো থামবে না .... কিন্তু কেন ? প্রশ্নটা আমার উদ্দেশ্যে ।

    তিনবছর পরেও এরকম গূঢ় সব ব্যাপার জলের মতো করে বুঝিয়ে দিতে পেরে আত্মগর্বে ফুলে উঠেছিলাম । গণপতির প্রশ্নের উত্তরে সবজান্তা সুরে বললাম, "বিজ্ঞান তো `কেন'র উত্তর বলে না, `কিভাবে'র উত্তরই বলে ।"

    "হুঁ:" করে একটা আধা-তাচ্ছিল্যের শব্দ করে গণপতি বলল "তা যা বলেছেন" ।

    "আপনি তাহলে কি নিয়ে কাজ করছেন ?"

    ভূদেব আইআইএসসিতে অপটিক্স নিয়ে কি সব করছে ।

    বলে দিলাম ।

    "তা জিনিসপত্তর কি কি লাগে ?"

    কিছুদিন আগেই ভূদেবের সঙ্গে দেখা করেছি । ইনস্টিটিউটেও একবার গিয়েছিলাম । ওদের ল্যাবটা হচ্ছে "লেজার ল্যাব", তিনখানা বড়ো বড়ো লেজার আছে ।

    "লেজার ! বা: । নিশ্চয়ই নিজেরা তৈরি করেন না, বাইরে থেকে আনান । দেশে কি পাওয়া যায় নাকি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় ?"

    জ্বালিয়ে মারল দেখছি । লেজারগুলো ভারতের কিনা সেটা তো ভূদেবকে জিজ্ঞেস করা হয়নি । তবে নির্ঘাত নয়, ওরা নিশ্চয়ই বাইরে থেকেই আনায় ।

    "না, এখানে আর কি পাওয়া যাবে, অ্যামেরিকা থেকেই আমদানি করতে হয় ।"

    "হা:, গণপতি এটাই আশা করছিল । ভারি খুশি হলো সে । হাঁটু চাপড়ে বলল, "এখানেও অ্যামেরিকা । আচ্ছা উদয়ন, আপনার কি মনে হয়, ভারতের ওপর অ্যামেরিকার প্রভাব এখন কতটা ?"

    হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম । অবশেষে ফিজিক্সএর জাল কেটে বেরোনো গেছে । অ্যামেরিকার আগ্রাসন নিয়ে আমি আড্ডায় যথেষ্ট গলা ফাটিয়েছি, এটা আমার একটা প্রিয় বিষয় বলা যায় ।

    শুরু করলাম, "দেখুন মিস্টার গণপতি, একটা দেশের ওপর অন্য একটা দেশের প্রভাবকে মারাত্মক বলা যায় তখনই যখন সেটা সাংস্কৃতিক প্রভাবে গিয়ে দাঁড়ায় । আমাদের ক্ষেত্রে ঠিক এটাই ঘটছে । অ্যামেরিকা এখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, আমাদের আচার আচরনে, কথাবার্তায়, জামাকাপড়ে, গানে - বিশেষ করে শহুরে যুবসমাজ তো অ্যামেরিকা ছাড়া কিছু ভাবতেই পারে না । আর ইকনমিক দিক দিয়ে যদি বলেন, ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক, আই এম এফ চালায় কে বলুন ?

    মুচকি হেসে গণপতি বলল, "আপনার কোনোদিন অ্যামেরিকা যেতে ইচ্ছে হয়নি ?"

    জিআরই নিয়ে একসময় ক্ষেপেছিলাম বটে, কিন্তু খরচা এবং শেষ পর্যন্ত কুঁড়েমির জন্য ব্যাপারটা এগোয়নি ।

    "ইচ্ছে যে হয়নি তা বলব না, কিন্তু দেখলাম যে এদেশেও কাজ করার সুযোগ আছে । আই-আই-এস সি-তে যখন ঢুকে পড়তে পারলাম তখন মনে হলো কি আর হবে অ্যামেরিকা অ্যামেরিকা করে । এখানে তো ভালোই সুযোগ-সুবিধে পাচ্ছি ।

    "কিন্তু টাকা ? টাকা পাচ্ছেন এখানে ?"

    সপ্তাহে সাত দিন, দিন-রাত কাজ করে মাসে মোটে সাড়ে পাঁচ হাজার পায় ভূদেব । "কান ধরে তোদের টাকাগুলো কেড়ে আমাদের দিয়ে দেওয়া উচিত" যে মাঝেমধ্যে বলে না তা নয়, কিন্তু হা-হুতাশ করতে বা ঈর্ষান্বিত হতে দেখিনি ।

    "না, মানে টাকাটা তো সবসময় বড়ো কথা নয়, কাজের আনন্দ বলেও কিছু আছে ...."

    "উত্তর অপ্রয়োজনীয়" ভঙ্গিতে গণপতি বলল, "অ্যামেরিকায় নিশ্চয়ই অনেক বেশি পেতেন ?"

    "হ্যাঁ আমাদের হিসেবে ধরলে তো পেতামই ।"

    "হুঁ । তাও আপনি এখানেই রয়েছেন । টাকার লোভ নেই আর ওদের নজরেও পড়েননি, বোধহয় এখনও দুধর্ষ কিছু করেননি বলে ।"

    ঘাবড়ে গেলাম সামান্য । "নজরে পড়িনি মানে ?"

    আবার মুচকি হাসল গণপতি । হেসে এ বিষয়ে-আমার চেয়ে জ্ঞানী-কেউ-নয় ভাব দেখিয়ে বলল, "আপনি কি জানেন যে এদেশের প্রত্যেক বিখ্যাত ব্যক্তির সমস্ত গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখে অ্যামেরিকা, অধিকাংশই ওদের হাতের পুতুল ! এই যে শালা পলিটিশিয়ানগুলো, এই ...", বলে ভারতের তাবৎ রাজনীতিকদের প্রতি যে মার্কিন বিশেষণ দুটি প্রয়োগ করল সেগুলোর বাংলা করলে মূল রস এবং তাকৎ হারিয়ে যাবে । "এ বাঞ্চোত্গুলো সবকটা ওদের খেলার ঘুঁটি, জাস্ট ঘুঁটি । ওরা চাইলে এরা ক্ষমতায় আসে, না চাইলে হাওয়া হয়ে যায় । নইলে এদের মতো ওয়ার্থলেসরা দেশ চালাচ্ছে, এটা বিশ্বাস হয় আপনার ?"

    একটানা কথাগুলো বলে থামল গণপতি । রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়েছে লোকটা ।

    আমি একটা মৃদু হেঁ হেঁ করলাম । এ ব্যাটা মনে হচ্ছে দেশের হাঁড়ির খবর জেনে ফেলা হাওড়া-রাণাঘাট লাইনের শান্তিগোপালবাবুর মতো ।

    "যাকগে, আসল কথাটা বলি আপনাকে । ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস পড়েন ?"

    এক্সপ্রেস এখানকার অন্যতম জনপ্রিয় কাগজ । আমি অবিশ্যি ব্যাঙ্গালোরে থাকাকালীন সব ইংরেজি কাগজই পড়ি, অধিকাংশ সন্ধেয় কিছু করার থাকে না ।

    "হ্যাঁ, পড়ি ।"
    "গত শুক্রবারের আগের শুক্রবারে এক্সপ্রেসের সম্পাদকীয়খানা পড়েছিলেন ? অ্যামেরিকা সম্পর্কে ছিল, মানে অ্যামেরিকার দাদাগিরি সম্পর্কে ।"

    দু-সপ্তাহ পুরোনো এক্সপ্রেসের সম্পাদকীয় খোদ সম্পাদকই ভুলে গেছে সম্ভবত, আমি মনে রেখে দেব, ভেবেছে কি এ !

    "মনে নেই ! কি আর করা যাবে," হতাশ হয় গণপতি । "তবে জেনে রাখুন, সম্পাদকীয়টা আমার ।"

    "আপনার মানে ?"
    "মানে খুব সোজা । সম্পাদক আমার বন্ধু হয় । সপ্তাহ তিনেক আগে আমার বাড়ি এসেছিল, দুদিন ছিল । তখনই আমার লেখাটা ওকে দেখিয়েছিলাম । ব্যাটা পড়ার জন্য নিয়ে গিয়েছিল । এখন দেখছি সেটাই ছেপে দিয়েছে । হুবহু ।

    "তাই নাকি ? আপনি তাহলে ভালোই লেখেন বলতে হবে ।"

    প্রশংসায় খুশি হয় গণপতি । "হ্যাঁ, তা একটু আধটু লিখি । কূর্গে যে কাগজটা লোকালি বেরোয় সেটায় আমার একটা কলাম আছে । তবে এখন যখন এক্সপ্রেসেই আমার লেখা বেরিয়েছে, তখন আর ছাড়ছি না । ব্যাঙ্গালোরে পৌঁছেই ব্যাটা সম্পাদককে ধরব । একটা লেখা নিয়ে যাচ্ছি । সেটা ছাপাতেই হবে । দারুণ স্যাটায়ার, শুনবেন ?"

    না বলাটা এক্ষেত্রে অভদ্রতা হয় । অবিশ্যি আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই শুরু করল সে ।

    "এটা তো জানেনই যে ভারতের ব্রিলিয়ান্ট লোকেদের, সৃজনশীল লোকেদের মধ্যে প্রায় সবাইকে অ্যামেরিকা নিয়ে নেয় । আইআইটি থেকে যারা বেরোয়, তাদের অধিকাংশই চলে যায় অ্যামেরিকায় । এই "ব্রেন-ড্রেন"-এ অ্যামেরিকা কতটা লাভবান হচ্ছে সেটা কখনো ভেবে দেখেছেন ? যাদের জন্ম এখানে, তৈরি হয়েছে, গড়ে উঠেছে এখানে, তারা শেষ পর্যন্ত ওদের দেশটাকে আরও উন্নত করছে । অ্যামেরিকায় এই মুহূর্তে প্রায় পঞ্চাশ হাজার ভারতীয় দারুণ গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করছে । এদের ছাড়া অ্যামেরিকার চলবেই না । অথচ অ্যামেরিকা আমাদের চোখ রাঙায়, শাসন করে, এমন ভাব দেখায় যেন সে দয়া করলে আমরা বাঁচব । শুধু আমরা কেন, সমস্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর প্রতিই ওদের এই মনোভাব । তৃতীয় বিশ্বের ব্রেনগুলোকে নিয়ে অ্যামেরিকা প্রগতির চরম সীমায় পৌঁছে যাবে । কিন্তু বিনিময়ে কিছুই দেবে না, এটা কিছুতেই চলতে পারে না । আমি তাই প্রস্তাব করেছি যে এই সমস্ত দেশগুলো অ্যামেরিকার কাছ থেকে "মগজ-কর" দাবি করুক । এই, ধরুন বাত্সরিক দশ বিলিয়ন ডলার । বেশ ভালো আইডিয়া না ?"

    আইডিয়াটা ভালো না মন্দ সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না আমি । চশমার মধ্যে দিয়ে গণপতির চোখদুটো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম । আমার ভেতরটা দেখতে চাইছে সে । এরকম দৃষ্টির সম্মুখে কি বলা উচিত সেটা আমার জানা নেই । আমতা-আমতা করে হ্যাঁ, মানে, তা তো বটেই অবধি এগিয়েছি - আমাকে থামিয়ে সে বলল "লোকে কি বলল তাতে অবিশ্যি আমার কিছু এসে যায় না । আমার কাজ আমি করেই যাব ।" একটু থেমে বলল, "আপনার কাছ থেকে একটু সাহায্য আশা করতে পারি কি ?"

    এই খেয়েছে আবার সাহায্য কিসের ।

    "আমি ! আমি আবার কিভাবে সাহায্য করব ?"

    "ব্রেন-ড্রেন" কিভাবে আটকানো যায় সে সম্পর্কে আপনার মতটা জানাবেন । আমার লেখার জন্য তাহলে আরও মসলা পাব আই-আই-এস সি'র বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক বললেন - এই এই এই - লেখাটাকে আরো জোরালো করা যাবে ।

    আই-আই-এস সি'র বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক । লোকটা দেখছি আমায় মহা ঝামেলায় ফেলল ।

    "দাঁড়ান, দাঁড়ান, বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক আবার কি । আমি তো সবে পি এইচ ডি করছি ।"

    "তাতে কি ? আজ না হোক, পাঁচ বছর, দশ বছর - একদিন তো আপনি বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হবেনই, আমি না হয় একটু আগাম লিখে দিলাম । তাছাড়া আপনার নাম তো ছাপছি না ।" আমি শুধু বলব "আই আই এস সি'র বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক । এতে আপনার আপত্তিটা কোথায় ?"

    ভেবে দেখলাম যে ব্যাপারটায় তেমন কোনো গণ্ডগোলের আশঙ্কা বোধহয় নেই, আই আই এস সি তে অসংখ্য বৈজ্ঞানিক আছেন, তাদের মধ্যে কে বলেছেন লোকে জানাবে কি করে ? এটা নিয়ে মাথাই বা ঘামাবে কজন ?

    সুতরাং আমার মতটা জানানো যেতেই পারে ।

    "হয়ত কিছুটা ক্লিশে শোনাবে, কিন্তু আমার মনে হয় দেশপ্রেম, আত্মসম্মান, এগুলোই শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় । মানে, টাকার ইয়েটা তো আপনি আটকাতে পারছেন না, না ! ওখানে টাকা সবসময়ই বেশি থাকবে । আর জোর করে কাউকে এখানে ধরে রাখাও সম্ভব নয় । মসৃণ জীবনযাত্রা, বেশি সুযোগ সুবিধে - এসবকে তুচ্ছ করতে পারে শুধুমাত্র দেশের প্রতি কর্তব্যবোধ আর বিক্রি হয়ে যাওয়া সম্পর্কে ঘৃণা । সেটা না থাকলে মনে হয় ....।

    কথাটা শেষ না করেই ছেড়ে দিলাম ।

    গণপতির মুখটা দেখেই বুঝলাম যে "সায়েন্টিস্ট" এর এরকম ম্যাড়ম্যাড়ে, একঘেয়ে কথা তাকে বেশ হতাশই করেছে । ঘাড় নেড়ে বলল । "নানা উদয়ন । ভুল বলছেন আপনি । টাকার সামনে ওসব আত্মসম্মান, দেশপ্রেম, স্রেফ উড়ে বেরিয়ে যাবে । আপনার সামনে ডলারের থলি ঝুলিয়ে যখন বলবে "নে ব্যাটা এক মিলিয়ন । চলে আয়, আরও পাবি । তখন কোথায় থাকবে আপনার দেশপ্রেম । সুগন্ধী বায়ুর মতো পশ্চাদ্দেশ দিয়ে বেরিয়ে যাবে । আর যদি আপনি সত্যি সত্যিই খ্যাপা হন, টাকার ভাণ্ডার খুলে দেওয়া সত্ত্বেও না যান, তাহলে ভাবছেন ওরা আপনাকে এখানে কিছু করতে দেবে ! কিস্যু পারবেন না । পদে পদে আটকে যাবেন । জানেন, গত দু'মাস ধরে আমার এস্টেটের কাছে একটা রাস্তা সারাতে চাইছি আমি, কিছুতেই পেরে উঠছি না । শালাগুলো কাজই শুরু করবে না । ডি এম এর কাছে যাই, কালেক্টরের কাছে যাই, জোকারগুলো বলে পয়সা নেই, এই নেই, ওই নেই । আমিও ছাড়িনি, চিফ মিনিস্টার অবধি গিয়েছি, চিঠি এনে ওদের নাকের সামনে ধরে বলেছি, এই যে বেজন্মার দল, জানো এটা কি ? তবু কিছু হয়নি । কলার ধরে ঝাঁকিয়েছি । ওরা বলেছে আমাদের কেন দোষ দিচ্ছেন ? এতে আমাদের কিছু করার নেই, চিফ মিনিস্টার বললেও কিছু হবে না, তারও বাবা আছে । বুঝতে পারছেন যে কার এত ক্ষমতা যে সি এম চাইলেও কিছু হয় না ।"

    গণপতির ভাষা ত্রক্রমেই খারাপ হচ্ছে - এন্তার ইংরেজি চার অক্ষরিয়া শব্দ ব্যবহার করে চলেছে সে । ততক্ষণে আমি বুঝে ফেলেছি যে লোকটা ঠিক সাধারণ নয়, হয়ত স্বাভাবিকও নয় । ঠিক কতটা অস্বাভাবিক সে সেটা দেখার ইচ্ছে হলো আমার । পাগলদের অবিশ্যি আমি এড়িয়েই চলি, ছোটোবেলায় একটা পাগলি আমাকে স্কুলে যাবার সময় তাড়া করেছিল । সেই স্মৃতি এখনও তাজা হয়ে আছে মনে । গণপতি যদি পাগলই হয়, তবে বেশ জ্ঞানী পাগলই বলতে হবে - খুব কম পাগলই "বিগ ব্যাং" নিয়ে ভেবে থাকে । আচ্ছা, বিগ ব্যাং নিয়ে ওর প্রশ্নটা ঠিক কি ছিল ? জিজ্ঞেস করার আগেই তো থামিয়ে দিলাম । জানতে পারলে হতো ।

    বাসের মধ্যে লোক বেশ কম । অর্ধেক সিটই খালি । লোকঅলা সিটগুলো পেছনদিকে ঢলে আছে তাদের ঘুমন্ত বোঝা নিয়ে । সত্যিই, বাসে বোধহয় একজন লোকও জেগে নেই ।

    বেশ জোরে চলছে বাসটা, একটানা বিরক্তিকর গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে । আমাদের দুজনকেই বেশ জোরে জোরে কথা বলতে হচ্ছে । গণপতি অবশ্য উত্তেজিত, সে এমনিতেই জোরে বলছে । তাও আমাকে ঝুঁকে পড়ে ওর কথা শুনতে হচ্ছে ।

    লোকটাকে "কালটিভেট" করা উচিত, লালমোহনবাবুর কায়দায় ।

    "আপনি হঠাৎ এয়ার ফোর্স ছাড়লেন কেন ?"

    উত্তর দিতে একটু সময় নিল গণপতি । বোধহয় এই হঠাৎ প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্যই ।

    "বাবা বলল বলে । দশ বছর হয়েছে তখন আমার এয়ারফোর্সে । বাবা একদিন ডেকে বলল, অনেক দেশের সেবা করেছ, এবার নিজের মাটির সেবা কর ।" আমাদের একটা কফি প্ল্যান্টেশন আছে কূর্গে । বাবার তখন বয়স হয়ে গিয়েছে, একা আর চালাতে পারছে না । এয়ারফোর্স আমাকে ছাড়তে চাইছিল না, আসলে আমি তখন কিছুটা রিসার্চও করছিলাম ।

    "রিসার্চ ।" আমি রীতিমতো বিস্মিত হলাম ।

    "হ্যাঁ, রিসার্চ । পাইলট থাকতে থাকতেই আমি প্যারালেলি পড়াশুনো করে গিয়েছি । তখন নতুন একটা এরোপ্লেনের মডেল নিয়ে রিসার্চ করছি । সেই সময়ই তো নাসা আমাকে ফেলোশিপও দিতে চাইল ।"

    "নাসা !" "সা" বলে আমার হাঁ-টা চট করে বন্ধ হলো না ।

    "হ্যাঁ নাসা । যাওয়া যখন প্রায় ঠিক-ঠাক হয়ে গেছে, তখনই বাঞ্চোত্গুলো ভিসা আটকে দিল । যেতে দিল না আমাকে ।"

    "তাহলে ?" আমি বললাম, "অ্যামেরিকা তাহলে সবাইকে নিয়ে যেতে চাইছে না বলুন ।" ওর কথার মধ্যে ফাঁক ধরেছি বলে মনে হলো আমার ।

    অবজ্ঞার একটা হাসি হেসে আমাকে উড়িয়ে দিল গণপতি । তখন কি শয়তানগুলো জানত আমার ক্ষমতা । ওরা ওদের দেশে সাধারণত্বকে কখনও ঢুকতে দেবে না । যারা অসাধারণ তাদেরই এখান থেকে নিয়ে যাবে । এটাই ওদের পলিসি । যখন বুঝল, তখন থেকে .... যাকগে, যেতে আমি পেরেছিলাম অবশ্য, তবে প্রায় বছরখানেক পরে । আমার একজন মাসি (পিসি কিংবা মামীও হতে পারে, "আন্টি" বলেছিল গণপতি) থাকেন সেখানে, মেসোমশায় ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট এল এ-র প্রফেসর । বললাম যে বেড়াতে যাব তার কাছে, হয়ে গেল ভিসা । চলে গেলাম । তারপরেই তো খেল আরম্ভ হলো ।

    "খেল মানে ?"

    "আপনি ভাবছেন কি, আমি বেড়াতে গিয়েছিলাম নাকি অ্যামেরিকায় ! আমি গিয়েছিলাম অ্যামেরিকা জয় করতে ।"

    তারপর গম্ভীর গলায় সে বলল, "আমি একজন শিল্পী ।"

    "আচ্ছা !"
    "হ্যাঁ, আমি গান গাই ।"
    "বা:, তাই নাকি !"
    "হ্যাঁ, আমি গান গেয়ে, নেচে বৃষ্টি নামাতে পারি ।"

    সুট করে আমার ভুরু দুটো ওপরে চলে গেল । মুখটা আরো সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল ।

    "কি বললেন ?"

    "বিশ্বাস হচ্ছে না !" মুচকি হাসল গণপতি । সত্যিই আমি বৃষ্টি নামাতে পারি । এয়ারফোর্স ছেড়ে দেবার পর সারা ভারত ঘুরেছিলাম । মনটা ভীষণ অশান্ত হয়ে ছিল তখন, একটা অবলম্বন খুঁজছিল । ধর্ম জিনিসটা নিয়ে কোনোদিনই মাথা ঘামাইনি, কিন্তু সেই সময় মনে হল, দেখা যাক না কি আছে ব্যাপারটার মধ্যে । এই যে সাধু, সন্ন্যাসী, পীর, ফকির - এরা ঠিক কি ধরনের মানুষ । কিছুদিন ঘুরেই অবশ্য বুঝলাম যে আগে যা ভাবতাম এদের সম্বন্ধে সেই ধারণাটা অনেকটাই ঠিক - অধিকাংশ "ধার্মিক"-ই একেবারে হাড়-হারামজাদা, বজ্জাত, জালিয়াতিতে ওস্তাদ সব চামার । একজন সন্ন্যাসীকেও খুঁজে পাচ্ছিলাম না যে কিনা সাধারণ মানুষের চাইতে একচুলও আলাদা । হাল ছেড়ে দিয়ে যখন প্রায় ঘরে ফিরব-ফিরব করছি, ঠিক তখনই উড়িষ্যায় একজনের দেখা পেলাম । তাকে অবশ্য ঠিক সন্ন্যাসী বলা যায় না । সমাজচ্যুত ঠিকই, কিন্তু ধর্ম-টর্ম নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না, নিজের মনে থাকে, ছোট্ট একটা ক্ষেতে ফসল ফলায়, আর মাঝে মধ্যে অদ্ভুত ভাবে নাচে-গায় । গাঁয়ের লোক তাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারত না । তারা অবশ্য জানত যে লোকটার নাচ-গানের ঠিক পরেই কম বেশি বৃষ্টি হয়, কিন্তু সবাই সেটাকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক একটা ঘটনা হিসেবে মেনে নিয়েছিল সে নিজেও কোনোরকম দাবি করত না । তখন আমার ব্যাপারটা খুব আশ্চর্যের লেগেছিল, এরকম একজন লোক তো গাঁয়ের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত । এখন অবশ্য বুঝি এটাই আমাদের দেশের লোকেদের স্বভাব .... যাইহোক, আমি ওর অসাধারণত্ব সহজেই অনুভব করতে পেরেছিলাম - লোকটা সত্যিই প্রকৃতির ছন্দ বুঝত । সেটাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণও সে করতে পারত । সারাক্ষণ ওর সঙ্গে লেগে থাকতাম আমি, প্রথম প্রথম আমাকে সন্দেহের চোখে দেখত, এড়িয়ে চলার চেষ্টা করত । পরে যখন বুঝল যে আমি অন্যদের মতো নই, ওর গুণ, ওর অসাধারণত্বকে আমি সম্মান দিই, তখন আমাকে নিজের সবকিছু উজাড় করে শিখিয়ে দিল । বিশেষ কিছু সুর, তার সঙ্গে তালে-তালে বিশেষ ছন্দে নাচ । কথার কোনো গুরুত্ব নেই, কিন্তু একটা ছন্দ থাকা চাই, তবে আসল হচ্ছে সুর আর তাল । গান গেয়ে আর "বৃষ্টি নাচ" নেচে মে মাসে বৃষ্টি আনিয়েছিলাম আমরা । ছোট্ট কিন্তু তীক্ষণ এক পশলা বৃষ্টি । ভেবে দেখুন সেই গানের ক্ষমতা । মে মাসে উড়িষ্যায় কস্মিনকালেও বৃষ্টি হয় না । ওকে আমার সঙ্গে নিয়ে এলাম । কিছুতেই আসতে চাইছিল না গ্রাম ছেড়ে, কিন্তু আমার মনে হলো ওর এই অসাধারণ ক্ষমতা কাজে লাগবে আমাদের দেশে - অনেক জায়গায় বৃষ্টি যে দরকার, সত্যিই দরকার । জোর করেই নিয়ে এলাম - কিন্তু খাঁচার পাখি সে নয়, পালিয়ে গেল । গ্রামেও ফেরেনি আর, কোথায় গেল কে জানে । তবে আমায় যেহেতু শিখিয়ে দিয়েছিল, আমি ঠিক করলাম সে না হোক আমি অন্তত চেষ্টা করে দেখব । সেইমতো আসরে নামলাম । কিন্তু একজন লোকও বিশ্বাস করল না আমায় । বুজরুক বলে উড়িয়ে দিল সবাই । এমনকি আমার নিজের বাড়ির লোক অবধি । অথচ আমি সফল হয়েছি, চ্যালেঞ্জ নিয়ে বৃষ্টি নামিয়েছি, সবাই বলেছে কাকতালীয়, বৃষ্টি হতোই । মজার ব্যাপারটা কি জানেন - সত্যিকারের বুজরুকদের এখানে সবাই বিশ্বাস করে, মাথায় তোলে, আর আমাকে কেউ পাত্তাও দিল না । আমি বলছি না যে "বৃষ্টি সঙ্গীত" আমি তৈরি করেছি, কিন্তু এটা অবশ্যই ঠিক যে প্রচণ্ড অধ্যবসায় দিয়ে সেটাকে আমি প্রায় আয়ত্ত করেছি, প্রতিভা না থাকলে কেউ নাচ আর গান নিখুঁতভাবে করে বৃষ্টি নামাতে পারে না । সেই লোকটা বুঝেছিল যে আমার মধ্যে আছে, তাই আমাকে শিখিয়েছিল । কিন্তু এই হতচ্ছাড়া দেশের একজনও আমাকে বিশ্বাস করল না । সেই জন্যেই আমি দেশ ছাড়লাম ।"

    আবেগে ওর গলা কাঁপছে । প্রত্যেকটি শব্দ ঠিকরে ঠিকরে বেরোচ্ছে । আমাদের আশেপাশের দু-একজন জেগে উঠেছে ওর গলার আওয়াজে । সুগত আমার আর গণপতির দিকে অবাক হয়ে একবার তাকাল । আমাকে চোখ দিয়ে বলতে চাইল, "কি বকবক করছিস এই পাগলটার সঙ্গে ? তোকে নিয়ে আর পারা গেল না ।"

    আমি তখন ঠিক করে ফেলেছি যে শেষ অবধি দেখব । গণপতি যদি পাগলও হয় । বিপজ্জনক নয় । কামড়ে-টামড়ে দেবে না । এরকম লোকের সঙ্গে চট করে কথা বলার সুযোগ পাওয়া যায় না ।

    "তারপর ?"

    "অ্যামেরিকায় লস অ্যাঞ্জেলেসে গিয়ে উঠলাম মাসির বাড়ি । মনে তখন একটাই ভাবনা -কিভাবে একটা সুযোগ পাওয়া যাবে । ভাগ্য ভালোই বলতে হবে, দেখলাম হাতের কাছেই সুযোগ । সানফ্রান্সিসকোতে তখন মাঝারি ধরনের খরা চলছে । দু-তিনমাস বৃষ্টি হয়নি । আমি স্থানীয় একটা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বললাম যে বৃষ্টি আনব । কেউ পাত্তা দিল না প্রথমে । আমি হাল ছাড়লাম না । বললাম অমুক তারিখে অমুক সময়ে আমি বীচে বৃষ্টি নাচ আর গান করব । তার ফলে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বৃষ্টি হবেই । সবকটা কাগজকে জানালাম । দিনের দিন বীচে বেশ ভিড় হলো । লোক ইণ্ডিয়া থেকে আসা "রেন-ম্যান"-কে দেখতে এসেছে । আমার গানগুলোর ইংরেজি অনুবাদ করে ফেলেছিলাম । করলাম পারফর্ম । লোকে সুর, তাল, নাচ বেশ উপভোগ করল । অনেকে তো নাচতেই শুরু করল আমার সঙ্গে । তা বলে কেউ অবশ্য ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নেয়নি । তবে পরেরদিন যখন দুঘন্টার প্রচণ্ড বৃষ্টি সানফ্রান্সিসকোকে ভাসিয়ে দিয়ে গেল আবহাওয়াবিদদের স্তম্ভিত করে দিয়ে, লোকে আর এটাকে "আ বিগ জোক" বলে উড়িয়ে দিতে পারল না । কাগজে কাগজে আমার ছবি বেরোল । স্বয়ং মেয়র আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন । এরকম প্রচণ্ড বৃষ্টি বহুকাল সানফ্রান্সিসকোতে হয়নি । রাতারাতি আমি বিখ্যাত হয়ে গেলাম । যেখানেই যাই একটা বিশাল লিমোজিন আমাকে ফলো করতে লাগল । আমি কি খাই, কি করি, কার সঙ্গে মিশি সব খুঁটিয়ে দেখা হতে লাগল । আমি অবশ্য কেয়ার করিনি, যা খুশি করে গিয়েছি । ইতিমধ্যে আরো দু-একজায়গায় ডাক পেলাম । নাচলাম, গাইলাম, সবজায়গাতেই বৃষ্টি হলো । তখন সি বিএস আমাকে ডাকল ।

    "সি বি এস !" সি বি এস অ্যামেরিকার অন্যতম নামজাদা রেকর্ড কোম্পানি ।

    হ্যাঁ, সি বি এস আমাকে ক্যাসেট, ভিডিও করতে বলল ।

    "করলেন আপনি ?"

    মুচকি হাসল গণপতি, তখনই তো লাগল । রাস্কেলগুলো বলল তোমার গানের কিছু শব্দ অশ্লীল, পাল্টাতে হবে । ভেবে দেখুন - অ্যামেরিকা । যেখানে চার-অক্ষরের শব্দ ছাড়া লোকে কথাই বলে না, সেখানে আমার গানকে বলে অশ্লীল । অবশ্য আমার গানে আমি বৃষ্টিকে কল্পনা করেছিলাম নারী হিসেবে, যাকে অনেক তোয়াজ করলে তবে সে নিজেকে সঁপে দেয় । সেটা করার সময় আমি বেশ ডায়রেক্ট হয়েছি । তার শরীরকে কিছুটা খোলামেলা ভাষায় বর্ণনা করেছি, কিন্তু সেটা প্রয়োজনের অতিরিক্ত কখনো হয়নি । আর ওই বাঞ্চোত্গুলো বলে কিনা আমি অশ্লীল, এটা কি সহ্য করা যায় নাকি ! আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চাইল ওরা ।"

    "কি করলেন তাহলে ?"

    "বলে দিলাম ওসব হবে-টবে না । ভিডিও করতে হয় তো আমার গান ঠিক যেরকম আছে সেভাবে কর, নইলে কোরো না । আমি কিসসু পাল্টাবো না । ওরা তখন আমার এজেন্টকে ধরল ।"

    "বাবা, এর মধ্যে আবার এজেন্টও জোগাড় করে ফেললেন কোথা থেকে ?"

    "সে তো জুটে যাবেই । অ্যামেরিকায় আপনি সামান্য বিখ্যাত হয়েছেন কি হননি, অমনি আপনাকে একজন এজেন্ট ধরে ফেলবে । আমারটি অবশ্য বেশ ভালো ছিল, ইতালিয়ন, সুন্দরী । চমত্কার র্যাপো তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমাদের মধ্যে ।" গণপতির চোখের সামনে বোধহয় সেই সুন্দরী এজেন্ট ভেসে উঠল, মনে হলো কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল চোখদুটো ।

    বাসটা তখন একটা শহরের মধ্যে ঢুকেছে । বেশ ঘিঞ্জি সরু রাস্তাওয়ালা শহর । নামটা দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু দোকানপাটের গায়ে কন্নড় ছাড়া আর কোনো ভাষা লেখা নেই । চলার গতি বেশ আস্তে হয়ে গেছে বাসের । তারস্বরে হর্ন দিচ্ছে । খানিকটা ঘোরার পর একটা টার্মিনাস গোছের এলো । কিছুক্ষণ বিশ্রাম এবার । বেশ কিছু লোক নামল । বোধহয় হাত পা ছড়ানোর জন্য । রাজীব আর সুগত দুজনেই উঠল । আমাকে জিজ্ঞেস করল নামব কিনা । ।

    "না:, তোরা যা, আমি জিনিসপত্তর পাহারা দিই ।"

    "আপনার বন্ধুরাও কি আই আই এস সিতে আছে ?" ওরা নামার পরে জিজ্ঞেস করল গণপতি ।

    "না:, দুজনেই কলকাতায় থাকে । কোঁকড়ানো চুল ছেলেটা লেখক, ওর নাম রাজীব, বেশ নাম-টাম করেছে ইতিমধ্যেই । আর দ্বিতীয়জন সুগত, আই আই এম-এ ম্যানেজমেন্ট করছে । তাছাড়া গান-ও গায় । বাংলা গানের ক্যাসেট আছে ওর । দুজনেই আমার পুরোনো বন্ধু । কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছে এখানে, একসঙ্গে মাদিকেরিটা ঘুরে এলাম আর কি ।"

    রাজীবের বাংলা লেখা বানান ভুলে ভর্তি থাকে । ওর মতো বাজে চিঠি লিখতে আমি কাউকে দেখিনি । জেমস বণ্ড আর হ্যাডলি চেজ ছাড়া গল্পের বই পড়ে না ।

    সুগত ম্যানেজমেন্ট পড়তে চেয়েছিল, আই আই এম-এ চান্স পায়নি । গানটা নিয়েও ওর সখ ছিল, খুব যে খারাপ গায় তা নয়, তবে মাঝে মাঝে তালে ভুল হয়ে যায় ।

    "বা: খুব ইন্টারেস্টিং বন্ধু তো আপনার । ওরা কেউ ফিজিক্স পড়েনি বোধহয় ।"

    "না, রাজীব ইংরিজীতে আর সুগত ইকনমিক্সে গ্রাজুয়েশন করেছে । সুগত তো মাস্টার্স করতে করতেই ছেড়ে আই-আই-এম-এ ঢুকল । রাজীব গ্রাজুয়েশনের পর আর পড়েনি, এখন ফুল টাইম সাহিত্য করছে ।

    সাব্জেকটগুলো বানিয়ে বলিনি ।
    গণপতি সারাক্ষণ সানগ্লাসটা পরে আছে । আমাদের কলেজে একজন প্রফেসার ছিলেন, কি একটা অসুখ ছিল বলে রোদ্দুরে তাকাতে পারতেন না । গণপতিরও কি সেরকম নাকি ? জিজ্ঞেস করব ভাবলাম কিন্তু তারপর মনে হলো অভদ্রতা হবে ।

    বাসটা হর্ন দিল কয়েকবার । একে একে উঠে পড়ল সবাই । অনেকেরই হাতে টুকটাক খাবার । সুগতও বিস্কুট কিনেছে দু প্যাকেট ।

    বাস ছাড়লে আবার আমাদের কথা শুরু হলো । গণপতির গলাটা জোরে কথা বলার ফলে ভাঙতে শুরু করেছে, বাস দাঁড়িয়ে থাকার সময় লক্ষ করেছিলাম । তাতে অবশ্য ওর ভ্রুক্ষেপ নেই । সেই একইভাবে কথা বলে যেতে লাগল ।

    "আপনার বন্ধুদের অ্যামেরিকা সম্পর্কে কি মত ? দাদাগিরি নিয়ে ওরা কি ভাবছে ?"

    "রাজীব পাক্কা কমিউনিস্ট । অ্যামেরিকাকে সহ্য করতে পারে না । তবে সুগতর অ্যামেরিকা সম্পর্কে কিছুটা ফ্যসিনেশন আছে । ম্যানেজমেন্ট করে অ্যামেরিকান কোম্পানিতেই হয়ত চাকরি পেতে পারে । তবে অবসেসড নয় ।

    "ম্যানেজমেন্ট করছে, না ! তার মানে আর একজন পোটেনশিয়াল ত্রক্রীতদাস ।"

    "হুঁ: করে হাসলাম আমি ।" তা যা বলেছেন । "একটু কেরিয়ারিস্টিক । আমি বলেছিলাম রিসার্চ লাইনে আসতে । ইকনমিক্সটা বেশ ভালোই বোঝে । কিন্তু রাজি হলো না । টাকা পয়সা রোজগার করতে চায় ।"

    "নিজের স্বাধীনতা বেচে পয়সা করাটা আমি ঘৃণা করি ।" গর্জে উঠল গণপতি । "আদ্রিয়ানা আমাকে বহুবার বলেছিল, তাও আমার গানের একটা শব্দও পাল্টাইনি । সি বি এস-এর প্রেসিডেন্টও দেখা করেছিল আমার সঙ্গে, বলেছিল তোমার গান একটা রিভিলেশন, শুধু একটু পাল্টাও, তাহলেই যা দাম চাও পাবে । ওদের মুখে লাথি মেরে চলে এসেছিলাম । আর তারপর থেকেই ...." গণপতির হাসিটা কিছুটা ক্লান্ত দেখাল । "তারপর থেকেই, বুঝলেন, আমার পিছু ছাড়েনি ওরা ।"

    "পিছু ছাড়েনি মানে ? আপনাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে নাকি ?"

    "আমার প্রতিটি গতিবিধি ওদের নখদর্পণে । ওরা চায় কোনোভাবে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে । কিন্তু আমিও ঠিক করে ফেলেছি মরে গেলেও আর ওদের হাতে ধরা দেব না । কিছুতেই অ্যামেরিকায় নিজেকে বেচব না । একবার গিয়েছি, ওদের দেখিয়ে দিয়েছি আমি কি, ব্যস । এবার মরুক ওরা এই ভেবে যে এই প্রতিভাটির নাগাল পাবে না ওরা । কিন্তু মুশকিল হলো .... "

    "কি, কিসের মুশকিল ?"

    "মুশকিল হচ্ছে এই দেশ, এই দেশের মানুষ, যারা এখনও আমাকে স্বীকার করে না, আমার গুণকে মানে না, আমার শিল্পকে মানে না । এখনও এদের বোঝাতে পারলাম না যে প্রকৃতির হৃত্পিণ্ডের ধ্বকধ্বকানি শুনতে পাই আমি, আমার গানে আদিম প্রকৃতির প্রকাশ । সেই জন্যই আমি বৃষ্টিকে আনাতে পারি । আর ওরা বলে আমার গান নাকি অপসংস্কৃতি ! শালা বেজন্মার দল । কেন প্রতিভাবানরা এদেশ থেকে চলে যাবে না বলুন ? যে দেশ গরীব, সে দেশ কিভাবে নিজেদের প্রতিভাদের আটকে রাখতে পারে জানেন ?"

    আমার ইচ্ছে করছিল সানগ্লাসটা খুলে নিয়ে ওর চোখদুটো ভালো করে দেখতে, ঠিক কতটা আগুন ঝরছে সেখান থেকে । তবে কপালের শিরা ফুলে উঠছে, নাকের পাটা থরথর করে কাঁপছে ।

    "কিভাবে ?"

    "সম্মান দেখিয়ে । সমস্ত সাধারণদের মধ্যে হুকুম জারি করতে হবে যে তোমার সামনে কোনো প্রতিভাবানকে দেখলেই তুমি মাথা নীচু করে শ্রদ্ধা জানাবে, আগেকার দিনে লোকে ব্রাহ্মণদের যেরকম করত, সেরকম । কাস্ট সিস্টেমের ভীষণ প্রয়োজন, তবে জন্মের বিচারে নয়, প্রতিভার বিচারে । প্রতিভার ক্ষেত্রে যারা সত্যিকারের ব্রাহ্মণ, একমাত্র তারাই টাকা পয়সার টানকে অস্বীকার করে দেশে থেকে যাবে । অ্যামেরিকা যতই দাদাগিরি ফলাক, প্রতিভার যোগ্য দাম আর সম্মান সে দেয় । এ দেশ দামও দেয় না, শ্রদ্ধাও করে না, তাহলে কেন, কোন দু:খে প্রতিভারা এখানে পড়ে থাকবে?"

    ঘাড় নাড়লাম আমি, ওর কথায় তাল ঠেকিয়ে যাওয়াই এখন আমার কাজ ।

    "এখানে ফিরে আসার পর ব্যাঙ্গালোরের বাড়িতে উঠেছিলাম । সপ্তাখানেক পর থেকে দেখি আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে একটা লিমোজিন দাঁড়িয়ে আছে । অ্যামেরিকায় থাকতে যেটা আমায় ফলো করত, ঠিক সেইরকম একটা । দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকত সেই লিমোজিন । আমাকে লোভ দেখাত । জানতাম যে আমি গিয়ে দরজা খুলে উঠে পড়লেই ওটা ছেড়ে দেবে । আমাকে ওরা বলতে চেয়েছিল যে দ্যাখো হে, গাড়িটা তোমার - এইরকম হাজার-হাজার গাড়ি তোমাকে দিতে পারি - তুমি শুধু আমাদের হয়ে যাও । গাড়িটার সামনে দিয়ে আমি পায়ে হেঁটে যেতাম, সবসময় ড্রাইভারের চোখের সামনে থুতু ফেলতাম । মাসখানেক এইরকম করল, তারপর যখন দেখল যে আমি কিছুতেই সাড়া দেব না, গাড়ি আসা বন্ধ হয়ে গেল । তারপরে, ওফ! তারপরে যেটা করল সেটা অসাধারণ, স্রেফ অবিশ্বাস্য ...."

    আমি আবার একটু সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লাম ।

    "অ্যামেরিকায় শেষের দিকে আমি বেশ উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়েছিলাম । মদ খেতাম, মেয়ে-বাজি করতাম - আসলে ওরা নজরদারি করত বলে আরো রোখ চেপে গিয়েছিল বলতে পারেন । মনে হতো আমার ইচ্ছে মতো আমি যা খুশি করব, ওদের কি ! এখানে এসে কাজের অভাবে আবার ওই দোষগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠল । ব্রিগেড রোড চেনেন তো ?"

    ব্রিগেড রোডকে ব্যাঙ্গালোরের পার্ক স্ট্রীট বলা যেতে পারে । বিশাল বিশাল দোকানের সম্ভারে অবশ্য পার্ক স্ট্রীটকে ছাড়িয়ে যাবে, তবে রাস্তাটা বেশ সরু । ব্যাঙ্গালোরের প্রচুর ছেলে-মেয়ের উইকএণ্ডের একমাত্র পাসটাইম হলো ব্রিগেড রোডে ঘুরে বেড়ানো, আমরাও করেছি দু'একবার ।

    "ব্যাঙ্গালোরে থেকে ব্রিগেড রোড চিনব না ?"

    "নাসা বলে সেখানে একটা বার আছে জানেন ?"

    বার ওখানে গাদাখানেক আছে । গোটা ব্যাঙ্গালোর শহরেই বার ভর্তি । এত খোলাখুলি মদ খাওয়া ভারতের অন্য কোনো শহরে হয় বলে মনে হয় না । তবে "নাসা" বলে কোনো বার মনে পড়ছে না ।

    "যাইহোক, নাসা বলে একটা ব্রিগেড রোডে আছে । অদ্ভুত বার, ওয়েটাররা সেখানে অ্যাস্ট্রোনটদের মতো পোষাকে পরিবেশন করে । তো নাসায় আমি এক সন্ধেবেলায় গিয়ে প্রচুর নাচ-গান ফুর্তি করেছিলাম । বাড়ি ফিরেছিলাম পরের দিন ভোরে । তারপর দুপুরবেলা, কিছু করার নেই, বাড়িতে বসে বসে ইউ জি-সি'র প্রোগ্রাম দেখছি । বেশ ভালোই হচ্ছে । ফিজিক্সের একটা কি নিয়ে, বোধহয় নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেসোনেন্স সম্পর্কিত কিছু দেখাচ্ছে । হঠাৎ প্রোগ্রাম থামিয়ে এক সুন্দরী ঘোষিকা বললেন "আমাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আছে ।" তারপর যা দেখাল, আপনি ভাবতে পারবেন না !"

    ইউ জি-সি'র প্রোগ্রামের মাঝখানে রোমহর্ষক কি দেখাতে পারে সেটা সত্যিই আমি ভাবতে পারলাম না ।

    "একজন অ্যাস্ট্রোনটকে দেখাল, মহাশূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে । তারপরেই চলে এল সমুদ্রের দৃশ্য, একটি সাদা পাখি খোলা সমুদ্রের ওপর উড়ে যাচ্ছে । উড়ছে, উড়ছে বেশ কিছুক্ষণ উড়ল পাখিটা । ব্যাকগ্রাউণ্ডে সুন্দর মিউজিকের সঙ্গে, তারপর হঠাৎ কি হল, নীচে নামতে থাকল সে, নামতে নামতে ঝপাং করে জলে পড়ে গেল । স্ক্রীনে লেখা ফুটে উঠল `ইফ ইয়ু ডোন্ট টেক কেয়ার, ইয়ু উইল লুজ এভরিথিং ।' বুঝলেন ব্যাপারটা?"

    অস্বীকার করব না যে এ ধরনের আঁতেল ব্যাপার-স্যাপার আমার মাথায় কিছুমাত্র ঢুকল না । অবাক ভাবটা মুখে ফুটে উঠেছিল নিশ্চয়ই, গণপতি এরকম মোটাবুদ্ধির সায়েন্টিস্ট দেখে বেশ হতাশ হয়েছে মনে হলো ।

    "অ্যাস্ট্রোনট মানে কি ? নাসা, ওরা জানে যে গতরাত্তিরে আমি নাসায় গিয়েছিলাম । সমুদ্রের ওপর দিয়ে মুক্ত পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে । সেটা কে ? আমি, খোলা আকাশে উড়ে যাচ্ছি, অর্থাৎ যা খুশি করছি । তারপর জলে পড়ে গেলাম, তার অর্থ এভাবে নিজের ইচ্ছে মতো বেহিসেবির মতো কাজ করলে, বেশি স্বাধীনচেতা হয়ে যা তা করে বেড়ালে, আমার পরিণতি হবে ধ্বংস । আমার শিল্পী সত্ত্বা, আর বৃষ্টি আনার ক্ষমতা, মানে যার জন্যে আমাকে ওদের দরকার, সেটা আমি নিজেই শেষ করে ফেলছি আস্তে আস্তে । সেটা ওরা কিছুতেই হতে দিতে চায় না । সেই জন্যেই এত কাণ্ড । কিন্তু পয়েন্টটা হচ্ছে ওদের ক্ষমতার রেঞ্জ, জাস্ট অভাবনীয় !"

    ইউ জি-সি'র প্রোগ্রাম থামিয়ে অ্যামেরিকা গণপতিকে সাবধান করে দিচ্ছে, কথাটা ভাবতে গিয়ে আমার হাসি পেয়ে গেল, কিন্তু এখানে হাসা একেবারে চলে না, লোকটার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এটা ।

    "হ্যাঁ, সত্যিই ভাবা যায় না ।"

    "আমার সমস্ত চাল-চলন ওদের জানা । মায় আমি যে তখন টিভিতে ইউজিসি দেখছি, তাও ওরা জানে । আমার সঙ্গে তখন মা-ও দেখছিল, অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল "এটা কি দেখাল রে ?' আমি কিছু বলিনি, বললে মা ভয় পেয়ে যেত খুব । কিন্তু সেদিন থেকে আমি সাবধান হয়ে গেলাম । আমার সংকল্পও দ্বিগুণ হলো, কিছুতেই ওদের হাতে ধরা দেব না । এর পরে আরও প্রমাণ পেয়েছি যে আমাকে ওরা চোখে চোখে রাখছে, একের পর এক প্রলোভন দেখিয়েছে, কিন্তু আমি ওদের সঙ্গে লড়ব, কিছুতেই ওদের এই মাস্তানি মেনে নেব না ।"

    আমার তখন এরকম আরও কিছু অসাধারণ ঘটনা শুনতে ইচ্ছে করছে, জিজ্ঞেস করলাম, "আর কি প্রমাণ পেলেন ?"

    গণপতি বলল "অনেক, অনেক, তার মধ্যে একটা বলছি, শুনলেই বুঝবেন কোথায় ওরা পৌঁছতে পারে । সেদিন ব্রিটিশ কাউন্সিলে একটা সাংবাদিক সম্মেলন হচ্ছে । উদ্দেশ্য এখানকার এমব্যাসির নতুন সাংস্কৃতিক অফিসারের সঙ্গে লোকের পরিচয় করিয়ে দেওয়া । আমার কাছে একটা কার্ড ছিল । গেছিলাম । তবে যেতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল । যখন পৌঁছলাম তখন সেই অফিসার বক্তৃতা দিচ্ছে, বোধহয় বিবিসি'র প্রসঙ্গে । বিবিসি ভারতে কি কি কভার করে তা নিয়ে । খেলাধূলো অবধি পৌঁছেছিল, আমি যাওয়া মাত্রই একটা লোক উঠে গিয়ে ওর কানে-কানে কিছু বলল, সঙ্গে-সঙ্গে ওই বাঞ্চোত্টা আমার দিকে তাকিয়ে - একেবারে শেষ সারিতে বসেছিলাম আমি - বলল "উই অলসো রিপোর্ট দ্য ডেথ অফ চার্লি চ্যাপলিনস ।' ঘর ভর্তি লোক কেউ কিছু বুঝল না, আমি ছাড়া । কি সাহস দেখুন, সবার সামনে ওরকম একটা কথা ওকে দিয়ে বলাল, স্রেফ আমাকে শোনাবে বলে । সবাই ওদের কেনা ।"

    আমার মনে হলো বলি তাহলে তো আপনি জাতে উঠে গেলেন মোয়াই, একেবারে চার্লি চ্যাপলিনের সঙ্গে আপনাকে তুলনা করে দিল । কি-না কি প্রতিক্রিয়া হবে ভেবে ভাবনার স্তরেই ইচ্ছেটা রেখে দিলাম ।

    মুখে বললাম "আপনাকে তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না তাহলে ওরা ।"

    ম্লান ভাবে হাসল গণপতি । "প্রাণপণ চেষ্টা করছে কাবু করে ফেলার । কিন্তু আমার জেদও বেড়ে যাচ্ছে, আরো । শুধু দেশের লোকের একটু সাহায্য - কিন্তু সাহায্য যে একদম পাব না তা নয় । কূর্গের প্রাইমারি স্কুলগুলোয় লেকচার দিয়ে এলাম কিছুদিন আগে । বাচ্চাগুলোকে জানালাম অ্যামেরিকার আগ্রাসনের কথা, ওদের মত জানতে চাইলাম, আপনি ভাবতে পারবেন না কি পরিণত মত ওদের । আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি ফাইভ-সিক্সের ছেলেমেয়েদের কথা শুনে । আমার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছে ওরা ।

    "বাচ্চাদের আত্মসম্মানজ্ঞান অনেক সময়ই বড়োদের চাইতে বেশি হয় ।

    "তা যা বলেছেন উদয়ন । ওরাই তো আমাদের আশা । ওদের ঠিক করে তৈরি করতে হবে ।"

    ব্যাঙ্গালোরের সীমানায় চলে এসেছি আমরা । আর বোধহয় আধঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাব বাস স্টেশনে ।

    গণপতির কথা বোধহয় শেষ হয়ে গেল । আমাকে কিছুটা বিদায়ী মার্কা ঘাড় নেড়ে উঠে জানালার দিকে চলে গেল সে । আমিও আমার জানলার দিকে চলে গেলাম ।

    পাঁচটা বেজে গেছে, আলোর রঙ সোনালি থেকে কমলা হতে শুরু করেছে । সূর্যের দিকে অবশ্য এখনো ভালো করে তাকনো যাচ্ছে না । আর মিনিট দশেক পরেই যাবে । আকাশে কিছু ছড়ানো-ছেটানো মেঘ আছে । বেশ জম্পেশ একখানা সূর্যাস্ত হবে বোঝা যাচ্ছে । মেঘগুলোর গায়ে তখন বিভিন্ন রঙ দেখা যাবে, হালকা সবুজ থেকে আরম্ভ করে বেগুনি ।

    ব্যাঙ্গালোরের সূর্যাস্তগুলো ভারি সুন্দর হয় ।

    সুগত পেছন ফিরে বলল "কি আরম্ভ করেছিলি বল তো । বদ্ধ একটা পাগলের সঙ্গে অতক্ষণ বকরবকর । সমস্ত বাসের লোক তাকাচ্ছিল আর হাসছিল ।"

    লোকজন যে তাকাচ্ছে সেটা আমি বুঝছিলাম । বললাম, "লোকটা কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং ।"

    "রাখ তোর ইন্টারেস্টিং, আস্ত পাগল শালা ।"

    ব্যাঙ্গালোর এসে গেছে । দোকানপাটে ইংরেজি ।

    "উদয়ন !"

    ফিরে তাকালাম ।

    আবার পাশের সিটে ফিরে এসেছে গণপতি । "আপনার মতটা জানালেন না তো অ্যামেরিকা সম্পর্কে । আমি লিখতাম ।"

    "বললাম যে, ওইটাই আমার মত ।"

    "মানে ওই আত্মসম্মানের ব্যাপারটা । একদিক দিয়ে দেখলে অবশ্য সেটা একটা প্রতিরোধের অস্ত্রই বটে । আত্মসম্মানের চেয়ে বড়ো আর কি আছে মানুষের ।"

    বুঝলাম না সে সত্যিই সন্তুষ্ট হলো কিনা । তার এতক্ষণকার কথা অনুযায়ী সে নিজে যে অ্যামেরিকার যাবতীয় প্রলোভন ওই বস্তুটি দিয়েই তুচ্ছ করছে তা আর মনে করিয়ে দিলাম না । তবে তার লেখাকে জোরালো করার জন্যে হয়ত দারুণ কোনো আইডিয়া দেওয়া উচিত ছিল আমার, কিন্তু কি করব, এ বিষয়ে যে সত্যিই অনেক ভেবে কিছু বার করতে পারিনি ।

    ব্যাঙ্গালোরের টার্মিনাসে যখন বাসটা ঢুকল তখন সূর্যটা একটা কমলালেবু লজেন্সের মতো গোল । টপ করে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে ।

    সবাই উঠে পড়েছে সিট ছেড়ে । সামনের কিছু লোকের গাদাগাদা মাল, তারা এক-এক করে সেগুলো নামাতে লাগল ।

    গণপতির একটা মাত্র সাইড ব্যাগ । সে এগিয়ে গিয়ে টুক করে কোন ফাঁকে নেমে পড়েছে ।

    আমি তখন সিটের তলা থেকে স্যাক বার করছি । কিছু না বলেই চলে গেল গণপতি আমার একটু অবাকই লাগল ।

    সে নেমে যাওয়া মাত্রই বাসের দু'তিনজন আমার দিকে চেয়ে সহানুভূতির হাসি হাসতে লাগল ।

    "আপনার ধৈর্য আছে বটে, আমি হলে তো নিজেই পাগল হয়ে যেতাম ।" একজন বলল ।

    রাজীব বলল "ওকে বকে যেতে দিলি কেন বল তো ?"

    আমি সবার দিকে চেয়ে হাসলাম একবার । কি বোঝাতে চাইলাম কে জানে ।

    "উদয়ন ।"

    জানালার ঠিক তলায় এসে দাঁড়িয়েছে গণপতি । বুড়ো আঙুল তুলে বলল "আমরা সফল হবই দেখো । অ্যামেরিকা আমাদের হারাতে পারবে না । তুমি তোমার মতো লড়ো । আমি আমার মতো ।" কথাগুলো বলে একবার মাথাটা ঝুঁকিয়ে সে হাঁটা আরম্ভ করল ।

    ইংরিজী "ইয়ু" বাংলার তিনটে সম্বোধনের যে কোনো একটা হতে পারে, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে গণপতির এই শেষ "ইয়ু" বাংলার "তুমি"।

    সমাজের চোখে একজন পাগল আমার সঙ্গে তিনঘন্টার আলাপে "আপনি" থেকে "তুমি"তে নেমে এল, এটা একটা ঘটনা বটে ।

    দূরে ভিড়ের মধ্যে গণপতিকে দেখতে পেলাম । মাথায় সেই বেসবল ক্যাপ, জিনস । জ্যাকেট - আপাদমস্তক মার্কিন পোষাক । কূর্গের কফি এস্টেটের মালিক, বিশাল পয়সা নিশ্চই । কিন্তু নাচ-গান করে বৃষ্টি নামায় । আবার মার্কিনদের সঙ্গে একাহাতে যুদ্ধও করে চলেছে ।

    কিংবা আমিই এক রাম পাঁঠা, সম্পূর্ণ ছিটগ্রস্ত এক মানুষ যাকে তিনঘন্টা ধরে যা খুশি বুঝিয়েছে ।

    সূর্যটাকে আর দেখা যাচ্ছে না ।

    গণপতি একবার ফিরে তাকাল । দেখলাম সানগ্লাসটা খুলে ফেলেছে সে ।


  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments