• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৭ | মার্চ ২০০৬ | গল্প
    Share
  • বিসর্জন : মহুয়া মল্লিক রায়

    শমতা না ?

    হ্যাঁ, শমতাই তো ।

    সেই ফাগুন হাওয়ার মতোই সুগন্ধী । ওড়নার প্রান্ত দু'টো নীল জ্যোত্স্নার মতো তিরতির করে কাঁপছে । পাঁচবছর আগের সেই শমতাই তো, কিছুটা কঠোর কিছুটা বা অলিভের মতো মসৃণ, চিকন । এ শমতা না হয়েই যায় না । এ তার বুকের নিজস্ব কুঠুরিতে জমিয়ে রাখা রঙিন পালকের মতোই মাধুর্যে ভরপুর । পাঁচবছরের অসাক্ষাতের মালিন্য ছঁংউতে পারেনি লাল আবীর-ঘোরের এই কিন্নরীকে ।

    যা: কি সব যে ভাবছে, শমতা এখানে আসবে কি করে !

    কপালে ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শ । ধীরে ধীরে চোখ খুললো আকাশ । কিন্তু কে এই রমণী ? সোনালী পাড়ের ঘন সবুজ পাট ভাঙা তাঁতের শাড়িতে অরণ্যের হাতছানি ! চোখ দু'টো কচলে ভালো করে দেখলো আরেকবার ।

    -- কি দেখছো এমন করে ? তিন বছরের বিয়ে করা বউকে চিনতে পারছ না নাকি ?

    আরে যা: এতো বৃষ্টি । কিন্তু কোন জাদুবলে আজ সে শমতার মতো করে কথা বলছে !

    -- এই ওঠো তো । ন'টার মধ্যে আমাকে মণ্ডপে পৌঁছাতে হবে । আজ সপ্তমী, সে খেয়াল আছে তো ?

    আকাশ আর দেরি করে না । বিছানা ছাড়তে ছাড়তে বলে, `তোমার গলাটা না দিন দিন --' - খুব হাস্কি তো ? আমি জানি । মিস্টার মজুমদার সেদিনই বলছিলেন । -- আকাশের মুখ থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে কথাটা শেষ করলো বৃষ্টি ।




    অষ্টমীর সন্ধে



    -- আমি কিন্তু কোথাও যাবো না ।
    -- সে আমি জানি । -- খোঁপায বেলফুলের মালা জড়াতে জড়াতে বৃষ্টি জবাব দিল ।

    হ্যাঁ, তুমি তো আমার অনেক কিছুই জানো ! তুমি জানো আমার কষ্টনুড়িগুলোর কথা । তুমি জানো আমার রঙিন পালক জমানো গোপন কুঠুরিটার কথা, যেখানে ধূপের ধোঁয়ায় আঁকা হয় বিষাদের কলতান । তুমি শুধু আমাকেই জানলে না--------

    -- আমি বেরোচ্ছি ।
    -- হুঁ
    -- কি হুঁ ? একবার দেখবেও না বুঝি ? -- মুখে প্রশ্রয়ের হাসি ।

    টিভির স্ক্রীন থেকে চোখ সরিয়ে বৃষ্টিকে দেখল আকাশ, কিংবা দেখল বারিশকে কিংবা - - -

    কেন যে এমন হয় ! দু'টো মুখ ভেঙেচুরে একটা হয়ে যায় ! বুকের কাছে তুফান ওঠে, লোনা ঢেউ সজোরে আছড়ে পড়ে সেই গোপন কুঠুরির, মেহগনি কাঠের দরজাতে ।

    -- হুমম, পলক যে একেবারে পড়ছেই না ।- ঠোঁট টিপে অদ্ভূত একটা ভঙ্গি করল বৃষ্টি ।

    আকাশ আলতো ভাবে একটা চুমু খেতে যেতেই, -- এই না, এখন না । লিপস্টিক নষ্ট হয়ে যাবে বলে ছিটকে গেলো আকাশের নীলাম্বরী দয়িতা ।


    বিজয়াদশমী

    ঠিক চারবছর, নাকি সাড়ে তিন ? আসল হিসেবটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে । অনেকদিন পর পলাশডাঙা যাচ্ছে তারা । সাধারণত এই দিনটা বাবা-মায়ের কাছে তাদের হুগলীর বাড়িতেই কাটায় আকাশ, কিন্তু এবার মা-বাবা দিদির কাছে এলাহাবাদে । অগত্যা বৃষ্টির আবদারে পলাশডাঙা । গন্তব্য এগিয়ে আসছে যত, ততই যেন বিসর্জনের বাজনা বেজে উঠছে বুকে । সেই পলাশডাঙা ! চকিতে মুখ ঘুরিয়ে দেখে নেয় বৃষ্টিকে । কি স্মার্টনেসের সঙ্গে একটার পর একটা গাড়িকে ওভারটেক করছে । কি আর্শ্চয ! এ মুখের সাথে শমতার কোন মিলই নেই । এমন কি মিল নেই আদবকায়দা, স্বভাব- কোনকিছুতেই । কিন্তু সেদিন যে কি হয়েছিল তার, আজও সে ব্যাখ্যা খঁংউজে পায় না ।

    পুজোর ঠিক আগেই শমতা ইউ এস চলে গেল । গোপনে অনেকদিন ধরেই স্কলারশিপের চেষ্টা চালাচ্ছিল, ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা সবাই জানত, এক আকাশই কিছু জানত না ।

    যাবার আগে শুধু বলে গেল, `আমি ফিরে আসব, তুমি অপেক্ষা করবে তো ?'

    ছোট্ট করে `হঁযা' বলেছিল আকাশ ।

    শমতা চলে যেতেই কেমন একটা ছন্নছাড়া ভাব, কিছুই ভালো লাগত না । নতুন চাকরি, অফিসটা যেতে হত, তাই যাওয়া । নয়তো মেসের সঁযাতস্যাঁংএত ঘরেই ঠিক হেজে পচে পড়ে থাকত ।

    কলিগ রূপকই পুজোর কটা দিন টেনেটুনে নিয়ে এল পলাশডাঙার পুজোয় । জমিদার বাড়ির দূর্গাপুজো আগে দেখার সৌভাগ্য হয়নি আকাশের, আর কিছুটা মুক্তির জন্যই এক কথায় রূপকের সঙ্গে চলে এল ।

    আর তারপর ? কি যে হয়ে গেল রূপকের তুতো বোন বৃষ্টিকে দেখে । যতবারই চোখাচোখি হয়, মনে হয় এ যেন শমতাই । হ্যাঁ শমতা, না শমতা তার চোখের সামনেই প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে । আকাশের এক চোখে মুগ্ধতা তো আরেক চোখে তীব্র জ্বালা । বা, বেশ তো ! আমাকে দগ্ধ করে ডানা ফড়ফড়িয়ে উড়ছো ! উড়তে যদি হয়ই তো এই আকাশে ওড়ো যত খুশি । মনে মনে গর্জে ওঠে সে ।

    বাইরে বিসর্জনের বাজনা । বাড়ির প্রায় সবাই প্রতিমা নিয়ে কাছের নদীতে গেছে । আকাশ যায়নি । তার জন্য নির্দিষ্ট ঘরটাতে চুপচাপ শুয়ে ছিল । অন্ধকার দেখে আলো জ্বালাতে এসেছিল বৃষ্টি ।

    কি যে হয়ে গেল আকাশের । ঝটকায় টেনে নিল বৃষ্টিকে । ও পক্ষ থেকে কোন বাধাই আসেনি, ছিল সমর্পণের ব্যাকুলতা । বহুদিন বাদে জ্বালা কমে আসছিল আকাশের । অনাস্বাদিত মুগ্ধতায় আরো নিবিড় করে মেখেছিল অঝোর বৃষ্টিধারা । আর এই প্রবল বর্ষণেই বিসর্জন হয়ে গেল শমতা নামের এক মানবীর ।

    তারপর বৃষ্টি কি ভাবে যে তার গোলার্ধের অংশিদার হয়ে গেল, সে নিজেই জানে না । আজকাল একটা ভয় যখন তখন শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এসে কাঁপিয়ে দেয় আকাশকে । শমতা ফিরে এলে কোন মুখে দাঁড়াবে সে ? বৃষ্টিকেই বা কি বলবে তখন ? লজ্জায় কঁংউকড়ে ওঠে সে ।

    বাঁ দিকে টার্ন নিতে নিতে বৃষ্টি বলল, এই দেখো এসে গেলাম বলে ।

    আকাশ তখন বিড়বিড় করছে, `কেউ কথা রাখেনি ।'


    (পরবাস, মার্চ, ২০০৬)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)