`দিগন্ত আমি ছুঁয়েছিএই গানের সঙ্গে ম্যাডিসন স্কোয়্যার গার্ডেনে বেঙ্গলি শো (জনৈক ফুটপাথবাসীর ভাষায়) অর্থাৎ ২৫তম বঙ্গ সম্মেলন সাঙ্গ হল । ম্যাডিসন স্কোয়্যার গার্ডেন অনেকটা হাতিবাগান বা সবজি বাগান লেনের মত, অর্থাৎ নামের সঙ্গে আসল জিনিসটার কোনও মিল নেই । এটা আসলে কংক্রীটের বাগান যেখানে দেদার বিজ্ঞাপনের ফুল আর পোকামাকড়ের বদলে কিলবিল করছে মানুষ । বেশিভাগই পিঁপড়ে, অনেকে বোলতাজাতীয়, কেউ বা নেহাৎ গুবরে, আবার কেউ কেউ রংদার প্রজাপতি । এমন জব্বর জায়গায় সম্মেলন হবে জেনে গতবছর থেকেই আমাদের উত্সাহের শেষ ছিল না । উত্তর আমেরিকা বঙ্গ সম্মেলন এখন শহুরে বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে এক জবরদস্ত প্রতিষ্ঠান । আনন্দবাজারের দৈনিক প্রতিবেদন মারফৎ সম্মেলনের যে রোমান্টিক চেহারাটি পয়দা হয়েছে তার ধাক্কায় ঘায়েল হবে না এমন বঙ্গসন্তান বিরল । তাতে অবশ্য অবাক হবার কিছু নেই, প্রচার ও প্রতিষ্ঠান ছাড়া স্বয়ং ভগবানেরই চলে না, আমরা তো কোন ছার । আমরা যারা অনেকদিন ধরে এই সম্মেলনের সঙ্গে আছি, তাদের মনে মিশ্র অনুভূতি কয়েক বছর ধরেই দানা বাঁধছিল । সেসব বেরসিক বক্তব্য কখনোই প্রকাশ করা হয় না, সম্মেলন শেষে রুটিন মনখারাপ নিয়ে যে যার কাজে ফিরি । এবারও তাই করার কথা কিন্তু নিউইয়র্ক শহরটার হাওয়ায় কেমন যেন একটা পরাবাস্তবিক আমেজ আছে, হয়ত ছত্রিশ জাতের দীর্ঘশ্বাস মিশে মিশে বাতাসটাকেই বিগড়ে দিয়ে থাকবে । আমিও তাই মাঝরাত্তিরে নেহাৎ অকারণেই আমার প্রিয় ঠেক সীপোর্ট স্ট্রীটে গুটিগুটি পায়ে হাজির হলাম । এখানকার বাতাসে মাছের গন্ধ পাকাপাকি বাসা বেঁধেছে । এইখানে পুরনো কালের মস্ত এক চারমাস্তুলের স্কুনারের ছায়ায় বসে আমার সঙ্গে ক্যাবি জামালের প্রথম আলাপ হয়েছিল । ঘটিবাটি বেচে বাংলাদেশ থেকে ক্যানাডায়, সেখান থেকে বেআইনি পথে নিউইয়র্কে ঢুকে ইয়ালো ক্যাব কোম্পানির জোয়ালে জুতে গেছে এমন বহু বাঙালির মধ্যে জামালও একজন হতে পারত । তাহলে আমার সঙ্গে ওর আলাপ হবার বিশেষ কোনও কারণও থাকত না । জামালের বিশেষত্ব, সে কবি এবং তার দুটি কিডনির একটিও কাজ করে না । নিউইয়র্কে প্রথম শীতকালেই তার মারা যাবার কথা ছিল যদি না কোনও এক অচেনা ভারতীয় ডাক্তার ওয়েলফেয়ারের গোলকধাঁধা পেরিয়ে, ইনসিওরেন্সের পাঁচিল ডিঙিয়ে, শেষ অব্ধি তার কিডনিটি বদলাতে সক্ষম হতেন । সে এক মস্ত গল্প কিন্তু আজ সে গল্প বলার সময় নেই, জামালকে আজ ডেকেছি বৃহৎ বঙ্গ নিয়ে কথা বলব বলে । যেহেতু এই আড্ডায় শুকনো গলায় কথাবার্তা হয় না, আমাদের বক্তব্য পছন্দ না হলে মাতালের বুকনি বলে আপনারা স্বচ্ছন্দে উড়িয়ে দিতে পারেন ।
ডানা মেলে আমি উড়েছি
আলোছায়া মেখে পৃথিবীর পথে
বহুপথ আমি হেঁটেছি'
এবার বঙ্গ সম্মেলনের কাঠামো, শিল্পী নির্বাচন, সম্বর্ধনা, উদ্বোধনী থেকে সমাপ্তি সঙ্গীত পর্যন্ত প্রায় সবকিছুতেই দুটো সমসাময়িক প্রবল ধারার যুগলবন্দী -- কাঞ্চন কৌলীন্য এবং ভারতীয়ত্ব । অন্তত ইউইয়র্কের বাঙালি ক্যাব ড্রাইভার ও খুচরো ব্যবসায়ীরা তাই মনে করে । যেহেতু তারা সবাই ওপার বাংলার লোক তাই তাদের বক্তব্য আমরা অতি সহজেই বাংলাদেশিদের (পড়ুন মুসলমানদের) হিংসুটে ভারত বিরোধীতা বলে উড়িয়ে দিতে পারি । আমার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া যে ওরকম হবে জামাল নিশ্চয় সেটা জানত । তাই প্রথমেই ও কবুল করে নিল যে ভারত বিরোধীতা বাংলাদেশি মুসলমান মানসিকতার সাধারন অবস্থান । এটা মেনে নিয়েই ও ভারতীয়ত্ব এবং হিন্দু বাঙালির মানসিকতা নিয়ে কতগুলো প্রশ্ন আমার সামনে পর পর দাঁড় করিয়ে দিল । বাঙালি জাতিসত্ত্বার ধর্মীয় ও আর্থ-সামাজিক মেরুকরণ নিয়ে কতজন বাঙালির মাথাব্যথা আছে তা আমার জানা নেই । আমি এবং জামাল, আমি বর্ণহিন্দু, ভদ্রলোক ডাক্তার, শ্বেতাঙ্গপ্রধান পাড়ার বাসিন্দা, জামাল মুসলমান, ক্যাব ড্রাইভার, ইনার সিটি অ্যাপার্টমেন্টবাসী, যদিও আমরা বন্ধু, আমাদের চেনাজানা বাঙালিরা সাধারণভাবে যে যার মেরুতে স্বচ্ছন্দ । জামালের মতে এই মেরুকরণ মুসলমান বাঙালিকে ঠেলে দিচ্ছে সেমেটিক গোঁড়ামির দিকে আর হিন্দু বাঙালিকে উত্তর ভারতীয় হিন্দিভাষী মূলস্রোতের দিকে, আর্য জাত্যাভিমান যার মজ্জাগত । বাঙালি সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য এই যে সে অনেকটাই প্রান্তিক ও মিশ্র সুতরাং বিশুদ্ধতার সঙ্গে তার বিরোধ । এই প্রান্তিক সংস্কৃতিই বাঙালির গোপন ঐশ্বর্য, তার প্রতিভার উত্স, তার বৈপ্লবিক মানসিকতার জননী । জামাল আমার কাছে জানতে চাইল বঙ্গ সম্মেলন বাঙালির এই মিশ্র সংস্কৃতির সঠিক প্রতিনিধিত্ব করেছে কি না ।
আমি অন্যমনস্কভাবে ম্যানহাটান ব্রিজের দিকে তাকিয়ে রইলাম । এটা যদি ১৯৯২-৯৪ হত তবে আমি এককথায় হ্যাঁ বলে দিতে পারতাম । ওই সময়ে বঙ্গ সম্মেলনের এমন জেল্লা, জাঁকজমক হয়নি, ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন ভাড়া করার ক্ষমতা ছিল না । কিন্তু সম্মেলনে দুই বাংলার শিল্পীরা আমাদের ভুলিয়ে দিতেন যে বাংলা ভাগ আদৌ হয়েছিল কোনদিন । আজকের সম্মেলন দেখে প্রথমেই মনে হয় যে এটা ভারতীয় বাঙালির । অনুষ্ঠানের শুরুতে ত্রিবর্ণ পতাকা নিয়ে ভারতমাতা, প্রধান আকর্ষণ কবিতা কৃষ্ণমুর্তির হিন্দি গান, তারপরে সমাপ্তি অনুষ্ঠানের ঘোষণা `শত রঙে মন রাঙিয়েছি তবু ত্রিবর্ণ আমি ভুলিনি'- এই সব আর কি । তার মধ্যে মণি ভৌমিক, পুর্ণেন্দু চ্যাটার্জিদের ছবি, কলকাতায় শহরতলিতে এন আর আই স্পেশাল জমিজায়গা, ফ্ল্যাট ইত্যাদির বিজ্ঞাপন, গয়নার দোকানে হীরের চমক, সব মিলিয়ে সম্মেলন হয়ে দাঁড়াচ্ছে যেন এক শহুরে আত্মসন্তুষ্ট সমাজের আপনার পিঠ আপনি চাপড়ানোর প্রতিযোগিতা । অন্তত জামালের তা মনে হতেই পারে । ওর বক্তব্য হচ্ছে যে ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি উত্তর ভারতের সাধারণ সংস্কৃতির স্রোতে মিশে যাবে এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতি ডুবে মরবে আরবী মৌলবাদের পাঁকে । বাঙালির নিজস্বতা নষ্ট হয়ে যাবে যদিও তাতে ব্যবহারিক দিক দিয়ে (অন্তত পশ্চিমবঙ্গের) ক্ষতির বদলে উপকারও হতে পারে । অন্যদিকে বাংলাদেশের পক্ষে ব্যাপারটা হবে নিখাদ সর্বনাশ কারণ বাংলা সংস্কৃতি বাদ দিলে দেশটার অস্তিত্ত্বই হয়ে দাঁড়ায় এক অবান্তর ঐতিহাসিক বিপর্যয় ।
যে বঙ্গসন্তানরা বর্তমানে উত্তর আমেরিকা আলো করে রয়েছেন, তাঁরা প্রায় সকলেই বর্ণহিন্দু ভদ্রলোক । অধুনা প্রবাসী ভারতীয়দের যে তূরীয় মনোভাব (বিজেপি কথিত ফিল গুড), অর্থনৈতিক সাফল্যের সাথে সাথে ভারতীয়ত্বের নয়া বিশ্লেষণ, মূলধারার প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা এবং চাপা সাম্প্রদায়িকতা -- এই সবকটি ভাবেই তাঁরা ভাবিত । তাঁদের আয়োজিত সম্মেলন যে দিনে দিনে আরো বেশি করে ভারতীয় হয়ে উঠবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই । প্রশ্নটা এই যে আমরা কি বঙ্গ সম্মেলনের, তথা বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনের এই বিবর্তন স্বাভাবিক বলে মেনে নেব ? হিন্দি সিনেমায় বিশ্বরূপ দর্শন আমাদের সয়ে যাবে এবং বাঙালির আগে আমরা ভারতীয় হয়ে ওঠার চেষ্টা দেখব ? তাহলে আমাদের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, আমাদের ছৌ নাচের মুখোশ, আমাদের মরমিয়া আউল, বাউল, অনার্য সংস্কৃতি, আমাদের ভাটিয়ালি আর রবীন্দ্রসংগীত, আমাদের একাত্তরের স্মৃতি - এ সবই আস্তে আস্তে তামাদি হয়ে যাবে না তো ? এই প্রশ্নগুলো ভীষণরকম জরুরি কারণ এই বোমাবাজির বাজারে ভারতীয় ডায়াস্পোরা ত্রক্রমে ত্রক্রমে বড়কর্তাদের প্রিয় হয়ে উঠছে, দুপয়সা কামাচ্ছে এবং সামাজিক মূলধারায় হিন্দু হিসাবে নিজেদের অবস্থান ত্রক্রমশ পাকাপোক্ত করে তুলতে চাইছে । তার মনে এখন দিগন্ত ছোঁয়ার, ডানা মেলে ওড়ার আকাঙ্খা । অন্যদিকে মুসলমান বাংলাদেশী প্রবাসে হয়ে পড়ছে বিচ্ছিন্নতা, সন্দেহ ও মানসিক বিভ্রান্তির শিকার, স্বদেশে সোজাসুজি উগ্র সাম্প্রদায়িকতার মুখোমুখি-গরম কড়াই অথবা উনুন ।
জামাল ও আমি পরস্পরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম । আমাদের ভাষা ও বিশ্বাস এক, রাজনীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের চেয়ে সামাজিক ন্যায়ে আমাদের আস্থা বেশি এবং ভাষা ও সংস্কৃতি আমাদের অস্তিত্ত্বের সবটুকুই । অথচ আমরা কি নিশ্চিন্তভাবে বিভাজিত । আকাশে তাকিয়ে আমরা দুজনের কেউই সাতটি তারার তিমির খুঁজে পেলাম না -- সেখানে ম্যানহাটান ব্রিজ হাজার আলোর চোখ মেলে পাহারা দিচ্ছে ।
(পরবাস, মার্চ, ২০০৬)