রাশিয়া থেকে অবিশ্বাস্য রকমের কম দামে আসতো ছবি-ছড়া-গল্প-রূপকথার বইপত্র ; প্রকাশক প্রগতি প্রকাশন, জুবোভস্কি বুলভার, মস্কো ; অনুবাদ করতেন বাংলার ডাকসাইটে লেখক-কবিরা - সমর/ননী/সুভাষ/কামাক্ষীপ্রসাদ - দুয়েকটি নাম এই মধ্য বয়েসেও স্মৃতিতে উজ্জ্বল - "ইউক্রেনের রূপকথা", "হলদে ঝুঁটি মোরগটি"- "জানলা দিয়ে মুখ বাড়াও/মটরশুঁটি নিয়ে যাও" ধরনের পংক্তি আমাদের মুখে মুখে ফিরতো তখন । কলকাতায় "মনীষা" এবং মেদিনীপুরে "অন্বেষা" নামক গ্রন্থালয় দুটি রঙিন হয়ে থাকতো সেই গ্রন্থসম্ভারে ।
একেবারে কচিকাঁচাদের জন্যে ছিলেন সুকুমার, উপেন্দ্রকিশোর, দক্ষিণারঞ্জন, যোগীন্দ্রনাথ । সেই ধাপ পেরুলে হেমেন্দ্রকুমার রায় - জয়ন্ত, মানিক, সুন্দরবাবু; নীহাররঞ্জন গুপ্ত - কিরীটি, সুব্রত ; শিবরাম চক্রবর্তী - হর্ষবর্ধন, গোবর্ধন ; লীলা মজুমদার থেকে শুরু করে সুখলতা রাও । আরেকটু বয়েস বাড়লে টেনিদা, ঘনাদা, প্রফেসার শংকু; "চাঁদের পাহাড়ে"র বিভূতিভূষণ, "মাঝির ছেলে"র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়; বুদ্ধদেব বসুর "ছায়া কালো কালো"; সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের "চালিয়াৎ চন্দর", "মা কালীর খাঁড়া" । বিদেশি সম্ভারেরও কমতি ছিল না - অশোক গুহর ভাবানুবাদে শেক্সপিঅর; সুধীন্দ্রনাথ রাহা অনুবাদ করতেন নামী লেখকদের রচনা - ডিকেনস, স্টিভেনসন, ডুমা, স্কট ; কুলদারঞ্জন রায় ও অদ্রীশ বর্ধনের অনুবাদে জুল ভার্ন । এইসব সাহিত্যসম্ভারের এক বিশেষ কেন্দ্রস্থলে বিরাজ করত "সন্দেশ", আমোদ ও শিক্ষার ভেতর এক নিখুঁত ও সাবলীল ভারসাম্য রেখে; তার হই চই ও শোরগোলের মধ্যেও মিশে থাকত নিবিড় মনস্কতা, প্রসার পেত মনের দিগন্ত ।
নতুন পর্যায়ের সন্দেশ মাসিকপত্রের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় রবীন্দ্র শতবর্ষে - ১৩৬৮ সনের বৈশাখ মাসে । দুটি কথা মনে পড়ছে এই প্রসংগে : এক, সাপ্তাহিক পত্রিকা "অমৃতে"রও প্রকাশ শুরু হয়েছিল এই একই মাসে এবং পরবর্তী কয়েক দশক বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল কাগজটি । দুই, সদ্যপ্রয়াত নগ্নপদ ঐতিহাসিক তারাপদ সাঁতরার একটি নিবন্ধে পড়েছিলাম যে পঞ্চাশের দশকে হাওড়ার শিল্পাঞ্চলে তিনি একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, নাম `সন্দেশ', খুব সম্ভবত একটি বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নের মুখপত্র । ষাটের দশকের প্রথমে যখন সত্যজিৎ রায় ও অন্যেরা সন্দেশ প্রকাশের তোড়জোড় করছেন, তখন বিনামেঘে বজ্রপাতের মতন সরকারি প্রেস রেজিস্ট্রার তাঁদের প্রকাশের অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন, কারণ একই নামে আরেকটি পত্রিকা বর্তমান । তারাপদবাবু সেই খবর পেয়ে সরকারকে চিঠি লিখে জানান যে তাঁর পত্রিকাটি অধুনাবিলুপ্ত এবং ওই নামটির ওপর তাঁর কোনো দাবি নেই; এর ফলেই সম্ভব হয় সন্দেশের ঐতিহাসিক পুন:প্রকাশ ।
সন্দেশের প্রথম শুরু ১৩২০ সালের ১লা বৈশাখ অর্থাৎ এপ্রিল ১৯১৩ । এর ঠিক এক বছর আগে উত্তর অতলান্তিক মহাসাগরে ডুবে গিয়েছিল টাইটানিক জাহাজ । আর ঠিক সাত মাস পরে নোবেল পুরস্কার পেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সম্পাদনায় সন্দেশের প্রথম প্রকাশ - তাঁর নিজের ছাপাখানায়, সম্পূর্ণ নিজের খরচে ; পত্রিকাটির দাম তিন আনা হলেও সুন্দর কাগজ, ঝলমলে মলাট, ভেতরে সাদা-কালো ও রঙিন ছবির সমাহার । প্রথম সংখ্যার উপেন্দ্রকিশোর রচিত ভূমিকাটি এই সংকলনে গ্রন্থিত হয়েছে ; তিনি লিখেছেন, "... আমরা যে সন্দেশ খাই তার দুটি গুণ আছে । উহা খাইতে ভাল লাগে আর উহাতে শরীরে বল হয় । আমাদের এই যে পত্রিকাখানি `সন্দেশ' নাম লইয়া সকলের নিকট উপস্থিত হইতেছে, ইহাতেও যদি এই দুটি গুণ থাকে - অর্থাৎ ইহা পড়িয়া যদি সকলের ভাল লাগে আর কিছু উপকার হয়, তবেই ইহার সন্দেশ নাম সার্থক হইবে ।" সন্দেশের আগে আরও দুটি ছোটদের পত্রিকা বেরিয়েছিল - প্রথমে "সখা ও সখী" - খুব সম্ভবত বাংলা ভাষায় প্রথম শিশু পত্রিকা এবং তার কয়েক বছর পরে `মুকুল' । দুটিরই প্রধান উদ্যোক্তা উপেন্দ্রকিশোর এবং লেখকদের তালিকার পুরোভাগে তিনি ও তাঁর পরিবারের অন্যান্যেরা । আমাদের দেশে তখন ছবির ব্লক তৈরি করা ও ছাপানোর কোনো ব্যবস্থাই ছিল না বলতে গেলে । তিনি নিজে এই সব প্রযুক্তি শিক্ষা করলেন এবং নিজের ছাপাখানায় হাফ টোন, ব্লক প্রিন্টিং এর ব্যবস্থা করলেন - শুধু দেশে নয়, বিলেতেও ইউ রায় অ্যাণ্ড সন্স-এর ছাপা বইপত্র অকুন্ঠ প্রশংসা ও সমাদর পেয়েছিল ।
এইভাবে শিশুসাহিত্যে শুরু হল এক নতুন যুগের । সন্দেশে তখন লিখছেন উপেন্দ্রকিশোর, রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ এবং তখনকার সব বড় বড় লেখকেরা । আর কমবয়েসিরাও প্রতিভায় কিছু কম যান না - ১৩২১ সালের একটি সংখ্যায় বেরুল প্রবাদ প্রতিম কবিতা "খিচুড়ি", লেখক সুকুমার রায় -
"হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না)শুরু হল `আবোল তাবোল' সিরিজের প্রথম উদ্ভট কবিতা - আজগুবি, জমকালো, নির্মল হাসির, বিরামহীন আনন্দের । কিন্তু ১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মৃত্যু হল উপেন্দ্রকিশোরের এবং আঠাশ বছর বয়েসি সুকুমার সম্পাদক হলেন আড়াই বছর বয়েসি `সন্দেশ' পত্রিকার । ১৯২১ সাল পর্যন্ত চললো সন্দেশের স্বর্ণযুগ, তারপর কালাজ্বরে আক্রান্ত হলেন সুকুমার । অসুস্থতার মধ্যেই তিনি চালিয়ে গেলেন সন্দেশের সম্পাদনা, কিন্তু ১৯২৩ সালে তাঁর মৃত্যুর পর বন্ধ হয়ে গেল সন্দেশ । কিছুদিন পরে সুকুমারের মেজভাই সুবিনয় রায়ের সম্পাদনায় আবার শুরু হল তার এবং অনিয়মিত ভাবে হলেও চললো ১৩৪২ সাল পর্যন্ত । তারপর একেবারেই বন্ধ ।
হয়ে গেল হাঁসজারু কেমনে তা জানি না ।"
পঁচিশ বছর কাটলো । মা সুপ্রভা রায়ের ইচ্ছেপালনে ও অনুপ্রেরণায় আবার "সন্দেশ" প্রকাশের তোড়জোড় করলেন সত্যজিত্, তাঁর সঙ্গে ছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ; প্রথম সংখ্যা বেরুলো মে ১৯৬১, ভুমিকা লিখলেন উপেন্দ্রকিশোরের মেজ মেয়ে পুণ্যলতা চক্রবতী - "এতদিন পরে সন্দেশ আবার এসেছে - কত আশা আর আনন্দের সঙ্গে তাকে আদরে বরণ করছি । আবার সন্দেশ ঘরে ঘরে নির্মল হাসি আর আনন্দের ভাণ্ডার খুলে দিক, হাসি ও আনন্দের মধ্যে দিয়ে ছেলেমেয়েদের জ্ঞানবুদ্ধি ফুটিয়ে তুলুক, তাদের মনের সুকুমার বৃত্তিগুলি বিকশিত করে দিক । সন্দেশের নবজন্ম সার্থক !" প্রথম দিকে নতুন সন্দেশের সম্পাদক ছিলেন সত্যজিৎ ও সুভাষ; দুবছর পরে সম্পাদকের দলে যোগ দিলেন লীলা মজুমদার ; এরও কিছুদিন পরে যোগ দিলেন পুণ্যলতা চক্রবর্তীর মেয়ে নলিনী দাশ এবং তাঁর স্বামী অশোকানন্দ দাশ হলেন মাসিক সন্দেশের প্রকাশক । আলোচ্য গ্রন্থটি সন্দেশ পত্রিকার প্রথম কুড়ি বছরের প্রকাশিত লেখা ও ছবি থেকে "বেছে নিয়ে, ছেঁকে নিয়ে" বের করা এক নির্বাচিত সংকলন । লেখা বাছাই করার দায়িত্বে ছিলেন তিনজনেই - লীলা, নলিনী ও সত্যজিৎ ; সম্পাদনা ও অঙ্গসজ্জার ভার নিয়েছেন সত্যজিৎ । ভূমিকা লিখে দিয়েছেন লীলা মজুমদার, জানিয়েছেন - "ছোটদের দেখাতে চাই এই জীবনটা কত ভালো । জানাতে চাই ব্রহ্মাণ্ডের কোথায় কি ঘটেছে, ঘটছে, ঘটতে যাচ্ছে । মানুষের মত মানুষ দেখাতে চাই । এমন মানুষ যাদের সাহস আছে, যারা ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলে । যারা দলাদলির বাইরে; যারা ঘৃণা করে শুধু মিথ্যাকে নিষ্ঠুরতাকে আর কুঁড়েমিকে । বাদ দেয় যত রাজ্যের ন্যাকামি আর ঢং । যারা বিশ্ব প্রকৃতিকে তার ন্যায্য জায়গা দিতে প্রস্তুত । যাদের মন উদার । এত সবের সঙ্গে আমরা পাঠকদের খুশিও করতে চাই । খুশি করতে না পারলে আমাদের সব চেষ্টাই বৃথা ।" না, কোনোমতেই বৃথা নয়, মোটা সোটা, নাদুস নুদুস, রঙচঙে বইটি হাতে নিলেই অপার খুশি আর অনাবিল আনন্দে ভরে উঠবে যে কোনো বয়েসের শিশুর মন । এর প্রমাণ, সতেরো বছরে দশ দশটি মুদ্রণ এবং মুদ্রণ সংখ্যা প্রায় পঞ্চান্ন হাজার । সন্দেশের জয় হোক !
বাংলা শিশুসাহিত্যে নারীচরিত্রের সর্বকালীন খরা ; রূপকথায় সুয়োরানীরা বছর বছর সন্তান বিইয়ে যান, বেশিরভাগই পুত্রসন্তান - আর দুয়োরানীকে উপরে কাঁটা, নিচে কাঁটা সমেত নির্বিবাদে মেরে ফেলার পরও কোনো শাস্তি হয় না অপরাধীদের । অরুণ বরুণ ও কিরণমালার কাহিনীতে - "অরুণ বরুণ দুই ভাইয়ে পড়ে, শোনে ; ফল পাকিলে ফল পাড়ে ; বনের হরিণ দৌড়ে ধরে", আর "কিরণমালা বাড়ীতে কূটাটুকু পড়িতে দেয় না ; কাজললতা গাইয়ের গায়ে মাছিটি বসিতে দেয় না ।" (ঠাকুরমার ঝুলি, মিত্র ও ঘোষ) অবস্থাটা শোধরানোর কিছুটা চেষ্টা হল সন্দেশে, বেথুন কলেজের প্রিন্সিপাল এবং সন্দেশের অন্যতম সম্পাদক নলিনী দাশের কলমে - তাঁর গোয়েন্দাকাহিনীর প্রধান চরিত্র চারটি কিশোরী - কালু, মালু, বুলু ও টুলু, অর্থাৎ "গোয়েন্দা গণ্ডালু"। মালুর ভেতরে উদাস উদাস ভাব, "হাতে খাতা পেনসিল ধরিয়ে দিলেই কবিতা লিখে ফেলবে গোটা কতক ।" কালু বেরসিক, ডাকাবুকো, নির্ভয়; বুলু খানিকটা ভীতু, অল্পেতেই মুখে কাঁদো কাঁদো এসে যায় ; টুলু কাহিনীর কথক । চারজনে একই স্কুলে পড়ে, থাকে হস্টেলে, বেড়াতে যায় নানা জায়গায় আর জড়িয়ে পড়ে অ্যাডভেঞ্চারে । বর্তমান গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে "গণ্ডালু ও হিড়িম্বাদেবীর রহস্য", (পৃষ্ঠা ২০০) একটু পরের দিকের রচনা - সন্দেশে প্রকাশ ১৩৮৬ তে ।
১৯৭০ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সন্দেশে নিয়মিত লিখেছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ; মহারাষ্ট্র-প্রবাসী এই লেখকের একটি প্রধান চরিত্র সদাশিব, অল্পবয়েসি ছেলে - তখনো গোঁফ গজায়নি, সে শিবাজীর সেনাদলে যোগ দেয় খুব কম বয়েসে এবং সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিয়ে দলনেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে । সদাশিবের প্রেমিকার নাম কুঙ্কু - তাকে নিয়ে সে নিজের গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছিল এবং কুঙ্কুকে আশ্রয় দিয়েছিলেন শিবাজী-জননী জিজাবাই । শরদিন্দুর জীবনের প্রায় অর্ধেকটাই কেটেছে মহারাষ্ট্রে, ১৯৫২ সাল থেকে তিনি স্থায়ীভাবে পুনেনিবাসী - মহারাষ্ট্রের ইতিহাস ও ভূগোল তাঁর নখদর্পØংএণ । সদাশিবের গল্পগুলিতে সঠিক ঐতিহাসিক তথ্য, স্বদেশপ্রেম ও অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গে রয়েছে লেখকের অর্ন্তদৃষ্টি, ভাষার সজীবতা ও তুলনাবিহীন রসবোধ; দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা তাঁর চিত্রনাট্য লেখার - অল্পকথায় ফুটিয়ে তোলেন রুক্ষ, পাহাড়ি সপ্তদশ শতাব্দীর মারাঠা প্রদেশের জ্যান্ত শব্দচিত্র । আর সঙ্গে তো রয়েছেই সত্যজিতের আঁকা ছবি । "সদাশিবের ঘোড়া-ঘোড়া কাণ্ড"(পৃষ্ঠা ২৩) কাহিনীটি এই গ্রন্থের এক মূল্যবান সংযোজন ।
রয়েছে একটি ফেলুদা গোয়েন্দাকাহিনী, ১৩৮৭র সন্দেশে প্রকাশিত "গোলোকধাম রহস্য" (পৃষ্ঠা ৩৫০) - কলকাতার পটভূমিকায় গল্প ; ভ্রমণ নেই বলেই বোধহয় জটায়ু অনুপস্থিত ; "ভদ্রলোক আপাতত ঘরবন্দী অবস্থায় পূজোর উপন্যাস লিখছেন, তাই দেখা-সাক্ষাত্টা একটু কম ।" বালিগঞ্জ পার্কে এক পড়ন্ত বনেদি পরিবারে অসফল চুরির প্রচেষ্টা ; কিন্তু ব্যাপারটা সামান্য নয় কারণ যে-ঘরে চোর এসেছিল তার বাসিন্দা এক অন্ধ জীবরসায়নবিদ, যিনি অনেক বছর আগে আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে কাজ করতে করতে এক দুর্ঘটনার ফলে অন্ধ হয়ে যান ও কলকাতায় ফিরে আসেন । রহস্যের আঁচ পেয়ে ফেলুদা উত্সাহী, পরে আরো যোগ হয় চুরি ও খুন । কাহিনীতে রামায়ণ ও মহাভারত থেকে অনেক অনুষঙ্গ ও উদাহরণ রয়েছে আর আছে বাংলা ও ইংরেজি টাইপফন্ট সম্বন্ধে আলোচনা ও বর্ণনা । গল্পটি পড়ে কমবয়েসি পাঠক পাঠিকাদের অনেকেই এই বিষয়গুলি নিয়ে আরো বেশি করে জানতে আগ্রহী হবে । এই কাহিনীতে ফেলুদা প্রথম খুনি কে সেই রহস্যের সমাধান করেও তাঁকে অভিযুক্ত করেননি বা পুলিশকে জানাননি । যদিও সেই খুনি আর মাত্র সতেরদিন বেঁচেছিলেন, এ-বিষয়ে নীতিগত আপত্তি তোলা অসঙ্গত হবে না নিশ্চয়ই ।
বেশি বয়েসে দ্বিতীয় পাঠে ধরা পড়ল আর একটি অসঙ্গতি । সুবীর দত্ত ফেলুদার সঙ্গে প্রথমবার দেখা করতে এসে দু:খ প্রকাশ করলেন যে তিনি আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে পারেননি, কারণ রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে অনেকদিন ধরে তাঁদের পাড়ার ফোন সব ডেড । কিন্তু পরের দিন সকালেই তাঁদের বাড়ি থেকে ফোন এল ফেলুদার কাছে যে মি: দস্তুর খুন হয়েছেন । সে যাই হোক সব মিলিয়ে গল্পটি মনোজ্ঞ এবং উপভোগ্য ।
সংকলনে আছে সত্যজিৎ রায়ের আরো তিনটি লেখা - "মোল্লা নাসীরুদ্দিনের গল্প" (পৃষ্ঠা ১৪৫), লুইস ক্যারলের "জ্যাবারওয়াকি" অবলম্বনে লেখা কবিতা "জবর খাকী" (পৃষ্ঠা ২৬০) এবং "ক্লাস ফ্রেণ্ড" নামে আরও একটি গল্প (পৃষ্ঠা২৩৫) । যদিও পাঠকের সব আশা সবসময় মেটা সম্ভব নয়, প্রোফেসর শংকুর একটি গল্প থাকলে মজা আরো ভীষণভাবে জমতো এবং সংকলনটি সর্বাঙ্গসুন্দর হতো । খুব সম্ভবত আয়তনের কারণেই শংকু বাদ গেছেন, তবে ভাবতে ইচ্ছে করে "ক্লাস ফ্রেণ্ড" নামের সাদামাটা গল্পটির বদলে যদি একটি শংকু-কাহিনী নেওয়া যেত; বিশেষ করে শংকুর যে গল্পে রোবোট বিধুশেখরের কন্ঠে "ধনধান্য পুষ্প ভরা" গানটি ছিল । খুব সম্ভবত সেটি প্রথম শংকুকাহিনী এবং নাম বোধহয় "ব্যোমযাত্রীর ডায়রি" - সেখানে মঙ্গলগ্রহের প্রাণীদের গায়ের আঁশটে গন্ধ আর গলার "তিন্তিড়ি, তিন্তিড়ি" আওয়াজ বহুদিন পরেও মনে পড়ে । আসলে স্কটিশচার্চ কলেজের প্রবীণ অধ্যাপক ত্রিলোকেশ্বর শংকু তাঁর বেড়াল নিউটন, চাকর প্রহ্লাদ আর রোবোট বিধুশেখর মিলে যেভাবে প্রথম দর্শনেই আমার মতন ক্ষুদে পাঠককে দীর্ঘস্থায়ী গুণমুগ্ধ ফ্যান বানিয়ে ফেলেছিলেন, ফেলুদা তা পারেননি । ফেলুদার সময় লেগেছিল খানিকটা বেশি ।
আরো অনেক কিছু মণিমুক্তা রয়েছে এই রসালো সংকলনে । আছে রবীন্দ্রনাথের দুটি নাটিকা -"সম্পত্তি সমর্পন" গল্পটির নাট্যরূপ দিয়েছিলেন ক্ষিতীশ রায় (পৃষ্ঠা ৮৭) এবং "মচ্ং ষঠত্রভ ছত্ররু ঞচ্ং ওংঢংত্" কৌতুকনাট্যের জগদিন্দ্র ভৌমিক কৃত বাংলা অনুবাদ "রাজা ও রাজদ্রোহী" (পৃষ্ঠা ১৪)। রবীন্দ্রনাথ এই ইংরেজি কৌতুক নাটিকাটি লিখেছিলেন শান্তিনিকেতন আশ্রম বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ইংরেজি শেখানোর জন্যে । আছে মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রস্মৃতিচারণ "কত্তাবাবা" (পৃষ্ঠা ২১), ক্ষিতিমোহন সেনের নাতি-নাতনিকে লেখা চিঠিতে কিংবদন্তী "গাছের নাম বাঘশাল" (পৃষ্ঠা ৩৩), রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রামগড়ে গরমের ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার কাহিনী "এক ভাল্লুকের গল্প" (পৃষ্ঠা ৪২), রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের "কবি ও নোবেল পুরষ্কার" (পৃষ্ঠা ১৯৭), যেখানে কবি পুরষ্কারের খবর পাওয়ার পর আশ্রমের নেপালবাবুকে ডেকে বললেন, "এবার আপনাদের পাকা ড্রেন ও পাকা পায়খানা হবে ।"
সরকারি কাজে তিন দশকের ও বেশি সময় সিমলায় প্রবাসী ছিলেন সাহিত্যিক যোগেশচন্দ্র মজুমদার (১৮৮২-১৯৭৪); তিনি বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের উত্তর ভারতের জীবনযাত্রা বিষয়ে সন্দেশে কয়েকটি স্মৃতিকথা লিখেছিলেন । বর্তমান গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে তাঁর "স্মৃতিকণা" (পৃষ্ঠা ৪৪) রচনাটি - তাতে নানান পশু পাখি ও বনজঙ্গলের অনুপম বর্ণনা । বহুকাল হল যোগেশচন্দ্র সাহিত্যের জগতে সম্পূর্ণ বিস্মৃত । কবীর, দাদু ও অন্যান্য মধ্যযুগীয় ভক্ত কবিদের বিষয়ে তাঁর গভীর আলোচনাগুলি নানান রঙের মৌলবাদ কন্টকিত ভারতবর্ষে অতীব প্রয়োজনীয় এবং নতুন করে ছাপা উচিত । "গিরিডির স্মৃতি" (পৃষ্ঠা ২২৯) নামে আরেকটি উপভোগ্য স্মৃতিকথা লিখেছেন উপেন্দ্রকিশোরের ভাইপো হিতেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী । সেখানে রয়েছে পুরানো সন্দেশের কথা, সুকুমার রায়ের একটি বিখ্যাত কবিতায় উশ্রী নদীর উল্লেখ রয়েছে, নদীটি রয়েছে গিরিডি শহরের মধ্যে দিয়েই এবং তার পারে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থেকেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর । আর রয়েছে মহাশ্বেতা দেবীর বড়গল্প "বীরে ডাকাত ও ছিরে ডাকাত" (পৃষ্ঠা ১১৫) - নবাবী আমলের গল্প, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সমসময়ে দুই বর্ষীয়ান ছদ্মবেশি ডাকাত ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সায়েব পেয়াদাকে বোকা বানিয়ে খাজনার টাকা বেমালুম লুঠ করার কাহিনী । গল্পটি পড়ে এই একই সময় নিয়ে লেখা এবং বহুকাল আগে পড়া তাঁর "আঁধার মানিক" উপন্যাসটির কথা মনে করিয়ে দিল । আছে দুটি নীতিকথামূলক গল্প - তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের "ভবানন্দের কাশীমাতা" (পৃষ্ঠা ৩৪) এবং নরেন্দ্র দেব রচিত "মানিকের ফ্যাসাদ" (পৃষ্ঠা ৩৯)। আর নারায়ণ গংগোপাধ্যায়ের হাসির গল্প "হরিশপুরের রসিকতা" (পৃষ্ঠা ৮৩) -গল্পটি চমত্কার, কিন্তু লেখকের সন্দেশে প্রকাশিত গল্পের ভেতরে আমার একান্ত প্রিয় হল "হাতিচড়া মেজাজ", যা ১৯৬৮ সাল নাগাদ সন্দেশে বেরিয়েছিল । আশা দেবীর রচনা "আসল টেনিদা" (পৃষ্ঠা ৩২৬) আরেকটি মজার লেখা, কিভাবে তাঁদের বাড়িওয়ালা ছেলের হাবভাব দেখে টেনিদা চরিত্রটি মাথায় এসেছিল নারায়ণ গংগোপাধ্যায়ের । পরে অবশ্য অন্যত্র বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত ভাবে লিখেছেন দীপংকর চক্রবর্তী ও "টেনিদা সমগ্র"র সম্পাদক প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় ।
নামকরা ভূতাত্ত্বিক ও শিশুসাহিত্যিক এবং "জঙ্গলে জঙ্গলে"র লেখক শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষ নিয়মিত লিখতেন সন্দেশে । ঘাটশিলার বন ও খনির পটভূমিকায় লেখা তাঁর "পুলকের অ্যাডভেঞ্চার" গল্পটি (পৃষ্ঠা ৩১৬) অন্তর্ভূক্ত হয়েছে । এ ছাড়াও শিশু উপভোগ্য গল্প লিখেছেন স্বপনবুড়ো, শিবরাম চক্রবর্তী, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, গৌরী ধর্মপাল, পুণ্যলতা চক্রবর্তী ও অন্যান্যেরা তাঁদের স্বভাবসিদ্ধ দক্ষতায় । শিকারের গল্প পড়তে আমি একেবারেই ভালবাসি না, তবু জানিয়ে রাখি দুটি উপভোগ্য শিকার কাহিনীর কথা- সুলেখক ও আই সি এস প্রশাসক রণজিৎ রায়ের "খুটিমারীর বেয়াড়া বাঘ" (পৃষ্ঠা ১০৫) এবং বুদ্ধদেব গুহ রচিত "যমদুয়ারের ছোকরা বাঘ"।
এ ছাড়া রয়েছে অসংখ্য কবিতা ও ছড়া; তাদের লেখকতালিকাটিও চমকপ্রদ - অজিত দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অন্নদাশংকর রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, জসীমুদ্দিন থেকে শুরু করে নির্মলেন্দু গৌতম, সামসুল হক, সরল দে, বিনোদ বেরা ও আরো আরো অনেকে । অবাক লাগে পড়তে সৈয়দ মুজতবা আলির লেখা লিমেরিক । সব মিলিয়ে এই সংকলনটি বাংলা শিশুসাহিত্যে এক উজ্জ্বল সংযোজন ।
এ কেবল দিনে-রাত্রেমেদিনীপুর শহরে সে বছর ভীষণ খরা, স্কুলে পানীয় জলের আকাল, মনে আছে তেষ্টা পেলে স্কুল থেকে বেরিয়ে আশে পাশের গেরস্ত বাড়ি থেকে জল চেয়ে পিপাসা মেটানোর কথা । একই সময়ে আমাদের স্কুলে এলেন নতুন হেডমাস্টার - প্রথম দর্শনে মনে হয়েছিল রাশভারি, গম্ভীর মানুষ । সন্দেশের উদাহরণ দেখে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে একদিন পিছনের বেঞ্চিতে বসে লেখা হল আমাদের প্যারডি - রবীন্দ্রনাথ নয়, মধুসূদন -
চক ঘষে বোর্ড গাত্রে
বৃথা চেষ্টা অংক শিখাবারে
"পাঁশকুড়ার পাড়াগাঁয়ে আছিলা যেমতিজানি না হেডস্যার কোনদিন খোঁজ পেয়েছিলেন কিনা এই দুষ্কৃতির, তবে তাঁর স্নেহশীল প্রশ্রয়ের কোনদিন কমতি হয়নি । বর্তমান গ্রন্থে সেই বহুকাল আগে পড়া রবীন্দ্রনাথের প্যারডিটি সংকলিত হয়েছে (পৃষ্ঠা ৩৪৮) এবং অনেক পুরানো স্মৃতি ফিরে এল তার সঙ্গে সঙ্গে । সেই শুভব্রত রায় নামের কিশোর এখন কি লিখছেন জানতে ইচ্ছে করে ।
হে হরি, অভাগাদলে তুমি পুণ্যবান
আসি কলিজিয়েট স্কুলে পশিলা তেমতি
তৃষ্ণায় আকুল ছাত্র করিত রোদন" ... ইত্যাদি ।
সন্দেশে আমার প্রথম লেখা প্রকাশ আরো কয়েক বছর পরে - খুব সম্ভবত ১৯৭৩ বা ৭৪ ; তার আগেও দুয়েকবার কবিতা ও ছড়া পাঠিয়েছি কিন্তু মনোনীত হয়নি । সেবার বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়লো একটি বিজ্ঞান বিষয়ক ছড়ার ; আইনস্টাইন ও আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সংক্রান্ত একটি বহু প্রচলিত লিমেরিক থেকে তার অনুপ্রেরণা । সম্পাদক পালটে দিয়েছিলেন দুতিনটি পংক্তি এবং নামটিও - "আজকে গিয়ে আসবো ফিরে" নামটি হয়ে দাঁড়ালো সহজ সরল "আমার রকেট"। সেই সময় অনাবশ্যক রাগ করেছিলাম এই অনধিকার প্রবেশের, কিন্তু এখন বুঝতে পারি যে লেখাটিকে সন্দেশের কচিকাঁচা পাঠক পাঠিকার পক্ষে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্যে পরিবর্তনগুলি ছিল একান্ত প্রয়োজনীয় । মনোনয়নের সংবাদ দেওয়া লীলা মজুমদারের পোষ্টকার্ডটি অনেকদিন যত্ন করে রেখেছিলাম, কিন্তু বারবার ঠিকানা বদলানো কালে কোথায় হারিয়ে গেছে । তারপর ঠিক পুজোর আগে মানি অর্ডার পেলাম পাঁচ টাকা সন্দেশ পত্রিকার দপ্তর থেকে । অকস্মাৎ অর্থাগমে আমার সেদিন আনন্দের শেষ নেই । ভারবি থেকে তখন সবেমাত্র প্রকাশিত হয়েছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা - মল্লিক পুস্তকালয়ে রোজ একবার করে গিয়ে পাতা উল্টে আসি; দোকানের মালিক বিনয়দা দশ পার্সেন্টের বেশি ছাড় দিতে রাজি নন, দরাদরি তখনো চলছে । টাকাটা হাতে পেলে খুব সুবিধে হত, কিন্তু মা বলল সন্দেশের পয়সায় সন্দেশ কিনে সবাইকে খাওয়াতে, অতএব তাই সই ।
এইরে, সেরা সন্দেশের স্বাদগন্ধ বোঝাতে গিয়ে নিজের পোড়া স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেছি; যে মাসিক পত্রের রঙিন সান্নিধ্যে কেটেছিল নিজের কৈশোর, তার বাছাই করা রচনাগুলির সুসম্পাদিত, সুসজ্জিত সংকলন মনকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ফেলে আসা অতীতে । ২০০৩ এর তীব্র শীতে প্রবল ঝড়, হিমেল হাওয়া, অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপতন, বিশ্বজোড়া মন্দা ও ডুবিয়ার যুদ্ধনিনাদের ফাঁকে ফাঁকে বেশ কয়েকটি সুন্দর দিন রাত কাটলো এই মধুর গ্রন্থপাঠে, সেজন্যে সেরা সন্দেশ ও তার প্রকাশককে জানাই অসংখ্য, অকুন্ঠ ধন্যবাদ !